আয়েশা খাতুন
হতভাগ্য দেশের ভাগ আর মেটে না। ভারতবর্ষ একটা গোটা দেশের নাম। এই গোটা দেশগঠনের কথা বললেও উঠে আসে রক্তেগাঁথা সীমান্তের ইতিহাস। রাজায় রাজায় লড়াই হয়েছে, তাতে গরিবের ঘরের সন্তানেরাই সেই লড়াইয়ে মুণ্ডু দিয়েছে এবং মুণ্ডু কেটেছে। ঘুমোতে পারেনি, রাতে স্বপ্ন দেখেনি শীতলরাতের গভীর আঁধারে চাঁদ ওঠার। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে রক্তের লড়ায়েই নিজেরা করেছে রাজ্য-সীমানা নির্ধারণ। ডেকে আনার আগে যারা রাজা ছিল, তারা তো স্বজাতির ভাই-ই ছিল। সেই সব রাজারা বুঝি চুমু খেয়ে রাজ্য জয় করেছিল? তারা বুঝি পরাজিত রাজার বৌকে সসম্মানে সাতমহলা বাড়ি বানিয়ে প্রহরী রেখে সেই স্বামীর গুণ গেয়ে কান্নার স্বাধীনতা দিয়েছিল? তার বীর স্বামীকে যে রাজা হত্যা করেছে সেই কথার বিনুনি দিয়ে কাঁদতে দিয়েছিল? না, দেয়নি। একজন একা নারীকে হাতে পেয়ে বেশিরভাগ পুরুষ যেভাবে ছিঁড়ে খায় সেভাবেই খেয়েছে। বাবর থেকে আরঙ্গজেব রাজ্য জয় করেছে, তা-ও রক্ত দিয়েই। ইংরেজ তার রাজ্য দখল করেছে রক্ত ছড়িয়েই। স্বাধীনতা কিনেছি, তা-ও রক্তের বিনিময়ে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে অহিংসার লোকেরা ভারতের মাটিকে নিজের রক্তে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে। কারা চেয়েছিল এই রক্ত ছড়াতে? আবার এমন প্রাণঢালা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা যখন উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে, তখনই তীরে এসে তরি ডুবছে। তাই তো হয়, তরি তীরে এসেই ডোবে। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমাদের দেশভাগ হয়েছে। সরল ভাগ করতে শিখলে হয়তো এত এত রক্ত বয়ে যেত না। চণ্ডাল অশোক বা মহামতি অশোক তিনি-ও রাজ্য জয় করেছিলেন এক নদী রক্তের বিনিময়ে। কলিঙ্গবিজয় তাঁকে পরাভূত সন্ন্যাসী করে তুলেছিল। কিন্তু ততদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। রাজ্যে রাজাকে সঙ্গ দেবার মানুষ ছিল কি আর? তর্ক করুন, তর্ক করি। তাতেও আর একদফা রক্ত ছড়ানো যাবে। দেশের মাটি দাঙ্গায় পয়মন্তি হবে। দেশ সুজলা সুফলা হবে এই মানুষের রক্তে!
দেশভাগ দেখিনি। শুনেছি আমার মায়ের কাছে। শুনেছি আমার মায়ের নানা জানসুব উস্তাদজি কীভাবে এই দেশভাগে মুষড়ে গেছিলেন। এই জানসুব উস্তাদজি এবং তাঁর পাঁচ ভাগ্নের অন্যতম গদায়শেখ থেকে হেরুকা গ্রামের মস্তান, কায়েম, বাগডোহুরির জটায়ু-দেবাংশি থেকে শাহানগরের হামিদ, দিলুয়ার হোসেনদের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলার আগে কিছু কথা বলতেই হয়। ইংরেজদের অত্যাচারের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য যাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করে নেমেছিলেন, সেই তাঁরা দেশ স্বাধীন হবার দু-তিন বছর আগেই কেমন করে হারিয়ে যেতে থাকলেন। পার্ক সার্কাসের সমাজ বিজ্ঞানী মুহাম্মদ ফজলে কাদেরের একটা পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাই, সেখানে তিনি কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন দেশের স্বাধীনতা তরান্বিত হবার। একদিকে বিপ্লবীদের ফাঁসির মঞ্চে জয়গান, অন্যদিকে কবি লেখকদের কলম, নারীদের স্বাধীনতার যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া — নেতাজির আজাদহিন্দ বাহিনীর আক্রমণ গান্ধিজির অহিংস নীতি, অসহযোগ আন্দোলন, ভারতছাড়ো আন্দোলন। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের আর্থিক দেউলিয়াপনা ইত্যাদি। যখন স্বাধীনতা আসছে, তখন দেশের সম্পদের কারা মালিক হবে সে লড়াইটাও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। রাজতন্ত্রের কথা মাথায় থাকার ফলে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে সেই ওরা, যারা শরীরের লড়াই জানে না এবং যারা নিজের প্রাণকে দেশের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সুতরাং ভাগ নিয়ে এবার নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু হল। ঘটে গেল ছেচল্লিশের দাঙ্গা। এই দাঙ্গার কথা পড়তে গিয়ে পাগল পাগল লাগে। সারা শরীর নিংড়ে বমি হবার উপক্রম হয় বেশিক্ষণ পড়তে পারি না এই ঘটনা। তারপর যখন দুটো দেশ হল এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বিনিময় হতে থাকল তখন দেশছাড়া মানুষেরা কেঁদে উঠল। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা ছবি হয়ে মাথায় বসে থাকল। আতঙ্কে চমকাতে থাকল আবার হয়তো দৌড়াতে হবে সবাইকে ফেলে দিয়ে। তাই জোটবাঁধা। তাই সেই ঘটনাগুলোকে জড়ো করে একটা ইতিহাস রাখা হয়তো-বা। স্ব-স্ব ধর্মের লেখকগণ নিজের গায়ে রক্তের ছিটে ধুতে অন্যদের দোষ দিয়ে সাল-তারিখ জমা করে রাখে। হাসপাতালের নথি খুঁজে রেখে লিখে দলিল করে দিয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্মকে পরজন্মে যেন আবার এই দাঙ্গা উদ্ভাবিত হয়। আবার একথাও সত্য যে এই কাজ না করে গেলে এতবড়ো ঘটনার একটা উল্লেখ পাবে না তাও তো ঠিক না। মানুষের মনের ভিতরে দাঙ্গার যে আতঙ্ক আছে সেই আতঙ্ক মেটানোর চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্ক বাড়িয়ে রাখার কাজ হয়েছে। যার ফলে আজকের দিনেও নতুন করে দাঙ্গার গান শোনা যাচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে। দেশভাগে পরবর্তী প্রজন্ম কতটা লাভবান হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর— নিশ্চয়ই লাভ হয়েছে, যারা নিজের নিজের দেশ ছেড়ে চলে গেছে এবং চলে এসেছে তারা সকলেই এখন খুব ভালো আছে হয়তো। যারা নিজের নিজের দেশকে ভালোবেসে চলে যায়নি, চলে আসেনি, সেই তারা কেমন আছে? এর একটা অনুসন্ধান করা গেলে দেখা যাবে সেই মানুষগুলোই আজও কাঁদছে আর আজও দেশের মাটি আঁকড়ে বসে আছে নিশ্চই একদিন আমরা সরল ভালোবাসায় পাশাপাশি বাস করব।
এই তো এই কথা শুনে অনেকেই বলবে উচ্ছন্নে যাক। কে এই বদনসিব যে বাজে কথা লিখেছ? আমি বলি তর্ক করে চলুন, ততক্ষণে আমি একটু অন্য দিকে যাচ্ছি। ওই যে আগে লিখেছি, জানসুব উস্তাদজি, জটায়ু এবং আরও কিছু মানুষের নাম, সেই তাদের কথা উল্লেখ করছি। দেশভাগের দিনে গ্রামে গ্রামে যখন দু-একটি লরি পাঠিয়েছে সরকার। যারা ওপারে যেতে চায়, তারা যেন এই লরিতে উঠে পড়ে, সরকার তাদের নিরাপদে পৌঁছে দেবে। অনেক মানুষ লাটকি-ফুটকি গুছিয়ে লরিতে চাপতে যাবে এমন সময় তাদেরকে ধমকিয়ে লরি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন যিনি — সেই জানসুবের কথা-ই লিখছি। কলকাতা জুড়ে দাঙ্গা চলছে। অন্যদিকে দফায় দফায় অবাঙালি মুসলমান বিহার থেকে পালিয়ে এসে এই গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের রক্ত মাখা ছেঁড়া ফাটা জামা সালোয়ার, মৃতপ্রায় শিশুরা নেতানো লাউলতার মতো নেতিয়ে পড়ে আছে, সেই তাদের একদিকে আশ্রয় করে দিতেই ব্যস্ত হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে খবর নিচ্ছেন, কে কে আছে গ্রামের সেই মানুষ যারা আশ্রয়ের একটুখানি জায়গা দেবে। কারণ বিহারে দাঙ্গা চলছে তখনও। কোনও প্রশ্ন করেনি কেউ কাউকে, সেদিন কারা হিন্দু না কারা মুসলমান। চোখ মুখ বলে দিচ্ছিল ধর্মের ছবি। আবার অন্যদিকে স্বাধীনতার পরের দিন শত শত মানুষ এসে হাজির হয়েছে মুর্শিদাবাদ, মালদা দিনাজপুরের সীমান্তে। তাদের কোথায় পাঠাবে? তখন ঘোড়ার প্রচলন থাকলেও মোটরগাড়ি আসেনি। ট্রেনে করে মানুষ আসছে বর্ধমান রেলস্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে করে নিয়ে আসা হচ্ছে মানুষদের গুসকরা-বোলপুর, সাঁইথিয়া থেকে গদাধরপুর রেলস্টেশনে। রেললাইনের দুধারে মানুষ বসে আছে। জানসুব উস্তাদজি গ্রামে গ্রামে ঘুরে গোরুর গাড়ি জোগাড় করছেন। গদাধরপুর থেকে গোরুর গাড়িতে করে বিপন্ন মানুষদের নিয়ে যাচ্ছেন দূরবর্তী গ্রামগুলোতে। বসতি স্থাপন করাচ্ছেন। দেশভাগে আক্রান্ত মানুষ হাত আর পা নিয়ে কোনোক্রমে প্রাণহাতে করে ছুটে এসেছেন সেই তাদের আশ্রয় দিতে হবে। তখন গ্রামগুলো দূরে দূরেই ছিল। একটা গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দূরত্ব দশ কিমির কাছাকাছি। গোরুর গাড়ি যাবার রাস্তা ছিল না। অনেক ঘুরে ঘুরে যেতে হত। কেবলমাত্র ধান কাটার পরে মাঠ ফাঁকা থাকলে মাঠের আল কেটে ঘাঁটি তৈরি করে দিয়ে মাঠে মাঠে গোরু বা মহিষের গাড়ি নিয়ে যেতে পারত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী শ্রাবণের শেষের দিকেই দেশ ভাগ হচ্ছে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পরে পরে মানুষ চল্লিশের ১৪ই আগস্ট সেই দেশভাগের কাহিনিই বয়ে এনেছে এই মানুষদের। মাঠগুলোর অনেকখানি অংশ জুড়ে জলাভূমি। ধান বলতে মোটাধান — জল যত বাড়ে ধানের গাছও তত বাড়ে। চাষি একবুক জলে নেমে ধান রুয়েছে। কোথাও পারাপার হয় না। এমন পরিস্থিতে গোরুর গাড়িগুলোকে সারিবদ্ধ ভাবে নিয়ে চলেছেন জানসুব উস্তাদজি। তিনি আছেন একটি গাড়িতে। বাকি চল্লিশটা গাড়ি তিনি সামনে পিছনে নিয়ে চলেছেন। সঙ্গে আছেন স্থানীয় গ্রামের ভদ্রস্থ মানুষ। গাড়োয়ানরা গাড়ি ডাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তখন মণিকন্যার থানের কাছেই রেল পারাপার করার জন্য ৪৫টি ফোকোর করা হয়েছে। এই ৪৫ ফোকোর দিয়ে বর্ষার সমস্ত জল বয়ে যায় এবং একটা ঢাল হয়ে আছে । খুব সাবধানে গাড়ি ডাকাতে হবে। কাঠের মোটা মোটা চাকা আর মোষের গাড়ি। বেশির ভাগ সাঁওতাল মানুষ গাড়ি ডাকিয়ে নিয়ে গেছিল। প্রতিদিন চল্লিশটা গাড়িতে করে গদাধারপুর রেলস্টেশনে বসে থাকা মানুষগুলোকে বিভিন্ন গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসা এবং সেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে ডাঙা ডহর দেখে তাদের আশ্রয়স্থল তৈরি করে দেওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখলেন। তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন যে এই মানুষগুলো সর্বহারা মানুষ তাদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। গান্ধিবাদী মানুষ এই জানসুব তিনি দেশভাগের জন্য মুষড়ে আছেন। তার উপরে এই দেশ ভাগের নতিজা নিজে চোখে দেখছেন। যে গ্রামে গাড়িভরতি মানুষ নিয়ে যাচ্ছেন সেই গ্রামের মানুষ যে খুব আগ্রহ করে স্থান দিচ্ছে তা নয়। তাদের সকলেরই মনের ভিতরে সেই ভাগের কথাই জেগে উঠছে। এবার হয়তো আমাদের জমিতে কোপ পড়বে। জমিদার হয়তো খাজনা না মেটানোর অজুহাতে জমি কেড়ে নিতে পারে। হয়েও ছিল। তাই মানুষ রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে গেছিল সূর্যাস্ত আইনে। আজকের এই আলোচনায় অন্যদিকে যেতে চাইছি না। কেবল বলতে চাইছি দেশভাগ — যে মুসলমানেরা মেনে নেয়নি, যারা ভারত ছেড়ে যায়নি, সেই তারাই আবার জায়গা করে দিতে থাকল ওপার থেকে আসা মানুষদের। গদাধরপুর স্টেশনকে কেন্দ্র করে কাছাকাছি এবং দূরদূরান্তের যত হিন্দু গ্রাম আছে, সেই গ্রামের মধ্যে আপাতভাবে বিপন্ন মানুষগুলোকে স্থান করে দিতে থাকল। এই কাজ চলেছিল কয়েক বছর ধরে। বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া, মল্লারপুর, ময়ূরেশ্বর, মহম্মদবাজার ইত্যাদি ব্লকে। যত পূর্ববাংলার মানুষ এসেছিল, সেই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন হেরুকা গ্রামের জানসুব উস্তাদজি। শুধু তো জায়গা না, মাস দুই তিন গ্রামের লোকেরা তাদের ঢেঁকিশাল-গোহালবাড়ি-কোঠা ইত্যাদি ছেড়ে দিয়েছিল। এখানে একথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সদ্য স্বাধীন ভারতের এই মানুষগুলো নিজেরাও ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিল আর এই অভাব অনটনের ভিতরেই ওপার বাংলার দেশহারা মানুষগুলোরও দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। একদিকে খাবারের, পোশাকের আর উপার্জনের অভাব, অন্যদিকে রক্তের বন্যা।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতে কীভাবে বিপন্ন মানুষেরা দিন যাপন করেছিলেন? সে দিনের কাহিনি সুখের ছিল না। ধর্ম নিজেও খুব স্বার্থপর। ধর্ম এক হলেই কি বড়ো মিল-মহব্বত থাকে? মোটেও তা হয় না। মানুষ যখন কারও বাড়ি অতিথি হয়ে আসে তখন ঘোরি জানে সে কয়েকদিন পরেই আপন ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু মানুষ যদি নিঃস্ব হয়ে বিপন্ন হয়ে আসে সকলেই ভয় পায়। কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘোরির সম্পদের উপরে কোপ ফেলবে। জানসুব উস্তাদজির বোন বারেকজান বিবির ছিল অনেক সম্পদ — মানে সে তার স্বামীর কাছে থেকে পেয়েছিল। সেই সময় তার স্বামী ফকির মোড়ল বেঁচেছিলেন। ফকির মোড়ল বারেকজান বিবিকে বলেন — “তোমার ভাই তো দেশ উদ্ধার করেছে, সেই মানুষদের বিভিন্ন গ্রামে রেখে আসছে দুই-এক দিনের ভিতরেই ধান-চাল-মুড়ি-ডাল-কলাই-গম যা আছে, তা কিন্তু দিতে হবে। আর দিতে যখন হবে, তখন জানসুবকে যেন চাইতে না হয়। এখনই ফসল গোলা থেকে নামিয়ে দাও।” ফকির মোড়লের নাতনি নাশিয়া বিবির মুখে থেকে শোনা যায় যে, ওই সময়ে জানসুব তাঁর বোনের বাড়ির প্রায় সমস্ত ফসল বিতরণ করেছিলেন। শুধু জানসুব উস্তাদজিই না, তার সঙ্গে ছিলেন যাঁরা তাদের মধ্যে আগেই উল্লেখ করেছি যাঁদের নাম তাঁরাও আপন আপন ঘর থেকে ফসল এনে বিতরণ করেছিলেন। উল্লেখ করতেই হয়, যে জানসুব উস্তাদজির হাতের লাঠি ছিলেন বেশ কিছু আদিবাসী মানুষ। তাদের বাড়ি সেই সময়ের বিহারের দুমকাজেলার শিকারিপাড়া ব্লকের হিরাপুরে। এই মানুষগুলোর মধ্যে সোনা কিস্কু, হোপন কিস্কু, লোধরা মুরমু, ফাকড়ে মুরমু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা ছাড়া জানসুব উস্তাদজির আর এক ভাগ্নে ছিল, গদাই শেখ। সে, খুদু শেখ এবং হেরুকা গ্রামের বাসিন্দা কায়েম-শেখ। এরা সকলে মিলে ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময় রেললাইন উপড়ে ফেলে দিয়ে এসেছিল। আমি গদাইশেখের কাছে গল্প শুনেছি যে, জানসুব উস্তাদজির নেতৃত্বে এই গদাধরপুর স্টেশনের রেললাইনগুলো সে একাই এক একটা তুলে ফেলে দিয়েছিল মাঠের দিকে রাতের আঁধারে। তার পরের দিনে জল কাদা মেখে লালপাগড়ি পরা পুলিশে হেরুকা ছয়লাপ হয়ে গেছিল, কিন্তু গদায়, কায়েম, জানসুব— এদের খুঁজে পায়নি, ধরতেও পারেনি। সেই মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জানসুব উস্তাদজি গ্রাম গ্রামে চাল ডাল আলু পিঁয়াজ টাকাকড়ি চেয়ে সেই সেই গ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
এখন দেশ ভাগের ফলাফল নিয়েই হাঁটছি। হিন্দু মুসলমান প্রতিটি গ্রামেই চলেছিল শান্তি বজায় রাখার কাজ। প্রতিটি গ্রামের মানুষ দায়িত্ব নিয়েছিল যাতে গ্রামগঞ্জে কিছুতেই দাঙ্গার আগুন না আসে। কিন্তু শত শত মানুষ যখন দেশভাগের আগুনে দগ্ধ হয়ে রেললাইনের ধারে বসে আছে সেই তাদের দেখে হিংসার ফুল্কি মনের ভিতরে দেশভাগকারীদের প্রতি ক্ষোভ জমে উঠেছিল বেশি। যদিও সে রাগ তারা চেপেই রেখেছিল। তারই মাঝে যে হিন্দু গ্রামের মানুষ বিরক্ত হয়নি তা বলা যাবে না। আমি যে এলাকার কথা লিখছি, সেখানে তখনও মাঠ বলতে কমই ছিল, জলাভূমিই বেশি ছিল। মাঠের মাঝে মাঝে ছোটো বড়ো পুকুর শালুক ফুলে ভরা। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে শালুক ফুল তুলে যেমন আনত, তেমনি শালুকফুলের গোড়াগুলোকে তুলে নিয়ে এসে পুড়িয়ে খেয়ে গরিব মানুষেরা সেই সময়ে ক্ষুধা নিবারণ করত। এই কথা এই জন্য উল্লেখ করলাম যে, তাদের যেহেতু কিছুই নেই, প্রকৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে, তাই তাদের হারাবার কিছু নেই, আবার অন্য কোথাও যাবার বাধাও নেই।
দেশভাগের কয়েক বছর পরে শুরু হয়েছিল মুসলমান গ্রামের কিছু মানুষের পূর্বপাকিস্তানে চলে যাবার হিড়িক। পুরো পরিবার যায়নি। পরিবারগুলো ভাগ হয়ে চলে যায়। দেশভাগে নারী কী অবস্থায় ছিল সেকথাও উল্লেখ করা দরকার। দেশ থেকে উৎপীড়নের জন্য দেশত্যাগ যেমন কষ্টের, তেমনি দেশে থেকে দেশভাগের আগুনে পোড়াও ততটাই কঠিন। আমি সেই পরিবারেরই একজন মানুষ। দেশ থেকে চলে যায় আবার ফিরে আসে অনেকটা কুটুমবাড়ি বানিয়ে নিয়েছিল বীরভূমের বেশকিছু মুসলমান মানুষেরা। সকালে বাস ধরে বহরমপুর সেখান থেকে চলে যায় রানিনগর, আখরিগঞ্জ অথবা শেখপাড়া কাহার পাড়া। কারও বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরের দিনে ভোরে আবার দশ কিমি পথ হেঁটে পদ্মা পেরিয়ে উঠে গিয়ে রাজশাহীতে হাজির। দেশ যে ভাগ হয়েছে এই মানুষদের বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল। কেবল সরবতি আলু, সেকেরকুঞ্জি আলু, কলাই, নানা বিচিত্র ডাল যে চরের মানুষ ফলায়, তার এক নতুন বিনিময় শুরু হল। কিন্তু দিন যত এগিয়ে গেল, তার পরিণতি আরও খারাপ হল। বেড়া তৈরি হল। বি এস এফ এল। নানা কু-কাজে মানুষ লিপ্ত হতে বাধ্য হল বর্ডারে।
এক নারীর কথা এখানে বলব ভেবেছিলাম। এখন সেই কথা উল্লেখ করব। তাঁর কান্না আমি আজও ভুলতে পারি না। সেই নারী কেঁদে কেঁদে দু-চোখ অন্ধ করে ফেলেছিল। সেই নারীর দুই পুত্রেরও একই অবস্থা হয়েছিল। সেই নারীর নাম আহাজান। জন্ম আনুমানিক ১৯২০ সালে। তার মোট ছেলেমেয়ের সংখ্যা মরে মরে নয়টা। তার মধ্যে সাতটা বেঁচে ছিল। এই সাত ছেলে মেয়ের মধ্যে দু-টি ছেলে যাদের নাম জোহা এবং শিস। দুই ভাই ফুটবল খেলায় খুব ভালো। বীরভূমের এমন কোনও খেলার মাঠ নেই যে, এই দুই ভায়ের পা পড়েনি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভেঙে যাবার সময়ে যদিও এই দুই ভাই ছোটো ছিল, কিন্তু ১৯৬৪ সালে এই দুই ভাই কলকাতা খেলতে যায়। হেনকালে কলকাতায় ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা শুরু হয়। ব্যাস সেখানেই ঘটল যত বিপত্তি। দিশেহারা হয়ে তাদের কী হয়েছিল বাড়ির লোকেরা কিছুতেই সেই খবর পায়নি। তাদের এক জনের বয়স ছিল আঠারো বছর (শিস), এক জনের ষোলো বছর (জোহা)। এই দুই ভায়ের বহুদিন কোনও খবর পাওয়া যায়নি। তাদের মা জেনেছিলেন, তাঁর দুই ছেলে দাঙ্গায় খুন হয়ে গেছে কলকাতায়। সেই যে তার কান্না শুরু হল তরতাজা দুই তরুণ সন্তানের জন্য সে কান্না আমি আহাজানের শেষ দিন পর্যন্ত দেখেছি। একটি দেশভাগ কিছু বঞ্চিত মানুষের জন্য একটি অধিকার উপস্থাপনা হতে পারে, কিছু হিংসুক মানুষের পৃথক করে দেবার প্রবণতা হাসিল হতে পারে অথবা বহিরাগতদের বাঁধানো ঝগড়াকে কেন্দ্র করে দেশভাগ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন নারী হিসাবে একজন মা যেমন নিজের সংসার ভেঙে যাবার দৃশ্য সহ্য করতে পারেন না, ঠিক তেমনই দেশভাগ তাঁর কাছে অনেক সন্তানের এক সঙ্গে মৃত্যুর সমান। আবার নারী হিসাবে একজন তরুণী তনয়া, বোন যদি হয়ে থাকে তাহলে তাদের দাঁড় করিয়ে তরবারির আঘাতে এক কোপে ভায়েরা হত্যা করেছে শুধু এই ভেবে যে, তাদের বোনেদের ভিনজাতের পুরুষেরা বলাৎকার করবে। নারীদের কত ভাবে কত পথে সেদিন হত্যা করা হয়েছে! এই সব কথা ভাবতে গিয়ে অসাড় হয়ে যায়।
যাঁর কথা বলছিলাম, আহাজান। তিনি চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর তরতাজা পুত্রদের হারিয়ে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কাঁদতে থাকেন। মানভূমের নীচে নেমে এলে ঢোলকাটা, তার নীচে ভাঁড়কাটা গ্রাম। ক্রমশ নীচের দিকে নামতে থাকলে দ্বারকা নদীর দিকে আসা যায়। দ্বারকা নদীর উত্তর পাড় থেকে আরও এক দুই মাইল গেলেই সালুকা গ্রাম। সেই গ্রামেরই কন্যা এই আহাজান। ১৯৪৭ সালে সে গ্রামে কোনও প্রভাব পড়েনি দেশভাগের। তবুও প্রায় প্রতি ব্লক থেকেই কোনও না কোনও পরিবার চলে গেছে নতুন মাটিতে নতুন দেশে। আহাজান বা তাঁর পরিবারের মানুষেরা বারবার বলেছে লক্ষ হাজার বছরের মাটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। নতুন দেশের প্রলোভনের চেয়ে বুকফাটা হাহাকারের রোদনের নোনা জলে নুনস্নান করতে হয়েছিল তাদের বেশি।
আহাজানের কান্না থামেনি, পাঁচ বছরের মধ্যেই তার দুটো চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তার স্বামী আয়ুব হোসেন, তিনি লেটোগানের সাথে মাঝে মাঝে চলে যেতেন। তিনি ঝুমুর দলেও বিবেকের গান করতেন। কবি নজরুলের সঙ্গেও তিনি অনেকদিন লেটোগান করে বেড়িয়েছিলেন। তিনি অনেকদিন হল গান ছেড়ে দিয়ে তার ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্যই নানা কাজ করে চলতেন। তার স্ত্রীর এমন পুত্রহারার কান্নায় তিনি মর্মে মরে যেতেন। দিনের সমস্ত রোদবেলা, দুপুরবেলা, বিকেলবেলা নদীর ধারের জিয়াপতিগাছের নীচে বসে কাটিয়ে দিতেন। একদিন জানা গেল তাঁর ক্যান্সার হয়েছে। তিনি জানতে পারলেন সে কথা। তিনি প্রতিদিন মাটির বারান্দার বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে নাচের দরজার দিকে তাকিয়ে বলতেন — “শেষবারের মতো একবার যদি যমজ বাচ্চাদুটোকে দেখতে পেতাম!” চোখের কথাগুলো জল হয়ে ঝরে ভিজে যেত তার পিঠছেঁড়া মলিন গেঞ্জি। এইভাবে কয়দিন চলছিল। একদিন বিকেলবেলা সূর্য প্রায় ডুবে যাচ্ছে। আয়ুব হোসেন বললেন, “পিয়ন প্রতিদিন আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে চলে যায়, দু-একটা চিঠি থাকলে ঢোকে আমাদের ঘরে। আমার মন বলছে, তোমার বাচ্চারা মরেনি, ওরা বেঁচে আছে। একটি চিঠিও কি লিখতে পারে না? না আর ওরা আসবে না রে! ফিরবে না! ওরা দেশ থেকে চলে গেছে!” কিছুতেই তিনি বললেন না যে, ওরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তাঁর একটা বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছিল। আয়ুব হোসেন শেষ কথা বললেন, “না যমজ শিশুর সঙ্গে আর দেখা হল না এ জীবনে। রোজহাসরের মাঠে দেখা করিয়ে দিও খোদা!” তার পর তিনি মারা গেলেন।
আহাজান অনেক দিন বেঁচে ছিলেন। তিনি বলতেন, “চোখে দেখতে পায় না, জগৎ আঁধার হয়ে গেল। তবু যদি শিশু দু-টি মা বলে একবার ডাকত!” সত্যিই একদিন গভীর রাতে দুই ভাই এসে হাজির। ১৯৭০ সালের শীতের রাতে। দুই ভায়ের নিজের ঘর চিনতে কোনও কষ্ট হয়নি। আয়ুব হোসেন আর আহাজান দুজনেই তাঁদের ঘরের কোনও পরিবর্তন করেননি। শুধু এই ভেবে যে, যদি কোনোদিন বাচ্চারা ফিরে আসে।
১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় কলকাতা থেকে বীরভূমের দিকে না এসে কীভাবে যেন তারা পূর্বপাকিস্তানের ভিতরে চলে গেছিল। ওরা ফেরার সময়ে তাদের সবকিছুকে ফেলে দিয়ে সেই প্রিয় ফুটবলটাকে হাতে করে আবার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। দেশভাগ আহাজানের চোখ নিয়েছে, আয়ুব হোসেন ইহজগতের আশায় আশায় থেকে বুকভাঙা নিরাশা নিয়ে জগৎ ছেড়ে চলে গেছে। এখানেই ক্ষান্ত নয় দেশভাগ! আরও কথা আছে এই দুই শিশুর। বাংলাদেশ জন্ম হলে তারা ব’লে তাদের বৌ আছে এবং তাদের সন্তানাদি আছে সেই দুশমনের হাতে, আমাদের ফিরে যেতে হবে। তারা ফিরে গেছে। তাদের মাকে বলে গেছে, দেশভাগ মানে সরকারি খাতায় ভাগ হয়েছে মা। সত্যিকারের কোনও দেওয়াল নেই। এখন পাকিস্তানিরা বাংলার নরম মানুষদের থাকতে দিচ্ছে না। মারছে, মেরে শেষ করছে, গুলি চলছে কামান চলছে। বিশ্বাস কর মা, আমাদের দেশ আমাদের সঙ্গেই ফিরে আসবে ভারতে। শুরু হল আহাজানের কান্না। আহাজান প্রশ্ন করে — “সে দ্যাশে ক্যা আছে রে জজ, কুন সদর আছে! আপুন দ্যাশে এসে ঘর বেঁধে থাক। আপুন দ্যাশের গোরস্থানে তুর বাপ আমি তু করে পাশাপাশি জনম জনম শুয়ে থেকে দ্যাশের মাটি হয়ে থেকে যাবো বাপ!”
অনেক কথা অনেক কথা পদ্মায় ভাসিয়ে দিলাম। শেষটুকু না বললেই না। একটি দেশ ভেঙে গেলে হাজার কোটি মা মরে যায়। এক মাটি এক দেশ একই হাওয়া বয়ে যায় আমাদের পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর দক্ষিণে। কিন্তু কিছুতেই একবার এসে মাকে দেখে যাওয়া যায় না। যেদিন আহাজান মারা গেল সেদিনও কপাল ঠুকে ঠুকে কেঁদেছিল আহাজান — “জজ আমার শিশু ফিরে আয় বাবা! আমার জানাজার অভাব মিটবে কেমনে!”
আহাজান মারা গেল। জজ শিশু পদ্মার ওপারে এসে দাঁড়িয়ে ভিডিয়োকলে দেখে গেল আহাজানকে। নাওয়ানো (শেষ স্নান) হল, কাফনানো হল, তার দরজা দরজায় এল তাকে ভিন গ্রামের মানুষেরা কাঁধে করে গোরস্থানে নিয়ে গেল। দেখল জানাজা হচ্ছে, দেখল আহাজানকে গোরে নামানো হল, দেখল, শেষ বারের মতো মুখের কাফন সরিয়ে দিয়ে সূর্যের শেষ আলো মাখাল, দেখল বাঁশের পাড়োনে ঢেকে দিচ্ছে, একমুঠো মাটি পড়ল, সকলে বলে উঠাল, মিনহা খালাক নাকুম (এই মাটি থেকে তোমাকে তৈরি করা হয়েছিল) দুই মুঠো মাটি পড়ল, সকলে বলল, ওয়া ফি হা নাইদিকুম (এই মাটিতে তোমাকে প্রোথিত করা হল) শেষ মুঠো মাটি পড়ছে, চারিদিকে উচ্চারিত হচ্ছে, তারাতুন উখরা (এই মাটি থেকেই একদিন তোমাকে তোলা হবে)। ভিডিয়োকলের শেষটুকু শেষ ভালোবাসার চুমুক হয়ে যমজ দুই ভাই দুজনেই রাজশাহীর সীমান্তের পদ্মার ঢেউয়ে উপুড় হয়ে কেঁদে বলেছিল— “মা গো, দেশভাগ মানে হাজার মায়ের মৃত্যু, হাজার মেয়ের বলাৎকার! দেশভাগ মানে আপন জন্মভূমিতে আপন দেশে আর ফেরা যায় না মা গো!”
আমি যে দেখেছি তাদের এই ভাবে কান্নাকাটি করতে। এই তো দু-হাজার সালের কথা। সেই ছেলেরাও আর বেশিদিন বাঁচেনি। কয়েক বছর পরে ফোনে খবর এল জজ মারা গেছে। এমন দূরের বীরভূমের সালুকা গ্রাম থেকে কে যাবে তাকে এক মুঠো দেশের মাঠি পৌঁছে দিতে! তাদের দাদা দিদিরা কেবল দেখতে থাকল ভিডিয়োকল করে স্নেহের ভাই জজ শিশুর মৃতদেহ কোনও নক্শিকাঁথায় ঢেকে রেখেছে। এপারে ভায়েরা স্নান সেরে প্রস্তুত হয় ভিডিয়ো সারিতে জানাজা পড়তে। জজ শিশুর বড়দি ডুকুরে কেঁদে ওঠে— “ওরে আমার জজ শিশু ভায়েরারে, তোদের কোলে পিঠে মানুষ করেছি ভাইরে আমার, এতই কি নিষ্ঠুর হল খোদা, আপন ভাইকে ছুঁতে পারছি না! হায় খোদা! এদেশ কে বলেছিল ভাগ করে দিতে?” আমি এই জজ শিশু মারা যাবার সময়ে ছোটো ছিলাম না। এই তো ২০০২ সাল, ২০১২ সালের কথা। আমিও কেঁদেছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিঁড়ে যাওয়া ভারতের মাটি থেকে।
এখন যদি এই দেশভাগ নিয়ে দুই দেশের সরকারের ভালোলাগার কথা বলি তাহলে বলতে হয় এরা যেন দুই নিষ্ঠুর ভাই। একই ঘটনা ঘটায় দুজনেই। তাতে কেউ উনিশ আর কেউ বিশ। কয়েকটি সীমান্তবাসীর ঘটনার কথা উল্লেখ করি — বাংলাদেশের দিকে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের সীমান্ত আনুমানিক ৪০৯৬ কিমি। এই সীমান্ত সব চেয়ে বড়ো সীমান্ত আর সব চেয়ে বেশি রক্তমাখা সীমান্ত। এখানে কিছু জেলাভিত্তিক সীমান্ত এলাকার নাম উল্লেখ করছি, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ, গাইঘাটা উত্তর-চব্বিশ পরগনার সীমান্তরেখায় অবস্থিত। রানিনগর, লালগোলা, আখেরিগঞ্জ, শেখপাড়া মুর্শিদাবাদের সীমান্ত। নদিয়ার করিমপুর বা ধানতলা, বানপুর; মালদা জেলার কালিয়াচক, পঞ্চানন্দপুর; দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট হিলি। উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখর; জলপাইগুড়ি জেলার বেড়ুবাড়ি, কোচবিহারের দিনহাটা সিতায়, শিতলকুচি হলদিবাড়ি। এই সীমান্ত এলাকার মানুষগুলো কেমন আছে? জানতে চান? এ যেন বিমাতার শাসন। ভারতের নাগরিক হয়েও সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত। জীবন জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ প্রশাসনিক পরিকাঠামো, সরকারি কার্যকলাপ যেন উন্মাদ্গ্রস্ত। এদিকের বি এস এফ আর ওদিকের বি জি বি সমান দুর্নীতিগ্রস্ত। কী হয় না এই সীমান্ত জুড়ে! নারী পাচার থেকে গোরু পাচার থেকে ফেন্সিডিল, বাংলাদেশের এক টাকার কয়েন ইত্যাদি। উত্তর চব্বিশ পরগনার সীমান্তে কন্যা পাচার হলে বা কোনও মানুষ যদি এসে পড়ে ওপার কিংবা এপার থেকে তাহলে তাদেরকে ফরেনারস অ্যাক্ট-এর ১৪নং ধারায় অভিযুক্ত করে আদালতে চালান করে এবং আদালতের রায়ে তাদেরকে আজীবন সংশোধন করে চলে। এটা কি করার কথা ছিল? মোটেও না। ভারতের স্বরাষ্ট্রদপ্তরের ঘোষণাপত্রে (১ম মে ২০১২ এস এ এ আর সি) বলা হয়েছে যে — যদি কোনও মহিলা বা শিশু কোনও ভ্যালিড কাগজপত্র ছাড়া ধরা পড়ে তাহলে তাদেরকে অভিযুক্ত না করে কোনও হোমে রেখে যত তাড়াতাড়ি তাদের দেশে পাঠাতে হবে।
কিন্তু, তা করবে কেন বলো! একটি চেন ফেলে দেশ ভাগ করে দিয়েছে যারা তারা কি একবারও ভেবেছিল অপু-দুর্গার মতো ট্রেন দেখার নেশায় দৌড়ে কোনও শিশু চলে আসবেই কাশফুলের ভেলাকে ভর করে, তখন এই বি এস এফ এবং বি জি বি এই শিশুকন্যা ও মহিলাদের বলাৎকার করতেই থাকবে— এদের হাত থেকে এরা মানব জীবন ফিরে পাবে কী করে? এই সীমান্ত এলাকায় প্রতিদিন এমন ঘটনা দেখা যায়। যার কোনও খবর কেউ করে না, যার কোনও রেকর্ড করে না। এর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও নেয় না।
এ প্রসঙ্গে, কাঁটাতার জমি অধিগ্রহণের কথা বলতেই হয়। ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। দেশভাগ হয়ে গেলেই তো আর আপন আপন জিনিসপত্র তোলার মতো ভাগের মাটি কাঁধে করে নিয়ে চলে যেতে পারবে না। মানুষ আছে আর আছে তার খেত-খামার। দেশের সরকার ভাগের দড়ি ফেলতেই পারে, কিন্তু কার মাঠের উপরে ফেলবে? নিশ্চয়ই কোনও ব্যক্তির বা কোনও কৃষকের মাঠে। সেই কৃষক চাষ করে বেঁচেবর্তে থাকবে না? দেশ ভাগ করে কাঁটাতার তো দিলে, কিন্তু কথা দিলে যে, যাদের মাঠের উপরে এই কাঁটাতার পড়ছে তাদের চাকুরি দেওয়া হবে, ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেসব কোথায় গেল? সেই সব চাষিরা আজও ঘুরছে সরকারের ঘরে। আগেই বলেছি, এখানে দুঃশাসন দুর্যোধনেরা সব আছে, কিন্তু সুশাসনের বিচারক কোথায়? আই বি পি এর ফুলফর্ম হচ্ছে ইন্টারন্যাশানাল বর্ডার পিলার যা কিনা আইন অনুযায়ী ১৫০ গজ ফেলে রেখে পিলার গাড়তে হয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেসব মানা হয় না। এটা করলে কাঁটাতারের ওপারে থাকে ৫০০ মিটার বা এক কিমি আবার কোথাও কোথাও পাঁচ থেকে দশ কিমি পড়ে থাকে। এই এলাকাটা এদেশের সীমান্তবর্তী কোনও না কোনও চাষির। এই আইন না মানার ফলে চাষি তাদের জমি হারাল। আগেই উল্লেখ করেছি সরকার এর ক্ষতিপূরণ দেবার বিজ্ঞপ্তি বের করলেও বাস্তবে রূপায়িত করেনি।
এবার যদি বলা হয় চাষের কথা, তাহলে তো আরও হয়রানি হ্যারাসমেন্ট দেখা যাবে। কাঁটাতার ঘেরার ফলে চাষিরা প্রশ্ন করল, তাদের জমি তো তারের ওপারে। তারা সেখানে চাষ করতে যাবে কী করে? উত্তরে বলা হল — মাঝে মাঝেই গেট থাকবে। সেদিকে তারা যাবে। তার পর গেট কয়েকটি রাখলেও সে গেট আর খোলা থাকে না। খোলা থাকলেও তিন চার ঘণ্টার জন্য। চাষিকে নিজের পরিচয়পত্র জমা দিয়ে যেতে হয়। শুধু তাই না, বি এস এফ একটা পরিচয়পত্র দেবে এবং সেই পরিচয়পত্র মেন্ডাটারি। বি এস এফের কাছে থেকে সেই পরিচয়পত্র পেতে গেলে চাষিদের হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। কখনও দেয়, আবার কখোনও দেয় না। ক্ষেতের চাষের নানা ঋতু থাকে, সময় মতো বীজ ফেলতে না পারলে চাষ হবে না। কিন্তু বি এস এফ এতটাই কম সময় দেয় যে মাঠে চাষ দিয়ে বীজ ফেলে সার মাটি করা হয়েই ওঠে না। চাষি চাষ করবে কীসে? তাকে তো দুজোড়া বলদ নিয়ে যেতে দেবে না বি এস এফ। তাকে মাটি চষার জন্য ট্রাক্টর নিয়ে যেতে দেবে না। তাহলে সে কী দিয়ে চাষ করবে? এখানেই শেষ না। এমন ফসল লাগাতে হবে যার উচ্চতা তিন ফুটের বেশি হবে না। তাহলে পাট, শন, অড়হর, ধান, গম চাষ করা যাবে না। ভাবতে থাকুন, এই সীমান্তের চাষি কী চাষ করবে? অত্যাচারের শেষ নেই। এরপ্রেও তারা আশায় থাকে কবে ফসলের দাম একটু বাড়বে আর করে চাষ থেকে কিছু লাভ পাবে। কিন্তু দেশ ভাগ আর থামে না! চাষি সব কিছু মেনে নিয়ে যখন চাষ করতে যায় তার সঙ্গে থাকে খাবার। বি এস এফ সেই খাবার পরীক্ষা করে একটা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। ওই লাঠিটাই ব্যবহার করে গোরু খোঁচাতে এবং নর্দমার ময়লা সরাতে।
বি এস এফ কি শুধু চাষে বাধা দেয়? তারা এই সীমান্তবাসীদের ব্যক্তিগত জীবনেও এসে চারিয়ে দিচ্ছে। আই বি বি আর যে রাস্তা আছে, যাতে সীমান্তবাসীরা যাতায়াত করবে, সেই রাস্তায় সন্ধ্যার পরে তাদের যাতায়াত বন্ধ। তারা নিজের ইচ্ছায় আত্মীয়র বাড়ি দেখাসাক্ষাৎ করতে পারে না। সব কিছুতেই বি এস এফের বাধা। কী খাবে, কত সময় অনুষ্ঠান করবে, কী পরবে সব এই বি এস এফ ঠিক করে দেয়।
রাহেলার গল্প আমাদের অনেকের জানা। ২৯ বছরের রাহেলা — বিধবা, দু-টি সন্তান। ইদের মার্কেট করার অনুমতি নিয়ে আসে এবং মার্কেট করে সে বাড়ি ফিরছিল। যাবার সময় পরিচয়পত্র ক্যাম্পে জমা দিতে হয়। সে জমা করেছিল কিন্তু ফেরার সময় সেই পরিচয়পত্র নিতে গেলে তার ঝোলায় কী আছে দেখা হয়। সে ইদ উপলক্ষ্যে কিছুটা গোরুর মাংস কিনেছিল। এই অপরাধে বি এস এফ তার পেটে লাগাতার লাথি মারে এবং পরের দিন সে জলঙ্গী হাসপাতালে ভরতি হয়। সেখানে সে সুস্থ হয়, এরপরে থানার কাছে অভিযোগ করতে গেলে ডিউটিরত অফিসার তিনি বলেন, “যারা যারা সীমান্তে বাস করে তারা সবাই চোর।” এতেও দমে না রাহেলা। সে চলে যায় মুর্শিদাবাদ পুলিশ সুপারের কাছে। সেখানে লিখিত অভিযোগ করে, কিন্তু তার কোনও উত্তর আসে না। এই তো ২০২১ সালের ঘটনা। কোনও নিউজ হয়েছে নাকি? উত্তর কে দেবে! এমন হাজার নৃশংস ঘটনা আছে ঘটে যাচ্ছে। এখন তো সুরক্ষার নামে সীমান্তের ৫০ কিমির ভিতরে ঢুকে সীমান্তরক্ষী যেমন খুশি তদন্ত করতে পারে। এই আইনের বলে সীমান্ত নরক হয়ে উঠেছে। কেন এমন ঘটল? দেশভাগের এই কুফলগুলো কি এই মানুষদেরই ভোগ করে যেতে হবে?
সুরক্ষার কথা যদি বলে যে দেশের সুরক্ষার জন্য করতেই হবে! তাহলে প্রশ্ন আছে, দেশের সুরক্ষাকর্মীদের কোথায় থাকার কথা? কাঁটাতারের গা ঘেঁসে। কিন্তু সেখানে তারা থাকে না। তারা থাকে গ্রামের ভিতরে। সীমান্ত সুরক্ষিত কে করছে? ইউ পি এ সরকার বর্ডার হাট স্থাপন করল। দুইদেশের চাষি তাদের শস্য এনে এখানে বিক্রি করবে, হাতের কাজ, ফলমূল আসবে। তাতে কিছুটা পাচার বন্ধ হবে। তাতে চাষিরা কিছুটা পয়সা হাতে পাবে। দু-দেশের সীমান্তর মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়বে। এই হাট পরিচালনা করবে বি এস এফ। কিন্তু হল কি? এন ডি এ সরকার এসে সব বন্ধ করে দিতে বললে সেই হাট আর খোলাই হল না। এই বিষয়টা নিয়ে কেউ ভাববে কি? বর্ডারে ডেভেলপমেন্ট নিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প আছে, সেই খাতে অনেক অর্থ বরাদ্দ আছে, কিন্তু সেই টাকা তছরুপ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারেরা।
হায় দেশভাগ! কারা এই দেশভাগের লভ্যাংশ তুলছে প্রতিদিন আর কারা প্রতিদিন এই দেশভাগের গ্লানি মাখছে!
হে দেশের নাগরিক ভেবো না, এসব কেবল সীমান্তে হচ্ছে। কয়েকদিন পরে তোমাদের ঘরেও ঢুকবে এই বাঘ— সেই ছড়াকারের ভাষায়— হাঁক দিয়ে বলবে, ‘হালুম, পাশের ঘরে খাওয়া হল, তোমার ঘরে এলুম।’
[লেখার শেষ অংশটি “ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে বি এস এফ-এর ৫০ কিমি” পত্রিকার তথ্য থেকে সাহায্য নিয়ে লেখা।]