ভারত আমার ভারতবর্ষ — গায়ে তোর কাপড় কোথায়?

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

শুরুর কথা

আমাদের ভারতবর্ষ যখন ‘আজাদির অমৃত মহোৎসব’-এ বুঁদ হয়ে আছে সেসময়ও কি ভারতের টুকরো হয়ে যাওয়াকে বাদ দিয়ে কোনোভাবে লেখা যায় এ দেশের টুকরো হয়ে যাবার কোন কাহিনি?

জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে তাঁর ‘Remembering Partition: Violence, Nationalism and History in India’ (২০০৩) গ্রন্থের গোড়াতেই দু-টি প্রশ্ন তুলেছেন — (১) সরকারি সহস্র-অযুত বয়ানের মধ্য থেকে ‘ইতিহাস’ কীভাবে ‘সত্য’-কে (১৯৪৭-এর হিংসার সত্যকে) জন্ম দেবে, (২) সেদিনের সেই চরম মুহূর্তগুলোকে আজকের ইতিহাসে কীভাবে “struggle back into history” ঘটাবে? (পৃঃ ৪) এ গ্রন্থেরই অন্তিমে লেখক এক জরুরি প্রশ্ন রেখেছেন — “What would it mean to imagine India as a society in which the Muslim does not figure as a ‘minority’, but as Bengali or Malayali, labourer or professional, literate or non-literate, young or old, man or woman?” (পৃঃ ২০৫) 

‘নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনে (২২শে জুন, ২০১৫) ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডারলিমপল একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “দ্য গ্রেট ডিভাইড” শিরোনামে। প্রবন্ধে তিনি বলছেন — ১০০০ বছর একই সমাজে একসঙ্গে বসবাস করা সম্প্রদায়গুলো হঠাৎ করে ইতিহাসে অভূতপূর্ব পারস্পরিক মারণ খেলায় মেতে উঠল। একদিকে হিন্দু এবং পাঞ্জাবি, অন্যদিকে মুসলমানরা। ৭৫,০০০-এর মতো নারী ধর্ষিতা হয়েছিল বা দেহাঙ্গ কেটে নেওয়া হয়েছিল।

নিসিদ হাজারি তাঁর ‘মিডনাইট’স ফিউরিজ: ডেডলি লিগ্যাসি অফ ইন্ডিয়া’জ পার্টিশন’ (পেঙ্গুইন, ২০১৫) পুস্তকে বলছেন — “Gangs of killers set whole villages aflame, hacking to death men and children and the aged while carrying off young women to be raped. British soldiers and journalists who had witnessed the Nazi death camps claimed Partition’s brutalities were worse: pregnant women had their breasts cut off and babies hacked out of their bellies; infants were found literally roasted on spits. Foot caravans of destitute refugees fleeing the violence stretched for 50 miles and more. As the peasants trudged along wearily, mounted guerrillas charged out of the tall crops that lined the road and culled them like sheep. Special refugee trains… suffered ambushes all the way… blood seeping from their carriage doors।” (পৃঃ xii-xiii)

সহজভাবে বললে, নাৎসিদের মৃত্যু শিবিরের চাইতেও ভয়াবহ ছিল পার্টিশনের সময়কার মারণ খেলা — সমগ্র গ্রাম বহ্নিমান আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, গর্ভবতী নারীদের বুক দুটো কেটে নেওয়া হয়েছিল, কুপিয়ে গর্ভ থেকে শিশুকে বের করে মারা হয়েছিল, জন্মস্থান ছেড়ে যাওয়া ৫০ মাইল লম্বা কৃষকদের লাইনের প্রায় প্রত্যেককে ছাগল কাটার মতো মুণ্ডু ধরে কাটা হয়েছিল। যে স্পেশাল রিফিউজি ট্রেনে তারা যাচ্ছিল সেগুলোকে ‘অ্যাম্বুশ’ করে কচুকাটা করা হয়েছে। ট্রেনের বগির দরজা দিয়ে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। জনম মুখার্জি সংগতভাবেই তাঁর ‘হাংরি বেঙ্গল’ পুস্তকে মন্তব্য করেছেন — মৃত্যুর পরেও এই হতভাগ্য মানুষের দল কোনও মর্যাদা পায়নি। সমাজ মর্যাদা দিতে শেখেইনি।

রক্তস্নাত সেদিন / এদিন

দিনটি ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান রূপকার গান্ধি নিহত হলেন আততায়ীর হাতে। এক তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন না করে হত্যা করেছিল আততায়ী। খবর পৌঁছুল শান্তিনিকেতনে। ক্ষিতিমোহন সেন সংবাদ শুনে আরও সবার মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। পরে লিখছেন — “১৫ আগস্ট নাকি স্বাধীনতা পাওয়া গেল। কিন্তু কোন মূল্যে? সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে পৈশাচিক হানাহানি, লুঠতরাজ-গুন্ডামি, নারীদের লাঞ্ছনা, দীন-দরিদ্র-অসহায়ের নিপীড়ন, সবই নাকি ধর্মের জন্য। ধর্মের নাম করিয়া এই ব্যবসায়েও অনেকে বিলক্ষণ সুবিধা করিয়া লইল। এই নাকি স্বাধীনতার নমুনা।

“এই দারুণ দুর্গতির মধ্যে একমাত্র ভরসা ছিলেন মহাত্মা গান্ধি। হাতের কাছে সমস্ত সুবিধা তিনি ক্রমাগতই দূরে ঠেলিয়া ফেলিয়াছেন, পৈশাচিকতার আগুনের মধ্যে তিনি নির্ভয়ে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াছেন। নিঃসহায় নারী তাঁহার দিকে চাহিয়াই চক্ষের জল মুছিয়াছেন, ভিটামাটি-উচ্ছন্ন-যাওয়া হতভাগার দল তাঁহার চরণতলেই আশ্রয় পাইয়াছেন। এইটুকু ভরসাও আর রহিল না।” অন্তরের প্রক্ষোভকে ক্ষিতিমোহন এভাবে প্রকাশ করলেন — “তাঁহার অপরাধ, তিনি ধর্ম ভাঙ্গাইয়া খান নাই। অর্থাৎ ‘আমাদের ধর্ম গেল’, ‘ধর্ম বিপন্ন’ এই সব ধুয়া তুলিয়া চতুরের মতো তিনি সুবিধা আদায় করিতে জানিতেন না। কিন্তু মহাভারতের মতে এইরকম চাতুরী করার নামই ধর্মবাণিজ্য। যাহারা এই হীন বৃত্তি করে তাহারা ধর্মবণিক। ধর্মবাণিজ্যকা হ্যেতে যে ধর্মমুপুঞ্জতে।” (‘বঙ্গ মানস ও অন্যান্য’, পৃঃ ২৯১)

রামচন্দ্র গুহের লেখা থেকে জানতে পারছি — বারাণসীর এক হিন্দুমন্দিরে ধর্ম পরিচয়ে একজন মুসলিম আমাদের জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়িয়েছিলেন। জানতে পারছি — ১৪ আগস্ট, ১৯৮৭-এর সন্ধ্যায় গান্ধি যখন ভারত স্বাধীন হবার সমস্ত উল্লাস, উদ্‌যাপন আর উন্মাদনার বাইরে দাঙ্গা এবং মন্বন্তর-বিধ্বস্ত বাংলার কলকাতায় বেলেঘাটার এক সাধারণ ঘরে (এবং সাধারণের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত) দিন যাপন করছেন তখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাছে জানতে চান আগামীকাল কীভাবে উৎসব পালন করা হবে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, 

“মানুষ সর্বত্র বুভুক্ষায় মারা যাচ্ছে। তুমি কি এই ধ্বংস আর উৎসাদনের (devastation) মাঝে উৎসব পালন করতে চাও?” মুখ্যমন্ত্রীর কোনও জবাব ছিল না। (রামচন্দ্র গুহ – ‘India After Gandhi’, ২০০৭, পৃঃ ৮)

স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই স্বাধীনতার অভীষ্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। অন্বেষণ শুরু হল অর্জিত স্বাধীনতার চরিত্র, অন্তর্বস্তু এবং সাধারণ মানুষের প্রাপ্তি নিয়ে। এ প্রশ্ন নিরন্তর ধারায় বয়ে চলেছে। জীবন যৌবন বাজি রেখে স্বাধীনতার ভিন্ন অর্থ খুঁজতে নিজেদের অস্তিত্বকে আহুতি দিল এক অগ্নিগর্ভ সময়ের একটি বিশেষ প্রজন্ম।

এ প্রজন্মকে নিয়েই মণিভূষণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন উথাল পাথাল করে দেওয়া কয়েকটি লাইন — আমাদের চালু হিসেবে কবিতা বলে গ্রহণ করি। কিন্তু হৃদয়ের অবিশ্রান্ত রক্তক্ষরণ এবং উপচে পড়া মমতা যখন শব্দের চেহারা নেয় তখন কি সে কবিতা? কিংবা পশ্চিমি তাত্ত্বিকদের ভাষায় emobodied experience? মণিভূষণ লিখেছিলেন —

"অধ্যাপক বলেছিল, ‘দ্যাট’স র-ঙ, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?’
মাস্টারের কাশি ওঠে, ‘কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!’
চটকলের ছকুমিঞা, ‘এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ও. সি-কে।’
………
উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সে ডানপিটের তেজি রক্তধারা,
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।"

এখানে মণিভূষণ যখন এই সৃষ্টি করছেন তখন পৃথিবীর আর-একপ্রান্তে সময়ের কিছু ব্যবধানে লুই আরাগঁ সৃষ্টি করেন —

"It’s already too late to learn how to live,
Let our hearts mourn together at night.
For the least little song we pay with sadness
For each thrill we pay with regret
Even a sweet melody we pay with weeping.
There is no happy love."

১৯৭০-৮০-র দশকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হবার আগে বহু যৌবন পাঠ করেছে তাঁর কলম-কালির জরায়ু ছিঁড়ে জন্ম নেওয়া গায়ে কাঁটা দেওয়া কবিতার সেই লাইনগুলো —

"পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ — একা — নরক দর্শন করে
তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হতে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার;
মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।"

প্রতিবছর আমরা ১৫ আগস্ট তথা স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতে যথেষ্ট পরিমাণ বেলপাতা-ফুল-পাঁজি-বাতাসা নিয়ে স্বাধীনতার গল্প শুনি। ২০১৭ সালে দুই দিনাজপুর এবং মালদার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়ংকর বন্যা শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্ট। এক হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে গ্রামের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদের জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন, সাথে কয়েকজন বাচ্চা শিক্ষার্থী ছিল। পরের দিন সংবাদপত্রের খবর হয়েছিল এ ঘটনা। সমস্ত বঞ্চনা, অনাদর, অবহেলা, অবান্তর মৃত্যু, বুভুক্ষা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাজারো ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও মানুষের স্মৃতিতে নির্মিত হয় স্বাধীনতা দিবসের বর্ণময় চিত্রকাব্য— এমনকি জীবনে কোনও বর্ণ না থাকা সত্ত্বেও। এখানে এসে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা— হবসবম, হানা আরেন্ট, নর্বার্ট এলিয়াস, স্পিভাক, লাকাঁ আদি সমস্ত বিশ্ব তত্ত্বসাম্রাজ্যের শাসক সম্রাটেরা— ভেঙে পড়তে থাকে মানুষের শরীরী অভিজ্ঞতা বা emobodied experience-এর কাছে। অদ্ভুতভাবে অনেকেরই সেদিন মনটাও হয়তো বা একটু উড়ুক্কু থাকে। আমরা সেই ঘোরের মাঝে স্বাধীনতার লগ্নের বড়ো বড়ো নায়কদের — গান্ধি-নেহরু-জিন্না-প্যাটেল-নেতাজির গল্প শুনতে থাকি।

স্বাধীনতার গল্প শোনার ফাঁকে স্বাধীনতার লগ্ন কীভাবে জন্ম নিল, কীভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ স্রেফ অসমান দু-টুকরো হয়ে ধরাধামে আত্মপ্রকাশ করল, কীভাবে স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য সমস্ত মানুষের ভোটের যন্ত্র, মন্ত্র এবং অধিকার তৈরি হল — এ সবকিছুও শুনি আমরা, শুনতেই থাকি। বিভিন্ন রস, স্বাদ এবং রঙের যৌগপদ্যে নতুন নতুন ধারায় এবং বিভঙ্গে জমে উঠতে থাকে দেশ, জীবন, স্বাধীনতা আর আমাদের অস্তিত্বের যাত্রাপালা। আমরা সাধারণত এর সাথে মানসিকভাবে একাত্ম হয়ে পড়ি প্রায় সবসময়েই, অবশ্য কখনো distant observer হয়েও থাকতে পারি। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের এক জমাটি “জনতা” হিসেবে আমরা, বাখতিনের ভাষায়, carnivalesque / carnivalized literature-এর পাঠ নিতে অভ্যস্ত হতে থাকি। কিন্তু বাখতিন যে “সাবভার্সন” দেখেছিলেন জনতার এই আননন্দমুখর সৃজনে সে সৃজন বাখতিনের সময়ের প্রায় ১০০ বছর পরে লুঠ হয়ে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছে, রাষ্ট্রের হাতে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের আধুনিক চেহারায় এবং চলনে কার্নিভালের পরিবর্তে হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের “নির্মিত” জনতার উৎসব। ভারতভাগের ৭৬ বছর পার করে এসে রাষ্ট্রও তো একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে এমনটাই যেন থাকি আমরা— রাষ্ট্র-নির্ধারিত সংজ্ঞায় সুবোধ, সুশীল প্রজা (প্রশ্নময় তর্কশীল নাগরিক সত্তা খসে যাক আমাদের পরিচয় থেকে)।

শঙ্খ ঘোষ কী এরকম কোনও সম্ভাবনা, এরকম কোনও মুহূর্তের কথা ভেবেই আমাদের সচকিত করেন —

"আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব
আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব

আমাদের এই তীর্থে আজ ভেঙে পড়ার উৎসব
তাকিয়ে আছে হাজার মাঠ গহ্বর
বিনাশ আনন্দের উৎসারের প্রতীক্ষায়
ঝলসে ওঠে আকাশমুখী চিমনি

আমাদের এই তীর্থে ঘোর উৎসব
আমাদের এই তীর্থে শেষ উৎসব"

একজন সার্বভৌম নাগরিক, একজন ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে শিখলেই গৌরি লঙ্কেশ বা পানেসার বা কালবুর্গি হয়ে ওঠার বিপজ্জনক সম্ভাবনা ক্রমশ খুলতে থাকে। এমনকি ‘হিট লিস্ট’-এ থাকেন গিরীশ কার্নাডের মতো ব্যক্তিত্ব। আমাদের রাষ্ট্রের বর্তমান পরিধির মধ্যে এতটা জায়গা আমরা দিই কি করে? প্রত্যাশা করাও বড্ডো অনুচিত। যখন আনন্দমুখর উৎসবের প্রকাশকে সাফদার হাসমির মতো কেউ রাস্তায় সমস্ত মানুষের সাথে মিশিয়ে দিতে চান, ভাগ করে নিতে চান প্রতিজ্ঞাঋদ্ধ প্রত্যয়ে তখন তাঁর দোজখ যাত্রা ছাড়া আর কোন রাস্তাই বা খোলা থাকে? কারণ, ব্যক্তি কথা বলছে, সমষ্টিও কথা বলছে। কথা বলছে মানুষের নিজের জীবন-জগৎ-যাপন নিয়ে। এ এক সর্বনেশে পরিস্থিতি। তাই আমরা জনতাই থাকি, কার্নিভালের সুখে মাখামখি হয়ে থাকি। শঙ্খ ঘোষ তো কবেই নিজেকে এবং আমাদেরকে বলেছিলেন —

"তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
যে-কথাটাই বলাতে চাই বলি
সত্য এবার হয়েছে জমকালো।
গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর
হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর
তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে —
……
এ-দুই চোখে দেখতে দিন বা না দিন
আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন
আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে।"

স্বাধীনতার ঠাসবুনট গল্পের কি একটিই আখ্যান? একটি বয়ান? একটিই শরীর? যাত্রাপালা কি একভাবেই অভিনীত হয়? প্রতিটি অভিনয়ের সাথে সাথে তো নতুন উপাদান, নতুন ভঙ্গিমা তৈরি হয়। এভাবেই আমাদের রুধির-স্নাত স্বাধীনতার চলমান জীবনপ্রবাহ বেঁচে থাকে।

গল্পের ওপরে গল্প। আখ্যানের পরে আখ্যান, অসংখ্য চরিত্র, অগণন মৃত্যু, সংখ্যাতীত নারীর শরীর (তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া), টুকরো হয়ে যাওয়া জমি-জিরেত-পরিবার-আত্ম-দেশের ভূমি, হাজারো হাজারো নামগোত্রহীন শববাহী ট্রেনের যাত্রা, ক্ষমতার স্তরে স্তরে আরও বৈভব আরও মাৎসর্য্য— এসব নিয়েই তো স্বাধীনতার নির্লজ্জ বা অবগুণ্ঠিত কাহিনি।

"তুমি তো জানো,
জন্মভূমি আজ ছিন্নমস্তা; তার উলঙ্গ অভুক্ত দেহের ওপর
হাজার নরমাংসলোলুপ শ্বাপদেরা
তোমার শপথ, স্বপ্ন, ভালোবাসা, সবকিছুকে আড়াল করছে।
এমন কি তার হাতের মুঠোয় যে লাল পতাকাটা শক্ত ক’রে ধরা আছে
সেখানেও ভয়াবহ কুয়াশা, কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।" 

(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

এই ছিন্নমস্তা জন্মভূমির কাহিনি, আখ্যান, রক্ত-স্নাত কসাইখানা যেখানে রক্তক্ষরণ এখনও বন্ধ হয়নি, মানুষের ওপরে মানুষের ঢিবি করে রাখা লাশ — এসবকিছুর সালতামামি নেবার মাহেন্দ্রক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ছে। তখনই তো আবার শুনব উদার সুরে “সারে জঁহাসে অচ্ছা”, মন ভরিয়ে দেবে “ऐ मेरे वतन् के लोगों / ज़रा आँख् में भर् लो पानी / जो शहीद् हु हैं उनकी ज़रा याद् करो क़ुरबानी।”

এরকম কোনও মুহূর্তে আর-এক কবি হয়তো অন্য মাতৃভূমির স্বপ্ন নিয়ে একটি ভিন্ন চিত্র আঁকবেন —

"এখন আমি বলিষ্ঠ তুলির টানে
একটা নতুন শিশুর মুখ আঁকবো
আর ঘুমন্তদের ডেকে বলবো
শহিদদের সেই উজ্জ্বল স্বপ্নের কথা —
যে স্বপ্ন দেখতে কোনোদিন ঘুমোতে হয় না।"

সেসময়েই কোনও একজন কবি হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উঠে আসা আগ্নেয় প্রক্ষোভ নিয়ে রচনা করবেন —

"রক্তমাখা দ্রোণফুল পড়ে আছে ঘাতকের থাবার তলায়
ওই ফুল একদিন ফুটেছিল জ্যোৎস্নায়, কবিতায়
তাহার মায়ের স্নেহের ছায়ায়।"

(সনৎ দাশগুপ্ত)

এও তো আর-এক ‘কুরবানি’-র কাহিনি, তবে এক রাষ্ট্রের সাথে আর-এক রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়। দেশের মানুষের শোণিত-সিক্ত জীবন বনাম রাষ্ট্রের নখ-দাঁতের কাহিনি।

গায়ত্রী স্পিভাকের লেখা, ১৯০০০ বার রেফারড, প্রবন্ধ (পরে পুস্তক হয়ে প্রকাশিত) “Can the Subaltern Speak”-এ স্পিভাক মন্তব্য করছেন— “The subaltern cannot speak. There is no virtue in global laundry lists with ‘woman’ as a pious item.” তিনি তাঁর আত্মীয় ভুবনেশ্বরী দেবীর আখ্যান চিরে চিরে দেখিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এ সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পথে তিনি ফরাসি দার্শনিক ফুকো এবং দেলুজের “epistemic violence” তথা জ্ঞানতাত্ত্বিক হিংসা, ঔপনিবেশিক ভারতের মতো ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমিতে জন্ম নেওয়া জ্ঞান ও সত্যের নির্মাণ কি করে “universal” জ্ঞানের কাঠামোর মধ্যে নৈতিকভাবে আত্মসাৎ করে নেওয়া যায় ইত্যাদি প্রসঙ্গকে মার্ক্সীয় এবং দেরিদীয় প্রেক্ষিত থেকে সমালোচনা করেছেন। নতুন ভাবনার যাত্রাপথ নির্মাণ করেছেন। দু-টি প্রসঙ্গ এসেছে ওপরের উদ্ধৃতিতে— প্রথম, সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গের মানুষ তাদের নিজেদের কথা বলতে পারে না; দ্বিতীয়, “global laundry lists”-এ নারীরা কোনও পবিত্র সামগ্রী নয়। আপাতত সাবঅল্টার্নদের স্বর আদৌ আছে বা রেপ্রেসেন্ট করা সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে একটুখানি কথা বলব। পরে আমাদের স্বাধীনতা ও নারী নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা যাবে।

সংগত প্রশ্ন আসবে সত্যিই কি সাবঅল্টার্নরা নিজেদের রিপ্রেসেন্ট করতে বা কথা বলতে পারে না (এখানে নারীর প্রসঙ্গ ঊহ্য রাখলাম)? “আনন্দমঠ” পড়লে এরকম মনে হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। নামগোত্রহীন সন্তান সেনাদের (সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের মাঝে শুধু ভবানন্দ, ধীরানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র কিংবা সত্যানন্দের মতো প্রধান পুরুষদের কন্ঠনিঃসৃত সংলাপ শোনা যায়। যে অসংখ্য বিদ্রোহী — শান্তির বক্তব্য অনুযায়ী গড়ে “বিশ পঞ্চাশ হাজার” সন্তান সেনা থাকে — তারা ভাষ্যহীন, কণ্ঠহীন, স্বরহীন। সন্তান সেনাদের নেতৃত্ব ভবানন্দ বলেন — “আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেশাখোর নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?”

এরপরে মহেন্দ্রের সাথে ভবানন্দের কথোপকথনে আসে ইংরেজ এবং মুসলমানদের প্রতিতুলনা — “ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলেও পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায়— শরবৎ খুঁজিয়া বেড়ায় — ধর, তার পর, ইংরেজদের জিদ্ আছে — যা ধরে, তা করে, মুসলমানের এলাকাড়ি। টাকার জন্য প্রাণ দেওয়া, তাও সিপাহিরা মাহিয়ানা পায় না। তার পর শেষ কথা সাহস — কামানের গোলা এক জায়গায় বই দশ জায়গায় পড়বে না — সুতরাং একটা গোলা দেখে দুই শ জন পলাইবার দরকার নাই। কিন্তু একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায় — আর গোষ্ঠীশুদ্ধ গোলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।” এত প্রাঞ্জল এ বিবরণ যে পাঠক নিরপেক্ষভাবে এর আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু ইতিহাস কি এমনটাই বলে? সুপ্রকাশ রায়ের অসীম পরিশ্রমধন্য ১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত বই ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’-এর পাতায় পাতায় এ বক্তব্যের অর্থাৎ ‘আনন্দমঠ’-এর বিপরীত ভাষ্য বিধৃত আছে। সন্ন্যাসী, ফকির, নিপীড়িত হিন্দু-মুসলমান ভূমিহারা, সহায়সম্বলহীন কৃষক সম্প্রদায় ইংরেজ শাসন, কেবলমাত্র ইংরেজ কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে লড়াই করেছে। ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারী হিন্দু বা মুসলিম জমিদার বা কুসিদজীবীও বাদ যায়নি। বিদ্রোহীদের একটি পর্যায়ের নেতা ধর্মগতভাবে মুসলমান — মজনু শাহ। পরবর্তীতে নেতৃত্বে এসেছিলেন ইশা শাহ এবং অন্যান্যরা।

ইংরেজের সাথে চুক্তিবদ্ধ জমিদারদের ‘রেভেনিউ কাউন্সিল’ ১৭৭২ সালের ১৬ই মার্চ জমিদারদের সরকারিভাবে জানিয়েছিল — “ফকিরদের উৎপাতের ফলে রাজস্বের যে ক্ষতি হইয়াছে, আমাদের হিসাবে রাজশাহী জেলায় তাহার পরিমাণ ৮,৯৬৯ টাকা। আমরা মনে করি, চুক্তিবদ্ধ জমিদারগণ যে সকল দায়িত্ব বহন করিতে বাধ্য, এই ক্ষতি পূরণ তাহার মধ্যে একটি। কাজেই সরকার এই ক্ষতি সহ্য করুক— এই প্রস্তাবে আমরা সম্মতি দিতে পারি না।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃঃ ৩০) ১৭৮৭ সালের ২২শে জুন দিনাজপুরের কালেক্টর মুর্শিদাবাদের কলেক্টরকে চিঠি লিখছেন— “এই যুদ্ধে গ্রামবাসীরা ফকিরদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছে এবং বিপদের সময় ফকিরেরা যে ফেলে গিয়েছে তা সযত্নে রক্ষা করে পরে ফকিরগণ নিরাপদ স্থানে উপস্থিত হলে ফিরিয়ে দেবে।” (সুপ্রকাশ রায়, পৃঃ ৩৯) এসময়কার গ্রাম উত্তাল হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন না মেনে। অবশ্য মানুষের চলমান জীবনস্রোতে এ বিভাজন কোনওদিনই ছিল না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় বড়ো জোর দিয়ে এ সত্যের উল্লেখ করেছেন।

আমরা এর সাথে “আনন্দমঠ”-এর স্বকপোলকল্পিত কাহিনিকে মেলানোর চেষ্টা করতে পারি। ‘আনন্দমঠ’-এ শেষ অবধি ইংরেজকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রীয় প্লট হিসেবে প্রকারান্তরে কাজ করেছে। ঐতিহাসিক তনিকা সরকার তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Hindu Nationalism in India’ গ্রন্থে বলছেন ‘আনন্দমঠ’-এ তিনটি নতুন উপাদান রয়েছে— “a spatial or territorial imperative; a historical-temporal imperative; and a political message whose resonance, located in the past, was meant to influence present and future politics. To interlock the divine, the national, and the communal flowed from an exchange between sacred and profane realms and purposes.” (পৃঃ ১৮) আরও বলছেন — “Bankim, however, provided a compelling icon which unified the two concepts (হিন্দু রাষ্ট্র এবং এক হিন্দু দেবী) within a single vision … imagined through acts of opposition to the Muslim.” (পৃঃ ১৭)

ইতিহাসের ওপরে আর-এক ইতিহাসের, কাহিনির ওপরে আরও অনেক কাহিনির স্তরায়ন হয়েছে। কিন্তু সাবঅল্টার্নদের স্বর রয়ে গেছে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে, লোকগাথায়। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সাবঅল্টার্নরা “কথা” বলতে পারে— ঔপনিবেশিক দেশেও— কখনও বিদ্রোহের ভাষায়, কখনও ভিন্ন স্বরে। সেসময়ের লোকগান বা কাহিনি আমার জানা সূত্রের মধ্যে নেই। কিন্তু সামাজিক উথাল-পাথাল অবস্থায় গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এবং প্রকাশে পরিবর্তন তো আসবেই। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো মানুষ যখন একে রেপ্রসেন্ট করেন তখন সমগ্র চিত্রনাট্যই নতুন করে লেখা হয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ঢঙে। তখন আর নিম্নবর্গের কোনও কণ্ঠ, স্বর, ভাষ্য শোনা যাবে না। পার্থ চ্যাটার্জি “A Derivative Discourse?” দিয়ে এ সংকটকে বুঝতে চেয়েছেন। ১৯৪৭-এর নান্দীমুখ হিসেবে এরকম আখ্যান একের পরে নির্মিত হতে থাকে, যার এক অর্থে চূড়ান্ত পরিণতি মর্মন্তুদ স্বাধীনতার অভিনব চিত্রনাট্যে। আমরা পরতে পরতে সে ঘটনা দেখব এ প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে।

তখনও স্বাধীনতা হাতে এসে পৌঁছায়নি ভারতীয় জনতার হাতে। প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। সে রকম এক সময়ে ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট নিয়ে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা আবুল কালাম আজাদ তাঁর India Wins Freedom গ্রন্থে লিখলেন— “16th August was a black day in the history of India. Mob violence unprecedented in the history of India plunged the great city of Calcutta into an orgy of bloodshed, murder and terror …. The streets were deserted and the city had the appearance of death.”

“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ” হয়ে উঠল শেষ অবধি। শুধু এটুকু নয়। ‘স্বাধীনতা’ এই শব্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল সাম্প্রদায়িক হত্যা, নারীদের ক্ষত-বিক্ষত ধর্ষিত দেহ, এমনকি পণবন্দিতে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। আজাদ বলছেন— “It implied that partition was being accepted on the basis that in both India and Pakistan, there would be hostages who would be held responsible for the security of the minority community in the other state.”

ভারতভূমির রাষ্ট্র হয়ে ওঠা

বাইরে থেকে রোপণ করা বা এনগ্র্যাফটেড আধুনিকতার যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠল নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষণীয় যে যেখানে ইউরোপের একটি বড়ো অংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, ভারতে তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েকটি দশকে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে যেভাবে ব্যক্তির অভ্যুদয়, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি-নাগরিকের সহাবস্থান, সমাজ বা কৌমের অবস্থান বিলুপ্ত হওয়া এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (সেক্যুলারিজম) পরিসর তৈরি হয়েছে ভারতে তা হয়নি। ভারতে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের রাজনৈতিক ক্ষমতা-চিহ্ন, নীচের স্তরের সামাজিক ক্ষমতা নয়। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে মধ্যস্থতাকারী কোনও সামাজিক পরিসর নেই, রয়েছে নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। সামাজিক পরিসরের জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার রাষ্ট্রিক ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর এবং কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক “Occupy Wall Street” বা “Another World is Possible” কিংবা, বিশেষ করে, একেবারে হালের “#Black Lives Matter” আন্দোলনের কথা মনে পড়বে। এরকম একটি পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার, অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিক পরিসর অর্জন করে।

কিন্তু ভারতের মতো দেশে যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় ভিন্ন প্রেক্ষিতে এবং ভিন্ন উপাদান নিয়ে? রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি হয়ে ওঠে কেন্দ্রাভিমুখী। ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেল অন্তর্লীন গঠনগত বিরোধ। অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে আধুনিক ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য আখ্যান সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই’। “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জত বাড়ে, বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” “বোটের” সুতোয় রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনো নাগরিক হয়ে উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার এক আখ্যান। “বলান্টিয়ারদের” দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” ঢোঁড়াইয়ের মননে বা সাইকি-তে যোগসূত্র তৈরি হল “মহাৎমাজীর” সাথে— ইমাজিনড কমিউনিটিজ। এর অবস্থান আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে। ঢোঁড়াইয়ের ভিন্ন যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক ভারতের “পাক্কী” রাস্তার বাঁকে ঢোঁড়াই। কিন্তু তার নাগরিকতার মধ্যে রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান।

১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে অনুসৃত ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্যের উপাদানের মাঝে নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্রে নাগরিকদের ধরা হবে এক-একটি integer (পূর্ণসংখ্যা) হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশ অনুমোদিত নয়। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আলাদা কিছু হয় না। ওগুলো ভগ্নাংশ, পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়। এরকম এক সামাজিক মানসিকতা তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা। আবার পূর্ণসংখ্যা পজিটিভ হতে পারে। পূর্ণ সংখ্যা নেতিবাচকও হতে পারে। গোরখপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ কাফিল খান— সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ না থাকার ফলে কতকগুলো বাচ্চা স্রেফ মরে গেল, বাইরে থেকে অক্সিজেন জোগাড় করে ডাক্তারবাবু বাঁচালেন অনেকগুলো প্রাণ, তারপরে ৮ মাস জেল খাটলেন। এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে— আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা আর ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। কিন্তু নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা কখনও গৌরি লঙ্কেশ, কখনও কালবুর্গি, কখনও আখলাক, কখনও আসিফা, কখনও পানেসার নামে নিঃশেষ হয়ে যায়। এসবের মাঝে অলক্ষ্যে নাগরিক পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে তার সংকোচন ঘটেছে, রাজনৈতিক চরিত্রের পৌরুষীকরণ হচ্ছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলো বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে আপনমনে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম পাড়িয়েও দেওয়া হয়, যাকে বলে এথিকাল ট্র্যানকুইলাইজেশন (ethical tranquilization)।

কতসব অ-পূর্ণ রাশি! নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দি-অহিন্দি, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড-ডে মিলের ভারত! সবাইকে প্রকাশ করতে হবে পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? কিংবা চিহ্ন-জ্ঞাপক কোন স্লোগান দিয়ে? স্লোগান এবং নির্মিত কিছু শব্দসমষ্টি শুষে নেয় চিন্তাকে— যে চিন্তাহীনতা রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার অধীশ্বরেরা দাবি করে। যেমনটা ‘হীরক রাজার দেশে”-তে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। রাষ্ট্র তো বারেবারে একটি কথাই বলছে। হয় তুমি ভারতীয়, নয় তুমি ভারতীয় নও। এর মাঝে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার নানা রকমের কৃৎ-কৌশল রয়েছে, আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী (spectcularization) করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে এগুলো নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়ে উঠবে।

আর-একভাবে দেখলে নিজভূমে পরবাসী হবার সমস্ত সম্ভাবনা খোলা থাকল একটি আধুনিক তথা parochial রাষ্ট্রের কাছে। এ অবস্থাকে জয়া চ্যাটার্জি উদ্‌বাস্তু সমস্যার প্রেক্ষিতে বুঝেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে – “Building new nations, as one commentator has observed, is a ‘refugeegenerating process’. Efforts to create homogeneous nation states change some subjects into minorities who find themselves on the ‘wrong’ side of new borders or in the ‘wrong’ state, with the ‘wrong’ ethnicity, language or religion. Minorities are made to feel they should belong somewhere else, that they should be ‘nationals’ of some other new state made up of ‘people like them’.” তিনি দেখেছেন – “In the aftermath of empire, such migrations have profoundly transformed the demographic landscapes of the modern world.” হ্যাঁ, এভাবেই গড়ে উঠেছে আধুনিক রাষ্ট্র — exclusionary politics-কে আশ্রয় করে।

রাষ্ট্রের এরকম এক ভবিতব্যে শিক্ষকেরা হয়ে যাবে educational managers, শিক্ষাদান সংক্রান্ত নানারকমের টেকনিক্যাল কাজকর্ম সামলাবেন। ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোনও জ্ঞানভিক্ষু হিসেবে অবস্থান তৈরি হবে না। সিলেবাসও সেভাবে তৈরি হবে, যেমন সাম্প্রতিক দিল্লি বা জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। অঁরি জির (Giroux) শিক্ষার প্রেক্ষিতে “ক্ষমতা”-র ভূমিকা নিয়ে এক জায়গায় বলছেন— “Power, in this case, becomes a form of cultural production, linking agency and structure through ways in which public and private representations are concretely organized and structured within schools.”

এক নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ হচ্ছে যার ভিত্তিতে রয়েছে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকতা-নির্ভরতা, শুধুমাত্র বর্তমানকে যাপন করা। অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের লুম্পেনরা আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে। স্পষ্ট ভাষায় ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করবে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেবে “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যায়। আমাদের এতদিনের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছে না। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে এমন নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীদের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ তা্দেরকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথকেও কোথাও কোথাও সিলেবাস থেকে বাদ দেবার প্রস্তাব এসেছে। কর্পোরেট পুঁজির জগতে হয়তো তিনি বেমানান। ইতিহাসের পুনর্লিখন চলছে। ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করেছিলেন— “কুৎসিত বেশে সজ্জিত বর্বরতাপূর্ণ এই বৈষয়িকতা মানবিকতার বিরুদ্ধে এক প্রবল অভিশাপ, কারণ পূর্ণতার শক্তির উপরে ক্ষমতার প্রমত্ত আদর্শ চেপে বসেছে। … শক্তিমানের কাছে এই প্রলোভন যতটা সর্বনেশে, দুর্বলের কাছে তা আরও বেশি ভয়ংকর। … আমাদের জীবন হয়ে উঠুক বহিরঙ্গে সহজ আর অন্তরঙ্গে মহীয়ান। আর্থিক শোষণ ও বিরোধের উপরে নয়, সামাজিক সহযোগের ভূমিতে আমাদের সভ্যতা দৃঢ়ভিত্তি লাভ করুক।” (‘ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ’)

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অন্যতম প্রস্তুতি ছিল গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভোট। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে ঢোঁড়াই বুঝতে পারে — “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জত বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে আগে হয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি +++৬৬৬৯ লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” (সতীনাথ ভাদুড়ি, ‘ঢোঁড়াই চরিত-মানস’) এখানে অব্যর্থভাবে মনে পড়বে বেনেডিক্ট অ্যন্ডারসনের Imagined Communities-এর কথা — “anonymous performance of citizenship”. কোনও ভগ্নাংশে একে দেখা যাবে না — হয় শূন্য কিংবা ১, এরকম পূর্ণ রাশিতে তোমার পরিচয়। তুমি একইসাথে ভারতীয় এবং পাকিস্তানি হতে পার না। “গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থা তো একটি শক্তপোক্ত secularizing process — এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু জাতের সমস্যা, বিভাজন, পারস্পরিক হিংস্রতা রয়েই গেল। আবার ঢোঁড়াইয়ে ফিরি— “আমাদের সাহায্যেই ভোটে কংগ্রেসি জিতেছিল আগের বার। এবার তাই আমরা ঠিক করেছি কুর্মছত্রি, কুশবাহাছত্রি, আর যদুবংশছত্রি এই তিন জাত মিলে রাজপুত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব।” এর উত্তর ৬২ বছরেও মিলল না। The answer my friend is blowing in the wind!

ঢোঁড়াই দেখেছিল — “আর পূবের দিকের টুরমেনের ফারমের সিধা রেল লাইনের কাছে কাঠের ইস্টিশন করেছে ফৌজের সাহেবরা। বড়ো বড়ো চালা তুলেছে সেখানে। গোরু, ঘোড়া, ছাগল, খচ্চর, ভেড়ায় ভরা। সব বেলুচি ফৌজ মুসলমান নইলে এত কসাই আর কে হবে। অথচ মুসলমানরা চটবে বলে উট আর শুয়োর রাখেনি সরকার।” সেনাবাহিনীতে সাম্প্রদায়িকীকরণ অনেক পরে আবুল কালাম আজাদও অনুভব করেছিলেন — “This injected communal poison in the army which till then had been free from it.” আজাদ একথা বলছেন ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের অব্যবহিত আগে। ঢোঁড়াই আরও আগে একই বিষয় নিজের বাস্তবতা দিয়ে অনুভব করছে!

কীভাবে অখণ্ড ভারতবর্ষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের ক্ষমতার লোভে টুকরো টুকরো হল সে নিদারুণ ঘটনা বিস্তৃত জানার জন্য অন্তত তিনটি বইয়ের কথা উলেখ করব — (১) জয়া চ্যাটার্জীর Bengal Divided এবং The Spoils of Partition, (২) রজতকান্ত রায়ের “পলাশি থেকে পার্টিশন” এবং (৩) সুমিত সরকারের Modern India: 1885-1947।

কি হল তারপরে? উর্বশী বুটালিয়ার The Other Side of Silence-এর oral history, personal narrative, government documents ইত্যাদি সব নথিভুক্ত করেছে। তাঁর হিসেবে— “Twelve million people were displaced. Nearly one million died. Some 75,000 women were raped, kidnapped, abducted, forcibly impregnated by men of the ‘other’ religion, thousands of families were split apart, homes burnt down and destroyed, villages abandoned.” (p. 35) আরও মর্মান্তিক হল “while abducted women then entered the realm of silence, women who were killed by families, or who took their own lives, entered the realm of martyrdom.” (p. 158) একদল নারীর যাত্রা পরম নৈঃশব্দ্যে এবং বিস্মৃতিতে যাদের কোথাও কোনও চিহ্ন নেই (স্রেফ মুছে গেল), আর-একদল অর্জন করল শহিদের মর্যাদা। স্বাধীনতার কি অট্টহাস্যময় পরিহাস!

বীণা দাস তাঁর Transactions in the Construction of Pain প্রবন্ধে জানাচ্ছেন — “The bodies of the women were surfaces on which texts were to be written and read— icons of the new nations.” কিন্তু বিপরীত ঘটনাও ঘটল — “But women converted this passivity into agency by using metaphors of pregnancy…” অর্থাৎ, সন্তান ধারণ করার বিশেষ বায়োলজিক্যাল ক্ষমতাকে নারী তার agency হিসেবে ব্যবহার করছে — গর্ভধারণ করতে পারা যেন তার একমাত্র আইডেন্টিটি।

পরিবার, নারীত্ব, চিরকালীন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, দেশহারা-ভূমিহারা-আশ্রয়হারা-নির্বান্ধব হবার তীক্ষ্ণ বর্ণনা ধরা আছে An Epic Unwritten: The Penguin Book of Partition Stories-এ। সাদাত হাসান মান্টোর “সাহে” গল্পে হিন্দুদের সাথে একসাথে সারাজীবন, বংশ পরম্পরায় বেড়ে ওঠা বন্ধু মুমতাজ শেষ অবধি লাহোর যাবার জাহাজে উঠে পড়ল। সেসময় “After his bags had all been taken to the cabin, he took us out onto the deck. For a long time he gazed out of the place where sky and sea came together. He then took Juggal’s hand in his and said, ‘How perfectly deceptive … this meeting of the sky and the sea, and yet so incredibly delightful too!’” মান্টোর আর-একটি বিখ্যাত গল্প “টোবা টেক সিং”-এ পাগলা গারদের এক পাগল জিজ্ঞেস করে – If they were in India, where on earth was Pakistan? And if they were in Pakistan, then how come that until only the other day it was India?” অন্য একজন পাগল গাছের ওপরে উঠে পড়ে জানায় সে ভারত বা ভিন্ন কোনও ভূমিখণ্ডে নেই — এক নিরালম্ব অবস্থা। গল্পের প্রধান চরিত্র বিষাণ সিং ১৫ বছর ধরে শুধু দাঁড়িয়েই ছিল। তারপরে তাকে যখন জোর করে ভারতে পাঠানো হবে তখন এই চূড়ান্ত মানসিক আর শারীরিক ধকল সে নিতে পারে না, পড়ে থাকে তার প্রাণহীন দেহ— There behind the barbed wire, on one side, lay India and behind more barbed wire, on the other side, lay Pakistan. In between, on a bit of earth which had no name, lay Toba Tek Singh.” “নো ম্যান’স ল্যান্ডে” পড়ে রইল মানুষটি যার কোনও দেশ নেই। মান্টো তাঁর “সহায়” গল্পের (মূল উর্দু থেকে অনুবাদ সঞ্চারী সেন) শুরু করছেন এভাবে — “এমন কথা বলোনা যে এক লাখ হিন্দু আর এক লাখ মুসলমান মারা গেছে। দু লাখ মানুষ যে মারা গেছে সেটাও আসল ট্র্যাজেডি নয়। আসল ট্র্যাজেডি হল মৃত্যুগুলো খুব বেহিসেবি হয়েছে। এক লাখ হিন্দু মেরে মুসলমানরা ভেবেছিল হিন্দুধর্ম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা হয়নি, হিন্দুধর্ম রয়ে গেছে, রয়ে যাবে। তেমনি এক লাখ মুসলমান মেরে হিন্দুরাও আনন্দে বগল বাজিয়েছিল যে ইসলাম খতম হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব আপনাদের সামনে হাজির, ইসলামের গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি। তারা নির্বোধ, যারা মনে করে বন্দুক দিয়ে ধর্ম শিকার করা যায়। ধর্ম, ন্যায়, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এ সবকিছুই আমাদের শরীরে নয়, আত্মায় অবস্থান করে। ছুরি, কৃপাণ, গুলিতে এদের ধ্বংস করা যাবে কী করে?”

"রাইত কত হইলো? উত্তর মেলে না!"

কৃষণ চন্দরের “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” গল্পটি একবার স্মরণ করি। পেশোয়ার এক্সপ্রেস এখানে নিজের মনে কাহিনি শোনায়। এক ট্রেন ভরতি জবাই হওয়া হিন্দু ভারতে আসছে, ফিরতি ট্রেনে ট্রেনভরতি হিন্দুদের হাতে কাটা মুসলিম দেহ নজরানা হিসেবে ফেরত যাচ্ছে। ট্রেনটি গোঙায়। অবশেষে সেই মেয়েটিকে পেয়ে গেল দাঙ্গাবাজেরা – “মেয়েটি ওদের হাতে নিহত হল। জঙ্গলের শুকনো ঘাসের ওপর মেয়েটি ছটফট করতে করতে মারা গেল। আর তার হাতের বইখানা রঞ্জিত হল তারই দেহের রক্তে। বইটা ছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা।” জন স্ট্র্যাচির Why One Should Be A Socialist। “সে তো নারী ছিল। হয়তো কারও প্রিয়তমা অথবা জননী। আর এখন সে এই জঙ্গলে পড়ে আছে লাশ হয়ে। শকুন আর শেয়ালেরা তার লাশ ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা বইটা জানোয়ারেরা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। বিপ্লবের দরজা আর কেউ খুলছে না। কেউ কিছু বলছে না।”

আমাদের স্বাধীনতা পরিক্রমা আপাতত “শান্তি কল্যাণ” নিয়ে শেষ হল বেশ জবরভাবে বুঝতেই পারছেন। এত বছর পরেও বিস্মৃতির অতলান্ত গহ্বর থেকে উঠে আসা স্কন্ধ কাটা মানুষগুলো বারেবারে বেসামাল করে দেয়। শিকাগোর হে মার্কেটের শহিদ অগাস্ট স্পাইসের গলায় ফাঁসির দড়িতে টান পড়ার আগে তার শেষ কথা ছিল — “The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.” (‘History As It Happened’, p. 199)

আর আমাদের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের কানে যেন মন্ত্রোচ্চারণ করেন —

"কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল;
যদিও উজির, কাজি, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।"

মানুষের বাকি ইতিহাসের ভগ্নাংশ

ইতিহাসের কোনও বিশেষ ক্ষণে এসে ব্যক্তির কণ্ঠের প্রসঙ্গ কি আলাদা গুরুত্ব পায়? কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ব্যক্তির স্বর কি চাপা পড়ে যায় কৌম কিংবা সমষ্টির কণ্ঠের আড়ালে? রাজনৈতিক ইতিহাসের কোনও বাঁকে এসে ব্যক্তির উন্মেষের “discrete identity” একটি “concrete reality” হয়ে ওঠে? ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে— “আধুনিকতা” যখন মধ্যগগনে — তখন অন্তত দু-টি বিষয় বৌদ্ধিক স্তরে আলোচ্য বিষয়ের তালিকাভুক্ত হল। একদিকে “ঐতিহাসিকতা” এবং অন্যদিকে “রাজনৈতিক” হয়ে ওঠার ধারণা। (দীপেশ চক্রবর্তী, ‘প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ’) প্রাক্‌পুঁজিবাদী কৃষি অর্থনীতির সাথে জৈবিকভাবে যুক্ত কৃষক সিটিজেন বা “নাগরিক” হয়ে উঠল। প্রশ্ন আসবে এরা কি পূর্ণত “body politik”-এর সদস্য হয়ে গেল? তাহলে কণ্ঠরোধের প্রসঙ্গটিও ভিন্নমাত্রা নিয়ে হাজির হবে। পার্থ চ্যাটার্জী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন — “উচ্চবর্গের চেতনার স্বরূপ ও তার নিজস্ব-বিবর্তনের ধারা ঐতিহাসিকদের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য। নিম্নবর্গের চেতনার সন্ধান জানা যায় নানা জটিল বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে।” (পার্থ চ্যাটার্জী সম্পাদনা, ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’) এবার ঔপনিবেশিক সমাজেও ব্যক্তিকে নিয়ে কিছু গোল বেঁধেছিল। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, “শিক্ষিত বাঙালি তার নিজের সমাজর মতামত সম্বন্ধে নিরুত্তাপ হয়ে ইংরাজরা কী বলল — নিন্দা করল না প্রশংসা করল — তাই নিয়ে মাথাব্যথা করত।” (তপন রায়চৌধুরী, ‘ইউরোপ পুনর্দর্শন’)

যে জানল না “how one becomes what one is”, জানল না self-preservation কাকে বলে, সেখানে কোন কণ্ঠ কী উচ্চারণের জন্য পড়ে থাকে? রুদ্ধতা যেখানে আজন্ম সেখানে কণ্ঠরোধ শব্দটির অর্থই ভিন্নমাত্রা নেয়। আমরা যে কথাগুলো তৈরি করলাম আর-একজনের শ্রবণে পৌঁছে দেবার জন্য, যে শব্দগুলো সত্তার গভীরতম বিন্দু থেকে উৎসারিত হল নভোমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ার জন্য, সেগুলো যদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসমাপ্ত অসম্পূর্ণ বারিকণার মতো জন্ম নিয়েই শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায় তখনও তো আর-এক অবস্থার সৃষ্টি হয় — রুদ্ধতার, কণ্ঠরুদ্ধতার। শরণ নিই শঙ্খ ঘোষের —

"কে তোমার কথা শোনে? তুমিই-বা শোন কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।"

যখন মনোজগতে বিচ্ছিন্ন, চরা পড়ে থাকা দারুচিনি দ্বীপের মাঝে নিস্পত্র বৃক্ষ, বর্ণহীন পুষ্প আর নিঃসার অস্তিত্বপুঞ্জ রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি কথা কইতে চায়? যদি “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে” দাঁড়ায়, যদি আর-একবার বুঝতে চায় পল এল্যুয়ারের মতো —

"And by the power of a word I start my life again
I was born to know you
To name your liberty?"

যদি সে হঠাৎ জেনে ওঠে “আদিম অন্ধকারের মুখোশ-দেবতা / তোমার একটিই আনন্দ / আমাদের মুখ ম্লান করে দেওয়া?” (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একটি অসমাপ্ত কবিতা)

প্রকৃতপক্ষে এরকম এক পরিস্থিতিকে বুঝতে চাইছি, খানিকটা জলছবির মতো, খানিকটা লেখচিত্রের মতোও — “গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর / হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর / তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে— / …. এ-দুই চোখে দেখতে দিন বা না দিন / আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন / আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে” (শঙ্খ ঘোষ, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’)। কিন্তু রাষ্ট্রের এই বিপুল উৎসবের মাঝে যখন ভগ্নদূত schitz-এর মতো কেউ একজন হাত তুলে বলে ওঠে “Ecce Homo— ওই দ্যাখো মানুষ” তখন চরা পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মানুষগুলো আচমকা বুকের বাঁদিকে পকেটের নীচে থাকা অত্যাশ্চর্য হৃদয়টিকে আবিষ্কার করে ফেলে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি কবিতারও জন্ম হতে পারে —

"দেখ, এই আমার স্বদেশ —
বন্ধুদের হাতে হাত, ধমনীতে উষ্ণ রক্ত,
সময়ের প্রসারিত রেখা ছুঁয়ে যায় বুক
করতলে বেড়ে ওঠে রৌদ্রের শিশুরা।" 

(সব্যসাচী দেব, ‘সময় বাহুতে বাঁধে প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’)

যখন আকাশের দিকে তাকালে রক্ত আকাশ দেখি, মাটির দিকে তাকালে তপ্ত মাটি আমাকে তর্জনী তুলে শাসায়, বাতাস যখন ভারি হয়ে থাকে কত লাশ হয়ে যাওয়া, গুম হয়ে যাওয়া দেহের কটু গন্ধে তখন আমাদের কাব্য আর কবির মাঝে ঢুকে পড়েন স্টিভ বিকো লাশ হয়ে, মাত্র ৩১ বছর বয়সে।

কণ্ঠরোধ — কখন? কীভাবে? কেন? আরও আরও আরও? এখানে কাম্যুর এক উপলব্ধি মনে পড়ে। ১৯৪৬-এর ১৯ নভেম্বর লিখছেন — “The long dialogue among men has just come to an end. Naturally, a man who will not listen is a man to be feared. And so, along with those who have not spoken because they thought it useless, a vast conspiracy of silence has spread among us, a conspiracy sustained by those whose interests reside in silence.” (Albert Camus, Between Hell and Reason, p. 118) চকিতে শঙ্খ ঘোষ আর-একবার আমাদের স্মরণে চলে আসেন এরকম এক বাস্তবতার কাব্যিক ক্ষণে।

স্টিভ বিকোর (Steve Biko) কথায় আসি। ৩১ বছরের তরতাজা যুবক বিকো, সাহিত্যসৃজনের সাথে জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। আর-একটি বড়ো অপরাধ করেছিলেন — বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, আন্দোলন সংগঠিত করছিলেন। সেজন্য পুলিশ তাঁকে জেলবন্দি করে স্রেফ ঘুসি মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলেছিল। একটি কণ্ঠ রোধ হল। কিন্তু সত্যিই কি হল? হলে তো আমার এ লেখায় তিনি আসতেনই না। তাঁর বইও বিক্রি হত না নামী পুস্তকবিপণি থেকে। কণ্ঠ বোধহয় প্রকৃতপক্ষে কখনও রুদ্ধ হয় না। ওই লোরকার মতো — “বলেছিলুম কি না কবির হাত শেকলে বাঁধা থাকবে না।”

এলেইন স্কারি তাঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ ‘The Body in Pain’-এ যন্ত্রণা এবং ব্যথা নির্দিষ্টভাবে কি করে বোঝাতে গিয়ে বলছেন — “Physical pain does not simply resist language but actively destroys it, bringing about an immediate reversion to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makes before language is learned.” (p. 4) স্টিভ বিকোর মতো ইস্পাত-দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাঙ্ময় অস্তিত্বকে “to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makesbefore language is learned”-এর স্তরে নিয়ে যেতে পারলে রাষ্ট্রের শক্তির একটি নমুনা মেলে বই-কি। রাষ্ট্র আমাদের অস্তিত্বকে প্রাক্‌ভাষা (বা ভাষ, যে অর্থেই ধরিনা কেন) পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম— এই বোধ উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও সেটা রাষ্ট্রের বিজয় তিলক হিসেবেই গ্রাহ্য হবে। আমাদের আশ্বস্ত হবার অন্য কারণও আছে। হার্ভার্ড এবং আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে cognitive neuroscience নিয়ে বিপুল উদ্যমে গবেষণা ও চর্চা চলছে। এ গবেষণার একটি অভিমুখ হল যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ হার্ডকোর টেররিস্ট তারা দৈহিক এবং মানসিক অত্যাচারের ঠিক কোন পর্যায়ে ভেঙে পড়তে পারে (to the sounds and cries a human being makes before language is learned) তার ব্রেইন ম্যাপিং করা এবং মস্তিষ্কের অ্যানাটমিতে কীরকম বায়োকেমিকাল পরিবর্তন হয় সেগুলোকে পরিমাপ করা। দেহ-রাজনীতির এ অন্য এক অধ্যায়।

কণ্ঠ যখন কথা বলে তখন তার অভিঘাত কীভাবে এসে পড়ে আরও দু-একটি উদাহরণ ইতিহাস ঘেঁটে দেখে নিই। চার্টিস্ট আন্দোলনের নেতা আর্নেস্ট জোন্স। শ্রমিকদের সংগঠিত করছিলেন, মার্ক্সবাদের সাথে পরিচয় ছিল, এমনকি প্রভাবিতও হয়েছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহ তখনো অনেক দূরের ব্যাপার। ১৮৪৮ সালের ৬ই জুন একটি জ্বালাময়ী, “রাষ্ট্রদ্রোহী” বক্তৃতা দিয়েছিলেন — “green flag of Chartism will soon be flying over Downing Street.” সে সময় সমগ্র পৃথিবীর অধীশ্বর ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কাছে এ কি কোনও সহনযোগ্য বিষয় হল? জোন্স চালান হলেন জেলের ১৩ ফুট বাই ৬ ফুটের একটি অন্ধকার খুপরিতে। তিনি কবি। কোনও কাগজ কলমও তাঁকে দেওয়া হত না। নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে প্রথম দু-টি লাইন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর মাস্টারপিস কাব্যগ্রন্থ ‘The Revolt of Hindostan’-এর। তিনি লিখলেন —

"In part by force, but more by panic driven.
Victorious deluge! from a hundred heights
Rolls the fierce torrent of a people's rights,
And Sepoy soldiers, waking, band by band,
At last remember they've a fatherland!
Then flies the huxtering judge, the pandering peer,
The English pauper, grown a nabob here!"

লিখলেন —

"A mighty shadow, deep, and stern, and still.
Threw o'er the fleet and flood each Indian hill;
The encampment's flag just reached the rising light,
Like lingering glory of the evening's fight:
One hour its last farewell majestic waved
Old England's pride, unchallenged and unbraved;
But a soft wind at sunrise, like God's hand,
Quietly bent it homeward from that land!—
Sad wound the weary numbers to the sea,
The signal's up, and Hindostan is free!"

সাগরপারের একজন অবরুদ্ধ কিন্তু অনবদমিত কবি ও সংগ্রামী রুদ্ধকণ্ঠ উপনিবেশের মানুষকে জানিয়ে দিলেন — তুমি মুক্ত হবে। জানিয়ে দিলেন ইংরেজ ভিখারিরা ভারতে এসে নবাব বনে যায় (The English pauper, grown a nabob here)। কী তীব্র শ্লেষ! কী তীক্ষ্ণ ও মরমি ভালোবাসা মানুষের জন্য! মনে রাখতে হবে ১৮৪৮ সালে লেখা এ কবিতার ৯ বছর পরে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল।

ইংল্যান্ড রাষ্ট্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শেলি লিখলেন England in 1819। রাজতন্ত্র, রাজপরিবার এবং এদের স্তাবকদের জন্য ঘৃণা ও বিদ্রুপের কি সম্ভার সাজিয়ে দিলেন কবি! ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র-গণতন্ত্র কবাডি খেলার প্রধান দুই দল টোরি আর হুইগদের নিয়ে লিখলেন অবিস্মরণীয় ‘Similes For Two Political Characters of 1819’।

তাঁর কলমে,

"As from an ancestral oak
Two empty ravens sound their clarion,
Yell by yell, and croak by croak,
When they scent the noonday smoke
Of fresh human carrion:—"

শুধু এটুকু নয়। কবিতাটি শেষ হচ্ছে —

"Are ye, two vultures sick for battle,
Two scorpions under one wet stone,
Two bloodless wolves whose dry throats rattle,
Two crows perched on the murrained cattle,
Two vipers tangled into one."

সেসময়ের আধুনিক ইংল্যান্ড রাষ্ট্রে একটি প্রসারিত নাগরিক পরিসরের বাস্তব উপস্থিতির জন্য জোন্স কিংবা শেলিরা এভাবে রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন, অগ্নিস্রবা সৃষ্টি করতে পারেন।

১৮৩৫ সালে লেখা একটা প্রবন্ধ/বই-এর উদাহরণ আমাদের কাছে আছে – ‘A Journal of Forty-Eight Hours of the Year 1945’। লেখক হিন্দু কলেজের ছাত্র কৈলাশ চন্দ্র ঘোষ। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল Calcutta Literary Gazette (or, Journal of Belles Letters, Science, and Arts)-এ (vol. III, new series, number 75, June 6, 1835)।

দীর্ঘ কাহিনিতে না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায় এ গল্পের নায়ক ২৫ বছরের যুবক ভুবনমোহন এবং তার দুজন বিশ্বস্ত সাথী হল গঙ্গানারায়ণ এবং পার্বতীচরণ। এ গল্পের সময় ভাইসরয়ের নামও তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেওয়া হয়েছে Lord Fell Butcher এবং তার সামরিক জেনারেলের নাম John Blood-Thirsty। হিন্দু কলেজের হোস্টেলে (১৯৪৫-এ নামকরণ হয়ে গেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যদিও ১৮৩৫-এ লেখা বলে কৈলাশচন্দ্র ঘোষ এ নাম জানতেন না) এক অসম যুদ্ধের কাহিনির বর্ণনা আছে। কর্নেল ভাইসরয়কে ২৫ জন গোরা সৈন্যের মৃত্যু ও ২৫ জনের আহত হবার সংবাদ দিচ্ছে। কিন্তু দেশপ্রেমিক বিদ্রোহীরা মারা গেছে ৬ জন, ১৩ জন আহত। যুদ্ধ শুরু হবার আগে ভুবনমোহন ইংরেজ প্রতিনিধিকে স্পষ্ট স্বরে, নিরুদ্ধ কণ্ঠে জানায় — “Worthy Magistrate, I am sorry we are not able to comply with your proposition; we defy you to do your worst. You see before you men who will neither be terrified by the neighing of a steed, the waving of a sword nor the flashing of a gun. We are determined to assert our liberties, when every other resource has failed, by the strength of our arms. Go tell them that sent thee that we have resolved to hurl Fell Butcher from his seat, we have renounced the allegiance of the feeble and false Harry of England, and that we mean to abide by our own laws and parliaments!”

আমাদের এসময়ে শেলি এবং জোন্সের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই!

শেষ অবধি অসম স্বাধীনতার যুদ্ধে ভুবনমোহন ও তার বাহিনী হেরে যায়। আক্ষরিক অর্থে যূপকাষ্ঠে তাকে প্রাণ দিতে হয়। তাকে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাবার মূহূর্তে তার শেষ কথাগুলো ছিল — “আমার সহযোদ্ধা এবং দেশবাসী! জন্মভূমির বুকে মৃত্যু হবার সান্ত্বনা বহন করছি আমি। আর যদিও বধ্যভূমিতে আমার জীবন দেওয়াই ছিল ঈশ্বরের অভিপ্রায়, সহযোদ্ধাদের উপস্থিতি আমার শেষ মুহূর্তগুলোকে আনন্দোচ্ছল করে তুলেছে। দেশরক্ষার জন্য আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু আমি ঢেলেছি এবং যদিও এখন সেই ক্ষণ সমাগত যে আমার ভঙ্গুর দেহকাঠামোর মধ্যেকার দুর্বল জীবন-স্ফুলিঙ্গ আমাকে ছেড়ে চলে যাবার মুখে, আমার আশা যে গৌরবোজ্জ্বল পথের সূচনা তোমরা করেছ সে পথেই তোমরা হাঁটবে।” ভাইসরয় এরকম বীরত্বের সঙ্গে পূর্বপরিচিত ছিল না, যেমন নগ্ন দ্রৌপদীর উপচে পড়া তেজ দেখতে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না “সেনানায়ক”। এভাবেই সময়ের বদল হলেও কিছু কাঠামো আর উপাদান হাজারো সংস্কারের পরেও একরকমই রয়ে যায়। যাহোক, “While he (ভুবনমোহন) was going on in this strain, the viceroy struck with awe at the energy of the young patriot, dispatched an officer to conclude the scene immediately.” নিরুদ্ধ কণ্ঠের এই অবারিত দার্ঢ্য বহন করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য, “His hands were powerfully arrested, his head forcibly thrust between two wooden pillars and severed from his body at a single blow.” (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ভারতে ১৮৫৭ পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানোর ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার খুব আগ্রহী ছিল না, বিশেষ করে ১৮৩৫ সালে তো নয়ই। এখানে লেখকের মাথায় ফ্রান্সের গিলোটিনের ছবি কাজ করেছে বলে মনে হয়।)

ভারতের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের কাছে সিপাহি বিদ্রোহ খানিকটা “লিটমাস টেস্ট” ছিল তো বটেই। হিন্দু প্যাট্রিয়টের বিখ্যাত সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জী বিদ্রোহীদের “হৃদয়হীন” বলে গালি দিয়েছেন। সিপাহি বা নিম্নবর্গের কণ্ঠ প্রাধান্যকারী ভাষ্যে জায়গা পায়নি। “পদ্মিনী উপাখ্যান”-এ রঙ্গলাল লিখলেন —

"ইংরেজের কৃপাবলে      মানস উদয়াচলে
জ্ঞানভানু প্রভায় প্রচার।
হে বিভো করুণাময়      বিদ্রোহ বারিদচয়
আর যেন বিষ না বরিষে।।"

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পরম-কারুণিক ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন —

"হে নাথ করুণাময়       নিবেদন তাই
তব পদে ইংরাজের জয়ভিক্ষা চাই।
এই মত রক্ষা করো      তব অধিকার
ভারতে বিভ্রাট যেন নাহি ঘটে আর।।" 

এদের থেকে ভিন্নধর্মী ভাষ্য জন্ম নিয়েছে একই সময়ে গ্রামীণ জনসমাজে। গ্রামীণ কবি এবং কবিয়ালদের দল গান বাঁধছেন, ছড়া কাটছেন —

"রাজা হল নিশান (ঈশান) বাবু, কালসাপ জমিদার।
গোলাপপুরের জমিদারের লুটলো বাড়িঘর।।
……………
শুনে হয় শঙ্কিত বিদ্রোহের ফটাং কত।
অস্থির হল জমিদার আর তালুকদার যত।।"

(তথ্যসূত্রঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য, “বিক্ষুব্ধ সময় – নিস্তরঙ্গ সংস্কৃতি”, সাগ্নিক সংকলন, ১৯৯১)

১৮৭০ সাল নাগাদ এক পল্লিকবি কলকাতা বেড়াতে এসে সাধারণ লোকের অর্থকষ্ট দেখে মহারানি ভিক্টোরিয়াকে সম্বোধন করে লেখেন —

"পেটভরে পাই না খেতে
কাজ কি পথে,
কলের জলে, কাজ কি গ্যাসে?
করভার মুক্ত কর সয় না আর।"

(সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান’, পৃঃ ৩১৪)

কিন্তু সমাজের নীচের স্তরের এসমস্ত আবেগ, প্রক্ষোভ, অনুভূতি, প্রতিবাদ, নিবেদন ওপরের স্তরের মূল ভাষ্যে কোনও জায়গা নিতে সক্ষম হয়নি। সমাজ যে body-politik এবং technique দিয়ে (ফুকোর ভাষ্যকে অনুসরণ করছি) চলে তার মাঝেই এর অন্তত আংশিক উত্তর আছে। আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে, যেমন ফুকো আমাদের দেখান, দু-টি ভিন্ন ভিন্ন ধরনে যেন “Man-the-Machine”-এর স্ক্রিপ্টটি লেখা হয়েছিল। স্ক্রিপ্টের একদিকে ছিল “anatomico-metaphysical register”, আর-একদিকে “technico-political register” যা তৈরি করেছিল “a whole set of regulations and by empirical and calculated methods relating to the army, the school and the hospital, for controlling or coercing the operations of the body.” (‘Discipline and Punish’, p. 136)

পরবর্তী সময়ে ফুকো আরও বিস্তারে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন – “‘Government’ did not refer only to political structures or to the management of states; rather, it designated the way in which the conduct of individuals or of groups might be directed: the government of children, of souls, of communities, of families, of the sick. … To govern, in this sense, is to control the possible field of action of others.” (“The Subject and Power”, 1982) এই যে অন্যের কর্মভূমির বিচরণক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা এর মাঝেই governmentality তথা প্রশাসনিকতার সার্থকতা। এখানেই বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠের উদ্ভব ও অন্য কণ্ঠের লুপ্ত ও সুপ্ত হয়ে থাকার মেকানিজম কাজ করে। যদিও আমাদের ভাবতে হবে এটা একরৈখিক কোনও যাত্রা নয়।

একটি অমোঘ সত্য জানান দেবেশ রায় — “যে-কেন্দ্রকে ভাঙতে চেয়েছি — সাম্রাজ্যের, পেষণের, ক্ষমতার, শোষণের — সেই কেন্দ্রই আমরা গড়ে তুলেছি, দেশজুড়ে, আমাদের কল্পনা-মনন জুড়ে, আমাদের চেতনা জুড়ে। কোথায় গেল আমাদের মুক্তির আলোময় পরিধি, লবণাম্বুরাশির আভাচিক্কণ বেলাভূমি, অয়শ্চক্রনিভ দিগন্তময় দেশ, পর্বত যেখানে দেবতাত্মাআর গ্রাম-জনপদ যেখানে কেন্দ্রিকতা-নিরপেক্ষ এক-এক স্বাধীন কেন্দ্র। কেন্দ্রিকতা উদাসীন এক-এক স্বাধীন কেন্দ্র। এমনকি কেন্দ্রিকতা-বিরোধীও বটে।” (‘ব্যক্তিগত ও গোপন সব ফ্যাসিবাদ নিয়ে একটি বই’, পৃঃ ১০৮)

মহাশ্বেতা দেবীর “স্তনদায়িনী” গল্পটিতে একবার প্রবেশ করা যাক। যশোদা হল প্রফেশানে মা। “নিজের স্তন দু-টিকে বড়ো মহার্ঘ মনে হল তার। রাতে কাঙালীচরণ খুনসুড়ি করতে এলে সে বলল, ‘দেখ! এখন এর জোরে সংসার টানব। বুঝে শুনে ব্যবহার করবে।’ … গিন্নিমা কি তেরটা বিয়োয়নি? গাছের কি ফল ধরতে কষ্ট হয়?”

যশোদার স্তন তার সত্তা, তার agency, তার অস্তিত্ব, তার স্বর, তার জীবন্ত জাগতিক প্রকাশ, এমনকি তার নিরুচ্চার কণ্ঠ হয়ে ওঠে। এরপরে ক্যানসার-আক্রান্ত যশোদার স্তন? “ওর জন্যেই এত আকুলি-বিকুলি ছিল? — সেই মনমাতানো বুকের এই পরিণাম? হোঃ! মানবদেহ কিসসু নয়। তার তরে যে পাগল হয় সেও পাগল।” যশোদার ক্ষেত্রে ঈশ্বরত্ব-প্রাপ্তি কঠিন শ্লেষ আর বিদ্রূপ হয়ে বাজে — “এ সংসারে মানুষ ঈশ্বর সেজে বসলে তাকে সকলে ত্যাগ করে এবং সতত একলা মরতে হয়।” যশোদার মৃত্যুও ঈশ্বরের মৃত্যু।

এখানে নারী পুরুষ শাসিত রাষ্ট্রের কাছে একটি ভোগযোগ্য সামগ্রী যাকে চেটেপুটে খাওয়া যায়, যেকোন কাজে ব্যবহার করা যায়। ১৯৪৪-৪৫ সালে প্রকাশিত সরলাদেবী চৌধুরানি তাঁর আত্মজীবনী “জীবনের ঝরাপাতা”-য় লিখছেন — “রাজনীতি এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে কোন পুরুষ কোন মেয়ের জন্য ‘seat’ ছাড়তে পরাঙ্মুখ, সবাই ‘আপ-কা-ওয়াস্তে’ — তাই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি থেকে আরম্ভ করে বেঙ্গল কৌন্সিল-এসেম্ব্লি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য গুটিকত আলাদা ‘সেয়াত’ নির্ধারিত করা হয়েছে … কিন্তু মেয়েরা যদি পুরুষ দেবতাদের বলে বসেন — “তোমার সিংহাসনটা আমায় ছেড়ে দাও না ভাই” — তাহলেই বিপদ, তাহলেই পুরুষের পৌরুষ বেরিয়ে পড়ে চোখ রাঙা করে বলে “কভী নেই”।” (দে’জ পাবলিশিং, ২০১৬, পৃঃ ১৪৬) সরলাদেবীর লেখার প্রায় ৮০ বছর পরেও ‘আধুনিক’ ভারত রাষ্ট্রে এ প্রশ্নের সমাধান হলনা। আমরা আমরা লিঙ্গ বৈষম্যের সমাধান খুঁজতে নিজেদের মনকে পরিচ্ছন্ন করতে পারিনি।

পরে আরও তীক্ষ্ণ ভাষায় বলছেন – “মনুর সময় হইতে আরম্ভ করিয়া অদ্যাবধি যাহা কিছু অধিকার নারী পাইয়াছেন, তাহা কেবল পুরুষদের আরাম ও সুবিধাকল্পে, নারীর দিক ভাবিয়া নহে। ছবিটা যদি সিংহের আঁকা হইত, সিংহ যেমন আর এক রকম করিয়া আঁকিত, তেমনই ধর্ম্মশাস্ত্র-রচনা নারীর হাতে পড়িলে শ্লোক কয়টা পুরুষকে উলটা করিয়া পড়িতে হইত।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৭)

শক্তি চট্টোপাধ্যায় “ঋত্বিক, তোমার জন্য” পদ্যে উচ্চারণ করেছিলেন —

"তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে
পোড়া পাথরের মতো পড়ে আছো বাংলাদেশে, পাশে
ঋত্বিক, তোমার জন্য তুচ্ছ কবি আর্তনাদ করে।।"

স্পর্ধিত প্রকাশ ক্রম-অপসৃয়মান। আমরা সবাই খণ্ড মানুষ, স্পর্ধাহীন অ-সাহসী মানুষ। কিন্তু অনেকগুলো মানুষ জুড়ে গেলে? রুদ্ধ কণ্ঠ কথা বলতে পারে। নেরুদার মতো হয়তো বা বলে উঠতেও পারে এই মনুষ্যপুঞ্জ —

"And you will ask: why doesn’t his poetry
speak of dreams and leaves
and the great volcanoes of his native land?
 
Come and see the blood in the streets.
Come and see
the blood in the streets.
Come and see the blood
in the streets!"

আর আমাদের নিজেদের শঙ্খ ঘোষ আমাদের বলেন —

"শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?"

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান