অন্নদাশঙ্কর রায়
ভদ্রলোক বললেন, “চল্লিশ বছর বাদে আপনি ঢাকায় ফিরেছেন। আর একখানা ‘ফেরা’ লিখবেন তো?” মাত্র চারদিন কাটিয়ে আর একখানা ‘ফেরা’ লেখা যায় না। সে বয়সও কি আর আছে? তবে এটাও তেমনি এক সেন্টিমেন্টাল জার্নি। আবেগে কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। পদে পদে দমন করতে হচ্ছিল। চল্লিশ বছর বাদে ঢাকা, চব্বিশ বছর বাদে পূর্ব বাংলা। দেশভাগের পর একদিন সরকারি কাজে বহরমপুর থেকে রাজশাহী ঘুরে আসি। সেই শেষ দেখা। পরে একবার মওলানা ভাসানীর আমন্ত্রণে ভারত সরকার যে ডেলিগেশন পাঠান আমাকেও তার শামিল করা হয়েছিল। যাইনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলুম, তখন যেতে পারিনি।
এবারেও শেষ দিনটি পর্যন্ত যাওয়া অনিশ্চিত ছিল। তাই পাকা খবর দিতে পারিনি। জানতুম না কেউ নিতে আসবেন কি না। কোথায় যাব। কোন্খানে উঠব। মাত্র পঁচিশ মিনিটের বিমান যাত্রা। তার জন্যে এত রকম হ্যাঙ্গামা পোহাতে হয় যে একই মেহনতে লন্ডনে বা টোকিওতে যাওয়া যায়।
কিন্তু এহো বাহ্য। ঢাকার সঙ্গে কলকাতার কায়িক ব্যবধান মাত্র পঁচিশ মিনিটের, কিন্তু ওপারের সঙ্গে এপারের মানসিক ব্যবধান প্রায় পঁচিশ বছরের। কায়িক দূরত্বটা কিছু নয়, মানসিক দূরত্বটাই আসল। ওঁরা আর আমরা দু’রকম বিবর্তনের ভিতর দিয়ে গেছি। মনের মিল হবে কী করে? আইন অনুসারে আমরা এলিয়েন। সেটা না হয় উপেক্ষা করা গেল। কিন্তু এলিয়েনেশন উপেক্ষা করি কেমন করে? মনে মনে স্থির করি যে গায়ে পড়ে আত্মীয়তা ফলাতে যাব না। লোকে ভুল বুঝবে।
বিমান বন্দরে নেমে দেখি চেনা অচেনা মিলিয়ে বেশ কয়েকজন আমাদের নিতে এসেছেন। আমাকে, আমার স্ত্রীকে। সমাদরের উচ্ছ্বাসে আমরা অভিভূত। তারই ফাঁকে একজন আমাদের বললেন, “ইন্ডিয়ান আর্মি যদি আর একটা কি দুটো দিন দেরি করত আমাকে আপনারা আজ দেখতে পেতেন না।”
আর একজন — ইনিও মুসলমান — আমার কানে কানে বললেন, “পাকিস্তানি আমলে আমরা ওদের বিরোধী হতে গিয়ে সত্যিকার সেকুলার ছিলুম। এখন আর তা নই। সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে যাচ্ছে।”
সেই চারদিনে চেনা অচেনা অসংখ্য জনের সঙ্গে মিশেছি, বিভিন্ন কথা শুনেছি। সব রিপোর্ট করা আমার সাধ্য নয়। উচিতও নয়। মোটের উপর কী রকম লাগল সেই কথাই গুছিয়ে লিখছি। ঘটনা যা ঘটে গেছে তা তো সকলের মতো আমারও জানা ছিল। কিন্তু তার তাৎপর্য এক বছর আগে জানতুম না। তখন আমার ধারণা ছিল বিরোধটা বাঙালিতে পশ্চিমাতে। সেটা অর্ধসত্য। বিরোধটা আরও জটিল। তার খানিকটে বাঙালিতে বাঙালিতে। খানিক বলতে কতখানি বোঝায় তা দেখতে পাওয়া যাবে সামনের সাধারণ নির্বাচনে। তার আগে আমরা শুধু আন্দাজ করতে পারি। সে আন্দাজ ভুল হতেও পারে।
পাকিস্তানি ফৌজের আত্মসমর্পণের বর্ষপূর্তির চার দিন বাদে ঢাকায় ঘুরে ফিরে দেখি চারদিকে বাংলাভাষার জয়জয়কার। উর্দু অদৃশ্য। উর্দুভাষীরা হয় ফেরার, নয় বন্দি, নয় উপেক্ষিত। পাকিস্তানের কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। পাকিস্তানি বলে কেউ পরিচয়ও দেয় না। ইংরেজ আমলের মতো পাকিস্তানি আমলটাও হাওয়ার সঙ্গে গেছে। গন্ উইথ দি উইণ্ড।
বাংলার ইতিহাসে ঐটেই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আমল। প্রক্ষিপ্ত বললেও চলে। জাতির জনক বলে বিখ্যাত অমন যে কায়দে আজম জিন্না তাঁর ফোটো দূরের কথা নামটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। জিন্না অ্যাভিনিউ এখন বঙ্গবন্ধু সড়ক। জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে। নতুন জনক বঙ্গবন্ধু। আর ওই যে চাঁদ-তারা আঁকা পাকিস্তানি নিশান এখন ওর জায়গায় উড়ছে সবুজ সোনালী পতাকা। চব্বিশ বছরের মধ্যে ধর্মভিত্তিক প্রদেশ ভাষাভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। এই যে রূপান্তর এটা কি বৈপ্লবিক নয়? এর জন্যে কি ত্রিশ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়নি? পৃথিবীর কটা যুদ্ধে ক’টা বিপ্লবে মাত্র নয় মাসের মধ্যে এত বেশি মানুষ নিহত হয়েছে? একজন বললেন, “না, অত নয়। তিন থেকে চার লাখ।” আর একজন বললেন, “আমি যতদূর বুঝতে পারছি দেড় লাখ।” দেড় লাখও কি কম নাকি? ইংরেজের সঙ্গে লড়তে গিয়ে গোটা ব্রিটিশ আমলেও এত লোক প্রাণ হারায়নি।
“পাকিস্তানের যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুও থাকবে না, দেখবেন। সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাখতুনিস্তান সব একে একে বেরিয়ে যাবে। পাকিস্তান নামটাই লোপ পাবে।” তিক্ত স্বরে বললেন এক সুধী। একদা যিনি ছিলেন তার ঘোর পক্ষপাতী।
“পাকিস্তানি আমলটা ছিল শোষণের আমল। আমাদের ভাগ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে ওদের ওখানে ওরা সমৃদ্ধ হয়েছে। তারবেলা ড্যামের মতো ড্যাম এখানে কোথায়? সেইজন্যে আমরা কৌতুক করে বলি, ‘তার বেলা’? আপনার কবিতার সেই পঙ্ক্তি।” মনে করিয়ে দেন এক ইঞ্জিনিয়ার। আমার ওই কবিতার উল্লেখ অন্যত্রও শুনেছি।
চব্বিশ বছরে ঢাকার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, তা একটু চোখ বুলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু তার জন্যে কেউ কৃতজ্ঞ নয়, কারণ একই সময়ে করাচি ও রাওলপিণ্ডির উন্নতি হয়েছে আরও অনেক বেশি। ইসলামাবাদ তো আনকোরা নতুন শহর। দেশভাগ তথা প্রদেশভাগের ফলে পশ্চিম পাকিস্তান মরুভূমি থেকে উদ্যানে রূপান্তরিত হয়েছে, অথচ পূর্ব পাকিস্তান বন্যায় সাইক্লোনে বিপর্যস্ত। এক যাত্রায় পৃথক ফল। তেমনি বৈষম্য চাকরি-বাকরির বেলা। সাধে কি কেউ লক্ষ লক্ষ প্রাণের পণ রেখে স্বাধীনতা চায়?
“দেখুন, ২৫শে মার্চের দিনও আমরা পাকিস্তানি ছিলুম, পাকিস্তানে থাকতেই রাজি ছিলুম। কিন্তু সেই রাত্রে যে কাণ্ডটা ঘটে গেল তার পরে আর আমরা থাকতে পারলুম না। স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না।” বেদনার সঙ্গে বললেন এক ভদ্রমহিলা। পরিবারের লোকের দুঃখের কাহিনি শোনালেন। অনুরূপ কাহিনি শুনলুম আরও অনেকের মুখে। একটা দিনও তাঁরা নিরুদ্বেগে কাটাননি। পদে পদে মৃত্যুভয়, লাঞ্ছনাভয়। এক বন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন দলে দলে যুবককে চোখ বাঁধা ও পিছমোড়া অবস্থায় বধ্যস্থলে নিয়ে যাওয়া হত।
এখন যিনি রাষ্ট্রপ্রধান তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে ইউরোপে ছিলেন। যেই শুনলেন তাঁর ছাত্রদের ম্যাসাকার করা হয়েছে অমনি মনঃস্থির করলেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে কাজ করে যাবেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ জানালেন ব্রিটেন যেন শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ রক্ষার জন্যে সচেষ্ট হয়।
“রাতারাতি এত বড়ো ঝুঁকি আপনি নিলেন? যদি হেরে যেতেন তাহলে কী হত?” আমি জিজ্ঞাসা করি।
“তখন আমার কেবলই মনে পড়ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের ম্যাসাকারের পর রবীন্দ্রনাথ কী করেছিলেন সেই কথা। আমার ছেলেদের ওরা ম্যাসাকার করেছে, আমি সহ্য করব। আমি জানতুম অন্যায় কখনও জয়ী হতে পারে না। আমরা জিতবই, কিন্তু বলতে পারব না কবে। ওই জল্লাদদের সঙ্গে আপস আমি করতে পারতুম না। কক্ষনো না।” তিনি গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগের পর মহাত্মা গান্ধিও ব্রত নেন যে ইংরেজের সঙ্গে আপস তিনি কোনওকালেই করবেন না। কিন্তু তিনিও একবছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দিতে পারেন না।
পঁচিশে মার্চ তারিখের ম্যাসাকারের পর স্বাধীনতা ঘোষণা যাঁরা করেন তাঁরাই হয়ত দেশের অধিকাংশ লোকের প্রতিনিধি। কিন্তু যে ম্যান্ডেট নিয়ে তাঁরা সংবিধান সভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন সে ম্যান্ডেট স্বাধীনতার জন্যে নয়, পাকিস্তানের ভিতরে থেকে স্বাধিকার আদায়ের জন্যে। ওপারের বেশ কিছু লোক যে পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক এটা দূর থেকে আমরা বুঝতে পারিনি। পাকিস্তানের প্রতি যাদের আনুগত্য আর বাংলাদেশের প্রতি যাদের আনুগত্য এদের দুই পক্ষই বাঙালি। বাঙালিতে বাঙালিতে এই মতভেদ যে কতদূর গড়াতে পারে তার চূড়ান্ত দেখা গেল ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েকদিন আগে থেকে। যখন আল বদর, আল শামস প্রভৃতি গোষ্ঠীর বাঙ্গালিরাই বাঙালিদের ফাঁদে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রায় হাজারখানেক বুদ্ধিজীবী এইভাবে নিহত হন। চোখের ডাক্তারের চোখ উপড়ে ফেলা হয়। হার্টের ডাক্তারের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে ফেলা হয়। মানুষকে আগে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে পরে গুলি করে মারা হয়। কিংবা আগে গুলি করে পরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। এটাও একপ্রকার ম্যাসাকার, কিন্তু এবার খান্ সেনার দ্বারা নয়, বাঙালি ঘাতকের দ্বারা। এটা আরও বীভৎস।
এর ব্যাখ্যা এই যে, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। সুতরাং তার শাস্তি হচ্ছে ঘাতকতা। অপর পক্ষে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। সুতরাং তার শাস্তি হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিশেষ আদালত কর্তৃক প্রাণদণ্ড বা কারাদণ্ড। প্রাক্তন গভর্নর মালিক সাহেবের কারাদণ্ড হয়েছে। তাঁর উজিরদেরও তাই হয়েছে বা হবে। ইতিপূর্বে মুক্তিযোদ্ধারাও যে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকদের সরাসরি কোতল করেনি তা নয়। জনতাও আইনকে আপনার হাতে নিয়ে চরম দণ্ড দিয়েছে। নিরপেক্ষ বিদেশি সাংবাদিকরা বা সাক্ষীরা দুই পক্ষেরই বাড়াবাড়ির বিবরণ প্রকাশ করেছেন।
যেখানে দুই আনুগত্যের বিরোধ সেখানে দুই পক্ষই উন্মাদ হয়। যেখানে আপসের কোনও রাস্তা নেই সেখানে চরমপন্থাই একমাত্র পন্থা। গান্ধিজি ছিলেন বলেই একটা অহিংস টেকনিক প্রয়োগ করা হয়েছিল। নইলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও এমনি রক্তক্ষয়ী হত। ইংরেজরাও মরণ কামড় না দিয়ে নড়ত না। ভারতীয়দের মধ্যেও একদল তাদের পক্ষে লড়ত। রাজার প্রতি আনুগত্য ও দেশের প্রতি আনুগত্য প্রজা ও পেট্রিয়টদের দুই ভাগে বিভক্ত করত। ক্ষমতার হস্তান্তর আমাদের মহতী বিনষ্টির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বাংলাদেশে সেরূপ ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপ্লবাত্মক। তাই একদল প্রতিবিপ্লবীও সেখানে ম্যাসাকার ঘটিয়েছে। যে ক্ষতি তারা করেছে তা অপূরণীয়।
ঢাকা গিয়ে কয়েকটি তথ্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। আগে অত কথা জানতুম না। মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে আলাপ আলোচনার সময় মুসলিম লিগ যখন ভারতভাগ দাবি করে তখন কংগ্রেস থেকে বাংলাভাগের প্রস্তাবও ওঠে। বাংলার লিগ নায়করা ভারতভাগ চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলাভাগ চাননি। বেকায়দায় পড়ে তাঁদের মধ্যে তখন তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। বাংলা যাতে অবিভক্ত থাকে সেকথা ভেবে সুহরাবর্দী সাহেব চাইলেন স্বাধীন বঙ্গ। যে বঙ্গ ভারতেরও বাইরে, পাকিস্তানেরও বাইরে। তাতে হিন্দু মুসলমান প্রায় সমান সমান। তাই শরৎচন্দ্র বসুও সায় দেন। গান্ধিজিরও সমর্থন ছিল। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে বাংলার একভাগ ভারতে ও একভাগ পাকিস্তানে গেলে ভয়ংকর অনর্থ ঘটবে। ওদিকে নাজিমুদ্দীন সাহেব কিছুতেই পাকিস্তানের আঁচল ছাড়বেন না। হয় হোক বাংলা ভাগ। শেষ পর্যন্ত নাজিমুদ্দীনেরই জিত হল। সুহরাবর্দীর হার।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সুহরাবর্দী সাহেবের মতো স্বাধীন বাংলার পক্ষে। ধীরে ধীরে তিনি মুসলিম লিগ থেকে সরে যান, সুহরাবর্দী সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করেন, পরে তার থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেন, দলটিতে হিন্দুদেরও নেন। যৌথ নির্বাচনের প্রবর্তন এঁদেরই উদ্যোগের ফল। অমনি করে সেকুলার রাজনীতি আসে। অবশেষে পাকিস্তানের বাইরে ভারতের বাইরে স্বাধীন বাংলার আবির্ভাব হল। পশ্চিমবঙ্গ ততদিনে ভারতের অঙ্গ হয়ে গেছে। তাকে আর পাওয়া গেল না। তাকে বাদ দিয়েই বাকি বঙ্গ “বাংলাদেশ” নাম পরিগ্রহ করল। যেমন পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে বাকি ভারত “ইন্ডিয়া” নাম পরিগ্রহ করেছিল। কোনওটিই অখণ্ড নয়, তবু প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে অন্বয় রক্ষাকারী, পুরাতনের উত্তরাধিকারী।
নতুন ভারত হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়, ব্রিটিশও নয়, তিনটির সমন্বয়। নতুন বাংলাদেশও তাই। কিন্তু মাঝখানে যে চব্বিশটি বছর পাকিস্তানের আঁচলে বাঁধা হয়ে কাটল সেই সময়টাও তার বিবর্তনের একটা যুগ। সুহরাবর্দীর আইডিয়া চব্বিশ বছর আগে হেরে গিয়েও চব্বিশ বছর বাদে জেতে। নাজিমুদ্দীনের আইডিয়া চব্বিশ বছর আগে জিতে গিয়েও চব্বিশ বছর বাদে হারে। কিন্তু হার জিত যে চূড়ান্ত সেকথা মেনে নিতে কি নাজিমুদ্দীনের অনুবর্তীরা রাজি? না, পাক-বাঙালিরা অত সহজে হার মানবে না। ধর্মই তাদের তুরুপের তাস। জনগণ এখনও তেমনি ধর্মপ্রাণ। তাদের বোঝাতে হবে যে ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ হলেও রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে ও হওয়া উচিত। স্বাধীন বাংলা যদি ‘মুসলিম বাংলা’ হয় তা হলে সেটাও একপ্রকার আপস। খামোখা লক্ষ লক্ষ মানুষ মরতে গেল কেন!
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যেমন ভারত ভাগ করেছে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ তেমনি পাকিস্তান ভাগ করেছে। প্রথমবারের ভাগকরণে মুসলিম লিগের যে ভূমিকা দ্বিতীয়বারের ভাগকরণে অওয়ামী লিগেরও সেই ভূমিকা। ইতিহাস যাকে যে ভূমিকা দিয়েছে সে সেই ভূমিকায় অভিনয় করেছে। ব্যক্তি এক্ষেত্রে গৌণ। শক্তিই মুখ্য। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ইউরোপের ইতিহাসেও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে, এশিয়ার ইতিহাসেও আরও নজির আছে। তুরস্কও তো একদা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল, পরে কামাল পাশা তাকে ভাষাভিত্তিক তথা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করেন। জাপানও ধর্মভিত্তিক ছিল, শোগুনদের আমলে বৌদ্ধ, মেইজির আমলে শিন্তো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষ। বাংলাদেশ যুগের সঙ্গে তাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েছে। ভাষাভিত্তিক হয়েছে। গণতন্ত্রী হয়েছে। ইতিমধ্যেই তার নতুন সংবিধান সংরচিত হয়েছে। তার জন্যে অপেক্ষা না করেই ব্যাংক ইনশিওরান্স জাতীয়করণ হয়েছে। কলকারখানা জাতীয়করণ হয়েছে।
সত্তর বছর আগে অন্যের তুলনায় পূর্ব বাংলা ছিল একটি অনগ্রসর অঞ্চল ও মুসলিম সম্প্রদায় একটি অনগ্রসর সম্প্রদায়। এই দু-টি কারণেই লর্ড কার্জন ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ ও আসাম সৃষ্টি করেন। তাঁর আসার আগে থেকেই বঙ্গপ্রদেশকে দু’ভাগ করার প্রস্তাব উঠেছিল, আদিতে সে প্রস্তাব ছিল ওড়িশার কতক অংশ ও ছোটনাগপুর মিলিয়ে আলাদা একটি প্রদেশ গঠনের। লর্ড কার্জন পূর্ববাংলা সফর করে এসে সুপারিশ করেন যে পদ্মানদীই প্রাকৃতিক বিভক্তি রেখা, সেই রেখা ধরেই প্রদেশ দু’ভাগ করা সংগত। তাতে প্রশাসনের দিক থেকে অনগ্রসর অঞ্চলের উপর অধিকতর মনোযোগ দেওয়া সম্ভব। আর তাতে মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু হওয়ায় তাদেরও সুযোগ সুবিধা লাভ সহজ। লর্ড কার্জনের যুক্তির মূলে যথেষ্ট সত্য ছিল। অনগ্রসর অঞ্চলকে সুশাসিত করার জন্যে, অনগ্রসর সম্প্রদায়কে উৎসাহ দেবার জন্যে অমন একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলন যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয় তখন ইংরেজরা বুঝতে পারে বঙ্গভঙ্গ রদ করতেই হবে। তার বিকল্প হিসাবে তারা মুসলিম সম্প্রদায়কে দেয় স্বতন্ত্র নির্বাচন-ব্যবস্থা। ঢাকাতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লিগের নেতাদের দিয়েই এ দাবি পেশ করিয়ে নেওয়া হয়। একভাবে না হোক আর-একভাবে মুসলমানদের একটা ভাগ দেওয়াই হয়ে দাঁড়ায় ব্রিটিশ নীতি। আদিতে সেই ভাগটা ছিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম। মাঝখানে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা, চাকরিতে সংখ্যানুপাত, আইনসভায় নির্দিষ্টসংখ্যক আসন। অন্তে পাকিস্তান। আবার সেই পূর্ববঙ্গ।
মুসলমানরা অখণ্ড ভারতের সর্বত্র মাইনরিটি ছিল না, কতক প্রদেশে বা অঞ্চলে মেজরিটি ছিল। সেইসব মেজরিটি প্রদেশ বা অঞ্চল জুড়ে জুড়ে পাকিস্তান তৈরি হয়। কথা ছিল পূর্বদিকে একটি পশ্চিমদিকে একটি দু’দিকে দু-টি পাকিস্তান সৃষ্টি হবে। তা যদি হত তা হলে এমন নিদারুণ রক্তপাত হত না। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের পরিকল্পনা পরে একসময় পালটানো হয়। ফলে একটাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে যদি সংবিধান রচিত হত, বাঙালি মেজরিটিকে দেওয়া হত কেন্দ্রীয় আইনসভায় তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীমণ্ডলীতে অধিকতর সংখ্যক আসন, চাকরিবাকরিতে অন্তত সমসংখ্যক স্থান, ঢাকা যদি হত কেন্দ্রীয় সরকারের সদর তা হলে কেই বা পেশ করত ছয় দফা দাবি, কেনই বা করত? কিন্তু গোড়া থেকেই নেওয়া হল বিপরীত নীতি, মেজরিটিকে করতে চাওয়া হল মাইনরিটি, তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হল মাইনরিটির ভাষা উর্দু। প্যারিটির নামে, বেসিক ডেমোক্রাসীর নামে ধোঁকা দেওয়া হল। পরিণামে পাকিস্তান গেল ভেঙে। এর মধ্যে ভারতের হাত বা হিন্দুর হাত কোথায়?
কিন্তু চব্বিশ বছর ধরে এমনভাবে ভারতবিদ্বেষ সঞ্চারিত করা হয়েছে যে স্বাধীনতার পরেও তাকে বিদূরিত করা সহজ হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তাও কারও কারও চোখে সাম্রাজ্যবাদী কৌশল। ফলে হিন্দুরা পূজা করতে গিয়ে বাধা পাচ্ছে। এসব শোনবার জন্যে আমি ঢাকায় যাইনি, কিন্তু শুনে দুঃখিত হই। আবার ভারতের প্রতি ভালোবাসার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তিও লক্ষ করি। হিন্দুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনও দেখি। আমার সিদ্ধান্ত এই যে সর্বত্র দুই রকমের লোক আছে। যেমন এপারে তেমনি ওপারে। দুই রকমকে এক রকমে পরিণত করা মানুষের সাধ্য নয়। সেটা ইতিহাসের উপর ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের সাধনা হবে এপারের লোককে অসাম্প্রদায়িক হতে উদ্বুদ্ধ করা। ওপারের দায়িত্ব ওপারের বন্ধুদের। তাঁদের মধ্যে আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দায়িত্ববোধ নিরীক্ষণ করেছি। কেউ কেউ তো আমার চেয়েও সেকুলারমনস্ক। স্বাধীনতার আলো বাতাস গায়ে লাগলে বাংলাদেশের মাটিতে রেনেসাঁসের ফুল ফুটবে, রেফরমেশনের ফল ধরবে। ইতিমধ্যে তার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। জীবন সম্বন্ধে প্রচণ্ড কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা। নতুন করে ভাবা, নতুন করে গড়া। বিশ্ব গ্রন্থমেলায় অহোরাত্র ভিড়। ভারতীয় স্টলে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো।
চব্বিশ বছরের অপরিচয় এক বছরে দূর হতে পারে না। অবিরাম যাওয়া-আসা চাই। মেলামেশা চাই। যাত্রা কথকতা বাউল লোকগীতি থিয়েটার ফিল্ম চিত্রপ্রদর্শনী প্রভৃতির অব্যাহত চলাচল চাই। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও যথাসম্ভব বিনিময় চাই। মাল পাচার হচ্ছে, এটা নিরেট সত্য। কিন্তু শূন্যতা থাকলে প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে পূরণ করা। প্রকৃতির নিয়ম যা করিয়ে নিচ্ছে সরকার তাতে কতই বা বাধা দেবে! আমিও এককালে বাধা দিতে গিয়ে বিফল হয়েছি। পুলিশকেই অসাধু হবার সুযোগ যুগিয়েছি। ভোগ্য পণ্যের অভাব যাতে মেটে তার আশু ব্যবস্থা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন বৃদ্ধি চাই।
পূর্ব বাংলার কারুশিল্প চিরকালই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এবারেও করল। এই একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অপরাপর দেশের উপর টেক্কা দিতে পারে। মেয়েরাও এইভাবে সংসারের আয় বাড়াতে পারে। এতে খুব বেশি মূলধন লাগে না। উপকরণও হাতের কাছে মেলে। সৌন্দর্যবোধ তো সহজাত। দক্ষতাও পুরুষানুক্রমিক। আমাদের কারিগর শ্রেণিই আমাদের সব চেয়ে মূল্যবান সম্পদ। খান্ সেনা এদের মেরে উজাড় করতে চেয়েছে। এ যেন সেই কোম্পানির আমলে দক্ষ তাঁতীর বুড়ো আঙুল কাটা। আমাদের চাষি শ্রেণিই বা কম মূল্যবান কিসে! এরা অশিক্ষিত হলেও অজ্ঞ নয়। হাতে কলমে এরা যা শেখাতে পারে বিশেষজ্ঞরাও পারেন না। সরকার থেকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিদেশ থেকে এক্সপার্টরাও আসছেন। যে পূর্ব বাংলা আমি পঁচিশ বছর পূর্বে পেছনে রেখে এসেছি এ পূর্ব বাংলা তার চেয়ে অনেক বেশি কর্মচঞ্চল জগৎসচেতন। দেশ বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে ফিরে এসেছেন এমন অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হল। দেশের বাইরে যাবার জন্যে প্রবল আগ্রহ লক্ষ করলুম মেয়েদের মধ্যেও। পর্দা উঠে গেছে, তা হলেও বোরখা পরা মুখও মাঝে মাঝে চোখে পড়ল। এর মধ্যেই এক ঝাঁক মেয়ে ভারতে পড়তে এসেছে। আরও আসতে চায়। বৃত্তি পেলে সুবিধে হয়।
“মুখ্য স্রোতটা তো ওপারেই।” বললেন এক সাহিত্যিক। “এতদিন বিচ্ছিন্ন থাকাটাই ভুল হয়েছে।”
এতদিন বাদে এটা ওঁরা উপলব্ধি করেছেন দেখে খুশি হলাম। কীসের মোহে ওঁরা ভেবেছিলেন মুখ্য স্রোতটা পশ্চিম পাকিস্তানে? পূর্ব পাকিস্তান নামকরণটাই ওঁদের বিভ্রান্ত করেছিল। এখন সে নামকরণও গেছে, সে বিভ্রমও গেছে। সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ্য স্রোতটা কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় লাভ যেটা হয়েছে সেটা হয়তো আর্থিক। সংরক্ষিত এলাকায় বইপত্র বিক্রি হয়েছে, কিন্তু মুখ্য স্রোতের সঙ্গে সংযোগ না থাকলে ক্ষতি কি কম? পক্ষান্তরে লোকসংস্কৃতির দিক থেকে মুখ্য স্রোতটা আমার মতে পূর্ব বাংলায়। ঠাকুমা’র ঝুলি, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, লালন ফকির এসব তো এপারের নয়।
মুখ্য স্রোতটা যে সংস্কৃতির দিক থেকে ভাগীরথী তীরে ও লোকসংস্কৃতির দিক থেকে পদ্মাপারে এ প্রতীতি আপাতত অল্প কয়েকজনের মনে মুদ্রিত হয়ে যাক। পরে অধিকাংশের মনে অঙ্কিত হবে। বাঙালিমাত্রেই — তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, ভারতেরই হোক আর বাংলাদেশেরই হোক — বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন। আর সংস্কৃতি বলতে কেবল শিক্ষিতজনের মার্জিত সংস্কৃতি নয়, জনগণের প্রাকৃত সংস্কৃতিও বোঝায়। এক্ষেত্রে পূর্ববাংলার ঐশ্বর্যের তুলনা নেই। পতিসরে না থাকলে, শিলাইদায় না থাকলে রবীন্দ্রনাথও কি তাতে অবগাহন করতে পারতেন? আর অবগাহন না করলে তাঁর স্বদেশিযুগের প্রসিদ্ধ গানগুলি কি লিখতে পারতেন। না, “গীতাঞ্জলি”ও নয়। চব্বিশ বছর আগে কুষ্টিয়ায় যখন ছিলুম তখন লালনের এক হিন্দু শিষ্য আমাকে বলেছিলেন যে কবিগুরু লালন ফকিরের বাউল গানের খাতা নিয়ে গিয়ে ফেরত দেননি ও তাই পড়ে “গীতাঞ্জলি” লিখেছেন। আমি অবশ্য হেসে উড়িয়ে দিই। তার পরেও তিনি পীড়াপীড়ি করেন যে সে খাতা আমি যেন কবিগুরুর কাছ থেকে উদ্ধার করি।
রবীন্দ্রনাথকে অধ্যাপক ডিমক বাউল বলেছেন। আমিও অনেক সময় মনে করি যে তিনি কেবল উপনিষদের শাশ্বত ধারায় লালিত নন, আউল বাউল সাঁই দরবেশদের সমান শাশ্বত অপর একটি ধারায় অভিষিক্ত। তাঁর পরিণত বয়সের মানুষের ধর্ম প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টির সমন্বয়। তৃতীয় একটি ধারাও তাতে যোগ দিয়েছে। সেটি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের হিউমানিজম বা মানবিকবাদ। রামমোহনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল উপনিষদের বেলা, হিউমানিজমের বেলা, কিন্তু বাউল বৈষ্ণবের বেলা নয়। তেমনি রামমোহন ছিলেন ইসলামি ধারার ধারাবাহী। রবীন্দ্রনাথ সে ধারার থেকে দূরে। তবে মহর্ষি ভালবাসতেন হাফিজের রসে ডুবে থাকতে। সেটিও তো ইসলামি ধারা। সে ধারা হিন্দুদের মধ্যে তার পরে শুকিয়ে যায়। তেমনি উপনিষদের ধারাও মুসলমানদের মধ্যে ছিল। দারা শিকোর পর সে ধারাও শুকিয়ে যায়। ইউরোপীয় শিক্ষা বর্জন করার ফলে আধুনিক ইউরোপীয় হিউমানিজমও মুসলিম মানসে রেখাপাত করে না। ওই বাউল দরবেশই বলতে গেলে একমাত্র মিলনদূত। হিন্দু মুসলমানকে ওরাই অন্তরের অন্তরালে মিলিয়েছে। নয়তো আমাদের ভাষা এক হলেও ভাবনা এক হত না। যদি না ইউরোপীয় শিক্ষায় মুসলমানের আগ্রহ জাগত। ততদিন হিন্দুরা অর্ধ শতকের পথ এগিয়ে রয়েছে।
খ্রীস্টধর্ম ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি একই বস্তু নয়। আধুনিক সভ্যতা তো নয়ই। বাংলার হিন্দুরা এটা ঊনবিংশ শতকের প্রথম পাদেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বাংলার মুসলমানেরা খ্রিস্টধর্মের ভয়ে আধুনিক ইউরোপীয় সংস্পর্শ পরিহার করেছিলেন। পরে সে ভ্রম সংশোধন করেন। হিন্দুরা সুলতানী ও বাদশাহী আমলেও হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন যে ইসলাম ধর্ম ও পারসিক সংস্কৃতি একই বস্তু নয়। অনেক হিন্দু পরিবারেই পারসিক শিক্ষার রেওয়াজ ছিল। কোনও কোনও পরিবারে তো পুরুষদের নামকরণই হত পারসিক ভাষায়। এখনও তার রেশ পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশের এক কায়স্থ ভদ্রলোকের নাম ইকবাল বখ্ত। তাঁর পিতার নাম খুশ্বখ্ত রায়। এরা তিন চার শতক পারসিক ভাষায় নামকরণ করে আসতেন। তবে শুধু পুরুষদের বেলা। পোশাক পরিচ্ছদও পুরুষদের বেলা পারসিক। উর্দু যে উত্তর ভারতের হিন্দুদেরও অন্যতম ভাষা একথা সকলেই জানেন। শিখদেরও। ইংরেজি যখন সরকারি ভাষা ছিল না পারসিক ভাষাই ছিল হিন্দু শিখ রাজ্যেরও সরকারি ভাষা।
ধর্মের সঙ্গে ভাষাকে অভিন্ন করার নীতি গ্রহণ করে মুসলিম লিগ যে সর্বনাশটা ডেকে আনে তার ফলে উর্দুভাষাকেই উত্তরভারতে হতমান হতে হল। উর্দুপ্রেমিক হিন্দুরা যদি তার পৃষ্ঠপোষক না হতেন, সে ভাষার বই কাগজ ক্রেতার অভাবে অর্ধেকও বিকোত না। পারসিক সম্বন্ধেও সেই কথা। বোলপুরের কাছে একটি হাইস্কুল আছে, সেখানকার হিন্দুর ছেলেরা এখনও ফারসি পড়ে, পড়ান মুর্শিদাবাদের এক মৌলবি সাহেব। ফারসির প্রতি এই অহেতুক প্রীতি ধর্মের ধার ধারে না। ছত্রিশ বছর আগে কুমারখালিতেও হিন্দুর ছেলেকে আমি ফারসি পড়তে দেখেছি। আরও আগে দেখেছি আমার হিন্দু সহপাঠীকে কলেজে ফারসি পড়তে। ফারসির উপর, উর্দুর উপর এই যে মমতা এটা চাকরির জন্যে নয়। আমার ছেলেবেলায় আমার ঠাকুমা আমাকে গোলেবকাওলির কাহিনি শোনাতেন। মনে মনে আমি পরীর রাজ্যে হানা দিতুম। ধর্ম এর মধ্যে কোথায়?
তবে ধর্মেও একটা বোঝাপড়া হয়েছিল। ঠাকুমার মানত ছিল আমি মহরমে লাঠি খেলব। আমারও সাধ ছিল আমি বাঘ সাজব। বাঘের নাচের স্টেপগুলো আমি এখনও জানি। নাচের বাজনাও ভুলে যাইনি। গোঁড়া মুসলমানরা মহরম পছন্দ করতেন না। আমরা কিন্তু মহরমের জন্যে দিন গুনতুম। বোখারী সাহেবকে মনে পড়ে। তিনি দিয়ে যেতেন সত্যপিরের সিন্নী। আনন্দে আস্বাদন করতুম। মুসলমানের ছোঁয়া বলে অপবিত্র মনে হত না। আতাহার মিঞার হালুয়ার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।
বড়ো হয়ে দেখেছি মুর্শিদাবাদ জেলায় কদম রসুল রক্ষা করছে ব্রাহ্মণ সেবায়েত। আর মেদিনীপুর শহরে পিরের দরগার চেরাগ জ্বালাবার ভার নিয়েছে হিন্দু মুরিদ। মুসলিম ফকিরদের হিন্দুরাও ভক্তি করে। মুসলমানদের পুণ্যতীর্থে হিন্দুরাও দলে দলে যায়। মানত করে। হিন্দুদের হাজার হাজার বছরের সংস্কার সাধু সন্তু দেখলেই তাঁদের সমাদর করতে হবে, ধর্মের বিচার করলে চলবে না। আবার সেই হিন্দুদেরই হাজার হাজার বছরের সংস্কার রোটি ও বেটির বেলা জাতের বিচার করতে হবে। এক হিন্দু অপর হিন্দুর সঙ্গে আহার করে না, বিবাহসম্পর্ক পাতায় না। এই দু-টি প্রশ্নে সমাজ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, তার সংহতি বলে কোনও পদার্থই নেই। প্রতিরোধ শক্তি মুসলমান বা ইংরেজ এসে কেড়ে নেয়নি। তাদের আসার অনেক আগে থেকেই প্রতিরোধশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছিল। ছয় শতাব্দী ধরে ভারত খণ্ড খণ্ড থাকার পর মুসলিম আমলেই আবার জোড়া লাগে। ইংরেজ আমলেই অখণ্ড হয়। ছয় শতাব্দী ধরে এই ইন্টিগ্রেশনের প্রক্রিয়া চলে।
হিন্দু মুসলিম বিরোধের বিভিন্ন কারণ। কিন্তু মূল কারণটা ইসলামবিদ্বেষ নয়, ম্লেচ্ছবিদ্বেষ। সেটা দু’হাজার বছর আগেও ছিল। যবনবিদ্বেষ। সেটা তারও আগে ছিল। প্রধানত আচার ও সংস্কার নিয়ে তীব্র মতভেদ। একের মতে যেটা শুচি অপরের মতে সেটা অশুচি। একের মতে যেটা নির্দোষ অপরের মতে সেটা নিষিদ্ধ । ইহুদিরা যাদের জেণ্টাইল বলে তাদের সঙ্গেও তো সেই একই বিরোধ। জেন্টাইলরা সভ্যতার শীর্ষে উঠলেও ইহুদিদের চোখে জেণ্টাইল বই তো নয়। খ্রিস্টানের সঙ্গে ইহুদির ধর্মগত বিভেদ কতটুকু? আদি খ্রিস্টানরা বরং ইহুদিদের সঙ্গে বিবাহাদি করত, কিন্তু খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত গ্রিকদের সঙ্গে কদাপি নয়। ধর্মের বিচারের চেয়ে জাতের বিচারটাই ছিল বড়ো। এ সমস্যার শিকড় মুসলিম আগমনের পূর্বেই এদেশের মাটিতে ছিল। মুসলিমবিদায়ের পরেও থাকবে।
ধর্মীয় বিদ্বেষটা মুসলমানদেরই দিক থেকে। মূর্তিপূজা তাঁরা সহ্য করবেন না। মূর্তিপূজা তাঁরা আরবদেশে বন্ধ করেছেন, ইরানে বন্ধ করেছেন, ভারতেই বা না করবেন কেন? আল্লাহ ভিন্ন অপর কোনও উপাস্য নেই, এই যখন তাঁদের ধর্মের প্রথম কথা তখন তেত্রিশ কোটি দেবদেবী কেন? পশুপাখি কেন? গাছপালা কেন? সমন্বয়ের প্রস্তাবে তাঁরা সম্মত নন। শেষ পর্যন্ত যে দেশভাগ হয়ে গেল সেটা কিন্তু ধর্মীয় বিদ্বেষের জন্যে নয়। আশা করা গেছল ইংরেজদের মতো ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয়রাও একটি নেশন হবে। জিন্নাসাহেবও তার অগ্রণী ছিলেন। কিন্তু তিনি মেজরিটিকে চাইলেন প্রকারান্তরে মাইনরিটিতে পরিণত করতে। নিদেনপক্ষে প্যারিটিতে রাজি করাতে। মেজরিটি নারাজ। অগত্যা দুই নেশন।
পাকিস্তানের হিন্দুদের তো তিনি মাইনরিটিতে পরিণত করলেনই, এবার তাঁর লক্ষ্য হল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মেজরিটিকে পাকিস্তানের ইসলামি রাষ্ট্রে মাইনরিটিতে পরিণত করা। ইসলামের ভাষা নাকি উর্দু। অতএব উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। ফলে পশ্চিমাদের হাতেই থাকবে সামরিক ও অসামরিক ক্ষমতার সিংহের ভাগ। সে চাল যখন ব্যর্থ হল তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের দ্বিতীয় চাল হল বাংলা উর্দুর প্যারিটি। এ চাল সফল হল, কিন্তু পরে দেখা গেল তৃতীয় এক চালে চূড়ান্ত ক্ষমতা চলে গেছে সামরিক একনায়কের হাতে। তিনি পশ্চিমের লোক, পশ্চিমের কোলেই ঝোল টানলেন। মুড়োটা পশ্চিমাদের, ল্যাজটা পুরবিয়াদের।
এক ডিকটেটর যান, আর-এক ডিকটেটর আসেন। ইয়াহিয়াকে মনে হয়েছিল বিসমার্কের মতো “অনেস্ট ব্রোকার”। এবার এক বিশিষ্ট ডিপ্লোমার্টের সঙ্গে খেতে বসে জিজ্ঞাসা করি, “মনটাকে প্যাশনমুক্ত করে বিচারকের মতো বলুন দেখি ইয়াহিয়া খান্ সম্বন্ধে আপনার রায় কী।” ইয়াহিয়াকে তিনি নিকট থেকে চিনতেন। তাঁর উত্তর, “ইয়াহিয়া লোকটা স্টুপিড। ভুট্টোর প্যাঁচ বুঝতে পারেননি। ওই তো যত নষ্টের গোড়া।”
আমি ইতিহাসের ছাত্র। ব্যক্তি গৌণ। শক্তিই মুখ্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বার বার বিড়ম্বিত হয়ে পণ করেছিল যে মেজরিটির প্রাপ্য অধিকার সে আদায় করবেই। অপরপক্ষে সামরিক ও অসামরিক ক্ষমতার পশ্চিমা মালিকদেরও ধনুর্ভঙ্গ পণ ব্যালান্স অফ পাওয়ার তাঁরা ছলে বলে কৌশলে স্বহস্তে রাখবেনই। ইসলামের তকমা এঁটে তাঁরা বাঙালিকে ভুলিয়ে রাখবেন। ইয়াহিয়া খান্ যদি শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করে সত্যি সত্যি ক্ষমতার হস্তান্তর করতেন তা হলে শেখ সাহেবও হয়ত ভুট্টোকে ক্ষমতার ভাগ দিয়ে ছয় দফা দাবি শেলফে তুলে রাখতেন। মেজরিটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে না, মাইনরিটিই করে। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটল পৃথিবীর ইতিহাসে। তার কারণ মাইনরিটিই ক্ষমতা দখল করে বসেছিল ও কোনও মতেই হাতছাড়া করত না। বাংলাদেশের বরাত ভালো যে তার দূরত্ব স্থলপথে দেড় হাজার মাইল, জলপথে তিন হাজার। কাছাকাছি হলে সে এক বছরেই স্বাধীন হতে পারত না।
এখন আবার সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলেছে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক শক্তিও সমান সক্রিয়। সাম্প্রদায়িকতাকে প্রবলতর হতে দিলে সে যে কেবল হিন্দুদেরই দেশছাড়া করবে তাই নয়, মুসলমানদের একটি বিপুল অংশকেও পরপারে পাঠাবে। হিন্দুরা বেঁচে থাকলে আবার একদিন ফিরবে, মুসলমানরা আর ফিরবে না। শহিদ মিনার, রাজার বাগ, ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণের গোরস্থান, রায়ের বাজারের বধ্যভূমি। সর্বত্র গেছি। কোথাও তারা ফিরে আসেনি। জন ব্রাউনের মতো তাদের আত্মা মার্চ করে চলেছে। মাথা নত করে প্রর্থনা করলুম।
বিবর্ণমুখে এক বন্ধু বললেন, “আমার নামটাই ছিল ওদের বধ্য তালিকায় পয়লা নম্বর। কেমন করে যে বেঁচে গেলুম জানিনে। আমার বাড়িতেই সেই মিটিং হয়েছিল যাতে আমরা সরকারি কর্মচারীরা সবাই অসহযোগের সংকল্প নিই।”
“বাঙালিকে দিয়েই ওরা বাঙালিকে মারিয়েছে। ঘরের শত্রু বিভীষণ।” বললেন অপর এক বন্ধু। “ছাত্ররাই অধ্যাপকদের স্তোক দিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেছে। চেনা জানা ছাত্র। অবিশ্বাস করবেন কী করে?”
এমনি কত সব কাহিনি। টেপ রেকর্ড করলে একখানা বই হয়। এ রকম শত শত বই হবে। কোনও এক কার্লাইল কোনও এক ডিকেন্সকে একগাড়ি বই দেবেন। আর নতুন ডিকেন্স সেসব বই মন দিয়ে পড়ে তারই অন্তঃসার নিয়ে নতুন একখানি “এ টেল অফ টু সিটিজ” লিখবেন। কলকাতা আর ঢাকা। কলকাতায় ছিল মুজিবনগর। এইখান থেকেই পরিচালিত হত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার। ওপার থেকে রিপোর্ট আসত এপারে। বুদ্ধিজীবীরা এপারে এলে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেতেন।
আমার বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের মুখে সেই একটি বছরের ছায়া এখনও আঁকা রয়েছে। তাঁরা একটুতেই চমকে ওঠেন। হোটেলে বসে বেশ গল্প চলছিল। হঠাৎ গুলির আওয়াজ। তাঁদের মুখ শুকিয়ে যায়। টেররিজমকেই তাঁদের ভয়। নীচে নেমে দেখি হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে একরাশ লোক হোটেলের লবিতে। একজনকে বলতে শোনা গেল “স্টেনগান”। ঢাকায় ওসব এখন জলভাত হয়ে গেছে। ঘটনাগুলোর কোনোটা পলিটিকাল, কোনোটা নিছক ক্রাইম। দু’রাত্রি গাড়ি করে রাত্রে বেরিয়েছি, যদিও বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছিলেন না বেরোতে। একদিন যাঁর সঙ্গে বেরিয়েছিলুম তিনি ভয়ে ভয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হাইজ্যাকিং-এর ভয়।
এই পঁচিশ বছরে একটি এলিট শ্রেণির বিকাশ হয়েছে। সবাই মুসলমান। কিন্তু সবাই সাম্প্রদায়িক নন। যাঁরা মনে প্রাণে সেকুলার তাঁদেরই ভয় বেশি। স্বধর্মীদের হাত থেকে। তা ছাড়া তাঁদের গাড়ি আছে বাড়ি আছে টাকা আছে পদমর্যাদা আছে বলে বামপন্থীদেরও তাঁরা চক্ষুশূল। শুনলুম মাসে দু’হাজার টাকার বেশি কাউকে দেওয়া হয় না। সরকারি চাকরিতে যাঁদের আয় ছিল তিন চার হাজার তাঁদের আয় এখন দু’হাজার। সওদাগরি প্রতিষ্ঠানে যাঁদের আয় ছিল চার পাঁচহাজার তাঁদের আয় এখন দু’হাজার। পাবলিক সেকটরে। তবে যাঁরা প্রাইভেট বিজনেস করেন তাঁদের উপার্জনের বিভিন্ন সূত্র থেকে তাঁরা আরও বেশি পান।
প্রচুর নতুন বই দেখলুম। ঢাকা থেকে দশখানা বাংলা ও তিনখানা ইংরেজি দৈনিক বেরোয়। চট্টগ্রাম থেকে যথাক্রমে ন’খানা ও তিনখানা। বগুড়া তো ক্ষুদ্রতম জেলা। সেখান থেকে একখানা বাংলা দৈনিক। কৃষি ইঞ্জিনিয়ারিং সমেত গোটা ছ-সাত বিশ্ববিদ্যালয়। অজস্র স্কুল কলেজ। পাইকারিভাবে পরীক্ষায় নকলও চলে। বাইরে থেকে দল বেঁধে লোকজন এসে প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে যায়। কার সাধ্য বাধা দেয়।
স্বাধীনতা বলতে কি সব প্রশ্নের উত্তর বোঝায়? কত রকম নতুন নতুন প্রশ্ন উঠছে। উত্তর দেবে কে? বুদ্ধিজীবীদেরও বুদ্ধিতে কুলোয় না। মন্ত্রীরা কি সবজান্তা? না সর্বশক্তিমান? সামরিক একনায়কত্বের পতনের পর কেয়স দেখা দেয়নি, আইন ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েনি, এটা কি কম কৃতিত্ব? আমাদের পুলিশ আছে, ওদের পুলিশের একটা বৃহৎ অংশ নিহত। আমাদের পুলিশ ব্যর্থ হলে সি আর পি আছে। ওদের সি আর পি নেই। থাকলে ইসলামাবাদে। আমাদের সি আর পি ব্যর্থ হলে আর্মি আছে। ওদের সেরা রেজিমেন্টগুলো পাকিস্তানে বন্দি। বলতে গেলে বিনা সৈন্যদলেই কাজ চালাতে হচ্ছে। আমাদের রাজ্যের প্রশাসকরা অভিজ্ঞ। ওদের অভিজ্ঞ প্রশাসক যাঁরা তাঁদের বৃহত্তর অংশই পাকিস্তানে আটক। বলতে গেলে বিনা অভিজ্ঞতাতেই প্রশাসন চালাতে হচ্ছে। এ কি কম কৃতিত্ব ?
যে সরকারের পেছনে সামরিক শক্তি নেই তার থাকবার মধ্যে আছে নৈতিক শক্তি ও অথরিটি। তাই দিয়ে সে দেশ চালিয়ে যাচ্ছে দেখে আশ্চর্য হতে হয়। পৃথিবীতে এরকম নিরস্ত্র সরকার আর একটিও আছে কি না সন্দেহ। সশস্ত্র আক্রমণের সম্মুখীন হলে জাগ্রত জনগণই এর একমাত্র ভরসা। তারা যে হাতিয়ার হাতে পাবে তাই দিয়ে শত্রুকে রুখবে। গেরিলা যুদ্ধই বাংলাদেশের শেষ অবলম্বন। যদি না ভারত সৈন্য পাঠায়। কেউ সেটা চায়ও না। না ডাকলে ভারতও যাবে না। আক্রান্ত না হলে ভারত যেতও না গতবার।
সশস্ত্র বিপ্লব ঘটলে একই কথা। সরকার তখন পুলিশ ও মিলিশিয়া দিয়ে সে জলতরঙ্গ রোধ করতে পারবেন না। জনগণকে ডাকলে তারাই রোধ করবে। কারণ এ সরকার জনগণেরই সরকার। এমন যে জনগণ তাকে যারা ধর্মের নামে ঘুম পাড়ায় বা ছিন্নভিন্ন করে তারা কি জনগণের বন্ধু? জনগণকে অবিভক্ত রাখতেই হবে। তারা হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়, তারা বাঙালি ও তারা যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটার। সংবিধানে তাদের হাতেই চূড়ান্ত ক্ষমতা। সামনের নির্বাচনে তারা তাদের সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।
অপোজিশন একটা থাকবেই, থাকা উচিতও। মনে হয় একটা নয়, দুটো অপোজিশন। একটা সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিণপন্থী। অন্যটা অসাম্প্রদায়িক ও বামপন্থী। সরকার বেছে নিয়েছেন মধ্যপন্থা ও অসাম্প্রদায়িকতা। ভারতেরই মতো। সেইজন্যে ভারতের সঙ্গে সরকারি মহলের এত বনিবনা। অপোজিশন তো ভারতবিরোধী প্রচারণা চালাবেই। এক বন্ধু আমাকে বুঝিয়ে বললেন যে ভারতবিরোধিতা হিন্দুবিরোধিতা নয়। বামপন্থীরা হিন্দুবিরোধী নয়। যারা হিন্দুবিরোধী তারা সরকারবিরোধী তথা অসাম্প্রদায়িক মুসলিমদেরও বিরোধী।
যাদের সঙ্গে দেখা হলে খুশি হতুম তাঁদের অনেকেই আটকা পড়ে আছেন পাকিস্তানে। তাঁদের কথা জিজ্ঞাসা করলে তাঁদের আত্মীয়দের মুখ অন্ধকার। তাঁরা কেমন আছেন, কোথায় আছেন, কবে ফিরবেন এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁরা সঠিক জানেন না। চিঠিপত্র পান না, কিংবা পেলেও অনিয়মিত পান। হয়তো লন্ডন ঘুরে রেডক্রশের সৌজন্যে। একটা দেশ যে তার নিজের ন্যাশনালদের সঙ্গে বহিঃশত্রুর মতো ব্যবহার করতে পারে এর নজির কি পৃথিবীর ইতিহাসে আছে? পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে চেষ্টা করলে কী হয় তাও শোনা গেল। সহায়করাই পথে সর্বস্বান্ত করে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়। তারপর কাবুলে গিয়ে বিমানের প্রতীক্ষা। হপ্তায় একবার বিমান ছাড়ে। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোটো সে তরি। কাবুলে পড়ে থাকতে হয় অনির্দিষ্টকাল। শুনে আনন্দ হল যে বিমানভাড়া ভারত সরকার বহন করেন দিল্লি পর্যন্ত। তারপর রেলভাড়া বাবদ পঞ্চাশ টাকা ধরে দেন। রাজস্থানের পথেও কেউ কেউ ফিরেছেন।
পাকিস্তান যাঁরা হাসিল করেছিলেন তাঁরা চেয়েছিলেন মুসলমানদের জন্যে নিজস্ব একটি বাসভূমি। এখন নিজ বাসভূমিতেই তাঁরা প্রকারান্তারে যুদ্ধবন্দি। যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গেই তাঁদের বিনিময় করা হবে। তারপরেও কি কয়েক লাখ আটক থাকবেন না? পাকিস্তানের বারগেনিং পাওয়ার বলতে ও ছাড়া আর কী আছে? পাকিস্তানি বণিকদের প্রচুর মুলধন ও প্রভূত সম্পত্তি আটক হয়েছে বাংলাদেশে। অবিভক্ত পাকিস্তানের বৈদেশিক দায়দায়িত্বের প্রশ্নও আছে। আন্তর্জাতিক চুক্তির হাত থেকে একতরফা অব্যাহতি অত সহজ নয়। তাছাড়া বিহারিদের ভবিষ্যৎ, উর্দুর ভবিষ্যৎ এসব প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে বাসভূমির মোহে ওরা ভারত ছেড়ে এসেছিল সে বাসভূমিতে ওরা অনধিকারী হলে ওদেরও তো একভাবে না হোক আর-একভাবে ক্ষতিপূরণ চাই।
বন্ধুবান্ধবদের আশ্বাস দিই, “সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা হয়ে চুকেছে।” আমি নিজেও বিশ্বাস করি তাই। ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অঘটিত হবে না। বাংলার লোকের গণতন্ত্র অঘটিত হবে না। অঘটিত হলে হতে পারে সমাজতন্ত্র, যদিও তার সম্ভাবনা কম। যেটার সম্ভাবনা বেশি সেটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সেটব্যাক। যেমন তুরস্কে হয়েছে, মিশরেও হয়েছে। কামালের পরে, নাসেরের পরে। মুজিবের পরেও যদি তেমন কিছু হয় তবে দুঃখের বিষয় হবে। কলকাতার মতো ঢাকা আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার দান নয়। মধ্যযুগীয় মুসলিম সভ্যতার দান। এর সর্বত্র আরব পারসিক শৈলীর মসজিদ ও ইমারত। যে দেশের রাজধানী সে দেশেরও শতকরা নব্বই জন মুসলমান। স্বাধীনতা বলতে প্রতিক্রিয়াশীলতার স্বাধীনতাও বোঝায়।
হিন্দু মুসলমানের বলপরীক্ষা শেষবারের মতো শেষ হয়েছে। বাঙালি পশ্চিমার বলপরীক্ষাও চূড়ান্তভাবে সমাপ্ত হয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। আমরা এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে এখনও অনেক দেরি। যারা যুদ্ধে হেরে গেছে, তারা কূটনীতিতে জিতবে আশা করেছে। বড়ো বড়ো ঘুঘু রয়েছে পেছনে। ভারতের লোক ধৈর্য ধরতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের লোকের অভাব এত বেশি যে তারা অধীর হয়ে কী যে করে বসে বলা যায় না। পরিস্থিতিটা সাম্প্রদায়িক কলহের মোড় নিতেও পারে। শ্রেণিদ্বন্দ্বের মোড় নিতেও পারে। যে মোড়ই নিক না কেন কতক হিন্দুর উপর উৎপাত বিচিত্র নয়, তারা পৌত্তলিক বলেই হোক বা ধনিক বলেই হোক। ধর্ম আর অর্থ এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে কারণটা অনেক সময় উপর থেকে বা দূর থেকে বোঝা যায় না। আমার বন্ধুরা যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কেউ অপ্রিয়তার ঝুঁকি, কেউ বিপদের ঝুঁকি। ভরসার কথা এই যে দেশের নেতারা কড়া হাতে শাসন করছেন। তাঁরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে নির্বাচনের বলপরীক্ষাতেও তাঁদেরই জিত হবে।
দেশ এমনভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, অর্থনীতি এমনভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে যে পুনর্গঠন সময়সাপেক্ষ। দু’পক্ষই পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেছে। ভাঙতে যত সময় লেগেছে গড়তে তার চেয়ে বেশি সময় লাগবেই। অথচ সাধারণ মানুষ এপারেও যেমন ওপারেও তেমনি। গঠনের কাজে অমনোযোগী। ওদের জন্যে আসমান থেকে নেমে কেউ একজন বা একদল গড়ে দিয়ে যাবে। বাইরে থেকে সাহায্য নিতে নিতে আমাদেরই মতো ওরাও পরনির্ভর হয়ে গেছে। অথচ গণতন্ত্র জোর খাটাতেও পারে না। জোরের বদলে করে মুদ্রাস্ফীতি। তার পরিণাম মূল্যবৃদ্ধি। এপারের চেয়ে ওপারে চতুর্গুণ মূল্য। আমরাও যে ধুঁকছি এটা ওরা দেখতে পাচ্ছে না। কারণ ওদের ধুঁকুনিটাই বেশি। ফলে ঈর্ষা।
পরস্পরকে চেনা, পরস্পরকে জানা, পরস্পরকে বোঝা, পরস্পরকে বোঝানো, পরস্পরের সঙ্গে ভাববিনিময় এসব কাজ রাজনীতিকদের উপর বা আমলাদের উপর ছেড়ে দেবার নয়। বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদেরই এ ভার নিতে হবে। কিন্তু প্রচারক হিসাবে নয়। দুই পারেই সংস্কৃতিকেন্দ্র খুলতে হবে, ভারতেরটা ঢাকায়, বাংলাদেশেরটা কলকাতায়। যেমন জার্মানদের ম্যাক্সমুয়েলার ভবন। পাশ্চাত্য সংগীতের জন্যে আমরা ওখানে যাই। জার্মানিকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। বিশিষ্ট গুণীদের গানবাজনা শুনি। তাছাড়া ঢাকার বাংলা অ্যাকাডেমির অনুরূপ প্রতিষ্ঠান কলকাতায় স্থাপন করতে হবে। ওটি অদ্বিতীয়।
ঢাকার বন্ধুরা আমাদের এমন খাওন খাওয়ালেন যে মনে হল খাওনের জন্যেই যাওন। তার সঙ্গে ছিল ভালোবাসার আস্বাদন। সে যেন ফুরোবার নয়।
(রচনাকাল : ১৯৭৩)
[কৃতজ্ঞতা : পুনশ্চ প্রকাশনী]