কুমারজিৎ মণ্ডল
দেশভাগ কোনও এক জনগোষ্ঠীর উপর এক রাজনৈতিক অভিঘাত। এর ফল সুদূরপ্রসারী। কয়েক প্রজন্মের মানুষকে এর মূল্য চোকাতে হয়। এই মূল্য চোকানোর প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ হয় সেই জনপদের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চায়। এই উপমহাদেশের মানুষ সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত।
দেশভাগের অভিঘাতে মানুষকে ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হয়। ঠাঁইনাড়া হতে হয়। নতুন দেশে গিয়ে নতুন করে নিজের পরিচয় তৈরি করতে হয়। এমন অভিজ্ঞতা এই উপমহাদেশের বহু পরিবারের।
দেশভাগের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনায় সবচেয়ে বেশি যে দু-টি ক্ষেত্র উঠে আসে তারা হল অস্থাবর সম্পত্তির বাজার এবং শ্রমের বাজার।
আমরা জানি যে দেশভাগের জন্য বিরাট সংখ্যক মানুষকে ঠাঁইনাড়া হতে হয়। তাদের পরিচিত বাপ-ঠাকুরদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হয়। নতুন দেশে নতুন পরিবেশে আবার নতুন করে সংসার পাততে হয়। অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে তাদের দিন গুজরান করতে হয়। নতুন করে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে হয়। এই জীবনযুদ্ধের মর্মন্তুদ কাহিনি বিধৃত হয়ে আছে বিশ্বসাহিত্যে। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন সেসব কাহিনি।
অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখব যে এখানে অস্থাবর সম্পত্তির বাজারে যে স্থিতাবস্থা সাধারণত বিদ্যমান থাকে তাতে প্রবল আঘাত হানে এই দেশভাগ। তারফলে তৈরি হয় চাহিদা আর জোগানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। যে দেশ থেকে দল বেঁধে মানুষকে বিতাড়িত হতে হয় সেখানে স্বাভাবিকভাবে অস্থাবর সম্পত্তির জোগান হঠাৎ খুব বেড়ে যায়। তার ফলে সম্পত্তির দাম খুব পড়ে যাবার কথা। বিভিন্ন দেশে এই ব্যাপারটা দেখা গেছে। জার্মানি ভাগের পর পূর্ব জার্মানি থেকে অনেক মানুষ পশ্চিম জার্মানিতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে পূর্ব জার্মানিতে জমির দামের পতন হয়। তবে যেহেতু পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক সরকার ছিল তাই সেখানে এই পরিত্যক্ত অস্থাবর সম্পত্তিগুলো রাষ্ট্রের হস্তগত হয়। তারপর রাষ্ট্র সেই সম্পত্তিগুলো বণ্টনের ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে আমাদের ভারতভাগের পর একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বহু মানুষ পূর্বপাকিস্তান থেকে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে চলে আসে উদ্বাস্তু হিসাবে। তাদের ফেলে আসা সম্পত্তিগুলো হয় দখল হয়ে যায় ওদেশে বসবাসকারী মানুষদের দ্বারা অথবা জলের দরে তারা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। উলটোদিকে পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এদেশে স্থান সংকুলান হওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। কারণ এদেশে তখন আবাসগৃহের জোগানের থেকে চাহিদা অনেক বেশি। তাদের দামও তাই আকাশ ছোঁয়া। তাই সরকারকে এগিয়ে আসতে হয় এই উদ্বাস্তু মানুষদের গৃহ সমস্যার উপশমে। কলকাতা এবং তার সন্নিহিত অঞ্চলে গড়ে ওঠে অনেকগুলো উদ্বাস্তু কলোনি। সেখানে কোনোরকমে মাথা গুঁজে দিনগুজরান শুরু হয় অসহায় মানুষগুলোর। দিল্লি শহরে দেশভাগের সময় পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশ থেকে বহু উদ্বাস্তু পরিবার এসে হাজির হয়। তারাও মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনিতে। অবশ্য এই চিত্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশভাগের পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে সংখ্যায় অল্প হলেও কিছু মানুষ এদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছিলেন। তাদেরও নিশ্চয় সেদেশে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু সংখ্যায় অল্প হওয়ার দরুন তাদের সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তারসঙ্গে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সহায়তা তাদের ক্ষেত্রে অনেক সহজলভ্য ছিল। এদেশ ছেড়ে গিয়ে যারা পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের এদেশে ফেলে যাওয়া অস্থাবর সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল এনেমি প্রপার্টি অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে। কিন্তু সেরকম বাজেয়াপ্ত হওয়া সম্পত্তির পরিমাণ কম ছিল। তাই দিয়ে পাকিস্তান থেকে আসা সব উদ্বাস্তুদের বাসগৃহের সংস্থান হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে উদ্বাস্তুদের বাস্তুসমস্যা বহুদিন জিইয়ে ছিল।
এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন শিল্পের জন্য স্থাপিত কলকারখানাও একধরনের অস্থাবর সম্পত্তি। দেশভাগের পর এই বাংলায় তথা উপমহাদশে শিল্প সম্ভাবনার উপর জোরদার আঘাত আসে। বিশেষত বস্ত্র শিল্পে। কারণ এই শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিজ কাঁচামালের জোগান আসত পূর্বপাকিস্তান থেকে। কিন্তু কলকারখানাগুলো অবস্থিত ছিল কলকাতার আশেপাশে হুগলি নদীর দুই তীরে। দেশভাগের ফলে ভারত এবং পূর্বপাকিস্তানের মধ্যে যে পাঁচিল উঠল তাতে কলকাতার কারখানাগুলোতে কাচাঁমালের জোগান ভীষণভাবে ব্যাহত হল। ফলে বস্ত্রশিল্পের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়েছিল। বস্ত্রশিল্পের ভরকেন্দ্র যে ক্রমশ বাংলা থেকে পশ্চিম ভারতে স্থানান্তরিত হল তার মুখ্য কারণ ছিল এই দেশভাগ। কারণ পশ্চিম ভারতে গুজরাত বা মহারাষ্ট্রে কারখানা এবং কৃষিজ কাঁচামালের উৎপাদন ক্ষেত্রের মধ্যে এত দুস্তর ব্যবধান ছিল না। তাই ওখানে সরবরাহ ব্যাহত হয়নি। বস্ত্রশিল্পের অপর এই আঘাত সবচেয়ে বেশি হলেও অন্যান্য শিল্পও কমবেশি আঘাত পেয়েছিল। অনেকেই মনে করেন যে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে পশ্চিম ভারতের রমরমার অন্যতম কারণ পূর্ব ভারতের ভাগ্যাকাশে দেশভাগের এই অভিঘাত।
দেশভাগের পরোক্ষ সুদূরপ্রসারী ফলাফল বেশ উল্লেখযোগ্য। ইদানীংকালে বাংলাদেশের আর্থিক বিকাশের হার চমকপ্রদ। বিশেষ করে কৃষিতে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। পশ্চিমবঙ্গও নব্বই দশক থেকে কৃষিতে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। পশ্চিমবঙ্গের এই সাফল্যের কারণ হিসাবে ভূমিসংস্কার কর্মসূচির সাফল্যকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষিতে সাফল্য কেমনভাবে সাধিত হল সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সম্প্রতি কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন যে, দেশভাগ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক (natural) ভূমিসংস্কারের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে বৃহৎ কৃষিজোতের মালিক যারা ছিল তারা দেশভাগের কারণে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়। ফলে তাদের ওদেশে ফেলে আসা জমিজমা প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করতে অনেক সুবিধা হয়। তারফলে কোনও রকম রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়াই বাংলাদেশে ভূমিসংস্কার সাধিত হয় এবং তার ঈপ্সিত ফল সাম্প্রতিক কালে ফলতে শুরু করেছে।
শ্রমের বাজারে দেশভাগের অভিঘাত অনেক জটিল এবং সুদূরপ্রসারী। দেশছাড়া হয়ে শ্রমজীবী মানুষ নতুন দেশে আসতে বাধ্য হয়। তখন সেই নতুন দেশে শ্রমের বাজারে আকস্মিকভাবে কাজ-প্রত্যাশী মানুষের জোগান চাহিদার তুলনায় বৃদ্ধি পায়। তাতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। শ্রমের মজুরি কমে। এমন ঘটনা এই উপমহাদেশে ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর কালে ঘটেছিল। পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষী থেকেছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার। বাংলা সাহিত্যে বা নাটক এবং চলচ্চিত্রে এই সময়ের উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর দুরবস্থা লিপিবদ্ধ আছে।
অনেক দেশে এই উদ্বাস্তু সমস্যা জাতিগত দাঙ্গায় পর্যবসিত হয়েছে। ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যার কারণে তেমন দাঙ্গার নজির নেই। সেটা ভারতের তৎকালীন জাতিবিন্যাস এবং আর্থসামাজিক বিন্যাসের কারণে সম্ভব হয়েছিল।
সাধারণত উদ্বাস্তু মানুষজন যখন নতুন দেশে গিয়ে স্থিতু হতে চেষ্টা করে তখন তাদের স্থানীয় মানুষজনের তুলনায় মানব সম্পদ কম থাকে। অনেক সময় স্থানীয় শ্রমের বাজারে যে দক্ষতা প্রয়োজন তা তাদের থাকে না। কিন্তু তারা সেই মানবসম্পদ অর্জন করবে কিনা সেটা অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সাধারণভাবে তাদের এই মানবসম্পদ অর্জনের জন্য বিনিয়োগের খরচ কম। একই সঙ্গে সেই বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন খুবই বেশি। কিন্তু বাদ সাধতে পারে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তারা নতুন দেশে পাকাপাকিভাবে আশ্রয় পাবে কিনা। কিছু শরণার্থী হয়তো তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে চায়। কিন্তু তারা জানে না তারা কোনোদিন সেই সুযোগ পাবে কিনা। এই অনিশ্চয়তার কারণে তারা নতুন মানবসম্পদ আহরণে উৎসাহী না হতে পারে। এই অনিশ্চয়তার একটা মানসিক অভিঘাতও আছে। তার ফলে ওই উদ্বাস্তু মানুষগুলোর নতুন দেশের জনসমষ্টির মধ্যে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অন্তরায় সৃষ্টি হয়। তার উপর দেশভাগের কারণে উদ্বাস্তুদের যে মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাতে তাদের শরীর এবং মন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেটা তাদের মানবসম্পদকে নষ্ট করে দেয়। ফলত নতুন দেশে এসে তাদের ফলপ্রসূ কর্মোদ্যোগে শামিল হওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।
তবে সাধারণভাবে দেখা যায় যে নতুন দেশে আসার পরে পরেই উদ্বাস্তুদের শ্রমের বাজারে নিযুক্তি কম হয়। তাদের পারিশ্রমিক কম হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে। তাদের মজুরি বাড়ে। তারা স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তাদের জায়গা করে নেয়।
পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে পশ্চিমপাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা এসে যে-যে জেলাগুলোতে বসতি স্থাপন করেছিল সেই জেলাগুলো অর্থনৈতিকভাবে বেশি অগ্রসর হয়েছে। সেই জেলাগুলো সবুজ বিপ্লবের সময় খুব দ্রুত নতুন প্রযুক্তি রপ্ত করেছিল। সেটাই তাদের সমৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ।
তবে একথা সত্য যে দেশভাগকে অর্থনীতির আতস কাচে দেখাই শেষ কথা নয়। দেশভাগ যে কোনও জনসমষ্টির উপর নিদারুণ আঘাত। তাকে অর্থনীতির লাভ ক্ষতির নিক্তিতে সবটা মাপা যায় না।