সুকুমার সেন
কথায় আছে ‘স্মৃতি সততই সুখের’। কিন্তু সত্যিই কি তাই? কিছু কিছু স্মৃতি থাকে যা অত্যন্ত বেদনার। যে বেদনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলে। পূর্বপুরুষের প্রত্যক্ষ বেদনার বিবরণ পরবর্তী প্রজন্মের মননে এক স্থায়ী প্রভাব রেখে যায়। ১৯৪৭ সালের ভারত তথা বাংলার বিভাজন এমনই এক দুঃসহ স্মৃতি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও যা বাঙালির মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখে। দেশভাগ অবিভক্ত বাংলার মতো এক সমৃদ্ধশালী রাজ্যকে শুধু ভৌগোলিকভাবে খণ্ডিত করেনি, তাকে আর্থ-সামাজিকভাবে পঙ্গু করেছে। বাকি ভারতের কাছে হতমান করেছে। কোটি মানুষের বাধ্যতামূলক অভিবাসন বাঙালিকে শিকড়হীন করেছে। চিরায়ত ভারতীয় মূল্যবোধ বিলুপ্ত হয়েছে। এটা দুই বাংলার ক্ষেত্রেই সত্য। ওপার বাংলাও ১৯৭১ সালে দেশভাগের চরমমূল্য দিয়েছে পাকিস্তানিদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে। দেশভাগ বাঙালির কাছে এক অভিশাপ। এর অভিঘাত কতখানি তা এতদিনেও আমরা মূল্যায়ন করে উঠতে পারিনি। আর একটা বিষয় লক্ষণীয়। দেশভাগের ৭৫ বছর পরে দুই পারের নতুন প্রজন্ম পরস্পরের কাছে জাতি হিসাবে অপরিচিত হয়ে পড়েছে এমনকি দুই পারের বিভিন্ন স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধেও এরা অজ্ঞ। পরস্পরের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কেও খুবই ভাসা ভাসা ধারণা বহন করে। এটা বাঙালির দুর্ভাগ্য। যে প্রজন্ম দেশভাগ প্রত্যক্ষ করেছিল আজ সেই প্রজন্ম প্রায় নেই। বয়োবৃদ্ধ অল্প কিছু মানুষ আছেন যাঁরা কিছু স্মৃতি কিছু পূর্বজদের কাছে শোনা তথ্যের ভিত্তিতে দেশভাগকালীন পরিস্থিতির কিছু ব্যাথাতুর স্মৃতি মন্থন করতে পারেন। আমাকে হয়ত সেই গোষ্ঠীর মানুষ ভাবা যায়।
আমার জন্ম বঙ্গ-বিভাজনের অব্যবহিত পূর্বে অবিভক্ত বাংলার নদিয়া জেলার কুষ্টিয়া শহরের সেন পরিবারে। প্রসঙ্গত, দেশভাগের সময় নদিয়া জেলার পাঁচটি মহকুমার মধ্যে তিনটি, অর্থাৎ চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাণাঘাট ও কৃষ্ণনগর সদর ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত হয়। বিভাগপূর্ব কুষ্টিয়া শহরে সেন পরিবার ছিল অতি সমৃদ্ধশালী ধনী পরিবার। বৈভবের সূচনা আমার প্রপিতামহ বিহারীলাল সেনের কর্মকৃতিত্বে। তিনি ছিলেন রেলওয়ে কন্ট্র্যাক্টর, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, তালুকদার। ৩২ বিঘা জমির ওপর দু-টি পুকুর, ধানের গোলা, আমবাগান, কাছারিবাড়ি নিয়ে মূল বসতবাড়ি। এছাড়া, আরও ১১টি বাড়ি শহরে। পাটের আড়ত, আখ মাড়াই কলের কারখানা, মোহিনী মিলের শেয়ারের মালিকানা, স্বদেশি ভান্ডার (আজকের শপিং মল), পাঁচটি চা বাগানের বিপুল শেয়ার, জলকর ও তৎসহ ৩৬০ বিঘা কৃষি জমির মালিকানা। দেশভাগের আগে এই বিপুল সম্পত্তি নিয়ে সেনেদের জমজমাট যৌথ পরিবার কুষ্টিয়া শহরে।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশভাগের ঘোষণায় এই পরিবারের ওপর এক বিপর্যয় নেমে আসে। সৌভাগ্যবশত, এই সময় আমাদের বাবা-কাকারা অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে (আজকের পশ্চিমবঙ্গে) কর্মসূত্রে বাস করছিলেন, তাই আমাদের বাবাদের প্রজন্মকে আক্ষরিক অর্থে উদ্বাস্তু হতে হয়নি। তবুও পরিবারের শিকড় তো কুষ্টিয়ায়। আমাদের বাবা-কাকা কিছুটা দিশাহারা হয়ে পড়েন। যদিও কুষ্টিয়াতে সে সময় কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়নি কিন্তু কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। সে উত্তেজনার আঁচ আমাদের পরিবারের উপরও পড়েছিল। এই অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কেটে যায়। সে সময় আমার দাদু, ঠাকুমা ও বড়ো জ্যাঠামশাই কুষ্টিয়ায় ছিলেন। পরিবারের অন্যান্যরা বিশেষত মেয়েরা, ব্যান্ডেলে ন-কাকার বাসায় চলে আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পাসপোর্ট ব্যবস্থা ছিল না। ফলে দু-দেশের মধ্যে অবাধ যাতায়াত ছিল। ট্রেন ব্যবস্থাও চালু ছিল। ফলে আমাদের পরিবারের কেউ কেউ মাঝে মাঝে কুষ্টিয়ায় যাতায়াত করতেন। এই সময় থেকেই পারিবারিক সম্পত্তির যথাযথ দেখাশোনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দাদু ও বড়ো জ্যাঠামশাই ছাড়া অন্যরা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত। তাঁরা এই ডামাডোলের মধ্যে কুষ্টিয়াতে ঘন ঘন যেতে পারতেন না। সব মিলিয়ে পরিবারের খুব অনিশ্চিত অবস্থা।
এই সময় একটি ঘটনা আমাদের পরিবারের অশান্তির ঘটায়। ১৯৫১-৫২ সালে হুগলী জেলার চুঁচুড়া থেকে রিষড়া পর্যন্ত অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি হয়। এই কারণে শেওড়াফুলির প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সামসুদ্দিন আহমেদ সপরিবারে ঢাকায় চলে যাচ্ছিলেন। পথে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি কুষ্টিয়াতে আমাদের প্রতিবেশী গোলাম মিঞার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে কথা প্রসঙ্গে দাদুর সঙ্গে বাড়ি বিনিময়ের প্রসঙ্গ ওঠে। জানা যায় যে শেওড়াফুলির বাড়ি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ব্যান্ডেলে ন-কাকাকে টেলিগ্রাম করা হয় বাড়ির দখল নেওয়ার জন্য। ন-কাকা ও অন্যরা গিয়ে বাড়ির দখল নিয়ে কুষ্টিয়াতে খবর দিলে আইনত শেওড়াফুলি ও কুষ্টিয়ার বাড়ি বিনিময় হয়। সেই থেকে সেন পরিবারের ভদ্রাসন শেওড়াফুলিতে।
কুষ্টিয়ার অতি সামান্যই কিছু স্মৃতি আমার রয়েছে। কারণ ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাবা-মা কুষ্টিয়ায় গেছেন। মনে আছে বাড়িটির কথা। সাদা রঙের কুঠিবাড়ির মতো। বাড়ির সামনে ঢেউ খেলানো পাঁচিল। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে ঝাউ গাছ আর সুপুরি গাছের সারি। মা বলতেন জ্যোৎস্না রাত্রে বাড়িটিকে যেন স্বপ্নের মতো মনে হত। মনে আছে বাড়ির রাখালের ছেলের সঙ্গে খেলা, বাবার পুকুরে সাঁতার কাটা আর প্রচুর ডাবের জল খাওয়ার কথা কারণ আমার সে সময় প্রচুর ফোঁড়া বেরিয়েছিল শরীরে।
১৯৫২ সালেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুন সাহেবের মধ্যে চুক্তি অনুসারে দু-দেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৫২ সালেই বাবা-মার শেষবার কুষ্টিয়ায় যাওয়া হয়। এবারেই কুষ্টিয়া থেকে ফেরার সময় একটি ঘটনা ঘটে। যেহেতু অনির্দিষ্টকালের জন্য কুষ্টিয়া ছেড়ে যাওয়া হচ্ছে তাই আমাদের সঙ্গে অলঙ্কার, বাসনকোসন, তৈজসপত্রসহ বিশাল লটবহর ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত স্টেশন দর্শনাতে এক নারকীয় ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি পুলিশ ও রক্ষী বাহিনী (আনসার) ভারতমুখী যাত্রীদের সমস্ত সম্বল কেড়ে নিতে থাকে। বক্তব্য যে পাকিস্তানের জিনিস ভারতে নিয়ে যেতে দেব না। চতুর্দিকে কান্নাকাটি, হাহাকার, চিৎকার, চেঁচামেচিতে দর্শনা স্টেশনে এক বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় বাবা-মা উদ্বিগ্ন মুখে ট্রেনে বসে আছেন কি পরিণতি হয় দেখার জন্য। এমন সময় একজন আনসার আমাদের কামরায় উঁকি দিয়ে বাবাকে দেখেই বলল “নারাণদা! আপনারা চলে যাচ্ছেন?” বাবা উদ্বিগ্ন ও বিষণ্ণ মনে মাথা নাড়েন। ছেলেটি মুহূর্তে পরিস্থিতি বুঝে অন্য আনসারদের বলল, “এই কামরায় কেউ আসবে না। এ কামরার সব মাল আমার।” ট্রেন ছেড়ে দিল। ছেলেটি কামরার দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ট্রেন ভারতের সীমান্ত স্টেশন বানপুরে এসে দাঁড়াল। (তখন গেদে স্টেশন ছিল না)। ছেলেটি ট্রেন থেকে নেমে বাবাকে প্রণাম করে বলল “আপনারা আর আসবেন না, না?” ছেলেটির চোখে জল। বাবার চোখও অশ্রুসিক্ত। বাবা নীরব। ছেলেটি মুসলমান ছিল। ছেলেটি কুষ্টিয়া হাইস্কুলে বাবার ছাত্র ছিল। মা পরে বলেছিলেন ছেলেটি দেবদূতের মতো এসে পড়েছিল নইলে হয়ত কিছুই রক্ষা পেত না।
সেই শেষ। বাবা আর কোনওদিন কুষ্টিয়াতে যাননি। কোথাও একটা গভীর, চাপা অভিমান ছিল। যেতে বললেও অস্বীকার করেছেন। তবে ফল্গুধারার মতো কুষ্টিয়ার স্মৃতি বাবার মনে বয়ে চলেছিল। আমার শৈশব ও বাল্যকালে বাবার কাছে কুষ্টিয়ার অসংখ্য গল্প শুনেছি। সেই গোরাই নদী, কুষ্টিয়া হাই স্কুল, থানা পাড়া, চড়োই খোলে গোরাই নদীর উপর রেলব্রিজ, মোহিনী মিল, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর কোম্পানি, খেলার মাঠের গল্প— বাবা ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন, মোহনবাগানেও খেলেছেন, কুষ্টিয়ার আশেপাশের এলাকার কথাও শুনেছি — চুয়াডাঙ্গা, পোড়াদহ, জগতি, কুমারখালি, কয়া, গোয়ালন্দ — নামগুলি আমার আশৈশব পরিচিত। মায়ের কাছে শুনেছি কুষ্টিয়ার সংসারের গল্প — পুণ্যাহ, প্রজাবিদায়, অন্তরের পুকুরে সাঁতার কাটা, আমবাগানে আমকুড়ানো, বাড়িতে দু-বেলা পরিবার, আত্মীয়, আশ্রিত চল্লিশজনের পাত পড়া — সব স্মৃতি বাবা-মার বুকের মধ্যে পাথর হয়ে জমেছিল। মা-র আবেগের প্রকাশ একবারই মাত্র দেখেছিলাম দক্ষিণ ভারতে বাবার এক দক্ষিণী সহকর্মীর কুষ্টিয়ার মতোই পুত্তুর নামে এক ছোটো মহকুমা শহরের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। নারকেল বাগান, সুপুরি বাগান, স্বাচ্ছল্য মাকে কুটিয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। মা অঝোরে কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন, “নিজেদের তো সব ছিল। সব ফেলে রেখে এসে এখন আমাকে অন্যের দেখে ‘খুব ভালো’ বলতে হবে!” সেখানে আমি অনুভব করেছিলাম আমরা কত শেকড়হীন হয়েছি। আমাদের দক্ষিণী বন্ধুর পরিবার, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম যে আধুনিকতা এলেও তাদের সমাজ-সম্পর্কের শিকড় গভীরভাবে সমাজে প্রোথিত। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে স্থিতিশীল। অর্থনৈতিকভাবে সম্পদশালী। আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমরা কী হারিয়েছি। বাকি ভারতের কাছে আমরা এখন করুণার পাত্র।
আশৈশব বাবা-মার কাছে কুষ্টিয়ার কথা শুনে কুষ্টিয়া আমার মনে এক স্বপ্নময় কল্পজগতের সৃষ্টি করেছিল। চাক্ষুষ কুষ্টিয়া দেখার সুযোগ এল ১৯৮১ সালে। দেখলাম বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জানা গেল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বাড়ির আমবাগানে ধরে এনে খুন করে পাশেই গোরাই নদীতে ফেলে দিত। বাড়ির বাসিন্দারা পলাতক। সেই থেকে বাড়িটি পরিত্যক্ত। আমি সেই পরিত্যক্ত বাড়ির ঘর-বারান্দা সব ঘুরে দেখলাম। আমার নিজেকে ক্ষুধিত পাষাণের নায়কের মতো মনে হচ্ছিল। এখুনি যেন দাদু-ঠাকুমার কণ্ঠস্বর, মায়ের হাসি, বড়দির কান্না শুনতে পাব। আমার রোমাঞ্চ হচ্ছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে বাড়ির সদর দরজার সিঁড়িতে চুপ করে বসেছিলাম আর পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচারণ করছিলাম। ঠাকুরদার উদ্দেশ্যে মনে মনে বলছিলাম — “দাদু আমি তোমার নাতি। চলে গিয়েও আবার এ বাড়িতে ফিরে এসেছি।”
দ্বিতীয়বার কুষ্টিয়া যাই ২০১৮ সালে সস্ত্রীক। কিন্তু সময় অনেক বয়ে গেছে। দেখলাম বাড়িটি আর নেই। পুকুর দু-টিও আর নেই। কুষ্টিয়া শহরেরও বড়ো আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের বাড়ির জায়গায় এখন একটি বহুতল তৈরি হয়েছে। সামনে গোরাই নদীর উপর বিশাল ব্রিজ। স্ত্রীকে আর তার আদি শ্বশুরবাড়ি দেখান হল না। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।
তবু সে রয়ে গেল। আমার মনের মধ্যে যে কল্পজগতের সৃষ্টি হয়েছিল কুষ্টিয়া নিয়ে, সেইখানে সে রয়ে গেল অমলিন — চিরভাস্বর।