হিমাদ্রি চ্যাটার্জী
বিগত দুই দশক ধরে, ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় দলিতবিদ্যা ইতিহাস রচনার নানান নিয়ম নীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে চলেছে। এই নতুন ভাবনা চিন্তার ফলে ইতিহাস লেখার কারণ, ইতিহাস লেখার ভাষা, অতীতের সঙ্গে বর্তমান রাজনীতিক সম্পর্ক, ঐতিহাসিক ন্যায়ের মানদণ্ড, নৈতিক রাজনীতি সময়গতির সীমানা, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দলিত জীবন অভিজ্ঞতার প্রামাণিকতা¹ এবং ভারতীয় সভ্যতার পুনর্মূল্যায়ন নতুন আঙ্গিকে নতুন লেখাপত্রে পাঠকদের সামনে উঠে এসেছে। সেফোরা হোসে এই নতুন ধরনের লেখাকে নাম দিয়েছেন “মুঠি পাকিয়ে লেখা”²। ইতিহাস রচনার গঠনের এই পরিবর্তন বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের লেখকদের চিন্তাভাবনার ফসল। তার মধ্যে যেমন আছেন পি সনল মোহনের³ মতন দার্শনিক তেমনই আবার আছেন ইয়াগাতি চিন্না রাও এবং সব্যসাচী ভট্টাচার্যের⁴ মতন ইতিহাসবিদেরাও। জুডিথ মিস্রাহি বারাক⁵ এবং কল্যাণ দাসের⁶ মতন সাহিত্যের গবেষকরাও ইতিহাসচর্চার এই পরিবর্তনে নিজেদের অবদান রেখেছেন। ওপরের গবেষক এবং লেখকদের তালিকা দেখে আমরা সহজেই এটা বলতে পারি যে ভারতীয় ইতিহাস চর্চার মূল স্রোতের থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে এই নতুন ধরনের ইতিহাস লেখার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ইতিহাস লেখার দর্শন এবং তার ধারণাগত ভিত্তি ভারতীয় ইতিহাস চর্চার অন্যান্য স্রোতের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। দলিত বিদ্যা এবং দলিত চর্চার একাধিক চিন্তা নায়করা দাবি রেখেছেন যে, দলিত ইতিহাস চর্চা ঔপনিবেশিক, জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী এবং সাবঅলটারনিস্ট ইতিহাস চর্চার থেকে স্বতন্ত্র। এই দাবি আজ প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। এই প্রবন্ধে আমি বাংলার দলিত এবং আম্বেদকরবাদী লেখকদের গবেষণায় এবং লেখায় খোঁজার চেষ্টা করব যে তাদের কাছে দলিত ইতিহাস লেখার ধারণাগত কাঠামো কী।
দলিত বুদ্ধিজীবীদের বাংলা লেখা আজ বিশ্ব বিখ্যাত, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এবং চর্চিত। আজকে এটা ভাবাও শক্ত যে ২০১০ সাল অবধিও দলিত লেখকদের জবাবদিহি করতে হয়েছে যে আদৌ বাংলা ভাষায় দলিত চর্চা বা দলিত ইতিহাস লেখা হয়েছে না হয়নি! সেই প্রশ্নের অবসানের ১৪ বছর পরে আমরা আর অনস্তিত্বের বিপদ বিশেষ বোধ করি না বলাটা হয়তো খুব ভুল হবে না। দলিত বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ভাষায় লেখা লাখো কিতাব আজ সহজলভ্য। আমার গবেষণায় সব থেকে বেশি সংখ্যায় লেখা হয়েছে সম্ভবত দলিত আত্মজীবনী, এবং বিশেষ করে দলিত পুরুষদের আত্মজীবনী। এই লিঙ্গ বৈষম্যের বোধের থেকেই তৈরি হয়েছে দলিত নারীবাদীদের লেখালেখির নতুন ঢেউ। ধীরে ধীরে দলিত মহিলাদের আত্মজীবনীমূলক লেখার একাধিক সংকলন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আত্মজীবনের পরেই সবথেকে বেশি যেটা লেখা হয়েছে সেটা বোধ হয় বাবা সাহেব আম্বেদকারের এবং বহুজন সমাজ পার্টির নেতৃত্বে জীবনীমূলক বইপত্র। আমরা বাংলা ভাষায় তৃতীয় একটি ধারার লেখাপত্রের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত যাকে বলা হয় মতুয়া সাহিত্য। লেখাপত্রের এই তৃতীয় ধারায় বিভিন্ন আঙ্গিকের বইপত্র পাওয়া যায়। এর একটা বড়ো অংশ জীবনী সাহিত্য, দ্বিতীয় ভাগে মতুয়া আধ্যাত্মিক সাহিত্য, পদ, সংগীত ইত্যাদি, তৃতীয় ভাগ মতুয়া জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক লেখাপত্র প্যাম্ফলেট, বুকলেট, চতুর্থ ভাগ হচ্ছে মতুয়া দৈনিক পত্র এবং পঞ্চমভাগ মতুয়া জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ইতিহাস চর্চা। আমার এই প্রবন্ধে আমি এই পঞ্চমভাগের একটি ধারণাগত স্রোত সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাই। মতুয়া সাহিত্যের সবথেকে কম বইপত্র এই বিষয়ে লেখা হয়ে থাকে। তবে আমরা যদি মতুয়া সাহিত্যের অন্যান্য স্রোতগুলোকে কাছ থেকে পড়ে দেখি তাহলে বোঝা যাবে যে এই সমষ্টিবাচক ইতিহাস বইগুলোর খুব বড়ো প্রভাব অন্যান্য ধরনের লেখালেখির উপর পড়ে। যেমন এই সমষ্টিবাচক ইতিহাস বইগুলোর নাম প্রায় সমস্ত জীবনীমূলক বইতেই পাওয়া যায়। মতুয়া পদ এবং মতুয়া গানের বইতেও অনেক সময় সমষ্টিবাচক ইতিহাসের লেখকদের নাম উল্লেখিত হয়। এর ফলে বোঝা যায় যে এই স্রোতের লেখাপত্রের সংখ্যা কম হলেও মতুয়া বৌদ্ধিক জীবনে তার প্রভাব সুপ্রসারিত এবং সুগভীর। বাংলা দলিত সাহিত্যের এই অংশ নিয়ে একটা প্রসারিত দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার অংশবিশেষ এই প্রবন্ধে আমি উপস্থাপিত করার চেষ্টা করব। এই গবেষণার অংশবিশেষ এর আগেও প্রকাশিত হয়েছে এভিন লে এস্পিরিতু গান্ধি এবং ভিন নুয়েন– এদের সম্পাদিত ভলিউমে।⁷
হারানোর ইতিহাস
বাংলা দলিত গবেষক এবং লেখকদের গবেষণার যেই আঙ্গিক নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই সেই ধারার একাধিক বইতে দলিত ইতিহাস চর্চার সাথে আলো এবং অন্ধকারের সম্পর্ক বারে বারে উঠে আসে। ভারতীয় দর্শন ভাবনায় অন্ধকারের বিশেষ গুরুত্ব আছে বলে জানা যায়। অরিন্দম চক্রবর্তী এবং কেনগো হারিমোতোর মতন একাধিক লেখক, চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং সংস্কৃতজ্ঞ মানুষেরা তর্ক তুলেছেন যে ভারতীয় চিন্তা ভাবনায় অন্ধকার এবং ছায়া শুধুমাত্র আলোর থাকা বা না থাকার ফলস্বরূপ নয় বরং তার নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। এখানে এমন প্রশ্ন উঠে আসতে পারে যে দলিত ইতিহাস চর্চার মূলধারা আসলে সংস্কৃতে লেখা ভারতীয় পুঁথির সামাজিক ঐতিহ্যকে ব্রাহ্মণ্যবাদ-এর নামান্তর বলেই দাবি করে থাকে— তাহলে কেন আমরা আবার করে সেই প্রথাগত ভারতীয় দর্শনের অবধারণাগত আলোচনা দলিত ইতিহাস চর্চার আঙিনায় এনে ফেলব? তার কারণ দলিত ইতিহাস চর্চার এই বইগুলো বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্যের ঐতিহ্যের সাথে একই সঙ্গে সংগ্রাম এবং খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। সমকালীন বাংলা গদ্যে সব থেকে বেশি সংস্কৃতের ব্যবহার সম্ভবত দলিত ইতিহাস চর্চাতেই হয়ে থাকে। অন্ততপক্ষে আমার পড়াশোনায় এমনটাই মনে হয়। সংস্কৃত ভাষার চর্চার সাথে দলিত বিদ্যার পণ্ডিত মানুষদের এক অদ্ভুত দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বারে বারে চোখে পড়ে। বর্তমান সহস্রাবদের প্রথম দশকে প্রকাশিত হওয়া একাধিক বাংলা বইতে বাংলার নিম্নবর্গের ইতিহাসকে বারবার সম্বোধন করা হয়েছে ‘অনালোকিত’ ইতিহাস বলে। ইতিহাস অনালোকিত হয় কেমন করে আর কেমন করেই বা তার ওপর আবার আলো ফেলতে হয়? প্রশ্ন শুনে এমনটা মনে হতেই পারে যে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের ইতিহাসের একাডেমিক কাঠামোর ভিতর বর্ণগত বৈষম্য এবং শক্তি সামঞ্জস্যের গবেষণার মাধ্যমে এর উত্তর দেওয়া যেতে পারে। প্রথমেই বলে রাখি, এরকম গবেষণা করা সম্ভব এবং তা করা হয়েছে। দলিত মানুষদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের, উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণের বাইরে রাখার রাজনীতি সম্বন্ধে আমরা আজ অবগত। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়— দলিত মানুষের ইতিহাস চর্চার ভাষাকে আমরা কি শুধুই যান্ত্রিকভাবে দেখতে চাই নাকি তার গভীরতর তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক স্তর অবধি পৌঁছোতে চাই? আমার তর্ক এই যে দলিত ইতিহাসের ভাষার গঠন সম্বন্ধে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের অত্যন্ত মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। দলিত লেখকেরা নিজেরাও ভাষার গঠন, আঞ্চলিক সাহিত্যের ইতিহাস এবং ইতিহাস চর্চার রাজনীতি সম্বন্ধে বিশেষ মনোযোগী এবং দলিত বুদ্ধিজীবীদের লেখা দলিত ইতিহাস চর্চার বেশিরভাগ বাংলা বইতেই আমরা ভাষা সম্বন্ধে গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং জটিল আত্ম-প্রতিফলনের প্রমাণ পাই। ফলা, কুপো, শাক, ঠেস, নোড়া, ডাবা, চাঁছা, খোঁজা, মানত, আঁটি ইত্যাদি বহু শব্দকে প্রাচীন দলিত সভ্যতার প্রাকৃত ভাষার বাংলা রূপ বলে দাবি করেছেন এই লেখকেরা। নিজেদের ইতিহাস রচনায় এই সমস্ত শব্দকে ব্যবহার করেছেন একাডেমিক ইতিহাস এবং মধ্যবিত্ত সাহিত্য ভাবনার থেকে নিজেদের পার্থক্য নিজেদের ভিন্নতা বোঝানোর জন্য। এই দাবি ভুল বা সঠিক নির্ধারণ করার দায়িত্ব আমরা না হয় ভাষাতত্ত্ববিদদের উপর ছেড়ে দিলাম। আমি শুধু এইটুকু বুঝতে চাই যে দলিত ইতিহাসের রচয়িতাদের মতন সমান মনোযোগ দিয়ে আমরা যদি ভাষার প্রতি তাদের দায়িত্বকে বোঝার চেষ্টা করি এবং বুঝতে চেষ্টা করি যে কেন তারা এই ভাষাতেই ইতিহাস রচনার চেষ্টা করছেন তাহলে তাদের ব্যবহার করা অন্ধকার শব্দটাকেও সমান দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার।
ফেরত আসা যাক অন্ধকারের আলোচনায়। ইতিহাস অনালোকিত হয় কীভাবে? এবং সেই অনালোকিত ইতিহাসকে খুঁজে বার করে আনার প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের উত্তরে দেখি একাধিক দলিত ইতিহাসের বাঙালি লেখক ফেরত যান বঙ্কিমচন্দ্রের সুবিখ্যাত প্রচেষ্টায়, যেখানে জাতির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ইতিহাস এবং সাহিত্যকে কাজে লাগানো হয়েছে। এই চেষ্টার ফসল বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ইতিহাসের বইয়ের অফুরান সম্ভার। শহর, পাড়া, গ্রাম, গোষ্ঠী, জাতি, থানা, এমনকি বিল, বাঁওড়, খাল এবং পুকুরের ইতিহাস লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। বহু বিখ্যাত লেখক কলম ধরেছেন নিজের জেলার জনপ্রিয় ইতিহাস রচনা করার জন্য। বাংলা ভাষায় জীবনীসাহিত্যের সম্পদ যে-কোনও অন্য ভারতীয় ভাষার তুলনায় শুধু যে সমান সমৃদ্ধ তাই নয় বরং মাথাচাড়া দিয়ে অনেকটা উঁচু পদের দাবি রাখার হকদার। সেই ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে দলিত ইতিহাস চর্চা নিজেকে উপস্থাপিত করেছে। আবার তার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের ঐতিহ্যকে রাজনীতিকরণ করে যে হিন্দুত্ববাদী সমাজ চিন্তা তৈরি হয়েছে, দলিত সাহিত্য এবং দলিল ইতিহাস চর্চা তার সরাসরি বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ দলিত ইতিহাস চর্চায় বঙ্কিমের চিন্তার যে সূত্র আমরা পাই সেটা বাংলা ভাষার বহু চর্চিত সাহিত্যধারার কিছু উপাদানকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পুনর্গঠন করার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। এই পুনর্গঠনের মাধ্যমে দলিত বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের সভ্যতার ব্যাখ্যান তৈরি করার চেষ্টা করেন। অন্ধকারের ইতিহাস লেখার যে পদ্ধতি দলিত বুদ্ধিজীবীরা ব্যবহার করে থাকেন এটা তারই একটা রূপ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনা চিন্তার সঙ্গে যথেষ্ট তার্কিক ফারাক থাকা সত্ত্বেও সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চিন্তাভাবনার মধ্যেই বাংলা ভাষা এবং বাংলার আঞ্চলিক সভ্যতার যে আকরটুকুন ধরা আছে সেটাকে বার করে আনার ইচ্ছা এই লেখকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাপত্রের ওপর যে ঝলমলে আলো ফেলে বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতের ইতিহাসের লেখকেরা বাংলা গদ্যের উৎস খোঁজেন তাদের উলটো পথে হেঁটে দলিত বুদ্ধিজীবীরা খোঁজেন বঙ্কিমের চিন্তার আঁধারে পড়ে থাকা দিকটাকে। ইতিহাসের অনালোকিত অধ্যায় বলতে দলিত বুদ্ধিজীবীরা যেই জিনিসগুলিকে চিহ্নিত করেন সেগুলো মানব সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস এবং পুরাতত্ত্বের সংমিশ্রণে তাঁরা তুলে আনার চেষ্টা করেন। এই অনালোকিত অধ্যায়কে বোঝার জন্য যে চেষ্টা তাঁরা করেন তার তিনটে ভাগ আছে। প্রথমত চেষ্টা করা হয় দলিত মানুষদের প্রাচীন সভ্যতার গৌরবগাথার প্রমাণ প্রস্তুত করা। এই প্রমাণ যে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন সে কথা দলিত ইতিহাসবিদরা শুরুতেই বলে দেন। কেন কঠিন? এই প্রশ্নের জবাবে আমরা পৌঁছাই চেষ্টার দ্বিতীয় ভাগে— কেননা প্রাচীন ইতিহাসের সমকালীন লেখকরা এবং বর্তমানের লেখক এবং বিশ্লেষকরা দলিত মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে রুচি রাখেন না। অর্থাৎ, অন্ধকারের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল এমন এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে যে কিনা ইতিহাসের সম্পাদনা করেছে এবং ধীরে ধীরে সেই ইতিহাসের ‘সম্পদ- স্রষ্টা’ জনগোষ্ঠীকে ইতিহাসের উপাখ্যান থেকে মুছে দিয়েছে। চেষ্টার তৃতীয় ভাগ হচ্ছে এমন একটা পাঠ পদ্ধতি তৈরি করা যেটার মাধ্যমে এই লুকিয়ে ফেলার ভাষাকে ভেঙে তার ভিতরের জমাট অন্ধকারের মধ্যে থেকে দলিত সভ্যতার ইতিহাসের আলোকে বের করে আনা যাবে। এই পদ্ধতির প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষাকে বোঝার নতুন চোখ তৈরি করা। যেমন, দলিত ইতিহাসবিদরা অনেক সময় বেদ, উপনিষদ এবং বিভিন্ন পুরাণের থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন যে সেই সমস্ত শ্লোকে আসলে ভারতবর্ষের ‘মূল নিবাসী’ জনগোষ্ঠীর মানুষদের ‘গালাগালি’ দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের জটিল ভাষা পৃথিবী বিখ্যাত এবং সম্মানিত। এই লেখকেরা নিজেরাও প্রচুর সময় ব্যয় করে এই জটিল কাব্যের পাঠোদ্ধার করে, তার একাধিক টীকা এবং ভাষ্য পড়ে যখন শ্লোকগুলি নিয়ে বিশ্লেষণ করেন তখন তাঁদের পরিশ্রম বড়ো কম হয় না। অথচ এই পরিশ্রমের প্রধান লক্ষ্য এই শ্লোকগুলোকে গালাগালি বলে তথাকথিত ভদ্র সমাজের কাছে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে ডিগবাজি খাইয়ে দেওয়া। এই পদ্ধতিতে ভাষা, ভাষার মর্ম, ভাষার সাংস্কৃতিক শক্তি এবং ভাষার অবদমনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আভাস আছে। বিশেষ করে খেয়াল করতে হবে যে দলিত ইতিহাস চর্চায় সংস্কৃত শ্লোকের মর্মোদ্ধার করার পদ্ধতি মূল স্রোতের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের উদ্ভাসনের পদ্ধতির থেকে আলাদা। সাধারণত সংস্কৃত কাব্যে ছন্দ, অলংকার, ব্যাকরণের ঐতিহাসিক চলমানতা এবং একই শ্লোকের বিভিন্ন সময় হওয়া বিভিন্ন টীকা এবং ভাষ্যের মধ্যে তুলনা করার একটা লম্বা ঐতিহ্য আছে। কিন্তু দলিত বুদ্ধিজীবীদের লেখায় অনেক বেশি প্রাধান্য পায় লেখার হরফ এবং সেই হরফের মধ্যেও বিশেষ কয়েকটি অক্ষর।
মতুয়া সাহিত্যের বিশ শতকের শেষের দিকের এবং একবিংশ শতাব্দীর একদম শুরুর দিকের লেখকেরা বিশেষ করে ‘নম’ শব্দটাকে সংস্কৃতের বিভিন্ন বইপত্রে লেখায় খুঁজে বেরিয়েছেন। ভাষাকে ভেঙে তার সব থেকে ছোটো উপাদানে পৌঁছে বোঝার চেষ্টা করেছেন ঠিক কোথায়, কীভাবে, কোন অন্ধকারে তাদের জাতির অতীত ঐতিহ্যকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। সত্যিই ইতিহাস এইভাবে সম্পাদিত হয়েছে নাকি হতে পারে? এই প্রশ্ন এই প্রবন্ধের বিষয়ের অন্তর্গত নয়। আমাদের কাছে লক্ষণীয় এই যে এই লুকিয়ে ফেলার ব্যাখ্যানের মাধ্যমে এক ধরনের রাজনৈতিক ক্রিয়ার কল্পনা করা হচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে তার বিপরীত রাজনৈতিক ক্রিয়া ঠিক কীরকম হতে পারে সেটারও একটা কল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। এই বিপরীত রাজনৈতিক ক্রিয়া হচ্ছে অতীতকে নতুন করে কল্পনা করা। এই নতুন কল্পনার জন্য বিশেষভাবে যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ‘অনুপস্থিতি’-কে লেখার এবং ভাবার নতুন ধরনের ভাষা তৈরি করা। ‘অনুপস্থিতি’ এখানে জ্ঞানচর্চার একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে। খরোষ্ঠি সঠিকভাবে পাঠোদ্ধার করা গেল না কেন? সিন্ধু সভ্যতার হরফ আজও বোঝা গেল না কেন? কেনই বা অশোকের শিলালিপির ভাষা অন্যান্য ভারতীয় শিলালেখর থেকে এতটা আলাদা? প্রশ্ন তৈরি করার এই আদলটা একাডেমিক ইতিহাসের প্রশ্নের ব্যাকরণের থেকে অনেকটাই আলাদা, স্বতন্ত্র। যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় হয়তো তার উত্তর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না, ঠিক সেই রকম প্রশ্নই এই ধরনের লেখার প্রধান রুচি। তার কারণ হচ্ছে এই যে জ্ঞানচর্চার এই ধারার প্রধান লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব অর্জন করা। কাজেই ইতিহাসের যে পাতায় তাঁরা নিজেদের সৃষ্টিশীলতা এবং উদ্যমের প্রমাণ চেয়েও খুঁজে পাচ্ছেন না সেই পাতায় নিজেদের নামের আঁচর কেটে দেওয়ার জন্য অনুপস্থিত প্রমাণের অনুপস্থিতিকে প্রামাণ্য বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই জন্য নমুচি, নমস, নমসেজ ইত্যাদি শব্দগুলোর মধ্যে তাঁরা বারবার নিজেদের অস্তিত্বকে খুঁজে পাওয়ার দাবি রাখেন। বিভিন্ন টীকায়, ভাষ্যে, ব্যাখ্যায় এবং ইংরেজি অনুবাদে এই শ্লোকগুলির মানে অন্যরকম হলেও হতে পারে। কিন্তু সেটা এখানে প্রয়োজনীয় নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই প্রাচীন সাহিত্যে নিজেদের নামে এবং অস্তিত্বের অক্ষরকে খুঁজে পাওয়া।
পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে এবং বিশেষ করে ইতিহাসের গবেষণায় অনেকগুলো বড়ো প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা ছিল স্মৃতির প্রশ্ন। ইউরোপের একাধিক জনগোষ্ঠী, যেমন ইহুদি, যাযাবর ইত্যাদি মানুষদের উপর হয়ে যাওয়া চূড়ান্ত অবদমন এবং অত্যাচারের ইতিহাস লিখতে বসে ইউরোপের ইতিহাসবিদরা বুঝতে শুরু করেন যে রাষ্ট্রের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের প্রামাণ্য দস্তাবেজ অনেক সময় মহাফেজখানায় খুঁজে পাওয়া যায় না। যদি বা খুঁজে পাওয়া যায়, অবদমন এবং অত্যাচারের হাত থেকে কোনোক্রমে বেঁচে পালিয়ে আসা সারভাইভারদের জবানবন্দি সেই কাগজপত্রের থেকে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অবদান এবং অত্যাচারের স্মৃতি যখন জনপরিসরে এসে পৌঁছায় তখন তার থেকে তৈরি হওয়া ট্রমা সমষ্টিগত রাজনীতির এবং গোষ্ঠীগত মনস্তত্ত্বের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। শহরের গঠনে, আইনের ভাষায়, সমকালীন শিল্পকলায় তার ছাপ পড়ে। এই সমস্যা অনুধাবন করে তৈরি হয় স্মৃতি বিদ্যার চর্চা। এবং স্মৃতি বিদ্যার সমালোচনামূলক এবং আক্রমণাত্মক গবেষণার ফলে একাডেমিক ইতিহাস রচনাধারা কিছুটা হলেও বদলে যায়। দলিত বুদ্ধিজীবীরা প্রাচীন ভারতের যে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছেন সেটা যে ঠিক স্মৃতি নির্ভর এমনটা বলা যায় না। অনেক সময় তাঁরা যে সময়কাল নিয়ে লিখেছেন সেটা আড়াই থেকে তিন হাজার বছর বা তারও বেশি পুরানো। এটা এক ধরনের ব্যাখ্যান গঠনের (narrative building) রাজনীতি। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্মৃতি এবং সমষ্টিগত স্মৃতি তৈরি করা সম্ভব।
যাঁরা ব্যাখানের গঠন নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা সাধারণত সাংস্কৃতিক স্মৃতি এবং সমষ্টিগত স্মৃতিকে আলাদা করে দেখেন। সাংস্কৃতিক স্মৃতি ভাষা নির্ভর এবং সাধারণত সমষ্টিগত স্মৃতির থেকে কম নমনীয়। সমষ্টিগত স্মৃতি প্রধানত রাজনৈতিক বিরোধ এবং আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি হয়। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনে সমষ্টিগত স্মৃতির নানান রূপ তৈরি করা হয়। সমাজ এবং ইতিহাসের নানান রকমের উপাদান আত্তীকৃত করে, কিছুটা যান্ত্রিকভাবে এবং কৌশলগতভাবে সমষ্টিগত স্মৃতি উৎপাদন করা হয়। সাংস্কৃতিক স্মৃতির কোনও যান্ত্রিক ব্যবহারিকতা সাধারণত থাকে না। এই ধরনের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকে আঞ্চলিক ভাষা, কাব্য, শিল্পকলা এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানান দিক। কাজেই কোনও তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রয়োজনে সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে তৎকালীন বদলে ফেলা যায় না। ঠিক তেমনি আবার কোনও গোলমেলে আধিপত্যবাদী উপকরণ যদি সাংস্কৃতিক স্মৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে তখন তাকে মুছে ফেলাও বেশ কঠিন। দলিত বুদ্ধিজীবীরা সাংস্কৃতিক এবং সমষ্টিগত স্মৃতিকে একসাথে জুড়ে রাখার একটা বিশেষ কৌশল তৈরি করেছেন বলে আমার ধারণা। যে লেখকদের নিয়ে আমরা আলোচনা করছি তারা অনেকেই ধর্মতত্ত্ব এবং অধ্যাত্ম্যের ইতিহাসে বিশেষ মনোযোগ দেন। যেমন তারা হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন আচরণ অনুষ্ঠানে সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ লিখে থাকেন তেমনি আবার তারা দলিত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মাচরণ এবং আধ্যাত্মিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার ইতিহাস এবং বিশ্লেষণ করে থাকেন। দলিত আধ্যাত্মিক ইতিহাসের চর্চায় আমরা যেটা বিশেষ করে দেখে থাকি সেটা হচ্ছে এই যে সেখানে দু-ধরনের তর্কে বিশেষ মনোযোগ করা হয়। প্রথম ধরনের তর্কে দলিত আধ্যাত্মিকতাকে ব্রাহ্মণ্য আধ্যাত্মিকতার তুলনায় শ্রেয় এবং বাস্তববাদী বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় ধরনের তর্কে ব্রাহ্মণ্য আধ্যাত্মিকতা এবং পুরোহিততন্ত্রের কৌশলগত কার্যকলাপের প্রমাণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। এর আগেও যে লেখকদের কথা বলেছি তাঁদের বইপত্রে ফেরত গিয়ে এর একটা উদাহরণ তুলে আনা যায়। দলিত বুদ্ধিজীবীদের লেখায় একাধিকবার এ কথা উঠে এসেছে যে, ঋগ্বেদে ‘নম’ শব্দটা একাধিকবার পাওয়া গেলেও এর পরের উপনিষদে বা পুরাণে এই শব্দটার ব্যবহার কমে যায়। তার বদলে নতুন যে শব্দটা উঠে আসে সেটা হচ্ছে ‘চণ্ডাল’। সাধারণত আধ্যাত্মিক ইতিহাসের চর্চায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান, বিশেষ করে সাধনার আচার অনুষ্ঠানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, সাধকের বিভিন্ন ঈশ্বর দর্শনের বা ঈশ্বর অনুভূতির অভিজ্ঞতা এরকম নানান জিনিস নিয়ে লেখা হয়। কিন্তু দলিত বুদ্ধিজীবীদের অধ্যাত্ম্যের আলোচনায় আমরা দেখব বারবার গোষ্ঠীগত পরিচয় এবং সর্বনামের আলোচনায় ফেরার চেষ্টা। এর ফলে আধ্যাত্মিক আলোচনার ব্যাকরণ বদলে যায়। সংস্কৃতি এবং সমষ্টি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যস্থতার পাশ কাটিয়ে একটা নতুন ধরনের একত্রীকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্গঠিত হয়। গীতার একটি শ্লোকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দলিত নাট্যকার হর্ষবর্ধন চৌধুরী লিখেছিলেন “এর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তারা (অসুরেরা) ছিল বস্তুবাদী, অলীক ঈশ্বর বা পূর্বজন্মের কর্মফলে বিশ্বাস করত না। আর বস্তুবাদ শোষণের অন্তরায়। তাই শাসক তাকে সহ্য করতে পারে না। তবুও ভাবতে ভালো লাগে এই ভারতে একসময় বস্তুবাদ শক্তিশালী ছিল। বিষ্ণু ভক্তরা এসে সেটা নষ্ট করে দিয়েছে… এই অসুরেরা কোথায় গেল? বৈদিক যুগের শেষ ভাগে অসুরদের একভাগ ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে পারস্য বা তুর্কিস্তানে গিয়ে বাস করা শুরু করেন। ৫০০০ বছর আগে ব্যাবিলনের শতক্রোশ উত্তর-পশ্চিমে এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই সাম্রাজ্যের নাম হয় অসুর বা আসেরিয়া। আরেকদল তারা ছোটানাগপুর বা দক্ষিণ ভারতে গেলেন। সিংভূম থেকে গাংপুর স্টেট পর্যন্ত ৪০ ক্রোশ স্থানকে স্থানীয় লোকেরা অসুরগড় বলে চেনে। দুর্গের ভগ্নাবশেষ আজও দেখা যায়।”⁸ এই উদাহরণের মধ্যে দিয়ে আমার এর আগে তোলা তর্কগুলো স্পষ্ট করেই বোঝা যাচ্ছে বলে আশা করি। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একই সঙ্গে বস্তুবাদী ধর্মতত্ত্বের ভিত রাখা হচ্ছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মতত্ত্বের বিরোধ জানানো হচ্ছে, গোষ্ঠীগত মর্যাদা এবং পরিচয়ের প্রমাণ খোঁজা হচ্ছে, সেই প্রমাণের নষ্ট হওয়ার রাজনৈতিক কারণ এবং সেই রাজনৈতিক ক্রিয়ার কর্তাকে নির্দেশ করা হচ্ছে এবং পরিচয়ের ইতিহাসের একটা ক্ষেত্রীয় কল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো দলিত ইতিহাস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত দিক।
ফলিত ইতিহাস এবং দ্রোহ
সুনীল কুমার রায়ের লেখায় পাই “পরিশেষে উল্লেখ করতেই হয় যে বুদ্ধের চোখের সামনেই কোশল রাজ প্রসেনজিৎ সামরিক অভিযান চালিয়ে নারী ও শিশুসহ তার (বুদ্ধের) বহু আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করে তার জন্মভূমিকে কুশল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তাই কি তিনি নিজেকে কুশলের নাগরিক বলতে বাধ্য হয়েছিলেন? তিনি চেষ্টা করেছিলেন শোষক কুলের মানুষদের বৌদ্ধ ধর্মের দ্বারা বশ করতে। অবশেষে কি তিনি বুঝেছিলেন তিনি নিজেই তাদের বশ্য হয়ে গেছেন?”। এই উদ্ধৃতি দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় যে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ এবং কর্ণাটকের দলিত আন্দোলনের আধ্যাত্মিক ভিত্তি এবং পশ্চিমবাংলার দলিত প্রতর্কের মতামত খুব আলাদা ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। যে বৌদ্ধ ধর্মকে আঁকড়ে ধরে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের দলিত সমাজের বহু সংখ্যক মানুষ নিজেদের স্বতন্ত্র সভ্যতার আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের খোঁজ অতীতেও করছিলেন এবং আজও করে চলেছেন, পশ্চিমবাংলার দলিত বুদ্ধিজীবীরা তার নেতিবাচক মূল্যায়ন করতে পিছপাও নন। দ্বিতীয়ত এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় যে পশ্চিমবাংলার দলিত বুদ্ধিজীবীদের লেখায় প্রাচীন সভ্যতায় যুদ্ধের এবং সংঘর্ষের ইতিহাস খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই লেখকের অন্য একটি বইতে পাই “মহা পণ্ডিত নিমাই বিপ্লবী বৈষ্ণব ধর্মের নামে বিপন্ন নমোদের বস্তুবাদী মতাদর্শে ভক্তিবাদের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। অচিরে তিনি নিজেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে ফিরে গেলে নমজাতির বহু মানুষের চোখ খুলে যায় এবং তাঁরা ভক্তিবাদের বিষ হজম করে ফেলেন এবং বৈষ্ণবীয় আদর্শ ত্যাগ করে স্বকীয় মতাদর্শে অনড় থাকেন। তাই তো তাঁরা তাঁদের উত্তরাধিকারকে শানিত করতে বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদের পথ ত্যাগ করে দলে দলে বারো ভুঁইয়াদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে বিহারের দুসাদদের সাথে মিলে ক্লাইভ-এর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সাফল্যের সঙ্গে শিখে নেন।” যোদ্ধা হয়ে ওঠার এই ইতিহাস ‘ফলিত’ ইতিহাসের অন্যতম উপাদান।
লেখক সুনীল কুমার রায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের শিক্ষক। তাঁর ইতিহাস চর্চায় বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা এবং বিজ্ঞানের দার্শনিক পদ্ধতির ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি বিভিন্ন সময় ইতিহাস লেখার বিভিন্ন ধারাকে তুলনামূলক এবং বয়ানমূলক সমালোচনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের ইতিহাস চর্চার পদ্ধতিগত সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে বস্তুবাদী ‘ফলিত’ ইতিহাসের ধারণাকে। ফলিত শব্দের মানে বাস্তব, তথ্যনিষ্ঠ এবং প্রায়োগিক পদ্ধতির ব্যবহার। সম্ভবত ফলিত বিজ্ঞানের এই শব্দটি থেকেই লেখক একে ফলিত ইতিহাসের চর্চায় শামিল করেছেন। ফলিত ইতিহাসের মাধ্যমে উনি প্রধানত চেষ্টা করেছেন ওনার মতানুযায়ী ‘ভাববাদী’ ইতিহাসের নানান অসঙ্গতি দর্শিয়ে দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষদের হারানো ইতিহাস পুনরুদ্ধার করার। বস্তুবাদী এবং নৈতিক ব্যাখ্যানের সংযুক্তিকরণ এই প্রচেষ্টার একটা বিশেষ দিক। ‘বস্তুবাদী’ শব্দটার মানে আমরা মার্কসীয় দর্শনে ‘মেটিরিয়ালিজ্ম্’ শব্দের কাছাকাছি বলে ধরে নিতে পারি। আম্বেদকরবাদী চিন্তাবিদরা হয়তো প্রশ্ন রাখতে পারেন যে এই শব্দের মানে ‘প্রাগমাটিজ্ম্’ শব্দের সাথে সংযুক্ত করে কেন ভাবছি না। কিন্তু খেয়াল করে দেখলে সুনীল কুমার রায়ের লেখায় বারবার ফিরে আসে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ— ১। সম্পদ-স্রষ্টা— নিজের ব্যাখ্যানের প্রধান নায়ক নম জনগোষ্ঠীকে বোঝানোর জন্য উনি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন, ২। পরজীবী— ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং অভিজাত বর্গের ‘শোষক’ জনগোষ্ঠীকে বোঝানোর জন্য উনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমার মনে হয় যে ওনার শব্দ চয়ন ওনার তাত্ত্বিক ধারণার কাঠামোর ঠিকানা খুব স্পষ্ট করে নির্দেশ করে। তবে অন্যান্য মূল স্রোতের মার্কসীয় দর্শনের অবলম্বনে লেখা ইতিহাসের থেকে ওনার কাজ কিছুটা ভিন্ন ধর্মী। এই ভিন্নতা বিশেষ করে চোখে পড়ে যখন লৈঙ্গিক সামাজিকতা এবং যৌন সম্পর্কের ব্যাবহারিক দিক নিয়ে ওনার আলোচনা খুঁটিয়ে পড়া হয়। একাডেমিক ইতিহাস চর্চার মূল স্রোতে বর্তমানকালের খুব সাধারণ তর্ক এই যে যৌন সম্পর্কের মনোগ্যামাস বাঁধুনি মানব সভ্যতার মধ্যকালে তৈরি হয়েছে এবং তার ফলে মহিলাদের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে এবং তাঁরা পরিবারের, গৃহকর্মের এবং গেরস্থালির পুরুষতান্ত্রিক নৈতিকতায় বাঁধা পড়েছেন। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক সময় প্রাচীন কাব্যে, মন্ত্রে, নিয়ম-নীতিতে যখনই বিয়ের নিয়ম নীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায়, সাধারণত মূল স্রোতের ইতিহাসবিদরা সেখানে তর্ক তোলেন যে এই বাড়াবাড়ির ফলেই প্রমাণ পায় যে এই মন্ত্র নিয়ম নীতি লেখার আগে অবধিও মনোগামাস পরিবারতন্ত্র সমাজের সাধারণ গঠনের অংশ ছিল না। নম জনগোষ্ঠীর সম্বন্ধে এই একই তর্ক মানতে সুনীল কুমার রায় নিজের আপত্তি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য কিছুটা এরকম— নম জনগোষ্ঠীর মানুষ সুশৃঙ্খল যোদ্ধা, সাহিত্যিক, শিল্পী, কারিগর এবং সম্পদ স্রষ্টা ছিলেন। তাঁদের সমাজ যদি প্রাচীনকালে সভ্যতা এবং সম্পদ গড়ে তোলার মতন যথেষ্ট সংগঠিত হয়ে উঠতে পেরে থাকে— সেই সংগঠন নিশ্চয়ই পরিবারের মৌলিক ব্যাকরণের বাইরে হয়ে উঠতে পারেনি। তাহলে যদি নম জনগোষ্ঠীর অনার্য সভ্যতার উন্নত অর্জনকে স্বীকার করতে হয় তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে এই জনগোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকেই, এবং বিশেষ করে প্রাক্-বৈদিক যুগে একগামী এবং যৌন সম্পর্কের ব্যাবহারিকতায় শিষ্টাচার মেনে চলা সমষ্টি। তাঁর এই তর্কের মাধ্যমে ধারণাগতভাবে তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা মেলে ধরেছেন বলে আমার ধারণা। আমরা আগেও এই আলোচনা করেছি যে দলিত ইতিহাস চর্চায় ব্যক্তি সত্তা এবং ব্যক্তি অভিজ্ঞতার থেকে সমষ্টিগত বা সর্বনামের অভিজ্ঞতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ইতিহাস চর্চার নৈতিকতার ব্যাখানের ক্ষেত্রে একটা বিপদ সৃষ্টি হয়। যেহেতু এখানে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যান অপ্রয়োজনীয়, তাই নৈতিক নির্ণয়ের ব্যক্তিগত ব্যাকরণ ঊহ্য থেকে যায়। হয়তো নৈতিক নির্ণয়ের ব্যাকরণ তুলে ধরার জন্যই দলিত জনগোষ্ঠীর সৈনিকসম শৃঙ্খলা পরায়ণতা এবং যৌন শিষ্টাচারের ব্যাখ্যান গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। দলিত সাহিত্যের এই আঙ্গিকের অবধারণাগত কাঠামোকে বোঝার চেষ্টা রাজনীতির গবেষণার বর্তমানকালের সবথেকে প্রয়োজনীয় দিকগুলোর মধ্যে একটা বললেও কম বলা হয়। এই শৃঙ্খলাপরায়ণতাই হয়তো দলিত রাজনীতির কল্পনার ব্যাকরণের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে একটা হয়ে উঠেছে।
সূত্র-নির্দেশ:
¹ Ganguly, Debjani. 2008. ‘Caste and Dalit Life Worlds: Postcolonial Perspectives’. Hyderabad: Orient Blackswan. Also see Guru, Gopal and Sarukkai, Sunder. 2012. ‘The Cracked Mirror: An Indian Debate on Experience and Theory’, New Delhi, Oxford University Press.
² Sephora Jose (2023), ‘When Fists Write (of) the Past: Conceptualising Dalit Historiography through the Cultural Productions of Dravida Varga Aikya Munnani’, Caste, Vol 4(2), pp 417-436
³ P. Sanal Mohan (1999), ‘Dalit Discourse and the Evolving New Self: Contest and Strategies’, Review of development and change, Vol 4(1), pp 1-24
⁴ Bhattacharya, Sabyasachi and Rao, YagatiChinna. 2018. ‘The Past of the Outcaste: Readings in Dalit History’. Hyderabad: Orient Blackswan.
⁵ Barak, Judith Misrahi, Satyanarayana, K. and Nicole Thiara. 2019. ‘Dalit Text: Aesthetics and Politics Reimagined’. New Delhi: Routledge.
⁶ Kalyan Das (2015), ‘Subaltern historiography to Dalit historiography: Tracing heterogeneity in Dalit ‘Subalternity’’, EPW, Vol 50(7)
⁷ Himadri Chatterjee, ‘Writing, belonging, forgetting: Waterscapes in Bangla Dalit Refugee literature’ in Evyn le Espiritu Gandhi and Vinh Nguyen (ed.) (2023), The Routledge Handbook of Refugee Narratives, Routledge, Routledge, New York
⁸ Harshabardhan Chowdhury (2018), ‘Prabandha Sankalan’, self-published, pp 47