সুরেশ কুণ্ডু
ধর্মীয় মৌলবাদের উৎস
মানবসমাজে মৌলবাদ এসেছে ধর্মীয় চেহারা ও চরিত্র নিয়ে। মানববিভাজনের বার্তা বহন করে। মানববিভাজন, অংশে অংশে মানববিরোধ প্রতিষ্ঠার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দিতে মৌলবাদের আবির্ভাব। মৌলবাদের সংজ্ঞা তার স্বরূপের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। একটাই মানব প্রজাতিকে বহুত্বে বদলে দেবার বাণী বহনকারী মতবাদ হল মৌলবাদ। বিজ্ঞান মানবপ্রজাতির একত্বের প্রমাণ রাখে। ধর্ম সেখানে মানুষের শ্বেত-পীত-কালোর নজির দিয়ে মানবপ্রজাতির জিনগত অভিন্নতা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
ইংরেজি ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ কথাটার সুবাদে বাংলা ‘মৌলবাদ’ কথাটার জন্ম। বিষয়টার ইংরেজির পড়াশোনা দিয়ে তৈরি এই আলোচনাটা। আমরা এখানে ‘মৌলবাদ’ শব্দটাই ব্যবহারে রাখছি।
মৌলবাদ কথাটা একুশ শতকে মানবজীবনের একটি জ্বালানো-পোড়ানো শব্দ। এই সময়ে এই শব্দটার শিকড় খুঁজতে হচ্ছে বিশ শতকের শুরুর প্রোটেস্টান্ট আমেরিকার ধর্মত্ব ‘থিয়োলজি’র মধ্যে। আরও একটা ঘটনায় ধর্মীয় মৌলবাদের আধুনিক উৎস খোঁজা যায়। বলা হচ্ছে, এটা শুরু হয়েছে ১৯৮০ দশকের শেষ এবং ১৯৯০ দশকের শুরুতে। ঘটনা হিসেবে বার্লিন ওয়ালের ধ্বংস এর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের উল্লেখ রয়েছে।
আরও খানিক পিছিয়ে ১৯২৫ সালের একটা ঘটনার কথা বলা যায়। এটা আমেরিকার টেনেসি রাজ্যের ঝড়-তোলা ‘মাঙ্কি ট্রায়ালে’র কথা। বিদ্যালয়ে জীববিদ্যার শিক্ষক জন স্কোপস্ তাঁর ক্লাসে বিবর্তনতত্ত্ব পড়াচ্ছিলেন। প্রশাসন আর খ্রিস্টধর্মীয় বিরোধিতা এই শিক্ষককে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাল। বিচারে শিক্ষকই জয়ী হলেন। কিন্তু সামনে চলে এল ধর্মীয় মৌলবাদের মূল কথা। সংক্ষেপে সেটা হল, বিবর্তনবাদ না-মানুষী প্রাণীদের সাথে মানুষের আত্মীয়তার কথা বলে। এটা ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মবিরোধী। সৃষ্টিকর্তা বিশেষ বিবেচনায় আলাদাভাবে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখকষ্টের মূলে রয়েছে বিবর্তনবাদ শিক্ষণ। তাই জেনেসিসের (genesis) তিনটি তত্ত্ব রক্ষা করতে বাকি সব বই ধ্বংস করা দরকার।
এটুকু বলে ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মীয় মৌলবাদের কৃশ পরিচয় দেওয়া গেল। ইসলাম ধর্মেও ওই দুই ধর্মের মূল কথার সাথে সহমত রয়েছে। তফাত শুধু ভাষার। আগের দুটো ধর্মের ‘অ্যাডাম’ ও ‘ইভ’ ইসলামের কাহিনিতে হয়ে গেল ‘আদম’ ও ‘হাওয়া’। হিন্দুধর্মে ‘মনু’ থেকে ‘মানব’। সব ধর্মই মানবসৃষ্টি তত্ত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরোধিতা করে।
মৌলবাদ দেশে দেশে
ইহুদি মৌলবাদ বাইবেলের জেনেসিস তত্ত্ব থেকে তৈরি। এটির বর্তমান পোষক রাষ্ট্র ইজরায়েল। আমেরিকা রাষ্ট্রের উৎপত্তির ধর্মগত ভিত্তি প্রোটেস্টান্ট ধর্ম। এই ধর্ম-প্রেরণায় আজও ওদেশের একাধিক রাজ্যে বিবর্তনবাদকে বিদ্যালয়-শিক্ষার বাইরে রেখেছে। ইসলাম ধর্মীয় মৌলবাদ কথাটা প্রথম বলেন, বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ এইচ. এ. আর. গিব তাঁর ‘Mohammedanism’ (পরের শিরোনাম ‘Islam’), বইটিতে। তিনি প্যান-ইসলামিক সংস্কারক ও রাজনৈতিক কর্মী জামাল আল্-দিন আল্-আফগানির প্রসঙ্গটাও টানেন। তিনি নাকি আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ রুখতে ধর্মীয় ঐতিহ্য বাঁচাতে লাগাতার সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। ভারতের ক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদের উৎস আরও প্রাচীন। সেটা শুরু হয়েছিল ‘মনু স্মৃতি’র সময় থেকে। সেই ধারা আধুনিক সময়ে ‘হিন্দুত্বে’র রাজনৈতিক মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতত এটুকুই মৌলবাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ নিয়ে আলোচনা।
মৌলবাদের দর্শন
আমেরিকান মৌলবাদীরা ধর্ম ও দেশপ্রেমের মধ্যে বিরোধের কথা মানেন না। ওদেশের প্রায় সবাই ধর্মবিশ্বাসে খ্রিস্টান। অবশ্য খ্রিস্টধর্মগত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার পার্থক্য থেকে ওই একই ধর্মের নানা সংগঠন রয়েছে। ধর্মবিশ্বাসের প্রায় অভিন্নতা থেকে দেশপ্রেমের ঐক্যমত তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রের মুদ্রায় ছাপা আছে In god we believe। রিপাবলিকান নেতা প্যাট রবার্টসন বলেছিলেন, আমাদের দেশটা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এর কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিদ্যালয়ের প্রার্থনা বন্ধ হয়েছে এবং গর্ভপাতের অনুমোদন দিয়ে নরহত্যা করার ব্যবস্থা করেছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ফিরতে হবে ঈশ্বরের কাছে। এমন কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল কতিপয় ইসলামি লেখক ও ইতিহাসবিদের কাছে। তাঁরাও বললেন, ইসলামি আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র না চললে ইসলামের নানা বিপর্যয় ঘটবে। মানুষের তৈরি আইন কখনোই সৃষ্টিকর্তার আইনের বিকল্প হতে পারে না। একজন প্রভাবশালী লেখক, Abul Ata Mawdudi, মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদ ধর্মের বিপরীত ভাবনা। তাঁর মতে, আল্লাহ-ই সার্বভৌম এবং তাঁর কম্যান্ডমেন্টস্-ই হল ইসলামের আইন (Law of Islam)।
ঢেউ এল ভারতে
জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমকে ধর্মের সাথে জড়িয়ে দেবার চেষ্টা, আমেরিকা ও ইসলামি দুনিয়ার মতো, ভারতেও যথাসময়ে পৌঁছে যায়। আধা-ধর্মীয় এবং আধা-রাজনৈতিক সংস্থা বা সংঘ ভারতে এ-ব্যাপারে অগ্রণী ও অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। আগে শুরু হলেও ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের দিনগুলোতে এমন প্রবণতা বেগবান হয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়েই হিন্দু ধর্মের বাহ্মণ্যবাদ এবং মুসলিম ধর্মের ধর্মীয় আবেগ মঞ্চে অবতীর্ণ হল। এই দুটো শক্তিই তো পুরোপুরি ধর্মীয় মৌলবাদের চরিত্র অর্জন করে ফেলেছে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের চেষ্টার অপ্রতিরোধ্য শক্তি স্বাধীনতার রাজনৈতিক অভিমুখ ধর্মের দিকে সরিয়ে দিল। ধর্মের ভিত্তিতে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ দাঁড় করাতে গিয়ে মৌলবাদ হলাহল রাজনীতির আবহটাকেই বিষক্রিয়ায় ভরিয়ে দিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর হিন্দু ও মুসলমানের আপ্রাণ যৌথযুদ্ধ থাকল না। ভাগ হয়ে গেল দুটো ধর্মের ধর্মযুদ্ধে।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগেই
শুরু হয়ে গেল ধর্মদাঙ্গা। ইতিহাস যাকে ছেচল্লিশের দাঙ্গা বলে চিহ্নিত করেছে। সেই শুরু। এই সাল ও সময় অবধি ভারতে ছোটো-বড়ো মাঝারি অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে ও ঘটছে। ধর্মদাঙ্গার বৈশিষ্ট্যই হল, যতদিন ধর্ম ততদিন এমন দাঙ্গায় যতিচিহ্ন টানা যায় না।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথাবার্তা, যুক্তি-চুক্তি, উদ্যম-উদ্যোগ, অখণ্ড ভূভাগের খণ্ড খণ্ড ভাগ-বাটোয়ারা, স্বাধীনতা অর্জন নয়, হস্তান্তরের দিনক্ষণের সর্ব শর্ত ধর্মীয় মৌলবাদী ভাবনার নিয়ন্ত্রণে এসে গেল। ধর্মীয় নাটকের এই পর্বে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নাটকের নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক ছিল ব্রিটিশ শক্তি।
দেশভাগের পটভূমিকা
এটাই হল সেটা। এই হল ধর্মীয় দেশভাগের করুণ ও মর্মান্তিক ইতিহাস। ভেসে গেল রাজনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের ত্যাগ-তিতিক্ষা সব কিছু। ক্ষুদিরামের ফাঁসির দড়ি যে-সংগ্রাম শুরু করেছিল, ভগৎ সিং-এর ফাঁসির দড়িতে সে-সংগ্রামের সমাজতান্ত্রিক ভারত গঠনে পরিণতি পেল না। হয়ে উঠল, আজও হয়ে রইল, ধর্মমনস্ক অসফল রাষ্ট্র।
সাতচল্লিশের দেশভাগ কী দিল দেশের মানুষদের? শ্রেষ্ঠ উপহারটির নাম দেশত্যাগ। নিরীহ, নির্বিরোধী, অসংখ্য মানুষের ভিটেমাটি, রুজি-রোজগার, স্থানীয় ও আঞ্চলিক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, প্রজন্ম-প্রেম, বসবাসের আবেগ ও ইতিহাস সবকিছু দিতে হল। পেতে হল ঘাম-কান্না-রক্ত। ক্ষুধা-রোগব্যাধি-বেকারত্ব। শূন্য থেকে জীবন, অর্ধ জীবন অস্তাচলের জীবনে এসেও, শুরু করতে হল আবার!
ভারতভাগে আরও দুটো ভাগ
দেশভাগ বলতে শুধু অখণ্ড ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি বোঝায় না। ধর্মীয় মৌলবাদের দেশভাগের আরও ‘তাৎক্ষণিক অবদান’-এর প্রয়োগ দেখলাম আমরা। হ্যাঁ, ‘প্রতিক্রিয়া’ শব্দটাকে ব্যঙ্গ করতে ‘অবদান’ বললাম আমি। ধর্মবাদী মানুষের সংখ্যার অনুপাতে দু-ভাগ হল অভিন্ন পাঞ্জাব। ভাগ হয়ে গেল অভিন্ন বাংলা। বাসভূমিকে বধ্যভূমি তৈরি করার এমন চক্রান্তে শামিল করা হল আমাদের। একেই বলি ধর্মীয় মৌলবাদের ‘চেইন রি-অ্যাকশন’। গোটা পৃথিবীর দেশে দেশে এই রাজনৈতিক কেমিস্ট্রির কত যে-মিষ্ট্রি তার ইয়ত্তা নেই।
তীব্র আঘাত মনোভূমে
দেশভাগের আর-একটি রি-অ্যাকশন হল বাধ্য ও বধ্য দেশত্যাগী মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ট্র্যাজেডি। দেশভাগ লক্ষ-কোটি মানুষের মন-মনন তছনছ করে দিয়েছে। মনোভূমি অনাবাদি করে ছেড়েছে। উদ্বাস্তু মানুষদের মনের বিপর্যয়ের হদিস কে, কতটা দিতে পারলেন, জানা নেই। পরিসরের কার্পণ্যে এখানে আমরা দু-জনে টাটকা অভিজ্ঞতার কথা জানাব। একজন বর্তমানে আমেরিকার প্রবাসী ভারতীয় জেনেটিক অঙ্কোলজিস্ট ডাক্তার সিদ্ধার্থ মুখার্জী। অন্যজন অবিভক্ত ভারতীয় লেখক সাদাত হোসেন মান্টো। ডা. মুখার্জী স্বপরিবারে পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় উঠেছিলেন। আলোচ্য বিষয়টা নিয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি তাঁর ‘The genes’ বইয়ে। তিনি তাঁর দু-জন আপন ভাইয়ের মনোরোগী হয়ে ওঠার তীব্র ট্র্যাজেডির কথা প্রায় সবিস্তারে জানিয়েছেন। দুই ভাই রাজেশ ও জগু কলকাতায় ছেচল্লিশের দাঙ্গা, ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্ট পরবর্তী গণহিংসা সেই ছোটো বয়সেই চাক্ষুষ করেছে। হিংস্রতা আর নরমেধ যজ্ঞের এটা-সেটা কাহিনিও পৌঁছেছিল ওঁদের কানে। এর ফলে মানসিক ট্রমার শিকার হন ওঁরা। পরিণতিতে বদ্ধ মনোরোগী। মনোবিকারের সে-সময়ে প্রাপ্ত চিকিৎসা ওঁদের রোগমুক্ত করতে পারেনি।
উপরের আলোচনার সূত্রে ডা. মুখার্জী সাদাত হোসেনের প্রসঙ্গ টেনে লেখকের একটি ছোটো গল্প ‘টোবা টেক সিং’-এর প্রসঙ্গটা তোলেন। সদ্য বিভাজিত ভারত ও পাকিস্তানের একটা ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ ছিল। গল্পের চরিত্র টোবা টেক সিং ওই আনক্লেইমেড্ ভূমিটুকুতে একটি গাছে উঠে পড়েন। দু-দেশের জন-বিনিময়ে তিনি শামিল হবেন না কিছুতেই। দেশভাগের উদ্বাস্তু বিনিময়ের এই অমানবিক ঘটনাকে তিনি তীব্র ধিক্কারে জর্জরিত করেন। টোবা টেক সিং মানুষটার কোনও দেশ নেই। বিভাজনপূর্ব অখণ্ড ভারতের নাগরিক তিনি। একটি নাগরিকত্ব কেন ত্যাগ বা বর্জন করবেন তিনি? অন্য একটি নাগরিকত্ব কেনই-বা গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে তাঁকে? বর্জন আর অর্জনের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে তাঁর অনুভূতির মধ্যে উদ্বাস্তুর মানবিক যন্ত্রণা ভাষা পেল।
দেশভাগে লক্ষ-কোটি মানুষের এমন মানসিক বিপর্যয় কতটা মানবিক সমীক্ষার বিষয় হয়ে উঠল, জানতে বড়ো সাধ হয়। এটা না জানলে, আমার মনে হয়, দেশভাগের মর্মান্তিক ইতিহাস জানাটা খণ্ডিত হয়েই থাকল।