রাহুল রায়
মুখপাত
উনিশশো সাতচল্লিশ। ভারতবাসী স্বাধীনতা পেল। অনেক রক্ত ঝরল। ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ল। দেশ ছাড়ার দাগ তারা রেখে গেল স্থায়ী ভাবে। জন্ম নিল পাকিস্তান রাষ্ট্র। তৈরি হল এক নতুন সমস্যা। যে সব মানুষ এতদিন সুখেদুঃখে পাশাপাশি ছিল, তারা পর হল। নিজেদের দেশ গেল হারিয়ে। তছনছ হল সামাজিক জীবন। পালটাল আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থা। দেশভাগ ছিল রাজনীতির ফসল। রাজনীতিটি ঘটেছিল ধর্মকে নিয়ে। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র। নতুন এই রাষ্ট্রটি ছিল ভারতের দুই প্রান্তে — পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। দুই জায়গাতেই দলে দলে হিন্দু নাগরিক তাদের বাড়ি, জমি, সম্পত্তি সব ফেলে এদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। তারা এখন উদ্বাস্তু। নিঃস্ব। পাকিস্তানি শাসকেরা দাঙ্গাকারীদের মদত দিয়েছে। উস্কানি দিয়েছে হিন্দুদের তাড়াতে।
দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু
১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে দাঙ্গা হয়। এর পরেই তখনকার পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে হিন্দুরা চলে আসতে শুরু করে। দেশভাগের পরে এই সংখ্যাটি ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৫০ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির পরেও এই আসা থামেনি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৮-এর ডিসেম্বর অবধি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে ৪১.১৭ লক্ষ উদ্বাস্তু আসে। এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আসে ৩১.৪২ লক্ষ। এর পরেও ১৯৬১-৬৫ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ১০ লক্ষ উদ্বাস্তু চলে আসে। ১৯৭১ সাল অবধি ভারতে আসা উদ্বাস্তুদের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৮ লক্ষ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পরে আরও বহু মানুষ পাকাপাকি ভাবে ভারতে চলে এল। ফলে উদ্বাস্তুর সংখ্যা আরও বাড়ল। ১৯৭৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্ল্যানিং কমিশন-এর কাছে এ ব্যাপারে এক প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ১৯৭১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে চলে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। উদ্বাস্তুদের এই হিসেবটি কষা হয়েছিল পুলিশের নথি দেখে। কারণ এরা চেকপোস্ট হয়ে এসেছিল। কিন্তু এরা ছাড়াও আরও মানুষ এদেশে এসেছিল দীর্ঘ ও খোলা সীমানা দিয়ে, পুলিশের নজর এড়িয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কোনও হিসেব নেই, থাকলে সংখ্যাটি নির্ঘাৎ ৬০ লক্ষের অনেক বেশি হত। ১৯৭৬ সালে ভারত সরকারের ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সাল অবধি আসা এই উদ্বাস্তুদের মূলত দু-টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অক্টোবর, ১৯৪৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৬৩ সালের মধ্যে আসা মানুষদের বলা হল পুরানো উদ্বাস্তু। আর ১ জানুয়ারি, ১৯৬৪ থেকে ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের মধ্যে আসা মানুষদের বলা হল ‘নতুন উদ্বাস্তু’।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন
১৯৪৭-এর গোড়া থেকেই বিপুল সংখ্যায় আসতে থাকা উদ্বাস্তুদের ত্রাণ দেওয়া সরকারের এক প্রাথমিক কাজ ছিল। নানান জায়গায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার মধ্যবর্তী ত্রাণ শিবির খুলেছিল। এসব শিবিরে উদ্বাস্তুদের খাবার, জামাকাপড়, ওষুধ ও আশ্রয় দেওয়া হত। উদ্দেশ্য ছিল সরকারি সাহায্যে এরা যেন নিজেদের আবার কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারে। মোট ৩১.৩২ লক্ষ পুরানো উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৭.১২ লক্ষ মানুষকে শিবিরে রাখা হয়েছিল। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য রাজ্য সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। বেশ কিছু চাষের ও ভিটে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল এদের জন্য। এমনকি জমি কেনার জন্য ঋণ দেওয়ারও বন্দোবস্ত হল। এই উদ্বাস্তুরা যাতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু করতে পারে, ছোটো মাপের কোনও ব্যবসা চালাতে পারে, চিকিৎসা পায়, তার বন্দোবস্তও করা হল। এসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান ও নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হল। নানা কাজও এদের দেওয়া হল। পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও শহরে ছড়িয়ে থাকা এই উদ্বাস্তু পরিবারদের জন্য রাজ্য সরকার আলাদা ভাবে সাহায্য করেছিল। গ্রামে প্রায় ৩.৮৪ লক্ষ চাষি ও অ-চাষি পরিবার রাজ্য সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিল। চাষিদের পুনর্বাসনের জন্য রাজ্য সরকার চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। যেমন — ‘টাইপ প্রকল্প’, ‘ইউনিয়ন বোর্ড প্রকল্প’, ‘বারুজীবী প্রকল্প’ এবং ‘উদ্যানপালন প্রকল্প’। একই ভাবে শহরের প্রায় ১.৩৯ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবারও সরকারের কাছ থেকে নানা সাহায্য পেল। এরা জমি কেনা থেকে শুরু করে বাড়ি করা, ব্যবসা ইত্যাদির জন্য সরকারি ঋণ পেল।
স্বাধীনতার পরে উদ্বাস্তু রা পশ্চিমবঙ্গে আসার পর থেকে রাজ্য সরকার নানা ভাবে তাদের আর্থ-সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে। উদ্বাস্তু দের পুনর্বাসনের কাজটি সহজ ছিল না। এই কাজটি সরকারের শরণার্থী-ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রক-এর আওতায় পড়ে। এই মন্ত্রকের বিভিন্ন বিভাগে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্বটি ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। পুনর্বাসন বিভাগটির দায়িত্ব ছিল উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা এবং না-থাকা মানুষদের দেখভাল করা। উদ্বাস্তু পরিবারগুলি যেন আর্থিকভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সেই গুরুদায়িত্বটিই ছিল এই বিভাগের।
উদ্বাস্তুদের চিকিৎসার জন্য রাজ্য সরকার সাধারণ হাসপাতাল, যক্ষ্মা হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও নানান ডিসপেনসারি খুলেছিল। হাসপাতালগুলিতে শয্যাসংখ্যাও বাড়ানো হয়েছিল।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কর্মসংস্থান
উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নানা প্রায়োগিক ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৭ হাজার মহিলা সহ ৪৫ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু এই প্রশিক্ষণ পায়। প্রশিক্ষণ শেষে এরা কারুশিল্পী, সুপারভাইজার এবং ইঞ্জিনিয়ার হয়। বিভিন্ন শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও পলিটেকনিক কেন্দ্রে উদ্বাস্তুদের জন্য জায়গা সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে এদের থাকার জায়গা করে দেওয়া, প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি কেনা ও অন্যান্য খরচ চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিকে সরকারি ভাবে আলাদা অনুদান দেওয়া হয়। অবশ্য ১৯৬৪ সালের পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে মহিলা উদ্বাস্তুদের প্রশিক্ষণ ও কাজ দেওয়ার জন্য ৩৮টি প্রশিক্ষণ তথা উৎপাদন কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। ব্যক্তিমালিকানাধীন ও রাজ্য সরকারি কলকারখানায় উদ্বাস্তুদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। কয়েকটি রাজ্য সরকারি সংস্থায়, যেমন রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ ও কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম-এ আর্থিক সাহায্য করা হয় উদ্বাস্তু যুবক-যুবতিদের কাজ দেওয়ার জন্য। যে সব উদ্যোগী উদ্বাস্তু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বা সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছিল, তারাও সরকারের আর্থিক সাহায্য পেল। উদ্দেশ্য আরও অন্য উদ্বাস্তুদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া। উদ্বাস্তুদের কর্মসংস্থানের জন্য ভারত সরকার কলকাতায় ‘দ্য রিহ্যাবিলিটেশন ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন লিমিটেড’ স্থাপন করে।
বিদ্যালয় শিক্ষা
উদ্বাস্তু বিদ্যালয় পড়ুয়াদের শিক্ষার দিকেও রাজ্য সরকারের নজর ছিল। বিনা পয়সায় তারা প্রাথমিক শিক্ষা পেত। উদ্বাস্তু শিশুদের জন্য প্রায় ১৩০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা হয়েছিল। লেখাপড়ায় ভালো ছাত্রছাত্রীরা মাধ্যমিক স্তর অবধি বিনা পয়সায় পড়ত। দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের বেতন ও বই কেনার জন্য বৃত্তি পেত। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কলা, বিজ্ঞান, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং তা সে যে বিষয় নিয়েই পড়ুক না কেন বৃত্তি পেত।
উদ্বাস্তু কলোনি
কলকাতা ও তার আশেপাশে স্বাধীনতার ঠিক পরেই বেশ কিছু উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে ওঠে। এই কলোনিগুলি দুই ধরনের ছিল। বেশ কিছু কলোনি ছিল ‘সরকার পোষিত’। সরকারি জমিতে ভিটের নকশা তৈরি হত। পরে উদ্বাস্তু পরিবারগুলির হাতে এই ভিটেজমি তুলে দেওয়া হত অর্পণ পত্র-এর মাধ্যমে। অর্পণ পত্র দেওয়ার কিছু শর্ত রাখা হত। জমির ন্যায্য দামটির আংশিক বা পুরোপুরি সরকারকে ফেরত দিতে হত। যে সব পরিবার উদ্বাস্তু শিবিরে থাকত, মূলত তাদেরকেই এই কলোনিগুলিতে পুনর্বাসন দেওয়া হত। দুই ধরনের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলোনি ছিল, যেমন — ‘শহুরে কলোনি’, যেখানে কেবল ভিটেজমি উদ্বাস্তুদের হাতে তুলে দেওয়া হত এবং ‘গ্রামীণ কলোনি’, এখানে প্রতি উদ্বাস্তু পরিবার পিছু ১০ কাঠা ভিটেজমি এবং ৩ একর (১ বিঘা) চাষজমি দেওয়া হত। বিভিন্ন জেলায় ‘সরকার পোষিত’ শহুরে কলোনি-র মোট সংখ্যা ছিল ৩৩১। এই কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল বর্ধমান (২০টি), কুচবিহার (১টি), দার্জিলিং (১টি), বাকুড়া (১টি), বীরভূম (৪টি), হুগলি (৪৪টি), হাওড়া (২২টি), জলপাইগুড়ি (৬টি), মেদিনীপুর (৩টি), মুর্শিদাবাদ (৭টি), মালদা (৬টি), নদিয়া (২৭টি), উত্তর ২৪ পরগনা (১৫৬টি) এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা (৩৩টি) জেলায়। আর সরকার পোষিত মোট গ্রামীণ কলোনি ছিল ২৭২টি। এরা গড়ে উঠেছিল বর্ধমান (৫টি), কুচবিহার (১৩টি), দার্জিলিং (২টি), বীরভূম (১৫টি), হুগলি (১১টি), হাওড়া (১টি), জলপাইগুড়ি (৭টি), মুর্শিদাবাদ (১৮টি), মালনা (১টি), নদিয়া (২৮টি), দক্ষিণ ২৪ পরগনা (১২টি), উত্তর ২৪ পরগনা (৮২টি), মেদিনীপুর (৫০টি), উত্তর দিনাজপুর (১টি) এবং দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় (২টি)।
জবরদখলকারী কলোনি
সরকার পোষিত এই সব কলোনি ছাড়াও আর এক ধরনের কলোনি ছিল। এই সব কলোনি এমন সব জমিতে গড়ে ওঠে যেগুলি কখনোই কারুর কাছ থেকে কেনা হয়নি, বা পাওয়াও যায়নি। কোনও ব্যক্তিগত, আধা সরকারি, এমনকি সরকারি জমিতেও কোনও অনুমতি ছাড়াই এগুলি গড়ে ওঠে। সোজা কথায় যাকে বলা যায় এসব জবরদখল করা জমি। এসব জমি সরকারও পরে কখনও অধিগ্রহণ করে উদ্বাস্তু পরিবারদের দেয়নি। সরকারি উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব ছিল জবরদখলকারী কলোনিগুলির নিয়ন্ত্রণ। প্রধানত তিন ধরনের ‘জবরদখলকারী কলোনি’ ছিল, যেমন ১৪৯টি দলের কলোনি, অল্পসংখ্যক ১৭৫টি দলের কলোনি এবং ৬০৭টি দলের কলোনি।
১৯৫২ সালে গঠিত ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ এবং ‘পরে ওয়ার্কিং’ গ্রুপ স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরেই গড়ে ওঠা ১৪৯টি এই কলোনিকে চিহ্নিত করেছিল। ১৯টি বিভিন্ন পুলিশ থানায় জবরদখলকারী এই কলোনিগুলি অবস্থিত ছিল। যে সব থানায় জবরদখলকারী এই কলোনিগুলি অবস্থিত ছিল সেগুলি হল যাদবপুর (৩১টি), কসবা (১৭টি), টালিগঞ্জ (৩টি), রিজেন্ট পার্ক (১টি), তিলজলা (১টি), বেহালা (২টি), ঠাকুরপুকুর (১টি), বালি (১টি), হাবড়া (২টি), শ্রীরামপুর (৩টি), নোয়াপাড়া (৪টি), নৈহাটি (২টি), খড়দহ (১৫টি), বীজপুর (৪টি), বরানগর (৭টি), দমদম (৩৮টি), লেক টাউন (১টি), জগদ্দল (৩টি) এবং বেলঘরিয়া (৫টি)। ওয়ার্কিং গ্রুপ পরে জবরদখল করা জমিতে গড়ে ওঠা নতুন আরও ১৭৫টি কলোনির খোঁজ পায়। জবরদখল করা এই কলোনিগুলির ১২৮টি গড়ে উঠেছিল কলকাতা মেট্রোপলিটান ডেভেলপমেন্ট ডিস্ট্রিক্ট (সিএমডি)-এর অর্ন্তগত খাস কলকাতায় ২৭টি, উত্তর ২৪ পরগনায় ৬৩টি, নদিয়ায় ২টি, হাওড়ায় ৩১টি এবং হুগলিতে ৫টি। আর বাকি ৪৭টি গড়ে উঠেছিল সি এম ডি এর বাইরে শহরাঞ্চলে পশ্চিম দিনাজপুরে ১টি, উত্তর ২৪ পরগনায় ২১টি, নদিয়ায় ১টি, হুগলিতে ৪টি, বর্ধমানে ১২টি (৫টি শহরে, ৭টি গ্রামীণ), বীরভূমে ৭টি (গ্রামীণ) এবং মুর্শিদাবাদে ১টি (গ্রামীণ)। এই সব কলোনি ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৪ সালের মধ্যে গড়ে ওঠে।
অন্য উদ্বাস্তু কলোনি
এগুলি ছাড়াও ১লা জানুয়ারি, ১৯৫১ সালের পর থেকে ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সালের মধ্যে গড়ে ওঠা ৬০৭টি আরও এক ধরনের কলোনি ছিল। এই কলোনিগুলির নাম ছিল ‘পোস্ট-৫০ ডিসপ্লেসড্ পার্সনস্ স্কোয়েটার কলোনি’। এই কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল বীরভূম (২২টি), মুর্শিদাবাদ (১৩টি), হুগলি (৩৮টি), নদিয়া (৬৫টি), বাকুড়া (২১টি), হাওড়া (২৯টি), মালদা (৩৮টি), মেদিনীপুর (২০টি), কলকাতা (১৩টি), বর্ধমান (৬৬টি), দার্জিলিং (১৭টি), কুচবিহার (২৬টি), জলপাইগুড়ি (৩৯টি), দক্ষিণ ২৪ পরগনা (৩৭টি), উত্তর ২৪ পরগনা (১১০টি) এবং পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় (৫২টি)। এদের প্রতি ভারত সরকারের একটু বেশি লক্ষ ছিল। কারণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সে সময়টা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। পশ্চিমবঙ্গের ‘দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অফ ডিসপ্লেসড্ পার্সনস্ অ্যান্ড এভিকশন অফ পার্সনস্ ইন আনঅথোরাইজড্ অকুপেশন অফ ল্যান্ড অ্যাক্ট’, ১৯৫১-তে ডিসপ্লেসড্ পার্সনস্ বা স্থানচ্যুত মানুষ হিসেবে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে যারা আদতে পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। সাম্প্রদায়িক অশান্তির জেরে এরা ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবরের পরে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ভাবে এদের নথিভুক্ত আসার দিন ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে। পশ্চিমবঙ্গে এরা কোনও জমির মালিক নয়। যোগ্য কর্তৃপক্ষের কাছে করা এদের এক এফিডেভিট থাকতে হবে যে, এরা আর কোনও অবস্থাতেই পূর্ববঙ্গে ফিরতে চায় না। এই আইনে পূর্ববঙ্গ বলতে সেই অংশকেই বুঝিয়েছে যা তখনকার নতুন ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্তর্গত।
সরকারি উন্নয়ন বিভাগের কাজটি ছিল এই কলোনিগুলির উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা গোনা, তারা কোথায় কী ধরনের কাজ করে তার হদিস করা এবং কলোনি গড়ে ওঠা জমির নানান খবরাখবর নেওয়া। উন্নয়ন বিভাগকে এই কাজের জন্য উদ্বাস্তু শংসাপত্র, এফিডেভিট ইত্যাদি খতিয়ে দেখতে হত। সরকারি অধিগ্রহণ বিভাগটি উদ্বাস্তু পরিবারগুলির বাসস্থানের জন্য কীভাবে জমি নেওয়া বা পাওয়া যেতে পারে, বা জমি হাতবদল করা যেতে পারে, উদ্বাস্তু কলোনি গড়তে গেলে সরকারকে কী পরিমাণ টাকা জোগাতে বা ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হবে, তা দেখত। সরবরাহ ও হিসেব বিভাগটি উদ্বাস্তু শিবির, উৎপাদন কেন্দ্র এবং হেডকোয়াটার্সে বিপুল পরিমাণে নানান জিনিসপত্র নিয়মিত জোগান দিত। এসবের মধ্যে ছিল চাল, গম, ডাল, আসবাব, জামাকাপড়, মানচিত্র, বইপত্র ও লেখসামগ্রী।
ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর প্রতিবেদন
১৯৫৬ সালে রাজ্য সরকার এক উন্নয়ন কমিটি তৈরি করে। উদ্বাস্তু কলোনিগুলির উন্নয়নের জন্য নানা পরিকাঠামো কীভাবে গড়ে তোলা যায় তার জন্যই এই কমিটি নিযুক্ত হয়েছিল। শহুরে এলাকায় সরকার পোষিত ও জবরদখলকারী কলোনি এবং গ্রামীণ অ-কৃষি এলাকায় সরকার পোষিত কলোনিগুলির উন্নয়নের মান কী করে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে এই কমিটি এক সুপারিশ করে। ভারত সরকার এই সুপারিশ মেনে নেয়। সেই মতো ১৯৫৭ সাল থেকে উন্নয়নমূলক কিছু কাজ শুরু হয়। ভারত সরকারের ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ এদের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নজর দেয়। ১৯৭৬ সালে এরা এক প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনে কলোনিগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে সিএমডি-এর অন্তর্গত শহুরে ও গ্রামীণ কলোনি। আর অন্যভাগে রয়েছে সিএমডি-এর আওতার বাইরে শহুরে ও গ্রামীণ কলোনি। প্রথম পর্যায়ে উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে এমন ১০২টি সরকার পোষিত এবং ১টি জবরদখলকারী শহুরে কলোনিকে বেছে নেওয়া হয়। সরকার পোষিত এই ১০২টি কলোনির মধ্যে ৬৩টি ছিল সিএমডি-এর অন্তর্গত। এদের মধ্যে শহুরে ও গ্রামীণ দুই ধরনের কলোনি ছিল। মোট ৬১টি শহুরে কলোনি ছিল ২৪ পরগনা (৩৮টি), নদিয়া (৪টি), হুগলি (১৫টি) এবং হাওড়ায় (৪টি)। আর একটি করে গ্রামীণ কলোনি ছিল ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলায়। সরকার পোষিত বাকি ৩৯টি কলোনি ছিল সিএমডি-এর বাইরে। এদের মধ্যে শহুরে কলোনির সংখ্যা ২৩টি, আর গ্রামীণ কলোনি ১৬টি। শহুরে কলোনিগুলি ছিল ২৪ পরগনা (৪টি), দার্জিলিং (২টি), বর্ধমান (১টি), নদিয়া (৫টি), মুর্শিদাবাদ (১টি) ও জলপাইগুড়িতে (২টি)। গ্রামীণ কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল ২৪ পরগনা (৬টি), মেদিনীপুর (১টি), মুর্শিদাবাদ (২টি), কুচবিহার (২টি), হুগলি (৩টি), জলপাইগুড়ি (১টি) এবং হাওড়ায় (১টি)। জবরদখলকারী ১টি শহুরে কলোনি ছিল ২৪ পরগনায়।
ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর ১৯৭৬ সালের প্রতিবেদনে উল্লিখিত এসব কলোনি ছাড়াও স্পষ্ট ভাবে আরও বেশ কয়েক প্রকার কলোনির উল্লেখ রয়েছে, যেমন- সিএমডি-এর অন্তর্গত সরকার পোষিত অনুন্নত শহুরে ও গ্রামীণ কলোনি, সিএমডি-এর বাইরে সরকার পোষিত অনুন্নত শহুরে ও গ্রামীণ কলোনি, ১৯৫০ সালের আগে ও পরে গড়ে ওঠা সিএমডি-এর অন্তর্গত শহুরে জবরদখলকারী কলোনি, সিএমডি-এর বাইরে ১৯৫০ সালের পরে গড়ে ওঠা শহুরে ও গ্রামীণ জবরদখলকারী কলোনি, সিএমডি-এর অন্তর্গত শহুরে ব্যক্তিমালিকানাধীন কলোনি এবং সিএমডি-এর বাইরে শহুরে ও গ্রামীণ ব্যক্তিমালিকানাধীন কলোনি।
সিএমডি-এর অন্তর্গত সরকার পোষিত অনুন্নত শহুরে কলোনিগুলি ছিল ২৪ পরগনা (১৮টি), হাওড়া (১৫টি), হুগলি (২৭টি) এবং নদিয়া (৫টি) জেলায়। আর এই ধরনের গ্রামীণ কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল ২৪ পরগনা (১০টি), হুগলি (৫টি) ও নদিয়া (৪টি) জেলায়।
সিএমডি-এর বাইরে সরকার পোষিত অনুন্নত শহুরে কলোনিগুলি ছিল ২৪ পরগনা (২৪টি), মেদিনীপুর (৪টি), বর্ধমান (৭টি), নদিয়া (৪টি), মুর্শিদাবাদ (৪টি), কুচবিহার (১টি), মালদা (৬টি), বীরভূম (৩টি), বাঁকুড়া (১টি), হাওড়া (২টি) এবং জলপাইগুড়ি জেলায় (৩টি)। আর সরকার পোষিত অনুন্নত গ্রামীণ কলোনিগুলি ছিল ২৪ পরগনা (৭০টি), মেদিনীপুর (১১টি), নদিয়া (২২টি), মুর্শিদাবাদ (১৮টি), কুচবিহার (১২টি), মালদা (১টি), হুগলি (১টি), পশ্চিম দিনাজপুর (২টি), জলপাইগুড়ি (৫টি), বীরভূম (১টি), বর্ধমান (২টি) এবং দার্জিলিং জেলায় (২টি)।
১৯৫০ সালের আগে গড়ে ওঠা সিএমডি-এর অন্তর্গত শহুরে জবরদখলকারী কলোনির মোট সংখ্যা ছিল ১৪০। এগুলি ২৪ পরগনা (১৩৬টি), হুগলি (৩টি) ও হাওড়া (১টি) জেলায় গড়ে উঠেছিল। ১৯৫০ সালের পরে গড়ে ওঠা সিএমডি-এর অন্তর্গত এই ধরনের শহুরে কলোনিগুলি ছিল কলকাতা (২৭টি), ২৪ পরগনা (৬৩টি), নদিয়া (২টি), হাওড়া (৩১টি) এবং হুগলি জেলায় (৫টি)। সিএমডি-এর বাইরে ১৯৫০ সালের পরে গড়ে ওঠা শহুরে কলোনিগুলি দেখা যেত পশ্চিম দিনাজপুর (২টি), ২৪ পরগনা (২১টি), নদিয়া (১টি), হুগলি (৪টি) এবং বর্ধমান জেলায় (৫টি)। সিএমডি-এর বাইরে ১৯৫০ পরবর্তী গ্রামীণ কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল নদিয়া (৭টি), মুর্শিদাবাদ (১টি) এবং বীরভূম জেলায় (৭টি)।
সিএমডি-এর অন্তর্গত বেশ কিছু শহুরে ব্যক্তিমালিকানাধীন কলোনিও ছিল। পঞ্চাশ বা তার বেশি পরিবার নিয়ে এই কলোনি গড়ে উঠত। এ ধরনের কলোনি ছিল ২৪ পরগনা (৪৮টি), হুগলি (১৯টি) এবং হাওড়া জেলায় (১২টি)। সিএমডি-এর বাইরে এ ধরনের বেশ কিছু শহুরে ও গ্রামীণ কলোনি দেখা গিয়েছিল। শহুরে কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল ২৪ পরগনা (৪টি), বর্ধমান (১টি), পশ্চিম দিনাজপুর (১টি), কুচবিহার (১২টি) ও জলপাইগুড়ি জেলায় (৩টি)। আর গ্রামীণ কলোনিগুলি ছিল ২৪ পরগনা (১০টি), নদিয়া (৪৮টি), মেদিনীপুর (৩টি), বর্ধমান (৩৩টি), মালনা (৪২টি), পশ্চিম দিনাজপুর (১০টি), কুচবিহার (১৪টি), জলপাইগুড়ি (১৫টি), মুর্শিদাবাদ (১৫টি) এবং বীরভূম জেলায় (১টি)।
উদ্বাস্তু কলোনির উন্নয়ন
ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর প্রতিবেদনে স্থানচ্যুত মানুষদের কলোনিগুলিতে, তা সে সরকার পোষিত বা ব্যক্তিগত যে উদ্যোগেই গড়ে উঠুক না কেন, নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, ১৯৫০ সালের আগে গড়ে ওঠা কলোনি এবং তার পরে গড়ে ওঠা জবরদখলকারী কলোনিগুলিকে একই চোখে দেখা হবে। এদের মধ্যে এখন থেকে কোনও তফাত থাকবে না। শহুরে ও গ্রামীণ, দুই এলাকার উদ্বাস্তু কলোনিগুলির উন্নয়নের মান বাড়ানোর সুপারিশও এই প্রতিবেদনে রয়েছে। মোট ১,৭০,২৬১টি উদ্বাস্তু প্লট বা জমির উন্নয়নের জন্য ৫২.৪৩ কোটি টাকা খরচ হবে বলে ধরা হয়েছিল। ঠিক করা হয়েছিল, এসব কলোনির উন্নয়নের পরে সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন, যেমন — কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং পঞ্চায়েতের হাতে দেওয়া হবে। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০৮টি কলোনির উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত স্থানচ্যুত মানুষদের কলোনিগুলির উন্নয়নে অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সেই মতো তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৯৫-৯৬ সালে উদ্বাস্তু কলোনির উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। শহুরে উদ্বাস্তু কলোনির প্রতি প্লটের উন্নয়নের জন্য ১৭,৭৭৭ টাকা ধরা হয়েছিল। ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত সরকার বাকি আরও ৪৪,০২৫টি প্লটের শহুরে উদ্বাস্তু কলোনির উনয়নের কাজ শেষ করার জন্য ৭৮.২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। এই সঙ্গেই গ্রামীণ উদ্বাস্তু কলোনির ৬৭,১১২টি প্লটের উন্নয়নের জন্যও ভারত সরকার নজর দেয়।
বেশ কিছুদিন ধরেই রাজ্য সরকারের মাথায় এক ভাবনা ঘুরছিল। জবরদখল কলোনিতে বেশ কিছু স্থানচ্যুত মানুষ ছিল। এই কলোনিগুলি গড়ে উঠেছিল পুরোপুরি রাজ্য সরকারের জমিতে। অথচ ভারত সরকার এদের কোনও স্বীকৃতি দেয়নি। সরকার এই স্থানচ্যুত মানুষদের বিনা পয়সায় ভিটেজমি দেওয়ার কথা চিন্তা করল। ভারত সরকারের স্বীকৃতি বিহীন এরকম ৯৯৮টি কলোনির এক তালিকা তৈরি করা হয় ২৯.১২.৯৬ তারিখে। এছাড়াও উত্তরবঙ্গে অবস্থিত অন্যান্য উদ্বাস্তু কলোনির উন্নয়নের জন্যও ১৯৯৭-৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করে।
মহিলা পুনর্বাসন
উদ্বাস্তু মহিলাদের থাকার হোম বা আবাস এর ব্যাপারেও নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করা হয়। মহিলা পুনর্বাসন বিভাগ (উইমেন্স রিসেটলমেন্ট সেকশন) এটির দায়িত্বে ছিল। স্বাধীনতার পরে এই রাজ্যে উদ্বাস্তুদের থাকার অনেক আবাস ছিল। ক্রমশ এদের সংখ্যা কমানো হল। ১৯৯০ সালের ৪ অক্টোবর অবধি এরকম আবাস ছিল নয়টি। এরা হল —
১। ধুবুলিয়া হোম অ্যান্ড ইনফামিটি, থানা- কৃষ্ণনগর, জেলা- নদিয়া।
২। চাপতা উইমেন্স হোম, থানা কৃষ্ণনগর, জেলা- নদিয়া।
৩। কুপার্স পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি হোম, থানা- রানাঘাট, জেলা- নদিয়া।
৪। রানাঘাট উইমেন্স হোম, থানা রানাঘাট, জেলা নদিয়া।
৫। চাঁদমারি অ্যামালগ্যামেটেড হোম, থানা- কল্যাণী, জেলা- নদিয়া।
৬। হাবড়া অ্যামালগ্যামেটেড হোম, থানা হাবড়া, জেলা ২৪ পরগনা (উত্তর)।
৭। টিটাগড় উইমেন্স হোম, থানা টিটাগড়, জেলা ২৪ পরগনা (উত্তর)।
৮। ভদ্রকালী উইমেন্স হোম, থানা উত্তরপাড়া, জেলা হুগলি।
৯। বাঁশবেড়িয়া উইমেন্স হোম অ্যান্ড কার্তিকপুর ইউনিট, থানা-চুঁচুড়া, জেলা- হুগলি।
এসব আবাসে থাকা উদ্বাস্তুরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা (ক্যাশ ডোল) পেত। এছাড়াও এদের চাল-গম-ডাল (ড্রাই ডোল), জামাকাপড় ও কম্বল দেওয়া হত। ১৯৯৭ সালের ১লা জুন থেকে সরকারি আদেশে ডোল-এর নির্দিষ্ট টাকার পরিমাণ বেড়েছিল। উদ্বাস্তুরা বিনা পয়সায় আবাসে থাকতে পেত। চিকিৎসাও পেত। ক্রমশ রাজ্য সরকার স্থির করে আবাসের সংখ্যা নয়টি থেকে কমিয়ে তিনটিতে আনা হবে। ১৯৯০ সালের ৫ অক্টোবর এক সরকারি নির্দেশে এই কথা বলা হল। সেই মতো ধুবুলিয়া, চাপতা, রানাঘাট, কুপার্স, টিটাগড় ও ভদ্রকালীর আবাস গোটানো হল। থাকল কেবল চাঁদমারি, টিটাগড় ও বাঁশবেড়িয়া-র আবাস। ৬টি আবাস গুটিয়ে আনার পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল বেশ কিছু উদ্বাস্তু পরিবারকে সেখানেই পুনর্বাসন দেওয়া, অথবা ধারে-কাছে কোনও সরকারি সাহায্যে গড়ে ওঠা কলোনির ফাঁকা জমিতে তাদের বসানো। উদ্বাস্তুদের এভাবে পুনর্বাসনের পরেও যে সব পরিবার বাদ থেকে যাবে, তারা টিকে থাকা তিনটি আবাসে পাকাপাকিভাবে সরকারের ঘাড়ে রয়ে যাবে (‘লায়াবিলিটি গ্রুপ অফ ফ্যামিলিজ’)।
কর্মসংস্থান
নানা শিবির বা আবাসে থাকা যে সব উদ্বাস্তু পরিবার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, তাদের বেশ কিছু পুরুষ বেসরকারি সংস্থা, কলকারখানা বা সরকারি অফিসে কাজ পেল। কিন্তু দেখা গেল, আরও অনেক উদ্বাস্তু বিশেষ করে প্রশিক্ষণ নেওয়া মহিলারা কাজ পায়নি। এদের কাজের বন্দোবস্ত করার জন্য তখন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিকে উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করা হল। ১লা জানুয়ারি, ১৯৯৮ সালে এরকম ৪টি উৎপাদন কেন্দ্র ছিল। যেমন — (১) উত্তরপাড়া উৎপাদন কেন্দ্র, জেলা- হুগলি, (২) হাবড়া উৎপাদন কেন্দ্র, জেলা ২৪ পরগনা (উত্তর), (৩) টিটাগড় উৎপাদন কেন্দ্র, জেলা- ২৪ পরগনা (উত্তর) এবং ব্যাম্বু প্রসেসিং সেন্টার, কামারহাটি, কলকাতা-৫৮। উত্তরপাড়া, হাবড়া ও টিটাগড় উৎপাদন কেন্দ্রে তিনটি বিভাগ ছিল— দর্জিগিরি, বুনন শিল্প ও হোসিয়ারি (মোজা তৈরি)। এসব কেন্দ্রের কর্মীরা ১৯৯৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে নির্দিষ্ট মজুরি পেত। প্রত্যেককে কী পরিমাণ কাজ করতে হবে, তা ঠিক করা ছিল। নির্দিষ্ট কাজের বাইরে কাজ করলে কর্মীরা ওভারটাইম পেত। আবার, নিজের কাজটুকু ঠিক সময়ে ওঠাতে না পারলে, তার নির্দিষ্ট মজুরি থেকে ১০%-২৫% কাটা যেত।
শিকড় ছেঁড়া বিষণ্ণ মুখ
তো এভাবে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গে সেই ১৯৪৬ সাল থেকে আসা বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু মানুষকে পুনর্বাসন দিতে রাজ্য সরকার ও ভারত সরকার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে উদ্বাস্তু কলোনিগুলির উন্নয়নে। এমনকি এদের নানান ধরনের কাজও পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য উদ্বাস্তু কলোনিগুলির অবস্থা বা উদ্বাস্তু মানুষগুলিকে যে ডোল দেওয়া হত, তার গুণগত মান যে কী খারাপ ছিল, তার পরিচয়ও পাওয়া যায় বিশিষ্ট গবেষক-অধ্যাপক প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী-র লেখা রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত বই ‘দ্য মার্জিনাল মেন’ (প্রান্তিক মানব)-এ। কী দুঃসহ যন্ত্রণাকে দিনের পর দিন বুকে চেপে নিঃস্ব এই উদ্বাস্তু মানুষগুলি মুখ বুজে যে নতুন ভোরের আশায় কোমর বেঁধেছে, তা অধ্যাপক চক্রবর্তীর বইটির প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে রয়েছে। আসলে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার দিনটিতো কখনোই পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু মানুষগুলির কাছে কোনও খুশির খবর নিয়ে আসেনি। স্বাধীনতা ছিল তাদের কাছে অর্থহীন। দেশ স্বাধীন হল। আর তারা সবকিছু হারাল। বাঁচার তাগিদে এরা অজানা এক ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তখন প্রাণ বাঁচানোটাই এক বড়ো দায় হয়ে উঠেছিল।
ভারত স্বাধীন হবার পর পশ্চিম পাঞ্জাব (পাকিস্তান) ও পূর্ববঙ্গ এই দুই জায়গা থেকে উদ্বাস্তুরা এদেশে আসে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সব উদ্বাস্তু ১৯৪৮ সালের মধ্যেই ভারতে চলে আসে। এ বিষয়ে উল্লেখ করার মতো ঘটনা যে, ভারত সরকারের চোখে পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ববঙ্গ এই দুই জায়গা থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কখনোই সমান ছিল না। সরকারি একচোখোমি ছিল চোখে পড়ার মতো। কেন্দ্রীয় সরকারের বিপুল টাকা পাঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে তড়িঘড়ি ঢালা হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে ‘এস্টিমেটস্ কমিটি’-র কাছে পেশ করা কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন মন্ত্রকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের পুনর্বাসনের কাজ প্রায় শেষ। অল্প কিছু কাজ বাকি। এই অল্প কিছু শেষ পর্যায়ের পুনর্বাসনের কাজ আরও ১২ বছর ধরে করা হয়েছিল। আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৪৮ সাল অবধি পশ্চিমবঙ্গে আসা প্রায় ২৯ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের কপালে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে জুটেছিল শুধুই বঞ্চনা ও অসম্মান। আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৫৫ সালের আগে কেন্দ্রীয় সরকার পুরানো উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য নীতিও ঠিক করতে পারেনি। উল্লেখ্য, প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তীর ‘দ্য মার্জিনাল মেন’ বই থেকে এ-ও জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে উদ্বাস্তুদের অন্য সব পুনর্বাসন প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছিল। রাজনীতিতে উদ্বাস্তু শব্দটির এক সংজ্ঞা আছে। জাতিপুঞ্জ-এর এক সম্মেলনের ১৭(২) ধারায় বলা আছে, বেশ কিছু মানুষ যখন জাতিগত, ধর্মগত, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনও কারণে নির্যাতনের ভয়ে নিজের ভিটে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, তাদের উদ্বাস্তু বলা হয়। সে দিক থেকে পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কোনওই তফাত নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় পাঞ্জাবি উদ্বাস্তুরা সব হারিয়েও আবার সব পেল। ওদের গা থেকে মুছে গেল উদ্বাস্তু গন্ধ। আর বাঙালি উদ্বাস্তুরা হল কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতা ও নির্মম অবহেলার শিকার।
ঋণ :
১। ‘এস্টিমেটস্ অফ পার্লামেন্টারি কমিটি’, ১৬তম প্রতিবেদন, ১৯৫১-৬০।
২। চক্রবর্তী প্রফুল্লকুমার : ‘একটি পুরানো প্রসঙ্গ’, কল্যাণী বার্তা, শারদীয়া সংখ্যা, ১৯৮৩।
৩। চক্রবর্তী প্রফুল্লকুমার : ‘প্রান্তিক মানব’, দীপ প্রকাশন, ২০১৩, কলকাতা-৬।
৪। ‘ম্যানুয়াল অফ রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন’, ভল্যুম-১, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৯৮।