কাঁটাতারের এপার ওপার

সুশীল সাহা

আমার জন্ম উনিশশো সাতচল্লিশের ফেব্রুয়ারি মাসে। অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা লাভ তথা দেশভাগের ছ-মাস আগে। আমরা থাকতাম পূর্ব বাংলার হিন্দুপ্রধান এলাকা খুলনায়। অনেকেই আশা করেছিলেন, খুলনা ভারতেই থাকবে। অগাস্ট মাসের ১৫ থেকে ১৭ — এই তিন দিন ভারতের পতাকাও উড়েছিল সেখানে। তারপর কীভাবে যেন মুর্শিদাবাদের বদলে খুলনা চলে গেল পাকিস্তানে। আর সেই সূত্রে আমরা হয়ে গেলাম পূর্ব পাকিস্তানি। ব্রিটিশ ভারতীয় থেকে পাকিস্তানি হয়ে যাবার পিছনে আমার কোনও হাত ছিল না। আমার কোনও ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনও গুরুত্ব ছিল না এই নাগরিকতা গ্রহণে। তারপর দীর্ঘ তেইশ বছর পরে অর্থাৎ উনিশশো সত্তর সালের মার্চ মাসে আমরা দেশান্তরী হয়ে চলে এলাম পশ্চিম বাংলায়। এবার বলা যায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে গ্রহণ করলাম ভারতীয় নাগরিকত্ব। তখন অশান্ত পূর্ব ভূখণ্ডের মানুষেরা বিশেষ করে হিন্দুরা কাতারে কাতারে দেশত্যাগ করছিল। আমরা দেশত্যাগ করেছিলাম খানিকটা উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে। মনে রাখা দরকার খুলনা অঞ্চল সাতচল্লিশের পরে দীর্ঘ সতেরো বছর একরকম নিরুপদ্রুত ছিল। ওখানে সাম্প্রদায়িকতার আঁচ লাগে ’৬৪ সালের দাঙ্গা পরিস্থিতির পরে। অবশ্য একে দাঙ্গা না বলে একতরফাভাবে  হিন্দু উৎপীড়ন ও তাদের সম্পত্তি লুন্ঠন বা দখল ইত্যাদি বলা যায়। ওই সময়ে প্রচুর গৃহে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আর পাশাপাশি বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডও ঘটে। বেশ একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হলেও আমরা অবশ্য তখনই দেশত্যাগের কথা ভাবিনি। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে আমরা প্রায় বাধ্য হই দেশত্যাগ করতে। আমি তখন সদ্য যুবক। আবাল্য স্মৃতিঘেরা খুলনা ত্যাগ করতে আমার নিজের তরফের তেমন সায় ছিল না। বরং কষ্টই হচ্ছিল। বলা যায় প্রায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরিবারের দিকে চেয়ে আমি দেশ ছেড়ে আসি। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল জন্মভূমিতে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর পরই কী এক অমোঘ আকর্ষণে আমি আমার প্রাণের শহর খুলনায় চলে যাই। ইচ্ছে ছিল ওখানেই একটা কাজ জুটিয়ে থেকে যাব। মনে মনে ভেবেছিলাম, পাকিস্তানের অপশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। এর পিছনে ভারতের অবদান নেহাৎ কম ছিল না — তাই  দুই দেশের মধ্যে খুবই মধুর সম্পর্ক হবে, ভেবেছিলাম, দুই দেশের মধ্যে অবাধ যাতায়াত করা যাবে। সপ্তাহান্তে বাড়ি যাওয়া যাবে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বুঝলাম আমার সেই স্বপ্ন নিতান্তই অলীক। ’৭২ সালের এপ্রিলে গিয়ে টানা চার মাস ওই দেশে ছিলাম। একটা স্কুলে আমার কাজের কথাও হয়েছিল। কিন্তু না, অনেক পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে আমি আমার প্রাণের শহর খুলনা ছেড়ে চলে এলাম কলকাতায়। মনের দুঃখে অজানা অচেনা দেশের রুক্ষ কঠিন জীবনকেই বেছে নিয়েছিলাম। এই সিদ্ধান্ত যে কেন নিয়েছিলাম, সে কথা সবিস্তারে না লিখে একটি মাত্র শব্দে সেটা বিবৃত করতে চাই। স্বপ্নভঙ্গ! হ্যাঁ স্বপ্নভঙ্গই হয়েছিল আমার! তখনকার সেই বাংলাদেশকে আমি যে চাইনি! আসলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন অনেক অসংগতি। দেশ জুড়ে তখন নানারকম সঙ্কট। পুনর্গঠনের সেই পর্বে আমার ওই প্রত্যাশা ছিল নিতান্তই ছেলেমানুষি। তাই আমি চলে এলাম আমার আত্মীয় পরিজনদের মাঝে। ফেলে এলাম আমার আবাল্য স্মৃতিবিজড়িত খুলনাকে। কলকাতার ইট কাঠ পাথরের জীবনের মধ্যে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে বেড়াতে থাকলাম। আর এক দুর্মর অভিমানে আমার নিজের জন্মভূমি থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলাম দশ দশটা বছর।

ততদিনে কলকাতার জীবনে আমি খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একটা সরকারি চাকরিও জুটেছে। তখন কলকাতার শিল্প সংস্কৃতির মধ্যে অন্য এক ধরনের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে যাচ্ছি আমি। বাংলাদেশের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। ওখান থেকে চেনা অচেনা বহু মানুষ আমার কাছে আসে। তাদের কাছে দেশের কথা শুনি। কিন্তু ভিতরের কী এক নিরুদ্ধ অভিমানে বাংলাদেশের কথা ভাবতে চাই না। তাছাড়া কলকাতার ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে অত কিছু ভাবার অবকাশও তেমন ছিল না। তবে জন্মভূমি নিয়ে কিছুই ভাবতাম না, তা তো নয় একেবারেই। মাঝে মাঝে মনোগহনে ডুব দিয়ে চলে যেতাম আমার প্রিয় শহরে। ওখানকার নানারকম স্মৃতি রোমন্থন করতাম মনে মনে। বয়স যত বাড়তে থাকল, ওখানকার আকর্ষণও ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল।

অবশেষে আশির দশকের গোড়ার দিকে পাসপোর্ট করালাম। ছেড়ে আসা দেশটাকে নতুন করে দেখব বলে মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। খুলনা জায়গাটার প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ বোধ করতাম প্রায়শই। আর মনের মনিকোঠায় যাদের ঠাঁই চিরকালের স্থান সেইসব মানুষদের কথা ভাবতে ভাবতে একদিন বাংলাদেশে যাব বলে মনস্থির করলাম। বলতে দ্বিধা নেই এ ব্যাপারে আমার শিক্ষাগুরু মুহম্মদ কায়কোবাদের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। এই মানুষটার কাছে আমার ছিল পাহাড় প্রমাণ ঋণ, যা একজীবনে শোধ করা যায় না। এর মধ্যকার একটি ঘটনা এক্ষণে না বললেই নয়। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাস করার পরে (১৯৬৪) বাবা মায়ের নির্দেশে আমি কলকাতায় চলে এসেছিলাম। ছোটমামা তখনও বিয়ে করেনি। কাজ করেন পুলিশ দপ্তরে। কলকাতার শ্যামবাজারে থাকেন। তাঁর আশ্রয়ে থেকে আমি কলেজে ভরতি হব, এমনটাই ঠিক ছিল। মণীন্দ্র কলেজে ভরতি হব বলে ফরমও আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে কলকাতায় আমার মন বসল না। মাসখানেকের মাথায় আমি আমার জন্মশহর খুলনায় ফিরে এলাম এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজে ভরতি হলাম। ওই কলেজে ভরতি হয়েই আমি কায়কোবাদ স্যারের সান্নিধ্য পাই এবং তা একটু একটু করে নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়। কলকাতাকে ‘টা টা’ জানিয়ে খুলনায় চলে গেলেও আমি আবার সেই কলকাতাতেই ফিরে এলাম ’৭০ সালে। কলেজে থাকাকালীন এবং পরবর্তীতে কায়কোবাদ স্যারের উজ্বল সান্নিধ্য আমাকে নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। তাই আশির দশকে নতুন করে স্বদেশে যাবার অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে একটা বড়ো কারণ ছিল স্যারের কাছে যাবার। ততদিনে স্যার সংসারী হয়েছেন। গৃহিণী হয়ে যিনি এসেছেন, সেই মুক্তি মজুমদার সম্পর্কেও আমার নানা কৌতূহল ছিল। ভদ্রমহিলা শুধু দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপকই ছিলেন না, ছিলেন একজন মুক্ত উদার মনের মানুষ। পার্থিব জীবনের প্রতি নির্মোহ এই মানুষটা সম্পর্কে অনেক কথাই শুনেছিলাম। এবার চাক্ষুষ দেখার জন্যে তৈরি হলাম। মনে রাখা দরকার রবীন্দ্র সংগীতে নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই রবীন্দ্রানুরাগী।

অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে অবশেষে ’৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত পেরিয়ে খুলনায় গেলাম। স্যার সীমান্তে এসেছিলেন। বেনাপোলে পা দিতেই আমার ফেলে আসা অনেক স্মৃতি এসে মনের মধ্যে ভিড় করল। সেই বেনাপোল! বরিশাল এক্সপ্রেসে সেই যে খুলনা থেকে সীমান্ত পুলিশ আর কাস্টমসের নানারকম ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে ভারতে আসা! বেনাপোল পেরিয়ে পেট্রাপোলে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা। শৈশবের সেই দিনগুলোর স্মৃতি কিছুটা ধূসর হয়ে গেলেও মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি। যা হোক স্যারের সঙ্গে চলে এলাম ওঁদের খলিশপুরের বাসায়, ‘কল্যাণী’ যার নাম। মুক্তিদির সঙ্গে দেখা হতেই মনে হল কতদিনের চেনা এক মানুষ। কী যে সমাদর পেলাম সেবার! সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্তগুলো শুরু হল সন্ধ্যায়। দিদির ছাত্র ছাত্রীদের গানের আসর বসল। ঘরভরতি ছেলে মেয়ে। সবাই কী ভালো গায়! ওঁদের গানের সঙ্গে শুরু হল আমার নাচ। বাংলাদেশের আসার প্রথম দিনটাই এমন আনন্দঘন হয়ে দেখা দিল আমার কাছে। দিন দশেক ছিলাম সেবার। প্রতিদিনই গানের আসর বসত। দিদির গানের ক্ষমতার কথা আগেই শুনেছিলাম। সামনাসামনি শুনে বিস্মিত ও হতবাক হয়ে গেলাম। বাংলাদেশের এক অখ্যাত মফস্‌সল শহর খালিশপুরে থাকেন এমন একজন গুণী মানুষ, যাঁর সেই অর্থে কোনও প্রচার নেই। বলতে দ্বিধা নেই, কলকাতার বাঘা বাঘা শিল্পীদের গান ততদিনে আমি শুনে ফেলেছি। তবু বলছি, মুক্তিদির গানের সত্যিই কোনও তুলনা হয় না। দুঃখের কথা চিরকাল তিনি নিরালা নিভৃতেই রয়ে গেলেন। যে মানুষটা সম্পর্কে ভালোমন্দ নানারকম কথা শুনেছিলাম, তাঁর মুখোমুখি হয়ে বুঝলাম এমন একজন অসীম ক্ষমতাধর উচ্চমার্গের মানুষকে বুঝতে পারা অত সহজ ব্যাপার নয়।

খালিশপুরের ওই অবস্থানকালেই একদিন একা একাই খুলনায় গেলাম। এক যুগ পরে নিজেদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই কালীবাড়ি রোড, ডেলটাঘাট, বাজার, বাটার দোকান, মইনুদ্দিন আখতারুদ্দিন চৌধুরীর দোকান সবই আছে। আছে কালার চায়ের দোকান। কেবল আমরাই নেই। বাড়িটা শত্রুসম্পত্তি থেকে অর্পিত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। সরকার ভাড়া দিয়েছে। সবাইকে পরিচয় দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। পরিচিত হলাম ভাড়াটেদের সঙ্গে। সবগুলোই হিন্দু পরিবার। তাঁরা আমার পরিচয় পেয়ে খুবই সমাদর করল। আমি যে ঘরে থাকতাম সেখানে গেলাম। দেওয়ালে আমার আঁকা একটা ছবি তখনও মুছে যায়নি। আমার উচ্চৈস্বরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে চলে এলাম। পড়ে রইল থরে থরে সাজানো নানা খাবার। ওঁরা কী বুঝলেন জানি না, তবে আমাকে সেগুলো খাওয়ার জন্যে ওঁরা তেমন পীড়াপীড়িও করলেন না। আমি রাস্তায় নেমে এলাম। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম জেলখানার ঘাটে। ভৈরব নদীর উত্তাল ঢেউগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল আমাদের কলেজ জীবনের সেই মধুর দিনগুলোর কথা। বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডার কথা। এলাম হাদিস পার্কে। শহিদ মিনারের দিকে চেয়ে মনে পড়ে গেল ষাট দশকে এটার সেই উদ্বোধনের কথা। উদ্বোধন হয়েছিল আমাদের অনীক সংসদের কবিতা পাঠ দিয়ে। শুরুতেই আমার স্বরচিত কবিতা পড়তে হয়েছিল। সেদিক থেকে খুলনার শহিদ মিনার উদ্বোধন হয়েছিল আমার কবিতা পাঠ দিয়ে। এই গৌরবের কথা তো কোনওদিন ভোলার নয়। ওখান থেকে গেলাম আমাদের সেন্ট জোসেফস হাই স্কুলে। ’৬৪-তে এই স্কুল থেকেই স্কুল ফাইনাল পাস করেছিলাম। গুন্ডা, টেনা, দারা, দুলু, আলতাফ, কামরু, জিয়া, গোরা ইত্যাদি অনেক বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিল। না, সেদিন আর কারও বাড়িতে যাইনি। অতিদ্রুত ফিরে এলাম কল্যাণী গৃহাঙ্গন, খালিশপুরে। স্যার ও দিদি খুব চিন্তা করবেন জানতাম। তাই আর দেরি করিনি।

এক যুগ পরে জন্মভূমিতে গিয়ে পরমানন্দের স্মৃতি বুকে নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। আমরা তখন হাবরায় থাকি। খুব ফলাও করে আমার স্বদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সবাইকে শোনালাম এবং পুনর্বার যাবার পরিকল্পনা করতে থাকলাম। তখন তো চিঠিপত্রের যুগ। স্যার ও দিদিকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম। চিঠি লিখতাম রাজশাহীতে কথাকার হাসান আজিজুল হক সাহেবকে। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তিনি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধাপনা করেন। ঠিক করলাম পরের বার রাজশাহীতে যাব। যাব আমার না দেখা পাহাড়পুর এবং মহাস্থানগড়ে। স্যারের সঙ্গে এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করা হল। তিনি বললেন, তাঁরও ওই জায়গাগুলো দেখা হয়নি। এই সূত্রে দেখা হয়ে যাবে। খুব তাড়াতাড়ি আবার ওঁদের কাছে আসব, এই কথা দিয়ে ফিরে এলাম এবং কলকাতার ব্যস্ত জীবন পরিক্রমার মধ্যেই পরের ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকলাম।

পরের ভ্রমণের জন্যে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পরের বছরেই আবার গেলাম খুলনায়। মুক্তিদির নেতৃত্বে ওঁদের মহেশ্বরপাশার বাড়ির ছাদে করা হয়েছিল রবীন্দ্র নাটক ‘ফাল্গুনী’। বন্ধু গৌতমবরণ অধিকারীর গান আর আমার নাচে জমজমাট অভিনয় হল সেই নাটকের। কথামতো সেবার রাজশাহীতে গেলাম। দেখা হল অদেখা পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়। দেখা হল হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে। তাঁকে ঘিরে তখন রাজশাহীতে এক অসাধারাণ বুদ্ধিজীবী সমাবেশ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নাজিম মাহমুদ, সনৎকুমার সাহা, শহিদুল ইসলাম, আলি আনোয়ার এবং আরও কত গুণীজন! এঁদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনন্য। তবে নাজিম মাহমুদের সত্যিই তুলনা হয় না। তাঁর উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তখন ‘স্বনন’ আবৃত্তি গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গিয়েছে। আবৃত্তিনির্ভর এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও তখন ছিল না। একটা ঘরোয়া আসরে ওঁদের আবৃত্তি শুনলাম। টেপ রেকর্ডার চালিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শঙ্খচিলের গানের সঙ্গে আমার নাচও হল। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে স্যারের সঙ্গে ঢাকা মহানগরেও গিয়েছিলাম। স্যারের ভাইপো অধ্যাপক মেসবাহ কামালের সঙ্গে সেবারই প্রথম দেখা হল। তাঁর বিবর্তন নাট্যদলের ছেলেমেয়েদের গান শোনা হল। দেখা হল তাঁদের পথনাটক।

বাড়ি ফিরে আসতে না আসতেই নাজিম মাহমুদের ফরমান এল, দলবল নিয়ে তৈরি হও। ’৮৬-তে রবীন্দ্রনাথের ১২৫ তম জন্মজয়ন্তীতে যোগ দিতে হবে। আমাকে তখন আর পায় কে ! এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিলাম। দত্তপুকুরের ময়ূখ সাংস্কৃতিক সংস্থার ছেলেমেয়েদের নাচের তালিম দিয়ে তৈরি করা হল দু-টি নৃত্যাল্লেখ্য। বন্ধু গৌতম সেনগুপ্তর দক্ষ পরিচালনায় প্রস্তুত করা হল নাটক ‘তোতা কাহিনি’। পাকেচক্রে রাজার ভূমিকায় আমাকে অভিনয় করতে হয়েছিল।

‘৮৬’র ডিসেম্বরে সত্যি দলবল নিয়ে গেলাম রাজশাহীতে রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে অংশ নিতে। প্রায় কুড়ি জনের সেই দলের নেতৃত্ব আমাকেই দিতে হয়েছিল। আমরা নাটক, নৃত্য-আলেখ্য ও গানের ডালি নিয়ে গিয়েছিলাম। শুধু রাজশাহী নয়, অনুষ্ঠান করলাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জাহাঙ্গীরনগর, যশোর এবং খুলনায়। তখন বাংলাদেশের আধা সামরিক শাসনের সময়। ক্ষমতায় ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দেশময় ধূমায়িত হচ্ছে বিক্ষোভ। তারই মধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গায় অনুষ্ঠান করে এলাম আমরা। ওই ’৮৬-তেই মুক্তিদি এক অসাধ্যসাধন করেছিলেন। খুলনার হাদিস পার্কে রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট আয়োজন করে বসলেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন শান্তিদেব ঘোষ। তাঁর যাবার ব্যাপারে এই দিককার সমস্ত আয়োজনের ভার পড়ল আমার উপর। যথাসময়ে সস্ত্রীক শান্তিদেব ঘোষ গেলেন, সঙ্গে তাঁর দুই যন্ত্রী। আমি ওঁদের সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।

’৯০ সালে আবার গেলাম খুলনায়। সেবার খুলনার হাদিস পার্কের শহিদ মিনারের পাদদেশে রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ মঞ্চস্থ করালেন মুক্তিদি। রাজপুত্রের ভূমিকায় আমি, গানে গৌতমবরণ। তখনও কিন্তু ওখানকার পরিস্থিতি খুব ভালো ছিল না। তবু ওরই মধ্যে খুবই সাফল্য পেল আমাদের আয়োজন। অবশ্য এই আয়োজনের জন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে একেবারে কিছু আনাড়ি ছেলেমেয়েদের তৈরি করেছিলাম, নাচে এবং অভিনয়ে। বন্ধু গৌতমবরণ কিছুদিন পরে এসে গানের দিকটার হাল ধরে। আমাদের পোশাক ও মঞ্চসজ্জার দায়িত্ব পালন করেছিল মৃত্যুঞ্জয়। এই অসামান্য গুণধর ছেলেটির অকালমৃত্যুর শোক এখনও আমাকে তাড়া করে ফেরে।

পাঠক এই আত্মবয়ানে এতক্ষণে একটু বিরূপ হতে শুরু করেছেন মনে হয়। এইসব আত্মকথনের সঙ্গে দেশভাগের সম্পর্ক কী? এই প্রশ্ন তাঁরা করতেই পারেন। তাঁদের কথা ভেবেই আত্মপক্ষ সমর্থনে বলছি, এগুলো আসলে মানুষের তৈরি দেশভাগের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যারা সংস্কৃতির সেবক, তাদের যে কিছুতেই রোখা যাবে না, তারই কিছু পাথুরে প্রমাণ দেবার জন্যে এত কথা। আসলে সীমিত সাধ্যে সীমায়িত পরিবেশে কাজ করে যাবার এক অদম্য ইচ্ছা যাদের থাকে তাঁদের যা কিছুতেই থামানো যায় না, তারই সমর্থনে এত কথা বলতে হল।

’৯৬ সালে স্যার ও দিদি নিজস্ব গৃহ নির্মাণ করে চলে এলেন ফুলতলার কাছে এক গ্রামে। প্রচুর গাছগাছালির মধ্যে একটি চমৎকার গৃহ নির্মাণ করলেন তাঁরা। নাম দিলেন ‘আরণ্যক’। এটা অবশ্য বিভূতিভুষণের ‘আরণ্যক’ নয়, অথর্ব বেদের ‘আরণ্যক’ হিসেবেই নামকরণ করেছিলেন ওঁরা। সত্যিকারের গৃহই নির্মাণ করেছিলেন তাঁরা। অবারিত দ্বার এক গৃহাঙ্গন, সেই অর্থে গেরস্থের বাড়ি নয়। সংস্কৃতিমনস্ক সবার জন্যে সত্যি সত্যি অবারিত দ্বার। বিশেষ করে শিশুদের জন্যে ছিল এক অসাধারণ সমাদরের আয়োজন। দিদির দক্ষ পরিচালনায় সারাক্ষণ গান আর গানে ভরে থাকত ওই গৃহাঙ্গণ। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে নাচ শেখাতাম। দেশভাগের সমস্ত বিধিনিষেধকে মান্যতা দিয়েও আমার এই অদম্য ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করেছি দিনের পর দিন। ‘৯৬তে ওই গৃহ নির্মাণের পরেও প্রায় ১৭-১৮ বছর ওই গৃহ ভরে থাকত নানারকম সাংস্কৃতিক কাজকর্মে। পরে স্যার ও দিদির অসুস্থতার কারণে অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই ওই কর্মকাণ্ড থেমে যায়। সেটা নিতান্তই ভিন্ন প্রসঙ্গ। আসলে পাসপোর্ট ভিসার নানান জটিলতা, অফিসের ছুটি ইত্যাদি সবকিছুকে মান্যতা দিয়ে আমি এইসব কাজ করে গেছি। নিরন্তর এক সৃজনের আনন্দ উপভোগ করেছি।

তবে আমাদের কোনও সুখই তো স্থায়ী হয়না, আরণ্যকের ক্ষেত্রেও তাই হল। স্যার ও দিদির শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে আসছিল। বিগত দশকে একে একে দু’জনেই প্রয়াত হলেন। একদা যে গৃহাঙ্গন কোলাহল মুখরিত হয়ে থাকত সেটাই কালক্রমে স্তব্ধ হয়ে গেল। তবে ওঁদের মৃত্যুর আগে ওঁদেরকে নিয়েই একটি প্রামাণ্যচিত্র (‘একটি গৃহের কথা’) তৈরি করি। আর করেছিলাম ওই গৃহাঙ্গন নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ ‘আরণ্যক দীপাবলি। ওঁরা চলে গেলেও সেগুলো রয়ে গেল।

এবার আমারও কার্যক্রম একটু বদলে গেল। ২০১৫-১৬ সালের দিকে এক প্রস্তাব এল বন্ধু তানভীর মোকাম্মেলের কাছ থেকে। তিনি তখন খুলনার বসুরাবাদ গ্রামে একটা অন্য ধরনের স্কুল করতে চাইছেন। স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়াশুনোয় শিশুদের উৎসাহ দেওয়া, নাচ গান নাটক ইত্যাদি শেখানো। গল্পের বই পড়ায় উৎসাহী করে তোলা ইত্যাদি। সংস্থার নাম দেওয়া হল, ‘মানবরতন শিশু কেন্দ্র’। বলা যায় প্রায় জন্ম লগ্ন থেকেই ওই সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। মনের আনন্দে ছেলেমেয়েদের নাচ গান শেখাতে শুরু করলাম। ততদিনে আমি চাকরির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছি। প্রায় পূর্ণোদ্যমে ওইসব শিশুদের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম। অতিমারির আগে প্রায় ছ-সাত দফা ওখানে গেলাম। কখনও সাত দিন, কখনও বা দশ দিন কখনও বা পনেরো দিন ওখানে থাকলাম। সকাল বিকেল ওইসব ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতাম। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে ওরা আসত। গান শিখত, আবৃত্তি শিখত, নাচ শিখত, নাটক করত। কয়েকটা দিন পরমানন্দে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। হ্যাঁ, পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদির ঝামেলার মধ্যে, সীমান্তের নানা কড়াকড়ির ফাঁক গলে আমি আমার সাংস্কৃতিক কাজকর্ম চালিয়ে গেছি। সীমান্তের কাঁটাতার আমার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার কাছে দেশ কিংবা বিদেশের বাছবিচার সেইভাবে ধরা দেয়নি। মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের জন্যে কাজ করতে চেয়েছি, করেছি। আমার আনন্দ সেখানেই।

এরই মধ্যে অন্য এক ধরনের আমন্ত্রণ এল খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে। দেশভাগ নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেবার আহবান। আমি তখন দেশভাগের সিনেমা নিয়ে বইয়ের কাজ করছিলাম। ওতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নির্মিত সিনেমা, যার বিষয় দেশভাগ তার উপরেই বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছিল। অনেক মানুষের লেখা নিয়ে সেই বইটা অনেক পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছিলাম। সেজন্যে ওই সেমিনারে এই উপ-মহাদেশে নির্মিত দেশভাগের সিনেমা নিয়েই কিছু বলব বলে স্থির করলাম। যথাসময়ে যাওয়া হল। সেমিনার পর্ব সেরে ওখানে আরও কিছুদিন থাকলাম। দেখা হল অনেক বন্ধুদের সঙ্গে। ওই সময়ে বিশেষ আগ্রহ নিয়ে পুরনো দিনের অভিনেত্রী শবনমের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার যৌবনকালে ওঁর অভিনয় আমি আমি দেখতাম মন দিয়ে। ভিতরে ভিতরে ওঁর সঙ্গে দেখা করার এক বাসনা লালন করেছিলাম বহুদিন ধরে। অবশেষে এক বন্ধুর সৌজন্যে ওঁর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হল। তাঁর সঙ্গে সেই সাক্ষাৎকার নিয়ে পরে একটি লেখাও তৈরি করেছিলাম।

বাংলাদেশের কোথায় কোথায় কী কী কাজ করেছি সেইসব সবিস্তারে বলার জন্যে এই লেখা কিন্তু নয়। এসব নিয়ে লিখেছি আলাদাভাবে ‘আমার বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। তারপর একসময় ‘নন্দন’ পত্রিকার দপ্তর থেকে বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য নিয়ে যখন লিখবার বরাত এল তখন আমিই ওঁদের জানালাম এইভাবে না লিখে ওখানকার মানুষজন যাঁরা আসলে শিল্প সাহিত্যের মানুষ, তাঁদের সাক্ষাৎকার মুদ্রণের জন্যে। ওঁদের সদর্থক অভিমত পাবার পরে কাজে লেগে পড়লাম। গত বছরের (২০২২) নভেম্বর থেকে প্রতি মাসে সেগুলো একটা একটা করে মুদ্রিত হতে শুরু করেছে। পরে ওগুলো নিয়ে একটা বই করার ইচ্ছে আছে। এই হল আমার বাংলাদেশ প্রীতির আর-একটা পাথুরে প্রমাণ।

আসলে এই রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে তৈরি হওয়া দেশভাগকে আমি সেইভাবে মান্যতা দিইনি কখনও। মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের জন্যেই কিছু করার উদগ্র বাসনা আমাকে সবসময় তাড়া করে ফেরে। সেজন্যে জন্ম থেকে তেইশটা বছর যেখানে কাটিয়েছি সেখানকার প্রতি অন্তরের একটা বিশেষ টান অনুভব করি সবসময়। সেখানকার মানুষদের জন্যে কিছু করার জন্যে মন আনচান করে। তাই সুযোগ পেলেই চলে যাই ওখানে এবং সাধ্যমত কিছু করার চেষ্টা করি। অতিমারির আগে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সাগরদাঁড়িতে গিয়েছিলাম মধুমেলায় যোগ দেবার আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। ভিসা ছিল এক বছরের। কিন্তু অতিমারির আবহে সেটা নষ্ট হয়ে গেল। কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারলাম না। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে নতুন করে আবার যাবার উদ্যোগ নিলাম অতি সাম্প্রতিক কালে। আবার ভিসা পেলাম এক বছরের। এ বছরের (২০২৩) মে মাসে দলবল নিয়ে গেলাম খুলনা, যশোর এবং কুষ্টিয়ায়। নাচ হল, গান হল, ম্যাজিক হল, নাটক হল। কয়েকটা দিন বেশ কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমাদের সময়টা কেমন হু হু করে কেটে গেল। তারপর আবার গেলাম গত মাসে (অগাস্ট ’২৩)। এবার অবশ্য সস্ত্রীক। গেলাম ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, ত্রিশাল (ময়মনসিং), শাহজাদপুর, খুলনা এবং যশোর। সীমিত সাধ্যে সীমাবদ্ধ পরিসরে যতটুকু সাধ্য করলাম। নতুন নতুন কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। ওঁদের কেউ কেউ আমাকে ভিনদেশি মানুষ হিসেবে গণ্য করলেও আমি সব সময় ভেবেছি, আমি তো আমার জন্মভূমিতেই আছি। স্বভূমির নতুন নতুন জায়গা দেখছি, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় হচ্ছে। এ যে কত আনন্দের, তা কী করে বোঝাই! এবারে আমার অবস্থান ছিল দীর্ঘ সময়ের। তিন সপ্তাহ। ত্রিশালের কাজি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগের আয়োজনে সত্যজিৎ রায়ের ‘সদ্‌গতি’ সিনেমাটা দেখালাম। তার আগে মূল গল্পটা পড়া হল। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হল। খুব ভালো সময় কেটেছিল সেখানে। শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু কথা বললাম। দেখা হল এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। তাঁর নাম শাহ আযম শান্তনু। তিনি আবার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ফলে সময়টা কাটল পরমানন্দে। মনেই হল না আমি অন্য দেশে রয়েছি।

পাঁচ বছর বাদে তানভীর মোকাম্মেলের সঙ্গে তাঁর ‘মানবরতন শিশু কেন্দ্রে’ গেলাম। এখন ওখানে দুটো শাখা বেশ ভালোভাবে চলছে। একটা বসুরাবাদ আর একটা ফুলতলা গ্রামে। নবকুমার, শিবানী আর মণীষার তত্ত্বাবধানে কাজকর্ম বেশ ভালোই হচ্ছে দেখলাম। দু-জায়গাতেই নতুন করে গান শেখালাম। খুলনা থেকে যশোরে এলাম। সেখানেও একটা ছোট্ট আয়োজন করে রেখেছিল ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু হাসান রহমান। দু-দিন ধরে নাচগানের কর্মশালা হল। অনুষ্ঠান হল।

বাংলাদেশে আমার কর্মকাণ্ডের বিবরণ আপাতত শেষ করছি। খানিকটা আত্মকথনের বাগাড়ম্বর হয়ে গেল হয়তো। কিন্তু সংক্ষেপে হলেও এতসব জানানোর একটাই কারণ কাঁটাতারের বেড়া আমার স্বদেশপ্রীতিকে একটুও কমাতে পারেনি। বরং সীমান্তের বিধিনিষেধকে সম্পূর্ণ মান্যতা দিয়েও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে আমার কাজ। জানি না ওই দেশে যদি আমি থেকেই যেতাম, তাহলে এইভাবে কাজ করতে পারতাম কিনা! একটু অন্যভাবে বলা যায়, কলকাতার বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত থাকার ফলে আমি নিজেকে যেভাবে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলাম, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আমার কাজে। ভিনদেশি মানুষের কাছ থেকে অকাতরে গ্রহণ করতেও ওঁদের তাই কোনও অসুবিধে হয়নি। তাছাড়া নাগরিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমি যে ওঁদেরই লোক সে কথা আমি সর্বত্র সবসময় বলে এসেছি।

যে দেশে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, সেই দেশটাকে স্বদেশ বলতে আমার কোনও দ্বিধা কাজ করে না। জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বরং তাকে বেশি করে ভালবাসতে শিখেছি। তাই যখনই বাংলাদেশে যাবার সুযোগ আসে আমি একটু বেশি রকমের পুলকিত হই। সবাইকে বলি দেশে যাচ্ছি। যে দেশে জন্ম থেকে তেইশটা বছর কাটালাম তাকে যে কিছুতেই ভুলতে পারি না, আর যে দেশে তিপ্পান্নটা বছর কাটালাম তার কাছেও আমার ঋণ কম নয়। সবই নত মস্তকে স্বীকার করি। রাজনীতির টানাপোড়েনে সীমান্তের কাঁটাতার যতই শক্ত করে দেওয়া হোক না কেন তারই মধ্যে দিয়ে আমি ঘুরে আসি আমার স্বদেশ। আরব্ধ কাজগুলো সম্পন্ন করি। ওখান থেকেও দলে দলে মানুষ আসে আমার কাছে। চিকিৎসা, লেখাপড়া, ভ্রমণ, নাটক দেখা সিনেমা দেখা আরও কত কিছুর মধ্যে আমরা হারিয়ে যাই! তাছাড়া চিঠিপত্র, টেলিফোন ইত্যাদির সংযোগ পেরিয়ে এখন এই ই-মেল আর হোয়াটসঅ্যাপের যুগে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই নিবিড়। এইভাবেই আমাদের যোগসূত্র রেখে চলি আমরা। আসলে ইচ্ছেই হল আমাদের এক সর্বশক্তিমান চালিকাশক্তি। সেই ইচ্ছের জোরেই কাঁটাতারের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। আমার কাছে সীমান্তের কাঁটাতার একটি স্থবির চোখরাঙানি মাত্র। খুব ছোটোবেলায় যা এক আতঙ্কের ব্যাপার, আজ আর তাকে তেমন ভয়ংকর আর বিভীষিকাময় বলে মনে হয় না। হাজার হাজার লোক নানারকম বিধিনিষেধের মধ্যেই যখন সীমান্ত পার হচ্ছে, তখন আমিই বা কেন তাকে এত ভয় করব ! হ্যাঁ, পাসপোর্ট ভিসার সমস্তরকম পদ্ধতিকে মান্যতা দিয়েও আমি তো দিব্যি আমার জন্মভূমিতে যাচ্ছি এবং নানারকম কর্মকাণ্ডের মধ্যে ডুবে থাকছি।

না, এখন সত্যি সত্যি কাঁটাতারের এপার ওপার আমার কাছে মিলেমিশে একাকার। এভাবেই যখন ছিয়াত্তরটা বছর পেরিয়ে আসতে পেরেছি, বাকি ক-টা বছরের জন্যে আর-একটু অকুতোভয় হই না কেন!!!!!

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান