গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
"আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত
আমার বুকে পালানোর পালানোর আরও পালানোর দেশ জোড়া স্মৃতি"
— শঙ্খ ঘোষ
‘দেশ ভাগ’ বাঙালির চেতনায় এক আশ্চর্য শব্দ — জীবনকে রক্তের অক্ষরে চিনে ওঠা, দেশহীন মানুষের বর্ডার পেরিয়ে বাকি জীবন শুধু দেশকে খুঁজে বেড়ানো। দেশ খুঁজতে খুঁজতে লোকাল ট্রেনে গোপাল ভাঁড়ের গল্প, মেয়েদের ব্রতকথা, বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা হয়ে যাওয়া। ওপারের মাস্টার মশাইয়ের এপারের লোকাল ট্রেনে বিষহরি তেল, ওপারের স্কুলের ইতিহাসের দিদিমণির এপারে স্টেশনের ওভারব্রিজের নীচে টুলে বসে খরিদ্দারকে চা বাড়িয়ে দেওয়া। দেশভাগ মানে কলকাতা — মফস্সলে মাঝদুপুরে ঘুমিয়ে থাকা অলিতে গলিতে ফেরিওয়ালার হাঁক হয়ে যাওয়া। আলতা, ফিতে, চিরুনির হাঁক হয়ে সুখী গৃহবধূর আধা ঘুমের প্রান্তরে মিলিয়ে যাওয়া।
তখন ছোটোরা খেলছিল মাঠে। মায়ের ডাক ভেসে গেল মাঠের দিকে — ওরে তোরা চলে আয়, এখুনি যেতে হবে ইন্ডিয়ায়। তারপর? তারপর শুধু পালানোর আর পালানোর ইতিহাস। পেছনে পড়ে থাকল সারা জীবনের ঘরবাড়ি, তুলসীতলা, পুকুর ঘাট, উঠোনের পেঁপে গাছটা— যাদের হাত ধরে ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠে চিনে ওঠা দেশকে। সবাই চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থাকল নির্বাক। সামনে বর্ডার যত এগিয়ে আসে অনন্তের বুকে শৈশব ততই ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। দাঙ্গায় প্রিয়জন হারানো আধখানা ভাঙা মানুষ বোঝাই ট্রেন ঢোকে শিয়ালদা স্টেশন। যে মহিলা পূর্ব বাংলার গ্রামের বাড়িতে দরজা ধরে অপেক্ষা করে থাকত— ঘরের মানুষটা আর ফিরবে বলে, সে মহিলা মধ্যরাতে প্ল্যাটফর্মে জেগে বসে থাকে অনাহারে।
এই দেশভাগ শুধুই ভৌগোলিক ছিল না, লক্ষ লক্ষ মানুষের মনের ভাগাভাগি ঘটে গেছে, যার মাঝে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়েছে দুর্লঙ্ঘ্য এক অবিশ্বাস। জীবনের মানেটাকেই পালটে দিয়েছে আমূল, পালটে দিয়েছে জীবনকে দেখার চোখ, ভাষা, সংস্কৃতি। দেশভাগ মানে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি নয়, দেশভাগ মানে এক কোটি মানুষের স্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে এসে দাঁড়ানো। বাঙালির হৃদয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া — হয়তো বাকি যুগ যুগান্তর দুই আলাদা পথে চলবার জন্য।
দেশভাগ শুধুই তো স্থানান্তর নয়, মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে জীবনটাই ফুরিয়ে যাওয়া, ভিখিরি হয়ে যাওয়া, নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, অনাহারে একালেই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া। এক একটি মানুষের দুঃখের পাহাড় হয়ে ওঠা— যেখানে টোকা দিলে হু হু করে বেরিয়ে আসে অশ্রুভেজা জন্মভূমির স্মৃতি। দেশহীন এই রিফিউজিরা দৌড়ে, হাঁপিয়ে, জিরিয়ে, গ্রীষ্মের মাঝ দুপুরের দাবদাহে ঘুমিয়ে থাকা মহানগরীর অলিতে গলিতে গৃহস্থের দরজায় দরজায় টোকা দিয়ে যাওয়া — বাড়ির ভেতরটা এক ঝলক চোখে পড়লে ওপার বাংলার বাড়ির কথা মনে পড়ে যাওয়া।
সম্পত্তি হারানোর শোকে অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজেদের বাকি জীবন বন্ধক রেখে যান পূর্ববঙ্গে। ধর্মান্তরিত হবার ফলে পূর্বপুরুষের পৈতৃক ভিটে আঁকড়ে রইলেন ঠিকই, কিন্তু সে আঁকড়ানোয় জোর থাকল না। সে জীবন স্ববিরোধিতায় কন্টকাকীর্ণ, সত্য-মিথ্যার টানাপোড়েনে ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। হৃদয়ের গভীরে যে স্বদেশ, সে চলে গেল ভারতেই।
আত্মপরিচয়ের সংকট
‘স্বদেশ’ বা ‘মাতৃভূমি’ শব্দের যে ব্যঞ্জনা, তারই নাদ আমাদের অন্তস্তলে বেজে চলে অনাদি অনন্ত সময় ধরে, তাকেই ঘিরে অনুবর্তিত হয়ে চলে দেশ, মাটি তথা দেশবাসীর সাথে এক গভীর একাত্মতা। সেই হৃদয়ের কেন্দ্রেই ঘটে গেছে এক বিপর্যয়, এক ধ্বংস প্রক্রিয়া। হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে জন্মভূমিতে। জাতি রাষ্ট্রের নতুন মাটিতে, কিংবা রিফিউজি ক্যাম্পে। ঘর নেই কোনও, সবটাই বাহিরে, সবটাই চেনা অচেনায় দোলা। স্বদেশভূমিতে দাঁড়িয়েই পৃথিবীকে নিজের বলে মনে হয়, মানুষকে দেশবাসী আর পৃথিবীর মানুষকে নিজের প্রজাতি বলে একান্ত বোধ হয়। স্বদেশ হারিয়ে গেলে পায়ের নীচের মাটিকে পৃথিবী গ্রহের যে কোনও মাটি, কোনও আশ্রয় নয়, দাঁড়ানোর মাটি শুধু। মাটির সাথে, মানুষের সাথে ঘটে যায় যোজন যোজন বিচ্ছিন্নতা। মনে হয় কোনটা দেশ আমাদের? ইন্ডিয়া! জন্মভূমিতো দূর দেশে ফেলে আসা! খেলার মাঠের হইচই, বাতাসে ভেসে আসা মায়ের ডাক সবই তো ওদেশে পড়ে আছে! এদেশে তো আমাকে তেমনভাবে কেউ ডেকে ওঠে না। আমি থাকলাম কি না থাকলাম, পৃথিবী নির্বিকার! এদেশ তো শুধু বসবাসের! অনাহুত, অবাঞ্ছিত এদেশে আমরা, সব সময় পরবাসের অনুভূতি। মাটির উপর জোরের মুঠিটা কোথায় যেন আলগা হয়ে যায়। দেখা দেয় আত্মপরিচয়ের সংকট। তারই পেছনে হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, সংখ্যালঘুর উপলব্ধি।
কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে গড়ে উঠল দেশহীন মানুষের প্রতিরোধের জীবন দর্শন নিয়ে নতুন এক একাত্মবোধ— যার নাম বাঙালি নয়, রিফিউজি। এক-একটা কলোনিই দেশহীন নিজের বাড়ি। পিছনে পড়ে থাকল জন্ম রাষ্ট্র, পায়ের নীচে আশ্রয় রাষ্ট্র। সামনে অচেনা পৃথিবীর ধূ ধূ প্রান্তর — যেখানে ঝাপসা জেগে আছে টিকে থাকার অনিশ্চিত লড়াইয়ের ছবিটুকু। নিজের দেশ শুধু কলোনিটুকু।
হিন্দু উদ্বাস্তুরা যে ঘর হারিয়েছেন — সে শুধু নিজেদেরই ঘর নয়, সমগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের আশ্রয়, তার মাটি, যার মধ্যে বাঙালির লোকাচার, গ্রাম বাংলার হৃৎস্পন্দন মিশে ছিল। দেশভাগের অভিঘাতে উৎপাটিত বিপন্ন অগণিত মানুষের স্রোত শ্যাওলার মতো ভেসে ভেসে ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার গলিতে, রেল লাইনের ঝুপড়িতে, আন্দামানে, সুদূর দণ্ডকারণ্যের অরণ্যের নির্জনতায়। তার স্বপ্ন জীবনের লক্ষ্যগুলো ছেঁড়া কাগজের টুকরোর মতো উড়ে উড়ে পড়েছে এখানে সেখানে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আর-এক দফা বাঙালি নিধনে ৩০ লক্ষ বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে বাঙালির ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ।
কীভাবে বাঙালি এগিয়ে গেল দেশভাগের দিকে
বাংলার প্রান্তজনের মধ্যে, গ্রাম বাংলার শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভেদ রেখা ছিল ক্ষীণ, অস্পষ্ট। শ্রমনির্ভর জীবন থেকে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, গৃহ নির্মাণ, পোশাক রীতি, কবি গান, ভাটিয়ালি, সুখ-দুঃখ, যাত্রাপালা, বিপদ-আপদের একটাই সাধারণ ছবি ছিল। একে অন্যের উৎসবে মিশে গেলে কোনও সীমারেখাই খুঁজে পাওয়া যেত না।
তাহলে এই ভয়ংকর ঐতিহাসিক বিভাজন ঘটে গেল কীভাবে? কে ঘটাল? এ বিভাজন নেমে এল ওপর থেকে, বলা ভালো নামিয়ে আনা হল, শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের ক্ষমতা-আধিপত্যের দ্বন্দ্ব থেকে। আত্মীয়তায় একসাথে জড়িয়ে থাকা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে ওপর থেকে নেমে এল প্রতিপক্ষতার গণসম্মোহন, বাঙালি নিমেষে গুজবে গুজবে আক্রান্ত হয়ে পড়ল Mass Hysteria-তে। বাঙালি জাতিসত্তা ভেঙে গেল হিন্দু ও মুসলিম সত্তায়। কিন্তু এত সহজে সম্ভব হল কীভাবে এই উৎপাটন? হয়তো এ বিভাজন সম্ভব হয়েছে হিন্দু উচ্চবর্ণের কাছে মুসলিম প্রজার যুগ-যুগান্তরের নির্যাতন ও অপমানে। এক পক্ষ আর-এক পক্ষের চোখে দেখল অবিশ্বাসের ছায়া। অবিশ্বাস থেকে জাতিগত প্রতিহিংসা। তাই বলা যায়, দেশভাগ হল হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক থাপ্পড়। এই অবিশ্বাস দেখতে দেখতে মহিরুহ হয়ে ওঠে। এক সময় যারা একজনের অসুস্থতায় আর-একজন রাত জাগত, তারাই এখন একজনের বাড়িতে আর-একজন আগুন লাগিয়ে দেয়। একদিন যারা একজনের কাছে নিজের গোপন দুঃখের কথা অকপটে বলে শান্তি পেত, তারাই আজ কেউ কারও মুখ খুলতে ভয় পায়। শুধু ফিসফাস। শিশুরাও কীভাবে যেন বুঝতে পেরে যায় সব। একে অন্যের সাথে কথা বন্ধ করে দেয়। মাঠে মাঠে যারা খেলছিল তারা বুঝতই না তারা আলাদা, আজ তারা একে অপরকে এড়িয়ে চলে, নিঃশব্দে পাশ কাটায়। আল্লা হো আকবর আর বন্দেমাতরম্ ধ্বনির মধ্যে সমস্ত মুখ মুহূর্তে অপরিচিত হয়ে ওঠে। বহুদিনের সম্পর্কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক-একটি পশু। বহুদিনের সম্পর্কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক-একটি পশু, তারা কি লুকিয়েছিল তাহলে?
দেশভাগের স্মৃতি এক জটিল মনস্তত্ত্ব। মুসলমান দেখল প্রতিবেশী ঘনিষ্ঠ হিন্দু পরিবারটি মাঝরাতে নিঃশব্দে ইন্ডিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। ভোরের আলোয় পড়ে আছে শূন্য নিঃস্তব্ধ বাড়ি। কাউকে কিছুই জানায়নি অবিশ্বাসে। রোজ সকালে যে বাড়ি গিয়ে চা খেত, সে বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। এই চলে যাবার মধ্যে যে ঐতিহাসিক ভাঙচুর হয়ে গেল, তা আজও জোড়া লাগেনি। বর্ডারের দিকে এগোতে এগোতে পিছনে ফিরে দেখি অজস্র আমিকে — বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমি, জানলা ধরে অপেক্ষায় দাঁড়ানো মা, মাঠের কোণে নিম গাছটার ছায়া, রোদে ছোটাছুটি করে যার নীচে এসে ঢগ্ ঢগ্ করে জল খেতাম। সেই নিম গাছ এখন অন্য দেশের। সেই জানলা, সেই দরজা সবই ঐ দেশের। এর সঙ্গে মিশে থাকে অপমান, স্বজন হারার কান্না, পাপবোধ, চোখের সামনে স্বজনদের ভিখিরি অথবা মৃতদেহ হয়ে যাবার স্মৃতি, আর এসব কিছু ডিঙিয়ে পালানোর, শুধুই পালানোর স্মৃতি।
নতুন সীমারেখার দুপারে নিজেদের পুরনো আবাসেই তাঁরা উপলব্ধি করেন — কোনও এক ভুল ভাষায় বুঝি কথা বলছেন তাঁরা। তাঁদের এতদিনের চেনা ধর্ম বুঝি ভুলে ভরা। কখন যেন ঘড়ির কাঁটার শব্দে হয়ে গিয়েছেন — ‘সংখ্যালঘু’। সমষ্টি থেকে একলা হয়ে পড়ার অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে তাই উদ্বাস্তু হয়ে সীমান্ত বদল। যে লক্ষ্মীর আসনের সামনে মন শান্ত হয়ে আসত, সেই আসনই আজ রক্তের কারণ। সম্পন্ন হিন্দুরা অর্থের জোরে দেশ ত্যাগ করল দলে দলে, হিন্দু সামাজিক জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা অন্ত্যজ গণৎকার, পুরোহিত, নাপিত, ঢোলি প্রভৃতি পেশার মানুষ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদেরও দেশত্যাগ ছাড়া আর উপায় রইল না। এদেশে এসে অনেকেই তারা মিশে গেল ‘হরেক মাল চার আনা’-র দলে।
দেশভাগ মানে দুঃখ নয়, হতাশা নয়, উদ্বেগও নয় — বর্ণনার অতীত মনের এক ধ্বংসাবশেষ। আর ভেতর দিয়ে বয়ে যায় হু হু হাওয়া। তাই তাকে কখনও মনে করতে না চাওয়া। এই মনে করতে না চাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে উদ্বাস্তুর ইতিহাসের মূলভাষ্য। দুর্মর সেই স্মৃতি থেকে পালিয়ে অন্য স্মৃতির আড়ালে খুঁজতে চাইলেও তার অতীত ছায়াকে এড়িয়ে যাওয়া যে সম্ভব নয়! এই ভুলে যেতে চাওয়ার মধ্যেই তো জেগে আছে বাস্তুহীনের ইতিহাস। বেঁচে রয়েছে তার হারানো দেশ।
দেশভাগের স্মৃতি হল হাহাকার আর স্তব্ধতার স্মৃতি, অবিশ্বাসের স্মৃতি, ধ্বংসাবশেষের স্মৃতি। অপমান, অবহেলা আর পালানোর স্মৃতি। কোনও দুঃখ নয়, অভিমান নয়, হতাশাও নয়— দেশভাগ আত্মপরিচয়হীনতা আর অস্তিত্বহীনতার এক ভয়াবহ অন্ধকার। যে অন্ধকারে চেতনা ছুটে যায় মৃত্যুর অনন্তের দিকে, সঙ্গে থাকে শুধুই নিজের হৃৎপিণ্ড আর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। দেশভাগ যে ক্ষত বা wound, তা এখনও দগদগে, নিরাময় হয়নি। এখনও তা স্পন্দনময়, এখনও মাছি বসে।
১৯৫০ সালের দাঙ্গা জন্ম দিল বিশাল উদ্বাস্তু প্রবাহের। শিক্ষা-সংস্কৃতি ভেঙে পড়ল। পূর্ব বঙ্গের এক কোটি মানুষ বিতাড়িত হয়েছিল স্বদেশভূমি থেকে। কলোনি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক স্বতন্ত্র একাত্মতাবোধ, প্রাণপাত করে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে বাঁচার তাগিদেই তারা কথাবার্তায় অনেক বেশি সরব হয়ে উঠেছিলেন। ৬৪-র দাঙ্গায় আরও বড়ো ধাক্কা। আবার দেশত্যাগ। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দেশব্যাপী হিন্দুদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষিত হলে হিন্দুদের পায়ের নীচের মাটি আর রইল না। যেসব পরিবার, মানুষ, সম্প্রদায় দেশভাগের কারণে অপরিণাম যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছিল, তাঁদের জীবনটাই পালটে গেছে চিরতরে। ক্ষমতার অঙ্গুলি হেলনে কেন্দ্রে গদিয়ান মহাবলী ব্যক্তিদের ইচ্ছায় নির্ধারিত হয়েছে জনজাতির ভাগ্য।
অন্যদিকে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মুসলমানের কাছেই ১৯৪৭ মানে শুধুই দেশভাগ নয়, তার অনেক বেশি। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা শুধু নয়, যুগ যুগান্তরের হিন্দু প্রভু ও জমিদারদের অধীনে দাসত্ব থেকে মুক্তি— যা অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষিত ছিল বাঙালি মুসলিমের। নতুন দেশ বাংলা নয়, মুসলিমদের নিজের দেশ। ভাষাভিত্তিক অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তা হারিয়ে গেল হিন্দু মুসলিম সত্তার নীচে পড়ে।
দেশভাগে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তা ভেঙে চুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, এ জীবনে কতজনের আর দাঁড়ানো হল না, শিক্ষা হল না, সংসারের সুখ ধরা দিল না এ জীবনে, কতজনের বড়ো হয়ে ওঠা হল না, রাস্তায় রাস্তায় ফেরিওয়ালা হয়ে হাঁক দিতে দিতে ফুরিয়ে গেল গোটা জীবনটাই। দেশভাগ যদি না ঘটত, তাহলে যে অখণ্ড বাঙালি সত্তা তার সমৃদ্ধি আর সংস্কৃতি নিয়ে বিরাজ করত, তা জন্ম নিল না ইতিহাসের বুকে। বাঙালি হয়ে গেল শুধু ফেরিওয়ালার হাঁক। তবু সেই হাঁকের ভেতরে দারিদ্র্য আর লড়াইয়ের যে তাপ, সেই তাপে উদ্বাস্তু বাঙালি চিনল পৃথিবীকে। ঠুনকো মূল্যবোধের আলগা ছবি যতই ঝরে ঝরে পড়ল, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর যে কঠোর সত্য, সেই সত্যের আলোর মধ্যে এসে দাঁড়াল দেশহীন মানুষ। নতুন সেই দেশহীনতার আগুনে পুড়ে সত্য আর পবিত্র হয়ে উঠল নতুন এই জীবনবোধ। শুধু সত্যের দাবিতেই সে সুন্দর — সেই নতুন আলোয় সে চিনতে পারল সুরক্ষিত ভদ্র মানুষের ভেতরের কঙ্কাল, রাজনীতিবিদদের জটিল তত্ত্বের ভিতরে লুকিয়ে থাকা নরক। বেঁচে থাকার জন্য বাঙালি জাতির এই লড়াই, সেই হিরণ্য আলোয় আলোকিত করেছে ইতিহাসের বুকে তার সাংস্কৃতিক চেতনাকে।