নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা : বিশিষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

চলমান সবকিছুর মতো ইতিহাসেরও একটা গতি আছে, রয়েছে বিধি। ইতিহাসের এই গতিবিধি মানুষই নিয়ন্ত্রণ করে, আর এর যে বিবরণ সেও ব্যক্তি মানুষেরই লেখা। বিবরণের লেখক যাঁরা, তাঁরা থাকেন নিজ নিজ স্থানে, কালে ও শ্রেণিতে, সে জন্য যা লিখিত হয় তা এক রকমের হয় না, বিবরণকে ভিন্ন ভিন্ন হতেই হয়। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের কালে ভারতে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল তার লিপিবদ্ধ ইতিহাসেও স্বাভাবিক বিভিন্নতা রয়েছে, ইতিহাস লেখকদের অবস্থানের কারণে। ওই ইতিহাসকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদরা একভাবে দেখেছেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে। সেটাই স্বাভাবিক। ইতিহাসের গতিবিধি দেখার ওই দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য যে থাকবে এটা প্রত্যাশিত, কিন্তু তাদের মধ্যে আবার মিলও রয়েছে। মিলটা এইখানে যে, উভয় দলের ঐতিহাসিকেরাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকে দেখেছেন নিজেদের উচ্চবর্গের অবস্থান থেকে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদেরা প্রায় সবাই ব্রিটিশ, তাঁরা মনে করেন যে ব্রিটিশ শাসনের কালে এই উপমহাদেশে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে তার মূল অনুপ্রেরণাটা এসেছে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকেই। ব্রিটিশের শাসনকালে এখানে যেসব সুযোগসুবিধা ও সম্পদ তৈরি হয়েছে তার ভাগ পাবার জন্য স্থানীয় উচ্চবর্গের মানুষেরা ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে এবং ওই মানুষেরাই আবার ভাগবাঁটোয়ারার প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে ভীষণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এই ইতিহাসবিদদের মতে উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস মোটামুটি ওই সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতারই ইতিহাস। জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষীয় ইতিহাসবিদেরা কিন্তু বলেছেন একেবারেই ভিন্ন কথা। তাঁদের মতে আন্দোলন হয়েছে স্বাধীনতার জন্য, সেই আন্দোলনে মানুষ পরিচালিত হয়েছে নিঃস্বার্থ আদর্শবাদিতার অনুপ্রেরণায়, এবং আত্মত্যাগ করেছে অকুণ্ঠচিত্তে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর ঐক্য থাকার কথা নয়, ঐক্য প্রতিষ্ঠা ঘটেওনি। কিন্তু দুইয়ের ভেতর ঐক্য যে একেবারেই নেই তাও নয়। আছে। এবং সেটা এখানে যে উভয় পক্ষই উচ্চবর্গীয়, এঁদের হাতে রচিত ইতিহাস বইতে তাই উচ্চবর্গের মানুষদের কথাই থাকে। অথচ দেশে নিম্নবর্গের মানুষ তো ছিল, সংখ্যায় তারাই বেশি, শতকরা পঁচানব্বই ভাগই তারা; স্বাধীনতার জন্য তারাও সংগ্রাম করেছে; কিন্তু তাদের কথা উচ্চবর্গীয় কোনো পক্ষই সঠিক ভাবে তুলে ধরেনি। ফলে উচ্চবর্গীয় ইতিহাসের নীচে নিম্নবর্গীয় ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে।

নিম্নবর্গের (সাবঅলটার্ন) ইতিহাসবিদেরা এই ব্যবস্থাটাকে মেনে নিতে প্রস্তুত নন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে নিম্নবর্গের মানুষের যে অংশগ্রহণ তার ইতিহাস উদ্ধারের ব্যাপারে তাঁরা সংকল্পবদ্ধ। তাঁদের মতে এই অংশগ্রহণের ঘটনা ও তার তাৎপর্যকে সঠিকভাবে তুলে না ধরলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবেই, সে-আন্দোলনের চরিত্রকেও সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।  অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই তাঁরা বিবেচনা করেন যে, ঔপনিবেশিক ইতিহাস মোটেই গণতান্ত্রিক হবে না যদি তাতে নিম্নবর্গের মানুষদের অংশগ্রহণের বহুবিধ ঘটনাকে জায়গা করে না দেওয়া হয়।

পরাধীনতার কালে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষ অসংখ্য অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সব নিম্নবর্গের মানুষ এক রকমের নয়, তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে, বৈচিত্র্য রয়েছে, সকল অভ্যুত্থান যে এক রকমের ছিল তা নয়, আকারে ও প্রকৃতিতে ভিন্নতা ছিল। কিন্তু আবার মিলও ছিল তাদের মধ্যে। কেননা অভ্যুত্থানগুলোর কোনোটিই অরাজনৈতিক ছিল না, যদিও সেভাবে তাদেরকে চিত্রিত করবার চেষ্টা হয়েছে। হ্যাঁ, স্বতঃস্ফূর্ত ছিল অবশ্যই, কিন্তু ভেতরে নির্দিষ্ট চেতনাও ছিল, এবং দেশের নানা জায়গায় ঘটা অভ্যুত্থানগুলোর ভেতর ঐক্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার। এই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা সফল হয়নি, কিন্তু তাই বলে এতে আপোষকামিতা যে দেখা গেছে তাও নয়। উচ্চবর্গের মানুষেরা সহজ মীমাংসায় সম্মত হয়, নিম্নবর্গের মানুষেরা শেষ দেখে ছাড়তে চায়।

‘নীচ থেকে লেখা ইতিহাস’ বলে ইতিহাস রচনার একটি ধারা আছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখকেরা এই ধারার অন্তর্গত নন। উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের সম্পর্কটিকে এঁরা ভিন্নভাবে দেখেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের মতে উপনিবেশের কালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ওপর এবং নীচ ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; নিম্নবর্গ উচ্চবর্গের দ্বারা পরিচালিত হয়নি, নিম্নবর্গের মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস তৈরি করে নিয়েছে। ওপর-নীচে সম্পর্ক একটা অবশ্যই থাকে, কিন্তু অভ্যুত্থানকারী নিম্নবর্গ কাজ করে অনেকটা স্বাধীন ভাবে, তাদের কাজের এলাকাটা পৃথক, কাজের ধরনও আলাদা। এই ইতিহাসবিদদের মতে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের ওপর কর্তৃত্ব করেছে ঠিকই, কিন্তু আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, উচ্চবর্গের পক্ষে নিম্নবর্গের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করা (হেজিমনি প্রতিষ্ঠা) সম্ভব হয়নি; উচ্চবর্গের কর্তৃত্বটা ছিল নিম্নবর্গের দিক থেকে বশ্যতাহীন (ইংরেজিতে, উইদাউট হেজিমনি)। সংখ্যায় নিম্নবর্গের মানুষ উচ্চবর্গের তুলনায় বহুগুণ বেশি; কিন্তু ক্ষমতা রয়ে গেছে উচ্চবর্গের হাতে, যেজন্য নিম্নবর্গ প্রান্তবর্তী।

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিম্নবর্গকে নীচ থেকে দেখেন না, ওপর থেকে দেখার প্রশ্ন তো ওঠেই না; দেখতে চান ভেতর থেকে। তাঁরা খুঁজতে ও বুঝতে চান নিম্নবর্গের মানুষের চেতনার জগৎটাকে। জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে নয়, পাঠের মধ্য দিয়ে। ওই চেতনাই হচ্ছে নিয়ামক, তাঁরা মনে করেন। নিম্নবর্গের ওই চৈতন্যকে ইতিহাসের ভেতরে নিয়ে আসা দরকার, নইলে ইতিহাস না হবে পরিপূর্ণ, না গণতান্ত্রিক। নিম্নবর্গের চেতনা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক; সেখানে স্বর বিভিন্ন। সেইসব মাত্রা ও স্বরকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, তবে তাদের খুঁজে বের করা নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অঙ্গীকার। তাঁরা চান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উচ্চবর্গীয় ও একপেশে, এবং সেই কারণে অনৈতিহাসিক, ইতিহাসবিদ্যাকে স্থানচ্যুত করতে। তা সে ইতিহাস ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাতে লেখা হোক, কিংবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের হাতে। ভিন্নধারার এই ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি কোনো এক জায়গায় আবদ্ধ থাকবে না, এঁদের ইতিহাসপাঠে রাজনীতি আসবে, থাকবে অর্থনীতি, কিন্তু জোরটা পড়বে গিয়ে সংস্কৃতির ওপর।

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে একটা রেখাবয়ব আমরা পেতে পারি এঁদের কাজের শুরুতে-প্রকাশিত একটি বক্তব্য থেকে, যেটিকে একটি ঘোষণাপত্রও বলা চলে। ১৯৮১ সালে এঁদের নিয়মিত-প্রকাশিতব্য রচনাসঙ্কলন ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজে’র প্রথম খন্ড প্রকাশের সময়ে এটি লেখা হয়েছিল। লিখেছেন গোষ্ঠীর প্রধান তাত্ত্বিক ও সংগঠক খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। ‘ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসবিদ্যার কয়েকটি দিক’ (‘অন সাম আসপেক্টস অব দি হিস্টরিওগ্রাফি অব কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’) নামের এই প্রবন্ধটিতে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম এই রকমের।

দীর্ঘকাল ধরেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসপাঠ উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। এই উচ্চবর্গীয়তা দুই রকমের, একটি উপনিবেশিক, অপরটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী। উভয়েরই উদ্ভব ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আদর্শিক পরিমন্ডল থেকে। ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও এই উচ্চবর্গীয়তা বহাল রয়েছে। ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গীয় ইতিহাসবিদেরা মূলতঃ ব্রিটিশ; কিন্তু ভারতে এবং অন্যত্র যে তাদের অনুসরণকারীরা নেই তা নয়। অপরদিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদেরা প্রায় সবাই ভারতীয়। ইতিহাসের উভয় পাঠই মনে করে যে, ভারতীয় জাতির সৃষ্টি এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশ উচ্চবর্গীয়দের দ্বারাই ঘটেছে।

স্পষ্টতই এই অনৈতিহাসিক ইতিহাসপাঠে যা জায়গা পায় না তা হল জনগণের রাজনীতি। জনগণের এই রাজনীতির অবস্থান উচ্চবর্গীয় রাজনীতির বাইরে এবং সমান্তরালে। রাজনীতির এ একটা স্বতন্ত্র এলাকা। নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীতে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষেরা, রয়েছে শহর ও গ্রামের মধ্যস্তরের লোকেরাও। সংখ্যার দিক থেকে উচ্চবর্গ ক্ষুদ্র, নিম্নবর্গ বিপুল। আসলে উচ্চবর্গের বাইরের যে বিরাট জনগোষ্ঠী তারা সবাই নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত। এই জনগোষ্ঠী উচ্চবর্গ থেকে উদ্ভূত নয়, এবং উচ্চবর্গের ওপর যে নির্ভরশীল তাও নয়। নিম্নবর্গের মানুষেরা প্রথাগত (ট্র্যাডিশনাল) কেবল এই অর্থে যে, প্রাক-উপনিবেশ কাল পর্যন্ত তাদের শিকড় প্রোথিত, কিন্তু তাই বলে তারা যে সাবেকি তা কিন্তু মোটেই নয়। স্থানীয় আধুনিক রাজনীতির মতোই এদের রাজনীতিও আধুনিক, তফাৎটা এখানেই যে সময় ও গঠনের দিক থেকে এই রাজনীতি গভীরতর। উচ্চবর্গের রাজনৈতিক কাজে থাকে সতর্কতা ও নিয়ন্ত্রণ, নিম্নবর্গীয়দের কাজ স্বতঃস্ফূর্ত। ঔপনিবেশিক আমলে জনগণের জমায়েত প্রায়ই কৃষক অভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছে। এমনকি শহরে শ্রমজীবী ও পেটি বুর্জোয়াদের যে জমায়েত ঘটেছে তাদেরকেও দেখা গেছে কৃষক অভ্যুত্থানের রূপ নিতে।

নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ক্ষেত্রটিতে সামাজিক বিন্যাসের কারণে মতাদর্শিক বিভিন্নতা দেখা যায়; কিন্তু উচ্চবর্গের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ওই রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ। এরকমটা না হয়ে উপায় নেই, কেননা নিম্নবর্গের মানুষেরা তাদের নিজেদের অবস্থানটাকে জানে। সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্ররোচনায় কোথাও কোথাও হয়তো আড়াআড়ি ঐক্যটা ভেঙ্গে যায়, এবং বিভেদ দেখা দেয়; তবে সেটা নিয়ম নয়, বিচ্যুতি বটে। এই রাজনীতির আরেকটি নিজস্বতা বেরিয়ে এসেছে এই সত্য থেকে যে, নিম্নবর্গের লোকেরা তারা যে শোষিত সে-বিষয়ে অবহিত।

এই যে নিম্ন ও উচ্চ এই দুই বর্গের রাজনীতির সহঅবস্থান এটা একটি জরুরী ঐতিহাসিক সত্যকে স্পষ্ট করে তোলে। সত্যটি হল এই যে, ভারতীয় বুর্জোয়ারা কখনোই সমগ্র জাতির মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারেনি। সাধারণ মানুষের জীবন ও চেতনায় বড়ো বড়ো এলাকা পড়ে রয়েছে, বুর্জোয়ারা যেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ঔপনিবেশিক ভারতীয় ইতিহাসের এই দ্বৈত ধারাকে অস্বীকার করা হবে ভ্রমাত্মক। তার মানে অবশ্য এটা নয় যে, দুই বর্গের মধ্যে একেবারেই যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ আছে। সময় সময় সীমান্তের লঙ্ঘন ঘটেছে, বিশেষ করে এই কারণে যে, বুর্জোয়াদের অগ্রসর অংশ দুই বর্গকে একত্র করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ যখন পরিষ্কার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তখন চমৎকার ফল পাওয়া গেছে। আর ওই লক্ষ্যের যখন অভাব ঘটেছে, কিংবা লক্ষ্য যখন হারিয়ে গেছে, তখন ঐক্যের জায়গায় দেখা গেছে পিছু হটা এবং কুৎসিত গোষ্ঠীসংঘর্ষ। মোটকথা, উচ্চবর্গ যখন সাধারণ মানুষকে উচ্চবর্গের উদ্দেশ্যসিদ্ধির লক্ষ্যে নিযুক্ত করেছে নিম্নবর্গ তখন উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে বের হয়ে গেছে এবং উচ্চবর্গের হাতে-তৈরি আন্দোলনের ওপর নিজেদের রাজনীতির চিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছে।

