ভাঙা দেশ, স্মৃতির ফ্ল্যাটবাড়ি

সাধন চট্টোপাধ্যায়

স্মৃতির আকাশ ঠেলতে ঠেলতে কত পেছনে যেতে পার, রোহিত?

বল্লাম, মহাত্মা গান্ধির হত্যার দিন অবধি।

সেতো ১৯৪৮ এর ৩০ জানুয়ারি?

হ্যাঁ, তখন আমরা বরিশাল শহরের মধ্যে কোনও একটা বাসায় থাকি। অস্থায়ী ভাড়াটে।

কেন? তোমরা তো শোলনা গ্রামের মানুষ?

রোহিত শুনে নীরব। রহস্যময় মিচকি হাসি শুধু। এখন সে আটাত্তুরে বুড়ো। আটাত্তরে পড়ল সবে। ‘আটাত্তুরে’ বললে যা বোঝায়, তাই কি? চুলে পাক ধরেনি। সোজা হাঁটে। রোজ তিন-চার কিলোমিটার অনায়াসে চলাচল করতে সক্ষম। ফিটফাট থাকলে ভালই লাগে দেখতে। চরৈবেতি মন্ত্রটি খুবই প্রিয় তার। হ্যাঁ, শোলনা আমাদের গ্রামের নাম। প্রায় পাঁচ পুরুষের ভিটে। বরিশাল শহরের কাছেই কাশিপুর, কাশিপুর হয়ে মাধবপাশা জমিদারদের আওতায় শোলনা গ্রাম। মাধবপাশার জমিদারদের খুব নামডাক। ওখানেই আছে দুর্গাসাগর। কিংবদন্তী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার তাঁর মাকে বলেছিলেন, যতখানি পথ তুমি হেঁটে যেতে পারবে, আমি সেই তক মাটি কেটে সাগর বানিয়ে দেব।

নাম হল দুর্গাসাগর। ওখানে নাকি ‘মাইট’ আছে শেকলবাঁধা। গুপ্তধনে ভরতি। মাইটগুলো নাকি চলাফেলা করত জলের তলায়। বহু মানুষ লোভে মাইটের গুপ্তধন চুরি করতে গিয়ে দুর্গাসাগরে ডুবে মরেছে। কিংবদন্তী কিনা জানি না।

ঐ-মাধবপাশার কাছেই ধুলো আর কাদার রাস্তায় কয়েক মাইল হেঁটে গেলে শোলনা গ্রাম। হ্যাঁ, আমাদের পাঁচ পুরুষের ভিটে।

এক রাতে, পার্টিশনের পর, একপোশাকে শুনেছি আমাদের পালাতে হয়েছিল। নইলে নাকি বাবা খুন হয়ে যেতেন।

কী রকম?

রোহিত শান্ত, রহস্যভরা চোখ দু-টি সুদূরে ঠেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।

বলে, আগে গান্ধিজির হত্যার দিনটির কথা বলে নেই। অবশ্য ‘বলা’ শব্দটি দিয়ে কোনও নিখুঁত বর্ণনা বোঝাচ্ছিল না। তখন আমার বয়স কত? সবে চার ছাড়িয়েছি। যদিও কুষ্ঠির বয়সে সেকালে, ইদানীংকালের মতো হুবহু দিন ক্ষণ থাকত না, ছমাস একবছরের গরমিল হত, তা ধরলেও আমার বয়স পাঁচ। এতদিন পর, কি অঙ্কের হিসেবে স্মৃতি জেগে থাকতে পারে? বড়োজোর, টুকরো টুকরো কয়েকটি দৃশ্য, মানুষের আবছা কিছু মুখ, কোনও ঘ্রাণ কিংবা মেঘবিদুড়ির পর চোখের মধ্যে ধরা যেমন থাকে অনেকক্ষণ — আমারও সেদিনটার কথার তেমনই নিভন্ত কিছু স্মৃতি আছে।

বরিশাল শহরের ভাড়া বাড়িটার দেয়ালগুলো পুরনো, পলেস্তেরার গায়ে শ্যাওলা একটু-আধটু। আমরা রাস্তা লাগোয়া বারান্দায় পাশাপাশি বসে। আমি এবং আমার বড়ো বৌদি। আমাদের যৌথ পরিবার। বাবারা চার ভাই। বড়ো জ্যাঠা, মেজ জ্যাঠা, সেজ জ্যাঠা এবং সর্বকনিষ্ঠ আমার বাবা। বড়ো জ্যাঠা ছিলেন ঠাকুরদার প্রথম পক্ষের। ঠাকুরদা দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেছিলেন। দ্বিতীয় পক্ষের, মেজো, সেজো এবং বাবা। হ্যাঁ, প্রথম পক্ষের এক কন্যা ছিল এবং দ্বিতীয় পক্ষেরও একজন। দুজনই অল্প বয়সে বিধবা হতে, ঠাকুরদা তাদের স্বামীদের সংসারে বিধবা দাসী হয়ে থাকতে দেননি। নিজের সংসারে সন্তানদি সহ দুই মেয়েকে এনে রেখেছিলেন। কিন্তু যৌথ সংসার এবং সম্পর্কের ফেভিকল দেখে কে বলবে, ভাই-বোন তারা একমাত্রায় নয়? যাক্‌গে, বড়ো জ্যাঠার বড়ো ছেলে শ্যামাপ্রসাদ সবে বিয়ে করেছে। পার্টিশনের কয়েক মাস আগে, বড়ো জোর বছর খানেক। বউ খুবই সুন্দরী। পাশে বসে ফুলতেলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। ফর্সা, পানপাতার মতো মুখ, সর্বদা হেসে কথা বলে। কি মস্ত বড়ো খোঁপা! আমি বৌদির খুট ছাড়িনা। তো, আমরা সেদিন বারান্দায় খোলা দরজার সামনে বসেছিলাম। আমি বৌদির বাঁ মুঠোটি তুলে নিয়ে সোনার আংটির ঝিলিকটি বিস্ময়ে লক্ষ করছিলাম।

কে যেন দরজার সুমুখ দিয়ে, ছায়ার মতো যেতে যেতে বলে উঠল, উনুন চড়াওনি এখনও?

পুস্প বৌদির অভ্যেস হেসে সকলের কথার জবাব দেয়া। হাসলে বৌদিকে দেখতে আরও ভালো লাগে। চোখের কোলের কালিটুকুর মধ্যে লাল শাড়ি ও উজ্জ্বল দাঁতের কপাটি অপরূপ একটি বৈপরীত্য তৈরি করে। বৌদি বল্লে, আজ অরন্ধন আমাদের!

কেন?

কাল গান্ধিজি খুন হয়েছেন।

চোখ বুজলে, এতটা বয়সে এসেও দেখতে পাই, বাইরে প্রচুর আলো-রোদ্দুর। রাস্তাটার ওপাশেই একটা চওড়া খালের মতো নদী — কীর্তন খোলা, তার ওপারে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর আগুনের শিখা। অনেক্ষণ ধরেই জ্বলছিল। ছোটো ছোটো লোকজনের চলা ফেরা চোখে পড়ছিল। কিছু আগেই বৌদি আমায় বলছিল ওটা নাকি মড়কখোলা।

মড়কখোলা কি, সে মুহূর্তে বুঝিনি। তবে, মড়কখোলা শব্দটির মধ্যে ঐ-বয়সেও একটু রহস্যের ছোঁয়া পাচ্ছিলাম। পড়ে, জেনেছি, শ্মশান।

রাতারাতি, প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বরিশালে ওঠার দলে কারা কারা ছিলে তোমরা, রোহিত?

আমি বললাম তালে তো আগেভাগে একটু শোলনা গ্রাম, আমাদের শরিক সদস্য এবং প্রাত্যহিক কিছু চালচিত্রের সুদূর স্মৃতির রংতুলি আঁকা ছবিটা তুলে ধরতে হয়। তারপর আমাদের যৌথ পরিবার, প্রাণভয়ে বাবার পালানোর পটভূমি এবং তজ্জন্য আমাদের পরিবারে ন’বছর বয়সে বিয়ে হয়ে আসা, আমার সেজো জ্যাঠাইমার তীব্র অভিমান, যা ওপারে গিয়ে বাবা পুষিয়ে দেয়ার জন্য একটি অনিকেত জীবন বেছে নিয়েছিলেন,— ছবিগুলো অপটু হাতে এঁকে যেতে হয়।

আমাদের পাঁচ পুরুষের মধ্যে আমি চার পুরুষ অবধি নাম মনে রেখেছি। রামচন্দ্র, তার দুই পুত্র বরদাকান্ত ও হারান এবং বরদাকান্তর চার পুত্র — আমার বাবা ও তিন জ্যাঠা। কিন্তু রামচন্দ্রেরও তো ভাই থাকতে পারে। ‘থাকতে পারে’ না, অবশ্যই ছিল। মহল্লায় ছিল পাঁচ বাড়ি এক উঠোন। উঠোন ঘিরেই পাঁচ বাড়ি। ঠিকঠিক উঠোনও বলা যাবে না, দলে সাতজন করে প্লেয়ার নিয়ে ফুটবল খেলা যায়। আমাদেরটা উত্তরে ছিল বলে, বলা হত উত্তরের বড়ো বাড়ি। কাঠের মস্ত দোতলা ঘর। দোতলার ঘরে বাবাকে মধ্যাহ্নভোজনের পর বিছনায় ঘুমোতে দেখতাম। অতিরিক্ত আরামের জন্য একটা তাকিয়ার ওপর পাজোড়া স্থাপন করে রাখতেন। এ-ঘরে এসে দাঁড়ালে খোলা জানলা দিয়ে দেখা যেত মাঝারি সাইজের পুকুর — উত্তরের পুকুর বলত সবাই — ওপারে জঙ্গল, তা ছাড়িয়ে একটা রাস্তা— সিংহ বাড়ি, বোসবাড়ি নামের সম্ভ্রান্ত কায়স্থদের বাড়ি যাবার পথ — টপকে আরও ওপাশে বিজন দিঘি, চলতি নাম বড়োপুকুর — তার ধারে তিন-দরমা বেড়ার পাঠশালা। চলতি কথায় কৃপানাথের পাঠশালা। পরে শুনেছি, আমাকে নাকি তিন বছর বয়সেই ঐ-কৃপানাথের পাঠশালায় দেয়া হয়েছিল কিছুদিনের জন্য।

ঐ-পাঠশালা যাওয়ার পথ? আবছা মনে পড়ছে, আমাদের বারোয়ারি উঠোনটার এক কোণ ধরে খানিক গেলেই উত্তরের পুকুরটার পাশ দিয়ে এগুলেই একটা টিনের ছোটো ঘর। বলা হত, আমাদের কাছারি ঘর। সামনেই মস্ত একটা হরিতকি গাছ। সেটা পেরিয়ে, এবড়ো-খেবড়ো ধুলোর একটা রাস্তা, বর্ষায় যা ভ্যাদোর কাদায় থমথমে হয়ে থাকত, ধরে খানিকটা এগোলে বড়ো পুকুরের পাড়ে পাঠশালাটা।

ওমা! কত আর ব্যাখ্যা দেব আপনাকে? রোহিত মনে মনে ভাবে। কাছারি ঘর নিয়ে তো কিছু বলা হল না। আমরা কি জমিদার ছিলাম? মোটেই নয়। জমিদার তো থাকতেন মাধবপাশায়। তবে, সে-কালের ভূমি ব্যবস্থায়, প্রজা-থাক্‌ অনুসারে, আমাদের দু-ঘর প্রজা বসানো ছিল। আবছা মনে পড়ে, দিদি, জ্যাঠিমা, পিসিমারা তাদের বলতো ভুঁইমালি। আমাদের পারিবারিক উৎসবে অনুষ্ঠানে তারা — তাদের বউ-ছেলেমেয়েদের বিনে পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হত। এ-সব বড়োদের কথা পরে শুনেছি। তবে, ঐ ছোটো বয়সে আমার একটি দৃশ্যের কথা আজও চোখে ধরা আছে।

আমাদের পাঁচ শরিকের সকলেরই মাটির উঁচু বারান্দা — দেশের ভাষায় বলতাম ‘হাইতনা’ — নামলেই মস্ত উঠোন। প্রতিদিন যার যার অংশে ঝাঁটমারা, গোবরজল লেপা হত বলে, সর্বদাই ঝলমলে। তো, একদিন আমাদের দাওয়া-সংলগ্ন উঠোনে মঙ্গল ভুঁইমালিকে কী উপলক্ষ্যে মনে নেই, খেতে দেওয়া হয়েছিল। ওদের ডেকে ঘরে খেতে বসানো নিয়ম ছিল না, এমন কি বারান্দায় বসানোরও শাস্ত্রসম্মত জাত-পরিচয় থাকা প্রয়োজন ছিল। না হলে, ঐ উঠোন। মুসলমানরা আমাদের অন্ন গ্রহণ করত না।

তো, আমার কৌতুহল ছোট্ট থাকতেই। পিসিমা কিংবা জ্যাঠাইমার তিরস্কার বহুবার শুনতে হত। তো, মঙ্গলের খাওয়া দেখতে দেখতে আমি কেমন আনন্দ পেতেম। আজও মনে পড়ছে, একদম শেষে একস্তূপ ভাতের মধ্যে ছোটো এক বাটি দুধ ঢেলে, চটকে মেখে, এক দলা লবন ফেলে হাপ-হুপ খেয়ে ফেলল। শেষে এঁটো স্থান গোবর-ন্যাতায় নেতায় ভালো করে লিপে, উচ্ছিষ্ট পাতাটা নিয়ে চলে গেল। গোবরের লেপ তখন প্রায় শুকিয়ে উঠছে, হঠাৎ সেজো জ্যাঠাইমার মেজো মেয়ে — আমার গায়ত্রী দিদি শ্যেন দৃষ্টিতে একটি অন্নের কণা দেখতে পেয়ে, জ্যাঠাইমাকে জানাতেই, বাড়ি জুড়ে হইচই। বিষম বিঘ্ন ঘটে গেছে যেন। বাড়ির কে যেন দৌড়ে গেল, প্রায় ঘাড় ধরে মঙ্গলকে ডাকা হল, অপরাধী সেজে মঙ্গল যেন পরিষ্কার করে হাসতে হাসতে চলে গেলে। আমি ফ্যাল ফ্যাল চোখে, জ্যাঠাইমাকে বললাম, একটা ভাতে কি হইয়েছে?

জ্যাঠাইমা বলে, জাননা তুই। দুধে লবন দিলে, গো-মাংস তুল্য হয়? ঐ ভাতটায় পা-দিয়া দাওয়ায় ওঠলে, সব্বনাশ! আমি কিছুই না বুঝে হাঁ করে ছিলাম।

মস্ত একফালি উঠোনটার কোণে কোণে মাটির উনুন করা হত। শুনেছি, বয়স্করা উনুনকে বলত ‘আহাল’। ওই সব ‘আহালে’ যার যার ঘরের ধানসিদ্ধ হত, পাটি পেতে সেদ্ধ ধান শোকাতে দেওয়া হত। কখনও কোথাও ছেলে-ছোকরারা ‘ডাং সুপুরি’ খেলত। আমি ‘দুধ ভাত’ হয়ে বসে দেখতাম। ‘ডাং-সুপুরি’ খেলা হল, একখণ্ড বাঁশকে উঠোনে শুইয়ে রেখে, সিঁদুররঙা পাকা সুপুরি গোটা দশেক বসানো হত, দূর থেকে একটা মুগুর ছুঁড়ে, যে-কটা সুপুরি ছিটকে ফেলা যেত — সেগুলো তার। এ-টুকুই আজ আবছা চোখে ভাসছে, খেলায় আরও কিছু নিয়ম থাকলেও, আজ আর মনে নেই।

আর বিকেল ঘন হয়ে এলে কয়েকজন কিশোরী ঘাস-জঙ্গল ছিঁড়ে স্তূপাকৃত করে চার পাশে নাচতে নাচতে এক ধরনের খেলা খেলত। এখানে আমি দুধ-ভাত হতাম না। ডাং-সুপুরির দাদারা আমাকে মিছে দুধ-ভাতের দলে ফেললেও, এখানে আমার গাল টিপে, আদর করে সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচার দলে দিদিরা উৎসাহ বোধ করত। তবে, মেয়েরা যার যার ঘরের কাজকম্ম না সেরে বেরতে পারত না।

বিকেল ঢলে পড়ত। আম, কাঁঠাল, বাঁশবনের ছায়ার আড়ালে রোদ চলে যেত, অন্ধকার অন্ধকার চারদিক। তখন নাকে একপ্রকার ঘ্রাণ পেতাম— অনেকটা জংলি গন্ধ। আজও চোখ বুঝলে টের পাই। একে দিদিরা বলত ‘ঘুর-ঘুর’ খেলা। মাঝে মাঝে ওরা আমার সঙ্গে দুষ্টুমিও করত। একস্তূপ ঘাসের চার পাশে ঘুরে ঘুরে, হঠাৎ ‘ঐ আলির মা আসছে’ বলে যে-যার ঘরের দিকে দৌড়। আমি ভয় কেঁদে ফেলতাম। কে আলির মা — সঠিক জানতাম না। জ্যাঠাইমা শুনে বলেছিল, শেখ পাড়ার এক মহিলা। একমাত্র সরল আলি অজানা জ্বরে মরার পর, মহিলার মাথাটা নাকি বিগড়ে গিয়ে, মাঝে মধ্যে হিন্দু পাড়ায় বিকেল-সন্ধ্যা-রাতে হাজির হত।

হাসত, কাঁদত — কারও ক্ষতি করতনা। জ্যাঠাইমা বলত, আলির মা-এর নাকি পাঁচ সন্তান। চারজন আগেই কলেরা-বসন্ত নানা রোগে মরবার পর, আলি টিঁকেছিল। তার শোক আর মা হয়ে নিতে পারেনি।

শোলনা শুনেছি বড়ো গ্রাম। শেখ পাড়া, নমঃশুদ্দুরদের পাড়া, হিন্দু পাড়া হিসেবে মুখে মুখে নির্ধারণ থাকত। হিন্দু পাড়া আবার বাড়ি হিসেবে নির্ধারিত। যেমন সিংহ বাড়ি, বোস বাড়ি, পৈতাণ্ড (পুতুতুণ্ডু) বাড়ি, পুরোহিত বাড়ি ইত্যাদি। আমাদেরটা ছিল যেমন বড়ো বাড়ি। ধূ ধূ মনে পড়ে, জ্যাঠাইমা একবার আমি হাঁটতে শেখার পর পুরোহিত বাড়ি নিয়ে গেছল। সে-সব আজ আর খুঁটিয়ে মনে নেই। তবে, চোখ বুজলে দেখতে পাই, ঝোপঝাড়, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু মাটির পথ, দু-পাশে বেতবন। শোলনা গ্রামে খুব বেতের ঝোপ ছিল। তীক্ষ্ণ কাঁটা গায়ে। শুনেছি, বেতের নাকি ফল হয় আর সরু ডগা (চলতি কথায় মুইন ডগা) কেটে বিধবারা রান্নায় চমৎকার একপ্রকার পদ তৈরি করত। বাড়ির সকলের রান্নার সঙ্গে বিধবাদের রান্না হত না। ওদের রান্নাঘরটা মূল ঘরের বাইরে ভিন্ন একটা চালার মধ্যে হত। বলা হত বিধবাদের ‘ওস্যাখানা’। সারাদিনের খাটাখাটনির পর, চান করে কাঠের উনুনে পরিবারের বিধবারা একত্রিত হয়ে রান্না করত। শাকপাতা, কচু, বেতের ডগা, মেটে আলু, কচুর হলদে ফুল, বড়ি, ডালবাটা— নানা পদ তৈরি হত। সবার সঙ্গে মেশানো হত খানিকটা কোরা নারকোল। কোনও একটা পদ বিশেষ সুস্বাদু হলে, ছেলেমেয়েদের জন্য সস্নেহে পাঠিয়ে দেয়া হত।

কোনও কোনও দিন ঐ-ঘুরঘুর খেলতে খেলতে, হঠাৎ দেখতাম মা, গায়ত্রী দিদি, কখনও বাবার কাকা হারানচন্দ্রদের বাড়ি থেকে, প্রায় ছ’সাতজন কাঁখে পেতলের কলসি নিয়ে জল আনতে চলেছে। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ পেতলের কলসির শরীরে ছিলিক তুলছে।

বিকেল গড়িয়ে গেলে এই কলসি কাঁখে জল আনাটা ছিল খুবই মজার ও আনন্দের। রোহিত ছোটোবেলায় ছিল মোটাসোটা নাদুসনুদুস। দু-একবার ঘুরঘুর খেলতে খেলতে, ছুটে চলে আসত ঐ জল আনার দলে। কখনও গায়ত্রী কপট বকা দিয়ে বলত, যা বাড়ি যা। …. হাঁটতে পারবি তুই?

আমি করুণ মুখে মাথা কাৎ করতেই, শরিকবাড়ির কেউ হয়ত বলে উঠত, আহা বকো কেন? সঙ্গে থাকুক না ঠাকুরঝি!

গায়ত্রী দি মাকে বলত, কাকি, রোহিত যাবে? হাঁটতে পারবে?

মায়ের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হতেই, গায়ত্রীদি আদরে কলসটা হাতে ঝুলিয়ে আমাকে কাঁখে তুলতেই, মা বলত, ছাইরা দে তুই! …. ও হাঁটতে পারবে!

আমি তখন গায়ত্রী দিদির হাত ধরে ছোটো ছোটো পায়ে ধুলোর সরু পথ ধরে জল আনার দলটির সঙ্গে চলতে থাকি। আমার পরনে সামান্য একটা ইজের প্যান্ট। উদলা শরীর। শুনেছি আমি ছোটোবেলায় ধপধপে থাকায়, শীত বর্ষা ছাড়া জামা পরানো হত না।

আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই, দলটার সঙ্গে সরু একটা পথ ধরে জঙ্গলে ঢুকছি। নারকোল, সুপুরির বাগান ধরে এগুতে নির্জনতা যত বাড়ছে, মা-গায়ত্রী দিদিদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা, হাসি, উচ্ছ্বাস সাবলীল হচ্ছে। চারপাশের বনজঙ্গলের মধ্য থেকে ভয়মাখানো অদ্ভুত শব্দে একটা পাখি ডাকছিল। হাত ছাড়িয়ে গায়ত্রী দিদির কোলে চড়ার কোন্দল জানাতেই, হেসে প্যাঁচা-প্যাঁচা — এক ধরনের প্যাঁচা। বলেই তালি বাজাতে থাকে, যাতে আপদ পাখিটা উড়ে যায়।

তারপর একটা বাঁশ ঝাড়ের ঝরা পাতায় শব্দ করতে করতে, মা কাঁখ থেকে কলসিটা নামাল, দল পুরোনো কোনও আলোচনার সূত্র ধরে, কে যেন হাসতে হাসতে বলে উঠেছিল, চুপ কর। অ-স-ভ্য!

আমি বিস্ময়ে দেখি পুরোনো ভাঙা চোরা বাঁধানো ঘাটের ফাটফাটল ও পিণ্ড, সিঁড়িগুলো ভাঙা, ঘাসে ঢাকা। অনেক নীচে কালো পরিষ্কার জল— সারা পুকুর শাপলার জঙ্গল। সুন্দর ফুল ফুটে আছে।

এর অনেক পর, আমরা যখন বরিশাল ছেড়ে, মির্জাপুর স্ট্রিটে বড়ো জ্যাঠামশাই কালীপ্রসাদের ঘাড়ে ছ’মাস কাটিয়ে, সুদূর সেন্ট্রাল প্রভিন্সের একটি দেহাতি স্টেশন বিল্‌হাতে পিসিমার সংসারে বোঝা হয়ে আরও ছ’মাস — পিসিমা একরাতে দেশের বাড়ির জল আনার কাহিনি বলেছিলেন। এই আমার ছোটো পিসি, তরুবালা। ঠাকুরদার দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম কন্যা, তারপর মেজো জ্যাঠা নরনারায়ণ, সেজো জ্যাঠা নলিনীকান্ত এবং বাবা রমণীকান্ত। এ-সম্পর্কে কিছু পরেই বিস্তৃত জানা যাবে রোহিতের কাছ থেকে।

পিসিমা বলেছিলেন, বিধবা হয়ে বাপের সংসারে উঠবার সময় ঐ ছাড়াবাড়ি থেকে জল আনার ‘আস্য’ ছিল না। পিসিমার মুখে ‘আস্য’ শব্দটা প্রায়ই শুনেছি। ‘আস্য’ অর্থাৎ ‘নিয়ম’। কোনও কিছু খাওয়ার হয়ত বায়না করেছি, সংসারে তা হয়ত নেই, মায়ের নিষেধে আমি অবুঝের মতো ঘ্যান ঘ্যান কান্না করেই যাচ্ছি, বুঝতে পেরে পিসিমা গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝাতেন কান্দে না রোহিত, ‘আস্য’ নাই। অর্থাৎ আমার কাঙ্খিত বস্তুটি খাদক হিসেবে নিয়মে এখনও পড়ে না। তো, পিসিমা বলেছিলেন, তার বিয়ের আগে কিংবা বিধবা হয়ে বাপের সংসারে উঠে আসবার অনেক দিন পর্যন্ত, শোলনার বড়ো বাড়ির শরিকরা বিকেলে জল আনতে কেউ ‘ছাড়াবাড়ি’ যেত না।

‘ছাড়াবাড়ি মানে?’ আমার কৌতূহলে পিসিমা বলেছিলেন, ওখানে নাকি তার ঠাকুরদা রামচন্দ্রর আমলে যাদের বসত ছিল, কী কারণে সব ফেলে রেখে, পশ্চিমে চলে যায়। সেই থেকে নাম ছাড়াবাড়ি। সম্ভবত রামচন্দ্রর খুড়াদের কোনও শাখা।

তারপর, ভিটেমাটির সঙ্গে মিশে যেতে, ঘাটলা ভেঙে, এলাকাটা ভূতের রাজত্ব। আগে পুকুরের পারের রাস্তা ধরে সিংহ বাড়ি, বোস বাড়ির মানুষরা শর্টকাট করত। একবার মনা বউয়ের কাকা নিরঞ্জন কাকা একটু রাতে ঐ পথে আসছিল। মিটমিটে জ্যোৎস্না।

রোহিত থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, মনা বউস কেডা পিসিমা?

ঐ মনা বউসই তোগো দুর্ভাগ্য! … রমণীকে কি এক কাপড়ে পলাইতে হয় পার্টিশনে? … মনা বউস ছিল খুন করানোর ষড়যন্ত্রে। আমার বাবার নাম রমণীকান্ত। পিসি তার ছোটো ভাইকে স্নেহে ডাকতেন রমন!

আমি উৎসাহে জানতে চাইলাম, মিটমিটে জ্যোৎস্না … তারপর?

কাকা দ্যাহে, ভাঙা ঘাটলায় ঘোমটা দেওয়া কোনও বউ বইশ্যা। … খটকা লাগল। দাঁড়াইয়া পড়ল। ভাবল নমঃশুদ্দুরদের কোনও বউ ঘরে মাইরধর খাইয়া পলাইয়া বইসা আছে। … কেডা, কেডা আপনি? গলা খাঁকারিতে কাকা খানিক আগাইয়া আসতেই, দ্যাখে বউডা আস্তে উঠে জলের মধ্যে ডুইব্যা গেল।

ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠতেই, বীরেশ্বর দাদা — তরু পিসির একমাত্র সন্তান, বিল্‌হা স্টেশনের সহকারি স্টেশন মাস্টার, যিনি ডিউটির ফাঁকে বিশেষ প্রয়োজনে স্টেশন সংলগ্ন কোয়ার্টারে এসেছিলেন, আমাকে জড়িয়ে হাসতে হাসতে বলে, তুমি তো মি: পালোয়ান! ভয় পেলে চলবে?

ধারে কাছে মা-কে দেখতে পেলাম না। মা দিন রাত মুখ বুজে সংসার ঠ্যালে। তরু পিসি মায়ের উদ্দেশে চ্যাঁচাল, দ্যাখ বিরাজ! রোহিতের কাণ্ডডা দ্যাখ। কুয়োতলা ঝ্যাঁটাতে ঝ্যাঁটাতে মায়ের আওয়াজ পেলাম, আছা করে কান খুলে দ্যান ঠাকুরঝি, ঢং!

তরু পিসি ফাঁকে কৌটো খুলে দাঁতে তামাকের গুড়ি লাগিয়ে বলে, নিরঞ্জন কাকাও এমন ডরাই ছিল। বাড়ি ফিরে ধুম জ্বর। জ্বর ছাড়তে চায় না। মাঝে মাঝে তড়কা। চেহারা এই কাকলাস হইতেছে দিনে দিনে। একবছরের মাথায় …। পিসিমা আর বল্লেন না, চোখ দুটো বুজিয়ে, জিভটা বার করে রাখল শুধু। আমি তাকিয়েই থাকি। হঠাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে বলে, আমাগো বিয়া হবার আগে, সবাই বিকালে জলে বসতে যাইতাম, পুরুতবাড়ির কাছের পুকুরে। … শোলনা দ্যাশটা জলের হইলে কি হইবে, খাওয়ার জলের অভাবে, কলেরায় উজাড় হইয়া যাইত। যাউক আমাগো বিয়ের আগে ছাড়া বাড়ি ছিল না। পুরুত বাড়ির পুকুরটায় কাউয়ার চোখের মতো জল। শাপলায় ছাওয়া। একবার শেখ পাড়ার আমিনুদ্দিন শাপলা তুলতে গিয়া ঝাঁঝিতে পা আটকাইয়া মরে। তিন দিন প্যাটে কিছু পড়ে নাই হারামজাদার! ঢোপে আটকাইয়া চুপচাপ তিনদিন পর লাশ ওঠে। সেই থিকা জলে বসার জন্য ছাড়াবাড়ি ছাড়া উপায় কি? এখন তো এদেশে আইস্যা টিউকল দেখি, পাতকুয়া দেখি! বিল্‌হাতো শুকা দ্যাশ!

এই তরু পিসিমা দেখতে ছিলেন খুবই সুন্দরী — আমার ছোটোবেলায় তো বুড়ি হয়ে পড়েছে, তবুও। একটু ঢ্যাঙা ধরনের, ছিপছিপে গায়ের রং ও-বয়সেও ডালিমের রোয়ার মতো। নাকটা খাড়া, চোখ দুটো টানাটানা। দাঁতগুলো সর্বদা তামাকের গুড়ো দিয়ে নিয়মিত ঘষবার ফলে, ঝকঝক করে না। কালো। চুল ঘন এবং ছেলেদের মতো ছোটো ছোটো। কালো। ও বয়সেও পাক ধরেনি।

শুনেছি এগারো বছরে ঠাকুরদা বরদাকান্ত লাখুটিয়ার জমিদার পরিবারের ছোটো মেয়ের বিয়ে দিলেন। লাখুটিয়া নাকি শোলনা থেকে পাঁচ ভাটির পথ।

আসানসোলে ছিলাম যখন, জ্যাঠাইমার মুখে ‘ভাটি’ শব্দটি প্রায়শই শুনতাম। বিকৃত উচ্চারণে বলত ‘ভাডির দ্যাশ’। পরে, জ্ঞান হতে, জেনেছিলাম বরিশালের দক্ষিণ অংশে সুন্দরবনলগ্ন অঞ্চলকে বলা হয় হত ভাটির দেশ। ভাঁটার টানে নৌকায় যে-সব অঞ্চলে যাওয়া সহজ ছিল। পাঁচ ভাটির রাস্তা মানে, উজান স্রোতে নৌকো বাওয়া মুশকিল, তাই বিশ্রাম নিয়ে পাঁচটা ভাঁটা লাগে সেখানে যেতে, তাই পাঁচভাটির দ্যাশ। লাখুটিয়া ছিল তেমনই দূরত্বে।

এই ভাটির দেশ থেকে মাঝে মাঝে নাকি ছৈ নৌকায় গাদাগাদি করে নানা বয়সের মেয়েদের বিয়ের জন্য নদী-খাল দিয়ে আনা হত। তাদের বলা হত ভাডির দ্যাশের মেয়ে। অনেকেই নাকি নারকোল বা ইলিশ মাছের মতো এক গন্ডা, আধগণ্ডা কিনে নিত। এদের স্বভাবচরিত্র কিংবা জাত-কুল-মান নিয়ে বর্ণহিন্দুরা খুবই সন্দিহান।

যাক্‌ সে-সব প্রসঙ্গ, রোহিতের মুখে পরে বিস্তৃতভাবে আসবে। ঠাকুরদা বরদাকান্ত ছোটো মেয়ে তরুবালাকে পাঁচ ভাটির দ্যাশ লাখুটিয়ার জমিদার বাড়িতে পাত্রস্থ করায়— আমাদের শরিকদের মধ্যে নাকি চোখ টাটানি। তবে জামাই মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দ্বিরাগমন ছাড়া শশুরবাড়ি পা দেইনি। তখন নাকি, বড়ো বাড়ির এমন চাকচিক্য ছিল না। জাতে নতুন জামাইকে নিয়ে শরিক বাড়ির বউ মেয়েরা কোনও রকম ঠাট্টা-তামাশায় বর ঠকানোর ব্যবস্থা যাতে না করে— আমাদের পরিবারে নাকি পাহারার ব্যবস্থা। এতে শরিকরা অনেকে ক্ষুণ্ণ হয়। পান-সুপারি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। পরে নাকি রটিয়েছিল জামাই দোয়াজবর এবং হাঁপানি-রুগি। নইলে কি আর জমিদার ঘরে তরুর বিয়া হয়? এগারো বছরে বিয়ে হবার পর, উনিশ বছরে বিধবা হন যখন তরুপিসি, দু-টি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আড়াই বছরের বড়ো ছেলে চডা, আর কোলে তিন মাসের ছেলে এই বীরেশ্বর। পিসিমার মুখেই পরে শুনেছি, মহেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাকি সন্ন্যাস রোগ হয়েছিল। তহশিলদারের সঙ্গে খাজনা আদায়ের জন্য মহলে গেছলেন — সেখানেই শেষ। পিসিমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, মৃতদেহ আনা হোক। শেষবারের মতো মৃত স্বামীর মুখদর্শনটি করে। কিন্তু মহেন্দ্রনাথের বড়ো ভাই নাকি মহলেই দাহকার্য সম্পন্নের হুকুম দিয়েছিলেন। শুনেছি, ঠাকুর্দা বরদাকান্ত সংসারের শত অনটনেও বিধবা মেয়েকে জমিদারের সংসারে দাসী-বাঁদি হয়ে ফেলে রাখতে চাননি।

আমার জন্মের বহু আগেই বরদাকান্ত দেহ রেখেছিলেন। দেখিনি তাকে। শুনেছি, প্রথম পক্ষের স্ত্রী তখন মৃত্যু শয্যায়। তবু বলেছিলেন ঠাকুর্মাকে, রাড়ি হইয়া আমার মাইয়া অন্যের সংসারে দাসী থাকবে না।

মেয়েদের মুখে মুখে তখন বিধবার বদলি শব্দ ‘রাড়ি; প্রচলিত। ঘোর অভাবের সংসারে বরদাকান্ত প্রথমে ইতস্তত করছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ দিয়ে, কালীপ্রসাদ সবে বরিশাল শহরে ইন্টারমিডিয়ট পড়তে গেছে। ছোটো বোন তরুর দুর্ঘটনায় শোলনায় ফিরে এসছে। মাধবপাশার স্কুলে যখন তিনি থার্ড ক্লাসে পড়তেন, গিরিবালা রাড়ি হয়ে এক কন্যা, এক পুত্র নিয়ে আগেই বাপের বাড়ি উঠে এসছে। সেকেন্ড ক্লাসে উঠতেই কালীপ্রসাদের বিয়ে দেয়া হয়। সেও এক চমৎকার নাটক— সেজো জ্যাঠাইমার কাছে শুনেছি আসানসোল শহরে এসে। পরে তা খুঁটিয়ে বলা যাবে।

কালীপ্রসাদও পিতাকে বল্লেন, আপনি লাখুটিয়া যান, সঙ্গে আপনার নলিনী যাবে।

নলিনী হল সেজো ভাই, আমার বাবার ঠিক ওপরে। শুনি, তিনি নাকি ছোটবেলা থেকে কুস্তি করা, মুগুর ভাজায় ওস্তাদ। গায়ে গতরে লম্বা চওড়া, শান্ত মেজাজ, কিন্তু কোনও কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে পড়লে, তাকে সামলানো ছিল দায়। আমি তাকেও স্মৃতিতে আনতে পারছিনা। হয়, তিনি আমার জন্মের পরে পরেই ম্যালেনজাইটিস ম্যালেরিয়ায় গত হয়েছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে — তখনও রোগটার ওষুধ আবিষ্কার হয়নি— অথবা তার মৃত্যুর কিছু পরই আমার জন্ম। এ জন্য বলছি। রোহিত তার আটাত্তর বছরের জীবনে এসে বহুদূর পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায়, সেজো জ্যাঠামশাই নলিনীকান্তর মৃত্যুটাই ছিল পরবর্তীতে বহু ট্র্যাজেডির উৎস মুখ। তবে হ্যাঁ, কলকাতায় জাপানি বোমা পড়বার ত্রাশ ও ভয়ে শহর ছাড়া মানুষের জলের ধরে সম্পত্তি বেঁচে পালানোর আগে নলিনীকান্ত দেহ রাখেননি। তা হিসেব করেই রোহিত এখন বলে দিতে পারে।

তরুবালা এ-সংসারে উঠে এলেই, কালীপ্রসাদ পড়া বন্ধ করে কলকাতায় আসে চাকরি করতে। পিতার অসহায় দারিদ্র্যকে মুখবুজে সহ্য করার মানে হয় না। বুদ্ধিমান সন্তান। প্রথম ডিভিশনে ম্যাট্রিক এবং শোলনা গ্রামে সেদিন হইহই হয়েছিল। তো কালীপ্রসাদ কলকাতায় সরকারি পি. ডব্লু. ডিতে বেশ কয়েকবছর চাকরি করছে এবং বউ নিয়ে বাসা ভাড়ায় থাকে। যুদ্ধের হাল, সস্তা দরে বাড়ি বিক্রি দেখে, ভাইদের বলেছিল বিকল্প কিছু ব্যবস্থা করতে। তিনভাই-ই কলকাতা সম্পর্ক উদাসীন। তবু দাদার উপরোধে বেহালা অজ গ্রামে, আঁস ফলের ঘন জঙ্গল — পাশাপাশি তিন-তিন কাটা জমি কিনে ফেলেছিল। সে ভিন্ন ইতিহাসের পর্ব।

তরুপিসি শোলনা ফিরে এলেন। মস্ত সংসার। তার বড়দা পড়া অসমাপ্ত রেখে, কলকাতায় চাকুরিতে। সংসারে নিত্য অনটনের দিন শেষ। বরদাকান্ত তখন একটু আয়েস চায়। সব আবদার তরুর ওপর। আফিং এর অভ্যাস হয়েছে বলে নিত্য একটু দুধের প্রয়োজন। চারটে হাঁস আছে। সকাল সন্ধ্যা তাদের দেখাশোনা — এই তো অসাবধানে একটাকে পাতিশেয়াল নিয়ে গেছে, গিরিবালার মেয়ে মুনি-র কি কান্না! গিরিবালাও এ-সংসারে বয়স্ক দু সন্তান নিয়ে আছে। ধোনা আর মুনি। ঢেঁকিঘর, সংবৎসরের জ্বালানি কাঠ, যৎসামান্য যে ধান ওঠে— তা ঠিকঠাক রাখা— সবই তো ধোনা আর মুন্নি করে। এ-অবস্থায় রোহিতের বড়ো জ্যাঠা কালীপ্রসাদ চাকরিতে যোগ দেয়ার কিছু পরই কালীপ্রসাদের বউ, শ্যামাপ্রসাদ জন্মে গেছে তখন — বাবার অনুমতি নিয়ে কলকাতায় বাসাভাড়া। বরদাকান্তর অনুরোধে বড়ো নাতি শ্যামাপ্রসাদকে চোখ ছাড়া করা গেল না। কালীপ্রসাদও জোরাজুরি করলেন না।

রোহিত বলে, আমি তখন কোথায়? পৃথিবীতে আসিইনি। সব কিছুই পরে অন্যের মুখে মুখে শোনা। সংসারে বড়ো নাতি শ্যামা। বড়ো ভাসুর কইলকাতায় কাজ করে, নগদ টাকা পাঠায়। তোর  ঠাকুরদারা একটু সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছে। সংসারে বড়ো নাতিকে কেউ শাসন করলে বিরক্ত হতেন। সেই তালে, ছেলেও লেখাপড়া করে না, গাছে গাছে চড়ে বেড়ায়, ঐ মুনির মা পেছন পেছন ‘বাবা’ ‘বাছা’ করে দৌড়ায়। ডাকাডাকি করলে, গাছের ডালের আড়াল থেকে পাখির ডাক দিত ‘কু-উ!’ ‘কু-উ!’

নিত্য অভাব-অনটন সংসারের শেষ হয়ে, সুদিনের মুখে মুখে নাকি বরদাকান্ত চলে যান। তখন অবশ্য বরদাকান্তর প্রথম পক্ষ, কালিপ্রসাদ ও গিরিবালার মা গত। ফলে, দ্বিতীয় পক্ষের, তরু পিসির নিজের মা প্রফুল্লবালা রাড়ি হয়েছিলেন। তাঁকে আমি চোখে অস্পষ্ট মনে করতে পারি। পার্টিশনের আগেই মেজো জ্যাঠামশাই নরনারায়ণ কালীঘাটে বাসা নিয়ে উঠে গেছলেন। যৌথ বাংলার বা গ্রামের প্রতি বিশেষ টান ছিল না তাঁর। তাঁর বাসাটি ছিল ক্যাওড়াতলা শ্মশানের কাছে একটা গলির মধ্যে। তিনি কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেছিলেন, একটু শৌখিন প্রকৃতির, সেই-যুগে স্ত্রীর মতামতকে গুরুত্ব দিতেন বলে, কেউ কেউ আড়ালে আবডালে নরনারায়ণকে বিশেষিত করত ‘মাইগ্যারুদা’ বলে।

আমার জ্ঞানবুদ্ধি ফোটার পর শব্দটি আমাকে চমৎকৃত করত। সাধু ভাষায় বলে স্ত্রৈণ। কিন্তু স্ত্রৈণ শব্দে তেমন কিছু প্রতিক্রিয়া হয় না শরীরে। যেন তেলের শরীর বেয়ে মোলায়েমভাবে জলের ফোঁটাটি গড়িয়ে যায়। ‘মাইগ্যারুদা’ মুগুরের ঘা মারে হৃৎপিণ্ডে।

যাক্‌ নরনারায়ণ-এর সঙ্গে আমার বাবা রজনীকান্তর আদায় কাঁচকলা সম্পর্ক। এর গূঢ় কারণ আমি বড়ো হয়েও সমাধান করতে পারিনি। যে-সব প্রসঙ্গ দু চারজনের মুখে শুনেছি — যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। আমিও দুপক্ষের কাউকেই একশ ভাগ নির্দোষ ঠাওরাতে পারিনি।

অদ্ভুত, আমার মাকে মেজো জ্যাঠামশাই খুব স্নেহ করতেন। ভাশুর ঠাকুরের দূরত্ব বজায় রাখতে হত সে-যুগে, নইলে সম্পর্কটি আরও মধুর রূপে ফুটে থাকতে পারত।

মনে পড়ে খুব ছোটোবেলায়, আমাদের গ্রাম-গাঁয়ে যখন স্যানিটেশন এর কোনও ব্যবস্থা নেই, জঙ্গলের পাশে ছোটো ছোটো নয়নজুলির ওপর, বাঁশের চারটে খুঁটি এবং হোগলার ঘের দিয়ে পায়খানা বানানো থাকত। বসার জন্য দু-দুখানি বাঁশের খুঁটি। তলায় নয়নজুলি জুড়ে ময়লার গাদা। তো, ঐ-টুকু বয়সে আমাকে কে যেন ওখানে বসিয়ে দিয়ে চলে যাবার পর, পা হড়কে আমি বেশ খানিকটা নীচের ওই মলের গাদায় (আমাদের ভাষায় ছিল ভ্যাদোর) চিৎ হয়ে পড়ে যাই। সংসারে সেদিন ওটা ছিল একটা ঘটনা। কাঁদছি, হাত ছুড়ছি যত, নরম ময়লায় গেঁথে যাচ্ছি। মনে পড়ে, সস্নেহে মেজো জ্যাঠামশাই নেমে দুহাতে আমাকে উদ্ধার করে উত্তরের পুকুরের ঘাটে সাফাই-উপাই করে প্রচুর পাউডার মাখিয়ে, এক ধরনের দামি বিলিতি অলিভ অয়েল মাখিয়ে দিয়েছিলেন। জ্যাঠাইমাকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য তিনি দেশের বাড়িতে ছিলেন। তখন তো, আমার ঠাকুমাকে মাঝেমধ্যেই কালীঘাট দর্শন করিয়ে, নিজের বাসায় রেখে দিতেন। একবার মায়ের সঙ্গে আমিও ছিলাম। টুকরো দৃশ্যটি মনে আছে, ধবধবে থান পরা অবস্থায় তিনি পিছন ফিরে কুলোয় চাল বাছছিলেন— আমি টলমল পায়ে তার পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। নাকে গন্ধের ঝাঁঝ লাগল। ঐটুকু বয়সে কিছুই বুঝিনি। আজ এতটা বয়সে পৌঁছে, আইওডেক্স বা কদম পাতা ডলে  নাকে ধরলে, সেই-গন্ধটা পাই এবং ঠাকুরমা অন্নপূর্ণা দেবীর কথা মনে আসে — সাদা থান পরে পেছন ফিরে বসে থাকার অস্পষ্ট ছবি। স্মৃতির আকাশ ঠেলে তা বহু দূরের। তবু অস্পষ্ট ভেসে ওঠে।

বরদাকান্ত চলে গেলেন, অন্নপূর্ণা দেবীকে ‘রাড়ি’ হতে হয়েছিল। আমাদের উত্তরের পুকুরের ঘাটে শরিক পরিবারের বয়স্কা এয়োরা মিলে, তার হাতের শাঁখা ভেঙেছিল। প্রায়-বিকেলেই ছাড়াবাড়িতে জলে বসতে যাওয়ার মতো, কোনও পরিবারে ‘রাড়ি’ হলে শরিক বাড়ি থেকে প্রবীণারা এসে কর্তব্যটি করিয়ে যেত। কর্তব্যটি খুবই শোকাবহ চেহারার এবং সমস্ত পরিবেশ জুড়ে কয়েকদিনে বিষণ্ণতা লাগু থাকত।

আমি জন্মাইনি তখন। তবু অন্নপূর্ণা ঠাকুমার ‘রাড়ি’ হওয়ায় শ্যাখা ভাঙা এবং বাড়িশুদ্ধ পুরুষদের ধরাচুরো পরে অশৌচ পালনের পর শ্রাদ্ধান্তে মৎস্যমুখীর পরদিন চরম বিপর্যয় ও বেদনাক্রান্ত দিনটির খবর বিল্‌হা‌তে থাকতে এক বিকেলে পিসিমা তরুবালার কাছে শোনার পর, এতটা বয়স পেরিয়েও রোহিতের বুকে ঝুপঝাপ অন্ধকারময় একটি পর্দার সন্ধান দেয়।

আমরা তখন বিল্‌হায় পিসিমার সংসারের ঘাড়ে রিফিউজি হয়ে চেপে আছি। কলকাতায়, খানিকটা ঋণ লাঘবের জন্য মা দিনরাত মুখবুজে গৃহকর্ম ও হেঁশেলের দায়িত্বে থাকত। বড়ো হয়েও, মা’কে বরাবর দেখেছি, সংসারে কম কথা বলেছেন, বাবার নানা ব্যবহার কষ্ট পেয়েছে, একটু আধটু অবসর পেলে, তার আনন্দ খুশিতে সাথ দেয়ার জন্য আমাকে কাছে ডেকে নিয়েছে। হয়তো, দুপুর খাড়া থেকে বিকেলের পথে ঢলছে, সংসারের উষা থেকে খাটাখাটনির পর, একটু নিরালা বিশ্রাম — আমাকে নিঃশব্দে হাতের ইঙ্গিতে কাছে ডেকে, উত্তরের পুকুরের ঘাটলায় একটা ছিপ বড়শি নিয়ে বসল, আমি আধবালতি জল পাহারা দিচ্ছি। টপাটপ পুঁটি-খলসে ধরে ধরে বালতিতে রেখে যাচ্ছে। আর ঐ টুকু জলে মাছগুলোর বুচকুড়ি, লাফিয়ে ওঠা আমাকে রহস্যময় জগতে নিয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলা থেকেই চাক্ষুষ কিছুকে নিছক চাক্ষুষ মনে হয় না — যেন একটু পরই কে যেন পর্দাটা সরিয়ে ভিন্ন কোনও বাস্তবের মুখটা খুলে দেখিয়ে দেবে। তাই, পিসিমা আদরে কখনও কখনও বলতেন, তুই একটা বলদ! তাঁর এ-ধারণা আমৃত্যু স্থির ছিল। আমি তখন স্কুল ফ্যাইনাল দেব — তরুপিসির মৃত্যু হয়। তবুও, আমার কোনও অবাস্তব সম্ভাবনা খোঁজায় বলতেন, রোহিত পড়াপাঁঠা!

বলদ থেকে পাঁঠায় এলাম এবং সে-পাঁঠা যে পড়াশুনো জানা — তরু পিসি স্বীকার করে নিল। তো, একদিন বিল্‌হার দুপুরে আঁধি ওঠার পর, কঠিন শুষ্ক আকাশ চুঁইয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। রু রু লালমাটির মরুর দেশে একটি ঘটনা। সন্ধ্যার ভুতুড়ে পরিবেশে আমরা কয়েকজন — বীরেশ্বর দাদার দুই ছেলে, আমার বয়সী অদ্ভুত খেলায় মত্ত ছিলাম। খেলাটা নিষ্ঠুর যদিও।

সম্পর্কে, রোহিত ও বীরেশ্বর ভাই হলেও — মামাতো, পিসতুতো — বয়সের ফারাক তিরিশ-পঁয়ত্রিশ। রোহিত ডাকত ‘দাদু’ — বীরু দাদু। তখনকার কালে, নানা সম্পর্কের দাদা ভাই-এর মধ্যে সম্বোধন ছিল ‘দাদু’। যেমন শ্যামাপ্রসাদকে রোহিত সম্বোধন করত ‘ভাসা দাদু’! তার ডাকনামটি ছিল ভাসা। অর্থাৎ জন্মের পর, দীর্ঘায়ুর কামনায়, পুত্রসন্তানটির আপাত তাচ্ছিল্যে ভাসিয়ে দেয়ার প্রস্তাব রাখা হত। পরিবারের বিশ্বাস, নবজাতকের প্রতি এ-তাচ্ছিল্য যমরাজ তাকাবেন না। সে-কালে পরিবারে পরিবারে শিশু মৃত্যুর আকছাড় ঘটনায়, এমনই সংস্কার জাজ্বল্যমান ছিল। রোহিতকে নিয়েও মা-পিসিদের এমন কিছু আয়োজন ছিল — পরে খুলে বলা যাবে।

তো, আমরা সে-সন্ধ্যায় বিল্‌হার কোয়ার্টারে কাঠের ‘দেউড়খার’ আলোতে বসে, কালো ডেয়োপিঁপড়ে ধরে ধরে রেড়ির তেলের জ্বলন্ত শিখায় পোড়াচ্ছিলাম। এক ধরনের খেলা। শংকর আর পরেশ। শংকর আমার চাইতে দেড় বছরের বড়ো, পরেশ আর আমি তিন মাসের ছোটো বড়ো। ঐ দেড় বছরের দৌলতে, বিল্‌হায় শংকর ছিল আমাদের নেতা। কত যে তথ্য, কত যে ঘটনা — শংকর সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, আমার কল্পনাকে আলোড়িত করত এবং জীবনের নানা পর্বে বহুদিন সে-সব গাঁথা ছিল।

তো, সেই-সন্ধ্যায় তরু পিসি দু পা ছড়িয়ে থান কাপড়ের ছোটো ছোটো টুকরো বিছিয়ে জলের ছিটায় পাকিয়ে সলতে বানাচ্ছিলেন। আমাদের ভাষায় বলে ‘দশি’। সংসারে হারিকেন থাকলেও, এই ‘দশি’ ও ‘দেউড়খার’ ছিল খুবই জরুরি। ‘দেউড়খার’ বলতে ছোটো ছোটো গোল চৌকো কাঠের দণ্ড — মাথায় খানিকটা খাবলানো স্পেস্‌ থাকত, তেল ঢেলে, সলতে ভিজিয়ে আলোর কাজ হত। তখন রেল কোম্পানিতে র‍্যাশন চালু ছিল — তেল, নুন, ডাল, মশলা, চাল থেকে সবকিছু রেলের রেশনে লভ্য। তেল বলতে সরষের তেল। কিন্তু কেরোসিন বাজার থেকে কিনে নিতে হত — ওদেশের মানুষ বলত ‘মিট্টিকা তেল’।

পিসিমার সংসার খুব ছোটো ছিল না। বিরু দাদু, বীণা বৌদি, শংকর, পরেশ ও ছোটো মেয়ে দীপালি, আমরা গিয়ে ঘাড়ে পড়েছি — আমি, মা, বড়দি শেফালিকা এবং রোহিতের নীচে এক ভাই ও বোন। নান্টু ও গোলাপী। নান্টুটা অতি গ্যাদা। যখন তখন, যেখানে সেখানে হেগে দিত। বীণা বৌদির মুখ গম্ভীর হবে, ভেবেই পিসিমা অবলীলায় অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সাফাই করেই মাকে বলত, বিরাজ, নান্টুরে কিরমিতে ধরছে! … চুনের জল খাওয়াইস্‌। সে যুগে, ঘরে ঘরে চুনের জল করা হত। কারও পেটে গুঁড়োকৃমি বাসা বাঁধলে — চুনের জল খাওয়ানো  রীতি।

তো, তরু পিসির নজর সব দিকে। বাজার থেকে কেরোসিন কিনতে হত— রেলের র‍্যাশনে মিলত না। ও-দেশে কেরোসিনকে বলে ‘মিট্টিকা তেল’। তাই, বারান্দা, রান্নাঘর আর দু-খানা শোয়ার ঘরের অন্ধকার একটা হারিকেনে সারা হত, সঙ্গে দু-তিনখানা ‘দেউড়খার’। ‘দশি’ বা সলতে জ্বলত ভ্যাড়েন্ডার তেলে। ও দেশে প্রচুর ভ্যাড়েন্ডার জঙ্গল। দেহাতি ছেলেমেয়েদের লোভের কিছু বস্তু ফুসলিয়ে তরু পিসি প্রচুর ভ্যাড়েন্ডা ফল আনা করাতেন। ঝ্যাঁটার কাঠি দিয়ে আট দশটা বিচিকে গেঁথে, আগুনে ধরলে টপ্‌ টপ্‌ করে তেল গড়িয়ে পড়ত। যত্নসহকারে মাটির সরাতে পিসিমা তা মজুত করে রাখতেন।

প্রায়ই অবসরে পা ছড়িয়ে ঘন ‘দশি’ বানাতে হত। ভ্যাড়েন্ডার তেলের আলো প্রদীপের চার পাশের বেশি অন্ধকার দূর করতে না পারলেও, আমরা ছোটোরা মজা পেতাম আগুনে অনেক কিছুকে দগ্ধ করে। বিশেষত বিচিত্র সব পোকাদের ধরে ধরে আমরা ওদের নানা প্রকারের অপরাধের শাস্তি জারি করে আগুনে কার্যকর করতাম।

তো, মাকে কাছে পেয়ে পিসিমা সেদিন, অতীতের দুর্ঘটনার সেই দিনটির কথা বলেছিলেন। কত পুরনো, পেছন দিনের কথা। বরদাকান্তর শ্রাদ্ধের পর দিনের ঘটনা। তরু পিসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছে, বুঝলি বিরাজ, রমন ছাড়া আমার সব ভাইগো বিয়া হইছে, অনেকের পোলা মাইয়া হইয়া গেছে! জীবনে শোক, চোখের জল কম ঝরল না! … তোর ঠাকুরমশাই স্বগ্গে যাওয়ার পর, লাখুটিয়া থিকা বাপে শোলনা আনলে কি হবে— বিছানায় গ্যালেই বালিশ ভিজত। তারপর, বাপের মরণ! … মরার বয়স তো হইছিল না! … গলার ঘা না হইলে বরদা চারাইজ্জারে ঐ বয়সেও বিয়ার পিঁড়িতে বসানো যাইত, এমন চেহারা! … শ্রাদ্ধের পর দিন, সবাই ক্লান্ত, দুপুরে ঘুমাইছি! … কোলের পাশ থিকা কখন যে চডা উইঠা গেছে জমির টানে কে বুঝছিল! … নইলে কি ঘুমাইয়া পড়তাম … খোঁজ খোঁজ খোঁজ! … বিকালে আমার জলজ্যান্ত পোলা উত্তরের পুকুরে ভাইস্যা উঠে… কপাল কোথায় রাখুম ক। … আইস থাকলে, বীরেশ্বরের মতো হেও বউ পোলা মাইয়া লইয়া সংসার করত! …

আমি শুনে ‘দেউড়খার’ আগুনে ডেয়োপিঁপড়ার পেট-মাথা ঠুসে ধরা ফেলে, এ-ঘরে এলাম। আবছা আলোতে, ননদ-ভাজবউয়ের কেউই আমায় দেখতে পেল না।

তরু পিসি বলে, কাঁদতে কাঁদতে, চোখের জল শুকাইয়া গেছে … শ্যাষ কালে কী করতাম জানো? চাইর-পাঁচ বছর পরও, চডার কোনও ইজার বোচকা খুইজা পাইলে, নাকে শুকতাম। যদি একটু পেচ্ছাবের গন্ধ আসে!

তখন কিন্তু হারানো পেচ্ছাপের গন্ধে কী জীবনের লক্ষণ — কিছুই টের পাইনি। তবু বুকের মধ্যে কৌতূহলে মোচড় দিয়েছিল কারণ, বালতির জলে পুঁটি খোলসের বুচকুড়ি, লেজ নাড়ানো লাফ এবং ঘাটের ধাপে বসে একাগ্রে ছিপ ফেলে বসা মা-র পুরনো দৃশ্যটা ভেসে উঠেছিল। পিসিমা জানে না, হয়তো জলে পড়ে পিসিমার চডা মাছ হয়ে গেছল। মানুষ মরে গিয়ে ভূত হয়, ব্রহ্মদৈত্য হয় ছোটোবেলায় শুনেছি। চডা বাচ্চা বয়সে জলে ডুবে নিশ্চয়ই পুঁটিমাছ হয়েছিল — পিসিমা এ খবরটা জানে না। মা গোপনে মাছ ধরেছিল, আমাকেও চুপি চুপি গোপনে ডেকে নিয়ে বালতি পাহারায় বসিয়ে রেখেছিল। বিল্‌হায় আলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, পিসিমার চডা যে উত্তরের পুকুরে ডুবে পুঁটি মাছ হয়ে গেছিল — গোপন রেখে দিলাম। ধীরে ধীরে, ফের পতঙ্গ নিধন খেলায় এসে শংকর-পরেশের সঙ্গে যোগ দিলাম।

রোহিতের সঙ্গে তাঁর পিতা রমণীকান্তর বরাবরেরই সম্পর্ক আবেগহীন, কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার প্রলেপ মাখা। বাবা অস্মিতা ছিল প্রবল, কোনও দিনই আবেগ তাঁর মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। তাঁর মতামত, সিদ্ধান্ত, ভালো লাগা না-লাগাটাই হবে শেষ কথা। অন্যকে দমিয়ে চলার মধ্যেই তিনি আনুগত্যের সার্থকতা বোধ করতেন। আর আমি ছিলাম ভিন্ন স্বভাবের। খুব ছোটোবেলা থেকেই। সব কিছু ঘিরেই রহস্য লাগত বলে যে, কোনও নিয়মানুবর্তিতার খোলসে আটকে থাকতে কষ্ট হত। কোনও বিষয়েই নিষ্ঠুরতা পছন্দ হত না। সব কিছুতেই অচলায়তন ভাঙায় মজা পেতাম।

রমণীকান্তর মধ্যে, বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম, রসবোধের বড্ড অভাব। শুনেছি, বরদাকান্তর মধ্যেও ছিল তা। বড়ো বস্তুনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। আমার স্বভাবে, মা বলতেন, দাদুর প্রভাব কে যেন বসিয়ে দিয়েছিল। আমার জন্মের বছর দুই পর দাদু, আরও কিছু দিন কাটিয়ে দিদিমা। শুনেছি রমণীকান্ত শ্বশুর বাড়িতে বিশেষ পাত্তা দিতেন না। বহু অনুরোধ ও উপরোধে ‘জামাই’ তবে শ্বশুরবাড়ির কথা ভাবতেন। মা একপ্রকারের বিরহ মনে পুষে পুষে পাথর করে ফেলেছিল নিজেকে।

আমার জন্মের খবর পেয়ে, দিদিমা আমার দুগ্ধ পানের জন্য কাঁসার ঝিনুক বাটি, পরে আধ সের জল ধরে একটি পেতলের গ্লাস পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে বাসন-বাটি-গ্লাসে নাম খোদাই থাকত।

আমার স্কুলজীবনে, পরবর্তীতে, সংসারের প্রবল অনটনে, বাবা মায়ের রক্ষিত গোপন কিছু বাসনপত্র বিক্‌কিরি করতে গেলে, একটা থোলো কাঁসার বাটিতে ‘চন্দ্রশেখর’ নাম খোদাই, দেখে মা ঘন ঘন চোখের কোণ ও নাক মুছতে মুছতে, বাবার হাতে তুলে দিয়েছিল। রমণীকান্তর কোনও হেলদোল ছিল না। সব কিছু একটা থলিতে ভরে, কাঁসা পিতলের দোকানে কিছু টাকার জন্য চলে গেছল।

তখন আমরা পানশিলায়। এ নিয়ে বিস্তৃত পরে বলা যাবে — জখন পানশিলায় আমাদের তৈরি বালক সংঘ ক্লাবের বহু প্রাচীন অশথ গাছটার তলায়, সব্বাই মিলে মোটা গুঁড়িটাকে — ধিকি ধিকি আগুন ধরিয়ে — হপ্তাখানেকের মাথায় মেরে ফেলেছিলাম। কোনও বাধা দেওয়া হয়নি আমাদের বা আমার পক্ষে।

যাক্‌, সে-প্রসঙ্গ।

রমণীকান্ত পুরনো বাসন কোসনের থলিটা নিয়ে চলে যেতেই, মাকে রোহিত বলেছিল, চন্দ্রশেখর কে মা?

তোর নাম।

কে দিয়েছিল?

তোর দিদিমা।

কেন?

মায়ের ফের অন্তঃসত্ত্বার খবর গিয়েছিল সরমহল। সরমহল ছিল আমার মামাবাড়ির গ্রাম। নৌকোয় শোলনা থেকে বিকেল বিকেল পৌঁছানো যেত। মা বলতেন, ছোটো বড়ো তিনটে নদী পার হতে হত। সন্ধ্যা, কালোজিরা এবং আরিয়াল খাঁ। কালোজিরা? রোহিত জানতে চাইলে, মা বোঝালেন, নদী ছোটো হলে কি হবে, খুব স্রোত এবং জল কালোজিরার মতো কুচকুচে।

দিদিমা নাকি মানত করেছিলেন, এবার তার একমাত্র মেয়ে ‘খুকি’-র গর্ভে যেন পুত্র সন্তান হয়। মায়ের পেটে প্রথম নাকি কন্যাসন্তান। মৃত অবস্থাতেই আঁতুড়ঘরে এসেছিল। তার কোনও নাম হওয়ার সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় বারও মেয়ে সন্তান, তবে মৃতজন্মা নয়, দুবছরের মাথায় তড়কার মতো হয়েই চির তরে চোখ বুজল। তার অবশ্য নামকরণ করা গেছি। বাণী।

রোহিত বৃদ্ধ বয়সে আজও ‘বাণী’ নামটির সঙ্গে সুদূর কুয়াশার কতগুলো অর্ধবিষণ্ণতার বিন্দু ভেসে উঠতে দেখতে পায়।

বানীকে হারিয়ে মা-র পেটে এল আমার দিদি শেফালিকা। আমি গর্ভে আমার সময় শেফালিদি ফ্রক ছেড়ে মাঝেমধ্যে শাড়ি পড়ে।

দিদিমার আনন্দ, আকুতি, মানতের ইচ্ছে — খুকি! যেন এ-যাত্রা পুত্র সন্তানের মুখ দেখতে পায়। মার মনেও সম্ভবত পুত্রের প্রত্যাশা দানা বাঁধছিল সেদিন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান