মন কী ও কেন

অতীশ চট্টোপাধ্যায়

মন কী?

মন কোনও ভৌত পদার্থ নয়, তবে তা ভৌত পদার্থ সঞ্জাত। শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, কলা বা কোশের মতো তার ছবি তোলা যায় না বা তাকে মাপা যায় না। যেমন রক্ত। শরীরের কোনও অংশ কেটে গেলে আমরা রক্ত বেরোতে দেখি, কিন্তু কোনও অংশ কেটে গেলে আমরা কি মন বেরোতে দেখব? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির মাধ্যমে এখন আমরা জীবন্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, বিভিন্ন কলা এমনকি জীবন্ত কোশের ছবি তুলতে পারি। এই ছবি দৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, অদৃশ্য তরঙ্গ, শ্রবণের অতীত শব্দতরঙ্গ, ইলেকট্রন ও পজিট্রন সহ বিভিন্ন কণার স্রোত, চুম্বকীয় পরিবর্তন পরিমাপের মাধ্যমে তোলা সম্ভব। এমনকি জীবন্ত কোনও নির্দিষ্ট কোশকে পৃথক করা এবং তাকে দেহের বাইরে বৃদ্ধি ঘটিয়ে কোশ ও কলা তৈরির প্রক্রিয়াও এখন বিজ্ঞানীদের অজানা নয়। কিন্তু মনের কি ছবি তোলা যায়? বা দেহের বাইরে মনকে কি সৃষ্টি করা যায়? এখনও পর্যন্ত এ কেবল প্রকৃতির বীক্ষণাগারেই তৈরি হয় এবং শেষ হয়। একথা প্রাণের ক্ষেত্রেও সত্য। মৃত কোনও জীবকে কি জীবনদান করা সম্ভব? থাক সে অন্য কথা। এখন তা হলে যে কথায় আসা যায় তা হল মন আসলে কী? তাকে কি দেখতে পাওয়া যায়?

খুব সংক্ষেপে বলা যায় মন এবং তার বিভিন্ন গুণাবলি ও সচেতনতার মতো ব্যাপারগুলি হল অ-ভৌত সত্তা যার মূলে রয়েছে তথ্য এবং তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ। এসবের অস্তিত্বের উদ্বর্তন ঘটে সেই প্রজাতির জীবিত থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি ঘটাতে, যে প্রজাতি এইসব প্রক্রিয়াকরণ করে। অর্থাৎ মনের মূল কাজ হল যার মন তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনার বৃদ্ধি ঘটানো। এটাকে বলা যেতে পারে মন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের অত্যাধুনিক ভাবনা এবং তাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টা। এখন প্রশ্ন হল, কী করে বুঝব মন আছে। মনের অস্তিত্ব বোঝা যায় দর্শন, শ্রবণ, গন্ধের অনুভূতি, আবেগ বা চিন্তার মতো যা-কিছু আমরা মনের মাধ্যমে অনুভব করি, তার সাহায্যে। আমরা তাই কম্পিউটার বা রোবটের মতো নই। কারণ মনের মাধ্যমে আমরা যখন অনুভব করি তখন তার এবং সচেতনতার দ্বারা তার যখন প্রক্রিয়াকরণ ঘটে তার কিছু ভৌত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এবং সেগুলি একটি প্রজাতির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে বিভিন্ন রকম শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেমন কোনও মানুষ ভয় পেলে তার শরীর অজানা বিপদের জন্য তৈরি হতে থাকে। তার মধ্যে নানা শারীরিক পরিবর্তন ঘটে, যাকে বলে ‘ফ্লাইট অ্যান্ড ফিয়ার রিঅ্যাকশন’ বা পলায়ন এবং ভয়ের প্রতিক্রিয়া। এর দরুন শরীরে হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, তাপমাত্রা, অনাল গ্রন্থির নিঃসরণ সহ অসংখ্য পরিবর্তন ঘটে। ফলে মানসিক এবং শারীরিকভাবে সেই মানুষ বা সেই জীব সম্ভাব্য লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে ওঠে। আবার ব্যায়াম বা কোনও খেলায় নামার কথা ভাবার সঙ্গে শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। সেগুলির ভৌত-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিমাপ করা সম্ভব। এসবই মনের কাজ, অর্থাৎ সহজ কথায় মনের এইসব কাজ দেখে আমরা বুঝতে পারি যে মন আছে। যার মন নেই অর্থাৎ মৃত জীবের ক্ষেত্রে এসব ঘটবে না।

মনের অবস্থান কোথায়?

দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় লব্ধ জ্ঞান ও ধারণা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে যে মন সবসময় অবস্থান এবং কাজ করে জীবন্ত মস্তিষ্কের মধ্যে। আবার জীবন্ত মস্তিষ্কও অবস্থান ও কাজ করে মনের মাধ্যমে। একটিকে ছাড়া অন্যটির সক্রিয় অবস্থান অসম্ভব। তারা আসলে একটি ঐক্য (ইউনিটি)। এই দুটি-ই একে অপরের অন্তর্নিহিত ও সমতুল্য। কিন্তু একই ঐক্যের দুটি ভিন্ন দিক। একটি অ-ভৌত (নন-মেটেরিয়াল) অন্যটি ভৌত (মেটেরিয়াল)। মনের ভৌতপ্রকাশগুলি এবং জীবন্ত মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি সমূহ, যেগুলি অ-ভৌত, থেকে এই কথা বলা যায় যে জীবন্ত মস্তিষ্কের তথ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিগুলির সমাহারের মধ্যেই মনের অবস্থান।

এখন মস্তিষ্ক হল স্নায়ুতন্ত্রের সর্বোচ্চ এবং সর্বোত্তম অঙ্গ। আমাদের দেহের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রিত হয় স্নায়বিক-অনালগ্রন্থীয় (নিউরোএন্ডোক্রাইনাল) নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে। তাই স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপ বোঝার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির উদ্ভাবনের চেষ্টা চলেছে বিজ্ঞানচর্চার উষাকাল থেকে। যার প্রাচীনতম পদ্ধতি এই তন্ত্রের কোনও অংশকে কেটে বাদ দেওয়া (অ্যাবলেশন) বা কোনও অংশকে উত্তেজিত (স্টিমুলেশন) করা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতিরও ক্রমান্বয়ে উন্নতি ঘটেছে। যার সর্বোত্তম পর্যায় হল লেজার অ্যাবলেশন, ক্রায়োজেনিক অ্যাবলেশন থেকে সিঙ্গল সেল স্টিমুলেশন। এসবের মাধ্যমে মস্তিষ্ক সহ স্নায়ুতন্ত্রের নির্দিষ্ট অংশের কী কাজ তা বোঝা সম্ভব হচ্ছে। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ কী কাজ করে এবং সেই অনুযায়ী তাদের নামকরণও করা হয়েছে। পরবর্তীতে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছবি তোলার নিত্য নতুন মাধ্যম। যেমন স্ক্যানিং, ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং— এম আর আই, পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফিক স্ক্যানিং— পি ই ট স্ক্যানিং— পেট স্ক্যানিং। এম আর আই এবং পেট স্ক্যানিং -এর মাধ্যমে অনেক কাজের মধ্যে শরীরের একটি অংশে কতটা রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে তার ছবি তোলা সম্ভব। এভাবেই বোঝা সম্ভব হচ্ছে মানুষ যখন একটি কাজ বা চিন্তা করছে তখন মস্তিষ্কের কোন অংশে বেশি রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে। তা থেকে বোঝা যাচ্ছে মস্তিষ্কের সেই অংশটি কোন নির্দিষ্ট কাজ বা মানসিক অবস্থার সঙ্গে যুক্ত।

রাসায়নিকভাবেও মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের, বিভিন্ন কোশের অর্থাৎ নিউরোন এবং অন্যান্য কোশের ক্রিয়াপদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারা যেমন নিউরোবায়োলজি, নিউরোকেমিস্ট্রির মাধ্যমে কোন কোন রাসায়নিক মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোশে, বিভিন্ন জালিকা বা সারকিউরিটিতে কীভাবে কাজ করছে, এইসব কোশে রাসায়নিকের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অংশে নিঃসরণ (সিক্রিশন) বা পুনর্গ্ৰহণ (রি-আপটেক) পরিমাপ করা যাচ্ছে। এভাবেও চলছে মনের কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রচেষ্টা।

মনের রসায়ন

এ-পর্যন্ত আলোচনা থেকে এটা বোঝা গেল মনের অবস্থান মস্তিষ্কে, আরও সুনির্দিষ্টভাবে অগ্র মস্তিষ্কে (সেরিব্রাল কর্টেক্স) অবস্থিত বিভিন্ন স্নায়ুকোশ এবং তাদের জালিকায়। এই জালিকাগুলি তৈরি হয় বিভিন্ন স্নায়ুকোশের সংযোগের মাধ্যমে, এই সংযোগস্থলকে বলা হয় সাইন্যাপস। এছাড়াও রয়েছে একত্রে অবস্থিত স্নায়ুকোশের এলাকা বা গোষ্ঠী। যাকে বলা হয় নিউক্লি। মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থানে এইরকম বিভিন্ন নিউক্লি এবং জালিকা মিলে জীবিত মস্তিষ্ক এবং মন তার কাজ করে। বিভিন্ন কাজের জন্য রয়েছে বিভিন্ন এলাকা। কাজ করার সময় সেই সব এলাকার নিউক্লি এবং জালিকার কোশগুলি উত্তেজিত (স্টিমুলেটেড) হয়, অন্য সময় স্তিমিত বা অবদমিত (ইনহিবিটেড) থাকে। এখন এই উত্তেজনা বা অবদমনের কাজটি করে বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক। যাদের নিউরোকেমিক্যাল, নিউরোট্রান্সমিটার, নিউরোস্টিমুলেটর বা নিউরোইনহিবিটর বলা হয়। যত দিন যাচ্ছে তত এইরকম অজস্র নিউরোকেমিক্যালস এবং তাদের কাজের কথা জানা যাচ্ছে। এও বোঝা সম্ভব হচ্ছে যে কিছু এই ধরনের নিউরোকেমিক্যালস বা নিউরোট্রান্সমিটার মনকে ভালো রাখে আবার কিছু মনকে অবসাদগ্রস্ত বা অবদমিত করে তোলে। তা হলে এক ভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে মস্তিষ্কে অবস্থিত বিভিন্ন নিউরোকেমিক্যালসের সমষ্টিকেও মন হিসাবে ভাবা যেতে পারে। এরকমই বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করে চিকিৎসকরা বর্তমানে বিভিন্ন মানসিক রোগের বা অবস্থার চিকিৎসা করতে সমর্থ হচ্ছেন। আর এই স্নায়ুজালিকা (নিউরো সরকিউরিটি) এবং স্নায়ুকোশ নিঃসৃত রাসায়নিক (নিউরোকেমিস্ট্রি) নিয়ে চলছে নিরন্তর গবেষণা। যেপথ ধরেই মানুষ এগিয়ে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স), স্নায়ু জীববিদ্যা (নিউরোবায়োলজি)-র পথে। এরকমই কয়েকটি স্নায়ু কোশ নিঃসৃত বা উৎপাদিত রাসায়নিক হল— অ্যাসেটাইল কোলিন, নরএপিনেফ্রিন, গামাঅ্যামিনোবিউটিরিক অ্যাসিড (জি এ বি এ– গাবা), ডোপামিন, সেরোটেনিন। এছাড়াও নরএপিনেফ্রিনের মতো কিছু নিউরোট্রান্সমিটার হরমোন এবং রিলিজিং হরমোন হিসেবে কাজ করে। অ্যাড্রেনালিন, মেলাটোনিন, কর্টিসল এবং আরও কিছু হরমোন মানসিক অবস্থা, মনের ভাব, মেজাজকে প্রভাবিত করে।

এখন কোনও রাসায়নিককে নিউরোট্রান্সমিটার হতে গেলে তার ছ-টি (৬) গুণ থাকা দরকার। সেগুলি হল— ১) নিউরোন বা স্নায়ুকোশে সেগুলি তৈরি বা সংশ্লেষিত হবে। ২) সেখানে সেগুলি সঞ্চিত হবে বা থাকবে। ৩) সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণে নিঃসৃত হয়ে কিছু শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটাবে। ৪) যখন পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে তখন একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটাবে। ৫) সাইন্যাপস উত্তর পর্দায় (পোস্ট সাইন্যাপটিক মেমব্রেন) তার গ্রাহক (রিসেপ্টর) থাকবে। ৬) এই রাসায়নিক কাজ দ্রুত বন্ধ করার ব্যবস্থা থাকবে। তা দ্রুত সেই রাসায়নিক অণুর ভাঙন বা তা নিঃসরণ কোশে দ্রুত পুনর্গ্ৰহণের মাধ্যমে হবে।

এই সব নিউরোট্রান্সমিটার কাজ করে ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুৎ তৈরির মাধ্যমে। কিন্তু তা মিলিভোল্ট পরিমাণের এবং মিলি সেকেন্ডের মধ্যে তা পরিবর্তিত হয়। তাই জীবিত মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে সংকেত (সিগন্যাল) তৈরি এবং পরিবাহিত হয় এইসব নিউরোকেমিক্যালস এবং নিউরোট্রান্সমিটার সৃষ্ট বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে। কিন্তু জটিলতার জায়গাটি হল মস্তিষ্কে এক সেকেন্ডের মধ্যে কয়েকশো স্নায়বিক উত্তেজনা (নার্ভ ইম্‌পাপাল্স) তৈরি হতে পারে। এর ফলে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক সংকেত বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এসবের মধ্যেই রয়েছে মনের খোঁজ। একাজ বিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছেন। যা অত্যন্ত উত্তেজক এবং চিত্তাকর্ষক।

মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রে উপস্থিত এরকম শত সহস্র জানা-অজানা রাসায়নিকের মন গঠনে ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তা আলোচনার অন্তর্গত করা সম্ভব নয়। কিন্তু তা এই সংক্রান্ত গবেষণা এবং জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মানুষের মনের অসুখের চিকিৎসা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। জানতে চাইছেন মনের সুখের চাবিকাঠি।

আর একটি প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করতে চাই। এইসব নিউরোট্রান্সমিটার এবং নিউরোহরমোনগুলির মধ্যে কিছু আছে যেগুলি মানুষের মন ও মেজাজ ভালো রাখে। যাদের মধ্যে রয়েছে — সেরোটোনিন, ডোপামিন, এন্ডরফিন ও অক্সিটোসিন। এরা নির্দিষ্টভাবে সক্রিয় হয়, সংকেত তৈরি করে বিভিন্ন আবেগ সৃষ্টি করে। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু এলাকাকে উত্তেজিত করে। এদের বলা হয় ভালো নিউরোট্রান্সমিটার (গুড নিউরোট্রান্সমিটার)। এদের গ্রহণ বাড়িয়ে বা এদের উৎপাদন বাড়িয়ে মনকে ভালো রাখার চেষ্টা করা হয়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান