দ্বিখণ্ডিত ভারত

গোপাল চন্দ্র সিন্‌হা

স্বাধীন ভারত। পরাধীন ভারত। অখণ্ড ভারত। দ্বিখণ্ডিত ভারত। এইসব শব্দগুলি শুধু এখন নয় ভারত স্বাধীন হবার কিছুকাল আগে থেকেই বেশ প্রচলিত। প্রসঙ্গত বলা যায় বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশ শব্দদুটি ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতীয় ভূখণ্ডের সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে প্রারম্ভিক পর্বে কিছু ইতিহাস সম্মত তথ্য আলোচনা করে নেওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। কারণ আগে তো বীজ। তারপর অঙ্কুর। এরপর ক্রমান্বয়ে চারাগাছ, যৌবন, মহিরুহ, প্রবল ঝড়ঝাপটায় তার ভাঙন এবং পরে আবার নতুন করে গঠন ও চলমানতা।

এক

দেশ অর্থে ভারতবর্ষ বিষয়ক ধারণা গড়ে উঠেছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। ভারতীয় এবং বিদেশীয় উভয় তথ্যসূত্রে নানা নামে ও নানা ভাবে এর প্রকাশ লক্ষ করা যায়। প্রথমেই ভারতীয় তথ্যসূত্রগুলির উপর আলোকপাত করা যায়। ভারতবর্ষ নামটির মধ্যে ‘ভারত’ শব্দটির একটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ রয়েছে এবং তা হল ভরতের বংশধর। ‘ভরত’ নামটি একটি জনগোষ্ঠী বা উপজাতি হিসাবে বারে বারে উল্লেখিত হয়েছে ঋগ্বেদ (আনুমানিক ১৫০০ খ্রিঃ পূঃ – আনুমানিক ১০০০ খ্রিঃ পূঃ)–এর সপ্তম থেকে দশম মণ্ডলে এবং ঐ কৌম বা উপজাতি গোষ্ঠীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে রাজা সুদাসের অসামান্য বীরত্ব, সামরিক সাফল্য ও দানশীলতার খতিয়ান বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, রাজা বিশ্বামিত্রের নেতৃত্বে পুরু, অনু, যদু প্রভৃতি দশটি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাভি নদীর তীরে সুদাস চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিলেন। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হিসাবে ভারতবর্ষ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিঃ পূঃ প্রথম শতকের শেষভাগে উৎকীর্ণ প্রাকৃত ভাষায় লেখা কলিঙ্গের রাজা খারবেলের হাতিগুম্ফা প্রশস্তিতে। প্রাকৃতভাষায় শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে ‘ভরধবষ’ নামে, যা ভারতবর্ষ নামের অভিন্ন রূপ বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা। তবে এই প্রশস্তিতে ‘ভরধবষ’ বা ভারতবর্ষের এলাকা হিসাবে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে না বুঝিয়ে মগধ ও মথুরার অন্তর্বর্তী গাঙ্গেয় উপত্যকাকে বোঝানো হয়েছে। এর প্রায় চারশো বছরেরও অধিককাল পরের রচনা বিষ্ণুপুরাণে ভারতবর্ষের একটি স্পষ্ট ভৌগোলিক সংজ্ঞা ও পরিচিতি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। এর একটি শ্লোকে বলা হয়েছে —

"উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষং তদ্ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ॥"

এই শ্লোকটির অর্থ হল সমুদ্রের উত্তরে ও হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত যে বর্ষ বা দেশ তার নাম ভারতবর্ষ। এই ভূখণ্ডে বাস করেন ভরতের উত্তরসূরিবৃন্দ (সন্ততি)। এইভাবে বিষ্ণুপুরাণে ভারতবর্ষ বলতে আসমুদ্র হিমাচল এক বিশাল ভূখণ্ডকে বোঝানো হয়েছে।

ভারতবর্ষ অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশ প্রাচীনকালে পরিচিত ছিল ‘জম্বুদ্বীপ’ নামে, যা সমকালীন ও প্রায় সমকালীন শিলালৈখিক ও সাহিত্যিক উপাদান থেকে প্রমাণিত হয়। প্রসঙ্গত বলা যায় মৌর্য সম্রাট অশোক (আনুঃ ২৭৩ খ্রিঃ পূঃ – ২৩২ খ্রিঃ পূঃ)–এর প্রথম অপ্রধান শিলালেখতে তাঁর অধিকৃত সুবিশাল সাম্রাজ্য ‘জম্বুদ্বীপ’ নামে উল্লেখিত হয়েছে। এর থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে বর্তমান ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামগ্রিক ভূখণ্ড অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশ বা অবিভক্ত ভারতবর্ষ অশোক তথা মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। এই বিষয়টি বিশেষভাবে প্রমাণিত হয় ওই সামগ্রিক ভূখণ্ডে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপি ও প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ণ অশোকের অসংখ্য লেখমালা বা অনুশাসন (Edict) থেকে। উল্লেখ্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে এটাই হল প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য (আনুঃ ৩২৪ খ্রিঃ পূঃ – ১৮৫ খ্রিঃ পূঃ) এবং এখানে প্রচলিত ছিল একটি অতি কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা। অশোকের লেখমালা ছাড়াও ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য যথা অগ্নি, মৎস্য ও পদ্মপুরাণে এবং মহাভারতে ভারতবর্ষ অর্থে ‘জম্বুদ্বীপ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে যেহেতু ভারতবর্ষের বাইরের নানা এলাকার মানুষ এই উপমহাদেশে এসেছিলেন অথবা এই উপমহাদেশ সম্পর্কে নানা সূত্রে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন সেহেতু বিদেশীয়দের লেখা ও বক্তব্যের মধ্যেও এর ভৌগোলিক পরিচিতি ও ধারণা বর্ণিত হয়েছে। গ্রিক ও চিনা লেখকদের বিবরণে এই উপমহাদেশ মূলত ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান ও শেন-তু— এই তিনটি নামে পরিচিত ছিল। এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। শুধু একথা উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে যে জিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় পাঁচশো বা তারও আগের মানুষ গ্রিক লেখক হেরোডোটাস ভারতীয় উপমহাদেশে না এসেও পারসিক সূত্র (পারস্যের অ্যাকামেনিড বংশের শাসক প্রথম দরায়ুসের নকস্-ই-রুস্তম লেখ) থেকে তথ্য আহরণ করে তাঁর ‘হিস্ট্রি’ গ্রন্থে ‘ইন্দোই’ বা ‘ইন্দিয়া’ শব্দের উল্লেখ করেছেন, যা অনেক পরবর্তীকালে ইন্ডিয়া নামে উচ্চারিত হতে থাকে। তবে মনে রাখা দরকার ঐ ‘ইন্দোই’ বা ‘ইন্দিয়া’ তখন পারসিক শাসক প্রথম দরায়ুস (খ্রিঃ পূঃ ৫২২ – খ্রিঃ পূঃ ৪৮৬ অব্দ)-এর শাসনাধীন প্রদেশ হিসাবে পরিচিত ছিল। প্রসঙ্গত বলা যায় এই প্রদেশটি তখন নিশ্চিতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ অর্থে ব্যবহৃত হত না। এর অবস্থান ছিল তখন সিন্ধুনদের উপরে (বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সঙ্গে অভিন্ন)। আর ‘হিন্দুস্তান’ নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পারস্যের সাসানীয় বংশের শাসক প্রথম সাপুরের ২৬২ খ্রিস্টাব্দের নক্স-ই-রুস্তম্ লেখতে। ‘হিন্দুস্তান’ তাঁর বিজিত এলাকাগুলির মধ্যে একটি — এই তথ্যটি সেখানে উল্লেখিত হয়েছে। প্রসঙ্গত পারসিকরা ‘সিন্ধু’ কে উচ্চারণ করত ‘হিন্দু’ নামে। সুতরাং হিন্দুস্তান নামটি মুসলমান লেখকরা দিয়েছিলেন বলে যে ধারণা সাধারণভাবে প্রচলিত আছে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আবার চিনা লেখক ফ্যান-ই (খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধের মানুষ) তাঁর ‘হৌ-হান-শু’ গ্রন্থে ‘শেন-তু ও তিয়েন-চু’ শব্দের উল্লেখ করেছেন যা প্রাথমিকভাবে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলকে বোঝাত। তবে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের গোড়ার দিক থেকে ঐ চিনা নাম দু-টির ভৌগোলিক সীমানাভুক্ত হয়েছিল খুব সম্ভবত সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ।

এখন সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রে যে পট পরিবর্তন ঘটেছিল সে ব্যাপারে সংক্ষেপে উল্লেখ করে মূল আলোচনায় আসব। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২৪ খ্রিঃ পূঃ-১৮৫ খ্রিঃ পূঃ)-র পতনের পরে পরেই ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের ধারণা ভেঙে যায়। এই সময় থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিদেশীয় শক্তিসমূহ যেমন গ্রিক, শক, পার্থিয়ান, কুষাণ এবং দেশীয় শক্তিসমূহ যেমন শুঙ্গ, কান্ব ও সাতবাহনরা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের গোড়া পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। এরপর খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরাংশে প্রথমে গুপ্তরাজবংশ (৩২০ খ্রিস্টাব্দ – ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং তারপর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে সেখানে স্থানীয় ভিত্তিতে যথাক্রমে পুষ্যভূতি, মৌখরী, মৈত্রক ও বিভিন্ন রাজপুত রাজবংশ যেমন গুর্জর-প্রতিহার, পরমার, গাহড়বাল, চৌহান, চন্দেল্ল, গুহিল এবং পূর্বভারতে যথাক্রমে শশাঙ্ক, পাল ও সেনরা শাসন করেছিলেন ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর-ভারতে দিল্লিকে কেন্দ্র করে সুলতানি প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত। ওই একই সময়কালে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে স্থানীয় ভিত্তিতে শাসন করছিল কয়েকটি রাজবংশ যথা বাকাটক, কদম্ব, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, পল্লব, চোল, হয়সল প্রভৃতি শক্তিগুলি।

ত্রয়োদশ শতকের গোড়া (১২০৬) থেকে ষোড়শ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত (১৫২৬) ভারতবর্ষ বিশেষ করে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরাংশের সমস্ত ভূখণ্ড শাসিত হয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কি শাসকদের দ্বারা, যাঁরা দিল্লিকে কেন্দ্র করে সুলতানি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছিলেন। আলোচ্য সময়কালে অবশ্য দক্ষিণ ভারতে স্থানীয় ভিত্তিতে দু-টি শক্তিশালী সাম্রাজ্য যথা বিজয়নগর (হিন্দু) ও বাহমনি (মুসলিম) শাসকরা শাসন করছিলেন। ১৫২৬ থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত সময়কালে মধ্য এশিয়া থেকে আগত দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুঘল শাসকরা (বাবর থেকে ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত) ভারতবর্ষে তাঁদের আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। এখানে মনে রাখা দরকার যে মুঘল আমলে ঔরঙ্গজেবের সময়ই কেবল সমগ্র ভারতবর্ষ এক শাসনাধীনে এসেছিল। আবার একথাও ঠিক যে ১৭০৭-এ তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় ও বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক রাজশক্তি সমূহের উত্থান ঘটে। এ প্রসঙ্গে বাংলা, মহারাষ্ট্র, মহীশূর, পাঞ্জাব, হায়দরাবাদ প্রভৃতির নাম করা যায়।

এর পরবর্তীকালের ইতিহাস আমাদের প্রায় সকলেরই জানা এবং তা হল পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)–এ বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বাভাস দেয়। এরপর তিনটি ইউরোপীয় শক্তি তথা বাণিজ্যিক কোম্পানি যথা — ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচদের মধ্যে ভারতের বাণিজ্যিক আধিপত্য স্থাপনের জন্য লড়াই এবং সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয় লাভ (১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের ইংরেজ শক্তির একাধিপত্য স্থাপনের পূর্ণ সুযোগ এনে দেয়। এরপর থেকে নানা কৌশলে ধাপে ধাপে সমগ্র ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৭৬৫-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরে ব্রিটিশ রাজশক্তি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সরাসরি ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।

অপরদিকে কিছু স্বার্থপর ও লোভী জমিদার মহাজন শ্রেণির মানুষ ছাড়া আপামর জনসাধারণ যথা মহিলা, কৃষক, শ্রমিক, উপজাতি তথা নিম্নশ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়া শ্রেণি এবং বিশেষভাবে সত্যিকারের কিছু খাঁটি দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য মরণপণ সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিলেন। ক্ষুদ্র-বৃহৎ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যথা— ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড ব্লক, অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রভৃতি নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ ও আদর্শ অনুযায়ী ব্রিটিশ শাসনকে ভারত থেকে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কখনও স্থানীয় ও সর্বভারতীয় স্তরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আবার কখনও বৈপ্লবিক আদর্শ ও খাঁটি দেশপ্রেমকে পাথেয় করে বিদেশীয় শক্তি বিশেষ করে ব্রিটেনের শত্রুদেশের সঙ্গে সাময়িক গাঁটছড়া বেঁধে অসংখ্য বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন ভারতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। সেই বিশেষ তারিখটি ছিল ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭।

প্রারম্ভিক ওই আলোচনার পর এখন দু-টি বিষয় সম্পর্কে বিশদে আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয় হবে। প্রথমত প্রাক্‌স্বাধীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা লাভ ও দ্বিখণ্ডিত ভারত। দ্বিতীয়ত ভারত-বিভাগ কি অবশ্যম্ভাবী ছিল? একে কি কোনোভাবেই আটকানো যেত না? এবং এই বিষাদময় বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য দায়ী কে বা কারা? এই দু-টি বিষয়কে যথাক্রমে দুই ও তিন নম্বর পর্যায়ে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে। বস্তুত ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদানের সময় যে দ্বি-খণ্ডিত ভারত (ভারত ও পাকিস্তান)–এর সৃষ্টি করা হয়েছিল তার মধ্যে স্পষ্টতই নিহিত ছিল দ্বিখণ্ডিত বাংলার বীজ, যা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণরূপ লাভ করে। তবে এ বিষয়ে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের তরফে লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে বাংলাকে বিভক্ত করার সক্রিয় প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল অনেক আগে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার মাধ্যমে, যা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। বরং এর সূত্র ধরে বাংলা তথা ভারতের জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয়েছিল।

দুই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু (সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) হবার সময় থেকেই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে থাকে, যা পক্ষান্তরে ভারতের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল। কারণ এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী দু-টি প্রতিপক্ষ (অক্ষশক্তি জোট ও মিত্রশক্তিবর্গ)-এর মধ্যে মিত্রশক্তি জোটের অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল গ্রেট ব্রিটেন। বলা বাহুল্য, দীর্ঘকাল (১৯৩৯-১৯৪৫) ধরে যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থাকার দরুন ভারতে তার ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ১৯৪৫-এর সেপ্টেম্বরে জাপান তথা অক্ষশক্তি জোট মিত্রশক্তি বর্গের কাছে আত্মসমর্পণ করলে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং সমগ্র বিশ্বের ওপর এর কম-বেশি প্রভাব পড়ে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ভারতবর্ষ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে অক্ষশক্তি জোটের সঙ্গে সাময়িকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভূতপূর্ব বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট বিপ্লবের দরুন স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ এদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অস্তিত্বে সংকট সৃষ্টি করেছিল। যুদ্ধোত্তর পর্বে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতার দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, আজাদ হিন্দ বাহিনীর কয়েকজন বন্দি সৈন্যের মুক্তির দাবিতে (১৯৪৫-১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ) — গণসংগ্রাম প্রবল আকার ধারণ করে। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজ নিজেদের মধ্যে বিভেদ ভুলে গিয়ে এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। বস্তুত, দিল্লির লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের বিচার ও তার প্রতিক্রিয়া এবং এর সূত্র ধরে বোম্বাই (মুম্বাই)–এ ১৯৪৬-এর ১৯শে ফেব্রুয়ারি যে নৌবিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় যে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা ব্রিটিশ সরকারকে স্তম্ভিত করে দেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি যথাযথই অনুভব করেন সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপস্থিতি তাঁর উপস্থিতির থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। এর সঙ্গে পুন্নাপ্রা-ভায়লার সংঘর্ষ (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দ) যুক্ত হয়ে গণজাগরণকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এসব কিছুর ফলে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অস্তিত্বে সংকট সৃষ্টি হয়। অপরদিকে দীর্ঘস্থায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত থাকার ফলে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের সামরিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে। আবার যে ভারতীয় সেনা ও নৌবাহিনীর ওপর নির্ভর করে সরকার এদেশে শাসনের শক্ত মুঠি ধরে রেখেছিল তারা অসন্তুষ্ট ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠায় গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার মতো মানসিক দৃঢ়তা বিনষ্ট হয়েছিল। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের পতন যে আসন্ন তা বুঝতে দেরি হয়নি প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলি তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। তবে দাম্ভিক ইংরেজ সরকার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ভারতবর্ষ পরিত্যাগ না করে এদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তর তথা স্বাধীনতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখা যাবে যে এ ব্যাপারে সরকার বেশ তৎপরতা দেখায়।

প্রধানত পাঁচটি বিষয় যথা ওয়াভেল পরিকল্পনা (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ), ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ), অন্তর্বর্তী সরকার গঠন (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ), মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা, (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ও সর্বোপরি ভারতের স্বাধীনতা আইন (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)-এর মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশভাগের বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়।

গভর্নর জেনারেল লর্ড লিনলিথগো উত্তরসূরি লর্ড ওয়াভেলের সময়কাল (অক্টোবর, ১৯৪৩ – মার্চ, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)-এ দেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল আকার ধারণ করে। এর সমাধানের জন্য ওয়াভেল ১৯৪৫-এর মার্চে ইংল্যান্ডে যান এবং প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ও ক্যাবিনেট সাবকমিটিতে আলোচনা করেন। তিনি শর্তাধীনে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের প্রস্তাব দিলে তা তখন গৃহীত হয়নি। পরে তিনি ভারতে ফিরে এলে ভারত সচিব জন আমেরি ১৯৪৫-এর ১৪ জুন ওই শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে একটি ঘোষণা জারি করেন, যা ‘আমেরি-ওয়াভেল’ পরিকল্পনা বা ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এরপর ওই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৪৫-এর ২৫ জুন সিমলায় একটি সম্মেলন আহূত হয়, যেখানে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, শিখ সম্প্রদায় ও অন্যান্য দলের মোট একুশ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যোগদান করেন। ওই সম্মেলন চলেছিল ১৪ জুলাই পর্যন্ত। সিমলা সম্মেলনে ওয়াভেল যে পরিকল্পনা উত্থাপন করেছিলেন তার প্রধান কয়েকটি বিষয় হল — (১) ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী সভায় ভাইসরয় ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া কাউন্সিলের অন্যান্য সমস্ত সদস্যদের নিয়োগ করা হবে ভারতীয়দের মধ্য থেকে। (২) ভাইসরয়ের ওই সভায় যতদূর সম্ভব ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত করা হবে এবং সেক্ষেত্রে বর্ণহিন্দু ও মুসলমানদের সংখ্যা সমান হবে। এবং (৩) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ভারতীয়রা সম্মিলিতভাবে একটি নতুন সংবিধান তৈরি করবে। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সদস্যদের মধ্যে ঐ পরিকল্পনা সম্পর্কে মতভেদ থাকায় এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অতঃপর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তরফে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। আসলে যুদ্ধোত্তর পর্বে ভারতের রাজনৈতিক জটিলতা ও বিভিন্ন প্রান্তে গণবিক্ষোভ থেকে মুক্তি লাভের জন্য ব্রিটিশ সরকার দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এই সময় ব্রিটেনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ১৯৪৫-এর সাধারণ নির্বাচনে শ্রমিক দল বিজয়ী হলে শ্রমিক নেতা ক্লিমেন্স অ্যাটলি নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হন।

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি কমন্স সভায় এক বিবৃতিতে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং এব্যাপারে ভারতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে আলাপ আলোচনার জন্য একটি ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণের সিদ্বান্ত ঘোষণা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের তিন সদস্য যথা লর্ড পেথিক লরেন্স, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, এ ভি আলেকজান্ডারকে ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তাঁরা ভারতে এসে পৌঁছান ২৪ মার্চ। কংগ্রেসের পক্ষে আবুল কালাম আজাদ এবং মুসলিম লিগের পক্ষে মহম্মদ আলি জিন্না সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। মন্ত্রী মিশনের প্রধান আলোচ্য বিষয়সূচি ছিল দুইটি — (১) স্বাধীনতা অনুমোদনের জন্য নতুন সংবিধান রচনার পদ্ধতি ও নীতি এবং (২) ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে চূড়ান্ত ঐক্যমতের ওপর ভিত্তি করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন।

মন্ত্রী মিশনের আলোচনা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল সমকালীন ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল যথা জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে। উল্লেখ্য, এই দু-টি দল তাদের পরস্পর রাজনৈতিক কর্মসূচির বিষয়ে বেশ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত বলা যায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৭-৯ এপ্রিলে দিল্লিতে মুসলিম লিগ বিধায়কদের সম্মেলনে পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে দাবি করা হয়। বলা হয় যে, উত্তর-পূর্ব আসাম ও বাংলা প্রদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অপরদিকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ১৫ এপ্রিল দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন যে ঐক্যবদ্ধ ভারত এবং পূর্ণ স্বাধীনতাই জাতীয় কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্য। উল্লেখ্য, ছয়টি মুসলিম প্রধান প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠনের যে দাবি জিন্না তুলেছিলেন ক্যাবিনেট মিশন তাকে অবাস্তব বলে বাতিল করে দেয়।

অতঃপর রাজনৈতিক স্তরে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে বারবার আলোচনার পর মন্ত্রী মিশন ১৯৪৬-এর ১৬ মে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে ঘোষিত একটি প্রস্তাবে জানায় যে, ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার জন্য একটি ত্রিস্তরীয় শিথিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো থাকবে, যার অন্তভুর্ক্ত থাকবে প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলি। বলা হয় সর্বোচ্চে অধিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে থাকবে প্রতিরক্ষা, বিদেশ বিভাগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও এই কাজগুলি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায়ের অধিকার। এর বাইরে বাকি সমস্ত ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে এবং এই সরকারগুলির জোট গঠন করার স্বাধীনতা থাকবে। সমগ্র ভারতবর্ষের জন্য একটি সংবিধান রচনা করার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক আইনসভাগুলির দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সাংগঠনিক সভা গঠন করার কথা বলা হয়। ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের বাইরে ভারতের তিনটি অংশ থাকবে। প্রথম অংশটি গঠিত হবে প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশগুলি নিয়ে। এগুলি হল মাদ্রাজ, বোম্বাই (মুম্বাই), উত্তরপ্রদেশ, বিহার, সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও উড়িষ্যা। দ্বিতীয় অংশটির অন্তর্ভুক্ত করা হয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলি যথা পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশ এবং তৃতীয় অংশে রাখা হয় বাংলা ও আসাম। বলা হয় এই নতুন ব্যবস্থা অনুসারে নির্বাচনের পর যে কোনও প্রদেশ ইচ্ছা করলে জোট বাঁধতে পারবে। স্থির হয় যে, নতুন সংবিধান চালু না হওয়া পর্যন্ত একটি জাতীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। আরও বলা হয় যে, সংবিধান সভার সদস্যরা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। এই সভা কর্তৃক সংবিধান রচনার কাজ সম্পূর্ণ হলে ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারত বিভাগের বিষয়ে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবের ভালো মন্দ দিক নিয়ে এখন আলোকপাত করা যাক। এই বিষয়ে ঐতিহাসিক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা একমত নন। বি এন পান্ডে ভারতের এক কঠিন রাজনৈতিক সংকটের সময় মন্ত্রী মিশনের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “The cabinet Mission plan was the best that could be devised to maintain the unity of India at critical period of Indian history১০”। মনে হয়েছে, এই প্রস্তাবে প্রদেশগুলিকে যেভাবে তিনটি অংশে ভাগ করা হয়েছিল তার ভিত্তিতে বোঝা যায় যে, মুসলিম জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। এক কথায় এই প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের পরস্পরবিরোধী দাবিগুলির মধ্যে মোটের ওপর একটা সমঝোতা রক্ষা করার চেষ্টা নেওয়া হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ মুসলিম লিগের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মহম্মদ আলি জিন্নাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “Jinnah had to admit that there could be no fairer solution of the minority problem than that presented in the cabinet Mission plan১১”। কিন্তু একথাও ঠিক যে মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনার মধ্যে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারাও ছিল। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবি বা ভারত-বিভাগের কথা প্রত্যক্ষভাবে ঘোষিত না হলেও পরোক্ষভাবে প্রদেশগুলিকে হিন্দুপ্রধান ও মুসলিমপ্রধান— এই দুইটি ভাগে বিভক্ত করে ও প্রয়োজনে তাদের জোট বাঁধার অধিকার প্রদান করে ভারত-বিভাগের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে বলিষ্ঠ আকার ধারণ করে।

ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য থেকেই যায়। উভয় রাজনৈতিক দলই ওই প্রস্তাবের মধ্যে ভালো, মন্দ উভয় দিকই লক্ষ করেছিল। মুসলিম লিগ বিশেষ করে মহম্মদ আলি জিন্নার কাছে মনে হয়েছিল মিশনের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত পূর্ণ সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে১২। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৪৬-এর ৬ জুন মুসলিম লিগ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নেয়। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর কংগ্রেসও প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি বাদ দিয়ে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ২৯ জুন মন্ত্রী মিশন ভারত ত্যাগ করে। এরপর থেকে অবশ্য কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবের কিছু কিছু বিষয়ে মতদ্বৈততা প্রকট হয়, যার চূড়ান্ত সমাধান করা ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

১৯৪৬–এর জুলাই মাস থেকে মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সংঘাত ব্যাপক আকার ধারণ করে। প্রসঙ্গত বলা যায় ৬ই জুলাই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি ক্যাবিনেট মিশনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে শর্তসাপেক্ষে অনুমোদনের কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এর মাত্র চারদিন পরেই ১০ জুলাই জাতীয় কংগ্রেসের নতুন সভাপতি জওহরলাল নেহরু (তাঁর আগে ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ) মুম্বই-এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে সাংবিধানিক সভায় অংশ গ্রহণ করা ছাড়া কংগ্রেস অন্য কোনও কিছুতেই রাজি নয়, এবং খুব সম্ভবত গ্রুপ ব্যবস্থাও ভেঙে যাবে কারণ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আসাম এই ব্যবস্থায় রাজি নয়১৩। তাঁর এই বিবৃতির তাৎক্ষণিক ফল শুভপ্রদ হয়নি। কেননা, এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাটি আপাতত বাস্তবায়িত হল না। সবচেয়ে বড়ো কথা হল জিন্না তথা মুসলিম লিগ নেহেরুর ওই বিবৃতিকে কংগ্রেসের চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করতে থাকে। এরই ফলস্বরূপ মুসলিম লিগের কার্যকরী সমিতি ক্যাবিনেট মিশনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে এর আগে যে অনুমোদন দিয়েছিল ১৯৪৬–এর ২৯ জুলাই তা প্রত্যাহার করে নেয়। আবুল কালাম আজাদ মুম্বাই-এ সাংবাদিক সম্মেলনে জওহরলালের ওই বিবৃতিকে চিহ্নিত করেছেন “ভারত ইতিহাসের অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা”১৪ হিসাবে। কারণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দেশভাগ রদ করার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল এর ফলে তাও বন্ধ হয়ে গেল। আসলে জিন্না ইতিপূর্বে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যে অনুমোদন দিয়েছিলেন পরে নানা কারণে তার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। নেহেরুর ওই ঘোষণা তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছিল।

অতঃপর জিন্না মুসলিম সম্প্রদায়কে আন্দোলনভিত্তিক রাজনীতির জন্য নতুনভাবে প্রস্তুত করার কাজে মনোযোগী হন। সমস্ত সাংবিধানিক পথকে বিদায় জানিয়ে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট দিনটিকে ‘Direct Action Day’ বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস বলে ঘোষণা করেন — শুরু হয় পাকিস্তানের দাবিতে গণ-আন্দোলন। কংগ্রেসকে অন্তবর্তী সরকার গঠন না করতে দেওয়াও ছিল এর একটি তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য। কারণ যাই হোক না কেন, বাংলার মুসলিম লিগ প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি ১৬ আগস্ট দিনটিকে ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করেন। মুসলিমদের বলা হল তারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ সভা, পাকিস্তান প্রস্তাবের অর্থ ব্যাখ্যা করে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা বাতিল করার কারণ দেখিয়ে ওই দিনটিকে পালন করবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬-১৯ আগস্ট কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। শুরু হয় ভারত ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। উল্লেখ্য, ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই কলকাতার মানিকতলায় মুসলিম মিছিল বের হয়। তাদের স্লোগান ছিল “লেকর রহেঙ্গে পাকিস্তান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”। এর সাথেই শুরু হল নির্বিচার হিন্দু আক্রমণ। এর বিরুদ্ধে হিন্দুরাও পালটা আক্রমণ চালায়। এর ফলে কলকাতায় এক নৃশংস ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই ঘটনা ইতিহাসে কলকাতার মহা হত্যাকাণ্ড (The Great Calcutta Killing) নামে পরিচিত। এর পরিণাম হিসাবে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় প্রায় পনেরো হাজার মানুষ এবং গৃহহীন হয় প্রায় লক্ষাধিক১৫। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ভারতের অন্যত্র যথা বোম্বাই, নোয়াখালি ও যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ)-এর গড়মুক্তেশ্বরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বীভৎস আকার ধারণ করে। সুমিত সরকার তাঁর ‘Modern India’ গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন যে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ থেকে নজিরবিহীন দাঙ্গার ফলে গোটা ভারতের প্রেক্ষাপট অতি দ্রুত পালটাতে থাকে।

এখন প্রশ্ন হল যে, কলকাতা ১৯৪৬-এর ফেব্রুয়ারি ও জুলাই মাসে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাক্ষ্য রেখেছিল, সেখানে মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে এই ধরনের বীভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কারণ কী? এক কথায় এই প্রশ্নের সদুত্তর আজও মেলেনি। তথাপি বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের গবেষণায় এ ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস এ ব্যাপারে একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হল, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার কুখ্যাত দাঙ্গার সময় থেকে প্রাদেশিক রাজনীতিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে। ওই সময় থেকেই মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভা সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িক ভাগে বিভক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন১৬। জয়া চ্যাটার্জীও এ ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের মূল কথা হল ১৯৪০–এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাংলার হিন্দু সংগঠনগুলি যথা হিন্দু সভা, হিন্দু মহাসভা ও ভারত সেবাশ্রম সংঘ, তাদের স্বেচ্ছাসেবীদের আধা সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল১৭। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুরঞ্জন দাসের বক্তব্য হল, এই সময় “উচ্চকোটির ও সাধারণ মানুষের সাম্প্রদায়িকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়”, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ, যা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে চূড়ান্তরূপে বিস্ফোরিত হয়েছিল১৮। এতৎসত্ত্বেও মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাবে উল্লেখ থাকা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মোট ১৪ জন সদস্যের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হন। ১৯৪৬–এর ২৪শে আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে গঠিত হবে তা ঘোষণা করা হয়। বলা হয় যে, ১৪ জন সদস্যের মধ্যে দুজন মুসলিম সদস্যের নাম আপাতত ফাঁকা রেখে (এছাড়াও তিনজন মুসলিম সদস্যের নাম উল্লেখিত ছিল) ১২ জন সদস্যের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। ২ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হল এবং জওহরলাল নেহরু হলেন এই সরকারের সহ-সভাপতি তথা প্রধানমন্ত্রী ও ওয়াভেল হলেন সভাপতি। ওয়াভেলের বারবার আহ্বানে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জিন্না তথা মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান করে কংগ্রেসকে নানাভাবে সংকটের মধ্যে ফেলা এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে সরকারের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে কর্মপন্থা স্থির করে তা কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি।

ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ছাড়াও সংবিধান সভা বা গণ পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছিল। এক্ষেত্রে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে মতৈক্য হয়নি। উল্লেখ্য, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে গণ পরিষদ গঠিত হয় এবং ৯ ডিসেম্বর প্রথম অধিবেশনে মুসলিম লিগ যোগদান করেনি। এর ফলে সংবিধান সভার পক্ষে একটি স্থায়ী সরকার গঠনের উপযোগী শাসনতন্ত্র রচনার কাজ বিঘ্নিত হয়। এইভাবে একদিকে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাত এবং অপরদিকে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে পারস্পরিক অসহযোগিতার নীতি ভারত অখণ্ড থাকবে কিনা সেই প্রশ্নটিকে জাগ্রত করে তুলল। এরপর থেকে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বিশেষ সংশয় থাকল না — সংশয় প্রকট হতে থাকল ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে কিনা সেই আশঙ্কাকে কেন্দ্র করে। ইতিমধ্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফ্রেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি হাউস অফ কমন্সে স্পষ্টতই ঘোষণা করেন যে ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ইংরেজরা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেই। এর পাশাপাশি তিনি ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে সরিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের নতুন ভাইসরয় হিসাবে দায়িত্বভার দেন। মূল উদ্দেশ্য, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাইসরয় হিসাবে কার্যভার গ্রহণের পরে পরেই সারা ভারতে প্রায় গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থায় শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধি, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, মহম্মদ আলি জিন্না, লিয়াকৎ আলি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৬ মে-র মধ্যে তিনি প্রায় ১৩৩টি সাক্ষাৎকার নেন। একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তিনি পরস্পর বিরোধী ও ভিন্ন ভিন্ন মতামত পান। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর দু-টি ধারণা জন্মায় — (১) ১৯৪৬-এর মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা কার্যকরী করা যাবে না এবং (২) দেশভাগ ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এরপর ১৯৪৭-এর ১৪ এপ্রিল মাউন্টব্যাটেন তাঁর পারিষদবর্গ যথা ভি পি মেনন, এরিক মিভিল প্রমুখর সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে একটি পরিকল্পনা রচনা করেন, যা ‘Plan Balkan’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ এই পরিকল্পনায় ভারতবর্ষকে ইউরোপের বলকান রাষ্ট্রগুলির মতো খণ্ড খণ্ড করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য, ভারতের এই খণ্ডীকরণ প্রথম সারির প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক নেতারাই প্রত্যাখ্যান করেন।

অতঃপর পূর্ববর্তী ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের সচিবালয়ের উচ্চপদস্থ আধিকারিক ভি পি মেন-এর উপর মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনার খসড়া রচনার দায়িত্বভার দেন। উল্লেখ্য, মেনন এই ব্যাপারে যে খসড়া রচনা করেন তার মূল বিষয় ছিল হিন্দু প্রধান অঞ্চল নিয়ে ভারত ইউনিয়ন ও মুসলিম প্রধান অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন এবং বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভাগ করে পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বঙ্গকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা। পরে এই খসড়াটির সাধারণ কয়েকটি দিক পরিমার্জন করে মাউন্টব্যাটেনের নিকট উপস্থাপিত করেন, যা ‘Plan Partition’ নামে পরিচিত। মাউন্টব্যাটেন এটি খুঁটিয়ে দেখেন এবং জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, মহম্মদ আলি জিন্না, লিয়াকৎ আলি খাঁ এবং শিখ নেতা বলদেব সিং-র সঙ্গে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করলে তাঁরা তা সমর্থন করেন।

এরপর ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭-এর মে মাসে লন্ডনে যান এবং ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশভাগ সংক্রান্ত ওই পরিকল্পনা ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় পেশ করেন। মে মাসের শেষদিকে মন্ত্রীসভা তা অনুমোদন করে। ২ জুন মাউন্টব্যাটেন একটি মিটিং–এ ভারতের সাতজন নেতা যথা জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল, জে বি কৃপালনি, মহম্মদ আলি জিন্না, লিয়াবৎ আলি খাঁ, আব্দুর রাব নিস্তার ও বলদেব সিং–এর উপস্থিতিতে ওই প্রস্তাব ঘোষণা করেন। লক্ষণীয় এই সাতজন নেতার মধ্যে মহাত্মা গান্ধির নাম নেই। পরের দিন ৩রা জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি কমন্সে এই পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। ওই তারিখেই ভাইসরয় এই পরিকল্পনার কথা ভারতে বেতারের মাধ্যমে ঘোষণা করেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ পূর্বঘোষিত ১৯৪৮–এর জুন মাস থেকে ১৯৪৭–এর ১৫ আগস্ট এগিয়ে আনার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি জুন মাসের মধ্যেই আইনগতভাবে এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানায়। এটি ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমেই ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করার বিষয়টি সম্পূর্ণ হয়। এই পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৪৭–এর ১৮ জুলাই তৎকালীন ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জ ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিলটিতে স্বাক্ষর করলে তা আইনে পরিণত হয়। এটি ‘Indian Independence Act’ নামে পরিচিত। বাইশটি ধারা সংবলিত এই আইনের প্রধান ধারাগুলি হল — (১) ভারত ও পাকিস্তান নামে দু-টি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। (২) ব্রিটিশ ভারতের বোম্বাই (মুম্বাই), গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, পূর্ব পাঞ্জাব, বিহার, পশ্চিম বাংলা, মাদ্রাজ, মধ্যপ্রদেশ, আজমির ও কুর্গ এবং আসাম (মুসলিম অধ্যুষিত শ্রীহট্ট বাদে) নিয়ে গঠিত হবে ভারত ডোমিনিয়ন। (৩) সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, শ্রীহট্ট ও পূর্ব বাংলা নিয়ে গঠিত হবে পাকিস্তান রাষ্ট্র। (৪) প্রতিটি ডোমিনিয়নের সীমানা নির্বাচনের জন্য স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফের সভাপতিত্বে কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল।

অতঃপর ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট মাউন্টব্যাটনের উপস্থিতিতে রাজধানী করাচিতে একটি অনুষ্ঠানে পাকিস্তান স্বাধীনতা ডোমিনিয়নের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মহম্মদ আলি জিন্না। ১৪ আগস্টের মধ্যরাতেই ভারতীয় ডোমিনিয়নের গণপরিষদের অধিবেশন বসে এবং ওই অধিবেশনে মাউন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেল ও জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ বাক্য পাঠ করেন১৯। ১৫ আগস্ট দিল্লির লাল কেল্লায় স্বাধীন ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই প্রসঙ্গে ভারত ডোমিনিয়নে দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল। প্রসঙ্গত বলা যায় হায়দরাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর ছাড়া প্রায় ৬০০টি দেশীয় রাজ্য প্রধানত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বাস্তববুদ্ধি ও সক্রিয় প্রচেষ্টার দরুন মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে ভারত ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়া, প্যাটেল ও ভি পি মেননের কূটনৈতিক দক্ষতার দরুন স্বাধীনতা লাভের এক বছর পর ১৯৪৮–এর শেষ নাগাদ, হায়দরাবাদ, জুনাগড় ও কাশ্মীর ভারত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

তিন

কৌতূহলী পাঠকের মনে এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগবে, অখণ্ড ভারতকে কি দু-টি ভাগে বিভক্ত করা খুব জরুরি ছিল? ভারত বিভাগ ছাড়া ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব ছিল না? কেন ঘটল এই অঘটন? আসলে এই বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্কিত। বলা বাহুল্য, এই ধরনের কোনও বিতর্কিত বিষয়ে শেষ কথা বলা খুবই কঠিন। এরকম ধারণা হতেই পারে যে, যদি ওই দল বা উনি না করতেন অথবা সেই দলের বিরোধী গোষ্ঠী বা দল যদি ওই ধরনের কথাগুলি না বলতেন, কিংবা যদি ওই বিশেষ দলের প্রভাবশালী নেতারা আন্তরিকভাবে এর সঠিক সমাধানের পথ খুঁজতেন নিজেদের কিছু স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তাহলে হয়তো ভারত বিভাগকে আটকানো যেত। কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি তার সদুত্তর এখনও মেলেনি। ভবিষ্যতে মিলবে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। তথাপি এই অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় নিয়ে ঐতিহাসিক তথা পণ্ডিতেরা গবেষণায় লিপ্ত আছেন। এই বিষয়ে ইতিহাস চর্চার কাজ এগিয়ে চলেছে অবিরাম গতিতে। উঠে এসেছে নানা প্রশ্ন ও নতুন নতুন অভিমত। পণ্ডিতদের সেই সব মতামতগুলি যতটুকু সম্ভব সংক্ষেপে আলোচনা করে এবং সেই সাথে নিজস্ব চিন্তাধারার উপর আলোকপাত করে এই প্রবন্ধের ইতি টানব।

নানা মুনির নানা মত একথা যেমন সত্য, তেমনি এর মধ্য থেকেই একদিন হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটিত হবে। সাধারণভাবে দ্বিখণ্ডিত ভারতের জন্য মহম্মদ আলি জিন্নাকে দায়ী করা হয়ে থাকে। লিওনার্ড মসলে তাঁকে স্পষ্টতই ‘পাকিস্তানের জনক’ বলে অভিহিত করেছেন২০। আবার অনিতা ইন্দর সিং মন্তব্য করেছেন যে জিন্নার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এই বিষয়টিকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে তিনি এই সম্প্রদায়ের উপর ব্রিটিশ সরকার ও বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেসের আধিপত্য মেনে নিতে পারেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের দ্রুত অবনমন ঘটে। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে তিনি প্রকৃতপক্ষে ‘কলকাতার মহা হত্যাকাণ্ড’–র মতো ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। এরপর ভারত-বিভাগ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না২১

দ্বিখণ্ডিত ভারতের জন্য জিন্নাকে পুরোপুরি দায়ী করা অবশ্য বাস্তবসম্মত নয় বলে সমকালীন ও পরবর্তী কালের একাধিক পণ্ডিত মত প্রকাশ করেছেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে অন্যতম মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কাছে মনে হয়েছে যে জিন্না প্রথমদিকে পৃথক পাকিস্তান চাননি। তবে প্রথম থেকেই তিনি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। এক সময় তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যও ছিলেন। পরে অবশ্য ঘটনাক্রমে তিনি মুসলিম লিগে যোগ দেন এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন কাজকর্মের বিরোধিতায় উত্তাল হন। জিন্নাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে নারাজ আয়েশা জালালও। তাঁর কাছে মনে হয়েছে জিন্না দ্বিখণ্ডিত ভারত চাননি২২। তিনি আরও মনে করেন যে জিন্না রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেশাননি; বরং ওই কাজটি করেছিলেন মহাত্মা গান্ধি। কারণ তাঁর জীবনযাপন ও কর্মপদ্ধতি ছিল পুরোপুরি হিন্দু নেতার মতো। এই কারণেই সম্ভবত মুসলমানরা ভারতীয় জনজীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা ভাবেন। তাঁদের এই নিরাপত্তাবোধের অভাবের চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবেই ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।

আয়েশা জালালের ওই মত অবশ্য সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারেনি। একথা ঠিক যে গান্ধি রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার তাঁর মধ্যে কোনও ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। এর সুস্পষ্ট নজির হল ১৯২০-র দশকের গোড়ায় খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি তাঁর আন্তরিক সমর্থন এবং অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একে সংযুক্ত করা। স্মরণে রাখা দরকার, সব দোষ কেবল গান্ধি বা কংগ্রেসের উপর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত হবে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলগুলি যথা হিন্দু মহাসভা, আর এস এস প্রভৃতির ভূমিকাও কম ছিল না, যা কিছুটা আগে অধ্যাপক সুরঞ্জন দাসের মন্তব্যের নিরিখে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পূর্বের আলোচনা থেকে আরও দেখা গেছে যে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী নেহরু তথা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ দিকে প্রায় সমস্ত কার্যকলাপে মুসলিম লিগের নেতারা চরম বাধার সৃষ্টি করেছিল। আসলে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কম-বেশি পরিমাণে সাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগরূক ছিল।

আপাতত দৃষ্টিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পিছনে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি তথা ধর্মীয় বিভেদ প্রধান বলে মনে হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি এর অনুকূলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে বিশেষ করে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব এবং সেগুলি কেন্দ্র করে মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রতিক্রিয়া থেকে এই বিভাজন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে থাকে। ধর্মীয় বিভেদ ছাড়াও ওই দুই প্রধান দলের মধ্যে আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও যথেষ্ট মতানৈক্য ছিল বলে অধ্যাপক অমিয় বাগচী মনে করেন। তাঁর মতে মুসলিম লিগের উদীয়মান ব্যবসায়ী শ্রেণি তথা শিল্পপতিরা টাটা বিড়লার আধিপত্য মানতে রাজি ছিল না। এছাড়া নবাব, তালুকদার ও উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানরাও হিন্দুদের প্রাধান্য মেনে নিতে অসম্মত ছিল। এই সব বিষয়গুলিও দেশভাগের পিছনে পক্ষান্তরে দায়ী ছিল। এদেশে শাসনরত সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকদের ভূমিকাও এক্ষেত্রে কম ছিল না। সরকারের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভারতীয়দের অন্তর্নিহিত বিরোধের সুযোগ নিয়ে প্রয়োজনমতো এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ইন্ধন দেওয়া। ১৯০৯-এর মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন প্রণয়নের সময় থেকে ভারত ছাড়ার প্রায় আগে পর্যন্ত এই ভাবধারা বিশেষভাবে বজায় ছিল। বস্তুত, সরকার অনুসৃত ‘Divide and Rule’ নীতি এদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষকে জিইয়ে রেখে ভারতকে দু-ভাগ করে দিয়েছিল। পরে ইতিহাসের নিয়মে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ইতিহাসে কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সব কিছুই নিয়ম মেনে হয় না। সমকালীন বাস্তব পরিস্থিতির একটা বড়ো ভূমিকা থাকে পূর্বতন ব্যবস্থা টিকে থাকা বা না থাকার ক্ষেত্রে। বিস্তৃত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেছে যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও ইংরেজ সরকার — এই তিনটি পক্ষের মধ্যে কোনও পক্ষই এককভাবে দায়ী নয়। আবার একথাও ঠিক যে প্রত্যেকেরই এক্ষেত্রে কিছু না কিছু দায়িত্ব ছিল; সেটা কম বা বেশি হতে পারে। এখানে একটা কথা বোধ হয় স্বীকার করা ভালো যে প্রাক্‌-১৯৪৭ পর্বে দেশের পরিস্থিতি যেরকম অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো ভারত-বিভাগ অনিবার্যই ছিল। এই বিভাজনের ফলে স্বাধীনোত্তর পর্বে পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে উদ্‌বাস্তু সমস্যা, বাসস্থানের সমস্যা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, অর্থ-সংকট প্রভৃতি চরম বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিল। যদি ১৯৪৭-এর আগস্টে আইনগত দিক থেকে ভারত দ্বিখণ্ডিত না হয়ে অখণ্ড অবস্থায় স্বাধীনতা লাভ করত, তাহলে তার ফল যে এর থেকেও ভয়াবহ হত না তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তাই যেটা ঘটে গেছে সেটা নিয়ে বেশি ভাবনা চিন্তা না করে, যাতে ভারতীয় উপমহাদেশ তথা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিমূলক সম্পর্ক বজায় থাকে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সজাগ থাকা উচিত।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ :

১. এক্ষেত্রে একটি তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরলে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হবে। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি অঞ্চলের উদ্ভব ঘটেছে, জাতিরাষ্ট্র হিসাবে ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের অভিঘাতে। কিন্তু প্রাক্‌ঔপনিবেশিক পর্বে ওই এলাকাগুলিতে মনুষ্য বসতির নজির থাকলেও দেশ অর্থে তাদের কোনও ইতিহাস সম্মত পরিচিতি নেই। কিন্তু ভারতে দেশাত্মবোধক অর্থাৎ দেশ সংক্রান্ত ধারণা সুপ্রাচীন কাল থেকেই গড়ে উঠেছে।

   রণবীর চক্রবর্তী, ‘ভারত ইতিহাসের আদিপর্ব’, প্রথম খণ্ড, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ২০০৭, পৃঃ সতেরো।

২. দীনেশ চন্দ্র সরকার, ‘অশোকের বাণী’, অনিমা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮১, পৃঃ ৫৬।

৩. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত’ মিত্রম, কলকাতা, ২০০৯, পৃঃ ১৬৯।

৪. D.R. Bhandarkar, ‘Asoka’, University of Calcutta, 1969, PP. 231-245.

৫. D.C Sircar, ‘Select Inscriptions’, Vol. 1, Delhi, 1991, .P. 10.

৬. এই বিষয়ে সুবিস্তৃত আলোচনা আছে ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ ১৬৭, ১৬৮।

৭. ওই, পৃঃ ১৬৮।

৮. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘পলাশি থেকে পার্টিশান ও তারপর : আধুনিক ভারতের ইতিহাস’, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০০৯, পৃঃ ৫২৬।

৯. আবুল কালাম আজাদ, ‘ভারত স্বাধীন হল’, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৮৮, পৃঃ ১৩৭-১৩৯ দ্রষ্টব্য।

১০. B.M Pandey, ‘The Break-up of The British Empire’, London, Macmillian, 1969, PP. 155-156.

১১. আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫০।

১২. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২৭।

১৩. ওই, পৃঃ ৫২৮।

১৪. আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৪-১৫৫।

১৫. অমলেশ ত্রিপাঠী, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫-১৯৪৭)’, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, বৈশাখ, ১৩৯৭, পৃঃ ৪৪৩।

১৬. Suranjan Das, ‘Communal Riots in Bengal, 1905-1947’, Delhi, 1991, PP. 161-188.

১৭. জয়া চ্যাটার্জী, ‘বাংলা ভাগ হল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজন, ১৯৩২-১৯৪৭’, পৃঃ ৩১১-৩১৪।

১৮. শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫২৯ দ্রষ্টব্য।

১৯. এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে মাউন্টব্যাটেন ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ১৯৪৮ সালের ২১ জুন পর্যন্ত। এরপর ভারতের নতুন গভর্নর জেনারেল হন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। গভর্নর জেনারেল পদের অবলুপ্তি ঘটে ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারী, স্বাধীন ভারতের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান প্রবর্তনের পর।

২০. R.Mosley, ‘Last Days of The British Raj’, London, 1961, PP. 68-70.

২১. Anita Indor Singh, ‘The Origins of the Partition of India: 1936-47’, Delhi, OUP, 1987, PP. 37-38.

২২. Ayesa Jalal, ‘The Sole Spokesman: Jinnah, The  Muslim League and the Demand For Pakistan’, Cambridge, 1985, PP. 122-127.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান