ভাগের স্বাধীনতা : ছিন্নমূলের উত্তরকাল 

কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর   

রূপকথার আশ্চর্য উপাখ্যান যেন। যেন দুয়োরানিরই সন্তান এঁরা। অনেক লড়াই সংগ্রাম, জেল, ফাঁসি, রক্তক্ষরণের মূল্যে স্বাধীন বলে ঘোষিত হওয়ার পরই নিজেদের ভিটেমাটির অধিকার হারিয়ে উচ্ছিন্ন পরবাসে যেতে বাধ্য হলেন। সেই ভূমিতে প্রথমে তাঁদের ঠাঁই হল এক-একটি শিবিরে। তাঁবুর নীচে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটতে থাকে। তাঁরা নাকি স্বাধীন, অথচ তাঁদের স্বাধীন জীবিকা নির্বাচনের সুযোগ বা অধিকার কোনোটাই জুটল না। তাঁরা সৃষ্টিশীল, কর্মঠ, অথচ কর্মহীনভাবে শিবিরে আটকে রেখে তাঁদের উদ্যম ও কর্মক্ষমতা শুষে নেওয়া হল। সরকারি বদান্যতায় দুবেলা যে সামান্য খাবারের ব্যবস্থা হল, তাতে পেট ভরে না। ফলে তাঁদের ভরাট শরীর শুকিয়ে কাঠ হল, বুকের পাঁজর বেরিয়ে এল। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে রোগাক্রান্ত হয়ে বিনি চিকিৎসায় কেউ কেউ স্বর্গলাভ করার সুযোগ পেয়ে মানবজীবন ধন্য করলেন।

তবু ওঁরা দমেন না। ওঁরা লড়াকু, সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পেয়েছেন। শপথ নেন— আবার লড়াই করবেন। প্রতিবাদ করবেন বঞ্চনা ও উপেক্ষার। শিবিরে শিবিরে আবার শুরু হয় লড়াই। ক্ষমতাসীন প্রভুরা তা মানবেন কেন? ব্রিটিশ শাসকের বদলে স্বদেশি শাসক হলেও— শাসক তো। তাকে অমান্য করা? তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া? ফলে, বর্ষিত হয় লাঠি, গুলি, কাঁদানে গ্যাস। মহিলাদের উপর বলাৎকারও বাদ যায় না। কিন্তু আন্দোলন তাতে দমে না, আরও ছড়িয়ে পড়ে। শিবির ছেড়ে আন্দোলনকারীরা নেমে আসেন রাজপথে। মিছিল, স্লোগান, বক্তৃতার তুফান ছোটে। ফের চলে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস। নেতাদের পাকড়াও করে ভরে দেওয়া হয় জেলে। কিন্তু আন্দোলন তাতে থামে না। এমন রক্তবীজের ঝাড়— নিকেশও হয় না কিছুতে। নিরুপায় হয়ে মন্ত্রী-অমাত্যরা বসে সিদ্ধান্ত নেন, ওদের দূরে কোথাও একটা পাঠিয়ে আপদ দূর করা হোক।

ভিটেছাড়ারা পিতৃপুরুষের ভিটেয় থাকার স্বাধীনতা পায়নি। বরং দেশ ভাগ হওয়ায় দেশ হারিয়েছে। দেশের ভাগ নিয়েও টালবাহানা। অবজ্ঞা করে বলে রিফুজি। এরপর পুনর্বাসনের নামে নির্বাসনে গিয়ে বুঝতে পারে— স্বাধীনতার মন্থনে ওঠা অমৃত থেকে এ-কালের দেবকুল তাদের বঞ্চিত করেছে। কেবল গরলটুকু তাদের জন্য বরাদ্দ। পুনর্বাসনের প্রতিটি পদক্ষেপে তারই অযাচিত আয়োজন। চাষের জমির বদলে বরাদ্দ গভীর জঙ্গল, কোথাও রুক্ষ, পাথুরে মাটি। সেখানে তাদের সাথি বন্য জন্তু কিংবা চরম প্রতিকূল পরিবেশ। বাঁচতে পারলে বাঁচো, নইলে মরো! পরাধীন দেশে ভিনদেশি শাসকেরা তাদের কখনও এমন বিপদের মুখে ঠেলে ফেলেনি। আপন দেশের আপন ধর্মের মানুষেরা অক্লেশে তা করতে পারল। 

এ-কালের অতিশয় গল্প-বুভুক্ষু কোনও কিশোর এ পর্যন্ত শুনেই হয়তো বলবে,— বিষম আজগুবি এক গল্প। রূপকথার মতোই অবাস্তব। এত রং চড়ালে কি তা বিশ্বাসযোগ্য হয়? পরাধীন দেশের কথা নয়, স্বাধীনতা পাওয়া একদল মানুষের কথা বলতে বসেছ, তা নিশ্চয় তুমি ভুলে যাওনি। কোনও উপনিবেশেই এমন হতে পারে, স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ভাগ্যে এমন ঘটতে পারে কখনও?

এ তর্কের মীমাংসা হতে পারে শুধুমাত্র প্রামাণ্য ছবি ও তথ্যের উপস্থাপনায়। দুর্ভাগ্যবশত তা সহজলভ্য নয়। দায়িত্ব ও ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে বলে বীজ ছড়িয়েই কৃষক নিরস্ত হয় না, ফসল ফলা অবধি তার পরিচর্যা করে। কিন্তু যে কাজকে সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার দায়িত্ব বলে ভাবেনি, বিরক্তিকর দায় বলে শুধু ভেবেছিল, সেই পুনর্বাসন নামক প্রহসনের পরিসংখ্যান ও তার উত্তরকালের পরিণতির হিসাবনিকাশ তার কাছে আশা করা অন্যায়। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনোত্তর চিত্রের জন্য প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের উপরেই তাই নির্ভর করতে হবে। ভিনরাজ্যে বাঙালি সেটেলারদের জীবনযাপনের একটি আলেখ্য তারই সাহায্যে প্রস্তুত করা যেতে পারে। 

দেশভাগের ফলে দেশ হারানো পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের যতগুলি রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার বেশ কয়েকটি রাজ্যের একাধিক পুনর্বাসন পল্লিতে পৌঁছাবার সুযোগ হয়েছে বর্তমান প্রতিবেদকের। সব রাজ্যের সব কথা বলার সুযোগ এখানে নেই। পশ্চিমবঙ্গের কণ্ঠলগ্ন রাজ্য বিহার এবং কালাপানির পারে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কিছু চিত্র এখানে উপস্থাপন করা যেতে পারে।

বিহারে বাঙালি সেটলার

১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত যেসব ছিন্নমূল পরিবার পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন তাঁদের একাংশকে পাঠানো হয় বিহারের শতাধিক উদ্বাস্তু কলোনিতে। এর মধ্যে পশ্চিম চম্পারণে ৪৬, পূর্ণিয়ায় ৩৮, পূর্ব চম্পারণে ১৩, গোপালগঞ্জে ২, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, কাটিহারে ১টি করে এবং বর্তমান ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত সাহেবগঞ্জ, রাঁচি ইত্যাদি জেলাতেও গড়ে তোলা হয় কয়েকটি কলোনি। পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হলেও সরকারের সাধারণ নীতি ছিল কয়েক বছর কোনও ট্রানজিট ক্যাম্পে তাদের ফেলে রাখা। বস্তুত পূর্ব পরিকল্পনা না থাকায়, পুনর্বাসনের জন্য জমির সন্ধান ও অন্যান্য আয়োজন সম্পন্ন করতে সরকারের বিলম্ব হত। লালফিতের ফাঁস, দীর্ঘসূত্রিতা এবং অনাগ্রহ পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে আরও বিলম্বিত করে তুলত। বছরের পর বছর এভাবে শিবিরে আটকে থাকা ছিল খুবই কষ্টদায়ক। খাদ্য, বস্ত্রের অনটন ছিল প্রবল। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগে আর্থিক সমস্যা সমাধানের কোনও পথ খোলা ছিল না। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর নিষেধ বলবৎ থাকত। ফলে অসহায়, কর্মহীন অবস্থায় কঠোর পরিশ্রমী হিসাবে জীবন কাটানো মানুষেরা শারিরীক ও মানসিক ভাবে পঙ্গু হতে থাকলেন।

স্বাধীন দেশে বন্দির মতো জীবন কাটানো অসহ্য হতে থাকলে শিবিরে থাকা উদ্বাস্তুরা বিক্ষোভ ও আন্দোলনে শামিল হলেন। পুনর্বাসনে গতি আনতে ব্যর্থ হলেও প্রশাসন গতি বাড়াল আন্দোলন দমনে। বহুস্থানে গুলি পর্যন্ত চালানো হল। ১৯৫৭ সালে বেতিয়ার বিরিঞ্চি ক্যাম্পে এ-রকমই এক ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হন। তখনও অবধি ছিন্নমূল পরিবারগুলির কাছে স্বাধীনতার উপহার এভাবেই পৌঁছেছিল। আন্দোলনের চাপে পুনর্বাসনের উদ্যোগ শুরু হলেও তা কতটা দায়সারা ছিল একটি উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হবে। বৈরিয়া ও মাঝেরিয়া কলোনির বাসিন্দারা ১৯৫৯ সালে কাগজে কলমে চার একর জমি ও এককালীন ১২৯০ টাকা হাতে পান। বাস্তবে তারা কৃষিজমি হাতে পান আরও তিনবছর পর। ততদিনে চাষের জন্য দেওয়া টাকা সংসারের পিছনে খরচ হয়ে গেছে। জমি প্রস্তুত করা ও চাষ করার কোনও উপায় নেই। ফলে মহাজনের কাছে জমি বন্ধক রাখতে বাধ্য হন তারা। ভূমিহীন মজুর হওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকে না। পরাধীন দেশে যারা ছিলেন সম্পন্ন কৃষক, এভাবে স্বাধীন দেশে তারা মজুরে পরিণত হলেন। 

নির্বিঘ্নে জমি হাতে পেয়েছিলেন যারা, কৃষিকর্মে তাদের অভিজ্ঞতাও কিন্তু সুখকর ছিল না। এমন কয়েক জনের বিবরণ শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বকর্ণে। এরা পূর্ব চম্পারণের বাসিন্দা। তাঁদের কাছেই জানা গিয়েছিল কীভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে তাঁরা পরিণত হয়েছেন। শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবিকার সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। আইনসভায় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের কোনও সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক বঞ্চনার নিত্য নতুন পরিসর তৈরি হয়ে চলে। কয়েকটি উদাহরণও পাওয়া গেল। যেমন, স্থানীয়দের তুলনায় বিস্থাপিত বাঙালি মজুরদের কাজের মজুরি সব সময়ই কম দেওয়া হয়। সম কাজে সম মজুরির নীতি এখানে অচল। ফসল বিক্রির উদ্দেশে হাটে উপস্থিত হলে তাঁদের জায়গা হয় হাটের এক প্রান্তে। প্রথম দিকে পাইকারেরা কেউ সেখানে উঁকি মেরেও দেখে না। স্থানীয়দের বিক্রিবাটা শেষ হলে তবে তারা এদিকে আসে। একই সবজি অন্যদের কাছ থেকে পাইকাররা যে দামে কিনেছে, বিস্থাপিত বাঙালিদের দেওয়া হয় তার থেকে কুড়ি শতাংশ কম দাম। এটাই অলিখিত নিয়ম। তার ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। 

২০০৯ সালে বিহার বাঙালি সমিতির চেয়ারম্যান ডাঃ দিলীপ সিনহা কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে যখন বিহারের বাঙালি কলোনিগুলি ঘুরে দেখেন, তখনও সেগুলি ছিল যাতায়াতের অযোগ্য। ধূমাটার, জসৌলি, পাঁচরুখা, ধোকরাহা, পঙ্গোবি ইত্যাদি বিস্থাপিত বাংলাভাষী গ্রামগুলিতে স্বাধীনতার ৬০ বছর পরেও যাতায়াতের জন্য কোনও রাস্তাই তৈরি হয়নি। নদী বা মাঠ ডিঙিয়ে তাঁদের সেখানে পৌঁছাতে হয়েছিল। নেপাল সীমান্ত থেকে ৩/৪ কিমি দূরে ভেরিহারিতে পৌঁছে তাঁরা জেনেছিলেন, ২০০টি বাঙালি পরিবার সেখানে বাস করলেও গ্রামে পোস্ট অফিস নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বটে, তবে তাতে বাংলা পড়ানো হয় না। সব থেকে কাছের বাজার ভৈসালোটন মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে। দেশভাগের অর্ঘে সাজানো স্বাধীনতার স্বাদ ছিন্নমূল পরিবারগুলির কাছে কতটা মধুময় হয়ে উঠেছিল এসব তথ্য থেকেই স্পষ্ট। বঞ্চনা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বাস্তুরা কদাচিৎ অন্যদের সহযোগিতা পেয়েছেন। বরাবরই শিক্ষা ও জীবিকার জন্য তাদের লড়াই ছিল অসম। সে লড়াইকে এড়িয়ে যাবার উপায় ছিল না। সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি যতই থাক, কিংবা বাংলা যতই হোক সংবিধান স্বীকৃত ভাষা, বাঙালি শরণার্থীদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল শত প্রতিকূলতায় ভরা। বাঁচার অধিকার কণ্টকিত তো ছিলই, ভাষার অধিকারও ছিল অনুরূপ কাঁটায় ঘেরা। এ যেন— স্বাধীনতা নাও, ভাষা ও সংস্কৃতি হারাও, এমনই এক লেনদেনের খেলা। ভাষা হারাবার প্রশ্নে আঁতে ঘা খেয়ে সাবেক পূর্বপাকিস্তান ঘুরে দাঁড়ালেও সতীর অঙ্গের মতো সারা ভারতে ছিটকে পড়া উদ্বাস্তুদের পক্ষে ভাষা রক্ষার তেমন লড়াই করা সম্ভব ছিল না। সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধেক ত্যাজতি পণ্ডিতঃ— এই নীতিবাক্য মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁদের উপায় ছিল না। তবে হারানোর তালিকায় শুধু জীবিকা ও শিক্ষা লাভের সুযোগ, পছন্দের পরিবেশ, আত্মীয়-স্বজন এবং ভাষা-সংস্কৃতিই ছিল না, কখনও কখনও এমন হয়েছে যে, পুনর্বাসনে পাওয়া পায়ের নীচের সামান্য জমিটুকুও হারাবার ভয় এসে উপস্থিত হয়েছে। সে ভয় থেকে বাঁচতে নিজেদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েই তাঁদের লড়তে হয়েছে। কোনও সংবাদ মাধ্যম কখনও সেসব খবর তুলে ধরেনি। বিহার বাঙালি সমিতির সভাপতি ডাঃ দিলীপ সিনহা সদলে ভাগলপুরের বরারিতে গিয়ে উপস্থিত হলে, তেমনই এক ঘটনার কথা জানতে পারেন। জমি মাফিয়ারা উদ্বাস্ত কলোনির জমি দখল করবে বলে জিপে চড়ে এসেছিল। পুরুষরা তখন সবাই কাজে বেরিয়েছে। গুন্ডাদের হাতে ছিল বাগিয়ে ধরা বন্দুক, মুখে হুংকার। কিন্তু লড়াকু উদ্বাস্তু মহিলারা তাতে ভয় না পেয়ে, উলটে আঁশবটি নিয়ে তাদের তাড়া করে। বেগতিক বুঝে গুন্ডারা পিছু হটে। এভাবে নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আজও তাঁদের লড়ে যেতে হয়। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে আর কোনও জনগোষ্ঠীকে নিজদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এতটা মূল্য চোকাতে হয়েছে কি কখনও?

সাগরপারে আন্দামানে

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি উদ্বাস্তুদের বাসভূমি গড়ে তোলার আগেই সেখানে পুনর্বাসন পেয়েছিলেন আন্দামানে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের পরিবার। সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরে বা স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে যাদের সাজামুক্তি ঘটেছিল এবং ১৯৪৮ সালে বার্মা থেকে রিপ্যাট্রিয়ট হিসাবে দেশে ফিরে আসা কিছু ভারতীয় পরিবারও সেখানে পুনর্বাসন পান। তাঁরা বসতি গড়েছিলেন মুখ্যত পোর্টব্লেয়ারের আশপাশ অঞ্চলে। আন্দামানের আদিম অরণ্য তখনও অবধি অক্ষত ছিল। তার কোনও কোনও অংশে বাস করত জারোয়া, ওঙ্গি ইত্যাদি সভ্যতার সংস্পর্শরহিত আদিম অধিবাসীরা। জাপানের সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ ফৌজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্বে আন্দামানে পদার্পণ করে। ১৯৪৫ সালের ৬ অক্টোবর দ্বীপপুঞ্জ জাপানের দখলমুক্ত হওয়ার পর অপরাধীদের শাস্তিক্ষেত্র হিসাবে আন্দামানকে ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রত্যাহৃত হয়। তখন থেকে সরকারের ভাবনা ছিল দ্বীপপুঞ্জকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার। কিন্তু, সহজ ছিল না তার উপায় খুঁজে পাওয়া।

১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হওয়ার পর অনিবার্য ভাবে উদ্বাস্তু আগমন ঘটতে থাকে। এদের একটা বড়ো অংশই সুদক্ষ কৃষিজীবী সম্প্রদায়। তাদের কাঁধেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার দায়িত্ব দিলে কেমন হয়? ভাবনাটি মাথায় আসার পর আর দেরি না করে মন্ত্রী নিকুঞ্জিহারী মাইতির নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের অক্টাবর মাসে এক প্রতিনিধি দল পাঠানো হয় দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শনের জন্য। তাঁরা সবুজ সংকেত দিলে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রিলিফ ক্যাম্পে হ্যান্ডবিল বিলি করা হয়। তাতে নয়াবসত হিসাবে আন্দামানের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরা হলেও গোপন করা হয় তার দুর্ভেদ্য জঙ্গল, আদিবাসীদের হিংস্র আক্রমণ এবং পানীয় জলের সমস্যার কথা। (দ্রষ্টব্য- ‘Resettlement of East Pakistan Refugees in Andaman Islands, Report on Survey of Possibilities of Resettlement : January-May 1952’ – By Surajit Chandra Sinha, R R Dept. Govt. of W. B.) 

সরকারের এই গোপনীয়তার মধ্যেই ছিল সমস্যার বীজ। তার ফলও ফলেছিল হাতেনাতে। অনেক আশা নিয়ে কালাপানি পেরোলেও দুর্ভেদ্য জঙ্গল দেখে ও অন্যান্য সমস্যার কথা জেনে ভীত হয়ে পড়ে অনেকেই। ১৯৪৯ সালে প্রথম ব্যাচে ১৯৮টি উদ্বাস্তু পরিবারকে দুটো ভাগে ভাগ করে পাঠানো হয় ১৩ ও ১৮ মার্চ তারিখে। ২৮টি অকৃষিজীবী পরিবার জাহাজ থেকে নামতেই রাজি হয়নি। তারা ফিরতি জাহাজেই কলকাতায় ফিরে আসে। এই অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীকালে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়— কঠোর শ্রমে অভ্যস্ত এবং সাহসী শ্রেণির মানুষদেরই শুধু এখানে নিয়ে আসা হবে। তাঁদের নির্বাচন পদ্ধতি ছিল অদ্ভুত। হাত টিপে টিপে কর্মঠ ও সাহসী কিনা বুঝে তবে আন্দামানগামী জাহাজে ওঠার ছাড়পত্র দেওয়া হত। কৃষিজীবী ছাড়াও অন্যান্য পেশার মানুষদেরও পুনর্বাসন পরিকল্পনার অঙ্গীভূত করা হয়েছিল ননাবিধ প্রয়োজনের কথা ভেবে। ১৯৫২ সালের মে মাস পর্যন্ত পুনর্বাসন প্রাপ্ত মোট ৩৫০টি (৪২০টি পরিবারের মধ্যে ৭০টিই ফিরে যায়) পরিবারের সামাজিক পরিচয় সরকারি পরিসংখ্যান থেকে যেমন পাওয়া গেছে— 

১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ যখন উদ্বাস্তুদের চাপে হিমশিম খাচ্ছে, তখন মাত্র সাড়ে তিনশো পরিবারের পুনর্বাসন চিত্র বুঝিয়ে দেয়, বিভিন্ন ক্যাম্পে অপেক্ষমাণ অধিকাংশ উদ্বাস্তু পরিবারগুলির ধৈর্য্যের পরীক্ষা কেমন ছিল। অনেক প্রতীক্ষার পর যারা আন্দামানে পুনর্বাসন পেয়েছিলেন, তাদের কী সংগ্রাম করতে হয়েছিল সে বিবরণ কখনও প্রচারের আলো পায়নি। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন শুরুর পঞ্চাশ বছর পর, ২০০১ সাল নাগাদ দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে নানা জনের কাছ থেকে অকথিত সে কাহিনি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।

দ্বীপপুঞ্জে বাঙালি উদ্বাস্তুদের অভ্যর্থনা ছিল তিক্ততায় ভরা। ইতিপূর্বে যাদের সেখানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল (প্রি ৪২ ক্যাটাগরি-সহ অন্যরা) বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেবার বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষাভ দেখান তাঁরা। কালো পতাকা হাতে পোর্টব্লেয়ারে জাহাজ ভিড়তেও বাধা দেন। ফলে চাথামের বদলে পানিঘাটে গিয়ে উদ্বাস্তুদের নামাতে হয়। কিন্তু সে স্থানও নিরাপদ ছিল না। আদিম অরণ্যের গভীরে বিষাক্ত তির নিয়ে অপেক্ষা করত জারোয়ারা। চারদিকে হিংসা ও বিদ্বেষের এমন অভূতপূর্ব পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে শিরোধার্য করে নতুন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনও বিকল্প ছিল না।

১৫/২০টি পরিবারকে এক একটি দলে ভাগ করে অরণ্যের গভীরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল কিছু চাল, ডাল আর দা, কোদাল ও কুড়ুল। কোনও কোনও দলকে দুর্ভেদ্য জঙ্গলের বাধা ভেঙে, প্রায় তিনঘণ্টা পায়ে হেঁটে অস্থায়ী আস্তানায় পৌঁছাতে হয়েছিল। আস্তানা বলতে বেতের কাঠামো আর হেঁতাল পাতায় ছাওয়া কুঁড়ে— ব্যারাক তার নাম। বিহার থেকে সাঁওতাল শ্রমিকদের এনে সদ্য সে সব কুঁড়ে তৈরি হয়েছিল। মনুষ্যহীন নির্বান্ধব জঙ্গলে শুরু হল তাদের স্বাধীনতা-উত্তর জীবন।

পুনর্বাসন দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল প্রত্যেক পরিবারকে ত্রিশ বিঘা সমতল জমি দেওয়া হবে। এখানে আসার পর জানানো হয়— ত্রিশ বিঘার পনেরো বিঘা হবে সমতল, বাকি পনেরো বিঘা পাহাড়ি। সবই নিজেদের পরিস্কার ও আবাদযোগ্য করে তুলতে হবে। সেজন্য একবছর সময় তাদের বরাদ্দ। এই এক বছর সরকারি ডোলের ব্যবস্থা থাকবে। তারপর ডোল বন্ধ, বাঁচতে হবে নিজেদের চেষ্টায়। অথচ সরকারি পর্যবেক্ষকের অভিমত, অন্তত চার বছর লাগবে জঙ্গলকে চাষযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত করতে। আবার ত্রিশ বিঘা জমির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও অনেককে তা দেওয়া হয়নি। ডিগলিপুরের সেটলাররা যেমন ১৫ বিঘা পাহাড়ি টিলা থেকে বঞ্চিত। ৪০ বছর ধরে আন্দোলন চালিয়েও বাকি জমি তারা পাননি।

নিজেদের জমিতে ঘর তোলার জন্য সরকার টিন দিয়েছিল, চাষের উপযোগী একজোড়া মোষও দিয়েছিল। তবে দান হিসেবে নয়। মূল্য ধার্য ছিল ১৭৩০ টাকা। পর্যায়ক্রমে সে টাকা সরকারকে শোধ করতে হবে। কথা ছিল প্রথম বছর সরকার থেকে ডোল দেওয়া হবে। পথ ও পরিবহণের কোনও ব্যবস্থা ছিল না যেখানে, সেখানে নিয়মিত ডোল পৌঁছে যেত এমন ভাবার কারণ নেই। ফলে চরম খাদ্য সংকট ছিল অনিবার্য। তখন শাকপাতা ও কচু সিদ্ধ খেয়ে দিন চলত। শিক্ষা ও চিকিৎসার কোনও সুযোগ ছিল না। পানীয় জলের জন্য বৃষ্টির জল ধরে রাখতে হত। পানযোগ্য জলের অন্য কোনও ব্যবস্থা ছিল না। 

জঙ্গলে বিপদ ছিল সাপ আর শ্বাপদের। তবে সব থেকে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল বিশাল বন্য জোঁকেরা। আলোহীন ঘরে রাতের বিছানাতেও চলে আসত তারা। উদ্বাস্তুদের রক্ত শুষে খেয়ে তারা অভাবিত রূপে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছিল। খাদক ছিল আরও। অনেক কষ্টে জমি আবাদ করে ফসল বোনা গেলেও ফসল তোলার উপায় ছিল না। ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ এসে কচি ধানপাতা মুড়ে খেয়ে যেত। দিনরাত পাহারা দিয়ে কিছুটা রক্ষা করা গেলেও, ধান পাকলে শত শত টিয়াপাখি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ত। ফলে ১৫ বিঘা জমিতে যেখানে কমবেশি ৩০০ মণ ধান পাওয়ার কথা, সেখানে ৩০/৪০ মণ নিয়েই খুশি থাকতে হত। যারা স্বাধীনতা চেয়েছিল, দেশভাগ চায়নি— অসামান্য উর্বর ও ফলন্ত জমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে, সহায় সম্বল, আত্মীয় স্বজনহীন, বিপদসংকুল আদিম অরণ্যভূমিতে তাদের জন্য এমনই ছিল স্বাধীনতার উপহার। দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামানের দুটি দ্বীপেই প্রথম শুরু হয় পুনর্বাসনের কাজ। মংলুটন, ওয়ান্ডুর, রঙ্গত, বিল্লিগ্রাউন্ড, কদমতলা প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয় এভাবেই। উত্তর আন্দামানের ডিগলিপুর, কালীঘাট প্রভৃতি অঞ্চলে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয় ১৯৫৪ সাল নাগাদ। এখন পর্যটনের জন্য বিখ্যাত হ্যাভলক দ্বীপেও ১৯৫৪ সাল থেকে পুনর্বাসন শুরু হয়। প্রথম ৪০টি পরিবারকে পাঠানো হয়। ১৯৬০ সালে ৫৬টি ও ১৯৬১ সালে আরও ৯২টি পরিবারকে হ্যাভলকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। হ্যাভলকের নিকটবর্তী নীল দ্বীপে ১৯৬৫ সালের পর মূল ভূখণ্ড থেকে উদ্বাস্তুদের এনে অস্থায়ী ভাবে রাখা হত। পরবর্তীকালে ৯৯টি পরিবারকে এখানে স্থায়ীভাবে বসতি দেওয়া হয়।

নীল দ্বীপের মতো লিটল আন্দামানও প্রথম দিকে ট্রানজিট ক্যাম্প হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরে সেখানেও উদ্বাস্তুদের স্থায়ীভাবে বসানো হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, অন্যান্য দ্বীপে ধান বা সবজি চাষের উপযোগী মাটি পাওয়া গেলেও লিটল আন্দামান ছিল তার ব্যতিক্রম। জীবনধারণ সেখানে তাই কঠিন ছিল। নারকেল, সুপারি, পাম জাতীয় গাছের চাষ করেই সেটলারদের বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে হল। আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ শস্যসম্পদে পরিপূর্ণ। কিন্তু একদিনে তা হয়ে ওঠেনি। এর পিছনে রয়েছে বাঙালি উদ্বাস্তুদের অশ্রু রক্ত ঘাম আর হার-না-মানা দুরন্ত জেদ। এমন দিন যে কখনও আসবে, সমৃদ্ধির মুখ দেখবেন, সন্তানের মুখে নিশ্চিন্তে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে পারবেন— তারা ভাবেননি। শুধু আন্দামান নয়, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, উত্তরাখণ্ড— ভারতের যেখানেই তারা গেছেন, কৃষি অর্থনীতিকে সম্ভাবনার স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। অন্ধ্রপ্রদেশে শাক-সবজির চাষ অপ্রচলিত ছিল, বাঙালি কৃষকরাই সে রাজ্যে তার প্রচলন ঘটান। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে উন্নত পাটের অভাবে জুটমিলগুলি সংকটের মুখে পড়েছিল, অথচ ভারতীয় অর্থনীতিতে জুটমিলগুলির তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জে বি পন্থ সমাদর করে উদ্বাস্তু বাঙালি কৃষকদের সে রাজ্যের তরাই অঞ্চলে বসতি দেন এই আশায় যে, উন্নত পাট ফলিয়ে তারা দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবেন। এসব অবদানের কথা কেউ কোথাও লিপিবদ্ধ করেনি, ফলে জাতীয় ইতিহাসে তার কোনও স্থান নেই।   

দেশভাগ ভিনরাজ্যের বাঙালি সেটলারদের কাছ থেকে শুধু ভিটেমাটি কেড়ে নেয়নি, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও কেড়ে নিয়েছিল। ইতিপূর্বে বিহার প্রসঙ্গে বাংলাভাষা চর্চার যে সংকটের কথা বলা হয়েছে, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও সেই একই সমস্যা ও সংকট। দ্বীপপুঞ্জে বাংলাভাষীরা বিপুল পরিমাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও স্কুলে বাংলা পড়ার সুযোগ পাননি। পরবর্তীকালে নিজেদের চেষ্টায় বাংলা মাধ্যম স্কুল খুললেও অনুমোদন জোগাড় করা কঠিন হয়েছে। অনেক আয়াসে সে বাধা অতিক্রম করা গেলেও, পাঠ্য বইয়ের অভাবে এবং বাংলা মুদ্রণযন্ত্র না থাকায় দেবনাগরী অক্ষরে বাংলা গল্প কবিতা পড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। 

এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ সন্ধানে স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভাবিত উত্তর পেয়েছিলাম। বিজেপির টিকিটে জিতে আসা বাংলাভাষী সাংসদ বিষ্ণুপদ রায় স্পষ্ট স্বরে বলেছিলেন— কী হবে বাংলা শিখে? সবাই যাতে হিন্দি ও ইংরাজি মাধ্যমে পড়ে, তার জন্য কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিক্ষাকেন্দ্রের সহায়তায় এ বছর ১৬টি স্কুল করা হচ্ছে। পরের বছর ৫০ এবং তারপরে আরও বাড়ানো হবে।অনেকেই তবু মেরদণ্ড সোজা রেখে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের জুটেছে সাম্প্রদায়িক তকমা। সংবিধানে অন্যতম স্বীকৃত ভাষা হয়েও বাংলা যেন দুয়োরানির সন্তান। পোর্টব্লেয়ারের অনেক বাঙালির কণ্ঠে ঝরে পড়েছে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বাংলা সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করার বিরুদ্ধে ক্ষোভ। এমনকি রবীন্দ্রসংগীত এবং নৃত্যও সেখানে ব্রাত্য। সব থেকে ভালো উপস্থাপনা করেও পুরস্কার অধরা থেকে গেছে। বিচারকরা ঠোঁট উলটিয়ে বলেছেন, পারফরম্যান্স আচ্ছা লাগা। লেকিন… বাংলা..! এরপর প্রতিযোগীদের বাংলা বর্জন করা ছাড়া আর উপায় কী?

সেটলারদের আর একটি বঞ্চনার ক্ষেত্র হলো চাকুরি। নিম্বুডেরার গৌরপদ রায় একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানিয়েছিলেন— আন্দামানিজরা জনসংখ্যার ৬% হলেও চাকুরিতে তাদের কোটা ১৭.৫%। সেটলাররা ৬২% (প্রি ৪২ ক্যাটেগরি ইত্যাদি সহ) হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য বরাদ্দ ১৭.৫% চাকুরি। প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে প্রি ৪২ গোষ্ঠীর প্রার্থীরাই এ ক্ষেত্রে সুবিধা পান, পিছিয়ে পড়েন বাঙালি সেটেলারের সন্তান। এটাই বাস্তব, কিন্তু তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তাকে সাম্প্রদায়িক তকমা দিয়ে কোণঠাসা করা হয়।

ভিনরাজ্যে বসত গড়ে তোলা বাঙালি উদ্বাস্তুরা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক, প্রথম শ্রেণির নন। আসামে বাঙালির হাল নিয়ে বলার কিছু নেই। তারা কেউ ডিটেনশন ক্যাম্পে, কেউ এনআরসি তালিকার বাইরে। শীর্ষ আদালতে মামলা চলছে, ভবিষ্যৎ কী কেউ জানে না। অন্যান্য রাজ্যেও তারা নিশ্চিন্তে নেই। মোট ৪টি ভিলেজ সমন্বিত বাঙালি উদ্বাস্তুদের সংক্ষিপ্ত পুনর্বাসন হয়েছিল কর্ণাটকে। একই সময়ে পুনর্বাসন পাওয়া পরিবারগুলির অনেকের হাতেই নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট পৌঁছেছিল। যাদের হাতে পৌঁছায়নি তাদের পরিবারের প্রায় তিন হাজার নতুন ভোটারের নাম গত বছরের ভোটার তালিকা বাদ দেওয়া হয়েছিল। হয়তো এনআরসি বা নতুন নাগরিকত্ব আইনের গোপন প্রভাব ছিল সেটা। 

এদের সঙ্গেই ঘটেছে আর একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। অনেক পরিবারেরই রয়েছে ‘সরকার’ পদবি। প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে এটার অর্থ তাদের জমিগুলি সরকারের জমি। সেই অজুহাতে কৃষকের জন্য বরাদ্দ ফসলের ভর্তুকি বা কৃষক প্রকল্পে সরকারি অনুদান তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দিয়েছিল ভূতপূর্ব বিজেপি সরকারের আঞ্চলিক কর্তারা। তাই কর্ণাটকে শুরু হয়েছে জমি রক্ষার নতুন লড়াই। এমন লড়াই ভিন্ন আকারে এই মুহূর্তে চলছে ওড়িশার কেন্দ্রাপাড়াতেও। উদ্বাস্তুদের ফের উদ্বাস্তু হওয়ার সম্ভাবনা। 

বিপদের এখানেই শেষ নয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্মম ভাষায় বলে থাকেন— শরণার্থীরা নাগরিক হতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টেও এ নিয়ে সওয়াল করছেন তাঁরা। বিশেষ ভাবে নিশানা করা হচ্ছে পূর্ববাংলা ছেড়ে আসা মানুষদের। কূটতর্কে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাভাগের প্রসঙ্গ। মনে রাখা হচ্ছে না— ধর্মের ভিত্তিতে বাংলভাগ হওয়ার কারণেই নির্দিষ্ট অংশে আসার জন্য ওরা দেশ ছেড়েছেন। পরিবারের সম্পত্তি ভাগ হলে কেউ সম্পত্তি হারা হয় না। নির্দিষ্ট অংশে তার অধিকার থাকে। নানান কৌশলে, আইনের মারপ্যাঁচ কষে সে অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা ঘোরতর অন্যায়। ভাগের স্বাধীনতাই অখণ্ড ভারতের ভূমিপুত্রদের একাংশের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। তাদের অধিকার ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে সেই ঐতিহাসিক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব। অন্য কোনও পথ নেই।

তথ্যঋণ :

১. ‘বিহারে পুনর্বাসিত বাঙালি উদ্বাস্তু এবং বিহার বাঙালি সমিতি’— বিদ্যুৎ পাল-এর ব্লগ থেকে। 

২. ‘Resettlement of East Pakistan Refugees in Andaman Islands’— Surajit Chandra Sinha . Govt.of W.B. 1955.

৩. ২০০১ সালে আন্দামান ভ্রমণ কালে প্রথম ব্যাচের (১৯৪৯) কিশোর সদস্য, পরবর্তীতে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং কৃষি বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা অনন্ত কুমার বিশ্বাস-সহ গুপ্ত পাড়ার প্রাক্তন গ্রাম প্রধান লক্ষ্মীপ্রিয়া বিশ্বাস, এন সি রায় (হ্যাভলকের প্রথম ব্যাচের সদস্য ও পরবর্তীতে জেলা পরিষদ মেম্বার), অরবিন্দ দাস (শিক্ষক, নিম্বুডেরা), পোর্টব্লেয়ারের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী নীতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় রায়চৌধুরী, নিকুঞ্জ বিশ্বাস, ডাঃ রামকান্ত হালদার, ‘আহেলী’ পত্রিকা সম্পাদক শুভ্রাংশু চ্যাটার্জী, শিক্ষাব্রতী এস পি মণ্ডল, শশাঙ্কশেখর সমাদ্দার (বিল্লিগ্রাউন্ড), ডিগলিপুরের প্রবীণ সমাজসেবী বিজয়কৃষ্ণ মণ্ডল ও কানাইলাল বিশ্বাস প্রমুখের সাক্ষাৎকার।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান