উনিশশো সাতচল্লিশ

ওয়াসি আহমেদ

“আমি নোয়াখালির গোপাল হালদার — ষোলোই আগস্টের সকালবেলায় কলকাতায় আমার হিন্দুস্থান এলাকায় নিরাপদে বসেও শিউরে উঠেছিলাম… সেদিন আমার পক্ষে না বুঝে উপায় রইল না যুগান্তরের ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে ভারতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন সেদিন, ষোলোই আগস্ট, হয়েছে প্রথম ক্যাজুয়েলটি।” — (শারদীয় যুগান্তর, ১৯৫৩)

উনিশশো ছেচল্লিশের ষোলোই আগস্ট তারিখটা যে ভারতভাগের এক আগাম ও অখণ্ডনীয় বার্তা তা তখনকার পরিস্থিতি-সচেতন কারও পক্ষে অস্বীকার করা কঠিন ছিল। তারিখটা নিছক একটা তারিখ ছিল না — ঘটনার কিছু পূর্বাভাস, এমনকি তোড়জোড়ও ছিল। ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ নামাঙ্কিত সেদিনের ঘটনার পেছনে মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির উসকানি ছিল কি না এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও, এক ধরনের আগাম প্রশ্রয়বাণী ও পরবর্তীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তখনকার অক্টারলোনি মনুমেন্টে (Ochterlony Monument) সেদিন তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসা জনতা যে এমন (পরোক্ষ) প্রশ্রয়ে আশ্বস্ত হয়েছিল তাতে সন্দেহের কারণ ছিল না। সেদিন বিকালেই এর প্রমাণ মিলেছিল। তবে ঘটনাপ্রবাহ যে একপেশে থাকেনি তা পরদিন থেকেই ভয়ংকরভাবে পরিস্ফুট হতে শুরু করেছিল।

ষোলই আগস্টের ঘটনাকে বলা যেতে পারে শেষের শুরু। শুরুটা অনেক আগে থেকেই দানা বাঁধছিল, যদিও এককাট্টা লক্ষ্য নিয়ে নয়। ফলে এক বছর পর উনিশশো সাতচল্লিশের মধ্য আগস্টে যা ঘটেছিল তা দীর্ঘ দিনের নানা ঘটনাপ্রবাহের পরিণতি হিসাবে যেমন ছিল লক্ষ্যমুখী, তেমনি সেসময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মোটেও আকস্মিক কিছু ছিল না।

তারপরও আজ যখন সাতচল্লিশের দিকে তাকাতে হয়, বছরটা ইতিহাসের মাইলফলক হিসাবে উপমহাদেশের ভূগোল তো বটেই, সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক-নৃতাত্ত্বিক চিত্রপটের নানা ভাঙচুরকেই মেলে ধরে। ওপরে গোপাল হালদারের যে উদ্ধৃতিটি দেওয়া হয়েছে তাতে ষোলোই আগস্টের ঘটনাকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ক্যাজুয়েলটি বলা হলেও সাতচল্লিশের আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে ক্যাজুয়েলটির কোনও মাপেই ফেলা যাবে না। বরং গণহত্যা ও জাতিগত হত্যাযজ্ঞের নারকীয় পরিস্থিতি বললে একটা মোটা দাগের চিত্র পাওয়া যেতে পারে। আর যদি ক্যাজুয়েলটি বলতে হয়, তবে তা উপমহাদেশের আপামর মানুষের কয়েক হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ক্যাজুয়েলটি। ভারতভাগের ফলাফল তাহলে কারা নিরূপণ করবেন? তৎকালীন রাজনীতিকেরা যারা এর ক্রীড়নক, তাঁরা তো না-ই, বরং ফলাফলের চেয়ে যদি বলা হয় ‘সত্য’ — ভারতভাগের সত্য— তবে ‘আপামর’ কথাটাকেও বাদ দিতে হয়। বলতে হয় সেই সব মানুষের কথা যারা ছিলেন সেই বিভীষিকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার। সত্যটা তাদের চেয়ে ভালো কাদের জানা! কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি সাতচল্লিশ-পরবর্তী কয়েক বছরে দেড়কোটি মানুষকে তাদের পৈত্রিক ভিটামাটি থেকে উৎখাত হতে হয়েছিল। হিসাবে কিছু গরমিল থাকতে পারে। ইতিহাসবিদ মুশিরুল হাসানের মতে, বছর চারেকের মধ্যে প্রায় নব্বই লাখ হিন্দু ও শিখ পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী হয়ে আসেন ও প্রায় ষাট লাখ মুসলমান ভারত থেকে পাকিস্তানে (তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে) চলে যান। মুশিরুল হাসানের গবেষণা আরও বলে, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্যে পঞ্চাশ লাখ এসেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান (বিশেষত পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ) থেকে, আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে চল্লিশ লাখের কাছাকাছি। ১৯৫১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সেনসাস রিপোর্ট থেকে যে তথ্য মেলে তা এ রকম : ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের হিসাব অনুযায়ী ভারত থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল বাহাত্তর লক্ষ ছাব্বিশ হাজার ছয়শো। একই বছরে ভারতের সেনসাস অনুসারে পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা বাহাত্তর লক্ষ পঁচানব্বুই হাজার আটশো সত্তর। মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় এক কোটি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ। ফলে দেশভেদে সংখ্যার তারতম্য থাকলেও উভয় দেশের সেনসাস ভিত্তিক মোট শরণার্থীর সংখ্যা মুশিরুল হাসানের হিসাবের কাছাকাছি। সংখ্যার কথা উল্লেখ করছি বটে, তবে সংখ্যা দিয়ে একটা পরিস্থিতির ওপরকাঠামোকেই আন্দাজ করা সম্ভব।

দুই

সাতচল্লিশকে দীর্ঘদিন ধরে যে ইতিহাসের এক সহজ ও একরৈখিক পাঠ হিসাবে দেখা হচ্ছিল তাতে সময়প্রবাহে চিড় ধরেছে। এই সহজপাঠ প্রধাণত জাতীয়তাবাদী প্রেরণাপ্রসূত। উপমহাদেশের তিন দেশ তিনভাবে এ সালকে দেখে। ভারত সাতচল্লিশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অবসান হিসাবে দেখতে গিয়ে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করে। সেইসঙ্গে একে পাকিস্তানি বিচ্ছিন্নবাদীতার কারসাজি বলেও বিশ্বাস করে। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে সালটি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাফল্যগাথা বই কিছু নয়। আর মুখে না আওড়ালেও আজকের বাংলাদেশ সালটিকে দেখে একাত্তরের স্বাধীনতার এক পরোক্ষ সূচনাপর্ব হিসাবে। ভেবে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এই সহজপাঠের পেছনে রয়েছে সাতচল্লিশকে এক অতীত অধ্যায় হিসাবে অতিক্রম করার চিন্তা-ভাবনা। কিন্তু বাস্তবতা হল, অতিক্রম করা দূরের, সাতচল্লিশ ইতিহাসের এমন এক অলঙ্ঘনীয় ও অনিরূপণীয় পরিহাস বা তপোধীর ভট্টাচার্যের ভাষায় ‘ট্রাজিক উল্লাস’ যার শুরু বা শেষ কোনোটাকে সহজপাঠ দিয়ে ধরা যাবে না। পাকিস্তানি-মার্কিন ইতিহাসবিদ ও দেশভাগ বিশেষজ্ঞ আয়েশা জালাল সাতচল্লিশকে বলেছেন ‘ডিফাইনিং মুমেন্ট’ যার দীর্ঘ ছাপ উপমহাদেশের মানচিত্র, ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে প্রভাবিত করে চলেছে। এতে দ্বিমতের সুযোগ নেই। সাতচল্লিশ তাই অতীত হয়েও প্রবলভাবে বর্তমান; আমাদের চিন্তাভাবনাকে এই সাল যেমন এক বিস্তৃত ক্ষেত্র দিয়েছে, তেমনি মনোজগতের অনড় জাতীয়তাবাদী প্রকল্প থেকে বেরোনোর পথও দেখিয়েছে।

মোটা দাগে দেখলে সাতচল্লিশকে দু-টি ঘটনা দিয়ে চিহ্নিত করা যায় : উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশনের অবসান ও দেশভাগ। কিন্তু দেশভাগোত্তর দাঙ্গা কি তিন নম্বরে অতি আবশ্যিকভাবে আসার কথা নয়? ১৯৪৬ থেকে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে বা পরবর্তীকালে নানা জায়গায় যে সমস্ত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেসব ছিল সাতচল্লিশে পাঞ্জাবে সংঘটিত গণহত্যার পটভূমি। আলি রিয়াজের মতে, “এত বছর ধরে এই গণহত্যার দায় কেবল যারা এর সঙ্গে যুক্ত তাদের ধর্মীয় পরিচিতিতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এগুলোকে ১৯৪৭ এর গণহত্যার অংশ বলেই বিবেচনা করা উচিত এবং ১৯৪৭ এর প্রেক্ষাপটেই আলোচিত হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা এই বিষয়ে গভীর উৎসাহ বা অনুসন্ধানী কাজ দেখতে পাই না, তার চেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে ১৯৪৭ নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থেও এই দিক অনুপস্থিত বা কম গুরুত্ব লাভ করেছে।”

এই যে দৃষ্টিভঙ্গি এর পেছনে কি সাতচল্লিশের অশান্ত ডামাডোলে নিহত, সর্বস্বান্ত, বাস্তুত্যাগী বা যৌনসহিংসতার শিকার অগুনতি সাধারণ মানুষের প্রতি পিঠটান? সে জন্যই কি সাতচল্লিশ বা সাতচল্লিশপূর্ব রাশি রাশি ঘটনাপুঞ্জে আমরা ইতিহাসের তাবড় তাবড় ক্রীড়নকদেরই দেখি— তাঁরা কে কী বলেছেন, তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সেসব ফিরিস্তির বিচার-বিশ্লেষণই বড়ো হয়ে ওঠে। সাতচল্লিশের ন্যারেটিভে তারা একটা অংশ বই কিছু নন, বড়ো অংশও বলা যায়, কিন্তু সহায়-সম্বলহীন লক্ষ লক্ষ মানুষের স্থান নেই সেখানে। সেদিক দিয়ে দেখলে সাতচল্লিশের ইতিহাস উপমহাদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞার কুশ্রী ইতিহাস। ইতিহাসের এই ঘাটতি কিছুটা হলেও সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকেরা নিজেদের লেখাজোখায় মিটিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য ও ইতিহাস এক নয়।

দেশভাগ-পরবর্তী ঐতিহাসিক বয়ানে ভুক্তভোগী ছিন্নমূল মানুষের পাদটীকায় ঠাঁই পাওয়া যেমন সত্য, তেমনি অন্য সত্যটি হল, ভাগপূর্ব কয়েক বছরের এত ডামাডোলেও সাধারণ মানুষকে বড়ো একটা পাওয়া যায় না। ইতিহাসচর্চা মূলত নিবন্ধ থেকেছে ইতিহাসবিদেরা কে কীভাবে উপনিবেশ বিরোধিতাকে তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, যা বস্তুত এলিটিস্ট মানসিকতারই প্রকাশ। অথচ ঘটনাবলির যে মহাসমারোহময় তোড়জোড় তাকে পরম্পরাময় ও মোটামুটি এক সূত্রে গাঁথতে গেলে উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ — যাদের অংশগ্রহণ ছিল উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারিতে — তাদেরকেও পাদটীকায় নেমে যেতে হয়েছে।

তিন

গোড়ার দিকে নজর দেওয়া যাক। আজকাল এ নিয়ে আর তর্ক হয় না যে, বিভাগপূর্ব ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের যে বিভাজন তা ১৯৪৭-এর অন্তত একশ বছর আগে থেকেই পরিস্ফুট হচ্ছিল। দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচারের অনেক আগে থেকেই ইংরেজশাসিত ভারতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে শুধু ধর্মভিত্তিক দুই সম্প্রদায় হিসাবে নয়, বরং দুই আলাদা জাতি হিসাবে দেখার প্রবণতা ও পটভূমি অনেকটাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিক সাভারকার বা অরবিন্দ ঘোষ যেমন হিন্দুত্বকে জাতিত্বে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, তেমনি বঙ্কিমচন্দ্রের লেখালেখিও হিন্দু-মুসলমান বিভেদকে উসকে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সময়কাল নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দুই সম্প্রদায়ের বিভাজিত মানস গঠনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার শুরু ১৯৩০ সালের পর থেকে নানা ঘটনাপ্রবাহে। এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের ব্যাখ্যা এ রকম — উপমহাদেশের হিন্দুরা উনিশ শতকের মধ্যভাগে স্বদেশপ্রীতি ও স্বধর্মপ্রীতিকে আলাদা করে দেখেনি। অন্যদিকে মুসলমানদের ক্ষেত্রে ঘটনা ছিল এর বিপরীত, তারা ধর্মপ্রীতির আতিশয্যে দেশকে স্বদেশ বলে ভাবেনি। ভারতবর্ষের অধিবাসী হয়েও ভারতের বৃহত্তর ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে তারা নিজেদের ঐতিহ্যের তালাশ করেছে আরব, পারস্য, তুরস্কে। উমরের জবানিতে, “সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পার্থক্যের যে-চেতনা বিদ্যমান ছিল, সে-চেতনা ভারতীয় ধনতন্ত্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রসার ও অগ্রগতির সাথে ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে সৃষ্টি করল এক কুৎসিত জটিলতা। এ জটিলতার নামই সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু মধ্যবিত্ত যখন ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ক্ষেত্রে অনেকখানি অগ্রসর হল, তখন বিদেশি ইংরেজদের সাথে সর্বক্ষেত্রেই শুরু হল তাদের অল্প-বিস্তর প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতাই ধীরে ধীরে অবসান ঘটাল হিন্দু মধ্যবিত্তের একাংশের ইংরেজপ্রীতির। শুধু তাই নয়, এর ফলে সূত্রপাত হল ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের, যে-আন্দোলনের পুরোভাগে থাকল হিন্দু মধ্যবিত্ত। ঠিক এই সময়ে মুসলমান মধ্যবিত্তের সাথে ইংরেজদের প্রতিযোগিতার প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ তারা হিন্দুদের তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অনেকখানি পশ্চাৎপদ।… সীমাবদ্ধ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিযোগিতা এ সময় ছিল প্রধানত হিন্দু মধ্যবিত্তের সাথে এবং সেই প্রতিযোগিতায় জয়লাভের জন্য মুসলমান সমাজ ছিল ইংরেজদের সাথে আপসপন্থী। সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের এই বিভেদ ও রেষারেষি ইংরেজরা উপেক্ষা করল না। উপরন্তু তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের হাতিয়ার হিসেবে এই রেষারেষিকে অবলম্বন করে তারা নির্মাণ করল তাদের ভেদনীতি।” দুই সম্প্রদায়ের রেষারেষিকে পুঁজি করে ইংরেজদের মদতেই যে সম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করল তা-ই না, ধর্মভিত্তিক বিভাজন দুই সম্প্রদায়কে পরিণত করল দুই জাতিতে। এক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল একচ্ছত্র। ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র’ প্রবন্ধে উমর যথার্থই বলেছেন, “হিন্দু মধ্যবিত্তের সম্প্রদায়িক শ্রেণিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসেবে পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু মুসলমান মধ্যবিত্তের সে প্রয়োজন ছিল।” দ্বিজাতিত্ত্বের এটাই মূলমন্ত্র। অখণ্ড ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা নয়, বরং রেষারেষি ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্তের শ্রেণিস্বার্থ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই ছিল মুখ্য। এ নিয়ে কেউ কেউ তর্ক করতে পারেন, কিন্তু পেছনের ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল করলে তর্কটা তর্কেই সীমিত থাকবে। সাতচল্লিশের অব্যবহিত পরপরই যা ঘটেছে তার সঙ্গে বিভাগপূর্ব প্রেক্ষাপটের মিল খোঁজা নিরর্থক।

হিন্দু-মুসলমান বিভাজনে নানা ধরনের প্ররোচনা কাজ করেছিল। স্বদেশি আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবোধের যে প্রবল রূপ দেখা দিয়েছিল, তাতে হিন্দুত্বকে বড়ো করে দেখানই হয়নি, বরং মুসলমানদের প্রতি অলিখিত নিষেধাজ্ঞার মতো ছিল বন্দেমাতরম ও শিবাজি-স্তুতি। সে-সময়ের তথাকথিত বামপন্থী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসাবে বিপিনচন্দ্র পাল ও তাঁর সহগামীরা যে প্রচারণায় যোগ দিয়েছিলেন তার সঙ্গে বামপন্থার সংস্রব ছিল না, যা ছিল তাকে বলা যেতে পারে বানোয়াট হিন্দু মিস্টিসিজম। ফলে এ থেকে মুসলমানদের সরে আসাই স্বাভাবিক ছিল, শুধু মুসলমানেরা নন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু নেতৃস্থানীয়রাও সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন (যেমন — মতিলাল নেহরু)।

বিভাজন তৈরিতে একের পর এক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে বড়ো ভূমিকা ছিল তাতে কোনও অস্বচ্ছতা নেই। বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫), মুসলিম লিগের জন্ম (১৯০৬), মর্লি-মিন্টো সংস্কার (১৯০৯), বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল (১৯২৬), সর্বদলীয় কলকাতা সম্মেলনের ব্যর্থতা (১৯২৮), সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ (১৯৩৫), নির্বাচনী জুটিবন্ধনে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের অনৈক্য (১৯৩৭), লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০), ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের ব্যর্থতা (১৯৪৬), একই বছরে ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে ও কলকাতার দাঙ্গা, অন্তরবর্তী সরকার বিষয়ে লিগ-কংগ্রেস দ্বন্দ্ব (১৯৪৭) ইত্যাদি। অনেক ঘটনার মধ্যে এ ঘটনাগুলোর গুরুত্ব বেশি। মনে হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয় সবকটারই একই লক্ষ্য — ভারতবিভাগ।

বঙ্গভঙ্গের পর হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে উসকে দিতে শাসকদের একটা কুটচাল ছিল উল্লিখিত মর্লি-মিন্টো সংস্কার (Morley-Minto Reform) যার অন্যতম বিষয় দুই সম্প্রদায়ের আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা। এর পরের বড়ো ঘটনা ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট। এই অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯৩৭ এর প্রাদেশিক নির্বাচন-পূর্ব ঘটনাপ্রবাহ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগকে দুই মেরুতেই নিয়ে যায়নি, মুসলমান সম্প্রদায়কে, বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের মুসলমানদের জাতিত্ব-সন্ধানী করে তুলেছিল বললে ভুল হবে না। বাংলায় মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা বলতে তখন ফজলুল হক। জিন্নাহ অনেক দূরের মানুষ। সেই ফজলুল হক যখন কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনে জুটি বাঁধতে পারলেন না, বা তাঁকে তা করতে দেওয়া হল না, তখন এটা পরিষ্কার হয়ে পড়েছিল যে ফজলুল হকের দলের সঙ্গে আঁতাতে কংগ্রেসের অসম্মতির পেছনে ক্ষমতালিপ্সাই ছিল বড়ো কারণ। এ ছাড়াও ভারতের অখণ্ডতা নিয়ে এক শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকেদের মাথাব্যথা ছিল না। বলা নিষ্প্রয়োজন, এরই ফলস্বরূপ ফজলুল হক মুসলিম লিগে ভিড়লেন ও নির্বাচনে ভরাডুবির পর ১৯৪০-এ তাঁর মুখ দিয়েই জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব পেশ করালেন।

১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ, ছয় বছর পর বাতিল এবং ১৯৪৭-এ ভারতভাগের ফলে বাংলাভাগ নিয়ে সাধারণ জনগণের (মধ্যবিত্ত প্রধানত) মনে যত আবেগই খেলা করুক, এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই যে, জিন্নাহ বা নেহরু দুজনের কারোরই পূর্ববাংলা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। জিন্নাহ পাকিস্তানের আওতায় অখণ্ড বাংলা ও অখণ্ড পাঞ্জাব চেয়েছিলেন; মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি অখণ্ড বাংলার জন্য যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই বলে যে কলকাতা ও কলকাতা বন্দর ছাড়া পূর্ববাংলার অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য। খুব যে গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন বলা যাবে না। অন্যদিকে নেহরু দারিদ্র্যপীড়িত, কচুরিপানা ও জলাভূমিবেষ্টিত এ অঞ্চলের প্রতি কোনও আকর্ষণই বোধ করেননি, আর তা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে গান্ধির সঙ্গে দেখা করতে নোয়াখালিতে গিয়ে তিনি পূর্ববাংলার গ্রামীণ চালচিত্র দেখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য রামমনোহর লোহিয়াকে বলেছিলেন এরকম অনুন্নত জায়গা ছেড়ে দিলে যদি ভারতের স্বাধীনতা বেগবান হয় ক্ষতি কী!

নেহরুর এই মনোভাবকে কার্যত বাস্তবায়িত করলেন হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। ১৯৪৭ এর ফেব্রুয়ারিতে এক সংবাদ বিবৃতিতে তিনি বললেন, যদি সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় ভারতভাগ করতে হয়, তাহলে বাংলাকেও বিভক্ত করে হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক প্রদেশ গঠন করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি আচার্য কৃপালিনি এই বিবৃতিকে সমর্থন জানিয়ে বাংলা বিভাগের দাবি জানালেন।

চার

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের অনিবার্য পরিণতি হিসাবে সাতচল্লিশকে না দেখে উপায় নেই। সেই আর্যদের আমল থেকে শুরু করে মধ্যযুগ ও মধ্যযুগ-পরবর্তী দীর্ঘ সময় উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নানা ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও একত্রে বাস করে এসেছে। এর ফলে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ছত্রছায়ায় সহস্রাধিক বছরের ধারাবাহিক ঐতিহ্যকে উপমহাদেশ তার বহুত্ব ও বিভিন্নতা সত্ত্বেও ধারণ করেছিল তার সমূল বিনাশ সভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়।

দেশভাগের অনেক আগে থেকে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে সামাল দেওয়ার ব্যর্থতা মূলত রাজনীতিকদের। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, সময়ের পরিবর্তনে মানুষের জীবনযাপন যেমন বদলায়, তেমনি তার আকাঙ্ক্ষা, হতাশাও নতুন পথে বাঁক নেয় যার সঙ্গে রাজনীতি, দেশপ্রেম, নাগরিক চেতনা, ধর্মীয় চেতনা ও গোষ্ঠীস্বাতন্ত্র্য যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে যথেষ্ট জটিল, কখনও ঘোলাটেও করে তোলে। ফলে চার-পাঁচশ বছর আগের নাগরিক অধিকারসচেতন অল্পসংখ্যক মানুষের তুলনায় ঊনবিংশ বা বিশ শতকে এর সংখ্যাধিক্য বিভিন্ন মত ও পথের সন্ধান দিয়ে মানুষকে তার পূর্বের সনাতন ও পরিবর্তনবিমুখ মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাবে, তা খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। তারপরও এ কথা বলাই যায়, দেশভাগের পরিণতি কী হতে পারে এ নিয়ে নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের চিন্তা বেশি দূর এগোয়নি বা এগোতে দিতে তাঁরা মন থেকে জোর সাড়া পাননি। মুসলমানদের বাস সারা ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক (রাষ্ট্রের) অবস্থানে তাদের নিয়ে আসার লিগপন্থী চিন্তা যে চরম অদূরদর্শী তা মওলানা আবুল কালাম আজাদসহ মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া কাউকে বিচলিত করেছিল বলে মনে হয় না। একটা বিষয় তো পরিষ্কার ছিল, দেশভাগ হলে মুসলমানদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভারতে থেকে যাবেন, অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে যে সংখ্যক হিন্দু ও শিখ ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হবেন তার ফলে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের চরম বিদ্বেষ ও হানাহানির শিকার হতে হবে। পাঞ্জাবে এর সূত্রপাত সাতচল্লিশের আগে থেকে হলেও সাতচল্লিশের আগস্ট থেকে পরের চার মাসব্যাপী এর বীভৎসতা সব হিসাবনিকাশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দাঙ্গা অন্যান্য জায়গায়ও কম-বেশি হয়েছিল— যেমন সিন্ধুতে, বাংলায়। তবে দীর্ঘকাল ধরে পাঞ্জাবে মুসলমান, হিন্দু ও শিখদের সম্প্রীতিপূর্ণ অবস্থান যে অকল্পনীয় সাংঘর্ষিকতায় রূপ নেবে তার কোনও পূর্বাভাসই কি নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকের মগজে খেলেনি? হয়তো তাই, কারণ দেশভাগ বলতে মুখে মানুষের কথা বললেও মূলত এক অনির্দিষ্ট ভৌগোলিকতাই গুরুত্ব পেয়েছিল।

আজকাল যখন কথা ওঠে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব যদি শেষপর্যন্ত গৃহীত হত (জিন্নাহ রাজি ছিলেন, নেহরু প্রথমে রাজি থাকলেও পরে বেঁকে বসেছিলেন), তাহলে ঢিলেঢালা ফেডারেল ব্যবস্থায় ভারতভাগ কি ঠেকানো যেত? তখন এ কথা মনে রাখা দরকার, যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে প্রস্তাবটি ইংরেজরা করেছিল তার ইতিবাচক ফলাফল কিছু হলেও অত্যন্ত ক্ষণজীবী হত। যা হয়নি তা নিয়ে কে কী তখন বলেছেন সে প্রশ্ন অবান্তর, বিশেষত এ জন্য যে ১৯৪৬-এ যখন প্রস্তাবটি আসে, তখন ভারতভাগ ছিল প্রায় অনিবার্য। ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতার পর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। সাতচল্লিশের গোড়ার দিকে শরৎ বসু (ততদিনে তিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন), মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম ও কিরণশঙ্কর রায় United Bengal Plan বা স্বাধীন যৌথ বঙ্গের একটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত করেন। জিন্নাহ ও গান্ধির সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা হয়। জিন্নাহ অরাজি ছিলেন না, গান্ধি ঠিক রাজি না হলেও নিমরাজি ছিলেন। তবে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালিনি, জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তাতে বিন্দুমাত্র সায় দেননি। সেই সঙ্গে যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে যুক্ত বাংলা প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করেছিলেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। যুক্ত বঙ্গের এই প্রকল্প অনেকের মতে সেসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটা প্রচেষ্টার বেশি কিছু ছিল না, যদিও প্রচেষ্টাটি আন্তরিকই ছিল। কিন্তু এর পেছনে উভয় বংলার জনসমর্থন ছিল কি না, বা প্রকল্পটি কতটা বাস্তবানুগ এসব নিয়ে তেমন বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি বলেই মনে হয়। ফলে তা প্রচারেরও তেমন সুযোগ পায়নি।

পাঁচ

সাতচল্লিশের চরম ভুক্তভোগী পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বাংলা অঞ্চলের শরণার্থীরা। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে শরণার্থীরা সম্প্রদায়গতভাবে আলাদা হওয়ায় নতুন আবাসভূমি খুঁজতে কোন সম্প্রদায় কোথায় ঠাঁই নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে এ সত্য স্বীকার করতে হবে, যে ভারতীয় মুসলমানদের কথা বলে দেশভাগ, তাদের এক বড়ো অংশের নতুন মুসলমান রাষ্ট্রে ঠাঁই হয়নি। ওয়ালি খান তাঁর ‘Facts are Facts: The untold story of India’s Partition’ বইতে এ ঘটনাকে বলেছেন মুসলমানভাগ, ভারতভাগ নয়। “… this was not partition of India but partition of Muslims. The League was prepared to desert crores of Muslims of India, without bothering to look back at their miserable plight.” সংখ্যালঘু তকমা নিয়ে তাদের ভারতেই থেকে যেতে হল। জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ বইতে লিখেছেন, “৪৭-এর পর পশ্চিম বাংলার মুসলিমদের অবস্থান ও মর্যাদার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যায়। ১৯৪৭ সালের আগে এক দশক ধরে যুক্ত বাংলায় মুসলিমদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল। প্রতিবেশীদের ওপর, এমনকি যেখানে তাদের চেয়ে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি ছিল সেখানেও তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পেরেছিল।” মন্তব্যটিতে সরলীকরণ রয়েছে, বৈপরীত্যও। কর্তৃত্ব ও অধিকার সংরক্ষণ কখনোই সমার্থক নয়। মোদ্দা কথা, সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবাংলাবাসী মুসলমানেরা নিরাপত্তাহীন ও অরক্ষিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় অনেকে পূর্ববাংলায় পাড়ি জমান, কিন্তু তাদের চেয়ে বহু সংখ্যক মানুষ পশ্চিম বাংলায় থেকে যান। ১৯৫১ সালের ভারতীয় জনগণনা উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যদি দেশভাগের পরপর পশ্চিমবাংলার মোট পঞ্চাশ লক্ষ মুসলমান জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ দেশত্যাগী হয়ে থাকেন, তাহলে রয়ে যাওয়া বিরাট অংশের মানুষকে টিকে থাকার প্রয়োজনে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। নিজ দেশে নতুন প্রেক্ষাপটে আত্তীকৃত হওয়া ছিল কঠিনতম চ্যালেঞ্জ।

নিজে দেশে নতুনভাবে আত্তীকৃত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব একটা নেই। অন্য দেশে অভিবাসী হতে গিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে নব্যঅভিবাসীদের সে দেশের ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে তো বটেই, জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে আত্তীকৃত না হয়ে উপায় থাকে না— অন্তত চেষ্টা করে যেতে হয়। উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া মূলত অভিবাসীদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও মাল্টিরেসিয়াল সামাজিক সংস্কৃতিতে অভিবাসীদের জন্য খাপ খাওয়ানো একটা বড়ো কাজ। ভারতে যে বড়ো জনগোষ্ঠী রয়ে গেল, তাদের খাপ খাওয়ানো মানে নিজেদের এক ‘পরিশোধিত’ আত্মপরিচয়ে পরিচিত হওয়া।

ছয়

সাতচল্লিশের দেশভাগে অর্থনীতির অবশ্যই এক জোরালো ভূমিকা ছিল। দেশভাগে লাভবান হবেন এমন আশা সবচেয়ে বেশি ছিল পশ্চিম পাঞ্জাবের সামন্ত শ্রেণি, ব্যবহারজীবী, প্রতিষ্ঠিত ও উঠতি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর। নতুন রাষ্ট্রে কম প্রতিযোগিতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভবান হওয়া যাবে, তাদের এ চিন্তার পেছনে যুক্তি যেমন ছিল, বাস্তবে হয়েও ছিল তাই। একই ভাবনার প্রেরণা পূর্ববাংলার স্বল্পসংখ্যক বিত্তবান ব্যবসায়ী, ভূস্বামী ও উঠতি মধ্যবিত্তের মধ্যেও কাজ করেছে, আর কার্যত তা বিফলে যায়নি। দুই পক্ষের চিন্তায় একটা খামতি অবশ্য ছিল। দেশভাগের ফলে কলকাতা ও বোম্বাইয়ের মতো ব্যবসা ও পুঁজি বিনিয়োগের পরিকাঠামো অন্য কোথাও ছিল না, তবু মাড়োয়ারি বা গুজরাটি বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে না, এ হয়ত তাদের জন্য এক ধরনের সান্ত্বনা ছিল।

অর্থনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও বাংলাভাগ হওয়ায় লাভ হল পূর্ববাংলার অবস্থাপন্ন ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের। প্রথমত তাদের বাস্তুত্যাগী হতে হল না, উপরন্তু পাকিস্তানের অংশ হয়েও তারা নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের স্বপ্নে বিভোর হলেন। স্বপ্নটা অবাস্তব ছিল না, তারা ভেবেছিলেন শিক্ষা-দীক্ষায় এগোতে পারবেন, চাকরি-বাকরিতে সুবিধা পাবেন। সে স্বপ্ন একেবারে অধরা থাকেনি। দুর্ভোগে পড়েছিলেন পূর্ববাংলাত্যাগী বিপুল হিন্দু জনগোষ্ঠী। সীমাহীন, বর্ণনাতীত দুর্ভোগ।

সাত

আজ এ প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক — পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয়েও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের প্রথম সোপান কি সাতচল্লিশে রচিত হয়েছিল? নাকি ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে? বাংলাভাগ না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বলে কি কিছু থাকত? বাংলাভাগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকে বিব্রত বোধ করেন এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন। পাশ কাটিয়ে যান কেউ কেউ, আবার কেউ কেউ এমনও বলেন সাতচল্লিশে বাংলাভাগ না হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হত। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশভাগের ন্যারেটিভে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এক ভিন্ন প্রেক্ষিত তৈরি করেছে। যে যেভাবেই দেখুন, সাতচল্লিশের কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র এ সত্য অস্বীকারে কার লাভ?

একটা কথা ওঠে — একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দ্বিজাতিতত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্ব যে এক ভ্রান্তির নাম তা প্রমাণ করতে একাত্তরের বাংলাদেশ পর্যন্ত আসার দরকার পড়ে না। বস্তুতপক্ষে, একাত্তরের বহু আগে সাতচল্লিশের পরপরই যখন মুসলমানদের গরিষ্ঠ অংশ ভারতে থেকে গেল, তখনই এই তত্ত্বের ভিত্তিহীনতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। তত্ত্বটা যে বানোয়াট ও প্রাক্‌ভাগ সময়ের পপুলিজম থেকে এর জন্ম ও বিকাশ তা আর কেউ জানুন না জানুন, জিন্নাহ জানতেন। কৌতূহলের বিষয় হল, পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে জিন্নাহ যা বলেছিলেন তাতে অনেকেরই চমকে ওঠার কথা। বলেছিলেন, রাষ্ট্রের নাগরিকেরা রাজনৈতিক অর্থে হিন্দু থাকবে না, মুসলমানও না। “In course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims in the political sense as the citizens of the state.” তার মানে, দেশভাগের আগে মুসলিম জাতীয়তাবাদ বা দ্বিজাতিতত্ত্বের ক্যাম্পেইন একটা মোহজাগানিয়া রাজনৈতিক কৌশল ছিল, যা দেশভাগের পরপরই জিন্নাহ পরিত্যাগ করেছিলেন। ব্যক্তিগত বিশ্বাসপ্রসূত তাঁর এই বাঁকবদল অবশ্য কাজে আসেনি, সময় তা প্রমাণ করেছে। এ থেকে যা বেরিয়ে পড়ে তা সাতচল্লিশ-পূর্ব ঘোঁটপাকানো এমন এক পরিস্থিতির যার সতাসত্য ধূম্রজালে আবদ্ধ ছিল।

আট

সাতচল্লিশকে অতিক্রম করা নয়, এর মুখোমুখি দাঁড়ালে একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিতেই পারে। কী হত যদি ভারতভাগ না হত, বা অন্যভাবে বললে ভারতভাগ ঠেকানর কি আদৌ কোনও সম্ভাবনা ছিল? বাস্তুচ্যুত বিশাল জনসংখ্যার অকথ্য যন্ত্রণা-কষ্ট পরিহার এবং হাজার বছরব্যাপী ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ভাষাভাষীদের আবাসভূমিকে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যিক পরিচিতি ও বিন্যাসে অবিভক্ত রাখা নিঃসন্দেহে অনন্য গৌরবের ঘটনা হতে পারত। তবে গোড়ার কথা এই — ভারতবর্ষ কখনোই ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক বাঁধুনিতে অখণ্ড দেশ বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। ইংরেজরা নিজেদের উপনিবেশায়নের স্বার্থে বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার করলেও পাঁচশ-রও বেশি স্বশাসিত রাজ্য (প্রিন্সলি স্টেট) নিয়ে ভারতবর্ষের একীভূত দেশ-চরিত্র ছিল না। কারও কারও মতে অখণ্ড ভারত এক ঔপনিবেশিক ধারণা, যা প্রায় মিথতুল্য। এই যখন অবস্থা বা অচলাবস্থা, পারা কি যেত ঠেকাতে ভারতভাগ? হয়ত যেত, যদি ঔপনিবেশিক শক্তি বিভেদকামিতায় ইন্ধন না জোগাত বা একের পর এক কূটচাল না চালত। একে ঠিক উপযুক্ত জবাব বলা যাবে না, যদিও অস্বীকারের উপায় নেই, প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের একটা অত্যন্ত প্রভাবক শক্তি ছিল যাকে নানা গোষ্ঠীতে, ধর্মে, ভাষায় ভাগাভাগি মানুষজনের অস্বীকার করার বা এড়িয়ে যাওয়ার পথ ছিল না। যা হতে পারত, আজকের দিনে যা অসম্ভব মনে হতে পারে তা এই — সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যে যৌথতার সম্মিলনে গড়ে উঠতে পারত তাকে অটুট রাখা, আর তা করতে হত ঐক্যবদ্ধভাবে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু উনিশ শতক থেকেই এই যৌথতা নানা মাত্রায় ও গভীরতায় বিভেদকামিতার খোরাক হয়েছে। কট্টর জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড ও নানা ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়ায় প্রবলভাবে বিভক্তিকে চূড়ান্ত করেছে।

সাতচল্লিশ এক বহুমাত্রিক, শাখাপ্রশাখাময় ঘটনাপুঞ্জের সারাৎসার। ঘটনাক্রমের ঐতিহাসিক বা তথ্যভিত্তিক বয়ান একে মোটা দাগেই চিহ্নিত করতে পারে। এর পরিণতিহীন পরিণতিকে নয়।

তথ্যসূত্র :

১. বদরুদ্দীন উমর : ‘সাম্প্রদায়িকতা’, মওলা ব্রাদার্স, ষষ্ঠ সংস্করণ, ঢাকা, ১৯৯৪

২. বদরুদ্দীন উমর : ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র’, বিজ্ঞাপন পর্ব, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ

৩. Ayesha Jalal : ‘The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League,  and the Demand for Pakistan’, Cambridge University Press, 1985

৪. Nitish K. Sengupta : ‘Bengal Divided. The Unmaking of a Nation (1905-1971)’, Penguin, Viking. 2007

৫. Joya Chatterji : ‘The Spoils of Partition: Bengal and India, 1947-1967’, Cambridge University Press, 2007

৬. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও জনগণের মুক্তি — ১৯০৫-৪৯’, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫

৭. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : নিবন্ধ- ‘দেশভাগের দায়-দায়িত্ব’, বুদ্ধদেব ঘোষ ও দেবব্রত বিশ্বাস সম্পাদিত “সাতচল্লিশের দেশভাগ”, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০২০

৮. রতন খাসনবিশ : নিবন্ধ- ‘দেশভাগের অর্থনীতি’, প্রাগুক্ত

৯.  আলি রিয়াজ : নিবন্ধ- ‘১৯৪৭ সালকে আমরা কীভাবে বর্ণনা করব?’ ঈষাণ, বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা, সেপটেম্বর ২০২২

১০. Wali Khan: ‘Facts are Facts-The untold story of India’s Partition’, Translated by Dr Syeda Saiyidian Hameed, University Press Ltd, Dhaka, 1987

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান