সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়
নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা, যা কিনা সাবঅলটার্ন হিস্ট্রি নামে পরিচিত তা চার দশক অতিক্রম করেছে। ১৯৮২-তে রণজিৎ গুহের নেতৃত্বে এক দল তরুণ ঐতিহাসিক নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার এই ধারা শুরু করেছিলেন। সাবঅলটার্ন স্টাডিজ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে আর প্রথম সাবঅলটার্ন স্টাডিজ সম্মিলন হয় ১৯৮৩-তে। এতদিনের পথ চলার পরে অনেকেই নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চাকে ফিরে দেখতে চেয়েছেন। তার মধ্যে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার কুশীলবরাও আছেন। এই ধারার ইতিহাসচর্চার এক দশক পরেই স্বয়ং রণজিৎ গুহ লেখেন, ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ: প্রজেক্টস অব আওয়ার টাইম অ্যান্ড দেয়ার কনভারজেন্স’। ২০১২-তে পার্থ চট্টোপাধ্যায় লেখেন, ‘আফটার সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’। কিন্তু প্রশ্ন হল এই নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার ধারা সূচিত হওয়ার আগে কি নিম্নবর্গের প্রতিরোধের ইতিহাসকে বিচার করা হত না?
সত্যি কথা বলতে কি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রাথমিক প্রতিরোধগুলো গড়ে উঠেছিল সেইসব বিদ্রোহের প্রধান কুশীলব ছিলেন গরিব মানুষ, ছোটো কৃষক, দেশীয় সেনাবাহিনীর পাইক-বরকন্দাজ এবং জনজাতিরা। অর্থাৎ, এক কথায় নিম্নবর্গের মানুষজন। তাঁদের সেই সব বিদ্রোহের প্রকৃতি বিচার করতে গিয়ে কেউ জোর দিয়েছেন তাঁদের শ্রেণিচরিত্রে, কেউবা ধর্মগত সংহতিতে, আবার কেউবা তাঁদের সম্প্রদায়গত চেতনায়। বিদ্রোহের চরিত্র একরকম ছিল তা নয়। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার ঐতিহাসিকেরা জোর দিলেন নিম্নবর্গীয় চৈতন্যে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৮৫৭-এর বিদ্রোহের আগের বিদ্রোহগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ধরনের আবার স্বতঃস্ফূর্ত।
ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধের প্রথম শতকে যুদ্ধের মূল কুশীলব ছিলেন নিঃসন্দেহে নিম্নবর্গীয় গরিব মানুষ। এইরকম বিদ্রোহীদের ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের কথা বললে প্রথমেই বলতে হয় সন্ন্যাসী ফকিরদের কথা। ১৭৬০-এর দশক থেকেই সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে হিন্দু ও মুসলমান গ্রামবাসীরা বিদ্রোহী হন। এই বিদ্রোহে প্রধান নেতা ছিলেন মজনু শাহ ও ভবানী পাঠক। এর বিস্তৃতি ছিল সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে, পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ অঞ্চলে এবং বিহারে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় ছিল এই বিদ্রোহ। এই যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে বহু গ্রামবাসী নিহত হন। অনেক ইংরেজ সেনাও এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন। শেষ অবধি ইংরেজরা বর্বর অত্যাচার করে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। ১৭৮৬-তে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে, কালেশ্বরে মজনু শাহ মারাত্মকভাবে আহত হন। এই আঘাতের যন্ত্রণা থেকে তিনি আর কোনোদিন মুক্তি পাননি। পরে বিহারের মাখনপুরে এক গোপন ডেরাতে মজনু মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর অনুচরেরা, বিহারে শোভন আলি, বাংলায় মুশা শাহ ও চেরাগ আলি বিদ্রোহের আদর্শকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ দমনপীড়নের মুখে বেশিদিন তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
একই সময়ে আরও কয়েকটি ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধ হয়েছিল। যেমন ১৭৮৩-৮৪-তে উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলায় কৃষক বিদ্রোহ; ১৭৬৯-১৭৯৯ জুড়ে রাঢ় বাংলায় চুয়াড় বিদ্রোহ যার অন্যতম নেতা ছিলেন গোবর্ধন দিকপতি; পুরীর বক্সী জগবন্ধুর নেতৃত্বে ওড়িশার ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে পাইক বিদ্রোহ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে একের পর এক বিদ্রোহ হয়েছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। উল্লেখ করা যায় ১৮১০-১৮১৬ সময়কালে মেদিনীপুর জেলায় অচল সিংহের নেতৃত্বে পাইক বিদ্রোহ, ১৮২৫-১৮২৭-এ টিপু গারোর নেতৃত্বে ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বিদ্রোহ, ১৮৩০ ও ১৮৪০-এর দশকে যথাক্রমে তিতুমীরের নেতৃত্বে চব্বিশ পরগণায় ওয়াহাবি বিদ্রোহ এবং শরিয়তউল্লাহ ও দুদু মিঞার নেতৃত্বে ফরিদপুর জুড়ে ফরাইজি বিদ্রোহ।
ইংরেজবিরোধী যুদ্ধে জনজাতি বিদ্রোহের কাহিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রথমে উল্লেখ্য ১৮৩০-১৮৩৩ সময়কালে ছোটোনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা জনজাতি বিদ্রোহ। রাঁচি থেকে মানভূম অবধি বিস্তৃত এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন হো এবং মুন্ডারা। ব্রিটিশরা দমননীতি প্রয়োগ করে এই বিদ্রোহ থামায়। তবে বিদ্রোহ থেমে থাকে না। পরাধীন ভারতের প্রথম একশো বছরের মধ্যে সংঘটিত জনজাতি বিদ্রোহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে ১৮৫৫-১৮৫৬ সালে কানু এবং সিধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সাঁওতাল বিদ্রোহ, যা ঘটেছিল বাংলার মুর্শিদাবাদ আর বিহারের ভাগলপুর জেলার মধ্যবর্তী দামিন-ই-কো অঞ্চলে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে একজন সহযোগীর বিশ্বাসঘাতকতায় সিধু ধরা পড়েন, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কানু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়া পড়েন। বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। ব্রিটিশরা তাঁর ফাঁসি দেয়। তবে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি দৃঢ়তা হারাননি।
প্রাথমিক পর্বে সম্পদের নিঃসরণ ঘটানোর পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সচেষ্ট হয়েছিল এদেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে আয় সুনিশ্চিত করতে, সেই লক্ষ্যেই ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ভূমি-রাজস্বর ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে অর্থনীতি ও সমাজে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এদেশের কৃষি-সমাজে আঘাত করার প্রতিক্রিয়ায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নানান জায়গায় স্থানীয় স্তরে কৃষক বিদ্রোহ দেখা গেল। নিশ্চিতভাবেই এই সমস্ত বিদ্রোহের মূল নিহিত ছিল অর্থনীতির মধ্যে, কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক কারণজনিত বিদ্রোহ হিসেবে এই বিদ্রোহগুলোকে চরিত্রায়িত করা যায় না। এর পেছনে দায়ী ছিল ধর্ম, সামাজিক অসন্তোষ, বিদ্রোহীদের মানসিকতা ইত্যাদি। তবে নিঃসন্দেহে একথা বলা যায় যে, এই বিদ্রোহগুলোর বীজ নিহিত ছিল কৃষক অসন্তোষের মধ্যে।
ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনে প্রাথমিকভাবে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তার কুশীলব ছিলেন কৃষক এবং কৃষি সম্পর্কিত পেশায় যুক্ত গ্রামীণ মানুষ। এই কৃষক বিদ্রোহগুলো প্রাথমিকভাবে দেখলে হয়তো ব্রিটিশ শাসকবিরোধী বলে মনে হয় না কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে জমিদার এবং মহাজন-জাতীয় স্থানীয় প্রভুবিরোধী বিদ্রোহও আসলে ছিল ব্রিটিশবিরোধী অভ্যুত্থান। এই সমস্ত কৃষক বিদ্রোহের বিভিন্ন দিক রয়েছে। তবু এটা মানতেই হবে যে ব্রিটিশ শাসক প্রবর্তিত ভূমি বন্দোবস্তর ফলেই কৃষি-সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। তারই ফলে দেখা দিয়েছিল এইসব কৃষক বিদ্রোহ। এই কৃষক বিদ্রোহগুলো ছিল স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ। এক জায়গার কৃষক বিদ্রোহের সঙ্গে অন্য জায়গার কৃষক বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না, তবে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই নানান মিল ছিল। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক রূপ বোঝানো যায় না, পাশাপাশি বুঝতে হয় সমাজ এবং সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানও, যেমন ধর্ম, মানসিকতা, সংগঠন ইত্যাদি। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রাথমিকভাবে জানা দরকার ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমি বন্দোবস্তর ফলে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল, যা কৃষক বিদ্রোহগুলোকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে সমস্ত ভূমি বন্দোবস্ত বলবৎ করেছিল তার ফলে ভূমিরাজস্বের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছিল। ব্রিটিশ ভূমি বন্দোবস্ত প্রবর্তনের আগে ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় কর প্রদানও ব্যক্তিগত ছিল না। কৃষকদের কর দিতে হত সমবেতভাবে কারণ ভূমির মালিকানা ছিল যৌথ। আর এই কর দেওয়া হত উৎপন্ন (শস্য) পণ্যের মাধ্যমে। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পর যখন জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হল তখন ভূমিকরও ব্যক্তিগতভাবে প্রদান করার রীতি প্রবর্তিত হল। আর এও বলা হল যে এই কর শস্যর মাধ্যমে দিলে হবে না, দিতে হবে নগদের মাধ্যমে। ফলে কৃষকরা কর প্রদান করার জন্য বাধ্য হলেন উৎপন্ন শস্য বিক্রি করার জন্য, ফসল ওঠার মরশুমেই তা বাজারে নিয়ে যেতে। বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় শস্যের দাম কমে গেল। ফলে আগে ভূমিরাজস্ব দেওয়ার জন্য কৃষককে তার উৎপন্ন ফসলের যত অংশ দিতে হত এখন তাকে ভূমিকর দেওয়ার জন্য উৎপন্ন শস্যের আরও বেশি পরিমাণ অংশ বিক্রি করতে হল। ফলে সারা বছর ধরে চালাবার মতো ফসল তার কাছে আর বিশেষ রইল না। ফসলের সঙ্গে সঙ্গে টাকাও আর তার হাতে রইল না। ফলে তার পক্ষে সারা বছর ক্ষুন্নিবৃত্তি করাটাই কঠিন হয়ে পড়ল। এই অবস্থায় কৃষকের পক্ষে জীবন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ল। তখন তার সামনে একমাত্র বিকল্প রইল টাকা ধার নেওয়া। আগে তার পক্ষে অর্থ ঋণ পাওয়া কঠিন ছিল কিন্তু এখন ঋণ পাওয়া তুলনায় অনেক সহজ হয়ে গেল। এর কারণ জমিতে কৃষকের ব্যক্তিগত মালিকানা। যেহেতু ব্রিটিশ প্রবর্তিত ভূমি বন্দোবস্তে জমির উপর কৃষকের মালিকানা স্বীকৃত হল সেহেতু জমি বিক্রি করার বা বন্ধক দেওয়ার অধিকার পেলেন কৃষকরা। কৃষিজীবী মানুষ জমি বিক্রির কথা সহজে ভাবেন না। তাই মহাজনের কাছে জমি বন্ধক দিয়ে টাকা ধার নিলেন কৃষক। সুদের হার চড়া। কৃষক কষ্ট করে কিছু দিন সুদ দিলেন, আসল ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য তার হল না। কিছুকাল পরে সুদ দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। স্বভাবতই তার বন্ধক দেওয়া জমি বাজেয়াপ্ত করে নিলেন মহাজন। এই মহাজন অনেক সময়ই জমিদার। এই মহাজনি জমিদারকেই বছরের গোড়ায় তার উৎপন্ন ফসল বিক্রি করেছিলেন কৃষক। আবার তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে পরে নিজেরই উৎপন্ন ফসল কিনতে হল কৃষককে।
‘আইন’ অনুসারেই কৃষক তার বন্ধক দেওয়া জমি হারালেন। হাতে ফসল বা অর্থ কিছুই রইল না। কৃষক দেখলেন নতুন ব্রিটিশ ভূমি বন্দোবস্তর ফলে জমিদার/ মহাজনের যে চক্রে পড়ে তিনি তার জীবিকা নির্বাহের জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হলেন সেই চক্র থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় হিসেবে তার সামনে রইল আন্দোলন। কাজেই প্রতিরোধের পটভূমি হিসেবে এই পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় রাখা দরকার।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে বাংলায় যে-সমস্ত নিম্নবর্গীয় বিদ্রোহ হয়েছিল তা বৈশিষ্ট্যর দিক থেকে ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই বিদ্রোহগুলো অনেক সময়ই প্রাথমিকভাবে ছিল ধর্মীয় সংহতি সৃষ্টির জন্য সূচিত। তিতুমীর পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলন বা শরিয়ত উল্লাহ-দুদু মিঞার নেতৃত্বাধীন ফরাইজি আন্দোলন প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল ধর্মীয় সংস্কার করার জন্য। ইসলাম ধর্মাবলম্বী এই দুই আন্দোলন ছিল ইসলামের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে ধর্মসংস্কার আন্দোলন। এই ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হওয়া আন্দোলন গ্রামীণ মানুষদের সংহত করেছিল যারা অধিকাংশই ছিলেন কৃষক। এই সংহতি গ্রামের ক্ষমতাগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করেছিল। জমিদাররা ভয় পেয়ে দমনপীড়ন চালিয়েছিলেন। বিদ্রোহী কৃষকরা দেখেছিলেন তারা আইনের শাসনে সুবিচার পাচ্ছেন না। জমিদারকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে পুলিশ-বিচারক। ব্রিটিশ আইন তাদের আরও শোষণ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে। ফলে তারা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হতেন। এই বিদ্রোহের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল জমিদার বা মহাজনের কাছে বন্ধকিকৃত জমির দলিল বা ঋণের চুক্তিপত্র নষ্ট করে দেওয়া। এই আক্রমণাত্মক আন্দোলনগুলো ক্ষমতাশীল ব্যক্তিকে আঘাত না করে এই কাগজপত্রগুলো নষ্ট করতে চাইত।
এর পাশাপাশি মুসলমান বা নিম্নবর্গীয় হিন্দু– উভয়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল এই যে সব জমিই আসলে আল্লার বা ঈশ্বরের। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা তাই অবৈধ। এই চেতনা জমিদারদের পক্ষে লড়াই করার সময় বিদ্রোহী কৃষকদের নৈতিক শক্তি প্রদান করে। আসলে নিম্নবর্গ, তা সে হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক না কেন তাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। এর মূলে নতুন ভূমি ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়। ১৭৯৩ থেকে ১৮৪৫-এর মধ্যে হওয়া নতুন আইনও পুরোপুরিই ছিল জমিদারদের অনুকূলে। ফলে বিদ্রোহী কৃষকদের মধ্যে তাদের হারানো অবস্থা ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। ধর্মগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যর সঙ্গে কৃষকচৈতন্য যুক্ত হয়ে যায়। স্বধর্মে আসক্ত কৃষকনেতাদের রাজশক্তি বিরোধিতা এখানে উল্লেখযোগ্য। বিদ্রোহীদের ধর্ম আর রাজধর্ম (হিন্দু জমিদার-ব্রিটিশ শাসক)-র বিরোধই মূল উপজীব্য। ধর্ম যথেষ্ট নয়, সেই ধর্ম রাজশক্তির সঙ্গে না মেলাতেই তার ধর্মোন্মত্ততা প্রবল হয়ে ওঠে। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা, যেমন সুপ্রকাশ রায়, নরহরি কবিরাজ প্রমুখ ওয়াহাবি, ফরাইজি বিদ্রোহকে ধর্মের আবরণে ঢাকা কৃষক বিদ্রোহ এবং শ্রেণিসংগ্রাম আখ্যা দিয়েছেন। এই আন্দোলনগুলোয় সাম্প্রদায়িক দিক থাকলেও তা এঁদের কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এঁদের মতে, ধর্মের পোশাকে এই বিদ্রোহ ছিল কৃষক আন্দোলন যার মূল দিক হল জমিদারের বিরুদ্ধে রায়তের লড়াই। এখানে শ্রেণি সংগ্রামে ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে। নরহরি কবিরাজের মতে সামন্ততান্ত্রিক দুনিয়ায় ধর্মই হল সেই মাধ্যম যা কৃষক সহজে বুঝতে পারেন। সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন, “ধর্মতন্ত্র ও শিল্পবিকাশের পূর্ব যুগে প্রায় প্রত্যেক দেশে এই প্রকার ধর্মীয় ধ্বনির সাহায্যেই কোনও যুদ্ধ বা বিদ্রোহর জন্য ব্যাপক জনসমাবেশের পন্থা গ্রহণ করা হইত।… বিদেশি আক্রমণের ফলে এখন ভারতের প্রাচীন গ্রাম্য সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া চুরমার হইয়া গিয়াছিল।… তৎকালীন অবস্থায় জনসমাবেশের জন্য ধর্মের ধ্বনির আশ্রয় গ্রহণই ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক ও অনিবার্য ঘটনা।” তাঁর মতে, “ওয়াহাবী আন্দোলন প্রথমে ধর্মের বুলি লইয়া আরম্ভ হইলেও ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণবিদ্রোহে পরিণত হইয়াছিল।” প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহগুলোকে একমাত্রিকভাবে ‘সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ’ বা ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ কিছুই বলা যায় না। গৌতম ভদ্রর কথায় বলা যায় এই বিদ্রোহগুলো ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন। গৌতম ভদ্রের মতে, “এই নিম্নকোটির মানুষের জোরের উৎস আসে দুটি ক্ষেত্র থেকে– (১) সম্প্রদায় হিসেবে সংহতির জোর আর (২) নিজের ইমানের জোর। জীবনচর্চায় আর নৈষ্ঠিক ধর্মচর্চায় নিজেকে অপরের চাইতে সঠিক পথের রাহি হবার বিশ্বাস। এখন যদি একজন জোলা বা নিকারি নিজের জীবনে হজরত মহম্মদর ছায়া দেখতে পায়, সেই নীতিতে জীবন গঠিত করে, তবে তা কায়েমি ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে যেতেই পারে, সম্প্রদায়ের ঘোষিত বা তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন।”
এই নিম্নবর্গীয় বিদ্রোহগুলোকে ‘মিলেনেরিয়ান মুভমেন্ট’-এর অন্যতম বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ এই আন্দোলনগুলোর পেছনে এক বিরাট সংখ্যক মানুষের বহু-ব্যাপক বিশ্বাস কাজ করত। সেই বিশ্বাসটা হল সুদিন আসছে। Stephen Fuchs তাঁর ‘Rebellious Prophets : A Study of Messianic Movement in Indian Religion’ বইতে মন্তব্য করেছেন, সমকালীন জীবনধারণে দুর্দশাজনিত অসন্তোষ থেকেই আগের ‘স্বর্ণযুগ’-এর (‘সে এক সুদিন ছিল’) দিকে ফিরে যেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যায়। কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, এই সুদিন ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন ‘মেসায়া’ বা ঈশ্বরের দূত। বিদ্রোহীরা মনে করতেন আন্দোলনের নেতা ঈশ্বরপ্রেরিত প্রতিনিধি বলে অজর-অমর। তাদের এই ধারণাকে পুষ্ট করেছিল দু-একটি ঘটনা। যেমন তিতুমীরের নেতৃত্বাধীন ওয়াহাবি বিদ্রোহের ক্ষেত্রে বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার বাঙালিদের সাহস সম্পর্কে খুব হীন ধারণা পোষণ করতেন। বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করলেই তিতুমীররা পালাবে এই ধারণা থেকে তিনি বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করার নির্দেশ দেন। তাতে তিতুর দল অক্ষত থাকায় তিতুর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা সম্বন্ধে সঙ্গীসাথিদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়। ‘তিতুমীর মেসায়া’– এই বিশ্বাস আরও ছড়িয়ে পড়ে। এই বহু-ব্যাপক বিশ্বাস প্রাক্-১৮৫৭ বিদ্রোহগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
নিম্নবর্গর মধ্যে ধর্মের ভেদ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকই এই বিদ্রোহে শামিল হতেন। কৃষক ব্যতিরেকে নিম্নবর্গীয় জোলা বা তাঁতি, জমিদারের জমিদারির কর্মচারী (যেমন লাঠিয়াল)-রাও এই ধরনের বিদ্রোহে শামিল হতেন। এই নিম্নবর্গীয় বিদ্রোহগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ইসলাম ধর্মের সংস্কারের উদ্দেশ্য সামনে আসার বিশেষ কারণ ছিল। অষ্টাদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন এবং তারপরের রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতীয়দের মধ্যে, বিশেষত মুসলমান সমাজে এক তীব্র হতাশা সৃষ্টি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামকে বিশুদ্ধ রাখার প্রয়াস শুরু হয়। চেষ্টা চলতে থাকে ইসলাম থেকে অনৈসলামিক অংশ বা বিদত বাদ দেওয়ার। এই পর্বকে মুসলমাম সমাজের সত্তা সংকট থেকে মুক্তি লাভের প্রয়াসপৰ্ব রূপে চিহ্নিত করা চলে। চেষ্টা চলে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পৃথক গোষ্ঠীরূপে মুসলমাম সমাজ গড়ে তোলার। আসল লক্ষ্য ছিল দার উল ইসলাম বা ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
এই বিদ্রোহগুলোর মাধ্যমে সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষ ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বা দলের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। এখানে বলা দরকার, রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, শহরের শ্রমিক ও গরিব, সর্বোচ্চপদের আমলাদের বাদ দিয়ে মধ্যবিত্তের বাকি অংশকে এবং গ্রামের ক্ষেতমজুর গরিব চাষি ও প্রায় গরিব মাঝারি চাষিদের। আর তাঁর মতে, উচ্চবর্গ হল ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষে যারা প্রভুশক্তির অধিকারী ছিল। প্রভুগোষ্ঠীকে তিনি আবার দেশি ও বিদেশি দু-ভাগে ভাগ করেছেন। আবার বিদেশিদের মধ্যেও রয়েছে দুটি ভাগ; সরকারি আর বেসরকারি। সরকারি বলতে গণ্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অভারতীয় কর্মচারী ও ভৃত্য সকলেই, আর বেসরকারি বলতে গণ্য বিদেশিদের মধ্যে যারা শিল্পপতি, বণিক, খনির মালিক, জমিদার, নীলকর, খ্রিস্টান মিশনারি– সবাই। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে এত বিচিত্র এবং বিস্তৃত এই উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের পরিধি যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে নিম্নবর্গীয় বিদ্রোহের সামগ্রিক রূপ বোঝানো যায় না। প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিদ্রোহী কৃষকদের মনস্তত্ত্ব বা মানসিকতা বিশ্লেষণ করা, যে কাজটা নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকরা করার চেষ্টা করেছেন। নিম্নবর্গীয়দের নানা বিশ্বাস এবং ধারণা তাঁদের প্রতিরোধের সংকল্পকে প্রভাবিত করে। একটি বিশ্বাস কৃষকদের নিজেদের এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর আপেক্ষিক শক্তি সম্পর্কিত। বিদ্রোহ এক অর্থে ক্ষমতার লড়াই; কখনও সেই ক্ষমতার ক্ষেত্র কোথাও সংকীর্ণ, কোথাও ব্যাপক। শত্রু অপ্রতিরোধ্য নয়, এই বিশ্বাস না থাকলে সংঘবদ্ধ আন্দোলন সহজে গড়ে ওঠে না। কৃষকদের বিচার বস্তুনিষ্ঠ নাও হতে পারে। হয়তো কখনও তারা তাদের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেখে, কখনও শত্রুর ক্ষমতাকে কমিয়ে দেখে। এমন কথাই বলেছিলেন বিনয়ভূষণ চৌধুরী তাঁর ‘ধর্ম ও পূর্ব ভারতের কৃষক আন্দোলন ১৮২৪-১৯০০’-এ।
বিদ্রোহীরা কি সব সময় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মাথায় রেখে বিদ্রোহ শুরু করে? ফ্রান্স, রাশিয়া এবং চিনের সামাজিক বিপ্লবের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে Theda Skocpol তাঁর ‘States and Social Revolutions : A Comparative Analysis of France, Russia and China’ বইতে জানাচ্ছেন, বিপ্লবী আন্দোলন কদাচিৎ বিপ্লবী উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়, সংগ্রামের গতিপথে তা বিকাশ লাভ করে। আবার বিনয়ভূষণ চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, “প্রায়ই দেখা গেছে, বিদ্রোহীদের প্রথম ঘোষিত লক্ষ্য পরে অনেক পালটে গেছে। যে ধারণার উপর কোনো কোনো নূতন লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত, তার উৎস কৃষকদের অতীত দিনের যৌথ স্মৃতি, সে অতীত কোথাও বা সুদূর, কোথাও নিকট। বহু বাস্তব অভিজ্ঞতা এ স্মৃতিতে বিধৃত হয়ে আছে, কিন্তু তাই স্মৃতির একমাত্র উপাদান নয়। সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষকদের সহজাত আকাঙ্ক্ষা, অনিবার্য আশাভঙ্গ, নূতন স্বপ্ন রচনা, এবং আরও অনেক কিছু স্মৃতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলে। অতীতের প্রায়-বিস্মৃত এমন মুহূর্তও এমনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তাই, কৃষকদের সাম্প্রতিক শ্রেণি-সম্পর্ক এ অতীত-চারণা, ইতিহাস-চেতনার একটি উপলক্ষ্য মাত্র। অর্থাৎ যে ধারণা ও বিশ্বাস প্রভাবিত হয়ে বিদ্রোহীরা তাদের লক্ষ্য স্থির করে তা অত্যন্ত জটিল।”
এই জটিলতাকেই বুঝতে চেয়েছেন রণজিৎ গুহ (১৯২৩-২০২৩)। প্রথাগত উপাদান ব্যবহার করেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রথম গবেষণাগ্রন্থ ‘এ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’ যাতে তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাতের ইতিহাস, যা প্রথম বেরিয়েছিল ১৯৬৩-তে। তবে তার আগেই ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেছিলেন এই বিষয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তার কথা। তবে তাঁর খ্যাতি যে কারণে বিশ্বজোড়া তা হল ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাব-অল্টার্ন হিস্ট্রি বা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার ধারার প্রবর্তন করা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২-তে আর ১৯৮৩-তে বের হল রণজিৎ গুহের লেখা বই ‘এলিমেন্টারি অ্যাসপেক্টস অব পেজান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’। সেই বইতে রণজিৎ গুহ ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক অভ্যুত্থানের পেছনে বিদ্রোহী কৃষকদের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করলেন। আর এক্ষেত্রে কৃষক অভ্যুত্থানের প্রাথমিক উপাদানসমূহকে বিবেচনা করতে গিয়ে ছ-টি উপাদানকে নির্দিষ্ট করলেন তিনি। সেগুলি হল: নেতিবাচকতা (Negation), অস্পষ্টতা (Ambiguity), পদ্ধতি (Modality), সংহতি বা একতা (Solidarity), যোগাযোগ বিস্তার করা (Transmission) এবং ভূখণ্ডগত অবস্থান (Territoriality)।
নেতিবাচকতার কথা বলতে গিয়ে রণজিৎ গুহ দেখালেন, শুধুমাত্র বিদ্রোহের মাধ্যমেই যে কৃষক নিজের সম্বন্ধে সচেতন হন তা নয়। তার আত্মপরিচিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ক্ষমতাশীলদের শ্রেণি, বর্ণ এবং ক্ষমতার সাপেক্ষে। কৃষকের ওপর যাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত সেই জমিদার শ্রেণির সম্পদ, মর্যাদা এবং সংস্কৃতির নিরিখে কৃষককের আত্মসচেতনতা তৈরি হয়। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যর জন্য কৃষকের মনে ওপরের স্তরের বিরুদ্ধে একটা নেতিবাচক মানসিকতার বিকাশ ঘটে। এই নেতিবাচক মানসিকতার কারণ নিছক অর্থনৈতিক ব্যবধান নয়, এর সঙ্গে রয়েছে এক বিরাট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদার ব্যবধান। মূলত এই অবস্থানগত মর্যাদার ব্যবধানের জন্যই কৃষকের মনে ক্ষমতাগোষ্ঠীর প্রতি এক নেতিবাচকতার বিকাশ ঘটে। কৃষক যখন জমিদারের কাছে বা থানার দারোগার কাছে অপমানিত হন তখন তিনি এই বৈষম্য বুঝতে পারেন। তার মধ্যে নেতিবাচকতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই নেতিবাচকতার তত্ত্বের জনক হলেন ইতালির মার্কসবাদী চিন্তক আন্তোনিও গ্রামশি। তিনি কৃষকের শ্রেণিগত পরিচিতি ব্যাখ্যা করার জন্য এই তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন।
এই নেতিবাচকতা থেকেই বিদ্রোহী কৃষক, জমিদার বা ক্ষমতাগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে চান। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কে হবে তা কৃষক নিজের বিবেচনা অনুযায়ী ঠিক করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের কৃষক বিদ্রোহে আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন জমিদার দেবী সিং। ১৮৩২-র কোল বিদ্রোহে এবং পরবর্তী কালে অনুষ্ঠিত সাঁওতাল বিদ্রোহে আক্রমণের লক্ষ্য ছিল উপজাতি নয় এমন সম্প্রদায়। সাঁওতালরা বহিরাগতদের ‘দিকু’ আখ্যা দিয়ে তাদের আক্রমণ করেন।
কৃষকেরা তাদের ওপর আধিপত্যকারী শক্তির ক্ষমতার ধ্বংস চাইতেন। এর মধ্যে ছিল দলিল-দস্তাবেজ, বন্ধকি কাগজপত্র ইত্যাদি, যেমন দেবী সিংহের কাছারি বাড়ি আক্রমণের সময়ে বিদ্রোহী কৃষকরা দেবী সিংহের যাবতীয় কাগজপত্র, বন্ধকি দলিল পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। একইভাবে তিতুমীরের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী কৃষকরা নীলকুঠি আক্রমণের সময় তিনকাঠিয়া সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রণজিৎ গুহর মতে কৃষক অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল অস্পষ্টতা। বিদ্রোহর গতিপ্রকৃতিতে স্পষ্টতা না থাকা এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কৃষক বিদ্রোহের আগে কিছু হিংসাত্মক ঘটনা লক্ষ করা যায়। চিরাচরিত ইতিহাস রচনায় এই ঘটনাগুলোকে কৃষককৃত অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অধ্যাপক গুহর মতে, এগুলোকে অপরাধ বলা যায় না। চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং অত্যাচারের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে কৃষক আক্রমণাত্মক প্রতিবাদের পথ বেছে নেন। এই ‘হিংসাত্মক ঘটনা’-র মাধ্যমে কৃষকের দুর্দশাজনিত অসন্তোষ-এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর কেন্দ্রীয় পরিচালক শক্তি থাকে না তাই এই ধরনের প্রতিবাদ হয় বিক্ষিপ্ত ধরনের। এর উদাহরণ হিসেবে ১৮৫৫-র সাঁওতাল বিদ্রোহর কথা বলা যায়। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন এই ধরনের প্রত্যক্ষ বিক্ষিপ্ত আক্রমণাত্মক কাজের পেছনে ষড়যন্ত্র থাকে না। এটি হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অস্পষ্টতা হিসেবে চিহ্নিত এই বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধ্যাপক গুহ এটাও দেখিয়েছেন যে বিদ্রোহীরা যে লুঠ বা ডাকাতি করতেন তা ছিল সামাজিক ডাকাতি। ইংল্যান্ডের রবিন হুডের সাথে তুলনা করে তিনি এই বিদ্রোহী ডাকাতদের গরিব মানুষের পক্ষে কাজ করার কথা বলেছেন।
বিদ্রোহের পদ্ধতিও বিশেষ পর্যালোচনার দাবি রাখে। বিদ্রোহের জনচরিত্র কী? কোল এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ রাজ-বিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বিদ্রোহের সমর্থনে জনসাধারণের সম্মতির কথা বলা হয়। প্রকাশ্যভাবে তাদের বিদ্রোহর লক্ষ্য ঘোষণা ছিল অভ্যুত্থানের এক ধরনের পদ্ধতি। যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা জমিদারদের নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করতেন। এর পেছনে ঈশ্বরের অনুমোদনের কথা বলা হত। যেমন সিধু ও কানু ঈশ্বরের ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য আক্রমণ করতে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্রোহের সময় প্রকাশ্যে চাঁদাও তোলা হত। দেবী সিংহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহর ক্ষেত্রে দেবী সিংহকে হত্যা করার কথা বিদ্রোহী কৃষকরা আগে থেকেই ঘোষণা করেছিলেন।
পদ্ধতিগতভাবে বিদ্রোহ ছিল যৌথ আন্দোলন। বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার মতো সংগঠন গড়ে তোলা হত। বিদ্রোহর সিদ্ধান্ত ছিল যৌথ। একসঙ্গে মিলিত হয়ে বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত। বিদ্রোহ চলার সময় যাতে প্রত্যেকে সব খবর পান সেই ব্যবস্থাও করা হত। যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহে প্রত্যেকে যাতে খবর পায় সেজন্য নির্দিষ্ট তথ্যের বাহক হিসেবে শালপাতা বিলি করার পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। বিদ্রোহের যৌথ চরিত্রের আর একটা নিদর্শন হল বিদ্রোহে প্রাপ্ত লুণ্ঠিত জিনিসপত্র কেউ ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতেন না, তা সমগ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে বণ্টন করা হত। এই যৌথ আন্দোলন জীবনযাপনের মধ্যেই নিহিত ছিল। যেমন উপজাতীয় কৃষকরা মাছ ধরতে যাওয়ার সময় বা শিকার করতে যাওয়ার সময় যৌথভাবে অংশ নিতেন। বিদ্রোহের সময়ও বিদ্রোহীরা নিজের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী যৌথভাবে প্রত্যক্ষ আক্রমণ পরিচালনা করতেন।
এই আক্রমণ পদ্ধতির চারটে স্তর উল্লেখ্য, এগুলি হল ভাঙচুর করা (wrecking), পুড়িয়ে দেওয়া (burning), খেয়ে নেওয়া (eating) এবং লুঠ করে নেওয়া (looting)। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোল বিদ্রোহের সময় শোনপুরের বেশ কিছু গ্রামে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহে জমিদার-মহাজনের কাছে থাকা দলিল দস্তাবেজ এবং বন্ধকি কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। খেতে না পাওয়া বিদ্রোহীরা বিদ্রোহের সময় খাবার কেড়ে খেয়ে নিয়েছেন। তারা জমিদারদের কাছ থেকে খাদ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী লুঠ করে এনে তা সকলের মধ্যে বণ্টন করেছেন। সামগ্রিকতা (totality) ছিল বিদ্রোহের আর এক বৈশিষ্ট্য। বিদ্রোহে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের একাত্মতাবোধ বিদ্রোহকে এক সামগ্রিকতা প্রদান করত।
কৃষক বিদ্রোহে সংহতি বা ঐক্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংহতি বা ঐক্যসূত্র হিসেবে নানান উপাদান কাজ করত। অভ্যুত্থান পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্ম ভূমিকা নিত; উদাহরণ– ওয়াহাবি এবং ফরাইজি বিদ্রোহ। জাতিসত্তার সঙ্গেও শ্রেণিগত সংহতি সম্পর্কিত ছিল; উদাহরণ কোল এবং মুণ্ডা বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহে আন্তঃ-উপজাতীয় মৈত্রী লক্ষ করা যায়।
তবে বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐক্যর অভাবও যে কোনদিন দেখা যায় নি তাও নয়। কৃষক সমাজের মধ্যে যেমন সংহতি লক্ষ করা যায় তেমনই বিদ্রোহীদের মধ্যে দেখা মেলে শাসকগোষ্ঠীর সহযোগী অংশর যারা বিদ্রোহের তথ্য সরবরাহ করে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। উদাহরণ হিসেবে সাঁওতাল বিদ্রোহে বিশ্বাসঘাতক মোঝিয়া মাঝির বিশ্বসঘাতকতায় সিধুর ধরা পড়ার কথা বলা যায়। ক্ষমতাগোষ্ঠী এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতাকে মদত দিয়েছে। অন্যদিকে এই বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা আক্রমণ হেনেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিশ্বাসঘাতক মোঝিয়া মাঝিকে কানু মৃত্যুদণ্ড দেন। বিশ্বাসঘাতকতাকে বিদ্রোহীরা দুভাবে দেখতেন। একটি হল শত্রুপক্ষকে পরোক্ষ সহায়তা করা যা করা হত শত্রুকে প্রতিরোধ করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে এবং বিদ্রোহী দলে যোগ দিতে অস্বীকার করার দ্বারা। আর প্রত্যক্ষভাবে শত্রুকে সহায়তা করা ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা। যেমন শত্রুপক্ষকে বিদ্রোহের পরিকল্পনা বা গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তথ্য সরবরাহ করা।
বিদ্রোহ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল যোগাযোগ। এই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা বা বিস্তার করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন মাধ্যমের। কখনও যোগাযোগ করার জন্য দৃশ্য মাধ্যম, কখনও শ্রাব্যমাধ্যম ব্যবহার করা হত। বিদ্রোহর খবর পাঠানো হত বিভিন্ন প্রতীক বা চিহ্ন ব্যবহার করে। যেমন তেল-সিঁদুর, চাপাটি। মনে রাখতে হবে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যেখানে নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে নিরক্ষরতা একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য সেখানে লিখিত মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভবপর ছিল না। সাঁওতাল বিদ্রোহে মাদল বাজিয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে খবর পৌঁছে দেওয়া হত। এইভাবে দ্রুত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় শ্রাব্য মাধ্যমে খবর পৌঁছে যেত। আবার মশালের আগুন জ্বালিয়ে বিদ্রোহীরা এক স্থান থেকে আর এক স্থানে বার্তা পাঠাতেন। বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে গুজবেরও ছিল এক বড়ো ভূমিকা। গুজবের উৎস স্পষ্ট থাকত না। তবে গুজবের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিদ্রোহী চেতনার বিকাশ ঘটত।
উনিশ শতকের নিম্নবর্গীয় প্রতিরোধগুলো জাতীয় চরিত্রের ছিল না। বিস্তৃত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সত্ত্বেও এইসব বিদ্রোহ স্থানীয় সীমানা অতিক্রম করতে পারেনি। স্থানীয় জমিদার-মহাজন বিদ্রোহের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে। উপজাতি বিদ্রোহে স্থানীয় উপজাতীয় কৃষকরা একজোট হয়েছেন। জাতি, স্থান এবং সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে বিদ্রোহীরা সংগঠিত হয়েছেন। এতে আক্রমণ করা হয়েছে স্থানীয় জমিদার-মহাজন এবং প্রশাসনকে। স্থানীয় স্তরে কৃষকবিদ্রোহকে অনেক সময় জাত-বিদ্রোহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহের ইতিহাস বলে, স্থানীয় স্তরে বিদ্রোহ ধর্ম এবং জাতের পরিচয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিক্রম করেছে। যে অঞ্চলে শুধু এক জাতের বাস সেখানে হয়তো কৃষক বিদ্রোহ কোনও এক জাত-বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই সমস্ত কৃষক অভ্যুত্থান ধর্ম এবং জাত নির্বিশেষে গড়ে উঠেছিল যা বিদ্রোহের ইতিবাচক দিককেই নির্দেশ করে।
পরাধীন ভারতে অনুষ্ঠিত কৃষক বিদ্রোহগুলোর চরিত্রের যে পরিচয় তুলে ধরেছিলেন রণজিৎ গুহ তা যে কতটা অনন্য তা এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকেই উপলব্ধি করা যায়। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রণজিৎ গুহ তাঁর এই গবেষণায় স্থান বা কালকে সীমায়িত করেননি। স্থাননির্দেশ করেছিলেন সমগ্র ভারত আর কালসীমা ছিল ঔপনিবেশিক আমল। তবে তিনি তো ঔপনিবেশিক আমল জুড়ে বিদ্রোহের তালিকা তৈরি করতে বসেননি; তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এই বিদ্রোহগুলোর প্রাথমিক ধরন। আর এখানেই ঐতিহাসিক হিসেবে রণজিৎ গুহের বিশিষ্টতা।
আজ এতবছর পরে রণজিৎ গুহের সেই বই বা ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর বিভিন্ন খণ্ড পড়তে গিয়ে মনে হয়, সাব-অল্টার্ন ইতিহাসচর্চায় শুধু যে নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাস উঠে এল তা নয়, পাশাপাশি উঠে এল ইতিহাস রচনায় নতুন নতুন উপাদান ব্যবহারের কথা। সরকারি লেখ্যাগারের বাইরে সেখানে ঐতিহাসিকের অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াল গান-যাত্রা-কথকতা– সব। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল ব্যক্তিগত আর সামুদায়িক স্মৃতি যার প্রকাশ ‘মুখের কথায়’। কাজেই আজ মনে হয় একজন গবেষক (এবং সাধারণ পাঠকও) যখন নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চা করবেন তখন তিনি মাথায় রাখবেন, কোনও একটা ছকে নিম্নবর্গীয় প্রতিরোধকে বিচার করা কাম্য নয়। তাঁকে মাথায় রাখতে হবে এর বহুত্ববাদী চরিত্র এবং বৈচিত্র্য। কোনও একটা দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাসচর্চার কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রকাশ নয়, নবীন গবেষককে সমৃদ্ধ করুক লেখ্যাগারের পাশাপাশি অন্য ধারার তথ্য-উপাদান। তাঁর সামনের সমস্যা কাটাতে সাহায্য করতে পারে একটা বোধ তা হল ইতিহাস কোনও একমাত্রিক বিষয় নয়। ইতিহাসসন্ধানীর কাজ ইতিহাসের বিভিন্ন মাত্রার স্বরূপ উদ্ঘাটন করা।
দরকারি বইপত্র (প্রকাশের কালানুক্রমিক):
সুপ্রকাশ রায়, ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডি এন বি এ ব্রাদার্স,
১৯৬৬।
রণজিৎ কুমার সমাদ্দার, ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্থানীয় বিদ্রোহের প্রভাব’, কলকাতা, ১৯৮৪।
স্বপন বসু, ‘গণ-অসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ’, কলকাতা: পুস্তক বিপণি, ১৯৮৪।
‘মুক্তির সংগ্রামে ভারত’, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৬। (প্রথম প্রকাশ
১৯৮৬)।
অমলেন্দু দে, ‘বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ,
কলকাতা, ১৯৮৭।
সুপ্রকাশ রায়, ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক’, কলকাতা: ভারতী, ১৯৮৯।
বিনয়ভূষণ চৌধুরী, ‘ধর্ম ও পূর্ব ভারতের কৃষক আন্দোলন ১৮২৪-১৯০০’, গৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, ইতিহাস অনুসন্ধান ৩, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, ১৯৮৮। পাওয়া যাবে অনিরুদ্ধ রায় ও অন্যান্য সম্পাদিত, “ইতিহাসচর্চার ধারা”, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ফার্মা কে এল এম প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০৫-এ।
গৌতম ভদ্র, ‘ইমান ও নিশান উনিশ শতকে বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায়’, কলকাতা:
সুবর্ণরেখা, ১৯৯৪।
গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৮।
সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ও রাখী চট্টোপাধ্যায়, ‘বাংলার মুক্তিসন্ধানী’, কলকাতা: গ্রন্থমিত্র, ২০০৫।
মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, ‘বাংলাদেশ: নিম্নবর্গ, দ্রোহ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ’, ঢাকা: কথাপ্রকাশ, ২০১৫।
Sashibhusan Chaudhuri, ‘The Civil Disturbances During the British Rule in India 1765-1857’, Calcutta: The World Press, 1955.
Stephen Fuchs, ‘Rebellious Prophets: A Study of Messianic Movements in Indian Religions’, Bombay: Asia Publishing House, 1965.
Theda Skocpol, ‘States and Social Revolutions: A Comparative Analysis of France, Russia and China’, Cambridge University Press, 1979.
Narahari Kaviraj, ‘Wahabi and Farazi Rebels of Bengal’, New Delhi: People’s Publishing House, 1982.
Ranajit Guha, ‘Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India’, Oxford University Press, 1983.
Ranajit Guha, ‘On Some Aspects of the Historiography of Colonial India’, ‘Introduction to the Subaltern Studies Reader’ & ‘Subaltern Studies: Projects for Our Time and Their Convergence’ in Partha Chatterjee edted, “The Small Voice of History: Collected Essays”, Permanent Black, 2009.
Partha Chatterjee, ‘After Subaltern Studies’, Economic and Political Weekly, Vol. 47, No. 35, September 1, 2012.
Hiren Gohain, ‘Subaltern Studies: Turning Around the Perspective’, Economic and Political Weekly, Vol. 47, No. 35, September 1, 2012.