বঙ্গভঙ্গ ও পাকিস্তান

ভবানী সেন

বঙ্গভঙ্গ কি অনিবার্য?

বঙ্গভঙ্গের সমর্থক যে কোনও জাতীয়তাবাদীর কাছে এই প্রশ্ন উপস্থিত করিলে তিনি বলেন — ‘গভর্নমেন্ট যখন ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠন করিবেই, তখন আমাদের বঙ্গভঙ্গ করা ছাড়া আর উপায় কি আছে? পাকিস্তান যখন অনিবার্য, বঙ্গভঙ্গও তখন অনিবার্য।’ এই যুক্তিটা পরীক্ষা করিয়া দেখা যাক।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাহির হয় ২০শে ফেব্রুয়ারি। এই ঘোষণাতে তিনি বলেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হইবে, কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের হাতেও ক্ষমতা সমর্পণ করা যাইতে পারে। এই ঘোষণার পর ভারত ব্যবচ্ছেদের-বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতারা কোনও আন্দোলন তুলিলেন না, এমন কি এ্যাটলির ঘোষণাকে নিন্দা পর্যন্ত করিলেন না, বরং পণ্ডিত নেহেরু ঘোষণা করিলেন যে এ্যাটলির বিবৃতি সন্তোষজনক। ইহার ফলে ২০শে ফেব্রুয়ারির পর হইতে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রবল হইয়া উঠে।

মুসলিম লিগ কিছুতেই গণপরিষদে যোগদান করিল না। এ দিকে মধ্যবর্তী গভর্নমেন্টের ভিতর লিগ দল কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘর্ষ চালাইতে লাগিল। কংগ্রেসের দাবি ছিল মুসলিম লিগকে হয় গণ পরিষদে যোগ দিতে হইবে অথবা মধ্যবর্তী গভর্নমেন্ট হইতে পদত্যাগ করিতে হইবে। এ্যাটলির ঘোষণা কংগ্রেসের এই দাবিকে সম্পূর্ণ পাশ কাটাইয়া গেল। তথাপি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা করিল যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি সমর্থনযোগ্য। এমনি করিয়া ব্রিটিশ সরকার সুকৌশলে ভারত ব্যবচ্ছেদের প্রতি কংগ্রেসের সম্মতি আদায় করিয়া বঙ্গভঙ্গের উৎসাহ বাড়াইয়া দিল। তখন বাংলার জাতীয়তাবাদীরা ভারত-ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ না করিয়া বঙ্গভঙ্গের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করিলেন। ৪ঠা এপ্রিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যে যদি কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ না করা হয়, যদি বাংলায় সর্বজনীন ভোটের অধিকার না দেওয়া হয় এবং যদি বাংলায় যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তিত না হয় তাহা হইলে বঙ্গভঙ্গ চাই। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকরী করিবার ক্ষেত্রে ‘যদি’ লাগানো শর্তগুলি চাপা পড়িয়াছে, বঙ্গভঙ্গের জন্যই মাউন্টব্যাটেনের কাছে দরবার চলিতেছে। ‘যদি’ লাগানো শর্ত দ্বারা এইরূপ ধারণা হয় যে বাংলার যুক্ত নির্বাচন এবং সর্বজনীন ভোটের অধিকার প্রবর্তিত হইলে বঙ্গভঙ্গের দাবি প্রত্যাহৃত হইবে, কিন্তু বি পি সি সি এই প্রস্তাব পাশ করিবার পরও কংগ্রেসপন্থী সংবাদপত্র বঙ্গভঙ্গ দাবি করিতেছে ও শর্তগুলি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলিতেছে না। কি করিয়া ভারত ঐক্যবদ্ধ রাখা যায়, কি করিয়া বাংলায় সর্বজনীন ভোটের অধিকার চালু করা যায়, কি করিয়া যুক্ত নির্বাচনের জন্য মুসলমান জনগণের সঙ্গে হিন্দু-জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায় সেজন্য কংগ্রেসের কোনও আন্দোলন নাই, বরং যুক্ত নির্বাচন দিলেও বঙ্গভঙ্গ চাই, মুসলমান মেজরিটিকে বিশ্বাস নাই, এই আন্দোলনই চলিতেছে। মহাসভার নেতা বলিতেছেন পাকিস্তান বন্ধ হইলেও বঙ্গ-বিভাগ চাই। কাজেই বি পি সি সির প্রস্তাবে লিখিত ‘যদি’ গুলির কোনো প্রভাব নাই, হিন্দু মহাসভার ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ই আজ বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্তের অধিকাংশের মন আচ্ছন্ন করিয়াছে। হিন্দুর বাঁচিবার উপায় কি এই প্রশ্নই আজ প্রায় প্রত্যেক হিন্দুর মুখে, হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপায় কি সে প্রশ্ন তলাইয়া গিয়াছে। লিগের দেখাদেখি হিন্দুরাও জাতীয়তাবাদ বর্জন করিয়া হিন্দু এবং মুসলমানকে দুই জাতির পর্যায়ে দাঁড় করাইয়াছেন। আজ জিন্নার অবাস্তব নীতিরই জয় জয়কার।

“কাজেই পাকিস্তান অপরিহার্য বলিয়া বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছে একথা ভুল, পাকিস্তানের অন্তর্নিহিত সাম্প্রদায়িকতা যে সময় হিন্দুমনকে আচ্ছন্ন করিল সে সময় জাতীয় নেতারা বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করিয়া পাকিস্তান অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছেন।”  নতুবা কংগ্রেস কেন আজ মাউন্টব্যাটেনের কাছে দাবি করিবে যে যদি পাকিস্তান হয় তবে বঙ্গভঙ্গ চাই? বাংলার কংগ্রেসসেবীরা যদি দাবি করেন যে — ভারত বিভক্ত হইতে দিব না, ভারত বিভাগের যে কোনও পরিকল্পনা কংগ্রেস বর্জন করিবে তাহা হইলে এ্যাটলি কিংবা মাউন্টব্যাটেনের সাধ্য কি আছে যে ভারত বিভক্ত করে? ১৬ই মে-র (১৯৪৬) ঘোষণাতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় ঐক্যের কথা ঘোষণা করিতে বাধ্য হইয়াছিল, এমন কি ডিসেম্বরের ঘোষণাতেও এ্যাটলি সরাসরি ভারত বিভক্ত করিবার কথা উচ্চারণ করিতে সাহস পান নাই। আজ ভারত বিভাগ অনিবার্য কেন হয়?

যে সময় ক্ষমতা হস্তান্তরিত করিবার নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আসিল ঠিক সেই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বলিতেছেন যে, বাংলাদেশে যেহেতু মুসলমানরা সংখ্যায় অধিক এবং যেহেতু মুসলিম লিগ বাংলার শাসনকর্তা, সেই কারণে বাঙালি হিন্দুর ধন, প্রাণ ও ধর্ম বাঁচাইবার জন্য স্বতন্ত্র প্রদেশ চাই। “এই ধ্বনিতে পাকিস্তানিদের নৈতিক ও রাজনৈতিক জোর যত বাড়িয়াছে, লিগের অনমনীয় দৃঢ়তা সত্ত্বেও এতদিন তত বাড়ে নাই। এতদিন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ মুসলিম লিগের দাবি ছিল। কিন্তু দুনিয়ার সর্বত্র সে দাবি অসংগত বলিয়া গণ্য ছিল। আজ জাতীয়তাবাদীরা হিন্দু স্বার্থরক্ষার জন্য বাংলায় মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠন দাবি করিয়া বিশ্বের সম্মুখে প্রমাণ করিলেন যে জিন্নার যুক্তিই ঠিক, অর্থাৎ ভারতে হিন্দু এবং মুসলমান এক সঙ্গে এক রাষ্ট্র গঠন করিতে পারে না।” ঠিক যে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর তরফ হইতে ভারতীয় ঐক্যের উপর শেষ আঘাত আসিল, সেই সময় জাতীয়তাবাদীরা রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া ভারতীয় ঐক্যের সমাধি রচনার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করিলেন।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ বলিয়াছেন —

“সর্বপ্রথম আমি একথা বলিতে বাধ্য যে আমি এবং আমার বন্ধুগণ অখণ্ড ভারত ও অখণ্ড বাঙ্গলার পক্ষপাতী। চল্লিশ বৎসরেরও অধিককাল পূর্ব্বে আমরা এই বঙ্গবিভাগের আন্দোলনের সময়ই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ করি। আজ যখন আমরা সেই বাঙ্গালাকেই ভাগ করিবার প্রস্তাব সমর্থন করি তখন তাহা আমাদের পক্ষে খুব সুখের বিষয় বলিয়া মনে হয় না।” [‘ভারত’, ২রা মে, ১৯৪৭]

বঙ্গভঙ্গের জন্য আজ যাঁহারা উৎসাহিত তাঁহাদের অধিকাংশই সুরেনবাবুর মতো বিষাদের সঙ্গেই এ আন্দোলনে নামিয়াছেন। কিন্তু এই উত্তেজনা যখন থামিবে তখন বিষাদটাই থাকিবে এবং তাহার পর আসিবে বঙ্গভঙ্গের ফললব্ধ সংকটের আঘাতজনিত উদ্‌বেগ।

কিন্তু তবু জিজ্ঞাসা করি এ পথ কেন বাছিয়া লইলেন?

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর দুরভিসন্ধি

ভারত বিভাগ সম্পর্কে লিগের একটি পরিকল্পনা আছে, আবার বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে কংগ্রেসের একটি পরিকল্পনা আছে। উভয় দলই নিজ নিজ পরিকল্পনার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের আকাশ কুসুম রচনা করিতেছে। উভয়েই ভুলিয়া যাইতেছে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরও একটি পরিকল্পনা আছে।
লিগপন্থীরা মনে করেন যে কলিকাতা মহানগরীকে কেন্দ্র করিয়া বঙ্গদেশ ও আসাম প্রদেশ লইয়া পূর্বপাকিস্তান গঠিত হইবে এবং মুসলিম লিগ এই পূর্বপাকিস্তানের শাসনকর্তা হইবে। কংগ্রেস ও মহাসভাপন্থীরা মনে করেন যে কলিকাতাসহ পশ্চিম-বঙ্গ যেহেতু হিন্দু-প্রধান সুতরাং পাকিস্তানের নীতি অনুসারেও এই অঞ্চলে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন যুক্তিসংগত। তাঁহাদের ধারণা যে এই অঞ্চলটি বাংলার অন্যান্য মুসলমান-প্রধান অঞ্চল হইতে পৃথক করিয়া কলিকাতা, ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও বর্ধমানের শিল্প সম্পদের সাহায্যে তাঁহারা এক সমৃদ্ধিশালী হিন্দুস্তান রচনা করিতে পারিবেন। কিন্তু ভাগাভাগির সমস্ত পরিকল্পনাই কালনেমির লঙ্কা ভাগের সমতুল্য। কারণ ভাগাভাগির এই দাবি উপস্থিত করিতে হইতেছে ব্রিটিশ সরকারের নিকট এবং ইহাও জানা কথা যে ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশেরও একটা স্বার্থ আছে এবং একটা পরিকল্পনা আছে। ভারত বিভাগের ও বঙ্গভঙ্গের দাবি ব্রিটিশের নিকট উপস্থিত করিলে ব্রিটিশের স্বার্থ এবং পরিকল্পনা অনুসারেই ভারত বিভাগের ও বঙ্গভঙ্গের ব্যবস্থা হইবে।

১৯৪৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মি. এ্যাটলি ঘোষণা করেন যে ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ভারতবাসীর হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সমর্পণ করা হইবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইহাও জানাইয়া দেন যে, ক্ষমতা সমর্পণ কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের হাতে অথবা বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের হাতেও করা হইতে পারে। এই ঘোষণার সুস্পষ্ট অর্থ হইল এই যে, কংগ্রেস এবং লিগ যদি কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট সম্বন্ধে একমত না হয় তাহা হইলে ভারতবর্ষকে বিভিন্ন অংশে টুকরো টুকরো করা হইবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই কি ব্যবস্থা ব্রিটিশ সরকার করিতেছে তাহা লক্ষ করা দরকার। ভারত সরকারের রাজনৈতিক বিভাগ এখনই তলে তলে চেষ্টা করিতেছে যাহাতে দেশীয় সামন্ত রাজ্যগুলি যথাসম্ভব স্বতন্ত্র থাকে। এই দেশীয় রাজ্যগুলিতে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ও সামরিক শক্তি মোতায়েন থাকিবে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এই রাজনৈতিক বিভাগ চেষ্টা করিতেছে যাহাতে উক্ত অঞ্চলের উপজাতীয়রা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকে। বাংলার ও আসামের উত্তর-পূর্বসীমান্তে পাহাড়ি উপজাতীয়দের মধ্যেও রাজনৈতিক বিভাগের গুপ্ত প্রচারকার্য চলিতেছে যাহাতে উক্ত অঞ্চল হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকে। এই অঞ্চলটি ব্রিটিশের তাঁবেদারির তলায় রাখিতে পারিলে ব্রিটিশের চা বাগানগুলি নিরাপদ থাকিবে। এই ব্যবস্থা সফল হইলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব এই দুইটি সীমান্তই ব্রিটিশ সামরিক শক্তির ঘাঁটি হইবে। অধ্যাপক কুপল্যাণ্ড ১৯৪৫ সালে যে পুস্তক প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহাতেই তিনি— এইরূপ ইঙ্গিত করিয়াছেন যে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিভক্ত করা হইলে কলিকাতা শহরে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা চলিতে পারে, কারণ তাঁহার মতে কলিকাতা সদর লইয়া হিন্দু বঙ্গ ও মুসলিম বঙ্গের মধ্যে যে কলহ দেখা দিবে তাহার উপযুক্ত সমাধানই হইল কলিকাতা শহরে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা।

বঙ্গভঙ্গে বাঙালি জাতির ধ্বংস

গণপরিষদের সভায় বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ ঘোষণা করিয়াছেন যে, ভারতের যতটা অংশ ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর স্বেচ্ছায় আসিতে চায় ততটা অংশের জন্য গঠনতন্ত্র রচনা করিয়াই আমাদের সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। (২৮শে এপ্রিল, ১৯৪৭)

ওই একই দিনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী মি. সোহরাবর্দি দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করিয়াছেন যে, বৃহত্তম বঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের স্বাধীন সম্মিলিত রাষ্ট্র করিয়া আমরা বাংলাকে সর্বতোভাবে উন্নত করিয়া তুলিতে চাই।

বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদের ঘোষণায় লিগের ভারত ব্যবচ্ছেদের দাবি সমর্থিত হইয়াছে, আবার সোহরাবর্দি সাহেবের ঘোষণায় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আপোষের ইঙ্গিত রহিয়াছে। কিন্তু তথাপি কংগ্রেস এবং লিগ যতদূরে ছিল ঠিক তত দূরেই রহিয়াছে। এই দূরত্ব কমাইবার সম্ভাবনা দূর করিয়া জিন্নাসাহেব ১লা মে (১৯৪৭) তারিখে ঘোষণা করিয়াছেন যে, ভারতের ছয়টি প্রদেশ (সমগ্র বাংলা, সমগ্র পাঞ্জাব, আসাম, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে, সিন্ধুদেশ, বেলুচিস্তান) পুরাপুরিভাবে পাকিস্তানের ভিতর চাই।

হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তানের এই টানা-পোড়েনের মধ্যে হিন্দু-মহাসভা বঙ্গদেশ বিভক্ত করিবার জন্য এক শক্তিশালী গণআন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছে।

“এই বঙ্গ-বিভাগ যদি সফল হয় তবে দুনিয়া হইতে বাঙালি জাতির নাম মুছিয়া যাইবে।” বাঙালি জাতির একাংশ আছে বিহারে এবং একাংশ আসামে। বাঙালি জাতির একাংশকে লইয়া পশ্চিম বঙ্গে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হইবে আর একাংশ রহিবে পাকিস্তানে। এদিকে আসাম প্রদেশ উত্তর-বঙ্গের একাংশ দাবি করিতেছে। এমনি করিয়া বাঙালি জাতি বিভিন্ন প্রদেশে ও বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িলে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে নগণ্য এবং সবচেয়ে অকর্মণ্য জাতি হইবে এই বাঙালি।

বঙ্গভঙ্গের উৎসাহী সমর্থকেরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গে আমরা বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তার উন্নতি সাধন করিব। কিন্তু খাদ্যের অবস্থা বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে বঙ্গভঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে দুর্ভিক্ষেরই আলিঙ্গন।

হিন্দু এবং মুসলিম ভেদে বঙ্গভঙ্গ করিলে হিন্দু বঙ্গের লোকসংখ্যা হইবে প্রায় ২ কোটি এবং মুসলিম বঙ্গের লোক সংখ্যা হইবে প্রায় ৪ কোটি। বর্তমানে প্রতিবৎসর গড়ে হিন্দু বঙ্গে চাউল উৎপন্ন হয় প্রায় ৮ কোটি মণ এবং মুসলিম বঙ্গে চাউল উৎপন্ন হয় প্রায় ১৯ কোটি মণ। হিন্দু বঙ্গে মাথাপিছু চাউলের ভাগ হইবে গড়ে প্রতি বৎসর ৪ মণ এবং মুসলিম বঙ্গে মাথা পিছু গড়ে পৌনে ৫ মণ। জীবন ধারণের জন্য মাথাপিছু গড়ে ৫ মণ চাউল প্রত্যেকের জন্য জরুরি, এ অবস্থায় হিন্দু বঙ্গের লোকের অনাহার মুসলিম বঙ্গের চেয়ে বেশি হইবে।

এই হিসাবের মধ্যে যে অবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায় হিন্দু বঙ্গের খাদ্যাবস্থা তাহার চেয়েও বিপজ্জনক।

হিন্দু প্রধান বঙ্গে কলিকাতা, ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলির শহর ও কারখানা এলাকায় কমসে-কম ৪০ লক্ষ লোকের জন্য বাজার হইতে খাদ্য কিনিয়া সরবরাহ করিতে হয়। সারা বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবৎসর যে ২৭ কোটি মণ চাউল উৎপন্ন হয়, তাহার শতকরা ৪৬ ভাগ চাউল বাজারে বিক্রয় হয় আর শতকরা ৫৪ ভাগ উৎপাদনকারীরা নিজেরা খায়। [দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট]। এই হিসাব অনুসারে বাজারে ক্রয়যোগ্য চাউল হইল ২৭ কোটি মণের মধ্যে মাত্র ১২ কোটি মণ। বাংলার যত লোক চাউল কিনিয়া খায় সবাইকে এই ১২ কোটি মণ আমদানির উপর নির্ভর করিতে হয়। কলিকাতা, হাওড়া, ২৪ পরগনা এবং হুগলির জন্য বাজারে চাউল ক্রয়ের যে চাপ পড়ে, দেখা গিয়াছে যে সেই চাপ সহ্য করা বাংলার খাদ্যের বাজারের পক্ষে একরূপ অসম্ভব। এই জন্য ১৯৪৪ সালে এই অঞ্চলকে বাংলার বাহির হইতে খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।

এখন হিন্দু-প্রধান বঙ্গ যদি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রদেশ হয় তবে তাহার খাদ্যের অবস্থা কীরূপ সাংঘাতিক হইবে তাহা সহজেই অনুমেয়। হিন্দু-প্রধান বঙ্গের ৮ কোটি মণের শতকরা ৪৬ ভাগ যদি বাজারে আসে তবে বাজারে ক্রয়যোগ্য চাউলের পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ৩ কোটি মণ। কলিকাতা প্রভৃতি শহর ও শহরতলির ৪০ লক্ষ লোকের জন্য বৎসরে কম সে কম ২ কোটি মণ চাউল কিনিতে হইবে। ৩ কোটি মণের বাজার হইতে ২ কোটি মণের থোক চাহিদা বাজার হইতে চাউল অনবরতই অদৃশ্য করিয়া দিবে। যে চাহিদা ১২ কোটি মণ চাউলের বাজার সহ্য করিতে অপারগ সে চাহিদা ৩ কোটি মণ চাউলের বাজার কি করিয়া সহ্য করিবে?

প্রকৃত সংকট ইহার চেয়েও গুরুতর, কারণ মুসলিম-প্রধান বঙ্গেই বেশির ভাগ উদ্বৃত্ত জেলা। হিন্দু প্রধান বঙ্গে সেই অনুপাতে উদ্বৃত্ত জেলা অনেক কম, কাজেই বাজারে ক্রয়যোগ্য চাউলের পরিমাণ হিন্দু-প্রধান বঙ্গে শতকরা ৪৬ ভাগেরও কম হইবে। কাজেই বঙ্গভঙ্গের মানে হইল পশ্চিমবঙ্গে চির দুর্ভিক্ষ, এখন যে খাদ্য সংকট আছে তাহাও সে দুর্ভিক্ষের কাছে ম্লান হইয়া পড়িবে।

হিন্দু নেতারা হয়তো বলিবেন যে আমরা দামোদর উন্নতি পরিকল্পনা কার্যকরী করিয়া অনাবাদী জমি আবাদ করিয়া লইব, কিন্তু তাহাতেও যে কয় বৎসর সময় লাগিবে তাহার মধ্যেই দুর্ভিক্ষে দেশ উজার হইয়া যাইবে, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করিয়া দামোদর উন্নতি পরিকল্পনায় হাত লাগাইবার কিংবা টাকা খাটাইবার সুযোগও পাইবেন না। বঙ্গভঙ্গ যে দুর্ভিক্ষ ডাকিয়া আনিবে তাহা বাঙালিকে দীর্ঘকালের জন্য অবাঙালিদের গলগ্রহ ও রিলিফ-প্রার্থী করিয়া রাখিবে। সারা ভারতের খাদ্যাবস্থা এমন নয় যে এই বোঝা ভারতীয় ইউনিয়ন বহন করিতে পারে কারণ খাদ্য ব্যবস্থায় সারা ভারতই ঘাটতি দেশ।

বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-প্রধান বঙ্গ যেমন খাদ্যের অভাবে আর্তনাদ করিবে তেমনি মুসলিম-প্রধান বঙ্গ শ্রমশিল্পের অভাবে অন্যের গলগ্রহ হইবে। বাংলার সমস্ত শ্রমশিল্পের শতকরা ৮৫ ভাগ পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু-প্রধান এলাকায় অবস্থিত। এখনই সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে গোটা বাংলাকেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য অন্য দেশের উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হয়। বঙ্গভঙ্গের পর মুসলিম-বঙ্গকে এই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য অন্য দেশের নিকট আত্মবিক্রয় করিয়া দিতে হইবে।

পশ্চিমবঙ্গের শ্রমশিল্প এবং উত্তর-পূর্ববঙ্গের কৃষি যথাক্রমে এই দুই সম্পদের জন্য বাংলার এক অংশ অপর অংশের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কৃষি এবং শ্রমশিল্পের, খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ সারা বাংলাদেশটাকে অবিভাজ্য অর্থনৈতিক সত্তায় পরিণত করিয়াছে। এই অবিভাজ্য সত্তাকে দুই খণ্ডে খণ্ডিত করার অর্থ উভয়েরই স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিবার ব্যবস্থা। ইহার ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ডাকিয়া আনা হইবে। ‘মন্দের ভালো’ বলিয়া যাঁহারা বঙ্গভঙ্গের নামে নাচিতেছেন বাঙালি জাতির অস্তিত্বের কথা তাঁহাদের চিন্তার মধ্যে যতটা আছে তাহার চেয়ে বেশি আছে সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধের উৎসাহ।

শিল্পে, সাহিত্যে, ভাষায় ও সংস্কৃতিতে বাঙালি গত একশত বৎসর ধরিয়া একটি মহান জাতিতে পরিণত হইয়াছে। হিন্দু এবং মুসলমানের শত স্বার্থ-সংঘাত সত্ত্বেও বাঙালির একত্ব অবিভাজ্য। মহাসভার নেতারা হামেশাই বলিয়া থাকেন যে পশ্চিমবঙ্গে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করিলে তাহার যে আয়তন এবং যে লোকসংখ্যা হইবে ভারতের তাহার চেয়েও কম কম আয়তনের ও কম লোকসংখ্যার প্রদেশ আছে। সে কথা সত্য। কিন্তু ৬ কোটি বাঙালির জাতীয় সংহতি বিভক্ত করিয়া অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রদেশের সঙ্গে খণ্ডিত বাংলার তুলনা করা বাঙালি জাতির মহান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়া তাহাকে টানিয়া নামাইবার যুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। বাংলাদেশটাকে যদি খণ্ডিত করা হয় এবং বঙ্গভঙ্গ যদি চিরস্থায়ী হয় তাহা হইলে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতির সম্পদে ঐশ্বর্যশালী বাংলার উদীয়মান ইতিহাসে পূর্ণচ্ছেদ টানা হইবে।

বঙ্গভঙ্গে মজুর-কৃষকের সর্বনাশ

বঙ্গভঙ্গের উৎসাহী সমর্থকদের মুখে এবং অসংখ্য প্রচার পুস্তিকায় হামেশাই হিন্দু-সংস্কৃতির উন্নতি এবং কৃষি-শিল্প বিকাশ দ্বারা খণ্ডিত বঙ্গের ভবিষ্যৎ শ্রীবৃদ্ধি সাধনের শপথ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁহাদের প্রচারের মধ্যে বাংলার খাদ্য সমস্যা সমাধানের যেমন কোনও হদিস পাওয়া যায় না তেমনি যে-কৃষক সমস্যা বাংলার মূল সমস্যা তাহারও সমাধানের কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত নাই।

বাংলার মোট ৭৫ লক্ষ পরিবার জীবনধারণের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। জমিদারি প্রথার কুফল স্বরূপ কৃষির অবনতি এই ৭৫ লক্ষ পরিবারের অধিকাংশকেই অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে রাখিয়া দিয়াছে। কৃষি হইতে উৎপন্ন আয়ের ১০ ভাগের এক ভাগ হাজার করা আড়াই জনের দখলে যায়। চাষের জমির শতকরা ৩৭.৮ ভাগ জমিদার-জোতদারদের খাস সম্পত্তি। [স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরি হইতে শ্রীযুক্ত অম্বিকা ঘোষ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য]

৫ একর জমি না হইলে একটি কৃষক পরিবারের সংসার চলে না। কিন্তু বাংলার ২০ লক্ষ পরিবারের জমির পরিমাণ পরিবার পিছু ২ একর হইতে ৫ একরের মধ্যে এবং ৭৫ লক্ষ পরিবারের অর্ধেক পরিবার ২ একরেরও কম জমির ভোগদখলকারী অথবা একেবারেই ভূমিহীন। প্রায় ১০ লক্ষ পরিবার হইল বর্গাদার। [দুর্ভিক্ষ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট]

এই ভূমি-ব্যবস্থা কৃষকের ঘরে মৃত্যুর আর্তনাদ তুলিয়াছে।

ভূমি-ব্যবস্থার এই অবস্থাই কৃষির আর্তনাদ সৃষ্টি করিয়া দুর্ভিক্ষের জন্ম দিতেছে এবং দেশের শ্রমশিল্প প্রসারের উপযোগী মূলধন ও মেহনত নষ্ট করিতেছে। ভূমি-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ব্যতীত বাংলার উন্নতি নাই।

অথচ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতাদের উক্তিতে এমন কিছু দেখি না যাহাতে এই অবস্থার পরিবর্তন সাধন সম্পর্কে কোনো আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কৃষকদের যে সংগঠিত তেভাগা আন্দোলন এই অবস্থার পরিবর্তন সাধনে অগ্রসর হইয়াছিল, নির্মম অত্যাচার দ্বারা তাহা দমন করিবার জন্য মহাসভা, কংগ্রেস এবং লিগ সকল দলের নেতারাই একসঙ্গে জোট পাকাইয়াছিলেন। অথচ লিগ মন্ত্রীমণ্ডলীর অত্যাচারের ভয়েই নাকি বঙ্গভঙ্গের দাবি অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গের নেতারা লিগ মন্ত্রীমণ্ডলীকে সমর্থন ও সাহায্য করিয়াছেন, এই আন্দোলন আরও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে কেন দমন করা হয় না ইহাই তাঁহাদের অভিযোগ।

বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, অকৃষকের হাত হইতে জমি ছিনাইয়া লইয়া কৃষকের মধ্যে বিতরণ এবং গরিব মধ্যবিত্তের জন্য সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করিয়া জমির পরিপূর্ণ ভোগ দখলীস্বত্ব কৃষককে দেওয়া — এই ব্যবস্থার উপরই বাংলার জাতীয় জীবনের ভবিষ্যৎ উন্নতি নির্ভর করে। নির্বাচনের সময় কংগ্রেস প্রতিজ্ঞা করিয়াছে জমি হইতে মধ্যস্বত্ব ভোগীর উচ্ছেদ সাধন করিবে কিন্তু কার্যত মধ্যস্বত্বভোগীর স্বার্থের সপক্ষে এবং কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হইতেছে। লিগ মন্ত্রীমণ্ডলীও বর্গাদার আইন কাগজে ছাপানোর পর তাহা ধামাচাপা দিয়াছে এবং তাঁহারা যে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিল আনিয়াছেন তাহাতে অনেক প্রগতিমূলক বিধান আছে বটে কিন্তু মধ্যস্বত্ব ভোগীর বিলোপ এবং বহু কৃষকের হাতে জমির পরিপূর্ণ ভোগদখলীস্বত্ব দিবার ব্যবস্থা নাই। বাংলার হিন্দু মুসলমান জমিদার এবং জোতদাররা ভূমি-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের বিরোধিতা করিতেছেন।

বাংলাদেশ দুই খণ্ডে খণ্ডিত করিবার জন্য যে আন্দোলন উঠিয়াছে তাহা বাংলার কৃষকদের মধ্যে ভেদ বাড়াইবে। বাংলাদেশ দুই খণ্ডে খণ্ডিত হইলে বাংলার কৃষকেরা দুই দেশে বিভক্ত হইয়া পড়িবেন। বাংলার যে কৃষকেরা আজ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়িয়া তুলিয়াছেন, যে সব হিন্দু-মুসলিম কৃষক একসাথে দাঁড়াইয়া বাংলার পল্লি অঞ্চলে দাঙ্গা প্রতিরোধ করিয়াছেন, সাম্প্রদায়িক দুষ্ট ক্ষতের বিরুদ্ধে যাঁহারা লড়াই করিয়া বাংলার গৌরব রক্ষা করিয়াছেন, বঙ্গভঙ্গের ফলে সেই কৃষকের একাংশ অপর অংশের বিদেশি হইয়া পড়িবেন। বঙ্গ বিভাগের ফলে হিন্দু কৃষক এবং মুসলমান কৃষক একে অপর হইতে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হইবেন যে তাহার ফলে, জমিদার এবং জোতদারেরাই শক্তিশালী হইবেন। বাঙালি জাতির প্রধান গণবাহিনী কৃষক, কৃষকের ঐক্য এবং কৃষকের মুক্তির উপরই বাঙালি জাতির অস্তিত্ব এবং বাঙালি সংস্কৃতির উন্নতি নির্ভর করে।

কলিকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং ২৪ পরগনার শিল্প এলাকায় যে ৮ লক্ষ মজুর কাজ করেন তাঁহাদের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ হিন্দু এবং ৩ লক্ষ মুসলমান। ইঁহাদের ভিতর দুই লক্ষ আছেন বাঙালি মজুর, তাঁহাদের অধিকাংশই পূর্ববঙ্গের অধিবাসী। এই সমস্ত মজুরের ঐক্যবদ্ধ শক্তি বাংলার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সময় দাঙ্গার বিরুদ্ধে একটি প্রচণ্ড দুর্গ হিসাবে দেখা দিয়াছে। এই সমস্ত মজুরের সংগঠিত শক্তি সাম্রাজ্যবাদীর অর্থনৈতিক প্রভুত্ব এবং আমলাতন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার জাতীয় জীবনে এক অভিনব ইতিহাস রচনা করিতেছে। বঙ্গভঙ্গ এই মজুরের সংগঠিত শক্তি ভাঙ্গিয়া দিবে এবং মজুরের একাংশকে অপর অংশের শত্রু করিয়া তুলিবে। বঙ্গভঙ্গ আনিবে সংগঠিত মজুরের শোচনীয় পরাজয়।

পূর্ণ বঙ্গ

বর্তমান শাসনতন্ত্র অনুযায়ী যে প্রদেশটিকে বঙ্গদেশ বলা হয় তাহার বাহিরেও বাঙালি অঞ্চল আছে। আসাম প্রদেশের ভিতর শ্রীহট্ট জেলা এবং কাছাড়ের সমতলভূমির অধিকাংশ অধিবাসী বাঙালি। বিহার প্রদেশের ভিতর মানভূম জেলার বৃহত্তম অংশ, ধলভূম মহকুমা, পূর্ণিয়ার ভিতর মহানদীর তীর পর্যন্ত অঞ্চল এবং পাকুর — এই অঞ্চলগুলির প্রত্যেকটিতেই সমগ্র জনসংখ্যার শতকরা ৮০ হইতে ৯০ জন পর্যন্ত বাঙালি। আসামের প্রান্তে এবং বিহারের প্রান্তে অবস্থিত এই সমগ্র অঞ্চল বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই অঞ্চলগুলির সঙ্গে বর্তমান বঙ্গদেশ একত্র করিলে যে দেশ হয় তাহাই প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশ।

ব্রিটিশ শাসন বঙ্গভূমিকে বিভক্ত করিয়া বাংলার ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে ঢুকাইয়া দিয়াছে। বাঙালি জাতিকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী করিতে হইলে এই সমগ্র বঙ্গভূমিকেই ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে। ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনই বর্তমানে কংগ্রেসের বহুবিঘোষিত নীতি, এই নীতি অনুসারে অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ গঠনের চেষ্টা কংগ্রেসসেবীরা নিজেরাই করিতেছেন। বাংলার লিগনেতারাও ঘোষণা করিয়াছেন যে বৃহত্তর বঙ্গের ঐক্যই তাঁহাদের নীতি।

এই নবগঠিত বঙ্গের অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি হইবে। ইহার প্রায় অর্ধেক হিন্দু ও অর্ধেক মুসলমান। এই পূর্ণ বঙ্গের ঐক্য হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধ শান্তিপূর্ণ করিতে পারিবে, কারণ এখানে হিন্দু বা মুসলমান এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের উপর প্রভুত্ব করিতে পারিবে না। হিন্দু বা মুসলমান কাহারোই তথাকথিত কোনও জবরদস্তি সুলভ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এই বঙ্গে থাকিবে না।

এই বঙ্গের মধ্যে কতকগুলি সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি ও সম্প্রদায় আছে। নেপাল, ভুটান ও সিকিম এর সংলগ্ন এলাকায় দার্জিলিং-এ যে গুর্গা, ভুটানি প্রভৃতি উপজাতীয়রা বাস করেন তাঁহারা যদি ইচ্ছা করেন তবে নেপাল, ভুটান ও সিকিম এর সঙ্গে মিলিত হইয়া গণতন্ত্রের ভিত্তিতে সমবেত রাষ্ট্র গঠন করিবার স্বাধীনতা তাঁহাদের দিতে হইবে। কারণ তাঁহারা ভিন্ন ভাষাভাষী ভিন্ন জাতি। এই গুর্খালিস্তানের অধিবাসীদের উচিত হইবে তাঁহাদের মাতৃভূমিতে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া স্বেচ্ছায় ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া। ইহা না করিলে ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিভাগের চক্রান্তের ফলে বাংলার সীমান্তে ব্রিটিশ সামরিক শক্তির ঘাঁটি তৈরি হইবে।

এই বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে সাঁওতাল প্রভৃতি উপজাতিও আছে। এই সমস্ত উপজাতীয় জনগণের জন্য জমির মালিকানা, শিক্ষা ও রাজনীতিক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ ও সুবিধা দিতে হইবে। সাঁওতালদের জন্য বঙ্গের ভিতর পশ্চিম অঞ্চলে বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তৈরি করা সমীচীন ও সম্ভব কিনা তাহাও অবশ্য বিবেচনা করিতে হইবে। এই পূর্ণ বঙ্গের ভিতর বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি যে সমস্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ ধর্ম-সম্প্রদায় আছে তাহাদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষিত করার বিশেষ ব্যবস্থা চাই। এই পূর্ণ বঙ্গে যত তপশিলি জনগণ বাস করেন তাঁহাদের জমি, শিক্ষা এবং সামাজিক সাম্য সম্পর্কিত মৌলিক অধিকার দিতে হইবে। অস্পৃশ্যতা আইনত দণ্ডনীয় করিতে হইবে।

এই পূর্ণ বঙ্গের অন্যতম প্রধান সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা জমিদারি প্রথা। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সাধন করিয়া কৃষককে জমি দিতে হইবে। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ দুর্ভিক্ষের অবসান ঘটাইবে এবং গ্রামবাসীদের কায়েমি স্বার্থের প্রভুত্ব হইতে মুক্ত করিবে।

পূর্ণ বঙ্গের সর্বসাধারণের রাজনৈতিক মৌলিক অধিকার হিসাবে স্ত্রী, পুরুষ, ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটের অধিকার দিতে হইবে। সর্বজনীন ভোটের অধিকার দেশের শোষিত জনসাধারণকে কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করিবে।

কায়েমি স্বার্থ যাহাতে ধর্ম ও সম্প্রদায়গতভাবে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করিতে না পারে সেজন্য চাই যুক্ত-নির্বাচন প্রথা। সর্বজনীন ভোটের অধিকার এবং যুক্ত নির্বাচনের সাহায্যে মজুর, কৃষক এবং গরিব মধ্যবিত্ত সম্মিলিতভাবে কায়েমি স্বার্থের চক্রান্ত ব্যর্থ করিয়া পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী হইতে পারিবে। বর্ণহিন্দুর প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে মুসলমান এবং তপশিলিরা পৃথক নির্বাচন দাবি করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু যেহেতু জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলমান এবং তপশিলি সুতরাং এই বিপুল জনসংখ্যার সকলেরই ভোট থাকিলে তাঁহাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থরক্ষার জন্য পৃথক নির্বাচনের আবশ্যকতা কী? বরং কায়েমি স্বার্থ পৃথক নির্বাচনের সুযোগে জনগণকে বিভক্ত করিয়া নিজ প্রতিপত্তি বাড়াইবার সুবিধা পায়।

দেশের আইনসভায় প্রত্যেকটি দল যাহাতে নিজ নিজ সংখ্যা অনুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচন করিতে পারে সেজন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (Proportional Representation) ব্যবস্থা চাই। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মানে হইল এই যে, নির্বাচনের সময় মোট ভোটদাতার যত অংশ যে দলের ভাগে পড়িবে সেই অনুপাত অনুযায়ী প্রতি দলের প্রতিনিধিসংখ্যা স্থির করা হইবে।

মজুরদের জন্য ৮ ঘণ্টার অনধিক কাজ, কমসে কম মাসিক ৪০ টাকার মজুরি, ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, সামাজিক বিমা এবং বেকার ভাতা প্রভৃতির ব্যবস্থা করিতে হইবে। সর্বসাধারণের জন্য রুজি ও রুটির ব্যবস্থা মৌলিক অধিকারের মধ্যে গণ্য করিতে হইবে। স্ত্রীলোক ও শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নতির জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করিতে হইবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই স্ত্রীলোকদের পুরুষের সমান অধিকার ও সুযোগ দিতে হইবে। সর্বসাধারণের জন্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিক্ষার স্বাধীনতা রক্ষা করিতে হইবে।

বাংলার ভিতর দুইটি দেশীয় রাজ্য আছে, ত্রিপুরা ও কুচবিহার। রাজতন্ত্রের অবসান করিয়া এই দেশীয় রাজ্যের প্রজাদিগকে পূর্ণ বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে এবং দেশীয় রাজ্যের প্রজাদিগকে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হইবে।

এই খাঁটি গণতন্ত্রই হইবে পূর্ণ বঙ্গের ঐক্য, শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি। এই পূর্ণ বঙ্গ ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর থাকিবে কিংবা তাহার বাহিরে থাকিবে ইহা নির্ধারণ করিতে হইবে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের গণভোট দ্বারা। হিন্দু এবং মুসলমান কোনও সম্প্রদায়েরই অধিকার ইহাতে খর্ব হইবে না। গণভোটের পদ্ধতি হিন্দুকে মুসলমানের সমর্থনের জন্য এবং মুসলমানকে হিন্দুর সমর্থনের জন্য সংঘাতের পরিবর্তে ঐক্যের দিকে উদ্বুদ্ধ করিবার সুযোগ দিবে।

আমাদের বিশ্বাস, এই পথ অবলম্বন করিলে পূর্ণ বাংলার জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর স্বেচ্ছায় যোগদান করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করিতে পারিবে। স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ইহাই একমাত্র পন্থা।

ভারতীয় ইউনিয়ন কেন চাই?

মি. সোহরাবর্দি এবং মৌঃ আবুল হাসেম দুই জনেই মোটামুটি এই কথা বলিতেছেন যে, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রাষ্ট্র গড়িতে হইবে কিন্তু ভারতীয় ইউনিয়নের প্রশ্ন আলাদা। মৌঃ আবুল হাসেম তাঁহার বিবৃতি প্রসঙ্গে একটি মূল্যবান দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিয়াছেন —

“পশ্চিম বাংলায় শতকরা এক শত ভাগই ভারতীয় বা ইঙ্গ-মার্কিন মূলধন নিয়োজিত রহিয়াছে। আমাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক মনোভাব দেখিয়াই তাহাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হইয়াছে। অবিভক্ত বাংলায় তাহাদের বিপদ। বাংলাকে দুর্বল ও অক্ষম রাখিবার জন্য বঙ্গভঙ্গ আজ তাহাদের স্বার্থসিদ্ধ করে।”

ভারতীয় এবং ইঙ্গ-মার্কিন মূলধন উভয়কেই সমপর্যায়ে ফেলেন বলিয়া লিগের ভিতরকার প্রগতিশীলেরাও ভারতীয় ইউনিয়নের কোনও অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা দেখেন না, তাঁহারা সরাসরি ভারত হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বাংলার পূর্ণ স্বাতন্ত্র দাবি করেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রবাদীরা সব মূলধনকেই সব সময় এক পর্যায়ে দেখে না, তাহা যদি দেখি তাহা হইলে হিটলারের ফ্যাসিস্টবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন এবং আমেরিকার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হইত না, আবার লেনিনও রুশ বিপ্লবের পর কিছুকালের জন্য নূতন অর্থনৈতিক নীতি (New Economic Policy) জারি করিয়া ছোটোখাটো ক্যাপিটালিস্ট মূলধনের সঙ্গে সাময়িক রফা করিতেন না।

বাংলাদেশে ভারতীয় মূলধন এবং ইঙ্গ-মার্কিন মূলধনের সঙ্গে বর্তমান সময়ে কি তফাত তাহা নিম্নলিখিত তথ্য হইতে বুঝা যাইবে।

বাংলাদেশে যত জয়েন্ট স্টক কোম্পানি মূলধন আছে তাহার মোট পরিমাণ কিঞ্চিদধিক ৮৮৬ কোটি টাকা। ইহার মধ্যে সরাসরি ইঙ্গ-মার্কিন-ইউরোপীয় মূলধনের পরিমাণ ৫৬ কোটি পাউন্ড বা প্রায় ৭৬৮ কোটি টাকা। (Annual Register of Joint Stock Companies for 1938-39) অর্থাৎ বাংলার সমস্ত মূলধনের শতকরা ৮৬ ভাগ হইল ইঙ্গ-মার্কিন এবং ইউরোপীয়। এই মূলধন কোথা হইতে আসিল? ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের পর গত সাড়ে তিন শতাব্দী ধরিয়া ভারতের সর্বত্র ইংরেজ পুঁজিপতিরা যে লুণ্ঠন চালাইয়াছে তাহারই একাংশ তাহারা এদেশে শ্রমশিল্পের মূলধনে পরিণত করিয়াছে।

বাংলাদেশ যদি আজ ভারতীয় ইউনিয়ন হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয় তবে এই বিরাট ইঙ্গ-মার্কিন মূলধনের বোঝা বাংলা দেশটাকে ইঙ্গ-মার্কিন উপনিবেশ করিয়া রাখিবে। প্রতি বৎসর তাহারা তাহাদের এই মূলধনের জন্য আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা মুনাফা গ্রহণ করে। এই দেনা বাংলার রাষ্ট্রকে ইঙ্গ-মার্কিনের বন্ধকী সম্পত্তিতে পরিণত করিবে— যদি না সমগ্র ভারত সমবেতভাবে তাহার সমগ্র আর্থিক সম্পদ সমবেত করিয়া ইহার প্রতিবিধান করে। এই ইঙ্গ-মার্কিন সম্পদ জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য যে গণ-সংগ্রাম দরকার সে সংগ্রামে সারা ভারতের সমগ্র শক্তির ঐক্য অপরিহার্য। এই ইঙ্গ-মার্কিন সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ব্রিটিশ সরকারের রোয়েদাদ দ্বারা পাকিস্তান বা বঙ্গভঙ্গ আদায় করার মতো কাজ নয়। সে কাজ জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধের মতোই নির্মম এবং কঠিন। কাজেই ভারতীয় ইউনিয়ন হইতে আজিকার দিনে বাংলার সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ঘোষণার অর্থ ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনে বাংলা দেশ রাখিয়া দেওয়া।

সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে মোট বিদেশি মূলধনের পরিমাণ কমসে কম ৭৪ কোটি পাউন্ড আর তাহার মধ্যে ৫৬ কোটি পাউন্ড রহিয়াছে বাংলাদেশে। (Annual Register of Joint Stock Companies for 1938-39) অর্থাৎ সারা ভারতে যত ইঙ্গ-আমেরিকান মূলধন আছে তাহারা শতকরা ৭৬ ভাগ রহিয়াছে শুধু বাংলাদেশে। কাজেই বাংলাদেশ যদি ভারতীয় ইউনিয়ন হইতে বিচ্ছিন্ন থাকে তবে ইঙ্গ-আমেরিকান মূলধনের শতকরা ৭৬ ভাগ ভারতীয় জনগণের অধিকাংশের আক্রমণের পাল্লার বাহিরে আসিয়া পড়িবে, তখন শুধু বাংলাদেশের উপর নজর রাখিলেই তাহার প্রভাব বজায় থাকিবে।

কাজেই বাংলার সঙ্গে অবাঙালির সংঘাত আজ আসল কথা নয়, আসল কথা হইতেছে সারা ভারতবাসীর সঙ্গে ইঙ্গ-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীর সংঘাত। বাংলাদেশকে ভারতীয় ইউনিয়ন হইতে বিচ্ছিন্ন করিলে মাড়োয়ারি এবং গুজরাটির মূলধন হয়তো জব্দ করিতে পারিবেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৬ ভাগ মূলধন ইঙ্গ-আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীর আর ইহাদের হাতেই পৃথিবীর শক্তিশালী সামরিক যন্ত্র রহিয়াছে। সুতরাং তাহাদের হটাইবার চিন্তা আগে করিতে হইবে। সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রধান কথা হইতেছে বাংলায় ইঙ্গ-মার্কিন মূলধন বাজেয়াপ্ত ও বাংলা হইতে ব্রিটিশ ফৌজ অপসারণ করা। একমাত্র এই ভিত্তিতেই স্বতন্ত্র বাংলার কোনও অর্থ হয়।

বাংলার কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান কৃষক এই ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীর শোষণে জর্জরিত। এই সাম্রাজ্যবাদ জমিদার এবং জোতদার সৃষ্টি করিয়া কৃষকদের জমি হইতে বঞ্চিত করিয়াছে। জমিদার-জোতদার এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণ হইতে মুক্তিলাভ করিবার জন্য চাই সারাভারতীয় কৃষকের ঐক্য। সারা ভারত হইতে বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইলে বাংলার কৃষক দুর্বল হ‍ইয়া পড়িবে।

‘ভারত বিভাগ’ ও ‘বঙ্গালভঙ্গ’ সাম্রাজ্যবাদীর হাতে হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েরই মারণাস্ত্র। আগে ছিল ভারতীয় ঐক্য সম্বন্ধে কংগ্রেস এবং গের সংঘর্ষ, এই সংঘর্ষের সুযোগ লইয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী এতদিন ক্ষমতা দখল করিয়া রাখিয়াছে। এখন আরম্ভ হইয়াছে ভারত-বিভাগের সীমানা লইয়া কংগ্রেস এবং লিগের সংঘর্ষ, এই সংঘর্ষের সুযোগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ১৯৪৮ সালের জুন মাসে এমন চুক্তি আদায় করিবে যাহাতে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার পরও তাহার অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। যাঁহারা বিদেশি মূলধন ও সামরিক প্রভুত্বের শোষণ হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছেন তাঁহারাই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখিবার কথা ভাবিয়া থাকেন। ভারতের সর্বত্রই বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের অবসানের জন্য ভারতকে যেকোনও উপায়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করিতেই হইবে, খণ্ডিত ভারত এই সংগ্রামে অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িবে।

আর ভারতের একাংশ দ্বারা অন্য অংশের শোষণের আশঙ্কার বিরুদ্ধে একমাত্র গ্যারান্টি হইতেছে, ইউনিয়ন হইতে যেকোনও সময় বিচ্ছিন্ন হইবার অধিকার। ভারতীয় ইউনিয়ন বা ফেডারেশন অর্থাৎ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হইলে তাহার অন্তর্গত কোনও সমভাষাভাষী জাতি যাহাতে ভবিষ্যতে যে কোনও সময় গণভোট দ্বারা বিচ্ছিন্ন হইতে পারে তাহার অধিকার দিতে হইবে। ইহার ফলে ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর কোনও সময়ে কোনওরকম জাতিগত জুলুম-জবরদস্তি সহ্য করা অপরিহার্য হইবে না।

কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ যদি আজ এই গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করে তবেই ব্রিটিশের হাত হইতে সারা ভারতের দেশবাসী সম্পূর্ণ ক্ষমতা ঐক্যবদ্ধভাবে গ্রহণ করিতে পারিবে। এই পথেই দেশীয় রাজ্যগুলির স্বেচ্ছাতন্ত্র খতম করা, এবং সমস্তরকমের কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্টা করা সম্ভব হইবে।

স্বাধীন ভারতেই স্বাধীন বাংলা সম্ভব

ভারতীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রের বাহিরে বৃহত্তর বঙ্গের স্বাধীনতার কথা বলা লিগের প্রগতিশীলদের পক্ষে খুবই সহজ কারণ তাহাতে পাকিস্তানবাদের কথাও থাকিয়া যায়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীর শাসন হইতে বাঙালির স্বাধীনতা যদি অর্জন করিতে হয় তাহা হইলে ভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করিয়া ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে সমর্পণ করে তাহা হইলেই বাঙালির জাতীয় জীবনের উপর ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কব্জা খতম হইবে না কিংবা সঙ্গে সঙ্গেই অবাঙালি ভারতীয়দের সাম্রাজ্যবাদ আরম্ভ হইবে না। কারণ, ১৯৪৮ সালের জুন মাসে যে ধরনের ক্ষমতাই সমর্পিত হউক না কেন ইঙ্গ-মার্কিন মূলধন তাহার পরও অব্যাহত থাকিবে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে সারা ভারতের শক্তি পরীক্ষা ১৯৪৮ সালের জুন মাসের পরও চালাইতে হইবে। মিশর, ট্রান্সজোর্ডানিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান নামতঃ স্বাধীন, তথাপি ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আজও তাহাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম চালাইতে হইতেছে।

বাঙালির সঙ্গে অবাঙালির স্বার্থসংঘাত আছে সত্য কিন্তু আজ তাহার চেয়ে বড়ো সত্য বাঙালির সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চরম স্বার্থসংঘাত। বাংলার শতকরা ৮৬ ভাগ মূলধনের মালিক যাহারা, তাহাদের সঙ্গে বুঝাপড়া করিতে পারিলে শতকরা ১৪ ভাগ অবাঙালি ভারতীয় মূলধনের সঙ্গে বাঙালির প্রতিযোগিতা একটা প্রতিযোগিতার মধ্যেই ধর্তব্য নয়। লিগ-নীতির আসল কথা, ভারতীয় মূলধনের সঙ্গে বাঙালির সংঘাতের জন্যই যে বঙ্গদেশকে ভারতীয় ইউনিয়নের বাহিরে লওয়ার দরকার হইয়াছে তাহা নয়, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগ চাই অথচ ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ বিভাগ চাই না, এবং যদিও পাকিস্তান চাই তবু স্বাভাবিকভাবে মুসলিম গরিষ্ঠ অঞ্চলে পাকিস্তান হয় না বলিয়াই বাংলার হিন্দু-প্রধান অঞ্চলকে পাকিস্তানে চাই। তাই বাংলা দেশটাকে ভারতীয় ইউনিয়নের বাহিরে রাখা লিগপন্থীরা দাবি করিতেছেন। সেই জন্যই তাঁহাদের প্রচারে পরস্পর-বিরোধী কথা দেখা দিয়াছে। একই সঙ্গে তাঁহারা বলিতেছেন, সারা ভারতে হিন্দু এবং মুসলমান দুইটি ভিন্ন ভিন্ন জাতি কিন্তু সেই ভারতেরই একটি অংশে অর্থাৎ বাংলায় হিন্দু-মুসলমান মিলিয়াই একটি জাতি।

ভারতীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্র হইতে বাংলার পূর্ণ বিচ্ছেদ বাংলার মজুরদের সর্বনাশ সাধন করিবে।

কলিকাতা, হাওড়া, হুগলি এবং ২৪ পরগনার-শিল্প এলাকায় প্রায় ৮ লক্ষ মজুর কাজ করেন। তাঁহাদের মধ্যে অবাঙালির সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ। এই অবাঙালি মজুর বাঙালি মজুরের সঙ্গে একত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রাম অগ্রসর করিয়া লইয়া চলিয়াছে। “ইঙ্গ-মার্কিন মূলধনের বিরুদ্ধে বাঙালির জাতীয় সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ মজুরের শক্তিই শ্রেষ্ঠ সম্বল।”  বাংলার সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় তাহারা সংখ্যায় খুব কম হইলেও বাংলার রাজনৈতিক সংগ্রাম-ক্ষেত্রে তাহারাই সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে সংগঠিত এবং সবচেয়ে ঐক্যবদ্ধ। এমন কী কলিকাতাব্যাপী ভীষণ দাঙ্গার সময়ও কলিকাতার মজুরেরা ঐক্যবদ্ধভাবে বিদেশি কোম্পানিকে পরাস্ত করিয়া দাবি আদায় করিয়াছে এবং সমবেত ভাবে দাঙ্গা পর্যন্ত রুখিতে অগ্রসর হইয়াছে।

আজ যদি বাংলাদেশটাকে ভারতীয় ইউনিয়নের বহির্ভূত দেশ বলিয়া ঘোষণা করা হয় তবে এই অবাঙালি মজুরেরা মুহূর্তের মধ্যে বিদেশীয় পর্যায়ে পড়িবে। যে দেশের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদের এত অবদান সেই দেশটাকে আজ তাহাদের মাতৃভূমি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া বাংলাকে দুর্বল করা যায়, সবল করা যায় না, কারণ ইহার পরে সমগ্রভাবে ভারতীয় মাতৃভূমি বলিয়া আর কিছুই থাকিবে না। বাঙালি অবাঙালি বিরোধের কথা তুলিয়া ভারতীয় ইউনিয়ন হইতে বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করিতে চাহিলে কলিকাতায় ছয়লক্ষ অবাঙালি মজুরের সঙ্গে দুই লক্ষ বাঙালি মজুরের বিরোধ সৃষ্টিতে উষ্কানি দেওয়া হয়।

লিগ-বর্ণিত ভারতীয় ইউনিয়ন-বহির্ভূত তথাকথিত ‘বাংলার স্বাধীনতা’ আসলে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দাসত্ব স্বীকার করা এবং সেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী যোদ্ধা মজুরের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করা।

ইহাই হইল সঠিক নীতির বিশ্লেষণ। কাজেই শান্তিপূর্ণভাবে যদি বাংলার ঐক্য রাখিতে হয় তবে পূর্ণ বঙ্গকে ভারতীয় ইউনিয়নে বা যুক্তরাষ্ট্রে সংযুক্ত রাখিতে হইবে, ভারতীয় ইউনিয়নে ভবিষ্যতে যাহাতে বাঙালি অত্যাচারিত না হইতে পারে সে জন্য যেকোনও সময় বাংলা দেশকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাহিরে আসিবার অধিকার দিতে হইবে এবং ভারতীয় ইউনিয়ন বা ফেডারেশন গণতান্ত্রিক মতে গঠন করিবার জন্য ইউনিয়নে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বৃহৎ বঙ্গের গণভোটের উপর ছাড়িয়া দিতে হইবে।

স্বাধীনতার অভিযান

কমিউনিস্ট পার্টি স্বেচ্ছামূলক ভারতীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভিতর ঐক্যবদ্ধ পূর্ণ বঙ্গের জন্য অনমনীয়ভাবে গণ-অভিযান পরিচালনা করিবে। কংগ্রেস এবং লিগের ভিতরকার প্রগতিশীল জনসাধারণকে আমরা এই অভিযান পরিচালনার জন্য আহ্বান করি। নিজ নিজ দলের আনুগত্য রাখিয়াই তাঁহারা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে জনমত সৃষ্টির এই অভিযান পরিচালনা করিতে পারেন। বাংলায় যাহারা আজ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য অনমনীয়ভাবে অগ্রসর হইবে তাহারাই হইবে ইঙ্গ-মার্কিন প্রভৃতি বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভারতীয় গণবাহিনীর অগ্রণী।

“ভারতীয় ঐক্য এবং বাংলার ঐক্যের জন্য এই অভিযানে জনসাধারণের বহু নির্দিষ্ট এবং বহু আংশিক দাবির জন্য গণ-সংগ্রাম করিতে হইবে।” ১৯৪৮ সালের জুন মাসের নূতন শাসন ব্যবস্থার জন্য ব্রিটিশের রোয়েদাদ চাই না, চাই গণ ভোট। ভারত বিভাগ এবং বঙ্গ বিভাগের সীমানা লইয়া কংগ্রেস-লিগ সংঘর্ষের বদলে চাই কংগ্রেস-লিগ আপোস। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ব্রিটিশের সঙ্গে ভারতীয় প্রতিনিধিদের যে চুক্তি-পত্র রচিত হইবে তাহাতে যেন ভারতের কোনও অংশে ব্রিটিশের অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করিবার অধিকার মানিয়া লওয়া না হয়। ভারতের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেশীয় রাজ্যের নৃপতিদের যে আলাপ আলোচনা হইতেছে তাহাতে যেন দেশীয় রাজ্যের জন্য পরিপূর্ণ গণতন্ত্র দাবি করা হয়। স্বদেশের জন্য যে গঠনতন্ত্র রচিত হইবে তাহাতে যেন পূর্ণ গণতন্ত্রের ব্যবস্থা থাকে।

ভারতীয় ঐক্য এবং বাংলার ঐক্যের জন্য যে আন্দোলন চলিবে তাহার সঙ্গে উল্লিখিত দাবিগুলি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকিবে। ভারতের যে গণবাহিনী এই সংগ্রামে যোগদান করিবে আজ সংখ্যায় তাহারা যতই কম হউক না কেন তাহারাই হইবে ভারতের সর্বত্র সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার শক্তিসমূহের মিলনের সেতু। আজ আমাদের সাময়িক জয় পরাজয় যাহাই হউক না কেন মহাভারতের মহামিলনের এই সেতুই ভারতীয় জনগণকে আজিকার এই বিষাদ সিন্ধুর ভ্রাতৃঘাতী রক্তস্রোত হইতে উদ্ধার করিয়া মুক্তি, শান্তি ও সাম্যের জনপদে প্রতিষ্ঠিত হইতে সাহায্য করিবে।

আমরা বিশ্বাস করি যে, দেশের প্রগতিশীল জনগণ এখনও যদি সাম্রাজ্যবাদীর দেশ বিভাগ নীতির বিরুদ্ধে অন্তত এই বলিয়া মিলিত হন যে আমাদের নিজেদের মধ্যেকার ভাগাভাগি যদি কিছু দরকার হয় তবে ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীকে সম্পূর্ণ বিদূরিত করিয়া তাহার পর করিব, তাহা হইলে আজও বঙ্গভঙ্গ রোধ করা যায়।

[ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক ভবানী সেন রচিত ‘বঙ্গভঙ্গ ও পাকিস্তান’ (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত) শীর্ষক পুস্তিকার অংশবিশেষ (আটটি পরিচ্ছেদ) বর্তমান প্রবন্ধ। কৃতজ্ঞতা: ড. সুজন চক্রবর্তী ও আবুল বাশার বুক সেন্টার।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান