দেবনারায়ণ মোদক
‘সাতচল্লিশের স্বাধীনতা’ এবং তার হাত ধরাধরি করে অনিবার্য হয়ে ওঠা দেশভাগ বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারত-ভাগের এই প্রক্রিয়াতেই বিভাজন ঘটেছে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের। সুনির্দিষ্টভাবে বাংলা-ভাগের কথায় এসে বলি যে, ধারণাগতভাবে (notionally) ধর্মীয় বিচারধারাকে প্রাধান্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-প্রধান এলাকা নিয়ে ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’-এর অঙ্গরাজ্য হিসেবে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ এবং মুসলমান প্রধান অংশ নিয়ে নবগঠিত ‘পাকিস্তান’-এর অংশ হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গড়ে তোলার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। বাস্তবে অবশ্য মিশ্র জনবিন্যাসের সমস্যা, ভৌগোলিক ধারাবাহিকতা (geographical contiguity) রক্ষার প্রয়োজনবোধ, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত বিবেচনা, নদীব্যবস্থা (river system)–র গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি নানা প্রশ্নের অভিঘাতে ‘অতিসরলীকৃত’ ধর্ম-কেন্দ্রিক প্রস্তাব সর্বাংশে গ্রহণীয় হয়নি। স্যার সিরিল জন র্যাডক্লিফ-এর নেতৃত্বে তাই সবদিক বিবেচনা করে সীমানা নির্ধারণের জন্য গঠিত হয়েছিল Bengal Boundary Commission। কমিশন কীভাবে এই সীমানা নির্ধারণের কাজটি চূড়ান্ত করেছিল; এই প্রক্রিয়ায় মূল টানাপোড়েনগুলিই বা কী ছিল, সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলি সম্পর্কে কমিশনের অবস্থান কেমন ছিল, ইত্যাদি বিষয়সমূহ বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাস অনুশীলনে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দেশভাগের দিনক্ষণ ইত্যাদি চূড়ান্ত হলেও সরকারিভাবে ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-র আঁচড় টানতে আরও কিছুটা সময় লেগেছিল। প্রাথমিকভাবে তাই ধারণাগত প্রতিপাদ্য মেনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ক্ষমতা হস্তান্তর’-এর কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। দিন-দুয়েক বাদে ‘র্যাডক্লিফ রায়’ সামনে এলে বেশ কিছু হেরফের লক্ষণীয় হয়েছে — একাধিক জেলার অবস্থান বদলে গেছে; কোথাও জেলা ভেঙে দু-টুকরো হয়েছে; মহকুমা বা ব্লকভিত্তিক অবস্থানেও ক্ষেত্র-বিশেষে কাটা-ছেঁড়া হয়েছে; জন্ম নিয়েছে একাধিক ‘ছিট মহল’। এ-সব নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বিভ্রান্তিও কম হয়নি। বর্তমান নিবন্ধে ইতিহাসের দিকে ফিরে এ-বিষয়ে একটি সামগ্রিক রূপরেখা উপস্থাপনের প্রয়াস গৃহীত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সময়ে দুই বাংলাতেই কমবেশি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ঘটেছে। এখানে আমরা সে-সব কথায় না গিয়ে কেবলমাত্র ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-য় বিভক্ত দুই বাংলার প্রশাসনিক স্থিতি সম্পর্কে আলোচনাকে সীমায়িত রেখেছি।
এক
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বা সংশ্লিষ্ট ঘটনা প্রবাহ — এমনকি দেশভাগ ও বঙ্গ বিভাজনের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল বিবিধ বিষয় সম্পর্কিত আলোচনা — এই নিবন্ধের উপজীব্য নয়। এখানে এটুকু বলে রাখাই যথেষ্ট যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিশেষ পর্বে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি তীব্রতা লাভ করায় দেশভাগের সিদ্ধান্ত যেন অনিবার্যই হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায়, সামগ্রিকভাবে ভারত-ভাগের প্রেক্ষিতে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ বিভাজনের প্রস্তাবও সামনে এসে পড়ে। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে ব্রিটিশ সরকারের ৩রা জুন ১৯৪৭ এর বিবৃতিটি উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে তার ৫.৯ অনুচ্ছেদে এই দু-টি প্রদেশ ভাগের সূত্র নির্দেশিত হয়। বলা হয় যে, সংশ্লিষ্ট প্রদেশ দু-টির আইনসভার প্রত্যেকটি দু-টি পৃথক কক্ষে সমবেত হয়ে প্রদেশ বিভাজন সম্পর্কে চূড়ান্ত অভিমত প্রদান করবে। কক্ষদুটির একটিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলির জনপ্রতিনিধিগণ এবং অপরটিতে অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা-সমূহের প্রতিনিধিগণ আসন গ্রহণ করবেন।১ উল্লিখিত বিবৃতির পরিশিষ্ট (Appendix) অংশে ১৯৪১-এর জনগণনা (Census) অনুসারে সংশ্লিষ্ট প্রদেশসমূহের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার তালিকা পেশ করা হয়। বাংলা প্রদেশ সম্পর্কে সেখানে বলা হয় —
2. BENGAL
Chittagong Division – Chittagong, Noakhali, Tippera
Dacca Division – Bakerganj, Dacca, Faridpur, Mymensingh
Presidency Division – Jessore, Murshidabad, Nadia
Rajshahi Division – Bogra, Dinajpur, Maldah, Rajshahi,
Rangpur২
বিবৃতিতে উল্লিখিত এই তালিকার ভিত্তিতে একথা বলা চলে যে, বাংলা প্রদেশের এই ষোলোটি জেলা ছাড়া বাকি জেলাগুলিকে অ-মুসলিম বা হিন্দু-প্রধান হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং সেক্ষেত্রে বলা হয়েছিল যে, প্রদেশের আইনসভা বিভাজনের পক্ষে রায় দিলে তবেই ‘সীমানা কমিশন’ (Boundary Commission) গঠন করে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত সেখানে একথারও উল্লেখ ছিল যে, প্রদত্ত তালিকাটি চূড়ান্ত নয় — একটি সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র— কাজের সুবিধার জন্যই তা উপস্থাপিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার ‘সীমানা কমিশন’-এর উপরেই অর্পিত হয়েছিল। অবশ্য মূলনীতি হিসেবে ‘Contiguous majority areas of Muslims and Non-Muslims’ চিহ্নিত করার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য একই সঙ্গে অন্যান্য পারিপার্শ্বিক উপাদানের গুরুত্বও বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত করার কথা উল্লিখিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ এর ১৭/১৮ই জুলাইয়ের পর যে Indian Independence Act জারি হয়েছিল, সেখানেও প্রথম ও দ্বিতীয় সিডিউলে ৩রা জুন ১৯৪৭-এর বিবৃতির পরিশিষ্ট অংশে বর্ণিত জেলাগুলির তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে, প্রথম সিডিউলে বর্ণিত যেসব জেলা সমূহ নিয়ে প্রস্তাবিত ‘পূর্ববঙ্গ’ গঠিত হতে পারে তার উল্লেখ করেও এ কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে, এটি নিতান্তই একটি সম্ভাব্য ব্যবস্থা বা notional arrangement। এক্ষেত্রে শিডিউলটির শিরোনাম লক্ষণীয় : ‘Bengal Districts provisionally included in the new province of East Bengal’৩
ইতিমধ্যে এসে পড়ে ১৯৪৭-এর ২০শে জুন, যেদিন বাংলার আইনসভার সদস্যগণ নির্ধারিত পদ্ধতিমাফিক প্রদেশ বিভাজনের পক্ষেই রায়দান করে। প্রথমে আইনসভার যৌথ অধিবেশনে ১২৬ : ৯০ ভোটের ব্যবধানে স্থির হয় যে, প্রদেশ যদি ভাগ না হয়, তবে তা পাকিস্তানের জন্য গঠিত নতুন সংবিধান সভায় যোগদান করবে। ওই দিনই আইনসভার অমুসলিম সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট অপর একটি কক্ষে ৫৮ : ২১ ভোটে প্রদেশ বিভাজন ও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের সপক্ষে অভিমত প্রদান করা হয়। অন্যদিকে আইনসভার মুসলমান সদস্যদের নিয়ে আর-একটি কক্ষে ১০৬ : ৩৫ ভোটে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়। সেখানে অবশ্য ১০৭ : ৩৪ ভোটের ব্যবধানে এটাও স্থিরীকৃত হয় যে, প্রদেশ বিভাজন অনিবার্য হলে ‘পূর্ববঙ্গ’ পাকিস্তানের জন্য গঠিত নতুন সংবিধান সভায় যোগদান করবে। বাংলার আইন সভায় গৃহীত এ-সব প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ৩রা জুনের সরকারি বিবৃতি প্রকাশের মাত্র ১৭ দিনের মধ্যেই বাংলা প্রদেশ ভাগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়।৪
এভাবেই সরকারি ঘোষণা এবং আইনসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক দেশভাগের সঙ্গে বঙ্গ-বিভাজনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও তা বাস্তবায়নের কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। সরকারিভাবেও সে কথার আভাস মেলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ৩রা জুনের বক্তব্যেই, যখন তিনি ‘administratative consequences of partition’ সম্পর্কে নেতাদের অবহিত করেন। বলা বাহুল্য যে, এ-সব কথাবার্তার মধ্যেই সীমানা কমিশন নিয়োগের কথা, কমিশনের বিচার্য বিষয় (terms of reference) নির্ধারণের কথা, ধারণাগতভাবে সীমানা নিরূপণের কথা (fixation of notional boundary) এবং এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা কথাও সামনে এসে পড়ে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় যে, এসব কাজ শেষ করার জন্য হাতে মাত্র ৭৪ দিন (৩ জুন, ১৯৪৭ থেকে ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭) সময় ছিল। ইতিমধ্যে আবার বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার বিবিধ প্রয়াস সামনে আসতে থাকে। সেগুলির মধ্যে প্রথম প্রস্তাবটির উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তাঁরা দেশভাগের আলোচনার প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ ‘স্বাধীন বাংলা’ গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখেন। নানা কারণে শরৎ বসুদের এই প্রস্তাব সোহরাবর্দির কাছেও বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। তিনিও তাঁর নিজের মতো করে অনুরূপ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিও ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা’-র সপক্ষে ময়দানে নেমে পড়ে। এসব আলোচনার আবহে মানভূম, সিংভূম, পূর্ণিয়া ও সুরমা উপত্যকাকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘বৃহত্তর বঙ্গদেশ’ গঠনের সম্ভাব্যতা নিয়েও কথা ওঠে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে পড়ে। এসব নিয়ে অন্যত্র বিস্তারিত লিখেছি।৫
দুই
আগেই বলা হয়েছে যে, প্রাদেশিক আইনসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই কার্যত বাংলা ভাগের সরকারি প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে এবং তৎপ্রেক্ষিতে সীমানা কমিশন গঠনের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এ বিষয়ে নানা ধরনের প্রক্রিয়া শেষে স্যার সিরিল জন র্যাডক্লিফ-এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠিত হয়। ঠিক হয় যে, কমিটিতে দু-জন হিন্দু সদস্য ও দু-জন মুসলমান সদস্য থাকবেন। তদনুসারে বিচারপতি বিজন কুমার মুখোপাধ্যায় এবং বিচারপতি চারুচন্দ্র বিশ্বাস হিন্দু-সদস্য হিসেবে মনোনীত হন; এবং বিচারপতি আবু সালেহ মহম্মদ আকরাম ও বিচারপতি এস এ রহমান মুসলমান সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। কমিশনের বিচার্য বিষয় (terms of reference) হিসেবে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, কমিশন সুনির্দিষ্টভাবে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলির সীমানা নির্দেশ করবে। এ-কাজ করতে গিয়ে কমিশন একদিকে যেমন উভয় সম্প্রদায়ের বসতি কেন্দ্রের সংলগ্ন এলাকাসমূহের (contiguous areas) কথা বিবেচনা করবে; তেমনই আবার অন্যান্য বিষয়সমূহও (other factors) বিচারের অন্তর্ভুক্ত করবে। এ বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনে যথা শীঘ্র সম্ভব কমিশনকে রিপোর্ট প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়।৬
সীমানা কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৫ জুলাই ১৯৪৭। কিন্তু তার আগেই সরকার যে কাজ চালানোর সুবিধা বিবেচনায় মুসলিম অধ্যুষিত যে ষোলোটি জেলার একটি তালিকা notional boundary হিসেবে ঠিক করে দিয়েছিল, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। অবশ্য সেই তালিকা যে সকলের গ্রহণীয় ছিল না — তা বলাই বাহুল্য। স্বাভাবিকভাবেই উক্ত ১৬ টি জেলা নিয়ে যে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গঠিত হবে সে বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। সে কারণে, কমিশনের সামনে বিভিন্ন মহলের দাবি ও পালটা দাবি উপস্থাপনের সুযোগ থেকে গেল; কমিশনের হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের পৃথক পৃথক প্রতিবেদনও পেশ করা হল। এ-সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলেও কার্যত কোনও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হল না। নানা বিষয়ে মতপার্থক্যের পাশাপাশি ‘ভৌগোলিক ধারাবাহিকতা’ (geographical contiguity) ‘নদী ব্যবস্থা’ (river system) এবং ‘সাংস্কৃতিক যোগসূত্র’ (cultural connections) ইত্যাদি মাপকাঠিগুলি (yardsticks) সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ সভায় প্রতিফলিত হতে থাকল। বস্তুতপক্ষে, এসব বিতর্কের জট ছাড়িয়ে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কমিশন কীভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপিত করবে, সে বিষয়ে বেশ কিছুটা অনিশ্চয়তাও পরিলক্ষিত হল। এ-সবের বিস্তারিত আলোচনা প্রবন্ধের কলেবরকে অহেতুক বাড়িয়ে তুলবে — এমনতর আশঙ্কায় বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে হল। এখানে তাই এটুকুই বলার যে, এসব কিছু সত্ত্বেও কমিশন কিন্তু ১২ই আগস্ট ১৯৪৭ এর মধ্যেই তার প্রতিবেদন পেশ করতে সমর্থ হয়েছিল বলেই জানা যায়। জনশ্রুতি এই যে, মাউন্টব্যাটেন সাহেবের অভিপ্রায় অনুসারে ‘র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড’ ১৪/১৫ আগস্টের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত প্রদেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে চেপে রাখা হয়েছিল। সেকারণে পূর্ব-ঘোষিত ধারণাগত সীমানা (notional boundary) ধরে নিয়েই আনুষ্ঠানিক কাজ সমাধা হয়েছিল। এর ফলে ১৫ আগস্টের স্থিতি এবং ‘র্যাডক্লিফ ঘোষণা’-র মধ্যে তারতম্য থেকেই গেছিল যা ১৭ আগস্ট সংশ্লিষ্ট সকলের জ্ঞাতার্থে প্রকাশিত হয়েছিল।৭
এভাবেই ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ ‘র্যাডক্লিফ রায়’ সামনে এলে দেখা গেল যে, কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক গোটা চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগ পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে; রাজশাহী বিভাগের রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলা এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের খুলনা জেলা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হয়। অপরদিকে সমগ্র বর্ধমান বিভাগসহ প্রেসিডেন্সি বিভাগের কলকাতা, ২৪ পরগনা এবং মুর্শিদাবাদ জেলা ও রাজশাহী বিভাগের দার্জিলিং জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। নদিয়া, যশোর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও মালদহ জেলা নবগঠিত দুই বাংলায় মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় ভাগ করে দেওয়া হয়। একইভাবে শ্রীহট্ট জেলার একাংশ অসম থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে অবিভক্ত বাংলার মোট আয়তনের শতকরা ৩৬.২০ ভাগ জমি ও মোট জনসংখ্যার ৩৫. ১৪ জন মানুষ। ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর ভাগে পড়ে শতকরা ৬৩.৮০ ভাগ জমি ও শতকরা ৬৪.৮৬ জন মানুষ। তৎকালীন হিসেব অনুসারে মোট মুসলমান জনসংখ্যার শতকরা ১৬.০৬ জন পশ্চিমবঙ্গে ও শতকরা ৮৩.৯৪ জন ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এ বসবাস করবে। অন্যদিকে অ-মুসলমান জনসংখ্যার শতকরা ৫২.২২ জনকে ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এ এবং শতকরা ৪১.৭৮ জনকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এ বাস করতে হবে। এই হিসেব অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংখ্যার সম্প্রদায়গত অনুপাত হবে ৭৪.৯৯ : ২৫.০১ শতাংশ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর ক্ষেত্রে তারা ৭০.৮৩ : ২৯.১৭ শতাংশ।৮
প্রসঙ্গত বলি যে ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-য় বিভক্ত দুই বাংলার প্রশাসনিক ও ভূখণ্ডগত এবং জনসংখ্যাগত এই প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে একটি সামগ্রিক ধারণায় উপনীত হওয়া খুবই দুরূহ। তার প্রধান কারণ বোধ করি এই যে, এই প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাগ এবং সীমানা নির্ধারণ— তা সে যেভাবেই করা হয়ে থাকুক না কেন— তার সঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে সীমান্ত রেখার দুই পারের মানুষের জীবনে বিপর্যয় এবং তা এমনই বহুমুখী প্রভাব সৃষ্টি করে যার কোনও অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যা অসম্ভব। প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক বিন্যাস নিয়ে এখানে কিছু কথা এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা সম্ভব হলেও জনবিন্যাসগত দিকটি যে পরবর্তীকালে একেবারেই বদলে গেছে— সে কথা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য দেশভাগ পরবর্তী সময়ের উদ্বাস্তু সমস্যার প্রেক্ষিতে পরিবর্তনশীল জনবিন্যাস যে এই নিবন্ধের বিষয়ীভূত নয়— সে কথাটাও অত্যন্ত স্পষ্ট। বর্তমান আলোচনায় আমরা তাই প্রতিবেদন অনুসরণে দুই বাংলার প্রশাসনিক স্থিতি সম্পর্কিত আলোচনাতেই নিজেদের সীমায়িত রাখব।
তিন
‘র্যাডক্লিফ রায়’ অনুসরণে বিভিন্ন মহলের দাবি ও পালটা দাবির আলোচনায় না গিয়ে বলি যে, প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় ভিত্তিতে জনসংখ্যাগত মাপকাঠিতে যে ধারণাগত বিভাজন (notional partition)-এর কথা বলা হয়েছিল— তা যে সর্বাংশে গৃহীত হয়নি একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে ১৬টি জেলা নিয়ে প্রস্তাবিত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল, তার মধ্যেকার ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রমগুলি এক্ষেত্রে বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। আলোচনার সুবিধার্থে সে-সময়ের প্রশাসনিক বিন্যাস এবং জনসংখ্যাগত বণ্টন সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখাটা জরুরি। উল্লেখ্য যে, অবিভক্ত বাংলার মোট পাঁচটি প্রশাসনিক বিভাগ ছিল—সেগুলি যথাক্রমে বর্ধমান, প্রেসিডেন্সি, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম। ১৯৪১-এর জনগণনা অনুসারে এগুলির মধ্যেকার মুসলিম প্রধান ১৬টি জেলা নিয়েই সরকারিভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছিল। ধারণাগত বিভাজন (notional partition) সম্পর্কিত সরকারি প্রস্তাবে ইতিমধ্যেই আমরা সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির নাম উল্লেখ করেছি। পক্ষান্তরে, বর্ধমান বিভাগের সব জেলাগুলি এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের কলকাতা, ২৪ পরগনা ও খুলনা; এবং রাজশাহী বিভাগের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি; এবং চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য চট্টগ্রাম; অর্থাৎ মোট ১২টি জেলাকে নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। এখন দেখার বিষয় এই যে ‘র্যাডক্লিফ রোঁয়েদাদ’ এই মূল প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কী ধরনের পরিবর্তন জারি করেছে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই উঠে আসে মুর্শিদাবাদ ও খুলনা জেলার কথা। মূল প্রস্তাবে জনসংখ্যাগত বিচারে মুর্শিদাবাদ মুসলমান-প্রধান (৫৬ শতাংশের কাছাকাছি) হওয়ার সুবাদে তা ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর অঙ্গীভূত হওয়ার কথা ছিল। পক্ষান্তরে, খুলনা হিন্দু-প্রধান হওয়ার দৌলতে (৫২ শতাংশের কাছাকাছি) তার ‘পশ্চিমবঙ্গ’-এ অন্তর্ভুক্তি একরকম নির্ধারিত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। অথচ ‘র্যাডক্লিফ বিবেচনা’-য় এই দু-টি জেলার অবস্থানে অদল-বদল ঘটে যায়। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে এবং খুলনা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ভৌগোলিক ধারাবাহিকতা (geographical contiguity) নদী ব্যবস্থা (river system)-র অবস্থিতি-সহ আরও নানা কথার অবতারণা করা হয়ে থাকে। সে-সবের বিস্তারিত আলোচনা এখন থাক। আমরা বরং দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি ‘র্যাডক্লিফ রায়’-এর সেইসব জটিল দিকগুলিতে যেখানে সামগ্রিকভাবে জেলার অবস্থান যেদিকেই হোক না কেন, দেশভাগ ও বাংলা-ভাগের প্রক্রিয়ায় যে জেলাগুলিও বিভিন্ন মাত্রায় বিভাজিত হয়েছে।
মুর্শিদাবাদ এবং খুলনা এই দু-টি জেলার সামগ্রিক অদল বদল যদি সরকারি প্রস্তাবনার নিরিখে ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-র সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বলে চিহ্নিত করা হয়, সেক্ষেত্রে যেসব জেলাগুলিকে দ্বিখণ্ডিত করা হল — গুরুত্বের দিক থেকে সেগুলিকে উপেক্ষা করা সংগত হবে না। এদিক থেকে প্রথমেই উঠে আসে নদিয়া ও দিনাজপুর জেলার কথা। উল্লেখ্য যে, সরকারি প্রস্তাবে মুসলমান-প্রধান জেলা হিসেবে নদিয়া (৬১ শতাংশ) এবং প্রায় সমসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা বিশিষ্ট দিনাজপুর (৫০ শতাংশ) ধারণাগত বিভাজন (notional partition) অনুসারে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু সরকারি প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এবং ‘র্যাডক্লিফ কমিশন’-এর বিচার্য বিষয়গুলি অবলম্বনে নানামহল থেকে কমিশনের কাছে দাবি ও পালটা দাবি উপস্থাপিত হতে থাকে। সেসবের বিস্তারিত আলোচনা এরকম একটি নিবন্ধে কার্যত অসম্ভব হলেও সংশ্লিষ্ট জেলাভিত্তিক আলোচনায় খণ্ডিত জেলা দু-টির প্রশাসনিক স্থিতি সম্পর্কে একটি রূপরেখা উপস্থাপন করা যেতে পারে।
নদিয়া জেলার কথায় এসে বলি যে, জেলাগত ভাবে জনবিন্যাসের বিচারে তা মুসলমান-প্রধান হলেও ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে সীমানা কমিশনের কাছে তার পশ্চিমবঙ্গ-ভুক্তির দাবি ওঠে। ক্ষেত্রবিশেষে ‘সংখ্যাতাত্ত্বিক সত্য’ মেনে নিয়েও সংস্কৃতি সূত্রে তার ভারত-ভুক্তি বা পশ্চিমবঙ্গ-ভুক্তির দাবি করা হয়। ধর্মভিত্তিক যোগসূত্রের কথাও নানাভাবে এবংবিধ আলোচনায় উঠে আসে। এমনকি জনসংখ্যাগত বিন্যাসের প্রশ্নে মহকুমা ভিত্তিক চালচিত্রটি খতিয়ে দেখার কথাও বলা হয়। উল্লেখ্য যে, ‘অবিভক্ত নদিয়া’ জেলা পাঁচটি মহকুমায় বিন্যস্ত ছিল। সেগুলি যথাক্রমে কৃষ্ণনগর (সদর), রানাঘাট, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিক বিচারে প্রথম দু-টি অর্থাৎ কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট মহকুমা নিয়ে ‘খণ্ডিত নদিয়া’ পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাকি তিনটি মহকুমা— কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা— নিয়ে ‘কুষ্টিয়া জেলা’ গঠন করে তা প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, র্যাডক্লিফ সাহেব বহুক্ষেত্রেই সীমানা নির্ধারণে মহকুমা তো বটেই, এমনকি থানা/ব্লকভিত্তিক পর্যালোচনা করে তার রায় চূড়ান্ত করেছিলেন। তদনুসারে কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট মহকুমার পাশাপাশি মেহেরপুর মহকুমার দু-টি থানা/ব্লক— করিমপুর ও তেহট্ট— ‘খণ্ডিত নদিয়া’-র সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবেই ‘র্যাডক্লিফ রায়’ অনুসরণে ‘অবিভক্ত নদিয়া’ জেলা দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।৯
দিনাজপুর প্রসঙ্গে বলি যে, অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৭ সালে জেলাটি তিনটি মহকুমায় বিন্যস্ত ছিল। সেগুলি যথাক্রমে দিনাজপুর (সদর) ঠাকুরগাঁও এবং বালুরঘাট। জনসংখ্যাগত বিচারে এই জেলায় মুসলিম ও অমুসলিম জনগোষ্ঠীর হার প্রায় সমান সমান ছিল। জেলার মোট ৩০টি থানার মধ্যে ১৫টি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। সরকারি প্রস্তাবের সম্ভাব্য বিভাজন তালিকায় এই জেলাটি ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর ভাগে বরাদ্দ হলেও ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-র আঁচড়ে তা দুই ভাগে বিভক্ত হয় এবং সে দু-টি যথাক্রমে ‘দিনাজপুর’ ও ‘পশ্চিম দিনাজপুর’ নামে চিহ্নিত হয়। মূল দিনাজপুর পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলা এবং পশ্চিম দিনাজপুর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান অংশের দিনাজপুরের আয়তন দাঁড়ায় ২৬০৯ বর্গমাইল। জেলা বিভাজনের থানা গত বিন্যাস অনুযায়ী মোট ৩০টি থানার মধ্যে অবশ্য ২০টি চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে। বাকি ১০টি থানা নিয়ে প্রাথমিকভাবে পশ্চিম দিনাজপুর জেলাটি গঠিত হয়। একটু বিশদে গিয়ে বলা যায় যে, অবিভক্ত দিনাজপুরের সদর মহকুমার ছ-টি থানা — রায়গঞ্জ, হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ, ইটাহার, বংশীহারী এবং কুশমন্ডি — এবং তপন, নাগারামপুর, কুমারগঞ্জ এবং ঈশ্বরদী, পার্বতীপুর রেল লাইনের পশ্চিম দিকে বালুরঘাট এই চারটি থানা নিয়ে পশ্চিম দিনাজপুর জেলা গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, প্রধান রেল লাইনের পূর্ব দিকে বালুরঘাটের অংশ বিশেষ— যা হিলি রেল স্টেশনের সাথে যুক্ত, সে অংশটি দিনাজপুরের পূর্ব পাকিস্তান অংশের মধ্যে পড়ে। উল্লেখ্য যে, মালদহ নদিয়া এবং যশোরের মতো দিনাজপুরের কোনও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। বালুরঘাট মহকুমার অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ধামোরহাট থানা, দিনাজপুর সদরের বিরল এবং ঠাকুরগাঁও মহকুমার বোঁচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ এবং কাহারুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার ভিতরে অবস্থিত হওয়ায় তা দিনাজপুরের পূর্ব পাকিস্তান অংশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।১০
এবারে আসা যাক সেই সব জেলাগুলির কথায়, যেগুলি সেই অর্থে দ্বিখণ্ডিত না হলেও মূল সরকারি প্রস্তাবের বাত্যয় বা ব্যতিক্রমী হিসেবে বিভিন্ন মাত্রায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পাকিস্তানের পূর্ব অংশের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই এসে পরে মালদহ জেলার কথা— বিশেষত এ কারণেই যে, মূল সরকারি প্রস্তাবে তা পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য সীমার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জনসংখ্যাগত বিচারে প্রাক্বিভাজন সময়কালে মালদহ ছিল এক অর্থে মুসলমান অধ্যুষিত (৫৬শতাংশ)। জেলার ১৫টি থানার মধ্যে ৯টি ছিল প্রধানত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এগুলি মোটামুটিভাবে পরস্পর সংলগ্ন। উল্লেখ্য যে, অন্যান্য বেশ কিছু জেলার মতোই ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট মালদা জেলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়নি। সংশ্লিষ্ট সকলকেই অপেক্ষা করতে হয়েছে ‘র্যাডক্লিফ রায়’ ঘোষণার জন্য। ১৭ই আগস্ট এই ঘোষণা সামনে এলে দেখা যায় যে, অবিভক্ত মালদহ জেলার মোট ১৫টি থানার মধ্যে দশটি থানা নিয়ে মালদহ জেলার অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেই নির্ধারিত হয়েছে; বাকি পাঁচটি থানা এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেগুলি হল নবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর এবং নাচোল। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত থানাগুলি হল হরিশ্চন্দ্রপুর, খররা, গাজোল, বামনগোলা, হবিবপুর, পুরাতন মালদা, ইংলিশ বাজার, রতুয়া, মানিকচক এবং কালিয়াচক।১১
জলপাইগুড়ি জেলা প্রসঙ্গে এসে বলি যে, এটি অমুসলিম প্রধান জেলা (৭৭ শতাংশ) হিসেবে চিহ্নিত ছিল এবং সম্ভাব্য তালিকাতেও তা স্বাভাবিকভাবেই অনুল্লিখিত ছিল। এতৎ সত্ত্বেও দেশভাগ এবং বঙ্গ বিভাজনের অভিঘাত এখানেও পরিলক্ষিত হয়েছে। সেই অর্থে জেলা ভাগ না হলেও এই জেলা থেকে পাঁচটি থানা এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তা সমগ্র জেলার প্রায় এক চতুর্থাংশ এলাকা। যেসব থানা এলাকাগুলি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৃহত্তর দিনাজপুর গঠিত হয় সেগুলি হল বোঁদা, তেঁতুলিয়া, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড় এবং পাটগ্রাম। উল্লেখ্য যে, এগুলির মধ্যে তেঁতুলিয়া সর্বাধিক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা (৬২.৯৩ শতাংশ)। পঞ্চগড় এবং বোঁদায় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫২.৯৭ এবং ৫০.৭৩ শতাংশ। এর ফলে বিভাজন-উত্তর জলপাইগুড়ি জেলায় থানার সংখ্যা কমে এসে ১৩টিতে দাঁড়ায় এবং তিনটি মহকুমা— জলপাইগুড়ি(সদর), মাল এবং আলিপুরদুয়ার— সেগুলিকে বিন্যস্ত করা হয়। আলিপুরদুয়ার সম্প্রতি নতুন জেলা হিসেবে গঠিত হয়েছে— সে আলোচনা বর্তমান নিবন্ধের বিষয়ীভূত নয়।১২
‘র্যাডক্লিফ রেখা’-য় দুই বাংলার প্রশাসনিক স্থিতি প্রসঙ্গে অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে সিলেটের পূর্ব-পাকিস্তান-ভুক্তির প্রসঙ্গ এসে পড়ে। র্যাডক্লিফ কমিশনের বিচার্য বিষয়সমূহের মধ্যে এ কথাও বলা হয়েছিল যে, সিলেট অঞ্চলের গণভোটে যদি ওই এলাকাটি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তির সপক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সিলেটের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসহ অসমের মুসলিম অধ্যুষিত সংলগ্ন অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়াও কমিশনের কার্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে। উল্লেখ্য যে, ১৯৪১-এর জনগণনা অনুসারে মুসলিম জনবসতির শতকরা হার ছিল ৬০.৭১ শতাংশ। এক্ষেত্রে জনসংখ্যাগত হিসেবের পাশাপাশি ভৌগোলিক ধারাবাহিকতা (geographical contiguity) এবং অন্যান্য বিষয়সমূহও (other factors) যে বিচার্য ছিল— তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কোন কোন দিকগুলি অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি বা তা হয়তো সম্ভবও ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই সিলেট বা শ্রীহট্ট অঞ্চলকে নিয়ে মতবিরোধ কম ছিল না। সেসব নিয়ে বিস্তারিত কথনে না গিয়ে বলি যে, গণভোটের সময়ে শ্রীহট্টের অধিবাসীদের একটা বড়ো অংশ প্রাণপণে ভারতভুক্তির জন্য সচেষ্ট হলেও ভোটের সামগ্রিক ফলে তাদের ব্যর্থতাই প্রকটিত হয় এবং শ্রীহট্টের অঙ্গচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সীমা (natural boundary), যার মধ্যে ভৌগোলিক অবিচ্ছিন্নতার প্রশ্নটি জড়িত এবং রেল যোগাযোগ বিশেষ বিবেচনার বিষয় হয়েছিল বলে জানা যায়। ফলত, কেবলমাত্র সম্প্রদায়গত প্রশ্নটি একমাত্র হিসেবে এখানে গণ্য করা হয়নি। সেখানে অসমের সঙ্গে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণে এক ধরনের এলাকা-বিনিময় এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়— যে আলোচনা এই নিবন্ধের বিষয়ীভূত নয়।১৩
একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে এসে বলি যে, প্রধানত অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হলেও সরকারিভাবেই এ কথা বলার চেষ্টা ছিল যে, চট্টগ্রাম জেলার বাকি অংশ যে ভাগে পড়বে, যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে সেই ভাগেই এলাকাটির অন্তর্ভুক্তি কাম্য। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে বলি যে, বাংলার তৎকালীন গভর্নর ব্যারোজ এরূপ যুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের অঙ্গীভূত করার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৪৭ এর ২৬ জুন তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে টেলিগ্রাম করেও তার এই অভিমতের কথা জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে, অনেকেই প্রধানত হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে বরাদ্দ করার তীব্র বিরোধী ছিলেন। নেহেরু ও প্যাটেল ব্যারোজের ‘ভৌগোলিক যুক্তি’-কে কার্যত অস্বীকার করে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থার ভাবনা থেকে অঞ্চলটিকে উত্তরের কোনও রাজ্য এবং সম্ভবত অসমের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন। নিজেদের দাবি সম্পর্কে তারা এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে তারা প্রায় আশ্বস্ত করেই রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘র্যাডক্লিফ রায়’ এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষেই যায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মূল চট্টগ্রাম জেলার অংশ হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হিসেবেই পরিগণিত হয়।১৪
৪৭-এর দেশভাগের প্রেক্ষিতে দুই বাংলার সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াতে আত্মপ্রকাশ করে ‘ছিটমহল’ নামে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুঃসহ এক ভৌগোলিক ব্যবস্থাপনা, যা এক অর্থে চূড়ান্ত অব্যবস্থার সমান। এক কথায় এটি ‘ছিটমহল সমস্যা’ নামে পরিচিত, যা কার্যত হয়ে পড়ে ‘রাষ্ট্রহীন’ বা ‘দেশহীন’ মানুষের আবাসস্থল। ব্যাখ্যা করে বলা যায় যে, ‘ছিট’ শব্দের অর্থ হল খণ্ড বা টুকরো। বিভিন্ন মহলকে এক একটি খণ্ডে বিভক্ত করার পরে এগুলির নাম হয় ‘ছিটমহল’, বাস্তবে তা হল কোনও রাষ্ট্রের বা এক বা একাধিক ক্ষুদ্র অংশ যা ভৌগোলিক দিক থেকে অন্য রাষ্ট্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ছিটমহলের দীর্ঘ ইতিহাসে না গিয়ে বলি যে, দেশভাগের প্রেক্ষিতে ছিটমহলগুলির দু-দেশের সীমান্ত রেখার উভয় পাশেই বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থিত থাকায় সেসব এলাকায় অধিবাসীদের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল সমস্যার আবর্ত সৃষ্টি হয়। বিভাগ পরবর্তী সময়কালে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু হলে ছিটমহলগুলির সংকট আরও গভীরতর হয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালের ৬ই জুন উভয় দেশের মধ্যে ছিটমহল ও অমীমাংসিত অপ-দখলীয় এলাকার বিনিময় চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং সমস্যার অনেকটাই সুরাহা হয়। এই চুক্তি অনুসারে মোট ১৬২টি ছিট মহল বিনিময় হয়েছে যার মধ্যে ভারতের ভাগে এসেছে ৫১টি ছিটমহল এবং বাংলাদেশ পেয়েছে ১১১টি। বলা বাহুল্য যে, ছিটমহল সমস্যা বর্তমান নিবন্ধের উপজীব্য নয় এবং তা নিয়ে পৃথক আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। এখানে কেবল এটুকুই বলা যায় যে, র্যাডক্লিফ সাহেব কাগজে কলমে যেভাবে ভাগাভাগি চূড়ান্ত করেছেন, বাস্তবে সেভাবে সীমানা নির্ধারণ সর্বত্র সম্ভব হয়ে ওঠেনি। র্যাডক্লিফ সেভাবে ছিটমহল সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেননি। ফলত, সীমানার দুইপারের মানুষকেই দীর্ঘকাল এই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে চলতে হয়েছে।১৫
চার
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলি যে ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-য় বঙ্গ বিভাজনের যে রূপরেখা এই আলোচনায় উপস্থাপিত হয়েছে তা এক অর্থে সামগ্রিক প্রক্রিয়ার ফলাফল মাত্র। বস্তুতপক্ষে একটি নিবন্ধের কলেবরে সার্বিক প্রক্রিয়াটি বিবৃত করা কার্যত অসম্ভব। এতৎসত্ত্বেও ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা অনুসরণে কয়েকটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয় যে, অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে র্যাডক্লিফ সাহেবের নেতৃত্বাধীন সীমানা কমিশনকে বঙ্গ বিভাজনের মতো জটিল বিতর্কিত এক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। উল্লেখ্য যে, একাজ অত্যন্ত দুরূহ ছিল এবং র্যাডক্লিফ সাহেব নিজেই এটিকে প্রায় দু-বছরের কাজ বলে মনে করতেন। অথচ, নানা মহলের চাপে ‘দু-বছরের কাজ’ তিনি মাত্র দু-মাসেই সেরে ফেলেছিলেন। স্বভাবতই কমবেশি বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সকলকেই। দ্বিতীয় প্রশ্নটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিগত বিষয়। উল্লেখ্য যে, কমিশনের দু-জন করে ‘হিন্দু সদস্য’ ও ‘মুসলমান সদস্য’ নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁরা যেমন নিজেদের মতামত সংবলিত পৃথক প্রতিবেদন কমিশনের সম্মুখে উপস্থাপিত করেছিলেন, তেমনই বিভিন্ন মহল থেকে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই কমিশনের সামনে আরও অনেক পরস্পর বিরোধী দাবি দাওয়া পেশ করা হয়েছিল। কমিশনের অমুসলিম সদস্যদের একটি প্রতিবেদন ২৯ জুলাই ১৯৪৭-এ জমা পড়ে এবং ঠিক তার আগের দিন অর্থাৎ ২৮ জুলাই ১৯৪৭-এ মুসলিম সদস্যদের রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হল এই যে, এ ধরনের পরস্পর বিরোধী প্রতিবেদন থেকে কোনও ঐক্যমতে উপনীত হওয়াটা একান্তভাবেই অসম্ভব ছিল। সে ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের ভূমিকা কী তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকে গিয়েছিল। সেই মর্মে র্যাডক্লিফ কমিশনের রায়-এর বৈধতার প্রশ্নে ব্রিটিশ সরকারকে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন করতে হয়েছিল এবং কার্যত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তকেই বৈধতা দিয়ে এই বিতর্কের অবসান ঘটানো হয়েছিল।
প্রসঙ্গত এসে পড়ে ‘র্যাডক্লিফ রায়’-এর যৌক্তিকতা নিয়ে নানা কথা। স্বভাবতই এক্ষেত্রে একদিকে যেমন সম্প্রদায়গত প্রতিক্রিয়া বেশ জোরালো, তেমনই আবার এলাকাগত ক্ষোভ-বিক্ষোভও বড়ো কম নয়। উল্লেখ্য যে, এলাকাগত প্রতিক্রিয়াসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানিক এবং সেগুলোর মধ্যে বিভিন্নতা এত বেশি যে কোনোভাবেই সেগুলিকে সূত্রায়িত করা একান্তভাবে অসম্ভব। সম্প্রদায়গত অবস্থান বিবেচনায় বলা যায় যে, ক্ষেত্রবিশেষে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই ‘র্যাডক্লিফ রায়’-এর বিরুদ্ধে তাদের প্রতি অবিচারের অভিযোগ উঠেছে। মুর্শিদাবাদ মুসলমান-প্রধান হওয়া সত্ত্বেও কেন তা পশ্চিমবঙ্গের ভাগে, বা খুলনা জেলা হিন্দু-প্রধান হলেও কেন তা পূর্ব পাকিস্তানের; তা এক বহুচর্চিত অভিযোগ। নদিয়া জেলা মুসলমান অধ্যুষিত হলেও কেন তার বিভাজন করে একটা বড়ো অংশ পশ্চিমবঙ্গে দেওয়া হল; মালদহ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাঁচটি থানা এলাকা পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়ে বাদবাকি গোটা জেলাটিকে কেন পশ্চিমবাংলার ভাগে বরাদ্দ করা হল— এরকম অসংখ্য অভিযোগ বিভিন্নভাবে উত্থাপিত হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, এ ধরনের অভিযোগ— তা সে যে সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই উত্থাপিত হোক না কেন — সেগুলি নিয়ে পৃথক আলোচনার অবকাশ রয়েছে। এখানে কেবল এটুকুই বলার যে, ধারণাগত বিভাজন (notional partition) কেবলমাত্র ১৯৪১-এর জনগণনা (Census)-র ভিত্তিতে জেলাগত অবস্থান বিবেচনায় মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ জেলার তালিকা উপস্থাপিত করেছে। কিন্তু র্যাডক্লিফ কমিশনের বিচার্য বিষয় (terms of reference)-এ ধর্মীয় পরিচিতি ছাড়াও ভৌগোলিক ধারাবাহিকতা (geographical contiguity) এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, কমিশনের কর্ম প্রক্রিয়ায় এটিও লক্ষণীয় হয়েছে যে, সম্প্রদায় বিশেষের জেলাগত পরিসংখ্যানকেই সবক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করে বহু ক্ষেত্রে মহকুমা ভিত্তিক তো বটেই, এমনকি ব্লক ভিত্তিক বা অন্যান্য বিবেচনাকেও স্থান দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই কমিশনের এমনতর উদ্যোগ বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
এক্ষেত্রে বলতে হয় যে ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-য় বঙ্গ বিভাজনের প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সূচনা বিন্দু (starting point) হিসেবে ধর্মীয় ভিত্তিতে নিরূপিত ধারণাগত বিভাজন (notional partition)-এর সরকারি ছকটি গৃহীত হয়েছিল, যেখানে মুসলমান অধ্যুষিত জেলাগুলি নিয়ে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত পূর্ব পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়েছিল এবং বাকি অংশ ভারতীয় ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের কথা স্থিরীকৃত হয়েছিল। কিন্তু সীমানা কমিশনের বিচার্য বিষয়ে কেবলমাত্র ধর্মীয় বিচারের মাপকাঠিকেই চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করা হয়নি, সেখানে ভৌগোলিক বিষয়সহ ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে যে অন্যান্য বিষয় (other factor) -এর কথা বলা হয়েছিল তা notional boundary-র ধর্মীয় মাপকাঠি অতিক্রম করে কমিশনকে প্রাকৃতিক সীমা (natural boundary)-র কথা ভাবতে প্রণোদিত করেছে। সেই পথেই নদী ব্যবস্থা, রেল পরিবহণ ব্যবস্থা, সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ইত্যাদি নানা বিষয় বিচারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্য কথায় বলি যে, এর ফলে বহু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনের ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা’ কমবেশি প্রয়োগের অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। আবার, কমিশনের এই অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগিক ক্ষেত্রে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে র্যাডক্লিফ সাহেবের ক্ষমতার রূপ পরিগ্রহ করেছে। এক্ষেত্রে বিদায়ী ঔপনিবেশিক শাসককূলের পৃষ্ঠপোষকতার দিকটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনই ছিল ‘র্যাডক্লিফ রায়’ মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও লিগ নেতৃবৃন্দের আগাম প্রতিশ্রুতি। সব মিলিয়ে ‘র্যাডক্লিফ রায়’ অর্জন করেছে এক ধরনের আইনি ও নৈতিক বৈধতা, যার ফলে তা প্রয়োগ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।
অবশ্য আইনগত বৈধতা পেলেও তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিক্ষোভ যে বড়ো কম ছিল না সে কথা আমরা আগেই বলেছি। বস্তুতপক্ষে পরস্পর বিরোধী সবমহলেই যে ‘অন্য পক্ষ’-কে বেশি করে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ যেমন ছিল, তেমনই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে মেনে নেওয়ার এক ধরনের মানসিকতাও বিদ্যমান ছিল। এরকম একটা প্রেক্ষিতেই ‘র্যাডক্লিফ রেখা’-য় বিভক্ত দুই বাংলার প্রশাসনিক স্থিতি সম্পর্কিত আলাপ আলোচনায় পরবর্তীকালে গৃহীত নানা সমীক্ষার কথাও উঠে আসে। বলা বাহুল্য যে, সেগুলিতে কার্যত উভয়বঙ্গে প্রাপ্ত অংশের প্রেক্ষিতে এক ধরনের লাভ-ক্ষতির হিসেব বড়ো আকারে সামনে আসে। এ ধরনের আলোচনায় সম্প্রদায়গত দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি, ভূমিবণ্টন, গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিল্প কারখানার অধিকারের প্রশ্ন, সাংস্কৃতিক বিচারে বিশিষ্ট স্থানের অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি নানা বিষয়ের কথা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়ে জনবিন্যাস সম্পর্কিত নানা কথাও। সেসব আলোচনায় না গিয়েও বলি যে ‘র্যাডক্লিফ রেখা’ যে ত্রুটিমুক্ত ছিল না এ কথা সব পক্ষই কম বেশি মনে করেছেন। তা সত্ত্বেও সব পক্ষই মোটের উপর এটি মেনেও নিয়েছেন। সর্বোপরি এই রায় অনুসারে ‘সীমানা নির্ধারণ’-এর কাজটিও যে মোটের উপর শান্তিপূর্ণভাবে ‘ভবিতব্য’ হিসেবেই সংশ্লিষ্ট সকলে স্বীকার করে নিয়েছেন সে কথাটা কিছুটা অস্বস্তিকর হলেও অনস্বীকার্য। সামগ্রিক বিপর্যয়ের আবহেও তাই একথা ভাবতে ভালো লাগে যে, ব্যাপক অসন্তোষ থাকলেও এই রায়কে ঘিরে অন্তত তাৎক্ষণিকভাবে বড়ো ধরনের কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ পরিলক্ষিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে মোড় নেয় এবং পরিবর্তনশীল জনবিন্যাস ‘র্যাডক্লিফ ঘোষণা’–কে ঘিরে অনেক হিসেব নিকেশকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। এতৎ সত্ত্বেও সীমানা নির্ধারণের প্রশ্নে দুই বাংলার প্রশাসনিক স্থিতি র্যাডক্লিফ নির্দেশিত বিভাজন রেখায় অপরিবর্তিত থাকে।
সূত্রনির্দেশ :
১. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, ‘ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ৮৮-৮৯ : সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত, বঙ্গ-সংহার এবং (১৯৪৬-১৯৫০), নয়া উদ্যোগ, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ৬৬-৮৩
২. Appendix to the Statement made by His Majesty’s Government, 3 June, 1947, as quoted in লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ.-
৩. পূর্বোক্ত, পৃ.- ৮৯
৪. পূর্বোক্ত, পৃ.- ৮৮-৮৯ [Also see, Viceroy’s Personal Report No. 10, dated 29th June, Para – 7, India Office Records, Private Office Paper L/PO/6/123 ff 137-50]; সত্যব্রত দত্ত, ‘বাংলার বিধান সভার একশো বছর : রাজানুগত্য থেকে গণতন্ত্র’, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা
৫. পূর্বোক্ত, পৃ.- ৯১ [বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন, অমলেশ ত্রিপাঠি, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’, আনন্দ প্রকাশন, কলকাতা, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৪৬০-৬৭; Shila Sen, ‘Muslim Politics in Bengal’ (1937-1947), Impex India, New Delhi, 1976; Amalendu Dey, Islam in Modern India, Maya Prakashan, Calcutta, 1982; কালীপদ বিশ্বাস, ‘যুক্ত বাংলার শেষ অধ্যায়’, নয়া উদ্যোগ, কলকাতা; Debnarayan Modak, “Revisiting the plea for ‘United Bengal’ in Pre-partitioned India; Different Perspectives”, Socialist Perspective, 45(3-4), December, 2017-March 2018; দেবনারায়ণ মোদক, ‘বিভাগ-পূর্ব ভারতে যুক্তবঙ্গের প্রয়াস : কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান,’ ইতিহাস অনুসন্ধান-১৮, ফার্মা কে এল এম, কলকাতা, ২০০৪; ইত্যাদি
৬. See, for details, ‘The Gazette of India Extra-ordinary’, dated 30 June, 1947; লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ.- ৯৬-৯৭
৭. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ.- ১১০-১১
৮. পূর্বোক্ত, পৃ.- ১১১-১২
৯. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য : দেবনারায়ণ মোদক, “কালপ্রবাহে নদিয়া : পরিবর্তনশীল প্রশাসনিক সীমা”; বনামি; দেবনারায়ণ মোদক, “দেশ-ভাগ, বঙ্গ-বিভাজন ও সীমানা-নির্ধারণ : নদিয়া জেলার বিভাজন-উত্তর প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস,” সমাজ জিজ্ঞাসা, বিদ্যাসাগর সমাজ বিজ্ঞান কেন্দ্র, মেদিনীপুর, একাদশবর্ষ, ১ম ও ২য় সংখ্যা, ২০১৮, পৃষ্ঠা : ১২৩-৩২
১০. মাহবুব সিদ্দিকি, “উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক পরিচয় ও প্রশাসনিক বিভাজন”, মননরেখা, বর্ষ-৬, সংখ্যা -৩, জুন ২০২২ (রংপুর ও ঢাকা, বাংলাদেশ) পৃ. ২৮-৮০; মহম্মদ নাজমুল হক, “১৯৪৭-এর দেশবিভাগ ও খণ্ডিত উত্তরবঙ্গ”, মননরেখা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৬-১৪৯; আসফাক হোসেন, “দেশভাগ এক (১৮৭৪), দুই (১৯০৫), তিন (১৯৪৭) এবং উত্তর ও উত্তরপূর্ব বঙ্গের সীমানা বদলের ইতিহাস” মননরেখা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫০-১৬৯; মোজাম্মেল বিশ্বাস, “দেশভাগে দিনাজপুর” মননরেখা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭০-১৮৫; এবং লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ.- ১১১
১১. মাহবুব সিদ্দিকি, পূর্বোক্ত; আসফাক হোসেন,পূর্বোক্ত; এবং লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত
১২. মাহবুব সিদ্দিকি, পূর্বোক্ত; আসফাক হোসেন,পূর্বোক্ত; এবং লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত
১৩. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. -৯৭-১১৯; মাহবুবুর রহমান, “১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ : মালদহ – মুর্শিদাবাদ ও রাজশাহী জেলার সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং তার প্রভাব”, মননরেখা, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১-১৩৫
১৪. লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. -১০৮-১০৯
১৫. মিজানুর রহমান নাসিম, “ছিটমহল : বদ্ধভূমির ইতিবৃত্ত”, মননরেখা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২-২৩৯