সমস্যাটা বায়োমেডিকেল সাইকিয়াট্রির : এখানে আলোচনাটা কৌম, সমাজ, ‘পাগল’ বিষয়ীর সাংস্কৃতিকতা আর প্রান্তিকতার প্রশ্নগুলো থেকে

অমিতাভ সেনগুপ্ত 

এ-কথাটা শুরুতেই বলে নেওয়া যাক যে মূলধারার সাইকিয়াট্রির বায়োমেডিকাল মডেলটিই এখনও আধিপত্যকারী বা বাজার চলতি। যা মানসিক অসুস্থতা-কে একমাত্র ব্রেন বা মস্তিস্ক বিকৃতি হিসেবে দেখেই তার যাত্রা শুরু করেছিল এবং সময়ের সাথে সাথে তার বিস্তৃতি ঘটে প্রামাণ্য বা গবেষণা লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে নিউরোকেমিক্যালস ইমব্যালান্স ও হরমোনাল ইমব্যালান্স-এর জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে মানসিক অসুস্থতার কারণ খোঁজাকে আরও সুর্নির্দিষ্ট ভাবে লক্ষ্য স্থির করে। 

উন্মাদ, অপ্রকৃতিস্থ, অসুস্থ-(অব)মন-কে বোঝার এই চলিত বিশেষণগুলি সঙ্গে নিয়ে এসেছে সারিয়ে তোলার, সুস্থতায় ফিরিয়ে আনার চর্চাও। সাইকিয়াট্রি তো মেন্টাল হেল্থ সায়েন্স-এর একটি দিক। কিন্তু ঔষধি-বিজ্ঞান, স্নায়ু বিজ্ঞান আর মনের অসুখের anatomo-clinical বোঝাপড়া নিয়ে এটি সময়ের সঙ্গে প্রভুত্বকারী নিয়ন্ত্রক দিক হয়ে উঠল। Neuropathology আর psychosis একসাথে চলতে শুরু করার পথে শরীর/ মনের পার্থক্য রেখা মুছে lunacy আর insanity-র ধারণা সীমাবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকল psychosis-এ। ‘উন্মাদনা’-কে চেনা, পড়া, নিয়ন্ত্রণে বাঁধার উপায় খুঁজতে খুঁজতে পাগল ‘বিষয়ী’ হয়ে উঠল ‘সাবজেক্ট’ (বা ‘object of knowledge’)— তার উন্মাদনা-কেও বাঁধা হল symptom আর clasification-এ। নির্দিষ্ট cause and cure-এর ধারণা ছাড়াই ECT, ইনসুলিন থেরাপি, সাইকো সার্জারি বা অর্গানিক থেরাপি কাজ করতে থাকল ‘disorder’ (ভুললে চলবে না ‘অ’প্রকৃতিস্থতা-র সমাজ সংস্কৃতি নির্ভর ধারণা নিয়েই তো গোলমাল শুরু থেকে) নিয়ে।

তিনটি বিশেষ ঘটনার দিকে নজর টান দিয়েছিলেন অনুপ (ডঃ অনুপ ধর) আর রঞ্জিতা’দি (ডাক্তার রঞ্জিতা বিশ্বাস)  ‘তেপান্তর ৭’ পত্রিকায় তাদের সাইকিয়াট্রি,’ অ্যান্টি-সাইকিয়াট্রি এবং অতঃপর…’ লেখাটায়। ফরাসি বিপ্লবের বছরটির অব্যবহিত আগেই ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপ পিনেল যখন অ্যাসাইলামের বন্দি (‘পাগল’)-দের শিকল খুলে দেওয়ার জন্য আওয়াজ তুললেন। ১৮৯৫-থেকে ১৯০৫-এর মধ্যে ফ্রয়েডীয় সাইকো অ্যানালিসিস-এর উদ্ভব। তৃতীয় ঘটনাটি হল ১৯৫০-এর দশকে সাইকোফার্মাকোলজির উদ্ভব। সাইকিয়াট্রির ইতিহাসে এই তিনটি ঘটনাকে তিনটি ‘বিপ্লব’ হিসেবে দেখা হয়। উন্মাদনার ইতিহাস চর্চায় ফুকোর তোলা প্রশ্নগুলোকেও ওরা সঙ্গে টেনে এনেছিলেন। পিনেল যখন উন্মাদের শিকল ঘোচাচ্ছেন, তখনই কি সূচনা হচ্ছে, তাকে সুস্থ করে তোলার নামে সাইকিয়াট্রি-র নিরাময়ের পদ্ধতি প্রকরণের, ক্ষমতার অদৃশ্য শিকলে পাগলকে বেঁধে ফেলবার? (অ)সুস্থকে স্ব-তে স্থিতি দেওয়ার নামে শায়েস্তা করা? ফুকো, দেলুজ, গুয়েত্তেরি সাইকোঅ্যানালিসিস-এর আঙিনাতেও দেখতে পান ‘খ্রিস্টীয় স্বীকারোক্তির পুনরুত্থান’ যেখানে ‘পাপীর পরিবর্তে রুগি তাঁর (যৌন) স্বীকারোক্তিগুলোকে ভাষার আকারে রাখেন; রাখেন চিকিৎসকের কাছে, পাদ্রির পরিবর্তে।’ আর সাইকোফারমাকোলজি এসে ‘মনের জটিল রসায়নকে নামিয়ে আনল, সরলীকৃত করে নামিয়ে আনল মস্তিষ্কের জৈব রসায়নে।’

১৯৬০-এর দশকে ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ই সি টি) বা সাইকোট্রপিক ড্রাগের নানা সমস্যার দিক সামনে এনে বায়োমেডিকাল মডেলের বিরুদ্ধে অন্য ভাবনাগুলো সামনে আসতে থাকে। ষাটের শেষ থেকে ‘৭০-এর দশক ছিল ঝোড়ো হাওয়ার— সময়, সমাজ, সংস্কৃতি আন্দোলিত হয়েছিল সবকিছুই। সারা দুনিয়া জুড়ে জ্ঞান চর্চা ও চিন্তার জগতে প্রভুত্বকারী ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করে ‘বিরুদ্ধতার সংস্কৃতি’ (কাউন্টার কালচার মুভমেন্টস) ও মানুষের  স্বাধিকারের দাবিকে নানা ভাবে তুলে ধরার আন্দোলনগুলির মধ্যেই জায়গা করে নিয়েছিল অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি মুভমেন্ট। ইউরোপে মনোচিকিৎসকদের একটি অংশই সাইকিয়াট্রির মনের অসুখকে মস্তিস্ক (‘ব্রেন’)সর্বস্ব ভাবে দেখা ও ওষুধ চিকিৎসাকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে ধরে নেওয়ার বিরোধিতায় মানসিক অসুখের কারণ খোঁজা ও চিকিৎসায় সামাজিক ও পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতামত ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠতে থাকছিল।

সময়ের প্রেক্ষিতটিকে মাথায় রাখলে বুঝতে সুবিধা হবে— অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি আন্দোলন আসলে ছিল একটি নানা ধরনের প্রতিস্পর্ধী চিন্তা ও মতামতের একটি যৌথ স্বর। দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিকেরা যেমন মিশেল ফুকো গিলেস দ্যলুজরা প্রতিরোধী চিন্তার দর্শন ভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন তেমন তাতে মিশে ছিল সামাজিক নৃতাত্ত্বিকদের ভাবনা, নিজেদের রোগী দেখার ক্লিনিক থেকে মূল ধারার সাইকিয়াট্রিকে ঘিরে প্রশ্ন তুলতে থাকা সাইকিয়াট্রিস্টরা যেমন ডেভিড কুপার, থমাস স্যাজ, আর ভি ল্যাঙ প্রমুখ, নৃতাত্ত্বিকরা যেমন আর্থার ক্লেইনম্যান, বায়রন গুড এবং অবশ্যই মনস্তত্ত্ব ও মানসিক স্বাস্থ্যের চর্চার অন্য ধারাগুলোর সঙ্গে জড়িত যারা অর্থাৎ এরিক ফ্রম থেকে কার্ল রজার্স, লুস ইরিগ্যারে সাইকোথেরাপিস্ট আর সাইকোঅ্যানালিস্টরা— তাঁদের উল্লেখ না-করলে গুরুত্বপূর্ণ অসম্পূর্ণতা থাকবে— আর হেলেন সিক্সু বা ক্যাথরিন ক্লেমেন্ট-এর মতো নারীবাদী চিন্তকরাও।

দশকের পর দশক ধরে থমাস স্যাজরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্র্যাকটিস করতে করতেই সাইকিয়াট্রিস্টরা প্রশ্ন তুলেছেন বারবার। বোনাফায়েড ব্রেইন ডিজিজ-এর চিকিৎসাটা চালাচ্ছে সাইকিয়াট্রির খবরদারিতে নিউরোলজিস্ট, ইন্টার্নিস্টস, এনডোক্রিনোলোজিস্ট আর সার্জেনরা। ঘুমপাড়ানি বা ট্র্যাঙ্কুলাইজিং মেডিসিন, শক থেরাপি, অবরুদ্ধ রাখা বা ইমপ্রিজনমেন্ট, ভায়োলেন্ট পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট-এর নামে প্যাডেলড সেলস বা অন্ধ কুঠুরিতে একলা আটকে রাখা, ওই লম্বা বস্তাটায় ঢোকানো বা স্ট্রেট জ্যাকেট, হট অ্যান্ড কোল্ড ট্রিটমেন্ট বা গরম ঠান্ডা জলে চোবানো, ওষুধ গেলানোর ফোর্স ফিডিং এক্সপেরিমেন্ট আর ব্রেইন সার্জারি— কেন এ-গুলোতে আটকে পড়ছে সাইকিয়াট্রি? জ্যাক নিকলসন অভিনীত One Flew Over The Cuckoo’s Nest যারা দেখেছেন, এই শব্দগুলোকে চিনতে বুঝতে তাদের একটুও সময় লাগবে না।

