সুভাষ বিশ্বাস
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম পাঞ্জাব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়। পশ্চিমবঙ্গের যেসব জেলায় উদ্বাস্তুরা আশ্রয় গ্রহণ করে তার মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ববঙ্গের সীমান্তবর্তী নদিয়া জেলা। সরকার উদ্বাস্তুদের আপাতত আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্প বা শিবির তৈরি করলেন। নদিয়া জেলার ধুবুলিয়া, রানাঘাটের কুপার্স, চাঁদমারির রুজভেল্ট নগরীর পরিত্যক্ত সেনা ব্যারাক ও উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে পূর্ববঙ্গ থেকে আগম উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিতে শুরু করে। ১৯৪৯-১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতনের আগুনের লেলিহান শিখা নেমে এলে সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের ঢল নামে।১ নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু শিবিরগুলি ছাড়াও এই জেলার রেলস্টেশনে, ফুটপাথে, রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত বাড়িতে উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিতে শুরু করলেন। শীঘ্রই এই স্থানগুলি উদ্বাস্তুদের ভিড়ে লোকারণ্য হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানের উদ্বাস্তুদের মতো নদিয়া জেলায় রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া ক্যাম্প, বিভিন্ন রেল স্টেশন, ফুটপাথ ও অন্যান্য উদ্বাস্তু ক্যাম্পে উদ্বাস্তুদের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ নারকীয় ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুদের এই নারকীয় ও দুর্বিষহ জীবন-যাপনের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলা বহুলাংশে দায়ী ছিল। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু দেশভাগের পর যখন নিজেদের জীবন ও ধর্মরক্ষার তাগিদে তারা পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করলেন তখন নেহরু তাদের আগমনের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়কে চিঠিতে লিখলেন যে, “আমি মনে করি পূর্ববঙ্গের যে সব হিন্দু নেতারা দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন, তারা তাদের সাধারণ মানুষের প্রতি কোনও কর্তব্যই পালন করেননি।… যদি যুদ্ধ করতে হয় তাহলেও শেষ অবধি এই উদ্বাসন বন্ধ করার চেষ্টা করব।”২ নদিয়া জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, নিঃস্ব, রিক্ত এই উদ্বাস্তুরা সরকারের কাছে উপেক্ষা ও অবহেলার পাত্র হয়েই থাকবে। এরূপ পরিস্থিতিতে নদিয়ার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবির ও অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণকারী উদ্বাস্তুরা নিজেদের বেঁচে থাকা ও জীবন-জীবিকার সুরক্ষার তাগিদে সরকারি প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজ্য পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠন গড়ে ওঠে। এসব সংগঠনের শাখা নদিয়া জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বাস্তু সংগঠনের মাধ্যমে নদিয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলন কিছুদিনের মধ্যেই জোরদার হয়ে ওঠে।
পূর্ববঙ্গের বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু নদিয়া জেলায় আশ্রয় নিয়ে যখন নরক-যন্ত্রণা ভোগ করছে তখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এবং পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস দল। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধী দলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, পি. এস. সি., ফরওয়ার্ড ব্লক, আর. এস. পি. প্রভৃতি। এই সময় নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুরা তাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য সরকার ও সরকারি বিভিন্ন পদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য কংগ্রেসের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সরকার-বিরোধী উদ্বাস্তু আন্দোলনে শামিল হয়ে উদ্বাস্তুদের পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় যে, উদ্বাস্তুদের সংগঠনগুলিতে এই রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃবৃন্দই পরিচালকের আসনে চলে আসেন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি নেতারা উদ্বাস্তুদের অন্যতম সংগঠন সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ বা United Central Refugee Council বা ইউ. সি. আর. সি.-র নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিভিন্ন জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির ছত্রছায়ায় ইউ. সি. আর. সি.-র শাখা সংগঠন গড়ে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম শাখা ছিল নদিয়া জেলা ইউ. সি. আর. সি.-র শাখা।
নদিয়া জেলায় কংগ্রেস দলের শক্তি সর্বদাই বেশি ছিল। কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করার উদ্দেশ্যে এই জেলায় বামপন্থী দলগুলি এখানকার নিঃস্ব উদ্বাস্তুদের নিজেদের ছাতার তলায় শামিল করতে সচেষ্ট হয়। এক্ষেত্রে আর. সি. পি. আই. নামে রাজনৈতিক দলটি নদিয়া জেলায় সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেয়। ক্রমে আর. এস. পি. ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলি নদিয়ার উদ্বাস্তুদের নিজেদের অনুগামী সমর্থকে পরিণত করতে সচেষ্ট হয়। ‘উদ্বাস্তু পঞ্চায়েত’ নামে আর. সি. পি. আই. দলের একটি শাখা পঞ্চাশের দশকে রানাঘাটের কুপার্স ট্রানজিট ক্যাম্পে উদ্বাস্তুদের স্বপক্ষে কাজ শুরু করে।৩ কুপার্স ক্যাম্পে তখন প্রায় ১ লক্ষ উদ্বাস্তুর আশ্রয় ছিল। আর. সি. পি. আই.-এর ‘উদ্বাস্তু পঞ্চায়েত’-এর কার্যাবলী শীঘ্রই রানাঘাটের রূপশ্রী পল্লি ও নদিয়ার অন্যান্য উদ্বাস্তু শিবিরে প্রসারিত হয়।
গৌর কুণ্ডু, সুভাষ বসু, দীনেশ মজুমদার প্রমুখ বামপন্থী নেতৃবৃন্দ প্রথম থেকেই নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে ধুবুলিয়ার শান্তিরঞ্জন দাস, উমেশ মজুমদার, রানাঘাটের অশোক চক্রবর্তী, ফুলিয়ার সমীরণ বসাক প্রমুখ বামপন্থী নেতারাও নদিয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলেন। নদিয়া জেলায় উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে এবং ক্যাম্পের বাইরে বসবাসকারী বিভিন্ন উদ্বাস্তুদের মধ্যে দ্রুত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। নদিয়া জেলায় শীঘ্রই ইউ. সি. আর. সি.-র শাখা গড়ে ওঠে। ইউ. সি. আর. সি.-র শাখা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনে তীব্র গতি আসে। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলন থেকে নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুদের আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন ছিল পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলনেরই একটি ধারা মাত্র। নদিয়া জেলার এই আন্দোলন বহু ক্ষেত্রেই এই জেলার বাইরের উদ্বাস্তু আন্দোলনের দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিল তেমনি বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বারাও এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল বিভিন্নভাবে। তাছাড়া রাজ্য সরকার যখন উদ্বাস্তুদের কল্যাণে কোনও কাজ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বা উদ্বাস্তুদের বিরোধী কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তখনই সারা রাজ্যের উদ্বাস্তুরা আন্দোলনে শামিল হয়েছে। এই পরিস্থিতিগুলিতে সারা রাজ্যের মতো নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুরাও বারংবার আন্দোলনে শামিল হয়েছে। তাই বলা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। তবে উদ্বাস্তুদের একটি অংশ খাদ্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা থেকে দূরে সরেছিল। কারণ পুনর্বাসন সমস্যা মোটামুটিভাবে মিটে যাওয়ার পর প্রচণ্ড পরিশ্রমী উদ্বাস্তুদের অনেকেই নিজের পরিশ্রমের জোরে খাদ্য সংস্থানে ব্যস্ত ছিলেন। তাছাড়া, নদিয়া জেলায় উদ্বাস্তুরা প্রথম পর্বে সরকার-বিরোধী যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাতে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কারণ ভোট-সর্বস্ব রাজনীতিতে ভোটাধিকারহীন উদ্বাস্তুরা তৎকালীন সরকারের কাছে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন ছিল। তবে নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুরা শীঘ্রই যে সুতীব্র আন্দোলন শুরু করেছিল তা সরকারকে উদ্বাস্তুদের সমস্যার প্রতি নজর দিতে বাধ্য করেছিল।
নদিয়া জেলার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী বাস্তুহারাদের জীবনযাত্রা কতটা দুর্বিষহ ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তাই কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের নিয়ে লেখা তাঁর ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইয়ের উপরের মলাটে উদ্বাস্তুদের জীবন-যন্ত্রণা প্রসঙ্গে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ‘বুঝিবে সে কিসে’ কবিতার নিম্নোক্ত চারটি লাইন উল্লেখ করেছেন যা নদিয়া জেলার তখনকার উদ্বাস্তুদের জীবন যন্ত্রণা সম্পর্কে খুবই মর্মস্পর্শী ও প্রাসঙ্গিক —
"চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন,
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে?
কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?"
নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু শিবিরগুলির উদ্বাস্তুরা এক কথায় মানবেতর জীবনযাত্রা অতিবাহিত করছিল। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিও অনেক উদ্বাস্তু একেবারেই পায়নি। বাকিরা যা পেয়েছিল তা উদ্বাস্তুদের প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক খাদ্য ও পোশাকের মতো জিনিসপত্রই যেখানে অপ্রতুল সেখানে উদ্বাস্তু পরিবারগুলির মর্যাদা ও শালীনতা রক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ আশা করা ছিল উদ্বাস্তুদের কাছে এক প্রকার বিলাসিতা মাত্র। এর সঙ্গে উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে পানীয় জল, শৌচাগার, স্নানাগার প্রভৃতির অভাব, প্রচণ্ড শীতে বা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে তীব্র কষ্টভোগ, ঔষধপত্রের অভাব প্রভৃতি উদ্বাস্তুদের জীবনকে সম্পূর্ণ দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এর পাশাপাশি বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ নীতি পশ্চিমবঙ্গ-সহ নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী তাঁর রচনায় কমিউনিস্ট নেতা সমর মুখার্জীর উদ্বাস্তু আন্দোলন সম্পর্কিত উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। সমরবাবু উদ্বাস্তু আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতা প্রয়াত অনিল সিংহের স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গে তাঁর উদ্ধৃতিতে বলেছেন যে,
“১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে যাবার আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কংগ্রেসের সহায়তায় দেশটাকে ধর্মের ভিত্তিতে তিন টুকরো করে দিয়ে গেছিল। ফলে পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে দলে দলে উদ্বাস্তুরা এসে উপস্থিত হতে বাধ্য হলেন। এই সময়ে নেহরু সরকার একদিকে পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের বললেন,- ফিরে যেতে। স্বভাবতই এই একপেশে নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠল। ১৯৫০ সাল নাগাদ উদ্বিগ্ন বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত মঞ্চ হিসেবে UCRC আত্মপ্রকাশ কর। …”৪
নদিয়া জেলায় আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালি উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিপুল কর্মশক্তি সঞ্চিত ছিল। তা সঠিকভাবে ব্যবহার করে অনেক গঠনমূলক কাজ করার সম্ভাবনা ছিল। বিভিন্ন পরিকল্পনামূলক উদ্যোগ নিয়ে উদ্বাস্তুদের শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন উৎপাদক ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনা ছিল। এর দ্বারা একদিকে যেমন উদ্বাস্তুদের দারিদ্র্য দূর হয়ে কিছুটা সমৃদ্ধি আসতে পারত, অন্যদিকে তেমনি নদিয়া জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির সার্বিক উন্নতি হতে পারত। কিন্তু নদিয়া জেলার এই উদ্বাস্তু মানব সম্পদকে কাজে লাগানোর কোনও সঠিক উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। হাজার হাজার উদ্বাস্তুর এই কর্মশক্তিকে কাজে লাগানোর কথা অনেক বছর ধরেও সরকার চিন্তাই করেনি। এবিষয়ে রানাঘাটের উদ্বাস্তু আন্দোলনের অন্যতম নেতা হরিনারায়ণ অধিকারী লিখেছেন যে, “সরকারি দপ্তরে প্ল্যান পরিকল্পনা দেওয়া সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কার্যত নীরব ছিলেন। এই নীরবতা মনুষ্য শক্তির অপচয় করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। সরকার এই জায়গার মানুষকে যে কাজে প্রেরণা দিয়েছিলেন তাতে মনুষ্য শক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হত। রামায়ণ গান, পালা গান, হরিসংকীর্তন, অষ্টপ্রহর থেকে কয়েকদিন ধরে নাম যজ্ঞের অনুষ্ঠান, ভাগবত গীতা পাঠের ব্যবস্থা ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিকে স্থানীয় সরকারি কর্তাদের ঝোঁক ছিল সব চাইতে বেশি।”৫ এভাবে কর্মদ্যোগী উদ্বাস্তুদের অলস করে রেখে ক্রমে তাদের ক্ষোভ বৃদ্ধি করা হচ্ছিল যা পরবর্তীকালে বাধ্য হয়ে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়।
নদিয়া জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্রের সরকারের উদাসীনতা ও বঞ্চনা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। উদ্বাস্তুদের অনেক অভিযোগ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বাঙালি উদ্বাস্তুদের প্রতি এক অদ্ভুত উদাসীনতা দেখিয়েছেন। জওহরলাল নেহরু ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে নদিয়ার উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে এসেও তাদের প্রকৃত দুর্দশাটি ইচ্ছে করেই বোঝার চেষ্টা করেননি বলে উদ্বাস্তুদের অভিযোগ। রানাঘাটের উদ্বাস্তু শিবিরে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর আগমন প্রসঙ্গে তৎকালীন রানাঘাটের উদ্বাস্তু বাসিন্দা এবং পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু আন্দোলনের অন্যতম নেতা হরিনারায়ণ অধিকারী লিখেছেন যে, “তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫১ সালে সরেজমিনে ভাগ্যহতদের প্রত্যক্ষ করতে এলেন। উভয়ের আগমন উপলক্ষ্যে কুপার্সে বিরাট জমায়েত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাস্তুহারা জীবনের দুঃখ অবসানের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে ভবিষ্যতে এই সমস্ত প্রতিশ্রুতির কিছুই রক্ষা হয়নি। উপরন্তু রূপশ্রী পল্লির লাবণ্যপ্রভা দাশগুপ্ত নামে জনৈক মহিলার পরিধানে সামান্য স্বর্ণালঙ্কার দেখে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রূপের সঙ্গেই বলেছিলেন, উদ্বাস্তুরা যখন অনেক সম্পত্তি নিয়ে এদেশে এসেছেন তখন এদের অভাব থাকবে কেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী উদ্বাস্তুদের ভিখিরির মতই নিঃস্ব দেখতে চেয়েছিলেন। তাই কোনও উদ্বাস্তু ভদ্রমহিলার পরিধানে স্বর্ণালঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর নিকট ছিল অস্বাভাবিক।”৬ নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুদের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এহেন দৃষ্টিভঙ্গির ফলে এখানকার উদ্বাস্তুদের জীবন সীমাহীন দুর্দশার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় এবং তাদের মনে ক্ষোভের কালো মেঘ জমতে থাকে। এই ক্ষোভ পরবর্তীকালে শক্তিশালী উদ্বাস্তু আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়।
১৯৫০ সাল নাগাদ নদিয়া জেলার বর্তমান কল্যাণীর নিকটবর্তী গয়েশপুর উদ্বাস্তু শিবিরে পুনর্বাসনকে কেন্দ্র করে উদ্বাস্তুরা আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। গয়েশপুর শিল্পাঞ্চল-সংলগ্ন অঞ্চলের নিকটবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তাই গয়েশপুরে মধ্যবিত্ত উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে পুনর্বাসন দিয়ে এলাকাটি একটি উপনগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু গয়েশপুরে জমির স্বল্পতা এখানে উপনগরী প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জমির অপ্রতুলতায় গয়েশপুরে পুনর্বাসন প্রাপ্ত উদ্বাস্তু পরিবারগুলির গৃহনির্মাণের জন্য চার কাঠা জমির বেশি বরাদ্দ করা অসম্ভব হয়। এর ফলে উদ্বাস্তুদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই ক্ষোভ ক্রমে আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। বহু পরিবার এই ক্ষুদ্র জমিতে পুনর্বাসন নিতে অস্বীকার করে। অথচ বহু মধ্যবিত্ত উদ্বাস্তু পরিবারের লক্ষ্য ছিল গয়েশপুরের উপনগরীতে বসতি নির্মাণ করা। এজন্য তারা আন্দোলনের পথে পা বাড়ালেন। কংগ্রেস, সমাজতন্ত্রী দল, প্রজা দল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল উদ্বাস্তুদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনে শামিল হয়। এই অবস্থায় সরকারি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তু নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আলোচনা চলে তৎকালীন উদ্বাস্তু কমিশনার শ্রীহিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, জমির স্বল্পতা কারণে উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে বেশি জমি না দেওয়া গেলেও এর বিনিময়ে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বেশি দেওয়া হবে। এই সূত্রে শেষ পর্যন্ত গয়েশপুরের উদ্বাস্তু আন্দোলন আপাতত বন্ধ হয়।৭
ইতিমধ্যে গয়েশপুরের নিকটবর্তী নদিয়া জেলার চাঁদমারী উদ্বাস্তু শিবিরে বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় নিঃস্ব রিক্ত উদ্বাস্তুদের মনোবল ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার একটি চিত্ত বিনোদন সমিতি গঠন করেছিল। তৎকালীন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, নাট্যকার মন্মথ রায় প্রমুখ কলাকুশলীগণ এই সমিতির উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন। শিল্পীদের এই দলটি ১৯৫০ সালের ১লা মে নদিয়া জেলার চাঁদমারীর উদ্বাস্তু শিবিরে সংগীত পরিবেশন করতে আসে। কিন্তু শিল্পীরা সেখানে গানের অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিলে চাঁদমারী উদ্বাস্তু শিবিরের উদ্বাস্তুরা প্রতিবাদী হয়ে বাধা দিতে এগিয়ে আসে। একদল উদ্বাস্তু ধ্বনি তুলতে তুলতে শিল্পী ও কর্মকর্তাদের কাছে এসে তাঁদের ঘিরে ফেলে এবং সংগীত পরিবেশনের প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। প্রতিবাদকারীরা জানায় যে, তারা এখন ভীষণ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আছে এবং এই অবস্থায় শিবিরে সংগীত পরিবেশন শোভনীয় নয়। এর পরিবর্তে বরং উদ্বাস্তুদের খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার জন্য সকলের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। উদ্বাস্তু জনতার উত্তেজনাপূর্ণ আচরণ দেখে কলকাতা থেকে আগত শিল্পীরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরে অবশ্য কিছু নেতৃস্থানীয় উদ্বাস্তুদের সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যটি বোঝানোর পর কোনও ক্রমে একটি দায়সারা সংগীতানুষ্ঠান করা সম্ভব হয়।৮
১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই নির্বাচনে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী উদ্বাস্তুদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি, এমনকি উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিক অধিকারও স্বীকার করা হয়নি। ১৯৫২ সালের নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে শিবিরের বেশিরভাগ উদ্বাস্তুই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। নির্বাচনের আগে জে. পি. মিত্র নামে জনৈক নির্বাচন প্রার্থী বিমান থেকে ব্যাপকভাবে তার নির্বাচনী প্রচারপত্র বিলি করেন। এই ঘটনা থেকে নির্বাচন সম্পর্কে শিবিরবাসী উদ্বাস্তুদের মধ্যে নানা আলোচনা শুরু হয়। এভাবে উদ্বাস্তুদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাদের আলোচনায় উঠে আসে ভারতের প্রথম নির্বাচনের গুরুত্ব, পূর্বপাকিস্তানে লিগের বিরুদ্ধে নির্বাচনের তোড়জোড়, নেহরু-লিয়াকৎ চুক্তি, উদ্বাস্তুদের সম্পত্তি বিনিময় প্রভৃতি প্রসঙ্গ। পরবর্তীকালে উদ্বাস্তুদের ভোটাধিকারের দাবি এবং নাগরিক অধিকার অর্জনের দাবি উদ্বাস্তুদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।৯
১৯৫২ সালে সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে উদ্বাস্তুদের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা ও মত-বিনিময় চলতে থাকে। এই আলোচনার সূত্র ধরে উদ্বাস্তু শিবিরে এবং শিবিরের বাইরে নানা স্থানে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের স্বজনপোষণ, স্বেচ্ছাচার প্রভৃতি বিষয়ে প্রকাশ্য আলোচনা শুরু হয়। সরকারি ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মচারীদের গাফিলতিতে উদ্বাস্তুরা অনেক সময় তাদের প্রাপ্য ডোল ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়মিত পেত না। উদ্বাস্তুদের জন্য ডোল বাবদ যে অর্থ সরকার বরাদ্দ করত তার অংশবিশেষ সরকারি কর্মচারীদের একাংশ দুর্নীতি করে আত্মসাৎ করত। ইতিমধ্যে রূপশ্রীপল্লি, ধুবুলিয়া, চাঁদমারী, দুধকুন্ডি প্রভৃতি স্থায়ী উদ্বাস্তু শিবিরগুলির জন্য একজন প্রশাসক বা কন্ট্রোলারের পদ সৃষ্টি করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাস নামে জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই প্রশাসক পদে নিযুক্ত হন। তাঁর অধীনে নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু শিবিরগুলি দুর্নীতির মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়। কন্ট্রোলার পদে নিযুক্ত হয়েই চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতার অকল্যাণ্ড (পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু দপ্তরের প্রধান অফিস) থেকে শুরু করে স্থায়ী শিবিরগুলির প্রতিটি স্তরে স্বজন পোষণের নীতি গ্রহণ করেন। প্রথম পর্যায়ে সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে বিভিন্ন দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে। এই চক্রগুলিতে চিত্তরঞ্জন দাস নিজের লোকজনদের নিযুক্ত করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষক, জি. এ., সহকারী শিবিরাধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে নিজেদের লোকজন নিযুক্ত হতে থাকেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিয়োগপত্র দিয়ে স্বজনপোষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।১০ উদ্বাস্তু শিবিরে দুর্নীতির বিভিন্ন ধরনগুলির কয়েকটি হরিনারায়ণ অধিকারী তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল —
(১) উদ্বাস্তুদের চিকিৎসার খরচ, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি, ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজনকে ভরতি প্রভৃতি কাজের জন্য উদ্বাস্তুরা অসৎ কর্মচারীদের ঘুস দিতে বাধ্য হত।
(২) বিভিন্ন তুচ্ছ কারণে উদ্বাস্তুদের প্রাপ্য সরকারি সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হত এবং তা আবার চালু করতে কর্মচারীদের ঘুস দিতে বাধ্য করা হত। ঘুস না দিলে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করা হত এবং নানা অজুহাতে সরকারি সাহায্য আটকে দেওয়া হত।
(৩) উদ্বাস্তুদের পক্ষ থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও অভিযোগ জানানো দূরের কথা, কোনও ন্যায়সংগত দাবি বা ন্যায্য পাওনার কথাও কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো ছিল এক গুরুতর অপরাধ। কোনও কিছু জানাতে হলে মোসাহেব ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে হত। তার জন্য আত্মসম্মানের অবমাননা বা অন্য ধরনের সেলামির প্রয়োজন হত।
(৪) কর্তৃপক্ষের গোপন উদ্যোগে উদ্বাস্তু নারীদের ব্যবহার করে ‘মধুচক্র’ গড়ে তোলা হত। এই মধুচক্রের ফাঁদে পড়ে বহু উদ্বাস্তু নারীর মর্যাদা বিকিয়ে দেওয়া হত।
(৫) সরকারি পুনর্বাসন পেয়ে যে সকল উদ্বাস্তু পরিবার শিবিরের জীবন ছেড়ে যেতে চাইতেন তারাও নানা কারণে কর্তৃপক্ষকে ঘুস দিতে বাধ্য হতেন।
(৬) যে সকল উদ্বাস্তু যুবক অলস জীবন ছেড়ে কোনও কাজে যুক্ত হতে চাইতেন তাতে কর্তৃপক্ষের স্বজনপোষণ প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াত। কর্তৃপক্ষ নিজেদের বা কাছের লোককে নিয়োগ করে উদ্বাস্তু যুবকদের সেই কাজ প্রাপ্তিতে বাধার সৃষ্টি করত।
(৭) উদ্বাস্তু শিবিরগুলির কন্ট্রোলার চিত্তরঞ্জন দাস উদ্বাস্তু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এক ব্যবসা শুরু করেন। সরকার উদ্বাস্তু ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ের বেতন মেটাতো। তাছাড়া উদ্বাস্তু ছাত্রছাত্রীরা বই কেনার জন্য ২০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত অনুদান পেত। প্রতিটি উদ্বাস্তু শিবিরে প্রায় ৩০০০ / ৪০০০ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভরতি হত। চিত্তরঞ্জন দাস বিধানচন্দ্র শিক্ষায়তন ও বিবেকানন্দ বালিকা বিদ্যালয় নামে উদ্বাস্তু ছাত্রছাত্রীদের জন্য দু-টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন। এখানে যে শিক্ষকদের নিয়োগ করা হল তারা আবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন এবং সরকার থেকেই মাইনে পেতেন। ফলে উদ্বাস্তু স্কুল থেকে তারা মাইনে না পাওয়ায় বহু অর্থ বেঁচে যেত। নিকটবর্তী অন্যান্য স্কুলের চেয়ে অনেক বেশি হারে মাইনে উদ্বাস্তু ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হত। ছাত্রদেরও ভয়ে অন্যত্র পড়ার সুযোগ ছিল না। কেননা চিত্তরঞ্জন দাস প্রচার করেছিলেন যে, অন্য স্কুলে পড়লে উদ্বাস্তু ছাত্রছাত্রীদের সরকারি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্যন্ত পরে তা বন্ধ হয়নি। আবার সরকারি নির্দেশ ছাড়াই ছাত্রছাত্রীদের বই কেনার টাকা তাদের হাতে না দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই টাকায় নিজেরা ছাত্রছাত্রীদের বই কিনে দিতে শুরু করলেন। এই সুযোগে তারা প্রচুর কমিশন ভোগ করতে থাকলেন। চারটি পি. এল. ক্যাম্পের ৮টি বিদ্যালয়ের ১৫ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির শিকার হয়ে বাজারে অচল বইপত্র পড়তে বাধ্য হল।১১ এসব নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। এই আলোচনা পরবর্তীকালে ক্রমে দানা বাঁধতে বাঁধতে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়।
নদিয়া জেলার উদ্বাস্তুরা শীঘ্রই উপলব্ধি করেছিল যে, তাদের এমন নারকীয় জীবন থেকে স্বাভাবিকভাবে মুক্তি পাওয়ার কোনও আশা নেই। তাই তারা ক্রমে বিক্ষিপ্তভাবে সরকারি অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ক্রমে বিভিন্ন স্থানের উদ্বাস্তুরা সংঘবদ্ধ হয় এবং কয়েকটি উদ্বাস্তু সংগঠন গড়ে ওঠে। এই উদ্বাস্তু সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ বা United Central Refugee Council (সংক্ষেপে U. C. R. C.)। ইউ. সি. আর. সি. ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউ. সি. আর. সি.-র প্রথম সভাপতি হলেন প্রখ্যাত বিপ্লবী শ্রী অম্বিকা চক্রবর্তী। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা বিচ্ছিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠনগুলিকে ইউ. সি. আর. সি.-র ছত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (CPI), ফরওয়ার্ড ব্লক (FB), মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক (MFB), সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (SUCI), রিভোল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (R.C.P.I.), ডেমোক্র্যাটিক ভ্যানগার্ড, বলশেভিক পার্টি, রিপাবলিকান পার্টি, হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি রাজনৈতিক দলগুলি ইউ. সি. আর. সি.-র আন্দোলন পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু প্রথম পর্বে ইউ. সি. আর. সি.-র আন্দোলন মূলত জবরদখল কলোনির উদ্বাস্তুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাছাড়া প্রথম পর্বে এই সংগঠনের আন্দোলন উদ্বাস্তু শিবিরগুলির সকল সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুদের কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়নি।
নদিয়া জেলায়ও ইউ. সি. আর. সি.-র শাখা গড়ে ওঠে। নদিয়া জেলায় বিভিন্ন ক্যাম্পের অবস্থানের জন্য এখানে ইউ. সি. আর. সি.-র সংগঠন প্রথম থেকেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইউ. সি. আর. সি.-র নদিয়া জেলা শাখার প্রথম সম্পাদক হন অমৃতেন্দু মুখার্জি। নদিয়ার রানাঘাট, ধুবুলিয়া, চামটা, চাঁদমারি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্যাম্পেই ইউ. সি. আর. সি.-র আঞ্চলিক শাখা গড়ে ওঠে। ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে সেখানকার ইউ. সি. আর. সি.-র প্রথম আঞ্চলিক সম্পাদক হন কানাইলাল আচার্য।১২ নদিয়ার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা অনুসারে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনগুলি জেলা ও রাজ্যস্তরে আন্দোলনে শামিল হত। তবে ইউ. সি. আর. সি.-র পাশাপাশি নদিয়া জেলায় ‘বাস্তুহারা কল্যাণ পরিষদ’ নামে একটি উদ্বাস্তু সংগঠন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। মূলত রিভোল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (R.C.P.I.) নামে রাজনৈতিক দলটির দ্বারা নদিয়া জেলায় ‘বাস্তুহারা কল্যাণ পরিষদ’ পরিচালিত হত। এই সম্মিলিত বাস্তুহারা উদ্বাস্তু পরিষদ ও বাস্তুহারা কল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন গতিশীল হয়।১৩ তাছাড়া পরবর্তীকালে ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তুদের মধ্যে ইউ. সি. আর. সি. ছাড়াও ‘পূর্ব ভারত উদ্বাস্তু পরিষদ’ নামে অপর একটি উদ্বাস্তু সংগঠন গড়ে উঠেছিল। পূর্ববঙ্গের দলিত হিন্দুদের একচ্ছত্র নেতা ও তৎকালীন পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ১৯৫০ সালে মাতৃভূমি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং নদিয়ার উদ্বাস্তুদের ঐক্যবদ্ধ করে এই সংগঠন গড়ে তোলেন। মূলত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তুদের মধ্যেই যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত উদ্বাস্তু পরিষদের বেশি প্রভাব ছিল। তাছাড়া সত্যশরণ মজুমদার নামে একজন উদ্বাস্তু নেতাও ইউ. সি. আর. সি.-র বাইরে উদ্বাস্তুদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য কাজ করে যান।১৪
১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ববঙ্গ থেকে বাস্তুহারা হয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য পরিবার নদিয়া জেলায় এসে প্রথমদিকে অসংগঠিতভাবে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অসংগঠিত উদ্বাস্তু আন্দোলন চলতে থাকে। এরপর ১৯৫০ সালে ইউ. সি. আর. সি. সহ বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠন গড়ে উঠলে উদ্বাস্তু আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব এসব সংগঠনগুলি নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নদিয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলন অন্তত ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে চলে। এই সময়কালের মধ্যে নদিয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন এখানকার রাজনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। মূলত উদ্বাস্তু আন্দোলনের প্রভাবে নদিয়া জেলায় বামপন্থী দলগুলির ভোটের হার দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়।
তথ্যসূত্র :
১. ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গার পরই বাস্তুহারা মানুষ ওপার বাংলা থেকে এপারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈন্যদের জন্য নির্মিত যে সকল পরিত্যক্ত ব্যারাকগুলিতে আশ্রয় নেন সেগুলিকে ‘ওল্ড ক্যাম্প’ বলা হত। আর ১৯৪৭ সালের পরবর্তীকালে, বিশেষ করে বরিশাল দাঙ্গার (১৯৫০) সময় থেকে বাস্তুহারা মানুষজন যে সকল পরিত্যক্ত সেনা ব্যারাকে আশ্রয় নেন সেগুলিকে ‘নিউ ক্যাম্প’ বলা হত। পরিত্যক্ত বিস্তীর্ণ রানওয়ের উপর টিনের একচালা ছাউনি দিয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য এই ‘নিউ ক্যাম্প’ তৈরি করা হয়। নদিয়ার ধুবুলিয়ায় ‘ওল্ড ক্যাম্প’ ও ‘নিউ ক্যাম্প’ মিলিয়ে পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই উদ্বাস্তুদের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
২. প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, ‘প্রান্তিক মানব’ : পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুজীবনের কথা, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৭, প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস্ প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃষ্ঠা- ২১।
৩. শুভলক্ষ্মী পান্ডে, ‘ষাট-সত্তরে নদিয়া: নকশালবাড়ির নির্মাণ’, জানুয়ারি, ২০০৪, রিডার্স সার্ভিস, কলকাতা-৭৫, পৃষ্ঠা- ২১।
৪. দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শোষণমুক্তির সংগ্রামে সমর মুখার্জী’, ৮ই নভেম্বর, ২০০৭, প্রকাশক- বিপ্লব মজুমদার, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), হাওড়া জেলা কমিটি, ৮২/১ নরসিংহ দত্ত রোড, হাওড়া-১, পৃষ্ঠা- ১৪০।
৫. হরিনারায়ণ অধিকারী (সম্পা.), ‘সংগ্রামী রূপশ্রী পল্লি’, ১৯৯৫, প্রকাশক: সুপ্রিয় চন্দ, বিবেকানন্দ পল্লি, কলকাতা-৬৫, পৃষ্ঠা- ২৯।
৬. হরিনারায়ণ অধিকারী (সম্পা.), তদেব, পৃষ্ঠা- ২৩।
৭. শ্রীহিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘উদ্বাস্তু’, প্রথম সংস্করণ- ১৯৭০, সাহিত্য সংসদ, ৩২ এ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড, কলিকাতা-৯, পৃষ্ঠা- ৫৩-৫৪।
৮. শ্রীহিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, তদেব, পৃষ্ঠা- ১০১।
৯. হরিনারায়ণ অধিকারী (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ৩৬।
১০. হরিনারায়ণ অধিকারী (সম্পা.), তদেব, পৃষ্ঠা- ৩৭-৩৮। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন বাংলায় ব্রিটিশ-বিরোধী সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী শ্রীমতী শান্তি দাসের স্বামী। চিত্তরঞ্জন দাস উদ্বাস্তু শিবিরগুলির কন্ট্রোলার হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার কিছুকাল পরই জনৈকা উদ্বাস্তু নারীর শ্লীলতাহানি সংক্রান্ত ‘সন্ধ্যারানি’ মামলায় জড়িয়ে পড়েন।
১১. হরিনারায়ণ অধিকারী (সম্পা.) তদেব, পৃষ্ঠা- ৪১-৪২।
১২. শুভলক্ষ্মী পান্ডে, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা- ২৩।
১৩. Anasua Basu Ray Chaudhury, ‘Living another Life: Un-Homed in the Camps’, in Anusua Basu Roy Chaudhury and Ishita Dey, “Citizens, Non-Citizens, and in the Camps Lives”, 2009, Mahanirban Calcutta Research Group, Salt Lake City, Kolkata, P- 24. (Web Source: http://www.mcrg.ac.in/pp21.pdf)
১৪. শুভলক্ষ্মী পান্ডে, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪।