জওহরলাল নেহরু
(অনুবাদ : মানস মুখোপাধ্যায়)
[স্বাধীনতার প্রাক্মুহূর্ত, ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যরাত্রি, পার্লামেন্ট হাউসে প্রদেয় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ‘Tryst with Destiny’ বক্তৃতার অনুবাদ।]
সুদীর্ঘ বছর ধরে নিয়তির সঙ্গে আমাদের অভিসার অব্যাহত ছিল। আজ আমাদের অঙ্গীকার সার্বিকভাবে অথবা পরিপূর্ণরূপে না হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে সাধন করার মুহূর্ত সমাগত। মধ্যরাত্রির প্রহরে, বিশ্ব যখন নিদ্রামগ্ন, ভারত তখন জাগ্রত হবে তার স্বীয়সত্তা ও স্বাধীনতায়। ইতিহাসের এ-এক দুর্লভ মুহূর্ত, যখন আমরা পুরাতনী অন্ধকার ভেদ করে প্রবেশ করব নবদিগন্তে; যুগাবসানের এই আলোকপাতে বারংবার বিধ্বস্ত দমিত জাতির আত্মা আজ মূর্ত হয়ে উঠবে। উদ্যাপনের এই ব্রাহ্মক্ষণে, ভারত ও তার জনগণের সেবায়, বিশেষত বৃহত্তর মানবতার মহাযজ্ঞে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব। ইতিহাসের এই উষালগ্নেও ভারতের অন্তহীন অন্বেষা বহমান থাকবে, হৃদয়ের মণিকোঠায় সযত্নে লালিত থাকবে সুদীর্ঘ যাত্রাপথের সাফল্য ও ব্যর্থতার স্মৃতি। সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যের গোলকধাঁধা তার দৃষ্টিকে অনুসন্ধানের অভিমুখ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করেনি, বিস্মৃত করেনি তার আদর্শকে; এখানেই যে তার অফুরান শক্তির উৎস। দুর্ভাগ্যের অভিজ্ঞতাকে পদদলিত করে ভারত আজ সত্যই নিজেকে পুনঃআবিষ্কার করবে। অর্জিত ধ্যানধারণা উদ্যাপনের শুভক্ষণ আজ। সূচনালগ্নের এই মুহূর্তে আমরা নিশ্চিত যে, বৃহত্তর সাফল্য ও কীর্তি আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ। সাহস ও প্রজ্ঞায় বলীয়ান হয়ে ভবিষ্যতের এই আহ্বানে আমরা কি সাড়া দিতে পারব না?
স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা দায়িত্বকে আবাহন করে। সেই দায়ভার এই গণপরিষদের ওপর ন্যস্ত। এই সার্বভৌম সংস্থাই প্রতিনিধিত্ব করবে স্বশাসিত ভারতীয় জনগণের। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বহু বেদনা ও যন্ত্রণাকে আমরা বহন করেছি, দুঃখদীর্ণ সেই স্মৃতিতে আমাদের হৃদয় ভারাতুর। কিয়ৎ যন্ত্রণার কাতরতা আজও অব্যাহত। তবুও বলব, অতীত আজ বিলীন হয়েছে, ভবিষ্যৎ আমাদের ডাক দিয়েছে।
সেই ভবিষ্যৎ স্বাচ্ছন্দ্য বা বিশ্রামের নয়, বরং নিরন্তর প্রচেষ্টার। আমরা যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছি তা যেন পূরণ করতে পারি, আজকে সেই প্রতিজ্ঞাকেই স্মরণ করব। ভারতের সেবা করা প্রকৃতপক্ষে লক্ষ-কোটি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সেবা করা। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, ক্ষুধা, ব্যাধি তথা সুযোগের অসমতার অবসান করা। আমাদের প্রজন্মের মহতী প্রাণের স্বপ্ন ছিল, প্রতিটি মানুষের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু মুছে দেওয়ার। হয়তো তা এখন সম্ভবপর নয়, কিন্তু যতদিন মানুষের অশ্রু ঝরবে অথবা দুর্ভোগের পাকচক্রে বন্দি থাকবে তারা, ততদিন আমাদের কর্মোদ্যোগ স্তব্ধ হবে না।
অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আরও বেশি পরিশ্রম, আরও কাজ— অনেক বড়ো কাজে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। সেই অযুত স্বপ্ন শুধু ভারতের নয়, তা সমগ্র বিশ্বের। জগৎ জুড়ে সমগ্র জাতি আজ যে সৌভ্রাতৃত্বের একাত্ম নিবিড়তায় নিবিষ্ট রয়েছে, বিচ্ছিন্নতা সেখানে অভাবনীয়! বিশ্বজুড়ে শান্তি যেমন অবিভাজ্য, স্বাধীনতা-সমৃদ্ধি যেমন সর্ব-ভোগ্য, তেমনি বিপর্যয় কোনও ভূ-ভাগের খণ্ডিত ভবিতব্য হতে পারে না।
ভারতীয় জনগণের কাছে আমরা আবেদন করছি, এই দুঃসাহসিক অভিযানে বিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় সহায়ে আমাদের সহযোগী হতে। তুচ্ছ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার সময় নয় এখন, নয় অন্যকে অভিসম্পাত ও দোষারোপ করার। স্বাধীন ভারতের জন্য এখন আমাদের উন্নত হর্ম্যপ্রাঙ্গণে সন্নিবেশিত হতে হবে, যা হয়ে উঠবে তার সমস্ত সন্তানের বাসযোগ্য।
নির্ধারিত দিন আসন্ন— নিয়তি নির্ধারিত দিন— দীর্ঘ তন্দ্রা ও সংগ্রামের পর ভারত পুনরায় দণ্ডায়মান— সার্বিক মুক্তি ও স্বাধীনতার অভিব্যক্তির জন্য যা অপরিহার্য ছিল। অতীতের এই ঘোর এখনও কিয়দংশে আমাদের আবিষ্ট রেখেছে; তবু আমাদের বহু লালিত প্রতিজ্ঞাকে আজ রূপায়িত করতেই হবে। নতুন ইতিহাসের শুভারম্ভ হল আমাদের— যে ইতিহাসকে আমরা আমাদের সত্তায় লালন করতে সক্রিয় হব, এবং অন্যেরা তা লিপিবদ্ধ করবে।
সৌভাগ্যের এই মুহূর্ত কেবল ভারতের নয়, সমগ্র এশিয়া এবং অবশ্যই সমগ্র বিশ্বের। নতুন তারার উদয় হল আজ; প্রাচ্যের স্বাধীনতার— এক নতুন আশার সঞ্চার, এক দীর্ঘলালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন হল। এই জাজ্বল্যমান তারকা যেন অস্তমিত না হয়, বিশ্বাসভঙ্গে ও বঞ্চনায় যেন অবলুপ্ত না হয়ে যায় আমাদের আশা!
স্বাধীনতার আনন্দে আমরা উদ্বেলিত, যদিও মেঘের আস্তরণ আমাদের ঘিরে— বহু প্রাণ আজ দুঃখে জর্জরিত, গভীর সংকটে নিমজ্জিত। তবে স্বাধীনতা আমাদের সেই দায়িত্ব ও ভারবহনের ক্ষমতা দিয়েছে; আমরা মুক্ত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার মুখোমুখি হব।
এই দিনটিতে আমরা স্মরণ করতে চাই আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিকে, জাতির পিতাকে, যিনি ভারতের প্রাচীন আদর্শকে প্রমূর্ত করে আমাদের পারিপার্শ্বিক অন্ধকারকে বিনাশ করতে স্বাধীনতার মশাল প্রজ্বলিত করেছিলেন। আমরা প্রায়শই তাঁর অযোগ্য অনুগামী হয়েছি, তাঁর বার্তা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি; কিন্তু ভাবীকাল সেই বার্তাকে আত্মস্থ করবে, ভারতের এই মহান পুত্রের স্মৃতিকে তাদের মননে লালন করবে। অ-সাধারণ ছিল যাঁর বিশ্বাস, শক্তিমত্তা ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ অথচ নম্রতায় ভরা ছিল যাঁর জীবনবোধ। আমরা কখনোই স্বাধীনতার এই আলোকবর্তিকাকে নির্বাপিত হতে দেব না, যতই খরতর হোক বায়ুপ্রবাহ, আগত হোক ঝড়ের অশনি তাণ্ডব।
আমাদের স্মৃতির সরণিতে থেকে যাবে স্বাধীনতার সেই-সকল অ-খ্যাত সেবক ও সৈনিকেরা, যাঁরা প্রশংসা বা পুরস্কারের ভাবনাকে তুচ্ছ করে জীবন দিয়ে দেশের সেবা করে গিয়েছেন।
আমরা আমাদের সেই সব ভাই-বোনেদেরও স্মরণে রাখছি যারা রাজনৈতিক সীমানার কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার এই আনন্দের অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত হলেন; তারা আমাদেরই স্বজন, যা-খুশি হোক-না-কেন তারা চিরকাল আমাদেরই আত্মজন। আমরা তাদের সৌভাগ্য [অথবা] দুর্ভাগ্যের সঙ্গে একাত্ম।
ভবিষ্যৎ আমাদের দিক্নির্দেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমাদের গন্তব্যের অভিমুখ কী হবে, কেমনই-বা হবে আমাদের অধ্যবসায়? স্বাধীনতার ফসলকে সাধারণ মানুষ— কৃষক, শ্রমিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে; দূর করতে হবে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, ব্যাধি। একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জাতিতে উন্নীত হতে হবে আমাদের। দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এই অঙ্গীকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে প্রত্যেক নরনারীর জীবনে ন্যায়বিচার ও পূর্ণতা সুনিশ্চিত হবে।
কঠোর পরিশ্রম আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। কোনোরূপ বিশ্রামের অবকাশ নেই, যতক্ষণ-না-পর্যন্ত আমাদের ভাগ্যবিধাতা ভারতবাসীর জন্য যে সোপান নির্ধারিত করেছেন, তাকে অতিক্রম করতে পারি। আমরা এক মহান দেশের নাগরিক, যারা এক চূড়ান্ত অগ্রগতির সমীপবর্তী; জীবনধারণের সেই উচ্চমানে আমাদের পৌঁছোতেই হবে। আমরা ভারতের সমস্ত সন্তানেরা, তা যে-ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমাদের সকলের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান দায়িত্ব রয়েছে। আমরা সাম্প্রদায়িকতা বা সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিতে পারি না; কোনও জাতি কখনও মহান রূপে চিহ্নিত হতে পারে না, যার চিন্তায় ও কর্মে রয়েছে নীচতা।
বিশ্বের আপামর জাতি ও জনগণকে আমরা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উন্নতি বিধানে সকলকে সহযোগিতা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছি।
এই ভারত, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি; সেই চিরন্তন এবং চিরনূতনকে আমাদের শ্রদ্ধা অর্পণ করছি— তার সেবায় নবউদ্যোগে সম্মিলিত হওয়ার শপথ গ্রহণ করছি।