কাজী নূরুল হামিম
“১৯৪৭-এর আগে ছিলাম ভারতবর্ষে, ১৯৫০-এ আবার এলাম ভারতবর্ষে এটা প্রহসন ছাড়া আর কি।’’১ উদ্বাস্তু হিসাবে পূর্ব বাংলা হতে কলকাতায় এসে সবচেয়ে বড়ো ব্যথার জায়গা ছিল পরিচয় সংকট, সেই প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে একথা বলেছেন সরজিৎ মজুমদার তাঁর “পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু-সংস্কৃতির সংঘাত” প্রবন্ধে। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে অনেক মানুষ তাদের বিষয় সম্পত্তি বিক্রয় করে পূর্ব পাকিস্তানের পাট চুকিয়ে কলকাতাসহ অনেক জেলায় নিজেরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। এরপর ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পাশাপাশি দেশ ভাগ হলে শুরু হয়েছিল অনিশ্চয়তা এবং দাঙ্গার আশঙ্কা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্তি লাভ করেছিল। ওইদিন মধ্যরাত্রি হতে সমগ্র ভারতবাসী দুটি শব্দের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল। একটি হল স্বাধীনতা এবং অপরটি হল দেশভাগ। দুটি শব্দের মধ্যে প্রথমটির সঙ্গে জড়িত ছিল দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার পর প্রাপ্তির এক অনাবিল আনন্দ, হাসি ও সুখের বাতাবরণ। আর দ্বিতীয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অনভিপ্রেতভাবে প্রাপ্ত বেদনা, বিচ্ছেদ ও বিরহের এক করুণ কাহিনি। ভারতের স্বাধীনতা আইনে বলা হয়েছিল ভারতবর্ষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করবে; ভারতের জনগণ ইচ্ছা করলে যে কোনও ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে এবং উভয় রাষ্ট্রের স্বাধীন সরকার তাদের থাকার সুবন্দোবস্ত করবে ও নিরাপত্তা দেবে। বলা বাহুল্য এই ঘোষণার মধ্য হতেই জন্ম লাভ করেছিল উদ্বাস্তু সমস্যা।
কারণ অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ সুবিধা ও নিরাপত্তার লাভের আশায় দুই দেশের সীমান্ত বরাবর শুরু হয়েছিল স্থানান্তর। তাঁরা কখনও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এক দেশ হতে অন্য দেশে গিয়েছিল, আবার অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ করা গিয়েছিল কিছুটা ভীত হয়ে বা নিছক আবেগের বশে জনগণ নিশ্চিত হতে অনিশ্চিত যাত্রায় গমন করেছিল। স্বাধীনতার আগে ও পরে এইভাবে সীমান্ত পারাপারের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। প্রাথমিক পর্বে উচ্চবর্গীয় হিন্দুরা কলকাতা ও তার আশপাশে নিজেদের বাসস্থান গড়ে তুলে সামাজিক ক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু বিভিন্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের যে সকল অধিবাসীরা এসেছিল তারা এসে প্রথমে আশ্রয় নেয় সরকারি বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে। পরবর্তীতে তাদেরকে স্থানান্তরিত করা হয় বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। কলকাতার মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে উদ্বাস্তুদের নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন কলোনি। এইভাবে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলাতে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে তুলে তাদেরকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। কিন্তু দিনের পর দিন এত বেশি হারে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটতে থাকে যে ওই সমস্ত জেলাগুলিতে তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ চাপ অনুভূত হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার অনাবাদি ও ফাঁকা এলাকায় বিভিন্ন কলোনি ও ক্যাম্প গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেই সময় অবিভক্ত বর্ধমান ও বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি থানা এলাকায় গড়ে ওঠে এই ধরনের কতকগুলি উদ্বাস্তু ক্যাম্প। পূর্ব বর্ধমান জেলায় সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা সর্ববৃহৎ দুটি উদ্বাস্তু ক্যাম্প ছিল মেমারি থানার অন্তর্গত পাল্লা চাঁচাই ক্যাম্প ও মহেশডাঙ্গা ক্যাম্প। মহেশডাঙ্গা ক্যাম্পের গড়ে ওঠার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্যাম্পের ৭৬ বছরের বৃদ্ধ সন্তোষ বিশ্বাসের কথা হতে এ ব্যাপারে স্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর কথায়— “বাংলার ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ সাব ডিভিশন হতে ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে দেশভাগের পরে পরেই আমরা বাবা কাকারা পরিবার সহ এদেশে চলে আসে। আসার সময় ওপার বাংলার অফিস হতে আমাদের মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, সেটা এপারে এসে বনগাঁ বর্ডারে জমা করলে আমাদের পরিবারগুলিকে নাগরিকপঞ্জি সহ বিভিন্ন প্রকার রিলিফ দেওয়া হয়। সেই নাগরিকপঞ্জিতে পরিবারের কর্তার নাম, পরিবারের সদস্য কতজন, কোথা হতে এসেছে এই সমস্ত বিষয় উল্লেখ থাকত। সেই নাগরিক প্রমাণপত্র ও বিভিন্ন ধরনের রিলিফ সামগ্রী নিয়ে আমরা ট্রেনে করে শিয়ালদা আসি। তারপর সেখান হতে আমাদের ৮০-৯০টি পরিবারকে থ্রু ট্রেনে রসুলপুর স্টেশনে নামানো হয়। সেখানে সরকারি উদ্যোগে গোরুর গাড়ি করে, বয়স্ক ও শিশুরা গাড়িতে চড়ে ও যুবকরা পায়ে হেঁটে এই ক্যাম্পে এসে উপস্থিত হয়। তখন এখানকার পরিস্থিতি মোটেই আশানুরূপ ছিল না। চারিদিকে কাঁটা জঙ্গলের মাঝে কিছুটা অঞ্চল পরিষ্কার করে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে অনেক ছোটো ছোটো তাঁবু তৈরি করা ছিল। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী একটি বা দুটি তাঁবু দেওয়া হত। সেগুলি তৈরি ও বিতরণ করার দায়িত্ব দেওয়া ছিল ক্যাম্প অফিসারদের হাতে। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করত। প্রতি সপ্তাহে কিছু টাকা রিলিফ হিসাবে দেওয়া হত তা দিয়ে খাবার কিনে চলত। তবে প্রতিদিন এখানে ভিজিট করতে আসত সরকারি কর্মী ও প্রত্যেকের উপস্থিতি নিত। ভিজিটের সময় কেউ অনুপস্থিত থাকলে পরে তাকে কৈফিয়ত দিতে হত। এক রকম বন্দিজীবনের মতো প্রায় ৫-৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল। এরই মধ্যে যারা পড়াশোনার উপযোগী ছিল তাদেরকে স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই মহেশডাঙ্গা ক্যাম্পে তখন পাঁচটি ক্যাম্প অফিস ছিল। প্রতিটি অফিসের অধীনে তিনশোর অধিক পরিবার থাকত। প্রতিদিনই প্রায় অনেক উদ্বাস্তু এই ক্যাম্পে আসত। আমাদেরকে বলা হয়েছিল এখানে আপাতত বাস কর, তারপর তোমাদেরকে দণ্ডকারণ্যে স্থানান্তরিত করা হবে। এক-দুবছরের মধ্যে অনেক পরিবারকে দণ্ডকারণ্যে স্তানান্তরিত করা হয়, অনেকে স্বেচ্ছায় সেখানে চলে যায়, আবার আমাদের মতো অনেক পরিবার যেতে রাজি না হওয়ায় এখানে থেকে যাই। যদিও সরকারি পক্ষ হতে ঘোষণা করা হয় যারা সরকারি নির্দেশ অমান্য করে দণ্ডকারণ্যে যাবে না, তাদেরকে সরকার পক্ষ হতে কোনোরূপ সহযোগিতা করা হবে না। সেই কারণে আমরা না যাওয়ায় সরকারি সাহায্য কিছু দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন কাজ ও পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা অনেকেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠি।”২
ওপার বাংলা ছেড়ে আসার মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক বর্ণনা দিয়েছেন পাল্লা চাঁচাই ক্যাম্পের বাসিন্দা ৮৫ বছরের বৃদ্ধ বিমল শিকদার। তিনি বলেন– “আজ আমরা এপার বাংলায় এসে বসবাস করছি ঠিকই, কিন্তু যদি ওপার বাংলার কথা মনে পড়ে তাহলে মনের ভিতরটা হু-হু করে ওঠে। বাবার মুখে শুনতাম হিন্দুমুসলমান আমরা একসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে একই এলাকায় বসবাস করতাম। আমাদের দেশের বাড়ি ছিল নোয়াখালি জেলাতে। আমাদের শৈশব বেশ ভালোভাবেই কেটেছিল। আমরা অনেক সময় বাবাকে বলতাম বাবা আমাদেরও কি একদিন এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে? দেখতাম এই কথা শুনে বাবার চোখ ছলছল করে উঠত। তিনি বলে উঠতেন এই বাপ চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে কোথায় অজানা বিদেশবিভুঁয়ে গিয়ে পরব? তোরা কিছু ভাবিস না একদিন দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু লক্ষ করা যায় আমাদের বাড়িতে সর্বসময়ের জন্য কাজকর্ম দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা রফিক চাচার হাবভাব কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে যেতে শুরু করে, সে সব সময় আমাদের কথাবার্তা আর আগের মতো শুনত না। এমনকি তাদের অভ্যাস ছিল আমাদের বাড়ির ছেলেদেরকে বাবু সম্বোধন করে ডাকা, আমরা লক্ষ করলাম তার কথাবার্তা হতে বাবু শব্দটি উঠে গিয়ে আমাদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করেছে। এইভাবে দুই-তিন পুরুষ ধরে আমাদের অন্নে লালিত চাকরের মধ্যে একটা ঔদ্ধত্য ভাব ফুটে উঠে। তার ব্যবহার হাবভাবে মনে হয় সেই যেন মালিক আর আমরা তার অনুগত।”৩
অবশ্য দেশভাগ হওয়ার পর হিন্দুরা দীর্ঘকাল হতে যে অঞ্চলে উচ্চবর্গীয় রূপে সম্মানের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করত, সেই অঞ্চলে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মুসলমান যারা ছিল, যারা এতকাল ওই সকল হিন্দুদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করত, তারাই এবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে হিন্দুদেরকে নানভাবে নির্যাতন করতে শুরু করে। এই বক্তব্যের সমর্থন মেলে ‘উদ্বাস্তু’ গ্রন্থে— “পাকিস্তান হবার পর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হেতু এখন তাদের সেখানে মান সম্ভ্রম, ইজ্জত নিয়ে বাস করা সম্ভব নয়, এই তাদের ধারণা হয়েছে। পূর্বের পরিবেশে সমাজে যে সম্মান পেতে তারা অভ্যস্ত তা এখন পাওয়া যায় না, বরং পাওয়া যায় উদ্ধত ব্যবহার এবং পদে পদে যেখানে সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত সেখানে অন্যায় অত্যাচার।”৪
পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে বিমল শিকদার বলেন— “সব সময় রেডিয়োতে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার খবর শুনে আমরা সবাই কেমন শিউরে উঠতাম আর আমাদের গ্রামের পরিবেশটাও কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যেই ১৯৪৮ সালের শীতের দিনে হঠাৎ করে তিন দিনের জ্বরে আমাদের ঠাকুমা গত হয়। আমাদের পরিবারের রীতি নীতি অনুযায়ী বাবা জ্যাঠারা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে আমাদের গ্রামের ও পাশাপাশি গ্রামের অনেক মুসলমান প্রতিবেশীদের কেউ নেমন্ত্রন করেছিলেন। কিন্তু অবাক করা ঘটনা এই অনুষ্ঠানে বেশিরভাগ মুসলমান আমাদের বাড়িতে খেতে এলেন না। অথচ এতকাল গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দু মুসলমান উভয়েই উভয়ের বাড়ির যে কোনও অনুষ্ঠানকে নিজের বাড়ির অনুষ্ঠান বলে মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কাজেই মুসলিম প্রতিবেশীদের এই রূপ আচরণ আমাদেরকে যেমন ব্যথিত করেছিল তেমন শঙ্কিত করেছিল। আমরা আশঙ্কা করতে শুরু করি এই দেশ আমাদের জন্মভূমি হয়তো অচিরেই আমাদের পরবাসে পরিণত হবে। এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হতে বেশিদিন সময় নেয়নি।”৫
আমি ও আমার সঙ্গী যারা ওনার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম তারা লক্ষ করলাম সেদিনের সদ্য কৈশোরে উপনীত হওয়া আজকের বৃদ্ধ এতক্ষণ কি অবলীলায় ওনার স্মৃতি আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছিলেন। কিন্তু এরপর আমরা লক্ষ করলাম পরের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে উনি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন, ওনার গলা বুজে আসছে, চোখগুলো কেমন ছলছল করে উঠছে। আমরা সবাই তাকে শান্ত করে বললাম আপনি বলুন এর পর কী হয়েছিল। উনি ভেজা কণ্ঠে আবার বলতে শুরু করলেন– “১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসের দিকে আমরা খবর পাই পাশাপাশি গ্রামে হিন্দুদের উপর মুসলমানরা বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার শুরু করেছে। যার আঁচ অচিরেই আমাদের গ্রামে পড়তে পারে। জানতে পারি আমার বড়দির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ইতিমধ্যেই ঢাকায় চলে গেছে। অবশ্য ছোড়দির শ্বশুরবাড়ির সবাই এক বছর আগেই পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এপার বাংলায় ২৪ পরগনায় কোনো একটা ক্যাম্পে এসে উঠেছে। একদিন খবর পাই আগের রাতে আমাদের গ্রামের উত্তরপাড়ায় পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু মুসলমান মাতব্বর এসে হুমকি দিয়ে গেছে, কালকের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে চলে না গেলে কাউকে আর আস্ত রাখবে না। ওই পাড়ায় হিন্দুদের বসতি কিছুটা কম ছিল তাই তারা ভীত হয়ে ভোর বেলায় গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। সেদিনই দুপুর বেলায় বাবার খুব অনুগত বন্ধু পেশায় মাঝি করিম চাচা আমাদের বাড়িতে আসে। বাবাকে গোপনে খবর দিয়ে বলে— গোরা দা (বাবার ডাক নাম) অবস্থা খুব একটা ভালো বুঝছি না, গতকাল পাশের গ্রাম নিয়ামতপুরে দাঙ্গায় দুজন মারা গেছে খবর নিশ্চয় শুনেছ। আমি ও-পাড়ায় কানাঘুষো শুনতে পেলাম আজ রাত্রে ওই বখাটে মুসলমান যুবকরা এ-পাড়ায় হামলা চালাতে পারে, তুমি বরং সপরিবারে এখান হতে আপাতত অন্যত্র চলে যাও। বাবা প্রথমে রাজি হতে চায়নি, কারণ এই চারকামরা বাড়ি, বড়ো উঠান, গোলা ভর্তি ধান, গোয়াল বাড়ি ছেড়ে যেতে চাননি, ভাগ্যে যা আছে হবে এই কথা বলেন। কিন্তু করিম চাচা বলে ওঠে দাদা প্রাণে বাঁচলে সব হবে। সে আরও বলে তুমি মনের দিক হতে তৈরি থাক। আমার নৌকা তোমার বাড়ির পিছন দিকে খালে রাখা থাকবে, বেগতিক দেখলে সপরিবারে সেই নৌকায় গিয়ে উঠবে। আমি আবার সন্ধ্যায় আসব বলে দ্রুত সে চলে গেল। খবর পেলাম আমার জ্যাঠা তাঁর একমাত্র ছেলে ও অবিবাহিত মেয়েকে নিয়ে ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে। মা ভিতর হতে করিম চাচার খবর শুনে খুব ভীত হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি সমস্ত টাকাপয়সা, গহনা ও কাপড়জামার সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চারটি ব্যাগে গুছিয়ে গোয়ালবাড়ির পিছন দিকে ঝোপের মধ্যে সন্ধ্যের আগেই রেখে এসেছিল। আমরা চার ভাই ও বাবা মা ভীত হয়ে দাওয়ার এক কোণে বসে আছি। সেই সময় বাবার মুখটা আমার আজও মনে পড়ে; সবকিছু থেকেও তিনি কতটা অসহায় তার ছবি বাবার মুখে ফুটে উঠেছিল। বাবা পাগলের মতো তখন আমাদেরকে বলছিল কী দরকার ছিল দেশ ভাগ করার, নেতারা শুধু নিজেদের স্বার্থের কথাই ভাবল আমাদের মতো আপামর জনগণের কী হবে তা একবার চিন্তা করল না। আমাদের প্রায় দশপুরুষের বেশি বাসস্থান আজ যেন নিমেষে কত অচেনা জায়গা মনে হচ্ছে। বাবা এই সব বলছে এমন সময় করিম চাচা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়ে বলল— গোরা দা তাড়াতাড়ি গোয়াল বাড়ির পিছন দিকে চলে চলো, ওরা এই পাড়ায় ঢুকে পড়েছে, তোমার বাড়ির দিকে আসছে, সংখ্যায় ওরা জনা ষাটেক, হাতে ওদের অস্ত্রশস্ত্র আছে। বাবা কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। আমরা সবাই একটা কোলাহল শুনতে পেলাম। আবছা আলোয় দেখতে পেলাম কয়েকজন আমাদের ধানের গোলা খুলে বস্তায় ধান ভরতে শুরু করেছে, খামারে খড়ের পোয়ালে কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গোয়াল বাড়ির সামনে হতে আমার বাবার শখের বলদ চারটির ডাক শুনতে পেলাম, মনে হয় কারা যেন খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সেই সময় কিছু উদ্যত যুবকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম— ভিতর হতে বের করে নিয়ে আয় সবাইকে ওদেরকে বুঝিয়ে দি এটা হিন্দুস্থান নয় এটা পাকিস্থান। সদর দরজায় ধাক্কা মারার আওয়াজ শুনতে পেলাম। করিম চাচা বলে উঠল দাদা আর দেরি করবেন না, দোহাই তোমায় বাচ্চাগুলোর মুখ চেয়ে তো এবার চলো। আর দেরি করা ঠিক হবে না অনুধাবন করে বাবা আমাদেরকে নিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গোয়াল বাড়ির পিছন দিয়ে করিম চাচার নৌকায় উঠল। করিম চাচা মায়ের গুছানো ব্যাগগুলিকে নৌকায় তুলে নৌকা ছেড়ে দিল। তারপরের কিছুক্ষণ কোলাহলের আওয়াজ পাওয়া যায় কারা যেন চিল্লে বলছিল সবাই প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। তারপর সারারাত নৌকা চালিয়ে আমরা কোনও একটা মফস্সল শহরে উঠি। এরপর বিভিন্ন গাড়ি পালটে— কখনো বাস, কখনো ছোটো গাড়ি চড়ে, বরিশাল খুলনা হয়ে, কখনো রাস্তায় কখনও বা বাস স্টপেজে রাত কাটিয়ে দুদিন পর পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ বর্ডারে হাজির হই। নৌকায় আসতে আসতে বাবা করিম চাচাকে বলতে থাকে করিম তুমিও মুসলমান আর ওরাও তো মুসলমান, ওরা এসেছে আমাদের প্রাণ নিতে, আর তুমি এসেছ নিজের প্রাণ বিপন্ন করে আমাদের প্রাণ বাঁচাতে সত্যি ভগবানের কি লীলা! মূর্খ হলেও করিম চাচা যে উত্তর দিয়েছিল তা আজ ও আমার কানে বাজে— সে বলেছিল গোরা দা এটা হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের লড়াই নয় এটা হল ধর্মের বিরুদ্ধে অধর্মের লড়াই, অহিংসার বিরুদ্ধে হিংসার লড়াই, কারণ মুসলমানদের ধর্ম কখনও শিক্ষা দেয় না অন্যকে আক্রমণ করতে। ওরা হল মুসলমানের নামে অধার্মিক বর্বর পশু।”৬ তবে শুধুমাত্র করিম চাচা নয় এইরকমভাবে বিপদগ্রস্ত হিন্দুদেরকে রক্ষা করতে অনেক মুসলমান তাদের জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ বিভিন্ন গ্রন্থ ও বাংলা উপন্যাসে বারে বারে উঠে এসেছে।
এরপর কীভাবে বনগাঁ বর্ডার হতে পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি বৃহৎ উদ্বাস্তু ক্যাম্প এই পাল্লা চাঁচাই-এ এসে পৌঁছালেন তার বর্ণনা প্রসঙ্গে বিমল শিকদার বলেন– “বনগাঁ বর্ডারে এসে পৌঁছানোর পর দেখলাম অনেক পরিবার আমাদের মতো সেখানে এসে হাজির হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমরা বর্ডারে পেরিয়ে ট্রেনে করে বনগাঁ হতে শিয়ালদহে এসে পৌঁছাই। তারপর সেখান হতে কিছু পরিবারের সঙ্গে আমরাও এই ক্যাম্পে এসে হাজির হই। তখন এখানে কিছুই ছিল না। সরকারি উদ্যগে বাঁশের কাঠামো ও ত্রিপলের দেওয়াল ও ছাউনি দিয়া দু-কুঠরি ঘর আমরা লাভ করি। সেই ঘর হতেই শুরু হয় বিদেশে এসে তাকে আপন করে নেবার জীবন সংগ্রাম।”৭
এছাড়াও মেমারি থানা এলাকায় অনেক জবরদখল কলোনিও গড়ে উঠেছিল। যেমন— ১) সাঁকো কলোনি, ২) উরা কলোনি, ৩) চাঁচই কলোনি, ৪) কালসী সুকান্ত পল্লি, ৫) রসুলপুর নতুন কলোনি, ৬) হরেকৃষ্ণ কোঙার কলোনি, ৭) বিষ্ণুপুর কলোনি, ৮) রসুলপুর নতুন রাস্তা কলোনি, ৯) রসুলপুর দলুইবাজার কলোনি, ১০) সিনুই সুকান্ত পল্লি, ১১) গোপীনাথপুর নতুন কলোনি, ১২) দখলপুর লেনিন কলোনি, ১৩) মনোহর ডাঙ্গা সুভাষপল্লি কলোনি, ১৪) বোহার নতুন কলোনি, ১৫) শুঁড়ে দুর্গাপুর আদর্শ কলোনি, ১৬) বাগিলা স্টেশন কলোনি।
পূর্ববঙ্গ হতে উদ্বাস্তুদের এদেশে চলে আসার কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে মেমারি শহরের হরেকৃষ্ণ পল্লির বাসিন্দা ৪৪ বছর বয়স্ক পেশায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হারাধন শিকদার বলেন— “আমি বাবার কাছে শুনেছি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একরকম রাতের অন্ধকারে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে যশোর জেলা হতে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। সেই সময় লক্ষ করা যায় পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের পর গ্রামে আওয়ামি লিগের কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক আন্দোলনকারী সন্দেহে অনেক বাঙালি সংখ্যালঘু মানুষের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালায়। প্রচুর পরিমাণে প্রাণহানি ও নারীদের ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে বাড়ির বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে খাবার দিয়ে, তাদেরকে না বলে অনেক পরিবারের অন্য সকল সদস্যরা এলাকায় সারি সারি মৃতদেহ টপকে সেই দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। কারণ তারা বুঝতে পারে বাড়ির বয়স্করা তাদের সঙ্গে দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে আসতে পারবে না, আর যদি দ্রুত এলাকা ছাড়া না যায় তাহলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাই অন্তত পরিবারের কিছু সদস্যের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে একরকম বাধ্য হয়েই নিজেদের বয়স্ক, অথর্ব, অসুস্থ পূর্বপুরুষদেরকে ফেলে রেখেই তারা ওই দেশ ছেড়ে এদেশে চলে আসে। তাদের সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার পরিবার সেই সময় রাতের অন্ধকারে কখন দেশের সীমানাসুরক্ষা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে, আবার কখনো দিনের বেলায় সীমানাসুরক্ষা বাহিনীকে বা দালালদের টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে এদেশে চলে আসে।”৮ তাঁর বক্তব্যের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুদের উপর ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গার সময় হতে যে অত্যাচার শুরু হয়েছিল, সেই ধারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত বহমান ছিল।
মেমারি থানার অন্তর্গত কালসী সুকান্ত পল্লির বাসিন্দা সন্তোষ দাস এদেশে তাঁর আগমন প্রসঙ্গে বলেন— “আমরা ১৯৭০ সালের পর এদেশে আসি। প্রথমে আমরা বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত সোনামুখি থানার হলদনারায়ণপুরে বসতি স্থাপন করি। সেখানে ঘরবাড়ি ও কিছু চাষযোগ্য জমিও ক্রয় করি। কিন্তু এখানে একটু সুযোগ সুবিধা ভালো পাওয়ায় আমি এখানে চলে আসি। সেই সময় আরও অন্যান্য কলোনি হতে অনেক উদ্বাস্তু এখানে চলে আসায় এই কলোনিটি গড়ে ওঠে। আমাদের আলাদা করে কোনও সংস্কৃতি নেই, এদেশের মানুষদের সঙ্গে আমরা মিশে গেছি, এদেশীয় সংস্কৃতিই আমাদের সংস্কৃতি। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে, খেলাধুলা করে, একই সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে, এক সঙ্গেই বড়ো হয়ে ওঠে, আলাদা করে কোনও সংস্কৃতি নেই, এদেশের মানুষদের সঙ্গে আমরা মিশে গেছি, এদেশীয় সংস্কৃতিই আমাদের সংস্কৃতি। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে, খেলাধুলা করে, একই সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে, এক সঙ্গেই বড়ো হয়ে ওঠে, আলাদা করে আমরা উদ্বাস্তু বলে আমাদের সঙ্গে স্থানীয়দের কোনো বিভাজন নেই। আমরা বয়সে বড়ো ব্যক্তিরাও একসঙ্গে মেশা, হাসি ঠাট্টা, তামাশা থেকে শুরু করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এমনকি এ-দেশীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েদের বিবাহ দিতেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমদের অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে এদেশের ছেলেমেয়েদের বিবাহও হয়েছে। আমদের সঙ্গে এ-দেশীয় হিন্দু মুসলমান সকলের সঙ্গেই আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ওপার বাংলা হতে এপারে এসে আমরা অনেকবেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে মানসিক দিক দিয়েও অনেক সুখের মধ্যে আছি।”৯ উল্লেখ্য অনান্য ক্যাম্প বা কলোনিতে এই বিবাহ বিষয়ে আবার আপত্তি আছে। সেক্ষেত্রে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। অর্থাৎ একটা বিষয় লক্ষণীয়, পূর্ববর্ধমান জেলার বিভিন্ন স্থানের পুরোপুরি উদ্বাস্তু ক্যাম্প ও কলোনিগুলির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারা ও তুলনায় বিভিন্ন ক্যাম্প ও কলোনি হতে স্থানান্তরিত হয়ে এসে যে কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল তাদের জীবনধারা অনেকটা আলাদা ছিল। কারণ দুই-তিনপুরুষ ধরে এখানে বসবাস করলেও প্রথম শ্রেণির উদ্বাস্তুরা নিজেদেরকে আজও উদ্বাস্তু মনে করে ও নিজেদের সঙ্গে এ-দেশীয় স্থানীয় অধিবাসীদের একটা ব্যবধান রক্ষা করে চলার চেষ্টা করে, কিন্তু তাঁর তুলনায় অনেক পরে গড়ে ওঠা দ্বিতীয় শ্রেণির কলোনির উদ্বাস্তুরা সেই ব্যবধান মুছে দিয়ে এ-দেশীয় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি থানার সমস্ত উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলি গড়ে উঠেছিল অল্প সময়ের ব্যবধানে এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে। প্রথম দিকে অল্প কিছু পরিবার নিয়ে এই ক্যাম্পগুলি গড়ে উঠলেও পরবর্তী কালে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গিয়েছে আত্মীয়তা সূত্রে অনেকে আবার একবারে নতুনভাবে দলে দলে এই ক্যাম্পগুলিতে বসতি স্থাপন করে ক্যাম্পগুলির আকৃতি অনেক বাড়িয়েছে। উল্লেখ্য বিপুল পরিমাণে উদ্বাস্তুরা যখন এইদেশে আসতে শুরু করে তখন অন্যান্য জেলার মতো এই জেলার মেমারি থানার রেললাইনের ধারে, নদীর ধারে ও বিভিন্ন ক্যানেলের পাড়ে অনেকে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এরা প্রথম দিকে বেশির ভাগ ক্যানেল কাটার শ্রমিক হিসাবে কাজে নিযুক্ত ছিল, যে পরিমাণ অল্প বেতন পেত তা দিয়ে কোনো রকমে তাদের দিন চলে যেত। এদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলনমুখী হতে থাকে। ১৯৬০-এর দশকে বামপন্থী আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল উদ্বাস্তুদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। এই উদ্দেশ্যে সমর মুখার্জীর সভাপতিত্বে গড়ে ওঠে উদ্বাস্তু আন্দোলন কমিটি। এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে মেমারি থানার অন্তর্গত অন্যান্য জবরদখল কমিটিগুলির স্বীকৃতি দানের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। এই সকল কলোনিগুলির নেতৃত্বদানকারীরা হলেন– ১) রসুলপুর নতুন রাস্তা কলোনি– সুধাংশু ঘরামী, ২) রসুলপুর দলুইবাজার কলোনি– জনার্দন সরকার, ৩) বিষ্ণুপুর কলোনি– নবদ্বীপ দত্ত, ৪) সিনুই সুকান্ত পল্লি– মণি পোদ্দার , ৫) মেমারি হরেকৃষ্ণ পল্লি– হরেন চক্রবর্তী, ৬) গোপীনাথপুর নতুন কলোনি— প্রভাস সমাদ্দার, ৭) দখলপুর লেনিন কলোনি— কৃষ্ণকান্ত গোস্বামী, ৮) মনোহর ডাঙ্গা সুভাষপল্লি— সুনীল কীর্তনিয়া, ৯) বোহার নতুন কলোনি– কৃষ্ণকান্ত মিস্ত্রি, ১০) শুঁড়ে দুর্গাপুর আদর্শ কলোনি– মাখন হালদার ও রমেশ রায়। এইভাবেই মহেশডাঙ্গা উত্তর ক্যাম্পে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি হলেন রবি গাইন। আর-একটা বিষয় লক্ষণীয় উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর সর্বপ্রথম বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে বিভিন্ন শহরের সংলগ্ন অঞ্চলে বা শহরতলিতে।
যাইহোক একটা বিষয় লক্ষণীয় পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি ব্লক এলাকায় স্বাধীনতার পর হতে যে সকল উদ্বাস্তু কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল সেখানকার অধিবাসীরা বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তাদের দেশ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। এদেশে এসেও তারা খুব যে সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিল তা বলা যায় না। একপ্রকার বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে থেকেই ক্যাম্প জীবনের বন্দিদশা কাটিয়ে ধীরে ধীরে আর্থিক ও সামাজিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠে তাদের জীবন অতিবাহন করতে থাকে।
সূত্রনির্দেশ :
১) সরজিত মজুমদার, প্রবন্ধ “পূর্ব পাকিস্থানের উদ্বাস্তু-সংস্কৃতি সংঘাত”, প্রকাশ— বাংলানামা, ২২ ডিসেম্বর, ২০১০
২) সাক্ষাৎকার সন্তোষ বিশ্বাস, বাসিন্দা— মহেশডাঙ্গা ক্যাম্প, মেমারি, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
৩) সাক্ষাৎকার বিমল সিকদার, বাসিন্দা— পাল্লা চাঁচাই ক্যাম্প, ১৫ অক্টোবর, ২০২০।
৪) হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, উদ্বাস্তু , শিশু সাহিত্যে সংসদ প্রাঃ লিঃ, প্রথম প্রকাশ আগস্ট, ১৯৭০, পাতা নং– ১৪
৫) সাক্ষাৎকার বিমল সিকদার।
৬) ঐ
৭) ঐ
৮) সাক্ষাৎকার হারাধন সিকদার, বাসিন্দা— হরেকৃষ্ণ পল্লি, মেমারি, ১৪ জানুয়ারি, ২০২১।
৯) সাক্ষাৎকার সন্তোষ দাস, বাসিন্দা— কালসী সুকান্ত পল্লি, মেমারি, ২২ নভেম্বর, ২০২০।