ইতিহাস এগোচ্ছে…

১৪৩১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যার অভিক্ষেপ পত্রিকা তার বিষয় নির্বাচন করেছে– বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে নিম্নবর্গের প্রতিরোধ। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে তেভাগা আন্দোলন, তেতাল্লিশের মন্বন্তর পর্যন্ত কালসীমায় বিষয়ালোচনা পরিব্যাপ্ত। বিস্তৃত এই সময়কালে নিম্নবর্গীয় তথা কৃষক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত, সংগঠিত প্রতিরোধ, আন্দোলন বিদ্রোহকে ফিরে দেখার চেষ্টা হয়েছে মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, নিম্নবর্গীয় ইতিহাস চর্চার ধারা, উত্তর-ঔপনিবেশিক বিচারধারা– প্রভিন্ন, আন্তঃসংযুক্ত দৃষ্টিকোণের স্বাতন্ত্র্যে, সংশ্লেষণে; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষকের নিজের বোঝাবুঝি, এক কথায় তাঁদের আর্থ-রাজনীতিক অবস্থান। নিম্নবর্গের ইতিহাস কীভাবে পড়ব– আগামী পাঠক, গবেষক, সমাজতাত্ত্বিকদের সামনে কাঠামোগত আলোচনার পাশাপাশি তাত্ত্বিকতার ব্যূহ, বহেশ, সীমাবদ্ধতা এবং অতিরেক উঠে এসেছে আলোচনায়। নিম্নবর্গীয় দ্রোহের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির বিশ্লেষণের সমান্তরালে সামগ্রিক সংস্কৃতির ধারায়, অর্থাৎ সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি মাধ্যমে এই সংঘর্ষণ কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে? কতটা প্রতিনিধিত্বমূলক সেই পরিকাঠামো; শৈলী, ভাষা, ঘটনা-চরিত্র সংস্থাপনে নিম্নবর্গ আদৌ নিজেদের কথা বলে (গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ন্যায্যত প্রশ্ন তুলেছেন– ‘Can the Subaltern Speak?’– ইতিহাসে নিম্নবর্গের কণ্ঠস্বর অপরের নির্মাণ!)