দেবাশিস মল্লিক
পৌরাণিক কাহিনিতে অমৃতলাভের জন্য সমুদ্র মন্থনের ফলে শুধু অমৃত ওঠেনি, তার সঙ্গে উঠেছিল তীব্র হলাহল, তাবৎ বিশ্বসংসারকে রক্ষা করতে দেবাদিদেব মহাদেব সেদিন স্বকণ্ঠে এই হলাহল ধারণ করে হয়ে উঠেছিলেন ‘নীলকণ্ঠ’। আর এ দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনে আনন্দ অবিমিশ্র থাকেনি, সঙ্গে দেশভাগের গভীর বেদনা ও মানুষের সীমাহীন অমর্যাদাকে শিরোধার্য করতে হয়েছিল। বাংলাভাগের কারণে উৎসারিত গরলে জর্জরিত হয়েছে উভয়বঙ্গের বাঙালির জীবন ও জীবিকা, ধ্বস্ত হয়েছে তার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ নিশ্চিতভাবে দুই বাংলার আর্থসামাজিক সুস্থিতির পক্ষে মস্ত বড়ো বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। ১৯০৫ সালে কার্জনের বাংলাভাগের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে উদ্দীপনাময় প্রতিরোধে যে হিন্দু ভদ্রলোকশ্রেণিকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছিল, মাত্র ৪২ বছরের ব্যবধানে তার পুনরাবৃত্তি তো ঘটেইনি, বরং এই ভদ্রলোকশ্রেণির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা এমন সাম্প্রদায়িক বিভেদের খাতে বইতে শুরু করে যে সাধারণ মানুষও বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করবার প্রস্তাবকে স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মেনে নিয়েছিল!১ কিন্তু কেন এমন হল আর এত অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবেই বা জনমানসের এই আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল তার কারণ অনুসন্ধান বর্তমান প্রবন্ধের মূল অভিপ্রায়। আমরা দেখি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সময় বাংলায় স্বাদেশিকতার জোয়ার এসেছিল, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন নতুন দিশা পেয়েছিল, তার অব্যবহিত পরেই বাংলায় তথা সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন শুরু হয়ে যায়। ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমানদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিলেন। ৩০শে ডিসেম্বর আগা খানের সভাপতিত্বে গঠিত হল নিখিল ভারত মুসলিম লিগ। সূচনা পর্বে লিগের ঘোষিত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল— ক) ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য বাড়ানো এবং সরকার বাহাদুরের সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানের মনে যাবতীয় ভুল ধারণা ও অসন্তোষ যথাসম্ভব দূর করা, খ) ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানো, তাদের স্বার্থরক্ষা করা এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের অভাব অভিযোগ, আশা আকাঙ্ক্ষা সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া, এবং গ) লিগের লক্ষ্যের কোনো ক্ষতিসাধন না করে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখা। লিগ গঠনের পর পরই নেতারা পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের দাবি জানালে ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রয়োজনীয় শাসন সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন, এর ফলে সমাজে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পথ প্রশস্ত হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করবার জাতীয় কংগ্রেসের প্রচেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই শাসন সংস্কারের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুদের একাংশ শুধু হিন্দুদের জন্যও পৃথক একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, ১৯১৫ সালের ৯ এপ্রিল হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নিয়ে গঠিত এই দলের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক ঐক্যগত মতাদর্শের বিরোধিতা করা এবং হিন্দুসমাজকে সম্প্রদায়গতভাবে ঐক্যবদ্ধ করা। এরপর ১৯২৫ সালে হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুললে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা জঙ্গি চেহারা পায়।২ এরপর মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সম্মিলিত প্রয়াসে সমাজে দ্রুত সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও ঘৃণার পরিবেশ বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত আকারে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় জনমানসে একটা সার্বিক হতাশা দেখা গেল। নৌ বিদ্রোহের সমর্থনে এবং আই এন এ-র সেনানী ক্যাপ্টেন রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে গোটা ভারতে হিন্দু মুসলমান জনতা একসঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামলে সারাদেশে উৎসাহের সঞ্চার ঘটে যা ব্রিটিশ শাসক ও বিভেদকামী শক্তিকে শঙ্কিত করে তোলে। এল ১৬ আগস্ট, যেদিন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিয়ে মুসলিম লিগ কলকাতায় যে হানাহানি শুরু করেছিল, অচিরে হিন্দুরা তার প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করলো। এর প্রতিক্রিয়ায় নোয়াখালিতে এবং তারও প্রতিক্রিয়ায় বিহারে ও উত্তরপ্রদেশে নারকীয় ধ্বংসলীলা চলল, সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে পাঞ্জাবের পরিস্থিতিও তখন হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও হিংসার সেই বিষাক্ত বাতাবরণে দুই সম্প্রদায় আর একসঙ্গে থাকতে পারবে না এটা সাধারণ মানুষের মনে নিশ্চিতভাবে গেঁথে গেল। অথচ আমরা ভুলে গেলাম এই হানাহানির সময়েও কিন্তু সম্প্রদায় নির্বিশেষে শ্রমজীবী মানুষ দাঙ্গা হাঙ্গামার বিরুদ্ধে দিকে দিকে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে একইসঙ্গে মহাত্মা গান্ধির আবির্ভাব ঘটে এবং প্রায় একই সময় থেকে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির প্রভাব ও গুরুত্ব খর্ব হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে মুসলমান সম্প্রদায়কে পাশে পেতে গান্ধিজি খিলাফতের দাবিকে জুড়ে নিয়ে শুরু করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলন, কিন্তু আন্দোলনের এক চরম পর্যায়ে তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় দেশজুড়ে চূড়ান্ত হতাশা সৃষ্টি হল। কংগ্রেসের মধ্যেও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে তীব্র মতভেদ দেখা দিল। অবশেষে ১৯২৩ সালের পয়লা জানুয়ারি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মতিলাল নেহরু প্রমুখ কংগ্রেসের মধ্যে স্বরাজ্য দল গঠন করলেন। কিন্তু হিন্দু— মুসলমান সম্প্রীতিরক্ষায় দেশবন্ধু প্রবর্তিত ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেল ১৯২৫ সালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে। এরপর তাঁর সুযোগ্য শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪০-৪১ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছেন। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সুভাষ অন্তর্ধান করেন। দেশের মুক্তি কামনায় প্রথমে আফগানিস্থান, তারপর রাশিয়া হয়ে জার্মানি, শেষে জাপান ও সিঙ্গাপু্রে এসে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ও ক্যাপ্টেন মোহন সিং প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে ১৮ই আগস্ট তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর খবরও প্রচারিত হয়েছিল। অন্যদিকে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক, যিনি লিগের লাহোর অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবিসম্বলিত লিখিত প্রস্তাব পাঠ করেছিলেন, অনগ্রসর মুসলিম কৃষকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয় হক সাহেব ১৯৪৬-৪৭ সালের বঙ্গরাজনীতিতে চলে গেছেন পিছনের সারিতে। ফলে বাঙালির একান্ত দুর্ভাগ্য যে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বে হিন্দু মুসলমান উভয়ের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য হতে পারেন এমন কোনো নেতা বাংলায় উপস্থিত ছিলেন না! বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির নেতাদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতার জন্য লালায়িত কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলা ভাগে সম্মতি দিলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভাও চাইছিল মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা করতে। শ্যামাপ্রসাদ নেহরুকে বলেছিলেন ‘You devided India, I devided Bengal’, অন্যদিকে সোওরাবর্দি ডাক দিলেন ‘বৃহত্তর বঙ্গের’, যা আয়তনে ও জনসংখ্যায় ভূমিষ্ঠ হতে যাওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৃহত্তম প্রদেশ হবে। ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স সমষ্টিগতভাবে এবং বিড়লা, জালান, গোয়েঙ্কাসহ বাঙালি শিল্পপতিরা সোওরাবর্দির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে কলকাতা সহ হিন্দুপ্রধান অঞ্চলকে নিয়ে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে পৃথক পশ্চিমবঙ্গের জোরালো দাবি তুললেন। আবার শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাসিম, কিরণশঙ্কর রায়রা ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার জন্য সওয়াল করছিলেন, কিন্তু লিগপন্থী বরিশালের তপশিলি নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলও বাংলা ভাগের পক্ষপাতী ছিলেন। এর ফলে বাংলা ভাগ অনিবার্য পরিণতি হয়ে উঠল।৩
আমাদের অনেকের মধ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে গৃহীত পাকিস্তান প্রস্তাবের অনিবার্য পরিণতিতেই বুঝি বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে যখন মুসলমানদের নিজের দেশ পাকিস্তান গড়ে তোলার দাবি ওঠে, তখন জনসংখ্যার নিরিখে মুসলমানপ্রধান প্রদেশ হিসেবে বাংলার পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ছিল। এতে হিন্দু ভদ্রলোকশ্রেণির মানুষজন ভয় পেলেন, বিষয়সম্পত্তি এবং সামাজিক প্রতিপত্তি হারাবার ভয়, যা তাঁরা এতকাল ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় ভোগ করে এসেছিলেন। আর একদল সম্পন্ন উচ্চবর্ণের হিন্দু, যাঁদের শিকড় পূর্ববঙ্গে থাকলেও পড়াশোনা বা জীবিকার কারণে বহুকাল আগে থেকেই কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করছিলেন, তাঁরা সহজেই পরিবার নিয়ে চলে আসতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য ছিল, তাঁরা কিন্তু রাতারাতি সাম্প্রদায়িক হয়ে যাননি। তাঁদের প্রজন্মবাহিত অভিজ্ঞতায় ছিল জমিদার ও মহাজনের (যাঁদের আবার সিংহভাগ ছিলেন হিন্দু) শোষণ অত্যাচার, যা থেকে পরিত্রাণ পেতে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি দেখতে চেয়ে তাঁরা পাকিস্তানের দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। একেবারে সাধারণ মুসলিম সমাজ তখনও কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে নতুন দেশে হিন্দু মুসলমান মিলে মিশে থাকার কথা ভেবেছেন।৪ কিন্তু সেইসময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একদল রাজনৈতিক কর্মী, স্থানীয় নেতা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে এবং একশ্রেণির জোতদার ও দালাল বৈষয়িক লাভের জন্য বাইরে থেকে গ্রামে গিয়ে পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলল। যা ক্রমশ সাধারণ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আসলে এই ডামাডোলের সুযোগে সম্পন্ন হিন্দুর জমিজমা, বাস্তুভিটে, পুকুর-বাগান সবকিছু গ্রাস করবার লোভ মাথাচাড়া দিচ্ছিল। বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোওরাবর্দি চেয়েছিলেন নির্বিচার খুনজখম চালিয়ে এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে, যার ফলে আপন শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে লিগ তার অভীষ্ট সহজেই পূরণ করে নেবে। কিন্তু কলকাতায় দাঙ্গা শেষপর্যন্ত একতরফা হয়নি, আবার নোয়াখালিতে একতরফা আক্রমণ হলেও তার জবাব মিলেছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশে। অদূর ভবিষ্যতে এত রক্তপাত, অগণিত হত্যা, অসংখ্য গৃহহারা, সহায়সম্বলহারা মানুষের চোখের জলকে যে দৃষ্টান্ত হিসেবে, দেশভাগের যুক্তি হিসেবে খাড়া করা হবে একথা সেদিন ক্ষমতালোলুপ রাজনীতির কারবারি ছাড়া আর কেই বা ভাবতে পেরেছিল?৫
এভাবেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে দু-টি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবের অধিবাসীদের আত্মত্যাগ সবচেয়ে বেশি ছিল, সেখানকার কোটি কোটি মানুষের জীবনকে রাতারাতি চূড়ান্ত বিপর্যস্ত ও অনিশ্চিত করে তুলে দেশভাগের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল! পিতৃপুরুষের জমি জায়গা থেকে একলহমায় উৎখাত হয়ে তাঁরা চলে এলেন অনেক আশা আর স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কিন্তু এখানে এসে পেলেন কি? বাংলা ও পাঞ্জাবের পরিস্থিতি কিন্তু একরকম ছিল না। স্বাধীনতালাভের ঠিক আগে থেকে বেশ কিছুদিন ধরে পূর্ব এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে এক ভয়ংকর হননযজ্ঞ চলেছিল, যার ফলে সেখানে দু-দিকে প্রায় সমানভাবে বাস্তুহারা মানুষের মিছিল দেখা গিয়েছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় খুব দ্রুত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, জন বিনিময় ও সম্পত্তি বিনিময়ের কাজও খুব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। অন্যদিকে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান কিংবা ১৯৭১ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বাঙালি বিতাড়ন ঘটেছে সুদীর্ঘকাল ধরে এক যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার আগে ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত জীবিত পরিবারগুলো আতঙ্কে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসে। সেই শুরু, তারপর স্বাধীনতার সময়কালে একের পর এক ঘটনায় বিপন্ন অপমানিত লক্ষ লক্ষ মানুষজন সব কিছু খুইয়ে এপারে আসে। স্বাধীনতার মহালগ্নে জাতির প্রতি প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নেহরু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন “তারা (পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা) আমাদের আপনজন এবং যা কিছু ঘটুক না কেন তারা আমাদের আপনজন থাকবেন এবং আমরা তাদের সুখ-দুঃখের সমভাগী থাকব।”৬ কিন্তু রূঢ় বাস্তব হল এই প্রতিশ্রুতি তিনি মনে রাখেননি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা প্রথম থেকেই সরকারের চরম ঔদাসীন্য, বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার। অজ্ঞাত কারণে সরকারের ধারণা হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষজন সামান্য কয়েকদিনের জন্য এসেছেন, আবার তাঁরা নিজের নিজের জায়গায় ফেরত চলে যাবেন, তাই তাঁদের স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনো প্রয়োজন নেই। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবহারে যে বৈষম্য তা দেখে নেওয়া যাক। সরকারি মতে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৫৮ লক্ষ (যদিও বেসরকারি মতে ১ কোটি ২০ লক্ষ), অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৪৭.৪০ লক্ষ। পুনর্বাসন বাবদ সরকার ব্যয় করেছেন পশ্চিমের জন্য যেখানে ৪৫৬ কোটি টাকা আর পূর্বের জন্য মাত্র ৮৫ কোটি টাকা। আসলে বহু সম্পন্ন মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিয়েছিলেন। যেমন নদিয়ার চাকদা এবং ফুলিয়া অঞ্চলে এরকম ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্পত্তি বিনিময় হয়েছিল। আর একদল গায়ের জোরে পড়ে থাকা জমি জায়গা বাড়ি জবরদখল করে নিয়েছিলেন। এদের বাইরে একদল ছিলেন যাঁরা অত্যন্ত গরিব, অসুস্থ এবং বয়স্ক একমাত্র তাঁরাই সরকারি ত্রাণ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বছরের পর বছর বাংলার শরণার্থী শিবির গুলিতে কয়েক লক্ষ মানুষকে শুধু ক্যাশ ডোল ও ড্রাই ডোল দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুর জন্য ১ লক্ষ ৬৬ হাজার বাসস্থান নির্মিত হয়েছে, তৈরি হয়েছে ১৯টি সম্পূর্ণ উপনগরী, যেখানে আধুনিক নগরজীবনের সমস্ত সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায়। পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাত্র ১১ হাজার বাড়ি তৈরি হয়েছে যা অবশ্যই পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের প্রদত্ত বাড়িগুলির স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে আদৌ তুলনীয় নয়। সরকার পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৬০ লক্ষ একর কৃষিজমি এবং ৬.৫০ লক্ষ একর বাস্তুজমি বণ্টন করেছিলেন। সেখানে পূর্ববাংলার ৯৫ হাজার উদ্বাস্তু কৃষিজীবী পরিবারের জন্য সরকার ৮৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন, যার অনেকটাই অনুর্বর এবং কৃষিকাজের অনুপযুক্ত। সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রেও বৈষম্য একইরকম ছিল। পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের মধ্যে যেখানে ২.৮৪ লক্ষ চাকুরি পেয়েছিলেন, বাংলায় সেখানে মাত্র ১.১০ লক্ষ।৭
১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের চিঠির উত্তরে প্রধানমন্ত্রী নেহরু জানাচ্ছেন পূর্ব বাংলা থেকে এভাবে দলে দলে হিন্দুদের চলে আসা ঠিক হচ্ছে না। পূর্ব বাংলার যেসব হিন্দু নেতারা জনগণকে না বুঝিয়ে নিজেরাই সে দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন, তাঁরা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছেন। আসলে নেহরু সমস্যা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, পূর্ব বাংলার হিন্দুরা কেউ স্বেচ্ছায় নিজের পিতৃপুরুষের জায়গা জমি ছেড়ে চলে আসেন নি, তাঁদের চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল। তিনি হিন্দু বাঙালির এই ভয়াবহ Exodusকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করলে দু-টি কাজ করতে পারতেন, পাকিস্তানকে বলতে পারতেন সংখ্যালঘুদের পূর্ববঙ্গে থাকতে না দিলে তিনি সৈন্য পাঠিয়ে আক্রমণ করতে বাধ্য হবেন অথবা পাঞ্জাবে যেমন দুই অংশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠুভাবে জনবিনিময় ও সম্পত্তি বিনিময় হয়েছে, ঠিক তেমনি বাংলায়ও করতে পারতেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল বাংলার বাস্তুহারাদের জন্য ভাষণ ছাড়া তাঁর দেয় কিছুই ছিল না!৮
স্বাধীনতার সময়ে কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের সবচেয়ে শিক্ষায়, শিল্পে, অর্থনীতিতে সবচেয়ে অগ্রসর, কিন্তু তারপর থেকে যতদিন গেছে, ক্রমে বাংলা ও বাঙালি শুধু পিছিয়ে পড়েছে। এর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে অনেকেই গড়পড়তা বাঙালির কর্মবিমুখতা ও অতিরিক্ত রাজনৈতিক সচেতনতার অভিযোগ তোলেন। এ সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিচার করতে গেলে আরও কিছু বিষয়ের উল্লেখ করতেই হয়। একদিকে যেমন ত্রুটিযুক্ত মাশুল সমীকরণ নীতি গ্রহণে, তেমনই উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের মতো আপৎকালীন পরিষেবাদানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম বৈষম্য দৃষ্ট হয়, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিষয়ে চূড়ান্ত অবহেলা দেখিয়েছেন। আবার উদ্বাস্তুদের নানা দাবি দাওয়া, অভাব অভিযোগ নিয়ে বামেরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন গড়ে তুললেও পরবর্তীকালে এদের নিশ্চিত ভোটব্যাংক হিসেবে নিজ স্বার্থচরিতার্থে ব্যবহার করেছেন। বাংলার উদ্বাস্তু ইতিহাসের পরতে পরতে এমন বঞ্চনা ও প্রবঞ্চনার সহস্র আখ্যান লিখিত আছে। ‘সেই একান্ত করুণ অথচ রোমাঞ্চকর ইতিহাস ভবিষ্যতে কোনোদিন লিপিবদ্ধ হবে কিনা জানি না। সরকারি দপ্তরে তার যে প্রমাণপত্র আছে তা হয়তো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ (সত্যরক্ষার জন্য) আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই অধ্যায় সম্বন্ধে বিবরণ উত্তরকালের জন্য রক্ষিত হওয়া উচিত’৯ বলে আমার বিশ্বাস।
তথ্যসূত্র :
১. চ্যাটার্জি জয়া, ‘বাংলা ভাগ হল’ (গ্রন্থ), ১৯৯৯, এল অ্যালমা পাবলিকেশনস, কলকাতা ৭০০০১৯, পৃ. ১
২. দত্ত আশিস, ‘৪৬-এর দাঙ্গার পশ্চাৎপট’ (প্রবন্ধ), ‘নিরন্তর’ পত্রিকা ১৩ বর্ষ ২য় সংখ্যা, মে ২০২৩, ISSN : 2278-7445 পৃ. ৭
৩. রায়চৌধুরী লাডলীমোহন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ’ (গ্রন্থ), এপ্রিল ২০২০, দে’জ পাবলিশিং, ISBN : 978-81-295-2202-3, পৃ.৯৩
৪. সরকার যতীন, ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু – দর্শন’ (গ্রন্থ), ফেব্রুয়ারি ২০১৩, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ১১০০, ISBN : 984-70000-0009-5, পৃ. ২৬
৫. বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দীপ, ‘ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ (গ্রন্থ), আগস্ট ২০১৯, র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ISBN : 978-81-939289-8-1, পৃ. ৭০
৬. সিংহ তুষার, ‘মরণজয়ী সংগ্রামে বাস্তুহারা’, ১৯৯৯, কলকাতা, পৃ. ৮
৭. চক্রবর্তী সুজন (সম্পা), ‘সীমান্ত পেরিয়ে সংগ্রাম বাস্তুহারা জীবনের ইতিবৃত্ত’ (গ্রন্থ), মে ২০২২, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, পৃ ৯ ও ১০
৮. চক্রবর্তী প্রফুল্লকুমার, ‘প্রান্তিক মানব’ (গ্রন্থ), ১৯৯৭, প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড, পৃ. ২২
৯. বন্দ্যোপাধ্যায় হিরণ্ময়, “প্রথম সংস্করণের ভূমিকা’’ ‘উদ্বাস্তু’ (গ্রন্থ), ডিসেম্বর ২০১৮, দীপ প্রকাশন, ISBN : 978 – 93 – 82040 – 97 -2, পৃ. xiii