বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদে নেহরু যখন তাঁর বিখ্যাত ‘Tryst with destiny’-র ভাষণ দিচ্ছিলেন তার কয়েকমাস আগে থেকেই পাঞ্জাব দাঙ্গার আগুনে জ্বলছিল। স্বাধীনতা বা সীমানা কমিশনের রোয়েদাদ ঘোষণার আগে থেকেই হিন্দু-মুসলমান-শিখের রক্তক্ষয়ী সংঘাত চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে। আর রোয়েদাদ ঘোষণার পর যা ঘটতে থাকে তা পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বীভৎস গণহত্যা। বিস্তৃত তথ্যের দরকার নেই, নিখুঁত পরিসংখ্যানও এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। তথাপি এটুকু বলা দরকার যে, হিন্দু-মুসলমান-শিখ মিলিয়ে পাঞ্জাবে অন্তত কয়েক লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, সম্পত্তি ও নারী লুণ্ঠন তো ছিলই। পেন্ডেরেল মুন তাঁর ‘Divide and Quit’ গ্রন্থে একটি হিসেব দিয়েছিলেন যে, দেশবিভাগের পর পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে পূর্ব-পাঞ্জাবে চলে এসেছিলেন ৪৫ লক্ষ হিন্দু ও শিখ পরিবার, অপরদিকে পূর্ব-পাঞ্জাব ছেড়ে চলে যাওয়া মুসলিম পরিবারের সংখ্যা ছিল ৬০ লক্ষ। এই যাওয়া-আসার ঘটনাও চরম নিষ্ঠুরতার কাহিনি। দেশছাড়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মিছিল পদে পদে আক্রান্ত হয়েছে, ট্রেন আটকে গোটা ট্রেনের আরোহীদের নিহত করা হয়েছে। আর কত নারী যে অপহৃত হয়েছিলেন তার সঠিক হিসেব আজও পাওয়া যায়নি।
তাই নেহরু যখন গণপরিষদে বলছিলেন যে, ‘ঠিক মধ্যরাত্রির ঘণ্টা যখন বাজবে, যখন সাড়া পৃথিবী নিদ্রামগ্ন তখন ভারত জেগে উঠবে স্বাধীন জীবনের মর্যাদায়’ (অমলেশ ত্রিপাঠীর অনুবাদ) তখন কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল, তাদের জীবন ও সম্পত্তি সবই হয়ে উঠছিল চরম বিপন্ন। অনেকের কাছেই সমস্ত ব্যাপারটা কেবল আবেগ ও উচ্ছ্বাসের ছিল না, ছিল রক্তাক্ত বাস্তবের। হিন্দি ও উর্দু কথাসাহিত্যে মনুষ্যত্বের এই চরম বিপর্যয়, এই অমানুষিক গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। ফুটিয়ে তুলেছেন সেই সব লেখকেরা যাঁরা বাস্তুহারা, যাঁরা ট্রেনের ছাদে চেপে, অথবা মিছিলে কয়েকশো মাইল পথ হেঁটে, ধ্বংস ও হত্যার শিকার হতে হতে নিরাপদ ভূমিতে পা রাখতে পেরেছিলেন। এঁদের অনেককেই দীর্ঘকাল উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটাতে হয়েছিল। সেখানকার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখের ছিল না। একদিকে কয়েকপুরুষের উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা, অপরদিকে অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা তাঁদের কিছুটা বিমূঢ় করেছিল ঠিকই, কিন্তু কেবল সেটিই তাঁদের লেখার সবটুকু ছিল না। অস্তিত্বের সংকট তারাও অনুভব করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্বের চরম বিপর্যয়ও তাঁদের কিছুটা হতাশ ও বেদনাকাতর করে তুলেছিল। এই দুইয়ের মিশ্রণে তাঁদের কথাসাহিত্য কেবল দাঙ্গার কাহিনি বা উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের চিত্র হয়ে ওঠে না, তা হয়ে ওঠে নিপীড়িত মানবতার উজ্জ্বল দলিল। কৃষণ চন্দর, ভীষ্ম সাহানি, সাদাত হাসান মান্টো— প্রমুখ দেশভাগের কথাসাহিত্যে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ গল্পটি তো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
বলতে দ্বিধা নেই, দেশবিভাগ অবলম্বনে রচিত বাংলা কথাসাহিত্য সামগ্রিকভাবে সেই উচ্চতায় পৌঁছোয়নি। না পৌঁছোনোর দুটি প্রধান কারণ ছিল। এক, প্রধান প্রধান লেখকদের অনেকেরই উৎস থেকে বিচ্ছিন্নতার বেদনা তেমন ছিল না। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুজন তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেউই জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের নন, বিভূতিভূষণের পিতৃভূমি ছিল যশোহর জেলার বনগ্রাম মহকুমায়। তাঁর দেশ র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডে পূর্ব-পাকিস্তানে পড়তে পারে এরকম এক গুজবে কিছুটা বিচলিত হয়ে তিনি এপারে জমির সন্ধান করতে থাকেন। ‘আচার্য কৃপালনী কলোনি’-র মতো গল্পে সেই স্বল্পস্থায়ী ব্যাকুলতার কিছুটা প্রতিফলন আছে মাত্র, আর কিছু নেই। জমি খুঁজতে খুঁজতে যখন তিনি ক্লান্ত তখনই ‘র্যাডক্লিফের রায় বাহির হইল। আমাদের দেশ পশ্চিমবঙ্গে পড়িয়াছে।’ দেশভাগকে এখানে অত্যন্ত ক্যাজুয়ালি নেওয়া হয়েছে। আসলে বিভূতিভূষণ কোনও তত্ত্ব দিয়ে ঘটনাকে বিচার করেন না, কেবল লেখা নয়, অনুভব করাই তাঁর সাহিত্যের বিষয়। দেশভাগের গুরুত্ব তিনি নিশ্চয় উপলব্ধি করেছিলেন, কিন্তু ১৯৫০-এর ১ নভেম্বর তাঁর অকালপ্রয়াণ অনুভবকে হয়তো তেমন দানা বাঁধতে দেয়নি। তাছাড়া ১৯৪৭-৪৮-এ পূর্ববঙ্গ থেকে দেশত্যাগ শুরু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা চরমে ওঠে ১৯৫০-এর জানুয়ারির পর। ১৯৫০-এর এপ্রিলে নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটায়নি। এই বিপুল উদ্বাস্তুস্রোত সরকার বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেই শুধু বিমূঢ় করেনি, আমাদের কথাসাহিত্যিকেরাও হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, জবর দখল, কলোনি রক্ষার সংগ্রাম, পুলিশ ও জমিদারদের সংগঠিত বাহিনীর বিরুদ্ধে উদ্বাস্তুদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ বহু কথাসাহিত্যিকেরই প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্বাস্তু শিবিরগুলির দুরবস্থা ও দাবি আদায়ের লড়াইও তাঁদের রচনায় অনিবার্য গুরুত্ব পায়। নারায়ণ সান্যালের ‘বকুলতলা পি. এল ক্যাম্প’ এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসটিতে পশ্চিমাঞ্চলের লেখকদের মতো উদ্বাস্তুদের অবিরাম যাত্রার বাস্তব বিবরণ আছে, ‘দর্শনা থেকে বানপুর। দলে দলে চলেছে মানুষ আর মানুষ।’ এই যাত্রাপথ, ক্লান্ত, বিষণ্ণ এবং সন্ত্রস্ত মানুষের। খুব কম উপন্যাসেই অন্তত এই সন্ত্রস্ত যাত্রাটুকু পাওয়া যায়। তবে এই উপন্যাসও বর্ণনাত্মক। এর আবেদন নির্দিষ্ট পরিসরেই সীমাবদ্ধ। এই প্রসঙ্গেই অন্য একটি আলোচনা সেরে নেওয়া যেতে পারে। দেশভাগ সংক্রান্ত উপন্যাসে কোন জিনিসটি বেশি ব্যবহৃত? খুন-জখম-লুণ্ঠন-দেশত্যাগের বর্ণনা থাকা স্বাভাবিক, তবে অনেকের রচনাতেই এই সন্ত্রস্ত মৃত্যু মিছিলের বর্ণনা নেই। এর কারণটি আগেই বলা হয়েছে। নিজেরা দেশত্যাগের মিছিলে অংশীদার না হলে এ চিত্র আঁকা যায় না। হিন্দি ও উর্দু লেখকেরা এই কারণেই অনেকটা এগিয়ে আছেন। আর একটা কারণও বোধ হয় আছে। বাঙালি কথাসাহিত্যিকরা অধিকাংশই উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হবার বেদনা অনুভব করেননি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু বা সমরেশ বসুর মতো লেখকদের জন্মভূমি ছিল পূর্ববঙ্গ। এঁদের অনেকেরই লেখাপড়াও সাঙ্গ হয়েছে এই অঞ্চলেই। কিন্তু ক্রমশই জীবিকা ও সাহিত্যচর্চার তাগিদে এঁরা দেশবিভাগের আগে থেকেই কলকাতার অধিবাসী। ক্রমশ কলকাতাতেই তাঁদের শিকড় ছড়িয়ে পড়েছিল। জমি-নির্ভর হিন্দু মধ্যবিত্তের জীবিকার সংকট ক্রমাগতই বাড়ছিল। চাকরির বাজার ছিল না বললেই হয়। অনেক জমি হস্তান্তরিত হচ্ছিল। তাছাড়া শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতার আকর্ষণও কিছু কম ছিল না। তাই এঁরা যখন দেশবিভাগ বা উদ্বাস্তুদের সাহিত্যের বিষয় করেন তখন তার মধ্যে থাকে নস্টালজিয়া, হারানো শান্তি ও মৈত্রীর স্মৃতি, বাস্তবে যা ছিল না, অথচ যা হলে সত্যিই ভালো হত— সেগুলির বর্ণনায় তাঁরা আবিষ্ট হলেন। দেশত্যাগের প্রধান কারণ যে দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং হানাহানি তা তাঁরা এড়িয়েও গেলেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পালঙ্ক’ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। হিন্দি বা উর্দু লেখকদের রচনায় এই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা নেই।
যে সমস্ত ঘটনা দেশবিভাগের সময় ঘটছিল নিজের স্ত্রীকে চিঠি লেখার সময় পোড় খাওয়া সেনাপতি লর্ড ইস্মে তার বর্ণনা দিয়েছেন এই ভাষায়, ‘It remains to me immaterial whether one hundred thousand or a million actually died or whether only 3% of the country is in turmoil. The essential facts are that there is a human misery on a colossal scale all around, one and millions are bereaved, destitute homeless, hungry, thirsty; worst of all, desperately anxious and almost hopeless about their future’ (উদ্ধৃতি, অমলেশ ত্রিপাঠী, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস)। এই ‘human misery on a colossal scale’ ফুটিয়ে তুলতে পারলেই বোধ হয় দেশবিভাগের ওপর রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাসটি রচিত হতে পারত। উদ্বাস্তু মিছিলের সঙ্গে পা মিলিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে না আসা কোনও লেখকেরই বোধ হয় এই মহাকাব্যিক বিস্তৃতি উপন্যাসে আনা সম্ভব নয়। আরও একটি কারণও বোধ হয় ছিল। বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের অধিকাংশেরই বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনা তাঁদের ধর্মের নামে হত্যা বা লুণ্ঠনের চিত্র আঁকায় উৎসাহিত করেনি। এই চিত্র আঁকতে গেলে সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়, মানবতাবোধের ওপরে ধর্মের নামে হানাহানি প্রধান বলে মেনে নিতে হয়। তাই এপার বা ওপার বাংলার ধ্বংসলীলাকে বাদ দিয়ে তাঁদের বেশিরভাগই এদেশে আগত উদ্বাস্তুদের দিকে তাকালেন। উদ্বাস্তুদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থনই প্রাধান্য পেল। যে কারণে এককোটির বেশি মানুষ কয়েকপুরুষের বাস্তুভিটা ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তাকে অস্বীকার করলে কোনও কাহিনিই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায় না।
দেশত্যাগের সবচেয়ে বড়ো কারণ তো নিশ্চয় এক সর্বগ্রাসী শূন্যতা বোধ, নিরাপত্তার অভাব। নিপীড়ন ও লুণ্ঠনের ভয় তো ছিলই, কিন্তু সবচেয়ে বড়ো বোধ ছিল একাকিত্ব, অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এটি সঠিক ভাবে ধরা পড়েছিল এক খ্যাতিমান ঐতিহাসিকের চোখে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও একটি সময়কে যে কাহিনিতে তুলে ধরা যায় তার নিদর্শনও তিনিই রাখেন। ঐতিহাসিকের নাম তপন রায়চৌধুরী। তাঁর অসাধারণ পরিহাসমিশ্রিত আত্মজৈবনিক রচনার ফাঁকে ফাঁকেই দেশবিভাগের স্বরূপটি ফুটে উঠছিল। উচ্চবর্গের বাঙালি হিন্দুর দেশত্যাগের কারণটিও স্পষ্টতর হচ্ছিল। গোটা গ্রাম বা গ্রামের মানুষের মানসিক অবস্থার বিবরণ দেওয়ার দরকার তপনবাবুর হয়নি। দেশভাগের মুহুর্তে তিনি নিজেদের, বিশেষ করে তাঁর পিতার মানসিক অবস্থাটি বর্ণনা করেছেন। যাকে ‘সংখ্যালঘু মানসিকতা’ বলা হয় তাঁর বর্ণনায় তা ধরা পড়ে, ‘আমরা বুঝলাম— পূর্বপুরুষের ভিটে এবার ছাড়তে হবে। ধর্মগত পার্থক্যের ভিত্তিতে যে নতুন রাষ্ট্র পত্তন হবে, সেখানে মুসলমান ভিন্ন অন্য সব সম্প্রদায়ের নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত হবেন, রাজনীতির যুক্তিতে এই কথাই দাঁড়ায়। তাছাড়া দাঙ্গার অভিজ্ঞতার ফলে নিরাপত্তা সম্বন্ধেও কিছুটা আশঙ্কা ছিল।’ ১৪ আগস্ট রাত বারোটায় পাকিস্তান ঘোষিত হল। কীর্তনখোলা নদীর ওপর ভিড় করা স্টিমার, লঞ্চ, মোটরবোট গম্ভীর ভেঁপু-নিনাদে নয়া রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা করল। চারিদিকে পাকিস্তানের হর্ষধ্বনি। ‘আমরা শুনেছিলাম সে রাত্রে দাঙ্গা হবে। বাড়িতে একটিমাত্র বন্দুক। সত্যই দাঙ্গা হলে ওই একটি অস্ত্র কি কাজে লাগত জানি না। বন্দুকটা হাতে নিয়ে বাবা সারারাত বসে থাকলেন। ১৯২০ সনে মানুষটি কলেজ ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার সাতাশ বছর পর আগস্ট মাসের এই অন্ধকার রাতে দেশ স্বাধীন হল। স্বাধীনতার রাতে বাবা কি করছিলেন আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করিনি। উনিও সে কথা আমাদেরও সম্ভবত বলেননি। (রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পর চরিত চর্চা)।’ এই ধরনের উপাদান তখন অনেক ছিল, এই ধরণের নির্বাক, বেদনাকাতর মানুষও ছিলেন অনেক। তাঁদের না বলা অনেক কথাও ছিল। কিন্তু সেই মানুষ অথবা তাঁদের অকথিত বাণী বাংলা কথাসাহিত্য পেল না।
আসলে এই বেদনাটা অনুভব না করলে লেখা যায় না। হাসান আজিজুল হক ১৯৫৪-তে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ববঙ্গে চলে গিয়েছিলেন, তাঁর সমগ্র কৈশোরটিই কেটেছিল এপারে, আর সেই স্মৃতি তিনি কোনওদিনই ভুলতে পারেননি, ‘তাই ওইদেশ থেকে আসার পর আমি যখন নিজের মনটাকে খুঁজতে গিয়েছি, তখন যে স্মৃতি, যে দেশ, যে প্রকৃতি মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা যে দেশটি ছেড়ে এসেছি, সেই দেশটিই।’ (কথা পরম্পরা : সাক্ষাৎকার শাহাদুজ্জমান) ওই সাক্ষাৎকারেই হাসান দেশবিভাগের স্মৃতিকে তাঁর মনের স্থায়ী ‘ক্ষত’ বলেছিলেন, ‘এ ক্ষতটি বোধ হয় চিরকাল আমার মধ্যে রয়ে যাবে।’ এই ক্ষত থেকে যাঁদের ক্রমাগত রক্ত চুঁইয়ে পড়ে, একমাত্র তাঁদের পক্ষেই বাস্তুত্যাগীর যন্ত্রণা বোঝা সম্ভবপর। এই ‘রক্ত চুঁইয়ে পড়া’ লেখা একেবারে নেই তা নয়। তার দু-একটি সম্পর্কে পরে আলোচনা করতে হবে। তার আগে দেশবিভাগের সূচনা পূর্বের বাঙালির মানসিকতাকেও বোঝা দরকার। ভারতবিভাগের সম্ভাবনা দেখা দেবার পর থেকেই সমগ্র এবং পশ্চিম ভারত বিশেষ করে পাঞ্জাবে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও তিক্ততার মাত্রা বাড়তেই থাকে, রক্তপাত আগে থাকতেই শুরু হয়ে যায়। রোয়েদাদ ঘোষণার পর তা এক ভয়াবহ রূপ নেয়। কিন্তু অবিভক্ত বাঙলার স্লোগান প্রাথমিক টেনশন থেকে বাঙালিকে কিছুটা মুক্ত রেখেছিল। যদিও নোয়াখালি বা ১৯৪৬-এর এহেন সংগ্রামের কাল থেকেই অবিশ্বাসের মাত্রা বেড়ে চলেছিল, তথাপি তা দেশজোড়া গৃহযুদ্ধের আকার নেয়নি। বরং প্রথম দিকে সাধারণ মানুষ দেশবিভাগ ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধিও করেনি। অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’ উপন্যাসের দু-একটি সংলাপে তা ধরা পড়ে—
‘শুনছেন মণ্ডল— দেশ ভাগ হতিছে।’
‘সে আবার কি?’
‘হাঁ, একভাগ হিঁদুর, আর একভাগ মোসলমানের।’
‘ভাগ কে করে? ইংরেজ? তার নিজের জন্য কি রাখবি?’
রামচন্দ্র হো হো করে হেসে উঠল
‘কী আবার রাখবি। মনে কয়, ঘাসের জমি পত্তনি দিতেছে।
মনে কয়, বিলেতে বসি খাজনা পাবি।’
রামচন্দ্র নিজে কিন্তু এক বড়ো চাষি। কেউ কেউ ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’-র করালীচরণের সঙ্গে তার তুলনা করেছেন। কিন্তু রামচন্দ্র নিজের জমিজমার পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে যতটা আগ্রহী, সামাজিক জোট বেঁধে উচ্চবর্গের কাজ থেকে মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে তাকে দেখা যায়নি।
কিন্তু দেশবিভাগ সম্পর্কে রামচন্দ্রের এই সংলাপের মধ্য দিয়েই অমিয়ভূষণ এদের সন্ত্রস্ত মানসিকতার কথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে সবার অলক্ষ্যে উপন্যাসে দেশভাগের বৃহত্তর পটভূমিকাও রচিত হয়। গড় শ্রীখণ্ড ওরফে চিকন্দী গ্রামে সান্যাল মশাইকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রীর যে প্রচেষ্টা হয় তা কলকাতার দাঙ্গার সংবাদে ব্যাহত হতে থাকে। শেষপর্যন্ত দেশত্যাগের ব্যাপারে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকে না। সকলেই দেশত্যাগের মহামিছিলে শামিল। অমিয়ভূষণ একে ‘শ্মশানযাত্রা’ আখ্যা দেন। খুব বড়ো মাপের ঔপন্যাসিকের ব্যাপ্তি নিয়ে তিনি পদ্মার ভাঙন ও দেশের ভাঙনকে এক সূত্রে মিলিয়ে দেন। অমিয়ভূষণ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, পদ্মাই তার কাছে একমাত্র নদী আর পদ্মা-বিধৌত জনপদই একমাত্র স্বদেশ। তাই তাঁর উপন্যাস শেষ হয় এইভাবে, ‘থেকে থেকে পদ্মার মুখ কালো হয়ে উঠছে, তখনো ফুলে ফুলে উঠছে তার বুক। উপরে ড ড ড করে মেঘ ডাকছে। পুরাণটা যদি জানা থাকে, হয়তো কারো মনে হতে পারে, কেউ যেন অন্য কাউকে বলছে, দয়া করো, দয়া করো।’ আসলে মানুষ যখন দয়া করে না, তখন পদ্মার কাছে দয়াপ্রার্থনা করা ছাড়া উপায় কি? হয়তো এই প্রাকৃতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়েই নতুন গড় শ্রীখণ্ড গড়ে উঠবে। এই পথেই দেশবিভাগকে কেন্দ্রে রেখেও উপন্যাসটি বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে।
আমরা উপন্যাস ধরে ধরে আলোচনা করছি না। আমরা কেবল সামগ্রিক ভাবে বাংলা কথাসাহিত্যে দেশবিভাগকে দেখার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের সন্ধান করছি। সূচনায় আমাদের বক্তব্য ছিল যে বাস্তুত্যাগীদের উৎস থেকে বিছিন্ন হবার বেদনা, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতার চিত্র তেমনভাবে উপন্যাসে ফোটানো হয়নি। তার কারণগুলিও আমরা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। তবে আলোচনার শেষপর্বে আমরা অন্তত তিনটি ব্যতিক্রমী উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে চাই। একটি হল একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’ অপর দুটি হল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ এবং ‘মানুষের ঘরবাড়ি’। এই উপন্যাসগুলিতে প্রাক্-দেশবিভাগ পর্বের পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলির সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক, দাঙ্গার