অভ্র ঘোষ
ইংরেজি-বাংলায় প্রচুর বই লেখা হয়েছে এই বিষয়টি নিয়ে। ফলে নতুন কিছু বলার ভরসা রাখি না। তবু কেন লিখছি, তার একটা অজুহাত আছে। দেশভাগের দায় কার — এ-বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। সেসব ইতিহাস যৎসামান্য ঘাঁটাঘাটি করে আমার তেমন কোনও প্রত্যয় তৈরি না হলেও কিছু সংশয় বা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে — সেসব বিষয়ে দু-চার কথা বলার জন্য এই রচনা। তাও বলার কোনও ইচ্ছে ছিল না, বাধ্য করলেন ‘অভিক্ষেপ’ পত্রিকার সম্পাদক মশাই।
ভারতীয় হিন্দুদের অধিকাংশ মনে করেন মহম্মদ আলি জিন্না এই বেদনাদায়ক ইতিহাসের সর্বপ্রধান খলনায়ক। এই সিদ্ধান্ত যে খুব অমূলক তেমন বলার অভিপ্রায় আমার নয়। তবে ইতিহাসের কুশীলব একক প্রচেষ্টায় মঞ্চে হাজির হন না, বিশেষ বিশেষ প্রতিবেশ-পরিপ্রেক্ষিতের বড়োসড়ো ভূমিকা থাকে। ব্যক্তির ভূমিকার গুরুত্ব বিশ্লেষণের আগে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতগুলির হিসেব-নিকেশ জরুরি। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন জিন্না। ইসলামের ধর্মভিত্তিকে তিনি কতটা নিজে বিশ্বাস করতেন — সে-বিষয়ে অজস্র প্রশ্ন থাকলেও, এটা ইতিহাসসিদ্ধ ঘটনা যে, ১৯৪০-এ পাকিস্তান প্রস্তাব তাঁরই। কিন্তু তার আগে ইতিহাস? মুসলিম লিগ দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে। পরিপ্রেক্ষিত ছিল বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। ইংরেজ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার নবাব সলিমুল্লা এবং পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিলেন এবং মুসলিম লিগ তৈরিও হল। ঘটনাটা হিন্দু বাঙালির পছন্দ না হলেও, ঘটনার মূলে কোনও যুক্তি ছিল না — এমনটাও তো নয়। সেই সময়কার বঙ্গদেশের অর্থনীতিতে হিন্দু জমিদারদের সংখ্যা মুসলিম জমিদারের চাইতে বহুগুণে বেশি। তৎকালীন বঙ্গে নিরন্ন মুসলিম চাষির সংখ্যাও অনেক বেশি। বর্ণ-হিন্দুর চাইতে দলিত (এখনকার ভাষায়) হিন্দু-প্রজার সংখ্যাও প্রচুর। এই দলিত হিন্দুরা তো বর্ণ হিন্দুদের পেষণে দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তাঁরা তো মনে করতেন মুসলমানেরাই তাঁদের বন্ধু। দলিত নেতারাও অনেকেই তাই বলতেন। প্রকৃষ্ট উদাহরণ বরিশালের যোগেন মন্ডল। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আম্বেদকর ইসলামের দিকে ঝোঁকেননি বটে। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বাস করতেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র-পোষিত হিন্দুরা তাঁদের বন্ধু নন। ‘অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট’ গ্রন্থটিতে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ ঘোষণা এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
অতএব অর্থনৈতিক শোষণ — সামাজিক প্রভুত্ব — সাংস্কৃতিক আধিপত্য হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে অপর্যাপ্ত উপাদান যুগিয়েছে। ত্রয়োদশ শতক থেকে ইংরেজদের আগমন পর্যন্ত ভারতবর্ষে তুর্কি-পাঠান-মুঘল রাজত্বের কালে ইসলামিক আধিপত্য যেমন ছিল, ইংরেজ শাসনকালে বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্যও তেমনি ঐতিহাসিক। আঠারো-উনিশ শতকে এগিয়ে থাকা হিন্দু সমাজের আধিপত্য মেনে নিতে হয়েছিল মুসলিম সমাজকে। ফলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলমানের অংশগ্রহণ কাম্য হলেও বাস্তব ছিল না। স্বার্থের সংঘাত তো ছিলই মুসলিম মানসে। তখন থেকেই হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বেড়ে উঠতে থাকল। জাতীয় কংগ্রেসও গোড়ার দিকে এই বিষয়টিতে বিশেষ নজর দেয়নি বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে। ১৯১৫-এর পর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি এই সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার মধ্যে অগ্রগণ্য ঘটনা খিলাফৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য — হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ তৈরি করা। কিন্তু বলতে আপত্তি নেই, গান্ধির এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না, বিশেষ ফলবতী হয়নি। স্বয়ং জিন্নাই এই খিলাফতের সমর্থক ছিলেন না। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে গান্ধির বিরোধিতাই করেছিলেন। পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথেরও, কারণ কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে গঠিত প্রগতিশীল মুসলিম সমাজ সাবেকি আধিপত্যবাদী খিলাফতকে পরাস্ত করতেই চাইছিলেন। ফলে ধর্মান্ধ খিলাফৎ আন্দোলনকে ভিত্তি করে গান্ধি খুব ঠিক কাজ করেননি। ওই সাময়িক হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বেশিদিন টেকেওনি।
মনে রাখা দরকার মহম্মদ আলি জিন্না তখন যুগপৎ জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সদস্য। এবং গোখলে তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন জিন্না ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রামদূত’। ১৯২০-এর দশকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজকে নানাবিধ অধিকার প্রদানের প্রকল্প ছিল এটি। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের আকস্মিক মৃত্যুর পর তারও যথাযথ রূপায়ণ ঘটেছিল। জিন্না বিশের দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত কংগ্রেসের আন্দোলনের শরিকই ছিলেন, মুসলিম লিগের কাজকর্ম চলতে থাকলেও কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক দর-কষাকষির রাজনীতি তেমন তীব্র হয়ে ওঠেনি। গান্ধির সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূত্রপাত খিলাফৎ আন্দোলন ও তার অব্যবহিত পরে অসহযোগ আন্দোলনের কালে। ক্রমে ফাটল চওড়া হল। অসহযোগ আন্দোলনের পর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনাও বাড়তে শুরু করেছিল। গোঁড়া হিন্দুদের দল হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের মধ্যে লড়াইও বাড়তে শুরু করল। পাশাপাশি জিন্না ক্রমশই গান্ধির প্রতি বিরূপ হতে শুরু করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন থেকেই তার সূত্রপাত। ফলে জিন্নাও কংগ্রেস বর্জন করতে শুরু করলেন — যদিও ‘নিষ্ঠাবান জাতীয়তাবাদী’ আখ্যা দিতে ঐতিহাসিকরা তখনও আপত্তি করছেন না। ১৯২৪ সালের এক ভাষণে জিন্না বলেছিলেন, ‘স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য’। ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য হিন্দু-মুসলমান ঐক্য একান্ত জরুরি। প্রায় একই সময় জিন্না মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার অপরিহার্যতার দাবিও করেছেন। কারণ সেটা ছাড়া মুসলমানদের স্বার্থ ও উন্নয়ন সংরক্ষণ করা যাবে না। অন্যদিকে মুসলিম লিগ দলটারও একজন জোরদার নেতার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। জিন্না শক্ত হাল ধরলেন। ১৯৩০ সালে লন্ডনে প্রথম গোল টেবিল বৈঠকেও আবর্তন আমন্ত্রণ পেলেন। সেবার কংগ্রেস গোল টেবিল বৈঠকে ছিল না। ১৯৩০ সালেই মুসলিম লিগের এক সাংগঠনিক সভায় সভার সভাপতি যশস্বী কবি ইকবাল প্রথম স্বাধীন একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং চৌধুরী রহমৎ আলি তার নাম দিয়েছিলেন ‘পাকিস্তান’।
প্রথম গোল টেবিল বৈঠকের সময় আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য গান্ধি-নেহরু প্রমুখ নেতারা কারারুদ্ধ ছিলেন। এরপর গান্ধি-আরউইন চুক্তির ঘটনা এবং ১৯৩১ সালে দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক। গান্ধি-জিন্না-আম্বেদকর সকলেই উপস্থিত সেই বৈঠকে। ১৯৩২ সালে এরই ফল হিসেবে ম্যাকডোনাল্ড অ্যাওয়ার্ড। মুসলিম সম্প্রদায় এই ভাগবাঁটোয়ারা বাবদ কেন্দ্রীয় পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ আসন মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত হল। আম্বেদকরের দাবি অনুযায়ী দলিতদের জন্যও আসন সংরক্ষণের কথা বলা হল। দেশে ফিরে আসার পর গান্ধি আবার কারারুদ্ধ। কারান্তরালে গান্ধি আম্বেদকরের দাবির বিরুদ্ধে অনশন শুরু করলেন এবং শেষ পর্যন্ত আম্বেদকর তাঁর মূল দাবি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন। এসব বিষয় বহুচর্চিত। বিশদে যাচ্ছি না।
এরকম এক প্রতিবেশে মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের মধ্যে বিভেদ প্রসারিত হতে থাকল এবং জিন্নার সঙ্গে গান্ধি-নেহরু-প্যাটেলের দূরত্ব বা শত্রু-মনোভাব বৃদ্ধি পেল। গান্ধি অবশ্য সবসময়েই জিন্নার সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য উদ্যোগী ছিলেন। তবে জিন্না তাঁকে মোটেই পছন্দ করতেন না। মহাত্মার বদলে তিনি মি. গান্ধি সম্বোধন করতেন।
সাম্রাজ্যবাদীরা সবসময়েই ভারতীয়দের মধ্যে অর্থাৎ শাসিতদের মধ্যে বিভেদ তৈরির সুযোগ খুঁজত। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গেও তার প্রকাশ, পরবর্তীকালে বিভিন্ন বৈঠকে ও চুক্তিগুলিতেও তার বারবার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। ম্যাকডোনাল্ড অ্যাওয়ার্ড একটি বড়ো প্রস্তরফলক। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রেক্ষিতে মুসলমান জাতি-চেতনার উন্মেষও গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকল। ১৯৩৫ সালের পর থেকে জিন্নাও সেই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর নেতৃত্ব ও ক্ষমতালিপ্সা বাড়িয়ে তুলেছিলেন। নেহরু-প্যাটেলদের মতো কংগ্রেসের বড়ো মাপের নেতারা এই বিদ্বেষবোধ কমিয়ে আনতে পারেননি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো ন্যাশনালিস্ট মুসলিম নেতারাও কংগ্রেস- মুসলিম লিগের মধ্যে আপস করতে সক্ষম হননি। গোড়ার দিকে ন্যাশনালিস্ট জিন্না বিভেদকামী মুসলিম লিগের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রেক্ষিতেই ১৯৪০ সালে সাম্প্রদায়িক জিন্নার কুখ্যাত পাকিস্তান প্রস্তাব।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, এই মহাযুদ্ধে ভারতবর্ষ অংশ নেবে না, সরকারকে কোনও প্রকার সাহায্য তাঁরা করবেন না। মুসলিম লিগ সাহায্য করতে প্রস্তুত, অতএব ইংরেজ শাসকদের অনুগ্রহের মাত্রা বেড়ে গেল তাঁদের প্রতি। কংগ্রেস ও গান্ধি পরিবর্তে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্রতী হলেন। তুমুল কাণ্ড ঘটল। ওদিকে জাপানের সাহায্য নিয়ে সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করে আন্দামান পর্যন্ত অগ্রসর হলেন। ১৯৪৬ সালে ভারতীয় নৌসেনারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধকালীন পর্বেই ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় এসে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তৎপর হলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মিশনের পর মিশন প্রেরণ শুরু হল।
কিন্তু কংগ্রেস-মুসলিম লিগের দ্বন্দ্বও তীক্ষ্ণ হতে শুরু করল। দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। গান্ধি তা মানতে রাজি নন, জিন্না তাঁর বৌদ্ধিক স্তরে ঐস্লামিক চিন্তায় কতটা প্রজ্জ্বলিত — সেটা সংশয়ের স্তরে থাকলেও, ক্ষমতালিপ্সার কারণে পাকিস্তান দাবি ছাড়তে নারাজ। নেহরু খানিক উদ্ভ্রান্ত, প্যাটেলের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের সংশ্রব ছিল বলে জিন্নার রাজনীতি তাঁর কাছে অসহ্য। নেহরুও তাই, কারণটা ভিন্ন। জিন্নার দম্ভ তাঁর কাছে বরাবরই অগ্রহণীয়। জিন্নাও মতিলাল নেহরুর সঙ্গে রাজনীতি শুরু করেছেন, জওহরলালকে প্রতিপক্ষ ভাবতে তাঁর কষ্ট হত। মনে হত উদ্ধত সে এক যুবনেতা।
এই জটিল পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পরেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন পাঠালেন। মিশনের উদ্দেশ্য ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদান করা এবং দেশটিকে দ্বিখণ্ডিত না করা। এই প্রক্রিয়া অবশ্য বছর-দুয়েক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ভাইসরয় ওয়াভেল কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছিলেন, কিন্তু কোনও পক্ষকেই বাগে আনতে সক্ষম হননি। ১৯৪৪ সালে কারামুক্তির পর গান্ধিজি দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রয়াসে বারবার জিন্নার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, মরিয়া গান্ধি চোদ্দবার জিন্নার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলন এবং জিন্নার বাড়িতে বা তাঁর প্রস্তাবিত জায়গায় গান্ধিকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু জিন্না পাকিস্তান প্রস্তাব ছাড়তে নারাজ। খেয়াল রাখতে হবে, এটা কিন্তু জিন্নার ব্যক্তিগত জেদ নয়, মুসলিম লিগের অন্যান্য পদস্থ নেতৃবর্গ ও সাধারণভাবে মুসলমান সমাজের প্রবল চাপ তাঁর ওপর ক্রিয়াশীল ছিল। ওয়াভেল গান্ধিকে একেবারেই পছন্দ করতেন না, তাঁকে, অসাধু, একগুঁয়ে ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পছন্দসই ব্যক্তিত্ব ছিলেন জিন্না। কিন্তু ওয়াভেলও তাঁকে বোঝাতে পারেননি যে, ব্রিটিশ সরকার চান ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। এর পিছনে ছিল আন্তর্জাতিক বিশ্ব- জনমতের গুরুত্ব। ভারতবর্ষে দ্বিখণ্ডিত হলে যে প্রবল রক্তগঙ্গা বইবে ব্রিটেন তার দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। এতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে তাঁদের মুখ পুড়বে। কিন্তু সমস্ত দৌত্যই বৃথা হল। ওয়াভেল ‘ব্রেক ডাউন’ নীতি গ্রহণ করতে চাইলে অ্যাটলি বিরক্ত হয়ে তাঁকে ভাইসরয় পদ ত্যাগ করতে বললেন। তার আগে ১৯৪৬-এর ১৬ই মে ক্যাবিনেট মিশন ঘোষণা করল যে, মুসলিম লিগের দাবি অনুযায়ী ভারতকে দু-ভাগ করলে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুর সমস্যার সমাধান হবে না। মিশন নতুন এক পরিকল্পনা দাখিল করল। এই সময় কংগ্রেসের সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। মূলত তাঁর সুপরামর্শে ক্যাবিনেট মিশন একটি চমৎকার প্রস্তাব সামনে নিয়ে এল। মুসলিম লিগের দাবি ছিল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক। ক্যাবিনেট মিশন জানাল, পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজন দুই রাজ্যের অধিবাসীদের এক অতি বৃহৎ অংশের স্বার্থ ও ইচ্ছার বিরোধী হবে। অতএব দেশের অখণ্ডতা বজায় রেখে বিভিন্ন দলের দাবি সমন্বয় করে একটি নতুন পরিকল্পনার কথা ভাবা যাক। এই পরিকল্পনার অস্যার্থ হল একটি ‘শিথিল যুক্তরাষ্ট্র’ (Loose Federaion) তৈরি করা। অর্থাৎ একটি কম ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে — যার হাতে থাকবে পররাষ্ট্র ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যোগাযোগ দপ্তর। এই তিনটি বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতাও এই ইউনিয়ন সরকারের হাতে থাকবে। বাকি সব ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতে ন্যস্ত হবে। প্রদেশগুলিকে তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করা হবে। এক, অমুসলমান ও হিন্দু প্রধান রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি বিভাগ। দুই, মুসলমান প্রধান রাজ্যগুলিকে নিয়ে আর-এক গোষ্ঠী। তিন, বাংলা ও অসম প্রদেশের গোষ্ঠী, যেখানে হিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যায় বিরাট পার্থক্য নেই। মিশন শেষোক্ত এই তৃতীয় বিভাগের যে আসন সংখ্যা স্থির করে দিয়েছিল তাতে এই গোষ্ঠীতে মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা অমুসলমান প্রতিনিধিদের চেয়ে দু-টি বেশি থাকত। পাঞ্জাবের জলন্ধর ও আম্বালা নিয়ে যেসব সমস্যা ছিল — এই পরিকল্পনায় তারও নিষ্পত্তি ঘটবে। আর বাংলায় কলকাতা শহরকে নিয়ে যে টানাপোড়েন ছিল — তারও মীমাংসা এতে হয়ে যাবে। বস্তুত মুসলিম লিগ যেসব দাবি সামনে নিয়ে এসেছিল তার বেশিরভাগ অংশই এই পরিকল্পনায় মেনে নেওয়া হয়েছিল, একমাত্র ইউনিয়ন সরকারের অখণ্ডতা বজায় রেখে। জিন্নার পক্ষে এই সমঝোতার বিরুদ্ধতা করার কোনও উপায় ছিল না। কারণ তাঁর প্রধান দাবি ছিল মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশে কংগ্রেসি হিন্দুদের আধিপত্য তাঁরা স্বীকার করেন না।
মৌলানা আজাদ তো বটেই, গান্ধি এই পরিকল্পনাকে দু-হাত তুলে সমর্থন জানালেন। নেহরু-প্যাটেল খুব উল্লসিত নন, কিন্তু কংগ্রেসের হাই কম্যান্ড প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিল। তবে অসম বিষয়ে কংগ্রেসের কিছু ভিন্ন মত ছিল। মুসলিম লিগ ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে বলেছিল যে, এই পরিকল্পনার কোনও কিছু আর পরিবর্তন করা যাবে না। কংগ্রেস জানাল এই পরিকল্পনায় প্রদেশকে যে-ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা প্রয়োগ করে অসম গোষ্ঠী ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে, তার ওপর অবাঞ্ছিত কোনও চাপ সৃষ্টি করা চলবে না। মুসলিম লিগ কিন্তু এসব কথা মানতে চাইল না।
ইতিমধ্যে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির কার্যকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল। মৌলানা আজাদের পরামর্শক্রমে জওহরলাল নেহরু নতুন সভাপতি হলেন। এ.আই.সি.সি. ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিলেও অসম সম্পর্কে ভিন্ন মত ছিল, আগেই উল্লেখ করেছি। নতুন সংবিধান তৈরি করার সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কংগ্রেসের নতুন সভাপতি নেহরু তাঁর এক ভাষণে বললেন, ‘We are not bound by a single thing except that we have decided to go into the Constituent Assembly’। এক প্রেস সাক্ষাৎকারে নেহরু জানালেন কংগ্রেস গণপরিষদে যাবে, কিন্তু গণপরিষদের সার্বভৌমিকতা, কার্যপদ্ধতি ও সিদ্ধান্ত বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি তোলার কোনও অধিকার নেই। অসমের বিষয়টি নিয়েও কিছু পরিবর্তন করতে হতে পারে। অর্থাৎ ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান সর্বতোভাবে কার্যকর হবে কি-না — খানিকটা সংশয় তৈরি হল। ক্যাবিনেট মিশন-এর প্রস্তাব জিন্নার মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু মুসলিম লিগের প্রভাবশালী বেশকিছু নেতা এবং সাধারণভাবে মুসলিম জনসমাজ পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি ছেড়ে দেওয়ায় জিন্নার প্রতি শুধু অপ্রসন্ন নয়, খানিকটা মুখর হয়ে উঠেছিল। জিন্নাও সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে এই প্রস্তাব থেকে বেরিয়ে আসা যায় — নেহরুর ওই সামান্য বক্তব্যটুকু তাঁর সুবিধে করে দিল। জিন্না ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অস্বীকার করলেন। ১৯৪৬ সালে তদুপরি ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করে বসলেন। কলকাতায় ‘গ্রেট কিলিং’ হল, নোয়াখালিতে তার পালটা নেওয়া হল, তার পালটা ঘটনা ঘটল বিহারে। পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল।
ওয়াভেলের পরিবর্তে মাউন্টব্যাটেন এলেন ভারতবর্ষে ভাইসরয় হয়ে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির নির্দেশ ছিল ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এবং সেটা যদি ঐক্যবদ্ধ ভারত হয়, তাহলে উত্তম। প্রাণপণ চেষ্টা চালানো আমাদের কর্তব্য। মাউন্টব্যাটেনের কার্যাবলি তার অভিমুখেই ছিল। পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের বোঝাপড়াও হল। কিন্তু জিন্নাকে ঐক্যসূত্রে আনা গেল না। কলকাতা, নোয়াখালি, বিহারের দাঙ্গা প্রশমনে গান্ধি তখন পূর্ব-ভারতে। কলকাতায় অনশন, নোয়াখালিতে গ্রামের পর গ্রামে শিবির করে থাকা। বিহারে কংগ্রেস সরকারকে দাঙ্গা বন্ধ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ — ইত্যাদি বিষয়ে গান্ধি তখন প্রবল ব্যস্ত।
দেশের অন্য প্রান্তে পাঞ্জাবের পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সমগ্র দেশেই প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি গান্ধিকে না জানিয়েই দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নিল। নেহরু-প্যাটেলের এই সিদ্ধান্তে গান্ধি মর্মাহত হলেন। বুঝলেন যে তাঁর আর কোনও গুরুত্ব নেই। তবে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘The British cannot give us our freedom. They can only get off our backs… It is not for the British Government to change the map of India. All it has to do is to withdraw from India, if possible in an orderly manner, may be even in chaos, but withdraw in any case on or before the date it has itself fixed.’ গান্ধি ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার দিকে ফিরে যেতে চাইছিলেন। বলেছিলেন, দেশভাগ সহ্য হবে কিন্তু ইংরেজ কর্তৃক নয়। তাঁর তখনও আশা মাউন্টব্যাটেন তাঁর কথা শুনবেন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন না। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান, ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেল। র্যাডক্লিফ তাঁর দলবল নিয়ে দেশভাগের সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করে দিলেন। বাংলা, অসম, পাঞ্জাব ভাগ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন ব্রিটেনের অধীশ্বরী। আর জিন্না আক্ষেপ করে বললেন, পোকায় খাওয়া (Moth-eaten) পাকিস্তান তাঁকে স্বীকার করতে হল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় বিপর্যস্ত হল গোটা উপমহাদেশ, নেতারা আশ্বাস দিলেন দেশভাগ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে। ট্র্যাজিক নায়ক গান্ধি পরাজিত হলেন, তাঁর চিরকালীন অস্ত্র — ‘অনশন’ ব্যবহার করে তিনি কলকাতায় সুহরাবর্দিকে নিয়ে বেলেঘাটার জীর্ণ মঞ্জিলে রয়েছেন। স্বাধীনতার উৎসবে তাঁর উৎসাহ নেই, সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথাও বলেননি। দাঙ্গা আর দেশভাগ তাঁকে মর্মাহত করেছে। আর এদিকে প্রবল দাঙ্গার মধ্যে দেশভাগ তো হলই, সঙ্গে এল প্রবল উদ্বাস্তু সমস্যা। যার জের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও কাটেনি।