অন্যদিকে মেহনতি মানুষের নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্যোগগুলোও এতটা শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে তারা জাতীয় মুক্তির পূর্ণ সংগ্রামে পরিণত করবে। ফলে জাতি হিসাবে পূর্ণতা অর্জনের ব্যাপারে ভারতীয়দের একটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা ঘটে গেছে। এর কারণ হল সামাজিক বাস্তবতার দরুণ মেহনতি মানুষ শ্রেণি হিসাবে, এবং শ্রেণিচেতনার দিক থেকেও, প্রাপ্তবয়স্কতা পায়নি; কৃষকদের সাথে তার ঐক্যও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই বুর্জোয়ারা যে কাজে ব্যর্থ হয়েছে মেহনতি মানুষ যে সেই কাজটা করে ফেলবে অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সফল বিজয় অর্জন করবে এবং একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবে তা সম্ভবপর হয়নি। ওই গণতান্ত্রিক বিপ্লব বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে সম্পন্ন হতে পারত, কিংবা ঘটতে পারত মেহনতি মানুষ ও কৃষকদের নেতৃত্বে। ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসপাঠের কেন্দ্রীয় বিবেচনা হওয়া উচিৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্পাদনে এই ব্যর্থতাটি। এক্ষেত্রে অনুসন্ধান প্রয়োজন। অনুসন্ধান বহু ধরনেরই হতে পারে, কোনোটা টিকবে, কোনোটা টিকবে না। কিন্তু আমরা একটি বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত। সেটা এই যে, উচ্চবর্গের ভুয়া ও অনৈতিহাসিক ইতিহাসপাঠের মোকাবিলা করার জন্য একটি বিকল্প প্রতর্ক (ডিসকোর্স) তৈরি করা আবশ্যক, যাতে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের রাজনীতির ভিন্ন দুই ধারার সহঅবস্থান এবং পারস্পরিক আদানপ্রদানের স্বীকৃতি থাকবে। ওপরের উদ্ধৃতিটির শেষে যে ‘আমাদের’ কথা বলা হয়েছে তাঁরাই হচ্ছেন নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ।

দুই

এঁদের মূল কথাটা হল এই যে, ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের ঊর্ধ্বগামিতাকে প্রতিহত করে ইতিহাসকে এঁরা নিয়ে আসবেন মূল ভূমিতে। এখন কাজটা হবে পাল্টা ইতিহাস লেখা যাতে জনমানুষের ভূমিকা স্পষ্টরূপে আলোচিত ও নির্ধারিত হয়। কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাসের উপাদানগুলো কোথায় পাওয়া যাবে? নিম্নবর্গের মানুষেরা নিজেরা লিখতে অভ্যস্ত নয়, তাদের অনেকেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। কাজেই কাজটা করতে হবে উচ্চবর্গে অবস্থিত কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনায় অঙ্গীকারাবদ্ধ ইতিহাসবিদদেরকেই। তাঁরা সে কাজ করতে আগ্রহী বটে। কিন্তু উপাদান কোথায় পাবেন? একটা উৎস হচ্ছে শত্রুপক্ষের লেখা কাগজপত্র। নিম্নবর্গের মানুষ যখন ব্রিটিশ-বিরোধী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, ঔপনিবেশিক শাসকগোত্রের প্রতিনিধিরা তখন সেই অভ্যুত্থান সম্পর্কে যেসব রিপোর্ট লিখেছে তা উল্টো করে পড়লে চমৎকার ফল পাওয়া যাবে, জানা যাবে অভ্যুত্থানকারীদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার বিষয়ে। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা, বিশেষ করে তাঁদের প্রধান রণজিৎ গুহ, এই কাজটি চমৎকার ভাবে করেছেন। ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যাবে মৌখিক বয়ানে, গানে, ছড়ায়, গল্পে, গুজবে, লোককাহিনিতে, নিম্নবর্গের মানুষদের সাংস্কৃতিক আচরণে, অভ্যাসে। এসব উপাদান সংগ্রহ করা সহজ নয়, এদের পাঠোদ্ধার করা এবং সঠিক পাঠ নির্ণয়, সবই কঠিন। কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা ওই কাজটা করেছেন দায়বদ্ধ মানুষের নিষ্ঠার সঙ্গে। এঁদের কাছে ইতিহাসচর্চা হচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আসলে এঁরা নৃবৈজ্ঞানিক ইতিহাসের নয়, রাজনৈতিক ইতিহাসেরই অনুসন্ধিৎসু পাঠক।

নিম্নবর্গের ইতিহাস কোনোমতেই তথাকথিত স্থানীয় ইতিহাসও নয়। স্থানীয় ইতিহাস সকল শ্রেণির কাহিনি বলে, নিম্নবর্গের ইতিহাস বলে জনমানুষের কথা, খোঁজ করে বিত্তবানদের বিরুদ্ধে জনমানুষের বিদ্রোহের ঘটনার। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অর্জনটা মোটেই সামান্য নয়। এই অর্জন যেমন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে, তেমনি রয়েছে ইতিহাসপাঠ সম্পর্কে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন অবশ্যই এই নতুন ঘরানার প্রবর্তক রণজিৎ গুহের নিজের। তিনি যে প্রচুর পরিমাণে লিখেছেন তা নয়, কিন্তু যা-ই লিখেছেন তাতেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বক্তব্য থেকেছে এবং ইতিহাসবিদ তো বটেই সাধারণ পাঠকদেরকেও তা প্রভাবিত করেছে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’-এর ওপর লেখা তাঁর প্রবন্ধ ‘নীল দর্পণ : দি ইমেজ অব এ পেজেন্ট রিভোল্ট ইন এ লিবারেল মিরর’, প্রথমে প্রকাশিত হয় ১৯৭২-এ, পরে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে ১৯৭৪ সালে; এবং যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। প্রবন্ধটিতে রণজিৎ গুহ চমৎকার ভাবে দেখিয়েছেন উদারনীতিকদের দৃষ্টিতে কৃষক বিদ্রোহ কি রূপ নেয়, কেমনভাবে তা ব্রিটিশের প্রবর্তিত আইন, আদালত, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদিকে ভরসার স্থল বলে গণ্য করে, এবং শাসক ইংরেজকে আলাদা করে দেখে ব্যবসায়ী ইংরেজ থেকে। এই প্রবন্ধে তাঁর উপস্থাপনা অত্যন্ত যথার্থ। রণজিৎ গুহের ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘এলিমেন্ট্রি আসপেকটস অব পেজেন্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ নিম্নবর্গের ইতিহাসপাঠের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি ১৭৮৩ থেকে শুরু করে ১৯০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১৭ বছরে ভারতে উপনিবেশবাদ-বিরোধী যে অসংখ্য কৃষক অভ্যুত্থান ঘটেছে তাদের প্রকৃতি ও চরিত্র উদঘাটনে সচেষ্ট হয়েছেন। কৃষক অভ্যুত্থানের পেছনে সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের আকাঙ্খা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু কৃষকের বিদ্রোহ সামাজিক ঘটনা ছিল না, ছিল তা রাজনৈতিক ব্যাপার। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কৃষক তার নিম্নবর্গীয় অবস্থান টের পেয়েছে এবং সেই অবস্থায় পরিবর্তন আনবার জন্যই সংগ্রামে নেমেছে। ঔপনিবেশিক ভারতের কৃষক বিদ্রোহের এ ধরনের যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এর আগে কেউ করেননি।

রণজিৎ গুহের তিনটি রচনা একত্র করে ‘ডমিনেন্স উদআউট হেজিমনি : হিস্ট্রি এ্যান্ড পাওয়ার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ (১৯৯৮) নামে প্রকাশিত হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এতে তথ্য আছে প্রচুর, এবং মূল তত্ত্বটিও রয়েছে অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এবং খুবই যুক্তিগ্রাহ্য রূপে। তত্ত্বটি হল এই যে, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বণিক ও শাসকেরা একটি শক্তিশালী উপনিবেশ গড়েছিল ঠিকই, এবং তারা কর্তৃত্বও (ডমিন্যান্স) প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু আধিপত্য (হেজিমনি) কায়েম করতে সক্ষম হয় নি। জনগণের কাছ থেকে তারা যে সম্মতি আদায় করবে তা পারেনি, আর ওই সম্মতি না পেলে ‘হেজিমনি’ কায়েম করা যায় না। যে-কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে শাসন করে দুই ভাবে, একটি হচ্ছে কর্তৃত্ব করা; কর্তৃত্ব করবার জন্য তার আইন-আদালত, বলপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনী রয়েছে, তাদের সাহায্যে রাষ্ট্রশক্তি জনগণকে জোর করে বাধ্যবাধকতার মধ্যে রাখে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সম্মতি আদায়। বলপ্রয়োগের পাশাপাশি চালু থাকে জনগণের সম্মতি আদায় করার চেষ্টা। আর সেটি করা হয় নানাবিধ প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সম্পর্ক, চিন্তাধারা ইত্যাদির সাহায্যে। একটির ভিত্তি ভয়, অপরটির ভিত্তি জয়। ব্রিটিশের রাষ্ট্র ভারতবর্ষে তার জোর দেখিয়েছে ঠিকই, জোরের সাহায্যে কর্তৃত্ব করেছে, শাসন করেছে, টিকে থেকেছে, কিন্তু জনগণের কাছ থেকে সম্মতি অর্থাৎ বশ্যতা আদায় করতে পারেনি। সেখানে সে ব্যর্থ। আর সম্মতি যে আদায় করতে পারেনি সেই সত্যেরই প্রমাণ মেলে কৃষক বিদ্রোহের অজস্র ঘটনার মধ্যে। গ্রন্থের প্রবন্ধ তিনটির একটিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানাদিক নিয়ে আলোচনা আছে; আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ‘গান্ধিবাদী শৃঙ্খলা’। গান্ধির রাজনীতিতে একাধিক স্ববিরোধিতা ছিল; তার মধ্যে একটি হল জনতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসে গান্ধি ব্যাপক জনসংযোগে মনোযোগ দেন। জনসংযোগের প্রক্রিয়ায় গান্ধিকে বারবার তাঁর অতি উৎসাহী সমর্থকদের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। গান্ধি পীড়িত বোধ করেছেন, এবং এই স্থির জ্ঞান লাভ করেছেন যে, এভাবে চলবে না। জাতিকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে, জনগণের আইন প্রতিষ্ঠা করে বিশৃঙ্খল জনতাকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রণজিৎ গুহের সব প্রবন্ধই উল্লেখযোগ্য, বিশেষভাবে মূল্যবান হচ্ছে ‘দি প্রোজ অব কাউন্টার-ইনসারজেন্সি’, ‘দি কেরিয়ার অব এনে এ্যান্টি-গড ইন হেভেন এ্যান্ড অন আর্থ’, এবং ‘চন্দ্রা’স ডেথ [চন্দ্রার মৃত্যু]।’

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যরা সবাই রণজিৎ গুহের চেয়ে বয়সে কম, কেউ কেউ তাঁর ছাত্র। কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত নিষ্ঠাবান গবেষক; এঁদের তত্ত্বানুসন্ধান সজীব। এঁরা লেখেন চমৎকার গদ্যে, অধিকাংশই লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়, কিন্তু সে-ভাষা তাঁরা ব্যবহার করেন ঈর্ষণীয় স্বাচ্ছন্দ্যে। এঁরা অনেকেই সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক, আর এঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই লেখা অনস্বীকার্য সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন। এখানে তাঁদের লেখা নিয়ে আলাদা করে আলোচনার সুযোগ নেই, সব লেখা যে আমার পড়া আছে তাও মোটেই নয়। মোট কথা এটা যে, ব্রিটিশ শাসনামলের এবং তারপরেরও ইতিহাসপাঠে এঁরা একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন। সেটা যে কেবল পরিমাণগত তা নয়, গুণগতও বটে। ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিতেও এঁরা একটা পরিবর্তন এনেছেন। সেটা শুধু এই রকমের একটা বোধ নয় যে, নিম্নবর্গকে বাদ দিয়ে ভারতের জাতীয় ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব, ওকথা তো মোটামুটি জানা কথাই; তার চেয়েও বড়ো যে বক্তব্যকে এঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চান সেটা হল এই যে, নিম্নবর্গের মানুষেরা উচ্চবর্গের নিম্নবর্তী সংস্করণ নয়, তারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যেমন সংস্কৃতিতে, জীবনাচারে, তেমনি চেতনা এবং রাজনীতিতেও। আরও একটি বক্তব্য হচ্ছে এটা যে, নিম্নবর্গের মানুষেরা উচ্চবর্গের মানুষের সঙ্গে একত্র হয় বটে, দু’পক্ষের মধ্যে যোগাযোগও থাকে, একে অপরকে প্রভাবিতও করে, তবে নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই তৈরি করে নেয়। বিষয় আরও একটি আছে। সেটা এই যে, এই ইতিহাসবিদরা দেখাচ্ছেন যে, ইতিহাস একরৈখিক নয়, সেখানে বৈচিত্র্য রয়েছে, স্বর রয়েছে বিভিন্ন ও বিচিত্র, যেসবকে উপেক্ষা করা অত্যন্ত অনুচিত এবং ক্ষতিকর, ইতিহাসচর্চার দিক থেকে।

তিন

‘নিম্নবর্গ’ কথাটা ইংরেজি সাবঅলটার্নের বাংলা অনুবাদ। ‘সাবঅলটার্ন’ শব্দটির উদ্ভব লক্ষ করলেই এই গোষ্ঠীর কাজের স্বরূপ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। কনসাইজ অকস্ফোর্ড ডিকশনারীতে শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘নিম্নবর্গে অবস্থিত’ (অব ইনফেরিয়ার র‌্যাঙ্ক)। সেখান থেকেই নিম্নবর্গ এসেছে, এবং ‘সাবঅলটার্ন হিস্ট্রি’কে বলা হচ্ছে নিম্নবর্গের ইতিহাস। কথাটার অন্য একটি অনুষঙ্গ রয়েছে, যেটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘সাবঅলটার্ন’ কথাটা আমরা আন্তনিও গ্রামসি’র (১৮৯১-১৯৩৭) ‘প্রিজন নোটবুকস’এও পাচ্ছি। রণজিৎ গুহও পেয়েছেন। গ্রামসি ইংরেজি ভাষায় লেখেননি, লিখেছেন তাঁর মাতৃভাষা ইটালিয়ানে, মুসোলিনীর কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় অত্যন্ত সংগোপনে তিনি তাঁর চিন্তাগুলোকে লিপিবদ্ধ করেন, যা সহানুভূতিশীল কারাপ্রহরীদের সাহায্যে বাইরে পাঠানো হয়। পরে মূল ইটালিয়ানে এবং বিভিন্ন ভাষায় তা প্রকাশিত হয়। গ্রামসির লেখার ইংরেজি অনুবাদে ‘সাবঅলটার্ন’ কথাটি রয়েছে। গ্রামসি ‘সাবঅলটার্ন’ বলতে মার্কসবাদী পরিভাষায় যাদেরকে শ্রমজীবী বলা হয় তাদেরকেই বোঝাতে চেয়েছেন, এদেরই অপর নাম সর্বহারা। আরও কিছু কিছু শব্দের মতো ‘সর্বহারা’ (প্রলেটারিয়েট) শব্দটি গ্রামসি মনে হয় ইচ্ছা করেই ব্যবহার করেননি। যেমন মার্কসবাদ না লিখে তিনি লিখেছেন ‘প্রাক্সিসের দর্শন’, লেনিনের পরিবর্তে লিখেছেন ‘ইলিচ’, তেমনি প্রলেটারিয়েটের জায়গায় লিখেছেন ‘সাবঅলটার্ন’। উদ্দেশ্য হল সরকারের শ্যেন দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া। তাই বলে ‘সাবঅলটার্ন’ বলতে গ্রামসি ধ্রুপদী মার্কসবাদের শ্রমিক শ্রেণিকেই (প্রলেটারিয়ট) যে শুধু বুঝিয়েছেন তা নয়, কৃষককেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রলেটারিয়েট বলতে যেভাবে অর্থনীতির ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাজনের ধারণা মনে আসে, সাবঅলটার্নের ধারণা তার থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র। সাবঅলটার্নে অর্থনীতির সঙ্গে ইতিহাস এবং সংস্কৃতির যোগাযোগের বিবেচনাটাও এসে যায়।

আমাদের আলোচ্য নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা সমাজকে, এবং তার চেয়েও বেশি করে সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেন, যে জন্য ‘সাবঅলটার্ন’ কথাটি তাঁদের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। সেই সঙ্গে গ্রামসির কাছ থেকে আরও একটি প্রত্যয় তাঁরা পেয়েছেন। সেটি হল আধিপত্য, হেজিমনি, যার অর্থ করা যায় শাসিতের কাছ থেকে শাসকের মতাদর্শিক সম্মতি আদায় করা। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা এই আধিপত্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, কারণ তাঁরা লক্ষ্য করেছেন যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাপ্রবাহে উচ্চবর্গ (বিদেশী ও দেশী উভয় উচ্চবর্গই) নিম্নবর্গের ওপর নানাভাবে কর্তৃত্ব করেছে ঠিকই কিন্তু মতাদর্শিক সম্মতি বা বশ্যতা আদায় করতে পারেনি; তাদের কর্তৃত্ব ছিল আধিপত্যবিহীন। (বলা বাহুল্য মতাদর্শিক কথাটা এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।)

কিন্তু কেবল ইটালির গ্রামসি নন, নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিজেদের হাতের কাছে পেয়েছেন ফরাসী দেশের উত্তর-আধুনিক দার্শনিক মিশেল ফুকোকে-ও (১৯২৬-৮৪)। এই ইতিহাসবিদদের জন্য সময়টা ছিল বেশ হতাশাব্যঞ্জক। যেমন ষাটের দশকে ইউরোপে প্রবল ছাত্র আন্দোলন ও তার অসফল পরিণতি এবং ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরোধী গণবিক্ষোভের অবসান। বামপন্থী আন্দোলনে ক্লান্তি দেখা দিচ্ছিল। সোভিয়েট ইউনিয়ন শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান এবং পরে অপুঁজিবাদী বিকাশের তত্ত্ব প্রচার করছিল। চীন-সোভিয়েট বিরোধ তুঙ্গে উঠছিল। অন্যদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝড় ততদিনে থেমে গেছে। বিশ্বজুড়ে তখন হতাশা দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে বামপন্থী শিবিরে। ফুকো হচ্ছেন এই বিশেষ সময়ের দার্শনিক। নিজেকে তিনি বলেছেন অতিরিক্ত স্পর্শকাতর একজন নৈরাশ্যবাদী। আমরা যোগ করতে পারি এই মন্তব্যটি যে, তিনি একজন নৈরাজ্যবাদীও; মোটেই মার্কসবাদী নন, বরঞ্চ মার্কসবাদের বিপক্ষেই তাঁর অবস্থান, এবং তা যে কেবল তত্ত্বের ক্ষেত্রেই তা নয়, বাস্তব কার্যক্ষেত্রেও বটে, ১৯৮১-তে পোল্যান্ডে যে কমিউনিস্টবিরোধী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন হয় ‘সলিডারিটি’ নামে তাতে তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন বলে তাঁর জীবনীকারেরা আমাদেরকে জানাচ্ছেন। মোটকথা, সময় যেন ফুকোর জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি যে দার্শনিক মতবাদ প্রচার করলেন সেটাই হচ্ছে তথাকথিত উত্তর-আধুনিকতার মূল ভিত্তি।

ফুকোর প্রধান বিবেচ্য হচ্ছে ক্ষমতা। তা ক্ষমতা কোথায় থাকে? ফুকো বলছেন এতদিন যে বলা হত ক্ষমতা থাকে বিশেষ কোনো একটি কেন্দ্রে সেই বক্তব্যটি ঠিক নয়। আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতা এমনকি রাষ্ট্রের হাতেও কেন্দ্রীভূত নয়। ক্ষমতা ছড়িয়ে আছে সমাজের সর্বত্র। সর্বত্র ছড়িয়ে থাকার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, ক্ষমতা সবকিছুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নিজের আলিঙ্গনের মধ্যে; তার অর্থ বরঞ্চ এই যে, ক্ষমতা সব জায়গা থেকে আসে, এবং সামাজিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতা স্থির নয়, সদাচঞ্চল, মুহূর্তে মুহূর্তে সে তৈরি হচ্ছে।

এক্ষেত্রে যে উপমাটি ফুকো ব্যবহার করেছেন সেটি হল মানুষের শরীরে যেমন শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, ক্ষমতার প্রবাহটাও এই রকমেরই। ক্ষমতা ব্যক্তিকে অব্যাহতি দেয় না, ব্যক্তির শরীরকে স্পর্শ করে, তার কর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গি, আলাপ-আলোচনা, শিক্ষার পদ্ধতি এবং প্রাত্যহিক কর্মকে প্রভাবিত করে। এই ক্ষমতা সমাজের ভেতরেই থাকে, সমাজের ওপরে না থেকে। সমাজ ব্যক্তিকে শৃঙ্খলার ভেতর ধরে রাখে। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তি দেয়। ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার একটি শান্ত উপায় হচ্ছে তাকে অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করে দেওয়া। এই কাজটা অন্যত্র তো বটেই হাসপাতাল, পাগলাগারদ, জেলখানা, স্কুল, কারখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানেও চলতে থাকে। রেনেসাঁসের সময় থেকে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, জ্ঞানই হচ্ছে শক্তি, ফুকো বলছেন অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে দেখা যাচ্ছে শক্তিই বরঞ্চ জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ক্ষমতার প্রশ্নে মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন। ধ্রুপদী মার্কসবাদীরা বলেন যে, রাষ্ট্র হচ্ছে বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে রাষ্ট্রকে তারা ব্যবহার করে নিপীড়নের যন্ত্র হিসাবে। গ্রামসি রাষ্ট্রের সংজ্ঞাকে প্রসারিত করেছেন, বলপ্রয়োগের সঙ্গে রাষ্ট্র কর্তৃক সম্মতি আদায়ের চেষ্টার বিষয়টিকে যুক্ত করে। ওদিকে ফুকো কিন্তু রাষ্ট্রকে প্রধান শক্তি হিসাবেই দেখতে চান না। তিনি চলে যান সমাজের কাছে। সমাজে অবিরাম বলপ্রয়োগ চলছে, কিন্তু ওই বলের কোনো সর্বজনীনতা নেই; বল জিনিসটা হচ্ছে আপেক্ষিক, এবং তা বহুভাবে বিভক্ত, তার টুকরোগুলো অসংখ্য। মার্কসবাদীদের সঙ্গে তো বটেই গ্রামসির সঙ্গেও এক্ষেত্রে ফুকোর ব্যবধানটি একেবারে মৌলিক। পুঁজিবাদ যে ব্যক্তিকে সমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করে এটা সকল মার্কসবাদীরই কথা; কিন্তু তাঁরা চান ব্যক্তিকে সমষ্টির মধ্যে নিয়ে আসতে, যাতে করে বলপ্রয়োগকারী শ্রেণিকে জব্দ করা যায়, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়, এবং ক্ষমতা নিয়ে আসা যায় সকলের কাছে। সমষ্টির বিজয়ের কারণে রাষ্ট্র এক সময়ে অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, সে শুকিয়ে মরবে, কিন্তু তার আগে তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে, কেননা সে আছে, কেবল যে আছেই তা নয়, ক্ষমতাধর হয়ে বসে আছে, এবং নিরন্তর বলপ্রয়োগ করে চলেছে। ফুকো এবং তাঁর অনুসারীরা রাষ্ট্রের এই গুরুত্বকে মানেন না, তাঁরা অনেকটা নৈরাজ্যবাদী, তাঁদের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা একচ্ছত্র নয়। আর রাষ্ট্রের ক্ষমতার চেয়ে বরঞ্চ সমাজের ক্ষমতাই বেশি।

রাষ্ট্রক্ষমতাকে জনগণের হাতে আনতে হবে, এই লক্ষ্যে গ্রামসি কাজ করেছেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন, কারাযন্ত্রণা সহ্য করেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছেন। ফুকো করবেন উল্টো কাজ। তিনি চাইবেন ব্যক্তি নিজেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক। হ্যাঁ, প্রতিরোধ দরকার হবে। বস্তুত যেখানে ক্ষমতা আছে সেখানেই প্রতিরোধ চাই, এবং ক্ষমতা তো রয়েছে ঘরে বাইরে সর্বত্র। প্রতিরোধ তাই হবে সবখানে। কিন্তু এইসব প্রতিরোধ যে ঐক্যবদ্ধ হবে এমন সুযোগ নেই। গ্রামসি মনে করেন যে, জনগণের আন্দোলনে স্বতঃর্স্ফূততা থাকবে ঠিকই, কিন্তু আবার শৃঙ্খলাও থাকবে, যে-শৃঙ্খলা কার্যকর হবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। ফুকো যে-পরিমাণে নৈরাজ্যবাদী, গ্রামসি ঠিক সেই পরিমাণেই আশাবাদী। গ্রামসি মনে করেন যেখানে ইতিহাস আছে সেখানেই শ্রেণি আছে; ওদিকে ফুকো শ্রেণির কথা ভাবতেই চান না, তিনি ভাবেন ব্যক্তির কথা। যেখানে ক্ষমতা রয়েছে সেখানেই প্রতিরোধ চাই।

গ্রামসি ও ফুকোর অবস্থান তাই পরস্পরবিরোধী। গ্রামসি যেখানে স্থানীয় মানুষের মধ্যে তো বটেই আন্তর্জাতিক ভাবেও ঐক্যে বিশ্বাস করেন, ফুকো সেখানে চরম বিচ্ছিন্নতার কথা বলছেন। ফুকো অস্তিত্ববাদীদেরকেও অতিক্রম করে গেছেন, তিনি এমনকি ব্যক্তিসত্তার অবিভাজ্যতাতেও আস্থা রাখেন না। তাঁর চোখে স্থির বলে কিছু ধরা পড়ে না, সবকিছুই অস্থির ও আপেক্ষিক। গ্রামসির মতো ফুকোও প্রান্তবর্তী মানুষদের কথা ভাবেন; কিন্তু তাঁদের প্রান্তবর্তিতার সংজ্ঞা এক নয়। গ্রামসির প্রান্তবর্তীরা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ; ফুকোর প্রান্তবর্তীরা সংখ্যালঘু, তাঁর প্রান্তবর্তীদের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে সমকামী ও মস্তিষ্কবিকৃতরা। এর চেয়েও প্রাথমিক পার্থক্যটা এখানে যে, গ্রামসির প্রান্তবর্তীরা দীর্ঘকাল প্রান্তবর্তী থাকবে না, আর তাদেরকে মূল ধারাতে পরিণত করাটাই হচ্ছে গ্রামসির মতো বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর বিপরীতে ফুকোর প্রান্তবর্তীরা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে, প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে তাদের অবস্থানের জায়গাটা প্রশস্ততর হবে, অর্জন ঘটবে এটুকুই। গ্রামসি মনে করেন যে, নিম্নবর্গের মানুষদের দুর্বলতাটা হল এইখানে যে, তারা তাদের অবস্থানের দরুণ রাষ্ট্রকে নিজেদের চিন্তা ও কল্পনার ভেতর ধারণ করতে ব্যর্থ হয়; তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে, সেটাই তাদের নিম্নবর্গিতার কারণ; রাষ্ট্রকে ধারণার মধ্যে যদি তারা আনতে পারে তবেই তারা নিজেদের নিম্নবর্গিতাকে অতিক্রম করতে পারবে। ওদিকে ফুকো রাষ্ট্রকে সক্রিয় বিবেচনার ভেতর আনতেই নারাজ।

গ্রামসি ও ফুকো সম্পর্কে এই যে আমরা এত সব কথা বলছি এর কারণ হল এই যে, এঁরা উভয়েই নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের চিন্তাজগতে উপস্থিত রয়েছেন। একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী; অপরজন মোটামুটি অরাজনৈতিক, কিন্তু আসলে মার্কসবাদ-বিরোধী। ফুকো মার্কসবাদী অর্থনৈতিক শ্রেণিবিশ্লেষণে বিশ্বাস করেন না, পুঁজিবাদ যে সর্বত্র-বিস্তৃত এবং তাকে পরাভূত করার মধ্যেই যে ইতিহাসের মুক্তির সম্ভাবনা নিহিত এই তত্ত্বে আস্থা রাখেন না, আসলে সার্বিক মুক্তি সম্ভব বলেই তিনি মনে করেন না, আপেক্ষিক মুক্তির জন্যই লড়াই করতে হবে বলে ধরে নেন।

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা যা করেছেন তা হল গ্রামসির কাছ থেকে নিয়েছেন নিম্নবর্গ ও আধিপত্যের ধারণা; আর ফুকোর কাছ থেকে নিয়েছেন ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকৃত অবস্থান ও আপেক্ষিকতার প্রত্যয়। তাঁদের চিন্তাজগতে এই দুই ধারা একত্রে এসে মিলেছে। মার্কসবাদীরা ইতিহাসকে ঈশ্বরের শূন্যস্থানে স্থাপন করেন, নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরাও অতি অবশ্যি ইতিহাসকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁদের ইতিহাসচর্চা মার্কসবাদী ঘরানার নয়। রণজিৎ গুহ নিজে এক সময়ে মার্কসবাদী ছিলেন, কিন্তু আশির দশকের শুরুতে যখন তিনি নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার একটি ধারা গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছেন তখন তিনি আর বাম আন্দোলনে নেই, নিম্নবর্গের প্রতি তাঁর প্রচুর সহানুভূতি আছে, উদারনীতির তিনি বিরুদ্ধে, উচ্চবর্গের মানুষদের ইতিহাসচর্চার যে ধারা আধিপত্য করছে তাকে তিনি স্থানচ্যুত করতে চান; নিম্নবর্গের তরুণ ইতিহাসবিদদেরও অনেকেই প্রথম জীবনে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় যখন এসেছেন তখন সঙ্গে করে তাঁরা মার্কসবাদের জ্ঞান এনেছেন ঠিকই, কিন্তু ওই মতাদর্শের প্রতি পূর্বতন অঙ্গীকারটিকে আনেননি।

বস্তুত তাঁদের জন্য এই জ্ঞানানুশীলন একটি নতুন জগতে প্রবেশ বটে, যে জগতে আন্তনিও গ্রামসি সত্য, কিন্তু সমান সত্য হচ্ছেন মিশেল ফুকো। আসলে এটা সন্দেহ করা হয়তো অন্যায় হবে না যে, এঁদের পক্ষপাত ফুকোর দিকে যতটা গ্রামসির দিকে ততটা নয়। এটাকে অস্বাভাবিকও বলা যাবে না। প্রথম কথা, এঁরা যাঁদের জন্য লিখছেন তাঁরা মার্কসবাদী নন, অধিকাংশই বরঞ্চ মার্কসবাদবিরোধী। দ্বিতীয় সত্য এই যে, মার্কসবাদীরা যখন সাবেক হন, অর্থাৎ ওই মতাদর্শের আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে পড়েন, তখন মুক্তির ওই চাঞ্চল্য অনেক দিক দিয়েই প্রকাশ্য হয়ে পড়ে, বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয় মার্কসবাদের সমালোচনায়, যদিও সে-সমালোচনা যে সব সময় প্রত্যক্ষ থাকে তা নয়, বেশির ভাগ সময়েই সেটা থাকে অন্তর্লীন। এঁদের ক্ষেত্রে সেটা যে ঘটেনি এমনটা ভাববার পক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আমাদের হাতে নেই। দলত্যাগীরা তাঁদের দলত্যাগটা কেন যথার্থ ছিল তা বুঝবার জন্য ব্যস্ত থাকেন, অপরকে তো বোঝাতে চানই, নিজেদেরকেও বোঝানো অত্যাবশ্যক জ্ঞান করেন।

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা যে-ইতিহাস লেখেন তা অবশ্য স্বঘোষিত ভাবেই রাজনৈতিক। নিম্নবর্গের মানুষেরা যখন বিদ্রোহ করে ঠিক সেই সময়েই তারা এই ইতিহাসবিদদের অনুসন্ধিৎসার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে, স্থবির থাকার সময়ে নয়। এই ইতিহাসবিদেরা ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাঁরা নিম্নবর্গের মানুষদেরকে আদিবাসী হিসাবে দেখতে চান না, তাঁরা চান নিম্নবর্গের মানুষেরাই মূল ধারা হয়ে উঠুক। তাদের সাহায্যে কিংবা নেতৃত্বে ভারতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হোক, ইতিহাসবিদেরা এটাই কামনা করেন। অর্থাৎ তাঁদের অবস্থানটা নিছক দর্শকের নয়, তাঁরা ইতিহাসনির্মাণের সঙ্গেও জড়িত হতে যে অনাগ্রহী তা নন। তাছাড়া নিম্নবর্গের মানুষদের যে অভ্যুত্থান তার পেছনে কেবল যে কৃষকের নিজের জগৎ সম্পর্কে সচেতনতা রয়েছে তাই নয়, সেই সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ওই জগৎকে বদলাবার দৃঢ় ইচ্ছাও এবং তারা সংগ্রাম করছে নিজেদের নিম্নবর্গিতা ঘুচিয়ে ফেলতে। জগৎ-বদলাবার আকাঙ্খা-বিষয়ক প্রায়-গ্রামসির উপলব্ধিটির কথা রণজিৎ গুহের ‘এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজেন্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ বইতে বেশ পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান এবং জগৎকে বদলাবার ইচ্ছা, এই উভয় চেতনাই জরুরী, এদু’টি না থাকলে নিম্নবর্গের মানুষ আদিবাসী হয়ে থাকতে বাধ্য।

তবে কৃষকদের সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের এই সচেতনতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তখন যখন ইতিহাসের অনুসন্ধানের বেলায় নিজেদেরকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন রাষ্ট্র থেকে, রাষ্ট্রের ভেতরে যে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তা থেকে এবং রাষ্ট্র যে রয়েছে একটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অধীনে তা থেকেও। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও তাঁদের ভারতীয় অনুকারকেরা কেউ কেউ যে ভারতের ইতিহাসকে ব্রিটেনের ইতিহাসেরই অংশ হিসেবে দেখতেন তাতে অবশ্যই একটা স্থূলতা ছিল, কিন্তু তাই বলে মিথ্যা ছিল না তো এই সত্য যে, ভারত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই অংশ। কৃষকের অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ও তার দেশী-বিদেশী পরিমণ্ডলের ছায়া কোনো না কোনো ভাবে পড়েছে নিশ্চয়ই; নিম্নবর্গের রাজনৈতিক অভ্যুত্থান স্থানীয় বটে, কিন্তু সে তো কেবল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল না, বিদ্রোহ ছিল গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই। নকশালবাড়ি আন্দোলনের কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। সেই আন্দোলন প্রান্তে ঘটেছে, ঘটেছে প্রধানত গ্রামাঞ্চলেই, কিন্তু তার ভেতরে শ্রেণিচেতনা ছিল, গোটা ব্যাপারটাকেই মনে করা হয়েছিল শ্রেণি সংগ্রাম। প্রান্ত কেন্দ্রকে ঘেরাও করে ফেলবে, ঘেরাও করে উচ্ছেদ ঘটাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার-এই বোধটা ছিল বই-কি। নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চার ঘোষণাপত্রেই তো বলা হয়েছে যে, কৃষকের রাজনৈতিক সংগ্রাম যখন স্থানীয় বুর্জোয়াদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার লক্ষ্যে যুক্ত হয়েছে তখন চমৎকার ফল পাওয়া গেছে; আর যখন ওই লক্ষ্য থেকে তার বিচ্যুতি ঘটেছে তখনই দেখা গেছে গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ। নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা কিন্তু উচ্চবর্গের রাজনীতির সঙ্গে নিম্নবর্গের মানুষের সংযোগটিকে গুরুত্ব দিতে চায়নি, বরঞ্চ চোখ রেখেছে দু’য়ের মধ্যকার পার্থক্যের ওপর। ইতিহাসচর্চার এই ঘরানার কাছে দুই বর্গের ভেতর পার্থক্যটাই গুরুত্বপূর্ণ, নৈকট্যটা নয়। বস্তুত এই ধারার গবেষকরা মনে করেন যে, নিম্নবর্গের ইতিহাস হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র এলাকা, সেটি হচ্ছে মোটামুটি স্বায়ত্তশাসিত (অটোনমাস), তার যত বিরোধ সবটাই প্রায় উচ্চবর্গের ইতিহাসের সঙ্গে। এখানে বিচ্ছিন্নতা ও আপেক্ষিকতার প্রতি যে পক্ষপাতপূর্ণ দৃষ্টিপাত ঘটেছে সেটা ফুকো-সমর্থিত, মোটেই গ্রামসি-সমর্থিত নয়। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা যে ফুকোপন্থী এমনটা বলা যাবে না, তবে নিম্নবর্গের ভেতর ওই যে নানাধরনের স্বাভাবিক বিভিন্নতা তা নিয়ে তাঁরা যে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট তা নন, পার্থক্যের ইতিহাসেই বরঞ্চ তাঁরা অধিক আগ্রহী, ঐক্যের ইতিহাসের তুলনায়।

উত্তর-আধুনিকেরা সামগ্রিকীকরণে (টোটালাইজিং) বিশ্বাস করেন না, তাঁরা সাধারণীকরণেও আস্থাহীন। তাঁরা দেখেন নির্দিষ্টকে, তাকাতে চান এককের দিকে, যে জন্য মার্কসবাদ তাঁদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। কেননা মার্কসবাদীরা নির্দিষ্ট একককে অবশ্যই দেখেন, নির্দিষ্ট ও এককের মুক্তিই তাঁদের কাম্য, কিন্তু এটাও তাঁরা জানেন যে, ওই মুক্তি কিছুতেই আসবে না যদি না বৃহৎ, সাধারণ ও সামগ্রিককে (যার নাম পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে) ভেঙ্গে ফেলা যায়; উত্তর-আধুনিকেরা যেটা জেনেও জানতে চান না, চোখ ফিরিয়ে রাখেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা সুনির্দিষ্ট ও একককে জানতে চান, ইতিহাসবিদ মাত্রেই যা জানতে চাইবেন; তাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত; কিন্তু উত্তর-আধুনিকদের মতোই তাঁরা ওই ব্যবস্থাটির সঙ্গে নিম্নবর্গের সম্পর্কটা কি, ওই ব্যবস্থা কীভাবে নিম্নবর্গকেও একই সঙ্গে প্রভাবিত করছে তা খতিয়ে দেখতে উৎসাহ প্রকাশ করেন না। পুঁজিবাদের একটা সর্বজনীনতা আছে, সে ছড়িয়ে পড়ে, এবং যেখানে যায় ভেতরে ঢুকতে চায়। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা মনে করেন ভারতবর্ষে পুঁজিবাদ সর্বত্রগামী হতে ব্যর্থ হয়েছে। তার কারণ হল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো। ওই কাঠামোর ভেতর থেকেই ঔপনিবেশিক শোষণ চলেছে, সম্পদের লুণ্ঠন ঘটেছে, ঘটেছে পণ্যবিক্রয় ও খাজনা আদায়; একটি স্বাধীন দেশে যেমন পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা ঘটে তেমন ঘটনা পরাধীন ভারতে স্বভাবতই ঘটতে পারেনি, পুঁজি এখানে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়নি; কোম্পানির শাসন এক ধরনের সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল, কিন্তু তার পরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে এখানে সর্বাত্মক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে তা পারেনি, পুঁজি স্থানীয় ছিল না, ছিল মূলত বহিরাগত, এবং তা দেশে ব্যাপক শিল্পায়ন যে ঘটাবে তা করেনি। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কর্তৃত্ব করেছে ঠিকই, কিন্তু সমাজকে যে নিজের আধিপত্যের ভেতর নিয়ে আসবে তা পারেনি। বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষের সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ণই রয়ে গেছে।

আলোচ্য ইতিহাসবিদেরা নিম্নবর্গের এই সাংস্কৃতিক নিজস্বতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। ইতিহাসের ঘটনাকে যখন তাঁরা বিচার করেন তখন ঘটনার কার্যকারণের চাইতে বরঞ্চ ঘটনার পেছনে যে-চেতনাটি কাজ করেছে তার অনুসন্ধানই অধিকতর প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করে থাকেন। এই চেতনার মধ্যে নিশ্চয়ই শ্রেণিচেতনাটাই প্রধান। তেমনটাই হবার কথা। কিন্তু এঁদের বিবেচনায় শ্রেণিচেতনার চাইতে গোষ্ঠীচেতনা, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, এক কথায় সংস্কৃতিই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, চেতনা হয়ে পড়ে সাংস্কৃতিক চেতনা। ফলে শ্রেণিবিন্যাস, শ্রেণিসম্পর্ক, অর্থনৈতিক নির্যাতন, এসব উপাদান অপ্রধান হয়ে যায়। শ্রেণির চেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়ায় সমাজ (কমিউনিটি)। ইতিহাসের পাঠ রূপ নেয় সংস্কৃতির পাঠে। ইতিহাসে গ্রামসির আগ্রহ অত্যন্ত গভীর; কিন্তু ইতিহাসকে তিনি যুক্ত করে দেখেন সংস্কৃতির সঙ্গে। তাই বলে সংস্কৃতি যে রাজনীতি-নিরপেক্ষ তা তিনি কখনোই ভাবেন না। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন, বিশেষ করে মার্কসবাদ কখনোই তাঁর বিবেচনার বাইরে থাকে না। শ্রেণিচেতনার কথা তিনি কখনোই ভোলেন না। ওদিকে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা শ্রেণিকে বিবেচনার মধ্যে না আনতে পারলেই খুশি হন। শ্রেণি নয়, তাঁদের কাছে বর্গই প্রধান; উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গ লড়ছে; কিন্তু ওই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিম্নবর্গ যে একটি সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, এই সম্ভাবনা নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা দেখেন না; গ্রামসি যেটা পরিষ্কারভাবে দেখতেন।

উত্তর-আধুনিকেরা আরেকটা কাজ করতে পারেন না। তাঁরা অগ্রগতিতে বিশ্বাস রাখতে পারেন না। মার্কসবাদীরা কিন্তু রাখেন। মার্কসবাদীরা লক্ষ্য করেছেন যে, ইতিহাস এগুচ্ছে, উত্তর-আধুনিকেরা দেখছেন ইতিহাসের পক্ষে আর এগুনো সম্ভব নয়, বিপ্লবের আশা দুরাশামাত্র। ইতিহাস এগুবে না; ক্ষমতা প্রবহমান থাকবে; যা করতে হবে তা হল প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে নিজের জন্য জায়গা করে নেওয়া এবং জায়গা যেটুকু পাওয়া গেছে সেটুকুকে প্রসারিত করা। এর বাইরে আর কোনো আশা নেই। ফুকো নীৎসের কাছে অনায়াসে চলে যান। নীৎসে যেভাবে ব্যক্তির ওপর নির্ভর করেন, ফুকো তাতে তাঁর নিজের অবস্থানের সমর্থন পান। মনস্তাত্ত্বিক ফ্রয়েডও উত্তর-আধুনিকতার সমর্থক, তিনিও ব্যক্তিকেই প্রধান করেন, এবং ব্যক্তির ভেতরে যে রহস্যময় জগৎ আছে সেখানে বহিরঙ্গীয় কর্মের ব্যাখ্যা পান। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকে বড়ো করে দেখেন না, তাঁরা সমষ্টিগত ইতিহাসেরই পাঠক, কিন্তু ইতিহাসে মনস্তত্ত্বের যে ভূমিকা সেটা তাঁদের কৌতূহলের বিষয় বই-কি। মনস্তত্ত্বও চেতনারই অংশ বটে।

