উত্তরবঙ্গের দেশভাগ, দেশভাগকেন্দ্রিক স্মৃতি ও আখ্যান   

প্রদীপ রায়

উত্তরবঙ্গে দেশভাগের প্রভাব, সেখানকার দেশভাগাক্রান্ত মানুষের স্মৃতি ও সংকট, তাঁদের প্রত্যাশা, তাঁদের প্রাপ্তি, তাঁদের অনুভূতি — এসব কিছুকেই বুঝতে হলে সে অঞ্চলের মানুষদের, লেখকদের আবেগকে স্পর্শ করা প্রয়োজন। স্বভাবতই সে আবেগ, সে অনুভূতি দক্ষিণবঙ্গ, গৌড়বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গের থেকে আলাদা হবে এটাই বাস্তব। তাই স্মৃতি-শিল্প সাহিত্য ও ইতিহাসে উত্তরের দেশভাগকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে ফিরে যেতে হবে তরাই-ডুয়ার্স সহ নিবিড় ছায়াঘন সবুজের নিভৃত কুহুকে। কতটুকুই বা জানি উত্তরের এই নীরব কান্নাকে, কতটুকুই-বা বুঝি ওপার বাংলা থেকে উত্তরভূমিতে চলে আসা সে সব মানুষদের যন্ত্রণার কথকথাকে। আর যারা চলে গেলেন ওপারে…? আমরা বরং চোখ রাখব এ বিষয়ক উত্তরবঙ্গের দেশভাগকেন্দ্রিক স্মৃতি ও আখ্যানে। হয়তো সংখ্যাটি কম কিন্তু যন্ত্রণার বহরটি কম নয় একটুও।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার পার্টিশন সাহিত্যকে যদি আমরা বুঝতে চাই, তাহলে শুধু বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারতই নয়, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা কেন্দ্রিক পার্টিশন সাহিত্যের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে আরও বেশি দেশভাগের সাহিত্য-শিল্পের চর্চা ও পাঠ নেওয়া জরুরি। স্বাভাবিক কারণে তর্ক উঠতেই পারে উত্তরবঙ্গের দেশভাগের সাহিত্য বলে স্বতন্ত্র কিছু হয় কি? সাহিত্য স্থাননামে দোষে দুষ্ট হয় কি না? কিন্তু উত্তর আধুনিক সাহিত্য বিচ্ছিন্নতাকেই গ্রহণ করে। অখণ্ডকে নির্মাণ করতে হয় খণ্ড দিয়েই। পশ্চিম বাংলার আটশো কিলোমিটার সীমান্তের দক্ষিণবঙ্গের সাথে উত্তরবঙ্গের জলবায়ুগত, ভাষা, পেশা ও জীবনযাপনের ভিন্নতার কারণে দেশভাগের সাহিত্যে সংকটের মাত্রাও ভিন্নরূপ। আবার উত্তর-পূর্বের দেশভাগের সাহিত্যে বাঙালিদের যে অস্তিত্বের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে ঘুরেফিরে আসে পশ্চিমবঙ্গের উভয়বঙ্গের দেশভাগের সাহিত্যে সেভাবে প্রায় নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের মলয়কান্তিদের ‘আসরাফ আলির স্বদেশ’, দেবব্রত চৌধুরীর ‘আব্বাজানের হাড়’, অরিজিৎ চৌধুরীর ‘আগুন’ প্রভৃতি উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই এক অনিশ্চিত সময়ের কথা, বিদেশি উচ্ছেদ, নাগরিকত্বের সপক্ষে প্রমানপত্র, উদ্‌বাস্তু হয়ে আসা দেশে আবার নতুন ‘দেশ’ খোঁজার টেনশন, বারবার বাস্তুহারা হয়ে ভারত-বাংলাদেশের মাঝখানে ‘নো ম্যানস ল্যাণ্ডে’ আশ্রয়ের মতো বিচিত্র সংকট। উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে দেশভাগের স্মৃতি ও সাহিত্যও ধারণ করে রয়েছে কিছু মৌলিক সংকট, ছুড়ে দিয়েছে নতুন কিছু প্রশ্ন যা বাংলা দেশভাগের সাহিত্যে নতুন স্বর সংযোজনের দাবি রাখে।

দেশভাগের স্মৃতি ও উত্তরবঙ্গ

স্মৃতিকথায় ও আত্মকথায় বিভিন্ন দিক থেকে উত্তরবঙ্গের দেশভাগের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। উত্তরবঙ্গের দেশভাগের স্মৃতিসাহিত্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অমিয়ভূষণের জীবন কথা নিয়ে গ্রন্থিত ‘বনেচর’ বইটির কথা প্রথমে বলতে হয়। বইটি লিখেছেন তাঁর কন্যা এণাক্ষী মজুমদার। এই বইয়ে পাওয়া যাবে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অমিয়ভূষণের স্মৃতিকথায় দেশভাগ কীভাবে এসেছে এবং তাঁর দেশভাগের যাপিত জীবন।

সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’ উত্তরবঙ্গের দেশভাগের স্মৃতিকথা মূলক রচনা হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থে পাওয়া যায় সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে চলে আসা ছিন্নমূল কিছু মানুষ এবং এপার বাংলার উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক অঞ্চল তোর্সা নদী সংলগ্ন কোচবিহারের মানুষদের কথা, মুসলিম মানুষদের কথা পূর্ববঙ্গে যারা রিফিউজি নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

এছাড়া উত্তরবঙ্গে জন্ম ও আমৃত্যু কাটালেও অশ্রুকুমার সিকদারের স্মৃতিকথা ‘পুরনো পথের রেখায়’য় পাব  অবিভক্ত বাংলা ফরিদপুরের জন্য শেকড়ের টান ও দেশকে ভুলতে না পারার স্মৃতি কিংবা দেশ হারানোর যন্ত্রণা।

আখ্যানে উত্তরবঙ্গের দেশভাগ

কোচবিহারে জন্ম হলেও অমিয়ভূষণের পূর্বপুরুষের ভিটে আসলে ওপার বাংলায়। সমগ্র জীবনের মাত্র কিছুকাল ওপারে কাটানো অমিয় আজন্ম অন্তরে লালন করে চলেছেন ওপারকেই। তাই তিনি বলতে পেরেছেন— ‘পৃথিবীতে অনেক দেশ থাকতে পারে — যে দেশে পদ্মা নেই, সেটা আমার দেশ না। যে দেশে পদ্মা প্রবাহিত, সেটি আমার দেশ।’আসলে পোস্ট পার্টিশনের কোলে বসে এভাবেই দেশভাগে আক্রান্ত মানুষেরা দেশ খুঁজে চলেন। সাহিত্যিকরা নির্মাণ করেন গল্পের ছলে ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাসই। রাজনাগরিক অমিয়ভূষণ মজুমদারের (১৯১৮-২০০১) দেশভাগ ও উদ্‌বাস্তু সমস্যা নিয়ে ‘গড় শ্রীখণ্ড’ (১৯৫৭), ‘নির্বাস’ (১৯৬০) উপন্যাস দু-টি রচিত হলেও সরাসরি উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের উদ্‌বাস্তু মানুষদের সাথে উত্তরবঙ্গের জনজাতিদের একটি ভিন্ন সংকটের চিত্র ‘বিনদনি’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। উত্তরবঙ্গে দেশভাগের ফলে কেবল ওপার বাংলা থেকে চলে আসা মানুষদের যন্ত্রণার কথাই লেখক বলেননি, তিনি দেখিয়েছেন উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্রদের চরম দুর্দশার কথা। দেশভাগের পরোক্ষ প্রভাবের যন্ত্রণা তাঁদেরকেও আস্বাদ করতে হয়েছিল। বাড়তি জনসংখ্যার চাপে ও সুবিধাবাদী শাসক দল তাঁদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। ওপার বাংলার মানুষদের সাথে উত্তরবঙ্গের জনজাতিদের ঘটতে থাকে ভাষা ও সংস্কৃতির বিমিশ্রণ। উত্তরবঙ্গের জনজাতিরা ধীরে ধীরে পরিণত হয় প্রান্তিক শ্রমিকে। বিনদনি উপন্যাসে ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের জনজাতিদের অসন্তোষের কথা জনাদনের সংলাপেই স্পষ্ট —

      “দেখেক গাদলু ভুখটাই সব নো-হয়। ভুখ যারা মিটায় তাকেই কেনে ফির ঘৃণা করে উম্রা। হামরা না টাইবাল। দেশ যেদু আমার তা মুই কেনে টাইবাল থাকি যাই? আর উম্রা হয় জাতি বডার থাকি আসিয়াও।”

দেশভাগের সাহিত্যে — নিজভূমে পরবাসী, দেশে থেকেও যারা উদ্‌বাস্তু উত্তরবঙ্গের সেই জনজাতিদের বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামের কথা লেখক অমিয়ভূষণ যেন উলটোদিক থেকে বোঝার চেষ্টা করেন।

দেশভাগ নিয়ে লেখা ‘স্বপ্ন ও অন্যান্য নীলিমা’ (২০০০) কথাকার অভিজিৎ সেনের (১৯৪৫) আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জন্মসূত্রে বরিশালের কেওরা গ্রামের লেখক অভিজিতের সাহিত্যভুবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে দেশভাগের স্মৃতি। দেশভাগজনিত আঘাত, হৃদয়হীনতা, লোভলালসা, স্বার্থপরতা তাঁর লেখক সত্তাকে বিশেষভাবে অলোড়িত করেছিল। স্বপ্ন ও নীলিমা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সরোজের শৈশব থেকে ব্যক্তি সরোজ হয়ে ওঠার পর্ব-পর্বান্তরে আমারা লেখক অভিজৎ সেনের হয়ে ওঠাকেই প্রত্যক্ষ করি। এই উপন্যাসে দেশভাগের পূর্বে কোলকাতায় পড়তে আসা সরোজ দাঙ্গা, দেশভাগ ও রাজনৈতিক কারণে কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গের মাঝের বন্দরে আশ্রয় নেয় — কলেজ জীবনের ছোটো বেলার বন্ধু মনীষের কাছে। সরোজ দায়িত্ব পায় ওপার থেকে উত্তরবঙ্গে আসা মানুষদের শরণার্থী শিবিরের কাজে। সে প্রতিদিন হিসেব রাখে শরণার্থীদের, ব্যবস্থা করে রেশন ও বাসস্থানের। পূর্ব পাকিস্তানের পালিয়ে আসা পরিবারগুলির এখানে (উত্তরবঙ্গে) দেখা হয় একে অপরের সঙ্গে, যেমন, সতীর (ভালো নাম-ফরিদা মনসুর) সঙ্গে দেখা হয় সরোজের, চিঙ্গিস ভাইয়ের সাথে সতীর ও তার বোন হেনার। কিন্তু কেউ নিজেদের দুর্ভাগ্য কিংবা অত্যাচারিত হওয়ার গল্প করে না — ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’। এভাবে এক আশ্চর্য নীরবতার মধ্যে দিয়ে নির্মিত হয় এই উপন্যাসের দেশভাগের অখ্যান। যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পাঞ্জাবের দেশভাগের প্রেক্ষাপটে লেখা উর্বশী বুটলিয়ারের ‘The Other side of Silence’-এর কথা।

উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরে বেড়ে ওঠা বিপুল দাসের (১৯৫০) উপন্যাস ‘সরমার সন্ততি’ (২০১৩) তে আমরা দেখতে পাব দেশভাগের ফলে একদিকে উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্রদের সংকট অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষের জীবন যন্ত্রণা ও স্বদেশের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি, সমাজ-সংস্কৃতিতে বসবাসের কারণে নিজেদের দেশের সেসব স্মৃতি তাঁদের আরও বেশি বেশি করে তাড়িত করত। হরিদেব চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলে বিজনলাল নামে দু-টি চরিত্রের কথা জানতে পারি দেশভাগের সময় যারা চলে আসে উত্তরবঙ্গে। হরিদেব চক্রবর্তী উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ সন্তান, নিজেদের দেশে যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার কারণে সব রকম সুযোগ সুবিধে ভোগ করত কিন্তু সবকিছু হারিয়ে নতুন দেশে ক্যাম্প জীবনে সে যেন আর খুব একটা খাতির পান না। তাঁর কথায় আমরা জানতে পারি—   

      “আমাগো আর লক্ষী নাই। পালে পালে লক্ষীছাড়ার দল তোমাগো দ্যাশে আইস্যা পড়ছি। তাঁর ঘট, তাঁর আসন ফালাইয়া বিজুরে নিয়া এই পারে আসলাম। মন মানে না, ঠাকুরের আসন পাতছি। আসল লক্ষ্মী হইল গিয়া ধানের গোলা। সেইটি গেল গিয়া।… যারা কুনোদিন চোখের দিকে তাকাইয়া কথা কওনের সাহস পায় নাই, তাঁরা সিধা আইস্যা বারান্দায় উইঠ্যা মোড়ায় বসে। চালের টিন কয় সালের পুরানা তালাশ করে। পুষ্কর্ণিতে মাছ কেমুন জিগায়। ঘাড় উচাইয়া ঘরের ভিতর দেখবার চায়। দাড়ি ধইরা মোচড় দ্যায় আর ফিচিক ফিচিক হাসে।”

কথায় কথায় মহাভারত, পুরাণ, বেদের প্রসঙ্গ আওড়ানো হরিদেবের জীবন যেন হয়ে ওঠে অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার দেবীগঞ্জ থানার মণিভূষণ রায়ের স্মৃতি কথার ‘নিজগৃহে পরবাসীর মতো তিনটি বছরের জীবন।’ হরিদেবও কেমন যেন মুষড়ে পড়েন দেশভাগের স্মৃতিগুলি মনে পড়লে। যেই মুহুর্তে সে জানতে পারল নিজেদের দেশে তাঁরা থাকতে পারবে না সেখানকার বাতাস হিন্দুদের জন্য ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে, সে অনুভব করত একরাশ আতঙ্কের ছায়া, বুকে চেপে বসত অদৃশ্য ভয় ও চাঁপা কান্না যা ভিতর থেকে গুমরে গুমরে উঠত। এমনকি দেশত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে তাঁর শরীর কেঁপে উঠত পবিত্র আজান আল্লা হু আকবর শুনলেই। হরিদেব চক্রবর্তীদের মতো হিন্দুদের ঘরদুয়ার ও বাগান দেখে মুসলিমরা তাকিয়ে থাকত লালসাভরা চোখ নিয়ে, দুর্যোধনের মতো উরুতে থাপর মারত লুঙ্গির উপর দিয়েই। বুকভরা বাতাসে হিন্দুরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছিল নিজস্ব দেশের ঘ্রাণ। হরিদেবের চোখেও জল আসে, দৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে ওঠে — ধানখেত, নারকেল-সুপারি ও পুষ্করিণীর জল।  

দেশভাগের পর এপারে উত্তরবঙ্গে এসে হরিদেব চক্রবর্তী উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্র জোতদার ভান্ডি সিং এর জোতজমি, মাঠভরা ফসল, সবুজ গাছপালা দেখে সে ভুলো মানুষের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, সদ্য ফেলে আসা অতীত স্মৃতির মুখোমুখি হয়। পরবাসে ভান্ডি সিং এর ধানখেত যেন তাঁর কাছে ফেলে আসা জীবনের এক টুকরো স্মৃতির সলতে। হরিদেব চক্রবর্তীর মনে হয়েছিল— হেমন্তের ভোরে সোনালীহলুদ খেতের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ধানের খোসার আড়ালে জমাট দুধের গন্ধ তাঁর মতো নাকে আসে নিশ্চয় ফরিদপুরের জ্যোতিষ, পাবনার ধীরেন নন্দী ও কুমিল্লার সুদেবেরও। তখন তাঁদের বুকের গভীর থেকে শুকনো বাতাস উঠে আসে। সেই বিষাদময় বাতাস বয়ে নিয়ে আসে মনসামঙ্গলের পুঁথিপাঠ, ব্রতকথা ও স্টিমার। উত্তরবঙ্গের তেলিপাড়ায় ভাঙাপোলের ওপর দাঁড়িয়ে হরিদেবের মনে পড়ে স্বদেশের মানুষের ঘরবাড়ি পোরার কথা, মেয়েবউদের নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রসঙ্গ, দেশভাগের স্মৃতি—

      “একটা দেশ দুভাগ হয়ে গেল। রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল সে জমি জল বাতাস, সে সব আর নিজের রইল না। রক্তের সঙ্গে আরও কিছু ছিল। দ্বিজত্বের অভিমান, লোকগান, মহাভারত, বেদ উপনিষদ, ব্রতকথা। সে সব কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।”

কিন্তু আমরা বিস্মিত হই চাল চুলোহীন, দেশহীন হরিদেবের দ্বিজত্বের অভিমান দেখে। এদেশের পুরনো বাসিন্দাদের সে মানুষ বলে গন্য করে না। রূপলাল সিং-কে যখন সে শাস্ত্রকথা শোনাত, তার কথকতায় মিশে থাকত উচ্চবর্ণের আভিজাত্য। রূপলালকে এস সি হিসেবে উল্লেখ করার মধ্যে মিশে থাকত বিদ্রূপ ও ঘৃণা। উত্তরবঙ্গের আদি বাসিন্দা ভান্ডি সিং-এর পুত্র রূপলালকে সে বলেছে —

    “বুজ্জ? তোমাগো যদি একটু স্যাংস্কৃটাইজড্‌ করতে পারতাম… কী করুম, দ্বিজবংশে জন্ম, অনাচার সহ্য হয় না। যেই খানেই যাই, মনে হয় ঈশ্বর বুঝি আমারে কুনো দায়িত্ব দিয়া পাঠাইছে। বিপ্র হইলেই তো হয়না, সমাজটারে বুঝোন লাগে। এই দেহ এই মনটারে পবিত্র করণ লাগে। ব্রাহ্মণ ছাড়া কেডায় করব সেই কাম। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রগো কর্ম ঈশ্বর আলাদা কইরা দিছে। ব্যাদপাঠ, হোমযজ্ঞ, শান্তিস্বস্ত্যয়ন… সংসার পবিত্র করণের ভার ঈশ্বর ব্রাহ্মণের উপর অর্পণ দিছে।”   

তাঁর কথা সূত্রে আমরা জানতে পারি ওপারের দাশেরা কীভাবে এদেশে মজুমদার সাজে, কাকের পিছনে ময়ূরের পেখম পরে। হরিদেব রূপলালকে জানিয়েছে তাঁদের স্বদেশের শ্রাবণসংক্রান্তির দিন থেকে পুঁথি পাঠের কথা, বেহুলা লখিন্দরের বিয়ের পৃষ্ঠা এলে প্রত্যেক বাড়িতে বিয়ের আয়োজন, নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো চল। হরিদেব চক্রবর্তীকে স্বদেশের সে সব সুখস্মৃতি ছাঁপিয়ে এক লহমায় যেন আচ্ছন্ন করে দেশভাগ পরবর্তী জীবনসংগ্রাম ও ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণা। তাঁর কথায় উঠে আসে সেই অস্তিত্বের সংকটের কথা —

       “স্ট্রাগল্‌ ফর এগজিস্টেন্স। বাইচ্যা থাকনের লড়াই। কম স্ট্রাগল্‌ করি নাই। পুঁথি পুস্তক সব কৈ গেল গিয়া। বিজুর মায়ে দ্যাহ রাখল। ইন্ডিয়ায় আইস্যা এই ঘড়বাড়ি করতেই আমার দম শ্যাষ। দ্যাশে দালান, পুষ্কর্ণি, নাইরলের বাগান, সব শ্যাখেরা ভোগ করতাছে। এই দ্যাশেও মনে হয় যেন উপরে উপরে ভাসতাছি। শিকড়টাই গেল গিয়া।… শিকড় ছিঁড়ল, ইজ্জত গেল, অহন আবার নতুন কইরা বাইচ্যা থাকনের লড়াই— সর্ব অঙ্গ দিয়া রক্ত। রুট বুঝ ?… আমাগো রুট ওভার করলে পূর্ণ সংখ্যা পাইবা না। ছিন্নমূল হয়্যা পড়ছি।”

হরিদেব চক্রবর্তীদের মতো দেশহীন শিকড়হীন ছিন্নমূল মানুষেরা যেন তখন হয়ে ওঠে George Borrow-এর লেখা উপন্যাসের জিপসিদের মতো ভাসমান বা অভিজিৎ সেনের ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের বাজিগর সম্প্রদায়ের দনু, পীতেম কিংবা লুবিনিদের মতো থিতুহীন। নিজের ‘দেশ’ বলতে যাঁদের কাছে নিছকই একটি স্বপ্নমাত্র। এই দেশহীনতাই যেন হরিদেবের নিয়তি। রাজায় রাজায় যুদ্ধে হাঁটু গেলেও হাঁটতে হবে। প্রাণ রক্ষাই ত ধর্ম। নতুন দেশে তাঁদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম যেন বট গাছের চারার— পাথর ফেটে এগিয়ে আসা। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতা মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার মাঝেও দেশহীন হরিদেব দেশকে খুঁজে পেতে চায় বুকের ভিতর উথাল পাথাল করা জারি, সারি কিংবা ভাটিয়ালি গানে, মাঝি মাল্লাদের গানে। যে সব গানের সুরের স্মৃতি তাকে প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা দেয়—

    “জারি, সারি নাকি ভাটিয়ালি — বুকের ভিতর উথাল পাথাল করে। চক্ষুতে আপনেই জল আয়্যা পড়ে।… নতুন জুতা পায়ে দিতে গিয়া কেমুন ফোস্‌কা পড়ছে। শরীর মন জুইড়্যা কেমন জ্বালা করে।… শীতল বাতাসটিরে তো লগে আনবার পারি নাই।… শালগ্রাম শিলার বদলে যদি সেই দ্যাশের শীতল বাতাস, মাঝিমাল্লাগো গান, দুইখান নাইরলের চারা আনবার পারতাম… যদি আমাগো গ্রামের শ্যাম কবিয়ালরে সঙ্গে আনতে পারতাম।” 

হরিদেবের কথায় আমরা জানতে পারি উত্তরবঙ্গের নতুন কলোনিতে রংপুর, ফরিদপুর, ঢাকা, কুমিল্লার সুদেব বোস, বলরাম সাহা, শ্রীকৃষ্ণ দাস, স্বদেশ পালের মতো চাষিদের কথা। যাঁরা বাঁশের খুঁটি, দরমার বেড়া দিয়ে ঘর তোলার পর পড়ে থাকা মাটিতে প্রচন্ড খিদে নিয়ে চাষবাসের ভেলকি দেখায়। বাজাডাঙ্গা জমিতে সোনার ফসল ফলায়। রিফিউজিদের এই চাষবাস উত্তরবঙ্গের পুরনো বাসিন্দারে তাগ লাগিয়ে দেয়, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে যেন।

অর্ধেক জীবন উত্তরবঙ্গের শেকড়হীন মানুষদের সান্নিধ্যে কাটানো কথাকার অলোক গোস্বামীর (১৯৬২) মাইগ্রেশন মনস্তত্ত্ব, দেশভাগ, উত্তরবঙ্গের ক্যাম্পজীবনের গ্লানি-বেদনার কথা দিয়ে নির্মান করেছেন ‘অদ্ভুত আধার’ (২০১৬)-এর আখ্যান। উপন্যাসের শিরোনামের মধ্যে দিয়ে তিনি যেন দিশেহারা সময়ের দেশহীন মানুষদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিয়তিকে ব্যঞ্জিত করেছেন। দেশভাগের যন্ত্রণার সেই আঁধার বাইরে থেকে নয়, স্পর্শ করতে হয় হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে। লেখকের মননশীল গদ্যে ‘অদ্ভুত আঁধার’-এর অখ্যান ধারণ করেছে দেশভাগের অভিঘাতে-প্রতিঘাতে উত্তরবঙ্গের বদলে যাওয়া সমাজ ও সংস্কৃতিকে। আমরা জানতে পারি দেশভাগ পূর্ববর্তী উত্তরবঙ্গ কিংবা দেশভাগ পরবর্তী উত্তরবঙ্গের সাধারণ ‘কলোনি’গুলির ধীরে ধীরে বানিজ্য নগরী হয়ে ওঠার ইতিহাসকে। সেখানকার মানুষদের দেশভাগের পরা-ইতিহাসের কথা— যে বিষয়গুলি সচরাচর প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকার বা নাগরিক লেখকরা এড়িয়ে চলেন। উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে দেশবিভাজনের সেই উত্তাল দিনগুলিতে কীভাবে দক্ষিণবঙ্গের মতো সীমান্তবর্তী উত্তরবঙ্গেও নেমে এসেছিল বাস্তুহারা উদ্‌বাস্তু মানুষের ঢল। কেমন করে তারা আশ্রয় নিয়েছিল উত্তরবঙ্গের শহরের বিভিন্ন প্রান্তে, রেল, বন এবং সরকারি দপ্তরের ফাঁকা জমিতে। ত্রাণদপ্তর এগিয়ে এসেছিল সরকারি মদতে, তৈরি হয়েছিল দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিপত্র। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা দেয় উত্তরবঙ্গের বুকে নতুন একটি সংকট — আদিবাসীরা হারাতে থাকে ভূমি সম্পদ। লেখকের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি সেই ফ্যালাসিকে ধরতে চেয়েছেন। হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্‌বাস্তু গ্রন্থের মতো এই উপন্যাসেও দেশহারানো মানুষেরা ফেলে আসা অতীত ঐতিহ্যের মোহে গড়ে তোলে সুভাষপল্লি, অরবিন্দ নগর, দেশবন্ধু, বিধান পল্লির মতো নতুন কলোনি। স্বদেশ হারানো মানুষেরা ক্যাম্প জীবনের এক চিলতে ঘরেও ফিরে পেতে চান নিজস্ব শিকড়, নিজেদের ভাষা ও পরিচয়। মোহিত ঘোষের কথায় ক্যাম্পজীবনের মানুষেরা পুনরায় স্বপ্নদেখে নিজের দেশে ফেরার। ক্যাম্পের নতুন নাম হয় — ‘হিন্দু সর্বহারা কলোনি’। বাস্তু ছেড়ে আসা মানুষগুলো এখনও বাতাসে নাক বাড়িয়ে খুঁজে পায় পুরোনো মাটির গন্ধ, রেডিয়োর কাঁটা ঘুরিয়ে আজও খোঁজে পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, দেশের মাটির স্বপ্নগুলিকে। কিন্তু তাঁদের হৃদয় খুঁড়ে বেরিয়ে আসে কেবল কান্না, একরাশ গভীর যন্ত্রণা ও হাহাকার।    

উত্তরবঙ্গের দেশভাগকেন্দ্রিক স্মৃতি ও সাহিত্য কয়েক দশকের ব্যবধানে দাঁড়িয়েও নির্মান করে চলেছে টুকরো টুকরো স্মৃতিকথা দিয়েই স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের অখ্যান। স্মৃতিকথারা এখনও উত্তরবঙ্গে পথচেয়ে বসে থাকে— অজানা গল্প শোনাবে বলে। তুলনায় খুব কম হলেও, দেশভাগেরই ফসল হিসেবে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আমরা পেয়েছি অধ্যাপক বরেন্দু মণ্ডলের ‘ছিটমহলের গল্প’, রাজর্ষি বিশ্বাসের ‘ছিটমহলের নতুন গল্প’ নামে দু-টি গুরুত্বপূর্ণ গল্প সংকলন। সিদ্ধার্থ দেবের ইংরেজি উপন্যাস ‘The point of Return’, অমিতাভ ঘোষের ‘The Glass palace’, ভীষ্ম সাহনির ‘তমস’–এর সঙ্গে তুলনীয় দেশভাগ-উপন্যাস উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়নি বটে, তবে ভবিষ্যতে পথিক হওয়ার লক্ষ্যেই হোক আমাদের পথহাঁটা।   

 তথ্যসূত্র :

১. ভট্টাচার্য, উৎপল (সম্পা.), ‘সাক্ষাৎ অমিয়ভূষণ’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত সংকলন, “কবিতীর্থ”, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ- নভেম্বর ২০১৬, পৃ. ৫৫

২. মজুমদার, অমিয়ভূষণ, ‘বিনদনি’ (অমিয়ভূষণ রচনাসমগ্র ৭ম খণ্ড), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা , প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৯, পৃ. ১৪০

৩. সিকদার, অশ্রুকুমার, ‘ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ- নভেম্বর ২০০৫, পৃ. ২৪

৪. দাস, বিপুল, ‘সরমার সন্ততি’, ভাষাবন্ধন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ- ২০১৩  

৫. মণিভূষণ রায়, ‘এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম জন্মান্তর’, মধুময় পাল (সম্পা.), “দেশভাগ বিনাশ ও বিনির্মান”, গাঙচিল, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১১, পৃ. ১১০

৬. দাস, বিপুল, ‘সরমার সন্ততি’, ভাষাবন্ধন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ- ২০১৩  

৭. পূর্বোক্ত

৮. পূর্বোক্ত

৯. পূর্বোক্ত

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান