তানভীর মোকাম্মেল
অভিক্ষেপ: আপনার কাজে দেশভাগের প্রসঙ্গ বারে বারে এসেছে। এর কারণ কী?
তানভীর মোকাম্মেল: বিষয়টা হয়তো দু-ভাবে কাজ করেছে। কিছুটা সচেতনভাবে, কিছুটা অবচেতনায়। সচেতনভাবে কারণ আমার কাছে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৪৭-এর দেশভাগ এক ভয়াবহ ও করুণ ট্র্যাজেডি। অতীতকালেও বাংলা বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত থেকেছে― রাঢ়, বরেন্দ্র, হরিকেল, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ। কিন্তু কখনোই বাংলার দুই অংশের মাঝে এরকম কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়নি, থাকেনি সশস্ত্র প্রহরী। বাংলা সত্যি সত্যিই দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল! একজন সংবেদনশীল বাঙালি হিসেবে দেশভাগ তাই আমার কাছে এক সুগভীর বেদনার বিষয়। আমরা সংবেদনশীল শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তো বাংলাকে অবিভাজ্য এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা হিসেবে দেখি। ফলে বাংলাভাগ আরও অনেকের মতো আমাকেও গভীরভাবে পীড়িত করে। দেশভাগের বেদনাকে এবং দেশভাগের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তু মানুষদের দু:খ-বেদনাকে তুলে ধরার একটা তাগিদ আমি অন্তর থেকেই অনুভব করি।
আর অবচেতনে যেটা হয়তো কাজ করে যে আমি খুলনা শহরে বড়ো হয়েছি। খুলনা সে সময় হিন্দুপ্রধান একটা জায়গা ছিল। আমার পাড়ার বল খেলার সাথীরা বা স্কুলের বেঞ্চে পাশে বসা সহপাঠীরা অনেকেই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে। ষাটের দশকে, বিশেষ করে ১৯৬৪-এর দাঙ্গার পরে, খুলনার হিন্দু পরিবারগুলো ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে শুরু করে। যে আবহটা আপনি কিছুটা হয়তো পাবেন আমার “ক্ষমা করিস অবিনাশ” নামের কবিতাটায়। এমন হয়েছে যে কোনও এক বিকেলে সুব্রত বা অরুণ এসে বিষণ্ণ কন্ঠে বলত; “আমরা কাল চলে যাচ্ছি।” “কোথায় যাচ্ছিস?” আমার এ প্রশ্নের জবাবে বলত; “কলকাতা”। তখন আমি এত ছোটো ছিলাম যে ‘কলকাতা’ যাওয়ার অর্থ তেমন বুঝতাম না। আমার কাছে ‘কলকাতা’-কে মনে হত যেন এক অন্ধ গহ্বর যেখানে আমার বাল্যবন্ধুরা একে একে হারিয়ে গেছে! এদের অনেকের সঙ্গে আমার সারা জীবনে আর দেখা হয়নি। আমার ‘চিত্রা নদীর পারে’ ছবির শেষ শটটা মনে করুন। মিনতি ও পিসিমাকে নিয়ে বাসটা যশোর রোড ধরে অন্ধকার এক গহ্বরের মতো বিশাল সব শিরীষ গাছের মধ্য দিয়ে বেনাপোলের দিকে ভারতে চলে যাচ্ছে। পেছনে সাউন্ডট্রাকে মিনতিদের ছেলেবেলার ছড়াটা শোনা যাচ্ছে; “কলকাতা.. কলকাতা”।
আসলে শিল্পের অনেক কিছুই তো অবচেতনে ঘটে। একজন শিল্পীর নিজের পক্ষে সবটা ব্যাখ্যা করাও কঠিন। তবে আমার মনে হয় দেশভাগ আমার সচেতন মননে ও অবচেতন আবেগে দু-ভাবেই কাজ করেছে এবং এখনও করে।
অভিক্ষেপ: দেশভাগ নিয়ে এপারের তুলনায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে খুব বেশি কাজ না হওয়ার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
তানভীর মোকাম্মেল: একটা কারণ হতে পারে যে বেদনার কথাটা তো সেই-ই বেশি বলে যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তারা শুধু স্বদেশই হারায়নি, ঘর-বাড়ি-জমি-সম্পত্তি সব কিছুই হারিয়েছিল। ফলে তাদের ব্যথা ও বেদনার ব্যাপ্তিটাও ছিল খুব সুগভীর ও মর্মস্পর্শী। পক্ষান্তরে দেশভাগের ফলে বাঙালি মুসলমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে ততটা ব্যাপকভাবে হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের পরিত্যক্ত জমি-বাড়ি এসব দখল করে কেউ কেউ লাভবানও হয়েছে। ফলে এই স্পর্শকাতর বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় তারা ততটা আগ্রহী নয়।
আর-একটা বিষয় হচ্ছে সব শ্রেণি তো আর নিজেকে স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করতে পারে না। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া হিন্দুদের মধ্যে এক ব্যাপক অংশ ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকও ছিলেন। তারা বই লিখে বা নানা মাধ্যমে তাদের বেদনাকে প্রকাশ করতে পেরেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে যেসব মুসলমানেরা এসেছেন তারা অধিকাংশই ছিলেন কৃষক বা তেমন শিক্ষিত নন। ফলে তাদের বেদনাগুলোকে তারা তেমনভাবে প্রকাশ করতে পারেননি।
আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে আর-একটা যে বিষয় হয়তো কাজ করেছে তা হচ্ছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। নিকট অতীতের ১৯৭১-এর কিছুটা সময়কাল দূরের ১৯৪৭-এর সেসব দু:খজনক ঘটনাগুলো হয়তো সে কারণে তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দেশভাগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতে কাজ কম হওয়ার এটাও হয়তো একটা কারণ।
অভিক্ষেপ: ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ আর ‘সুবর্ণরেখা’, যাকে এক কথায় পার্টিশন ট্রিলজি বলা হয়, এই সৃষ্টিকে কীভাবে দেখেন? এখানে কি দেশভাগ নিয়ে ব্যক্তির নস্টালজিয়া অথবা শিল্পীর দায় মুখ্য; শিল্পের নান্দনিকতার সঙ্গে তার কী বিরোধ আছে? এর ফলে ঋত্বিক কী সীমায়িত হয়ে পড়লেন?
তানভীর মোকাম্মেল: আমি তা মনে করি না। বরং একজন শিল্পী হিসেবে ঋত্বিক ঘটকের মহত্ত্ব এখানেই যে উনি ওঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ও নস্টালজিয়াকে একটা গোটা সম্প্রদায়ের বেদনা ও দু:খবোধের প্রতীক করে তুলতে পেরেছেন। শুধু তাই-ই নয়, পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষদের ঘটনাকে তিনি একটা বিশ্বজনীন রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। মনে আছে ‘সুবর্ণরেখা’-র চরিত্রটা বলেছিল, “উদ্বাস্তু! কে নয়?” নিজের বেদনাকে বিশ্বজনীন করতে পারা শিল্পের অন্যতম বড়ো সার্থকতা। আসলে এই মহাজাগতিক বিশ্বে আমরা সবাই-ই তো কোনো না কোনোভাবে উদ্বাস্তুই! আমি মনে করি শিল্পকর্ম হিসেবে ঋত্বিক ঘটকের পার্টিশন ট্রিলজি অবিস্মরণীয় এক সৃষ্টি।
অভিক্ষেপ: এবার সাবির্কভাবে বিভাজনের ওপর কয়েকটা প্রশ্ন রাখতে চাই। আপনি নিজেই এই প্রশ্নটা ‘সীমান্তরেখা’-য় রেখেছেন। সেটা দিয়েই শুরু করব। বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান — দুই সম্প্রদায় কেনই বা বিভাজনের আগে নিজেদের দুই জাতি বলে মেনে নিল? এখানে সম্প্রদায় কীভাবে জাতি হয়ে উঠল?
