ফ্রয়েড থেকে ইয়ুং — এক অভিচলন

অনিন্দ্য সুন্দর দত্ত

আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে ফিরে যাই। সন তারিখটা ১৮৭৫-এর ২৬ জুলাই (সোমবার)। মধ্য ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের একটি গ্রাম— কেসিল (kesswil)। জন্মগ্রহণ করলেন ফ্রয়েডের ‘Crown Prince’ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং। ফ্রয়েডের বয়স তখন উনিশ কিংবা কুড়ি। ১৮৯৫ থেকে ১৯০১— এই পাঁচ-ছ বছর ইয়ুং বেসেলে ব্লয়লারের অধীনে কাজ করলেন। এই ব্লায়লারই প্রথম সিজোফ্রেনিয়া কথাটি উদ্ভাবন করেন। ১৯০০-তে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক হলেন। ইয়ুং ব্লয়লারের পরামর্শে শব্দানুষঙ্গ (word association) অভীক্ষাটি সাইকোটিকদের নির্জ্ঞান চিন্তা ভাবনার প্রকৃতি অনুসন্ধানে প্রয়োগ করেন। এমন করে অনেক সময় রোগীর নির্জ্ঞান মনে অবরুদ্ধ ‘জটিল গ্রন্থির’ (complex) সন্ধান পাওয়া যায়। ‘জটিল গ্রন্থি’-র ধারণাটি মূলত ইয়ুং-এর। ১৯০২ – ০৩-এর শীতকালটা তিনি পিয়ের জানের সাথে অধ্যয়ন করেছেন। ফরাসি মনোবিদ ও দার্শনিক পিয়ের জানের (Pierre Janet ১৮৫৯ – ১৯৪৭) খ্যাতি তখন বিশ্বব্যাপী। পরিচয়টা এভাবে দেওয়ার কারণ ইয়ুং-এর গবেষণালব্ধ ফল এতদিনে বিশিষ্ট মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত।

চেতন মনের চর্চা থেকে নির্জ্ঞান মনের অভিযান শুরু হল ফ্রয়েড ও ইয়ুং-এর হাত ধরে। চলল নির্জ্ঞানের কুহেলিকা উদ্ঘাটনের নিরলস চেষ্টা। ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়’। তবে বলা হয় নির্জ্ঞানের ধারণার উদ্ভাবক নাকি ফ্রয়েড নন। বিশেষ করে ইয়ুং কান্ট ও রোমান্টিকতাবাদের কাছ থেকে unconcious সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণাগুলি সন্ধান করেছিলেন। সে সব কথা এখন থাক। ফ্রয়েডের সঙ্গে অনেকেরই মতপার্থক্য হল। এটাই তো স্বাভাবিক। তাই বলে ফ্রয়েডকে কেউ উপেক্ষা করতে পারবেন না।

১৯০০-তে ফ্রয়েডের Interpretation of Dreams, ১৯০৫-এ Three Essays on the theory of Sexuality প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বইটি ভিক্টোরীয় মানসিকতার ধর্মীয় সমাজে বিস্তর নিন্দা কুড়িয়েছে। সত্যিকথা। তবে এতদিন ধরে যৌনতা বিষয়ে আলোচনায় যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল তা উঠে গেল। 

তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে / প্রাণের মাঝে আয়

ফিরে যাচ্ছি ১৯০০-তে। ‘The Interpretation of Dreams’ প্রকাশের পর পরই ইয়ুং বইটি পড়ে ফেলেন। তবে তেমন অভিভূত হননি (Singert ১৯৯৪)। কয়েক বছর পর পুনরায় পড়ার সময় ইয়ুং ফ্রয়েডের ধারণা ভালোভাবে বুঝতে পারেন। মুগ্ধ হয়ে নিজের স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। ১৯০৬ থেকে নিয়মিত ফ্রয়েডের সাথে ইয়ুং-এর পত্রালাপ চলতে থাকে। অবশেষে ১৯০৭-এর ৭ এপ্রিল ভিয়েনাতে দু-জনের দেখা হল। শোনা যায় প্রথম দর্শনেই তাঁরা দু-জন দু-জনের ব্যক্তিত্বে এমন অভিভূত হয়ে যান যে নাওয়া খাওয়া ভুলে টানা তেরো ঘণ্টা কথা বলেছিলেন। ১৯০৯-এ বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী স্টেনলে হলের আমন্ত্রণে ফ্রয়েড ও ইয়ুং আমেরিকার ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যান। জাহাজেই দু-জনে তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ‘Freud diagnosed unresolved Oedipal tentions with his adopted intellectual heir jung’। এসবের পরে ও ইয়ুং আন্তর্জাতিক মনঃসমীক্ষণ সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হলেন ফ্রয়েডের আনুকূল্যে । ১৯১২-তে ইয়ুং-এর Psychology of unconscious প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ফ্রয়েডের ‘লিবিডো’ ধারণার বিরোধিতা করেন। ধীরে ধীরে ফ্রয়েড ও ইয়ুং-এর মধ্যে অনেক বিষয়ে পার্থক্য দেখা যায়। ইয়ুং-এর সমালোচনাকে ফ্রয়েড ভালো চোখে দেখেননি। ইয়ুং-কে তিরস্কার করে বলেছিলেন যে যখন তিনি ফ্রয়েডের মৌলিক চিন্তাগুলিকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না তখন তাঁর নিজেকে মনঃসমীক্ষণে বিশ্বাসী বলে প্রচার করা উচিত নয়। ফলে ইয়ুং ফ্রয়েডের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মতকে বিশ্লেষণাত্মক মনোবিদ্যা (Analytical Psychology) বলে চিহ্নিত করলেন।

এখন প্রশ্ন হল কেনই-বা ফ্রয়েড হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে ইয়ুং-কে স্থান দিতে চেয়েছিলেন? এর উত্তর T. H. Leahy-কে অনুসরণ করে দেওয়া যেতে পারে। Leahy বলেন ইয়ুং এতদিনে মর্যাদাপূর্ণ বুরঘোলজি (Burghölzi) ক্লিনিকের বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত সাইকিয়াট্রিস্ট। ফ্রয়েড মনে করেছিলেন ইয়ুং-এর সংযোগে তাঁর ধারণা বৈজ্ঞানিক সমর্থন ও অনুমোদন  পেতে পারে। তার ওপর ইয়ুং ইহুদি ছিলেন না। ফ্রয়েডের প্রথম দিকের অনুগামীরা প্রায় সকলেই ইহুদি। ফ্রয়েড ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, একটি মারাত্মক ইহুদি বিদ্বেষী যুগে মনোবীক্ষণকে ইহুদি বিজ্ঞান হিসাবে ঘেটো করা হতে পারে। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি বিজ্ঞানীর ভাগ্যের কথা ভেবে ফ্রয়েড খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই ইয়ুং-কে ‘crown prince’ করতে চেয়েছিলেন। করতে চেয়েছিলেন মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের যোগ্য উত্তরসূরি।

তবে একলা চলো রে

ইয়ুং মনঃসমীক্ষণের স্রষ্টা হিসাবে ফ্রয়েডকে অনবরত প্রশংসা করে গেছেন। ফ্রয়েড বললেন জীবনের মৌল সত্যি হচ্ছে যৌনতা। ইয়ুং বললেন, জীবনে কাম বা যৌনতার বিরাট গুরুত্ব রয়েছে সত্য, কিন্তু তা জীবনের মূল শক্তি নয়। জীবনের শক্তি হচ্ছে উদ্যম, অগ্রগমন এবং আদিম শক্তির মধ্যে যেমন কামের তাড়না আছে তেমনি আছে নীতি-বুদ্ধি ও ধর্মচেতনার বীজ।

মানব মনের সামগ্রিক কাঠামোকে ইয়ুং সাইকি বলেছেন। ফ্রয়েডের তিনতলা ভিত্তিক মডেলটিকে ইয়ুং গ্রহণ করেছিলেন সত্য, তবে তিনি সেটাকে একটু বদলে দেন। ইয়ুং-এর কাছে তিনটি তলা হল ইগো, ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান ও যৌথ নির্জ্ঞান। মনের সচেতন অংশটিকে তিনি ইগো নাম দিয়েছেন। এটি এমন কিছু যার সম্বন্ধে আমরা সচেতন। চিন্তা, ভাবনা, সমস্যা সমাধান, মনে রাখা বা উপলব্ধির সাথে এটি সম্পর্কিত।

ইয়ুং যৌথ নির্জ্ঞান ও আর্কিটাইপের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর জীবন চর্চার অন্তিম লক্ষ্য ছিল নির্জ্ঞান মনকে সঠিকভাবে অনুভব ও উপলব্ধি করা। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে তিনি যখন আত্মকথা লিখতে বসলেন, তখন Memories Dreams, Reflection গ্রন্থটির প্রথম লাইন শুরু হল এই ভাবে— ‘My life is a story of self realization of the unconscious’ [P-15] । ইয়ুং-এর সবচেয়ে রহস্যঘন, বিতর্কিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল যৌথ নির্জ্ঞান যা Collective unconscious। তবে তিনি ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান (personal unconscious)-ও স্বীকার করেছেন। ফ্রয়েডের প্রাক্-চেতন (preconscious) এবং নির্জ্ঞানের ধারণাকে সংযুক্ত করে তিনি ব্যক্তিগত নির্জ্ঞানের ধারণা গঠন করলেন।

কী আছে এই ব্যক্তিগত নির্জ্ঞানে?

আমাদের জীবনের সাদামাটা কিছু যা কোনও কারণে আমরা ভুলে থাকি; যেটা আর আমাদের চেতন মনে নেই— এসবই রয়েছে মনের এই মণিকোঠায়। আমরা সাধারণত দুঃখ, বেদনা ও লজ্জার স্মৃতিগুলিকে কম বেশি ইচ্ছাকৃতভাবে অবদমিত করি। আড়ালে থাকা সেই সব উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতা আমাদের ব্যক্তিগত নির্জ্ঞানের অধিবাসী। ইয়ুং বলছেন, ‘ ….. We must include all more or less intentional repression of painful thoughts and feelings. I call the sum of these contents the personal unconscious’। এই ভুলে যাওয়া অভিজ্ঞতা চেতন মনে চলে আসতে পারে। তবে তাদের সম্বন্ধে সচেতন হওয়া বিরাট কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত নির্জ্ঞানের একই ধরন বা ধাঁচের অভিজ্ঞতাগুলি এক-একটা পিণ্ড বা জোটবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এগুলিকে ইয়ুং কমপ্লেক্স (complex) বলেছেন। কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুকে ঘিরে একটি কমপ্লেক্স সুসংগঠিত হয়। ইয়ুং-এর দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে এমন একটি হল মাতৃত্ব (motherhood ১৯৫৪)। মাকে ঘিরে কারও ব্যক্তিগত ধারণা, অনুভূতি সব মিলেমিশে mother complex তৈরি হয়। এমন কিছু কমপ্লেক্স আছে যা সমগ্র ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভুত্ব করে। প্রায়ই বলা হয় নেপোলিয়ান নাকি ক্ষমতার প্রতি এক অভ্যন্তরীণ বলের দ্বারা চালিত হতেন।

Collective Unconscious (The Cloud Clapped Star)

ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান প্রতিটি ব্যক্তির জন্য অনন্য। কিন্তু যৌথ নির্জ্ঞান ব্যক্তিগত নয় যৌথ। ইয়ুং যৌথ নির্জ্ঞানকে ‘trans personal’ বা স্ব-অতিবর্তী বলেছেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি বলতে চাইলেন যৌথ নির্জ্ঞান ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে চলে যায়। নির্জ্ঞান বিষয়ে ফ্রয়েডের ধারণা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং ওই অভিজ্ঞতা অবদমিত অথবা বিস্মৃত। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো। ফ্রয়েডের অনুগামী নন এমন অনেকেই নির্জ্ঞানের শক্তিকে হ্রাস করতে চেয়েছেন। এখানে ইয়ুং কিন্তু নির্জ্ঞানকে বিরাট গুরুত্ব দিলেন। Transpersonal শব্দটি প্রণয়ন করে তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিঅতিবর্তী প্রকৃতি অন্বেষণে Maslow প্রমুখদের উদ্বুদ্ধ করলেন। ইয়ুং-এর বিশ্বাস এই যৌথ নির্জ্ঞানই ব্যক্তিত্বের গভীরতম ও সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান। এটি বিবর্তনের সমগ্র পথ ধরে মানুষের সমষ্টিগত অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। ইয়ুং বলছেন লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত প্রাগৈতিহাসিক বিশ্বের ঘটনাগুলির প্রতিধ্বনি প্রতিটি শতাব্দীতে অতি সামান্য পরিমাণে প্রকরণ ও পৃথকীকরণ সংযুক্ত করে চলেছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে যৌথ নির্জ্ঞানে রেজিস্টার করে চলেছে। বিশেষ ধরনের কিছু আবেগ অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া জানতে এই সব নিবন্ধীকৃত অভিজ্ঞতাকে আমরা প্রবণতা হিসাবে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে থাকি।

ইয়ুং বললেন জন্মের সময় মন ‘অলিখিত ট্যাবলেট’ (blank tablet)-এর মতো থাকে না। ল্যামার্ক নির্দেশিত কায়দায় একটা কাঠামোকে ধারণ করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী প্রজন্মের অভিজ্ঞতা নতুন প্রজন্মে চলে আসে। যুগ-যুগান্তরের মানুষের যে চিন্তাস্রোত তারই অবিচ্ছিন্ন ধারারূপে জাতিনির্জ্ঞান (racial unconscious) প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সমভাবে সর্বজনীন মানসিকতারূপে বর্তমান। এই সর্বজনীন মানসিকতাই আর্কিটাইপ। 

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো

এখন কথা হল এই আর্কিটাইপ ব্যাপারটা কী? ইয়ুং-এর কাছে সাইকির প্রধান চালিকাশক্তি, চিন্তার এক সর্বজনীন ধরন হল archetype। আবেগগত উপাদান-ই এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যৌথ নির্জ্ঞান বলুন বা আর্কিটাইপ-ই বলুন দুই ক্ষেত্রেই ‘Predisposition’ কথাটি আসে।

Predisposition-এর মধ্যে potential-এর ভাব রয়েছে। এই potential হল অস্ফুট শক্তি-সম্ভবনা বা ব্যক্ত হবার আর্তি বা আকুলতা। আর্কিটাইপকে কখনও সম্পূর্ণ জানা যায় না বা নষ্ট করে দেওয়া যায় না। যাবেই বা কী করে? সে তো চেতনায় পূর্ণ রূপে কখনোই দেখা যায় না। বিষয়গত কারণে বার বার যে ইমপ্রেশনের উদ্ভব হয় তাই আর্কিটাইপ। ইয়ুং-এর ভাষায় আর্কিটাইপ-কে বোঝাবার চেষ্টা করা হল। তবে একে কোনও সংজ্ঞায় ধরা যাচ্ছে না। যেটুকু আসছে তো আর্কিটাইপাল ইমেজ। ইয়ুং যদিও অনেক আর্কিটাইপের কথা বলেছেন তবু কয়েকটির বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন।

আর্কিটাইপগুলির মধ্যে persona একটি। এটি যেন একটি ‘মুখোশ’। সভ্যতার তাগিদে মানুষ তার আদিম স্বভাবকে এক নতুন মার্জিত রূপ দিয়ে থাকে। চলতি কথায় একে আমরা ‘ভদ্রলোক’ বা ‘ভদ্রমহিলা’ বলি। এই মুখোশ পরে সে সমাজের কাছে ও নিজের কাছে পরিচিত হয়। মানুষের এই সামাজিক পরিচয়কেই ইয়ুং persona নাম দিয়েছেন।

সামাজিক পরিচয়ের পেছনে মানুষের এক অজ্ঞাত, অসামাজিক রূপ থাকে। মানুষের এই অকাম্য অসভ্য পরিচয়টিকে ইয়ুং Shadow আর্কিটাইপ বলেছেন। এই shadow-র মধ্যে কী আছে? এর মধ্যে আছে নৈতিকভাবে আপত্তিকর কিছু প্রবণতা। এরই সঙ্গে আছে সংগঠনাত্মক ও সৃজনশীল এমন কিছু ধর্ম যেগুলির মুখোমুখি হতে আমাদের ভালো লাগে না। ইয়ুং বলছেন আমাদের পূর্ণ হয়ে উঠতে হলে নিরন্তর এই shadow-র অনুসন্ধান করে চলতে হবে। আর সেই আকাঙ্ক্ষাই হল আমাদের সাহসের প্রথম পরীক্ষা। ছায়াকে অবহেলা বা অস্বীকার করার চেষ্টা আমাদের ভণ্ডামি ও প্রতারণা। ইয়ুং বলছেন আমরা যত আমাদের archetypal shadow-কে জানব আমাদের ইগোর সীমানা তত প্রসারিত হবে ও জীবনে আনন্দ আসবে।

ফ্রয়েডের মতো ইয়ুং বিশ্বাস করতেন সমস্ত মানুষ মনস্তাত্বিকভাবে উভকামী এবং তাদের একটি ম্যাসকুইলিন বা পুংলিঙ্গবাচক ও অন্যটি ফেমিনাইন বা স্ত্রীলিঙ্গবাচক। পুরুষের নারীসুলভ দিকটি যৌথ নির্জ্ঞানে একটি আর্কিটাইপ হিসাবে উদ্ভূত হয় এবং চেতন মনের প্রতি অত্যন্ত প্রতিরোধী হয়। এটিকে বলে অ্যানিমা (Anima)। অ্যানিমা অভিক্ষেপের ওস্তাদ হতে হলে পুরুষকে অবশ্যই বুদ্ধির বাঁধা অতিক্রম করতে হবে। তাকে নির্জ্ঞানের সুদূরে অনুসন্ধান চালাতে হবে ও তাদের মেয়েলি দিকটি উপলব্ধি করতে হবে। ইয়ুং বলছেন স্বপ্নে অ্যানিমা নারী হিসাবে আসার কোনও প্রয়োজন নেই, বরং তা অনুভূতি বা আমেজ হিসাবে আসতে পারে।

মহিলাদের মধ্যে পুরুষালি আর্কিটাইপ হল অ্যানিমাস। অ্যানিমা যেমন যুক্তিহীন ভাবাবেগের প্রতিনিধিত্ব করে অ্যানিমাস (Animus) তেমনি চিন্তাভাবনা ও যুক্তিবোধের প্রতীক। এটি একজন মহিলার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করলেও আসলে তার অন্তর্গত নয়। এটি যৌথ নির্জ্ঞানের অন্তর্গত। পুরুষের সাথে প্রাগৈতিহাসিক মহিলাদের মুখোমুখি হওয়ার ফলে এর উদ্ভব।

এরকম আর কিছু আর্কিটাইপ হল ‘গ্রেট মাদার’, ‘ওয়াইজ ওল্ডম্যান’, ‘সেল্ফ’ ইত্যাদি। ইয়ুং-এর বয়স যখন চল্লিশ তখন তাঁর জীবনে নানা রকমের আঘাত নেমে আসে। একটা মিডলাইফ ক্রাইসিস শুরু হয়। তিনি সব দিক থেকে একাকিত্ব ও অনিশ্চয়তায় ভুগতে শুরু করলেন। মানসিক দিক থেকে চুরমার হয়ে যাওয়ার মুখে তিনি ওয়াইজ ওল্ড ম্যান বা ফিলেমনের সাক্ষাৎ পান। এই ফিলেমন নির্জ্ঞানের গভীর থেকে উঠে এসে তাঁর মনে আবার অস্থা ফিরিয়ে আনে।প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে এরকম একটা যুক্তিনির্ভর সত্তা থাকে। বিপদের সময় যার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায়। অথচ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এ ধরনের আর্কিটাইপের অস্তিত্ব ইয়ুং জানতেন না।

প্রতিন্যাস বা attitude অনুসারে ইয়ুং ব্যক্তিত্বকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করেছেন— ‘অন্তর্বৃত’ ও ‘বহির্বৃত’ (introvert and extrovert)। অন্তর্জগত ও বহির্জগতের প্রতি সকল মানুষের সাড়া একরকম নয়। সাড়া অনুযায়ী একদল অন্তর্মুখী ও অন্যদল বর্হিমুখী। বহির্মুখী ব্যক্তিদের মনঃশক্তি বাইরের জগতের দিকে ধাবিত এবং এদের বর্হিজগত সম্বন্ধে উৎসাহ দেখা যায়।

এরা বাস্তববাদী। আর অন্তর্মুখী ব্যক্তিদের মনঃশক্তি নিজের অন্তর জগতের উপর স্থাপিত। এরা নিজেকে গুরুত্ব দেয়। অন্তর্মুখী ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক বলে নিজেদের ভাব জাগতে বিচরণ করা পছন্দ করে। কোনও মানুষকেই চরম অন্তর্বৃত বা বহির্বৃত বলে চিহ্নিত করা যায় না। ইয়ুং তাই সাধারণ সকল মানুষকে এই দুই চরম প্রকারের মাঝামাঝি আপস রফা বলে মনে করেন। এই প্রকার ব্যক্তির তিনি নাম দিয়েছেন উভয়বৃত (Ambivert)। আবার মানসক্রিয়া অনুযায়ী চার রকম টাইপের কথা বলেন— চিন্তাশীল দল, অনুভূতি-প্রধান দল, সংবেদন-প্রধান দল ও স্বজ্ঞা -প্রধান দিল (Four function types— the thinking, feeling, sensation and intuition)। চিন্তাশীল ও অনুভূতি-প্রধান দল দুটিকে ইয়ুং বলেছেন rational type। আবার সংবেদন-প্রধান ও স্বজ্ঞা-প্রধান দল দুটিকে বলেছেন irrational types। কান্টকে বলতে পারেন চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী। আবার ডারউইন চিন্তাশীল ও বর্হিমুখী। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

ইয়ুংএর বিশ্লেষণী মনোবিদ্যার একটি স্কেচ দেওয়ার চেষ্টা করা হল। যদিও অনেক বিষয়ই ছোঁয়া হল না। এবার ইয়ুং-এর বিশিষ্টতার দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ইয়ুং বিশ্বাস করতেন সত্যিকার অর্থে কাউকে বুঝতে হলে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতাকে যেমন জানতে হবে তেমনি যৌথ নির্জ্ঞানে নিবন্ধীকৃত যা কিছু তাও জানতে হবে। এর সাথে জানতে হবে ভবিষ্যতে ব্যক্তির লক্ষ্যগুলি। দেখা যায় ফ্রয়েড ও ইয়ুং দুজনেই পরিণামবাদী বা determinist হওয়া সত্ত্বেও ইয়ুং উদ্দেশ্যকারণতা বা tetology-কে আঁকড়ে ধরলেন। অল্প কথায়, ফ্রয়েড বুঝলেন শৈশব ব্যক্তিত্বকে নির্ধারণ করে (causalty); ইয়ুং যুক্তি দিলেন আচরণকে অবশ্যই, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য (teleology) এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা উচিত। ইয়ুং অবশ্য এর সাথে synchronicity বা অর্থপূর্ণ সমাপতনের কথাও বলেছিলেন— আকস্মিকতার মধ্যেও কিছু একটা রয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ইয়ুং-এর চিন্তার অপর একটি বিশিষ্টতা হল তা সমন্বয়-প্রয়াসী। ফ্রয়েড বলছেন কামই জীবনের মূল শক্তি আর অ্যাডলার বলছেন, হীনতাবোধ অতিক্রম করে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠাই মূল শক্তি। ইয়ুং বললেন, জীবনের মূল শক্তি এ-দুয়েরই ঊর্ধ্বে এক সাধারণ উদ্যোগিতা (urge); কাম ও শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষা দুই-ই সেই একই সাধারণ শক্তির দ্বিবিধ প্রকাশ। ইয়ুং-এর জীবনের মূল সাধারণ উদ্যোগিতাকে আমরা সহজেই বের্গসঁ-এর জীবন-স্রোত (elan vital) অথবা শোপেনহয়্যার-এর জীবন বোধ (will to live)-এর সাথে তুলনা করতে পারি।

এই সাধারণ উদ্যোগিতা বহুরূপে আপনাকে প্রকাশ করে। তার মধ্যে কাম ও শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষা দুটি প্রধান। ফ্রয়েড-এর মত তা আধুনিক বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। ইয়ুং মনে করেন ধর্ম এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস গাঁজাখুরি হাস্যকর ব্যাপার নয়। তাঁর ঘরের দরজার মাথায় ল্যাটিন ভাষায় এই বাণীটি উৎকীর্ণ আছে— ‘Whether or not you think about God, He is always present.’

ইয়ুং নিঃসন্দেহে তাঁর তত্ত্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। তবে শেষের দিকে তাঁর চিন্তাধারা রহস্যময় হয়ে উঠেছে। কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিজ্ঞানের রাজ্য পরিত্যাগ করে এমন এক অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করেছেন যা সাধারণ লৌকিক যুক্তিবুদ্ধিতে অনুধাবন করা কঠিন। ল্যামার্কের ধারণার অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের তত্ত্বের প্রয়োগের জন্য সমালোচিত হয়েছেন। এই সব সমালোচনা সত্ত্বেও ইয়ুং যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছেন। তাঁর ‘অন্তর্মুখিতা’ ও ‘বহির্মুখিতা’ অধিকাংশ ব্যক্তিত্ব পরীক্ষার অংশ— যেমন মিনেসোটা মাল্টিফেজিক পারসোনালিটি ইনভেন্টরি এবং মায়ার-ব্রিগস টাইপ ইন্ডিকেটর। পাঠককে এই মুহূর্তে ঋত্বিকের ছবিগুলি স্মরণ  করতে বলছি। ভাবুন না ‘অযান্ত্রিকের’ বিমল একস্ট্রোভার্ট না ইনট্রোভার্ট? অথবা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র মিথিক্যাল মেট্রিক্সের কথা। শুধু ঋত্বিক কেন ফেলিনির ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ ছবির নায়ক গুইডো তার মানসী ক্লডিয়াকে বলছে ‘You are young yet ancient’ অর্থাৎ অ্যানিমা একই সঙ্গে নবীনা ও প্রাচীনা। শুধুমাত্র মনোলোভা নয় জ্ঞানদাতাও বটে। বলতে চাইছি ফ্রয়েডকে যেমন ত্যাগ করতে পারিনি তেমনি ইয়ুং-কেও মনে রাখতে হয়েছে। অবশ্যই গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে। বিগলিত শ্রদ্ধা ও চরম বিরোধিতা কোনোটাই নয়। তাহলে কি নিরপেক্ষতা? না। নিরপেক্ষতার আড়ালে এক ধরনের বিশ্লেষণ ক্ষমতার খামতি থেকে যায়। তাই বিশ্লেষণের সংগঠনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে পাঠক ইয়ুং সমীক্ষণ এগিয়ে নিয়ে চলবেন এই ভরসায় ইতি টানছি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান