দেশভাগ ও মানবীয় সম্পর্ক

দিলীপ দাস 

১৯৭২ সালের এপ্রিল। দীর্ঘ নয় বছর পরে আবার জন্মভূমিতে গেলাম। ১৯৬৪-তে যখন দেশ ছেড়ে আসি তখন বয়স এগারো, দেশটির নাম পূর্ব-পাকিস্তান। আর বাহাত্তরে, ১৯ বছর বয়সে যখন আবার দেশে গেলাম, তখন পূর্ব-পাকিস্তান মুছে নতুন এক দেশের জন্ম হয়েছে। বাঙালির একমাত্র দেশ। যেখানে বাংলা মাতৃভাষা। ফোনের নাম দূরালাপনী, এয়ারম্যান মেসের নাম বৈমানিক ভোজনালয়, এমনি আরও কত কি। সব সাইনবোর্ড বাংলায়। লন্ড্রির নাম মলিন মোচন।  

যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন তখনও দেশের সর্বাঙ্গে। সেবারই আমি প্রথম ঢাকায় গিয়েছিলাম। মেঘনা নদী পেরোতে হল নৌকায়, কারণ মেঘনার বিখ্যাত পোল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নৌকা ভাড়া মাত্র চার আনা, অর্থাৎ এক সিকি। ভৈরব থেকে ট্রেনে উঠতে হয়। কারণ চট্টগ্রামের ট্রেন আশুগঞ্জ এসে থেমে যায়, মেঘনার পোল পেরোতে পারে না। রেলের রাস্তা তখনও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ডিনামাইট দিয়ে যেসব জায়গা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেসব জায়গায় ট্রেন চলে শম্বুক গতিতে। ঢাকায় যখন পৌঁছুলাম কমলাপুর স্টেশন ছাড়া বাকি অঞ্চলে অন্ধকারের একচ্ছত্র আধিপত্য। রাস্তার কিনারে ইলেকট্রিকের তার পেঁচিয়ে পড়ে আছে। বাড়িঘরগুলোও অন্ধকারে। আমার রিক্সাওয়ালার হারিকেনের আলো যতটুকু আলোকিত করে রাস্তায় ততটুকুই আলো।

যেতে যেতে আমার রিক্সাওয়ালা রাস্তার বাম দিকের একটি প্রায়ান্ধকার বাড়ি দেখিয়ে বললেন, এইটা অমুক হোটেল। সত্যজিত রায় এই হোটেলে থেকেছিলেন। রিক্সাওয়ালা হঠাৎ সত্যজিত রায়ের কথা বললেন হয়তো আমি ভারতীয় বলে। যে হোটেলে আমাকে নিয়ে তোলা হল তার নাম কুমিল্লা মুসলিম হোটেল। গুলিস্তান সিনেমা হলের কাছে, আবার ওদিকে সদরঘাটও দূরে নয়। রাত এগারোটা বাজে, ঘুমুতে যাব, হঠাৎ বাইরে স্টেনগানের আওয়াজ। কে যেন বললেন, ছিনতাইবাজরা বেরিয়েছে। আর-একজন ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন, মিয়া, বাতি নিবান। বাতি নিবান।  আল্লারে ডাকেন। আমার তো আল্লাও নেই, ঈশ্বরও নেই। আমি কাউকে না-ডেকে বিছানার উপর গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম। এরপর একটা শোরগোল শোনা গেল।  কিছুক্ষণ পরে সব থেমে গেল। কে যেন বললেন, ছিনতাইবাজরা ধরা পড়সে।  আবার আলো জ্বলল। দেখলাম অন্যান্যরাও আমার মতোই বিছানায় ভয়ে জড়সড়ো। সেবার ঢাকায় এক সপ্তাহ ছিলাম। চারিদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের এক করুণ ছবি সেদিন দেখেছিলাম।  

এতক্ষণ এত কথা বললাম, তখনকার বাংলাদেশের অবস্থা বুঝানোর জন্য।  

গত নয় বছরে কতকিছু পালটে গেছে আমি অবাক চোখে দেখি। আমাদের পাড়াটাকে আর চেনা যায় না। কেমন ছন্নছাড়া অবস্থা। গৌরাঙ্গ দাসরা ছিলেন আমাদের পাড়ার সবচেয়ে ধনী পরিবার। তাঁদের চারভিটিতে বড়ো বড়ো চারটে আটচালা টিনের ঘর। দুটো ঘর প্রায় খালিই পড়ে থাকত। আমরা সেই ঘরগুলোতে লোকপলান্তি খেলতাম। একটি ঘরও নেই। কে বা কারা যেন উপড়ে নিয়ে গেছে।  মাটির ভিটিটুকু নিয়ে লাভ নেই বলে ফেলে রেখে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সরাইল  রাস্তার পাশে আমাদের জ্যাঠামশায়দের বাড়ির উত্তরের আটচালা টিনের ঘরটি উধাও, পুবভিটির আটচালা টিনের ঘরটিরও সব টিন খুলে নিয়ে গেছে। ঘরটির বেড়া কোনও মতে টিকে আছে। পাশের বাড়িটি আমাদের, তা মোটামুটি অক্ষতই আছে, কারণ এবাড়িতে রমজান কাকা থাকতেন, যার সঙ্গে বিনিময় করে আমরা ওপারে চলে গেছি; নিছক ভয়ে। ছত্রখান বাড়ির দক্ষিণ দিকে খালটি তখনও অক্ষত আছে (পরে যা ড্রেনের মতো হয়ে পড়বে), আর বাঁশঝাড়গুলো আছে, তবে তেমন বাঁশ নেই। কেমন ন্যাড়ান্যাড়া।

আমার বাল্যবেলার বন্ধুরা কে কোথায় আছে তখনও জানি না। শুধু হাসান আছে এটুকু জানি। খসরু, ফয়েজ, শান্তি কোথায় আছে জানি না। কানুরা তো কবেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে। শুনেছি ওদেরকে দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দিয়ে ভারত সরকার কর্তব্য করেছে। ওরা কেমন আছে, আদৌ আছে কিনা কেউ বলতে পারে না।  মেয়েবন্ধুদের প্রায় সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে।  

আমার গ্রাম, আমার পাড়ায় আছি, দু-পা দূরেই আমার চির চেনা তিতাস নদী, তবু যেন কেমন খালি খালি লাগছিল। এত চেনা রাস্তাঘাট আট-নয় বছরে কেমন অচেনা হয়ে গেছে। আগে যা কিছু দূরের মনে হত এখন যেন কেমন কাছে এসে গেছে। আমাদের ছোটোবেলার দূরত্ব বোধ আর বড়োবেলার দূরত্ব বোধ বোধহয় এক থাকে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমার বাল্যবেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর আর আগের মতো নেই।  

কেমন ছাড়া ছাড়া। যেখানে যা ছিল সেখান থেকে তা উধাও। নয় বছরে সবকিছু এত বদলে যায়!  

হাসানকে বাড়িতেই পেলাম। সে-ও আমার মতোই ১৯ বছরের যুবক। শোনলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। হাসান বলল, চলো, তোমাকে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। বললাম, কে?  

হাসান বলল,  চলোই না….. 

আমাদের বাড়ির রাস্তার ওপারে ছিল প্রতাপ পালের মুদির দোকান। দোকানে বসেই প্রতাপ পাল থেলো হুঁকোয় তামাক খেত। তেলি পাগলি এলে এক কোষ তেল দিয়ে দূর-দূর করে বিদেয় করে দিত। কিন্তু এন্তা পাগলাকে কিছু বলত না। ভয় করত এবং সমীহ করত। সরাইল থেকে এন্তা পাগলা রোজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আসত। কেন আসত কেউ জানত না। কারও কাছে হাত পাততেও দেখিনি। দশাসই চেহারা।  রীতিমতো সুপুরুষ। সারা গায়ে কোনও বস্ত্রখণ্ড নেই শুধু একখানি ছালার লেংটি ছাড়া। হাতে থাকত হাত দুয়েক লম্বা একখানা শক্তপোক্ত লাঠি। ‘এন্তা গোল গোল বাতাসা’ বললে কেন যে খেপে যেত কে জানে! মুদির দোকানটি ছিল গোলাপদাদের বাড়িতে। খুব সাজানো গোছানো ছিল গোলাপ মিয়ার বাড়ি। বাগান ছিল। বাগানে নানা ধরনের গোলাপ গাছ, কলাগাছিয়া ফুল, মোরগচণ্ডী ফুল, দোপাটি আরও কত ফুল গাছ ছিল।  কুমারশীলের মোড়ে গোলাপদার মাইকের দোকান ছিল। সম্ভবত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মাইকের দোকান। রোজই গান বাজত। সব গানই ছিল ভারতের বাংলা সিনেমার গান। ‘আপনা দিল তু আওয়ারা’, ‘নীলামবালা ছ আনা’, ‘চিড়া ভাজারে তোর লাগি ঘুম আসে না’, ‘মরমিয়া তুমি চলে গেলে’ এরকম গানগুলোর কথা এখনও মনে আছে।  

এখন প্রতাপ পালের দোকান আর নেই। হয়তো তিনি আমাদেরই মতো দেশান্তরী হয়েছেন। সেখানে খান চারেক দোকান নতুন করে গজিয়েছে। একটা দোকানে চার-পাঁচটি ছেলে বসে আড্ডা মারছে। হাসান আমাকে সেই আড্ডাতেই নিয়ে গেল।  ঘরে ঢুকেই ফর্সা মতো একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলল, দেখ ত চিনতে পার কি না! আমি ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম। ছেলেগুলোও অপার কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কাউকেই চিনি  না। ওরাও আমাকে চেনে না। মাত্র তো নয় বছর! এরমধ্যেই সব এমন পালটে গেল! আমি কাউকে চিনতে পারছি না,  আমাকেও কেউ চিনতে পারছে না! আমরা কি এতই বদলে গেছি! হাসান কৌতূহলের পারদ আর না চড়িয়ে বলল, তোমরা কেউ চিনতে পারছ না! দিলীপ,  আমাদের বন্ধু দিলীপ।  

আড্ডারুদের মধ্যে এবার একটু চাঞ্চল্য জাগল। ফরসা মতো ছেলেটি এবার উঠে দাঁড়াল, তারপর দু-পা এগিয়ে এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! হাউমাউ করে সে কি কান্না তার। আমিও কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, তুমি এমন করে চলে গেলে! আমাকে একটু বলে গেলে না!  

দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। অন্যদেরও কেমন বিহ্বল চাহনি! হাসান এবার আমাকে আবার বলল, বলো তো কে? আমি চেয়েই আছি। কে হতে পারে! হাসানই রহস্য উন্মোচনের ভঙ্গিতে বলল, খসরু…. খসরুকে তোমার মনে নেই! ওরা এখন নাসিরনগর থাকে…. 

এবার খসরুর চেহারা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। সারাদিন তো খসরুদের বাড়িতেই ছিল আমাদের আড্ডা। খসরুর এক কাকা ছিল — ফয়েজ। বাঁ হাতটি ছিল ঢ্যাঙা। খসরুদের বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করত।

আস্তে আস্তে অনেক কথা মনে পড়ল। খসরুর বাবা একটা অফিসে চাকরি করতেন। একবার খসরুর মা-বাবা-বোন সবাই গ্রামের বাড়িতে গেল। সেদিন রাতে খসরুদের ঘরে হাসান-সহ আমরা চারজন কাটিয়েছিলাম। গল্প করে, আড্ডা মেরে, অনেক রাতে আমরা ঘুমুতে গেলাম। ডিম আর আলু সেদ্ধ ভাত ছিল রাতের মেনু। মুসলমান বাড়িতে রাত কাটানো, একসঙ্গে খাওয়া, এইসব কি করে যেন পাড়ার গুরুপদদা জেনে গেলেন। তারপর সে কি নিন্দেমন্দ! শেখবাড়িতে ভাত খেয়েছি বলে আমার নাকি জাত গেছে! কিন্তু আমাদের বাড়ির কেউ সেসব পাত্তাই দিল না। ফলে, দুদিন পরেই গুরুপদদা চুপ মেরে গেলেন।  

খসরু টেনে নিয়ে পাশে বসাল। অন্যরাও তখন চিনতে পেরে অনেকে কথা বলল। খসরু ব্যথিত দু-চোখ মেলে বলল, তুমি এভাবে চলে গেলে! আমাকে একটু বলে গেলে না!  

বললাম, তোমার সঙ্গে যে তখন আমার কথা বন্ধ। কী একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। তাই আড়ি।  

খসরু এবার হেসে ফেলল। হাসতে লাগল অন্যরাও। সত্যি, কী ছেলেমানুষই না ছিলাম!  

জানুয়ারির শীতের দুপুর। বাবা আমাকে নিয়ে লঞ্চঘাটের দিকে চলেছেন। মা-র চোখ ছলছল, ঠাকুমা নদীর ঘাট পর্যন্ত এসেছেন, জোরে কাঁদলে হবে না, সবাই নানা কথা জিজ্ঞেস করবে, তাই আষাঢ়ে মেঘের মতো তাঁর মুখ থমথমে, ঠাকুরদা সবসময়ই চুপ থাকেন, এখন যেন একেবারেই  চুপ, ছোটোছোটো ভাইবোনেরা বুঝতেই পারছে না তাদের দাদা কোথায় চলে যাচ্ছে! 

কারখানারঘাট থেকে আমরা লঞ্চে করে যাব চান্দুরা, সেখান থেকে মাঝরাতের অন্ধকারে সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে যাব এক নতুন দেশে, তার নাম ইন্ডিয়া।  ইন্ডিয়ার যেখানে যাব তার নাম নতুন হালি অর্থাৎ নতুন হাবেলি। জায়গাটির পোশাকি নাম আগরতলা।  

নদীর ঘাটেই হাসানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে স্নান করতে এসেছে। তার হাত ধরে বললাম, ইন্ডিয়া যাই গা। না, এই বলার মধ্যে কোনও দুঃখ ছিল না। যেন ইন্ডিয়া যাওয়ার মধ্যে বিচ্ছেদ ভারাতুর কোনও ব্যাপার নেই। এ যাওয়া যে চিরদিনের জন্য যাওয়া, আর যে কোনও দিন এখানে ফিরে আসা হবে না, এগারো বছরের বালকের সে কথা মনেই এল না। জন্মভূমি ত্যাগের কষ্ট, বেদনা, তার কিছুই সেই বালকের উপলব্ধিতে ছিল না। অনেক পরে, প্রায় ছ-সাত বছর পরে, সেই বালক যখন একটু বড়ো হয়েছে, নাকের নীচে পাতলা মিহি গোঁফ গজিয়েছে, একটু সাবালক হয়েছে,  সে তখন জন্মভূমির প্রতি এক অকারণ টান অনুভব করল। সেটা যে কীসের টান এবং কেন, সে তখনো বুঝতে পারল না। শুধু মনে হল, সে যেন কী হারিয়েছে, যা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না।

আমার বাবার মামাবাড়ি ছিল সানমুড়া নামে এক জায়গায়। আগরতলা শহর থেকে খুব দূরে নয়। তারা বাড়ি পালটাপালটি করে এপারে চলে এসেছে। রাউৎহাটে তারা ছিল যথেষ্ট সচ্ছল। বাবার মামা চৌকিদার ছিলেন বলে এক সময়ে বেশ দাপটও ছিল। জমিজমাও বেশ ছিল। কিন্তু এদেশে এসে তারা পড়লেন একেবারে দারিদ্র্যের মুখে। তাদের বাড়ির কাছেই সীমান্ত। দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে। এখানকার লোকেরা সীমান্ত চেনে না, চেনে বর্ডার। বাড়ি থেকে একটু দূরেই একটি ছোটো পাহাড়, এখানকার লোকে বলে টিলা। টিলা পেরোলেই সমতল ভূমি, আর ওইটাই নাকি অন্য দেশ, যেখানে পাসপোর্ট ছাড়া যাওয়া যায় না।  

একদিন বিকেলে সন্ধ্যা হয়-হয় সময়ে, কি জানি কেন ওই টিলার দিকে তাকিয়ে আমার মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। চোখ জলে ভরে উঠল। অথচ, আমি এর কারণ জানি না। মনে হল, আমি যেন কী হারিয়েছি। কী হারিয়েছি তা-ও স্পষ্ট নয়। আমার যেন কী ছিল, যা এখন নেই। আমি তো এদেশে খারাপ নেই। স্কুলে পড়ছি, কিছুদিন পরে কলেজে যাব, তাহলে এমন খালিখালি লাগছে কেন?  

আমি এদেশে আসার দু-তিন মাস পরেই আমাদের পুরো পরিবার সম্পত্তি বিনিময় করে এপারে চলে এল। তবু, এমন শূন্য লাগছে কেন, সেদিনের বালক তা বুঝতে পারেনি। কোনও স্মৃতি আমাকে খুব তাড়িত করছে, তা-ও নয়। তাহলে, কী সেই ব্যথা, কী সেই হারিয়ে ফেলা! 

দেশত্যাগ এবং সম্পত্তি বিনিময় পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু মানুষের কাছে তখন অমোঘ ভবিতব্যের মতো। যেন এর কোনও বিকল্প কেউ জানে না। যেন এটাই অলিখিত আইন। মন্দভাগ্য মানুষদের এই পরিণতি মেনে নিতেই হবে! সাত পুরুষের যে ভিটেকে এতদিন নিজের বলে জানতেন, রাতারাতি সেখানে হয়ে গেলেন পর। ভয় কী করে মানুষকে রাতের অন্ধকারে পালাবার প্ররোচনা দেয় সংখ্যালঘু না-হলে সেটা বোঝা যায় না। পৃথিবীর  যেখানে যে সংখ্যালঘু তারই জীবন যেন অনিশ্চয়তায় ভরা। নিরাপত্তাহীনতা, গলা উঁচিয়ে কথা বলার কোনও অধিকার তার নেই। একই দেশে বাস করেও সংখ্যাগুরুর জীবন আর সংখ্যালঘুর জীবনে কত ফারাক। কখনো জাতের নামে, কখনো ধর্মের নামে, কখনো অন্য কোনও অছিলায় তার জীবন নিরাপত্তাহীনতার মোড়কে বাঁধা। নতুন উৎপাত জুটেছে রাজনীতির নামে। মানুষকে স্থানচ্যুত করে বাস্তুহীন করার খেলা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে।  

আমি চলে আসার মাস তিন-চার পরেই আমাদের পরিবার বাড়ি বদল করে এপারে চলে এল৷ আগেও বলেছি। ১৯৬৪-৬৫ সালে বাড়িঘর বদল করার সুযোগ ছিল। তখন ব্যাপারটা প্রায় হিড়িকের মতো শুরু হয়েছিল। যারা এপারে, অর্থাৎ ইন্ডিয়াতে ছিলেন, সংখ্যালঘু হয়ে, তাদের অবস্থাও ছিল প্রায় একই রকম। নইলে তারাই বা চোদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ওপারে, পাকিস্তানে  যাবেন কেন! একই মনোকষ্ট,  মর্মবেদনা ছিল তাদেরও। এপার থেকে যারা ওপারে গেলেন, তারাও খুব সুখে ছিলেন তা নয়। আমার ছেলেবেলার যে সংখ্যালঘু বন্ধুরা ওপারে চলে গেল, তাদের মুখে শুনেছি, যে নিরাপত্তা ও সম্মানের আশায় তারা গিয়েছিল, তা তারা পাননি। একে শিকড়ের টান তাদের বেদনাহত করে রেখেছিল, অন্যদিকে, ওদেশে জমিজিরেত দখল নেওয়ার আগেই তারা দেখলেন কিছু জমি বেহাত হয়ে গেছে। কিছু দুর্বৃত্ত,  কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি তা দখল করে নিয়েছে। মনুষ্যসমাজে আর যা কিছুরই অভাব থাকুক, কোনও দিন দুর্বৃত্তের অভাব পড়েনি। সকলকালে, সকল দেশেই দুর্বৃত্তরা সংখ্যাগুরু জনসমষ্টির প্রশ্রয় পেয়েছে। সেদিন, সরকার তো বলেইনি, একজন মানুষও বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে বলেনি, তোমরা দেশ ছেড়ে চোদ্দো পুরুষের ভিটে ছেড়ে যাবে কেন? আমরা আছি। আমরা তোমাদের আগলে রাখব। যা আছে তাই আমরা ভাগ করে খাব। না, কেউ বলেনি। আজও যেমন কেউ বলে না। না এদেশে,  না ওদেশে।

যে কথা বলছিলাম, আগরতলা শহরের প্রান্তেই আমাদের বাড়ি বদল হয়েছিল। সাদা চোখে দেখলে আমরাই লাভবান হয়েছিলাম। রমজানকাকা তার বন্ধুকে বলা যায় জিতিয়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বাবার স্বল্প রোজগারে ওদেশে মোটামুটি চলে যেত। কিন্তু এদেশে চলা খুব দুষ্কর হল। বাড়িটি শহরের কাছে হলে কি হবে,  চারিদিকে ফাঁকা। দূরে দূরে বাড়িঘর আর আচোট জমি। গাছপালা প্রায় নেই।  ঝড়-ঝঞ্ঝা আমাদের বাড়িটিকে নিশানা করেই যেন আসত। ফলে, বছরে দু-তিনবার ঘরের চাল উড়ে যেত। একে স্বল্প রোজগার, তার মধ্যে এই উৎপাত পরিবারটিকে একেবারে সর্বস্বান্ত করে দিল। আমার দাদু এবং ঠাকুমা এইরকম পরিবেশে, আর্থিক দুর্দশায় নিজেদের একেবারেই মানিয়ে নিতে পারলেন না। ফলে তাঁরা অচিরেই গভীর মনোবেদনা নিয়ে চলে গেলেন। আমি নিশ্চিত, পাকিস্তানের বাড়িতে থাকলে তাঁরা এত তাড়াতাড়ি চলে যেতেন না।  

দেশভাগ বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের জীবনে যে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, মনোবেদনার কারণ হয়েছিল, তা ভারতের আর কোনও প্রদেশের মানুষের জীবনে ঘটেনি।  স্বাধীনতার যুদ্ধে অকাতরে রক্তদানের পুরস্কারই হয়তো তারা এভাবে পেয়েছিলেন। ভারতের অন্য প্রদেশের লোকেরা দিব্যি বহাল তবিয়তে থেকে স্বাধীনতার সকল সুযোগ সুবিধা চেটেপুটে খেলেন, ফলে, বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের দুঃখ দুর্দশা তারা কেউ বুঝতেই পারলেন না। সেদিনও তারা বুঝেননি, আজও বুঝেন না। শুধু গল্প-উপন্যাস-কবিতা ও সিনেমায় হতভাগ্য মানুষগুলোর দুর্দশা পড়ে এবং দেখে কিঞ্চিৎ হা-হুতাশ করে নিজেদের কর্তব্য সমাপন করেন। তবু পাঞ্জাবিরা কেন্দ্রের সরকারের সাহায্য পেয়ে কিছুটা শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারলেন। সবুজ বিপ্লবের পুরো সুবিধাও পেলেন।

কিন্তু বাঙালির কপালে জুটল দুর ছাই, স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, ফুটপাথ, কলোনির বস্তি, জঙ্গুলে জমি, দণ্ডকারণ্য আর আন্দামানের নির্বাসিত জীবন। কেন্দ্রের যে সামান্য সাহায্য জুটল তা এতই অকিঞ্চিৎকর আর হেলাফেলার যে, পিঠ ঢাকতে গিয়ে বুক উদোম হয়ে যায়। আর দিল্লির মসনদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা তো তাদেরই রয়ে গেল, যারা নতুন দিল্লির চারপাশে ঘিরে ছিল।  

পুরোনো কথায় ফিরে যাই। একবার আমি, আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্র আখাউড়া থেকে ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাব। এত ভিড় যে ট্রেনে উঠাই মুশকিল। তবু আখাউড়া থেকে একজন বন্ধুস্থানীয় ঠেলেঠুলে ট্রেনে তুলে দিলেন। কিন্তু বসার জায়গা নেই। ঠিক ভাবে পা রাখার জায়গাই নেই তো বসার জায়গা! মুশকিল আসানের মতো এসময় এক বয়স্ক ভদ্রলোক, মুখে দাড়ি মাথায় ফেজ টুপি, আমার স্ত্রীকে ডাকলেন — অ বেডি (মানে মেয়ে) এইখানঅ আয়। এই মিয়ারা, মায়াডারে একটু বআর জাগা দেন না। বলে নিজেই ঠেলেঠুলে বসার জায়গা করে দিলেন। কৃতজ্ঞতায় আমাদের মন ভরে গেল। 

আর-একবার ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরছি। বসার টিকিট পাইনি। তাই দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একটি যুবক উঠে দাঁড়াল। আমার স্ত্রীকে বলল, আপা, আপনে বসেন। স্ত্রী বললেন, না না, তুমি বসো। যুবকটি কিছুতেই বসল না। উলটে বলল, আমারে চিনতে পারসেন নি! আমি অমুক। সুলতানপুর ইস্কুলে আপনের ছাত্র আছিলাম। এবার দিদিমণির অধিকারে আমার স্ত্রী আসন গ্রহণ করলেন। কিন্তু তিনি এই বাধ্য ছাত্রটিকে তখন চিনতে পারলেন না। পরে আমাকে বলেছিলেন, এর নাম ছিল সম্ভবত আনোয়ার। একেবারে পচা ছাত্র ছিল। পড়াশোনায় খারাপ হলে কি হবে,  আদবকায়দায় ছেলেটি ছিল যথেষ্ট ভালো। (বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার স্ত্রী সুলতানপুর স্কুলে মাস ছ-সাত পড়িয়েছিলেন। এতদিন পর সেই সুবাদেই এক ছাত্র নিজের বসার জায়গা ছেড়ে দিয়ে শিক্ষিকাকে সম্মান জানাল।)

আর একটি মানবীয় সম্পর্কের কথা বলেই এ লেখা শেষ করব।  

আসলে, মানুষের মানবীয় সম্পর্কগুলো কিছু লোকের চোখের বিষ। তারা চায় না,  মানবীয় সম্পর্কগুলো টিকে থাকুক। তাই ভিন্ন ভিন্ন দেশ তৈরি করে, সীমান্ত ভাগ করে, জাতির নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে এত বিভেদ, এত বিদ্বেষের বিষবৃক্ষের সযত্ন লালন পালন। এগুলো না থাকলে হয়তো কিছু লোক ভালো, আর কিছু লোক খারাপ থাকত না। সকলেই মোটামুটি ভালো থাকত। আমাদের এক কবি লিখেছিলেন, কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে। কিছু মানুষ সত্যিই তো ভালো রয়ে গেছে। নইলে এক বৃদ্ধ একটি স্বল্প পরিচিত মেয়ের মাথায় ছাতা ধরে কেন স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে! কেন ভিন ধর্মী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,  মাইঅ, তুই তর বাপেরে ভুইল্যা গেছস!

আমার স্ত্রী বিয়ের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুরের একটি স্কুলে আট-নয় মাসের জন্য শিক্ষকতা করেছিলেন। বাস থেকে নেমে বেশ খানিকটা রাস্তা হেঁটে স্কুলে যেতে হত। যাবার পথে দেখতেন এক বৃদ্ধ একটি ছোটো দোকানে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। রোজই বৃদ্ধকে দেখতেন। ধীরে ধীরে কথা হল, কি গো মাইঅ, তুমরার বাড়ি কই? বাড়িতে কে কে আছেন? ইখানঅ কই থাক, ইত্যাদি। এরপর বৃদ্ধর রোজকার কাজ হল লম্বামতো মেয়েটিকে রোদ থেকে বাঁচাতে মাথায় ছাতা ধরে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। রোদ-বৃষ্টি কিছুতেই এর অন্যথা হত না। কথায় কথায় বৃদ্ধ জানাল,  তাঁর দুই ছেলে। একজন শহরে থাকে, আর ছোটোজন এই স্কুলেই পড়ে। মেয়ে নেই।  

লম্বা, একহারা চেহারা বৃদ্ধের। নাম সুলতান খাঁ। কিছু জমিজমা আছে, লোক দিয়ে চাষ করান। আগে নিজেই চাষ করতেন, এখন আর পারেন না। ছেলে দুটোর চাষবাসে মতি নেই। হেরা খালি চাকরি আর শহর চিনে।  

বৃদ্ধর বাড়ি পাশের গ্রামেই। নাম রাধিকা। এরপর একদিন বৃদ্ধ বলেই ফেলল, আমার মাইয়া নাই, তুই আমার মাইয়ার লাখান। দুজনের বাপ-মেয়ের সম্পর্ক হয়ে গেল এরপর। যেদিন স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যায়, সেদিন বৃদ্ধ মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যান। তোর মা তোরে দেখতে চায়। মা নরম-সরম গ্রামের মানুষ। ঝি-কে (মেয়েকে) খালি চোখ ভরে অবাক হয়ে দেখেন। যেদিন ঝি আসবে সেদিন ভালো-মন্দ রান্না করে রাখেন। ঝি আচার ভালোবাসে, তাই নানা রকমের আচার বয়াম ভরতি করে বানিয়ে রাখেন। কোনো কোনো দিন যাওয়ার সময় দিয়েও দেন। মেয়ে শহরে বোনের বাড়ি থাকে। আম-কাঁঠাল-কলা পাকলে বুড়ো তা নিয়ে বোনের বাড়িতে হাজির হন।  বোনকেও মাইঅ ডাকেন।  

রাধিকা গ্রামে সুলতান খাঁর প্রচুর আত্মীয়স্বজন। সবাই জানে এই মেয়েটি সুলতান খাঁর মাইয়া। যেদিন মেয়ের চাকরি শেষ হল, সেদিন বুড়ো-বুড়ির প্রচণ্ড মনখারাপ।  দুচোখ ভরা জল। ছোটো ভাইটি মুখ ভার করে ঘুরে বেড়ায়। কাল থেকে আপা আর আসবে না। স্কুলেও না, তাদের বাড়িতেও না। সুলতান মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চোখ মুছেন। আর তাঁর স্ত্রী গ্রামের প্রান্তে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যতক্ষণ মেয়েকে দেখা যায়, আর বারবার আঁচলে চোখ মোছেন। 

সুলতান খাঁ ছিলেন ভারতের লোক। কলকাতার পার্ক-স্ট্রিট অঞ্চলে বাড়ি ছিল। দর্জির কাজ করতেন। বেশ ভালোই ছিলেন, রোজগারপাতিও ভালো ছিল। ভালো মানুষ হিসেবে এলাকায় তাঁর নামডাকও ছিল। কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গা সব তছনছ করে দিল। তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন। মনে ভয় ঢুকে গেল। নিজেকে খুব অনিরাপদ বোধ করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত দেশ ভাগ হওয়ার কিছুদিন আগে সব ছেড়ে ছুড়ে ভাইবেরাদর, আত্মীয়স্বজন নিয়ে দেশ ছেড়ে এসে সুলতানপুরে বাসা বাঁধলেন। সেই থেকে এই রাধিকা গ্রামে তাঁর বাস।  

এদিকে, মেয়েটির বাবাও তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড়ি বিনিময় করে আগরতলার কাছে খয়েরপুরে চলে গেছেন ১৯৬৫ সালে। ওই একই বৃত্তান্ত, অনিরাপদ বোধ করা।  সুলতানপুরের চাকরিটি চলে যাওয়ার পর মেয়েটি তার বাবার বাড়িতে চলে গেল।  এরপর সরকারি চাকরি, বিয়ে, সন্তান জন্মানো, ইত্যাদির পর আবার বাংলাদেশের  বাপের বাড়ি গেল। ততদিনে আট-নয় বছর পেরিয়ে গেছে। জামাইমিয়াও এবার মেয়ের সঙ্গে এসেছে। মূলত বাবা-মাকে জামাই দেখানোর জন্যই মেয়ের বেশি উৎসাহ।  

গ্রামে ঢুকে দুটো বাড়ি পরেই সুলতান খাঁর বাড়ি। মেয়ে গ্রামে পা দিতেই কে যেন ছুটে গিয়ে জানাল, ও সুলতান মিয়া, তোমার মাইয়া আইসে। লম্বা, ছিপছিপে এক বৃদ্ধ,  খালি গা, লুঙ্গি পরা, পাকা দাড়ি, পাকা চুল, প্রায় ছুটে এলেন। এসেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুড়োর সেকি কান্না — ঝি (মেয়ে) তুই আমারে ভুইল্যা গেছস।  

বাড়িতে যাওয়ার পরে একটা উৎসবের আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়ল। কতদিন পরে মেয়ে বাপের বাড়ি এসেছে! সুলতান খাঁর আত্মীয়পরিজন এবং পাড়াপড়শিরাও মেয়েকে দেখতে এল। কত বচ্ছর পর সুলতান খাঁর মাইয়া আইসে। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে বলল, আসল মাইয়া না। ইন্ডিয়া থাকে।  

বাড়ির পোষা মুরগি ধরা হল। ঘরে খান্দেশ পিঠা, নাড়ু ছিল। জামাইমিয়াকে খাটে বসিয়ে পরিপাটি করে খেতে দেওয়া হল। ঘরের টিনের বেড়ায় মেয়ের দু-তিনটা বাঁধানো ছবি। সেদিকে তাকিয়ে বুড়ো ছলছল চোখে বলল, আমি ত ভাবসি, তোরে বুঝি আর দেখতে পামু না। অখন প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে। কবে শুনবি তর বাপ কবরে গেছে গা!  

মেয়ে বাপের জন্য একটা করাত মার্কা লুঙ্গি আর মায়ের জন্য শাড়ি এনেছিল। লুঙ্গি পেয়ে বুড়োর চোখ খুশিতে চকচক করে উঠল! বললেন, বুঝলি, তরার দেশের করাত লুঙ্গির মতো এমুন ভালা লুঙ্গি এই দেশঅ পাওয়া যায় না। বুড়ো সেই লুঙ্গি পরে দুপুরের নামাজ পরতে গেলেন। পথে যাকে পেলেন ডেকে ডেকে দেখাতে লাগলেন, আমার মাইয়া আনছে। ইন্ডিয়া থিকা। বুঝলা মিয়া, আসল করাত লুঙ্গি। বাইনডা (বয়নটা) দেখ, রংডা দেখ। এক্কেরে পাক্কা রং! 

জামাই এসেছে এই প্রথমবার, তাই কোর্মা, পোলাও যত্ন করে রাঁধা হল। খাটের উপর নতুন চাদর বিছিয়ে খেতে দেওয়া হল। জামাই এত কম খায় কেন, মেয়েকে এই অনুযোগ শুনতে হল। গ্রামের বাড়ি, ফ্যান নেই। খাওয়ার পর জামাই শোবে শাশুড়ি পাখা নিয়ে এলেন বাতাস করার জন্য। 

বড়ো ছেলে বাড়ি নেই তাই খুব আপশোশ করলেন, শাহনওয়াজডা জামাইবেডারে দেখতে পাইল না। নাতিরে একটা ট্যানটেনি গাড়ি, একটা বল বের করে দিলেন — নানা, তুমি এইডি দিয়া খেলঅ। রইদে যাইও না।  

মেয়েকে আস্তে আস্তে বললেন, জামাইবেডা পরথম আইলেন, তাইনরে ত কিছু দেওয়া হইল না। তুই ত না জানাইয়া আইয়া পড়লি। শাহনওয়াজডাও বাড়িত নাই।  এরপর খবর দিয়া আইবি।  

বিকেলে মেয়ে চলে যাবে। 

বুড়ো-বুড়ির মুখ ভার। চোখ ছলছল। এর মধ্যে বুড়ো জামাইবেডারে সারা পাড়া ঘুরিয়ে এনেছে। সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরিচয় থাকা দরকার। বুড়োবুড়ি না-থাকলেও জামাই মেয়ে এলে যেন একটু আদরযত্ন পায়।  

মেয়ে যখন সুলতানপুর স্কুলে চাকরি করত সেই দিনগুলোর মতো বুড়ো চলেছেন মেয়েকে বাসে তুলে দেবার জন্য। পথে যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে তারা জিজ্ঞেস করছে,  চাচা, তুমার মাইয়া কবে আইসিল? যারা চেনে না, তাদেরকে উপযাচক হয়ে বুড়ো বললেন, মিজানের বাপ, চিনছ নি, আমার মাইয়া। ইন্ডিয়া থাকে। নয় বচ্ছর পর আইল। আর ইলা জামাইবেডা!  

অচেনা লোকেরা একটু জরিপ করে নেয়। হয়তো মনে মনে বলে, মুসলমান বেডার হিন্দু মাইয়া! বুড়োর উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে একটু অবাকও হয়!  

বুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন গ্রামের প্রান্তে একটি ঝুপড়ি আমগাছের নীচে। বারবার আঁচলে চোখ মুছছেন, আর অপলক তাকিয়ে আছেন মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে। মেয়েও বারবার ফিরে তাকাচ্ছে, হাত নেড়ে বলছে বাড়ি যাও। কিন্তু বুড়ি একটুও নড়ছে না।  ঠায় দাঁড়িয়ে। যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়েই রইল।  

এবার বুড়োর পালা।  

মেয়ে বাসে উঠল আর বুড়ো কাঁদতে লাগল। জোরে জোরে বলতে লাগল, মাইঅ, আবার আইয়া দেইখ্যা যাইস। জামাইবেডা আবার আইয়েন। দাদু, তুমি মা-বাবারে লইয়া আইয়। এইবার ত কিছু করতে পারলাম না। জামাইবেডারে একটা কিছু দিতে পারলাম না।  

জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মেয়ে দেখল, বুড়ো ঠায় দাঁড়িয়ে। পাঞ্জাবি দিয়ে চোখ মুছছে আর হাত নাড়ছে।  

এইরকম সম্পর্ক এখনও অজস্র আছে। মাঝেমাঝে মনে হয় যারা দেশটাকে ভাগ করেছিল, যারা এখনও চায় দু-দেশের ফাটল আরও বিস্তৃত হোক, তাদের জিজ্ঞেস করি, এর কি কোনও প্রয়োজন ছিল? এতে কার লাভ হল?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান