দেশভাগ : ফিরে দেখা ইতিহাসের ভূত

আনন্দময় ভট্টাচার্য

ইতিহাসের পাতায় নজর রাখলেই বুঝি সেখানে বারবার বড়ো ঘটনাগুলির প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে আমরা যা দেখি, অন্তর্লীন কারণ, যেটা আসলে মুখ্য, সেই মুখ্য কারণগুলি ওই অধিতলীয় গৌণ প্রত্যক্ষতার নীচে আত্মগোপন করে নেয়। আর সেই সুযোগে ভুলিয়ে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের ভৌগোলিক অধিকার, বাস্তুর ওপর অধিকার, দেশের মাটির ওপর অধিকার। ওপর মহলের অধ্যাদেশের ওপর নির্ভর করে মানুষের অবস্থান থেকে অস্তিত্ব। সে অধুনা বিশ্ব রাজনীতির তোলপাড় করা ঘটনা প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সংঘাত হোক, বা আমেরিকা-তালিবান সংঘাত হোক বা ভারতের সীমানা বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো ঘটনা। সর্বত্র এই ইতিহাসের ভূতের উপদ্রবে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই সমস্ত ঘটনায় যাদের মতামতের কোনো গুরুত্ব থাকেনি, সেই বৃহত্তর অংশটির, সেই সাধারণ মানুষগুলি। বর্তমান আলোচনা সেই ইতিহাসকেই একটু নিবিড় করে তুলে ধরতে চায়।

গাজার আকাশ ভেঙে পড়ছে ইজরায়েলি রকেটের আঘাতে। মাটির ভূখণ্ডে জলের থেকে রক্তের কাদা বেশি আকর্ষণ করছে বিশ্বসংবাদের চোখ। মাথা ঠোকাঠুকি করে চলেছে অপারেশন আল-আকশা ফ্লাড বনাম অপারেশন আয়রন শোর্ড। মানবসভ্যতার ওপর চলমান এই উপনিপাত ফুসকুড়ির মতো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সমস্যা নয়, যে বড়ো দাদাদের ধম্‌কাধম্‌কিতে থেমে যাবে। বড়ো দাদারাও অবশ্য নাস্তা-গোসল করে ‘সহজ মৃত্যু’-র দোকান খুলে বসে পড়েছেন। বিকিকিনির এই মরশুমে দু’পয়সা ইনকামের সু্যোগ এমনি এমনি তো আর হাতছাড়া করা যায় না! বিশ্বসংবাদের দৌলতে হামাস বা ইজরায়েলের ওপর ওপর সমস্যাটা এখন আর অনেকের কাছেই অজানা বিষয় না। অনেকের কাছেই এটা ওপর ওপর একটা ভূখণ্ডের লড়াই। আর একটু তলিয়ে খোঁজ রাখছেন যাঁরা, তাঁদের মতে লড়াই লেগেছে কর্তৃত্বের। মধ্যপ্রাচ্য বনাম পশ্চিমা। প্যালেস্তাইন আর ইজরায়েল সেই লড়াইয়ের সামনের দুটো বোড়ে। কেউ কেউ আবার এই অবসরে ক্রুসেড স্মরণ করছেন সন্দেহ নেই। সুখের ব্যাপার এই যে, প্রাজ্ঞজন মাত্রেই মেনে নিচ্ছেন লড়াইটা ক্রুসেডের সময়েও ধর্মে ধর্মে ছিল না, আজও নেই। সে যতই তাকে ধর্মের ষাঁড় সাজানো হোক না কেন। লড়াইয়ের আঁতের কথা অন্য। সেখানেই বাস করেন ইতিহাসের ভূত। সেই ভূতের কারসাজিতেই প্রকৃত বিষয়ের ওপর ভেসে থাকে অপ্রকৃত কচুরিপানা। এমন কৌশলে তা ভেসে থাকে যে সেটা আসলে অপ্রকৃত বিষয়, তা বোঝার উপায় থাকে না। সে ভূত দেখা দিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতাকালে দেশ ভাগের সময়েও। বারবার সেই ভূতের হানাদারিতেই সভ্যতার বৃহত্তর যে অংশটা, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, তারা হারায় তাদের আজন্মলালিত পরিচিতি, হারায় মনুষ্যত্ব, হারায় বাস্তুর ওপর, তার মাটির ওপর যাবতীয় অধিকার। কেবল ওপরতলার আজ্ঞাবাহী যন্ত্রের মৌনে বরণ করে নিতে হয় নিজেদের অনতিক্রম্য দুর্ভাগ্য। সেই কথা পাড়ার আগে আমরা এই গাজা প্রসঙ্গটা থেকেই ভূতের সন্ধান শুরু করতে চাই। পৃথিবীজুড়ে বড়ো বড়ো উপনিপাতের আগেই বারবার দেখা দেন ইতিহাসের ভূত। এখনও তিনি বিদ্যমান। বর্তমান আলোচনা সেই ইতিহাসের ভূতকেই ফিরে দেখার সংক্ষিপ্ত আয়োজন।

ইজরায়েল সীমান্তে প্রায় পাঁচ হাজার রকেট নিক্ষেপ করেছে প্যালেস্তাইনপন্থী দল হামাস। সেই অজুহাতেই ইজরায়েলের পালটা হানা (অজুহাত বলছি আমরা এই কারণে যে, তার আগে পর্যন্ত ইজরায়েল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন করছিল তেমনটা একেবারেই নয়)। হাজার হাজার নর-নারী-শিশু প্রতিদিন ইজরায়েলি সেনার হাতে আহত নিহত হয়ে চলেছে। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজার মতো সমুদ্রতীরের গুরুত্বপূর্ণ  ও ঘনবসতিপূর্ণ শহর। কিন্তু কারা এই হামাস? কীভাবে তারা প্যালেস্তাইনের বিধাতা হয়ে উঠল? কীভাবে তারা ইজরায়েলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠল? ঘটনা হল, প্রায় দু’দশক গাজাকে সামরিক অবরোধ করে রেখেছে ইজরায়েল। সেখানে বাইরের পৃথিবীকে ঢুকতে দেওয়া হয় না দীর্ঘকাল। প্রতিদিন মানবাধিকার কলুষিত হয়। অমেরুদণ্ডী রাষ্ট্রসংঘের অনুরোধই হোক আর নির্বিষ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের নিন্দাই হোক, কোনো সমালোচনাকে আমল না দিয়ে একটা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলকে চূড়ান্ত দরিদ্র ও বেকার অধ্যুষিত অঞ্চল করে রেখেছে তারা শুধুমাত্র পশ্চিমা মদত আর আয়রন ডোমের লালচোখকে সামনে রেখে। হামাসের হামলা নাকি আমেরিকার মদতে ইজরায়েলের সেই চলমান অত্যাচারের প্রতিবাদ। কিন্তু ইজরায়েলও তো ঠিক এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল। হোক না সীমান্তের কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আরও অনেক মানুষ মারা যাবে। কিন্তু তারা এখন মধ্যপ্রাচ্যের নকশা বদলের যে আয়োজনে নামার সুযোগ পেয়েছে আত্মরক্ষার মালা গলায় দুলিয়ে, এই হামলা হামাস না ঘটালে তেমন সুবর্ণ সুযোগ কি সহজে হাতে পাওয়া যেত? আমাদের এই স্থানে এসেই আবার একবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কারা এই হামাস?

হারকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া ওরফে হামাস। মুসলিম ব্রাদারহুডের ছায়া সংগঠন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর প্যালেস্তাইন নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের নেতৃত্বে এবং ইজরায়েলের সরাসরি মদতে তৈরি হওয়া একটা সংগঠন যেখানে ইয়াসিনের সহযোগী ছিলেন আবদেল আজিজ আল-রানতিসি এবং মাহমুদ আল-জহর। ইজরায়েলের মতো আমেরিকার মদতে তৈরি ইহুদিদের জন্যে আলাদা একটা দেশের অস্তিত্ব মানতে না চাওয়া তৎকালীন প্যালেস্তাইন অধিশ্বর ইয়াসির আরাফতকে পর্যুদস্ত করতে হামাসই ছিল ইজরায়েলের উত্তর। ঠিক যেমনটা ছিল সোভিয়েতের মোকাবিলার জন্যে আমেরিকার তালিবান অস্ত্র। আমরা সেটা নিয়েও আলোচনা করব পরবর্তীতে। তালিবান যেমন আমেরিকার কাছে ফিরে আসা বুমেরাং এবং আজ এটা প্রকাশ্য-গোপনীয়তা, হামাসও ইজরায়েলের কাছে ফিরে আসা সেই বুমেরাং। হামাসই হল গাজার লাদেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ইজরায়েলের রকেটের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন শেখ আহমেদ ইয়াসিন এবং আবদেল আজিজ আল-রানতিসি। আমারিকার আদরের লাদেনকেও একই পরিণতি দেখতে হয়েছিল ২০১১ সালে। হামাসের তিন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে বেঁচে আছেন কেবল মাহমুদ আল-জহর। ইতিহাসের ভূত এবারেও হাজার হাজার গাজাবাসীর ওপর নেমে আসা অবর্ণনীয় দুঃসময়ের মুখে চাদর ফেলে বিষয়টাকে ইসলামের ওপর ইহুদি আক্রমণ হিসেবে দেখাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় ইসলামিয় সংগঠন প্যালেস্তাইনের পক্ষে মিছিল, প্রতিবাদসভা করাটা নিজেদের মানবিক দায়িত্বের থেকেও ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে বেশি দেখছেন। স্বাভাবিক ভাবেই অইসলাম ধর্মীয় সংগঠন ও তাদের অনুসারী রাজনৈতিক আউটফিটগুলির পক্ষে সুবিধা হচ্ছে ইজরায়েলের নরমেধ যজ্ঞের পক্ষে জনমত জোগাড় করা। ফোকাল পয়েন্ট থেকে একেবারেই দূরবর্তী স্থানে আলো পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিমা উভয়েই নিজেদের আলটিমেট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে একটা যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে। কিন্তু বাইরে থেকে মনে হচ্ছে দুপক্ষই আত্মরক্ষার লড়াই লড়ছে। এই ভৌতিক চক্রান্ত একেবারেই নতুন কোনো বিষয় না। পুঁজির পক্ষে বিপজ্জনক মার্কসের মতামত থেকে দুনিয়াকে দূরে রাখতে এই পশ্চিমা দাদারাই সারা পৃথিবীকে দেখিয়েছিলেন কমিউনিজমের ভূত। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত বইটার উদ্ধৃতিটুকু উদ্ধারের লোভ সামলানো গেল না,

“A specter is hunting Europe – the specter of Communism. All the powers of old Europe have entered into a holy alliance to exorcise this specter; Pope and Czar, Metternich and Guizot, French radicals and German police spies.

Where is the party in opposition that has not been decried as Communistic by its opponents in power? Where the opposition that has not hurled back the branding reproach of Communism, against the more advanced opposition parties, as well as against its reactionary adversaries? 

Two things result from this fact,

I. Communism is already acknowledged by all European powers to be in itself a power.

II. It is high time that Communists should openly, in the face of the whole world, publish their views, their aims, their tendencies, and meet this nursery tale of the Specter of Communism with a Manifesto of the party itself.”

কমিউনিজমের ভূতের ভয় একদিন ইউরোপের অলিন্দে অলিন্দে প্রবেশ করেছিল। শাসক সব বিরোধিতার মধ্যে কমিউনিজমের ভূতের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল। তার কায়েমি স্বার্থের পক্ষে হানিকর যেকোন মতামতের মধ্যেই কমিউনিজমের প্রলম্বিত ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। শাসকের সুহৃদ শিল্প-সাহিত্যের পাতায় পাতায়, ক্যানভাসে ক্যানভাসে প্রচারিত হচ্ছিল সেই ভূতের ভয়। এর একশো বছরের মাথায় কমিউনিজমের প্রহরী দেশ সুপার পাওয়ারে পরিণত হওয়ায় সেই ভূতের ভয় আরও জোরদার হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের পাতায় তখন দু-টি ব্লক। একটি কমিউনিজমের ব্লক, আর একদিকে জোটবদ্ধ লিবারেল-র‍্যাডিক্যাল-টোট্যালেটেরিয়ান-অটোক্র্যাট-ব্যুরোক্র্যাট-আইডিয়াল-পোপ। পশ্চিমা দাদারা সেই ভূতের ভয় যে নিছক শিশুসাহিত্যের পাতা থেকে তুলে এনে বিশ্বের আকাশে লোকদেখানো ফানুস করে উড়িয়ে দিতে চাইল, তা নয়। নিরন্তর আঘাত করতে লাগল কমিউনিজমের বলিষ্ঠ শরীরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের শোচনীয় পতনের পর তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এই বিশ্বাস নিয়ে যে, ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে গেছে। এখন শান্তিতে নিজেদের এজেন্ডাগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। কারণ তারা চোখ মেলে দেখল ডলারের গুঁতোয় রুবেল ধরাশায়ী, বেশিরভাগ জায়গায় কমিউনিজম অফিসিয়াল এবং শিরদাঁড়াহীন রেজিমেন্টেড। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে ইতিহাস দেখালো তার সমাপ্তি হয়নি। পশ্চিমাদের নতুন কপাল ব্যথার কারণ মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছে। তার নাম ইসলাম। এই ইসলাম কোরানকে সামনে রাখে বটে, কিন্তু কোরানের মতো শান্তিপ্রিয় না। বেশ চড়া সুর। আরবীয় সভ্যতার পুরাতন ইসলাম নয়, মৌলবাদী মুজাহিদিন ইসলাম।

পশ্চিমা দাদারা আরও তাজ্জব বনে গেল এটা অনুভব করে যে, নিজেদের স্বার্থে এই প্রতিপক্ষকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশ্রয় দিয়ে রসেবশে গড়ে তুলেছে তারাই; নানা সময়ে। এরা স্থানে স্থানে পশ্চিমা দাদাদের বসানো পুতুল সরকারকে উৎখাত করে নিজেরা জাঁকিয়ে বসতে চায়, দাদাদের মানতে চায় না, সব খাওয়ার খিদে নিয়ে চড়াও হয়, সীমানা বাড়ায়, সংখ্যায় অল্প হলেও নিজেদের একমাত্র ইসলামের প্রতিনিধি ও রক্ষক হিসেবে চওড়া গলায় হাঁক পাড়ে। অন্যদিকে দাদারা তাঁদের লোকলস্কর নিয়ে এদের যত সন্ত্রাসবাদী হিসেবে দেগে দিতে চায়, তত এরা লভবান হয়, স্বীকৃতি পায়, প্রচার পায়। যেহেতু দাদাদের স্কুলে গুডবয় হয়ে স্কোরকার্ড বাড়ানোর কোনো বাসনা এদের নেই, ফলে এরাও ইসলামকে সামনে রেখে নিজেদের প্রোপ্যাগান্ডা পূরণ করে চলে। এও ইতিহাসের ভূতের কারসাজি। কিছুতেই প্রকৃত সত্য সামনে আসতে দিতে রাজি নন তিনি।

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার শতাধিক প্রাণসহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার পরে আবারও তৈরি করা হল দুটো ব্লক। দাদা বললেন হয় তুমি এদিকে, নয় আমাদের শত্রু। যদি তুমি এদিকে থাকো তবে নিজের বাড়ির উঠোনে আমেরিকার ঝান্ডা লাগাও। ঝান্ডা লাগিয়ে প্রমাণ করো তুমি আমেরিকান। দাদারা তখন আগুন চোখে পৃথিবীতে কেবলমাত্র দুটো দেশ দেখতে পাচ্ছেন। একটার নাম আমেরিকা, যেখানে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ছিল, অক্ষত বীর পেন্টাগন ছিল, আজ নেই। ফুটো হয়ে গেছে আমেরিকান অস্মিতার ঢাক। আর একটা দেশের নাম ইসলাম, যেখানে তথাকথিত ‘জেহাদি’-‘মুজাহিদিন’-‘আক্রমণকারী’-‘মানবতার শত্রু’-রা অবস্থান করছে। হয় তুমি জাপান-ভিয়েতনাম-লাওস সহ পৃথিবীময় নামিয়ে আনা মানবতার প্রতি আমেরিকান মারণ আয়োজন ভুলে উঠোনে ঝান্ডা তোলো, না হলে তুমি বিবেচিত হবে বিরুদ্ধ ব্লকের মতাদর্শী হিসেবে। বহুকাল ধরে তুমি বাস করছ এই ভূখণ্ডে! ট্যাক্স দিয়েছ! দেশের উন্নতিতে যোগদান দিয়েছ! ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও নিজেকে গর্বিত আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দিয়েছ! মুখে বললেই আর এখন হবে না। অতীত অবলুপ্ত এখন। এই ভূখণ্ড এখন রক্ত দেখতে চায়। পতাকা তুলে নিজের রক্ত রক্ষা করো। তুমি মুসলমান হলেও নিখাদ আমেরিকার পক্ষে বললেও কেউ শোনার নেই। তোমাকে দেখাতে হবে তুমি আমেরিকার। তুমি হয় জেহাদি, নয় আমেরিকান। এই যে মানুষের আজন্মলালিত পরিচয়গুলো মুছে দিয়ে ইতিহাসের ভূত তাদের স্বার্থলগ্ন পক্ষগুলির আনুপাতিক নবপরিচিতি লিখে চলেন, এখানেই নিহিত থাকে যত দাঙ্গার ইতিবৃত্ত, যুক্তিহীন ঘৃণার ইতিবৃত্ত, মানুষের দেশহীন হয়ে পড়ার ইতিবৃত্ত, বিচ্ছিন্নতার ইতিবৃত্ত। এই ইতিবৃত্তের ফাঁদে পড়ে মানুষ বুঝতেই পারে না সে কেন এবং কখন তার পড়শির রক্তের তৃষ্ণা অনুভব করে, নিজের ভূখণ্ডে পরবাসী হয়ে পড়ে, সমাজবিচ্ছিন্ন নরখাদক অথবা শরণার্থী অথবা উদ্‌বাস্তু হয়ে পড়ে। ইতিহাসের ভূতের এই মায়াজাল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাক্কালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে দেশভাগের মতো মানব ইতিহাসের জঘন্য অপরাধগুলোকে সহজতর করেছিল সন্দেহ নেই।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কীসের ফলশ্রুতি? স্বদেশি আন্দোলনের? বিপ্লবী আন্দোলনের? নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতার? বহুল প্রচারিত এবং আদতে মিথ্যে ব্রিটিশ উদারতার? ব্রিটিশ কৃতজ্ঞতা বোধের (যেহেতু দুটো বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ স্বার্থে বড়োসংখ্যক ভারতীয় জনতা প্রাণ দিয়েছিল; কিছু যুদ্ধক্ষেত্রে, কিছু মন্বন্তরে)? এককথায় এগুলো কোনোটাই প্রথম প্রশ্নের উত্তর না। উত্তর হল, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রধান কারণ সময়। বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি বিচার করলেন ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়াই সর্বাধিক বিবেচনার কাজ হবে। কারণ উপনিবেশ চালানোর মতো রেস্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত মুদ্রাস্ফীতিআক্রান্ত ইংল্যান্ডের একেবারেই নেই। এই অবস্থায় ঢিলেঢালা প্রশাসন চালাতে গিয়ে গণঅভ্যুত্থানের প্রকোপে ভারতছাড়া হলে বিশ্বজুড়ে ইউনিয়ান জ্যাকের যে পরিমাণ মুখ পুড়বে, তার থেকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সসম্মানে ভারত ত্যাগ করে আসা ঢের ভালো। সেই বিবেচনা থেকেই মাউন্টব্যাটেনকে পাঠানো হল ভারতে। অর্থাৎ লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারতে আসা অ্যাটলির ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি সাকার করতেই। সীমানা বিভাজনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনার প্রাক্কালে আমাদের একটু সচেতন হতে হয় ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ওপরে। 

একাদশ শতকের আগে ভারতের সমাজ-রাজনৈতিক অলিন্দে মুসলমান শব্দটার তেমন কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তার পরেও তেমন ছিল না প্রথম প্রথম। হানাদারের থেকে শাসকের ভূমিকায় পাকাপোক্তভাবে তাদের জাঁকিয়ে বসতে ভারতের সমকালীন দেশীয় রাজাদের অনেক অন্তর্কলহের পর্ব পার করতে হয়েছিল। অমুসলমান সমাজপতিদের ক্ষমতার অস্তগামী সূর্যের সীমা থেকেই মুসলমান সমাজপতিদের চাঁদ-তারা ঝকমকিয়ে উঠল ভারতের আকাশে। অমুসলমান, বিশেষত হিন্দু মুখিয়ারা বড়ো আনন্দের সঙ্গে যে সেই পরিবর্তন মেনে নেননি, তার সাখ্য বহন করে চলেছে সমগ্র ভারতীয় মধ্যযুগীয় সাহিত্যমালা। আমরা যদি ভাবি ১৯৪৬ সালেই একমাত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাটি ঘটেছিল আলি জিন্নাহ্‌র প্ররোচনায়, তাহলে আমাদের ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে। এর আগে একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে বাংলা তথা ভারতজুড়ে। নানা কারণে ঘটেছে। ধর্মান্তরকরণ ও গোমাংস সংক্রান্ত সংঘাত সেই কারণগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। তবে সাধারণ মানুষ সে’সব দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়লেও মূলত স্থান বিশেষে কয়েকজনের প্ররোচনাই সেই সমস্ত দাঙ্গা সম্ভবপর করে তুলেছিল। ইংরেজদের সঙ্গে হিন্দুদের অধিক হৃদ্যতার কারণ ক্ষমতা হারিয়ে কয়েক শতাব্দী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে জীবনযাপনের ইতিবৃত্তের মধ্যেই নিহিত ছিল। 

ইংরেজ শাসনে ক্ষমতা হারিয়ে মুসলমান সমাজপতিদের মনে হতে লাগল তারা বঞ্চিত হচ্ছে, আর যাবতীয় প্রগতির ফসল ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিলেতি শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ঝটপট আত্তীকরণ করে নেওয়া প্রাগ্রসর অমুসলমান বিশেষত হিন্দু জমিদার, সমাজপতি বা তাদের ছেলেপুলেরা। ফলে আসন্তোষের ধোঁয়া জমার ইতিহাস কয়েক বছরের না, কয়েকশো বছরের। ইংরেজরা তাদের উন্নত মেধায় পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মতো পদক্ষেপে এই ধোঁয়া আরও গুরুতর করে তুলেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু ঠোকাঠুকি লাগানোর সলতে একমাত্র ইংরেজরা পাকিয়েছিল বললে অন্যায় হবে। সেটা কালে কালে পাকছিল। দুই সম্প্রদায়ের সুবিধাভোগী শ্রেণি অনেককাল ধরে নিজেদের হতাশা আর কায়েমি স্বার্থের তৈলাক্ত হাতে পাকিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মসনদ বদলে কোনোদিনই কিছু যায় আসেনি। যাদের যায় আসে, তারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশে উদ্‌বিগ্ন হয়ে ওঠে। সেই উদ্‌বেগ জাগরূক করে তোলে ইতিহাসের ভূতকে। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, ধর্মভিত্তিক পৃথক ভূখণ্ডের দাবি, ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ডে বসবাসের অধিকার পর্যালোচনা করার মতো উদ্ভট অপ্রয়োজনীয় জঘন্য ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। তাতে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পড়েন সাধারণ মানুষ। 

মাউন্টব্যাটেনের আগমনে ও ক্ষমতা স্থান্তরের ঘোষণায় অবিশ্বাসদীর্ণ দেশীয় নেতারা নেমে পড়লেন কুৎসিত প্রতিযোগিতায়। জিন্নাহ্‌ শিবির যখন আতঙ্কিত কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ তাবড় নেতাদের চাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে, সেখানে নেহরু শিবির আতঙ্কিত পাকিস্তানপন্থীদের দ্বারা অপমানিত এবং ক্রমে সীমাভাগের সিদ্ধান্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কংগ্রেসকে চাপে রাখতে একদিকে জিন্নাহ্‌ ডাক দিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের, অন্যদিকে লিয়াকৎ আলির মতো ক্যাবিনেটের লিগপন্থীরা ভাইস প্রেসিডেন্ট নেহরু থেকে কংগ্রেসের পদাধিকারীদের প্রতিদিন অপমান করার পথ ধরল। একজন আর্দালি নিতেও বল্লভভাইদের লিয়াকৎ আলির দুয়ারে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে উপস্থিত হতে হত। কারণ ভূখণ্ডের অংশে সমান্তরাল প্রশাসনের অধিকার না পেলে তাদের কোনো স্বার্থ সুরক্ষিত হবে না, এমন একটা ভাবনায় সুনিশ্চিত ছিল লিগ নেতারা। কিন্তু তাদের এই আতঙ্কের রেশ সমাজের, দেশের বৃহত্তর অংশকে না ছুঁলে তাদের স্বার্থ পূরণ হবে না, সেটা কংগ্রেস ও লিগ নেতারা জানত। তাই একদিকে চলল বক্তৃতায় বক্তৃতায় জনতাকে নিজেদের আতঙ্কের অংশীদার করে তোলা, অন্যদিকে দেশভাগের নীল নকশা নামল কূটনৈতিক টেবিলে।

দেশভাগের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টাতে কোন বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটা আমরা মাউন্টব্যাটেনের আহ্বানে ১৯৪৭ সালের ৩জুন সর্বদল বৈঠকে উপস্থিত কংগ্রেস ও লিগপন্থীদের আলোচনায় নজর দিলেই বুঝে যাই। দুই হবু দেশের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন কী হবে সেই নিয়ে তারা বিস্তর লড়াই করল। কোন ভাগে ভূখণ্ডের কোন লাভজনক অংশ যাচ্ছে, তাই নিয়ে লড়াই করল। রেজোল্যুশন লেখা হল। কিন্তু সেই রেজোল্যুশনে এই দেশভাগ সীমার দুইদিকে বসবাসকারী মানুষের জীবনে কী প্রভাব নিয়ে আবির্ভূত হবে, সেই নিয়ে উভয়পক্ষের নেতারাই উদাসীন মৌন থাকল। কোনো হিসেব না করে বাংলা ও পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে ছুরি চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হল ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা ব্যারিস্টার স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফের হাতে। র‍্যাডক্লিফ সাহেব ভারত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। বলা চলে সে ভারত নামটি ছাড়া ভারত সম্পর্কে কিছুই জানত না। ভারতের মানুষের সংস্কৃতি, জীবনাচরণ, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, ভারতের ডেমোগ্রাফি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না ব্যারিস্টার সাহেবের। বস্তুত এটাই চেয়েছিল কংগ্রেস ও লিগের নেতারা। তাদের দাবি ছিল সীমা ভাগের দায়িত্ব এমন একজনের হাতে দিতে হবে যার ভারত সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারণা নেই। তারা পরস্পরকে এতটাই অবিশ্বাস করছিল যে, কারোর স্বার্থের প্রতি কোনোরকম পক্ষপাতের রাস্তা তারা বন্ধ করতে চেয়েছিল। তাদের এই অবিশ্বাসের বলি হল সীমার দুপারে থাকা সাধারণ মানুষ। র‍্যাডক্লিফকে সীমাভাগের বিষয়টা নিশ্চিত করতে সময় দেওয়া হয়েছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ। এই সংক্ষিপ্ত সময়কাল নিয়ে একমত ছিল নেহরু-জিন্নাহ্‌ উভয়েই। নেতাদের চেয়ার দখলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছিল। তারা তখনি তখনি একটা হেস্তনেস্ত চাইছিল। পরিণামে ১৭ আগস্ট প্রকাশিত হল চূড়ান্ত নকশা। নেমে এল কয়েককোটি সাধারণ মানুষের জীবনে সীমাহীন বিপর্যয়।

দেশভাগের ডিক্রি জারি হতেই অগণিত সাধারণ মানুষকে তাদের প্রজন্মান্তরের বাস ছেড়ে র‍্যাডক্লিফের দেগে দেওয়া সীমার এপার ওপার হতে পোঁটলা-ছাঁদা বেঁধে প্রিয়জন সঙ্গে করে উঠে দাঁড়াতে হল। তারা বুঝতেই পারল না এতে করে কী অপরিসীম দুর্ভাগ্যের মধ্যে তারা নিজেদের নিক্ষেপ করতে চলেছে। যারা নির্দেশ মানতে প্রাথমিক ভাবে অসম্মত হল, তাদের জন্যে নামিয়ে আনা হল দাঙ্গা, গৃহে-জমির ফসলে আগুন দেওয়া, মাছভরতি পুকুরে বিষ ঢালা, বাড়ির মেয়েদের ধর্ষণ-সম্ভ্রমহানির মতো ওষুধ। ফলত বাধ্য হয়েও নারাজ পা ফেলে রিফিউজির জীবন বরণ করল হাজার হাজার নরনারী। শিয়ালদা স্টেশন তার আশপাশ নিয়ে তখন ওই হাজার হাজার নরনারীর উন্মুক্ত আকাশের নীচে আতঙ্কিত রাত্রি যাপনের আস্তানা। উলটোডাঙ্গা, যাদবপুর, সন্তোষপুর, দমদম, বালিগঞ্জ, ফুলবাগানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে রিফিউজি কলোনি। বুকের রক্ত দিয়ে জঙ্গল এলাকা বাসযোগ্য করে তোলার পরেই নেমে আসছে জমিদার আর পুলিশের ফতোয়া। ছেড়ে যেতে হবে ওইসব দখলীকৃত আস্তানা। পরিণামে অপরিহার্য সংঘর্ষ, মিছিল, রক্তারক্তি, প্রাণহানী। সীমার ওপার থেকে প্রাণ বাঁচাতে এপারে এসেও সেই বাঁচার নিশ্চয়তা পাওয়া গেল না। অপরিণামদর্শী দেশভাগের সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে যে অবর্ণনীয় দুঃসসময় নামিয়ে এনেছে, তা স্বীকার করতেই আপত্তি ছিল সেই সিদ্ধান্তের কুশীলবদের। তাঁরা তখন নজর ফেরাতে পুনরায় ভূতের ভয় ছড়াতে শুরু করলেন। হিন্দু মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস সেই ভূতের সৌজন্যে আগেই সৃষ্টি করা গিয়েছিল। নতুন করে শুরু হল এদেশি-ওদেশি লড়াই, বাঙাল-ঘটি লড়াই। 

ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাঞ্জাব, বিহার, বাংলা জুড়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল আতঙ্কিত মানুষের ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্‌বাস্তু হওয়ার স্রোত। বিভ্রান্ত সংখ্যালঘু হিন্দু, যারা বেশিরভাগ ওপার বাংলায় সম্পন্ন জীবন যাপন করছিল, নোয়াখালি ও টিপেরার দাঙ্গার পরে তারা এপারে আসছিল। সরকারি হিসেব অনুসারে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত দাঙ্গা ও দেশভাগের কারণে ভিটেছাড়া হয়ে পশ্চিম বাংলায় আসা হিন্দু জনতার পরিমাণ দশলক্ষ দশ হাজার। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সংখ্যাটা বাইশলক্ষ ছত্রিশ হাজার তিনশো ষোলোজন। যারা উদ্‌বাস্তু হল দেশভাগে, দাঙ্গায়, যারা খুন হল, ধর্ষিতা হল, নিরুদ্দেশ হল, আর যারা সেই জঘন্য পরিণামের জন্যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করল, তারা বাস্তবিক পরস্পরের পড়শি ছিল। তাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছিল ইতিহাসের সেই ভূত, যার প্রভাবে নিজেদের পাপের ঘড়া পূর্ণ করে কতিপয় নেতার সুপ্ত ক্ষমতার সম্ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করে চলেছিল।১০ তারা বাধ্য হয়েছিল ভুলে যেতে নিজেদের আজন্মলালিত পরিচয়গুলো, বাধ্য হয়েছিল মাটির ওপর নিজের অধিকার ভুলে যেতে, বাধ্য হয়েছিল নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের সাপেক্ষে বাসস্থান ও জীবন বেছে নিতে। তারা জানতই না কেন তারা মাটিচ্যুত হয়ে অনিকেত যাত্রায় নিজেদের ভবিষ্যৎকে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন করে আজ গাজাবাসী জানে না কীসের অপরাধে তাদের মর্টারের সঙ্গে জীবন নিয়ে লুকোচুরি খেলতে হচ্ছে বা যেমন করে ডব্লু টি সি হানার পরে মার্কিন মুলুকের বাদামি চামড়ার মানুষগুলোকে কোন অপরাধে সীমাহীন দৈনিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল বা আজও হয়। দেশভাগের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় কর্তৃপক্ষের কোনো অংশ সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা ভাবেনি। উপরন্তু দেশভাগের পরবর্তী পুনর্বাসনের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায় পাঞ্জাবের উদ্‌বাস্তুরা কিছুটা সুয়োরানির সেবা পেলেও বাংলার উদ্‌বাস্তুরা একেবারে দুয়োরানির ট্রিটমেন্ট পেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ভারত সরকার প্রথমে স্বীকারই করতে চায়নি পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত ভয়াবহ অবস্থা। ধর্মের ভয়, ধর্মীয় পরিচিতির দোহাই, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সমীকরণ, ভাত ছেড়ে জাতের লড়াই করতে নামে বা নামতে বাধ্য হয় যখন বৃহত্তর মানুষ, তখন আমাদের বুঝে নিতে হয় ইতিহাসের ভূত সংহার অভিযানে নেমেছেন তাঁর মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে। তাঁর মালিকরা যুগে যুগে নানা পোশাকে সেই ভূত নামিয়ে আনেন নাগরিক কর্তব্য, ধর্মের বিপদে ধর্মপ্রাণের কর্তব্য, জাতের বিপদে জাতিভুক্ত হওয়ার কর্তব্য, দেশের বিপদে দেশবাসীর কর্তব্য, কমিউনিজমের বিপদে উদারনীতির কর্তব্যের মতো গল্প ফেঁদে। সেই গল্পে বারবার মানবিকতার সর্বনাশই হয়েছে। আমাদের চিনে নিতে হবে সেই ভূতের গল্পগুলো আর তাদের মালিকের অভিসন্ধি। দেশভাগের সময় সেই চেনার ইচ্ছা যদি দুর্ভাগ্যপীড়িত ভারতবাসী করত, আজ বোধ করি দেশের ইতিহাস অন্য গদ্যে লেখা হত। 

তথ্যসূত্র :

১. সেন, সোমদীপ, ৮ অক্টোবর ২০২৩, পোস্ট এডিটোরিয়াল, আলজাজিরা, গাজা, পৃ. ৪

২. ঐ, পৃ. ৫

৩. ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’, ২০১০, নাবু প্রেস, দক্ষিণ ক্যারোলিনা, পৃ. ৭১

৪. Marx, Karl and Friedrich Engels, 2021, ‘The Communist Manifesto’, New Delhi, Fingerprint Classics, ISBN 978-93-8653-825-3, p-23

৫. Al-Rahim, Muddathir, 1997, ‘Islam and Non-Muslim Minorities’, UAE, Just World Trust, p. 17

৬. নূরানী, এ জি, ২০০৩, ‘ইসলাম ও জেহাদ’, কলকাতা, ন্যশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, পৃ. ৫-১৩

৭. Ghosh, Bhaswati, 2022, ‘Victory Colony 1950’, New Delhi, Yoda Press, p. 143-197

৮. Butalia, Urvashi, 2017, ‘The Other Side of Silence : Voices from the Partition of India’, New Delhi, Penguin Random House India, p. 77-79

৯. Hajari, Nisid, 2016, ‘Midnight’s Furies : The Deadly Legacy of India’s Partition’, UK, Penguin, p. 124-133

১০. Khan, Yasmin, 2008, ‘The Great Partition : The Making of India and Pakistan’, USA, Yale University Press, p. 69-76 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান