দেশভাগ ও মানবাধিকার

সাহাবুদ্দিন

যে দেশকে ভাগ করে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান ও ভারত নামে দু-টি দেশ, এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ নামে আরও একটি দেশের জন্ম হল, সেই অখণ্ড দেশকে দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়নি, সেইসব হতভাগ্যদের একজন হিসেবে যখন আজকের ভারতের দিকে তাকাই তখন একইসঙ্গে দৃষ্টি চলে যায় এক দেশ ভেঙে ক্রমান্বয়ে তৈরি বাকি দু-টি দেশেও। কারণ, একটি দেশ ভেঙে তৈরি তিনটি দেশেরই চলমান চালচিত্রের সার্বিক অবস্থা একই ইতিহাসের গর্ভ থেকে উদ্‌গত। স্বভাবতই, তাদের ‘স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ’ তাদের পরস্পরের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত কর্মকাণ্ডের ঘাত-প্রতিঘাতের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে। বিশেষত, দেশভাগের কারণে উপমহাদেশে রাতারাতি ধর্মীয় সংখ্যালঘু হয়ে পড়া সাধারণ নাগরিকদের মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে এই ঘাত-প্রতিঘাত এক নির্মম সত্য।

আশ্চর্যজনকভাবে দেশভাগ নিয়ে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ — তিনটি দেশে তিন রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পাকিস্তানে ভারত-ভাগ মানে উদ্‌যাপনের আনন্দ, পৃথক জাতিসত্তা নির্মাণের আনন্দঘন স্বীকৃতি। স্বভাবতই, সেখানে সিংহভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠীর জীবনে সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার নিয়ে খুব বেশি তাপ-উত্তাপ নেই। এমনকি, সে দেশের আহমদিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠী (যারা মূলত উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে দেশভাগের সময় পাকিস্তান চলে যায় ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়)-র মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও সে দেশের তথাকথিত খানদানি আশরাফ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিশেষ কিছু এসে যায় না। কিন্তু ভারতে দেশভাগের সঙ্গে স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনুষঙ্গ থাকলেও সেখানে দেশভাগ মানে প্রকৃত অর্থেই দেশভাগ, নিজের মাতৃভূমি দু-টুকরো হয়ে যাওয়ার বেদনার্ত স্মৃতি। আর বাংলাদেশে দেশভাগ নিয়ে অত্যাশ্চর্য নীরবতা। সেখানে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ও তার পিঠে ভর করে ১৯৭১-এ বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বাংলাদেশ গড়ার গৌরব-গাথায় ১৯৪৭ যেন ঢাকা পড়ে গেছে। অথচ ১৯৫২-১৯৭১ কালপর্বে যে আত্মোপলব্ধি (জীবনে ধর্মের চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির স্থান অনেক উঁচুতে) হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে পূর্ব-বাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এসেছিল, তাকে যখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও নতুন করে সেই বস্তাপচা ধর্মীয় মৌলবাদই গিলে খায় (যা বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা), তখন কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যায়। আরও অবাক হতে হয় যখন দেখি, হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্নের সমাধির উপর দিয়ে ১৯৭১ থেকে আজ পর্যন্ত নতুন করে ক্রমাগত হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতের দিকে রওনা হয়।

আর তার প্রতিক্রিয়া ভয়ংকর অভিঘাত হেনে আছড়ে পড়ে ভারতের সংখ্যালঘু, বিশেষত বাংলাভাষী মুসলমানদের জীবনে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হয়েও ভারতের গর্বের ‘সেকুলার’ সত্তা তখন বিপন্নতায় ভোগে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও নতুন করে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সেকুলার’ শব্দটিকে বাদ দেওয়ার রাজনৈতিক তোড়জোড় চলে। বলা বাহুল্য, এই অপচেষ্টার নেপথ্যে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারকে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্য নিহিত। এভাবে গত ৭৫ বছর ধরে যেন নিউটনীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঘুর্ণাবর্তে পাক খেয়ে মরছে উপমহাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপযুক্ত মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা তথা সার্বিক ভবিতব্য। 

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি মুক্তিযোদ্ধা ধর্মনিরপেক্ষ নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা সত্ত্বেও ১৯৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের অসংখ্য সংখ্যালঘু মানুষকে সে দেশ থেকে ভারতে ঠেলে দেওয়াটা যে যুক্তিতে অমানবিক ও চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা, সেই একই যুক্তিতে কথায় কথায় ভারতের মুসলমানদের পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে চলে যেতে বলাটাও তাদের সঙ্গে একইরকম বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ, দেশভাগের সময় পাকিস্তান চলে না গিয়ে যে বিপুল সংখ্যক মুসলমান ভারতেই রয়ে গেল তারা ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচের উপর আস্থা রেখেই তা করেছিল। আজ হঠাৎ করে ভারতের বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নষ্ট করে একমাত্রিক ভারত নির্মাণের অপচেষ্টা আসলে পাকিস্তানের পাশে আর একটা ‘হিন্দু পাকিস্তান’ বানানো। আর এইসব ঘটনাক্রম দেখে মনে হয় দেশভাগোত্তর উপমহাদেশ নিজেই যেন এক ট্র‍্যাজিক চরিত্র, যার করুণ নিয়তি কোটি কোটি সংখ্যালঘু মানুষের প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন।

দুই

প্রশ্ন হল, মানবাধিকারের পরিসর কতটা? এক কথায় এর উত্তর হল— অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সহ পাঁচ মৌলিক অধিকার সহ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ভিন্নস্বরের সহাবস্থান নিয়ে সভ্য সমাজে মানুষের মতো বাঁচার অধিকারই মানবাধিকার। আর এগুলিকে যখন কোনও রাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক আদালত সংবিধানসংগত সিলমোহর দেয় তখন সেগুলি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে মান্যতা পায়। এ আলোচনার অভীষ্ট যদিও মূলত ভারত-ভাগ ও তার অভিঘাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যন্ত্রণাজর্জর ইতিবৃত্ত, তবু সেই অনুসঙ্গে স্বল্প পরিসরে হলেও দেখে নেওয়া দরকার দেশভাগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উপমহাদেশের বাইরের কিছু প্রাসঙ্গিক চিত্র। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির পর বেশ কিছু দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও সেই স্বাধীনতার সূত্রে তাদের অখণ্ড ভূমির ভাগ হয়ে যাওয়ার করুণ ও অনভিপ্রেত ইতিহাস। কারণ, সেই ইতিহাস যতই অপ্রিয় ও অনভিপ্রেত হোক, তাকে অস্বীকার করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মানুষের মানবাধিকার নিয়ে কোনও আলোচনাই সম্পূর্ণতা পেতে পারেনা। তাছাড়া, ভারত-ভাগের সঙ্গে উপমহাদেশের বাইরের দেশভাগের ইতিহাসের সাযুজ্য ও পার্থক্যের দিকটিও বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। 

সত্যি বলতে কী, দেশভাগ এ বিশ্বে বিরল কোনও ঘটনা নয়। উপমহাদেশের বাইরেও দেশভাগ হয়েছে। কিন্তু দেশভাগের প্রেক্ষিত ও তার অভিঘাত নানা দেশের ক্ষেত্রে নানা রকম। কোথাও মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে ধর্মকে অপব্যবহারের কদর্য রাজনীতি এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিদেশি শক্তির মদত ও কুচক্রী ভেদনীতি; কোথাও বা আর্থ-রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা, কোথাও প্রবল প্রতাপশালী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সদর্প উদ্‌যাপন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই জার্মানি ভাগ করার পরিণতি এ বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে। মানুষ শেষ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর, দুই জার্মানি এক হয়েছে আবার। ভাবতে অবাক লাগবে, আর্থ-রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা-ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের সঙ্গে মিত্রশক্তি হিসেবে কম্যুনিস্ট সোভিয়েত হাত মেলাতে দ্বিধা করেনি। আরও অবাক হতে হয় যখন অক্ষশক্তি (ফ্যাসিবাদী ইতালি ও নাৎসি জার্মানিকে ও তাদের দোসর জাপান)-কে পর্যুদস্ত করার পর সেই মিত্রশক্তিরই মনে হল অখণ্ড জার্মানিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়া যাক। তাতে জার্মানির সাধারণ মানুষের মানবাধিকার চুলোয় যাক। এমনকি সেই ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে মিত্রশক্তির মিত্রতাও কত ঠুনকো ও স্বার্থান্বেষী তাও প্রকাশ্যে চলে এল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই নতুন করে ভাগ হল জার্মানি। শুরু হল বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর ঠান্ডা লড়াই। ১৯৪৫-র পর থেকে জার্মানিকে কেন্দ্র করে আমেরিকা সহ পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে সোভিয়েতের ক্রমবর্ধমান শত্রুতা ক্লাইম্যাক্স দেখল ১৯৬১-তে। বার্লিনের পশ্চিম দিক বরাবর সোভিয়েত তুলে দিল ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বার্লিন প্রাচীর। একদিকে উঠল দেওয়াল, অন্যদিকে ধ্বসে পড়ল তথাকথিত মিত্রশক্তির অন্তঃসারশূন্য মিত্রতা। ভূলুণ্ঠিত হল জার্মানির লক্ষ লক্ষ মানুষের মানবাধিকার।

ঘটনার প্রেক্ষিতটা কেমন? কেমনই বা তার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি? ১৯৪৮-এর ২৪ জুলাই সোভিয়েত বার্লিন অবরোধ করলে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ অনাহার ও বিনা চিকিৎসার মুখোমুখি হল। দীর্ঘ ১১ মাস আমেরিকার তরফে আকাশপথে জোগান দেওয়া খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপর ভরসা করে বার্লিনের লক্ষ লক্ষ মানুষ কোনও রকমে বেঁচে থাকার লড়াইকে নিত্য সঙ্গী করল। সোভিয়েত-আগ্রাসনের জবাবে আমেরিকা সহ পশ্চিমি শক্তির দখলে থাকা জার্মানির অংশ নিয়ে তৈরি হল ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মান (FGR) বা পশ্চিম জার্মানি (২১ মে, ১৯৪৯)। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও তার করায়ত্ত অংশে অর্থাৎ পূর্ব জার্মানিতে পাঁচ মাস পরেই অক্টোবরে গঠন করল জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (GDR)। আর এই দেশভাগের ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে গেল লক্ষ লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক ছন্দ। ভারতীয় উপমহাদেশের মতো অবশ্য এক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচিতি বিশেষ ভূমিকা নেয়নি, আর্থ-রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতাই এখানে মুখ্য ভূমিকা নিল।

খুব স্বাভাবিকভাবেই অখণ্ড জার্মানির এই ভাগ হয়ে যাওয়াকে মানতে পারেনি জার্মানির সাধারণ মানুষ। ধূমায়িত ক্ষোভ অবশেষে গণরোষের আকার নিল ১৯৮৯-এ। পথে নামল পূর্ব জার্মানির হাজার হাজার মানুষ। ১৯৮৯-এর ৯ নভেম্বর ভেঙে দেওয়া হল ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর। আবার এক হল জার্মানি (৩ অক্টোবর, ১৯৯০)। আর এই ঘটনার আন্তর্জাতিক অভিঘাত গিয়ে পড়ল সোভিয়েতের অন্দরে। অভ্যন্তরীণ অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে এই ঘটনার আন্তর্জাতিক অভিঘাত এবং সেইসঙ্গে আমেরিকা সহ পুঁজিবাদী পশ্চিমি বিশ্বের মদত— ইত্যাদি নানা কারণে ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন(১৯৯১)। জন্ম নিল রাশিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, লাতভিয়া, লিথুনিয়া, এস্তোনিয়া, মলডোভা, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, কির্গিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান সহ ১৫টি দেশ। বলা বাহুল্য, ১৯৯১-এর পর থেকে এইসব দেশগুলির আর্থ-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গেছে। তৈরি হয়েছে ভিন্নতর সমস্যা। চেচনিয়া আজও রাশিয়া সহ অন্যান্য অনেক দেশের কাছে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। জন্ম নিয়েছে চেচেন বিদ্রোহ। ১৯৯৪-৯৬-এ প্রথম চেচেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ১৯৯৯-২০০৯ দ্বিতীয় চেচেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং তাতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের জড়িয়ে পড়া, সবই এ বিশ্ব দেখছে অবাক হয়ে। আর যুদ্ধ যে সব সময় নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না, বিশেষত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে, তা ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বারে বারে। এইসব যুদ্ধেও পৃথিবী অবাক চোখে তা দেখছে। প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার শরণার্থী আকাশছোঁয়া বিপন্নতা নিয়ে পার্শ্ববর্তী পোল্যান্ড, জর্জিয়া সহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। 

প্রশ্ন হল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে জন্ম নিল যে দেশগুলি তারা কেমন আছে? কেমন চিত্র দেশগুলির মানুষের মানবাধিকারের? স্ট্যালিনীয় নির্যাতনের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে গ্লাসনস্ত পেরেস্ত্রোইকার তথাকথিত খোলা হাওয়ায় ভর করে যে কোটি কোটি মানুষ মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক পরিসরের স্বপ্ন দেখেছিল তারা কি পেয়েছে মানবাধিকার নিয়ে বাঁচার উন্মুক্ত উঠোন? সত্যি বলতে কী, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি (লিথুনিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, মালডোভা) তা অনেকটাই প্রতিষ্ঠা করতে সফল হলেও মধ্য-এশিয়ার দেশগুলি (জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কির্গিস্তান, তাজিকিস্তান) তার কিছুই পারেনি। অপরদিকে যে জার্মানির সাধারণ মানুষ (বিশেষত পূর্ব জার্মানির) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছিল, জার্মানির একত্রীকরণের পর তারা বিশ্বে মানবাধিকার সুরক্ষায় এখন প্রথম সারিতে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত The German Institute for Human Rights (GIHR) জার্মানির মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষার ব্যপারে ঈর্ষণীয় ধারাবাহিকতায় সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছে। লিথুনিয়া মানবাধিকার সুরক্ষায় বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম অগ্রগণ্য দেশ। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট (Freedom House 2019) বলছে লিথুনিয়া মানবাধিকার সুরক্ষায় ৯১% নম্বর নিয়ে ১৮০ টি দেশের মধ্যে ৩০ তম স্থানে প্রোজ্জ্বল। লাতভিয়া (২০১০-এর সমীক্ষায় Press Freedom Index-এ) ১৭৮ টি দেশের মধ্যে ৩০ তম স্থানে আর Human Development Index (2008)- অনুযায়ী দেশটি ১৭৯ টি দেশের মধ্যে ৪৪ তম স্থানে। তুলনায় এস্তোনিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি বেশ খারাপ। জর্জিয়ার মানুষের মানবাধিকার অপেক্ষাকৃত বেশি সুরক্ষিত হলেও আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কির্গিস্তান ও তাজাকিস্তানের হাল অতীব উদ্‌বেগের। ভিন্নস্বরের কন্ঠরোধের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ১৯৯১-এ এরা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বেরিয়ে এসে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল যে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থে, সেই ব্যক্তিস্বাধীনতা এইসব দেশে প্রায় নেই বললেই চলে। তুর্কমেনিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহতা নিয়ে Reporters Without Boarders'(2006) বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ প্রথম তিনটি দেশের একটি হল এই দেশ। উত্তর কোরিয়া ও মায়ানমারের মতো এই দেশে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের উপর চূড়ান্ত কড়াকড়ি। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমও এখানে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারে না। কির্গিস্তানে নারীর অধিকার এতটাই পদদলিত যে ৬৯.৯% নারী বিশ্বাস করে যে বিবাহিত নারীর স্বামীর হাতে প্রহৃত হওয়ার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। উন্নতি বলতে, এইসব দেশগুলোর কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ডকে তুলে দিয়েছে। আর রাশিয়ার অবস্থা তো কমবেশি সবার জানা। দীর্ঘ দু’দশকের বেশি সেখানে প্রেসিডেন্ট থাকার সুবাদে ইতিমধ্যেই একনায়কতন্ত্র কায়েম করে ফেলেছেন পুতিন। স্বাধীন মতপ্রকাশ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ভিন্নস্বরের সহাবস্থান— যা ছিল গ্লাসনস্ত পেরেস্ত্রোইকার তথাকথিত খোলা হাওয়ার কাঙ্ক্ষিত, তা আজ শুধুই স্বপ্ন। রাষ্ট্রশক্তিকে কুক্ষিগত করে ইচ্ছে মতো সাংবাদিক আটক, রাষ্ট্রের অমানবিক সিদ্ধান্ত-বিরোধী স্বাধীনচেতা নাগরিককে আটক করে পুলিশি লকআপে নির্যাতন, সরকার-বিরোধী জমায়েত নিষিদ্ধকরণ সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে আজকের রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বিশেষ তফাত নেই। সম্প্রতি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষের জমায়েত ও মিছিল থেকে গত এক বছরেই প্রায় ২০,০০০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

দেশভাগ ও মানবাধিকার নিয়ে যেকোনও আলোচনায় সোভিয়েত ভেঙে তৈরি হওয়া রাষ্ট্রগুলির মতোই অনিবার্যভাবে আসে ইউরোপের বলকান সংকট থেকে উদ্ভূত সাবেক ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া (যার অধীনে ছিল সার্বিয়া, বসনিয়া হারজেগোভিনা, ম্যাসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, মন্টেনিগ্রো) ভেঙে তৈরি দেশগুলির প্রসঙ্গ। পরিসরের স্বল্পতার জন্য এখানে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। তবে যেটুকু না বললেই নয় তা হল, গত শতাব্দীর আটের দশকের পর থেকে সাবেক যুগোস্লাভিয়া জুড়ে নানান সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও জনজাতির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অর্ন্তকলহ ও গৃহযুদ্ধ এমন স্তরে পৌঁছোয় যে সোশ্যালিস্ট ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া (SFRY) ভেঙে যায়। এবং ২০০৩-২০০৬ পর্যন্ত মূলত সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো নিজেদেরকে সাবেক ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়ার আসল উত্তসূরি হিসেবে দাবি করতে থাকে। কিন্তু দেশভাগের এখানেই ইতি পড়ল না। ২০০৮-এ সার্বিয়া আবার ভেঙে তৈরি হল কসভো, যাকে জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশগুলির মধ্যে ১০২ টি দেশ স্বীকৃতি দিলেও সার্বিয়া স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি, ভারতও কসোভোর সার্বভৌমত্বকে মান্যতা দেয়নি। আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বলতেই হয়, যেকোনও দেশভাগের মতোই দেশভাগের কালপর্ব জুড়ে তো বটেই, সেইসঙ্গে পরবর্তী সময়েও গৃহহীন মানুষের বিপন্নতা গভীর উদ্‌বেগের। তফাত একটাই বলকান অঞ্চলের এই দেশগুলি তাদের দেশভাগজনিত সমস্যাগুলি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ এই দেশগুলিতে মানুষের শিক্ষার হার ও মাথাপিছু আয় বেশ উঁচুর দিকে।

১৯৪৮-এ জাপানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দুই কোরিয়া আজও আলাদা থাকলেও তাদের সম্পর্কের মধ্যে অবশ্য ভারত-পাকিস্তানের মতো নিরবচ্ছিন্ন টেনশন নেই। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে উত্তর কোরিয়ার জুড়ি মেলা ভার। জাতিপুঞ্জের তরফে ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছর উত্তর কোরিয়ার মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে লাগাতার উদ্‌বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও পরিস্থিতি যে তিমিরে সেই তিমিরেই। মূলত যে বিষয়গুলি এই উদ্‌বেগের কারণ তা হল: বাক্‌স্বাধীনতা ও ভিন্নস্বরের কন্ঠরোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে আকছার মৃত্যুদণ্ড, জোরপূর্বক যখন তখন বিনা বিচারে আটক করার স্বেচ্ছাচার, গণআন্দোলন ও গণ-অবস্থানে নিষেধাজ্ঞা, ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা, নারীকে বলপূর্বক গর্ভপাত করতে বাধ্য করা ইত্যাদি। তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থা অনেকটাই ভালো। সেখানে মানুষের মানবাধিকার অনেক বেশি সুরক্ষিত এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে মোটের উপর একটা গণতান্ত্রিক পরিসর রয়েছে।

প্রশ্ন হল, বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যে দেশগুলিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ভাগ করা হল, সেগুলি ভাগ হওয়ার পরেও কি নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় এড়াতে পেরেছে? ইতিহাস বলছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংঘাত বেড়েছে বই-কমেনি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাইরের শক্তির নাক গলানো, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আর সেই জটিলতর আবর্তে মাথা কুটে মরছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মানবাধিকারের প্রশ্নটি। একাধিক ভারত-পাক যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়া এবং গত ৭৫ বছর ধরে ভারত-পাক সীমান্ত সমস্যা ও কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কদর্য নজির, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘর্ষ ও দু’দেশের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন, ১৯৫০-৫৩-তে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধ, বলকান সংকট ও তা থেকে উদ্ভূত গৃহযুদ্ধ, কোভিড যেতে না যেতেই ইউক্রেন-রাশিয়ার বর্ষব্যাপী যুদ্ধ, ১৯৯০-এ নতুন করে এক হবার পরেও ২০১৫ থেকে চলতে থাকা হুথি বিদ্রোহী ও সরকার পক্ষের মধ্যে গৃহযুদ্ধ (যা নিয়ে পরে বিস্তারিত বলেছি), সর্বোপরি অতি সম্প্রতি ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ — তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। অবশ্য ১৯৫০-৫৩-র যুদ্ধ এবং মাঝে মাঝে ছোটোখাটো কিছু সমস্যা বাদ দিলে দুই কোরিয়া এ শতাব্দীর শুরু থেকেই সম্মিলিতভাবে নানান ক্ষেত্রে (অলিম্পিকের উদ্বোধনে একত্রে মার্চপাস্ট, ২০১৮-র এশিয়ান গেমসে একত্রে ‘কোরিয়া’ নাম নিয়ে বেশ কিছু খেলায় অংশ নেওয়া, পারস্পরিক সামরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা ইত্যাদি) যৌথভাবে অংশ নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের নজির রাখছে। বিশেষত একুশ শতকের শুরুর দিক (২০০৭) থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘sunshine policy’ দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এক অনন্য ইতিবাচক নজির। ২০১৮ সালে দু’দেশের প্রেসিডেন্ট কিম ও মুন স্বাক্ষর করেছেন ঐতিহাসিক পিয়ংইয়ং চুক্তি, যার পর থেকে দু’দেশের সীমান্ত বরাবর অনেক বিধিনিষেধ (যেমন— ল্যান্ডমাইন, গার্ড পোস্ট ইত্যাদি) তুলে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে অস্ত্র সংবরণ ও বাফার জোন ব্যবহার শুরু হয়েছে। একটি সমীক্ষা বলছে, দু’দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ (৪৬ শতাংশ) দু-টি দেশ নতুন করে মিশে যাওয়ার পক্ষে। আসলে দুই জার্মানির এক হয়ে যাওয়া কিংবা দুই কোরিয়ার অদূর ভবিষ্যতে এক হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে ভারত-পাকিস্তানের বিষয়টির একটা মূলগত পার্থক্য আছে। সেটি হল, ভারত ভাগ হয়েছে মূলত ধর্মের ভিত্তিতে, কিন্তু দুই কোরিয়া ভাগ হয়েছে আর্থ-রাজনৈতিক কারণে। আর ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছে বলেই উপমহাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা নিয়ে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্‌বাস্তু হয়ে গেছে, যা কোরিয়ার ক্ষেত্রে ঘটেনি। তুলনায় ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সঙ্গে ভারত-ভাগের বিষয়টির বেশ সাদৃশ্য আছে, কারণ দু-টি ক্ষেত্রেই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে ধর্মকে অপব্যবহারের কদর্য রাজনীতি তথা পশ্চিমি বিশ্বের ভেদনীতি।

তিন

ভাবতে অবাক লাগবে, ১৯৪৮-এর (১৪ মে) আগে পর্যন্ত ইজরায়েল নামে কোনও রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। অথচ প্যালেস্তাইন (ভূতপূর্ব কেনান)-কে দ্বিখণ্ডিত করে সমগ্র ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশ অর্থাৎ সিংহভাগ (বর্তমানে চরমপন্থী হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা এবং নরমপন্থী পি এল ও-নিয়ন্ত্রিত ওয়েস্ট ব্যাংক বাদে) নিয়ে পশ্চিমি শক্তির প্রত্যক্ষ মদতে মূলত জায়নিস্ট ইহুদিদের নিয়ে অনৈতিকভাবে তৈরি হল ইজরায়েল।

অনৈতিক কেন? বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে ইহুদিদের জনসংখ্যা ছিল অতি নগন্য, ঐ এলাকার মোট জনসংখ্যার মাত্র তিন থেকে চার শতাংশের কাছাকাছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধন-যজ্ঞের পর বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের নিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম ইজরায়েলের জন্ম দিতে উঠে পড়ে লাগল পশ্চিমি দুনিয়া। অবশ্য তার অনেক আগেই উনিশ শতকের শেষ দশকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি সাংবাদিক থিয়োডর হের্জল স্বপ্ন দেখান জায়নিজমকে হাতিয়ার করে এক ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের। মনে রাখতে হবে, জায়নিজম হল ইহুদি ধর্মকে ব্যবহার করা এক রাজনৈতিক মতাদর্শ, যার সঙ্গে ইহুদি ধর্ম গ্রন্থ ‘তাওরাত’ (বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট)-আশ্রিত জুডাইজম বা প্রকৃত ইহুদি ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। এমনকি, জায়নিস্ট হতে গেলে ইহুদি হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। অসংখ্য জায়নিস্ট আছে যারা খ্রিস্টান। আবার হাজার হাজার জায়নিস্ট আছে যারা ইহুদি ধর্ম তো দূরের কথা, কোনও ধর্মকেই ব্যক্তিগত জীবনে অনুসরণ করে না। স্বাধীন ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গ্যুরিয়ন নিজেই ছিলেন এই প্রকার নাস্তিক জায়নিস্ট। এ যেন অনেকটা স্বাধীন পাকিস্তানের কারিগর জিন্নার মতো, যিনি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে ইসলামকে ব্যবহার করলেও নিজের প্রাত্যহিক জীবনে ইসলামি যাপনরীতির ধারেকাছেও ছিলেন না। যাইহোক, প্রথমে উগান্ডা কিংবা আর্জেন্টিনাকে বাছাই করার কথা ভাবা হলেও পরে জেরুজালেমের পবিত্র ভূমির সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমি দুনিয়ার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পাখির চোখ করা হল প্যালেস্তাইনকে। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে প্যালেস্তাইনের সিংহভাগ নিয়ে অনৈতিক ভাবে তৈরি করা হল স্বাধীন সার্বভৌম ইজরায়েল রাষ্ট্র। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিদের জন্য তাদেরই স্ব-ভূমে পড়ে রইল গাজা আর ওয়েস্টব্যাংকের মতো দু’খণ্ড জমি, যা আসলে উন্মুক্ত কারাগারের নামান্তর। সেখানে রীতিমতো দমবন্ধ পরিবেশে ঠাসাঠাসি করে থাকতে বাধ্য হল ফিলিস্তিনিরা। তার পরেও থামলো না সাত পুরুষের ভিটেমাটি ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উগ্র জায়নিস্ট আগ্রাসন। ফিলিস্তিনিদের জীবনে এ এক অভূতপূর্ব বিপর্যয়, স্থানীয় পরিভাষায় যার নাম ‘নাকবা’। ইতিপূর্বেই অবশ্য জায়ানিস্ট ইহুদিদের আগ্রাসন চরিতার্থ করতে পশ্চিমি শক্তির মদতে তৈরি হয়ে গেছে ‘হাগানা’ নামক জঙ্গি গোষ্ঠী। ভাবতে অবাক লাগবে, আজ যারা হামাসকে জঙ্গি গোষ্ঠী বলে শায়েস্তা করতে চাইছে তারা যেমন নিজেদের স্বার্থে হামাসের শক্তি বৃদ্ধিতে প্রভূত অর্থ ঢেলেছিল, তেমনি প্রায় শত বছর আগেই ইহুদি আগ্রাসন চরিতার্থ করতে তৈরি কেরেছিল ‘হাগানা’। আর ‘হাগানা’কে হাতিয়ার করে জোরপূর্বক ইহুদি সেটলমেন্টকে তারা নাম দিয়েছিল ‘মাহাজ’। পশ্চিম এশিয়ায়, বিশেষত প্যালেস্তাইনে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের আলোচনায় তাই হামাসের প্রসঙ্গ আনার আগে ‘হাগানা’, ‘মাহাজ’ এবং ‘নাকবা’র প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে এসে যায়। বিশেষ করে সম্প্রতি যখন ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার একটা বিরাট অংশ এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে যে এই সমস্যার সূত্রপাত যেন হামাসের সাম্প্রতিকতম ইজরায়েল আক্রমণ থেকেই, তখন ‘হাগানা’, ‘মাহাজ’ ও ‘নাকবা’-র প্রসঙ্গ টানা অত্যন্ত জরুরি। 

তার মানে কি এই যে হামাস সম্প্রতি ইজরায়েলের সাধারণ নাগরিকদের উপর আক্রমণ করে যে ১৪০০ নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়েছে তা নৈতিক তথা মানবিক বৈধতা পেয়ে যায়? বলা বাহুল্য, এই আক্রমণ বর্বরোচিত ও অত্যন্ত ঘৃণ্য, যার নিন্দার কোনও ভাষা নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ এক কদর্য নজির, যার বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ আবশ্যক। কিন্তু ইতিহাসের প্রেক্ষিত যে একদিনে তৈরি হয় না সেটাও বিশ্ববিবেককে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে ‘হাগানা’, ‘নাকবা’, ‘মাহাজ’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ আকাশ থেকে পড়েনি। তা না হলে শতাব্দী-ব্যাপী এই দ্বন্দ্বের দীর্ঘমেয়াদি ও মানবিক কোনও সমাধান অধরাই থেকে যাবে। এ কথা ঠিক, আজ যদি হামাসের মতো গোঁয়ার্তুমি নিয়ে কেউ বলে যে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইজরায়েলিদের প্যালেস্তাইন থেকে উৎখ্যত করে প্যালেস্তাইনকে শুধু আরবদের জন্য মুক্ত করা হবে, তাহলে তা শুধু ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে অস্বীকারই হবে না, একই সঙ্গে তা হবে হাস্যকর ও অমানবিক। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে তা হবে প্রায় এক কোটি ইজরায়েলি নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নবতর নজির। মনে রাখতে হবে ইজরায়েলি, প্যালেস্তাইনি নির্বিশেষে সবাই আসলে মানুষ, আর মানবাধিকার নিয়ে বাঁচার অধিকার সকলের।

তাই উভয় পক্ষের মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় নীতি কিংবা যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভিত্তি করে ইউনাইটেড স্টেটস অব প্যালেস্তাইন এণ্ড ইজরায়েল নামক কোনও কসমোপলিটান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন আশু প্রয়োজন। আর ইজরায়েল যেহেতু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি ও অর্থনীতি— সব দিক থেকেই পৃথিবীর এক অগ্রগণ্য শক্তি এবং পশ্চিমি বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট, তাই বিদ্বেষবিহীন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক এই রাষ্ট্র গঠনের মহতী প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ইজরায়েল ও পশ্চিমি দুনিয়ার সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে হামাস তথা প্যালেস্তাইনবাসীকেও বুঝতে হবে অটোমান শাসনের সময়ে ইহুদিদের সংখ্যা এই ভূখণ্ডে যতই নগন্য হোক, জেরুজালেমের পবিত্র ভূমি তিন আব্রাহামিক ধর্মমতের অনুসারীদের কাছেই সমান পবিত্র। তাছাড়া পবিত্র কোরানের অসংখ্য আয়াতে বনি ইজরায়েলের উল্লেখ রয়েছে, যাদের আদি আবাস এই অঞ্চল। তাই জায়নিস্ট ইহুদিদের তরফে রাজনৈতিক আগ্রাসন চরিতার্থ করার দিকটি যেমন ঐতিহাসিকভাবে কদর্য সত্য, তেমনি রাজনীতির মারপ্যাঁচের দিকটি না বুঝে যে মুসলিম মানস এই শতাব্দীব্যাপী দ্বন্দ্বকে ইহুদি আর মুসলমানের লড়াই ভাবছে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। তাছাড়া, তারা পবিত্র কোরানের বনি ইজরায়েল-কেন্দ্রিক আয়াতগুলিই বা ভুলে যায় কীভাবে? 

দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব হল, হামাস-পন্থী ফিলিস্তিনি মানস যেমন অতি রক্ষণশীল ও ইজরায়েল-বিরোধী, তেমনি অন্যায়ভাবে হাজার বছরের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করার পরেও দিনের পর দিন ইজরায়েল যেভাবে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনকে বছরের পর বছর দুর্বিষহ করে রেখেছে তা নিয়ে বিশ্ব-বিবেকের (বিশেষত তথাকথিত উন্নত বিশ্বের) খুব বেশি এসে যায় বলে মনে হয় না। যদি এসে যেত তাহলে ফিলিস্তিনিরা এতদিনে নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও মানবাধিকার নিয়ে মানুষের মতো জীবন যাপনের পরিসর পেত। তা তারা পায়নি শুধু নয়, ১৯৯৩-এ অসলো চুক্তি অনুযায়ী ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইতঝাক রবিন ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসের আরাফাতের সঙ্গে এ নিয়ে একটা সমাধানে (দ্বি-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে) পৌঁছাতে চাইলে উগ্র জায়ানিস্ট (যা জুডাইজম বা ইহুদি ধর্ম-গ্রন্থ তাওরাত-আশ্রিত ইহুদিবাদের সঙ্গে মেলেনা) ইজরায়েলির হাতে নিহত হন। শুধু তাই নয়, অনেকটা অখণ্ড ভারতের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যেভাবে ব্রিটিশ ভেদনীতি (divide and rule) প্রয়োগ করেছিল, সেই একই ভেদনীতিকে হাতিয়ার করে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংহতি নষ্ট করতে (যাতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠন করতে না পারে) ইজরায়েল আরাফতের প্যালেস্তাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন বা পি এল ও-বিরোধী হামাসকে মদত দিতে উঠে পড়ে লাগে। এ যেন অনেকটা সাবেক সোভিয়েতকে শায়েস্তা করতে আমেরিকার হাতে তৈরি আফগান মুজাহিদিন তৈরির মডেল। ভাবতে অবাক লাগবে আজ যে হামাসকে (গাজার মানুষের ভোটে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও) ইজরায়েল ও পশ্চিমি বিশ্বের সঙ্গে অনেক রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলছে তা একদা ইজরায়েলেরই হাতে তৈরি। আরও অবাক লাগবে ভেবে ওয়েষ্ট ব্যাংকের পি এল ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েলকে স্বীকার করলেও ইজরায়েলের প্রত্যক্ষ মদতে তৈরি হামাস তা মেনে নিতে রাজি নয়। হামাস-নিধনের নামে ইজরায়েলের তরফে গাজার সাধারণ নিরীহ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি লন্ডনে হাজার হাজার ইহুদি সহ যে লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে মিছিল করছে তাতে যোগ দেওয়া ছিয়াত্তর বছরের আব্বাস (যিনি এক সময় পি.এল.ও-র হয়ে যুদ্ধ করেছেন) বলছেন: “ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গত তিরিশ বছরে আপোসকামী এবং জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় হামাসের এই উত্থান। আটের দশকে ইজরায়েলের মদতে হামাস তৈরি। আজ সে স্রষ্টাকে দংশন করছে।”

হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা ভূখণ্ডের মানুষের মানবাধিকারের বাস্তব চিত্র মর্মান্তিক বললেও কম বলা হবে। অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসা ইজরায়েলিদের অত্যাচারে আজ তারা হাজার হাজার বছরের ভিটেমাটি ছেড়ে ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে অবরুদ্ধ। তাদের নারকীয় জীবন আজ সহনসীমার মাত্রা ছাড়িয়েছে। এরই প্রত্যুত্তরে মাঝে মাঝেই হামাসের আক্রমণ ও তার জবাবে ইজরায়েলের সামরিক অভিযান। আর তার ফলশ্রুতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন পশ্চিম এশিয়ার প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। সম্প্রতি তা পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়ানোয় সারা বিশ্ব তোলপাড়। হামাস জঙ্গি সংগঠন না কি স্বাধীনতাকামী সংগঠন সেই কূটতর্কের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলি ফিলিস্তিনি নির্বিশেষে হাজার হাজার সাধারণ নিরীহ মানুষের মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার প্রশ্নটি। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই হামাস জঙ্গি সংগঠন, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে ওয়েস্টব্যাংকের ফিলিস্তিনিদের হাল কি খুব সন্তোষজনক? সেখানে কেন আজও জায়নিস্ট আগ্রাসন অব্যাহত? সেখানে তো হামাস নেই। কেনই বা জাতিপুঞ্জের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ তথা বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে মুসলমানদের হটিয়ে ইজরায়েলের অন্যায় আগ্রাসন? সেখানেও তো হামাস নেই! ওয়েস্ট ব্যাংকে তো দ্বি-রাষ্ট্র নীতিকে মান্যতা দিতে প্রস্তুত নরমপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পি এল ও। সে সব সময় চায় ইজরায়েলের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু ইতিহাস বলছে, জায়নিস্ট ইহুদি আগ্রাসন পি এল ও-র বিরুদ্ধে হামাসকে লেলিয়ে দেওয়ার কদর্য রাজনীতি করে এসেছে। ইতিহাসের চরম পরিহাস, আজ হামাস ইজরায়েলের গলার কাঁটা তথা এ শতাব্দীর নবতর ফ্র‍্যাংকেনস্টাইন। আর এই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে মান্যতা দিয়ে ইজরায়েল তো বটেই, এমনকি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ধর্মপ্রাণ ইহুদি (যারা জুডাইজমে বিশ্বাসী, কিন্তু জায়ানিজমে নয়) ফিলিস্তিনিদের প্রতি জায়ানিস্ট ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব। সম্প্রতি লন্ডনে প্যালেস্তাইনের মুক্তির জন্য মিছিলে হাঁটা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে দেখা গেছে হাজার হাজার ইহুদিকে। যেমন পেশায় চিকিৎসক বিরাশি বছরের ইহুদি এস্থার (যার মা বাবা দু’জনেই হিটলারের জমানায় মিউনিখের কাছে ডাখাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন) বলছেন: “এই নির্বিচার গণহত্যার দায় ইজরায়েলের জায়নবাদী শাসকের। দায় দখলদারির রাজনীতির। আমার মতো অসংখ্য ইহুদি মনেপ্রাণে এই গণহত্যাকে ঘৃণা করি।” 

সভ্যতার দুর্ভাগ্য তথা ইতিহাসের পরিহাস, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন ইহুদিরা ইজরায়েলের এই জায়নিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও এই গ্রহেরই লক্ষ লক্ষ মানুষ (যারা ইহুদি নয়) ইতিহাসের প্রেক্ষিত না জেনে শুধু মুসলিম-বিদ্বেষ তথা ইসলামোফোবিয়া থেকে ইজরায়েলকে সমর্থন করছে। উলটো দিকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান সেই একই রকম বিদ্বেষ ও বৈরিতা-তাড়িত গোঁড়ামি থেকে প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে—ইহুদি ও খ্রিস্টান মাত্রই ইসলামের শত্রু, আর আরব বিশ্ব মানেই ইসলামের রক্ষক। তারা কি ভেবে দেখেছে আরব লিগ তথা মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির প্রকৃত অবস্থান কী? 

ইজরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ১৯৪৮-এর পর থেকে আরব লিগের যে দেশগুলি মাঝে মাঝেই কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে, এমনকি ইজরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছে, তারা কি সত্যি সত্যিই ফিলিস্তিনিদের স্ব-ভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি তথা মানবাধিকার নিয়ে ভাবে? ইতিহাস কী বলছে? ইজরায়েলি আগ্রাসন থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করতে গিয়ে মিশর নিজেই তো দখল করে নিয়েছিল গাজা, আর জর্ডন দখল করেছিল ওয়েস্ট ব্যাংক, যা পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে পুনরায় দখল করে নেয় ইজরায়েল। আর এই দখলদারিত্বের পাঁকে তলিয়ে গেছে অসহায় ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার। ভূতপূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করতে গিয়ে ভারত যদি বাংলাদেশকেই গিলে নিত তাহলে তা কি খুব মানবিক হত? রক্ষক হতে গিয়ে ভক্ষক হয়ে যাওয়া মিশর ও জর্ডনের বর্তমান ইজরায়েল-বিরোধী অবস্থান তাই কুমিরের কান্নাই মনে হয়।

আর সৌদি আরব? তার ভূমিকা বুঝতে গেলে ইতিহাসের আলপথ বেয়ে আর একটু পিছিয়ে যেতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অটোমান শাসনের অধীনে যে ফিলিস্তিনিরা ছিল আরব দুনিয়ার এক সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী, তাদের অবস্থা গত এক শতাব্দী ধরে ক্রমাগত আরও খারাপ হওয়ার পেছনে সৌদি আরবের পরোক্ষ ভূমিকা অস্বীকার করবে কে? অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে পশ্চিমি বিশ্বকে আরব দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা সহায়ক রাষ্ট্র তো সৌদি আরব। আর সেই সৌদি আরব যদি আজ নতুন করে ইজরায়েল তথা পশ্চিমি শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে তাহলে তা হাস্যকর নয় কি? তাছাড়া, মাঝে মাঝেই আরব লিগের দেশগুলি যে মুসলিম ব্রাদারহুডের জিগির তোলে তা যে আসলে সোনার পাথরবাটি তা তাদের নিজেদের মধ্যের চূড়ান্ত অনৈক্য ও লাগাতার বৈরিতা দেখলেই বোঝা যায় (যা নিয়ে ‘জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি রাষ্ট্র ভাবনা: তত্ত্ব তথ্য সত্য’ শিরোনামে বিস্তারিত লিখেছি পুনশ্চ প্রকাশিত অভিক্ষেপ পত্রিকার ‘জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে)। ইজরায়েল যত সাধারণ ফিলিস্তিনির প্রাণ নিয়েছে তার চেয়ে সৌদি আরব আরও বেশি সংখ্যক ইয়েমেনি শিশু, নারী ও অসহায় বৃদ্ধদের উপর অমানুষিক আক্রমণ করেছে।

কোন ইয়েমেন? যে ইয়েমেন আরব-বিশ্বের প্রথম রিপাবলিক। যে ইয়েমেন বহু ঘাত-প্রতিঘাত, বহু গৃহযুদ্ধ পেরিয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে তার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে নিয়ে এক হয়েছিল ১৯৯০ সালে। দীর্ঘ প্রায় ২৫০ বছর বছর ধরে উসমানিয়া খিলাফতের অধীনে অখণ্ড থাকলেও ১৮৩৯-এ এডেন উপত্যকা তথা দক্ষিণ ইয়েমেনের এক বিস্তৃত অঞ্চল ব্রিটিশের অধীনে চলে যাওয়া, আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর ইয়েমেন এবং দক্ষিণ ইয়েমেন ভাগ হয়ে যাওয়া, ১৯৬৭-তে ব্রিটিশের অধীনতা থেকে দক্ষিণ ইয়েমেনের স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং অবশেষে ১৯৯০-এ আবার দুই ইয়েমেন এক হওয়ার ইতিহাস কি মানুষ ভুলে গেছে? ২০১৫ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধে দীর্ণ ইয়েমেন, যার নেপথ্যে মধ্য প্রাচ্যেরই দুই চির-প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র সৌদি আরব আর ইরানের ছায়া যুদ্ধ (proxy war)। আর সে ছায়া যুদ্ধে দু’পক্ষের দোসরেরও অভাব নেই। সৌদির পক্ষে সুদান, মরোক্কো, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি সহ সাতটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ, আর ইরানের পক্ষে লেবাননের হিজবুল্লা, সিরিয়া, উত্তর  কোরিয়া। কেন এই ছায়া যুদ্ধ? ইয়েমেনের রাজধানী সানাকে কেন্দ্রে রেখে দেশটির এক বিস্তৃত অংশ দখল করে রাখে হুতি বিদ্রোহীরা। জায়েদি শিয়া গোষ্ঠীর এই হুতিদের সাহায্যে এগিয়ে এল শিয়াপন্থী ইরান, আর তাদের বিপক্ষে চলে গেল সৌদি আরব, ঠিক যেমন সে বিপক্ষে গিয়েছিল ১৯৬২-তে মিশরের গামাল আবদাল নাসেরের সাহায্যে যখন রাজতন্ত্রের পতনে উত্তর ইয়েমেন নিয়ে তৈরি হয়েছিল আরব রিপাবলিক অব ইয়েমেন। মনে রাখা দরকার ঠিক তার পাঁচ বছর পরেই (১৯৬৭) দক্ষিণ ইয়েমেনও কম্যুনিস্ট প্রভাবিত হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা পায় ব্রিটিশের অধীন থেকে, অথচ ১৯৯০-এ এসে আবার মিশে যায় উত্তর ইয়েমেনের সঙ্গে।  

মজার কথা এটাই, শিয়া-সুন্নির চিরায়ত দ্বন্দ্বের মধ্যেই আবার ইরান ও তার মদতপুষ্ট লেবাননের হিজবুল্লার সঙ্গে একসুরে মায়াকান্না কাঁদে সৌদি আরব, যখন ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের গাজা আক্রমণ করে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘকালব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধে এই সুন্নি-অধ্যুষিত সৌদি আরব শিয়া-অধ্যুষিত ইরানের বিরুদ্ধে থাকে। আর মাথা কুটে মরে মানবাধিকার। আসলে শিয়া-সুন্নির বিরোধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ঘূর্ণাবর্তে পাক খাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে অপরিশোধিত তেল ও তার আমদানি-রপ্তানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালী (ইয়েমেনের উপকূলে), সুয়েজ খাল (প্যালেস্তাইন ও মিশরের নিকটবর্তী), সহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখাও পশ্চিমি বিশ্বের মতোই তাদের পাখির চোখ। আজ যে সৌদি আরব এবং ইরান ও তার মদতপুষ্ট লেবাননের হিজবুল্লা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে, ইয়েমেনে তাদেরই প্রক্সি যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত রকম উদাহরণ হাজির। Human Rights Watch-এর রিপোর্ট বলছে— লক্ষ লক্ষ শিশু, বৃদ্ধ, নারী সহ শুধু নিরপরাধ মানুষ হত্যাই নয়, ইয়েমেনে এই যুদ্ধে হাজার হাজার নাবালককে (১৭ বছরের নীচে) যুদ্ধে নামানোর অমানবিক নজির রেখেছে যুযুধান উভয় পক্ষই। UN Agency-র রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ২০১৫-তেই প্রায় ১৫০০ জন নাবালককে নামানো হয়েছে এই যুদ্ধে। Amnesty International এর চূড়ান্ত নিন্দা করেছে। গত পাঁচ বছরে ২.৫ লক্ষ ইয়েমেনি নিহত, ৩৩ লক্ষ বাস্তুচ্যুত, ৩.৫ লক্ষ শিশুর পুষ্টিহীনতা এবং প্রায় ২ কোটি সাধারণ মানুষের খাদ্য সমস্যা নিয়ে ইয়েমেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কদর্যতম নজির নিয়ে বিশ্ববিবেককে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আর বাক্‌স্বাধীনতা লঙ্ঘন, সাংবাদিক আটক ও মৃত্যদণ্ড তো আছেই। ২০০৫-এর Press Freedom Index অনুযায়ী বিশ্বে ১৬৭ টি দেশের মধ্যে ইয়েমেনের স্থান ১৩৬।

দ্বিখণ্ডিত অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে এক হওয়ার পরেও গৃহযুদ্ধ এড়াতে ব্যর্থ ইয়েমেনকে লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো ব্যর্থতর রাষ্ট্র এবং সোমালিয়ার মতো দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুঃস্বপ্নের দেশ বানাতে নিরন্তর মদত দিয়ে চলেছে সৌদি আরব ও ইরান শুধু নয়, আরব দুনিয়ার বহু দেশ। একইভাবে তারা নিজেদের স্বার্থে ক্রমান্বয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে ইজরায়েলকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে, যদিও জাতিপুঞ্জের প্রস্তাব মতো প্যালেস্তাইন আজও সেই মর্যাদা পায়নি। অথচ আজ তারা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার নিয়ে কুমিরের কান্না কাঁদছে। আর যে জাতিপুঞ্জ ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার নিয়ে আজ সরব হচ্ছে, সেই জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভাতেই তো ১৯৪৭-এ (২৯ নভেম্বর) একটা সমৃদ্ধ ও সুস্থিতিপূর্ণ ভূখণ্ডকে পশ্চিমি শক্তির মদতে অনৈকভাবে দ্বিখণ্ডিত করার পরিকল্পনা করে সেখানকার বৈধ নাগরিকদের (ফিলিস্তিনি) মানবাধিকার লঙ্ঘনের বীজ বোনা হয়েছিল।  

স্বভাবতই পশ্চিমি শক্তির চির-প্রাধান্যযুক্ত সেই জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার কাউন্সিলকে অতি সহজেই পশ্চিমি বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদতে আজ বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ইজরায়েল। হামাসকে শায়েস্তা করার নামে যেভাবে ইজরায়েল সাধারণ, নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর আক্রমণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতম উদাহরণ রাখছে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর কাছে নজিরবিহীন। এমনকি, জাতিপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস এই নিধন-যজ্ঞকে অবিলম্বে বন্ধ করার আবেদন করে দু’পক্ষকেই স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন— ‘Even war has rules’। সঙ্গে সঙ্গে তার কপালে জুটেছে পদত্যাগের হুমকি। জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার বিষয়ক কর্তা মার্টিন গ্রিফিতসকে ইজরায়েলের ভিসা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

ভারত অবশ্য প্রথম দিকে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিল। হামাসের আক্রমণকে সে যেমন নিন্দা করেছিল, তেমনি গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়ে মানবিকতার দৃষ্টান্ত রেখেছিল। কিন্তু যুদ্ধ-বিরতি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দান থেকে বিরত থেকে এই প্রথম তার এতকালের যুদ্ধ-বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে সে অবশিষ্ট বিশ্বকে অবাক করেছে। আশার কথা, শেষ পর্যন্ত (১৩ নভেম্বর, ২০২৩) ভারত তার বিদেশ-নীতির পরম্পরাতে শ্রদ্ধা রেখে আবার ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। এই ভারতই সদ্য স্বাধীন হওয়ার পর পরই বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার মহতী লক্ষ্যে পৃথিবীতে প্রথম দেখিয়েছিল জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রাসঙ্গিকতা। ইজরায়েলের জন্মের এক বছর আগে ১৯৪৭-এ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এই ভারতই ভেবেছিল, সদ্য-ভূমিষ্ঠ পাকিস্তান হয়তো বা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে আবার ভারতের সঙ্গে মিশে যেতে বাধ্য হবে। সেই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভারত-পাকিস্তান নতুন করে এক হতে তো পারেইনি, উপরন্তু তাদের মধ্যে সমস্যা ক্রমবর্ধমান, ঠিক যেমন প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সমস্যাও আজ সারা বিশ্বের কাছে এক মারাত্মক বিষফোড়া। কারণটা যদি শুধু আর্থ-রাজনৈতিক হত তাহলে বিষয়টি জার্মানি কিংবা কোরিয়ার মতো হত কিনা বলা শক্ত, কিন্তু কারণটা যেহেতু ধর্মীয় মৌলবাদ আর বিদেশি শক্তির মদত, তাই বিষয়টি পেয়ে গেছে জটিলতর মাত্রা, যেখানে বিদ্বেষ ও বৈরিতা কমছে তো না-ই বরং বেড়েই চলেছে।

চার

বিদ্বেষ ও বৈরিতা কোন স্তরে পৌঁছাতে পারে, আর তার মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে কতটা মারাত্মক হতে পারে সে কথা মাথায় রেখে দু-টি বিশেষ ঘটনার কথা বলি। একটি চলচ্চিত্রের, অন্যটি সেই চলচ্চিত্র যে সমাজকে প্রতিফলিত করে সেই সমাজ থেকে সরাসরি তুলে আনা। ২০১০-এ মুক্তিপ্রাপ্ত শাহরুখ খান অভিনীত একটি ভারতীয় হিন্দি ছবিতে রিয়াজ খান নামে এক চরিত্রের মুখে শোনা গিয়েছিল: “My name is Khan and I am not a terrorist.” আর তার ১৩ বছর পর গত ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ভারতের নব-নির্মিত সংসদ ভবনে খোদ স্পিকারের সামনে অধিবেশন চলাকালীন শোনা গেল সেই একই শব্দ সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গি ইত্যাদি সহ আরও কিছু (লেখার অযোগ্য) শব্দ। বর্তমান শাসক দলের জনৈক সাংসদের মুখে। টার্গেট বহুজন সমাজবাদী পার্টির সাংসদ দানিশ আলি। কারণ — তিনি মুসলিম। 

দু-টি ঘটনার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে তেমন যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া না গেলেও একটু গভীরে গেলেই তা খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না। আর সেক্ষেত্রে যা সামনে আসবে তা হল— ইসলামোফোবিয়া এবং মুসলিম-বিদ্বেষ, যা এখন এক আন্তর্জাতিক সমস্যা। যেটা বলার তা হল, এই ইসলামোফোবিয়া ও মুসলিম-বিদ্বেষের আন্তর্জাতিক অভিঘাতকে সুকৌশলে ভারতেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সুলতানি ও মুঘল যুগের কিছু বাছাই করা মুসলমান শাসকের পরধর্ম-বিদ্বেষের কিছু দৃষ্টান্তকে সামনে এনে মুসলমানদেরকে ঢালাওভাবে অত্যাচারী স্বৈরশাসকের বংশধর হিসেবে দেগে দেওয়ার রীতি তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বৈধতা পেয়ে যায়। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে এক ঐতিহাসিক বিকৃতি, যার মূল কথা হল— ভারত-ভাগের জন্য মুসলমানরাই দায়ী। আর এই সর্বনাশা ন্যারেটিভ তৈরি করতে গিয়ে মনে রাখা হচ্ছে না যে এ দেশে মুসলমানরা শুধু অত্যাচারী স্বৈরশাসকের বংশধর নয়, তাদের পূর্বপুরুষ সমন্বয়, সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের পরম্পরা তৈরির অগ্রণী শাসক আকবরও। শুধু তাই নয় তাদের পূর্বপুরুষ খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরু, মির্জা গালিব, মোলানা আজাদ, আল্লা বখশ, আফসাকুল্লা খান, আবিদ হাসান, শাহনাওয়াজ খান, বড়ে গুলাম আলি, বিলায়েৎ আলি, বিসমিল্লা খাঁর মতো অসংখ্য পুণ্যাত্মা। তাছাড়া, অত্যাচারী স্বৈরশাসকের কি কোনও বিশেষ ধর্ম হয়? তার একটাই পরিচয় সে অত্যাচারী, যেমন সন্ত্রাসবাদীরও নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম নেই; তার প্রথম ও শেষ পরিচয় সে সন্ত্রাসবাদী, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সত্য। কিন্তু যখন বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকে বৈধতা দেওয়ার অছিলায় তাদেরকে ‘অপরত্ব’-এর শিরোপা দিয়ে পাইকারিভাবে অত্যাচারীর বংশ বলে দেগে দেওয়ার রাজনৈতিক পরিকল্পনা চলে, এবং সুযোগ মতো ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে আস্ত একটা দেশকে ভাগ করার দায় তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তখন তা রীতিমতো শঙ্কার। বলা বাহুল্য, দেশভাগ-পরবর্তী ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর কপালে সেটাই জুটছে। উলটো দিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাটিতে নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া অমুসলিম-নির্যাতনের অসংখ্য উদাহরণ মজুত, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে এসবের নেপথ্যে মুখ্য কারণ দেশভাগ নামক কালান্তক অভিশাপ, যার অভিঘাত শুধু আজও অব্যাহতই নয়, বরং তার নানামুখী প্রভাব অন্যান্য অসংখ্য আন্তর্জাতিক ঘটনার সঙ্গে জট পাকিয়ে উপমহাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু তো বটেই, এমনকি প্রচলিত ধর্মমতে বিশ্বাসী নয় এমন নাস্তিক মানুষের জীবনকেও জটিল ও দুর্বিষহ করে তুলছে। 

এ কথা ঠিক, ইসলামোফোবিয়া তথা মুসলিম-বিদ্বেষ হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি। এর নেপথ্যে অবশ্যই আছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক ঘটনা ও তার অভিঘাত, যার পেছনে মুখ্যত কাজ করেছে ২০০১-এ আল কায়দার হাতে মার্কিন মুলুকে ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংস, এবং তার পর থেকে এ শতাব্দীর প্রথম দু-টি দশক জুড়ে বিশ্বব্যাপী নানান জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, যার দায় স্বীকারে এগিয়ে এসেছে অনেক তথাকথিত ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী। কিন্তু মুশকিল হল, কতিপয় জঙ্গি গোষ্ঠী (যাদের সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই)-র কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হচ্ছে কোটি কোটি সাধারণ মুসলমানকে। ঠিক যেমন উগ্র জায়ানিস্ট ইহুদিদের আগ্রাসনের দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ইজরায়েল তথা সারা বিশ্বের হাজার হাজার নিরপরাধ জুডাইস্ট (জায়ানিজম-বিরোধী) ইহুদিকে (শুধু ইজরায়েলেই যারা সমগ্র ইজরায়েলি জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ শতাংশ, এবং ‘হারেদি’ নামে পরিচিত)। আর এই কারণেই থেকে সারা বিশ্বে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি নরমেধযজ্ঞের বিরুদ্ধে যে লক্ষ লক্ষ ইহুদি পথে নেমেছে তাদের পোস্টারে লেখা রয়েছে— “নট ইন মাই নেম”। একইভাবে ঔপনিবেশিক ভারতে মুষ্টিমেয় কিছু নেতার অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক অবস্থানের মাশুল আজও গুনতে হচ্ছে উপমহাদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে। লঙ্ঘিত হচ্ছে তাদের মানবাধিকার। তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশভাগের কারণে রাতারাতি হয়ে গেল ধর্মীয় সংখ্যালঘু। আর সেইসব সংখ্যালঘু মানুষের জীবনে ১৯৪৭-পরবর্তী নানান ঘটনা-পরম্পরা সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিত্যনতুন উদাহরণ নিয়ে হাজির।

আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যেমন, তেমনই ভারতেও মুসলমান আর সন্ত্রাসবাদীকে সমার্থক ভাবা এখন প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। যেকোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ যতই মনে করুক ইসলাম তথা মানবতা-বিরোধী, ইসলামোফোবিয়া এবং ইসলাম-বিদ্বেষের আন্তর্জাতিক অভিঘাতে তাদের সেই সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অবস্থান বিশেষ কল্কে পায়না। একইভাবে গুরুত্ব পায় না ১৯৪০-১৯৪৭— এই ক্রান্তিকালে মুসলমানদের সিংহভাগ অংশের দেশভাগ-বিরোধী অবস্থান। উলটে বার বার শুনতে হয়, তারাই ধর্মের ভিত্তিতে দেশটা দু’টুকরো করে পাকিস্তান তৈরি করেছে। ভারত তো বটেই, অবশিষ্ট বিশ্বের কাছেও মুসলমানকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ দাখিল করার বাড়তি দায় নিয়ে বাঁচতে হয় যে সে জঙ্গি নয়। সে সাধারণ মুসলমান নাগরিক হোক, আর দেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিই হোক, তাকে প্রকাশ্যে খুব সহজেই জঙ্গি বলে দেগে দেওয়া যায়, এমনকি খোদ সংসদ ভবনের মধ্যেও। স্বাভাবিকভাবেই জন্ম হয় শাহরুখ খান অভিনীত চরিত্র রিয়াজ খান-এর মতো চরিত্র যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। একদিকে ইসলামোফোবিয়া ও ইসলাম-বিদ্বেষ, অন্যদিকে দেশভাগের কালান্তক অভিঘাত— দু’য়ের সাঁড়াশি-চাপে স্বাধীনোত্তর ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর যেন শাহরুখ খান চরিত্র অভিনীত রিয়াজ খানের মতোই আজ শিখরস্পর্শী বিপন্নতা। বিশেষত গত এক দশকে যে হারে তথাকথিত দলিত আর মুসলিম লিঞ্চিং বেড়েছে তা এই বিপন্নতাকেই প্রকট করে। দেশভাগের ৭৫ বছর পরেও উপমহাদেশের এ লজ্জা মুছবে কবে? 

মুশকিল হল, উপমহাদেশে যারা সাধারণ মানুষ, তাদেরকে যতটা না সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা হয় ধর্মীয় পরিচিতিতে। বৌদ্ধ, জৈন, পারসিক, খ্রিস্টান ইত্যাদি (যারা এ দেশে সংখ্যায়  খুবই কম) ছাড়া, মূলত হিন্দু আর মুসলমান। সত্যি বলতে কী, হিন্দু-মুসলমান পরিচিতিতে সমস্যা কিছু ছিল না, কারণ প্রাক্‌ঔপনিবেশিক ভারতে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তাদের মধ্যে মোটের উপর একটা সহাবস্থানের পরম্পরা ছিল, যা ইতিহাস-সিব্ধ। সহাবস্থানের পরম্পরার সঙ্গে অবশ্য তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বৈরিতা যে একেবারেই ছিল না এমন নয়, কিন্তু তা ঔপনিবেশিক ভারতের দেশভাগ পর্বের মতো তীব্র ও বিষাক্ত ছিল না। ঐতিহাসিক রাজিউদ্দিন আকিল তাঁর অসামান্য গবেষণা গ্রন্থ ‘In the Name of Allah’-তে লিখছেন: “Though colonial enumeration did play a role in sharpening categories such as Muslim and Hindu, this does not mean that these categories did not exist at all in medieval times.”

কিন্তু মোটের উপর যে সহাবস্থানের মহার্ঘ পরম্পরা ছিল,তাকে সরিয়ে ঔপনিবেশিক ভারতে তারা হয়ে গেল বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের হিন্দু এবং বাড়াবাড়ি রকমের মুসলমান। দ্বিজাতিতত্ত্বের বটিকা সেবনে উভয় সম্প্রদায়ের মাথা গেল বিগড়ে। সত্যি বলতে কী, তাদের সহজ সরল মাথাগুলোকে বিগড়ে দেওয়া হল, বেশ সুপরিকল্পিতভাবে, রীতিমতো আঁট ঘাট বেঁধে। কে বা কারা এই বিশেষ কৃতিত্ব দেখাল তা ইতিহাসের বদান্যতায় কম বেশি সবার জানা। একদিকে ব্রিটিশের ভেদনীতি, অন্যদিকে তার ফাঁদে পা দেওয়া স্বার্থান্বেষী কতিপয় হিন্দু-মুসলিম নেতৃত্ব।

যেটা বলার তা হল, ইতিহাসের এই দিকটা (ব্রিটিশের ভেদনীতি, দ্বিজাতিতত্ত্ব ও তার অভিঘাত এবং দেশভাগ) নিয়ে গত সাত দশক জুড়ে উপমহাদেশে বহু চর্চা ও গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু যে দিকটা বড়ো বেশি করে উপেক্ষিত ও অনালোচিত তা হল দেশভাগের কালো অধ্যায় রচনার সুপরিকল্পিত অপপ্রয়াসকে রুখে দিতেও একটা শুভশক্তি বুক পেতে দিয়েছিল। এই মহতী কর্মযজ্ঞে যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করলেন তাঁরা যেহেতু শেষপর্যন্ত ভারতভাগ রুখতে পারলেন না, তাই তাঁরা আজ উপেক্ষিত, অনালোকিত। কিন্তু সেই ব্যর্থতার দায় কি শুধু তাঁদের? তার দায় বর্তায় তাঁদের উপরেও যাঁরা দেশভাগ-বিরোধী সেই প্রচেষ্টাকে কুর্ণিশ করার পরিবর্তে তাঁদেরকে উপেক্ষা করেছেন, আর গুরুত্ব দিয়েছেন পাকিস্তান তৈরির প্রস্তাবক মুসলিম লিগকে। দুর্ভাগ্য, এই দিকটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়না। সেই সঙ্গে অনালোচিত থাকে সেইসব কুচক্রী স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক শক্তি, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনও ভূমিকা তো নেয়-ই নি, উপরন্তু দেশভাগ-বিরোধী অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমূলে ধ্বংস করতে যতরকম ঘৃণ্য কাজ করার সবই করেছে। শুধু তাই নয়, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই এই কুচক্রী স্বার্থান্বেষী শক্তিকে ইদানীং উপমহাদেশ জুড়ে নতুন করে হিরো বানাবার ঐতিহাসিক বিকৃতি দেখা যাচ্ছে। বলা বাহুল্য, দেশভাগোত্তর উপমহাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির রাখছে মূলত তারাই যারা এই মিথ্যা প্রপাগান্ডার হোতা। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘনকে রুখে দিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন এই কুচক্রী স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে শনাক্ত করা, এবং তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এজেন্ডা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা।

১৯৪০-১৯৪৭ — এই কালপর্বে দেশভাগের বিরুদ্ধে যে শুভশক্তি মাথা তুলছিল তা শেষ পর্যন্ত যতই ব্যর্থ হোক, তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। বিশেষত, আজকের দিনে যখন উপমহাদেশে নতুন করে বিভেদকামী শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে, যখন বিভেদকামী শক্তির কাছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকতে বার বার অক্ষমতা দেখাচ্ছে, যখন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তখন এই বিশেষ অধ্যায়টির উপর আলোকপাত জরুরি। মুশকিল হল, এই জরুরি আলোচনা তো হচ্ছেই না, পরিবর্তে ইতিহাসের এই অধ্যায়ের বিস্মরণ ও বিকৃতি বিভেদকামী শক্তিকে আরও শক্তিশালী হবার রসদ জোগাচ্ছে। বিশেষত বেশি বেশি করে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালোনো হচ্ছে যে দেশভাগের জন্য মুসলমানরাই দায়ী, সুতরাং ধর্মের ভিত্তিতে তারা যখন দেশভাগ করেই নিয়েছে তখন তারা ভারতে থাকার অধিকার হারিয়েছে। আর যদি থাকতেই হয় তাহলে তারা থাকবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে। নতুন করে নাগরিকত্ব আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট করে এই বিশেষ জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে সস্তার শ্রমিক বানানো যাবে। এমনকি, তাদের ইচ্ছে মতো লিঞ্চিং করা যেতেই পারে, তা চলন্ত ট্রেনেই হোক, কিংবা হাটে-মাঠে-ঘাটে-বাজারে যেকোনও জায়গায়, যেকোনও অবস্থায়। এমনকি নবনির্মিত সংসদ ভবনে ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে মুসলিম হওয়ার অপরাধে অতি আপত্তিকর ও ছাপার অযোগ্য ভাষায় আক্রমণ করে শাসকদলের প্রাক্তন মন্ত্রীদের বিদ্রুপ ও হাসি উদ্রেক করাও স্বাভাবিক ঘটনা।

অথচ ইতিহাস কী বলছে? শুধু সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকেই নয়, ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় জাগরণ ও দেশের জন্য আত্মত্যাগে উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভূমিকা কতখানি তা আন্দামানের সেলুলার জেলের তৎকালীন বন্দিদের তালিকা, এমকি দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে খোদিত নামের তালিকা দেখলেই কিছুটা অনুমান করা যায়। পাঠ্যবই থেকে মুঘল যুগ কিংবা ডারউইন বাদ দিয়ে যেমন ইতিহাস মুছে দেওয়া যায় না, তেমনি এঁদেরকেও বিস্মৃতি আর বিকৃতি দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে না। আর দেশভাগের পক্ষে জিন্না তথা মুসলিম লিগের সঙ্গে দেশের সিংহভাগ মুসলমান জনমত যে ছিল না, ছিল মূলত উচ্চবিত্ত শ্রেণির মুষ্টিমেয় মুসলমান তা ইতিহাসসিদ্ধ। অথচ সেই ইতিহাসকে সামনে না এনে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে প্রপাগান্ডা করা হচ্ছে যে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানরা যখন পাকিস্তান তৈরি করেই নিয়েছে তখন হিন্দু ভারত করতে বাধা কোথায়? আর সেই হিন্দু ভারতে মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই বৈধতা পেয়ে যায়।  

পাঁচ

দেশভাগে কার কত দায় ছিল তা খুঁজে বের করা অবশ্যই এ আলোচনার বিষয় নয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণা, অনেক বইপত্র লেখা হয়েছে, এবং হচ্ছেও। কিন্তু যেহেতু ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বৈধতা দেওয়া জন্য দেশভাগে তাদেরকে দায়ী করার একটা রীতি চলছে, তাই প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, যেটুকু না বললেই নয়, তা খুব স্বল্প পরিসরে বলতেই হচ্ছে।

মুসলিম লিগ ১৯৩৭-এর নির্বাচনে যে ফল করেছিল (মুসলিম-অধ্যুষিত প্রভিন্সে মাত্র ২৫ শতাংশ আসন) তাতে প্রমাণ হয় যে মুসলিম লিগ তখনও পর্যন্ত দেশের সিংহভাগ মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করত না। লাহোরে মুসলিম লিগের পাকিস্তান প্রস্তাবের (১৯৪০, ২৩ মার্চ)-এর মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই সিন্দের তৎকালীন জনপ্রিয় মুসলিম নেতা আল্লা বখশের নেতৃত্বে আজাদ মুসলিম কনফারেন্স ও অন্যান্য আরও সাতটি মুসলিম সংগঠন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে যে দেশভাগ-বিরোধী বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছিল (যা তৎকালীন প্রায় সমস্ত প্রতিনিধি-স্থানীয় সংবাদ পত্রে প্রকাশিত এবং যা নিয়ে “দেশভাগ-বিরোধী মুসলিম মানস: একটি উপেক্ষিত অধ্যায়” শিরোনামে অন্যত্র লিখেছি) সেটাই ছিল সিংহভাগ মুসলমান জনমতের প্রতিফলন। দুর্ভাগ্য, দেশভাগ-বিরোধী সেই জনমত ও তার নেতৃত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্রিটিশরাজ এবং কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে মান্যতা দেন জিন্নাকে। 

এখানেই শেষ নয়। ইতিহাস বলছে, ১৯৪০-১৯৪৭ কালপর্ব জুড়ে যখন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে ব্রিটিশরাজ দেশভাগের সলতে পাকাচ্ছে, যখন ক্রিপ্‌স মিশন, ওয়াভেল পরিকল্পনা ও মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের নেতারা একের পর এক ক্ষমতার বাঁটোয়ারা নিয়ে মিটিং আর ইটিং-এ ব্যস্ত, তখন দেশজুড়ে দেশভাগ-বিরোধী মুসলিম জনমানস আল্লা বখশের আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের ছাতার নীচে যে কী চূড়ান্ত ইতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আরও বেশি অবাক হতে হয়, যখন দেখা যায় সেই জনমানসকে বিশেষ আমল না দিয়ে দরকষাকষি করা মুসলিম লিগ ও তার স্বঘোষিত নেতা জিন্নাকে গান্ধি তথা কংগ্রেসসের তরফে (আবুল কালাম আজাদ, আসফ আলির মতো কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বাদে) ‘কায়েদ-ই-আজম’ তথা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মূল প্রতিনিধি তথা মসিহা হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর মুসলিম লিগকে বলা হচ্ছে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, সেই সময়ের সিংহভাগ মুসলমান জনমত ও সংগঠন ছিল তীব্রভাবে দেশভাগ-বিরোধী। মূলত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত, অভিজাত মুসলমানদের কিছু ভোট পাওয়া ছাড়া ১৯৩৭-এর সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলা, সিন্দ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাবে মুসলিম লিগের বিশেষ কোনও জনভিত্তিই ছিল না। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে মুসলিম-অধ্যুষিত বাংলাতে বেশি আসন পেয়েছিল ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি,মুসলিম লিগ নয়। মুসলিম-অধ্যুষিত আর এক প্রদেশ সিন্দে ক্ষমতায় এসেছিল আল্লা বখশের নেতৃত্বে ‘ইত্তেহাদ’ বা একতা দল (Unionist Party)। পরবর্তিতে মুসলিম লিগের উত্থানের নেপথ্যে যতনা জিন্নার কৃতিত্ব, তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব ব্রিটিশের ভেদনীতির এবং গান্ধি তথা কংগ্রেসের। কারণ, যে আল্লা বখশ ব্রিটিশের ভেদনীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-স্বরূপ ব্রিটিশের দেওয়া খেতাব ‘খান বাহাদুর’ খেতাব নির্দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন, যে আল্লা বখশ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে জিন্নার পাকিস্তান প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতায় দেশের সিংহভাগ মুসলমান জনমতকে সংগঠিত করে আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের তরফে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছেন, যে আল্লা বখশকে অন্যায়ভাবে (সিন্দ প্রদেশে তাঁর ‘ইত্তেহাদ’ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কার্যত অস্বীকার করে) প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে মুসলিম লিগকে ক্ষমতায় এনে উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম লিগের সম্প্রসারণে ইন্ধন দেওয়া হয়েছে, সেই আল্লা বখশের মতো নেতৃত্বকে মান্যতা না দিয়ে গান্ধি তথা কংগ্রেসের তরফে জিন্নাকে মান্যতা দেওয়া হয়। এমনকি, মুসলিম লিগের ষড়যন্ত্রে আল্লা বখশকে খুন (১৪ মে, ১৯৪৩) করা হলেও কংগ্রেস তার যথাযথ বিচার চাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ গা লাগায়নি।

যাইহোক, পরের নির্বাচনে (১৯৪৬) মুসলিম লিগের আসন বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে যেমন ব্রিটিশের ইন্ধন ছিল, তেমনি কংগ্রেসের এই ভ্রান্ত নীতিও কম দায়ী নয়। পরবর্তীতে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক মুসলিম লিগের দিকে সাময়িক ভাবে ঝুঁকলেও শেষমেশ ফজলুল হকও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতা আবদুল গফ্‌ফার খান তো জিন্না তথা মুসলিম লিগের চূড়ান্ত বিরোধী। অবশ্য এ জন্য তাঁকেও কম মূল্য চোকাতে হয়নি। সারাজীবন গান্ধির একনিষ্ঠ ভক্ত এই দেশভাগ-বিরোধী জননেতাকে শেষপর্যন্ত তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের তরফে বাধ্য করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেকে মিশিয়ে দিতে, যা ছিল তাঁর কাছে কংগ্রেসের তরফে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা। লাল কুর্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, এই দীর্ঘদেহী সুপুরুষ যখন হতবাক হয়ে দেখলেন (১৯৪৭- জুন মাসের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে) কংগ্রেস দেশভাগের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে, তখন যন্ত্রণাজর্জর, ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে তিনি গান্ধিকে বলছেন:

“আমরা পাখতুনরা আপনার পাশে দাঁড়িয়েছি, অনেক আআত্মত্যাগ করেছি, কিন্তু এখন আপনি আমাদের নেকড়ের মুখে ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে …। … ভাবছিলাম, এতগুলো বছর ধরে কাদের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম আর লড়াই করছিলাম, তার কতুটুকুই বা এরা বুঝতে পেরেছিল।”

‘নেকড়ে’ বলতে যে তিনি জিন্না ও তাঁর মুসলিম লিগকে বোঝাতে চেয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বলা বাহুল্য, জিন্না তাঁর সঙ্গে ‘নেকড়ে’-র মতোই ব্যবহার করেছিলেন। জিন্নার বাহিনী তাঁর শেষ বয়সে তাঁকে চূড়ান্ত অপমান আর লাঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। কারণ, আল্লা বখশের মতো তিনিও ছিলেন আপাদমস্তক আজীবন মুসলিম লিগ-বিরোধী। 

১৯২০ সালের পর থেকেই জিন্না (কংগ্রেস ত্যাগ করার পরে) তার রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রায় হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে গান্ধি কিছু ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিলে জিন্না নতুন করে রাজনৈতিক গুরুত্ব ফিরে পান। আজাদ লিখছেন:

“Large sections of Indian Muslims were doubtful if Mr Jinnah and his policy but when they found that Gandhiji was continually running after him and entreating him, many of them developed a new respect for Jinnah. They also thought that Jinnah was perhaps the best man for getting advantageous terms in the communal settlement.”

বলা বাহুল্য, গান্ধিই জিন্নাকে প্রথম ‘কায়েদি-আজম’ বলে সম্বোধন করা শুরু করে তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দেন।

অবশ্য প্রথম দিকে জিন্নার রাজনৈতিক অবস্থানও ছিল সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক। গোখেলের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘ambassador of Hindu-Muslim unity’. তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের বিবর্তন (পরিবর্তন নয়, যা বর্তমান ভারতে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের মতো হঠাৎ করে ঘটে শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থে) কেন হল,তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই তা নিয়ে এখানে চর্বিত-চর্বণ করব না। এখানে শুধু তথ্যের খাতিরে যেটুকু না বললেই নয় তা হল, একদা দাদাভাই নৌরজির অনুগামী একজন ধর্মনিরপেক্ষ, উদারমনা জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা জিন্নার মুসলিম লিগে যোগদান কোনও অকস্মাৎ সিদ্ধান্ত নয়। বরং প্রথম দিকে মুসলিম লিগে যোগদানের ব্যাপারে তার যথেষ্ট দ্বিধা ও আপত্তি ছিল। শেষমেশ মুসলিম লিগে যোগ দিলেও ১৯৪০-এর(২২ মার্চ) মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনের আগে পর্যন্ত জিন্না পাকিস্তান দাবির ধারেকাছেও ছিলেন না। আসলে জিন্না হলেন তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতির পরিস্থিতিগত ফসল (by-product)। কংগ্রেসের বাইরে ও কংগ্রেসের অন্দরমহলের হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মুসলমানদের প্রতি মানসিকতা জিন্নাকে কতটা প্রতিস্পর্ধী করে তুলেছিল সে ইতিহাস বহু-চর্চিত। কিন্তু যেটার চর্চা হয় না তা হল— ‘ইসলাম বিপন্ন’ — এমন এক ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে তিনি এ দেশের সিংহভাগ মুসলিম মানসকে আদৌ প্রভাবিত করতে পারেন নি। বরং একটা বাজার চলতি সস্তা অনৈতিকহাসিক দাবি করা হয় — জিন্নাকে মসিহা বানিয়ে মুসলমানরাই দেশটাকে ভাগ করেছে। এটাও খুব একটা চর্চা হয় না যে জিন্না মুসলমানদের ত্রাতা হতে গিয়ে আসলে সবচেয়ে ক্ষতিটা করে গেছেন উপমহাদেশের মুসলমানদেরই। আর যারা আজও হিন্দু জাতীয়তাবাদকে উস্কানি দেন তারাও কি বোঝেন দেশভাগের সময়ে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর উদ্‌বাস্তু হওয়া শুধু নয়, সেইসময় থেকে আজ পর্যন্ত এক নাগাড়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন উপকারে লেগেছে এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ?

ছয়

গত পঁচাত্তর বছরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার নিরবচ্ছিন্ন চালচিত্র ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা কে না জানে? বাংলাদেশ হাল আমলে একটু একটু করে মাথা তুললেও আজও মুক্ত হতে পেরেছে কি ধর্মীয় মৌলবাদের চোখরাঙানি থেকে? মুক্তচিন্তা ও বিরুদ্ধ-স্বরকে অস্বীকার, একের পর এক ব্লগার হত্যা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, নৈমিত্তিক ঘটনা। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতক পরেও সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে করতে হয় শাহবাগ আন্দোলন। দু-টি দেশই বয়ে বেড়াচ্ছে হিংসা, সন্ত্রাস আর খুনের রাজনৈতিক পরম্পরা। আর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত? সেখানে ইদানীং ইতিহাসের বিকৃতিকে পুঁজি করে দেশভাগের জন্য মূলত মুসলমানদের দায়ী করার যে কুনাট্য চলছে, তা প্রায় সর্বজনবিদিত। কথায় কথায় তাদেরকে বলে দেওয়া হচ্ছে — ভারতে থাকতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মর্জিমতো থাকো, নইলে পাকিস্তান চলে যাও। আর যে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাদের পাশে থেকে ভারতের সেকুলার চরিত্রকে মর্যাদা দিতে চায় এবং তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে, তারা হিন্দু হলেও তাদেরকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়ার এক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ইতিমধ্যেই হাজির। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, লেখক, শিল্পী, গবেষক, ইতিহাসবিদ কাউকেই রেয়াত করা হয়না।  ২০১৮-১৯ কালপর্বে নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশজোড়া বিতর্কের মধ্যে তৈরি হয় শাহিনবাগ আন্দোলন। আর যারা সে আন্দোলনে অংশ নেয় তাদেরকে শুনতে হয় যে তারা দেশদ্রোহী — ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’। তাদের উদ্দেশ্যে ধেয়ে আসে বুলেটের চেয়েও ভংয়কর বুলেট — ‘গোলি মারো শালো কো’। তাদের অপরাধ কী? তারা নয়া নাগরিকত্ব আইন, যা শুধুমাত্র মুসলমানদেরকে অন্যান্য সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আলাদা চোখে দেখে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায়। আসলে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে মুসলিমরা কেমন আছে তা এখন পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে তার সঙ্গে তুলনা করে বোঝানোর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবখানা এমন যে ওপারে তুমি যেমন রেখেছ, এপারে তেমনই রাখব আমি। তাতে দেশের সেকুলার চরিত্র চুলোয় যায় যাক।

মাত্র বছর চারেক আগেই নয়া নাগরিকত্ব আইনের গুঁতোয় যখন আসামে বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশি সন্দেহে চলছিল ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া, যখন বাদ যাচ্ছিল না দেশের প্রাক্তন সেনা অফিসারের পরিবারও, এমনকি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বংশধরও, তখন সেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়ল ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের ধ্বজাধারীরা। বাঙালি হিন্দুরাও ছাড় পেল না নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কাগজপত্র দাখিলের নয়া ফাঁদ থেকে। শত শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ হঠাৎ করে কোথায় পাবে কাগজপত্র? মাতৃভাষা বাংলা হওয়ার অপরাধে তাদের বলে দেওয়া হল, তারা সব বাংলাদেশি। তার অভিঘাত গিয়ে পড়ল ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও। সেখানেও বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিক সহ হাজার হাজার বাঙালিকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ শুরু হল। আর ঘটনাক্রমে যদি তারা মুসলমান হয় তাহলে তো গোদের উপর বিষফোড়া। নিজবাসভূমে পরবাসীর মতো আতঙ্ক গিলে ফেলতে লাগল গোটা একটা প্রজন্মকে। যেন রাতারাতি ফিরে আসলো সেই কালান্তক দেশভাগের দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি। যাদেরকে বাংলাদেশি বলে আসাম থেকে বাংলাদেশে তাড়ানো কিংবা ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর কথা বলা শুরু হল, তাদেরকে খুব সংগতভাবেই বাংলাদেশ সরকার ফেরত নিতে অস্বীকার করল, কারণ তাদের সিংহভাগই একাত্তর বা তার আগেই থেকেই বরাকের জলাজমিকে চাষযোগ্য করে সেখানে বংশপরম্পরায় বসবাস করছে। স্ব-দেশেই স্বদেশের খোঁজে হাজার হাজার মানুষকে গিলে ফেলতে লাগল আকাশছোঁয়া বিপন্নতা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠল মানবাধিকার লঙ্ঘনের। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার কর্মীরা জেগে উঠলেন। উপমহাদেশের সমস্যা পেল আন্তর্জাতিক মাত্রা। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আওয়াজ উঠতে লাগল ভারতের নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA)-এর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর উপমহাদেশে দু’পারের গল্পকে নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রে বেঁধে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফসল হিসেবে উপহার দেবার কৃতিত্বটুকু ছাড়া জিন্না ১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে সংখ্যালঘু বনে যাওয়া মুসলমানদের জন্য কী রেখে গেলেন? আর জিন্নার সেই দরকষাকষিতে অংশীদার হয়ে দেশভাগে সম্মতি জানিয়ে, কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী ও তথাকথিত সেকুলার উভয় প্রকার নেতৃত্ব রাতারাতি সংখ্যালঘু বনে যাওয়া হিন্দুদের (বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশে) জন্যই বা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন ছাড়া কী উপহার রেখে গেলেন?

উপমহাদেশের যে সমস্ত মুসলমান আজও ইতিহাস-অজ্ঞতা তথা সাম্প্রদায়িক একদেশদর্শীতা থেকে জিন্নাকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মসিহা অর্থাৎ ত্রাতা ভাবেন, তারা কি দেখছেন না যে এই তথাকথিত মসিহা দেশভাগের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে উপমহাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীকেই বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করে গেছেন। প্রথমত, যে সব মুসলমান উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে রাতারাতি উদ্‌বাস্তু হয়ে পাকিস্তান চলে গেল তাদের কপালে জুটেছে আহমদিয়া ও কাদিয়ানি তকমা। তারা তথাকথিত খানদানি সুন্নি মুসলমানদের চোখে প্রকৃত মুসলমান নামের অযোগ্য। কাজেই তারা তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্রে গিয়েও হয়ে গেল সেখানকার তথাকথিত খানদানি সুন্নি মুসলমানদের চোখে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এদের বিপন্নতার শেষ নেই। কারণ, এরা যদি পাকিস্তানের তথাকথিত খানদানি সুন্নি মুসলমানদের নির্যাতন থেকে নিস্তার পেতে আবার ফিরে আসতে চাই তাদেরই রেখে যাওয়া ভিটেমাটিতে, তাহলেও বিপদ। কারণ, ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, পারসিক, ইহুদি, জৈন, বৌদ্ধ— সবার জন্য নতুন করে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রাপ্তির পথ খোলা থাকলেও মুসলমানদের জন্য নৈব নৈব চ। দ্বিতীয়ত, সাতপুরুষের ভিটেমাটি আগলে যারা ভারতেই থেকে গেল তারা আজ নতুন করে নাগরিকত্ব আইনের জাঁতাকলে পড়ে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে নাকাল। এমনকি, নানা অছিলায় তাদের অনেকেই লিঞ্চিং-এর শিকার হয়ে কখনও হয়ে যান মহম্মদ আখলাখ, তবরেজ আনসারি, হাফিজ জুনেইদ, রাখবার খান, মহম্মদ ইসরার কিংবা অন্য কোনও নির্যাতিত মুসলমানের প্রতিনিধি। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের বর্তমান উর্দুভাষী সুন্নি ও শিয়া মুসলমান, যারা নিজেদেরকে খানদানি আশরাফ মুসলমান বলে দাবি করে কিন্তু নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছে। চতুর্থত, যারা প্রথমে ইসলামি জাতীয়তাবাদের খোয়াব দেখলেও পরে স্বপ্নভঙ্গ হলে ১৯৫২-১৯৭১ কালপর্বের লড়াইয়ের বিনিময়ে ভারতেরই সাহায্যে অর্জন করেছে বাংলাদেশি পরিচিতি, কিন্তু তথাকথিত কলকাতাইয়া এলিট বাঙালির চোখে আজও বাঙালি নয়, শুধুই মুসলমান। পঞ্চমত, যে সব অবাঙালি মুসলিম সাবেক বিহার থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলে গিয়েছিল অথচ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অক্ষমতা থেকে বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারলো না, এবং আবার নতুন করে ভারতে চলে এল। এরা ভিটেমাটি হারিয়ে চরম দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে এখন এ দেশে কোনোক্রমে টিকে আছে। ষষ্ঠত, বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আর একশ্রেণির মুসলমান, যাদেরকে সংখ্যালঘু মুসলমান বললেও অত্যুক্তি হবে না। চমকে উঠছেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু মুসলমান শুনে? বাস্তবতা এটাই যে দু-টি দেশেই একশ্রেণির মুসলমান আছে যারা প্রগতিশীল, উদারমনা, ধর্মনিরপেক্ষ, এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সরব। সর্বোপরি, তারা ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধ-স্বর, এবং মুসলমান-অধ্যুষিত দেশের নাগরিক হয়েও সংখ্যালঘু মুসলমান, কারণ বাকি (সংখ্যাগরিষ্ঠ) মুসলমানদের কাছে তারা বিধর্মী বা কাফের। এক অদ্ভুত দোটানার মধ্যে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত এই মুসলমানদের অবস্থা না-ঘরকা না-ঘাটকা। পাকিস্তানে তবু তারা ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্তায় এক হওয়ার সুবিধাটুকু পায়, কিন্তু বাংলাদেশে এই শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে ভয়ংকর দোটানা। কারণ, বাঙালিত্ব আর মুসলমানত্বের দ্বন্দ্ব তাদের আজও ঘুচল না। তাদের মধ্যে একধরনের বিপন্নতা কাজ করে যে বাঙালিত্বের পাল্লা ভারি হয়ে গেলে পাছে মুসলমানত্বে টান পড়ে। এরা ভারতের মাটিতে কোনও কারণে এলে এ বঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, বাংলাভাষী মুসলিমদের মতো এদেরকেও হিন্দু বাঙালিদের কাছে শুনতে হয়— “আপনাদেরকে দেখে ঠিক মুসলমান মনে হয় না, পুরোপুরি বাঙালি মনে হয়”। 

তাহলে পুরোপুরি বাঙালিত্বের চিহ্ন কী কী? বাঙালিত্ব অর্জন করতে কি তাহলে মুসলমানত্ব বিসর্জন দেওয়া আবশ্যক? ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের সঙ্গে জাতিসত্তার কী সম্পর্ক? 

এমন কথা যারা বলে তাদের ভাবা উচিত হাজার বছর ধরে যে সমস্ত বাংলাভাষী মুসলমান আরব্য ঘরানার জীবনচর্যা থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গীয় ঘরানার যাপনে অভ্যস্ত, তারা শুধু ধর্মীয় পরিচিতিতে মুসলমান বলে বাঙালি নয়? বাউল-ফকির-সুফি-পির-দরবেশের যাপনরীতির সম্মিলিত মিথস্ক্রিয়া বাংলার বাইরে কোন ইসলামি দেশে আছে? এগুলি কি বাঙালিত্বের চিহ্ন নয়? হিন্দু-মুসলিম উভয় কৃষ্টির সম্মিলনে সত্যপিরের দেশ আর কোথায়? দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছে মতো বাঙালিত্বেও ভাগ বসানোর এই মনস্তাত্ত্বিক বিকৃতি আর কতদিন চলবে? প্রশ্ন উঠতেই পারে, যা কিছু বাংলার মাটিতে উদ্ভূত নয় যা তা কীভাবে বাঙালিত্বের চিহ্ন হয়? আগেই বলেছি আরব্য ঘরানা থেকে বাইরে বেরিয়ে বাংলার কৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্তির কথা। ঠিক যেমন ইন্দোনেশিয়ার ইসলামি যাপনরীতি আরব্য কিংবা পারসিক কিংবা তুর্কি ঘরানা থেকে আলাদা। ভাবতে অবাক লাগে বর্তমান বাংলাদেশ যে আঙ্গিক ও মাত্রায় বাংলা নববর্ষ পালন করে এবং তাতে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে যে সর্বজনীন উৎসবের আবহ এনেছে তা যদি বাঙালিত্বের চিহ্ন না হয় তো কাকে বাঙালিত্বের চিহ্ন বলব? এ কোনও কূটতর্ক নয়, এ হল উপমহাদেশের বাঙালি মুসলমানের পরিচয় সংকট থেকে উত্থিত বেশকিছু যন্ত্রণাদীর্ণ প্রশ্ন (যা নিয়ে ‘ভারতীয় মুসলমানের পরিচয় সংকট: একটি মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষা’ শিরোনামে বিস্তারিত লিখেছি পুনশ্চ প্রকাশিত অভিক্ষেপ  পত্রিকার ‘পরিচিতি’ গ্রন্থে)। আর এইসব প্রশ্ন সংবেদী সদুত্তর আশা করে বাঙালিত্বকে হাইজ্যাক করতে চাওয়া পশ্চিমবঙ্গীয় এলিট বাঙালির কাছে। কারণ, এ প্রশ্ন যাদের যন্ত্রণাদীর্ণ মনে জাগে সেই না-ঘরকা  না-ঘাটকা মুসলমানরা দেশভাগের পরিস্থিতিগত ফসল তথা এক ব্যতিক্রমী ‘by-product’ হিসেবে কতদিন এই মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতকে বয়ে নিয়ে বেড়াবে? একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শেক্সপিয়ার-মিলটন-মির্জা গালিব-হাফিজভক্ত এবং কোরানের অনুসারী এই প্রগতিশীল সংখ্যালঘু মুসলমানেরা কিছুতেই এ বঙ্গের তথাকথিত এলিট হিন্দুদের, এমনকি নিজের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরও বোঝাতে পারেনা যে জাতিসত্তার সঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতির কোনও দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না। স্বয়ং হজরত মহম্মদ(স:) নিজেও আরব্য জাতীয়তাবাদ ও কৃষ্টিকে বিসর্জন দেননি, এবং প্রকৃত ইসলাম কোনও দেশের সংস্কৃতি তথা জাতিসত্তা ধ্বংসের পক্ষে সওয়াল করে না (এ নিয়ে পুনশ্চ প্রকাশিত ‘জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে ‘জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি রাষ্ট্রভাবনা: তত্ত্ব তথ্য সত্য’ প্রবন্ধে বিস্তারিত বলেছি)।

সাত

একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে দেশভাগ অনভিপ্রেত হলেও তা ছিল অনিবার্য। এ কথা ঠিক, ইতিহাস মানে জ্যোতিষশাস্ত্র নয়। কী হলে কী হতে পারত তা নিয়ে ভবিষ্যদ্‌বাণী করা অবশ্যই ঐতিহাসিকের কাজ নয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা তো নিতেই হয় যে কী করণীয় আর কী করণীয় নয়। কোনও ঘটনার অভিঘাত কতটা মারাত্মক হতে পারে তা তো অতীত থেকেই শিখতে হয়। কুরশিতে বসার ইচ্ছে চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে যখন কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ভবিষ্যতকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়, আর তাকে প্রতিরোধ করার শক্তিশালী আন্দোলনের ঢেউ উঠলেও (যা নিয়ে ‘দেশভাগ-বিরোধী মুসলিম মানস: এক উপেক্ষিত অধ্যায়’ নামাঙ্কিত প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি) তাকে গুরুত্ব না দিয়ে বিভেদকামী শক্তির কাছে নতিস্বীকার করা হয়, তখন কি মনে হয় দেশভাগ অনিবার্য ছিল, না কি দেশভাগ একটা তৈরি করা অধ্যায়? প্রকৃতপক্ষে, যেটা অনিবার্য ছিল তা হল দেশভাগের ফলে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের বংশ-পরম্পরায় ঘটে যাওয়া করুণ পরিণতি, যা আজও শেষ হয়নি। আগেই বলেছি, এই অনিবার্য পরিণতির জন্য দায়ী কে বা কারা তা নিয়ে গবেষণা, আলোচনা, বই-পত্তর লেখা কম হয় না। কিন্তু যেটা খুব কম হয়, অথচ বেশি করে হওয়া দরকার তা হল এর সর্বনাশা অভিঘাত, যার প্রভাবে আজও উপমহাদেশ জুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন এক নৈমিত্তিক ঘটনা।

ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র জিন্নার জাতীয়তাবাদী সত্তার বিবর্তন ও শেষ পর্যন্ত সম্প্রদায়-ভিত্তিক রাজনৈতিক মসিহা হয়ে ওঠা নিয়ে বলতে গিয়ে একটা চমৎকার কথা বলেছেন, যা সম্প্রদায় নির্বিশেষে পৃথিবীর যে কোনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য: 

“The proposition that communalism has a logic of its own and , if not checked in its early stages , inevitability develops into its ‘higher’ stages is illustrated by the life of Mohammad Ali Jinnah….Once the basic digits of communal ideology are accepted , the ideology takes over a person bit by bit , independent of the subjective desires of the person. This is how a person who started as the ‘Ambassador of Hindu-Muslim Unity’ ended up by demanding Pakistan.”

অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা নিজস্ব চরিত্র থাকে, যা ঘূর্ণাবর্তের মতো। সেখানে একবার জড়িয়ে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা, নিজের পূর্বতন অসাম্প্রদায়িক সত্তা (যা জিন্না ও সাভারকর উভয়েরই একদা ছিল)-কেও সেই ঘূর্ণাবর্ত গ্রাস করে নেয়। আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে ব্রিটিশকে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার পর থেকে যেমন সাভারকরের কাছে ছিল দ্বিজাতি-তত্ত্বকে বৈধতা দিয়ে বই লেখার বাধ্যবাধকতা, তেমনি ১৯২০ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা লন্ডন প্রবাসী জিন্নার নতুন করে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়াও ছিল তার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। তাই পাকিস্তান ইস্যু (যার বাস্তবায়ন নিয়ে জিন্না নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন) জিন্নার রাজনৈতিক সত্তার পুনর্নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য শর্ত হয়ে উঠল। এখানে ধর্মীয় পরিচিতি অস্ত্র মাত্র, রাজনীতিটাই মুখ্য। যশবন্ত সিং ঠিকই বলেছেন:

“The Muslim community for Jinnah became an electoral body. …… Religion in all this was entirely incidental ; Pakistan alone gave him all that his personality and character demanded. If Mr.Jinnah was necessary for achieving Pakistan , Pakistan, too, was necessary for Jinnah.”

তাই জিন্নাকে শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেখাটা ইতিহাসের সরলীকরণ তথা আংশিক পাঠ। এ কথা ঠিক, হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তার পালে হাওয়া লাগিয়েছিল, যেমন হাওয়া লাগিয়েছিল ব্রিটিশের ভেদনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন, যার পরিপূর্ণ সদ্‌ব্যবহার তিনি নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থতায় দক্ষতার সঙ্গে করেছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বন্ধক রেখে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থতায় তিনি নেহরু, প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেস নেতাদের (যারা নিজেদের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ক্লান্তিকর লড়াইয়ের কথা কবুল করেছেন) চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না। তাই আজও যারা শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য উপমহাদেশ জুড়ে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভূরিভূরি উদাহরণ সত্ত্বেও শুধু মুসলিম জাতীয়তাবাদ আর হিন্দু জাতীয়তাবাদের খোয়াবে বিভোর, তাদের নতুন করে ফিরে দেখা উচিত দেশভাগের প্রকৃত ইতিহাস ও তার আন্তর্জাতিক অভিঘাতকে।

হ্যাঁ আন্তর্জাতিকই বলব, কারণ এটা এখন আর শুধু ভারতের সমস্যা নয়। উপমহাদেশ তো বটেই, তার বাইরেও এখন অনুভূত তার নেতিবাচক অভিঘাত। বিশেষত কাশ্মীর সমস্যাকে ভারত ও পাকিস্তান যতই দ্বিপাক্ষিক বলে পাশ কাটিয়ে যাক, আসলে যে বিষয়টি এখন ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের মতোই আন্তর্জাতিক বিষফোড়া, তা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ কথা কে অস্বীকার করবে দেশভাগের ডামাডোলই হায়দরাবাদ, জুনাগড়, আর কাশ্মীর নিয়ে প্যাটেল-নেহরুকে রাজনৈতিক দৌত্য শুরু করতে প্ররোচিত করে? আর তার পরের ইতিহাস তো কম বেশি সবার জানা। দেশভাগ যেন ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। পাকিস্তানকে একের পর এক রাজনৈতিক দৌত্যে হারিয়ে হায়দরাবাদ, জুনাগড় আর সবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি। আর তার বেশ কিছুকাল পর পাকিস্তানের পেট চিরে বাংলাদেশের জন্ম দিতে ভারতের ধাত্রী মায়ের ভূমিকা। ব্যাস, আর দেখে কে! ফল তো যা হওয়ার তাই হল। আহত বাঘের মতো সেই যে ফুঁসতে থাকল পাকিস্তান তা আজও অব্যাহত। যেন জন্মাবধি যমজ দুই ভাই আন্তর্জাতিক মানচিত্রে হয়ে গেল একে অপরের জ্ঞাতিশত্রু। আর তার সুযোগ নিতে এগিয়ে এল প্রতিবেশী চিন সহ পশ্চিম দুনিয়া। দাদাগিরি করার এমন সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে! ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের মতো এক জিইয়ে রাখা জ্বলন্ত সমস্যার মতোই আর এক সমস্যা তাই কাশ্মীর সমস্যা, যেখানে সন্ত্রাস দমনের নামে চলে আর এক সন্ত্রাস, লুন্ঠিত হয় মানবাধিকার।

আট

কাশ্মীরের মুসলমানেরা ১৯৪৭-এ দেশভাগের অভিঘাতে অবশিষ্ট ভারতের মুসলমানদের মতো সংখ্যালঘুত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়ায় না ঠিকই, কিন্তু তারা দেশভাগের পরোক্ষ শিকার। তাদের প্রাত্যহিকতায় প্রতিনিয়ত চলে রাষ্ট্রীয় নজরদারি। একদিকে পাক-মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদী, অপরদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে ভারতীয় সেনা ও আধাসেনার অভিযান ও ধরপাকড় — দু’য়ের সাঁড়াশি আক্রমণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ। নিছক সন্দেহের বশে ইচ্ছে মতো আটক, নির্যাতন, নারী-ধর্ষণ, খুন, ফেক-এনকাউন্টার, রাষ্ট্রের মর্জিমতো যখন তখন ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ রাখা, ভিন্নস্বরের কন্ঠরোধ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের আটক, আর এই নানামুখী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা— কী নেই! মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত রসদই মজুত। প্রয়োজনে জনপ্রতিনিধিদেরও কপালে জোটে নজরবন্দি জীবনের অভিশাপ। মনিপুর, আসাম, অরুনাচল ও নাগাল্যান্ডে মা-বোনেদের ইজ্জত বাঁচাতে বিশেষ সেনা-আইন Armed Forces (Special Powers) Act (AFSPA)-তে কিছু শিথিলতা (flexibility) আনা হলেও কাশ্মীরের মা বোনেরদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না। অথচ এক দেশ এক আইনকে বৈধতা দেওয়ার অছিলায় রাষ্ট্রশক্তি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ করতে পিছপা হয় না। তাতে কাশ্মীরিয়াৎ তথা সাংবিধানিক রক্ষাকবচ অনুযায়ী তাদের স্বায়ত্তশাসন চুলোয় যায় যাক। জনমতের তোয়াক্কা না করে জম্মু, লাদাখ, আর কাশ্মীরকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত ক্ষেত্র করার পরেও যখন সেখানে পাক-মদতপুষ্ট সন্ত্রাস কমে না বরং বেড়ে যায়, যখন দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করাও যায় না, আর তা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করে, তখন সেখানকার মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চালচিত্র কেমন হতে পারে তা বুঝতে অসুবিধা হয় কি? 

মানবাধিকার লঙ্ঘনের একই ছবি দেখা যায় কাশ্মীরি পণ্ডিত (যারা সেখানকার সংখ্যালঘু) নিধন যজ্ঞে। তাঁরা বাধ্য হয়েছেন কাশ্মীরে তাঁদের সাতপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে জম্মু ও দিল্লিতে উদ্‌বাস্তুর জীবন আকঁড়ে বাঁচতে। দেশভাগের সময় যেমন ভারত সরকার বাধ্য হয়েছিল কোটি কোটি উদ্‌বাস্তুর পুনর্বাসন দিতে, তেমন একই স্মৃতিই যেন ফিরে আসে যখন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের জন্য কোটি কোটি টাকা সরকারি অর্থ বরাদ্দ হয়। 

শুধু কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েই পরিসংখ্যানের পর পরিসংখ্যান টানা যায়। কিন্তু পরিসরের অভাবে যেটুকু না বললেই নয় সেটুকুতেই কথা সীমাবদ্ধ রাখছি। ২০১৮-র জুনে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার কাউন্সিল অত্যন্ত উদ্‌বেগের সঙ্গে ৪৯ পৃষ্ঠার এক রিপোর্টে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের কাছেই সদর্থক ভূমিকা পালনের আর্জি জানিয়েছে। আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে, সম্প্রতি(১৯১৯) ৩৭০ ধারা বিলোপের পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। Human Rights Watch-এর দক্ষিণ এশিয়া শাখার ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলির উদ্‌বেগেই তা পরিষ্কার:

“Three years after the Government revoked Jammu and Kashmir’s constitutional status, the Indian authorities appear to be more concerned with projecting an image of normalcy than ensuring rights and accountability. The Government needs to end the assault and fundamental freedoms and act to protect minority groups at risk… . The Indian authorities should ensure justice for security force abuses and rights of Kashmiri people.”

আগেই বলেছি, কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিপূর্ণ ছবি তুলে ধরা এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। তবু যে বিষয়টির কথা না বললেই নয় তা হল, Unlawful Activities Prevention Act(UAPA)-এর যথেচ্ছ প্রয়োগ। এই আইনে কোনও প্রমাণ ছাড়াই স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে আটক করার অসংখ্য নজির নিয়ে কাশ্মীরিদের বিপন্নতা আকাশছোঁয়া। এই আইনেই মানবাধিকার কর্মী খুররম পারভেজকে আটক করা হয়। উল্লেখ্য, খুররম পারভেজ হচ্ছেন ‘Jammu and Kashmir Coalition of Civil Society’-র প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এবং Asian Federation Against Involuntary Disappearances-এর চেয়ারপার্সন। তাঁর অপরাধ তিনি হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের এবং অ-শনাক্তকৃত হাজার হাজার কবরের তদন্তমূলক ডকুমেন্ট তৈরি করেন। স্বভাবতই জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার শাখা তাঁর দ্রুত মুক্তি দাবি করে বলতে বাধ্য হয়েছে:

“… the Government continues to use the UAPA as a means of coercion to resist civil society’s, the media’s and human rights defender’s fundamental freedoms.”

নয়

ভারতের অন্যান্য প্রান্তের হালও যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষে উপযুক্ত মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য গত এক দশকে অনেকটাই প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। সেকুলার ভারতের মাটিতে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত স্থানে (public place), এমনকি রাস্তা আটকে মহা ধুমধামে পুজো করার অসংখ্য নিদর্শন থাকলেও মুসলমানদের নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে ইদানীং নিয়ম বদলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে শুধু নিষেধাজ্ঞাতেই শেষ নয়, কখনো বা তার জন্য গ্রেপ্তারি কিংবা তাদের প্রতি চড়াও হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে, যা এক দশক আগেও এ দেশে কল্পনা করা যেত না। ২০২২ -এর জানুয়ারিতে ব্যাঙ্গালুরু স্টেশনের যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে, ঐ বছরেরই মে মাসে তাজমহল চত্বরের ভিতরের মসজিদে, এবং জুলাইয়ে লখনউ-এর লুলু মল চত্বরে স্রেফ নামাজ পড়ার অপরাধে গ্রেপ্তারির ঘটনা এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে তো বটেই, সেইসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষদের ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের কাছেও বিস্ময় ও শঙ্কার। কারণ, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ভারতীয় সংবিধান সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে দিয়েছে। তাই জনসাধারণের জায়গায় (public place) উপাসনাতে নিষেধাজ্ঞা থাকলে তা সব ধর্মের মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। অথচ অবাক হতে হয় হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মনোহর লাল খট্টর টার্গেট করেছেন শুধুমাত্র মুসলমানদের। Hindustan Times (December 11, 2021)-এর  রিপোর্টে প্রকাশ, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মনোহর লাল খট্টর বলছেন: “This practice of offering namaz at public places will not be tolerated as it is leading to controversies and confrontations.”১০ স্বভাবতই, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে প্রশাসনিক স্তরে তৎপরতা তো দূরের কথা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উলটো ছবিই চোখে পড়ে। তাই Human Rights Watch-এর দক্ষিণ এশিয়া শাখার ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি উদ্‌বেগ প্রকাশ করে বলছেন: “The government has not only failed to protect Muslims and other minorities from attacks but is providing political patronage and cover for bigotry.”১১

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান রকম ভিত্তিহীন, বিদ্বেষ-মূলক মেসেজ ও ভিডিয়ো নিমেষে ভাইরাল হয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা এবং তার মারাত্মক অভিঘাত সংখ্যালঘু-সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে এক ভয়ংকর বিপন্নতা। দেশের নানান অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এমনকি বহু লিঞ্চিং-এর নেপথ্যে কাজ করছে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিকল্পনা মাফিক ছড়িয়ে দেওয়া গুজব। এছাড়াও ইতিহাস বিকৃতির এক সস্তা অস্ত্র হয়ে উঠেছে এই সোশ্যাল মিডিয়া। আপৎকালীন অবস্থায় সরকার অনেক সময় যেমন বাধ্য হচ্ছে ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ রাখতে, তেমনি তার নেতিবাচক ফল গিয়ে পড়ছে বাক্‌স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে। শুনতে অবাক লাগবে, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হয়েও শুধু ২০২২-এই দেশের নানা প্রান্ত মিলিয়ে ৮৪ বার ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে শুধু কাশ্মীরেই ৪৯ বার, রাজস্থানে ১২ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৭ বার। বাক্‌স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান অস্ত্র তথা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদ মাধ্যমের অবস্থা কেমন? World Press Freedom Day (3rd May)-তে বেরোনো রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-এর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচক (Press Freedom Index 2023) বলছে, বিশ্বের ১৮০ টি দেশের মধ্যে ভারত মাত্র ৩৬.৫ নম্বর স্কোর করে ১৬১ তম স্থান দখল করেছে, যেখানে ২০১৬-তে ভারতের জায়গা ছিল ১৩৩-এ। অথচ ভারতের প্রতিবেশী ভুটানের র‍্যাংকিং ৯০, শ্রীলঙ্কা ১৩৫, পাকিস্তান ১৫০, এমনকি তালিবানের কব্জায় থাকা আফগানিস্তানও ১৫২ তম স্থান নিয়ে ভারতের থেকে এগিয়ে। একমাত্র বাংলাদেশের চেয়ে (যার স্থান ১৬৩) ভারত সামান্য এগিয়ে। এমনকি, মাত্র একবছর আগেও ২০২২-এ ভারত ছিল ১৫০ তম স্থানে। গণতান্ত্রিক ও সেকুলার চরিত্র বজায় রাখা ও তাকে নষ্ট করার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলার স্বাধীনতার উপর ক্রমাগত এই নিষেধাজ্ঞা তো মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই শামিল। এছাড়া, অর্থের বিনিময়ে সংবাদমাধ্যমকে কায়েমি স্বার্থে পক্ষপাতিত্বমূলকভাবে ব্যবহারের নজির তো আছেই, যা মানবাধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ক্ষেত্রে এক কদর্য ও ভয়াবহ বিষয়।

পারস্পরিক সম্মতিতে সাংবিধানিক অধিকার মোতাবেক যারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তাদের অনেকেই ইদানীং এ দেশে ‘লাভ জিহাদ’ কিংবা ‘অনার কিলিং’-এর শিকার। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কী খাবে, কী পরবে, এমনকি কী ভাববে এবং কেমন করে ভাববে তাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ঠিক করে দিতে চায়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তো বটেই, তাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ কোটি কোটি সাধারণ নাগরিকও অবাক হয়ে দেখতে বাধ্য হয় ‘সেকুলার’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নতুন সংসদ ভবনের উদ্‌বোধন সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুসৃত ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী।

দশ

সুখের কথা এটাই যে ভারত সেই ব্যতিক্রমী দেশ, যেখানে বর্তমানে উগ্র হিন্দুত্বের আবহ থাকলেও এখনও পর্যন্ত ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রে আস্থাশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারমনা, প্রগতিশীলরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু একইসঙ্গে দুর্ভাগ্যের কথা হল, তাদের সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার অনেক ক্ষেত্রেই ইদানীং সুরক্ষিত থাকছে না, কারণ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক সংহতি ও যুথবদ্ধতার অভাব প্রকট। বাংলাদেশে অবশ্য বর্তমানে আওয়ামী লিগের জমানায় আগের তুলনায় কিছুটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় মোটেও সন্তোষজনক নয়। হিন্দুদের মন্দিরে কোরান রেখে এসে গোলমাল পাকানোর মৌলবাদী অপপ্রয়াস, হিন্দুদের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অশান্তি তৈরির চেষ্টা, মন্দিরের পুরোহিত হত্যার মতো কুকীর্তি ইত্যাদি আজও অব্যাহত। The New York Times (Nov.2 , 2016)-র একটি রিপোর্ট বলছে শুধু ২০১৬-তেই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে ১৫ (যদিও সরকারি মতে ৮) টি মন্দির ধ্বংস হয়েছে। Dhaka Tribune (Jan.6 , 2018) থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু ২০১৭-তেই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ১০৭ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু খুন হয়েছে, ৭৮২ জন দেশছাড়া, ২৩ জন ধর্মান্তরিত, ২৫ জন ধর্ষিতা, ২৩৫টি মন্দিরের বিগ্রহের ক্ষতি, এবং সংখ্যালঘুদের উপর ৬৪৭৪টি আক্রমণের খবর। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে শুধু ঠাকুরগাঁও জেলাতেই ৮টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৮-তে চিত্তরঞ্জন দত্ত ও তাঁর অনুগামীরা বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করতে, যা একটি অরাজনৈতিক সংস্থা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সরব। এই সংস্থার দেওয়া একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৫ বছরে ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কতটা ভরসার জায়গা তা বোঝার জন্য। কেমন সে পরিসংখ্যান? ১৯৪৭-এ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মিলে সেখানকার জনসংখ্যা ছিল ২১.৯%, ১৯৭০-এ ১৯.৯%, আর ২০২২ -এ তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯.১%, যার মধ্যে হিন্দু মাত্র ৭.৮%।  

Open Doors Website বলছে, ২০২৩-এর সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ হল খ্রিস্টানদের বসবাসের জন্য পৃথিবীর ৩০ তম খারাপ জায়গা। অথচ ২০১১-তে অনেক ঘটা করে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী আনা হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও তার সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, গত নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা ও তাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে অনেকটাই ব্যর্থ। এজন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ সংগঠন রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে অনশন ধর্মঘট করতে বাধ্য হয়েছে। সত্যি বলতে কী, যেটুকু বলা হল এই ছোট্ট পরিসরে তা বাস্তব চিত্রের তুলনায় অতি সামান্য। 

আর পাকিস্তান? যেখানে মুসলমানদেরই একটা অংশকে আহমদিয়া ও কাদিয়ানী হওয়ার অজুহাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হতে হয়, সেখানে অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা বুঝে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। স্বল্প পরিসরে সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু জলজ্যান্ত নজির সামনে আনছি, যা বিষয়টির সার্বিক চিত্রের তুলনায় মোটেও যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানের সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ নং আর্টিকল যদিও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার কথা বলে, তবু বাস্তব চিত্র বলছে অন্য কথা। জীবিকার তাগিদে ধর্মান্তরিত হওয়া, পৈতৃক এলাকা থেকে বিতাড়ন, নারীদের কিডন্যাপিং, ধর্ষণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মেয়েদের জোরপূর্বক বিবাহ, ইত্যাদি প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। আর এসবের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তৎপরতা প্রায় নেই চলে। সিনিয়র পাক সাংবাদিক মেহামল সরফরাজ The Hindu (April, 13, 2019)-তে লিখছেন: “Wealthy Muslim farmers see (Hindu Girls) as fair game for abductions, rape, and prolonged sexual exploitations in captivity. Some notorious religious establishments proudly violate these alleged crimes.”১২ মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই নির্মমতায় রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? সরফরাজ লিখছেন: “State institutions, the police and politicians have encouraged the trend by looking the other way.”১৩ অন্য একটি সংবাদ পত্র (Express Tribune, March 25, 2014)- এ All Pakistan Hindu Rights Movement-এর সমীক্ষা থেকে বলছে, ১৯৯০-এর পর থেকে গত ৩৩ বছরে পাকিস্তানে ৯৫ শতাংশ মন্দির শেষ হয়ে গেছে।১৪

শুধু হিন্দু নয়, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধরাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার, যা দেশভাগের প্রত্যক্ষ ফল। ২০১৩-এর সেপ্টেম্বর, পাকিস্তানের All Saints Church-এ আত্মঘাতী বোমা বর্ষণ কেড়ে নেয় ১২৭ জনের প্রাণ, আর গুরুতর আহত হন প্রায় ২৫০ জন। ২০১৫-তে ইউহানাবাদের রোমান ক্যাথলিক চার্চে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ১৫ জনের। Fox News (April 9, 2009)-এর একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৫-র ১ নভেম্বর থেকে ২০১৬-র ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানে ৭৬ জন খ্রিস্টান নিহত হয়েছেন, আর ১৩২৯টি চার্চের মধ্যে ৬০০টি চার্চে হামলার রেকর্ডে পাকিস্তান বিশ্বের শীর্ষে ছিল।

পাক তালিবানদের চাপানো জিজিয়া কর দিতে না পারার অত্যাচার এমন স্তরে পৌঁছায় যে যশপাল সিং নামক জনৈক শিখকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়। হাজার হাজার শিখ নিজের ভিটেমাটি ও জীবিকা ছেড়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় পেশোয়ার, নানকানা সাহিব ইত্যাদি শিখ-অধ্যুষিত এলাকায়। ২০২০-তে গুরুদ্বারা শহিদ ভাই তারু সিং দখল করে নতুন নাম দেওয়া হয় মসজিদ শহিদ গঞ্জ।১৫

যারা এভাবে গির্জা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে, তারা কি জানে আজ যে জেরুজালেম তথা প্যালেস্তাইন-ইজরায়েলের মাটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কদর্যতম নজির হাজির, সেই জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্ট চত্বরের গির্জার ভিতরে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর(রা:)-কে নামাজ পড়ার জন্য আহবান করা হয়েছিল? তারা কি এও জানে যে গির্জার অভ্যন্তরে নামাজ পড়লে ভবিষ্যতে ইসলামের অনুসারীরা সেই গির্জাকে মসজিদ বানিয়ে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় খলিফা ওমর (রা:) গির্জার বাইরে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত নেন? মানব সভ্যতার দুর্ভাগ্য, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই ঐতিহাসিক নজিরকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কদর্য নজির তৈরি হচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়, যারা এভাবে অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক মসজিদ বানিয়ে তথাকথিত ইসলামের দাওয়াত (আমন্ত্রণ) পৌঁছে দেওয়ার পুণ্যব্রত নেয়, তারাই আবার শিয়াদের মসজিদে নামাজরত মানুষদের উপর হামলা চালায়, আর আহমদিয়াদেরকে তো মুসলমানই মনে করে না। ১৯৭৪-এর সংবিধান সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাক-প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক আহমদিয়াদের মুসলিম পরিচিতিতে নিষেধাজ্ঞা আনেন। পাকিস্তানের তেহিরিক-ই-তালিবানের পাঞ্জাব শাখা ২০১০-এ আহমদিয়াদের মসজিদে হানা দিয়ে ৯৪ জনকে হত্যা করে, এবং ১২০ জন জখম হয়। ২০১৮-তে আতিফ খানকে সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয় শুধু আহমদিয়া হওয়ার অপরাধে। এমনকি, সুফিরাও ছাড় পান না। লাহোরে দাতা দরবার কমপ্লেক্সে বোমা মেরে ৫০ জনকে খুন করা হয়, আর আহতের তালিকায় প্রায় ২০০ জন। ২০১০-এর লাহোর গণহত্যা ছিল পাকিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম ঘৃণ্য নজির। এ নিয়ে জাতিপুঞ্জের তৎকালীন মহাসচিব Ban-ki-Moon, এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত Anne W. Pattern চূড়ান্ত উদ্‌বেগ প্রকাশ করেন। আর বিখ্যাত Dawn (May 30, 2010) পত্রিকাতে “Cultural Intolerance” শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখা হয়:

“Religious minorities in Pakistan have not only been shunted to the margins of society but also face outright persecution on regular basis.”১৬

এগারো

তাই যারা জিন্নাকে জাতির পিতা বলে গর্ব অনুভব করেন, তাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে যে দেশভাগ উপমহাদেশের সার্বিক চিত্র তো দূরের কথা, মুসলমানদের মানবাধিকার কতটা সুরক্ষিত করেছে। কতটা উত্তরণ তাদের হয়েছে বহির্বিশ্ব তথা সভ্যতার অগ্রগতির নিরিখে। আর যারা ইতিহাসের এই শিক্ষাকে কাজে না লাগিয়ে ধর্মীয় পরিচিতি ও উগ্র হিন্দুত্বের পিঠে চেপে আজ নতুন করে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের স্লোগান নিয়ে একটা একমাত্রিক হিন্দু ভারত তৈরির স্বপ্নে বিভোর তাদেরও চিন্তার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন বলে যারা বাংলাভাগকে হিন্দুদের জীবনে পরম প্রাপ্তি বলে বাংলাদিবস পালনের উৎসব করেন, আর সেই পালে হাওয়া লাগিয়ে যারা নতুন করে বাংলাদিবস পালনের জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখাকেও পরিবর্তন করতে দ্বিধা করেন না, তারা কি দেশভাগের অভিঘাত নিয়ে নতুন করে ভাববেন না? ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে রাজনারায়ণ বসু, নবগোপাল মিত্র প্রমুখের হাতে হিন্দু-জাগরণের নামে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণার অঙ্কুর দেখা গেল তা বিশ শতকের শুরুতে হিন্দু মহাসভা ও সাভারকরের হাতেই শুধু অক্সিজেনই পায়নি, পরবর্তীতে গোলওয়ালকর, হেডগেওয়ার প্রমুখের বদান্যতায় তা বিস্তর ডালপালা ছড়িয়েছে। এছাড়াও কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই বেশকিছু নেতা (তিলক, মদনমোহন মালব্য, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, এম.এস. আনে, বি.এস. মুঞ্জে, এম.আর.জয়াকর, এন.সি. কোলকার প্রমুখ) যে প্রকারান্তরে হিন্দু মহাসভার মতো হিন্দু ভারত তৈরির পরোক্ষ সমর্থক ও মদতদাতা ছিলেন, তাও কারোর অজানা নয়। ১৯০৯, ১৯১৮ও ১৯৩৩-এ যে মদনমোহন মালব্য কগ্রেসের সভাপতিত্ব করছেন, তিনিই আবার ১৯২৩, ১৯২৪ এবং ১৯৩৬-এ সভাপতিত্ব করছেন হিন্দু মহাসভার।

আর সেই পরম্পরাকেই বয়ে নিয়ে যারা নতুন করে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সেকুলার’ ও ‘স্যোশালিস্ট’ শব্দকে বাদ দিতে চান তাঁরা ভারতকে কোথায় নিয়ে যেতে চান তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেখানে আর যায়-ই হোক ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকতে পারেনা। আর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের মতো বহুত্ববাদী একটি রাষ্ট্রে যে পরিমাণ ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ বাস করেন তা পৃথিবীর বহু দেশের সর্বমোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি। এই ডেমোগ্র‍্যাফি এখন শুধু ঐতিহাসিক বাস্তবতা নয়, আজকের বিশ্বায়িত অর্থনীতির যুগে এ হল এক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। তাই তাকে অস্বীকার করে একমাত্রিক ‘হিন্দু ভারত’ এ শতাব্দীর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-কে কোথায় নিয়ে যাবে? একই সঙ্গে ‘হিন্দু ভারত’ আর ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ (থুড়ি, ‘ডিজিটাল ভারত’) কি সোনার পাথরবাটি না কি কাঁঠালের আমসত্ত্ব? আগামীর ভারতবর্ষে এটাই সবচেয়ে বড়ো জিজ্ঞাসা, যার উত্তর খোঁজা ভীষণ জরুরি। একইরকম জরুরি প্রতিনিয়ত ধর্মীয় সংঘাতে দীর্ণ, চূড়ান্ত অর্থনৈতিক দুর্দশায় ধ্বস্ত, ও সর্বোপরি দেশভাগের ৭৫ বছর পরেও উপযুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ একটি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা। তুলনায় বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও তা যে প্রয়োজনের তুলনায় যযথেষ্ট নয়, তাও জরুরি ভিত্তিতে ভাবা উচিত। আর এইসব ভাবনা থেকে সমাধান সূত্র তখনই বেরোতে পারে, যখন সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদ-আশ্রিত উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি ঐকবদ্ধ হয়ে প্রগতিশীলতার পথে অগ্রসর হবে। কারণ, এক দেশ ভেঙে তৈরি তিনটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ঘাত-প্রতিঘাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বাস্তবতাকে এড়িয়ে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সূত্র কল্পনা করাও ধৃষ্টতা।

তথ্যসূত্র :

১. ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, রবিবাসরীয়, “যুদ্ধসমাপ্তিই একমাত্র দাবি”, অর্ক ভাদুড়ী, নভেম্বর  ৫, ২০২৩

২. ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, তদেব

৩. Raziuddin Aquil, ‘In the Name  of Allah, Understanding Islam and Indian History’, Penguin Viking, 2009, p. 75

৪. Shamsul Islam, ‘Muslim Against Partition of India’, ভাষান্তর চিররঞ্জন সেনগুপ্ত, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, কলকাতা, ২০১৯, পৃ : ১৮৬

৫. Maulana Abul Kalam Azad, ‘India Wins Freedom’, Orient Blackswan Pvt.Ltd., 1988 Reprinted 2020, p. 97

৬. Bipan Chandra, ‘India’s Struggle for Independence’, Penguin Books, 1998, p. 432

৭. Jaswant Singh, ‘Jinnah, India-Partition Independence’, Rupa & Co, 2009 p. 485

৮. Minakshi Ganguly, ‘Human Rights Watch’

৯. ‘Human Rights Watch’, www.hrw.org

১০. ‘Hindustan Times’, December 11, 2021

১১. Minakshi Ganguly, ‘Human Rights Watch’

১২. ‘The Hindu’, April, 13, 2010

১৩. ‘The Hindu’, Apri 13, 2010

১৪. ‘Express Tribune’, March 25, 2014

১৫. ‘Religious Discrimination in Pakistan’, Wikipedia

১৬. ‘Dawn’, May 30, 2010

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান