অশ্রুকুমার সিকদার
রণবীর সমাদ্দার সম্পাদিত প্রবন্ধ Reflections on Partition in the East -প্রবন্ধ সংকলনে বাংলাদেশের লেখক কায়েস আহমেদের একটি প্রবন্ধের ইংরেজি তর্জমা সংকলিত হয়েছে। এই লেখক অনন্য কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটার সন্ধানে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মালপদিয়া গ্রামে গিয়েছিলেন। সেই গ্রামে দুইজন মানুষের সঙ্গে কায়েস আহমেদের পরিচয় হয়— একজনের নাম বিমল মুখার্জি, অন্যজনের নাম মোহান্ত মন্ডল। বিমল বাংলাদেশ ত্যাগের জন্য পা বাড়িয়ে আছে। সে মনে করে তার বুড়ো বাবা দেশত্যাগের পক্ষে একমাত্র বাধা। বুড়ো মরলেই সে দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবে। বিপরীত সিদ্ধান্ত নিম্নবর্গের চাষি মোহান্ত মন্ডলের। দুবার তার ঘরে ডাকাতি হয়েছে, সে বর্শায় বিদ্ধ হয়েছে, আতঙ্কে-আশঙ্কায় তার দিন কাটে, কিন্তু তবু সে দেশ ছাড়বে না। তার কোনও বিকল্প পথ নেই; এখানেই তার মাটি, এখানেই তার ঘর, এখানেই তাকে বাস করতে হবে। দুজনের বিপরীত সিদ্ধান্তের জন্য কায়েস আহমেদ তাদের শ্রেণিচরিত্রের ভিন্নতাকে দায়ী করেছেন। বিমল মুখার্জি শিক্ষিত, বর্ণহিন্দু, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সে নাগরিকতা-মনস্ক, পশ্চিমবঙ্গে তার স্বজনেরা আছে। সে জমির উপস্বত্ব ভোগ করে, সে নিজে কৃষক নয়। কিন্তু মোহান্ত মন্ডল নিজেই চাষি, জমি ছাড়া তার আর কিছু নেই। দেশ ছেড়ে যেতে না চেয়েও কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোহান্ত মন্ডলেরা, এইসব নিম্নবর্গীয় নমঃশূদ্র জেলে-চাষিরাও থাকতে পারে না নিজেদের দেশে, নিজেদের ভিটায়। ‘অভিশপ্ত অতীত’ শীর্ষক একটি লেখায় মনোরঞ্জন ব্যাপারী বলে একজন মানুষের কথা পাই। তিনি জানাচ্ছেন, “উচ্চবর্ণের লোকেরা আমাদের আদর করে চণ্ডাল, চাঁড়াল বলে ডাকত আর ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেলে চান করত।” ঠিক এমনই ছিল মুসলমানদের প্রতি হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষের ব্যবহার। “যে-মানুষ কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে আর একজন মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র বিবেচিত হয়, সে তাকে শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, এ হতে পারে না— হওয়া সম্ভব নয়।” উচ্চবর্ণের হিন্দুর দ্বারা দুই পক্ষই, মুসলমান ও নিম্নবর্গীয় হিন্দু, সামাজিকভাবে সমান অচ্ছুত বিবেচিত হয়েছিল। তাহলে ঘৃণিত এই দুই পক্ষের তো মিলিত একত্র বসবাস, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই তো প্রত্যাশিত ছিল। মোহান্ত মন্ডলদের শান্তিতে নিরুপদ্রবে পূর্বপাকিস্থানে, বাংলাদেশে থেকে যাওয়াটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুভার্গ্যবশত তা হয়নি।
বিমল মুখার্জিদের মতো মোহান্ত মন্ডলেরাও যে বঙ্গবিভাজনের পর নিজেদের মাটি ও দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেল, তার কারণ নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন কায়েস আহমেদ। ‘when a perceived “alien” community held the controls of power’, তখন শ্রেণি আর জাতপাতের বিভেদ ঘুচে গেল, সামনে চলে এল সংখ্যালঘুত্বের চেতনা, আর সেই চেতনাই মুছে দিল একজন মুখার্জি আর একজন মন্ডলের পার্থক্য। কায়েস আহমেদ এড়িয়ে গেছেন, কিন্তু এই পার্থক্য যে মুছে গেল, তার জন্য প্রধান দায়িত্ব মুসলিম লিগের প্রচারিত দ্বিজাতিতত্ত্বের। মুসলমান আর হিন্দু যদি দুই জাতি হয়, তাহলে হিন্দুর ছাতার তলায় জড়ো হতে বাধ্য হয় জাতি বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে সব হিন্দু— মুখার্জি থেকে মন্ডল পর্যন্ত। যেহেতু মুসলিম লিগ মুসলমানত্বকেই বড়ো করে তুলে ধরেছিল, সেই কারণে যারা অ-মুসলমান তারাও প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘু চেতনায় একত্রিত হয়ে যায়— ভুলে যায় বর্ণভেদ, ভুলে যায় শ্রেণিবৈষম্য। রণবীর সমাদ্দার তাঁর ‘Still They Come— Migrants in Post-Partition Bengal’ প্রবন্ধে বলেছেন, চল্লিশের দশকের শেষে হিন্দু মহাসভা নমঃশূদ্র চাষিদের ভারতে চলে আসতে প্ররোচিত করে। কিন্তু সেই প্ররোচনায় তত নয়, সামাজিক রাজনৈতিক পীড়ন ও অর্থনৈতিক বিপন্নতাই এইসব নিম্নবর্গীয় তপশিলভুক্ত মানুষের দেশত্যাগের কারণ। বঙ্গবিভাজনের পরেও পূর্ববঙ্গে/ পূর্বপাকিস্তানে/ বাংলাদেশে যে-হিন্দুরা থেকে গিয়েছিল তাদের বেশির ভাগই জেলে, চাষি, নিম্নবর্ণের নিম্নবর্গের মানুষ। রণবীর সমাদ্দারও স্বীকার করেছেন, এখনও ‘the Hindu peasantry ”there” in the villages of Bangladesh is cynically and most systematically robbed of land on communal consideration and then forced to flee.’ জমি ছাড়া আর যাদের হারানোর কিছু ছিল না, সেই জমিও যখন হাতছাড়া হয়ে গেল তখন অনন্যোপায় হয়েই মোহান্ত মন্ডলেরা দেশত্যাগ করে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কর্তৃক ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য: তথ্য ও দলিল’ সংকলন থেকে এই উৎপীড়নের বিস্তৃত বিবরণ মিলবে। এই সংকলনেই মতিউর রহমান লিখেছেন, “এটা সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক যে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার অবসান হল না।” এই হিন্দুরা যারা নির্যাতনের শিকার তারা প্রায় সবাই গ্রামে বসবাসকারী নিম্নবর্গীয় মানুষ। রাষ্ট্রীয় মদতেই যে এই দেশত্যাগ ঘটেছে তার প্রমাণ শত্রুসম্পত্তি আইন, Vested and Non-Resident Property (Repeal) Ordinance এবং ১৯৭৭ সালের ২৩ মে তারিখের সার্কুলার। সালাম আজাদের “হিন্দু সম্প্রদায় কেন বাংলাদেশ ত্যাগ করছে?” গ্রন্থে দেখা যায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন যে হিন্দুদের ওপর হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই গ্রামাঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দু।
গণপরিষদে তপশিলভুক্ত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল দেশভাগে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। বাংলা ভাগ হলে বর্ণহিন্দু অবস্থাপন্নেরা, চাকরিজীবীরা সহজেই পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে পারবে। ফলে, হিন্দুর অনুপাত কমে গেলে, বাধ্যত যে-সব তপশিলভুক্ত জাতির চাষি-জেলে-কারিগরকে পূর্ববঙ্গে থেকে যেতে হবে, তারা ‘will be at the mercy of the majority Muslim community’। উত্তরে গণপরিষদের অন্য একজন তপশিলভুক্ত জাতির প্রতিনিধি রাধানাথ দাস বলেন, মুসলিম লিগের শাসনে বা আশ্রয়ে নিম্নবর্গের হিন্দুদের যোগেন্দ্রনাথ নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। তিনি আরও মনে করেন, বরং নিম্নবর্গের হিন্দুদেরই দেশত্যাগ সহজ হবে, কারণ পূর্ববঙ্গে তাদের নিতান্ত দরিদ্র কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই তাদের হারাতে হবে না। গোড়ার দিকে কিন্তু নিম্নবর্ণের হিন্দুরা, কৃষিজীবীরা পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেনি। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত যারা পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেছিল, নীলাঞ্জনা চ্যাটার্জীর হিসাব অনুসারে তাদের শতকরা যাট জনই ছিল অ-কৃষিজীবী। কিন্তু সম্পন্নেরা, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুরা চলে যাওয়ায়, তাদের অর্থনেতিক পৃষ্ঠপোষকেরা দেশত্যাগ করায়, নমঃশূদ্র ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের গরিব হিন্দুর বলভরসা চলে যায়। শৈশবের স্মৃতিকথায় কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেন লিখেছেন, উকিলবাড়ি মাস্টারবাড়ি, ডাক্তারবাড়ি খালি হয়ে যেতে ‘যুগীপাড়ার কয়েক ঘর, ধোপা এবং নাপিতরা, কুমোররাই বা থাকবে কোন ভরসায়’, আর ‘গ্রাম যত খালি হতে লাগল, আগাছার জঙ্গল ততই এগিয়ে এসে বাড়িঘর গ্রাস করতে লাগল।’ অভিজিতের ভাই মিহির সেনগুপ্ত ঈষৎ ভিন্ন বিবরণ দিয়েছেন তাঁর ‘বিষাদ বৃক্ষ’ নামের চমৎকার স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ‘ভদ্র গৃহস্থেরা গ্রাম ছাড়লেও পিছারার খালের চৌহদ্দির অপবর্গীয়, অপবনীয়রা তখনও দেশ ছাড়ার কথা ভাবছিল না।… আমাদের ‘ভদ্দরলোকদের’ বাড়িগুলো শূন্য হলেও ওদের অঞ্চলে তার কোনোই প্রভাব তখনও দেখা যায়নি।’ কিন্তু নারীপীড়নের ঘটনা ঘটতে থাকলে ‘তারা এতকালের আশ্রয় বিষয়ে আস্থাহীন হয়ে পড়ে’ এবং ‘তারা এক অনির্দেশ্য যাত্রায় ক্রমশ উদ্যোগী হতে থাকে।’ বনেদি পরিবারগুলি চলে গিয়েছিল, এবার বাস্তত্যাগ করতে শুরু করে নিম্নবর্গের মানুষেরাও। হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করায় গরিব নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। তারাও মনে করল দেশে ‘থেকে গেলে তাদের ঘর পুড়বে, তাদের মেয়েরা ধর্ষিত হবে এবং নিজেরাও খুন হবে।’ হলও অনেক। যখন ধর্মই হয়ে উঠেছিল জাতীয়তার একমাত্র সূচক, তখন গরিব মুসলমান আর গরিব হিন্দুতে কোনও ঐক্যের মোর্চা গড়ে উঠতে পারেনি। বর্ণহিন্দুরা দেশত্যাগ করায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যেন আশ্রয়চ্যুত হল। শ্রেণিগতভাবে যাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে উঠতে পারত, ধর্মবৈষম্যের ফলে, সেই কৃষিজীবী-মৎস্যজীবী কারিগর মুসলমানের কাছেও তারা আশ্রয় পেল না। পাকিস্তান স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের অব্যবহিত পরে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়িয়েছিল পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চলে তার চমৎকার বিবরণ মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদ বৃক্ষ’ স্মৃতিকথায়। নারীপীড়নের কিছু ঘটনা ঘটতে থাকায় অপবর্ণীয় মানুষেরাও তাদের দেশ, ভূমি এবং এত-কালের আশ্রয়ের বিষয়ে আস্থাহীন হয়ে পড়ে। আগে গ্রামগুলি বনেদি পরিবারগুলিকে হারাচ্ছিল, এখন নিম্নবর্গের মানুষেরাও বাস্তত্যাগ করতে শুরু করল। মিহির সেনগুপ্ত লিখছেন, পাকিস্তান কায়েম হয়ে যাবার পর “নিম্নবর্ণীয় বা বর্গীয় হিন্দু-মুসলমানদের অভিন্ন স্বার্থের কথা ক্ষমতাসীন কায়েমি স্বার্থান্বেষী সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের মনে থাকে না। অথচ পাকিস্তান কায়েম করার সময় এই নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্গ তথা নিম্নবর্ণের মানুষদের সমর্থনের জন্য মুসলিম লিগ এক অভিন্ন স্বার্থের কথা বলেছিল। লাঙল যার, জমি তার, এরকম নারা লাগিয়েছিল। সামন্ততন্ত্রের অন্ত্যেষ্টির কথা, তেভাগার কথা, কত কিছু না বলেছিল তারা তখন। কিন্তু যখন ভদ্রলোক হিন্দুরা মাটি থেকে উচ্ছেদ হল, যখন দেখা গেল অতি অনায়াসে ছেড়ে যাওয়া সব মানুষদের জমিজমা করায়ত্ত করা যাচ্ছে, তখন লোভ তার জিহ্বার সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলল। তখন বিচারটা হল এই যে, যেনতেনপ্রকারেণ হিন্দুর বাড়িঘর জমিন জায়দাদ দখল করো। উচ্চবর্গীয়দের সম্পত্তি দখল হলে, তখন তাদের নজর পড়ে অপবর্গীয়/ বর্ণীয়দের গেরস্থালিতে।”
পাঁচের দশকের শেষেও বিভিন্ন জমায়েতে শোনা গেছে মুসলিম লিগ ও পাকিস্তানপন্থীদের বক্তব্য— নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে তাদের কোনও বিরোধ নেই, তাদের বিরোধ মাত্র উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের সঙ্গে। “কিন্তু একটা সময়ে সেই প্রতিজ্ঞা আর থাকেনি। তখন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুও হিন্দু আর নিম্নবর্ণীয় হিন্দুও হিন্দু বলেই চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রয়োজনবোধে কোথাও কোতল করাও হয়েছে।” মিহির তীব্রভাষায় লিখেছেন, “এইসব লোচ্চা লম্পট এবং লুম্পেনদের সে সময় রাষ্ট্রই ছেড়ে দিয়েছিল সংখ্যালঘুদের অবশিষ্টতম মানুষদের উচ্ছেদকল্পে’। মিহির সেনগুপ্ত প্রশ্ন করেছেন, নিম্নবর্গের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদের আগুন জ্বালালো কে, কেনই বা পরে নিম্নবর্গের হিন্দুদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হল? মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব এইসব মানুষকে অবজ্ঞা করত যদিও, তবু তাদের নিজেদের স্বার্থে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছিল। ধর্মই ছিল তাদের স্বার্থসিদ্ধির উপায়। ফলে, ধর্মবৈষম্যের কারণে হিন্দু চাষি জেলে কারিগরের সঙ্গে মুসলমান চাষি জেলে কারিগরের ঐক্য গড়ে উঠতে পারল না। অথচ উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা যেভাবে অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা ভোগ করত, ঠিক অনুরূপ অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা ভোগ করত মুসলমান সমাজের আতর বা আজলফেরা ওই সমাজের আসরদের কাছে। Understanding Bengal Muslims প্রবন্ধ সংকলনের ভূমিকায় সম্পাদক রফিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন “The masses of Muslims living in the countryside were so fragmented from within by caste-like features, and, more importantly, so widely separated from this upper class co-religionists (the so-called ashraf and the orthodox ulema, who did not even recognise the former as ‘Muslims’) that the notion of a community’ could hardly exist”, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন মিহির সেনগুপ্ত তাঁর বাল্যকৈশোরের স্মৃতিকথায়— “উচ্চবর্গীয়দের সাথে তাদের অর্থাৎ নিম্নবর্গীয় মুসলমানের একটাই সমানাধিকার ছিল, তা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের। মিলাদুন্নবির জমায়েত, জুম্মার নামাজ আদায়, ইদের দিনের কোলাকুলি এইসব ব্যাপারেই যা সমতা। নচেৎ শত ঢক্কানিনাদেও কি সারা মুসলিম জাহানে আলবেরাদরির কোনও নজির দেখা যায়?” মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে মার্চ ২০০২-তে Confronting Inequalities: Muslim OBC Communities বিষয়ে এক সেমিনার হয়। সেই সেমিনারে উপস্থিত প্রবন্ধগুচ্ছ Economic and Political Weekly-র ২০০৩-এর নভেম্বর ১৫-২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এইসব প্রবন্ধের লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-শূদ্রে যেমন তফাত, ততটাই তফাত মুসলমান সমাজের আসরফ-আজলফে। মুসলমান সমাজের মধ্যে যারা নিজেদের মনে করত বিদেশাগত মুসলমানদের উত্তরপুরুষ, তারা স্থানীয় ধর্মান্তরিত, বিশেষত নিম্নবর্গ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের খুবই নীচু নজরে দেখত। নীচু নজরে দেখত ধুনুরি, কলু, নাপিত, দর্জি, তাঁতি, এইসব কারিগর শ্রেণির মুসলমানকে। এই নিম্নবর্গীয় মুসলমানেরা হতে পারে না মসজিদের ইমাম কিংবা কাজি। কোনও-কোনও অঞ্চলে আসরদের কবরখানায়, কবর দিতে পারতেন না নিম্নশ্রেণির মুসলমানেরা তাদের মৃত পরিজনের। আসরফ-বংশীয়ের সঙ্গে এইসব নিম্নবর্গীয় মুসলমানের বৈবাহিক সম্বন্ধও বিরল ক্ষেত্রে হতে পারে। মুসলমান সমাজের উপরতলার লোকেরা এইসব নিম্নবর্গীয় মানুষকে অবজ্ঞা করত যদিও, তবু তাদের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছিল। ধর্মই ছিল তাদের স্বার্থসিদ্ধির উপায়। ফলে, ধর্মবৈষম্যের কারণে হিন্দু চাষি জেলে কারিগরের সঙ্গে মুসলমান চাষি জেলে কারিগরের ঐক্য গড়ে উঠতে পারল না।
দুই সম্প্রদায়ের নিম্নবর্গীয় মানুষের মধ্যে যাতে ঐক্য না গড়ে উঠতে পারে, তার উদ্যোগ অবশ্য শুরু হয়েছিল বঙ্গবিভাজনের অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে চল্লিশের দশকের গোড়া থেকে হিন্দুসম্প্রদায়ের নেতৃত্ব বুঝেছিল, বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে টক্কর দিতে হলে, নিজেদের সংখ্যা যতদূর সম্ভব বাড়াতে হবে। সুতরাং হিন্দু সম্প্রদায়ের ছাতার তলায় জড়ো করতে হবে নিম্নবর্গীয় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের— তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষদের, যাদের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা মন্দিরে ঢুকতে দিত না, যাদের জল-অচল মনে করত। অস্তিত্বের দায়ে হিন্দু সমাজকে সংহত ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনে, নিম্নবর্গীয় তথাকথিত হিন্দুদের এখন উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে এক মঞ্চে জায়গা দেওয়া হল। ফলে চল্লিশের দশক থেকে বহু ক্ষেত্রেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা পর্যবসিত হয়েছিল নিম্নবর্ণের হিন্দুর সঙ্গে নিম্নবর্গীয় মুসলমানের দাঙ্গায়। জয়া চ্যাটার্জী তাঁর Bengal Divided গ্রন্থে লিখেছেন, “In the early forties, when the movement to draw the low castes into Hindu politics was at its height, there were many incidents of violence involving low caste groups and Muslims”। গোয়ালাদের সঙ্গে মুসলমানদের, সাঁওতালদের সঙ্গে মুসলমানদের, নমঃশূদ্রদের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘর্ষের অনেক নিদর্শন জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে উল্লেখ করেছেন। ফলে যে-ঐক্য নিম্নবর্গীয় তপশিলি হিন্দু ও আতর/ আজলফ মুসলমানের মধ্যে হতে পারত, সেই সম্ভাবনা দেশভাগের আগে থেকেই নষ্ট হয়ে যেতে আরম্ভ করেছিল।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কিন্তু এই ঐক্যের উপর ভরসা করেছিলেন এবং মুসলিম লিগের সঙ্গে তপশিলভুক্ত নিম্নবর্গীয় হিন্দুর ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়েছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মুসলিম লিগ মনোনীত মন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি, পরে মন্ত্রী হন পাকিস্তান সরকারেরও। ১৯৫০ সালের ২৫ মে তারিখে The Hindu পত্রিকার সাংবাদিককে এক গোপন সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, গুন্ডাপ্রকৃতির লোকদের নিয়ে মুসলিম লিগ আনসার বাহিনী সংগঠিত করেছে এবং এই বাহিনী ‘perpetrated all sorts of crimes upon Hindus’। মুসলিম লিগের চোখেও যেহেতু একাকার, সেই কারণে যোগেন্দ্রনাথের চোখেও এখন আর বর্ণহিন্দু এবং তপশিলভুক্ত জাতির হিন্দুর মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকল না। উৎপীড়নের মুখে শ্রেণিগত, জাতপাতগত পার্থক্য ঘুচে গেল। পাকিস্তানের এই মন্ত্রী এই পরিস্থিতিতে নিরাশ হয়ে ভারতে অঘোষিত আশ্রয় নিলেন এবং ভারত থেকেই ১৯৫০ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন। এই পত্রে তিনি জানান, শেষ পর্যন্ত তিনি উপলব্ধি করেছেন, পূর্বপাকিস্তান সরকার সুপরিকল্পিত নীতি অনুসারে ‘squeezing Hindus out of the Province’ করে চলেছে, পাকিস্তানে হিন্দুরা কার্যত ‘stateless’ অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যোগেন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত, উচ্চবর্ণের হিন্দু হোক বা তপশিল জাতিভুক্ত হিন্দু হোক, ‘Pakistan is no place for Hindus to live’; হয় তারা ধর্মান্তরিত হবে, অথবা তাদের ‘liquidation’ হবে।
ফলে ভারতে চলে এল লক্ষ-লক্ষ তপশিলজাতিভুক্ত হিন্দু পূর্ববঙ্গ/ পূর্বপাকিস্তান থেকে— মোহান্ত মন্ডল থেকে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। এ দেশে এসে বাড়ি কেনে বা বিনিময়ে বাড়ির ব্যবস্থা হয় বা বাড়ি ভাড়া নিতে পারে এমন সংস্থান তাদের ছিল না। বেশির ভাগের এমন কোনও প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়-পরিজন এপারে ছিল না, যাদের কাছে তারা অস্থায়ীভাবেও আশ্রয় নিতে পারে। যাদবপুরে বা দক্ষিণ কলকাতার অন্য এলাকায় বা দমদমে যারা উদ্বাস্তু কলোনি প্রতিষ্ঠা করেছিল সরকারি জমিতে বা জবরদখল জমিতে, তারাও বেশিরভাগ ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দু, কোনও-না-কোনও পেশা ছিল তাদের বৃত্তি। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা প্রধানত আশ্রয় নেয় শেয়ালদা স্টেশনের প্লাটফর্মে বা ধুবুলিয়ার মতো কোনও ক্যাম্পে। তাদেরই পাঠানো হয় নৈনিতালে বা আন্দামানে বা দন্ডকারণ্যে। দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরে এলে তাদেরই মরিচঝাঁপি থেকে বলপ্রয়োগে উৎখাত করা হয়, বামজমানায়, যেহেতু তুমি আর নেই সে তুমি। এই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর, অসম্ভব পরিশ্রমী কৃষিজীবী নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের, নিম্নবর্গীয় তপশিলভুক্ত বাঙালি হিন্দু ছিন্নমূল উদ্বাস্তুর পায়ের ছাপ বাংলা সাহিত্যে কোথাও পড়ল না।
কীভাবে তারা স্বভূমির মূল থেকে উৎপাটিত উৎখাত হল, কী বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে সীমান্ত পার হয় তারা, এখানে এসে দালাল, পুলিশ, নানান শ্রেণির ধান্ধাবাজদের দ্বারা কীভাবে নাকাল হল, কীভাবে উপার্জনহীনভাবে খয়রাতি নিয়ে ক্যাম্পে দিনাতিপাত করে স্বভাববিরুদ্ধভাবে অলস হয়ে গেল, কীভাবে ছন্নছাড়া হয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে, অন্যরাজ্যের অনুগ্রহের উৎপীড়নে দিন যাপন করতে বাধ্য হল, তার কোনও ইতিহাস বাংলা সাহিত্যে লেখা হল না। বাংলা সাহিত্য গঙ্গোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, ঘোষ, বসু, মিত্র, সেন, চক্রবর্তীদের লেখা। এইসব পদবিধারী যারা উদ্বাস্ত হয়ে সীমান্ত পার হয়ে এসেছিল তাদের প্রায় কেউ স্টেশনের প্লাটফর্মে থাকেনি, ক্যাম্পে কালাতিপাত করেনি, বা দন্ডকারণ্যে-আন্দামানে গড্ডলপ্রবাহের মতো তাড়িত হয়ে প্রেরিত হয়নি। ফলে এইসব ‘অপর’ নিষিদ্ধ-পদবির মানুষের দেশভাগের চূড়ান্ত মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা ও আর্তনাদ বাংলা সাহিত্যে অনুপস্থিত। এখানে আমরা এক অখণ্ড নীরবতার সম্মুখীন হই। আমরা বাংলা সাহিত্যে নিম্নবর্গীয় মানুষদের দেখা যে পাইনি তা নয়, উচ্চবর্ণের লেখকদের লেখনীতেই আমরা পেয়েছি কুবের, নিতাই-বনোয়ারী-করালী, ঢোঁড়াইকে, পেয়েছি সুরতুন, বৈজু চণ্ডাল, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারু বর্মণকে। কিন্তু ভাঙা-দেশের ছিন্নমূল ছত্রখান নিম্নবর্গের মানুষ সম্বন্ধে বাংলা সাহিত্য বোবাই রয়ে গিয়েছে।