আসলে প্রশ্নটা উঠছিল এখান থেকেও যে মেন্টাল হেল্থ সায়েন্সের অন্য ধারণাগুলো, অন্য অভ্যেসগুলো এভাবে muted বা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছিল কেন সাইকিয়াট্রির কাছে। শরীর, শারীরিকতা আর তার docility ; madness/ abnormality/ non functional/ unproductive/insanity/ irrationality/ disability/ illness— এই ধারণাগুলোকে তন্নিষ্ঠায়, অভিনিবেশে ভাবছিলেন নানা স্কুল অফ থটের দার্শনিকরা, হাতে কলমে করে দেখার মানুষেরা। সাইকিয়াট্রি এবং উন্মাদনাকে তার মস্তিস্কের জৈব রসায়নে রিডিউস করাকে প্রশ্ন করতে করতে তারা যে প্রশ্নগুলো তুলছিলেন— তা-ই হল অ্যান্টিসাইকিয়াট্রি। এভাবেই তারা প্রশ্ন তুলেছেন cure-care-controll এবং coercion নিয়ে। চিকিৎসক আর রোগীর মধ্যের ক্ষমতার কাঠামো নিয়ে, কে সুস্থ কে অসুস্থ, রোগনির্ণয় পদ্ধতির বৈধতা কী, সারিয়ে তোলার অর্থই বা কী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন— (অ)স্বাভাবিকতাই (অ)সুস্থতা? নিয়ম না বিশু পাগলই অসাড়, অপ্রতিরোধী লাইন দিয়ে মেনে চলা ঊনসত্তরের ঙ-দের অস্বস্তি, প্রশ্ন শুনতে না-চাওয়াই কি রাজার অসুখ, উন্মাদনা কি তবে সুবিন্যস্ত সমাজ আর রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক? নারীবাদী দার্শনিকরা প্রশ্ন রাখছিলেন, মধ্য যুগে  ‘ভূতে পাওয়া’ ‘ডাইনি’ হিসাবে যাকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতার দাপটকে পুরুষতন্ত্র-কে প্রশ্ন করা সেই অবাধ্য নারী-ই আজ অভিহিত হচ্ছে ‘হিস্টেরিক’? রাজপরিবারের নিয়মের আগল, রানির তর্জনী বেয়ে যে পৌরুষের শাসন নেমে আসে তাকে ভাঙতে চাওয়া অবাধ্য প্রিন্সেস, অন্য কোথাও অন্য কোনও গোলার্ধে যে একদিন ছিল কলোনির কালো মেয়ে ‘হিস্টেরিক’— আজ কি নতুন সময়ে তাঁর নতুন ডায়াগনোসিস ‘অ্যানোরেক্সিক’?

কয়েক দিন আগেই বারাসতে স্টেট উনিভার্সিটির একটি peace psychology-র উপর কনফারেন্সে দেখা হল বন্ধু উজ্জয়িনী-র সাথে। সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার উজ্জয়িনী শ্রীমানি। ও দিল্লি চলে যাবার পর মাঝের ক-বছরে দেখা হয়নি। সময় আর জীবনের ফ্লুইডিটি বারবার আমাদের মনে করায় ক্যাটেগরাইজেশন-এর স্থির নিশ্চিত প্রত্যয় আসলে কত ঠুনকো। না উজ্জয়িনী-র সঙ্গে তত্ত্বের তর্কের সুযোগই হয়নি। শুধু ও জানালো ও ডাক্তারি প্র্যাক্টিস করছে না।ডায়াসে উঠে ওর বলা কথাগুলোয় জানলাম বুদ্ধ-পথের মনচর্চা বিপাসনা অভ্যাস ওর চিন্তা আর আত্মপরিচয় নির্মাণ জুড়ে এখন। অন্যের অ-সুখ-কে রোগ লক্ষণের নামে চিহ্নিত করার আগে আপনাকে জানার না-শেষ-হওয়া টুকু নিয়ে হয়তো সময় চাই আমাদের। এই আত্ম অনুসন্ধানের অবসরই তো হয় না কত ব্যস্ত ডাক্তারবাবুদের। তখনই মনে হল, এর পরে এই লেখাটা আমার নিজেরই বিভিন্ন সময়ের নেওয়া নোট বা টুকরো টুকরো পুরোনো কথা মনে হওয়া নিয়ে এগোতে থাকবে— কথার টানে কথা— তাই পড়ার সুবিধার মতো বিন্যস্ত করে রাখব যতটা সম্ভব হয়।

কলকাতায় অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি চর্চার conceptual contour-টার সাথে আমার নানা সূত্রে বিভিন্ন সময়ে আলাপ কথোপকথন হয়েছে। যদি-না সেই পরিচয় আলাপ চিন্তার ভাঙা গড়া পথচলার কথা বলি, অ্যান্টিসাইকিয়াট্রি নিয়ে আমার ভাবনার কথা আমার মতো করে বলাই হয়ে উঠবে না। ‘অযুক্তি’ (উন্মাদনা)-র সঙ্গে ‘বিষয়ী’ (subjective) আমার নিযুক্তিও সেই অলিগলি পথেই, ওই পথে পাই সেই মানুষগুলোকে যারা আমার চিন্তাকে গড়েছেন— মানে আমাকেও। কলকাতায় সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি, কালচারাল সাইকিয়াট্রি, ক্রিটিক্যাল সাইকিয়াট্রি চর্চার কথা জুড়ে এই মানুষগুলোর কথাই আসবে— আসলে কলকাতায় অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি চর্চার স্বরটাও তাই সমসত্ত্ব নয় বহুস্বরের।

অনেক বছর আগে ‘উন্মাদনা’-কে শব্দ-দৃশ্যর মাধ্যমে বুঝতে চেয়ে এক তথ্যচিত্র নির্মাতা বন্ধু সুস্মিতা ‘চিনতে যদি পেরেই থাকো’ নামের একটি ছবি বানানোর সময় আমাকে কাজটির সঙ্গে থাকতে বলে। সে কাজে বরানগরের স্ট্যটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট-এর ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রথম গল্পটা শুনি। গ্রিক পুরাণের দৈত্য প্রোকাস্টাস-এর গল্প। সে যাদের পাকড়াও করত শাস্তি দিত অদ্ভুত নিয়মে। একটি নির্দিষ্ট মাপের খাটে শুইয়ে যারা খাটের মাপের চেয়ে লম্বা হত কেটে ছোটো করে খাটের মাপে নিয়ে আসত তাদের, আর যারা খাটো হত খাটের চেয়ে তাদের জন্য টেনে লম্বা করে মাপে আনা। দেবপ্রসাদ বাবু যে ‘মাপ মতো’ নয় তাকে মাপ মতো বানানোর রেটরিকটা ব্যবহার করেছিলেন মানসিক ‘(অ)সুস্থতা’-র ধারনাটাকে— সে ধারণার  সামাজিক নির্মিতি, তার মাপজোক (এম্পিরিক্যাল বিজ্ঞানের প্রমাণ নির্ভর যুক্তিতে), নর্মালসি থেকে বিচ্যুতি— ডিসপারসন, লক্ষণ চিহ্নিতকরণ, ‘মাপমতো সুস্থ’-দের সমাজ থেকে উন্মাদের বাদ পড়া— এই বিষয়গুলো বোঝাতে। স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল সাইকিয়াট্রি-র কথাও। মানে সাইকিয়াট্রি-র দর্শন। ‘তার কেটে যাওয়া’ (উন্মাদনার চলতি মুখ-ফেরতা উপমা) মানুষটিকে আবার সুর-তাল-এ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় সাইকিয়াট্রির ভূমিকা। 

একদিন ডিসি, ডাক্তার দেবাশীষ চ্যাটার্জি আর মোহিত’দার সঙ্গে বসে মন ফাউন্ডেশন-এ কাজের শেষে আড্ডার পরিসরে— সাবজেক্ট থেকে যেন সাবজেক্টিভিটিতে ফেরা নিয়েই কথা হচ্ছিল। দিনের শেষে রোগী দেখার অভিঘাত কীভাবে কেয়ার গিভারের/ ডাক্তারের un-ease হয়ে ওঠে— সে কথায় ডাক্তার অজিতা চক্রবর্তীর নাম প্রথম শুনি।

মেডিকেল কলেজের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক আর ট্রান্সকালচারাল সাইকিয়াট্রির গবেষক অজিতা চক্রবর্তী-র কথা মন মনন চর্চায় রত কলকাতায় প্রায় সবাই তোলেন। অনেকগুলো বছর সামলেছেন ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির নানা গুরু দায়িত্ব। ‘মাই লাইফ অ্যাজ আ সাইকিয়াট্রিস্ট’ বইটি— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক সৌমিত্র বসু বিভাগের কাউন্সেলিং সেল-এ যাতায়াতের সময় ওনার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকায় একদিন জেরক্স করে নেওয়ার অনুমতি দেন। যা আমায় অনেকটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল— কেন স্থানিকতার দিকে  (লোকাল-কালচারালটায়), নিজের ‘ফারাক’-টার দিকে নজর না আনলে একজন ভারতীয় মনোচিকিৎসক ঔপনিবেশিক মনোচিকিৎসার জগতে নিজের অবস্থানটাই দেখাতে পারতেন না। ওনার ‘ভুঁইফোঁড়ের মনোবিদ্যা চর্চা’-তে অমিত রঞ্জন বসু ‘কালচার কলোনিয়ালিজম এন্ড সাইকিয়াট্রি’ বইটির অজিতা চক্রবর্তীর একটি মন্তব্য আনেন— ‘নানান সংশোধন সত্ত্বেও মনোচিকিৎসার প্রধান ধারাটি দৃঢ় ভাবে প্রোথিত রয়েছে ক্রেপলিনের ঊনবিংশ শতকের বিভাগীকরণে… সেখানে একটি কেন্দ্রীয় বিন্যাস (central pattern)-এর মধ্যে পশ্চিমের অসুস্থতাগুলিকে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ধরা হয় এবং স্থানীয় বিন্যাস (local pattern)-গুলিকে তার সামান্য পরিবর্তিত রূপ (minor variations) বলে মেনে নেওয়া হয়।”

ডাক্তার অমিত রঞ্জন বসু এমন একজন মানুষ যিনি ঔপনিবেশিক ভারতে মনোচিকিৎসার জ্ঞান নির্মাণের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে বাংলায় ধারাবাহিক লিখেছেন তাঁদের একজনেরও নাম করতে হলে অমিত’দার নাম আসবে। উনিশ শতকের বাংলায় পাগলাগারদের সূচনা থেকে বিস্মৃত প্রায় গিরীন্দ্র শেখর বসুকে আবার পড়ার প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দেওয়া— এভাবেই রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে ক্লাস নিতে এসে অ্যাকাডেমিক চর্চার আপাত নিস্পৃহতাকে ধাক্কা মেরে পলিটিক্যাল সাইকোলজির জলে ছাত্রদের নামান। আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর সেই ক্লাসগুলোতে আমিও ছাত্র ছিলাম। দীর্ঘকাল মানসিক হাসপাতালের রুগি নিরঞ্জন ভৌমিকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারভিত্তিক— ‘জীবন দর্পণে দেখা সমাজ— একটি নিম্নবর্গীয় উপাখ্যান’— এখনও জীবনকাহিনি গবেষণায় সবার আগে ছাত্রদের পড়তে দিই— কীভাবে সাইকিয়াট্রির দেগে দেওয়া রোগী পরিচয়ের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পরতে পরতে খুলতে হয় ব্যক্তি মানুষটির পরিচয় নির্মাণের মরমি পথ— অমিতদা দেখিয়েছেন।

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে দুটো ডিপার্টমেন্ট। সাইকোলজি (আগে ‘পিওর সাইকোলজি’ নামে চিনত দেখতাম সবাই) আর অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি। আমাদের সময়টায় দেখা দু-বিভাগের দুজন অধ্যাপক বরাবর ছাত্রদের বেয়াড়া প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন, অধ্যাপক সোনালী দে আর অধ্যাপক জয়ন্তী বসু। মানসিক স্বাস্থ্যের সামাজিক পরিসরে আরভিং গফম্যান-এর ‘স্টিগমা থিয়োরি’ বা উদ্বাস্তু বাঙালির বিপন্নতার বোধে মনোসমীক্ষকের কান পাতা— নিজেদের গবেষণায় আভাস দিয়ে গেছেন মন চর্চার অন্যতর বহুবাচিকতার। তাদের উদ্যোগেই সেমিনার দিতে এসেছিলেন ডাক্তার অনুপ ধর (ডাক্তারি ছেড়ে পরে দর্শনের ডক্টরেট হয়ে যাওয়ায়— এই প্রতিস্পর্ধী যাপনের কারণে যিনি ছাত্র গড়ার ‘অনুপদা’ হয়ে ওঠেন অনেকের মতো আমারও)। আর ‘অন্যরকম’ সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার রঞ্জিতা বিশ্বাস। এই কথাগুলো মনে পড়ছে কারণ, আরও ছোটো বয়সের অসহিষ্ণুতায় ক্লাসে বসে যখন সোনালী’দিকে কুতর্কের প্রশ্ন করেছি, ‘সাইকোলজি পাশ করে কাউন্সেলিং আর সাইকোথেরাপি করতে গিয়ে কি সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কম্পাউন্ডার বনে যেতে হয়?’— সেই সময়টাতেই অনুপদা রঞ্জিতা’দি এই প্রশ্নগুলোকে নিলেন।ক্লিনিক-ক্লায়েন্ট-এর সেটিং-টায় জ্ঞানের ‘বিষয়ী’ আর জ্ঞানের ‘বিষয়’-এর সম্পর্কটা দেখালেন।  ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির চিকিৎসা-সুস্থতা-অসুস্থতার ধারণাটা DSM (রোগ লক্ষণ চিহ্নিতকরনের ডায়াগনস্টিক ম্যানুয়াল) দিয়ে যেভাবে নির্ধারিত তা সাইকিয়াট্রির পাগল-কে ‘সঠিক পথে নিয়ে আসার’ দেখা থেকে কোথাও আলাদা? ‘caught in the game of knowledge and power’ হয়ে প্রশ্নহীন আনুগত্যে থাকার শর্তেই সে সাইকিয়াট্রির দাপুটে কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দেখার ধরনটা কখনও কি নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে এ প্রশ্ন করতে শিখবে ‘… are we , … not made of the same clay as those we mould ?’— তাহলে জ্ঞানের কাঠামোর মধ্যে যে ক্ষমতার দাপট আছে এ আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা ‘জানতে’ চায় ‘অ’-সুস্থ শরীর/ মনকে (বা শরীর-মন কে)। এখান থেকেই প্রশ্ন উঠেছে ‘কে’ ‘কাকে’ ‘জানতে’ পারে? কে হল জ্ঞানের ‘বিষয়’ ও কেই বা ‘বিষয়ী’ বা জ্ঞাতা। ইতিহাস ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই আহরিত জ্ঞানকে ইতিহাস ও সংস্কৃতি ‘নিরপেক্ষ’, সর্বজনীন/ সর্বজন গ্রাহ্য হিসেবে দাবি করার মধ্যেই আসে ‘জ্ঞান-ক্ষমতা’-র দাপট। সাইকিয়াট্রি-র দার্শনিক ভিত্তিকে বুঝতে গেলে বুঝতে হবে পশ্চিমি শরীর বিজ্ঞান কীভাবে কাজে লাগিয়েছে তার ocularcentrism বা ‘দেখা’ সর্বস্ব জানাকে। (EEG, PET Scan-এর মতো) নানা ভাবে ফুঁড়ে ফেঁড়ে দেখে সে যা পায় তাকেই সে ‘সাধারণ ও নৈর্ব্যক্তিক’ জ্ঞান হিসেবে দাবি করে। যদিও ‘কে’ দেখছে (বা জানছে) ‘কাকে’ এ প্রশ্ন সে non question করে রাখে, মানে তুলতেই দেয় না। যে তাকে ‘জানছে’ (বা দেখছে) জ্ঞাত বা জ্ঞেয় তাকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেয়— এবং এটা  ঘটে ‘বৈজ্ঞানিকতা’-র নামে (সায়েন্স হল ‘পরম’— এই বিনা প্রশ্নে মান্যতা দেওয়ার নামই ‘বিজ্ঞানবাদ’ !)— গোলযোগ বেধেছিলো ‘মন’-এর বেলায়। শরীর মনের ‘দ্বিত্ব’ নিয়ে যত কথাই পক্ষে বিপক্ষে থাক না কেন, মনের কথা যে কান পেতে ‘শুনতে’ হয়— এর পক্ষে জোরালো সওয়াল আছে মন চর্চার সাইকিয়াট্রি ভিন্ন অন্য দিকগুলোয়। ব্রেনের নিউরো কেমিক্যালসের ভারসাম্য হীনতা, আচরণের উৎশৃঙ্খলতা, অবিন্যস্ততাকে যতই দৃষ্টিগ্রাহ্য ‘লক্ষণ’-এ বেঁধে ডায়াগনস্টিক মানদণ্ড বানানো হোক না কেন, উপনিবেশের উন্মাদিনীর ‘প্রলাপ’ শুনতে (জানতে) কথায়-‘ভাষা’য় আসতেই হবে। আর ভাষায় লেপটে থাকবেই পরিচয়— স্থান কাল পাত্রের। যাদবপুরের দর্শনের অধ্যাপক সিএসএসএস পাটুলি-র অনির্বান দাস দেখলাম ‘আলোচনা চক্র'(২০২০)-য় ওঁর ‘শরীর, রোগ, মেডিসিন: ক্লিনিকের জন্ম’ লেখাটিতে বলছেন— বার্থ অফ ক্লিনিক-এ ফুকো দেখিয়েছেন- ‘দেখা কাকে বলি? প্যান-অপ্টিকনের যে গেজের কথা ফুকো পরে লিখবেন, এখানে পুরোপুরি তেমনটা নয়। অন্-আভিধানিক এই ‘দেখা’ এক অন্য মেটাফর’। ‘এর একটা কাঠামোর মধ্যে ধরা আছে নানান সংবেদনা। দেখা/ শোনা/ ছোঁয়া-র ত্রয়ী এমন একটা অনুভূতির বিন্যাস তৈরি করে যেখানে অনধিগম্য ব্যাধিকে অনুসরণ করা হয় চিহ্ন ধরে, মাপা হয় গভীরতা, টেনে আনা হয় উপরিতলে, কার্যত প্রজেক্ট করা হয় শবদেহের ব্যবচ্ছিন্ন অঙ্গগুলোতে।… যে দৃষ্টি ছোঁয়, শোনে আর তার সঙ্গে মূলত বা অবশ্যম্ভাবী নয়, দেখে।’  ডাক্তারখানার জন্ম-তে মিশেল ফুকো এও দেখিয়েছেন শরীর কীভাবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘ব্যাধি মন্দিরম’ হয়ে উঠল। আধুনিক মেডিসিনে জ্বরের ধারণার সঙ্গে যুক্ত হল প্রদাহ (inflamation), জ্বর আর ঠাকুমার হাতের ছোঁয়ার ভাষায় ‘ছ্যাঁকছ্যাঁক’ বা ‘ধুম জ্বর’ থাকল না, নির্দিষ্ট শরীর স্থানিকতায়, অঙ্গ ও টিস্যু স্পেসে চিহ্নিত হলো— তার সাধারণীকরণও হল— ‘দেখা’ সর্বস্ব সাইকিয়াট্রিকে ঘিরে আপত্তির কথাওতো উঠেছিল এখান থেকেই। তার এই সর্বগ্রাসী চোখ দিয়ে সে সবসময় অবজেক্টিভ সিম্পটম খুঁজে চলে কেন, সাফারিং-এ থাকা মানুষের বলে চলা কথাকে সে ‘প্রলাপ’-এর ছাপ দেবে কেন? কেন সে লক্ষণ চিহ্নিতকরণ আর বর্গীকরণ দিয়ে ভেঙে ভাগ করে গোটা ‘মানুষ’-টির আত্ম পরিচয়কে— ভ্যালিড রিলায়েবল মানসিক অসুখের ‘ডায়াগনোসিস’-এ রিডিউস করবে শুধু দেখার যুক্তিতে; ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ’, ‘ম্যানিক ডিপ্রেসিভ’, ‘সিজোফ্রেনিক’?— সাইকিয়াট্রির অকুলোসেন্ট্রিজম নিয়েই উঠেছিল এত কথা। পাগলের কাছে তার নিজের ‘কথা’ তো যত্নে বুনে বলা ক্ষতের চিহ্ন, ভিতরের সাড়া, ভাষার গায়ে তো সে রাখে কত সময় আর সংস্কৃতির সংকেত-চিহ্ন। যে শুধু দেখে সে কি বুঝবে, যে শোনে— সংলাপে যায় সেই তো উন্মাদনাকে ছুঁতে পারার সম্ভাবনাটা বাঁচিয়ে রাখবে। টাইপে, ধরনে, বর্গীকরণের হ্রাসে কে নিজেকে, নিজের বিশিষ্টতা কে, নিজস্বতাকে বিষয়িতাকে হারাতে চায়?কেন সাইকিয়াট্রি তবে শোনার সংস্কৃতি-টার উপর দেখার দাপট হয়ে চেপে বসল— এই প্রশ্ন ক্রিটিকাল সাইকিয়াট্রির-ই ।

মনে পড়ছে, প্রায় ১৭ বছর আগে আলাপ হয়েছিল ডাক্তার কে এল নারায়ণন-এর সাথে।কলকাতায় একদম শুরুর দিকের অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি নিয়ে ওঁর ভাবনা, ক্লিনিক থেকে রাস্তায় নেমে এসে প্রথাগত অভিভাবক সুলভ শাসন (প্যাটার্নালিস্টিক কেয়ার) আর কেয়ার-এ আদর মমতা মিশিয়ে নেওয়ার মাঝামাঝি কোথাও তাঁর দাঁড়ানোর জায়গা খুঁজতে চাওয়া। বারুইপুর ‘অন্তরা গ্রাম’-এর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে সরে এসে ভবঘুরে রাস্তায় থাকা মানসিক অসুস্থ মানুষদের জন্য ‘ঈশ্বর সংকল্প’ সংগঠন তৈরির প্রাথমিক ভাবনা যখন ভাবছেন— হঠাৎ-ই চলে গেলেন ডাক্তার নারায়ণন। কলকাতায় আমাকে প্রথম কেউ বলেছিলেন ‘মানসিক রোগীর ট্রিটমেন্ট রিফিউজ করার অধিকার আছে এটা তুমি মানবে?— কী হবে তখন কেয়ার গিভার হিসেবে তোমার ভূমিকা?’

ডাক্তার নারায়ণন-এর ভাবনা নিয়েই ২০০৭থেকে এগিয়েছে পরবর্তীকালে ‘ঈশ্বর সংকল্প’। সর্বানী রায় লাবনী রায় এর উদ্যোগে। যারা ক্লিনিকের ‘বাইরে’ রয়ে গেলেন, আসবেন না ক্লিনিকে, তাদের ক্লিনিক-কে প্রত্যাখ্যান করার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েই যেন এ এক নতুন care বা যত্নের ভাষা নির্মাণ। চলতি ভাষায় মানসিক ভারসাম্য হারানো ‘ভবঘুরে’— তাদের উপর গায়ের জোরে নাগরিক সমাজের ‘কল্যাণকামিতা’ চাপিয়ে না-দিয়ে শিয়ালদা স্টেশন চত্বরের বাইরে বা হেস্টিংস ফ্লাইওভারের নীচে পথবাসী ‘পাগল’ মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে গিয়ে ‘কমিউনিটি মেন্টাল হেল্থ কেয়ার’-এর সংজ্ঞাকেই যেন বিস্তৃত করে চলেছে লাবনী’দি সর্বানী’দিদের সংকল্পের কাজ। এও কি সাইকিয়াট্রি-র মূল ধারার প্রতি অস্বীকার রাখার মধ্যে দিয়েই ক্রিটিক্যাল সাইকিয়াট্রি হয়ে ওঠা নয়?

সৌগত দা চলে গেছেন অসময়ে। অমল সোম ও নেই। নানা ভাবে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা আগের প্রজন্মের মানুষগুলো যেভাবে আমাদের একা করে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন— আশির দশকে অ্যাকাডেমিক পরিসরের বাইরেও অ্যান্টি সাইকিয়াট্রি-কে শুধু ডগমা/ স্লোগান হিসেবে না দেখে রোজকার একটু একটু করে বদলে ফেলার উদ্যোগগুলো সময়ের সাথে আজ কি অনেক ম্লান? 

রাজাবাজারে মাস্টার্স কোর্সে পড়তে ঢোকার পর পরই একদিন অধ্যাপক সৌগত বসু সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন মদনপুর ‘মানস’-এ। মানসিক হাসপাতালের পাঁচিল, নিয়মের গরাদ ভেঙে ‘পাগলের সেরে ওঠা’-য় পরিজন প্রতিবেশী আর প্রকৃতির নিবিড়তা-কে আশ্রয় করতে চাওয়ার স্বপ্নদর্শী মানুষটি অমল সোম— আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন সৌগতদা। কম্যুনিটি সাইকিয়াট্রি-র উদ্যোগের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়।

‘Prison, sanatoria, boarding schools, ship at sea and most importantly psychiatric hospitals’— অন্য আর-একটি দিকে সরকারি মানসিক হাসপাতালের মধ্যে institutional care-এ/ (curing) কীভাবে controll আর coercion হয়ে ওঠে পাভলভ, লুম্বিনী পার্ক, বহরমপুর মেন্টাল সঙ্গে নিয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে দেখিয়েছিলেন রত্নাবলি’দি। রত্নাবলি রায়। ‘অঞ্জলী’ সংগঠনটি গড়েছেন যিনি। শুধু হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষটিকে ‘মূল স্রোতে’ পুনর্বাসন বা বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়াটুকুই নয়, মানসিক রোগীর মানবাধিকার, মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ— রুক্ষ বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে লড়াই। মানসিক হাসপাতালের আউট ডোরে বসে যখন কানে আসে ডাক্তার দেখাতে আসা সঙ্গের বাড়ির লোক রোগীকে ধমকাচ্ছে ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমায় আবার ভর্তি করে দিয়ে যাব ‘, বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের এক দিদি যখন ওয়ার্ড থেকে রিহ্যাব প্রোগ্রামে এসে এক ফাঁকে ফিসফিস করে বলে ফেলেন, ‘রোজ একই খাবার দেয়, পেট ও ভরে না, কিন্তু বেশি কথা বললে বকবে, ভ্যালেন্ট (ভায়োলেন্ট) হয়ে গেছে বলে বেশি করে ওষুধ খাইয়ে দেবে বা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে’, বা ‘সব সময় ভয় দেখায় উপর থেকে ভিজিট হবে, মুখ খুলবি তো রাতে ছেলেদের সেলে ঢুকিয়ে দেব ছিঁড়ে খাবে’, পাভলভ হাসপাতালে কেউ বলেন ‘গোরুর মতো লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে স্নান করায়, সন্ধ্যে বেলা সাড়ে সাতটায় একবার খেতে দিয়ে ওষুধ দেয় তারপর আবার কাল দুপুরে’…। প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতা দেয় কে, ক্ষমতাকে শাসন আর হিংস্র হয়ে ওঠার ছাড়পত্র দেয় কে?— ব্যক্তি মানুষটির পরিচয় মুছে দিয়ে কে দাগিয়ে দেয় তাকে পেশেন্ট নম্বরে, কে পরায় ওই এক রঙা ঢোলা ইউনিফর্ম, কে নির্ধারণ করে দেয় গুটি কয় সাদা পোশাকের অ্যাপ্রনই শাসন করবে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো, ইসিটি খেয়ে খেয়ে দাঁত ভাঙা, চুল ছেঁটে দেওয়া, একরকম পোশাকের ‘পাগল’-গুলোকে? সারিয়ে তোলার যত্ন কখন প্রতিষ্ঠানের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে শাসন আর হিংস্রতা হয়ে ওঠে এ প্রশ্নই হাসপাতাল প্রশাসন, সরকার, আইন, রাষ্ট্রের কাছে রত্নাবলি’দিদের নিরন্তর তুলে চলা প্রশ্ন— সাইকিয়াট্রি-র দিকে তোলা অ্যান্টি সাইকিয়াট্রিরও প্রশ্ন।

বলা হয় , হাসপাতালে এসো, ক্লিনিকে এসো, চৌকাঠের বাইরে তোমার লিঙ্গ জাত-ধম্ম— যাবতীয় অপরাপর স্বপরিচয় খুলে রেখে এসো। অসুখ করেছে তাই এখানে ‘অ’-সুস্থের ‘পরম’ পরিচয়টিই একমাত্র তোমার। এমনই নৈর্ব্যক্তিক ধরে নিই যেন আমরা ক্লিনিকটাকে।

লকডাউন চলছিল দেশে, ইন্ডিয়া টিভিতে দেখেছিল পরিযায়ী ভারতবর্ষ রেললাইন ধরে হাজার মাইল হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কেউ ভালো ছিলো না।

ঘরে আটকে থাকার ক্লসট্রোফোবিয়া কাটাতে আমরা যারা ডালগোনা কফি বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করছিলাম, অথবা লাইন ধরে হেঁটে আসতে থাকায় মালগাড়িতে কাটা পড়ে যার রক্ত মাখা রুটির টুকরোর ছবি ছেপে ছিল সংবাদপত্র। —মন কারুরুই ভালো ছিল না, চাপে মাথা ঠিক রাখতে পারছিলাম না কেউ-ই। অথচ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কাঠামো, পরিষেবা এসবের মধ্যে সর্বজন হিতায় কল্যানকামিতার দিব্যি (শপথ) নেওয়া থাকে— কেউ তো কাউকে বারণ করছে না— যে তুমি ভালো থেকো না? শুধু কেমন করে স্বাস্থ্য রক্ষা করবে, সুস্থতা চাইবে এসবে খরচা পাতি কেমন করে সামলাবে এটুকুই মনে রাখতে হবে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক কে! তাহলে সামর্থ্য, Access-ই প্রাণে বাঁচতে চাওয়া পাব্লিক আর মনে বাঁচতে চাওয়া নাগরিককে এধারে ওধারে ভাগ করে রাখছে যেন। এখানেই একটা যেন ‘পিপল লাইক আস’ আছে, যার কাছে আছে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’-এর একটি সংজ্ঞা, খারাপ থাকা থেকে ওয়েল বিইয়িং-এ আসতে চাইলে কেমন করে চাইতে হবে, ভালো থাকতে চাইলে কী কী চাইতে হবে এসব যেন তাতে জুড়ে থাকে — তাতেই যেন অনুচ্চারে নির্ধারিত থাকে কে কারা এগুলো এভাবে চাইতে পারবে না। এখন ‘ক্যানো’-টা আর একেবারেই আনছি না এখানে। আনলেই ‘ক্লিনিক’-টাই গন্ডগোলে পড়বে। এখানে মানসিক স্বাস্থ্যের কাঠামোগত পরিসরে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের বা বলি দেশের লোকের প্যাট্র্ন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক। এ-প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের কল্যাণকামিতা বা endowment -এর প্রশ্ন থেকেই এসেছে access প্রশ্নও। কাজ খুইয়ে লকডাউনে হেঁটে  আসা মজুর মনের চিকিৎসকের ক্লিনিকে পৌঁছোবে না, দাঙ্গায় ঘর পুড়লে ঘরপোড়া মানুষ মনখারাপের ক্লিনিকে পৌঁছোবে না, লঙ্গরে-ত্রাণ শিবিরে পৌঁছোবে। নিটোল রাষ্ট্র-পরিকাঠমো-পরিষেবা-নাগরিক আর নির্ভরতার যে আন্তঃসম্পর্ক, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা যে ‘গভর্নমেন্টালিটি’— তার কি কোনও ‘বাহির’ আছে, ব্যতিক্রম?

একবার যেন মনে ঝলক দিয়ে গেল নাকাশিপাড়ার গলায় দড়িগ্রামের মোসলেম মুন্সীর মুখ। বেথুয়া বাজারে দাঁড়িয়ে চপ খাচ্ছিলেন। পাশে এসে দাঁড়িয়ে এক পাগল চপ চেয়ে হাত বাড়ালে দোকানি খানিকটা গরম তেল ছিটিয়ে দিয়েছিল ওই উন্মাদ মানুষটির দিকে। মোসলেমদা তাকে বুকে জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে চলে গেছিলেন। বিশ বাইশ বছর আগে। তারপর থেকে এমন মানুষের সংখ্যা বেড়ে বেড়ে ওনার বাড়িতে আজ পঁয়ষট্টি জন। ওই গ্রামে মোসলেম মুন্সীর বাড়ি খুঁজলে মুর্শিদাবাদি টানে লোকে দেখিয়ে দেয় ‘ওই যে মোসলেমের পাগলা গ্যারেজ’। মোদলেমদা চলতি ব্যবস্থাটার সঙ্গে গ্রহণে বর্জনে, আত্মসমর্পণ-প্রতিস্পর্ধায় আমার কাছে হ্যাঁ/ না-এর এক ‘অ্যাপোরিয়া’ (aporia)। একদিকে অনুরোধ করে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে ডাক্তার ধরে আনেন, ওষুধ কম্বল জোগাড় করেন চেয়ে চিন্তে যেখান থেকে পারেন, আবার আছে নিজের কিছু যত্ন নেওয়ার ধরন। পুকুরে নাইতে নিয়ে যাওয়া, ফুটবল খেলানো। মাথায় ওদের কি ‘ফুঁ পরিয়ে আনা তেল’ মালিশ করেন— কখনও জানতে চাইলে বলেননি। ওটা ওর আদরের ছোঁয়া, পাগলকে নিয়ন্ত্রণ আর ‘functional’ করে তোলার বায়োমেডিকাল শাসন নয়, care-এর আদর।

এখানে থামি, এবার অন্যদের প্রশ্ন শুনি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান