আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি

আবুল হাশিম

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব

১৯শে জুলাই (১৯৪৬) বম্বেতে জিন্নাহ সাহেব নিখিল ভারত মুসলিম লিগের কাউন্সিলারদের এক সভা আহ্বান করেন। কাউন্সিলে যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় সেটি ইতিহাসে মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব নামে পরিচিত। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, পাকিস্তান অর্জনের জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করতে হবে। প্রস্তাবে লিগ সভাপতি জিন্নাহকে সংগ্রাম কমিটি গঠনের কর্তৃত্ব প্রদান করে। কাউন্সিল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব গ্রহণের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের উপর ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জন করলেন, তাঁরা জিন্নাহর প্রতি তাঁদের নিঃস্বার্থ সমর্থনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। খেতাব বর্জনের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হওয়ার পর সভায় বক্তৃতা প্রদানের জন্য জিন্নাহ আমাকে আহ্বান করলেন। আমি বললাম, “জনাব সভাপতি, আপনার প্রতি আমার নিঃস্বার্থ সমর্থন দানে আমি অপারগ। আপনার প্রতি আমার ঐকান্তিক সমর্থন থাকবে যদি প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিচালিত হয় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে — ভারতের কোনও দল বা জনগণের বিরুদ্ধে নয়। আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের খেতাব বর্জন লক্ষ করছিলাম। আমার যতদূর জানা আছে ব্রিটিশ সরকার তাদের একান্ত নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কাউকে উচ্চ খেতাব দান করে না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটিশদের তৈরি এইসব নেতৃবৃন্দ কি রাতারাতি তাঁদের স্বভাব পরিবর্তন করতে পারবেন?” জিন্নাহ মুচকি হেসে আমাকে বললেন, “মৌলানা সাহেব, এইসব ব্যক্তিদের প্রতি আপনি এতটা কঠোর হবেন না।”

আমি যখন আমার চেয়ারে উপবেশন করলাম তখন জিন্নাহর সেক্রেটারি আমার নিকট এসে অনুরোধ করলেন, বিকেলে আমি যেন মালাবার হিলসের বাসভবনে জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি বললেন, আমায় সহায়তা করার জন্যে সঙ্গে আমি একজনকে নিয়ে যেতে পারি। আমি ময়মনসিংহের শামসুল হককে আমার সঙ্গে নিয়ে সময় মতো জিন্নাহর বাসভবনে উপস্থিত হয়েছিলাম। তাঁর সেক্রেটারি আমাদের অভ্যর্থনা করে লাইব্রেরি কক্ষে উপবেশন করালেন। একের পরে এক সুহরাওয়ার্দি, মৌলানা আকরাম খান, হাসান ইস্পাহানী, হামিদুল হক চৌধুরী এবং ফরিদপুরের মোহন মিয়া এসে উপস্থিত হলেন। এরপর আরব সাগরের সম্মুখভাগের বারান্দায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। জিন্নাহ এসে তাঁর চেয়ারে উপবেশন করলেন। কি ব্যাপার হতে পারে ভেবে আমি আশ্চর্য হলাম।

সুহরাওয়ার্দি, শামসুল হক এবং আমি জিন্নাহর ডানপাশে বসেছিলাম, অন্যান্যরা তাঁর বামপাশে ছিলেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সভাপতি মৌলানা আকরাম খান আমার বিরুদ্ধে বত্রিশ পৃষ্ঠার এক টাইপ করা অভিযোগের আবেদনপত্র জিন্নাহর নিকট পেশ করলেন। জিন্নাহ মৌলানা আকরাম খানকে জিজ্ঞেস করলেন, কাগজগুলো কীসের। মৌলানা বললেন, “এগুলো আবুল হাশিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের আবেদনপত্র।” জিন্নাহ মুচকি হেসে বললেন, “আমি যদি এর বিচার করতে চাই তাহলে আমাকে সমস্ত ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট (Indian evidence Act) পেনাল কোড (Penal code) এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (Criminal Procedure code)-এর যাবতীয় ব্যবস্থাদি পড়তে হবে। যদি আমি আবুল হাশিমকে দোষী সাব্যস্ত করি তাহলে আমি কি করতে পারি? আমি তাঁকে এক সপ্তাহের জন্য সাসপেণ্ড করতে পারি, এর বেশি কিছু নয়। মৌলানা সাহেব, আপনি ভেবে দেখেছেন কি বাংলায় এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? জনগণের কাছে ফিরে যান সেটাই হল পুনর্বিচারের শ্রেষ্ঠ আদালত।” জিন্নাহ কাগজগুলো মৌলানা সাহেবের দিকে ঠেলে দিলেন।

ফরিদপুরের মোহন মিয়া বললেন, “স্যার আবুল হাশিম আমাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেন।” উত্তরে আমি বললাম, “মোহন মিয়া আমার বিপক্ষ দলের অন্যতম নেতা। তাঁর প্রতি আমাদের অবিচারের একটি উদাহরণ আমি আপনাকে দিচ্ছি। পার্লামেন্টারি বোর্ডে আমরা সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলাম। তিনি যে ভোট কেন্দ্র থেকে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন সেখানকার জন্য তাঁকে আমরা মনোনীতও করেছিলাম। এই ভদ্রলোক ফরিদপুর জেলা মুসলিম লিগের সভাপতি, ফরিদপুর জেলা বোর্ড এবং স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান। এতদ্‌সত্ত্বেও বাংলায় মুসলিম লিগ যখন অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল তখন সাধারণ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁর পরাজয়ের পর আমরা তাঁকে বিধানসভার জন্য মনোনীত করি এবং বর্তমানে তিনি বিধানসভার সদস্য।”

জিন্নাহ মুচকি হাসলেন। চা-চক্র শেষে সভা ভঙ্গ হল। জিন্নাহ কয়েক মিনিট থাকার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন এবং আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, “আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। এখন আপনি জনগণের নিকট গিয়ে তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করুন। বাংলার নিজস্ব একটি সংস্কৃতি রয়েছে।”

প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বিক্ষোভ প্রদর্শনের দিন ধার্য করা হয় ১৬ই আগস্ট (১৯৪৬)। এর আগে সুহরাওয়ার্দি আন্দামান থেকে ঢাকা জেলে প্রত্যাগত (repatriated) আন্দামান বন্দিদের মুক্তির প্রশ্নটি মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি পার্টির নিকট উত্থাপন করলে পার্লামেন্টারি পার্টি সর্বসম্মতিক্রমে বন্দিদের মুক্তির স্বপক্ষে মত পোষণ করেন। সুহরাওয়ার্দি ১৯৪৬ সালের ১৪ই আগস্ট ঢাকার বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত দাঙ্গার পরই সকল বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হল। মুক্তির পর তাঁরা কলকাতায় এসে আমার বাসভবন ৩৭নং রিপন স্ট্রিটে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এই বাসভবনে আমি মুসলিম লিগ অফিস থেকে মিল্লাতের প্রেস সহ ১৯৪৬ সালের জুন মাসে উঠে আসি। মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের আমি দুপুরের আহারে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সেদিনই আমি প্রথম বাংলার বিদ্রোহী নেতা মেসার্স অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, লোকনাথ বল, আনন্দ গুপ্ত এবং অন্যান্যদের দেখলাম। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড আবদুল্লাহ্‌ রসুল আমার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন।

১৯৪৬ সালের ১১ই আগস্ট কলকাতা জেলা মুসলিম লিগের সম্পাদক ওসমান ১৬ই আগস্টের কর্মসূচি ঘোষণা করে এক প্রেস বিবৃতি প্রদান করলেন। কলকাতা মুসলিম লিগের পরিচালনায় ধারাবাহিকভাবে কলকাতা, হাওড়া, মেটিয়াবুরুজ এবং চব্বিশ পরগনার কারখানা অঞ্চলে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করা হয়। পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও তার বিভাগ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, মাতৃসদন ইত্যাদির মতো অত্যাবশ্যকীয় জরুরি সার্ভিস ছাড়া সকল বেসামরিক, বাণিজ্য ও শিল্পকেন্দ্রে হরতাল এবং সাধারণ ধর্মঘট সম্পূর্ণভাবে প্রতিপালিত হয়েছিল। প্রতিটি কেন্দ্র থেকে মিছিল ব্যাণ্ড সহ বেলা তিন ঘটিকায় অক্টারলোনি মনুমেন্টে এসে মিলিত হল। সুহরাওয়ার্দি সভায় সভাপতিত্ব করলেন। সভায় যোগদানের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খ্রিস্টান, তপশিলি সম্প্রদায়, আদিবাসী উপজাতীয় সম্প্রদায়সমূহের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জুম্মার নামাজের পর প্রত্যেক মসজিদে বিশেষ মোনাজাত হয়েছিল।

১৩ই আগস্ট এক প্রেস বিবৃতিতে আমি উল্লেখ করলাম যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য মুসলিম লিগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করবে এবং একথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমাদের লক্ষ্যবস্তু কেবলমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে পড়ে বিশেষ এক মহলের উসকানী সত্ত্বেও যাতে জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে হেয় প্রতিপন্ন না করে সুশৃঙ্খলভাবে পালন করা হয়, সে বিষয়ে আমি প্রত্যেক শ্রেণির লোকদের নিকট আবেদন করেছিলাম। কেন না ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যই ছিল দেশে যে কোনও জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থানকে দমন করা।

১৬ই আগস্টের অভূতপূর্ব সংঘর্ষ যা সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলেছিল সে বিষয়ে মুসলিম লিগের কোনোই জ্ঞান, সন্দেহ বা ধারণা ছিল না। সংঘর্ষ চলা অবস্থায় অক্টারলোনি মনুমেন্টের পাদদেশে আমরা সভার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মুসলমানরা নিরস্ত্র এবং পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য অপ্রস্তুত ছিল। মানুষ মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পরিস্থিতি কখনও মিথ্যা বলে না। কলকাতায় এ উপলক্ষ্যে প্রত্যাশিত বিরাট জনসমাবেশ দেখাবার জন্য বর্ধমান থেকে আমি আমার দুই পুত্র বদরুদ্দীন মহম্মদ উমর (১৫) এবং শাহাবুদ্দীন মহম্মদ আলি (৮)-কে নিয়ে এসেছিলাম। আমি যেমন আমার দুই পুত্রকে ময়দানে নিয়ে এসেছিলাম তেমনি ফরিদপুরের লাল মিয়াও তাঁর ৬/৭ বছরের নাতিকে ময়দানে নিয়ে এসেছিলেন। বিপদের সম্ভাবনা আছে এমন জানা থাকলে আমরা আমাদের পুত্র এবং নাতিদের ময়দানে নিয়ে আসতাম না।

দাঙ্গা

জনসমাবেশে লাহোরের রাজা গজনফর আলি খান ও খাজা নাজিমুদ্দীন বক্তৃতা দিয়েছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর বক্তৃতায় বললেন, “আমাদের সংগ্রাম কংগ্রেস এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে।” আমি তাকে মাইক্রোফোন থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে ইঙ্গিত করে দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, “আমাদের সংগ্রাম ভারতের কোনও জনসাধারণের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের সংগ্রাম ফোর্ট উইলিয়ামের বিরুদ্ধে।” মঞ্চে আমরা যখন উপবিষ্ট ছিলাম তখন চতুর্দিক থেকে খবর পৌঁছতে লাগল যে কলকাতার সর্বত্র ভীষণ দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। লাল মিয়া এবং আমি আমাদের ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ময়দান থেকে পায়ে হেঁটে রিপন স্ট্রিটে পৌঁছলাম।

সুহরাওয়ার্দি ১৬ই আগস্ট সাধারণ ছুটির দিন ঘোষণা করে মারাত্মক ভুল করেছিলেন। শান্তিপ্রিয় হিন্দু ও মুসলমানরা এ দাঙ্গায় কোনোভাবে জড়িত ছিলেন না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বাহিনীর দ্বারা যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল সেটা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পর ভয়াবহ যেসব ঘটনা ঘটেছিল তার দ্বারা পরিপূর্ণভাবে সমর্থিত হয়। দাঙ্গা পূর্ণদ্যোমে ১৬ই থেকে ২০শে আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী চলেছিল। শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পুলিশকে সহায়তা দানের জন্য সেনাবাহিনী তলব করতে প্রদেশের গভর্নরকে সুহরাওয়ার্দি অনুরোধ জানালেন কিন্তু সৈন্য মোতায়েন করা হল না। পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কলকাতার পুলিশ বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালি ছিল না। কলকাতা পুলিশের কমিশনার ছিলেন ইংরেজ। দাঙ্গা চলাকালে সুহরাওয়ার্দি তাঁর প্রধান কর্মকেন্দ্র পরিবর্তন করে লালবাজার পুলিশের প্রধান কর্মকেন্দ্র কনট্রোল রুমে দিবারাত্রি অবস্থান শুরু করলেন। তিনি ট্রাক বোঝাই করে সশস্ত্র পুলিশ কনস্টেবল পাঠালেন কিন্তু তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারল না। সুহরাওয়ার্দির অন্য আর কিছু করার ছিল না এবং মহানগরী পাঁচ দিনব্যাপী অরক্ষিত অবস্থায় থাকল।

সুহরাওয়ার্দির অনুরোধে পাঞ্জাব সরকার একটি বড়ো সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন এবং তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। সুহরাওয়ার্দি তাঁর জীবন বিপন্ন করে দিবারাত্রি তাঁর গাড়িতে চড়ে মহানগরীর চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করেছিলেন, বিরাট হত্যাকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল মধ্য কলকাতা।

আমার জনৈক বন্ধু জানালেন, যে তিনি মৌলানা আজাদ সুবহানীকে বউবাজার স্ট্রিটে হেঁটে যেতে দেখেছেন। আমি তৎক্ষণাৎ মৌলানাকে খুঁজে বের করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক ও সশস্ত্র পুলিশ পাঠালাম। ভাগ্যক্রমে তারা মৌলানাকে বউবাজার স্ট্রিটে দেখতে পেয়ে আমার বাসভবনে নিয়ে এলেন। মধ্য কলকাতায় স্নাতকোত্তর মহিলা ছাত্রীদের হোস্টেল, মন্নুজান মহিলা হোস্টেল বিবেকানন্দ রোডে অবস্থিত ছিল। হোস্টেলে হামলা হয়েছিল, মহিলা ছাত্রীদের জীবন এবং সম্ভ্রমের প্রতি হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। দাঙ্গাবাজরা হোস্টেল থেকে মুসলিম লিগের পতাকা টেনে নামাতে চাইলে ছাত্রীরা সাহসের সঙ্গে বাধা প্রধান করেছিল। আমি সে খবর পেয়ে হোস্টেলের বসবাসরতা ছাত্রীদের উদ্ধার করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে একটি ট্রাকে স্বেচ্ছাসেবক ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠালাম। আমার বাসভবন ৩৭ নং রিপন স্ট্রিটে তাদের নিয়ে আসা হল। প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীদের পিতামাতা ও অভিভাবকদের জানিয়ে দিলাম যে তাঁরা আমার বাসভবনে নিরাপদে রয়েছেন। দাঙ্গা যখন প্রশমিত হল সুহরাওয়ার্দি কিছু সংখ্যক ছাত্রীদের পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য তহবিলের ব্যবস্থা করলেন।

কলকাতা হত্যাকাণ্ডের দুঃখজনক সংবাদ ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল এবং এই হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নোয়াখালি ও কুমিল্লা জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। খিদিরপুর পোর্টের ডক কর্মীদের অধিকাংশই ছিল নোয়াখালি ও কুমিল্লার অধিবাসী। কলকাতার দাঙ্গায় তারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কলকাতায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান।

২১শে আগস্ট (১৯৪৬) সুহরাওয়ার্দি তাঁর বাসভবন ৪০ নং থিয়েটার রোডে সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দের এক সভা আহ্বান করলেন। উপস্থিত নেতৃবন্দের মধ্যে ছিলেন সুহরাওয়ার্দি, শরৎচন্দ্র বোস, খাজা নাজিমুদ্দীন, কিরণ শংকর রায়, এম. এ. ইস্পাহানী, কে. সি. গুপ্ত, এস. এম. ওসমান, শামসুদ্দীন আহমেদ, হামিদুল হক চৌধুরী, খাজা নূরুদ্দীন এবং আমি। সুদীর্ঘ আলোচনার পর স্থির হল যে সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ অগ্রভাগে থেকে এক মিছিল সংগঠিত করে জনসাধারণকে অবহিত করবেন যে শান্তি আনয়নে সচেষ্ট হয়ে সব দল একত্রিত হয়েছেন। এভাবে তারা জনসাধারণকে শান্ত থাকার এবং মহানগরীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করার জন্য জনসাধারণকে উদ্যোগী করবেন। সুহরাওয়ার্দির বাসভবন থেকে লরি যোগে বিভিন্ন দলের পতাকা বহন করে হিন্দু, মুসলমান, তপশিলি সম্প্রদায় এবং কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ সমভিব্যাহারে মিছিল বের করা হল। এই মিছিল পার্ক সার্কাস, এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, এলগিন রোড, ভবানীপুর, বালিগঞ্জ, কালিঘাট, আলিপুর, খিদিরপুর এবং উত্তর কলকাতার মধ্য দিয়ে ঘোরায় এবং সব দলের নেতৃবৃন্দের অংশ গ্রহণের ফলে প্রত্যাশিত ফল লাভ হয়েছিল।

১৯৪৬ সালের ২৪শে আগস্ট ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেল কলকাতা সফর করলেন। তিনি সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকা এবং ত্রাণ কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করে ২৬শে আগস্ট তিনি দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। খাজা নাজিমুদ্দীন, সুহরাওয়ার্দি, মিজা আহমেদ ইস্পাহানী, কলকাতা মুসলিম লিগের সেক্রেটারি এস. এম. ওসমান, হামিদুল হক চৌধুরী, শেঠ আদমজী, হাজী দাউদ এবং আমি ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দীন বললেন, “মহামান্য বড়লাট বাহাদুর (your Excellency) আমার উচিত স্পষ্টভাবে কথা বলা। ইনি হলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম। ইনি আপনাদের ভারত ত্যাগ করে চলে যাওয়ার আগ্রহে বিশ্বাসী নন।” ফল দাঁড়াল এই যে, ভাইসরয় দাঙ্গার ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। আলোচনা করতে গিয়ে আমি বললাম, “কলকাতার প্রতিটি হত্যা, অগ্নিকাণ্ড এবং ধর্ষণের জন্য মহামান্য বড়লাট বাহাদুর দায়ী। ভাইসরয় জানতে চাইলেন কেন তাঁকে অপরাধের জন্য আমি দায়ী করছি।”

আমি বললাম, “সরদার প্যাটেল জোর গলায় বলেছেন যে কংগ্রেসকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশরা ভারত পরিত্যাগ করবেন। অপরপক্ষে জিন্নাহ চিৎকার করে বলেছেন মুসলমানদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশরা ভারত পরিত্যাগ করবেন— যাদের কাছ থেকে ভারতে তাঁরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এর ফলে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে এই বিশ্বাস দাঁড়ায় যে তাঁরা গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন।” ভাইসরয় বললেন, “ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উক্তিতে আমি কীভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারি?” আমি বললাম, “আমি চাই না যে আপনি হস্তক্ষেপ করুন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে আপনি কীভাবে আপনার সুস্পষ্ট নিরবতাকে ব্যাখ্যা করবেন? আপনার উচিত ছিল আপনার সরকারের মনোভাবকে ব্যাখ্যা করা।”

২৯শে আগস্ট নোয়াখালি জেলায় হঠাৎ আকস্মিক উত্তেজনার সৃষ্টি হল। খিদিরপুরের ডক কর্মীদের গণহত্যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এটা হয়েছিল। ৭ই সেপ্টেম্বর মৌলানা গোলাম সারওয়ারের নেতৃত্বে নোয়াখালির মৌলবীদের এক সভায় ঘোষণা করা হয় যে কলকাতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানদের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। নোয়াখালি এবং কুমিল্লা জেলার সর্বত্র দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল এবং সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পূর্ববঙ্গের সমস্ত জেলাব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ত। সুহরাওয়ার্দি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছিলেন।

গান্ধি নোয়াখালি জেলার দত্তপাড়ায় ১৪ই নভেম্বর (১৯৪৬) পৌঁছলেন। গান্ধির সেক্রেটারি, ভুলাভাই দেশাই, নাতনি মুন্নি গান্ধি এবং নাত বউ আভা গান্ধি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সুহরাওয়ার্দি দত্তপাড়ায় গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধি পদব্রজে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে হিন্দুদের মনোবল পুনরুজ্জীবিত করেন। সুহরাওয়ার্দি প্রত্যেক বিপজ্জনক জায়গায় শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করেন। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে শরণার্থী শিবির খোলা হয় এবং দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গান্ধি ও তাঁর সঙ্গীরা বঙ্গীয় সরকারের অতিথি হিসাবে নোয়াখালি যান এবং সেখানে অবস্থান করেন। গান্ধির নোয়াখালি সফর নোয়াখালি ও কুমিল্লা এই দুই জেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মুসলমানদের নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারে পৃথিবীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। কলকাতা এবং বিহারে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। গান্ধি কলকাতা বা পাটনা কোথাও সফর করেননি।


১৯৪৬ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর পাটনায় দাঙ্গা শুরু হয়। খাজা নাজিমুদ্দীন এবং আমি পাটনা সফর করে বিহারের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। পাটনার দাঙ্গা শুরু হওয়ার তিন দিন পর বিহারের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী রাঁচি থেকে সিনহা পাটনায় পৌঁছেছিলেন। পাটনায় পৌঁছতে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তিন দিন পর্যন্ত রাঁচি থেকে পাটনায় আসার কোনও প্লেন ছিল না। বিহারের দাঙ্গায় বিহার কংগ্রেস কমিটির সভাপতি প্রফেসর আবদুল বারি এবং একজন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা নিহত হন। জিন্নাহও কলকাতা এবং পাটনা সফর করেননি। দাঙ্গা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ‘স্থির মস্তিষ্কে’ জিন্নাহ বলেছিলেন যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রমাণ করেছে।

[আবুল হাশিম রচিত ‘আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি’ (কলকাতা, চিরায়ত প্রকাশন, ১৯৮৮) গ্রন্থের অংশবিশেষ বর্তমান প্রবন্ধ।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান