পরাজয়টা তাহলে কার কাছে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বিজয়ী বীরের ওই যে কান্না তাতে পরাজয়ের গোপন বেদনা কাজ করেছে। কিন্তু পরাজয়টা কার কাছে? গান্ধি, নেহেরু কিংবা ব্রিটিশ সরকারের কাছে অবশ্যই নয়, কেননা তিনি তো তাঁদের সকলের বিরোধিতা ও আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। পরাজয়টা আসলে যে-দ্বিজাতিতত্ত্বকে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন তার কাছেই। তত্ত্বের ভেতরে বাইরে যে মস্ত বড়ো দুর্বলতা ছিল জিন্নাহ যে সেটা জানতেন না তা নয়, জানতেন। তাঁর যুক্তি ছিল এই যে, হিন্দু ও মুসলমান দু-টিই প্রধান জাতি,তাই হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদেরকেও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসনে তাদেরকে প্রাপ্য সুযোগ দেওয়া চাই। এই দাবির ভেতরের দুর্বলতা অবশ্যই এটা যে, জাতি তো অনেকগুলো, তাহলে কেবল মুসলমান সংখ্যালঘুরাই আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার পাবে কেন, অন্যরা কেন বঞ্চিত হবে? তাদের সংখ্যা কম বলে? কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যাও তো কমই ছিল হিন্দুদের তুলনায়। তাহলে? দ্বিজাতিতত্ত্বের বাইরের দিককার দুর্বলতা হল এটা যে, কেবল হিন্দু ও মুসলমানকেই যদি জাতি বলে স্বীকার করা হয় তাহলে অন্য সংখ্যালঘুরা তা মানবে কেন? এবং তাদের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? এই প্রশ্নকে গ্রাহ্য না-করা।

ভারতবর্ষ যে বহুজাতির দেশ তার কারণ ধর্ম নয়, কারণ হচ্ছে ভাষা, যদিও এই সত্যটা কংগ্রেস স্বীকার করেনি, লিগও মেনে নেয়নি। মওলানা আজাদ বলছেন যে, জিন্নাহ এবং তাঁর অনুসারীরা যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তখন তাঁরা মনে হয় খেয়াল করেননি যে ভূগোল ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে; মুসলমানরা সারা ভারতজুড়ে এমনভাবে ছড়িয়ে অবস্থান করছিল যে তাদেরকে একটি রাষ্ট্রের আওতায় নিয়ে আসাটা ছিল অসম্ভব। সেটা অবশ্যই সঠিক। মৌলানা আজাদের দ্বিতীয় একটি বক্তব্যও যথার্থ। তাঁর মতে, ভারতবর্ষের মানুষের সঙ্গে এটা ছিল মস্ত বড়ো প্রতারণা যে, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এলাকাকে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে এক করা সম্ভব। তিনি যদিও সে-ভাবে বলেননি তবু আমাদেরকে তো মানতেই হবে যে, ভারতীয় পটভূমিতে ভাষাগত পার্থক্যটা ছিল খুবই বড়ো, যেটা এখনও আছে। বাঙালিরা যে বাঙালি, পাঞ্জাবিরা যে পাঞ্জাবি, এবং অন্যরা যে অন্যজাতি তার মূল কারণ ভাষা।

ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার এই সত্যটা জিন্নাহ বিশেষভাবেই মানতে বাধ্য হয়েছিলেন যখন মাউন্টব্যাটেন বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করার প্রস্তাবটি জিন্নাহর সামনে উপস্থিত করেন। জিন্নাহ তখন আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন সেটা করা হবে মস্তবড়ো অন্যায়, কেননা বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের স্বতন্ত্র নিজস্ব ‘জাতীয় চরিত্র’ রয়েছে। জাতীয় এই চরিত্রটির মূলভিত্তি যে ভাষা সেটা অবশ্য তিনি উল্লেখ করেননি। করার বোধ করি প্রয়োজনও ছিল না। এর আগে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য হিসাবে জিন্নাহর সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় জিন্নাহকে প্রশ্ন করেছিলেন বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য তো অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা পাঠান মুসলমান ও সিন্ধি মুসলমানদের মধ্যকার পার্থক্যের চেয়ে বেশি নাকি কম। এই প্রশ্নের জবাবে এমনিতে স্পষ্টভাষী জিন্নাহ কোনও স্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি, কেবল বলেছেন, মুসলমানরা যেখানেই থাকুক তারা কতগুলো মূলনীতিতে আস্থা রাখে, তারা এক আল্লায় এবং মানুষ মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাস করে; হিন্দুরা এসব নীতিতে বিশ্বাসী নয়। এরকমের আড়ম্বরপূর্ণ কথা জিন্নাহ বিশাল বিশাল জনসভাতেও বলেছেন। যেমন এলাহাবাদের এক জনসমাবেশে তাঁকে বলতে শুনি মুসলমানরা এক জাতি, কেননা তারা সকলেই এক ও অদ্বিতীয় আল্লায় বিশ্বাসী। অথচ তাঁর এটা অজানা থাকার কথা নয় যে, মুসলমানরা এক জাতি নয়, এমন কি মধ্যপ্রাচ্যেও তারা জাতিগতভাবে বিভক্ত। তাছাড়া কোরানেই তো বলা আছে যে ইচ্ছা করলে আল্লাহ সবাইকে একজাতিতে পরিণত করতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি, কেননা তিনি চেয়েছেন মানুষের মধ্যে যে গুণগুলো তিনি দিয়েছেন সেগুলো পরীক্ষিত ও বিকশিত হোক।

রাজনীতিতে জিন্নাহ ধর্মকে ব্যবহার করেছেন ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যে ধর্মের অনুশীলন করতেন তা নয়। সেদিক থেকে ছিলেন তিনি পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ। যেমন, রমজান কখন আসে কখন যায় সে-খবর তিনি রাখতেন না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটি পড়েছিল রমজান মাসে, সেদিন মাউন্টব্যাটেনের সম্মানে করাচিতে তিনি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন; পরে রোজার ব্যাপারটা অবগত হয়ে মধ্যাহ্নভোজকে নৈশভোজে পরিবর্তিত করেন। তাঁর তুলনায় গান্ধি বরঞ্চ মুসলমানদের পালাপার্বণের খবরের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন বলে জানা যায়। মওলানা আজাদ ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তিনি ধর্মানুশীলনও করতেন, যদিও জিন্নাহর মূল্যায়নে মওলানা ছিলেন মুসলিম কওমের জন্য একজন বিশ্বাসঘাতক। ১৯৪৭ সালে নেহেরু এবং প্যাটেল আশা করেছিলেন আপাতত ভাগ হয়ে গেলেও ভারতবর্ষ আবার একদিন এক হবে; মওলানা তেমনটা মনে করেননি; তবে এ বিষয়ে তিনি স্পষ্ট ছিলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যে এক হয়ে গিয়ে অভিন্ন জাতিতে পরিণত হবে এমন কোনও সম্ভাবনা আদৌ নেই; বলেছেন যে, এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানেও সিন্ধি, পাঞ্জাবি ও পাঠানদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা দেবে। তাঁর সেই ভবিষ্যদ্‌বাণী মোটেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি।

দ্বিজাতিতত্ত্ব যে ভ্রান্ত জিন্নাহর কাছে তা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। যে জন্য ১১ই আগস্টের সেই বহুল-আলোচিত, অলিখিত ও স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতাটিতে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ভবিষ্যতের পাকিস্তানে ধর্মীয় বিভাজন থাকবে না, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই হবে সমান নাগরিক। ওই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগুলে দেখা যাবে যে ব্যক্তিগতভাবে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান থাকবে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের প্রশ্নে রাজনৈতিক অর্থে হিন্দু মুসলমান আর আলাদা থাকবে না, সবাই হবে সমান। ধর্মনিরপেক্ষতার এমন সংক্ষিপ্ত অথচ পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা ভারতীয় নেতাদের অনেকেই দিতে পারেননি। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনও স্বতন্ত্র ধর্মীয় বিশ্বাস নেই, এমন কথা জিন্নাহ যখন বললেন তখন তো তিনি তাঁর নিজের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিটাকেই প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর নীরব অশ্রুপাত যা বলেছে, এই প্রত্যাখ্যান তো সে-ই একই পরাজয়ের সংবাদটা জানিয়ে দিচ্ছে। তবে দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শ থেকে ওই স্বতঃস্ফূর্ত সরে আসাটা যে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর হয়েছে তা নয়। পাকিস্তান ধর্মকে ছাড়েনি, বরঞ্চ প্রবল বিক্রমে আঁকড়ে ধরেছে, এবং ১৯৫৬তে যে সংবিধান রচিত হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছরেই ৩০শে অক্টোবরে লাহোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সমাবেশে দাঁড়িয়ে শ্রোতাদেরকে জিন্নাহ নিজেই আশ্বস্ত করেছিলেন এই কথা বলে যে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই, কেননা ‘আমাদের রয়েছে পবিত্র কোরান যেখান থেকে আমরা অনুপ্রেরণা ও পথনির্দেশ পাবো।’

তবু এই সত্যটা অলঙ্ঘনীয়ই থাকে যে জিন্নাহ জয়ী হয়েও পরাজিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর তত্ত্বের কাছেই। তাঁর পাকিস্তান টেকেনি, ভেঙে গেছে, এবং আরও ভাঙবে বলে ধারণা করা যায়। যে-পাঞ্জাবিরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ডাকে সাড়া দিয়েছে অনেক বিলম্বে, সেই পাঞ্জাবিরাই পাকিস্তান শাসন করেছে, এবং এখনও ভগ্নাংশের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে, অন্য কোনও জোরে নয়, জনসংখ্যা ও সেনাবাহিনীর জোরে, এবং সেনাবাহিনী ধর্মকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যে ইসলামি জঙ্গিদের এখন সেখানে পোয়া বারো।

দেশভাঙার কাজটা ঠিক হয়েছে কি না এ নিয়েও জিন্নাহর মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল। সংশয় নয়, যেন অস্থিরতা। ১১ই আগস্টের ওই বক্তৃতাতেই জিন্নাহ বলেছেন ভাগ করাটা ঠিক হয়েছে কি হয়নি সে নিয়ে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান উভয় জায়গাতেই প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ‘আমার বিচারে’, তিনি বলেছেন, ‘সমস্যার অন্য কোনও সমাধান ছিল না।’ অবিভক্ত ভারতবর্ষ কার্যকর হত না এবং তাঁর মতে অবিভক্ত রাখলে পরিণতিটা দাঁড়াত ভয়াবহ এক দুর্যোগ। কিন্তু তারপরেই, কথাটা অত জোরে বলার সঙ্গে সঙ্গেই, যোগ করেছেন সংশয়ের কথা, “হয়তো ওই দৃষ্টিভঙ্গিটা সঠিক, হয়তো নয়, সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।” এটি অস্থিরতার চিহ্ন বৈকি। দেশভাগ নিয়ে সংশয় নেহেরুর মনেও ছিল। তবে সাম্প্রদায়িক সমস্যার অন্য কোনও সমাধান ছিল না এমন কথা তাঁর বলবার কথা নয়। তিনি তা বলেনও নি। অনেকটা স্থির কণ্ঠেই নেহেরু বলেছেন, ‘আমরা ঠিক করেছি না ভুল করেছি একদিন ইতিহাসই তার বিচার করবে। তবে যে বিবেচনাটা সবচেয়ে জরুরি সেটা হল আমরা সঠিক কাজটা করতে চেষ্টা করেছি কিনা।’ তিনি মনে করেন যাই করে থাকুন সঠিক কাজটি করার চেষ্টার ত্রুটি করেননি, এবং এই আশা ব্যক্ত করেছেন যে, সেই বিবেচনায় হয়তো তাঁদের অনেক পাপ ও ভ্রান্তিকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সঠিক কাজটি করার চেষ্টা করেছেন এমন সান্ত্বনা জিন্নাহর মনে ছিল বলে ধারণা করা যায় না। কেননা তিনি যে-দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন দেশভাগের পর তাকেই নাকচ করে দিয়েছেন। দেশভাগের পর তেরো মাস পার না হতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, নইলে তাঁকে হয়তো আরও অনেক অনুশোচনার ভেতর দিয়ে যেতে হত। ভাগাভাগির কাজটা যে একেবারেই ঠিক হয়নি এবিষয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বে দৃঢ়রূপে অবিশ্বাসী মওলানা আজাদের মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। তবু ভগ্নহৃদয় আজাদও বিচক্ষণতার সঙ্গে বলেছেন, ইতিহাসই একদিন বিচার করবে রাজনীতিকরা প্রজ্ঞা ও যথার্থতার সঙ্গে কাজটা করেছেন কি না।

সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছেন দু’জন। একজন হলেন শরৎচন্দ্র বসু, অপরজন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি। তাঁদের দু’জনের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান; শরৎ বসু ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আর গান্ধি ছিলেন সমাজতন্ত্রবিরোধী। কিন্তু তাঁদের দেশপ্রেমই বলে দিয়েছে যে, দেশভাগের কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। ইতিহাস কী রায় দেবে বা দেবে না সে-নিয়ে এই দু’জনের কারও মনেই কোনও সংশয় ছিল না। শরৎ বসুর বক্তব্য ছিল (মে ১৯৪৭), ‘ভবিষ্যতের প্রজন্ম বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করার জন্য আমাদেরকে ধিক্কার দেবে।’১০ আর গান্ধি বলেছিলেন, মূল্য হবে কঠিন এবং ভবিষ্যত হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন।১১ আর কে না জানে যে, মূল্য যা দেবার তা ধনীদের নয়, দেশের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রকেই দিতে হয়েছে।

পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে জিন্নাহ জাতিতে জাতিতে সমতা বিধানের দাবি তুলেছিলেন, কিন্তু নাগরিকে নাগরিকে সমতা বিধানের কথা তাঁকে বলতে শোনা যায়নি। আর দু’জাতির কেবল নয়, অন্যজাতিরও যে রাজনৈতিক অধিকার থাকাটা ন্যায়সংগত এই সত্যকে উপেক্ষা করেছেন। তবে পুরোপুরি উপেক্ষা যে করতে পেরেছেন তাও নয়। তপশিলিদেরকে বর্ণবিন্দুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তারা যে স্বতন্ত্র জাতি এটা প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন, যে জন্য বাংলার যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী করেছিলেন, করার সময় এমন কি বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নামটিও তাঁর মনে পড়েনি। ওদিকে শিখদেরকে হিন্দুদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে টানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শিখরা যে উলটো পথ ধরেছে সে তো ইতিহাসের একটি রক্তাক্ত সত্য।

নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষে বহুজাতিক অধ্যুষিত ভারতবর্ষকে এক করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজদের মতো সাফল্য কেউই অর্জন করতে পারেনি; তারা তাদের ভারতবর্ষীয় সাম্রাজ্যকে বার্মা পর্যন্ত প্রসারিত করে ফেলেছিল। ১৯৩৫-এর নতুন ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলোকে কিছু পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল যার পেছনের অনুপ্রেরণাটা জনগণের উপকার করা ছিল না, ছিল আন্দোলনের মুখে হিন্দু মুসলমান জাতীয়তাবাদীদেরকে কিছুটা ছাড় দিয়ে নিজেদের শাসনকে রক্ষা করা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে মানুষের উপকার হবার কথা বৈকি। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় শাসনের জোয়াল যাদের কাঁধে, সেখানে দূরবর্তী কেন্দ্র যদি কিছুটা দুর্বল হয় এবং স্থানীয় শাসনের ক্ষমতা অল্প হলেও বৃদ্ধি পায় তাতে মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তি আসবার কথা। অবশ্য ভারত শাসনের ওই আইনে ভোটাধিকার মোটামুটি তেরো শতাংশ মানুষের বাইরে যায়নি; এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভোটাধিকারপ্রাপ্ত মানুষদেরকে ভাগ করে ফেলার বন্দোবস্ত ছিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে মুসলিম লিগ যেটুকু আগ্রহ দেখিয়েছে তার পেছনে ছিল কেন্দ্রে কংগ্রেসের একাধিপত্যের ভয়। এদিকে কংগ্রেস বরাবরই চেয়েছে এককেন্দ্রিক শাসন। এর কারণ কেবল যে ভারতবর্ষকে এক রাখবার আদর্শিক আকাঙ্ক্ষা তা নয়; ছিল সর্বভারতীয় ক্ষমতার অধিকারী হবার ইচ্ছাটাও। মুসলিম লিগের নেতৃত্বও যে প্রদেশকে যথার্থ স্বায়ত্তশাসন দিতে আগ্রহী ছিল তা মোটেই নয়, তারাও এককেন্দ্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠাই চেয়েছে।

মুসলিম লিগের অবস্থানগত পরিবর্তনটি লক্ষ করবার মতো। ১৯৪৬-এ পাকিস্তান নামে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখতে পাওয়ার পূর্বসময় পর্যন্ত মুসলিম লিগ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনই চাইত। আরও আগে ১৯২৪ সালে দেখছি মুসলিম লিগ স্বরাজ চাচ্ছে, এবং স্বরাজ বলতে বোঝাচ্ছে প্রদেশসমূহের একটি ফেডারেশন।১২ ১৯২১-এ জিন্নাহর দেওয়া চোদ্দো দফার প্রথম দফাতেই বলা হয়েছে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানকে হতে হবে ফেডারেল ধরনের, সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয় বাদে বাদবাকি সকল ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে। চোদ্দো দফার দ্বিতীয় দফায় আছে এই দাবি যে, সকল প্রদেশ একই ধরনের স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা পাবে; অর্থাৎ কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে কেন্দ্র বা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পাবে না।

১৯৩০ সালে মুসলিম লিগের সভাপতির ভাষণে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিত হিসাবে মুহাম্মদ ইকবালও একই কথা বলেছেন, আরও জোর দিয়ে। তাঁর মতে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারপ্রাপ্ত ভারতবর্ষের জন্য এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করাটাও অসম্ভব। ফেডারেশনভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদত্ত ক্ষমতার বাইরে কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য কোনও ক্ষমতা থাকবে না। বাদবাকি ক্ষমতা অবশ্যই ন্যস্ত হবে আত্মনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রগুলোর হাতে।১৩ নতুন ভারত শাসন আইনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে কথা শোনা যাচ্ছিল, সেই নির্বাচনের ব্যাপারে লিগের আপত্তি ছিল। কারণটা তারা তাদের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে পরিচ্ছন্নভাবেই বলে দিয়েছে (এপ্রিল ১৯৩৬)। কমিটি বলছে, তারা এমন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরোধী যাতে গণতন্ত্র ও সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আড়ালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের মতে বহুসংখ্যক জাতীয় সত্তা বিদ্যমান যে-ভারতবর্ষে এবং যার পক্ষে এক জাতি রাষ্ট্র হওয়া অসম্ভব তার স্বাভাবিক চরিত্রের (genius) সঙ্গে সংসদীয় ব্যবস্থা মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়।১৪ (সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এ ধরনের কথা পরবর্তীতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইউব খাঁ’র কাছ থেকেও পাওয়া গেছে।)

নির্বাচন চায়নি ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন হওয়াতে লিগের জন্য সুবিধাই হয়েছে। বাংলায় ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে লিগের পক্ষে সরকার গঠন করা গেছে, এবং শক্তিশালী না- হলেও সারা ভারতে মুসলমানদের প্রধান দল হিসেবে তারা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নেহেরু দাবি করতেন ভারতবর্ষে পক্ষ দু-টিই, সরকার ও কংগ্রেস; তার বিপরীতে জিন্নাহ বলবার সুযোগ পেলেন যে পক্ষ হচ্ছে তিনটি, তৃতীয়টি মুসলিম লিগ। এর পরে যখন বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেল, তখন কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতায় অসম্মতি জানানোর দরুন কংগ্রেস যেসব প্রদেশে তার মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল সেখান থেকে পদত্যাগ করল। এতে লিগের সুবিধা হয়েছে। তারা ‘মুক্তি দিবস’ পালন করেছে, কংগ্রেস শাসন থেকে মুক্তি তাদের জন্য ছিল মস্ত এক পাওনা। এর আগে (১৯শে আগস্ট ১৯৩৮) বড়লাটের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে জিন্নাহ সরকারের কাছে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশগুলোতে সরকার যদি মুসলমানদেরকে সাহায্য করে তবে কেন্দ্রীয় ব্রিটিশ শাসনে মুসলিম লিগ কোনও পরিবর্তন চাইবে না, বরঞ্চ সরকারকে সাহায্যই করবে।১৫

কিন্তু প্রদেশের ব্যাপারে জিন্নাহর যে বিশেষ কোনও আগ্রহ ছিল না এটা বাস্তব ও প্রকাশ্য সত্য; তা সে প্রদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠই হোক কি সংখ্যালঘিষ্ঠই হোক। এদিক থেকে তিনি নেহেরু ও প্যাটেলের মতোই অসংশোধনীয় রূপে কেন্দ্রীয়পন্থী ছিলেন। তাঁরা তিনজনই কেন্দ্র নিয়েই ভাবতেন, নিজেদের জন্য সর্বভারতীয় ক্ষমতা এবং সর্বভারতীয় হবার গৌরব চাইতেন। জিন্নাহর পক্ষে সর্বভারতীয় হবার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল কংগ্রেস; যে জন্য তিনি কংগ্রেস ছেড়েছিলেন, এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হাতের কাছে পেয়ে সেটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। প্রদেশকে তিনি শক্তি ও সমর্থনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেখানে কী ঘটছে না ঘটছে সেটা তাঁর জন্য ততটাই জ্ঞাতব্য ছিল যতটা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য তা উপযোগী হত ততটাই, তার বাইরে নয়। তাঁর পাকিস্তান কেন্দ্রেই প্রোথিত ছিল, প্রদেশে নয়। ‘প্রাদেশিকতা’র তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। কেন্দ্রকে শক্তিশালী রাখার ব্যাপারে আগের ও পরের সাম্রাজ্যবাদীদের এবং শত্রুপক্ষ কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে এ-বিষয়ে তাঁর কোনও দূরত্ব ছিল না, বরঞ্চ নৈকট্যই ছিল বলা যাবে।

দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেখানে পাঞ্জাবি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এটা যেমন সত্য, ঠিক সমান পরিমাণে সত্য হল এটা যে বাংলার সমর্থন না-পেলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল অসম্ভব। কিন্তু ১৯৩৭-এর নির্বাচনের আগে বাস্তবিক অর্থে বাংলায় মুসলিম লিগের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ১৯৩৬-এর জুন মাসে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের প্রথম বৈঠক বসে। এতে পাঞ্জাবের উপস্থিতি ছিল একবারেই হতাশাব্যঞ্জক, আর বাংলা থেকে যে চল্লিশজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে গিয়েছিলেন মাত্র দু’জন, হাসান ইস্পাহানী ও আব্দুর রহমান সিদ্দিকী, যাঁদের কেউই বাঙালি নন। বাংলায় তখন মুসলমানদের দল বলতে বোঝায় কৃষক শ্রমিক পার্টি ও ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি অব বেঙ্গল। কলকাতায় ফিরে হাসান ইস্পাহানী জিন্নাহকে আহ্বান জানালেন কলকাতা সফরে আসতে; উদ্দেশ্য বিদ্যমান দু-টি দলকে সঙ্গে নিয়ে বাংলায় মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করা। জিন্নাহ এলেন, কিন্তু হাওড়া স্টেশনে দেখা গেল তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত রয়েছেন সর্বসাকুল্যে তিনজন, ইস্পাহানীরা দুই ভাই ও খাজা নূরুদ্দিন। কলকাতায় এসে জিন্নাহ তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতা ও ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শন করে দুই দলের মানুষদের কাছে টানলেন, শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে সবাই মিলে মুসলিম লিগ গড়ে তুলবেন, এবং নির্বাচনে মনোনয়ন দেবার জন্য একটি যৌথ পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করা হবে। বোর্ড গঠিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঐক্য টেকেনি।১৬

ফজলুল হককে জিন্নাহ লিগের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল তার খবর ফজলুল হকের লিখিত একটি চিঠিতে পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে হকের কাছ থেকে আনুগত্যের অভাবের ব্যাখ্যা-চাওয়ার জবাবে হক জিন্নাহকে তাঁর ‘ঔদ্ধত্য’র জন্য তিরস্কার করছেন, এবং মন্তব্য করছেন যে তাঁর সন্দেহ হয় যে মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে জিন্নাহ অন্য কোনও গভীর খেলায় লিপ্ত রয়েছেন। পরিণতিতে জিন্নাহ তাঁকে পার্লামেন্টারি বোর্ড থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।১৭ ফজলুল হকের পক্ষে তখন এমন চিঠি লেখা সম্ভব ছিল। সর্বভারতীয় নেতা না-হলেও হক তখন রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, জিন্নাহর চেয়ে তিনি বয়সে বড়ো, সেই ১৯১৮ সালে একই সঙ্গে তিনি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লিগের এবং ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন; ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা ঘটে যে সম্মেলনে তাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন।

হকের বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তিনি সর্বভারতীয় নেতা হতে চাননি, প্রাদেশিক নেতাই থাকতে চেয়েছেন। ১৯২৪ সাল থেকে তিনি মন্ত্রীত্ব করেন, মন্ত্রীত্বের আগ্রহ তাঁকে কখনও ছেড়ে যায়নি। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রীসভা গঠন করতে চেয়েছিলেন; কংগ্রেস তাতে সম্মত না হয়ে নিজেদের তো বটেই, বাংলা ও সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য স্থায়ী ক্ষতির কারণ ঘটিয়েছে। বিফলমনোরথ ফজলুল হক মুসলিম লিগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; কেবল তাই নয়, মুসলিম লিগে যোগ দিয়ে প্রাদেশিক লিগের সভাপতির পদটি গ্রহণ করেছেন। মুসলিম লিগ তাঁকে খুঁজে নিয়েছে, লখনউ সম্মেলনে উর্দু ভাষায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে তিনি লিগের লোকদের হৃদয় হরণ করেছেন, তারা তাঁকে ‘শেরে বাংলা’ উপাধি দিয়েছে। তিন বছর পরে জিন্নাহ তাঁকে দিয়ে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করিয়ে নিলেন। এর ফলে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে, সাম্প্রদায়িকতা প্রবল হয়েছে, এবং বাংলা বিভাগ অনিবার্যতার দিকে এগিয়ে গেছে।

বাংলার রাজনীতিতে অত্যন্ত ক্ষতিকর ঘটনা ঘটেছে ১৯২৫ সালে, চিত্তরঞ্জন দাশের প্রাণত্যাগে। এর পরে সর্বভারতীয় রাজনীতির পক্ষে বাংলার প্রবেশের পথে আর কোনও অন্তরার রইল না। ১৯২৩-এ বেঙ্গল প্যাক্ট যখন স্বাক্ষরিত হয় তখন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ফজলুল হকও ছিলেন; কিন্তু ১৯৩৭-এ তিনি যখন মুসলিম লিগে চলে গেলেন তখন বাংলার রাজনীতি সর্বভারতীয় রাজনীতির জন্য সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। আবুল মনসুর আহমদের এই মন্তব্য মোটেই অতিরঞ্জিত নয় যে, হকের লিগে যোগদানের দিনেই বাংলার নিজস্ব রাজনীতির অবসান ঘটেছিল।১৮

কিন্তু জিন্নাহ তো কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী সহ্য করেন না, একক থাকতে চান, যেটি অন্যতম কারণ তাঁর কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসার। ফজলুল হককে কোণঠাসা করার চেষ্টা তাই শুরু হয়ে গেছে লাহোর প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেওয়ার পরপরই। যুদ্ধের পটভূমিতে-গঠিত সরকারি ডিফেন্স কাউন্সিলে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলার ফজলুল হক, পাঞ্জাবের সিকেন্দার হায়াত খান এবং আসামের সাদউল্লাহ যোগ দেন; কিন্তু জিন্নাহর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগ যেহেতু ঠিক করেছিল যে লাহোর প্রস্তাব মেনে না নিলে ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগ দেওয়া চলবে না, তাই প্রধানমন্ত্রীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হল নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিতে। পাঞ্জাব ও আসামের প্রধানমন্ত্রী সে-নির্দেশ আপত্তি সত্ত্বেও মেনে নিলেন, রাজি হলেন না বাংলার প্রধানমন্ত্রী; তিনি বরঞ্চ প্রদেশের ব্যাপারে জিন্নাহর হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে মুসলিম লিগ থেকে পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ পত্রে (৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৪১) ফজলুল হকের ভাষা ছিল দৃঢ়, তিনি সেই অভিযোগই উত্থাপন করেছেন যেটি পরে হাসান ইস্পাহানীর মতো অনুগতেরাও স্বীকার করেছেন, যদিও নম্র ভাষাতে। হক লিখেছেন, “মুসলিম-প্রদেশের সংখ্যালঘু তাদের নেতাদের দ্বারা বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলিমরা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে।” তাঁর পরিষ্কার অভিযোগ জিন্নাহর ‘স্বৈরাচারে’র বিরুদ্ধে। চিঠিতে তিনি বলেছেন, বাংলার ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মুসলিমের ভাগ্যের ওপর বাইরের কোনও মহলের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না, তা সেই মহল যতই শক্তিশালী হোক না কেন।১৯

ভারতবর্ষকে একক কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে রাখার অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতা করার ব্যাপারে হিন্দু মহাসভা ছিল আরও অনমনীয়। তাদের বক্তব্য ছিল এই যে, ভারত হিন্দুর দেশ, মুসলমানরা ভিন্ন জাতি, তারা অধিকাংশই ধর্মান্তরিত, অল্পকিছু বহিরাগত; হিন্দুর দেশ ভারত তাই এক ও অবিভাজ্য থাকবে। পরিহাস অবশ্য এখানে যে, মহাসভার এই অনমনীয়তা মুসলমানদেরকে ঠেলে দিয়েছে পাকিস্তানের পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান গ্রহণের দিকে, যার দরুন মওলানা আজাদ ও সীমান্তের গাফ্ফার খানের মতো জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের অবস্থানটা নাজুক রয়ে গেছে। উগ্ররূপে সাম্প্রদায়িক সাভারকারের পরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার সভাপতি হয়েছেন, তিনিও এককেন্দ্রিক সরকারের উগ্র সমর্থকই ছিলেন। ১৯৩৯ সালে মাদ্রাজে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ দেখতে পান যে সুভাষ বসু কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ায় অন্ধ্রপ্রদেশের লোকেরা বেজায় ক্ষেপেছে, এবং বাঙালিদেরকে যাচ্ছেতাই ভাবে গালমন্দ করছে। বাঙালি হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ তাতে দুঃখ পেয়েছেন বটে, তবে তাঁর মনে হয়েছে এসবই হচ্ছে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ফল। ইংরেজরা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিয়ে ভীষণ ধূর্ত একটা কাজ করেছে, যার ফলে ভারতের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ ও স্ব-শাসিত হওয়া কঠিন হবে বলে তিনি তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন।২০ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যে ইতিমধ্যে কাজ করা শুরু করেছে সেটা তিনি খেয়াল করছেন না, যদিও বাঙালিদের বিরুদ্ধে ওই বিদ্বেষ দেখে ডায়েরীতে তিনি এও লিখেছেন যে, বাঙালিকে দু’য়েক ঘা বসিয়ে দিতে পারলে সকল মহলই খুশি হয়। শ্যামাপ্রসাদ ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চান যাতে ভারতের তথাকথিত হিন্দুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। ১৯৪২-এ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস যখন তাঁর মিশন নিয়ে ভারতে আসেন তখন শ্যামাপ্রসাদ তাঁকে জোর দিয়ে বলেছিলেন প্রদেশগুলো ইচ্ছা করলে ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যেতে পারবে এই ব্যবস্থাপনা ভারত বিভাগের পথকে প্রশস্ত করবে, যার জন্য ক্রিপসের পরিকল্পনাকে তিনি ভীষণভাবে অপছন্দ করেন। ক্রিপসকে স্পষ্ট করে তিনি বলেছিলেন, “ভারতে যে রাজনৈতিক ঐক্য আপনাদের সবচেয়ে বড়ো অর্জন সেটাকেই আপনারা নিজ হাতে ভেঙে ফেলছেন।”২১ এখানে তিনি বাঙালি নন, হিন্দু। সেই পর্যায়ে ব্যক্তিগতভাবে শ্যামাপ্রসাদ যে সাম্প্রদায়িক ছিলেন তা হয়ত নয়, কিন্তু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যে ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্যকে বিপন্ন করে তার হিন্দুত্বকে বিপদে ফেলবে এ-বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন। ১৯৪৭এ শ্যামাপ্রসাদকে দেখা যাবে ভিন্নরূপে; এবার তিনি একাধারে বাঙালি ও হিন্দু, তাই বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে মুসলিম লিগের শাসন থেকে বাঁচাবার আগ্রহে তিনি বাংলাকে দু’টুকরো করতে চাচ্ছেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল পরিষ্কার। ভারতভাগ হোক কি না হোক, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, বাংলাকে ভাগ করতেই হবে। মুসলমানদের সঙ্গে তিনি কিছুতেই থাকবেন না।২২ সত্য এই যে, পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের কি হবে তা নিয়ে তিনি ভাবছেন না, পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের উদ্ধার করা নিয়েই শুধু চিন্তিত হয়েছেন; অবিকল জিন্নাহর মতো কাজ, যিনি সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভাগ্যের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না, ব্যস্ত ছিলেন তুলনামূলকভাবে কম বিপন্ন সংখ্যাগুরু মুসলমানদের কি ভাবে ‘মুক্ত’ করা যায় তা নিয়েই, অথচ রাজনীতিতে জিন্নাহ ও শ্যামাপ্রসাদের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী দুই চূড়ান্ত প্রান্তে। মিল অবশ্য ছিল, সেটা হল সমগ্র জনগণের যুক্তির প্রশ্নকে উপেক্ষা তথা বিরোধিতা করা। উভয় নেতাই সেটা করেছেন।

প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে কংগ্রেসের বিরোধিতার ব্যাপারটা আমরা জানি। ক্রিপসের প্রস্তাব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, ক্যাবিনেট মিশন প্রদেশগুলোকে যেটুকু স্বায়তশাসন দিতে চেয়েছিল তাতেও কংগ্রেস ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছে। বস্তুত জিন্নাহ যেমন নেহেরুর তেমনি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী ছিলেন, উভয়ে চাইতেন শক্ত কেন্দ্রীয় শাসন, এবং তা একই কারণে, প্রদেশগুলো যাতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে সেই লক্ষ্যে। তবে পার্থক্য ছিল এখানে যে, জিন্নাহ যেখানে আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন, নেহেরু সেখানে চেয়েছেন ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ। নেহেরুর দৃষ্টিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল ভারতবর্ষের ঐক্যের পরিপন্থী।

সাতচল্লিশে এসে অবশ্য নেহেরুর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন দেখা গেছে। সাতচল্লিশের একুশে ফেব্রুয়ারীতে নেহেরু ওয়াভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন যে, লিগের সঙ্গে যদি শেষ পর্যন্ত সমঝোতা না-ই হয় তাহলে বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করা হয়তো আবশ্যক হয়ে পড়বে।২৩ মুসলিম লিগের তৎপরতার ফলে খিজির হায়াত তিওয়ানার সংযুক্ত মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করার (২ মার্চ ১৯৪৭) ছয় দিন যেতে না যেতেই নেহেরু পাঞ্জাবকে ভাগ করার কথা তোলেন। পাঞ্জাবে তখন প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে। এর দু’দিন পরে নেহেরু দাবি করেন যে, গৃহযুদ্ধ এড়ানোর প্রয়োজনে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের জন্য দু-টি স্বতন্ত্র মন্ত্রীসভা গঠন করা হোক;২৪ কিন্তু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাউন্টব্যাটেন সত্যি সত্যি যখন তাঁর দেশভাগের পরিকল্পনাটি নেহেরুকে দেখালেন তখন নেহেরুই বলেছেন, ‘it will be a disaster.’।২৫

মাউন্টব্যাটেন ও নেহেরু উভয়েই এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে, ভারতের জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দরকার। কিন্তু সেটা এক ব্যাপার, আর ভারতকে এক রাখা আর-এক ব্যাপার। এক রাখাটা সম্ভব হয়নি। দেশভাগের কাজটাকে নেহেরু বলেছিলেন মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলার শামিল২৬; কিন্তু তাঁদের দিক থেকে এটা না করে উপায় ছিল না। তার নানা কারণ আমরা জানি।

পাঞ্জাবের দিক থেকে না হলেও বাংলার দিক থেকে দ্বিখণ্ডিতকরণ ঠেকানোর একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে প্রাদেশিক আইন সভায় বিরোধী দলের নেতা কিরণশঙ্কর রায় এবং সে-সময়ের ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎচন্দ্র বসু উভয়েই উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু তাঁদের উদ্যোগ বেশি দূর এগোয়নি, যদিও কোনও কোনও মহলে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বাংলা কিছুতেই ভাগ হতে চাইবে না, এবং বাঙালিরা হয়তো হিন্দুস্তান বা পাকিস্তানে যোগ না-দিয়ে বরঞ্চ স্বতন্ত্র থাকতেই পছন্দ করবে। এমনকি লিয়াকত আলি খানও এমনটা মনে করেছিলেন।২৭ মওলানা আজাদ এবং সর্দার প্যাটেলও মাউন্টব্যাটেনকে এ রকমের একটা ধারণা দিয়েছিলেন। তপশিলি নেতা জগজীবন রামও তেমনটাই ঘটবে বলে মনে করতেন। শুধু বাঙালিরা বলে নয়, পাঞ্জাবিরাও ভাগ না হতে চাইতে পারে বলে অনুমান ছিল কারও কারও; যদিও পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে সেটা ঘটার সম্ভাবনা বাংলার চেয়ে কম বলেই মনে হচ্ছিল। বাংলা ও পাঞ্জাব উভয়েই, এমন কি দু-টির একটিও, যদি বিভক্ত হতে অসম্মত হত তাহলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা যে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত তাতে অবশ্য কোনও সন্দেহ নেই।২৮

বাংলার যে প্রধানমন্ত্রী, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি (১৮৯২-১৯৬২), ১৯৪৬-এ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত লিগ দলীয় ব্যবস্থাপকদের সম্মেলনে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে লাহোর প্রস্তাব শুদ্ধ করে নেবার ‘সংশোধনী’ উপস্থিত করে বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষকে কিছুতেই অখণ্ড রাখা চলবে না, এবং অখণ্ড রাখবার উদ্দেশ্যে যদি কোনও সংবিধান চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে দশ কোটি মুসলমান একাট্টা হয়ে নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে প্রতিহত করবে;২৯ বছর ঘুরতে না-ঘুরতে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যখন অত্যাসন্ন তখন দেখা গেল বাংলাকে অখণ্ড রাখার পক্ষে তিনি অবস্থান নিয়েছেন, এবং আগের তুলনায় কেবল ভিন্ন নয়, সম্পূর্ণ উলটো বক্তব্য দিচ্ছেন। দশ কোটি মুসলমানের কথা না-বলে এবার তিনি ছয় কোটি বাঙালির কথা বলছেন, জানাচ্ছেন যে বাঙালিদের রয়েছে অভিন্ন মাতৃভাষা ও অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ। এও বলছেন যে, বাংলার সঙ্গে পাঞ্জাবের মিলটা অত্যন্ত সামান্য, তেমন কোনও মিল নাই বললেই চলে।৩০ বড়লাট মাউন্টব্যাটেনকে তিনি জানিয়েছেন (২৬ এপ্রিল ১৯৪৭) যে, ভারতবর্ষকে ভাগ করতে হলে বাংলাকেও যে ভাগ করতে হবে এমন কোনও যুক্তি নেই।৩১ ঠিক এই রকমের কথা জিন্নাহও বলেছেন, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে জানিয়েছেন যে, যে-যুক্তিতে জিন্নাহ ভারতবর্ষকে ভাগ করতে চাইছেন ঠিক সেই যুক্তিতেই তো বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করতে হয়।

সোহরাওয়ার্দির এই আকস্মিক পার্শ্বপরিবর্তনে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু আসলে সোহরাওয়ার্দি বদলাননি, পরিস্থিতি বদলেছিল। তিনি যখন দেশভাগ সমর্থন করছিলেন তখন তার পেছনে ব্যক্তিগত যে-বিবেচনাটি কাজ করছিল, যখন তিনি বঙ্গ দ্বিখণ্ডকরণের বিপক্ষে অবস্থান নিলেন তখনও তিনি সেই বিবেচনার দ্বারাই পরিচালিত হয়েছেন। সেটা হল প্রধানমন্ত্রী থাকা। অখণ্ড পাকিস্তানে বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে না এটা নিশ্চিত ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের যে তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এটি তিনি নিশ্চিত করতে চাইছিলেন, যে জন্য জিন্নাহর স্নেহ লাভের আশায় পূর্বোক্ত ‘সংশোধনী’টি তিনি সোৎসাহে উপস্থিত করেছিলেন। কিন্তু যখন দেখা গেল বাংলা ভাগ হয়ে যাবার আশঙ্কা তখন তিনি প্রায় নিশ্চিত হলেন যে, খণ্ডিত বাংলার প্রধানমন্ত্রী তিনি হবেন না, হবেন ঢাকার নবাব বাড়ির খাজা নাজিমুদ্দীন, এবং তখনই তিনি অখণ্ড বাংলার পক্ষে দাঁড়ালেন; এর পেছনে বাঙালিপ্রীতি যে কার্যকর ছিল সেটা ভাবা ঠিক নয়। ওদিকে কার্যোদ্ধার শেষে জিন্নাহ যে তাঁকে আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছেন না সেটাও ইতিমধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যখন দেখা গেছে যে মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটিতে ফজলুল হকের পদত্যাগজনিত শূন্যস্থানে তাঁকে না বসিয়ে বসানো হয়েছে অনুগত, ব্যবসায়ী হাসান ইস্পাহানীকে।

জিন্নাহর মতোই সোহরাওয়ার্দিও ছিলেন ধর্মবিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে উদাসীন, এবং অসাম্প্রদায়িক। জিন্নাহ যখন মাউন্টব্যাটেনকে প্রদেশওয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে বলছিলেন তখন তাঁর চিন্তাটি অবশ্যই ছিল এরকমের যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিশ্চয়ই পাকিস্তানে যোগ দেবে। মাউন্টব্যাটেন যখন জিন্নাহকে জানালেন যে, তাঁর ইচ্ছা প্রদেশওয়ারি নয়, বরঞ্চ জেলাওয়ারিভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের এবং জিন্নাহকে বললেন সে-ব্যাপারে সাহায্য করতে জিন্নাহ তখন বিশেষভাবে হতাশ হয়েছেন।৩২

জিন্নাহ ও নেহেরু উভয়েই ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা; কেন্দ্র দুর্বল হলে তাঁদের কর্তৃত্বও যে দুর্বল হবে এ বিষয়ে তাঁরা সজাগ ছিলেন। পাকিস্তানের জন্য একটি শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তুলবার আশাতেই জিন্নাহ বাংলা ও পাঞ্জাবকে অখণ্ড রাখতে চেয়েছেন। অপরদিকে বাংলা ও পাঞ্জাব যদি অখণ্ড থাকে তবে মুসলিম সংখ্যাধিক্য ও মুসলিম লিগের নেতৃত্বে-গঠিত সরকারের দরুন প্রদেশ দু-টি পাকিস্তানে যোগ দিতে চাইতে পারে এই আশঙ্কায় নেহেরু শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব ও বাংলাকে অখণ্ড রাখার বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাতকারের সময়ে কিরণশঙ্কর রায় স্বীকার করেছেন যে, বাংলাকে অখণ্ড রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে একটি নয়, দু-টি কারণে। একটি হচ্ছে মুসলমানদের একগুঁয়েমি, অন্যটি হল কংগ্রেসের চাপ। সেই সময়ে কোনও পক্ষই আন্তরিক ভাবে চায়নি যে বাংলা এক থাকুক।

মওলানা আজাদ তাঁর আত্মজীবনীতে অনেক সত্যেরই উদ্‌ঘাটন ঘটিয়েছেন। উদ্‌ঘাটিত সত্যগুলোর সবগুলোই যে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা নয়। তবে তাঁর দু-টি বক্তব্য যে সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া উচিত ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। দুটোই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কিত। একটিতে তিনি বলছেন যে, ভারতবর্ষের অবস্থাটা এমনই যে এখানে একটি কেন্দ্রীভূত ও এককেন্দ্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য এবং একইভাবে দেশটিকে দু’ভাগ করবার চেষ্টাও সফল হবার নয়।৩৩ হ্যাঁ, দেশ দু’ভাগ হয়েছে বটে, কিন্তু ক্ষতির ও ক্ষতের দিকটা বিবেচনা করলে তাতে যে সাফল্য এসেছে এমনকথা মোটেই বলা যাবে না। তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্যটি ছিল এই রকমের, “দেশের আসল সমস্যাটা সাম্প্রদায়িক নয়, অর্থনৈতিক বটে। পার্থক্যটা গোষ্ঠীগত নয়, শ্রেণিগত।”৩৪ এই মতের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করা যাবে না। সমস্যাটা যে সম্প্রদায়ের নয়, শ্রেণির, কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই তা মানতেনই না। গান্ধি তো নয়ই। মওলানা যে ভেবেছেন সেটা তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রমাণ। কিন্তু কংগ্রেসে মওলানার যতই গুরুত্ব থাক, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর স্থানটা ছিল সঙ্কীর্ণ। এটা নিশ্চয়ই তাৎপর্যহীন নয় যে, দেশভাগের সময়ে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় কমিটিতে ১৪৩ জন সদস্যের ভেতর মওলানা আজাদ ও গাফফার খান সহ মুসলমান সদস্য ছিলেন মাত্র ৬ জন।৩৫ জাতীয়তাবাদী মুসলমান বলে কথিত মওলানার ভূমিকার পক্ষে সঙ্কুচিত না হয়ে উপায় ছিল না।

সেই সঙ্গে এই কথাটাও বোধ করি যোগ করা প্রয়োজন যে, শ্রেণি সমস্যা সমাধানের আগে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরির জন্য জাতি সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন ছিল। ভারতবর্ষ যে নানা জাতির দেশ এটা এমনকি আজাদও বলেননি, তিনি বলেছেন এ হল বহু সম্প্রদায়ের আবাসভূমি। বহুজাতির দেশ হিসেবে মেনে নিয়ে ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিয়ে, তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে, এবং ইচ্ছা করলে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে প্রদেশগুলোর এই অধিকার স্বীকার করে নিয়ে যদি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গঠন করা যেত তাহলেই ভারতবর্ষের যথার্থ স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারত। এবং শ্রেণিবিভক্ত জনগণের মুক্তির পথ প্রশস্ত হত। এই কথাটা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি শেষ পর্যন্ত বলতে চেয়েছে; কিন্তু সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান এমন ছিল না যে সেই কণ্ঠস্বর সমসাময়িক নানাবিধ হুঙ্কার ধ্বনি ভেদ করে শোনা যাবে। শোনা যায়ও নি।

জিন্নাহ নাটক, নাটকীয়তা, নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া পছন্দ করতেন। নাটকীয় বীরত্বে নেহেরুরও যে অনাগ্রহ ছিল তা নয়। ওদিকে মাউন্টব্যাটেন যখন বড়লাট হয়ে আসেন তখন তাঁর বয়স ছেচল্লিশ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি গৌরব অর্জন করেছিলেন, ভারতকে ‘স্বাধীনতা’ দেবার সুযোগ পেয়ে তিনি নাটকীয় বীরত্ব অর্জনের নতুন ক্ষেত্র পেয়েছেন, এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন। তিনজনই নায়ক ছিলেন। তাঁরা নায়কের মতোই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করেছেন। দুর্ভোগ যা পোহাবার তা ঘটেছে জনগণের ভাগ্যে, যারা মুক্তি পাবে বলে আশা করেছে, এবং তার জন্য সংগ্রামেও অংশ নিয়েছে।

লক্ষ করবার বিষয় যে, ক্যাবিনেট মিশন ও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লিগের ভারতীয় নেতৃবৃন্দের যেসকল আলাপ আলোচনা এবং দরকষাকষির ঘটনা ঘটেছে তাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে দু-টি প্রদেশ — বাংলা ও পাঞ্জাব — তাদের কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। অথচ সবচেয়ে অধিক ভুক্তভোগী হয়েছে এই দুই প্রদেশের মানুষেরাই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাতচল্লিশে-প্রাপ্ত স্বাধীনতার যে মস্ত বড়ো দূরত্ব ছিল এ ঘটনা তার অনেক স্মারকচিহ্নের একটি বটে।

তথ্যসূত্র:

১. Maulana Abul Kalam Azad, ‘India Wins Freedom’, Madras, 1988, p. 248

২. H. V. Hodson, ‘The Great Divide, Britain, India, Pakistan, London’, 1969, p. 527

৩. Stanley Wolpert, ‘Jinnah of Pakistan’, New York, 1984, p. 258

৪. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘জিন্না/ পাকিস্তান’, নতুন ভাবনা, কলকাতা, ১৯৩৬, পৃ. ২১০

৫. Azad, প্রাগুক্ত, p. 248

৬. G. Allana, ‘Quaid-e-Azam: The Story of a Nation’, Lahore, তারিখ নেই, p. 515

৭. Wolpert, প্রাগুক্ত, p. 338

৮. Hodson, প্রাগুক্ত, p. 518

৯. Azad, প্রাগুক্ত, p. 248

১০. অমলেশ ত্রিপাঠী, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, (১৮৮৫-১৯৪৭)’, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ৪৬১

১১. ঐ, পৃ. ৪৯৩

১২. Wolpert, প্রাগুক্ত, p. 83

১৩. Hodson, প্রাগুক্ত, p. 81

১৪. Wali Khan, ‘Facts are Facts, The Untold Story of India’s Partition’, Dhaka, 1987, p. 19

১৫. ঐ, p. 13

১৬. M. A. H. Ispahani, ‘Quaid-e-Azam as I knew Him’, Karachi, 1967, p. 18-32

১৭. Harun-or-Rashid, ‘Inside Bengal Politics 1936-1947’, Dhaka, 2003, p. 8

১৮. আবুল মনসুর আহমদ, ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, ঢাকা,  ১৯৮৮, পৃ. ১৬৬

১৯. Harun-or-Rashid, প্রাগুক্ত, p. 161-67

২০. Shyamaprasad Mookerjee, ‘Leaves from a Diary’, New Delhi, 1993, p. 19

২১. ঐ, p. 63

২২. শংকর ঘোষ, ‘হস্তান্তর’, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১৫৮

২৩. Wolpert, প্রাগুক্ত, p. 309

২৪. Ayesha Jalal, ‘The Sole Spokesman’, Cambridge University Press, 1994, p. 239, 247

২৫. Wolpert, প্রাগুক্ত, p. 324-25

২৬. ঐ, p. 326

২৭. ঐ, p. 323

২৮. Hodson, প্রাগুক্ত, p. 245

২৯. Allana, প্রাগুক্ত, p. 349

৩০. Wolpert, প্রাগুক্ত, p. 320

৩১. Hodson, প্রাগুক্ত, p. 246

৩২. ঐ, পৃ. ২২৫

৩৩. Azad, প্রাগুক্ত, p. 172

৩৪. ঐ, পৃ. ২০০

৩৫. সুনীতি কুমার ঘোষ, ‘বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি’, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ২০৯

[সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭’ (ঢাকা, সংহতি প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ ২০১৫) গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে বর্তমান প্রবন্ধ গৃহীত।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান