অলকেশ দাস
এটা কোনও গল্প কথা নয়। সত্য কথন। ধুবুলিয়ার মাটিতে। যিনি বলছেন তার তিনকাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। হেমন্তের এই নিঃস্তব্ধ দুপুরে তিনি ডুব দিচ্ছিলেন স্মৃতির অতীত গভীরে। বলছিলেন সুখ-অসুখ মিশ্রিত এক উপাখ্যান। গত শতাব্দীর মধ্য পর্বের। ৭ দশক আগের ঘটনা যেন ছবির মতো তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। তাঁর প্রথম জন্মভূমি বরিশাল। বাকেরগঞ্জে। গ্রামের নামটি রুনসি। ঢাকার জমিদার আগা বাকের খান ৫০০ বছর আগে নিজের নামে এই বাকেরগঞ্জের পত্তন করেছিলেন। বাকেরগঞ্জের নিজের নামেই জেলা ছিল আগে। এখন উপজিলা। উথাল-পাথাল রাজনীতির অভিঘাতেই তাঁর শিকড়চ্যুত হওয়া। দেশভাগের সময় তাঁর শৈশব কাল চলছে। নোয়াখালির দাঙ্গাই বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তারপরেও প্রায় এক দশক কেটেছিল উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কা নিয়ে। আইনের তোয়াক্কা না করে সদ্য নতুন তৈরি হওয়া সীমানার সীমারেখা পেরিয়ে যাওয়ার হাতছানি পরিবারে ছিল। কিন্তু যখন দু-দেশের পাসপোর্ট চালু হয়েই গেল তখন গোটা পরিবার একেবারে পাসপোর্ট করেই নিল। তারপর মাইগ্রেশন। আর তখন পিছনে তাকানো নয়। বরিশাল থেকে সোজা খুলনা বর্ডার। খুলনা থেকে ট্রেন। বনগাঁ হয়ে শিয়ালদা। শিয়ালদায় নেমে ‘আর আর’ অফিসের খোঁজ। ‘আর আর’ মানে রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর। তখন জানতেন না। অনেক পরে জেনেছিলেন। ‘আর আর’ অফিসেই গণ্ডগোলটা বোঝা গেল। তাঁরা ছিলেন বাবা, মা আর তিন ভাই। আর ছিলেন দূর সম্পর্কের এক মাসিমা। দেখা গেল, মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট হয়েছে দু-টো। একটাতে বাবা-মা আর তার দুই ভাই। অন্যটাতে দূর সম্পর্কের মাসিমা এবং তিনি। ‘আর আর’ অফিসের কর্মীদের তখন দম ফেলার ফুরসত নেই। কলম চলছে যন্ত্রের মতো। বরাদ্দ হচ্ছে উদ্বাস্তুদের ঠিকানা। লাশ কাটা ঘরে যেমন সারি সারি মৃতদেহর কপালে নাম্বার পড়ে, তেমন আর কি। তার বাবা-মা আর দুই ভাইয়ের বরাদ্দ হল হাওড়ার ঘুসুড়িপাড়া ক্যাম্প। জুট মিলের গোডাউনের মেঝেতে। পার্টিশন করে করে এক এক পরিবারকে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেখানে। তারই এক খুপরিতে জুটেছে তার পরিবারের আস্তানা। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে জুটেছে বাবুঘাটের ক্যাম্প। দোতলায় কোণের এক ঘরে। অনাথ আশ্রমেই তৈরি হওয়া ক্যাম্প। এদিকে মা কাঁদছেন তাঁর সন্তান হারিয়ে। বাবার চোখেও জল। অসহায়তায় চোখ ঝাপসা হচ্ছে। দুই ভাই দিশেহারা। একখণ্ড শিলা দু-ভাগ হয়ে দু-দিকে। এদিকে আর এক জন। মায়ের আঁচলে মুখ গোঁজার সুযোগটুকু হারিয়েছে। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা। এ কোন অভিবাসী জীবনের ধ্বংসস্তূপে এসে পড়া! এ যেন এক সমান্তরাল পৃথিবী। ওদিকে নদীর নকশাকাটা গ্রাম। সারি সারি গাছ। শীতলপাটির মতো ছাড়া সুনিবিড় গ্রাম। এই পরবাসে সে গ্রামের গন্ধ মুদিয়ে দিচ্ছে চোখ। আর সে চোখ যখন খুলছে তখন চারিদিকে বিপুলসংখ্যক নিঃস্ব, ক্লিষ্ট মানুষ। এক হঠাৎ ঝড়ের দাপটে এলোমেলো হওয়া অজস্র জীবন। এরকম যখন চলছে তখন মনে হচ্ছে আর কোনও পথ নেই। আবার গ্রামের সেই চলতি কথা-আলো যেন তার গতি না হারায়। মনে আশা জাগাচ্ছে। পা ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করেছে গঙ্গার পাড় ধরে। দুর্বল শীর্ণ শরীর শত চেষ্টা করেও থামাতে পারছে না হাঁটা। এই করে চলে এল হাওড়া ব্রিজ। তিন ক্রোশ পথ হাঁটার পর এবার একে, ওকে জিজ্ঞাসা করার পালা। খুঁজতে খুঁজতে মিলে গেল ঘুসুড়ি ক্যাম্পের ঠিকানা। মা-ছেলের মিলনে জেগে উঠল ক্যাম্প। গোটা পরিবার বুঝে গেল এখনও হাঁটার পালা শেষ হয়নি। এই নতুন তৈরি হওয়া পৃথিবীতে অনুকূল কিছু থাকবে না। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নির্মাণে চোয়াল শক্ত করতে হবে।
এদিকে পরিবারের রেশন কার্ড ভাগ হয়ে দু-দিকে। বাবুঘাটের ক্যাম্পে আর ঘুসুড়িতে। এক জ্যাঠতুতো দাদা কাজ করতেন পুলিশে। তাঁর শরণাপণ্ণ হওয়া গেল। তাঁর সাহায্যে রেশন কার্ড এক জায়গায় হল। তারপর স্থানান্তর। শিয়ালদা থেকে ট্রেন করে একদম ধুবুলিয়া ক্যাম্পে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে মিত্রশক্তির ব্যবস্থাপনায় রেল লাইন প্রসারিত ছিল একেবারে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে। সেখানেই ট্রেন থেকে নামা। শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় জন্মভূমিতে পদচারণা।
১৯৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গার সময় থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল অভিবাসন। তখনও দেশভাগ হয়নি। দেশভাগের পরিণতির আঁচ যারা অনুভব করছিলেন তাঁরা পা বাড়িয়েছিলেন এই বাংলার দিকে। দেশভাগের পর তো আর কথাই নেই। দেশভাগের আগুনের ভগ্নস্তুপ থেকেই উদ্বাস্তুর জন্ম। ব্রিটিশরা সিরিল র্যাডক্লিফ সাহেবকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল ভারতে। ভারত-পাকিস্তান, বাংলা, পাঞ্জাব সীমানা কীভাবে ভাগ হবে তা ঠিক করতে। তিনি জানতেনও না কোথায় বাংলা, কোথায় বা পাঞ্জাব। ৩৫ দিন ভারতে থেকে ম্যাপের উপরে তাঁর অর্বাচীন পেন্সিল বুলিয়ে আমাদের দেশ ভাগ করে দিয়ে নিজের দেশে পালালেন স্বাধীনতার আগেই। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর মহকুমার বড়ো অংশ চলে গেল নদিয়া থেকে। নতুন জেলা কুষ্টিয়া ঢুকে গেল পাকিস্তানে। সেই থেকেই নদিয়ার ২৬৯ কিলোমিটার সীমান্ত। আন্তর্জাতিক সীমান্ত। আশায় বাঁচে চাষা। সেই আশায় কতদিন বুক বেঁধেছিল ওপার থেকে আসা মানুষগুলো। যাঁদের এপারে বাসা, ওপারে মন। তাঁরা বিশ্বাস করত দুই বাংলা আবার এক হবে। সেই বিশ্বাস তাঁরা ছড়িয়ে দিত পরের প্রজন্মে। এখন সীমান্তে ডালপালা গজানো লোহার খুঁটি আর কাঁটাতার ধীরে ধীরে সেই বিশ্বাসকে ভেঙে দিচ্ছে।
এদেশে যারা উদ্বাস্তু তারা কেউ শখে উদ্বাস্তু হয়ে যায়নি। আর উদ্বাস্তু হয়ে ওঠাটাও একদিনের নয়। ’৪৬ সালে নোয়াখালির দাঙ্গা। ওপার থেকে এপারে আসা। দেশভাগ। মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতায় ঢল এ বাংলায়। ’৪৮ – ’৫০ বরিশাল আর খুলনাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ওদেশ থেকে এদেশে লম্বা মানুষের স্রোত। ১৯৫৬তে পাকিস্তানের ইসলামিক সংবিধান গ্রহণ। ঘোর অমানিশার মতো আশঙ্কা গ্রাস করছে হিন্দুদের। অস্তিত্ব আর সম্মানের। জীবন সুনিশ্চিত করার তাগিদে তাঁদের এ বাংলায় আগমন। একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। রাজাকার বাহিনীর বীভৎস অত্যাচারের পর তাদের পরাজয় হতে পারে মানুষ ভেবে উঠতে পারেনি। হু হু করে মানুষ ঢুকেছে এই বাংলায়। ‘৭৫-এর মুজিব খুন ও পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের শাসনকালেও বাংলাদেশি হিন্দুদের এক অংশ আস্থা রাখতে পারেনি। সীমানা তাদের বাধা হতে পারেনি। হজরত বালের ঘটনার পরেও কিছু মানুষ এসেছে এই বাংলায়। ‘৯২-এর বাবরি মসজিদ উৎপাটনের ঘটনায় মৌলবাদ তার থাবা বসিয়েছে বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর। অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে অভিবাসনে। এই ভাবেই এই বাংলায় উদ্বাস্তুদের স্তর তৈরি হয়েছে।
ধুবুলিয়ায় দেশভাগের পর যারা এসেছিল তাদের ঠাঁই হয়েছিল সেনা ব্যারাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হওয়া। মিত্র শক্তির সেনাবাহিনীকে সেই সময় ব্রিটিশরা প্রস্তুতির সুযোগ দিয়েছিল। তাদের থাকার জন্য ব্যারাক, তাদের বন্দুক অনুশীলনের জন্য চাঁদমারি, তাদের অফিস, বিমান ওঠানামার জন্য রানওয়ে। আর এই পরিকাঠামো তৈরি করবার জন্য সেই সময় ব্রিটিশরা জমি অধিগ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্ব শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনী ফিরে গেলে এই পরিকাঠামো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। উদ্বাস্তুদের থাকার জন্য সেই পরিকাঠামো কাজে লেগে গেল। প্রথম যারা এল তারা যে ক্যাম্পে ঢুকল তাকে বলা হল ‘ওল্ড ক্যাম্প’। পাঁচের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে যে উদ্বাস্তুরা এখানে জায়গা পেল তাদের ক্যাম্পকে বলা হল ‘নিউ ক্যাম্প’। ১৯৫১ সালের জনগণনায় নদিয়ার জনসংখ্যার ৩৭.৩ শতাংশ ছিল উদ্বাস্তু। ১৯৫৮ থেকে ‘৭১ রাজ্যে যে উদ্বাস্তু অভিবাসন হয় সংখ্যায় জেলার বিচারে নদিয়া তৃতীয় ছিল। পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের কাছে নদিয়া পছন্দের এই কারণে ছিল যে তার নিকটবর্তী মুশিদাবাদ এবং মালদহে মুসলিম জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। তুলনামূলকভাবে নদিয়ায় মুসলিম সংখ্যালঘু জনশতাংশ কম ছিল। দেশ ভাগ হওয়ার আগে থেকেই পূববাংলার মানুষের আসার চল ছিল রানাঘাট, ফুলিয়া, শান্তিপুর, নবদ্বীপে। গঙ্গাস্থানে, মনসা পুজোয়, পৌষ পার্বণে, চৈত্র সংক্রান্তি ও বহুবিধ মেলা ইত্যাদিতে। জলপথে, স্থলপথে। এসব দেখে যশোরের জমিদার যশোর থেকে চাকদহ পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছিলেন রাস্তা। ওপার থেকে নদিয়াতে আসার কারণও ছিল সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতির মেলবন্ধন।
ধুবুলিয়া ছিল নদিয়ার উদ্বাস্তুদের সবচেয়ে বড়ো ক্যাম্প। প্রায় ৭৫ হাজার উদ্বাস্তুর মাথা গোঁজার জায়গা। সাড়ে বারো হাজার পরিবার। যে জায়গায় তাদের আস্তানা হল সেখানকার বড়ো সুবিধা হল জায়গাটা সরকার অধিগৃহীত। ফলে অন্য কোনও জনবসতি নেই। অন্য জায়গায় যেমন এদেশি মানুষ এবং উদ্বাস্তুদের আবেগ আর স্বার্থের সংঘাত ছিল— এখানে তার সুযোগ ছিল না। সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় সংঘাতের অবকাশও ছিল না। বরং উলটো। আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে যেখানে মুসলিম বসতি ঘন সেখানে ভয়ের আবহাওয়া ছিল। উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে দাপাদাপি এতটাই ছিল। সত্য মজুমদার বলে একজন নেতা ছিলেন। প্রকারান্তরে বোঝাতে চাইতেন তিনি কতখানি উদ্বাস্তুদের হিতৈষী। নিজেকে বলতেন টাইগার অব ধুবুলিয়া। কথায় কথায় দাঙ্গা বাঁধাতেন। প্ররোচনা দিতেন উদ্বাস্তুদের। মুসলমান এলাকায় আগুন লাগিয়ে তাদের জন্য ভয় তৈরি করতেন। উদ্বাস্তুর ভয় দেখিয়ে মুসলমানদের জমি জোর করে দখল করে রাখতেন। কিছু মুসলমান ভয় পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলেও গিয়েছিলেন। কিছুদিন থাকার পর সেখানে আর মন টেকেনি। আবার ফিরে এসেছে নিজের দেশে। সম্প্রীতির নতুন গাথা তৈরি হয়েছে।
ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুদের একটা সুবিধা ছিল। ছিল না পুরনো বাড়ি দখল করার প্রয়োজন। ছিল না ধনীদের কিনে রাখা জায়গার দখলের কিসসা। কিংবা রাজার কিনে রাখা এস্টেট। ছিল না পালটা লেঠেলের হুজ্জতি বা উচ্ছেদের মামলা। ছিল না বাঁকা দৃষ্টি উপেক্ষা, গঞ্জনা। অন্তত স্থানীয় মানুষের। কারণ ধারে কাছে তখন কোনও মানুষ ছিল না। বরং ছিল পুরনো পরিত্যক্ত সেনা ছাউনিতে নিজের ভাগ্য নিজ হাতে গড়ে নেওয়ার তাগিদ। সত্যিই তারা তখন বাঁচতে চেয়েছিল। সরকার ডোল, ক্যাশডোল দেয়। দেয় বাড়ি তৈরি করার লোন। সেটাই সম্বল। চোখের কোনায় হলুদ পিচুটি আর তেল না পাওয়া লাল চুলের রুক্ষ মানুষগুলোর সঙ্গে ছিল উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতারা। তিন ইঁট পাতা কাঠের উনুন, কোনোমতে বাঁচার জন্য খাওয়া, জীবন্ত নরকের মতো উদ্বাস্তু শিবিরে অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করতে হত উদ্বাস্তুদের নিজেদেরই। সরকার মেয়েদের যে কাপড় দিত তা ছিল লম্বায় আট হাত। সম্মানের ঘোমটা টানলে পিছনে কাপড় থাকত না। ছেলেদের জন্য সরকার যে পোশাক দিত তা পড়লে মনে হত যেন ঢোল্লা জার্সি। দেখলে যে কেউ উদ্বাস্তুকে চিহ্নিত করতে পারত। অন্ধকার, শিয়ালের ডাক আর বর্ষায় সাপের ভয় নিয়ে দিন গুজরান ছিল উদ্বাস্তুদের। মাথায় টিনের ছাউনি। গরমকালে টিনের উত্তাপ টিঁকতে দিতো না উদ্বাস্তুদের ঘরে।
নিদারুণ খাদ্য সংকটে বিকল্প পথ খুঁজেছে ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুরা। মানকচু, কচুর লতি, হিংচে শাক, শামুক, গুগলি এ-রকম অসংখ্য খাবার খাদ্যতালিকায় যুক্ত করেছে তারা। পকেটে কোনও পুঁজি নেই। অর্থ উপার্জনের কোনও রাস্তা নেই। ডোল দিয়ে পরিবার চলে না। ধূপকাঠি, কাগজের ঠোঙা, আচার তৈরি করা, লোকের বাড়ি বাড়ি আর রাস্তায় ফেরি করা ছাড়া উপায় ছিল না। পেট চালানোর তাগিদে গোরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন কিংবা ট্রেনে ঝালমুড়ি, চানাচুর, বাদাম ভাজা ইত্যাদি বিক্রির চল এদের হাত ধরে। রেলে হকারি শুরু করে উদ্বাস্তুরাই প্রথম। খেজুর রস, তালের শাঁস, নিমপাতা, নিমের ডাল, শালুক ফুল, ডাঁটার উপকরণে সাজানো ভান্ডার নিয়ে যখন উদ্বাস্তুরা এদেশি মানুষের বাড়ি বাড়ি যেত তখন সকলে অবজ্ঞার হাসি হাসত। পরে সেগুলোই তারা আপন করে নিয়েছিল। সকালে উঠে ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু মানুষ তৈরি করত লাল চা। কারণ দুধ জোটানোর সামর্থ্য ছিল না। দুধে পড়ত খানিকটা ভেলি গুড়। তারমধ্যেই দুটো রুটি গুঁজে সকালের পেট ভরাত ছিন্নমূল মানুষ। জ্বালানি জোগাড়ের অবস্থাও ছিল না। তখনকার চলতি আবরু ভেঙে মেয়েরা ট্রেনে করে চলে যেত কাঁকিনাড়ায়। সেখান থেকে নিতো কম পয়সার কয়লার গুঁড়ো। বাড়িতে নিয়ে এসে কাদা আর গোবর দিয়ে মাখিয়ে, শুকিয়ে তৈরি করত গুল। গুঁজে দিত উনুনে। এইভাবে গড়ে উঠতো গ্রাসাচ্ছাদনের উপায়।
১৯৫০ সালের ৭ জুলাই এর রিপোর্টে দেখা গেল ধুবুলিয়ার ক্যাম্পে ৬৮৫ জন উদ্বাস্তুর মৃত্যু হয়েছে। ২৭৭৩ জন অসুস্থ হয়েছে। অসুস্থতার মূল কারণ টাইফয়েড, কলেরা। তার কয়েক মাস পরে ১৯৫০-এর অক্টোবরে রাজেন্দ্রপ্রসাদ এসেছিলেন ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু ক্যাম্প পরিদর্শনে। বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলায়। আশ্বাস দিয়েছিলেন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের। তারপর গড়ে উঠেছিল রিফিউজি কলোনি হসপিটাল। একজন এম বি বি এস ডাক্তার। সেখানে লম্বা লাইন পড়ত ধুঁকতে থাকা উদ্বাস্তুদের। কোনোমতে বেঁচে যাওয়া মানুষের আকাঙ্ক্ষার অন্ত ছিল না। ছিল অদম্য শিক্ষার তাগিদ। উদ্বাস্তুরা নিজেরাই টিন, বাঁশ জোগাড় করে একের পর এক গড়ে তুলল প্রাইমারি স্কুল। অশ্বিনী বিদ্যাপীঠ, নেতাজি বিদ্যাপীঠ, রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠ, বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ, বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ, মদনমোহন বিদ্যাপীঠ, সরোজিনী বিদ্যাপীঠ………। উদ্বাস্তু দপ্তরের কর্মীরাই হয়ে গেল শিক্ষক। তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরাও এখানে ছাত্রছাত্রী। ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, রংপুর সব এখানে এক হয়ে গেল। পূর্ববঙ্গকে ছেড়ে এলেও পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতিকে ধরে রাখল ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুরা। এক মাস ধরে ব্রত পাঠ চলত মনসামঙ্গলের। বরিশালের কবি বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’ নামে মনসামঙ্গলের কাহিনি। শুরু হত আষাঢ় মাসের শেষ দিনে। শ্রাবণের শেষ দিনে হত পুজো। ক্ষণে ক্ষণে মেয়েদের উলুধ্বনি শোনা যেত। বেহুলা লখাইয়ের লোহার বাসর। বিশ্বকর্মার তৈরি করা হলে কি হবে মনসা তাকে নিশ্ছিদ্র হতে দেয়নি। সর্প দংশনের পরেও লখিন্দরকে বেহুলার বাঁচিয়ে আনার গল্প শুনত সকলে একজোট হয়ে। ছিল কৃষ্ণলীলা। ছিল এখানে ওখানে রাম যাত্রার আসর। রামের গলার মালা নিলাম হত। দাম উঠত। যে বেশি দর হাঁকত তার গলায় মালা উঠত। ছিল সত্যনারায়ণের পুজো। সিন্নি বিলি করা। ধান ও কড়ির স্ত্রী আচার। হাজারো আচার-আচরণ, ব্রত, পুজো-পার্বণ। ছিল মতুয়ারা। হরিচাঁদ ঠাকুরের নামে প্রেমে মাতোয়ারা যারা। নিম্নবর্গীয় মানুষের মতুয়া মন্দিরও গড়ে উঠেছিল। জাতি, বর্ণ, বিশ্বাসগত বিভেদের ঊর্ধ্বে ছিল তাদের মত। ডঙ্কা আর কাঁসরের তীব্র ধ্বনি দিয়ে তারা তাদের অস্তিত্ব জাহির করত। সঙ্গে ছিল হরিবোল ধ্বনি। মতুয়া সংগীত, পদগীতি চাপান-উতোরের কবিগান। এরই মাঝে যাত্রা টিম তৈরি হয়েছিল অনেকগুলো। থিয়েটার করার সাহসও তৈরি হল এইভাবে। গড়ে উঠল দল। ডোলের উপর নির্ভর করা মানুষের কাজ যখন থাকে না তখন অবসরের সময়ে চলে তাস খেলা। যুবকরা যাতে বেপথু না হয় তার জন্য বড়োরা তাদের উৎসাহিত করে ফুটবল খেলায়। তৈরি করে দেয় খেলার মাঠ। এই ভাবেই গড়ে ওঠা দেশবন্ধু স্কুল মাঠ, রেজিস্ট্রেশনের কাছে ইয়ং স্টারের মাঠ, খাপছাড়া ক্লাবের মাঠ, রামকৃষ্ণ ক্লাব প্যারেড গ্রাউন্ড। সকালে বিকালে মাঠে নামে যুবকের ঢল। এলাকায় তৈরি হয়ে যায় ব্যায়াম চর্চার কেন্দ্র।
১৯৫১-য় বিধানসভায় পাশ হয় এভিকসন বিল। উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদের। বামেরা আপত্তি করা সত্ত্বেও বিধানসভায় পাশ হয়ে যায় সেই বিল। ১৯৫৭ মার্চের সেই আইনের মেয়াদ শেষ হয়। তার পুনর্নবীকরণের জন্য ১৯৫৭ সালে আনা হয় বিধানসভায় সংশোধনী বিল। বিধানসভার বাইরে পঞ্চাশ হাজার উদ্বাস্তু জমায়েত হয়। ইউ সি আর সি-র প্রতিবাদের সেই জমায়েতে ধুবুলিয়া থেকে উদ্বাস্তুরা গিয়েছিল শান্তিপুর হয়ে। তার আগে উদ্বাস্তু দপ্তরের কর্মীদের খামখেয়ালিপনা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল ধুবুলিয়ার মানুষ। ১৯৫৪ সালে নদিয়ার কল্যাণীতে ৫৯তম নিখিল ভারত কংগ্রেস অধিবেশনে ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করেছিল কংগ্রেস। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শ্রী অজিত প্রসাদ জৈন দু-বার ধুবুলিয়া পুনর্বাসন ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন জলঙ্গির নদী পথে। সেই সময় সরকার উদ্বাস্তুদের যে ডোল দিত তাতে থাকত ১৫ দিনে একজনের জন্য দু-সের চাল, দু-সের গম বা আটা। ক্যাশ ডোল ছিল চার টাকা ন আনা। সুরেশ রায় বলে একজন আসতেন ধুবুলিয়ার মানুষের মধ্যে। উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইতেন— দু-সের চাল, দু-সের আটা/ চার টাকা ন আনায় দিন চলে/ দুঃখে আছি— ভাই রে ভাই, কে বলে? তাঁর এই তীব্র শ্লেষ দাগ কাটত গভীরভাবে উদ্বাস্তু মনে। মুসিয়ার সেই সম্পাদক ছিলেন সেলুলার জেলখাটা স্বাধীনতা সংগ্রামী অমৃতেন্দু মুখার্জি। সবাই গদাদা বলে জানত। ধুবুলিয়া থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দিতেন। ২০০০ মানুষ জলঙ্গি পেরিয়ে কালেক্টারিতে আইন অমান্য করতে যেত। বঞ্চনার বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য ভাতা, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য গৃহঋণ। কেন হবে? দেড়লক্ষ কৃষিজীবী উদ্বাস্তু মানুষের জমির দরকার ছিল তিন লক্ষ একর। সরকার বরাদ্দ করেছিল পনেরো হাজার একর। ১০ লক্ষ মানুষের জন্য দরকার ছিল ২ লক্ষ বাড়ি। সরকার দিয়েছিল কুড়ি হাজার বাড়ি। এরকম হাজারো বঞ্চনার উদাহরণ তাদের হাতে ছিল। পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষের সমস্যাকে কেন্দ্রীয় সরকার অস্বীকার করতে চেয়েছিল। বলেছিল যারা মাইগ্রেশন নিয়ে এসেছে, তারা পুনর্বাসন পাবে না। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের বক্তব্য ছিল, আর যে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সুতরাং উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন হবে না। ১৯৫৮ সালে সরকারি রিলিফ ক্যাম্পে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সরকার বার্তা ছড়ায়— রাজ্য ছেড়ে দণ্ডকারণ্যে যেতে হবে। সরকার ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। বলে যারা যাবে না তাদের ডোল, ক্যাশ ডোল বন্ধ হয়ে যাবে। তারা কোনওদিন সরকারি পুনর্বাসন পাবে না। বাড়ি বাড়ি উদ্বাস্তুদের ঘন ঘন উপস্থিতি নেওয়া শুরু হয়ে যায় উদ্বাস্তু দপ্তর থেকে। কাউকে অনুপস্থিত দেখলেই তার ডোল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৪৫ হাজার উদ্বাস্তু পরিবার চিহ্নিত করে বলা হয় তাদের মধ্যে ১০ হাজার বাংলায় থাকবে, বাকি ৩৫ হাজার দণ্ডকারণ্য যাবে। সরকার তাদের মুঠো এতটাই শক্ত করে যে, নিদান দেয় ১৯৫৯ সালের ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে সমস্ত ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। ইউসিআরসি সরকারের এই শর্ত মানে না। তারা বলে যে উদ্বাস্তু স্বেচ্ছায় দণ্ডকারণ্য যাবে তাকে ছাড়া অন্য উদ্বাস্তুদের জোর করে দণ্ডকারণ্যে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পালটা অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করে তারা। জোর করে দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন তৈরি হয় বিহারের বেতিয়ায়। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তার ছাপ পড়ে নদিয়ায়। সারা রাজ্য জুড়ে উদ্বাস্তুদের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যে ৩০ হাজার মানুষ গ্রেফতার হন তাদের মধ্যে অনেকেই নদিয়ার, ধুবুলিয়ার। তাদের বক্তব্য ছিল পাথুরে, রুক্ষ দণ্ডকারণ্যে যাব না। মানুষ যাতে আর আন্দোলনে এগোতে না পারে তার জন্য সরকার ঘোষণা করে যে উদ্বাস্তুদের পুলিশের খাতায় নাম থাকবে তাদের আর ডোল দেওয়া হবে না।
দেশভাগ, বাংলা ভাগে কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলো চলে যায় নদিয়া থেকে ওপার বাংলায়। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া। এপারে যে দু-টি মহকুমা কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাট — তারা অন্তত কৃষিপ্রধান ছিল না, ছিল শহরকেন্দ্রিক মহকুমা। নদিয়ায় ছোটোবড় খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ লেগেই থাকে। এরই মধ্যে ১৯৬৯ সালে খাদ্য সংকট তীব্র হয়। হু হু করে চালের দাম বাড়ে। ভুখা মিছিলে শামিল হয় ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুরা। তার আগে ১৯৬৫তে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ। তারপর ৬৫-৬৬তে ভয়ানক খরা। খাবার নেই। খাবার আছে তো দাম অনেক। দিনমজুরিতে পায় দু থেকে তিন টাকা। অথচ চালের কেজি পাঁচ টাকা। মাধ্যমিক শিক্ষকেরা তখন মাস মাইনে দেড়শ টাকা পেত। মানে দিনে ৫ টাকা। অথচ চালের কেজি ৫ টাকা। ১৯৬৬ সালের ৪ঠা মার্চ কৃষ্ণনগরে ছাত্ররা খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করে। পুলিশ গুলি চালায়। আনন্দ হাইত খুন হয়। খুন হয় রাজশাহী থেকে নদিয়ায় আসা হরি বিশ্বাস। প্রথমে আহত তারপর মৃত্যু হয় অর্জুন ঘোষের। ছাত্ররা গিয়েছিল ধুবুলিয়া থেকে ওই মিছিলে। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে খাদ্যের দাবিতে ধুবুলিয়া স্টেশনে ৫১ উদ্বাস্তু মানুষ রেল অবরোধ করে। প্রতিবাদে অভ্যস্ত ছিল ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুরা। একবার সব ছিলেন একজন কমান্ডার। অধীপ মুখার্জি। সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা সাধারণের মধ্যে আরোপেতে বিশ্বাসী ছিলেন। যুবকদের প্রতি তার নির্দেশ ছিল সন্ধ্যাবেলায় কেউ যেন বাইরে না থাকে। রাস্তায় যেন কোনও জটলা না থাকে। সন্ধ্যার পরে কিছু যুবককে রাস্তার বাইরে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অধীপ মুখার্জি তাদের গ্রেফতার করে। গোটা ক্যাম্পের মানুষ অধীপ মুখার্জিকে ঘিরে ধরে যুবকগুলির মুক্তির জন্য। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী চলে আসে অধীপ মুখার্জীকে উদ্ধার করবার জন্য। ছত্রভঙ্গ করে দেয় আন্দোলনকারীদের। কিন্তু শেষ অবধি যুবকদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেষ অবধি কমান্ডার অধীপ মুখার্জিকেও বদলি হতে হয়। ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু মানুষদের প্রতিবাদী, প্রতিরোধের এরকম অজস্র কথন ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।
ধুবুলিয়ার জনপদ, ধুবুলিয়ার মানুষ আর সেই জায়গায় নেই। পূর্ববঙ্গীয় ভাষাকে ধরে রাখার পরিবারের মধ্যে যে তার না তা এখন নেই বললেই চলে। ধুবুলিয়ায় গড়ে ওঠা উদ্বাস্তু মানুষ প্রতিষ্ঠা পেয়ে চলে গেছে বাইরে। এমন লোকের সংখ্যা কম না। যাদের পুনর্বাসন হয়নি, জমি তো সরকারিভাবে তাদের নয়। তবুও সেই মাটিতে গড়ে তুলেছিল ভিটে, যত্নের বাগান, তুলসী তলা, ঠাকুরের ঘর, রান্নার জায়গা, ছোটো গোয়াল ইত্যাদি। কখনও তাদের মনে হয়নি — পরের জায়গা, পরের জমি, ঘর বানাইয়া আমি রই/ আমি তো সেই ঘরের মালিক নই। বাম সরকারের সময়ে ‘৮৭ সালে রাজ্যে যে ৬০৭টি কলোনির স্বীকৃতি মেলে তার মধ্যে কয়েকটি ধুবুলিয়ার ছিল। পরে সরকার যে ৯৯৮টি কলোনির স্বীকৃতির জন্য কেন্দ্রের কাছে পাঠায় তার অনুমোদন হয়নি। এখনও এই ধরনের কলোনি ধুবুলিয়াতে আছে। ডোল পাওয়া পরিবার কয়েকটি এখনও ধুবুলিয়ায় রয়েছে। একেবারে প্রথম দিকে উদ্বাস্তু হিসাবে এখানকার ক্যাম্পে আসা বেঁচে থাকা মানুষ এখন এখানে হাতে গোনা যায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা স্মৃতির ঝাঁপ খুলে দেন। কিন্তু স্মৃতি যে ঝাপসা। কখনও তার মধ্যে থাকে অতিরঞ্জন, অতিকথন। এখনও পূর্ববঙ্গের স্মৃতিমেদুরতা কী ভীষণ তাদের মধ্যে কাজ করে! চার কুড়ি বছর পেরনো এরকম একজন শান্তি রঞ্জন দাস। উদ্বাস্তু আন্দোলনের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। খাদ্য আন্দোলনের সময় ৪৮ ঘণ্টা বাংলা বন্ধে দোকান বন্ধ করতে গিয়ে পুলিশের ফাঁদে পড়ে জেলে ঢুকতে হয়েছিল। উত্তাল সাতের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তার বাড়ি পোড়ানো হয়েছিল। তিনি আক্ষেপ করছিলেন যে সম্প্রীতির বিস্তৃতির জন্য বহুমুখী কর্মধারা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন তা আজ ভিন্ন খাতে। ধর্ম উন্মাদনা বাড়ছে। এক ধর্মে থেকে অন্য ধর্মকে ঘৃণা করার প্রবণতা বাড়ছে। যে ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু মানুষ নিজের অধিকারের জন্য, জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য অসম লড়াই করেছে সে এখন মিথ্যা নাগরিকত্বের লোভের মধ্যে। বাইরের জাঁকজমক বেড়েছে, ভিতরে বেড়েছে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা। আন্তরিকতার জায়গা নিয়েছে চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক। আগে পরিবারে তাড়না ছিল পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতি ধরে রাখার। অন্তত ঘরের মধ্যে ফেলে আসা দেশের ভাষার চল রাখা গিয়েছিল। ধীরে ধীরে তাও উধাও হয়েছে। ছিন্নমূল পূর্বসূরির ছেঁড়া শিকড়, নতুন শিকড়ের সন্ধানে এই ভূমিতে যে লড়াই, তার থেকে ক্রমশ বিস্মৃত হচ্ছে আজকের প্রজন্ম। পূর্ব স্মৃতি জাগরিত করবার শক্তিও দুর্বল। সারা দেশেই যখন চলছে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার বা ঘুরিয়ে দেওয়ার যজ্ঞ, ধুবুলিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়।