? ফলত লেখকের আপন বিদ্রোহী রোমান্টিসিজম, সাংগঠনিক নির্দেশ বা চেতনা বা বিপ্লবী নিয়তিবাদের হস্তক্ষেপ কতদূর অবারিত– বিবেচনায় এসেছে। সংস্কৃতির বিবিধ প্রকাশে ব্যক্তি ইচ্ছাপূরণ ও বস্তুসত্যের টানাপোড়েন-কে হাজির করার সময়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়েছেন প্রাবন্ধিকেরা। অবশ্য এক্ষেত্রে কেন্দ্রস্থিত ক্ষমতাশালী ইউরোপীয় সাহিত্য সমালোচনার ধারা, অভিধা, পরিভাষাকে বিদ্ধকারী বারবারা ক্রিস্টিয়ান-এর উত্থাপিত প্রশ্ন যথা কৃষ্ণাঙ্গ তথা তৃতীয় বিশ্ব ও উপনিবেশিত দেশের প্রতিবাদী সাহিত্যের পর্যালোচনায় এক বৈকল্পিক পরিসর প্রস্তুত করে। ক্রিস্টিয়ান বলছেন আধিপত্যহীন বিশ্বের, নিজস্ব সংগ্রামী চেতনার শিকড়ের কাছে পৌঁছোতে চাইছেন যাঁরা– ‘এঁদের কাছে সাহিত্য কিছুতেই কেবল সমালোচকের সামনে আলোচনা-সমালোচনার জন্য হাজির হওয়ার উপলক্ষ্য নয়, বরং নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর জন্য অতীব প্রয়োজনীয় সংগ্রাম-সহায়িকা। নিজেদের জীবনকে আরও ভালোভাবে বুঝে নেবার মোক্ষম কায়দা’ (‘The Race for Theory’, অনুবাদ: মোহাম্মদ আজম)। তাই দেরিদা, বার্থের কাছে লেখক গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেও গণ-প্রতিরোধের সংস্কৃতি রচয়িতার রাজনৈতিক, আর্থিক শ্রেণি অবস্থান অবশ্যই জানতে হবে। রচয়িতা-রচনা-পাঠকের পারস্পরিক সংলাপে নিপীড়িতের সাহিত্য সংস্কৃতি আপন সত্তার কাছে পৌঁছোতে পারে। কর্তৃত্বশীল ইউরোপের তত্ত্ববাজি সম্পর্কে ‘অপর’-ভুক্ত শাসিতের একজন বারবারা ক্রিস্টিয়ান সোচ্চারে বলেছেন— ‘কথিত মানবতাবাদীরা সাহিত্যকে একটা বিশুদ্ধ অনন্যনিরপেক্ষ অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য করে থাকেন এবং সাহিত্য যে আদতে ক্ষমতাবানদের উৎপাদন, মূল্যবোধ ও বণ্টন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা স্বীকার করেন না। অন্যভাবে বলা যায়, সাহিত্য– যে, প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনৈতিক– তা তারা শুনতে চান না।’ 

আধিপত্যশীল ইতিহাস রচনার ধারাতেও সমাজবিকাশের ধারায় অধস্তন, কপদর্কশূন্য, মানহীন মানুষদের ভূমিকা ব্রাত্য থেকেছে। অনুচ্চারিত সেই বিপুল মানুষের যূথবদ্ধ অভ্যুত্থানের ইতিহাস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন রণজিৎ গুহ ও তাঁর সহযোগী সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাসবিদ গবেষকেরা। ক্ষমতার প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে তাঁরা ‘আধিপত্য’ ও ‘অধীনতার’ বিপরীত যুগ্মপদের দ্বারা নিম্নবর্গত্বকে চিহ্নিত করলেন। গ্রামশির ‘সাবঅলটার্ন’ প্রত্যয়কে বিবেচনায় রেখে তাঁরা এলিটীয়, ক্ষেত্রবিশেষ মার্কসবাদী ইতিহাস রচনার বিপরীতে, ‘বিশুদ্ধ কৃষক-চৈতন্য’ বি-নির্মাণের প্রয়াসী হলেন। সদা অস্থির, চঞ্চল, ‘ক্ষমতা’-কে মূল নির্ধারণ করে ‘কর্তৃত্ব’, ‘প্রভুত্ব’, ‘প্রতাপ’-এর বিপ্রতীপে ‘অধীনতা’, ‘দাসত্ব’, ‘দলিত’– ক্ষমতা-প্রকীর্ণ বিভিন্ন দ্ব্যণুক সম্পর্কের ভিত্তিতে তাঁরা নিম্নবর্গীয় চেতনাকে বিশ্লেষণ করলেন। জাতীয়তাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত শাসকের বিরুদ্ধে অবাধ্যতার, প্রতিরোধের দলিল-দস্তাবেজ উলটো করে পড়া শুরু করলেন তাঁরা। ছড়ায়, গানে, গুজবে, লোককাহিনিতে নিম্নবর্গের আচার-আচরণ-মানসিকতার সন্ধান চলল। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামগ্রিক মানুষ ও তার সমাজকে সংযুক্ত, সর্বোপরি সংস্কার-লৌকিকতা-অলৌকিকতায় অর্গলবদ্ধ ধর্মচেতনাকে ভিত্তি করে এযাবৎকাল অপাঙ্‌ক্তেয় নিম্নবর্গীয় জনতার এক স্বতন্ত্র ইতিহাস রচিত হল। স্বতন্ত্র রূপে চিহ্নিত হল তারা আড়াআড়ি সমান্তরাল স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে, অনাপস মানসিকতায়, ভীরুতা-নিষ্ক্রিয়তা-সহকারিতার গণ্ডি অতিক্রম করে নিদারুণ সহিংসতার প্রতিরোধী ভূমিকায়। কিন্তু, ভারতবর্ষে তথা বাংলাদেশে সংগঠিত কৃষক তথা নিম্নবর্গের প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত মুক্তির দিশা অর্জন করতে পারেনি। দায়ী মূলত তাদের প্রাথমিক স্তরের চেতনা। আবেগোচ্ছ্বাস, সংস্কারাচ্ছন্নতা, ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি, বর্ণগত সামাজিক বিন্যাসের উচ্চাবচতায় সংস্কৃতায়নের প্রলোভন– প্রভৃতি বহুমাত্রিক বিচিত্র সমাবেশ অধীনস্থ মানুষের চেতনাকে উন্নতস্তরে উন্নীত করতে পারে না। এখানে, উন্নত স্তর বলতে বোঝানো হচ্ছে গ্রামশি কথিত ‘স্টেট’-কে নিজেদের চেতনায় তারা ধারণ করতে পারে না। রাজনৈতিক সমাজ ও পুরসমাজের যোগফল, অর্থাৎ একদিকে প্রভুত্বগ্রাসী দমনের প্রয়োগ ও অন্যদিকে জনগণের থেকে মতাদর্শিক সম্মতি আদায়ের আধিপত্যকামী কৌশলের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে যে রাষ্ট্র, নিজেদের প্রান্তিকতার, শাসিতের, পীড়নের মূলে তাকে চিনতে না পারার অক্ষমতার জন্য নিম্নবর্গীয় জনতা তার নিম্নবর্গত্ব অতিক্রম করতে পারে না। 

গ্রাম, মফস্‌সল, শহরের গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে রাষ্ট্র অনেকক্ষেত্রেই তার স্বরূপে ধরা পড়ে না। স্থানীয় ক্ষমতাসীনকেই দমন-দলনের প্রপীড়ক মনে করে দূরবর্তী রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রনেতাকে ‘দৈবীশক্তি’, ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতিভূ প্রজারঞ্জক রূপে মনে হয়। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে যেমন আমরা দেখি ব্রিটিশের নামে জয়ধ্বনি দিয়েই স্থানীয় ক্ষমতাকেন্দ্রে বিদ্রোহী জনতার অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন। পাঠক প্রসঙ্গান্তরে বর্তমান দিনে চলে আসতে চাইছি। ঔপনিবেশিক শাসনকালে উপনিবেশিত দেশের ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদ অপহৃত হবে এটাই আর্থনীতিক-রাজনীতিক লক্ষ্য, অভিসন্ধি ও দস্তুর– ঘটনায় ও পরিসংখ্যানে ইতিহাসসিদ্ধ এই লুটের কারবার। শোষণ, নির্যাতন, অবমাননার একান্ত অভিঘাতে ক্রুদ্ধ উপনিবেশিত জনতা সহসা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলনে, একমাত্রিক নয় বহুবিচিত্র উপাদানের সমাবেশে ক্ষমতার উপকেন্দ্রে আঘাত হেনেছে– ভারতের কৃষকবিদ্রোহ বারেবারে তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু, ২০২৪ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষের ৭৫ বছর পূর্তির অমৃতকাল উৎসব উদযাপনের সময়কালে ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব রিপোর্ট যখন বলে– ব্রিটিশ শাসনকালের চেয়ে আজকের ভারতে অসাম্য প্রকটতর– আলোকিত ইন্ডিয়ার এক শতাংশ ধনীর ধনী, তাদের হাতে একশো তিরিশ কোটি ভারতবাসীর জল-জমি- জঙ্গল-খনিজ সম্পদ সহ চল্লিশ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত; অথচ দেশের মোট বেকারের তিরাশি শতাংশ যুবশক্তি (যাদের পঁয়ষট্টি শতাংশ শিক্ষিত)– কৃষক ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত– স্থানান্তরিত শ্রমিক কর্মহারা– অত্যাশ্চর্য প্রযুক্তির দায়ভাগে কর্মচ্যুত মেধাজীবীর দল;– তখন ক্ষমতাহীন বিত্তহীন কোনো মতে দিন-গুজরান-করা মানুষ নিশ্চুপ, নীরব থাকেন কী করে? জীবন-জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা কি তাদের শুধুমাত্র জনবাদী অথবা কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার অনুগ্রহপ্রার্থী করেছে? তারা আর গণতন্ত্রের নাগরিক অংশগ্রহণকারী না হয়ে শুধুই গ্রহীতার পরিচয়ে ওপরওয়ালার দাক্ষিণ্যের প্রার্থনা করে? তারা কি নাগরিক থেকে ‘প্রজায়’ অবমানিত হয়েছে? নিরুপায় অসহায়তা তাদের বাধ্য করছে কর্তৃত্বশীল একনায়কতান্ত্রিক জনবাদী শাসকের রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে? ধর্ম-জিরাফ এক হয়ে যায়, দুর্নীতি চাড়িয়ে যায় সমাজমানসের গভীরে, তবু জনমোহিনী শাসকের প্রতি আনুগত্যে ফাটল ধরে না। রাজনৈতিক সমাজের, অর্থাৎ প্রশাসন, পুলিশ, কয়েদখানা প্রভৃতির সহায়তায় দমিত হয় বিরোধী স্বর; অন্যদিকে সুশীল সমাজ, যেমন– পরান্নভোজী নিমকখাওয়া বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক, ধর্মগুরু, সোশ্যাল মিডিয়ার ফিলগুড গুরুর দল জনমোহিনী শাসকের ‘অবতার’ মূর্তি রচনা করে কেন্দ্রীকরণের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতি সমর্থনের ভিত রচনা করে। জনবাদী শাসককে তাই দেবত্ব শক্তির প্রতিরূপ মনে হয়; অথবা সাক্ষাৎ ক্ষণজন্মা লৌহমানব। স্থানীয় টাউট নেতৃবর্গের প্রতি ঘৃণা, বিবমিষা উদ্গত হলেও কেন্দ্রীয় শাসক দেবতার মহত্ত্বে, তাঁর ঘোষিত মানবকল্যাণের পূত-প্রচেষ্টায় সন্দেহ জাগ্রত হয় না। ধান্ধার ধনতন্ত্রে সহায়-সম্বলহীন গরিব অভাবী মুমূর্ষু মানুষ কোনোক্রমে বাঁচার নিশ্চিতিতে জৈব-আকাঙ্খার রাজনীতিতে নিজেকে যোজিত করে নেয়। সরকারি প্রকল্প ভোক্তা– শুধুই কী তার একমাত্র পরিচয়?

নিম্নবর্গীয় ইতিহাস চর্চার তাত্ত্বিকরা ক্ষমতার প্রশ্নে ‘প্রভুত্ব’ ও ‘অধীনতার’ বাইনারি-কে সামনে রেখে নিম্নবর্গের চেতনার স্বরূপ অনুধাবন করতে চেয়েছেন। অধীনতার চৈতন্য-কে পুনরায় ‘সহকারিতা’ ও ‘প্রতিরোধের’ দ্ব্যণুক বৈপরীত্যে বিশ্লেষণ করেছেন। আজকের সময়ে কোথাও কি কোনো প্রতিরোধের ‘কান্তিময় আলো’ নেই? নায়কোচিত, ইতিবাচক ভূমিকা নেই অন্তেবাসী জনগণের? 

আছে। 

স্পিভাক কথিত ‘ছায়াতলবাসিনী’ প্রান্তিকের প্রান্তিক মুসলিম নারী সমাজ বেরিয়ে এলেন রাজধানীর উপকণ্ঠে শাহিনবাগের রাজপথে। সংশোধিত নাগরিক আইন ধর্মের অছিলায় তাঁদের রাষ্ট্রহীন করার পরিকল্পনা ছকেছে? অথচ, এ দেশ তাঁদেরও নানার আব্বার। প্রবল শৈত্যে ‘আজাদির’ স্লোগানে উত্তাপ ছড়াল শাহিনবাগ। দেশকে আপন করে আঁকড়ে ধরার এই ঐকান্তিক বার্তা অনুরণিত হল জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল জনগণের হৃদয়ে। রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনসমাবেশ নাগরিক অধিকার তথা স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ আহ্বান জানাল। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের নেতৃত্বে হিজাব পরা ও জিন্স পরিহিত তরুণী, অশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মুসলিম নারীরা। অশীতিপির, নবতিপর বৃদ্ধারা রাত জাগছেন, তাঁদের অসীম জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করে দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মে। ঘোলাটে, পিচুটি পড়া চোখ সহসা তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে; আসমা বিবি, বিলকিস বেগম দাদি-আম্মার স্নেহাঞ্চলের ওম বিছিয়ে দিয়েছেন শাহিনবাগে। ধর্মের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে…। সমবেত হচ্ছে কতশত হিন্দু-শিখ-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ কলেজ ফেরত, অফিস ফেরতা, রুটি-রুজির সন্ধানে ঘুরে ফেরা দিনগত ক্লান্তি সঙ্গে করে বহুধা ভারতবর্ষ। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিরোধের নতুন ভাষা, ধরন জন্ম নিল। 

২০২০-র নভেম্বর মাস, আওয়াজ উঠল দিল্লি চলো। রাজধানীর উপান্তে সমবেত হতে শুরু করলেন কৃষকেরা। দীর্ঘ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে কিষান জনতা শিবির গড়ে তুললেন দিল্লির সীমান্তে। জমায়েত গর্জন করল– কেন্দ্রীয় সরকার আনীত তিন কৃষি আইন তাঁরা মানছেন না। কেননা, এই আইন কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট রাজের প্রতিষ্ঠা করবে। কৃষকের ফসল ফলানোর স্বাধীনতায় বহুজাতিক পুঁজির হস্তক্ষেপ দৃঢ়ীকৃত করবে। মজুতদারিকে উৎসাহিত করে গণবণ্টন ব্যবস্থা ধ্বংস করবে। বলাইবাহুল্য, সরকারের যুক্তি ছিল উলটো পথে– এই আইন প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের আত্মনির্ভর করে ক্রেতা নির্বাচনের সুযোগ সম্প্রসারিত করবে। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়ে দালালরাজ নির্মূল করবে। কিন্তু, কৃষক সংগঠন সমূহ তাদের সিদ্ধান্তে অনড়– কালা কানুন প্রত্যাহার করতে হবে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। বিপরীতে সরকার তার অবস্থানে অটল। মুখোমুখি দুই প্রতিপক্ষ– শক্তিধর রাষ্ট্র ও লাঙলকর কৃষক। 

কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সংযোজিত হল ২০২০-র শীতে দিল্লির সিঙ্ঘু সীমান্তে। সমবেত হতে শুরু করলেন হাজার হাজার কৃষক। সিপাহি সান্ত্রির ব্যারিকেড, জলকামান, হাড়কাঁপানো হিমাঙ্কের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সরকারি কালা কানুনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন কৃষক। তরুণের হুংকার রণিত হল: ‘ইয়ে ইনকিলাব হ্যায়’। লাঠি, টিয়ার গ্যাসে; ‘মাওবাদী’ ‘খলিস্তানি জঙ্গি’ তকমায় আক্রমণ ধেয়ে এলে সিঙ্ঘু কুণ্ডরি টিকলি ধাসা গাজিপুর সীমান্ত মুখরিত হল চাচা অজিত সিংহের আহ্বানে– ‘পাগড়ি সামাল জাঠ্’। লাখে লাখে কৃষক চলে এসেছেন, সংহতি জানাচ্ছেন– হেই সামালো ধান হো … কাস্তেটায় দাও শান হো…। ঋণচক্র, খরা, শোষণে আত্মনাশের ভবিতব্যের বিরুদ্ধে অন্নদাতাদের নাসিক থেকে দিল্লি লং মার্চ দেখেছে দেশ ইতিপূর্বে। এবারের লড়াই আরও জোরদার। ধনপতি পালদের উদগ্র লালসা থেকে জমি রক্ষার লড়াই। ফসলের দামের লড়াই। ফসল ফলানোর স্বাধীনতার লড়াই। লড়াই শস্যের গণবণ্টনের। প্রাণ যায় যাক। গলন সিং তোমর, ভীম সিংহ, জগবীর সিং, শামশের, যশনদীপদের আত্মবলিদানের অনুপ্রাণনায় আগুন বুকে রাত জেগেছেন কিষান কিষানি। শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতাপান্বিত সরকার কৃষক বিরোধী তিন আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। জয়ী হয়েছে কৃষক প্রতিরোধ।     

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সুন্দরবন দ্বীপাঞ্চলে শয়ে-শয়ে দলিত আদিবাসী রমণী তর্জনী উঁচিয়ে চোখে চোখ রেখে শাসাচ্ছেন, হুংকার ছাড়ছেন– ‘শাঁখা নিন, শাড়ি নিন, পরে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকুন। শাঁখা, চুরি পরে আপনারা বসে থাকুন।’ জমিহারা নিঃস্ব নিরন্নের ঘুরে দাঁড়ানো বজ্রনির্ঘোষের প্রতিপক্ষে পুলিশ-প্রশাসন ভীরু, অসহায়, নিষ্ক্রিয় দর্শক। 

ছায়াতলবাসী নিম্নবর্গ গর্জে ওঠে এখনও। প্রতিস্পর্ধিত রাজনীতির সূচনা করে। প্রয়োজন নির্দ্বিধায় স্বীকার করা– জনগণ ‘ইতিহাসের উপাদান’ নয়, ইতিহাসের প্রকৃত নির্মাতা। ‘বিষয়’ থেকে ‘বিষয়ীর’ ভূমিকায় তাঁদের মর্যাদাকে স্বীকার করা। সংস্কৃতিমান মানুষ রূপে তাঁদের বহুবিচিত্র অনন্যতার অন্বেষণ করা– রাজনীতিক, আর্থনীতিক, সামাজিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নয়। গ্রামশি প্রান্তিকতা থেকে আধিপত্যকামী শক্তিতে নিম্নবর্গের রূপান্তরের প্রশ্নে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা নির্ভরতা-বিশ্বাস, চলিষ্ণু সংগ্রামের প্রতীক রূপে ‘আধুনিক নৃপতি’ তথা মার্কসবাদী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। তবে, প্রভুত্বের রকমফেরে সাবধান থাকতে হবে সর্বদা। আর স্বীকার করতেই হবে– ইতিহাস এগোচ্ছে…। 

অপরাপর বর্গবাসী যখন শম্বুকখোলসে স্বেচ্ছানির্বাসন অথবা নিরাপদ দূরত্বে হিসাবনিকাশে নিরত; কিংবা গুটিয়ে যাওয়া ভীত-সন্ত্রস্ত; তখন ক্ষমতার মদমত্ততা যেখানে প্রতিরোধের বার্তায় নিম্নবর্গ সেখানে। অধস্তন, অবনমিত, কপদর্শকশূন্য, প্রান্তিক মানুষের বিদ্রোহী সত্তার কাছে পৌঁছোতেই অভিক্ষেপ প্রকাশ করল– বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে নিম্নবর্গের প্রতিরোধ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান