সুখেন্দু হীরা
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ভারত শাসন আইন’ (The Government of lndia Act 1935) পাশ করল। এই আইন পাশ না করে উপায় ছিল না। এই আইনের মূল বক্তব্য ছিল ইংরেজদের হাতে প্রধান ক্ষমতা রেখে ভারতবাসীকে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। এর আগেই ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের দাবি উঠেছে। তারপর ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ শুরু। ভারতবর্ষে সর্বস্তরে স্বাধীনতা লাভের আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। তাই এইটুকু স্বায়ত্তশাসন দিয়ে আন্দোলনকে প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকার। আইন মতো ভারতবর্ষের প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্তশাসন চালু হয়।
এই ‘ভারত শাসন আইন’ বলে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচনের জন্য ভোট হয়। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কেবলমাত্র বাংলা ও পাঞ্জাবে কংগ্রেস পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বাংলায় মুসলিম লিগ ও কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যরা বেশি আসন পায়। কৃষক প্রজাপার্টির ফজলুল হক কংগ্রেসের সহায়তা না পেয়ে, মুসলিম লিগের সাহায্য নিয়ে বাংলায় মন্ত্রীসভা গঠন করেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগ নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে মুসলিম লিগের সভায় ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করেন। এর আগে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের এলাহাবাদ অধিবেশনে উর্দু কবি মহম্মদ ইকবাল পাঞ্জাব, সিন্ধু, কাশ্মীর, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত (বর্তমানে আফগানিস্তান) ও বালুচিস্থান নিয়ে একটি পৃথক মুসলমান প্রধান ও মুসলিম শাসিত অঞ্চল গঠনের কথা বলেন। এই উর্দু কবির বিখ্যাত গান, “সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা”। যা আমাদের অত্যাধিক প্রিয় দেশাত্মবোধক গান।
জিন্না প্রথমদিকে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র বা পাকিস্তান দাবি এসবে বিশেষ কান দিতেন না। কিন্তু ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে অধিকাংশ প্রদেশে মুসলিম লিগ পরাজিত হয়। এমনকি মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে একটি আসনও পায়নি মুসলিম লিগ। তার ওপর ছিল ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’র মতো জহরলাল নেহরুর বক্তব্য, ‘ভারতে এখন কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনও দলের অস্তিত্ব নেই’।
পরাজয়ের জ্বালা মেটাতে জিন্না দ্বিজাতিতত্ত্ব অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম দু-টি পৃথক জাতি এই তত্ত্বের দিকেই ঢলতে থাকেন। ইংরেজরাও এই দ্বিজাতিতত্ত্বে উৎসাহ দিতে থাকেন। কারণ এতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধার ও ভার কমবে।
১৯৪০ সালের পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধান (১৯৪১), ১৯৪২-এ ক্রিপস মিশন, তারপর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩), নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযান, নৌবিদ্রোহ (১৯৪৫) পেরিয়ে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আবার প্রাদেশিক নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাংলার মুসলিম লিগ জয় লাভ করে এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন হোসেন শাহিদ সোহারাবর্দী।
ইতিমধ্যে ভারতকে স্বাধীনতা দানের বিষয়টা অনেকদূর এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। তারপর থেকে ভারতের স্বাধীনতা ব্যাপারটা ব্রিটিশদের কাছে প্রাধান্য পেতে থাকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ইংরেজদের অন্যতম মিত্র কুয়োমিন তাং চিনের রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল চিয়াং কাইশেক ভারতকে স্বাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে ইংল্যান্ডের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাপানকে প্রতিহত করা। কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইলসন চার্চিল রাজি হননি।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন লেবার পার্টির ক্লিমেন্ট অ্যাটলি। তিনি ছিলেন উদারপন্থী নেতা। ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এক মন্ত্রী কমিশন পাঠান। তাঁদের প্রস্তাবে ভারত বিভাগ বা পাকিস্তান গঠনের কথা ছিল না। তখন মুসলিম লিগ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম (Direct Action Day)-এর ডাক দেয়। সেদিন কলকাতায় হয় সেই বিখ্যাত দাঙ্গা যা ইতিহাসে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে পরিচিত। এই দাঙ্গার আগুন ভারতবর্ষের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন পূর্ববাংলার নোয়াখালি ও ত্রিপুরায় দাঙ্গা লাগে। এই ঘটনাকে অনেকে দাঙ্গা না বলে গণহত্যা বলেছেন। এই দাঙ্গায় লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছিল। মহাত্মা গান্ধিকে নোয়াখালিতে ক্যাম্প করতে হয়। সরকারি হিসাবে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নোয়াখালি ও ত্রিপুরা থেকে ৫৮,৬০২ জন উদ্বাস্তু হয়। তাঁদের মধ্যে কিছু পরিবারকে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর রেলস্টেশনের অদূরে যমুনাবাঁধ কলোনিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। এই ভাবে বাঁকুড়া জেলায় প্রথম উদ্বাস্তু আগমন ঘটল।
কংগ্রেস বরাবর ভারত বিভাগের বিপক্ষে ছিল। মহাত্মা গান্ধি বলতেন, ভারত ভাগ করতে হলে তাঁর দেহের ওপর দিয়ে করতে হবে। কিন্তু এইসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তাঁরা ভারত বিভাগ মেনে নেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি মন্ত্রীসভায় ঘোষণা করেন, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসের আগেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করবে। ক্ষমতা হস্তান্তর সুচারু ভাবে করতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল ভারতের বড়োলাট হয়ে আসেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জুন ভারত বিভাগ প্রস্তাব ঘোষণা করেন। ১৮ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সেই প্রস্তাব অনুযায়ী ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’ পাশ করে। সেইমতো ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
আবার পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে (পশ্চিম পাকিস্তান) দাঙ্গা শুরু হয়। আবার পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে উদ্বাস্তুর ঢল নামে। দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু শব্দ দু-টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। স্বাধীনতার পর যতবার পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা বা বিপর্যয় ঘটেছে, ততবারই বন্যার জলের মতো উদ্বাস্তু বা শরণার্থীরা ভারতে এসেছেন। পূর্ববঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাঁরা অনেকে দেশে ফিরে গেছেন। বেশিরভাগ ভারতে থেকে গেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে যে অঘটনের জন্য ভারতে উদ্বাস্তু বা শরণার্থীরা এসেছেন তার একটি তালিকা দেওয়া হল।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ: সৈয়দপুর, রংপুর দাঙ্গা
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ: বরিশাল, পাবনা, রংপুর, বগুড়ার দাঙ্গা
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ: খুলনা দাঙ্গা (নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যাপক আগমন)
১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ; খুলনায় প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও দুর্ভিক্ষ (হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের আগমন)
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ: পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হয় ১৪ই অক্টোবর থেকে। তাই এর আগে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের আগমন।
১৯৬২-১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ: রাজশাহী ও পাবনার দাঙ্গা
১৯৬৪-১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ: পাক-ভারত যুদ্ধে ১২ লাখ সংখ্যালঘুর পশ্চিমবঙ্গে আগমন ও ৬ লাখ দণ্ডকারণ্যে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ।
এরমধ্যে একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো তা হল স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মূলত উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তরা ভারতে আসেন। কারণ এঁদের পূর্ববঙ্গে জমিদারি ছিল। জমিদারি করার জন্য প্রজাদের ওপর অত্যাচার করতে হয়েছে। প্রজারা বেশিরভাগ ছিল মুসলিম। তাই পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ায় তাঁরা বিপদ বুঝে প্রথমেই ভারতে চলে আসেন। এছাড়া ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মুসলিম রাজত্বে থাকতে অপরাগ হয়ে অনেক হিন্দু পূর্ব-পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসেন।
১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে সেরকম বড়ো রকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। কোনও দাঙ্গা ছাড়াই ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন খুব একটা থামেনি। সরকারিভাবে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। ১৯৭১ সালের পর হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় ভারতে এসেছেন অর্থনৈতিক কারণে। পৃথিবীর যে কোনও উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা দেখা যায়। পার্শ্ববর্তী বা প্রতিবেশী উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা সেখানে গিয়ে ভিড় জমায়, রুজি রুটির জন্য। শুধু তাই নয় অপরাধীরাও চলে আসে তাদের মৃগয়া ক্ষেত্র ভেবে।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যেসব উদ্বাস্তু কলকাতায় এসে জড়ো হতেন, তাঁরা বেশিরভাগ শিয়ালদা স্টেশনের কাছে ভিড় করতেন। তাঁদের ট্রাক বোঝাই করে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে এসে, হাওড়া-আদ্রা-চক্রধরপুর ট্রেনে রাতে তুলে দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হত। তারপর তাঁদের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত পিয়ার ডোবা এবং ওন্দা স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হত। পিয়ারডোবা স্টেশন থেকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হত বাসুদেবপুর-শিরোমণিপুর ক্যাম্পে। ওন্দা স্টেশন থেকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হত সাবানপুর ক্যাম্পে। এই দুটো ক্যাম্পে প্রায় ১০ হাজার উদ্বাস্তু পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করেছিল সরকার। এছাড়া পিয়ারডোবায় ছিল সহায় সম্বলহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ক্যাম্প।
কোনও বিপর্যয়ের পর কেউ যদি বাস্তুহারা হন তাহলে রাষ্ট্র বা কোনও হিতাকাঙ্ক্ষী সংস্থা বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা এবং আহারের ব্যবস্থা করে থাকেন। সেই ব্যবস্থাপনাকে ক্যাম্প বলে। তাই যখন পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা বা অন্য কোনও বিপর্যয় হয়েছে, তখন তাঁদের জন্য ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করেছে ভারত সরকার। কিন্তু ক্যাম্প স্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। তাই ক্যাম্প থেকে যারা নিজের দেশে ফিরতে পারতেন না, বা চাইতেন না তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতেন ভারত সরকার। ক্যাম্পে থাকার সময় উদ্বাস্তু ব্যক্তিবর্গদের ডোল-এর ব্যবস্থা থাকত। ডোল হচ্ছে ব্যক্তি কিছু সাপ্তাহিক রেশন। ডোল দু-রকম হত। ক্যাশ ডোল ও ফুড ডোল। ক্যাশ ডোলে থাকত পরিবার পিছু সংসার চালানোর টাকা। ফুড ডোলে থাকত চাল, গম, ডাল ইত্যাদি।
১৯৫৭ সালে এই সব ক্যাম্পে থাকা কিছু পরিবারবর্গকে রাজস্থানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। তাঁরা যেতে অস্বীকার করায় তাদের ডোল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলার বাইরে যেতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের ১৯৫৮ সালের প্রথমদিকে ডোল বন্ধ করে দেয় সরকার। ১৯৬১ সালে ডোলের ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ওই বছরই সমস্ত ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাসুদেবপুর-শিরোমণিপুর ও সাবানপুর ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গেলে কৃষিজীবী পরিবারগুলি দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদীর চরে খাসজমি, অনাবাদি জমি দখল করে থাকতে শুরু করেন। এগুলিকে বলা হয় জবরদখল কলোনি। অনুর্বর বালি জমি হাসিল করে চাষবাস করতে তাঁদের খুব কষ্ট হয়েছিল। যারা পারলেন না তাঁরা বেছে নিলেন ভিক্ষাবৃত্তি।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিটির সমীক্ষায় ৮০৭টি জবরদখল কলোনির সন্ধান মেলে। তার মধ্যে বাঁকুড়া জেলার ছিল ৪৪টি। পরবর্তীকালে কেন্দ্র সরকারের অনুরোধে, রাজ্য সরকারি নির্দেশে ছোটো ছোটো কলোনিগুলিকে বড়ো কলোনির সাথে সংযুক্ত করলে কলোনির সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬০৭। তখন বাঁকুড়া জেলায় জবরদখল কলোনির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯টি। এই ২৯টি কলোনির নাম নীচে দেওয়া হল —
বাঁকুড়া সদর মহকুমা:
১) শ্রীনগর কলোনি: মেজিয়া থানা
২) তেলেণ্ডামানা বিবেকানন্দ পল্লি: মেজিয়া থানা
৩) চরদামোদর মোহনা কলোনি: মেজিয়া থানা
৪) সীতারামপুর কলোনি: বড়জোড়া থানা
৫) রামকৃষ্ণপল্লি: বড়জোড়া থানা
৬) পল্লিশ্রী: বড়জোড়া থানা
৭) বড়মানা: বড়জোড়া থানা
বিষ্ণুপুর মহকুমা:
৮) শান্তিপুর: বিষ্ণুপুর থানা
৯) দেউলী সুভাষপল্লি: বিষ্ণুপুর থানা
১০) ভিতসায়ের ভুরকুণ্ডা: জয়পুর থানা
১১) পানখাই – চণ্ডীপল্লি: জয়পুর থানা
১২) মথুরা রানাচক – গৌড় মিলনপল্লি: কোতুলপুর
১৩) সরিষাদীঘি: কোতুলপুর থানা
১৪) আমদই: কোতুলপুর থানা
১৫) চুয়াডাঙ্গা: কোতুলপুর থানা
১৬) বেতালন – মহামায়া: ইন্দাস থানা
১৭) বাঙালচক – কলা – পাটরাই: ইন্দাস থানা
১৮) সাপুরা – তেঁতুলমুড়ি: ইন্দাস থানা
১৯) খটনগর: ইন্দাস থানা
২০) রাঙ্গামাটি – কেনেটি: সোনামুখী থানা
২১) বিলোয়া – নিত্যানন্দপুর: সোনামুখী থানা
২২) অমৃতপাড়া – বেশিয়া – রামচন্দ্রপুর: সোনামুখী থানা
২৩) কুরুমপুর – ভাটপাড়া – মুনোই সংযুক্তপল্লি: সোনামুখী থানা
২৪) বড়া – পলশুড়া: সোনামুখী থানা
২৫) উত্তর পতাশপুর – বারাসাত – মুড়াপাড়া: পাত্রসায়ের থানা
২৬) পুরুলিয়া – রামনগর – কেশপুর – শালখাড়া: পাত্রসায়ের থানা
২৭) পাঁচপাড়া – তাশুলী – চরগোবিন্দপুর: পাত্রসায়ের থানা
২৮) দক্ষিণ গোবিন্দপুর: পাত্রসায়ের থানা
২৯) উদয়পল্লি: পাত্রসায়ের থানা
এরমধ্যে মেজিয়ার শ্রীনগর কলোনিতে শুধু বাস্তুজমি। বাকি ২৮টি কৃষি কলোনি। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় সরকার সব জবরদখল কলোনিগুলিকে স্বীকৃতি দেয়। অর্থাৎ ওইসব কলোনিতে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে মালিকানার দলিল দেওয়া হয়। কেবলমাত্র মেজিয়া থানার চর-দামোদর মোহনা কলোনিতে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের মালিকানা দেওয়া যায়নি। কারণ দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন থেকে আপত্তি আসে। তখন সিদ্ধান্ত হয় কৃষি জমি হলে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তর থেকে পাট্টা দেবে এবং বাস্তু জমি নিরাপদ জায়গায় দেওয়া হবে। কৃষি জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বাস্তু জমি চিহ্নিত হলেও উদ্বাস্তুরা সেখানে উঠে যেতে রাজি হননি।
১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ৬০৭টি জবরদখল কলোনিকে স্বীকৃতি দেওয়ায় উদ্বাস্তুদের মধ্যে উৎসাহ বৃদ্ধি ঘটল এবং আরও ৯৯৮টি জবরদখল কলোনির সন্ধান মিলল। এর অনেকগুলি পূর্বেকার জবরদখল কলোনির কাছাকাছি। তাই অনেক ক্ষেত্রে নামগুলিও এক। ৯৯৮ গ্রুপের কলোনির মধ্যে বাঁকুড়ার কলোনির সংখ্যা ৯; সেগুলি হল —
বাঁকুড়া সদর মহকুমা:
১) পল্লিশ্রী জবরদখল কলোনি: বড়জোড়া থানা
২) রামকৃষ্ণপল্লি কলোনি: বড়জোড়া থানা
৩) বড়মানা কলোনি: বড়জোড়া থানা
৪) ঠাকুরপল্লি: মেজিয়া থানা
৫) চুয়াবেড়িয়া-বিলধান: মেজিয়া থানা
৬) চন্দননগর: মেজিয়া থানা
৭) শ্রীনগর কলোনি: মেজিয়া
বিষ্ণুপুর মহকুমা:
৮) নিত্যানন্দপুর: সোনামুখী
৯) দক্ষিণ গোবিন্দপুর: পাত্রসায়ের
এই কলোনিগুলিকে রাজ্য সরকার ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি দিলেও কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃতি দেয়নি। এই কলোনিগুলির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সম্পূর্ণভাবে রাজ্য সরকারের জমিতে অবস্থিত জবরদখল কলোনিকে বৈধ করা হবে। শুধুমাত্র বাস্তু জমিরই বৈধকরণ করা হবে। কৃষি জমি করা হবে না। তবে উদ্বাস্তুরা কৃষি জমি ছাড়া বাস্তু জমির দলিল নিতে রাজি না হওয়ায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি।
এখানেই থামলো না এরপরেও আরও জবরদখল কলোনির তালিকা বার হল। তখন খোঁজ মিলল ৮১৩টি কলোনির। তবে এগুলো ছোটো মাপের। এই তালিকায় বাঁকুড়ার একমাত্র কলোনি হল সোনামুখী শহরের অমলনগর। এখানে ৩.১৭ একর খাস জমিতে ৪৩টি পরিবারকে বাস্তু জমি দেওয়া হয়।
আর এক ধরনের উদ্বাস্তু কলোনি দেখা যায় তা হল বায়নানামা কলোনি। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আগেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য কোনও জমি নেই। তখন সংযুক্ত কেন্দ্রীয় বাস্তহারা পরিষদ (U.C.R.C.) সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখে উদ্বাস্তুরা যদি বিক্রয় ইচ্ছুক জমির মালিকের সাথে জমির জন্য বায়না করে সরকারকে জানায় এবং সরকারি উকিল যদি পরীক্ষা করে সম্মতি দেয়, তাহলে সরকার সেই জমি কিনে উদ্বাস্তুকে হস্তান্তর করবে। রাজ্য সরকার তাতে রাজি হয়। আপাত দৃষ্টিতে এই প্রকল্পটি ভালো হলেও কিছু অসাধু ব্যক্তির জন্য স্কিমটি কার্যকরী হয়নি।
বায়নানামার মতো আর একটি স্কিম ছিল আমলনামা। জমিদারদের প্রজা হিসাবে উদ্বাস্তুদের জমিতে বসার অনুমতি। এতে কোনও দলিল ছিল না। শুধুমাত্র একটি কাগজ দিত জমির মালিক; তাতে উল্লেখ থাকতে এত টাকা খাজনার বিনিময়ে এত পরিমাণ জমি অমুক ভোগ করতে পারবে। বাঁকুড়া জেলার বায়নানামা ও আমলনামা কলোনির তালিকা হল:
সবগুলো বিষ্ণুপুর মহকুমায়:
১) সেনহাটী কলোনি: বিষ্ণুপুর থানা
২) নেতাজিনগর কলোনি: বিষ্ণুপুর থানা
৩) কাটানধার কলোনি: বিষ্ণুপুর থানা
৪) যমুনাবাঁধ কলোনি: বিষ্ণুপুর থানা
৫) জয়কৃষ্ণপুর কলোনি: বিষ্ণুপুর থানা
৬) লায়েকবাঁধ কলোনি: বিষ্ণুপুর থানা
৭) চূড়ামনিপুর কলোনি: সোনামুখী থানা
৮) নারায়ণ সুন্দরী কলোনি: সোনামুখী থানা
৯) গোপালপুর কলোনি: জয়পুর থানা
১০) তেঁতুলমুড়ি কলোনি: ইন্দাস থানা
১১) সরিষাদীঘি কলোনি: কোতুলপুর থানা
বাঁকুড়া জেলায় একমাত্র সরকার অনুমোদিত উদ্বাস্তু কলোনি হল বাঁকুড়া শহরের লোকপুর-পার্বতীপুর জি.এস. (Government Scheme) কলোনি। যদিও এটা প্রথমে উদ্বাস্তুদের কলোনি হিসাবে প্রথমে চিহ্নিত ছিল না। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সেনাদের জন্য জমিটি চিহ্নিত ছিল। তার আগে ছিল এই জমি কেঞ্জাকুড়ার ধবলদের। সব জমি দিলি না হওয়ায় ১৯৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে ভূমি-রাজস্ব দপ্তর থেকে কিছু প্লট উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিলি করা হয়। এতে প্রায় ৭০/৭৫ টি পরিবার জায়গা পায়। অবশ্য দলিল বিলি হয় ১৯৮৭ সালে। বর্তমান বাসিন্দারা এই কলোনির নাম পালটে রেখেছেন মিলন পল্লি। কলোনি বললে উদ্বাস্তু হিসাবে একটু হলেও হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয়। তবে এজন্য হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনও মানে হয় না। কারণ উদ্বাস্তু হতে হয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ধর্মীয় আগ্রাসন নীতির জন্য।
আগেই বলা হয়েছে বাঁকুড়ার প্রথম উদ্বাস্তু কলোনি যমুনাবাঁধ কলোনি। ১৯৪৬ সালে আনুমানিক ৩৭০ টি পরিবার এসেছিল নোয়াখালি ও ত্রিপুরা থেকে। তার মধ্যে অধিকাংশ পরিবার আছে, আর কিছু পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বর্তমানে এখানে বসবাসকারী বাসিন্দাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ বাঙাল। তাই বিষ্ণুপুরের এই এলাকাটি বাঙালপাড়া নামে পরিচিত। শহর এলাকা বলে চাষবাসের সুযোগ নেই। বর্তমানে এখানের বাসিন্দারা কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা, দোকানদানি এবং কিছু ব্যক্তি সরকারি চাকরি করেন। পাড়ায় একজন সিভিক ভলেন্টিয়ারও আছে।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাসুদেবপুর ক্যাম্পে ১১০ টি পরিবার ও সাবানপুর ক্যাম্পে ৪৪টি পরিবার থেকে যায়। বাসুদেব ক্যাম্পের জমি ছিল প্রতিরক্ষা দপ্তরের। এখানে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের দাবি ছিল প্রতিরক্ষা দপ্তরের জমি পড়ে আছে তা বণ্টন করে পুনর্বাসন দেওয়া হোক। রাজ্য সরকার তা নীতিগতভাবে মেনে নেয়। রাজ্য সরকার কেন্দ্র সরকারের কাছে সেই প্রস্তাব রাখে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিরক্ষা দপ্তর ও রাজ্য সরকার যৌথ সার্ভে করে। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিরক্ষা দপ্তর রাজ্য পুনর্বাসন দপ্তরে জমি হস্তান্তর করে। কিন্তু নানা আইনি জটিলতায় সেই জমি উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিলি করার কাজ এখনও শেষ হয়নি।
বর্তমানে বাসুদেবপুর-শিরোমণিপুর ক্যাম্প এখন তিনটে কলোনিতে বিভক্ত। নামগুলো যথাক্রমে ১নং বাসুদেবপুর, ২নং বাসুদেবপুর ও ৩নং বাসুদেবপুর। এখানে আগত উদ্বাস্তুরা সকলেই ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার বাসিন্দা ছিলেন। বাংলাদেশের ১নং বাসুদেব গ্রামটি খুব বড়ো। এখানে দু-টি পাড়া আছে — আমবাগান ও শালবাগান। এখানে বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ লোক চাষবাস করেন। বাকিরা বেশিরভাগ সেন্টারিং-এর কাজ অর্থাৎ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কেউ কেউ হকারি, ছোটোখাটো ব্যবসা করেন। ১নং ও ২নং বাসুদেবপুরে কয়েকজন সরকারি চাকরি করেন। ৩নং বাসুদেবপুরে মাত্র একজন সরকারি চাকুরে হিসেবে সিভিক ভলেন্টিয়ার আছেন।
সাবানপুর ক্যাম্পের জমেছিল রাজ্য ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের, তাই সেখানকার উদ্বাস্তুদের জমি বিলিতে অসুবিধা বিশেষ হয়নি। এই দু-টি কলোনিকে বলে এক্স ক্যাম্প সাইড কলোনি। সাবানপুর ক্যাম্পের অবস্থান ওন্দা স্টেশন থেকে পাঁচ কিমি দূরে, দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে। এঁদের প্রধান জীবিকা দ্বারকেশ্বরের চরে চাষবাস। দ্বারকেশ্বরের চরের বালি মাটিতে আলুর ফলন খুব ভালো হয়। এছাড়া সরকারি চাকরি হিসাবে কয়েকজন মাস্টার, একজন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে কর্মরত আছেন। এঁরা এখনো কলোনি নামটিকে মুছে ফেলেননি। ঠিকানা লেখার সময় লেখেন গ্রাম সাবানপুর কলোনি। দ্বারকেশ্বরের ওপারে কলোনির অংশ আছে। যেখানে লেখা হয় শ্রীরামপুর কলোনি, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের নাম সাবানপুর কলোনি প্রাইমারি স্কুল।
বড়জোড়া থানার দামোদরের উত্তরে মানা চর এলাকা। দামোদরের চরে শর গাছ ও বনকুল গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। এই শর গাছকে স্থানীয় ভাষায় বলে মানা। সেই কারণে দামোদরের চর অঞ্চলকে বলা হয় মানা চর। সেই মানা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চারটি কলোনি। কলোনিগুলো গড়ে তুলেছেন বেশিরভাগ বাংলাদেশের বরিশাল জেলার লোকজন। তারপর সংখ্যায় বেশি ঢাকা জেলার লোক। তারপর খুলনা আর সামান্য কিছু নোয়াখালি জেলার উদ্বাস্তু মানুষজন।
বড়মানা কলোনি পখন্না গ্রামপঞ্চায়েতের অধীন। পল্লিশ্রী কলোনি ও রামকৃষ্ণপল্লি কলোনি বড়জোড়া গ্রামপঞ্চায়েতের অধীন। আর সীতারামপুর কলোনি ঘুটগড়িয়া গ্রামপঞ্চায়েতের অধীন। দামোদর চরে উর্বর জমিতে চাষবাস তাঁদের প্রধান জীবিকা। ধান চাষ ছাড়াও বাদাম, ফুল চাষ ভালো হয়।
এখানে দামোদরের জল বাড়লে মাঝে মাঝে তাঁদের এলাকা জলে ডুবে যায়। তবে প্রধান সমস্যা হল বাঁকুড়ার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্নতা। বাঁকুড়া সদরে আসতে হলে অনেক ঘুরে দামোদর পেরিয়ে আসতে হয়। বাঁকুড়ায় আসলে সেই দিনটা একেবারেই জলে চলে যায়। তাই ওনাদের দীর্ঘদিনের দাবি তাঁদের ওই অঞ্চলটা বা দামোদরের উত্তর চরের অঞ্চলটা বর্ধমানের সঙ্গে (বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমান) যুক্ত করে দেওয়া হোক। এককালে এই নিয়ে বৃহৎ আন্দোলন হলেও বর্তমানে ভাঁটা পড়েছে। বর্তমানে এনারা কলোনি কথাটা ব্যবহার না করে পল্লিশ্রী, রামকৃষ্ণপল্লি প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকেন।
বাঁকুড়া জেলার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত এলাকা হল সোনামুখী থানা এলাকার দামোদরের দক্ষিণ তীর বরাবর রাঙ্গামাটি, কেনেটি, নিত্যানন্দপুর, বেলোয়া, রামচন্দ্রপুর, অমৃতপাড়া, বেশিয়া, বড়া, কুরুমপুর, ভাটপাড়া, পলসরা, গ্রামগুলি। পলসরা থেকে আরও পূর্ব দিকে গেলে পাত্রসায়ের থানার উত্তর পতাশপুর, বারাসাত, রামনগর, পারুলিয়া, তাশুলি, গোবিন্দপুর, পাঁচপাড়া, শালখাড়া গ্রামগুলিতেও একই চিত্র। পূর্ববঙ্গের লোক অধ্যুষিত এখানের অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। দামোদরের চরের মাটিতে ধান, আলু, সবজি চাষ খুব ভালো হয়। এখানে এত উন্নতমানের সবজি চাষ হয় যে সোনামুখী থানার নিত্যানন্দপুরে একটি মিনি মার্কেট গড়ে উঠেছে। এখানে সবজির ডাক হয়। দুর্গাপুর, আসানসোল থেকেতো বটেই, ঝাড়খণ্ড থেকেও ব্যবসায়ীরা এসে পাইকারি দরে সবজি কিনে নিয়ে যায়। এই অঞ্চলে কিছু ব্যক্তি সরকারি চাকরিও পেয়েছেন।
রাঙামাটি কেনেটি এলাকার কেনেটি মানা, সমিতি মানা ও পান্ডে পাড়া এলাকাতে দামোদরে জল বাড়লে বন্যার জল প্রবেশ করে। এখানে দামোদরের মধ্যে উত্তর চর বলে একটি দ্বীপ আছে। সেখানে লোকজন তো আছেই, একটি প্রাইমারি স্কুলও আছে। বর্ষার সময় এই স্কুলে প্রায় জলবন্দি হয়ে যায়। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের খুলনা, ফরিদপুর ও ঢাকা জেলা থেকে আগত লোকেরা বসতি স্থাপন করেছিল।
বাঁকুড়া জেলায় বর্তমানে উদ্বাস্তু ক্যাম্প, কলোনিতে যারা বসবাস করেন তাঁদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্ম অন্তত কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। বর্তমানে তৃতীয় প্রজন্মে কিছুটা অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চর অঞ্চলে যে কৃষি কলোনি আছে, সেখানকার পরিবারগুলি কৃষিতে উন্নতি ঘটিয়ে অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। যেমন বড়জোড়া মানা অঞ্চলে ফুল চাষ লাভজনক হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে এইসব অঞ্চলের লোকেরা শিক্ষিত হয়ে সরকারি, বেসরকারি চাকরি খুঁজে নিয়েছেন।
কলোনি নামটা আর তাঁদের বাসস্থানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন না। আমার মতে উদ্বাস্তু কথাটিও আর ব্যবহার করা উচিত নয়। তাঁদের পূর্বপুরুষ উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে এসেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মের সবার জন্ম ভারতে। জন্ম থেকেই তারা বাস্তু হিসেবে ভারতবর্ষকে দেখেছেন। তাহলে তাঁরা কেন আর উদ্বাস্তু তকমা বহন করবেন?
তথ্য ঋণ:
১. ‘বাঁকুড়া জেলায় উদ্বাস্তু আগমন’: জীবনরঞ্জন ভট্টাচার্য
২. ‘পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু আগমন’: জীবনরঞ্জন ভট্টাচার্য
৩. ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’: প্রভাতাংশু মাইতি
৪. কথোপকথন: জীবনরঞ্জন ভট্টাচার্য (বিষ্ণুপুর), সুহৃদ দাসগুপ্ত (বাঁকুড়া, সভাপতি বাঁকুড়া জেলা বাস্তুহারা পরিষদ), রবিন মণ্ডল (রামকৃষ্ণপল্লি বড়জোড়া, সম্পাদক বাঁকুড়া জেলা বাস্তুহারা পরিষদ), জন্মেজয় চ্যাটার্জী (সার্ভেয়ার, উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর, বিষ্ণুপুর), সুধীর বিশ্বাস (৩নং বাসুদেবপুর), গৌতম দাস (যমুনাবাঁধ, বিষ্ণুপুর)