তানভীর মোকাম্মেল: সম্প্রদায় (Community) ও জাতি (Nation) কখনোই এক নয়। এ দু-টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই প্রত্যয়। সম্প্রদায় গড়ে ওঠে ধর্মের ভিত্তিতে। যেমন হিন্দু সম্প্রদায়, মুসলমান সম্প্রদায়, খ্রিস্টান সম্প্রদায়। আর জাতি গঠিত হয় নৃতাত্ত্বিকভাবে। সমভাষা, সমভূগোল, সমইতিহাসের এক-একটি ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তা— যেমন বাঙালি, পাঞ্জাবি, ইংরেজ, জার্মান। বিষয়টা বোঝা তেমন কঠিন কিছু নয়। কিন্তু মুহম্মদ আলি জিন্নাহ, কিছুটা সমাজবিজ্ঞানে অজ্ঞতা, কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কারণে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়কে মুসলমান ‘জাতি’ হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। এর আগে সাভারকরও ভারতে হিন্দু ‘সম্প্রদায়’-কে হিন্দু ‘জাতি’ বলতে চেয়েছেন। এগুলো এসব নেতাদের অশিক্ষা ও পুরোপুরি রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। পেছনে অবশ্য ছিল ধুরন্ধর ইংরেজদের “ভাগ করো ও শাসন করো’-র বিভাজন কৌশল। জিন্নাহ যে এ ব্যাপারে কতটা বিভ্রান্ত ছিলেন তা বোঝা যায় এ থেকে যে তিনি ভারতের ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ দু-টো সম্প্রদায়কে পৃথক দু-টো ‘জাতি’ বলছেন, আবার সেই তিনিই এক জায়গায় বলছেন, ‘বাঙালি জাতি’ ! অথচ বাঙালি জাতির মধ্যে তো ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ দুই সম্প্রদায়ই রয়েছে! আসলে কেউ দক্ষ ব্যারিস্টার হলেই যে ভালো সমাজবিজ্ঞানী হবেন, তা তো নয়। তার সঙ্গে যদি মিশে থাকে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সুবিধাবাদের ভিয়েন।
তবে এ ব্যাপারে বাংলা ভাষারও একটা সমস্যা রয়েছে। ইংরেজি ‘নেশন’ (Nation) শব্দটার বাংলা করা হয়েছে ‘জাতি’। এ পর্যন্ত হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু বাঙালিরা বিভিন্ন সম্প্রদায়কে (হিন্দু, মুসলমান), বর্ণকে (ব্রাহ্মণ, নমঃশূদ্র), এসব প্রত্যয়কেও ‘জাতি’ বলে। এর ফলে ‘জাতি’ শব্দটা নিয়ে নানা ভুল বোঝাবুঝি ঘটেছে। এখনও ঘটছে। একটা উদাহরণ দিই। বাংলাদেশের অনেক মানুষ মনে করে তারা ‘বাংলাদেশি’ জাতি। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে! তার আগে কি তারা ‘বাংলাদেশি’ জাতি ছিলেন? আসলে হাজার বছর ধরেই তারা বাঙালি জাতি। তাদের নাগরিক পরিচয় এখন “বাংলাদেশি”। কিন্তু “নাগরিকত্ব” ও “জাতিসত্তা” তো এক বিষয় নয়। বিষয়টা বাংলাদেশে অনেকে বোঝে না। বা ইচ্ছাকৃতভাবেই বুঝতে চায় না। চালাক-চতুর নেতাদের তাই সাধারণ জনগণকে এসব ‘হাঁসজারু’-তে বিশ্বাস করাতে পারা কঠিন হয়নি। আসলে ‘সম্প্রদায়’ ও ‘জাতি’-র শব্দগত এই পার্থক্য বোঝার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির ফলে ভারতবর্ষে কত বড়ো বড়ো সব ট্রাজিক ঘটনাই না ঘটে গেল! আমার আশঙ্কা, ভবিষ্যতেও আরও ঘটবে।
অভিক্ষেপ: দ্বি-জাতি তত্ত্বের স্বীকৃতির পেছনে কি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ চেতনা’ অর্থাৎ বাংলায় কর্তৃত্বকারী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের নিজ নিজ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে থাকার সুবিধা পাবার তাড়নাই মুখ্য ছিল?
তানভীর মোকাম্মেল: মধ্যবিত্তের একটা বড়ো ভূমিকা তো অবশ্যই ছিল। জায়মান মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজেদের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিল। তারা মনে করত মাথার উপরে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা শিক্ষিত হিন্দুরা থাকলে তাদের বিকাশ তেমনভাবে ঘটবে না। তাই তারা পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করেছিল। আর অন্য দিকে প্রথম জমানায় ব্রিটিশদের আনুকূল্য ও পরে ইংরেজি শিক্ষালাভের ফলে হিন্দু মধ্যবিত্তরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেগুলো ছাড়তে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুসলমানদের কোনও রকম আধিপত্য, এমনকি ক্ষমতায়নের সমতাও, তাদের জন্যে অস্বস্তিকর ছিল। মনে করে দেখুন, বাংলায় হিন্দু-মুসলমান বিরোধের এক বড়ো সূত্রপাত ছিল কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি, যা একেবারেই ছিল দুই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের ব্যাপার।
তবে বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা দ্বন্দ্বের এত এত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক রয়েছে যে কেবল একটি বা দু-টি বিষয় দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায় না। তা সঠিকও হবে না। মধ্যবিত্ত ছাড়া উভয় শ্রেণির ধনিক শ্রেণিও দেশভাগের ব্যাপারে খুবই সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে উভয় সম্প্রদায়ের বড়ো ব্যবসায়ীরা। হিন্দু বিড়লারা আর মুসলমান ইস্পাহানীরা নিজেদের পাতে ঝোল টানতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং সে উদ্দেশ্যে বিড়লারা কংগ্রেসকে আর ইস্পাহানীরা মুসলিম লিগকে অঢেল অর্থই শুধু দিত না, স্ব স্ব সম্প্রদায়ের নেতাদের পুষতও। আর সবার উপরে ছিল ব্রিটিশদের নানা প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা। আসলে দেশভাগ এমন একটা জিনিস, যেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ওই লাইনগুলো খুবই প্রযোজ্য, “পথ ভাবে আমি দেব/ রথ ভাবে আমি/ মূর্তি ভাবে আমি দেব/ হাসে অন্তর্যামী।” তো সেই ‘অন্তর্যামী’ হিসেবে ব্রিটেনের ইন্ডিয়া অফিস বা লন্ডনের বিদেশ মন্ত্রণালয় থেকে দেশভাগের অনেক কিছুই ঠিক হয়েছে। এমনকি, নতুন পরাশক্তি হয়ে ওঠা আমেরিকানদেরও এ ব্যাপারে কিছু ভূমিকা ছিল। তারা চাইছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিমে একটা মুসলিম রাষ্ট্র হোক। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানোর জন্যে একটা রক্ষণশীল ইসলামি বাফার স্টেট। পাকিস্তান সৃষ্টির সেটাও একটা কারণ। আমাদের নেতারা অনেক সময়ই বুঝে না-বুঝেই লাফিয়েছে। আজ দেশভাগের ব্যাপারে গবেষণা যত ব্যাপক ও গভীর হচ্ছে, ততই আমরা ইঙ্গ-মার্কিন ভূমিকায় বিষয়গুলো বুঝতে পারছি।
অভিক্ষেপ: শ্রমজীবী মানুষেরা ও কৃষকেরা মধ্যবিত্তের রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হল কেন? ধর্ম নির্বিশেষে কৃষক আন্দোলনের তো একটা পরম্পরা ছিল?
তানভীর মোকাম্মেল: কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন শ্রমিকদের কিছু সংগঠনে, যেমন পাটকল, চটকল বা রেলওয়ের ট্রেড ইউনিয়নে উভয় সম্প্রদায়ের শ্রমিকেরা সুসংগঠিত ছিল এবং অনেক দিনই তারা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থাকতে পেরেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দলগুলোর ক্রমাগত প্রচার ও বিশেষ করে ১৯৪৬-এ কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গার ফলে, শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ যার যার হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক লাইনে বিভক্ত হয়ে পড়া শুরু করল। কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একই কথা। পূর্ববঙ্গের অনেক জেলাতেই, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত কৃষক সংগঠনটি শক্তিশালী তেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল। তবে তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল মূলত হিন্দু ক্ষত্রিয় কৃষকেরা এবং হাজং, রাজবংশী এসব জনজাতিসমূহ। মুসলমান কৃষকেরা এ আন্দোলনে তেমন বড়ো সংখ্যায় যোগ দেয়নি। আর যারা যোগ দিয়েছিল মুসলিম লিগ নেতারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদের মধ্যে প্রচার করত “তেভাগা কি মিয়ারা?.. পাকিস্তানটা হউক। তোমরা চারভাগা করে জমির ফসল পাবা!” তাছাড়া দেশভাগের আগের দিনগুলোতে সব ব্যাপারেই সর্বগ্রাসী ও বিষাক্ত এক সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার তো ছিলই। ফলে মুসলমান কৃষকেরাও আস্তে আস্তে অসাম্প্রদায়িক তেভাগা আন্দোলন থেকে সরে আসে এবং সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান দাবির সপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়।
অভিক্ষেপ: ১৯৪৭-এর দেশভাগের প্রতি দুই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের একটা অংশের যে প্রচ্ছন্ন এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সমর্থন তার সূচনা কী ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে? কারণ, বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তো সংখ্যাগরিষ্ঠ চেতনা গড়ে তোলার একটা বড়ো পরিসর দিয়েছিল। আপনার কী মত?
তানভীর মোকাম্মেল: ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকে হিন্দু-মুসলমান দুই মধ্যবিত্তের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯০৬ সালে একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে ঢাকায় মুসলিম লিগ জন্ম নেবার পর থেকে। তবে মূল বিভাজনটা ঘটেছে আরও আগেই। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ শাসক ইংরেজদের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তারা বুঝতে পারছিল ভারতবর্ষ শাসন করতে চাইলে তাদেরকে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যকে ভাঙতেই হবে। যেহেতু মুসলমানদের হাত থেকে তারা ক্ষমতা নিয়েছিল বা মুসলমানেরা ছিল বেশি উগ্র, তাই ইংরেজরা হিন্দুদের মন জয় করার চেষ্টায় মন দেয়। স্কুল-কলেজ-প্রতিষ্ঠা করা হতে থাকে। হিন্দুদের মধ্যেও ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করার প্রচুর মানুষ জুটে গেল। বিশেষ করে কলকাতায়। তারা ইংরেজি শিখে নানা সুবিধা পেতে শুরু করল। মুসলমানেরা কিছুটা রাজ্য হারানোর দুঃখে ও কিছুটা অভিমানে ইংরেজি শিক্ষা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখল। ফলে সব কিছু থেকেই তারা পিছিয়ে পড়ল। হিন্দু-মুসলমানদের এই অসম বিকাশকেই লেজে খেলাল চতুর ইংরেজ এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হল। ফলে ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ তাৎক্ষণিক কারণ হলেও দুই সম্প্রদায়ের মাঝে বিরোধ, অবিশ্বাস এবং মুসলমানদের সঙ্গে সমঅধিকারে থাকার ব্যাপারে হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের যে অনীহা, তার শুরুটা আরও আগে থেকেই।
অভিক্ষেপ: দেশভাগের যন্ত্রণার নানান আঙ্গিক আপনার ‘সীমান্তরেখা’ প্রামাণ্যচিত্রে নানান অংশে নিদারুণভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু বাঙালির আরও বেশি ধর্মীয় পরিচয়কেন্দ্রিক হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ কী বাদ পড়েনি? আপামর ‘বাঙালি’ ধারণার পরিবর্তে বাঙালি হিন্দু-বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়কেন্দ্রিকতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
তানভীর মোকাম্মেল: ‘বাঙালি’ বিশেষণটা যুগে যুগেই বিবর্তিত হয়েছে। এক সময় কেবল হিন্দুদের ‘বাঙালি’ বলে মনে করা হত। মনে আছে নিশ্চয়ই শরৎচন্দ্রের লেখায় ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’-দের ফুটবল খেলার কথা! সেই ‘জাতি’ ও ‘সম্প্রদায়’-কে গুলিয়ে ফেলা! এখনও পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙালি হিন্দু মনে করেন যে কেবল হিন্দুরাই ‘বাঙালি’, মুসলমানেরা নয়!
অতি সম্প্রতি, বিশেষ করে বিজেপি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর হিন্দুকেন্দ্রিকতা যেভাবে বেড়েছে তার কারণ অনেকটাই বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী প্রচার-প্রচারণা। এটা গত এক যুগের ঘটনা। ‘সীমান্তরেখা’ ছবিটা তৈরি হয় ২০১৭ সালে। তখনও এ বিষয়টা এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। তবে বাংলাদেশে মুসলমানকেন্দ্রিকতা আরও আগেই শুরু হয়েছিল। গত শতকের সেই তিরিশ-চল্লিশ দশক থেকেই মুসলিম লিগের নানা তৎপরতার মধ্য দিয়ে। তবে আপনার কথায় যুক্তি আছে। এ বিষয়টা ‘সীমান্তরেখা’ ছবিতে আরও বেশি আসতে পারত। তবে আমার ছবিটার বিষয়বস্তু মূলত ছিল ১৯৪৭-এর দেশভাগ। ভারত-বাংলাদেশে দুই সম্প্রদায়ের বর্তমান ধর্মীয় অবস্থাটা ততটা নয়।
আসলে আমার কাছে হিন্দু-মুসলমান এ দুই সম্প্রদায়েরই ধর্ম নিয়ে এই বাড়াবাড়ি, এত তিক্ততা, খুবই বিরক্তিকর এক বিষয়। হয়তো একজন সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে আমাকে এসব মোটেই আকর্ষণ করে না। কে হায়! হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
অভিক্ষেপ: বাহান্ন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বাঙালি ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার (বাঙালির ঘরে ফেরার) এক বড়ো সুযোগ এনে দিয়েছিল। বাংলাদেশ কী সেই সুযোগ নিতে পেরেছে বলে মনে করেন?
তানভীর মোকাম্মেল: কিছুটা তো পেরেইছিল। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এক আন্দোলন। অত আন্দোলনের মতো এমন একটা ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারাটা ছিল খুবই ইতিবাচক এক ঘটনা। পুরো পঞ্চাশ ও ষাট দশকে এই অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলন পূর্ববঙ্গে শক্তিশালী থেকেছে যার ফলশ্রুতিতে ঘটল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যা ছিল পুরোপুরিই এক অসাম্প্রদায়িক যুদ্ধ। সে সময়কার জনপ্রিয় গান ছিল “বাঙলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালি”। ১৯৭১-এ যথার্থই ছিল বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ ফেরা। আরব-ইরানের মরুভূমির বদলে বাংলার জল-কাদার জন্মভূমিকেই স্বদেশ হিসেবে তাদের চিনতে পারা। কিন্তু ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশে এক উলটপুরাণ শুরু হল। তার ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ পালটে যেতে শুরু করে। আর এখন তো তা অনেকটাই পালটে গেছে। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্তু সমাজ অতটা সাম্প্রদায়িক ছিল না। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্র কিছুটা অসাম্প্রদায়িক হলেও বাংলাদেশের সমাজ আবার হয়ে পড়েছে ঘোর সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ। হ্যাঁ, অসাম্প্রদায়িক হবার একটা বড়ো সুযোগ বাংলাদেশের মুসলমানেরা ১৯৭১-এ পেয়েছিল। এবং কিছুটা হলেও হতে পেরেওছিল।
অভিক্ষেপ: যদি পেয়ে থাকে, তাহলে ব্লগারদের ওপর এত আক্রমণ কেন? কেনই বা সংখ্যালঘু-হিন্দুদের উৎসবে বাধা দেবার ঘটনা?
তানভীর মোকাম্মেল: আগেই বলেছি, ১৯৭৫-এ অর্জন ও মূল্যবোধসমূহ, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ, ভুলুণ্ঠিত হতে শুরু করে। বুঝতে হবে মাত্র কয়েক দশক আগে দেশটা পাকিস্তান নামের এক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে রাষ্ট্রের ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা ভালোভাবেই জাঁকিয়ে বসে ছিল। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন তো অত দ্রুত হয় না। তারপর পরপর দুই দক্ষিণপন্থী সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের আমলে সে উলটোযাত্রা আরও পূর্ণতা পায়। পাকিস্তানি ঘরানার মতোই বাংলাদেশ ক্রমেই আবার ‘মুসলমানদের দেশ’ (!) হয়ে উঠতে থাকে। দেখুন, রাষ্ট্র আর সমাজ এক নয়। বর্তমানে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্র কিছুটা অসাম্প্রদায়িক হয়েছে, কিন্তু সমাজে ধর্মচর্চা অনেক বেড়েছে ও মানুষ দিন কে দিন যেন আরও ধর্মান্ধ হয়ে পড়ছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লব, আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন, ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ, এসবের কারণে মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্ব জুড়ে যে ‘ইসলামি ঢেউ’ জেগেছিল, বাংলাদেশ তো তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশে ছোটোবড়ো অসংখ্য ইসলামি জঙ্গি গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতায় থাকার জন্যে শাসক দল আওয়ামি লিগ-ও এসব ইসলামি অশুভ শক্তিগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নানা আপোষ করেছে। ফলে ব্লগার হত্যা বা সংখ্যালঘু হিন্দুদের উৎসবে হামলা এগুলো আর দূর হচ্ছে না। বাংলাদেশের সমাজে বড়ো রকম কোনও রেনেসাঁ না ঘটলে, এই অন্ধকার সহজে কাটবে বলেও মনে হয় না।
অভিক্ষেপ: এক্ষেত্রে কী ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাড়-বাড়ন্তের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখেন?
তানভীর মোকাম্মেল: সেটাও অন্যতম এক কারণ। নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা মনে আছে তো? প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। যেমন ভারতে বাবরি সমজিদ ভাঙ্গার পরপরই গোটা বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দুদের ছোটোবড়ো মন্দিরগুলো আক্রান্ত হতে থাকে। আসলে এই উপমহাদেশের দেশগুলো এমনভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যে এক দেশের বড়ো রাজনৈতিক ঘটনাবলি আর-এক দেশকে প্রভাবিত করবেই। ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাড়-বাড়ন্ত বাংলাদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে বাড়াতে অনেকটাই সাহায্য করছে।
অভিক্ষেপ: বাঙালির মননে প্রোথিত হিংসাকে দূর করার উপায় কী?
তানভীর মোকাম্মেল: আপনি যদি দুই সম্প্রদায়ের মাঝে হিংসাকে দূর করার কথা বলেন তো বলব দুই সম্প্রদায়ের মাঝে অসম বিকাশকে আগে দূর করতে হবে। উভয় সম্প্রদায়ের জন্যে সমশিক্ষা ও সমসুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমি মনে করি যে সব রকম ঘৃণারই উৎস হচ্ছে অপরকে না জানা। আপনি যখন কাউকে চেনেন, জানেন, তখন তার সঙ্গে ভিন্নমত ঘটলেও আপনি তাকে ঠিক ঘৃণা করতে পারেন না। কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গিটা আপনি বুঝতে পারেন। কিন্তু দুঃখজনক যে হিন্দু ও মুসলমান এই সম্প্রদায় শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করলেও পরস্পর সম্পর্কে জানে খুব কম। আর অজানার এই অন্ধকার দিয়েই ঢোকে মনসার সাপ। জন্ম দেয় ঘৃণা ও হিংসার। আমি মনে করি দুই সম্প্রদায়ের আরও সামাজিক মেলামেশা, বন্ধুত্ব, প্রেম, এসব আরও বাড়লে দুই সম্প্রদায়ের মাঝে সামাজিক বিভেদ ও বিদ্বেষ হয়তো কিছুটা কমবে। আন্তঃবিবাহ এক্ষেত্রে একটা সমাধান হতে পারে।
অভিক্ষেপ: দাঙ্গার কলঙ্কিত ইতিহাসকে ধামাচাপা না দিয়ে তার নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস প্রকাশ্যে নিয়ে আসা উচিত বলে কী আপনি মনে করেন? জার্মানি তো তাদের পূর্বপুরুষের পাপকে আর লুকোয় না, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প খুলে দিয়েছে সবার জন্যে।
তানভীর মোকাম্মেল: অবশ্যই। কোনও সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখলে সে সমস্যার সমাধান তো কোনও কালেই হবে না। দাঙ্গা বাঙালির ইতিহাসে ও জীবনে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। আজ সময় এসেছে এ ব্যাপারে কোনও এক পক্ষকে দায়ী না করে দাঙ্গাগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো নিয়ে মননশীল আলোচনা করা। নৃশংস সব ভায়োলেন্সের কথাগুলোও বলা, যেন ভবিষ্যতে সেসবের আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমি মনে করি সময় এসেছে উভয় বাংলায় ঘটিত দাঙ্গাগুলো নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দায়িত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল আলোচনা করা।
অভিক্ষেপ: আপনি ‘সীমান্তরেখা’-তে যে কাজ করেছেন অর্থাৎ মৌখিক ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে রাখা। এ বিষয়ে দু-দেশে আরও কাজ হওয়া কী দরকার নেই?
তানভীর মোকাম্মেল: অবশ্যই আছে। মৌখিক ইতিহাস (Oral History) আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীর দেশে দেশে মৌখিক ইতিহাসকে চর্চা ও সযত্নে রক্ষা করা হয়। কোনও জনগোষ্ঠীর জীবনের অনেক ঘটনাই আমরা মৌখিক ইতিহাস থেকে জানতে পারি। চেক ঔপন্যাসিক মিলন কুন্দেরার একটা কথা আছে, “Struggle of people against power is struggle of memory against forgetting”, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। শাসকশ্রেণিগুলো জনগণের অতীত স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চায়, কারণ তাতে শাসন-শোষণের সুবিধা হয়। কিন্তু জনগণ তাদের স্মৃতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। সেসব স্মৃতি থেকে শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা লড়াই করার শক্তি তারা পেয়ে থাকে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার মেগা-প্রামাণ্যচিত্র ‘১৯৭১’ ও ১৯৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’ দু-টি ছবিতেই আমি সচেতনভাবেই এই ওরাল হিস্ট্রি বা মৌখিক ইতিহাসের উপর জোর দিয়েছি। ভবিষ্যতেও এ নিয়ে আমি আরও কাজ করব। আমি মনে করি দুই দেশেই এ নিয়ে আরও কাজ হওয়ার দরকার রয়েছে।
অভিক্ষেপ: ‘সীমান্তরেখা’ শিথিল করে দুই বাংলার মধ্যে যোগাযোগ আরও সচল করা প্রয়োজন বলে কী মনে করেন?
তানভীর মোকাম্মেল: অবশ্যই। যেহেতু দু-টি ভিন্ন রাষ্ট্র, ফলে পাসপোর্ট-ভিসার ব্যাপারটা হয়তো পুরো বাদ দেওয়া যাবে না। তবে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ আরও সহজ ও স্বল্পব্যয়ের হওয়া উচিত। দুই দেশের মধ্যে বিমান ছাড়াও আরও ট্রেন, বাস ও অন্যান্য যানবাহন বাড়ানো উচিত। যেহেতু আমাদের অনেক অভিন্ন নদী রয়েছে, ফলে যাতায়াতের জন্যে জলপথকেও ব্যবহারের কথা ভাবা যায়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে কেবল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নয়। সেটা তো থাকতেই হবে। প্রয়োজন “পিপল টু পিপল”, দু-দেশের জনগণের পরস্পরের মধ্যে, আরও বেশি আন্তঃসংযোগ, যাতায়াত, বন্ধুত্ব। দু-দেশের মানুষের মধ্যে এই যোগাযোগটা উভয় বাংলার বাঙালিদের মানবিক বিকাশের জন্যেই খুব প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ।
অভিক্ষেপ: দেশভাগের কী কোনও অর্জন রয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
তানভীর মোকাম্মেল: দেখুন, দেশ আর রাষ্ট্র এক নয়। রাষ্ট্র জন্ম নেয়, রাষ্ট্র পরিবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের মৃত্যুও ঘটে। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম-মৃত্যু আমরা দেখেছি। তিন পতাকার নীচে বাস করেছে এমন মানুষ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে― ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক তারা। ফলে রাষ্ট্র চিরন্তন কিছু নয়। কিন্তু দেশ চিরন্তন। দেশ মানে আমি যে গ্রাম বা ছোটো শহরে জন্মেছি, আমার গ্রামের পাশের নদীটা, আমার ইস্কুল, আমার পাড়া-প্রতিবেশী, গাছপালা, এসব নিয়েই আমার স্বদেশ― জন্মভূমি। নিজের জন্মভূমি বা মাতৃভূমিতে বাস করার অধিকার প্রত্যেক মানুষের এক মৌলিক মানবাধিকার। কোনও রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক সংগঠনের এই ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল না বলতে পারা যে তোমার দেশ এখানে নয়, তোমার দেশ ওইখানে! ১৯৪৭ সালে ওই অমানবিক কাজটাই করা হয়েছিল। যা লক্ষ লক্ষ পরিবারের জন্যে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, দেশভাগের মতো এক সুগভীর বেদনা ও ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষের জীবনকে এই দেশভাগ এতটাই বিপর্যস্ত করেছে যে দেশভাগের দু-একটা ইতিবাচক দিক থাকলেও তা অর্থহীন হয়ে পড়ে। আসলে দেশভাগের তেমন কোনও অর্জন নেই। এর প্রায় সবটাই নেতি। যদি বলতেই হয়, তবে একটা সুফলের কথা হয়তো বলা যায়। তা হচ্ছে পাকিস্তান, ও পরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার ফলে, পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকেরা, যারা চিরকালই ছিল বঞ্চিত, তাদের সন্তানেরা আজ মধ্যবিত্ত হতে পেরেছে, আর যারা বেশি উদ্যোগী তারা অনেকে বেশ ধনী হতে পারছে। দেশভাগ না হলে তারা এটা হতে পারত না। কিন্তু কীসের বিনিময়ে? পূর্ববঙ্গের দেশত্যাগী লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তুদের দু-তিনটি প্রজন্ম তো চিরতরেই হারিয়ে গেল দারিদ্র্য আর বঞ্চনার অন্ধকারে। তাছাড়া এ কেমন বিকাশ যে চিরচেনা প্রতিবেশীকে তাড়িয়ে নিজের বিকাশ ঘটাতে হবে! এ বিষয়টার মধ্যে এমন একটা অপরাধের গ্লানি রয়েছে যা সব অর্জনকেই ম্লান ও কলুষিত করে দেয়।