পটভূমি, তার ভয়াবহ হিংস্র রূপ এবং দেশত্যাগের মিছিল— ঐতিহাসিক নিষ্ঠায় চিত্রিত। আর এই বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে ভিটেমাটি ছাড়ার নীরব বেদনা, হাসান আজিজুল হক যাকে বলেছিলেন ‘অদৃশ্য ক্ষত’। এই দুই লেখকই বাল্য বা কৈশোরে পিতামাতার হাত ধরে নিঃসম্বল অবস্থায় এদেশে এসেছিলেন। ওপারেও তাঁরা ভোগ করেছিলেন অসহায় যন্ত্রণা, পদে পদে মৃত্যুভয়, অনেক হত্যা ও লুণ্ঠনের তাঁরা সাক্ষী ছিলেন। আবার এপারে এসেও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, পুনর্বাসনের সংকট, জীবন ও জীবিকার সমস্যা তাঁদের ক্রমাগত ক্লান্ত করেছে। আবার যেহেতু তাঁরা সাহিত্যস্রষ্টা, সাংবাদিক বা রাজনীতিবিদ নন, তাই কেবল তথ্যনিষ্ঠা বা রাজনৈতিক প্রচারে তারা আগ্রহী ছিলেন না। কোনোরূপ তিক্ততা তাঁদের লেখায় ধরা পড়েনি, আবার কঠোর বাস্তবকে চাপা দেবার কোনও উগ্র প্রয়াস তাঁদের নেই। এখানেই দুজনের সাফল্য। তাঁদের রচনা এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত ও কালগত, অপরদিকে তা সর্বকালের লাঞ্ছিত মনুষ্যত্বের কাহিনি।
প্রফুল্ল রায় কেয়াপাতার নৌকো-র (প্রথম খণ্ড) ভূমিকায় জানিয়েছিলেন, পঞ্চাশ সালে উদ্বাস্তু হয়ে চলে এসেছিলেন। দেশবিভাগের বেদনা ‘আমার স্মৃতি এবং অনুভূতিকে তখনও তীব্রভাবে বিদ্ধ করে চলেছে।’ আর অতীনও ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র ভূমিকায় একই অনুভূতির কথা জানান, ‘যা লিখি, মনে হয় তার পরও লেখা বাকি থেকে যায়, সেই কবে বাবা কাকা-জ্যাঠার সঙ্গে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ কথা ভুলে এদেশে পদার্পণ। ছিন্নমূল জীবনে দেখেছিলাম একখণ্ড জমি, একটুখানি বাড়ি, একটুখানি আশ্রয়, একটুখানি আহারের জন্য জীবনের সর্বস্ব বাজি রেখে দুর্গম এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অভিযানে বের হয়ে পড়েছেন।’ তাই প্রায় একই মানসিকতা থেকে দুই উপন্যাসের জন্ম। ‘কেয়াপাতার নৌকা’ উপন্যাসের কাহিনির সূচনা উনিশশো চল্লিশের অক্টোবর। বারো বছরের বিনুর চোখ দিয়ে সময়কে দেখা এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। পার্টিশন তখনও অনেক দূরে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলা তখন অব্যাহত, তার ধাক্কা ভারতবর্ষে বিশেষ করে পূর্ববাংলার গ্রামগুলিতেও ক্রমাগত লাগছে। এর থেকেই আসবে মহামন্বন্তর, তার পরে যুদ্ধ-শেষ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ। বারো বছরের বিনু বাবা অবনীমোহনের সঙ্গে যেদিন রাজদিয়ার স্টিমার ঘাটে নেমেছিল সেদিন তাদের ঘিরে শুধু রাজনাথের পরিবারই নয়, সমস্ত রাজদিয়াতেই যেন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। আর বাইশ বছরের বিনুকে ‘রাতের অন্ধকারে, নিঃশব্দে সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হচ্ছে। নিরানন্দ নিরুৎসাহ এই বিদায় বিনুর বুক অসীম বিষাদে ভরে যেতে লাগল।’ এই দশ বছরে রাজদিয়ার পরিবর্তন আসলে গোটা পূর্ববাংলার গ্রামসমাজের পরিবর্তন। রাজদিয়ার দাঙ্গা, হেমনাথের সামাজিক আধিপত্যের অবসান, সবকিছুই ইতিহাসের দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। প্রফুল্ল রায়ের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি রাজদিয়া বা হেমনাথের পরিসরের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশত্যাগের কারণ ও বেদনাটির যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
‘কেয়াপাতার নৌকা’-য় যেমন বিনু ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-তে তেমনি সোনা। সোনার চোখ দিয়েই অতীন নদী নালা গাছপালা ঘেরা জন্মভূমির অনন্য রূপটি তুলে ধরেন। আবার তার পরিবার-পরিজনের সঙ্গে গ্রাম ছাড়া, হালিশহরের উদ্বাস্তু ক্যাম্প থেকে ক্রমাগত অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে পা-বাড়ানো সোনাদের অতীত ও বর্তমানকে একই সঙ্গে তুলে ধরে। বোঝাই যায় যে, বিনু বা সোনার অভিজ্ঞতা আত্মজৈবনিক উপন্যাসের চেহারা নিয়েছে। কিন্তু আগেই বলেছি যে, এ জাতীয় উপন্যাস কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংকীর্ণতায় আবদ্ধ নয়। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েও অতীনের ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র প্রতি বর্তমান আলোচকের কিছুটা দুর্বলতা আছে। কারণ, উপন্যাসটি কেবল ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-র পরিপূরকই নয়, দেশবিভাগের একটি সদর্থক পরিণতির ইঙ্গিতও এখানে আছে। এ যেন একটি উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের শিকড় অন্য উৎসে প্রোথিত করার চেষ্টা। ‘মানুষের ঘরবাড়ি’-র সমাপ্তিতে দেখা যাবে যে, সেই চেষ্টাই সফল হয়েছে। কোনও মানুষই শিকড় ছেঁড়া অবস্থায় থাকে না। তাই বিনুদের ছিন্নমূল পরিবার দুবছর ধরে নানা জায়গায় তাড়া খেতে খেতে শেষে প্রায় এক জঙ্গলের মধ্যে থিতু হয়ে বসে। এখানেই তাদের নতুন ঘরবাড়ি। ধীরে ধীরে ছেড়ে আসা গ্রামের স্মৃতি মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নতুন ঘরকে চিরকালের ঘর বলে মনে হয়। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’-তে যেমন সোনার চোখ দিয়ে সব কিছু দেখানো হয়েছিল এই উপন্যাসে সে দায়িত্ব পালন করেছে বিলু। বনে ঘেরা নতুন বাড়িতে গ্রীষ্মের দুপুরে বিলুর মনে হয়, ‘কত রকমের পাখির কলরব বাড়িটাতে। গাছপালায় ঘেরা এই বাড়িঘর দেখে কে বলবে, আমরা প্রবাসে আছি। আমরা ছিন্নমূল। দেশবিভাগের স্মৃতি আমাদের কাছে যেন অন্য জন্মের কথা।’ অতীত স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে এভাবেই ধূসর থেকে ধূসরতর হতে থাকে। কিন্তু ঘরবাড়ির টান থেকেই যায়।
এইভাবেই উপন্যাসটি দেশবিভাগের রাজনৈতিক দিকটিকে পিছনে ফেলে তাকে একটা দার্শনিক উচ্চতায় নিয়ে যায়। বিলুর বাবা বিলুকে বলেছিলেন, ‘মানুষের শেকড় একজায়গায় থেমে যায় না। সে যাযাবর। আজ এখানে আছে, কাল আর এক জায়গায়। বুঝতে পারি দেশবাড়ি ছেড়ে যেতে কষ্ট। ভাইবোন ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। পরে আর তা থাকবে না।’ এ যেন সর্বস্বান্ত এক প্রধান বাস্তুত্যাগীর নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেওয়া। শুধু নিজেকেই বা কেন! তাঁর সমকালীন বাস্তত্যাগীদের প্রতিও যেন তাঁর এই সান্ত্বনাবাক্য। এই সান্ত্বনাটুকু তো তাঁদের কেউ দেয়নি, তাঁরা নিজেরাই একে খুঁজে বের করেছিলেন।