চার

আমরা নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অর্জনের কথা বলেছি। ভারতের ইতিহাসের অবজ্ঞাত অংশগুলোকে যে গণ্য করা দরকার এবং ওই অংশগুলো যে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সব সময়ে থাকেনি-এই সত্যের প্রতি তাঁরা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এবং ইতিহাসের বইতে সাধারণভাবে-উপেক্ষিত যে সাধারণ মানুষ তাদের পেছনে কার্যকর যে-চেতনা তাকে পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছেন।

ব্রিটিশ-বিরোধী অনেক নিম্নবর্গীয় আন্দোলনেরই প্রকৃত গুরুত্ব এখনও অনুধাবন করা হয়নি। সে-ইতিহাস অলিখিতই রয়ে গেছে। যেমন গোড়ার দিকে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ, পরে ১৯৪৫-৪৬-এর তেভাগা আন্দোলন এবং ১৯৪৫-৪৬ এ কলকাতায় শ্রমজীবী ও ছাত্রদের আন্দোলন-এদের ব্যর্থতার কারণ-অনুসন্ধান তাৎপর্যপূর্ণ সত্যের সন্ধান দিতে পারে। ১৯৪৭-৫১-র তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। সাতচল্লিশের পরে পূর্ববঙ্গের নাচোলে, সিলেটে, ময়মনসিংহে প্রান্তবর্তী মানুষদের যেসব অভ্যুত্থান ঘটেছে সেগুলোও যথার্থ পর্যালোচনার অপেক্ষায় রয়েছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে গবেষণা অত্যাবশ্যক। এমনকি ১৯৪৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটও একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা নিয়ে অনুসন্ধান চলতে পারে।

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদের একটি বিশেষগুণ সাহিত্যে তাঁদের আগ্রহ। ইতিহাস নিয়ে লেখা গ্রন্থ ও প্রবন্ধকে তাঁরা সাহিত্যের আবেদনে সমৃদ্ধ করেছেন। এঁদের রচনা অত্যন্ত সুখপাঠ্য। সেটা যে কেবল গবেষণা-সমৃদ্ধ উন্মোচনের কারণে তা নয়; সঙ্গে রয়েছে উপস্থাপনার দক্ষতা। ইতিহাস এঁদের কাছে বর্ণনার ব্যাপার নয়, অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসা এবং সর্বোপরি পাঠের ব্যাপার। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, এঁরা তথ্য-প্রমাণ দলিল-দস্তাবেজ সব কিছু পাঠ করেন অনেকটা সাহিত্যসমালোচকের দৃষ্টি দিয়ে। কথাটা সত্য। প্রকাশ্য অর্থের পেছনে লুকানো আছে যে গোপন অর্থ, কখনও হয়তো-বা উল্টো অর্থই, তা এঁরা খুঁজে বের করেন। এঁরা মহাফেজখানার সংরক্ষক নন, প্রাণবন্ত পাঠক। জ্যাক দেরিদা (১৯৩০—  ) যেভাবে রচনাকে ‘বিনির্মাণ’ করেন এবং বোঝাতে চান যে ‘টেক্সট’ই সব, যা পড়তে পেয়েছি সেটাই যথেষ্ট, তার বাইরে যাবার কোনো আবশ্যকতা নেই, সেই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের নয়, তদুপরি বিনির্মাণবাদীদের মতো এঁরা রাজনীতিবিমুখ নন, বরঞ্চ রাজনৈতিক ইতিহাস রচনাই এঁদের লক্ষ্য।

কিন্তু এই ইতিহাসবিদদের অসুবিধার জায়গাও রয়ে গেছে – একটি নয়, বেশ কয়েকটি। এবং সেগুলো যে নেহাৎ নগণ্য তা নয়, বেশ বড়ো বড়ো বটে। প্রথম অসুবিধার জায়গা হচ্ছে যে এঁরা পুঁজিবাদের মহান বয়ানকে (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ) নাকচ করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটি বৃহৎ ও সর্বজনীন ধারণাকে তাঁদের ইতিহাসের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছেন। এই ধারণাটি হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের। নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চার  ঘোষণাপত্র রচনার সময় রণজিৎ গুহের স্মরণে ছিল গ্রামসি লিখিত ‘নোটস অন ইটালিয়ান হিস্ট্রি’র প্রস্তাবনার কথা, যা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। আমরা এও জানি যে, ইউরোপের যখন বেশ কয়েকটি দেশে জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে ইটালির বুর্জোয়ারা যে তখন তেমন একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি সেই ব্যর্থতার বিষয়ে গ্রামসি সচেতন ছিলেন। অনুরূপভাবে নিম্নবর্গ ইতিহাসপাঠের ঘোষণাপত্রে বলা হচ্ছে ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসপাঠের সমস্যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুটি হচ্ছে এই সত্য যে, ভারতবর্ষের মানুষেরা ঔপনিবেশিকতাকে পরাভূত করে নিজেদেরকে একটি জাতিতে পরিণত হতে ব্যর্থ হয়েছে। এটিকে এঁরা বলছেন একটি ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। মনে করেছেন ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু ভারতীয়দের পক্ষে একটি জাতিতে পরিণত হওয়া আর ইটালীয়দের পক্ষে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করা তো এক ব্যাপার হতে পারে না। ভারত ছিল পরাধীন, আর ইটালি ছিল স্বাধীন; তাছাড়া যে ইউরোপীয় রেনেসাঁস স্বতন্ত্র জাতিগঠনের ধারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল তার জন্মভূমিও ইটালিই বটে। সেখান থেকে ভারত অনেক দূরে। এই দুই পার্থক্য তো ছিলই। আরও পার্থক্য রয়েছে এইখানে যে, ভারতবর্ষ কেবল যে বৈচিত্র্যপূর্ণ তা নয়, সমসময়েই বহুত্ববাদী; এই উপমহাদেশ কখনও এক জাতির দেশ ছিল না, এবং এখনও যে সকল ভারতীয় এক জাতিতে পরিণত হয়েছে তা কিছুতেই বলা যাবে না।

প্রশ্ন দাঁড়ায় জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তিটা কি। ভাষা, নাকি ধর্ম? ধর্ম অবশ্যই একটি ভিত্তি, কিন্তু মূল ভিত্তি কোনটা? সেটা হল ভাষা। একই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক থাকতে পারে, থাকেও; ভাষার ঐক্য তাই ধর্মের ঐক্যকে ছাড়িয়ে যায়। ভারতের অধিকাংশ মানুষ হিন্দুধর্মাবলম্বী, কিন্তু তাদের ভাষা একটি নয়, অনেক ক’টি। এই যে বিভিন্ন ভাষা তাদের অস্তিত্বের বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে যে ভারত এক জাতির দেশ নয়। কখনও ছিল না, এখনও নয়। ভারতীয়রা একটি অখন্ড জাতিতে পরিণত হয়নি। তার প্রধান কারণ ভাষাগত বিভিন্নতা। চাপিয়ে-দেওয়া ভাষা স্থানীয় ভাষাগুলোকে স্থায়ীভাবে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে সমর্থ হয়নি। ব্রিটিশ শাসন ভারতে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, যে-সাম্রাজ্য ছিল আগের যে কোনো সাম্রাজ্যের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী, সুবিস্তৃত ও মজবুত। ওই শাসকেরাও তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে, ইংরেজিকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছে; কিন্তু তাদের সেই তৎপরতাও সফল হয়নি, স্থানীয় মানুষেরা নিজেদের ভাষার চর্চা অব্যাহত রেখেছে। মাতৃভাষার চর্চা দেশপ্রেম ও উপনিবেশবাদ-বিরোধিতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ শাসন ভারতে যে-ঔপনিবেশিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তার বিরুদ্ধে ভারতে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, সেই প্রতিরোধ একটি জাতীয়তাবাদী চরিত্র নিয়েছে, কিন্তু তাই বলে ভারত যে এক জাতির দেশ হয়ে গেছে তা মোটেই নয়। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা যখন ভারতকে এক জাতীয় দেশ বলে ধরে নেন, এবং ভারতীয় বুর্জোয়ারা কিংবা ভারতের শ্রমজীবী মানুষ কেউই ভারতীয় জনগণকে একটি জাতিতে পরিণত করতে সমর্থ হয়নি দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন তখন তাঁরা ভুল করেন। কেননা ভারত কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ভবিষ্যতে যে হবে তাও নয়। ভারতে বিভিন্ন জাতি রয়েছে, এবং থাকবে; তারা সকলে মিলে একটি অভিন্ন আঞ্চলিক ঐক্য সংস্থা গড়ে তুলতে পারে, হয়তো একদিন তুলবেও, যেখানে কেউ কারও ওপর কর্তৃত্ব করবে না, আধিপত্যও থাকবে না, সকলের থাকবে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব।

ঘটনাক্রমে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অধিকাংশই হচ্ছেন বাংলাভাষী। বাংলা ভাষাতে না লিখুন, অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশ সম্পর্কে যখন লিখেছেন তখন তাঁদের মধ্যে যে ধরনের প্রত্যয় ও স্বাভাবিকতা দেখা গেছে সর্বভারতীয় বিষয়ে লেখার সময়ে তেমনটা দেখা যায়নি। রণজিৎ গুহের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘এ রুল অব প্রপার্টি অব বেঙ্গল’ (১৯৬৩) বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর লেখা; পরবর্তীতে তিনি সর্বভারতীয় বিষয়ে লিখেছেন, কিন্তু সেখানেও বাংলা থেকেছে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। এবং তার সর্বশেষ গ্রন্থে—‘হিস্ট্রি এট দি লিমিট অব ওয়ার্লড-হিস্ট্রি’তে তিনি চলে এসেছেন রবীন্দ্রনাথের এবং বাংলা ভাষায় ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম প্রণেতা রামরাম বসুর কাছে। পার্থ চক্রবর্তী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে জরুরী গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেছেন, কিন্তু তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দি কুমার অব ভাওয়াল এ্যান্ড দি সিক্রেট হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম’ (২০০২) গ্রন্থে গভীর অভিনিবেশ সহকারে উদ্‌ঘাটিত এবং রুদ্ধশ্বাসে পাঠযোগ্য যে একটি ইতিহাস রচনা করেছেন তার ভিত্তিতে রয়েছে ঢাকা জেলার ভাওয়ালগড়ের রাজকুমারত্ব নিয়ে সেই বিখ্যাত মামলা যেটির কথা মুখে মুখে আমরা অনেকেই শুনেছি, গ্রন্থকারও শুনেছেন। ভাওয়ালের রাজকুমারকে নিয়ে মামলার ওই কাহিনিকে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছেন; যুক্ত না করলেও ক্ষতি ছিল না, কেননা সংযোগটি অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু তা এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে শিরোনামে অন্তর্ভুক্তি দাবি করবে। গৌতম ভদ্র অবশ্য ব্যতিক্রম, এইজন্য যে তিনি তাঁর প্রকাশকের মতে, ‘অল্পবিস্তর ইংরেজিতে লিখলেও বাংলাভাষাতেই… স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন’; তাঁকেও দেখছি গভীর গবেষণার ও ইতিহাস বিষয়ে কৌতূহলের সঙ্গে অত্যন্ত প্রাণবন্ত একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন বর্ধমানের জাল রাজা প্রতাপচন্দ্রের ওপর। তাঁর এই গ্রন্থটি ইতিহাসগ্রন্থমালার অন্তর্গত, যার প্রধান সম্পাদক হচ্ছেন রণজিত গুহ নিজে। এই গ্রন্থমালার এ-পর্যন্ত প্রকাশিত আটটি গ্রন্থের তিনটিই বঙ্গদেশকে নিয়ে।

বস্তুত বাংলাভাষায় এবং বঙ্গদেশ সম্পর্কে লেখা ঘরের বিষয়ে লেখার সমতুল্য। বঙ্কিমচন্দ্রের কথা স্মরণযোগ্য। তাঁর পত্রিকার নাম ‘বঙ্গদর্শন’ এবং সে-পত্রিকাতে তিনি বাঙালির ইতিহাস নেই বলে কাতরোক্তি করে ইতিহাস লেখার আবশ্যকতার কথা বলেছেন। জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে ভাষার যে ভূমিকা সেটা বঙ্কিমচন্দ্র জানতেন, নইলে বাংলাভাষী মানুষকে তিনি ‘বাঙ্গালী’ বলবেন কেন, তা তারা যে বর্ণের মানুষই হোক না কেন। কিন্তু তিনিই আবার হিন্দু হয়ে যান, বাঙালিত্বকে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে এবং হিন্দু হয়ে সর্বভারতীয় জাতীয়তার অংশীদার হয়ে পড়েন। ধর্ম একই ভাষাভাষীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে, ঐক্য তৈরি না-করে। মধ্য-ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাভাষা যে শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে জাতীয় পরিচয়ের স্মারক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সে বিষয়টি রণজিৎ গুহ নিজেও লক্ষ্য করেছেন, তাঁর ‘ডমিন্যান্স উদ্আউট হেজিমনি’ বইতে। সেখানে ‘এ্যান আইডিওলজি অব মাতৃভাষা’ প্রবন্ধে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। নিজের পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বর গুপ্ত বলছেন যে, পৃথিবীতে সব জাতির মানুষই নিজেদের জাতীয় ভাষার চর্চা করে থাকে; কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এটি যে, বঙ্গের শিক্ষিত মানুষেরা জাতীয় ভাষার প্রতি কোনও প্রকার মনোযোগ না দিয়ে ইংরেজি ভাষার চর্চায় অধিকাংশ শক্তি ব্যয় করায় ব্যস্ত রয়েছে।

ওইকালে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ভাষা যে কতটা গুরুত্ব পেয়েছিল তা দেশপ্রেমিক অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যিকরা যেভাবে বাংলাভাষার চর্চা করেছেন তার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। না ঔপনিবেশিক কালে, না পরবর্তীতে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যে পূর্ণতা পায়নি সেই ঐতিহাসিক ব্যর্থতার জন্য নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের দুঃখের পেছনে তাই একটি ভ্রমের উপস্থিতি দেখি; সেটি এই যে, ভারতীয়রা তো কখনোই এক জাতি ছিল না, তারা একটি পরিপূর্ণ জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলবে কি করে? যা ছিল না এবং গড়ে ওঠা সম্ভবও নয়, তাকে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা বৃথা কালক্ষেপণ মাত্র। পার্থ চ্যাটার্জি তাঁর ‘দি নেশন এ্যান্ড ইটস ফ্র্যাগমেন্টস : কলোনিয়াল এ্যান্ড পোস্ট-কলোনিয়াল হিস্ট্রিজ’ (১৯৯৪) বইতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনায় ঐক্যের সমস্যাটির কথা তুলেছেন। তিনি বলেছেন যে, বাঙালির ইতিহাস বৃহত্তর ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে আলাদা, এই ধারণাটির মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তার অখন্ডতার বিষয়ে সংশয় নিহিত রয়েছে কি না সেটা একটা জিজ্ঞাসা বটে। বলছেন যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বিকল্প ইতিহাস যদি স্বতন্ত্র ভাবে লেখা যেত ভারতবর্ষের ইতিহাস তাহলে দিল্লীর সিংহাসনকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হতে পারত। কিন্তু ওই রকমের ভিন্ন ইতিহাস রচনার উপাদান যেহেতু এখনও হস্তগত হয়নি তাই স্বীকার না-করে উপায় নেই যে, ভারতবর্ষের জাতীয় ইতিহাসের অখন্ডতার ধারণাই ভারতীয়দেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে। (পৃ ১১৪-১৫) পার্থ চ্যাটার্জির এই মন্তব্য যথার্থ। কিন্তু ভৌগোলিক আঞ্চলিকতা আসল সত্য নয়, আসল সত্য হচ্ছে জাতিগত বিভাজন, যে বিভাজনের ভিত্তি ধর্ম নয়, ভিত্তি হচ্ছে ভাষা।

রণজিৎ গুহ সম্প্রতি যে গ্রন্থটি লিখেছেন—‘হিস্ট্রি এ্যাট দি লিমিট অব ওয়ার্লড-হিস্ট্রি’ (২০০২)—সেটি তিনি উৎসর্গ করেছেন বাংলা ভাষায় প্রথম ইতিহাসগ্রন্থের প্রণেতা রামরাম বসুকে। রণজিৎ গুহ তাঁর গ্রন্থটিতে  জার্মান দার্শনিক হেগেলের ‘প্রাচ্যবাদী’ ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করেছেন। ১৮৩০ সালে হেগেল বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষে কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। অথচ হেগেলের এই মন্তব্যের তিন দশক আগে, ১৮০১ সালে রামরাম বসু বাংলাভাষায় ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ নামে ইতিহাসের বই লিখেছিলেন; সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) তাঁর আইন-ই-আকবরী ও আকবরনামা তো লিখেছিলেন রামরাম বসুরও প্রায় দু’শ বছর আগে, এবং ইতিহাসের গ্রন্থ হিসাবে রচনা দু’টি উৎকৃষ্টতর বলেই স্বীকৃত। রণজিৎ গুহ আবুল ফজলের কথা না বলে রামরাম বসুর কথা যে বলছেন এতে তাঁর নিজের বাঙালি সত্তার প্রকাশ রয়েছে এমনটা বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। আবুল ফজল লিখেছেন ফার্সী ভাষায়, রামরাম বসু বাংলায়। এ-পার্থক্যটা যে অবজ্ঞা করবার মতো নয় সেটাই হয়তো ধরা পড়েছে বাঙালি লেখককে উচ্চাসন দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সে-জন্যই মানতে হয় যে, জাতীয়তাবাদের সংগঠক উপাদানের মধ্যে ভাষাই প্রধান, অন্যসব কিছুর তুলনায়।

১৯৫৬ সালে ভারতে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যের সীমানির্ধারণের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; এই উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিলে ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলার কাজটি সহজ হবে। সেই সঙ্গে অবশ্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সমাজকাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনেরও প্রয়োজন, যার কথা অন্যরা না বলুন নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের বলবার কথা, কেননা তাঁদের অধিকাংশই মার্কসবাদী রাজনীতির পটভূমি থেকে এসেছেন, গ্রামসির প্রতি তাঁদের ঘোষিত আদর্শানুরাগ রয়েছে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজনের বিষয়টি তাঁদের ‘ঘোষণাপত্রে’ উচ্চারিত হয়েছে, সর্বোপরি তাঁরা নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি ইতিহাসের অবজ্ঞায় বিশেষ ভাবে পীড়িত। ইতিহাসের অবজ্ঞা তো সামাজিক অবজ্ঞারই অপর নাম।

পাঁচ

নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের জন্য অসুবিধার আরও একটা জায়গা হচ্ছে সমাজের ইহজাগতিকতা এবং রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে প্রত্যাশিত আগ্রহের অভাব। এঁরা অবশ্যই গণতন্ত্রের পক্ষে, কিন্তু সে গণতন্ত্র তো আসবে না যদি না সমাজে ইহলৌকিকতার এবং রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা ঘটে। ওই প্রতিষ্ঠাই তো প্রথম পদক্ষেপ। ব্যক্তিগতভাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা যে ধর্মের ব্যাপারে দুর্বল তা নয়, তাঁরা সবাই অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ও ইহজাগতিক, তবে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে তাঁরা ধর্মকে গুরুত্ব দেন এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে বুঝতে চেষ্টা করেন। ধর্মকে ওই গুরুত্বদান ও তাকে বুঝবার চেষ্টা ইহজাগতিকতাকে যে সাহায্য করে না সেটা তাঁরা খেয়াল না করলেও আমরা কিন্তু টের পাই। বিষয়টি নিয়ে সুমিত সরকার তাঁর ‘দি ডিক্লাইন অব দি সাবঅলটার্ন’ প্রবন্ধে [‘রাইটিং সোসাল হিস্ট্রি’ (১৯৯৭) বইতে অন্তর্ভুক্ত] আলোচনা করেছেন।

ব্যাপারটা ঘটছে প্রত্যক্ষ নয়, অবশ্যই পরোক্ষভাবে। এই ইতিহাসবিদেরা সামনের ঘটনা নয়, ঘটনার পেছনে যে চেতনা কাজ করছে সেটার অনুসন্ধানে আগ্রহী। ইতিহাসকে তাঁরা কেবল চোখের সামনে প্রবহমান ঘটনা হিসাবে দেখেন না। তাকে মহান বয়ান বলে মনে করেন না, হেগেলের ইতিহাসতত্ত্বে যেমনটা পাওয়া যায়; তাঁরা ইতিহাসের ঘটনার পেছনে কার্যকর চেতনাকে খুঁজতে চান, এবং খুঁজতে গিয়ে তাঁদের জন্য ফুকোর মতো খনন ও কুলপঞ্জী নিরূপণ জরুরী হয়ে পড়ে। অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক কৌতূহলও থাকে, যে-কৌতূহল ফ্রয়েডকে স্মরণ করিয়ে দেয়। চেতনার তলদেশকে খুঁজতে গিয়ে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ইত্যাদির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে স্তরটিকে তাঁরা দেখতে পান সেটি চেতনার। সেখানে বিশ্বাস, সংস্কার, আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি অনেক কিছু রয়েছে। ‘এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজেন্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’  গ্রন্থে ঔপনিবেশিক ভারতের যে কৃষক অভ্যুত্থানগুলোকে রণজিৎ গুহ পর্যালোচনা করেছেন সেগুলোর সময়সীমা ১৭৮৩ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত; এই যে সময়সীমা নির্ধারণ এর কারণ কি? তিনি বলছেন কারণ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীতে এসে কৃষকের বিদ্রোহী চেতনা আর আগের মতো ‘বিশুদ্ধ’ (পিওর) থাকেনি, তাতে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের রাজনীতির লক্ষণীয় অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। বলা বাহুল্য, তাঁর আগ্রহ বিশুদ্ধ চেতনাকে পাঠ করায়। একটি অভ্যুত্থান অপরাপর অভ্যুত্থান থেকে স্বতন্ত্র বটে, কিন্তু সব অভ্যুত্থানই যেহেতু উচ্চবর্গের আধিপত্য-বিরোধী তাই তাদের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। গ্রন্থটিতে কিছু সাদৃশ্যকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এই যে সাদৃশ্য চিহ্নিতকরণ এখানেই ধর্ম এসে গেছে। যে-আসাটা খুবই স্বাভাবিক। ভারতে ধর্মের প্রভাব আধুনিক কালেও রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণা দিয়েও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ভারতীয় সংবিধানে সকল ধর্মের সমান অধিকারই বোঝানো হয়েছে, রাষ্ট্রের ধর্মহীনতা না বুঝিয়ে। প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের কৃষক বিদ্রোহের পেছনে ধর্ম যে একটি কার্যকর অনুপ্রেরণা ছিল তাতে মোটেই সন্দেহ নেই।

কিন্তু ইহজাগতিক বিদ্রোহের পেছনে ধর্মের কার্যকারিতাকে বড়ো করে দেখালে বিদ্রোহের চেহারাটা ভিন্ন রকম হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। ফলে ইতিহাসপাঠে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। রণজিৎ গুহ তাঁর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা, ‘দি প্রোজ অব কাউন্টার-ইনসারজেন্সি’তে দেখাচ্ছেন যে, ১৮৮৫ সালে সাঁওতালরা যখন বিদ্রোহ করে তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী সাঁওতাল নেতা কানু ও সিধু বলেছেন যে, তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন, কেননা তাঁদের দেবতা তাঁদেরকে বিদ্রোহ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অন্যতম, দীপেশ চক্রবর্তী, এই বিষয়টি নিয়ে একটি অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছেন। সেটা হল এই যে, নিম্নবর্গের লোকেরা নিজেরাই তাদের ইতিহাস তৈরি করে বলে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের যে বক্তব্য এখানে তো সেই সত্যটি চ্যালেঞ্জের সামনে এসে পড়ছে, কেননা নিম্নবর্গ তো দেখা যাচ্ছে নিজের ইচ্ছায় কাজ করছে না, কাজ করছে দেবতার ইচ্ছায়। অতিপ্রাকৃতের অনুপ্রেরণায় যদি বিদ্রোহ ঘটে তাহলে সে-বিদ্রোহ তো আর পুরোপুরি রাজনৈতিক থাকে না, অনেকাংশে ধর্মীয় হয়ে পড়ে। অথচ নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার মূল ক্ষেত্রটিই হচ্ছে রাজনৈতিক আন্দোলন।

ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে একেবারে প্রথম পদক্ষেপ; কৃষক বিদ্রোহের পেছনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে রাজনীতিতে ধর্মের ক্ষতিকর পুনর্বাসনে সাহায্য করা হয় কি না সেটা ভাববার বিষয় বই-কি। নিম্নবর্গের মানুষেরা যে আড়াআড়ি ঐক্য গড়ে তোলে ধর্মীয় বিভাজন তার বিরুদ্ধে খাড়াখাড়ি ভাবে নিজেকে স্থাপন করে সে-ঐক্য ভেঙ্গে দেয়। উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক বিরোধের ইতিহাস রাজনীতিতে ধর্মের হস্তক্ষেপের ইতিহাস বৈ অন্যকিছু নয়। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ওই দৌরাত্ম্য থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিজেরাও যে সবসময়ে নিরাপদে থেকেছেন, তাও বোধ হয় নয়। দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর ‘প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ’ (২০০০) বইতে দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছেন যে, তিনি তাঁর লেখায় হিন্দু মধ্যবিত্ত সম্পর্কেই শুধু লিখছেন, মুসলিম মধ্যবিত্তকে আলোচনার আওতায় আনতে পারেননি। এর কারণ হিসাবে তিনি সঙ্গতভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, মুসলিম মধ্যবিত্তের সঙ্গে মিশবার বা তাদেরকে জানবার তেমন সুযোগ তাঁর ঘটেনি। দূরত্বের এই কারণটি যে সাম্প্রদায়িক সেটা কেউই অস্বীকার করবেন না।

এবার অসুবিধার অন্য একটা প্রসঙ্গে আসা যাক। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা সামাজিক ইতিহাস লিখছেন না, তাঁদের ক্ষেত্র রাজনৈতিক ইতিহাসই। রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা। তা ক্ষমতা কোথায় থাকে? উপনিবেশের কালে তো বটেই, অন্যসময়েও ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রণ থাকে রাষ্ট্রের হাতে। উত্তর-আধুনিকেরা ক্ষমতাকে সমাজদেহের সর্বত্র যে প্রবহমান দেখতে পান, তাঁদের সে-দেখাটায় মিথ্যা নেই; কিন্তু যখন তাঁরা রাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে যান তখন ব্যাপারটা যে একপেশে হয়ে পড়ে তাতে সন্দেহ কী। উপনিবেশের কালে রাষ্ট্র ছিল কঠিনরূপে নিয়ন্ত্রণকারী ও আমলাতান্ত্রিক; দেশের মানুষের প্রধান দ্বন্দ্ব ছিল এই রাষ্ট্রের সঙ্গেই। একটি রাষ্ট্রে যে কোনো সময়ে একসঙ্গে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব থাকে, কিন্তু একটি প্রধান দ্বন্দ্বও থাকে বই-কি। ফুকোর অনুসারীরা এটা মানতে চান না, কিন্তু ঘটনাটা সত্য। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের কালে একদিকে রাষ্ট্র অন্যদিকে জনগণ, এই দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্বটাই ছিল প্রধান দ্বন্দ্ব। উচ্চবর্গের লোকেরা ছিল ওই রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী। কিন্তু তারা আবার রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতাতেও লিপ্ত ছিল। নিম্নবর্গের মানুষদের ওপর উচ্চবর্গের যে কর্তৃত্ব তা রাষ্ট্রক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতাতেই শক্তিশালী হয়েছিল, নইলে হতে পারত না। এটা দুঃখের ব্যাপার যে, নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিম্নবর্গের মানুষদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে বিরোধ সেটাকে প্রাধান্য দিতে চান না। এক্ষেত্রে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের একটা নৈকট্য দেখা যায়। নকশালবাড়ি আন্দোলন ছিল পরিপূর্ণরূপে শ্রেণিসচেতন, সংগ্রামটা শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণিরই ঘটেছিল; কিন্তু রাষ্ট্রের যে চরিত্র ও ক্ষমতা সেটাকে আন্দোলনকারীরা বিবেচনার মধ্যে আনেননি; ফলে জোতদার মরেছে, গ্রাম ও শহরের তরুণরা প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের যে বড়ো ধরনের ক্ষতি হয়েছে তা নয়। গ্রামসি এই ব্যাপারটাকে পরিষ্কার ভাবেই বুঝেছিলেন; যে জন্য বলেছেন যে, নিম্নবর্গের মানুষ যে নিম্নবর্গের থাকে তার কারণ নিজেদের কল্পনা ও চিন্তায় তারা রাষ্ট্রকে ধারণ করতে পারে না। আন্দোলনে নিয়োজিত মানুষেরা না বুঝুক, যাঁরা আন্দোলনের ইতিহাস লিখছেন তাঁদের তো ব্যাপারটা না-বোঝার কারণ নেই।

পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত করে, যে জন্য নিম্নবর্গের মানুষদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া কঠিন হয়। আর ঐক্যবদ্ধ যদি তারা না হয় তাহলে তো কোনোকালেই তারা মূল বর্গে পরিণত হতে পারবে না, নিম্নবর্গই রয়ে যাবে, আর উচ্চবর্গের লোকেরা তো সেটাই কামনা করে। শ্রেণি বিভাজনকে অপ্রত্যক্ষ করে দিয়ে উচ্চবর্গের লোকেরা ধর্ম, অঞ্চল, বর্ণ, বর্গ, গোষ্ঠী এসব নানা বিভাজন নিয়ে এসে নিম্নবর্গের আড়াআড়ি বিস্তারটাকে খাড়াখাড়ি ভাগ করে ফেলতে চায়। এবং পারেও। আর ওইসব উচ্চবর্গীয় তৎপরতার সঙ্গে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের বাইরের আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ সরাসরি যুক্ত থাকে। খণ্ডবিখন্ড নিম্নবর্গের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে না-পারাটিই উচ্চবর্গের জন্য আশ্বাসবাণী। গ্রামসি কিন্তু এঁদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নয়, বরঞ্চ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই। ফ্যাসিবাদীদের রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করে তিনি জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, যে জন্য অত্যাবশ্যক ছিল জনগণের রাজনৈতিক দলকে, তাঁর সেই নতুন রাজকুমারকে, শক্তিশালী করা।

না, নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিজেরা অবশ্যই রাজনৈতিক কর্মী নন, তাঁদের দায়িত্ব ঐতিহাসিক সত্যকে তুলে ধরা, সাধারণ মানুষের চাপাপড়া অভিজ্ঞাতগুলোকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলা। কিন্তু এই ইতিহাসবিদেরা তো নিছক দর্শক নন, তাঁরা অঙ্গীকারাবদ্ধ গবেষক। ইতিহাসের বিবরণে উচ্চবর্গের একাধিপত্য তাঁরা ঘোচাবেন, এবং সেটা যে কেবল ভিন্ন ইতিহাস লিখে সম্ভব নয় তাও তাঁরা পরিষ্কার ভাবে জানেন, যে জন্য তাঁদের ঘোষণাপত্রে ভারতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব না-ঘটার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন, অভিযুক্ত করেছেন উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলনের দুর্বলতাকে। তাঁরা ওই বিপ্লব চান। বস্তুত ওই রকমের একটি বিপ্লব ঘটেনি বলেই নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার জন্য তাঁদেরকে এগিয়ে আসতে হয়েছে।

কিন্তু বিপ্লব কেন ঘটল না তার ব্যাখ্যাও তো তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত বটে। এশীয় দেশ চীনে বিপ্লব হয়েছে, ভিয়েৎনামেও হয়েছে, ভারতে কেন হল না, এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত নয়। জবাবটা হয়তো এ রকমের হতে পারে যে, ওই দুই দেশে যথার্থ বিপ্লবী রাজনৈতিক দল কর্মরত ছিল, ফলে উচ্চবর্গের মানুষেরা ছিল ঠিকই, নেতৃত্ব তারাই দিয়েছে, কিন্তু তারা শ্রেণিচ্যুত হতে ব্যর্থ হয়নি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে যে-ব্যর্থতাটা ছিল প্রকট। তদুপরি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কাজ করেনি, আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের নির্দেশের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করেছে, যে-নির্ভরশীলতা নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্রের মধ্যেই প্রোথিত ছিল। এই ব্যাপারটা আমরা অনুমান করতে পারি; ইতিহাসবিদদের পক্ষে সম্ভব এর সত্যমিথ্যা যাচাই করা, এবং আমাদেরকে আলোকিত করা। আবারও বলি, তাঁদের কাছ থেকে আমাদের এই প্রত্যাশার ভিত্তিভূমি হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে তাঁদের সুস্পষ্ট অবস্থান।

রাষ্ট্রের প্রশ্নে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদের কাজের যে সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছি, সেটা কিন্তু শ্রেণির প্রশ্নে দেখা যাবে না। শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের ব্যাপারে এই ইতিহাসবিদেরা বরঞ্চ উচ্চবর্গীয়দের কাছাকাছি একটি অবস্থান নেন। যে-চেতনাকে এঁরা উন্মোচিত করেন তাতে ধর্মসহ সংস্কৃতিই রয়েছে প্রধান হয়ে; তুলনায় শ্রেণিচেতনা তেমন একটা নেই। সংস্কৃতির কথা গ্রামসিও বলেছেন, উচ্চবর্গের অধীনস্ত রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করবার যে আন্দোলন তাতে সাফল্য লাভ করতে হলে কেবল অর্থনীতির নিপীড়ন নয় সাধারণ মানুষের সংস্কৃতিক বোধকেও যে বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে এটা তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন; কিন্তু সংস্কৃতিকে কখনও তিনি রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখেন নি। স্বয়সম্পূর্ণ তো ভাবেনই নি।

গ্রামসির লেখায় আমরা আরও একটি বিষয় পাই, সেটি হচ্ছে ‘নিষ্ক্রিয় বিপ্লব’ (প্যাসিভ রেভুলুশন); যে-বিপ্লব সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন আনে না, বরঞ্চ যথার্থ বিপ্লবকে প্রতিহত করে (দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রামসি ভারতের গান্ধিবাদ ও রুশদেশের টলস্টয়বাদের কথা উল্লেখ করেছেন)। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অন্বেষণের বিষয়গুলোর মধ্যে এই ‘নিষ্ক্রিয়’ বিপ্লব রয়েছে এমনটা বলা যায়। এধরনের বিপ্লবেরও নিজস্ব মূল্য আছে। গ্রামসি মনে করেন সুসংহত (ইনটেগ্রাল) ইতিহাসবিদদের জন্য নিম্নবর্গের নিজস্ব বিদ্রোহী উদ্যোগগুলো অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে [‘সিলেকসনস ফ্রম প্রিজন নোটবুকস’, পৃ. ৫৫]। কিন্তু ওই উদ্যোগগুলোকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা হিসাবে দেখলে যে ভুল করা হবে সেটা তো অবশ্যই সত্য। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা যে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখেন তা অবশ্য নয়, কিন্তু ওইসব উদ্যোগের মধ্যে যে শ্রেণিচেতনা রয়েছে, রয়েছে যথার্থ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আকাঙ্খা তাদেরকে সুসংহত রূপে একটি ঐতিহাসিক বিবেচনার মধ্যে তাঁরা নিয়ে আসেন না। রণজিৎ গুহ তাঁর ‘এলিমেন্টারি আসপেকটস অব পেজেন্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ বইয়ের ভূমিকাতে লিখেছেন, “The object of this work is to try and depict the struggle not as a series of specific encounters but in its general form. The elements of this form derive from the very long history of the peasant‟s subalternity and his striving to end it.”  (পৃ. ১১) নিম্নবর্গের মানুষ নিম্নবর্গে থাকতে চায় না, নিজের দীর্ঘকালীন নিম্নবর্গীয়তা সে ঘোচাতে চায়, তাই বিদ্রোহ করে। কিন্তু তার এই নিম্নবর্তীতা তো কিছুতেই ঘুচবে না যদি না সে ‘নিষ্ক্রিয়’ বিপ্লবের পরিবর্তে স্থায়ী (প্রকৃত) বিপ্লব ঘটাতে পারে। সেই কাজের জন্য সাধারণ শত্রুকে ‘শত্রু’ বলে চিহ্নিত করতে হবে, তার সঙ্গে দ্বন্দ্বটিই যে প্রধান দ্বন্দ্ব তাও বুঝে নিতে হবে, নইলে প্রকৃত বিপ্লব সম্পন্ন হবে এমন ভরসা নেই। নিম্নবর্গের মানুষ যাতে তার অধীনস্ততাকে ছিন্ন করতে পারে তার জন্য তাকে সাহায্য করতে চাইলে তার চেতনার প্রাক-পুঁজিবাদী ‘বিশুদ্ধতা’কে নয়, ওই চেতনার মধ্যে যে সমাজবিপ্লবী উপাদান রয়েছে তাকে চিহ্নিত করা দরকার, এবং নিম্নবর্গকে তার অবস্থা পরিবর্তনে সহায়তা দান করতে হলে ওই উপাদান যাতে আরও বিকশিত হয় সে-ব্যাপারে হস্তক্ষেপই বরঞ্চ বাঞ্ছনীয়।

মোট কথা, পুঁজিবাদী মহান বয়ান যে কার্যকর ব্যবস্থার কথা বলছে, তাকে পরাভূত করতে হলে পাল্টা একটি মহান বয়ানের প্রয়োজন হবে। নিম্নবর্গ তখনই উচ্চবর্গের হাতে তার বশ্যতাকে (হেজিমনি) ছিন্ন করতে পারবে যখন সে পাল্টা হেজিমনির সাহায্যে উচ্চবর্গকে নিজের বশ্যতায় নিয়ে আসতে পারবে, তার আগে নয়। আর না-আনলে সে আদিবাসীই রয়ে যাবে, নাগরিক হবে না, এবং উচ্চবর্গ তো তাকে সেভাবেই রাখতে চায়। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা একাজে নিম্নবর্গের মানুষকে কতটা সাহায্য করছেন সেটা একটা বিবেচ্য বটে। এটা মনে হয় তাৎপর্যহীন নয় যে নিম্নবর্গ ইতিহাসবিদরা মোটামুটি হতাশাবাদী এবং কিছুটা নেতিবাচক। ইতিহাসের যে বিশেষ এলাকায় তাঁরা কাজ করেন সেখানে মানুষের সংগ্রামের পরিণতিতে সাফল্যের দৃষ্টান্ত বড়ো অল্প, ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত অত্যধিক। এই ইতিহাস বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে মানুষকে আশাবাদী করে না, ইচ্ছাশক্তির যে দৃঢ়তার ভেতর দিয়ে আশাবাদ জাগতে পারে তাকেও শক্তিশালী করতে উদ্যোগী হয় না। ফলে ইতিহাসের এই চর্চা নিম্নবর্গের মানুষদের ঐতিহাসিক বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যে সহায়ক হবে এমনটা ভরসা করা কঠিন।

ইতিমধ্যে নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চার ভেতরই একটা অসুবিধা দেখা দিয়েছে। দু’য়েকজন দলত্যাগ করেছেন, যেমন সুমিত সরকার। অন্যদের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যা দেখা যাচ্ছে তা হল গবেষণার জন্য যথার্থ নিম্নবর্গীয় বিষয়বস্তুর অভাব। এঁরা যখন কাজ করেন তখন এঁদের মেধা, মৌলিকত্ব, বিষয়ের অভিনবত্ব, বলবার নতুনত্ব অভিভূত করবার মতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসচর্চার বিরুদ্ধে এঁদের কাজ ছিল একটি অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা, যে-কথাটা এডওয়ার্ড সাঈদ উল্লেখ করেছেন, ‘সিলেকটেড সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’-এর ভূমিকাতে। এখন কিছুটা ক্লান্তি দেখা দিয়েছে। পার্থ চ্যাটার্জী রাজবাড়ি নিয়ে গবেষণা করেছেন; বর্ধমানের প্রতাপচাঁদ নিয়ে ‘জাল রাজার কাহিনি’ নামে বই লিখেছেন গৌতম ভদ্র। চমৎকার কাজ, কিন্তু নিম্নবর্গের সঙ্গে এইসব গবেষণার বিষয়বস্তুর যোগ নিতান্তই প্রান্তিক বটে। দীপেশ চক্রবর্তী এবং পার্থ চ্যাটার্জী কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবন ও সাহিত্য নিয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন; তেমন লেখা প্রথাগত সাহিত্যসমালোচকদের কেউ লিখেছেন বলে আমরা জানি না। গৌতম ভদ্রের লেখা ব্যতিক্রম; অন্যরা তাঁর মতো বাংলায় নয়, ইংরেজিতেই লিখেছেন। তবু, ইংরেজিতে লিখলেও মনে হয়, এসব লেখায় গৃহে প্রত্যাবর্তনের একটা আনন্দ রয়েছে। রণজিৎ গুহ নিজেও এখন আর নিম্নবর্গ নিয়ে লিখছেন না। তাঁর সাম্প্রতিক দু’টি লেখার একটি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে, অন্যটি ইতিহাসের তত্ত্ব নিয়ে। বলাবাহুল্য, দুটি রচনাই ইংরেজি ভাষাতে রচিত।

ইতিহাসতত্ত্বের বইটি মূল্যবান, এর নাম ‘হিস্ট্রি এ্যাট দি লিমিট অব ওয়ার্লড-হিস্ট্রি’, যার কথা আগেই একবার উল্লেখ করেছি। এ বইতে তিনি হেগেলের বিশ্ব-ইতিহাস বিষয়ের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। হেগেলের ইতিহাসদৃষ্টি অসংশোধনীয়রূপে ইউরোপকেন্দ্রিক, বলা যায় ‘প্রাচ্যবাদে’র তিনি প্রধান প্রবক্তা এবং উৎস। হেগেল মনে করেন যে, যাদের লিখিত সাহিত্য নেই তাদের ইতিহাস থাকবার তো কথাই নয়, যারা রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি তাদেরও কোনো ইতিহাস নেই। ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে হেগেলের উচ্চ ধারণা ছিল, ভারতীয়দের বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জনগুলোকে তিনি অন্যন্য ‘প্রাচ্যবাদী’দের দৃষ্টিতে দেখেননি, বরঞ্চ অকুণ্ঠ চিত্তে প্রশংসা করেছেন, কিন্তু তাঁর মতে, সভ্যতার অগ্রগতি সত্ত্বেও ভারতীয়দের সমাজে বর্ণবিভাজন এমনি স্থির হয়ে বসেছিল যে তারা কোনো ইতিহাস লিখতে পারেনি। রণজিৎ গুহ বলছেন, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, হেগেল যখন ওই কথা বলছেন তার প্রায় তিন দশক আগে রামরাম বসু বাংলায় ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ নামে ইতিহাসের একটি বই লিখে ফেলেছেন। ফারসী ভাষায় যে এরও প্রায় দু’শ বছর আগে রামরাম বসুর রচনার তুলনায় উন্নত মানের ভারতীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে সেটা স্মরণ না করে এবং রামরাম বসুর নিজেরও যে ফারসী জ্ঞান ছিল সেটা স্মরণে রেখেও রণজিৎ গুহ যে বাংলাভাষায় রচিত বইকে গুণগত বিবেচনায় প্রাপ্যের তুলনায় অতিরিক্ত মূল্য দিচ্ছেন তার পেছনে জাতিপ্রীতি (বাঙালির প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ) কাজ করেছে এমনটা বললে হয়তো অতিশয়োক্তি করা হবে না। ভারতীয়দের ইতিহাসচর্চার প্রমাণ হিসাবে রামরাম বসুর কাজের দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে অন্য একটি দুর্বলতাও কিন্তু রয়ে যায়; সেটি এই যে, রামরাম বসু তাঁর কাজটি স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে করেননি, করেছেন উইলিয়াম কেরীর নির্দেশে, আর কেরী তখন ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী, অর্থাৎ কিনা ইতিহাসের এই গ্রন্থরচনা যে বিশুদ্ধরূপে ভারতীয় এমন  দাবিকে ষোল আনা সত্যসম্মত বলা যাবে না।

ওই ইতিহাসতাত্ত্বিক গ্রন্থে রণজিৎ গুহের মূল নির্ভরতা অবশ্য অন্যত্র, সেটি হচ্ছে ‘সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা’ নামে একটি প্রবন্ধ, যেটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে লিখেছেন। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান হেগেলের রাষ্ট্রনির্ভর ইতিহাসতত্ত্বের একেবারে বিপরীতে। তিনি বলছেন যে, তাঁর মন বলে ‘দূর হোক গে তোমার ইতিহাস’। যে ইতিহাসকে তিনি নাকচ করে দিচ্ছেন সেটা হচ্ছে তথাকথিত ‘রাষ্ট্রিক ইতিহাস’। ওই ইতিহাস সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা ও বিস্ময়ের খোঁজ নেয় না। অন্যদিকে কবি যে-ইতিহাস রচনা করেন সেটি মানুষের জীবনযাপনের ইতিহাস, সেই ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রটিতে তিনি স্বাধীন; তিনি ব্যবহার করেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ও কল্পনা, রাষ্ট্রিক ইতিহাসের রচয়িতাদের যে-স্বাধীনতা নেই। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নির্ভুল। কিন্তু তাই বলে এটাও বোধ হয় বলা যাবে না যে, কেবল কবি বা সাহিত্যিকই পারেন প্রকৃত ইতিহাস রচনা করতে এবং পেশাদার ঐতিহাসিক মাত্রেই ওই কাজে ব্যর্থ। তাছাড়া রাষ্ট্রকে প্রধান করতে না চাইলেও রাষ্ট্র তো থাকছে, এবং রাষ্ট্রের বাইরে যাওয়া ব্যক্তি বা সমষ্টি কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে ইতিহাসচর্চার ইচ্ছেটা শেষ পর্যন্ত নৈরাজ্যবাদী আকাঙ্খায় পরিণত হতে পারে; নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা আর যাই চান না কেন, নিশ্চয়ই নৈরাজ্যবাদ চাইবেন না। ছোট্ট একটা মন্তব্যও যোগ করা যায়, রণজিৎ গুহের বইটি সম্পর্কে। রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথই, টেগোর নন; এই বইতে এবং নিম্নবর্গের অন্য ইতিহাস বইতেও ব্যতিক্রম বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ দেখছি টেগোর নামেই বারবার উল্লেখিত হচ্ছেন। বঙ্কিমচন্দ্রকে আমরা যেমন বঙ্কিমচন্দ্রই বলি, চ্যাটার্জি না-বলে, রবীন্দ্রনাথকেও তেমনি রবীন্দ্রনাথ বলাই বোধ করি সঙ্গত হবে, বিশেষ করে তখন যখন আমরা ‘প্রাচ্যবাদে’র বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি, কিংবা দাঁড়াতে চাইছি।

 ছয়

উপসংহারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে কি? সেটা ওপরের আলোচনার মধ্যেই বিক্ষিপ্ত আকারে রয়েছে। প্রথম কথা, নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা একটি জরুরী কাজ অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। তাঁরা ইতিহাসে উপেক্ষিত ও উচ্চবর্গের কর্তৃত্বের নীচে চাপা-পড়া মানুষদের অভিজ্ঞতাকে ইতিহাসের অন্তর্গত করেছেন; এবং ইতিহাসের অন্তর্গত করাটা যে আবশ্যক সে-বিষয়েও আমাদেরকে সচেতন করেছেন। উপনিবেশের যুগের তো বটেই পরবর্তী কালেরও ইতিহাসের পাঠকেরা তো অবশ্যই, সাধারণ পাঠকও এঁদের কাছে ঋণী থাকবেন। তবে এটাও বলতে হবে যে, ভারত যে একজাতির দেশ তাঁদের এই ধারণা ইতিহাস দ্বারা সমর্থিত নয়। দ্বিতীয় সত্য এই যে, নিম্নবর্গের (যাদের অধিকাংশই কৃষক) চেতনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ধর্মকে তাঁরা যে গুরুত্ব দিয়েছেন তা সমাজে ইহজাগতিকতা ও রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করেনি, হয়তো-বা কাজটিকে নিরুৎসাহিতই করেছে। তৃতীয়ত, ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের বাইরে দেখার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ রাষ্ট্রকে ছাড় দিয়েছে; রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণি, তাদের অনুচর ও বাইরের কর্তাদের জন্য যে-ছাড় পাওয়াটা সুবিধাজনক হয়েছে। চতুর্থত, তাঁদের গবেষণায় নিম্নবর্গীয় এলাকা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে।

কথা উঠতে পারে ইতিহাসবিদের কাছ থেকে আমরা অতসব সহায়তা আশা করছি কোন যুক্তিতে। যুক্তি আছে। প্রধান যুক্তি তাঁদের নামকরণ। দ্বিতীয় যুক্তি তাঁদের ঘোষিত পক্ষপাত। নামকরণের সঙ্গে আন্তনিও গ্রামসি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ‘সাবঅলটার্ন’ শব্দটি ইংরেজি অভিধানে অবশ্যই আছে, কিন্তু কেবল সেখানে থাকলেই যে এই ইতিহাসবিদদের জন্য তা এমন ভাবে গ্রহণীয় হত সেটা মোটেই নয়। গ্রহণীয় হয়েছে শব্দটি গ্রামসির লেখাতে আছে বলেই। কেবল ‘সাবঅলটার্ন’ নয়, গ্রামসি-ব্যবহৃত ‘হেজিমনি’  প্রত্যয়টিও তাঁরা গ্রামসি থেকেই নিয়েছেন। যা থেকে অনুমান করা যায় যে গ্রামসির মতো দৃঢ়ভাবে না হলেও নিম্নবর্গের মানুষদের নিম্নবর্গত্ব ঘোচাবার ব্যাপারে এঁরাও আগ্রহী বই-কি। নিম্নবর্গের মানুষেরা যে তাঁদের ওই অবস্থানে থাকতে চায় না সেই ব্যাপারটা তো একেবারেই মূলগত, নইলে তারা উচ্চবর্গের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়বে কেন? এই ইতিহাসবিদেরা সেটা জানেন বলেই তো এঁরা তাদের ব্যাপারে উৎসাহী। এঁদের কাজটা তো নৃতত্ত্ববিদের নয়, ঐতিহাসিকের বটে। নৃততত্ত্ববিদরা চাইতে পারেন তথাকথিত আদিবাসীরা আদিবাসীই থাকুক, তাতে নৃতত্ত্ববিদদের গবেষণায় সুবিধা হবে; কিন্তু নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা চান নিম্নবর্গের মানুষ ইতিহাসের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠিত হোক। দেশে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক বিপ্লব যদি ঘটে কেবল তাহলেই যে নিম্নবর্গ উচ্চবর্গের দূরত্বের অবসান সম্ভব এও এঁরা অবশ্যই জানেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে এঁরা বলেছেনও বটে। তাঁদের এই পক্ষপাতটা ঘোষিত। প্রত্যাশার তাই কারণ আছে বই-কি।

রণজিৎ গুহ তাঁর নতুন বই, ‘হিস্ট্রি এট দি লিমিট অব ওয়ার্লড-হিস্ট্রি’র প্রারম্ভে কবি টি.এস.এলিয়টের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে এলিয়ট জিজ্ঞাসা করছেন “After such knowledge what forgiveness?” রণজিৎ গুহ কথাটা হেগেলের এবং রাষ্ট্রিক ইতিহাসের তাত্ত্বিকদের উদ্দেশেই নিবেদন করেছেন; বলতে চেয়েছেন যে, হেগেলীয় ধারণার ভ্রান্তিটা যখন আমরা জানতে পারি তখন হেগেল ও তাঁর অনুসারীদেরকে কি আর ‘ক্ষমা’ করা যায়? নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের ক্ষেত্রে নিম্নবর্গের মানুষেরা অবশ্যই ওই রকমের কোনো উক্তি করতে চাইবে না। তবে তারা বলতে পারে যে, তাদের প্রত্যাশাটা পূরণ হয়নি, এবং নিম্নবর্গের এই ইতিহাসও শেষ পর্যন্ত উচ্চবর্গের মানুষদের হাতেই রচিত, যাঁরা অবশ্যই সহানুভূতিসম্পন্ন, পক্ষপাতে উদ্দীপ্ত, কিন্তু নিম্নবর্গের যে একেবারে আপন মানুষ তা নয়। নকশালবাড়ি আন্দোলনে উচ্চবর্গের প্রতিভাবান মানুষেরা যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা আবার ফিরেও এসেছেন, যেখান থেকে গিয়েছিলেন সেখানেই, কেউ কেউ সরে গেছেন আরও দূরে; নিম্নবর্গ মোটামুটি সেখানেই আছে যেখানে তারা ছিল। প্রান্তবর্তী মানুষদের আপনজন হওয়ার কাজটা সহজ নয়, বিশেষ করে বর্তমানের বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। তবে কঠিন কাজও করতে হয় বই-কি, বিশেষ করে তাঁদের জন্য করাটা কর্তব্যই যাঁরা বিশ্বকে বোঝেন, বুঝবার পরে বিশ্বকে ক্ষমা করতে অপারগ হন, এবং চেষ্টা করেন তাকে বদলে ফেলতে। সে-কাজ অবশ্য ভিন্নকাজ। তবে যাঁরা তা করতে চান তাঁদের পক্ষে ইতিহাসচর্চার নানাবিধ গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখা অবশ্যই প্রয়োজন। অজ্ঞতা শক্তি দেয় না। জ্ঞানই শক্তি দেয়; এবং জ্ঞানকে যদি ক্ষমতার দাসত্ব থেকে ছিন্ন করতে হয় তবে সে-কর্তব্য পালনের জন্যও জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। হয়তো-বা পাল্টা জ্ঞানের; কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে পাল্টা আধিপত্য স্থাপন কীভাবে করা যায়, সেই জ্ঞানের।

নির্বাচিত গ্রন্থ ও রচনাপঞ্জি : 

Antonio Gramsci, ‘Selections from Prison Notebooks’, (London, 1971)

Gary Gutting (ed.), ‘The Cambridge Companion to Foucault’, (Cambridge, 1994)

Ranajit Guha, ‘A Rule of Property for Bengal, An Essay on the Idea of Permanent 

                 Settlement’, (Delhi, 1982)

                ‘Neel Darpan : The Image of a Peasant Revolt in a Liberal Mirror’, Journal

of Peasant Studies, (London, 1974)

                ‘Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India’, (Delhi,

1983)

                ‘The Prose of Counter-Insurgency’, Subaltern Studies II, (Delhi, 1983)

                ‘Dominance Without Hegemony : History and Power in Colonial India’,

                 (Delhi, 1998)

                ‘Nationalism and the trials of becoming’, The Oracle, (Calcutta, August

2002)

                ‘History at the Limit of World-History’, (Delhi, 2002)

                ‘The career of an Anti-god in Heaven and on Earth’, in Ashok Mitra (ed.),

                 The Truth Unites, (Calcutta, 1985)

                 ‘Chandra’s Death’, Subaltern Studies V (Delhi, 1987)

Ranajit Guha & G. Chakravorty Spivak, ‘Selected Subaltern Studies’, (New York, 1988)

Dipesh Chakrabarty, ‘Provincializing Europe : Postcolonial Thought and Historical

                         Difference’, (Princeton, 1999)

                         ‘Habitations of Modernity : Essays in the Wake of Subaltern

Studies’,   (Chicago, 2002)

Partha Chatterjee, ‘The Nation and its Fragments, Colonial and Pastcolonial

Histories’,  (Princeton, 1993)

                      ‘The Kumar of Bhawal & the Secret History of Indian Nationalism’, 

                       (Delhi, 2002)

গৌতম ভদ্র, ‘জাল রাজার কথা : বর্ধমানের প্রতাপচাঁদ’, (কলকাতা, ২০০২)

Sumit Sarkar, ‘Writing Social History’, (Delhi, 1997)

Ashis Nandy, ‘Exiled at Home’, (Delhi, 1994)

Benedict Anderson, ‘Imagined Communities : Reflections on the Origin and Spread of Nationalism’, (London, 1983)

David Luden (ed.), ‘Reading Subaltern Studies’, (Delhi, 2002)

[‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকাতে প্রকাশিত ‘ঔপনিবেশিক ভারতে ইতিহাসের গতিবিধি’ প্রবন্ধের সংক্ষেপিত রূপ।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান