যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের….

তীর্থঙ্কর চন্দ

তখনও আমাদের বাড়িতে মাটির মেঝে বাঁশের বেড়া খড়ের চাল। যদিও বাবা মা দুজনেই স্কুলে পড়ান, গ্রামের সবার খুব সম্মানীয় মানুষও তাঁরা, কিন্তু তখনও ‘মাস্টারদের মায়না’ এত না, যাতে পাঁচ সন্তান, এই বাড়িতেই থেকে পড়াশুনো করা আরও ভেতরের গ্রামের একজন ছাত্র, গ্রামতুতো এক আত্মীয় আর রান্নার লোক — কারণ বাবা মা দুজনকেই স্কুলে যেতে হয় — সব  মিলিয়ে এতজনের খরচ-খরচা চালানো যায়! ফলে মাথার উপর টিনের চাল তখনও কল্পনায়। কিন্তু সেই খড়ের চালের উপরও বড়ো নারকেল গাছ থেকে যখন ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশা ঝরে পড়ে, অত স্পষ্ট না হলেও একটা স্নিগ্ধ মিষ্টি আলতো আওয়াজ হয়! আমরা ওতেই অভ্যস্ত ছিলাম, কোনও কোনওদিন ওই শব্দে ঘুমের মধ্যে জেগে উঠে আবার একসময় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতাম। একটা চৌকিতে বাবার সঙ্গে শুই আমি, বাকি দুই দিদি-দাদা-ভাইকে নিয়ে মা আর-একটা চৌকিতে। ভোর রাতে ঘুম যখন অনেকটা হালকা হয়ে আসত, তখন সেই আশ্বিন কার্তিকের মাসে অনেকদিনই ঝরে পড়া কুয়াশার শব্দের সঙ্গে শুনতে পেতাম একটা পাখির ডাক, বেশ অনেকটা সময় ধরে প্রায় উলু দেবার মতো সেই ডাক। আমাদের গ্রামে অনেকে পাখিটাকে বলেন, জুকাইরা পক্ষী। আমাদের গ্রামে ওপার বাংলার বেশির ভাগ মানুষ সিলেটের হলেও ঢাকা, কুমিল্লা-র মানুষেরাও আছেন। কিন্তু উলুধ্বনিকে সবাই বলেন ‘জুকার’। ওপার বাংলার প্রায় সবাই হয়তো তাই বলেন। মনে করা যেতে পারে বিজন ভট্টাচার্যের ‘গোত্রান্তর’ নাটকও শেষ হচ্ছে হরেনমাস্টারের সেই বিখ্যাত সংলাপ দিয়ে ‘বুড়ি জোকার দেও, মাইয়া উঠাও ঘরে…’। — ছোটোবেলায় এইরকমই এক শেষরাত্রে জুকাইরা পক্ষী যখন আমাদের উত্তরের বাঁশ ঝাড় থেকে ডেকে চলেছে, ঘুম ভেঙে যায় আমার। বুঝতে পারি বাবাও জেগে আছে। বাবাকে আস্তে আস্তে ডেকে বলি, ‘বাবা, ওই শুনো, জুকাইরা পক্ষীয়ে ডাকে!’— বাবা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলেন, ’সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু মানুষগুলো গেলো কই!’ — আমি অবাক হয়ে পাশ ফিরে শোওয়া আমাদের স্বল্পভাষী বাবাকে দেখি হাত তুলে চোখ মুছছে! আর সঙ্গের সেই দীর্ঘশ্বাস!

আমাদের আদি বাড়ি কুমিল্লা জেলার আখাউড়া সাব-ডিভিসন, দেবগ্রাম। বাবার কাছে এই কথা শুনে শুনে প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে আমাদের। আমরা কোনওদিন যাইনি, কিন্তু পুরো গ্রামটাই যেন আমাদের চেনা। এখন হয়তো সেই দেবগ্রাম অন্য কোনও জেলায়। আমাদের আর-একটা বাড়িও আছে, আগরতলা রানিরবাজারে। বাবার ছোটোকাকা, আমাদের ছোটোদাদু থাকতেন ওখানে। পড়াশোনার জন্য বাবার শৈশব কৈশোর যৌবন সব শিলচরে। কিন্তু দেশভাগের আগে ছাত্রাবস্থায় পুজো আর গরমের ছুটিতে বাবাকে দেশের বাড়িতে যেতেই হত। বাবার সেই ছোটবেলার দেশের বাড়ির গল্প, বাবার বন্ধুজন, গ্রামের আরও সব মানুষের গল্প বাবার কাছ থেকে শুনে শুনেই আমাদের জানা। আমাদের মামাবাড়িও ঢাকায়, কিন্তু মা-রও ছোটো থেকে বড়ো হওয়া সবই শিলচরে, খুব কমই ঢাকায় যাওয়া। মায়েদের পরিবার যথেষ্ট সম্পন্ন এবং নাগরিক। দাদু শিলচরে চাকরি করতেন। বোধহয় যুদ্ধের সময়ই একবারই মায়েরা ঢাকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার স্মৃতিতে দেশবাড়ি গ্রাম সব একেবারে ফেলে আসা অতীতের অত্যুজ্জ্বল ছবি। বাবা কথা বলতেন কম, কিন্তু দেশ-বাড়ির কথা হলে বাবা যেন আপন আনন্দেই কথা বলতেন, হাসতেন, কখনও গলা ধরে আসত, নিঃশব্দে চোখ দিয়ে জল গড়াত, একটা অপ্রস্তুতের হাসি হেসে সেই আবেগটা যেন লুকোতে চাইত। স্কুলের প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বাবা যেন আর কঠিন একটা মানুষ। অন্য কেউ। গ্রামে একটাই হাই স্কুল, বাবা মা দুজনেই স্কুলে পড়ান। আমরাও ওই স্কুলে পড়েছি। বাবাকে বাড়িতে দেখে ভাবতাম, ইনি বাড়ির সেই আপনভোলা অনায়াসে পিঠে ঘাড়ে উঠতে দেওয়া সেই বাবাই তো! সেই বাবাই যখন বাবার সোনাকাকা, গ্রামের দুষ্টের শিরোমণি ব্যাঙ্গাদা-র গল্প বলতো, বলত চাওরার পিসির আদরের কথা, এক-দুবার দেখা মেঘনার স্মৃতিকথা, হা হা করে হাসত, কখনও কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে যেত, চোখ মুছত, আমরা মনে মনে ভাবতাম, যদি কেউ আমাদের কোনও একটা বর দিতে চায়, একটাই মাত্র বর, তাহলে আমরা বলব, দেশভাগটাকে একটা দুঃস্বপ্ন হিসাবে ধরে নিয়ে দুটো দেশকে আবার আগের মতো করে দাও! — বাস্তবে যে এটা হয় না, বুঝেছি অনেক বড়ো হয়ে। আরও বুঝেছি, দেশভাগ যারা করল, দুঃস্বপ্নের কারিগর তাদের কাছে তারা শিশু!

আমাদের কাছে দেশভাগ এসেছে বাবার গল্পে স্মৃতিকথনের হাত ধরে। প্রধানত বাবা-মাকে নিয়ে আমাদের বই ‘অর্ঘ্যকুসুম’-এ আমরা এ নিয়ে অনেকটা বড়ো করেই লিখেছি, মানে আমরা যতটা জানি, জেনেছি। আমার বন্ধু পার্থপ্রতিম মৈত্র তার কবিতায় লিখেছিল, কুশিয়ারার ওই পারে রয়ে গেছে আমাদের দাফনের মাটি!— শুধু এ জন্মে না, আমাদের পুর্বপুরুষেরা মরে যাবার পরেও উদ্‌বাস্তু হয়ে রইলেন, আমাদের এই বেদনা অক্ষমতা আমরা রাখি কোথায়! বাবার সেই বেদনার স্মৃতি আরও হাজারটা হয়ে বাজল গ্রামের দু-চারজন মানুষকে দেখে, তাদের কথা শুনে। অবশ্য কেউ-ই দেশভাগ নিয়ে কিছু বলতেন না, কিন্তু কোনও একান্ত মূহুর্তে, কোনও উৎসব আয়োজনে বেরিয়ে আসত সেই দুঃখ। গ্রামটিতে বেশ কয়েকটি পাড়া মণিপুরি, কাছারি রাজার আমল থেকে তাঁদেরই দেওয়া পত্তনিতে দেশমুখ্য এবং দেব উপাধিধারি কয়েকটি জনবসতি আর প্রধানত মুসলমান মানুষদের বাস ছিল। দেশভাগের পর আমরা উদ্‌বাস্তু মানুষেরা আস্তে আস্তে গোটা গ্রামটা দখল করে নিলাম। ওপার থেকে সঙ্গে করে আমাদের অনেকেই কেউ কিচ্ছু আনতে পারেননি, কিন্তু ভেতরে নিয়ে এনেছেন সেই গ্রাম, মানুষজনের স্মৃতি আর মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি এক আজন্মের ক্রোধ। ওই ক্রোধ যদিও সবার না, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই তাই। তাঁরা এমনিতে বেশ ভালো মানুষ, অথচ সংগত কারণেই ভুলতে পারেন না, তাঁদের সেই নদী-নালা-খাল-বিলের জীবনকে। ওপারে সবাই যে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন তা না, কিন্তু প্রকৃতির অফুরান রসদে অন্তত বেঁচে-বর্তে ছিলেন। আর ছিল সম্প্রদায়গত সম্মান। নিজের কিছু না হলেও গ্রামের জমিদার আমাদেরই সম্প্রদায়ের, ফলে চাল বেয়ে বর্ষার জল শীতের হু-হু হাওয়া ঢুকে পড়া সেই বাঁশ-খড়ের ঘরগুলোতেও সেই জমিদারের বৈভবের ওম ঠিক পৌঁছে যেত! সেই জমিদার ক্ষেতের ফসল জোর করে কেড়ে নিলেও সে তো ‘আমাদেরই লোক’ — এই একটা সান্ত্বনা ছিল। আর জমিদারদের এই জুলুমের যে কথা কাঙাল হরিনাথ থেকে প্রফুল্ল চক্রবর্তীসহ আরও বহু বহু সত্য-কথকদের লেখায়, হাজারো সরকারি তথ্য থেকে। কিন্তু এতসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ওই মানুষজনদের ছিল না। ওঁরা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন কিছু মানুষকে, তাঁদের ধর্ম পরিচয়টাই মাথায় নিয়ে এপারে এসেছেন তাঁরা। আর যারা ভেতরে ভেতরে ওই বিদ্বেষটাকেই কাজে লাগাতে চায় তারা সেই সু্যোগ নিয়েছে সর্বার্থে। গুজব আর অতিকথন চৈত্রের আগুন বয়ে নিয়ে যাওয়া বাতাসের মতোই দ্রুত এবং সর্বত্রগামী! সেই আগুন নেভেনি আজও। কিন্তু তাঁরাও, ওই সব হারিয়ে আসা মানুষজনেরা, তাঁদের সেই ফেলে আসা গ্রামকে আচার-রীতিকে খুঁজে নিতেন কোনও ব্যক্তিগত বা সামাজিক উৎসব-আয়োজনে।

সেই বেদনার অভিজ্ঞতা যে এঁদের কোথায় নিয়ে যায় জীবনে প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম আমার সেই ছোটোবেলায়। আমরাও ওপার বাংলার মানুষ, কিন্তু ওইরকম সব হারিয়ে আসতে হয়নি আমাদের। আমরা শুধু গ্রাম বদলেছি মাত্র। আমাদের পৌষ সংক্রান্তির উৎসব খুব জমকাল। তার আগের রাত্রে একটা খড়ের ঘর বানিয়ে সারা রাতের পিকনিক‌। ওপার থেকে আসা আমাদের পরিচিত একজন বললেন, একে বলে, ‘টুপা ঘর’। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় একে বলে ‘মেজি’। যাই হোক, সংক্রান্তির দিন খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগে চান করে এসে সেই ঘর পুড়িয়ে দিয়ে আগুন পোহানো হত, এরপর শুরু হবে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিঠে খাওয়া। খুব সংক্ষেপে উৎসব এই। আর একটু পড়ে বের হবে কীর্তন, যাবে সবার বাড়ি বাড়ি। সেই তখনকার একটা স্মৃতি আজও একলা আমাকে আমার একাকিত্বে কাঁদিয়ে বেড়ায়।

আমাদের গ্রামের নদীর নাম মধুরা। মধুরার ধার ঘেঁষে কয়েক ঘর মানুষ, যাঁরা ওপারের। একটি আচার্যি পরিবার। একসময় হয়তো দেশ-বাড়িতে তাঁদের বেশ ভালো অবস্থা ছিল। জমিদার না হলেও সচ্ছলই ছিলেন তাঁরা। আজ ওই গৃহকর্তার এক ছেলে আমাদের কাছে দূরের গ্রামের হাটে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে যান, আর এক ছেলে কাজের সন্ধানে বেকার, এক মেয়ে পাঠশালায় আমাদের সহপাঠিনী। কীর্তন যখন গ্রামে ঘোরে আমরাও দল বেঁধে অনুগামী। কারণ হরির নামে লুট হয়, তিল্লাই কদমা এসব কাড়াকাড়ি করে পকেট ভরাই। কোনো কোনো বাড়িতে দু-আধখানা করা পাটিসাপটা মালপোয়াও মেলে। তেমনি আগের বাড়িতে সেই সংগ্রহের কাজেই সম্ভবত একটু পিছিয়ে পড়েছিল আমাদের দলটা। আচার্যি-বাড়িতে যখন ঢুকলাম, তখন দেখি একটা অদ্ভুত ছবি! কীর্তন চলছে, আর এরইমধ্যে সেই গৃহকর্তা বাড়ির উঠোনে সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে এদিক থেকে ওদিকে গড়াগড়ি দিচ্ছেন আর হাউ হাউ করে কাঁদছেন! আর দু-এক জন, তাঁরা অনেকেই ঠাকুরমশাই-এর একই গ্রামের, তাঁরাও কাঁদতে কাঁদতে, আমাদের শ্রীহট্টের ভাষায় ঠাকুরমশাইকে বলছেন, ‘ঠাকুরমশাই, উঠইন, উঠইন, স-ব অইবো, সব অইবো, কান্দইন না যে, আপনে উঠইন!’ — আমরা সেদিনের সেই বিস্মিত বালকশ্রেণির অনেকে সেই বেদনার ভাগ নিতে পারিনি। পড়ে জেনেছি, ওপারেও খুব সচ্ছল ছিলেন না ওই ঠাকুরমশাই, কিন্তু এইরকম উৎসব আয়োজনে যজমানি ব্রাহ্মণের ঘরে নানাদিক থেকে কিছু কিছু আসত। ওতে এক ধরনের সচ্ছলতা ছিল। আজ তিনি আর তাঁর যজমানেরা একই অবস্থানে! দেশ বাড়িতেও এইরকম ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়েছেন ঠাকুরমশাই। তখন সেইটা ছিল বিনয়ের প্রকাশ, আজ দারিদ্র্যের, নিঃস্বতার। এই বেদনা তাঁকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। অবশ্য সেই অনেক সান্ত্বনা সহানুভূতি দিয়েও আচার্যি ঠাকুরের কিছু হয়ওনি। আমরা পাঠশালা ছাড়তে ছাড়তে নদীর ভাঙনে ওঁদের ভিটে ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। তার উপর ছেলেরও ব্যবসা চলছিল না। বিক্রি করার লোক অনেক, কেনার লোক আর ক-জন! সামাজিক সম্মান দারিদ্র্যের অতি উপাদেয় আহার্য বস্তু। হঠাৎ একদিন চলে গেলেন ওঁরা। কেউই কিছুই জানতে পারেনি। প্রায় পালিয়েছিলেন বলাই যায়। আমরা জেনেছিলাম সহপাঠিনীর অনুপস্থিতির খোঁজ নিতে গিয়ে। হয়তো অন্য কোথাও আরও দুরবস্থায় গিয়ে পড়লেন তাঁরা। কিন্তু এককালের যজমান স্বজন বন্ধুদের সামনে এমন উলঙ্গ হয়ে পড়া সম্ভব ছিল না ওঁদের পক্ষে। কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না, অথচ এইসব মানুষদের কাছে পৃথিবীটা বড়ো ছোটো। দেশভাগ আরও ছোটো করে দিল!

এমন মানুষের ছবি আমাদের স্মৃতিতে অনেক অনেক। সেই আচার্যি ঠাকুরের ছবিটাই যেন সলিল সেন-এর ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে। শিলচরে বাবা-মায়ের পাড়া আর্যপট্টিতে দুর্গাপুজোর সময় একবার ধরা হল ওই নাটক। মা ওই ব্রাহ্মণীর ভূমিকায়, দিদি পরী। প্রায় প্রতি বছর এইরকম পুজোর নাটকে মা, দিদি, অভিনয় করতে যেত, একবার বাবা-ও বোধহয় নিজের পুরোনো পাড়ায় অভিনয় করেছিল। ঠিক মনে পড়ছে না। তা সেই ‘নতুন ইহুদি’ নাটকের সময় বাড়িতে মা দিদি যখন রিহার্সেল করত, তখন প্রথম দিনের কথা মনে আছে। বাবা মা-র সঙ্গে সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পার্টটা পড়ে যাচ্ছিল, আর মা নিজেরটা। আমরা দেখছিলাম, নাটক পাঠ শুরু হওয়ার একটু পড়েই বাবা মা দুজনেই কেমন চুপ হয়ে গেল। একটু পরে বইটা চৌকিতে রেখে বাবা উঠে চলে গেল। মা চৌকিতে বসে বসেই চোখ মুছছিল। আর আমরা পরী, দুইখ্যা, মোহইন্যার জন্য কেমন কষ্ট নিয়ে বসে রইলাম। আর দুর্গাপুজোর নবমীতে যেদিন নাটকটার অভিনয় হল, সেদিন এত কষ্ট হচ্ছিল, তেমন মানুষেরা আমাদের চারপাশেই অগণন!

‘নীলকন্ঠ পাখীর খোঁজে’ কিংবা ‘বিষাদবৃক্ষ’ সেই দেশভাগের অমূল্য ইতিহাস ধরে রাখল! কত লক্ষ কোটি মানুষ যে এইভাবে একেবারে গরঠিকানা হয়ে গেল! নৈহাটিতে কথাশিল্পী জ্যোৎস্নাময় ঘোষ, আমরা দু-চারজন স্যার বলে ডাকতাম তাঁকে, শুনিয়েছিলেন তাঁর নিজের পরিবারের এমনই একটি ঘটনা। নৈহাটিতে উদ্‌বাস্তু তাঁরা তখন, একটা ভাড়া বাড়িতে আছেন। স্যারের থেকে বয়সে বেশ বড়ো এক দিদি, গঙ্গা এত কাছে, ফলে গেছেন চানে। কিন্তু ফেরার সময় অলিগলির গোলকধাঁধায় পথ গুলিয়ে ফেলেন। দুয়েকজন জিজ্ঞেস, বুড়িমা কোথায় যাবেন! — বুড়িমা বলেন, ঘোষবাড়ি যামু। — এই শহরে ঘোষবাড়ি বললে কে চিনবে! অথচ ওপারে আশেপাশের পাঁচ গ্রামে পরিচিত সমৃদ্ধ ঘোষ পরিবার, এইখানে তাঁর কোনও অস্ত্বিত্বই নেই! এটা বুদ্ধিমানেরা নানা বাস্তব জ্ঞান ও তত্বে ব্যাখ্যা করতে পারেন, বিশ্লেষণ করতে পারেন, কিন্তু ওই বুড়িমা! কেউ চেনে না দেখে একসময় কেঁদেই ফেলেন। ‘ঘোষ বাড়ি চিনো না তুমরা, তুমরা থাহো কই!’ — এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ, উপলব্ধি করা খুব কঠিন। যাইহোক, লোকজনেরা খুঁজে খুঁজে বাড়ি দিয়ে যাবার পর ‘বুড়ির কী কান্দন! খালি কয়, আমারে বাড়িতে ফিরাইয়া দিয়া আয়, আমি আর এইহানে থাহুম না!’ — কিন্তু কোথায় ফিরবেন সেই মানুষ! মানুষেরা! তাঁদের বোঝানো কঠিন, একমাত্র স্মৃতি ছাড়া সেই বাড়ি আর নেই! আর সত্যি, আজীবন তাঁরা বাঁচলেন সেই অতীতে! বর্তমান তাঁদের দেখতে বাধ্য হওয়া দুঃস্বপ্ন! দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসলেই সেই অতীত সামনে চলে আসে সার সার ছবির মতো!

নন্দন-এ আমার প্রথম দেখা ঋত্বিক ঘটক-এর ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আগে থেকেই মনের ভেতর রয়ে গেছে দলা পাকানো কান্না। আর যখন ছবি শুরু হল, যখন ওই উৎসবের সঙ্গে ‘লীলাবালি লীলাবালি’ গান শুরু হল, আস্তে আস্তে বাবা মা আমার সেই গ্রামের মানুষজন আচার্যিঠাকুর গুপিকাকা মতি পাল ধনাই চন্দ্র দাস কবিরাজ কৃপাসিন্ধু ভট্টাচার্য আরও আরও কতজন স-ব সবাই যেন আমার পাশে এসে বসে পড়লেন। প্রথমে এক-দু-বার নিজের চোখ মোছার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এরপর মনে হল, প্রায়শ্চিত্ত করার আমার নিজের তো আর কিছুই নেই! কে কী ভাবলো, সে পরে দেখা যাবে, এখন তো বসি! ছবি শেষ হবার পর সবাই বেরিয়ে যাবার পরও বসেছিলাম অনেকক্ষণ। বাইরে বেরিয়েও এই ঘোর কাটাতে পারিনি, বাড়িতে এসেও…! ‘কোমল গান্ধার’-এ ভৃগু যখন দেখায় ওপারে রয়ে যাওয়া তার দেশ বাড়ি, ‘দোহাই আলি দোহাই আলি’ করতে করতে চিৎকারটা যখন তুঙ্গে উঠে হঠাৎ ধাম্‌ করে বাফারটার সামনে দাঁড়িয়ে যায়, আর পথ নেই, আটকে দেওয়া হয়েছে, মনে হয় ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠি — ‘আর একটু আর একটু চলো, আমারও আমারও স্বভূমি ওই ওই পারে’! — অথচ ওপারে যাইনি কখনও, এপারেও প্রায় এক শতাব্দীর বসতি আমাদের। কিন্তু তবুও কোন নিশির টান যেন স্বস্তি দেয় না। ঠিক যেমন আসাম থেকে এই বাংলায় আসা প্রায় চারটি দশক পরেও কেউ যখন জিজ্ঞেস করেন, বাড়ি কোথায় আপনার!— সঙ্গে সঙ্গে নদী-ধানক্ষেত-চা-বাগান নিয়ে ছোট্টো সেই গ্রামের ছবিই তো চোখের সামনে চলে আসে। সে বেদনা হারানোর না, শুধু দূরত্বের। ইচ্ছে করলেই যেতে পারি ওখানে। কিন্তু যাঁরা ছাড়তে বাধ্য হলেন তাঁদের সাত পুরুষের ভিটে, হয়ে গেলেন আত্মপরিচয়হীন একদল মানুষ রিফ্যুজি, উদ্‌বাস্তু, আর এটাও জানেন, আর কোনওদিন যেতে পারবেন না আম-  কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা বাড়ির কিশোরী মেয়েটির মতো বয়ে চলা নদী নিয়ে অপেক্ষায় থাকা সেই গ্রামে — সইতে বাধ্য হলেন হাজারটা লাঞ্ছনা উপহাস, তাঁদের বেদনার কাহিনি! —

আমাকে কোনওদিন নিজের শেকড় উপড়ে নিয়ে উঠে আসতে হয়নি। কিন্তু শেকড় উপড়োনো মানুষ দেখেছি অনেক অনেক। তাঁরা আমার আত্মার আত্মীয়। উর্বশী বুটালিয়া-র কথাকে সামান্য পালটে নিয়ে সবাইকে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘শোনো শোনো, এই মর্মান্তিক ইতিহাস মনে রাখা ভয়ংকর, ভুলে যাওয়া পাপ!’

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান