সঞ্জীব দাস
সে-দিন চলার পথে কর্ণগোচর হল জনৈক হিন্দিভাষী ফুচকাওয়ালার উত্তপ্ত ভাষণ : “সালে সভি ল্যগ বাংলাদেশি হ্যায়। সভিকো বাংলাদেশ জানা হোগা। ইসি লিয়ে এন আর সি তো হোগাহি।” এই হিন্দিবাদী ভারতবর্ষে বাঙালির ধূসর ভবিষ্য আঁচ করে মনটা ভারি হয়ে এল। আর তখনই অনেকদিন পূর্বে শোনা প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মর্মস্পর্শী একটি গানের কলি আমার ব্যাকুল মনের কোণে উঠে এল :
“দুজনে বাঙালি ছিলাম
দেখরে কি কাণ্ডখান...
তুমি এখন বাংলাদেশি
আমারে কও ইন্ডিয়ান।”
অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ১৯৪৭-এর আগস্ট মাসের ১৪-১৫ তারিখের আগেও তো বাংলাদেশ অখণ্ড ছিল। সুখে-দু:খে আমরা হিন্দু-মুসলমান তো ভালোই ছিলাম। মনে পড়ল শাহ আবদুল করিমের সে-ই স্মৃতিময় উচ্চারণ :
“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম।
হিন্দু বাড়িতে যাত্রাগান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
কে হবে মেম্বার
কে হবে গ্রাম সরকার
আমরা কি তার খবর লইতাম৷”
কবি আবদুল করিমের এই উক্তির শরীরে অনুস্যূত হয়ে আছে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের সহজিয়া জীবনের এক স্নিগ্ধ চিত্র। এই যাপনকথা যে অনৃতভাষণমাত্র নয় তা বাস্তব অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা জানেন। এরকমই একটি অভিজ্ঞতা এখানে আখ্যানের আদলে তুলে ধরা হল :
“শীতের আধো আধো আলোয় মোড়া দুপুরে মাদুরের উপর কাঁথার ওম নিতে নিতে কথা বলছিল অশীতিপর সুনীতিবালা ও তার দুই নাতি-নাতনি। নাতির নাম গোপাল, সুনীতিবালার উচ্চারণে ‘গুবাল’; আর নাতনির নাম রাখি।
নাতি গোপাল হঠাৎ বলে উঠল, দিদা দেশের কথা তোমার খেয়াল আছে?
সুনীতিবালা: ক্যান থাকবে না? আমাদের দ্যাশ পূর্ব পাকিস্তেন।
গোপাল: মানে বাংলাদেশ?
সুনীতিবালা: কেডা জানে! খুলনে জিলায় বাড়ি।
রাখি: ও বুড়ি তুমি বাঙাল! খুলনা বলো। তা না খুলনে!
সুনীতিবালা: ধুর ছেমরি। খুত ধরবিনে। বড়ো ফাজিল তুই।
গোপাল: দিদা ছাড়ো ওর কথা। তোমার দেশের কথা বলো। শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে।
সুনীতিবালা বলতে শুরু করে, দেশের কথায় তার দু চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে: আমরা ছিলান ঢাকার পোলাপান। তিন ভাই এক বুন। বিয়া হইছিল খুলনে। আমার স্বামী ছিলেন খুলনের জমিদারের দ্যাওয়ান। বিশ্বেস মশাই বইল্যা হক্কলে ডাকত। শ্রদ্ধা করত খুব। বিয়ার সময় আমারে পাল্লায় বসাইয়া সোনা দিয়াছিল বাবা। দ্যাশের বাড়িতে হিদু ও মোছলমান দুই-ই ছিল। তবে আমাদের গ্রাম ছিল হিন্দু প্রধান। আমরা উচ্চবর্ণের হিন্দু। কায়েত। তা-ই মোছলমানদের ছোঁয়া বাচাইয়ে চলা হইত। নমোদের আমরা ছুঁইতাম না।
গোপাল: এই মোসলারা খুব বদমাশ!
সুনীতিবালা: না না।
গোপাল: ওরাই তো মেরে তাড়িয়েছে তোমাদের।
সুনীতিবালা: সে কথা সইত্য। কিন্তু সব্বাই খারাপ কেন হইব? ওসব দুষ্ট লোকের কাম। খান সেনারা ওসব ঘটাইছিল। এমনিতে ওহানের মোসলারা খুব ভালো। তোর দাদুরে ওরা তো ভগবানের মতো মান্যি করত। আমার ছোটবেলায় এক বুড়ি আমারে মেয়ে ডাকছিল। নাম আমিনা। নিজের হাতে কইরা দুধ দুই্যা আমার তরে লইয়্যা আইত। তবে মা ঘরে ঢুকতে দিত না।
রাখি: ও বুড়ি দুধ খাবা। তার বেলায় জাত যায় না। আর বাড়িতে ঢুকলেই জাত যাবে?
গোপাল: এই জন্যই তোমাদের তাড়িয়েছে। তাই তো?
সুনীতিবালা: ওমা। কী কস? এ তো সেকালের নিয়ম ছিল। নমো আর মোসলা চাষিরা জমিতে চাষ করত। মাছ যারা ধইরত তারাও নমো আর মোসলা। ওদের বসতি দিত বাহির বাটিতে। খাতি দিত মাটির পাত্রে। ওরা চলি গেলি কাজের লোক ওগুলি ফেইল্যা দিয়া নদীতে স্নান করি বাড়ি ফিরত। তবে কেউ মনে কিছু করত না। সামাজিক বিধান হিসেবে সবাই নতমস্তকে মানি চলত।
গোপাল: এত প্ল্যান করে অপমান। এরকমটা করেছ বলেই ওদের মনে ধীরে ধীরে রাগ জমেছিল। জিন্নার দলবল এটাকেই কাজে লাগিয়েছে।
রাখি : বুড়ি তবে এলে কেন?
সুনীতিবালা: আসতে কে চাইছিল? বাপদাদার জমি! ও কত জমি, পুকুর, বাগান। ভাবলি চোখে জল আহে। শোনলাম ব্রিটিশেরা চলি যাবে। ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবে। তারপর শোনলাম পূর্ববাংলা নাকি পাকিস্তানে পড়বে। সেকি উদ্বেগ! মোসলাদের অনেকেরই ভাবসাব বদলে গেল। দেহি যারা মুখ তুইল্যা কথা বলতি ভয় পাইত তারা দেহি দালানের সিড়িতে আহি বইতে লাগিল। বামুন কায়েতের হুকো আলাদা। ওরা সে-ই হুকো খাইতে লাগিল। দেখে ভয় হতি লাগিল। তবু থাকি গেলাম।”
(এই আখ্যানের সঙ্গে মিলে যায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থে উৎকীর্ণ সুরঞ্জন চক্রবর্তীর বর্ণনা। তিনি স্মৃতিচারণায় বলেছেন,
“আমি ১৯৫১ সালে এ-দেশে চলে এসেছিলাম… আমাদের বাড়িতে গ্রামের গরিব মুসলমানেরা দুর্ভিক্ষের সময় এসে খেত। একজন ছিল দীন মহম্মদ। বাড়িরই কলাগাছের পাতা কেটে নিয়ে সে আমাদের বাড়ির উঠোনে বসে মাকে বলত, দিদিগো, ভাত না খাইয়া যামু না।’ সেই দীন মহম্মদের পরবর্তীকালে মন্তব্য ছিল, দ্যাখো ঠাকুর, এ দেশ এখন আমাদের দেশ। তাই তোমাদের বাগানের ফল, পুকুরের মাছ আমরা খাব, তুলে নিয়ে যাব। তোমরা কিচ্ছু বলতে পারবে না।’ সেই দীন মহম্মদের এমন কথায় খুব কষ্ট পেলাম……..।)
গোপাল: তারপর?
সুনীতিবালা: ভাবছিলাম খুলনে, যশোর হিন্দু প্রধান। এগুলি ইন্ডিয়াতে যাইবে। কিন্তু কোথায় কী! দ্যাখলাম এগুলি পাকিস্তানে পড়ল। তোর দাদুরে মোসলমান প্রজারা বলিল, “বাবু যাইবেন না। আপনারা চলি গেলে মাথার ছাতা সইরা যাইব। ভয় কী! আমরা জান দিয়া আপনাদের বাচাইমো।” ওদের কথায় আমরা থাকি গেলাম। কিন্তু আমাদের চেনা জানা অনেকেই চলি যাইতে লাগিল।
রাখি: তারপর!
সুনীতিবালা: তবু থাইক্যা গেলাম। কিন্তু দ্রুতই সব কিছু বদলাইতে থাকিল। আমার দুই দাদা চাকুরি করিত। শিক্ষকতার। পাকিস্তান সরকার শিক্ষকদের মাইনা দিয়েছিল বন্ধ কইরা। মাস খানেক পরে জানা গেল সরকার পুনরায় মাইনে দেবে। শুইন্যা ছোড়দা বলে, আগে আমি যাই। হাওয়া বুঝি। তারপর আপনি যাইবেন। সেই যে দাদা গেল; আর ফিরল না। জানা গেল খান সেনারা সবাইকে লাইনে দাঁড় করাইয়া গুলি কইরা খুন করিছে।
এই ঘটনার পর আতঙ্ক বাড়ি গেল। মুসলিম প্রজাদের অনেকেই বলল, বাবু চইল্যা যান। খান সেনাদের রুখব ক্যামনে! আপনারা চলি যান। তারপর ওদের সাহায্যেই দ্যাশ ছাড়ি চলি আইলাম ইন্ডিয়ায়।”
এই আলাপ-দ্বিরালাপের মধ্যে আছি আমি। আমার শিকড়সন্ধানী সত্তা। সেই সত্তা যা আজও নির্জন কোরক মুহূর্তে ব্যাথার্ত হয় এই ভেবে, কেন ভাগ হল আমাদের বাংলা! কেন সুনীতিবালারা সব ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে-দিন সমৃদ্ধ, নিশ্চিত ঠিকানা ছেড়ে নতুন দেশে, অনিশ্চয়তার বারুদস্তূপে!
এই পর্যন্ত যেটুকে জেনেছি নানা বই থেকে তার সারাৎসার হল পাজি মোল্লার দল দেশভাগের সুযোগে বড়লোক হিন্দুদের জায়গা-জমির দখল নেওয়ার জন্য বেপরোয়া, হিংস্র হয়ে ওঠে। তাদের অভূতপূর্ব অত্যাচারেই দেশত্যাগে বাধ্য হয় দয়াময়ী থেকে সুনীতিবালার মতো হতভাগ্যের দল। এই ধারণা থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত হয় উত্তর পুরুষের মন-জমিতে। সেখানে জল দেয় সংগোপনে ক্ষমতার ক্লিন্ন থাবা। নিরন্তর জল পেয়ে সেই বীজ থেকে জন্ম নেওয়া চারাগাছ কখন যে শক্তিশালী ও সর্বগ্রাসী বিষবৃক্ষের চেহারা নেয় তা কে জানে?
দেশভাগের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভাজন যে একটা বড়ো ভূমিকায় উঠে এসেছিল একথা অনস্বীকার্য। সাম্প্রতিককালে তেভাগা আন্দোলনের উপর প্রথাভাঙা এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ধর্ম তেভাগা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় উঠে এসেছিল। বঙ্গীয় মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীরা এই সত্যকে সন্তর্পণে উপেক্ষা কিংবা অস্বীকার করলেও ক্ষেত্র সমীক্ষা অন্য কথা বলে। উত্তরবঙ্গ এবং ওপার বাংলার রংপুর ইত্যাদি অঞ্চলে মুসলিম লিগের প্রচারে নিম্নবিত্ত প্রান্তিক বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই প্রভাবিত-বিভ্রান্ত হয় পড়ে। শ্রেণিশত্রুর বিষয়টি ভুলে গিয়ে তারা মুসলিম জমিদারদের পক্ষে চলে যায়। এর ফলে তেভাগা আন্দোলনের আদর্শগত ভিত্তি আলগা হয়ে পড়ে।
কিন্তু এ সত্ত্বেও একটু গভীরে তাকালে দেখা যায় দেশভাগের আসল কারণ অর্থনৈতিক। দেশভাগের নিহিত কারণ হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলির নিজস্ব আধিপত্য ধরে রাখার দুরন্ত এষণা।
প্রথমে সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রের কথায় আসা যাক। ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চ বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলায় হিন্দু উচ্চবর্গ রাতারাতি অধিকাংশ জমির মালিক হয়ে বসে। তাদের ক্ষমতা ও আভিজাত্য ছিল ঈর্ষণীয়। দরিদ্র মুসলিম থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দু কৃষক নতুন প্রভুর জমিতে কাজ করতে ও জোরপূর্বক কর দিতে বাধ্য হয়। এদের সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক মূল্যাঙ্কন, “জীবের শত্রু জীব, মনুষ্যের শত্রু মনুষ্য, আর বাঙ্গালী কৃষকের শত্রু বাঙ্গালী ভূস্বামী।”১ পরে অবশ্য তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। বাস্তব অবস্থা কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বহু পরে আসল সত্য উদ্ঘাটন করেন মহছেনউল্লা সরকার। ১৯০৭ সালে শ্রী মহছেনউল্লা সরকার ‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকায় তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার কৃষক-প্রজার দুর্দশার যে চিত্র তুলে ধরেন, তার মাধ্যমে অনায়াসেই বঙ্কিমচন্দ্রের দাবির অসারতা প্রতিপন্ন হয়। এখানে তাঁর রচিত ‘বুড়ীর সুতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে ধরা হল :
“পূর্ব্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মহামান্য শ্রীল শ্রীযুক্ত ছোটো লাটসাহেব বাহাদুর সমীপে-গুণু প্রামানিকের আবেদন।
সসম্ভ্রমে কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন এই যে —
আমি পূর্ব্ব বাঙ্গালার দরিদ্র কৃষক; লাট সাহেব বাহাদুরকে কীরূপে সম্মান করিতে হয়, তাহা আমি জানি না। ভরসা করি, আমার লাট সাহেব বাহাদুর তাঁহার নিজ মাহাত্ম্য গুণে, ইহাতে আমার যথোচিত ভক্তি ও তাঁহার যথাযোগ্য সম্মান প্রকাশিত হইয়াছে বলিয়া গণ্য করিয়া লইবেন। আমাকে সকল প্রকারে আক্কেল দিবার কর্ত্তা ইংরেজ। তিনি আমাকে যে প্রকার আক্কেল দিয়াছেন আমার লাট সাহেব বাহাদুরকে এই পত্রখানি লিখিতে আমি সেই প্রকার আক্কেল ব্যবহার করিব ভিন্ন উৎকৃষ্টতর আক্কেল কোথায় পাইব?
এই দেশে পূর্ব্বে দাসত্ব-প্রথা প্রচলিত ছিল, ইংরেজের আমলে তাহা উঠিয়া গিয়াছে- এই কথা যিনি বিশ্বাস করিতে চাহেন, পূর্ব্ব বাঙ্গালার কৃষকের অবস্থাটা তাঁহাকে একবার ভালো করিয়া দেখিতে অনুরোধ করি। ইংরেজ-রাজ নামে মাত্র কাগজে পত্রে উহা উঠাইয়া দিয়াছেন সত্য কিন্তু ফলে তাহা ঘটে নাই। বিশেষতঃ পূর্ব্ব বাঙ্গালার কৃষকগণ জমিদার কর্ত্তৃক যে প্রকার ব্যবহৃত হইতেছে তাহার চেয়ে সম্ভবতঃ পূর্ব্ব কালীন দাসত্ব-প্রথা ভালো ছিল। সেই দাসত্ব সম্প্রদায়গতভাবে এরূপ প্রবল ছিল না এবং দাস ছাড়া অন্য কাহাকেও দাসত্ব করিতে হইত না, অথবা দাস ব্যতীত দাসের আত্মীয়বর্গকে বা একজনের জন্য দেশশুদ্ধ লোককে দাসত্ব করিতে হইত না।”২
সেখানে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে মুসলমান প্রজাদের প্রতি হিন্দু জমিদারদের বিরূপতার কথা:
“মুসলমান জমিদারের এলাকায় গোরু কোরবানী হইয়াছিল কৃষক লোভ সম্বরণ করিতে না পারিয়া ঐ মাংস হিন্দু জমিদারের এলাকায় আনিয়া খাইল, জমিদার তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া জরিমানা করিল, জুলুম করিল। জানে প্রাণে আর কুলায় না দেখিয়া সকল আদালত ছাড়িয়া তোমার সিংহাসনে দরখাস্ত করিল। তুমিত তোমার ডেপুটীর প্রতি তদন্তের ভার দিলে ডেপুটী প্রমাণ উপস্থিত করিবার জন্য দিন ধার্য্য করিয়া সমন দিল। দরখাস্তকারী প্রমাণ সহ তোমার ডেপুটীর এজলাসে হাজির হইয়া দরখাস্ত দিয়া জানাইল যে, ‘‘জমিদার আমাকে ও আমার সাক্ষীগণকে বাধ্য করিয়া লইয়া যাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে, সুতরাং দয়া করিয়া, অদ্যই আমাদিগের জবানবন্দি গ্রহণ করিতে আজ্ঞা হয়”। ফল কথা যে সেদিন আর কাহারও জবানবন্দি গ্রহণ করা হইল না। দরখাস্তকারী ও তাহার সাক্ষীগণকে জমিদারের এলাকার মধ্যেই বাস করিতে হইল। পরদিন দরখাস্ত দিয়া জানাইল যে, জমিদারের সহিত তাহার আপোশে নিস্পত্তি হইয়া গিয়াছে। বাহ্, আর কথা কি তোমার আদলতের ফাইল ক্লিয়ার হইল।”৩
জমিদারের সঙ্গে ছিল নায়েব, ইজারাদার, দর-ইজারাদার, মহাজন প্রমুখ মধ্যস্বত্বভোগীদের অভূতপূর্ব মুদ্রালোভ। তাদের লালসার আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে দিতে পল্লিগ্রামের দরিদ্র প্রজারা সর্বস্বান্ত হয়। অক্ষয়কুমার দত্ত রচিত ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন’ প্রবন্ধে এই সত্য স্তম্ভিত হয়ে আছে।
পরবর্তীকালে নীল বিদ্রোহের সময় এই হিন্দু জমিদাররাই ইংরেজদের সহযোগী হয়ে ওঠে। বাংলার গরিব মুসলিম ও দলিত হিন্দু কৃষকদের জীবন তাদের অত্যাচারে ওষ্ঠাগত হয়। তাদের এই শোষণ-অত্যাচার নীচুতলার মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গের সময় এরা ভেবেছিল দেশের বিভাজন তাদের সম্মুখে মুক্তির দরজা খুলে দেবে। এই ভাবনা থেকেই তারা স্বদেশি আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। এই ভাবনা তাদের ক্রমশ হিন্দুদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এই বিচ্ছিন্নতারই ফল ১৯৪৭ সালের বঙ্গবিভাজন।
এই প্রেক্ষিতে স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী শক্তিগুলি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ও লালসা পূরণের উদ্দেশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু মহাসভা। এর Binary Opposition হিসেবে জন্ম নেয় মুসলিম লিগ এবং আর এস এস। কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ দল হলেও দক্ষিণপন্থী হওয়ায় প্রায়শই এইসব সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে নিজের স্বার্থে আপস করেছে।
এইসব সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলি শ্রেণিগত কারণে স্বাভাবিকভাবেই ছিল প্রোলেতারিয়েত শ্রেণির ক্ষমতায়নের ঘোর বিরোধী। বস্তুত হিন্দু জমিদারকুল নিজ শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করতেই কংগ্রেসের জন্ম দেয়। অবশ্য হিন্দুদের পাশাপাশি বঙ্গদেশের উচ্চশ্রেণির মুসলমানদের হাতেও প্রচুর জমি এবং জমিদারি ছিল। বিশেষত রাঢ়বঙ্গে। তারাও নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ছিল যত্নবান। তারা নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ সুরক্ষিত রাখবার তাগিদেই মুসলিম লিগের জন্ম দেয়। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে বিচার করলে আরও ভালোভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই দুই রাজনৈতিক দলের শ্রেণি চরিত্র। নিজেদের শ্রেণি চরিত্রের জন্যই এই দু-দল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকতার গণ্ডিতেই সীমিত রেখেছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদনে এই দিকটি চমৎকারভাবে উঠে এসেছে:
“শ্রেণিগত কারণে গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস অহিংস আন্দোলন করে আন্দোলনকে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ধরে রাখার ব্যবস্থা করত। কখনও কখনও আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করলে বা তার আশঙ্কা দেখা দিলে গান্ধি হস্তক্ষেপ করে তা থামিয়ে দিতেন।
কংগ্রেস-লিগের স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালে তারা সব সময়ই ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখত এবং তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করত। এই আলাপ-আলোচনা চল্লিশের দশকে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল। ভাইসরয়ের সাথে আলোচনা, সিমলা সম্মেলনের মতো মতবিনিময় সভা, কেবিনেট মিশনের সাথে আলাপ-আলোচনা এবং মাউন্টব্যাটেনের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়েছিল।
চল্লিশের দশকে কংগ্রেস-লিগের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতার থেকে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা ও বখরা ভাগের আলোচনা অধিক গুরুত্ব পেয়েছিল। ১৯৪৪ সালে গান্ধি-জিন্নাহর মধ্যে আপস মীমাংসার জন্য যে দীর্ঘ আলোচনা বেশ কয়েক দিনের জন্য হয়েছিল এবং কোনো মীমাংসা ছাড়াই শেষ হয়েছিল, সেটা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্বে আসল শত্রু ব্রিটিশ সরকার অনেকটা মধ্যস্থতার কাজ করেছিল! ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে হবে সেটা শাসক ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেস-লিগ টেবিলে বসে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করেছিল। এটা ছিল ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে এক চক্রান্তমূলক ব্যাপার। জনগণের মাথায় ঘোল ঢেলে, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেই তারা ভারত ভাগ করেছিল।”৪
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বরকত রচিত একটি প্রতিবেদনের কথা। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘Political Economy Of Fundamentalism In Bangladesh’ শীর্ষক প্রতিবেদনে স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি ও সেখানকার অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রের আন্ত:সম্পর্কের দিকটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি সহযোগে বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানে তাঁর পর্যবেক্ষণ:
“The economics of fundamentalism can be viewed as a concentrated expression of religion-based communal politics aimed at capturing state power using religion as a pretext. It runs contrary to the secular approach to people, smothering and decimating the free, unfettered outlook. It has launched a vicious onslaught on the spirit of secularism that was embedded in the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh in 1972 following the 1971 Liberation War. The act of satisfying the people’s hopes and aspirations turned out to be a fiasco. At the same time, there also occurred the erosion of a secular democratic mind-set. Both these two factors, besides encouraging the growth of fundamentalism and its economic agents and interests, have given birth to the institutions that turned favourable to their expanded reproduction. Consequently, came into being the economics of fundamentalism.”৫
দেশভাগের প্রাক্কালে এই সাম্প্রদায়িকতার অর্থনীতি প্রথম তার বিষাক্ত থাবা প্রসারিত করে। নিজদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি প্রান্তিক মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রচার চালায়। ফলে তেভাগা আন্দোলনে ভাঙন ধরে। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্র ভালোই জানত সাম্প্রদায়িকতার তাস দীর্ঘস্থায়ী সুফল এনে দেবে না। তেভাগা আন্দোলন সফল হলে তাদের মৌরুসি পাট্টা যাবে ভেঙে। ফলে তারা উদ্যোগী হল চাকাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে। তারা মুসলিম লিগকে কাজে লাগাল। সামনে এল পাকিস্তান-দাবি। ৪৭-এ ভারত পেল স্বাধীনতা। আর আমাদের দেশ ভাঙল। আমরা ধ্বস্ত-রিক্ত-সর্বহারা হলাম।
আজও সে-ই ইতিহাস চলমান। সামন্ততান্ত্রিক রথচক্রে পিষ্ট বাঙালি জাতি আজও দ্বিধা বিভক্ত। অলীক সীমান্ত ভেঙে দুই জার্মানি মিলেমিশে গেল। ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ । আর আমরা? কাঁটাতারের বেড়াকে লালন করেই চলেছি- – -।
উল্লেখপঞ্জি:
১. চট্টোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র: ‘জমীদার’, “বঙ্গদেশের কৃষক”, বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলী, সাহিত্য সংসদ
২. সরকার মহছেনউল্লা: ‘বুড়ীর সুতা’, মিহির ও সুধাকর পত্রিকা, ১৯০৭
৩. সরকার মহছেনউল্লা: ‘বুড়ীর সুতা’, মিহির ও সুধাকর পত্রিকা, ১৯০৭
৪. উমর বদরুদ্দীন : ‘দেশভাগের কথা’, সমকাল পত্রিকা, ৮ই জুন ২০২৩
৫. বরকত আবুল: ‘Political Economy Of Fundamentalism In Bangladesh’, Mainstream Weekly, ২৪ মার্চ ২০১৩