সঞ্জীব বিশ্বাস
১৯৪৭-এর স্বাধীনতা দেশভাগকে যে অনিবার্য করে তুলেছিল এবং ভারতভাগের প্রক্রিয়াতেই যে বঙ্গ বিভাজনও অবধারিত হয়ে উঠেছিল, এ-কথা আমাদের সকলেরই জানা। এ – রকম এক ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ ‘উদ্বাস্তু’ পরিচয় নিয়ে সীমানা অতিক্রম করতে বাধ্য হয়েছেন — কেউ পূর্ব থেকে পশ্চিমে — কেউ বা পশ্চিম থেকে পূর্বে — এবং বিভিন্ন ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা ‘উদ্বাস্তু’ জীবনের মানবিক দিকগুলিকে চিত্রিত করতে প্রয়াসী হয়েছি। বলা বাহুল্য যে, এটি এক বহুমাত্রিক সমস্যা, যার সব দিকগুলিকে একটি নিবন্ধের কলেবরে অঙ্গীভূত করা অসম্ভব। তা – সত্ত্বেও উদ্বাস্তু মানুষের জীবন যন্ত্রণা এবং তাদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত নানা দিক এক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রবন্ধের উপজীব্য হয়েছ।
এক
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশভাগ সংঘঠিত হয়েছে এবং এপার বাংলা ও ওপার বাংলা মিলিয়ে যে উদ্বাস্তু স্রোতধারা বয়ে নিয়ে এসেছে, তার পরিণাম হয়েছে সুদূরপ্রসারী। বেদনায় ভারাক্রান্ত মনে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে নিজেদের পিতা-পিতামহের বাস্তুভিটা ছেড়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে অজানা পরিবেশে নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে তা ঘটনাপ্রবাহে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ‘মাইল ফলক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কেবল দক্ষিণ এশিয়াই নয়, বরং সমগ্র আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে এটিই বোধহয় সর্ববৃহৎ অভিগমন। এই ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন ঐতিহাসিক সমস্যার যেমন সৃষ্টি করেছে, সাথে সাথে খুলে দিয়েছে ঐতিহাসিক বিতর্কের এক নতুন দিগন্তও। উদ্বাস্তু সমস্যা ইতিহাসে একটা গভীর মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
শুরুতেই আমাদের জেনে নেওয়া দরকার — ‘উদ্বাস্তু’ কারা? কী তাদের পরিচয়? কী তার স্বরূপ? সংজ্ঞাই বা কেমন? ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটির ‘উৎ’ উপসর্গ যোগে উৎখাত হওয়া বা সরিয়ে দেওয়া অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট পরিসরের বাইরে চলে যাওয়ার একটা অর্থ তৈরি হয়। অর্থাৎ ‘উদ্বাস্তু’ তিনিই, যাকে তার ভিটে থেকে, ভিত্তি ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি শব্দ ‘Refugee’-র দু-টি প্রতিশব্দ আছে একটা হল ‘শরণার্থী’, যার আক্ষরিক অর্থ হল এমন কোনও ব্যক্তি যিনি কোনও ঊর্ধ্বতন শক্তির শরণ নিয়েছেন, অর্থাৎ আশ্রয় এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা করেছেন। অন্য প্রতিশব্দটি হল ‘উদ্বাস্তু’, যার অর্থ হল গৃহহীন। বৈদিক ঐতিহ্যে সংস্কৃত ‘বাস্তু’ (বাড়ি) শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। উল্লেখ্য যে, ‘বাস্তু’ শব্দের সমার্থক হিসাবে মনিয়র উইলিয়ামস্ অন্য আরও কিছু কথা বলেছেন, তা হল বাড়ির ভিত্তিভূমি। বাংলায় এই শব্দটি প্রায়ই ‘ভিটা’ (ভিটে) শব্দের সঙ্গে জুড়ে উল্লেখ করা হয়। এই ‘ভিটা’র সঙ্গে আবার সংস্কৃত ‘ভিত্তি’ শব্দটির যোগ আছে। এই ‘ভিত’-এর সঙ্গে পূর্বপুরুষ অর্থাৎ পুরুষানুক্রমিক বংশধারার একটা যোগ আছে। বাংলায় বাড়ির আর একটা প্রতিশব্দ হল ‘দেশ’। যার অর্থ — কারও নিজস্ব ভূমি, নিজের দেশ।১
বহুকাল থেকে রাজনৈতিক উৎপীড়নে, গৃহযুদ্ধে, রাষ্ট্র-বিপ্লবে, অর্থনৈতিক বিপন্নতায়, মহামারিতে, দাবানল, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বহু মানুষকে বাস্তুত্যাগ করতে হয়েছে অনেকবার। মানুষ ঠিক কবে প্রথম ‘উদ্বাস্তু’ হয় সে সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ইহুদিদের জেরুজালেম ও প্যালেস্তাইন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এর ফলে ইহুদিরা উদ্বাস্তু হিসাবে পৃথিবীর নানা জায়গায় আশ্রয় নিয়ে ‘ঘেট্টো’ বা বস্তিতে বসবাস করতে থাকে।২ ভারতবর্ষের বাস্তুচ্যুতির একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভারতে আর্যদের আগমনের পর থেকে অনেক অনার্য ‘উদ্বাস্তু’ হয়।৩ এরাই সম্ভবত ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম উদ্বাস্তু। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের রাজত্বকালে অনেক নমঃজাতির লোকেরা স্বধর্মকে মর্যাদা দিতে দেশান্তরী হয়। — পূর্ব পুরুষের ভিটা থেকে বিতাড়িত হয়।৪ এই সব বিতাড়িত মানুষ বঙ্গের বিভিন্ন জলা, ডোবা বা নিম্নাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে।৫ এক কথায় বলি যে, যুদ্ধ, নিপীড়ন, হিংসা প্রভৃতি কারণে নিজের বাসভূমি ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বা নিরাপত্তার খোঁজে ভিন্ন দেশে চলে আসা ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষকেই উদ্বাস্তু বলা হয়ে থাকে। ইতিহাসের দিকে ফিরে বলা চলে যে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে প্রধানত তিন ধরনের উদ্বাস্তু স্রোত দেখতে পাই। যাদের শ্রেণিগতভাবে তিনভাগে ভাগ করা যায় — প্রথমত প্রত্যাখ্যাত মানুষ, দ্বিতীয়ত শোষণ ও অত্যাচারের ফলে রাজনৈতিক কারণগত বাস্তুত্যাগী, তৃতীয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্বাস্তু।
ভারতের প্রসঙ্গে এসে বলি যে, দেশ স্বাধীন হবার আনন্দে সারা ভারতবর্ষ যখন বিভোর, সেই মুহুর্তে বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষকে এই স্বাধীনতা প্রাপ্তি সেভাবে আনন্দমুখর করে তুলতে পারেনি। বাঙালিরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এবং সরল জীবনপ্রণালী পরিত্যাগ করার কথা ভাবতে পারেনি। ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসে ও বাঙালির জাতীয় জীবনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সব থেকে বড়ো বিপর্যের ঘটনা ভারত বিভাজন এবং সেই সূত্রে বাংলা ভাগ। বাঙালি জাতির সামাজিক ইতিহাসে, রাজনীতি, শিল্প ও সাহিত্যে একটা নতুন শব্দের সংযোজন হয়েছে তা হল ‘উদ্বাস্তু’। ভারতে উদ্বাস্তু আগমনের প্রধান পর্যায় দু-টি। প্রথমত ১৯৪৭ এর দেশ বিভাজনের থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত, দ্বিতীয়ত ১৯৭১ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত। দু-টি পর্যায়েই বিপুল সংখ্যক মানুষ যে-ভাবে সীমানা অতিক্রম করে এসেছেন এবং যে পরিস্থিতিতে জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছেন, তা এক কথায় অ-মানবিক।
এভাবে ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রেক্ষিতে দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু সমস্যা এক দীর্ঘস্থায়ী মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই তা কম-বেশি নেতিবাচক প্রভাব বয়ে নিয়ে এসেছে। তুলনামূলক বিচারে অবশ্য পশ্চিম থেকে পূর্বে মানুষের ঢল অনেকটাই কম ছিল; কিন্তু পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসা মানুষ যেমন সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল, তেমনিই তাদের আগমনের প্রেক্ষিত ও পর্যায়গুলি লক্ষণীয় ছিল। সেদিক থেকে বিচার করলে স্বাধীনতার আগে ও পরের উদ্বাস্তু স্রোতের মধ্যে যেমন পার্থক্য করা যেতে পারে, তেমনি আবার স্বাধীনতার অব্যাবহতি পরবর্তী সময় থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে পার্থক্যগুলিও লক্ষণীয়। অবশ্য সবক্ষেত্রেই মানবিক প্রশ্নগুলি অবধারিত ভাবেই বিচার্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, বাংলায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে উদ্বাস্তু স্রোতধারার প্রধানত দু-টি পর্যায় চিহ্নিত করা গেলেও তা কিন্তু প্রায় ধারাবাহিক ভাবেই চলেছে — রাজনৈতিক কারণে তা যেন বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন সময়ে তরঙ্গায়িত হয়েছে।
দুই
ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা সবচেয়ে গভীর আকার নেয় পাঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গে। কেননা এই দু-টি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেমন বিপুল পরিমাণে জনস্রোত প্রথমেই অবিরাম আসতে থাকে, পূর্ব পাকিস্তানের চিত্রটি ছিল অনেকটাই আলাদা। আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে, এখানে যেন বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তু স্রোত তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়েছে। প্রথমে ধীরগতিতে উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে কখনও এর গতি ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ, আবার মাঝে মধ্যে উদ্বাস্তু স্রোত প্রবল বন্যার আকার ধারণ করত। কখনও পুরোপরি থামেনি, এমনকি আজও তা অব্যাহত। উল্লেখ্য যে, ওপার–বাংলার রাজনৈতিক প্রবাহের গতিপ্রকৃতি এ ধরনের স্রোতধারার কিছুটা নিয়ামক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যতদূর জানা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানত দু-টি দিক থেকে বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু স্রোত পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল। প্রথম ধারাটি ট্রেনযোগে দর্শনা এসে সীমান্ত অতিক্রম করে। দ্বিতীয় ধারাটি যশোর এসে বনগাঁ সীমান্ত অতিক্রম করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৭,০০০ জন উদ্বাস্তু প্রবেশের নজির মেলে এবং এপ্রিল ও মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতিদিন গড়ে ৪০,০০০ জন। পরবর্তীকালে এই সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় দৈনিক এক লক্ষের ঘরে। এ সব উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগেরই প্রথম ঠিকানা ছিল শিয়ালদহ রেল স্টেশনে। এখানে নেমেই কলেরা ও আন্যান্য রোগের প্রতিষেধক টিকার লাইন দিতে হত। এরপর ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের লাইনে। এই পর্ব শেষ হলে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার স্টেশনে উদ্বাস্তু শিবিরে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হত। প্লাটফর্মে থাকাকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বিনা পয়সায় চিঁড়ে ও গুড় দেওয়া হত। সরকার উদ্বাস্তুদের জন্য কেবল মাত্র এইটুকু দায়িত্ব নিয়েছিল। কারও শরীর খারাপ করলে তার চিকিৎসা করার মতো কোনও ব্যবস্থা ছিল না।৬ সেই সময়ে উদ্বাস্তুদের ব্যাগপত্র, অপরিচ্ছন্ন বিছানাপত্র প্লাটফর্মের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকত। বদহজম, ডায়েরিয়া, আমাশয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ছিল। মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক উদ্বাস্তু কলকাতা ও শহরতলির আত্মীয় ও বন্ধুদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। তাই অনেকেই আবার পুরনো আশ্রয়স্থল — সেই শিয়ালদহ রেল স্টেশনে এসে আশ্রয় নেয়। সাপ্তাহিক মাথাপিছু নগদ ২ টাকা ও শুকনো চিঁড়েগুড়ের বরাদ্দের জন্য কাড়াকাড়ি, কল থেকে জল আনবার জন্য মারামারি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ঘুমহীন রাত তাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে যায়। পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষের পানীয় জলের জন্য মাত্র তিনটি নলকূপ, পুরুষদের জন্য বারোটি, মহিলাদের মাত্র দু-টি টয়লেট। শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে তখন অসহায়-সম্বলহীন মানুষের ঢল।৭
বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত উদ্বাস্তু জীবনের এই ছবি নিঃসন্দেহে ‘ঘরপোড়া’ পূর্ববঙ্গীয় অভিবাসীদের রাজনৈতিক দাবদাহের পরিস্থিতিতে বাস্তবকে আঁকড়ে ধরে আপ্রাণ লড়াইয়ের এক অনন্য নজির। অনেকেই মনে করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার প্রথমে বুঝতেই পারেনি পরিস্থিতি কত গভীর হতে চলেছে। স্বাভাবিক কারণেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে। সময়মতো কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের জন্য আবেদনও পেশ করা হয়ে ওঠেনি। যতক্ষণে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তারা সাহায্য চান, ততক্ষণে ১৯৪৮-১৯৪৯ এর বাজেট বরাদ্দ করা হয়ে গেছে। সরকার হয়তো ভেবেছিল যে, এই উদ্বাস্তু আগমন এক সাময়িক ঘটনা মাত্র। তাই কোনও আকর্ষণীয় ত্রাণ সাহায্য ঘোষণা করেনি সরকার। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে এরা হয়তো ফিরে যাবে। সেই কারণে বেশ কয়েক বছর পুনর্বাসনের পরিবর্তে সামান্য ত্রাণ সাহায্য মাত্র দিতে দেখা গেছে।৮ এরকম একটি প্রেক্ষিতে বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় স্তরের একটা বিমাতৃসুলভ মনোভাবের অভিযোগও স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারত বিভাজন সমকালের একটি প্রজন্মকে দিয়েছে ভয়ানক আঘাত। পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বহু সংখ্যক ক্যাম্প তৈরি করা হয়। এই সকল স্থানে উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব ও সরকারি বিভিন্ন সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সকলের জন্য সুষ্ট ব্যবস্থাপনা না থাকায় সমস্যা বাড়তে থাকে। উল্লেখ্য যে, পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের মতো সমস্ত ধরনের সুযোগ-সুবিধা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বাঙালি উদ্বাস্তুরা পায়নি বলেই অভিযোগ শোনা যায়। ফলে বাংলার ক্ষেত্রে অধিকাংশ উদ্বাস্তুকে বিভিন্ন শিবির, ফুটপাথ ও রেল স্টেশনে আশ্রয় নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে।৯ পর্যায় ক্রমে ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু স্রোত আসতে থাকায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠতে থাকে। প্রথম দিকে যারা উদ্বাস্তু হয়ে এলেন, তারা পরিত্যক্ত মিলিটারি ক্যাম্পে আশ্রয় পেল। সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় কিছু মানুষ কলকাতার উপর পরিত্যক্ত সামরিক ব্যারাকগুলিতে আশ্রয় নেয়। সেগুলি পূর্ণ হলে কলকাতা ও শহরতলির ফাঁকা বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ কী হবে — আদৌ তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে কি না — তার ভয়ে সেই সময়ে সকলেই আতঙ্কিত ছিল। যদিও সরকার বিভিন্ন স্থানে উদ্বাস্তু শিবির প্রতিষ্ঠা করে এবং সেসব স্থানে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত, কিন্তু সব থেকে বড়ো সমস্যা ছিল পূর্ববঙ্গের থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সরকারি সংজ্ঞা নির্ধারণের শর্তাবলি। এতকাল পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিম বঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের সুনির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা না থাকায় পুনর্বাসনের ব্যাপারে বহু জটিল প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।১০ এই সমস্যা এদের মধ্যেকার বিত্তবান বা উচ্চবিত্ত অংশের জন্য ততটা নয়, যতটা নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ছিন্নমূল মানুষের জন্য। তার ফলে, ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে জটিলতা থেকেই গেল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের উপযোগী স্থান নেই— এই যুক্তিতে ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে উদ্বাস্তুদের শিবির স্থাপন করে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা করে। এই সূত্রে বিহারের বেতিয়া প্রভৃতি দুর্গম স্থানে উদ্বাস্তু শিবির স্থাপন করা হয়। বাঙালি উদ্বাস্তুদের যেন আবর্জনার মতো বাংলার বাইরে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুদের তুলনায় বাঙালি উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সুষ্ঠ পুনর্বাসনের পরিমাণ ছিল খুব কম এ কথা আগেই বলা হয়েছে। যদিও উদ্বাস্তু সমস্যা এই উপমহাদেশের জনজীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সামগ্রিক ভাবেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তা-সত্ত্বেও বাংলার সমস্যার গভীরতা ছিল অনেক বেশি। একথা সত্য যে, শিবির থেকে উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসন দেওয়া হয়, সেইসময় উদ্বাস্তুদের বাড়ি তৈরি, জীবিকা নির্বাহ প্রভৃতির জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কিন্তু, সব কিছুই ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়ার মতো কোনও পরিকল্পনা ছিল না ভারত সরকারের। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি উদ্বাস্তু পরিবারকে ৭ একর করে জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রক্রিয়া শুরু হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নদীতে কচুরিপানা ভেসে আসার মতো একটি বড়ো সংখ্যক মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে ঢুকে পড়ে। এই সময়ে ওপার থেকে চলে আসা অনেক হিন্দু আর স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যায়নি। তাদেরকে উদ্বাস্তু ছাড়পত্র দিয়ে দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে আগেই যে সকল উদ্বাস্তু এসেছিল তাদের থেকে কিছু অংশ নতুন উদ্বাস্তুদের দেওয়া হয়। উদ্বাস্তুদের গরিব অংশকে রাজ্যের বাইরে পাঠানো হয়। ১১
বাঙালি উদ্বাস্তুদের মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা সংলগ্ন দণ্ডকারণ্য, আন্দামান প্রভৃতি দুর্গম স্থানে পাঠানো হয়। যেসব জায়গাতে উদ্বাস্তু মানুষেরা পুনর্বসতি পেয়েছে, প্রায় সব অঞ্চলগুলিই শহরের মুখ্য এলাকা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে, যেখানে দুর্গম পথ অতিক্রম করে যেতে হত। এগুলি কার্যত পুনর্বসতি নয়। নবনির্মাণের কাজে উদ্বাস্তুদের লাগানো হয়েছে তৎকালীন সময়ে। তাদের পূর্ববর্তী বাসস্থানের সঙ্গে এই সব স্থানের পরিবেশের কোনও মিল নেই। পূর্ববঙ্গের ভূগোলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নদী, নালা, খাল-বিল ইত্যাদি। তারা কৃষি কেন্দ্রিক পরিবেশে বড়ো হয়েছে। পুনর্বাসনের পরে এসে তারা স্থান পেল সম্পূর্ণ অন্য রকমের পরিবেশে, সেখানে খাল-বিল-নদী, ফসলি জমি, পুকুর নেই। পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। কৃষি জমি সেচহীন এলাকায় ৫ একর এবং সারাবছর সেচযুক্ত এলাকায় ৩ একর। বেঁচে থাকা এখানে বড়ো কঠিন, আগেকার বাসস্থানের মতো স্বচ্ছন্দ নয়। যে অল্প ঋণ দেওয়া হয়েছে তাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিস্তিতে। ফলে, ঋণ প্রদানের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে গেছে। তিনশো টাকা হিসেবে জমি খরিদের জন্য ঋণ প্রদান করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের কোথাও এই দামে জমি পাওয়া যায় না। মোট কথা, উদ্বাস্তু ত্রাণ শিবিরগুলোতে গুটিয়ে ফেলাটাই বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন বলে ধরা হয়েছে।১২ এর ফলে তারা জীবন ও জীবিকায় চতুর্মুখী সমস্যাকে বরণ করে নিয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তু মানুষজন পুনর্বাসন ছেড়ে পালিয়ে চলে আসতে থাকে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ১৯৬৫ সালে ১০৩৫ টি পরিবার অন্যত্র চলে যায়। ১৯৬৩ সালে ১৮৫৬টি পরিবার এবং ১৯৭২ সালে যায় ৪৪৬৫টি পরিবার। সব থেকে বেশি ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুনের মধ্যে ১৪,৩৮৮টি পরিবার অন্যত্র চলে যায়।১৩ এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, উদ্বাস্তু সমস্যা ভারত তথা বাংলার পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের উপর এক ভয়ংকর রকমের আঘাত হানে, যা আজ খুব কমই ঐতিহাসিক কালপরম্পরায় আলোচিত হয়। ছিন্নমূল জনতার বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত ভাবে বসতিস্থাপন ও খানিকটা জবরদখলের মনোভাব নিয়ে জীবনযাত্রার পুনর্বিন্যাসের প্রবণতা অরণ্য ও নিম্নগাঙ্গেয় সমতলভূমি তথা জলাভূমির উপর এক মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
তিন
ঘটনাচক্রে দেশভাগের ফলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত হয়েছে বাঙালি উদ্বাস্তুরা। এই অবস্থায় উদ্বাস্তুদের অধিকার অর্জন এবং দাবি ও সমস্যার সমাধানের জন্য একাধিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয় এবং ক্রমেই তা সংগঠিত আকারে আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের বিবিধ সমস্যা সমাধানের একাধিক বড়ো শক্তি হয়ে ওঠে। এসকল সংগঠন মিলে উদ্যোগ নিয়ে এক হয়ে তৈরি হয় সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ (United Central Refugee Council — UCRC)। UCRC গঠনে যেসকল সংগঠনের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো সেগুলো হল — নিখিলবঙ্গ বাস্তুহারা কর্মপরিষদ, উত্তর কলিকাতা বাস্তুহারা কর্মপরিষদ, দক্ষিণ কলিকাতা শহরতলী বাস্তুহারা সমিতি, বলশেভিক পার্টি, সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি। এই সকল সংগঠনের প্রতিনিধিরা মিলে UCRC পরিচালনা করত। বাংলার বাইরে প্রেরিত উদ্বাস্তুদের বাঁচার লড়াই, বিভিন্ন ভবঘুরে ক্যাম্প এবং আরও সংখ্যক উদ্বাস্তুদের বিক্ষিপ্ত সংগ্রাম ইত্যাদিতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তখন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।১৪
বাংলায় চল্লিশের দশক থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়া বামপন্থা এই উদ্বাস্তু জীবনের দুঃসহ দিকটিকে সামনে রেখে তাদের চিরায়ত সূত্রেই রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে হাঁটে। এই বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ছিল বিভিন্ন কর্মসূচিতে উদ্বাস্তু জনগণকে শামিল করার একটি প্রচেষ্টা। এর অন্যতম কারণ ছিল সাধারণ মানুষের আন্দোলনে উদ্বাস্তুদের শামিল করে জমায়েত বৃদ্ধি এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে উদ্বাস্তু মানুষের একটি মেলবন্ধন তৈরি করা। এর ফলে আন্দোলনকে জোরদার করা সম্ভব হয়, অনেক মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। এই প্রসঙ্গে খাদ্য আন্দোলন ও ভূমি সংস্কার অন্দোলনের একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা বলা যেতে পারে। সাধারণ ভাবে খাদ্য সংকটে গোটা রাজ্য তখন জর্জরিত এবং স্থানীয় জনসাধারণ সেই প্রেক্ষিতে আন্দোলনমুখী। উদ্বাস্তু জনগণের মধ্যেও সেই ঢেউ পরিব্যাপ্ত। কলকাতাতে তখন উদ্বাস্তুদের খাদ্য সংকট দেখা দেয়, বাঙালি উদ্বাস্তুরা যাতে খাবারের জন্য আন্দোলন করতে না পারে সেই জন্য সরকার উদ্বাস্তুদের জন্য হুকুমনামা জারি করে। সেখানে বলা হয় সরকার বিরোধী শোভাযাত্রা বা আন্দোলনে যদি ক্যাম্পের কোনও উদ্বাস্তু অংশগ্রহণ করে তবে তার সকল সুযোগ ও সুবিধা কেড়ে নেওয়া হবে। তার পরেও উদ্বাস্তুরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে।১৫ সরকারি হুকুমনামা অবমাননা করে আন্দোলনে যোগ দিলে উদ্বাস্তুরা পুলিশি লাঠিচার্জ ও অত্যাচারের শিকার হয় এবং অনেকে গ্রেফতার হয়।১৬
তৎকালীন সময়ের নানা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন মন্ত্রক শুধুই প্রতারণা করেছে। কেবলমাত্র বেঁচে থাকার সমস্যাই বিপুল সংখ্যক এই উদ্বাস্তুদের চারিদিক থেকে করেছে আক্রমণ। আর্থিক, সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক ভিত্তি তাঁরা সম্পূর্ণ খুইয়েছেন, সভ্যতার মানদণ্ডে গেছেন নেমে, বেকারের সংখ্যাকে করেছেন গুরুতররূপে স্ফীত, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার আর্থিক পরিস্থিতির উপরে এনে দিয়েছে অসহনীয় চাপ এবং এই দুই রাজ্যের সমস্যাগুলিকে তীব্র, ভয়াবহ করে তুলেছে। সে-সময়ে পশ্চিমবঙ্গ যে অতল গহ্বরের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তার অন্যতম কারণ হল এই অমীমাংসিত উদ্বাস্তু সমস্যা। সম্পূর্ণ বাঙালি জাতিই যেন হয়ে পড়েছে কলঙ্কের ভাগী।১৭ UCRC বিভিন্ন সময়ে উদ্বাস্তুদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করলেও তার সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তা সত্ত্বেও একথা সত্য যে, দেশ ভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বৃত্তে এমন একটি ঢেউয়ের সঞ্চার করেছিল যা নাড়িয়ে দিয়েছিল এপার বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে। এর ফলে শিক্ষিত উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এই ঢেউ খানিকটা সত্যরূপে থাকলেও সাধারণ মানুষ উদ্বাস্তুদের প্রতি ততখানি বিরূপ ছিলেন না।
পঞ্চাশের দশক থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহাওয়ার চরিত্র বদলাতে শুরু করে এবং উদ্বাস্তু মানুষেরাই হয়ে উঠেছিলেন এই বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের নেপথ্য নায়ক। সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রকে উত্তাল করে তুলেছিল এই বাঙালি উদ্বাস্তুরা। এদের বাদ দিয়ে পঞ্চাশ-এর দশকের বা ষাটের দশকের এমন কি আজকের সময় পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যদিও উদ্বাস্তু জীবনের রাজনীতিকরণ কিংবা রাজনীতিতে উদ্বাস্তুদের প্রবেশ — এই প্রক্রিয়াটি কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ততটা সহজ নয়। অত্যাচার, শোষণ, অবহেলা সহ্য করতে করতে একসময় উদ্বাস্তু মননে প্রতিবাদের জন্ম হয়। প্রতিবাদই চালিত করে রাজনৈতিক আঙিনা ব্যবহার করে অভীষ্ট সিদ্ধকরণের লক্ষ্যে। এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাঙালি উদ্বাস্তুরা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে থাকে। উদ্বাস্তুরাও সময়ের সঙ্গে রাজনীতিতে তাদের নিজেদের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সক্ষম হয়। পেশাদার রাজনীতিকরা এই সুযোগে উদ্বাস্তুদের মন জয় করে সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষকে অপপ্রচারের কাজে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়ায় উদ্বাস্তু মানুষেরাও এই বাংলার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তাকে রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করার দিকটি ছিল রীতিমতো এক জটিল এবং প্রতিযোগিতা কেন্দ্রিক বিষয়। সরকারের পুনর্বাসন নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল উদ্বাস্তুদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।১৮
১৯৫০ এর দশক ছিল উদ্বাস্তু আন্দোলনের দশক। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিভিন্ন রাজ্যে উদ্বাস্তুরা পরবর্তী সময়েও আর্থিক অনগ্রসর ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। যেমন মানা পি এল ক্যাম্পের ৭০০ জন মহিলা উদ্বাস্তুকে তাঁদের মাসিক ১০০ টাকা অনুদানে ভরণ পোষণ চালাতে হত। সারা ভারত জুড়েই বাঙালি বাস্তুহারাদের প্রতি বঞ্চনার এমন অসংখ্য করুণ চিত্র রয়েছে।১৯ ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৩ হাজার দলিল প্রদান করা হয়েছে এবং ২৫টি কলোনি অনুমোদন পেয়েছে। এখন উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরকে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই পুনর্বাসনের কাজগুলি অবহেলিত হচ্ছে। বাঙালি উদ্বাস্তুদের নতুন করে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে; একদম সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী অইন তৈরি হওয়ার পরে নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ছিন্নমূল মানুষগুলির সামাজিক অবস্থান পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতেও নাগরিক অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রটি তেমন গুরুত্ব পায়নি। স্বাধীনতার পরে পূর্ববঙ্গের খুবই কম সংখ্যক হিন্দু শখ করে কলকতায় এসেছিলেন, বেশির ভাগই এসেছেন প্রাণের দায়ে। উদ্বাস্তুদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের প্রশ্নটি মানবাধিকারের বৃহত্তম আঙ্গিকে যেমন ধরা উচিত ঠিক তেমনিভাবে নৈতিকতার মাপকাঠিতেও সমানভাবে বিবেচ্য। হিরণ্ময় বন্দোপাধ্যায়ের কথায় — দেশভাগ করুণ অথচ রোমাঞ্চকর, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এই অধ্যায় সম্বন্ধে বিবরণ উত্তরকালের জন্য রক্ষিত হওয়া খুবই প্রয়োজন।২০
চার
উপসংহারে এসে বলি যে, দেশভাগের পরে অতিক্রান্ত হয়েছে ৭৫ বছর। উদ্বাস্তু সমস্যার নানা দিক এই সময়কালে বিভিন্ন ভাবে আমাদের সামনে এসেছে। যদিও একথা সত্য যে এত বছর পেরিয়ে উদ্বাস্তু সমস্যাকে ঘিরে মানবিক বিপর্যয় এখন আর তেমন ভাবে আমাদের আন্দোলিত করে না। তা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, উদ্বাস্তু সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আজও নানা ভাবে আমাদের বিপর্যস্ত করে তোলে। সাম্প্রতিক কালে নাগরিকতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ভোট রাজনীতির অমানবিক রূপ আমাদের সামনে স্পষ্ট ভাবে নিজেদের মেলে ধরেছে। যদিও অখণ্ড জাতীয়তার শেষ ঘ্রাণ নেওয়া এই বাস্তুহারাদের কাছে রাষ্ট্রের সীমানা-সংজ্ঞা উপহাসের মতো লাগে বই-কি। আজও দেশহারানো মানুষদের কাছে দেশভাগের অনুভবকে স্বচ্ছ ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ বোধহয় নেই যা দেশভাগের অতলান্ত গভীরতাকে তুলে ধরবে। আজও উদ্বাস্তুরা তাদের অধিকার না পাওয়ার ব্যথা ও দেশভাগের বেদনার স্মৃতি বহন করে চলেছে। ৭৫ বছর পরেও উদ্বাস্তুদের প্রতি উপেক্ষাও প্রবহমান।
তথ্যসূত্র :
১. সৌমেন মিত্র, ‘উদ্বাস্তু জীবন ও মানবাধিকার’, কলকাতা: মুক্তমন, ২০১৩, পৃ. ৫৫
২. ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়, ‘আন্তর্জাতিক সমস্যা প্যালেস্তাইন’, কলকাতা: মিত্রম্, ২০০৮, পৃ. ৯
৩. স্বপন কুমার বিশ্বাস, ‘সেকালের ভারতবর্ষ ও আর্য আক্রমণ’, কলকাতা: ওরিয়ন বুক, ১৯৯৬, পৃ. ২৪
৪. জগদীশচন্দ্র রায়, ‘নমঃশূদ্র কবে হল পূর্ব্বে তারা কিবা ছিল’, কলকাতা: অমর একুশে প্রকাশনী, ২০১৮, পৃ. ২৯ ও ৩১
৫. বিপুল কুমার রায়, ‘নমশূদ্রের ইতিহাস’, বাংলাদেশ: মুক্তচিন্তা, ২০১৬, পৃ. ৩০
৬. ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, কলকাতা: ৮ অক্টোবর, ১৯৪৮
৭. Prafulla K Chakaraborty, ‘The Marginal Man’, Naya Udyog, Kolkata, 1999, P. 11
৮. বুদ্ধদেব ঘোষ ও দেবব্রত বিশ্বাস(সম্পা), ‘সাতচল্লিশের দেশভাগ’, বাংলাদেশ: কথাপ্রকাশ, পৃ. ৭-১০
৯. সুজন চক্রবর্তী (সম্পা), ‘সীমান্ত পেরিয়ে সংগ্রাম : বাস্তুহারা জীবনের ইতিবৃত্ত’, কলকাতা: ন্যাশানাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০২২, পৃ. ৯
(“দেশভাগ – উদ্বাস্তু আগমন” শীর্ষক অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য)
১০. ‘যুগান্তর পত্রিকা’, কলকাতা: ১৬ জুলাই, ১৯৫৪
১১. 6th Parlament Estimate Committee 30th report, p. 55
১২. রণজিৎ রায় ‘পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু: কেন্দ্র রাজ্য দ্বন্দ্ব – রাজনীতি’, সেমন্তী ঘোষ (সম্পা), “দেশভাগ স্মৃতি আর স্তব্ধতা”, কলকাতা: গাঙচিল, ২০২১, পৃ. ৬৩
১৩. বাবুল কুমার পাল, ‘বরিশাল থেকে দণ্ডকারণ্য’, কলকাতা: গ্রন্থমিত্র, ২০১০, পৃ. ১১৫-১১৬
১৪. তুষার সিংহ, ‘মরণজয়ী সংগ্রামেবাস্তুহারা’, দাসগুপ্ত, কলকাতা: ১৯৯৯, পৃ. ১৮
১৫. সুজন চক্রবর্তী(সম্পা), ‘সীমান্ত পেরিয়ে সংগ্রাম : বাস্তুহারা জীবনের ইতিবৃত্ত’, কলকাতা: ন্যাশানাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০২২, পৃ. ৬৮ (“ছয় ও সাতের দশকের উদ্বাস্তু আন্দোলন” শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য)
১৬. ‘স্বাধীনতা পত্রিকা’, কলকাতা, ১ জানুয়ারি, ১৯৫৪
১৭. রণজিৎ রায় ‘পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু: কেন্দ্র রাজ্য দ্বন্দ্ব – রাজনীতি’, সেমন্তী ঘোষ (সম্পা), “দেশভাগ স্মৃতি আর স্তব্ধতা”, কলকাতা: গাঙচিল, ২০২১, পৃ. ৫৩-৫৪
১৮. জয়া চ্যাটার্জী, ‘দেশভাগের অর্জন’, (বাংলা অনুবাদ – অবু জাফর), বাংলাদেশ: মাওলা ব্রাদার্স, ২০২০, পৃ. ১৩৯
১৯. সুজন চক্রবর্তী (সম্পা), ‘সীমান্ত পেরিয়ে সংগ্রাম : বাস্তুহারা জীবনের ইতিবৃত্ত’, কলকাতা: ন্যাশানাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০২২ পৃ. ১১৪ (“বাংলার বাইরে উদ্বাস্তু” শীর্ষক অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য)
২০. হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘উদ্বাস্তু’, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাঃ লিঃ (প্রথম প্রকাশ), ১৯৬০, পৃ. ৭