মিজানুর রহমান নাসিম
পূর্বকথা
‘বিহারি’ মূলত একটি হিন্দি শব্দ যা আক্ষরিক অর্থে ভারতের বিহার রাজ্যের অধিবাসীদের বোঝায়। বিহারিদের আদি শেকড় ভারতের বিহার রাজ্যে। বাংলাদেশে ‘বিহারি’ শব্দটি সাধারণত উর্দুভাষী অবাঙালিদের সম্পর্কে তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয় (ইলিয়াস ২০০৭: ১১)। এমনকি এই শব্দ কখনও কখনও ভুল অর্থে পাকিস্তানি জাতি-পরিচয়ের সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বিহারিরা কেবল বিহার থেকেই বাংলাদেশে আসেননি, ভারতের অন্যান্য রাজ্য, বিশেষ করে বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকেও এসেছেন। তবে অভিন্ন ভাবে তাঁদের সকলেরই ভাষা উর্দু; যার মাধ্যমে তাঁরা একটি স্বতন্ত্র ও সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। ধর্মীয় পরিচয়কে ছাপিয়ে ভিন্ন একটি আত্মপরিচয় ও আলাদা ভাষা-সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী হিসেবে বিহারিদের এদেশে বসতি স্থাপন এবং মূল জনগোষ্ঠী বাঙালিদের সাথে তাদের সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া ও খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
বাংলাদেশের বিহারিরা চার শতাধিক বছরের পুরোনো একটি ভিন্নভাষী অভিবাসী জনগোষ্ঠী। তবে এদেশে তাঁদের ব্যাপক আগমন ঘটেছিল ইংরেজ শাসনামল এবং ভারত ভাগের আগে-পরে। বর্তমানে তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের ভিন্নতার কারণে এমনকি ক্যাম্পবাসী জীবনযাপনের জন্য তাঁরা এখনও মূলধারার জনগোষ্ঠী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় ৫ লাখ বিহারির অধিকাংশজনের আবাস ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, রংপুর, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নির্ধারিত ক্যাম্পগুলোতে। ফলে তাঁদের সম্পর্কে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষ খুব বেশি জ্ঞাত নয়। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য, গবেষণা ও পরিসংখ্যান নেই। এই প্রবন্ধে উনিশশো ছেচল্লিশের বিহার দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে বিহারি জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ ও বাংলাদেশে অভিবাসী জীবনের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিবর্তন, তাঁদের জীবনযাপনের সংকটচিত্র, সম্ভাবনা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
দেশভাগ
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয় পাকিস্তান ও ভারত নামক দু-টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র্র জন্মের মধ্য দিয়ে। সাতচল্লিশের ১৬ আগস্ট বিলম্বিত বর্ষায় দেশভাগকেন্দ্রিক বাউন্ডারি কমিশনের সিদ্ধান্ত আসাম, বাংলা ও বার্মায় ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদ লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই সিদ্ধান্ত র্যাডক্লিফের অশুভ লাল রেখা সৃষ্ট এমন একটি বিভক্ত মানচিত্র হাজির করে যা একটি অনস্বীকার্য রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার জন্ম দেয় (Schendel 2004: 49)। এই বিভাজনরেখা যে জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তাদের কোনও মতামত নেওয়া হয়নি বা তাদেরকে অবগতও করা হয়নি। এর ফলাফল পরবর্তীতে উপমহাদেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাসমূহের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি আজও এই দেশভাগ শুধু একটি মৃত অতীত নয় বরং জীবন্তভাবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে উপস্থিত (Ferdous 2022: xiii)।
র্যাডক্লিফ বর্ডার লাইন মোতাবেক বাংলা দুই ভাগ হয়নি, ৪টি বড়ো ভৌগোলিক অংশে খণ্ডিতকরণের মধ্যে দিয়ে বাংলা প্রদেশের বিভক্তি ঘটেছিল। এর বৃহত্তম অংশটি ছিল কেন্দ্রভাগের ১৬টি জেলার সমন্বয়ে পূর্ব বাংলা যা পরে পূর্ব পাকিস্তান ও আরও পরে বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করে। বাকি ৩টি খণ্ড যা পশ্চিম বাংলা তথা ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয় এই পূর্ব বাংলা বা আজকের বাংলাদেশ সেগুলোর দ্বারা ঘিরে রাখা। পশ্চিম বাংলায় ১২টি জেলা অন্তর্ভুক্ত হয় (Schendel 2004: 43)। পুবের করদ রাজ্য ত্রিপুরা ১৯৪৯ সালে (Tripura District Gazetteers 1975: 118) এবং উত্তরের কোচবিহার (Tripura District Gazetteers 1975: 118) ১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। অবশ্য এই বিতর্কও আছে যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাভাগ ঘটেছিল তিন বার — ১৮৭৪, ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালে। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ ভারতে বৃহত্তর বঙ্গ প্রদেশের তিনটি প্রধান এলাকা: সুরমা উপত্যকার সিলেট ও কাছাড়, উত্তরবঙ্গের রংপুরের পার্শ্ববর্তী গোয়ালপাড়া বাংলা থেকে পৃথক হয়ে যায়। সিলেট ও কাছাড় ছিল ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, গোয়ালপাড়া ১৮২০ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল, এরপর ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত এটি ছিল উত্তরবাংলার সীমান্তবর্তী এক জেলা (হোসেন, মননরেখা ২০২২: ১৫১)।১ ১৮৭৪ সালে সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়াকে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের নতুন প্রশাসনিক বিন্যাসে ১৯০৫ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত আসাম ফের পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়, এরপর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি অঞ্চল। অবশ্য কোনও কোনও গবেষক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভক্তিকেও এই বিভাজন সূত্রে যুক্ত করতে চান (Ferdous 2022: xiii)। যাইহোক, ১৯৪৭ সালের ভারতের বিভক্তিই ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বড়ো ও বিপর্যয়কর ঘটনা এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সাতচল্লিশের আগের কয়েক বছরের দাঙ্গা-রক্তপাতকেই দেশভাগের অছিলা হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল।
ছেচল্লিশের বিহার দাঙ্গা
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার ১৯৪৫-৪৬ সময়কালে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘আগ্নেয়গিরির প্রান্ত (The Edge of a volcano) বলে আখ্যা দিয়েছেন (The Edge of a volcano)। ১৯৪৬ সালের মার্চে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি ও সংবিধান রচনার নীতি নির্ধারণের জন্য ‘ক্যাবিনেট মিশন’ নামক একটি প্রতিনিধি দলকে কেন্দ্রীয় ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেন থেকে ভারতে পাঠায়। মে মাসে ক্যাবিনেট মিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা প্রণয়ন করে। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ এই রূপরেখা নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয় এমনকি পরস্পর কঠোর বিরুদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করে। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে নেহরুর একটি হঠকারী বক্তব্যে২ লিগ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরিণতিতে মুসলিম লিগ ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয়। এর মধ্য দিয়েই ওইদিন কলকাতায় শুরু হয় বীভৎস ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। এক অকল্পনীয় হিংসার তাণ্ডব চলে টানা চারদিন ধরে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী এ দাঙ্গায় ৪ হাজার লোক নিহত এবং ১০ হাজার লোক আহত হয়, যদিও বেসরকারি মতে এ সংখ্যা বহুগুণ বেশি।৩ অক্টোবরে ওই ঘটনার জেরে নোয়াখালিতে হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিতভাবে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়; পালটা প্রতিশোধ হিসেবে বিহারে ব্যাপক মুসলমান নিধন শুরু হয়।৪ ৪ নভেম্বর বিহারের উপদ্রুত অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখে নেহরু মন্তব্য করেছিলেন, “What has occured is terrible… violence like this will not bring freedom for the country”। ১৯৪৬ সালের ৫ নভেম্বরের কলকাতার ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উক্ত মন্তব্যটি ছাপা হয়েছিল। কংগ্রেস নেতা ড. মাহমুদের হিসাব মতে, ৩.৫ লক্ষ মুসলিম পরিবারকে উদ্বাস্তু করে দিয়েছিল বিহারের দাঙ্গা (রসুল ২০১৯: ৭৩)। মূলত ১৯৪৬ সালে সংগঠিত ‘বিহার দাঙ্গা’র প্রেক্ষাপটে বিহারিদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রধান শিকার হয় বিহারের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলার পাটনা, মুঙ্গের, সরন ও ভাগলপুর এলাকা। উত্তর-পশ্চিম বিহারের সর্বত্রও ঘটে সমান বর্বরতা। একই দেশে একই সংস্কৃতির মানুষ শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিবেশী যাদের সাথে তারা বংশানুক্রমে বসবাস করে আসছিল, এই আক্রমণ ছিল তাদের দ্বারা সংগঠিত, আচমকা ও অকল্পনীয়। দাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া লক্ষ লক্ষ বিহারি সাতপুরুষের পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। বিহারের দাঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাসকে ভেঙেচুরে দেয়। পূর্বদেশ নিয়ে বিহারিদের নানা কুসংস্কার-অপছন্দ৫ থাকলেও ভবিষ্যৎ বসতি স্থাপনের জন্য তারা বাধ্য হয়ে পূর্বকেই বেছে নেয়।
বাংলাদেশে বিহারিদের অভিবাসন
ভারতের বিহার রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিহারিরা অনেক আগে থেকেই এদেশে বসবাস করে আসছেন। অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তাঁদের অনেকে চাকরি বা ব্যবসাসূত্রে এখানে বিভিন্ন সময়ে অভিবাসী হয়েছেন। তখনকার দিনে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, বম্বে ও সুরাট থেকে অনেকেই এসেছিলেন অধিকতর অর্থনৈতিক সুবিধালাভের আশায়। ব্রিটিশ শাসনামলে বিপুলসংখ্যক বিহারি সরকারি চাকুরিসূত্রেও বদলি হয়ে বাংলাদেশে আসেন। বিশেষ করে, ১৮৫৮ সালে পূর্ববাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের কাজ শুরু হলে বিহারি শ্রমিকদের রেলওয়ের কাজে এখানে আনা হয় (আহমেদ ২০২২: ৩০১)। দেশভাগের পরে মুসলিম চাকরিজীবীদের পশ্চিম পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানে বদলি ছিল নিজেদের পছন্দ সাপেক্ষে। তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও তাদের সংসারের উপার্জনক্ষম সদস্যদের সাথে এসে যোগ দেয়। অপরদিকে, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু চাকুরিজীবীরা চলে যায় ভারতে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির অব্যবহিত আগে-পরে সামাজিক পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যেতে থাকে। ভারত ভূখণ্ডে বসবাসরত মুসলমানরা পাকিস্তানে এবং পাকিস্তান ভূখণ্ডে বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে গমন করে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই ক্রস মাইগ্রেশন অব্যাহত থাকে (রহমান, মননরেখা ২০২২: ১২১)। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দুই দশকে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয় যাদের মধ্যে আনুমানিক ১০ লাখ ছিল উর্দুভাষী মুসলমান যারা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহণ করেন (Redclift 2013: 9)।৬ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম বাংলায় দেশান্তরিত হন ৪১ লাখ ১০ হাজার বাঙালি হিন্দু। তাদের দেশত্যাগের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল এই উদ্বাস্তুরা তা দ্রুত দখল করে (ইলিয়াস ২০০৭: ৫১)।
মুসলিম লিগ পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসী হতে ইচ্ছুক মুসলমান শরণার্থীদের জন্য কিছু যানবাহনের ব্যবস্থা করে এবং তাদেরকে নিশ্চয়তা দেয় শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ আগমনের। পাকিস্তান সরকার নবগঠিত ‘Ministry of Evacuation Organisation’ এর অধীনে পুনর্বাসন স্কিমের আওতায় শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করে। তাদেরকে সেনা নিরাপত্তায় ট্রেনে করে পূর্ব পাকিস্তানের রংপুর, দিনাজপুর, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে তৈরিকৃত ক্যাম্পে আনা হয়। ১৯৫১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট অনুসারে ৬৯৯,০৭৯ জন মোহাজের (ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমান অর্থে) পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করে। রিপোর্টে দেখানো হয়, এই সকল শরণার্থী একই সময়ে বা একই এলাকা থেকে আসেননি। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তর প্রদেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতিও ছিল ভিন্ন। উর্দু, হিন্দি, ভোজপুরি, বাংলা— শরণার্থী মধ্যে এসব নানা ভাষার লোক ছিল। পরবর্তীতে ভাষাগত ভিন্নতা ও ‘মুসলিম শরণার্থী’ বা ‘মোহাজের’ অভিধা বাদ দিয়ে পাকিস্তান প্রশাসন কর্তৃক তারা স্রেফ উর্দুভাষী বলে অভিহিত হতে থাকেন (Redclift 2013: 9)। অপরদিকে বাঙালিদের কাছে সবাই তুচ্ছার্থে বিহারি বলে আখ্যায়িত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাঁদের ‘মাউরা’৭ বলেও অভিহিত করা হত। ১৯৭৮ সালে জনৈক উর্দুভাষী রেল কর্মকর্তা নাসিম খান বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিদের জন্য এসপিজিআরসি (SPGRC- Srtanded Pakistani General Repatriation Committee) নামক একটি সংগঠন সৃষ্টি করার ফলে ক্যাম্পবাসী বিহারিদের ‘উর্দুভাষী’ পরিচয়ও খানিকটা বদলে যায়। নাসিম খান এদের ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ নামকরণ করে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের দাবি করেছিলেন (ইলিয়াস ২০০৭: ১২৭)। তাঁর সেই প্রচেষ্টা বিতর্কিত হয়েছিল ও আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল (এখনও সৈয়দপুরের বাঁশবাড়ি বিহারি ক্যাম্পে সাইনবোর্ডে ‘আটকেপড়া পাকিস্তানি’ শব্দটি দেখা যায়)।
পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয়গ্রহণকৃত বিহারি উদ্বাস্তুরা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, খুচরা দোকানদার, তবে বেশিরভাগই শ্রমজীবী। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য বিশেষ করে উচ্চস্তরের উর্দুভাষী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহায়তা এবং কারিগরি দক্ষতার কারণে তারা পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন মিল-কারখানায় কাজ পায়। ব্যবসায়ী ফার্ম ও ফ্যাক্টরিগুলোতে সুপারভাইজর ও প্রশাসক হিসেবে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় পেশাজীবী হিসেবে তারা প্রাধান্য বিস্তার করে। একইভাবে পুলিশ বাহিনীতে উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত উর্দুভাষী কনস্টেবলের সংখ্যা বেশি ছিল। বাঙালি হিন্দুদের ফেলে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান-পাট, কলকারখানা এবং ঘরবাড়ি স্থানীয় জনগণ ও অবাঙালি মুসলিম উদ্বাস্তু উভয়েই দখল করেন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত নগরায়ন ও অল্পবিস্তর শিল্পায়ন দক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্যে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে। বাঙালিদের এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার একটি অন্যতম কারণ হল কারিগরি দক্ষতার অভাব। ’৪৭ এর আগে পর্যন্ত এ অঞ্চল ছিল মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়া কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। উপরন্তু, পাকিস্তানি সরকারের পক্ষপাতমূলক অর্থনৈতিক কর্মসূচি পূর্ব অঞ্চলকে আরও পিছিয়ে দেয়।
এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা অবাঙালিরা পেত। যেমন বিনামূল্যে ট্রেন ভ্রমণ। ওইসব সুবিধা তারা গ্রহণ করতেন এই যুক্তিতে যে, তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে যেহেতু বঞ্চনার শিকার হয়েছিল সেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে এইসব সুবিধা পাওয়ার যোগ্য। অথচ তারা এই দাবি করে নি যে, পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে অবহেলিত বাঙালিদেরও সাংবিধানিকভাবে সমভাবে সুযোগ দেয়া উচিত। ফলে বাঙালিরা বিহারি উদ্বাস্তুদের এই সুবিধাগ্রহণকে ভালো চোখে দেখেনি (ইলিয়াস ২০০৭: ৬০)।
বিরাটসংখ্যক অভিবাসী জনসংখ্যার চাপে স্থানীয়রা অস্বস্তিতে ছিল। উর্দুভাষীরা ছিল আগন্তুক অথচ তারাই পাকিস্তান সরকারের অবাঙালি আমলা ও কর্মকর্তাদের সহায়তায় ক্রমান্বয়ে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণিতে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, দেশভাগের পরে ভারতে অভিবাসী হিন্দু মালিকদের সঙ্গে এদেশে অভিবাসী হয়ে আসা অনেক ধনী উর্দুভাষী তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিনিময় করে। এতে করে তুলনামূলকভাবে ধনী অভিবাসীগণ আর্থিক দিক থেকে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হননি, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন দেশে তাদের অবস্থান ও সামাজিক মর্যাদাও অপরিবর্তিত থেকেছে। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের নিশ্চয়তা সচ্ছল বিহারিদের মুসলিম লিগ নেতৃত্বকে গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে। তারা রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে আগমনের দিন থেকেই তারা সুবিধালাভের মনোবৃত্তি থেকে রাজনৈতিক বিভ্রান্তির পথে পা বাড়ায়। সব মিলিয়ে সময়ের সাথে সাথে বাঙালিদের সাথে সকল উর্দুভাষীদের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যমূলক কার্যকলাপ ছিল রাখঢাকহীন। সরকারের এই অবস্থান বাঙালিদেরকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তখন সুবিধাভোগী অভিবাসীরা মনযোগী থাকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের প্রতি। এমনকি তারা বাঙালিদের এইসব আন্দোলন-প্রতিবাদকে নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে। তারা নিশ্চিত থাকে যে, শাসক মুসলিম লিগই তাদের স্বার্থরক্ষা করবে, ফলে তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই উত্তম পন্থা। অন্যদিকে, বাঙালিরা স্বাভাবিকভাবেই অভিবাসীদেরকে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব হিসেবে ধরে নেয়। যতই দিন যেতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ২০ লক্ষ বাঙালির আর্থিক ও সামাজিক স্বার্থ ধারাবাহিকভাবে উপেক্ষিত হতে থাকে। পুরো পাকিস্তান আমলে অভিবাসী বিহারিরা বাঙালিদের আত্ম-অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে বুঝতে ব্যর্থ হয়, উপেক্ষা করে এবং প্রকাশ্যেই বাঙালিদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে। এই অবস্থানের ফলে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী এদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে নিতে ব্যর্থ হয়, নতুন ভূখণ্ডকে নিজের দেশ হিসেবে আপন করে নিতে অপারগ হয়ে পড়ে। পশ্চিম বাংলা ও আসাম থেকে আগত বাংলাভাষী উদ্বাস্তুরা শহর ও গ্রাম এলাকায় স্থানীয় জনগণের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেও উর্দুভাষী অভিবাসীগণ শুধু শহর এলাকায় বসতি স্থাপনের দরুণ মফস্সলের তৃণমূল পর্যায় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকে।
ভাষা যখন মূল সমস্যা
১৯৫২ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিণতি লাভ করে। এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকবর্গের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সংগঠিত প্রতিবাদ। বাংলার দাবিতে আন্দোলন কোনও আবেগপ্রসূত ব্যাপার ছিল না। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে বাংলাভাষী জনসংখ্যা ছিল ৫৬.৪০ শতাংশ। অপরপক্ষে উর্দুভাষী ছিল মাত্র ৩.৩৭ শতাংশ। এমনকি পাঞ্জাবি ভাষাও উর্দুভাষার চেয়ে এগিয়ে ছিল — শতকরা ২৮.৫৫ ভাগ। আর পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৯৮.১৬ শতাংশের মাতৃভাষা ছিল বাংলা এবং ০.৬৪ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু (Population Census of Pakistan 1961)। তা সত্ত্বেও উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ‘উর্দু হচ্ছে মুসলমান জাতির ভাষা’— এই প্রচারণা চালিয়ে। বিহারিরা ভাষাপ্রশ্নে স্বাভাবিকভাবেই উর্দুর পক্ষে অবস্থান নেয়। উর্দুকে নিয়ে তাদের মোহ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে উর্দুর স্থায়িত্ব খুবই স্বল্পকাল। বাংলাকে উপেক্ষা করা বা বাংলাভাষা শেখার ব্যাপারে উদাসীন থাকা ছিল তাদের একটি ঐতিহাসিক ভুল। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনই মুসলিম লিগের পতন ত্বরান্বিত করে। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লিগ ধরাশায়ী হয় এবং পূর্ব অঞ্চলে তাদের পায়ের মাটি সরে যেতে থাকে।
তবে বেশ কিছু সংগঠন ও উর্দু কবি-সাহিত্যিক বাংলার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। করাচিভিত্তিক ‘অল পাকিস্তান আঞ্জুমান তরিক্কায়ে উর্দু’র পূর্ব পাকিস্তান ইউনিট ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে করাচির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল উর্দুভাষী ছাত্ররা গড়ে তুলেছিল ‘আঞ্জুমানে আদাব’ যারা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। অপরদিকে, বাঙালি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলো অনুভব করতে শুরু করে যে, উর্দুভাষী ছাত্র ও তাদের সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান প্রয়োজন। উর্দুভাষী ছাত্র, যুবক, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক ও কবিরা আইয়ুববিরোধী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। মোহাজেরদের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি সংবলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রচারপত্র উর্দুভাষী বিহারিদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। সংখ্যায় স্বল্প হলেও উর্দুভাষীরা আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনে অবাঙালি যারা বাংলাভাষার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের মধ্যে ড. ইউসুফ হাসান, আদিব সোহেল, সালাউদ্দিন মোহাম্মদ, আরিফ হোসিয়ারপুরী, আখতার পায়ামী, নওশাদ নূরী, জয়নুল আবেদীন, আতাউর রহমান জামিল, আহমেদ ইলিয়াস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ভাষা আন্দোলেনে ড. ইউসুফ হাসান উর্দু জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন যার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ট বিহারি জনগোষ্ঠী ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বার্তা বুঝতে অক্ষম ছিলেন। অবশ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সচেতন বিহারিদের মোহভঙ্গ ঘটতে শুরু করে। তারা তাদের সন্তানদের বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দিতে আর পিছপা হননি।
বিচ্ছিন্ন বাসস্থান
পাকিস্তানে ঘন ঘন রাজনৈতিক সংকট-অস্থিরতা ছিল নিয়মিত দৃশ্য। এরই এক প্রেক্ষাপটে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর মার্শল ল জারি করে ক্ষমতায় আসীন হন। আইয়ুব খানকে তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অভিবাসীদের রাজনৈতিক সমর্থনলাভের পরামর্শ দেয়। অভিবাসীদের তখন ছিল আবাসন সংকট। আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রায় সকল শহরে স্যাটেলাইট উপশহর ও কলোনি তৈরি করে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় উর্দুভাষী অভিবাসীদের সিংহভাগ বরাদ্দ দেন। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর হাউজিং সেটেলমেন্ট, চট্টগ্রামের রৌফাবাদ, শেরশাহ, ফিরোজশাহ ও হালিশহর, খুলনার খালিশপুর স্যাটেলাইট শহর এবং যশোর নিউ স্যাটেলাইট শহরে এসব কলোনি নির্মাণ করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিহারিরা এসব সংরক্ষিত অঞ্চলে বসবাস করত। এসব কারণে বাঙালি ও বিহারি উভয়পক্ষের মধ্যে সামাজিক মেলামেশা ছিল না বললেই চলে। এই বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অন্যতম প্রতিবন্ধক। পাকিস্তানি শাসকরাও বিপুলসংখ্যক বিহারি জনগোষ্ঠীকে মূলধারার বাঙালি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতেই চেয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ
২৫ মার্চ ১৯৭১-এর গভীর রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক আক্রমণ ছিল ভয়াবহ। আচমকা নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ ছিল এমনই ব্যাপকতর যে, এমন দৃশ্য এ অঞ্চলের মানুষ আর দেখেনি। এই বর্বরতা ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী ছিল বিহারিদের বৃহৎ অংশ। তারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল অনিয়মিত মুজাহিদ বাহিনী এবং ইস্ট পাকিস্তান সিভিল এণ্ড আর্মড পুলিশ (ইপিক্যাপ) বাহিনীতে। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় তারা মারাত্মক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বিহারি জনগোষ্ঠীর ভূমিকা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ফলস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং অব্যবহিত পরে বিহারি জনগোষ্ঠীকে এর জন্যে খেসারত দিতে হয়। দেশের নানা প্রান্তে বসবাসকারী বিহারিরা বাঙালিদের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, সৈয়দপুর ও দিনাজপুরে নির্বিচারে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরীহ বিহারিকে। তাদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তারা তাদের বাড়িঘর ও বস্তি ছেড়ে পালাতে শুরু করে। পথেই অনেকে সশস্ত্র জনতার হাতে প্রাণ হারায়। অনেক বিহারি নেতা মায়ানমার ও ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে নেপাল হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সহযোগী বিহারিদেরও যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিস্থিতি ছিল এমন ভয়াবহ যে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পরে যুদ্ধের দিনগুলোতে সেনাবাহিনী সেইসব বিহারিকেই জীবিত পেল, প্রতিবেশী বাঙালি বন্ধুরা যাদের আশ্রয় দিয়েছিল।
ভুল পথে বার বার
৪৭ থেকে ৭১-এর আগ পর্যন্ত বিহারিরা বরাবরই এদেশে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ও মুসলিম লিগারদের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছিল; ব্যতিক্রম ছিল হাতে গোনা। মূলত শিক্ষিত, দূরদর্শী ব্যক্তিবর্গ ও প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকরাই বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভবিষ্যত পরিণতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ বিহারি, কর্মজীবী-পেশাজীবীদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি কোনও আকর্ষণ ছিল না বরং বিরোধিতা ছিল প্রচণ্ড। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামি লিগও তাদের দলে ভেড়াতে আগ্রহী ছিল না। অথচ তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের মোহাজেররা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিল। তারা বরাবর সেখানকার স্থানীয় আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছে। রাজনৈতিক চিন্তার দূরদর্শিতার অভাবে বাংলাদেশে বিহারিরা মূলধারায় প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয় এবং মুসলিম লিগের রাজনৈতিক বৃত্তেই আবদ্ধ থাকে। তারা পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সাময়িক সুবিধাগ্রহণের নীতি অনুসরণ করে। আহমেদ ইলিয়াসের মূল্যায়নে, বিহারিদের এই অজ্ঞতা ও অপরিণামদর্শিতা ছিল মারাত্মক যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে তাদের অবস্থানকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ করতে থাকে।
একথা স্মর্তব্য যে, বিহারিদের প্রগতিশীল অংশ সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসী যুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তারা অনেক বাঙালির জীবনরক্ষায়ও প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। এ সকল প্রগতিশীল উর্দুভাষী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নিজ সম্প্রদায়ের মানুষেরও চক্ষুশূল ছিলেন। তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছেন। তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। অন্যদিকে, কিছু বাঙালি রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় কিছু বিহারি পরিবারকে রক্ষা করেন।
পাকিস্তানের কূটকৌশল
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে বিহারিদের জন্য সম্মিলিত পাকিস্তানের ধারণাটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অতিমাত্রায় পাকিস্তান-মোহাচ্ছন্নতার কারণে তারা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পরিণতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও তারা স্বপ্ন দেখে যে, পাকিস্তান তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে বিগত পাঁচ দশকে শাসকদের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। তারা তাদের একসময়ের অনুসারী বিহারিদের গ্রহণ করতে কোনোভাবেই ইচ্ছুক ছিল না। তারা বিষ্ময়করভাবে বিহারিদের দায় বাংলাদেশের ওপরেই চাপিয়েছে। জুলফিকার আলি ভুট্টো থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন, তারা বিহারিদের মানবিক দিকগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে চলছে। বিহারিদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সিমলা চুক্তিই ছিল প্রথম দলিল। অথচ পাকিস্তান সিমলা চুক্তির মাধ্যমে ভারত থেকে ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দি সেনাদের ফিরিয়ে নিতেই বেশি আগ্রহী ছিল। অপরদিকে, বাংলাদেশ নিজস্ব পদ্ধতিতে এই মানবিক সমস্যাটির সমাধান করার কথা বিবেচনা করছিল।
১৯৭৩ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশের সম্মতিক্রমে ঐতিহাসিক দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই লক্ষে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির মাধ্যমে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুকদের নিবন্ধন শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধনকে ঐচ্ছিক হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ১ লক্ষ ১২ হাজার ৯১৫ জনকে শ্রেণিভিত্তিক প্রত্যাবাসনের অনুমতি দেয়। পরের দুই দশকে মাত্র সাড়ে ১৪ হাজার উর্দুভাষী পাকিস্তানে যেতে পেরেছিল, তাও আবার কতিপয় মুসলিম দেশের অর্থ সাহায্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে। এরপর পাকিস্তান সরকারের অনাগ্রহের প্রেক্ষিতে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জাতীয়তাবাদী নেতারাও প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
প্রত্যাবাসন বিষয়ে ভারত-পাকিস্তানের উপেক্ষানীতির প্রেক্ষিতে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসে যে, বাংলাদেশে পুনর্বাসনই বিপর্যস্ত বিহারি জনগোষ্ঠীর একমাত্র পথ। এই লক্ষে ১৯৮০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে একটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে ‘আল ফালাহ’ (কল্যাণ) আত্মপ্রকাশ করে। সংস্থাটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আহমেদ ইলিয়াস। এই সংগঠন ক্যাম্পে অবস্থানকারী উর্দুভাষীদের সামাজিক ও আর্থিক পুনর্বাসনে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা কনসার্ন ও এমসিসি বিহারি অধ্যুষিত এলাকাসমূহে সাক্ষরতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে আয়বর্ধনকারী কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। বিহারিদের মধ্যে শিক্ষিত ও যুব সমাজের প্রতিনিধিরাও নানা সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে যার উদ্দেশ্য হতাশা কাটিয়ে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন। তারা বাংলামাধ্যমে শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে। নিজেদের বাংলাদেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারা মনে করে, ‘আমাদের পিতামাতাদের কাজের জন্য আমরা কেন কষ্ট ভোগ করবো?’৮ (ইলিয়াস ২০০৭: ১২৯) তাদের এই বক্তব্য যৌক্তিক।
ক্যাম্পের মানবেতর জীবনযাপন
১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির তত্ত্বাবধানে অস্থায়ীভাবে বিহারি উদ্বাস্তু ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সারা দেশে ছোটো-বড়ো সব মিলিয়ে ১১৬টি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প যাতে প্রায় ১৭ হাজার অধিবাসী বাস করছে। পাকিস্তান খুব শীঘ্রই তার আটকে পড়া নাগরিকদের ফিরিয়ে নিবে এই আশায় ক্যাম্পগুলো বাঁশ, চটের বস্তা, প্লাস্টিক সিট, পুরোনো কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়। কিন্তু তাদের এই আবেগের বিপরীতে একটি ভিন্ন বাস্তবতা বিরাজ করছে। দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাকিস্তান কিছু সংখ্যক উর্দুভাষীকে পাকিস্তানে প্রত্যাবসনের সুযোগ দিলেও ১৯৯৩ সাল থেকে গত প্রায় ৩ দশক থেকে এই প্রক্রিয়া কার্যত মৃত। এই অবস্থায় ক্যাম্পে বসবাসকারী মানুষের গত পাঁচ দশকে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তারা ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থানেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বিহারিদের মধ্যে যারা অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল তাঁরা ক্যাম্পের বাইরেও সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা নগণ্য।
আগেই বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসী উর্দুভাষীরা প্রথমদিকে কৃষি, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা, ট্রান্সপোর্ট (রেলওয়ে) ও সরকারি চাকুরি ইত্যাদি পেশায় যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে কিছু এলিট উর্দুভাষী শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা, ট্রান্সপোর্ট ও সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র ক্যাম্পবাসীর উপার্জনের উৎস বদলে গেছে (Redclift 2013: 65)। তাঁরা এখন হস্তকুটির শিল্প, চুলকাটা ও মাংস বিক্রেতার কাজ করেন। আর যারা অদক্ষ; জমি-সম্পত্তি হারিয়ে নগরবাসী হয়েছেন তারা রিকসা চালানো, দিনমজুরি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করে জীবিকা অর্জন করছেন। তবে শহরের ধরন ও ক্যাম্পের স্থানিক অবস্থান অনুসারে জীবিকার ভিন্নতা রয়েছে। যেমন ব্যস্ততম বাজার এলাকা জেনেভা ক্যাম্পের ক্যাম্পবাসীরা চায়ের দোকান চালায় বা সেই দোকানে কাজ করে। আবার যুদ্ধের আগে থেকে মিরপুরে যে স্থানীয় বেনারসি শাড়ি তৈরির কারখানা চলছে তাতে ব্যবসা ও শ্রমিকের কাজে যুক্ত আছেন।
ক্যাম্পগুলোতে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। আহমেদ ইলিয়াস মাঠপর্যায়ের জরিপ উল্লেখ করে বলেছেন যে, জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ১৭ হাজার মানুষের জন্য ল্যাট্রিন মাত্র ২৪৭টি (এর ৭১টি ব্যবহারের অযোগ্য), পানির কল ৪০টি। অপুষ্টি, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া এখানে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ। এসটিডি/ এইচআইভি/ এইডস প্রভৃতি ঘাতকব্যাধি সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হলেও প্রতিরোধ স্বাস্থ্যসেবা অনুপস্থিত। ক্যাম্পের যুবকদের মধ্যে ড্রাগ ও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আহমেদ ইলিয়াস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন:
“It is said that three million Bengalis sacrificed their lives for the creation of Bangladesh in 1971. Similarly, it is said that millions of Urdu-speaking Indian Muslims were killed in 1946 and 1947 for the creation of Pakistan. The same Indian Muslims, who had migrated to the then East Pakistan to take shelter, were pushed back into so-called relief camps in 1972 to live a subhuman life for an uncertain period. For the last forty two years, this naked violation of human rights in the shape of Bihari camps could not draw the attention of the so-called champions of Human Rights. The very existence of Geneva camp in the heart of the capital Dhaka and so closed to the national assembly of an independent country is a glaring example of human rights violation.” (Ilias 2014: 119)
বাংলাদেশি নাগরিকত্ব
অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে চাকরিসূত্রে আসা এবং পরবর্তীতে দেশভাগ-দাঙ্গা কবলিত হয়ে ভারত থেকে এসে প্রাণভয়ে আশ্রয় নেওয়া অভিবাসী বিহারিদের কেন ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হিসেবে অভিহিত করা হবে— প্রখ্যাত আইনজীবী এমআই ফারুকী বিহারিদের বাংলাদেশি নাগরিকত্বের স্বীকৃতি বিষয়ে আদালতে আবেদনের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন (ইলিয়াস ২০০৭: ১৪১)। তিনি বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমান-হিন্দু-বিহারি সকলেই ছিল পাকিস্তানি নাগরিক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের নাগরিক। যদি বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না-ও দেয় সেক্ষেত্রে তারা ভারতীয় অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ হওয়াটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত না। অবশ্য বিহারিদের একটি অংশ নিজেদেরকে সেই পরিচয়ে অভিহিত করতেই অভ্যস্ত ছিল যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৭ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে দু-টি রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে মহামান্য আদালত রিট আবেদনকারীদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে রায় দেন। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কতিপয় মামলার রায় আছে (আবিদ খান বনাম বাংলাদেশ সরকার, মুখতার আহমেদ বনাম বাংলাদেশ সরকার এবং আব্দুল খালেক বনাম কোর্ট অব সেটেলমেন্ট এবং অন্যান্য) যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত থেকে দেশান্তরী হয়ে আসা অভিবাসী, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী অবাঙালি ব্যক্তিবর্গের বাংলাদেশের নাগরিক হতে বাধা নেই। বিষয়টি নিয়ে গত চার দশক থেকে আল ফালাহ কাজ করেছে। বর্তমানে প্রায় শতভাগ ক্যাম্পবাসী বিহারি বাংলাদেশের নাগরিক এবং তারা ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকারী। বিহারি জনগোষ্ঠীর তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার কারণে পূর্ণভাবে স্থানীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। তারা বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য বিহারিদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল এবং সেই একই পদ্ধতিতে তাদের আবেগ ও মনন, ধর্ম আর বিশ্বাসকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজে লাগিয়েছিল। এমনকি পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও তাদের বঞ্চনা থেমে থাকেনি। তারা অভিহিত ছিল ‘মোহাজের’ নামে এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন করার জন্য তাদের কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়নি বা তাদের কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না।
বিহারি তরুণরা বাংলাদেশের ব্যাপারে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও পরিপূর্ণ আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করেছেন। ২১শে মে ২০০৩ বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইল স্টার’ পত্রিকাকে মোহাম্মদ হাসান নামে একজন বলেছেন, ‘এখন বাংলাদেশি হবার অনুভূতি আমাদের মননের অংশ হয়ে গেছে।’ জনৈক কুলসুম বলেছেন, ‘এখন যদি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনও যুদ্ধ হয়, তাহলে আমি আমার নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশকে সমর্থন করব।’ (ইলিয়াস ২০০৭: ১৫৮-১৬২)। সুতরাং বর্তমান বাস্তবতায় এরা সকলেই এখন বাংলাদেশের নাগরিক — ‘বাংলাদেশি’।
শেষকথা
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বর্তমান বাংলাদেশে আনুমানিক ৫ লক্ষ বিহারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করছেন। অবাঙালিদের উন্নয়ন সংস্থা আল ফালাহ ক্যাম্পগুলোতে কয়েকটি সমীক্ষা ও গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছে যে, সমাজের মূলধারা থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে বিহারি জনগোষ্ঠী শিক্ষাসহ নানা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।৯ এসব কারণে তাদের সামগ্রিক জীবনধারায় দ্রুত অবক্ষয় লক্ষণীয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের বিহারি জনগোষ্ঠীকে মূলধারা সমাজে যুক্ত করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করা প্রয়োজন। তাদের জনশক্তিতে রূপান্তর করতে বাংলাদেশ সরকার এর যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সামগ্রিক মানব উন্নয়নের স্বার্থে বিভেদ নয়, ঐক্যই সমস্যা সমাধানের প্রকৃষ্ট পথ হতে পারে। দেশভাগের ক্ষত প্রসারিত হওয়া কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না।
টীকা :
১. পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ১৯৮৭ সালে প্রথম এ. কে. নিয়োগী এবং ১৯৯০ সালে সজল নাগ এবং ২০০৬ সালে জে. বি. ভট্টাচার্য্য লিখেছেন যে, বাংলার প্রথম বিভক্তি হয়েছিল ১৮৭৪ সালে যার ফলস্বরূপ পূর্ববঙ্গের এই তিনটি জেলা আসামে চলে যায়। (Nag 1990: 165-210), (Neogy 1987: 120-21), (Bhattacharjee 2005-06: 1022-1029).
২. The Congress had agreed only to participate in the Constituent Assembly and had regarded itself free to change or modify the Cabinet Mission plan as it thought best. (Azad 1988: 164-65)
৩. Secret Report, 2nd Half, August 1946, GFR, L/P &J/5/153, 90-91, হারুন-অর-রশিদ, ‘বঙ্গীয় মন্ত্রীসভা’, “বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১”, প্রথম খণ্ডে উদ্ধৃত।
৪. মুসলিম লিগ দাবি করেছিল, বিহার দাঙ্গায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কংগ্রেস ওই সংখ্যাকে কমিয়ে দুই হাজার দেখায়। সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, ওই দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা ছিল অন্তত দশ হাজার। সুমিত সরকার তাঁর বইতে লিখেছেন, “The Bihar Riots in the wake of observence of ‘Noakhaly Day’ on 25th October revealed yet another pattern, more difficult to explain: a mass upsurge of Hindu peasants against Muslims, resulting in a massacare far more terrible really than Noakhali, with at least 7,000 deaths…” (Sarker 1983: 434)
৫. বিহারিরা হিন্দিতে এই প্রবাদটি বলত যে, ‘সাব দেশ যাইও পুরব মাত যাইও’ (সব দেশেই যাবে তবে পূর্বে যাবে না), (ইলিয়াস ২০০৭: ৪৮)
৬. In May 1964, the Pakistan Observer newspaper reported that 150,000 Muslim refugees had officially registered with the authorities in East Pakistan. (Sur 2021: 62).
৭. ‘মাউরা’ শব্দটি মগধ (বিহার) বা মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-২৯৭) নাম থেকে এসেছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে ক্যাম্পবাসী বিহারিদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই শব্দটি তাচ্ছিল্য অর্থে ব্যবহার করা হয়। (ইলিয়াস ২০০৭: ১৪০)।
৮. ২০২০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম. আই ফারুকি ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য বাংলাদেশ অবজারভার’-এ এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন।
৯. Redclift stated that, ‘Divisions are not just of origin, culture, geograohy or language, but also of civil status, and one symptom of this has been increasing socio-economic disparity. Fundamental inequality of rights has reinforced previously existing stratification, enhancing divisions along socio-economic lines’, (Redclift 2013:72)
তথ্যসূত্র :
বাংলা
১. আহমেদ, শাকিল, ‘উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ: দেশভাগের প্রভাব’, “উত্তরবঙ্গে দেশভাগ”, রংপুর: মননরেখা।
২. ইলিয়াস, আহমেদ ২০০৭. ‘বিহারি: বাংলাদেশে ভারতীয় অভিবাসী, একটি বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ’, সৈয়দপুর: শামসুল হক ফাউন্ডেশন।
৩. হারুন-অর-রশিদ, ‘বঙ্গীয় মন্ত্রীসভা’, “বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১”, প্রথম খণ্ড, (সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত), ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি ১৯৯৩।
৪. রসুল, এনায়েত ২০১৯, ‘ফিরে দেখা ইতিহাস, ছেচল্লিশের দাঙ্গা’, ঢাকা: আকাশ।
৫. রহমান, ড. মো. মাহবুবুর ২০২২, ‘১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ: মালদহ-মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী জেলার সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং তার প্রভাব’, “উত্তরবঙ্গে দেশভাগ”, রংপুর: মননরেখা।
৬. হোসেন, আশফাক ২০২২ ‘দেশভাগ এক (১৮৭৪), দুই (১৯০৫), তিন (১৯৪৭) এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব বঙ্গের সীমানা বদলের ইতিহাস’, “উত্তরবঙ্গে দেশভাগ”, রংপুর: মননরেখা।
ইংরেজি
1. Azad, Abul Kalam 1988. “India Wins Freedom”, Complete Edition, (India: Orient Longman), 1988, pp. 164-65
2. Bhattacharjee, J. B. 2005-06. “The First Partition of Bengal”, Proceedings of the Indian History Congress.
3. Ferdous, Sayed 2022. “Partition as Border Making, East Bengal, East Pakistan and Bangladesh”, London and New York: Routhledge.
4. Ilias, Ahmed 2014. “The World I saw, Memoir of a Commoner”, Dhaka: Bangla-Urdu Sahitya Foundation.
5. Neogy, A.K. 1987. “Partitions of Bengal”, Calcutta: A Mukherjee & Co. Ltd.,.
6. Nag, Sajal 1990. “Roots of Ethnic Conflict: Nationality Question in India”, New Delhi: Manoher Publishers.
7. Redclift, Victoria 2013. “Statelessness and Citizenship”, London and New York: Routhledge.
8. Sarker, Sumit 1983. “Modern India 1885-1947”, India: Macmillan India Limited.
9. Schendel, Willem Van 2004. “The Bengal Bordreland, Beyond State and Nation in South Asia”, London: Anthem Press.
10. Sur, Malini 2021. “Jungle Passports”, University of Philadelphia: PENN.
অন্যান্য প্রকাশনী
1. Tripura District Gazetteers 1975: Department of Education, Agartola, Central Secretariat Library, India.
2. West Bengal District Gazetteers 1977: Cooch Bihar, Author: Majumder, Durgadas, Central Secretariat Library, India.