বাংলা কবিতায় দেশভাগ: বধ্যভূমির আখ্যান

পার্থসারথি হাটি

বিশ্বব্যাপী দুটো মহাযুদ্ধের বীভৎসতার পর আর-এক নবতর নারকীয় হত্যালীলা দেখার জন্য অখণ্ড ভারতবর্ষের মানুষ তৈরি ছিল না। দুই শতকের বেশি সময়কালের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসী অপেক্ষা করছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির এক বছর আগে থেকেই ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অসহ্য সাক্ষ্য নিয়ে ভাগ হল দেশ। এই বিষয়টি রাষ্ট্রীয় গর্বের ইতিহাসের মধ্যে পড়ে না। সামাজিক-সাংস্কৃতিক তীব্র সংঘাত ও দেশভাগ, এসবের মধ্যে রয়ে গেছে বহু কৌণিক সমাজ ইতিহাস চর্চার নবতর উপাদান। রাষ্ট্র যে কলঙ্কিত ইতিহাসকে গোপন করার চেষ্টা করে, সাহিত্যে তারই নির্মোহ অভিব্যক্তি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট এল স্বাধীনতা। ঔপনিবেশিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বরাজ প্রাপ্তির ইতিহাস — যা রাষ্ট্রের গর্বের। তবে সাধারণ মানুষের জীবনচর্যা থেকে দেশভাগের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদের কলঙ্ক কোনও ইরেজার দিয়ে মোছা তো যাবেই না, বরং তা কাল থেকে কালান্তরে আমাদের সমাজ সভ্যতার পৃষ্ঠে চিরন্তন অস্ত্র লেখা হয়ে রয়ে গেছে।

দেশভাগের পিছনে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিগ্রহণের চক্রান্ত, তা একদিকে কায়েমি স্বার্থের পরিপোষক; অন্যদিকে হৃদয় আগ্রাসী। সম্প্রদায় নির্বিশেষে সুস্থ চেতনার তথা সচেতন সাধারণ মানুষকেই বিভাজনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। কবিতা যেহেতু যুগযাপনের অন্তর্গত ভাব-ভাবনার এক শিল্পীত সচেতন প্রয়াস, তাই সব কালে, সব দেশের কবির কলমেই চিত্রিত হয় সেই দেশ-কাল-পাত্রের অভিপ্রায় ও যন্ত্রণা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, চাওয়া ও পাওয়ার বৈষম্য জনিত বেদনা। কবি যুগ-পটকে অস্বীকার করতে পারেন না। উপেক্ষাও করতে পারেন না। এই যুগ-পটেই তৈরি হয় কবির মেজাজ নির্জিত স্বকীয় মনোভূমি। কোনও ঘটনার দেশ-কালগত একটা সীমায়িত ক্ষেত্র থাকলেও ঘটনার অভিঘাত কখনও কখনও সীমাকে অতিক্রম করে যায়। কবিও হয়ে উঠতে পারেন সীমা অতিক্রমী। ঘটনার মাত্রা ও মানে কবিতা হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক। দেশভাগজনিত রণ-রক্ত-হিংসা দেশের শুভ চেতনাকে শুধু লাঞ্ছিত করেনি, বিক্ষত করেছে সমগ্র পৃথিবীর শুভবোধকে।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ বিভাজনের বিভিন্ন চক্রান্ত সফল হলেও এর সলতে পাকানো অনেক আগে থেকেই। এই বিভাজনের বীজ উপ্ত হয়েছিল হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের আচার সর্বস্ব জটিলতার ভিতরে, লালিত পালিত হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের লালসায়। ১৯৪৭ এর বহু আগে থেকেই হিন্দু মুসলমান এই দুই বৃহৎ সম্প্রদায় জাতীয়তাবাদের জিগিরে এক হলেও, কার্যত উভয়ের অবস্থান ছিল ভিন্নমুখী। ‘এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে’ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় জীবন গড়ে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথের উদাত্ত আহ্বান সাধারণ মানুষের মর্মে প্রবেশ করলেও রাজনৈতিক অংক কষিয়েদের হিসেবের জ্যামিতি অন্য উপপাদ্য-অন্বেষণে ব্যস্ত ছিল। যুগ-যাপনে রবীন্দ্র-নজরুলের সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষার আবেগময় প্রকাশকে উপেক্ষা করে একদিন বিভাজনের দীর্ঘ লালিত রাজনৈতিক হিসাব সফল হল। ‘করাতের দাঁত আমাদের রক্তাক্ত করেছে’। দ্বিপার্শ্বীয় অসম বিচ্ছেদে গড়ে উঠল ভারত ও পাকিস্তান। সাধারণ মানুষের সর্বনাশের দিনে বিভাজনের কারিগররা দেখল পরম উৎসবের দিন। তাদের সানন্দ স্বগতোক্তি — ‘চামড়া ছিঁড়েছে, ছিঁড়ুক / মাংস চিরেছে, চিরুক / হাড় পর্যন্ত আঁচড় লেগেছে, লাগুক — / আমরা বাঁচলাম।’ (‘সজ্জীবন’ / “উৎসের দিকে” / অরুণ মিত্র)।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণের সম্মিলিত সংগ্রামকে দমন করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ। দেশ শাসনে এখান থেকেই শুরু হয় ডিভাইড এন্ড রুল, ধর্মীয় ভাবাবেগকে উত্তেজিত করে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সাম্প্রদায়িক শক্তিতে বিভাজনীকরণের প্রচেষ্টা। সুতরাং শাসকের লাগাতার হিন্দু-মুসলমান একতা বিনষ্টির ব্রিটিশ প্রচেষ্টা কার্যকর ছিল বলেই রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বারবার আবেগমথিত আহ্বানে দেশকে মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠিত করে সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষার কথা বারবার বলতে হয়েছে। কিন্তু গোপন রাজনৈতিক অভিসন্ধি পারস্পরিক হার্দ্য অবস্থানকে রেওয়াত করেনি। তারপর! কাল নির্জিত সত্যের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়নি। আমাদের দেশভাগের ইতিহাস পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলিয়ে দেওয়ার কাঁপুনি। একে ভাগ বলে না। এ এক কৌশলী ছেদন বা ভেদন। জীবনানন্দ জেনেছেন, ‘এ ভারত ভূমি নহেকো তোমার নহেকো আমার একা, / হেথায় পড়েছে হিন্দুর ছাপ, – মুসলমানের রেখা;’ (‘হিন্দু-মুসলমান’ / “ঝরা পালক”)। এই চিন্তা ভাবনা খুব সংশয়াতীত ছিল না। স্বাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখা চোখে তুলসী পাতা চাপিয়ে দিয়ে, আনন্দ-বিষাদের ভাগাভাগির ভাগাড়ে রচিত হল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সমাধি। কবি অরুণ মিত্র তার ‘সজ্জীবন’ কবিতায় লিখলেন, সাধারণ মানুষের যাপন-বাস্তবতা কথা, অসহায় শিকড় ছিন্ন মানুষের বাস্তু হারিয়ে পথে নামার যন্ত্রণার কথা — ‘আমাদের বনেদি শিকলের জোড় ফেড়ে / বুড়ো বটের অগুন্তি শিকড় দ্বিখণ্ড ক’রে / আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল সড়কে ময়দানে।’ শুরু হল ‘মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দিয়ে তারপর তুলে’ দেশ দেখানোর, দেশ চেনানোর একটা নিকৃষ্ট প্রচেষ্টা। শিকড় ছিন্নতার বেদনা নিয়ে স্বাধীন নাগরিক রাতারাতি নিজ দেশে পরবাসী হয়ে বাস্তু হারানোর সমস্যাকে জানে মানে আজও বহন করে নিয়ে চলেছে।

দেশভাগ আসলে মানবিক সহাবস্থানের সম্পর্কটাকে বহু খণ্ডে বিভক্ত করেছে। অলোক ভাল্লা-র ‘Stories About the Partition of India’ গ্রন্থের ভূমিকায় pre-partition এবং Post-partition-মানুষের সমাজ-সাংস্কৃতিক মধুর ও বিষাক্ত সম্পর্কের বয়ান লিপিবদ্ধ হয়েছে। দেশ বিভাগের মানসিক আঘাতে (partition trauma) কুঁকড়ে যাওয়া মানুষজনের কাছে অবিভক্ত ভারতের ঐতিহ্যের বিস্মরণ যেমন অসম্ভব, দ্বিখণ্ডিত প্রাণের অনভ্যস্ত যন্ত্রণাকে মেনে নেওয়াও তেমনি এক নির্মম বাধ্যবাধকতা। প্রাণ-উৎসুক সবকালেই বাঁচার জন্য উন্মুখ। কিন্তু অপরাধহীনের বিচার হয়ে গেল সরব হাস্যে ও নীরব ক্রন্দনে। সময়ের পাঠকৃতি তৈরি হল নানান ভাষ্য ও উপভাষ্যে। দেশের ভাগ ও দশের মনমেদুরতাই সাহিত্যের নানান প্রকরণে চাপ চাপ রক্তের ছোপ ও অনিকেত জীবনবোধ (rootlessness) নিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। বাংলা কবিতাতেও তা দুর্লক্ষ্য নয়। তবে চরিত্র বিকাশের রাস্তায় আখ্যানের বিস্তারে নয়, বাংলা কবিতা ছুঁতে চায় কেন্দ্রীয় বিষয়ের অন্তর্গত অনির্বচনীয়তাকে। সেখানে স্বাধীনতার আস্বাদ ও দেশভাগের অবসাদ — এই দুই পরস্পর বিরোধী উপলব্ধির রসায়নে, অনুভব-নিবিড় হয়ে ওঠে ঘটনার তীক্ষ্ণতম অভিঘাত —

"বাতাস ছড়ায় অবসাদ
ছিন্নমস্তা করে শুধু রক্তের আস্বাদ৷
................
তবু এল স্বাধীনতা দিন
উজ্জ্বল রঙিন ......।"

(‘পনেরই আগস্ট, ১৯৪৭’ / দিনেশ দাশ)

ইতিহাসের সত্যকে, মানুষের শিকড় ছিন্নতার বহুস্বরায়িত আর্তনাদকে সাহিত্যের সত্যে রূপায়িত হতে দেখি কবিতায়। তাতে স্বপ্ন-মৃত্যুর হরিধ্বনি থাকলেও, তা এসেছে বিশ্ব মানব চেতনার সঙ্গে একাত্মতায়। ভুক্তভোগী কবিদের কবিতায় উঠে এসেছে দেশভাগের চৌকাঠ থেকে কাঁটাতার পেরোনোর অভিজ্ঞতা, পালিয়ে যাওয়ার ও টিকে থাকার নির্মম যাপন কৌশল। একরোখা মেজাজের স্বরায়ণে দীপ্ত হয়েছে ইতিহাসের মর্মসত্যের বহু রৈখিক আবেদন। স্বপ্নপোড়া ছাই কবি চেতনার সংস্পর্শে পেয়েছে স্ফুলিঙ্গের দ্যুতি। এর মধ্যেই রয়েছে প্রাকৃত জীবন সত্যের নির্মাণ এবং রাষ্ট্রিক সত্যের বিনির্মাণ। ফলে দেশভাগের পটভূমিতে রচিত কবিতা হয়ে উঠেছে সময় নির্দিষ্ট ঘটনা পথ থেকে সমাজ ও সংস্কৃতির অনন্ত পথ পরিক্রমায় বিশ্ব মানবতার বয়ান। যেখানে রয়েছে পরিচয় ছিন্ন মানুষের নতুন করে আত্মপ্রতিষ্ঠার আখ্যান। এ বিষয়ে নানান হেজিমনি ও ন্যারেটিভ তৈরি হলেও, এসব কবিতা মূলত সেই রক্তাক্ত প্রহরের পদাবলি। বেদনার আয়ু দীর্ঘস্থায়ী নয় জানি, প্রত্যক্ষত আমরা সেই নির্লজ্জ হত্যাবাদের অংশীদারও নই; তবু মানতেই হবে আমরা সেই সময়ের বিষামৃত করতলে ধারণ করে আছি। তাই সময়ের অভিঘাত হৃদয়কে বিক্ষত করে। বিস্মৃতির তলদেশ থেকে রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে যা ফিরে আসে— সে বেদনা অসীম। বিশ্ব মানব সত্তায় তার অধিকার।

পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের আনন্দ ও নৃশংস হৃদ্‌বিভাজনের বিষাদাত্মক ইতিহাস, সাধারণ মানুষকে প্রস্তুতিহীন এক অভিযোজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অর্জিত ও নির্মিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিমণ্ডল থেকে ছিন্ন হয়ে, আদিম জৈবিক প্রবৃত্তি পূরণের মরিয়া প্রয়়াস তাদের তাড়া করে ফিরেছে। ব্রিটিশ পোষিত ধান্দাবাজ ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতাদের চক্রান্তের কাছে কোনও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধই কাজ করেনি। অগত্যা উলুখাগড়া-জীবন স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়, এই অপ্রতিরোধ্য যন্ত্রণা মেনে নেওয়াকেই আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা হিসাবে গ্রহণ করেছে। ফেলে আসতে হয়েছে কয়েক পুরুষের বাঁধিয়ে রাখা আলতা-পায়ের ছাপ, সাত পুরুষের ভিটেমাটি, জন্ম-মৃত্যুর সাল দিন লেখা পূর্বপুরুষের স্মৃতিস্তম্ভ। হারাতে হয়েছে অসংখ্য হাত-পা, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, লিঙ্গ, স্তন ও যোনিদেশ। এই নারকীয় ঘটনার ক্ষতি নির্ণয় অসম্ভব। প্রত্যক্ষদর্শীর  সাক্ষ্যে থাকতে পারে রাষ্ট্র-ভীতি, কিংবা পারিবারিক আবরু রক্ষার তাগিদ। তবে কবিতার শব্দাবলীতে সেই সময়ের আগ্রাসী উন্মাদনার আভাস যেমন পাওয়া যায়, তেমনি কবিতার ভাষা-সংকেতের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে চাপা পড়া ইতিহাসের নির্ভুল পাঠ নির্মিতি, তথা পার্টিশনের ভিতরের ও বাইরের এক সাংকেতিক বয়ান।

জীবনানন্দের ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতার অনুসঙ্গে জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র মর্মান্তিক ছবি উঠে আসে। মানুষের জমি-জায়গা, ঘর-বাড়ি মূল্যবান কিছু স্থাবর সম্পত্তি মাত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষে প্রবাহিত পরিচয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। একজনের দখল মানে অন্যকে উৎখাত করা। আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য থেকে উৎখাত হলে মানুষ কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের বাধ্য দাস। সেদিনের গ্রামীণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ জীবন সংগ্রাম পৃথিবীর উঁচু লোকেদের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনকে পরাস্ত করতে পারেনি। প্রলোভন ও প্ররোচনায় একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছে অনির্বচনীয় হুন্ডির মজুতদাররা। সাধারণ মানুষের আর্থিক অসহায়তার সুযোগ নিয়ে, গ্রামে-গঞ্জে এমনিতেই সামন্ততান্ত্রিক মহাজনদের জাব্দা খাতা হাঁ করে থাকে। তারাও এই সুযোগে বহু মানুষের জোত-জমি, ভিটে-মাটি, মহাজনি হাঙর-খাতায় ঢুকিয়ে নিয়ে সর্বস্বান্ত করেছে। বিত্তের আস্ফালনে, রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনে সেসব নিলাম করেছে। মাটির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংকেত রেখেছে নারীদেহের উপর আধিকার প্রতিষ্ঠার আর্কেটাইপে। নারীর উপর বলদর্পী পুরুষের নিষ্ঠুর অত্যাচার, পরিবার ভাবনার শুদ্ধ চেতনাকে বিনষ্ট করেছে। সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষীর দল বারুদ-মুখ উসখুশে সলতে গুলোয় আগুন যুগিয়ে, ‘বিশৃঙ্খল শতাব্দীর সর্বনাশ’-এর শেষ সীমাকে স্পর্শ করেছে। ছলে বলে কৌশলে কিছু সাম্প্রদায়িকের ভাঁড়ারে জমেছে ন্যায্য অধিকার বহির্ভূত সম্পদ। এখানেই রয়েছে নব্য ধনতন্ত্রের ভূমিকাংশ। এরাই এই নারকীয় প্রেক্ষাপটে জল ঘোলা করে, ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে গেছে। খুড়োর কলে ঝুলিয়ে দিয়েছে ষোল আনা হিস্যা আদায়ের অবশ্যম্ভাবী নিশ্চয়তার মেকি স্লোগান। সুতরাং অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের উদার্য আর সহনীয় হল না। দীর্ঘদিনের সহাবস্থানজনিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বালির বাঁধের মতো ধ্বসে গেল। সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবিক আত্মীয়তা হয়ে উঠল প্রবল বিষময়। সুতরাং শত্রু বিতরণের পালা। আর শত্রু সম্পত্তি ‘দু’জন কি একজন কিনে নিতে পারে।’ সব দেশে সব কালে ‘এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে / সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।’ বিদ্বেষের চরমতা প্রকাশের সংকেত পেয়ে যায় অপর সম্প্রদায়ের মানুষ। সব দেশেই মা ও মাটির পবিত্রতা রক্ষার দায়ভার সাধারণ মানুষের তথা নিম্নবর্গীয় মানুষের। নারী নিধনের হিমশীতল অত্যাচারের অসভ্যতা নিম্নবর্গীয় মানুষের মাজাটাকে প্রথমেই ভেঙে দিতে চেয়েছে। অস্তিত্ব রক্ষার চরম সংকটের মুখোমুখি হয়ে কেউ ‘অন্ধকারে লীন হয়ে গেছে’, কেউবা হৃদয়ের ভিতর লীন হয়ে যাওয়া মুখের যন্ত্রণাকাতর রেখাচিত্র নিয়ে সূর্য-ধুলো-ঘাস-আলো-অন্ন-আকাশের অমৃতত্ত্ব আস্বাদনে ফিরে এসেছে সীমাহীন অনিশ্চয়তায়। কেউবা মন্বন্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে দেহ-ক্ষেত বাজি রেখেছে — ‘সপ্রতিভ রূপসীর মতো বিচক্ষণ / যে কোনো রাজার কাছে উৎসাহিত নাগরের তরে।’ (‘সোনালী সিংহের গল্প’ / জীবনানন্দ দাশ)। সহৃদয় মানবিক চেতনায় উদ্বেলিত আলোকোজ্জ্বল গ্রামজীবন ‘আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।’ সম্প্রদায় নির্বিশেষে গড়ে ওঠা গ্রামীণ সংস্কৃতি আজ অন্ধকারের প্রেত মূর্তি। গ্রাম জীবনের অমূল্য সম্ভব আলোকময়তার বিনষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হয়েছে মানুষী চেতনা — ‘নিভে গেছে সব’। সরে গেছে বাৎসল্যের হাত। মনুষ্যত্বহীন দ্বিপদীদের সচলতা থাকলেও কার্যত ‘কোথাও মানুষ নেই।’ পড়ে আছে শুধু অগনন ‘মানুষের হার খুলি।’ আলোকবিলাসে যারা অসাম্প্রদায়িক গ্রামীণ জীবনকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে উপভোগ করতে চেয়েছিল, তারা ‘আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায় / অন্ধ শতচ্ছিন্ন’ গ্রামের নিরালোক অধিবাসী। সংশয়-সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অর্ধসত্যের প্ররোচনায় আজ তারা ‘সকলেই আর চোখে সকলকে / দেখে’। সন্দেহ-দীর্ণ ব্যথাতুর এই জীবনের থেকে বুঝিবা প্রতিতামহের দল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দিন ভালো ছিল। অন্তত এই ভ্রাতৃঘাতী নরমেধের ক্লান্তিকর ঘুম ছিল না। উভয় সম্প্রদায়ের খুন, বিভাজনের ভাগাড় থেকে এসে মিশে গেছে একই রক্ত-নদীতে। এটাই তো সময়ের সাক্ষ্য এবং মূল্যায়ন। Flashback-এ “যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে / ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি, / হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ — / আর তুমি ?’ … / … রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে / ব’লে যাবে ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার; / মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালির —’।” কলকাতা থেকে করাচি একই রক্ত-নদীর স্রোত। রক্তে কোনও ধর্ম-সম্প্রদায়ের পরিচয় ছিল না, ছিল অধিকারের নির্মম আস্ফালনে। সুতরাং সম্প্রদায় বিবিক্ততায় উচ্চারিত হয় সেই নিষ্ঠুরতম ধ্বনিগুচ্ছ ‘মানুষ মেরেছি আমি’। এরপর অন্ধকারে মুখ মুছে নিয়ে, অনন্তের খণ্ডিত রূপকে বরণ করার অভিভাষণ ছাড়া আর কি থাকতে পারে! তবু যেটা থেকে যায়, এই ভারতকে মহাহত্যাশালায় পরিণত করার জঘন্য সাম্প্রদায়িক ক্রোধ ও সদাগ কলঙ্কের মার। ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের ভূমিকা থেকে উপসংহার সবটুকুই জীবনানন্দের অনুভূতি দেশের ভাষালোকিত অন্ধকারের ভাষ্যরূপ। প্রেমহীন, চেতনাহীন খণ্ডিত যাপন ভূমিতে কলঙ্কের চির চিহ্ন নিয়ে আজও অনুভব করছি ‘— এমন মহানুভ ব্যপ্ত অন্ধকার / নেই আর?’

মানুষের অজ্ঞানতাই মানব সভ্যতার অনির্বচনীয় অন্ধকারের দ্যোতক। ফ্রান্সিস বেকনের মতো জীবনানন্দও জানতেন ‘জ্ঞানই শক্তি’। পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে তিনি আর-একটু মানুষ ও সভ্যতার ইতিহাস লগ্ন হয়ে ভেবেছিলেন জ্ঞানই শুভ চেতনা। এই শুভ চেতনার শ্রেষ্ঠ বা পরম কারণ ও কার্য হল প্রেম। প্রেমের বিহনে বিশ্ব লোকের ভয়ংকর ইশারাকে তিনি সমগ্র চারের দশক জুড়ে উপলব্ধি করেছেন এবং কবিতায় তা অভিব্যক্ত। কিন্তু সময় বিচারে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, রণ-রক্ত সফলতায় বুঁদ হয়ে থাকা বিশ্বমানবের শকুন খিদেই, প্রতিস্পর্ধী চেতনা জারিত জীবনানন্দকে জ্ঞান থেকে প্রেমের সমীকরণে পৌঁছাবার রসদ দিয়েছিল। আসলে যুদ্ধবাজ সাম্প্রদায়িকরা অন্যের জীবনকে নরক করে দেওয়ার অমানুষিকতাকেই ‘শক্তি’ ভেবেছিল। ফলে তিমির বিনাশের পরিবর্তে পেলাম অনন্ত বেদনা। শঙ্খ ঘোষের কবিতায় দেখি প্রেমহীনতার নির্মম অনুভব — ‘প্রেমের অবসানে আমার ভয় সেই বেদনাকেই’। (‘হিমানী’ / শঙ্খ ঘোষ)। প্রেমের বিহনেই বারো ঘরের এক উঠোনের আকাঙ্ক্ষায় শহিদের রক্ত ছেঁচা স্বাধীনতা ও স্বরাজ, শুভ রাষ্ট্রের জন্ম দিতে ব্যর্থ হল। স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মাঝে প্রবল অস্তিত্ব নিয়ে রয়ে গেল সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদ্‌বাস্তু সমস্যাজনিত যাপনীয় জীবনের ক্ষত। সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষার মিথ্যে দিয়ে যে ভয়াবহতার সূচনা, তা-ই হয়ে উঠল বীভৎস ঐতিহাসিক সত্য — যা থেকে ঘৃণ্য রাজনৈতিক লালসাকে কোনওদিন তুলে ফেলা সম্ভব নয়। কাল থেকে মহাকালের প্রবাহে যার গতি অনিঃশেষ। ‘তবু তো মানুষ এই জীবনকে ভালবাসে; —।’ কিন্তু দু-একজন উঁচু লোকের লালসার হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। কারণ, ‘যুদ্ধ শেষ হ’য়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল; / মানুষের লালসার শেষ নেই / — কেবলই আসন থেকে বড়ো, নবতর / সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো।’ (‘এইসব দিনরাত্রি’ / জীবনানন্দ দাশ)। অন্তহীন লালসা, স্বার্থ-সংঘাত — সাধারণ মানুষের হৃদয়কে শতচ্ছিন্ন করে আত্মপরিচয থেকে উৎখাত করে। সুতরাং তিমির বিনাশের ব্রতযাত্রায় ভয়ংকর এক মানচিত্রের নির্মাণকে শরীরে মনে কিছুতেই এড়ানো গেল না। চিরন্তন এক ট্র্যাজেডির ভূমিকা রচিত হয়ে গেল। সাধারণ্যের নয়, ‘ব্যক্তির দাবিতে তাই সাম্রাজ্য কেবলি ভেঙে গিয়ে / তারি পিপাসায় / গড়ে ওঠে।’ (‘জনান্তিকে’ / জীবনানন্দ দাশ)। ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা রদ করা গেল না — এটা কোনও নিয়তি নয়, ব্রিটিশ প্ররোচনায় রাজনৈতিক নির্মাণ। স্বরাজ সাধনায় অমৃতের আকাঙ্ক্ষা ছিল; কিন্তু দাঙ্গা-দেশ বিভাগ-উদ্‌বাস্তু সমস্যার মধ্যে দিয়ে অতীত ঐতিহ্য থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে স্বাধীন নাগরিকের হৃদয় পেয়েছে আঁধির বিষাদ — ‘সাহস সাধনা প্রেম আনন্দের দিক লক্ষ ক’রে / আমরাও সূর্য খুঁজে নিতে গিয়ে গ্রহণের সূর্য কি খুঁজি?’ (‘মহাজিজ্ঞাসা’ / জীবনানন্দ দাশ)।

ভারতীয় উপাসনার চিরন্তন কল্যাণকামিতা কোথায়? আছে কেবল স্বপ্নভঙ্গ ও আত্মিক বিচ্ছেদের বিকৃত আনন্দ। আলো জ্বালাবার নামে অন্ধকার জ্বেলে দেওয়ার প্রতারণা। একটা যুদ্ধের পর নবতর যুদ্ধের সংঘটনে মানুষ শুধু সংকট অতিক্রমণের যোদ্ধা। যুদ্ধ ও যুদ্ধ থেকে নিরন্তর নিষ্ক্রমণের হোতা সেই মানুষই। মৃত্যুকে জয় করার নির্মম অভিজ্ঞতা সব যুদ্ধের প্রেক্ষিতে প্রায় একই রকম। মানববিনাশী কোনও যুদ্ধেরই পুনরাবৃত্তি মানুষ চায় না, এরই প্রতিস্বর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় — ‘মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে দিয়ে / তারপর তুলে —  / যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে / যেন না ফেরে।’ (‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’ / সুভাষ মুখোপাধ্যায়)।

এই বেয়ারা ছোপগুলো সময়ের অনন্ত ঘটনা প্রবাহের অভিঘাতে একটু ফিকে হলেও, সৃষ্ট বিষণ্ণতা ও অমানবিক নাশকতা আমাদের রক্তের ভিতরে জেগে থাকে। জাতীয়তাবাদী চিন্তায় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চায় ঘুরে ফিরে আসে সাম্প্রদায়িক অসভ্যতার দুঃসহ প্রহসন, মনুষ্যত্বের লজ্জা। শোকবিদ্ধ হৃদয় নিয়ে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্ত করলেন তাঁর এই সময়ের নিজস্ব পাঠ — ‘প্রনষ্ট পৃথ্বীর প্রান্তে তমিস্রার লজ্জাবস্ত্রে আজ / এসো নগ্ন মনুষ্যত্ব ঢাকি।’ — এর মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত সভ্যতার অন্যতর প্রস্তাবনা। কিন্তু ঘটনার অভিঘাত মানবিক ও চিন্তাশীল মানুষকে ক্লান্ত ও বিক্ষুব্ধ করেছে, ভেতরে বাইরে। তা শুধু পরিবার ও সঙ্ঘবদ্ধ সমাজকে বিপর্যস্ত করেনি, সুসভ্যতার আলোকসন্ধানী মন ও মেধাকেও জর্জরিত করেছে। দেশ শুধু ভাঙ্গেনি, মনের রাজ্যকেও বিদীর্ণ করেছে। ভেঙে পড়া এই মনোরাজ্যেই ভেসে উঠেছে কবির বিপন্ন দেশ — ‘প্রত্যেক শহর আজ ধুমায়িত যুদ্ধক্ষেত্র, প্রত্যেক গ্রামের / মূল্যমান বিপর্যস্ত।’ (রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী)। কিন্তু চাওয়া তো এমন ছিল না। চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে ঘটে গেল ব্যাপক বৈষম্য, বিস্তর ফারাক। চাওয়া ছিল — ‘নতুন দৃশ্য ঘুম ভেঙে যেন দেখি কাল ভোরে।’ কিংবা আশা ছিল, ‘এ দুর্যোগ কেটে যাবে, রাত আর কতক্ষণ থাকে? / আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে।’ (‘দেওয়ালী’ / সুকান্ত ভট্টাচার্য্য)। আর পেলাম — ক) ‘সারি সারি বাড়ি সব / মনে হয় কবরের মতো, মৃত মানুষের স্তূপ বুকে নিয়ে পড়ে আছে।’ (‘সেপ্টেম্বর ৪৬’ / সুকান্ত ভট্টাচার্য)৷ খ) ‘আশৈশব বন্ধুকেও আচমকা পিঠে ছুরি মেরে / প্রেম কিংবা চাকরির সুকঠোর যুদ্ধ করি আজ।’ (জীবনানন্দ দাশ)। গ) ‘আমাদের পরস্পর – বিপরীত দিক থেকে / ছুটে আসছে মৃত্যু ও মায়ের কণ্ঠ।’ (‘রক্ততট’ / অমিতাভ দাশগুপ্ত)।

অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে প্রতিমুহূর্তের। কিন্তু জাতি-দাঙ্গা, দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা – এই এ্যহস্পর্শ মানুষকে একরকম উৎকেন্দ্রিকতার জগতে ঠেলে দিয়েছিল। ঐতিহ্য রক্ষার সংকট আরও চরম হয়ে উঠল। হয়তো প্রশ্ন ছিল এর শেষ কোথায়? উত্তর এল — ‘বাড়ি ঘর ডিঙ্গি আর সাঁকো / কতবার ভাঙ্গা গড়া হবে জানি নাকো।’ (‘প্রাচীন পদ্ধতি কোনো’ / প্রেমেন্দ্র মিত্র)। ধর্মের জিগিরে দাঙ্গা ও দেশ বিভাজনের প্রেক্ষিতটি কোনও সর্বাতীত রহস্যের সৃষ্টি করে না। ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের মাঝখানে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যস্বত্ব ভোগের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা এই প্রেক্ষিতে একটি স্পষ্ট ভাষ্যের জন্ম দেয়। এরা ধর্মীয় সুব্যবস্থার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের শরীরকে ক্ষত লাঞ্ছিত ক’রে, না ফেরার ফরমান শুধু লিখে দেয়নি; অমানবিকতার নখ দাঁত দিয়ে হৃদয়কে বিক্ষত করেছে। গ্লানিকর জীবন নিয়ে মরণাধিক বেঁচে থাকার দুঃসহ রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে। অস্তিত্বের বিনাশকালের ভয়াবহতাকে প্রত্যক্ষ করে প্রতিশোধ নয়, কবি দিয়েছেন শান্তি রক্ষার শব্দ-কবচ — ‘পাপের বিরুদ্ধে পাপী হয়ে, হত্যার বদলে হেনে হত্যা-শোক / মাথা নীচু করব না কোটি লোক।’ (‘সত্যাগ্রহ’ / “আর নতুন দিন এল” / অমিয় চক্রবর্তী)। কিন্তু সাম্প্রদায়িক করাতের দাঁতে মানুষের রেহাই কই! ভারতবর্ষের নব পর্যায়ের ইতিহাস, এই কলঙ্ককে ধারণ করবে বলেই কি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম! তবে ইতিহাস জানে ‘বুক জোড়া পদ্মা হতে দূর সিন্ধু নদ।’ আর হৃদয়-অবাধ্য মানুষের আবেগের কাছে শ্রুত হয় ‘ডাক দেয় মাতা পদ্মা, পিতা সিন্ধু- তীর।’ (‘পনেরই আগস্ট, ১৯৪৭’ / দিনেশ দাস)। মনে হতে পারে এটা বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার বিবাদ কিংবা গৌরব দোষ। আসলে পুরোটাই স্বপ্ন বিপর্যয়ের যন্ত্রণার ফল। আলগোছে ছিল নির্লজ্জমনা শিক্ষিত সমাজের কূট প্রয়াস এবং স্বাদেশিকতার ভণ্ডামি। জাতীয়তাবাদের অসম্পূর্ণ পাঠ নেওয়া এই সব নেতারা জীবন ও দেশ দুই-ই রক্ষা করতে ব্যর্থ। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ নিরুপায় অসহায় হয়ে ঐতিহ্যকে চোখের সামনে ধর্ষিত হতে দেখেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি; বরং তারা অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। মানুষের তথা জীবের আদিমতম জৈবিক প্রবৃত্তি যে বেঁচে থাকার লড়াই, তা রক্তক্ষয়ী মুখোমুখি সংঘাতে আরও স্পষ্টভাবে নির্ণীত হল। সামাজিক প্রতিরোধের বদলে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষার তাগিদ বড়ো হয়েছে। ফলে ঐকত্রিক যাপন সংস্কৃতির খিলানগুলো ক্রমশই আলগা থেকে আলগাতর হল এবং সংহত মানব সত্য ও শক্তির মূলোৎপাটন ঘটল। এই প্রতিবেশে বিস্ময় রুদ্ধ কবির ‘— দুচোখে আজ করে ছলোছল / পদ্মার অজস্র জল —।’ এই হৃদ্‌গন্ধী অভিজ্ঞান নিয়েই ইতিহাসে শুরু হবে নতুন পর্যায়। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের গায়ে লেগে থাকবে করাতের দাঁতের দাগ। ক্ষতবিক্ষত সময় যাপনের সংহত ইতিহাসের পাতায় থাকবে ‘ছিন্নমস্তা করে শুধু রক্তের আস্বাদ।’ প্রাণে মনে বাহিত হবে রক্ত-দাগা সীমানা ও ব্রিটিশের অভিপ্রায়। কবি দিনেশ দাশের কবিতার যেন সেই ইতিহাস ছিন্ন শব্দগুচ্ছ — ‘সীমানার দাগে দাগে জমাট রক্তের দাগ / কালনেমি করে লঙ্কা ভাগ।’ (‘পনেরই আগস্ট, ১৯৪৭’ / দিনেশ দাস)।

১৯৪৬–৪৭-এর ভয়াবহ দাঙ্গায় ফলত দেশ বিভাজনে দু-টি বৃহৎ সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের নিরাপদ দুই বিশ্বের দিকে প্রাণ নিয়ে পালাতে চেয়েছে। অবশ্যই বিপরীত অভিমুখে। একজনের দরজা যেদিকে খোলা আর-একজনের দরজা সে দিক থেকে বন্ধই রয়ে গেল। একজন ঢাকা থেকে হাওড়ামুখী, তো আর একজন হাওড়া থেকে ঢাকামুখী। এই সোজা উলটো বুনোনের মধ্যেই জীবন বাজি রেখে ঘর খুঁজে ফেরার মারণ-অভিযান। বিষ্ণু দে’র কবিতায় দেশ ছেড়ে ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে মানুষ তার শিকড় সঞ্চালনের সন্ধানে অসহায় যাত্রী —

"এখানে ওখানে দেখ দেশছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায়
পার্কের ধারে শানে পথে পথে গাড়িবারান্দায়
ভাবে ওরা কী যে ভাবে ! ছেড়ে খোঁজে দেশ
এইখানে কেউ বরিশালে কেউ কেউ বা ঢাকায়
................
কোথায় যে যাবে ভাবে হাওড়ায় নাকি সে ঢাকায়
................
কোথায় যে যাবে ভাবে কোন্‌ দেশ শীতল বর্ষায়
................
হাওড়ায় চাটগাঁয় বাঁকুড়ায় চলেছে ঢাকায়।"

(‘জল দাও’ / বিষ্ণু দে)

স্বাধীনতার আস্বাদ অবসিত হতে সময় লাগল না। অনিকেত জীবনবোধের তাড়নায় ভিটে মাটি থেকে শিকড় ছিন্ন মানুষের অভাবিত উদ্‌বাস্তু জীবন। অগণিত সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে গ্রাম জীবন ছেড়ে ইমিগ্রেশনের খাতায় ঠিকানা জমা দিয়ে অজানার পথে হাঁটা দিয়েছে। ‘গ্রামে কে বলল পালারে সবাই পালা’। আদুরি দুলালিরা তাদের চোখের সামনে দেখেছে, গ্রামের অসংখ্য ভয়ার্ত পরিবারকে পালাতে, অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে। শুনেছে ‘ঘরে কে আগুন দিয়ে বলেছিল পালা’। সেই শুরু হল ঠিকানা বদলের ছুট। তারপর পরিজন বিচ্ছিন্ন হয়ে কাঁটাতার পেড়োনোর পালা। গ্রামে গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখায় আত্মপরিচয় জমা দিয়ে ‘ঘাড় নীচু মাথা নীচু’ করে হাঁটতে হয়েছে উদ্দেশ্যহীন ছেঁড়া ছেঁড়া দীর্ঘ পথ। আর জন্মভিটেয় ফেলে এসেছে স্মৃতি, সত্তা ও ভবিষ্যৎ। এক পরিচয় থেকে আর-এক পরিচয়য়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় ফেলে যেতে হয়েছে স্বজন, পরিজন, আত্মজ। আদুরি হারিয়ে গেলেও দুলালি বেঁচেছে। কিন্তু একটু একটু করে সংসার সমাজ ও দেশ-পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তার সত্তা। বাড়ি থেকে বস্তি, ভরা সংসারের আদর থেকে কাজের মেয়ে-লোক,রাত পড়শীর কাছে দেহ সমর্পন,অবশেষে দুলালি বা প্রিয়বালার পরিচয় হারিয়ে ‘নন্দর মা’ হয়ে ওঠার ঘটনা আসলে এক থেকে অসংখ্য নারীর বাস্তুচ্যুতির আখ্যান। কাঁটাতার পেরিয়ে পালিয়ে আসার রাস্তায় খসে গেছে তাদের ছায়া-মায়া ঘেরা সময়ের স্মৃতি, যাপন করেছে নারকীয় মুহূর্ত —

"খানিকটা নাম ধানক্ষেতে পড়ে গেছে, খানিকটা গেছে নদী জলে আঘাটায়
খানিকটা নাম নিয়ে নিল পাঠশালা, খানিকটা গেল রাস্তার দাঙ্গায়।
……………
খানিকটা গেছে রাত পড়শীর কাছে।"

(‘নন্দর মা’ / জয় গোস্বামী)

নারী পালিয়েও বাঁচেনি। ছলে-কৌশলে বাঁচতে হয়েছে, বাঁচাতে হয়েছে নন্দর মতো সন্তানদের। আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিতে হয়েছে নিরাপত্তা। তবুও মানবতার চোরাশিকারিদের কাছে এরাই হয়ে উঠল Soft target, ব্যবহারের সামগ্রী। একটা বয়স সময়ের হিসেবে কাটলেও, পরবর্তী সময় কেটেছে সব সাধ-আহ্লাদ-হৃদয় —

"একটা বয়স সে দেশে ছেড়ে এলাম
একটা বয়স নিয়ে ছেড়ে দিল স্বামী।
একটা বয়স ছেলে বড়ো করে শেষ
ছেলের নামেই আজ চেনা দিই আমি।"

(ঐ)

নীড় ভাঙা ঝড়ে সব হারিয়ে দুলালি আজ একা। দেশভাগের অভিঘাত একই সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে ব্যক্তি-পরিচয় (‘হারিয়ে গেছে নাম’), রাষ্ট্রিক পরিচয় ও সামাজিক অবস্থান। আজ তার পরিচয়, সে 5c-র ঠিকে ঝি ও নন্দর মা। দুলালিরা কেউ নন্দর মা হয়ে বেঁচেছে, কেউ মরে বেঁচেছে, কেউ অন্ধকারে বেঁচে মরেছে, কেউ বা আদুরির মতো ‘ছিটকে গিয়ে কোথায় পড়ল, কেউ জানলো না কিছু’। ‘এক চোখো চাঁদে জ্বালা’ গ্রাম থেকে পালিয়ে এসে বস্তির নরক দর্শনেও দুলালিদের রেহাই নাই, ‘গ্রাম পোড়া ছাই এখনো আসছে উড়ে’।

প্রাপ্তিকে ছাপিয়ে গেল হারানোর আর্তি। জীবন-ধাত্রী মাকেই বাস্তু ছিন্ন করে এনে বসিয়েছি বস্তিতে, শিয়ালদার ফুটপাথে। ভিক্ষা পাত্র হাতে মাতৃস্থানীয়াদের নরক যাপন দেখে ঘৃণা ও ধিক্কারে কবিকন্ঠ উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। বেআবরু হয়ে উঠেছে আমাদের যাপন ভূমির আত্মকথা —

"ধাইমা এ কোন পৃথিবী আমাকে দেখালে?
বুড়ি, সর্বনাশিনী, আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছিলি
এই কল্পনীয় পৃথিবীতে
আমি আর কত কিছু হারাবো?"

(‘ধাত্রী’ / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

ঘর হারানো, স্বজন হারানো, শিকড় ছিন্ন মানুষের এই নিদারুণ জীবনকে বয়ে বেড়ানোর ক্ষতই সভ্যতার গভীর অসুখের উৎস। নির্বাসিত মায়ের  তথা নারীদের অকল্পনীয় লাঞ্ছনায় বিস্মিত কবির শব্দগুচ্ছে স্থলিত হয়ে যায় সভ্যতার অহমিকা। আশায়-মায়ায়-ভালোবাসায় বাঁধা ঘর থেকে তাড়া খেয়ে শিয়ালদার নরককুণ্ডে ছিন্ন খঞ্জনাদের টিকে থাকার দুর্মর বাসনা, — সেদিনের জীবন-বাস্তবতার এক হৃদয় বিদারক ছবি। এই দৃশ্য-পটের প্রতিমান মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় —

শিয়ালদহর প্লাটফর্মে আছড়ে-পড়া উদ্‌বাস্তু সংসারে
বিষাদ প্রতিমা
মা তোমার ঘর নেই!

(‘শুকনো মুখ, উস্কো খুস্কো চুল’ / মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়)

এ তো কেবল বহিরঙ্গের ছবি। কিন্তু যে বহুমুখী জীবন যন্ত্রণার অভিঘাত নিয়ে ‘বিষাদ প্রতিমা’-দের টিকে থাকা বা ঝরে যাওয়া, সেই সব মুহুর্ত যাপনের অনুভব রয়ে গেছে সমাজ-সভ্যতার গভীরতর অসুখের ভিতরে। আজও বাতাসে ওড়ে নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষার ছাই। পরস্পর মুখোমুখি দু’হাতে মাখা নিঃশব্দ অপরাধ। পিছনে তাকালে আলোয় জমা জমাট রক্তের কালো। আমাদের দেশ-কালের ইতিহাস চেনে এই নৈঃশব্দ্যের অন্ধকার। আমাদের পিতামহের দীর্ঘশ্বাসে সরেনি আকাশের কালো। আমাদেরও সেই আকাশের নীচেই অবস্থান। সুতরাং কালের এই অভিজ্ঞান নিয়েই চেতনায় বহন করতে হবে, সেদিনের দাঙ্গা-লাঞ্ছিত দেশ বিভাগের ট্র্যাজেডি —

"যন্ত্রণা শুধু অস্তিত্ব — যে যন্ত্রনা ... যন্ত্রণা ....
এসো মিশে যাও জীবন যেখানে হাহাকার গর্জনে
বাঙলা, আমার বাঙলা।"

(‘এস দেখে যাও’ / মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়)

মৃত্যুদীর্ণ উপত্যকায় দাঁড়িয়ে বাংলার হাহাকার কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করেছে লাভার মতো। ঐক্যের মাটিতে যারা পরস্পর আত্মীয়তার বীজ বোনার স্বপ্ন দেখেছিল, তারাই বিশুদ্ধ আবেগ নিয়ে নেতাদের মর্জিকরণের ভাগাভাগিকে উপেক্ষা করেছে এবং পরস্পরকে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার আত্মিক আহ্বান জানিয়েছে —

"ফিরে এসো যারা গাঁ ছেড়ে গিয়েছো, তরুলতিকার বাঁধে
তোমাদরে কত অতীত দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।"

(‘বাস্তু ত্যাগী’ / জসীমউদ্দিন)

ধর্মকে ঢাল করে ক্ষমতাভোগের নেশায় ধর্ম ও রাজনীতির অশুভ আঁতাত বাস্তুচ্যুত মানুষকে আর বাস্তুতে ফিরতে দেয়নি। ‘এক বৃন্তে দু-টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’ বা ‘আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দু-টি তারা’ জাতীয় অসাম্প্রদায়িকতার বীজ মন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে খিল এঁটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ঐকত্রিক জীবন বোধের ঘর-দুয়ার। যাবতীয় দুঃখ শোক ক্ষোভ অভিমানকে অবসিত করার পর হৃদয়ের কাছে ফিরে এসে নির্মাণ করতে হয়েছে ভৌগোলিক সত্য নির্জিত এক কল্পলোকের — ‘ওপারে যে বাংলাদেশ / এপারেও সেই বাংলা।’ (‘পারাপার’ / সুভাষ মুখোপাধ্যায়)। মনোভূমিতে এর সত্যতা থাকলেও মেলবার উপায় নেই। কারণ, ‘মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে’ কাঁটাতারের বিভাজিকা, আইনি ফরমান। ‘তোমার’, ‘আমার’ ভাগাভাগির মধ্যেও আবেগে অনুভবে হৃদয়ের আনাগোনা রয়ে গেছে বন্ধনহীন — ‘তোমার পাখি এসে ডাকে আমার বাগানে’। (‘নষ্টনীড়’ / সমর সেন)। যদিও অখণ্ড সাজানো বাগান আজ একটা প্রাণহীন রুক্ষ ভাগাড়। এই ক্লেদাক্ত ছবিটা চোখ থেকে কিছুতেই সরবার নয় —

"নষ্টনীড় পাখি কাঁদে আমাদের গ্রামে
রক্তমাখা হার দেখি সাজানো বাগানে।"

(ঐ)

যুদ্ধের অশ্বারোহীরা শুধু জয় চায়। তার জন্য মানুষের জীবনকে নরক করে দেওয়া যায়। রক্ষকের মুখোশ এঁটে নারীর জীবনকেও করে দেওয়া যায় ভাগাড়। যৌনতার বিষাক্ত লালায় পরিবার বোধের বিশ্বস্ততাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়ে, সমাজকে ঠেলে দেওয়া যায় ঘোরতর অন্ধকারের দিকে। ভেঙেছে দেশ, রক্তের দাগে চিহ্নিত হয়়েছে সীমানা। এর জন্য মানুষের নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণার দায় কোনও সম্প্রদায়েরই সাধারণ মানুষের উপরে বর্তায় না। এই বিভাজনে যে তাদের সমর্থন ছিল না, তা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বয়ানেও স্পষ্ট। বরং সাধারণ মানুষ চেয়েছে —

"গরিবের ধন এক মানিক্য ......
জোরা-তালি মানচিত্র, যৌথ নিবাস ....।"

(‘সকরুণ’ / যীশু আহমেদ)

কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতি মুষ্টিমেয় সাধারণ মানুষকেই ব্যবহার করেছে। একজনের ‘দু-টি কলঙ্ক মাখানো হাত’ আর অন্যজনের ‘দুখানি রক্ত মাখানো হাত’ প্রতিরোধহীন আঘাতে সক্রিয় হয়েছে। হয়ে উঠেছে সভ্যতাবিনাশী, আলোকবিনাশী। অথচ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জয়ের আনন্দকে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে মানবিক ঔদার্যে ভাগ করে নেওয়া যেত। তা না পারার জন্য কবি শঙ্খ ঘোষের ক্ষমাপ্রার্থনা — ‘মার্জনা করো’। এরই সঙ্গে সত্তার সমগ্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন  হওয়ার বেদনার শব্দায়ন — ‘আমিই আমাকে ছেড়েছি মধ্যরাতে’। (‘একা’ / শঙ্খ ঘোষ)। সুতরাং কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ‘আমার আমি-র থেকে জেগে ওঠে আরও আরও আমি’ — মনুষ্যত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এই ‘আমি’-র অন্তর্গত  আলোকবিশাশী সত্তা-ই ‘একার দুঃখ, একার মৃত্যু, জয়’-কে ডেকে এনেছে। যেখানে ‘কেউ কারো বন্ধু নই, সকলে সবার আততায়ী’। (‘আদি পুরাণ’ / শঙ্খ ঘোষ)। দেশভাগের আখ্যান আসলে অনেক ‘আমি’-র সংগঠিত অপরাধ। কবিও এই ‘আমি’-র বাইরে নন। তাই মনুষ্যত্বের দায় মাথা পেতে নিয়ে তাঁর চরম স্বীকারোক্তি —

"আমার মুখে আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত
আমার বুকে পালানোর পালানোর আরও পালানোর দেশ জোড়া স্মৃতি
তাই আজ যদি দু-হাতে তুলতে চাই অভয়
কেঁপে যায় হাত, মনে পড়ে
   এত দীর্ঘদিন আমি কখনোই তোমার পাশে ছিলুম না ......"                     

(‘দেশহীন’ / শঙ্খ ঘোষ)

তাহলে কী অসুখের অনেক আগেই নির্ণয় করা গিয়েছিল রোগের লক্ষণ! অর্থাৎ, সম্প্রীতির পিছনে প্রয়োজনের তাগিদ যতটা ছিল, আন্তরিকতা ততটা ছিল না! এই মূল্যায়নের সমর্থন পাই রবীন্দ্রনাথেও। জয় করেও কবিকণ্ঠে তাই আত্মলাঞ্ছনার অবসাদ। পরস্পর পাশে থাকতে না পারার অপরাধবোধ নিয়ে শঙ্খ ঘোষ লেখেন — ‘তবু তোমার সামনে আজ বলতে চাই জয় / যে কথা বলা আমার সাজেনা’। (ঐ)৷ মানবতার এই নিধনযজ্ঞে কালনেমিদের যজ্ঞাগ্নিতে আমরাই ঘি ঢেলেছি। সংকোচের বিহ্বলতায় কণ্ঠ রুদ্ধ। স্বাধীনতা পর্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা ধর্ম ও রাজনীতির বোরে হয়েছি। শহিদের আত্মত্যাগের মহত্ত্বকে ঢেকেছি বীভৎস আত্মলাঞ্ছনার উপপ্লবে। মানবতার মহিমাকে ক্লেদাক্ত করে ‘মেদমজ্জামাংস দিয়ে এঁকে যাই আত্মজয়টিকা’। (‘আদি পুরাণ’ / শঙ্খ ঘোষ)। এই ‘জয়টিকা’ আসলে সভ্যতার কলঙ্ক তিলক। ভিটে-মাটি হারানোর বেদনা, স্বজন হারানোর কান্না, এত রক্ত, — ‘জয়ের আনন্দ কন্ঠে বাজেনা’। এত মৃত্যুর পরেও গভীর অনুভবে কবির মনে হয়েছে ‘মৃত্যুর ভিতর আজ কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ —’। (‘শহিদ শিখর’ / শঙ্খ ঘোষ )। এই মৃত্যুর মধ্যে না আছে স্বাভাবিকতা, না আছে গৌরব। এক আত্মঘাতী অসুখের ধারা পথেই ডেকে এনেছি এই রক্ত স্রোত ও বিচ্ছেদের বিপন্নতা। যার স্রষ্টা ও উপভোক্তা এক একজন ‘আমি’ তথা আমরা। কবিদের কবিতাতেও উঠে এসেছে দেশ ও জাতির রক্তস্নাত সেই বদ্ধভূমি ও জল্লাদের উল্লাস মঞ্চের স্থির চিত্র —

ক) "দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত
ভাইবোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে; ...............।"

(জীবনানন্দ দাশ)

খ) "সামনে গড়াগড়ি যাচ্ছে
ভাই বন্ধুদের মাথা;
পেছনে আততায়ী আমার ভাই।"               

(‘পাখির চোখ’ / সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

গ) "এর ওর মাংস খেতে আমরাই ঝাঁপিয়ে পড়ি সীমানার ধারে
সজীব সহাস মুখে প্রণয়ের কথা বলে কামড়ে ধরি অরক্ষিত ঘাড়ে।"

(‘আদিপুরাণ’ / শঙ্খ ঘোষ)

ক্রমাগত জীবন পতনের নিষ্ঠুর অভিঘাত সত্ত্বেও মানুষ নামক নির্মম প্রাণীর বোধ বুদ্ধি জেগেও জাগে না। মন্বন্তর-দাঙ্গা-দেশ বিভাগের সময় থেকে ‘প্রতিটা দিন আমরা শুধু সুধে যাই অন্য সকলের জমা দেনা’। (ঐ)৷ আজও সেই ভয়াবহ ঘটনার ‘মৃত্যুশব্দ রক্তশব্দ ভীতিশব্দ’ না ভোলা গেল, না এড়িয়ে পার পাওয়া গেল। ইতিহাস এমনই নির্মম। ‘আমি’-র শরিকি বাধ্যবাধকতায় সময়ের ভার আজও কাঁধ থেকে নামানো গেল না।

"...............আমি সেই প্রাচীন নাবিক
পাথরের ভার নিয়ে আমার গলার থেকে মালা হয়ে ঝুলে আছে পঞ্চাশ বছর।"

(‘আদিপুরাণ’ / শঙ্খ ঘোষ)

শুধু পঞ্চাশ বছর নয়, এই বেদনা ও যন্ত্রণার কলঙ্কিত ইতিহাস সময়ের অনন্ত যাত্রা পথে আমাদের বহন করতে হবে। পুরুষানুক্রমে। আর চিরন্তন শৈশব আমাদের অভিভাবকত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে তীব্র ধিক্কারে বলে যাবে —

"তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা।"

(‘খোকা ও খুকি’/ অন্নদাশঙ্কর রায়)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান