মিঠুন সাহা
বিষয় হিসেবে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বহুচর্চিত। এই লেখা আদতে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলনের বিস্তৃত পরিসরের অন্তস্থ একটি ক্ষুদ্র অংশে মনোনিবেশ করবে। নতুন কোনো গবেষণা উৎস ব্যবহার করে কিছু নতুন ভাষ্য এ লেখায় আছে, তা দাবি করা চলে না। তবে, সর্বসাম্প্রতিক প্রকাশিত গবেষণাকর্মের বিচারমূলক ব্যবহার এবং বহুপঠিত নানা লেখাপত্রের অকৃপণ সহায়তা গ্রহণ করে লেখাটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
উত্তরবঙ্গ চিহ্নিতকরণ
মূল আলোচনায় প্রবেশের স্বার্থে শুরুতেই ‘উত্তরবঙ্গ’ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নেওয়া উচিত বলে মনে করি। ‘উত্তরবঙ্গ’ বলতে এই রচনায় কোন মাটি-খণ্ডকে বোঝাবে? সংক্ষেপে বলা যায়, বঙ্গ বা বাংলায় ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্বে উল্লিখিত নামে কোনো সুনির্দিষ্ট ‘প্রশাসনিক এলাকা/অঞ্চল’ ছিল এমন প্রমাণ ইতিহাসে নেই। তবে, ‘উত্তরবঙ্গ’, ‘উত্তরকূল’, ‘বরেন্দ্রী’, ‘উত্তরদেশী’, ‘উত্তরা’ এ ধরনের কিছু শব্দবন্ধ প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানা উৎসে মেলে।১ কিন্তু উল্লিখিত শব্দবন্ধ দ্বারা আবার সুনির্দিষ্ট সীমানা চিহ্নিত করা হয় নি কোনো উৎসেই। ব্রিটিশযুগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় ‘উত্তর বাঙ্গালা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন। এখানেও উত্তর বাঙ্গালা এর সীমানা অচিহ্নিত রয়ে গেছিল।২ অনুমান করছি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের কাগজপত্রে ‘North Bengal’ বলতে যে ভূখণ্ডকে বুঝিয়েছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয় ঐ ভূখণ্ডটিকেই উত্তর বাঙ্গালা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
যেকোনো ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সীমানা প্রায়শ পরিবর্তনশীল। এটি একটি বাস্তবতা। উত্তরবঙ্গের ভূমিখণ্ডের সীমানা কখনও সম্প্রসারিত হয়েছে, কখনও হয়েছে সংকুচিত। আবার এখানে ব্রিটিশসৃষ্ট জেলাগুলোর অভ্যন্তরেও হয়েছে সীমানা বিষয়ক নানাবিধ পরিবর্তন এবং তা হয়েছে প্রধানত ব্রিটিশ আমলে।৩ একালে নানারূপ সম্প্রসারণ-সংকোচন ঘটে থাকলেও ‘উত্তরবঙ্গ’ বলে একটি মানসিক ভূখণ্ড বিরাজমান ছিল। তাহলে সে উত্তরবঙ্গের সীমানা কতটুকু? অধ্যাপক ড. আনন্দ গোপাল ঘোষ প্রথম বাঙালি ইতিহাসবিদ খ্যাত অক্ষয় কুমার মৈত্র মহাশয়ের সিদ্ধান্ত মেনে রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলা, পূর্র্ণিয়ার একাংশ ও গোয়ালপাড়া জেলার একাংশকে নিয়ে গঠিত ভূখণ্ডকে উত্তরবঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।৪ ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগের পূর্ব পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলা ছিল যথাক্রমে রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, মালদা, পাবনা, বগুড়া, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং। বাংলা ভাগ করতে গিয়ে র্যাডক্লিফ কমিশন ব্রিটিশ বাংলার অন্যান্য জেলার ন্যায় উল্লিখিত জেলাগুলোর ওপর যে ছুরি-কাঁচি চালালেন, তাতে ‘উত্তরবঙ্গ’ হয়ে গেল দুটি। একটি অংশ যুক্ত হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে, অপর অংশটি এল পূর্ব বঙ্গের ভাগে। ‘৪৭ পরবর্তী পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান (১৯৫৬ সাল হতে) বা বাংলাদেশে (১৯৭১ এ স্বাধীন হলে) উত্তরবঙ্গ বললে যে এলাকা আমাদের মনে ভেসে ওঠে, বর্তমান প্রবন্ধের ‘উত্তরবঙ্গ’ আসলে সেই মাটিখণ্ডকে বোঝায়। এই মাটিখণ্ডের উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুর দুয়ার; দক্ষিণে পদ্মার স্রোতধারা, পশ্চিমে ভারতের মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর; ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-করতোয়া-আত্রাই-পুনর্ভবা-মহানন্দা সিঞ্চিত বর্তমান রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাসমূহ নিয়ে যে অঞ্চল, তাই আলোচ্য প্রবন্ধের উত্তরবঙ্গ।
‘উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন’ শিরোনামের এই রচনায় ইতোমধ্যে উত্তরবঙ্গ বলতে যে সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই সীমানার মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন এর স্বরূপ কেমন ছিল, তা এ প্রবন্ধে নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন যেহেতু ব্রিটিশ শাসনের সূচনাকালের তথা আঠারো শতকের দ্বিতীয়াংশের ঘটনা, সেহেতু কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলোচনার স্বার্থে প্রবন্ধে নির্ধারিত সীমানার বাইরের নানা স্থানের ও ঘটনার কথা প্রাসঙ্গিকভাবে রচনায় এসেছে।
ফকির
ফকির বলতে সাধারণত মুসলমান সংসারত্যাগী ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যিনি মূলত ভিক্ষা তথা মানুষের দানের উপর নির্ভরশীল থাকেন। বর্তমান প্রবন্ধে ফকির হচ্ছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী সুফি সম্প্রদায়ের মাদারিয়া শাখার অনুসারী। এই শাখার প্রতিষ্ঠাতা সুফি সাধক বদিউদ্দিন শাহ-ই-মাদার। সিরিয়া থেকে এসে তিনি উত্তর ভারত ও অযোদ্ধায় তার মতবাদ প্রচার করেছিলেন।৫ এই মতবাদ বাংলায় বয়ে এনেছিলেন তার অন্যতম শিষ্য শাহ সুলতান হাসান মুরিয়া বুরহানা ১৭ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।৬ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে, মাদারিয়া ফকির ঘরানা অন্তত চারটি উপশাখা— যথাক্রমে দেওয়ানগন, খাদেমান, তালিবান ও আশিকান-এ বিভক্ত। মাদারিয়া সুফি শাহ সুলতান হাসান মুরিয়া বুরহানা ছিলেন মাদারিয়া চার উপশাখার দেওয়ানগন উপশাখার অন্যতম নেতা। মুঘল আমলে ১৬৫৮ সালে তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদার শাহ সুজার নিকট থেকে বিশেষ অধিকার সম্বলিত একটি সনদ পেয়েছিলেন।৭ এই সনদ মুরিয়া বুরহানা ও তার মতাদর্শী ফকিরদের বাংলায় তাদের সামগ্রিক প্রভাব বিস্তারে বেশ সহায়ক হয়েছিল— এই অনুমান করা যায়। এই অনুমান যে করা যায় তার স্বপক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ এই যে, মুরিয়া বুরহানা তৎকালীন দিনাজপুরের হেমতাবাদ থানাধীন বালিয়াদিঘীতে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যভুক্ত) একটি দরগা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।৮ কাছাকাছি সময়ে দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও থানার রানীশংকৈল-এ কুলিক নদীর নিকটবর্তী স্থানে প্রতিষ্ঠিত ফকির নেকমরদ এর দরগা। এসব দরগায় মাদারিয়া দেওয়ানগণ বা মাদারিয়া ফকির বা বুরহানা ফকিরদের আগমন ঘটত। দিনাজপুর ছাড়াও করতোয়া নদীর তীরবর্তী রংপুর ও বগুড়া, পাবনা ও পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে এই ধারার ফকিরদের দরগা, খানকা, আখরা প্রভৃতি স্থাপনা সতেরো শতকের শেষ ভাগ থেকে গড়ে উঠেছিল। এই ধারার ফকিরগণ সাধারণত শাহ্ উপাধি বা পদবি গ্রহণ করতেন। সুফি তরিকার এ বিশেষ ধারার ফকিরগণ সর্বক্ষণ স্রষ্টার প্রেমে দিওয়ানা থাকতেন বিধায় শরিয়ত নির্ধারিত অনেক নিয়ম-কানুন (নামাজ, রোজা পালন এর মতো বিধান) অনুসরণ করতেন না।৯ এই ধারার ফকিরগণের আচরণের সাথে তৎকালীন হিন্দুযোগী সন্ন্যাসীদের যাপন প্রণালীর কিছু সাদৃশ্য ছিল। পার্থিব জীবনযাপন থেকে দূরে থেকে সৃষ্টিকর্তার সাধনাই ছিল এদের মূল চর্চা। মৌলভী আবদুল ওয়ালীর ভাষ্যমতে, বুরহানা সুফি ফকিরদের অস্তিত্ব ছিল প্রাচীন সুফিবাদ ও হিন্দুযোগী আচার-আচরণের মিশ্রণের মধ্যে।১০ ফকিরগণ সাধারণত দরগা বা আখরায় থাকতেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সংসারিও ছিলেন।
সন্ন্যাসী
সন্ন্যাসীগণ ধর্ম পরিচয়ে বৈদান্তিক হিন্দু সাধক বা যোগী। আঠারো শতকের এই সন্ন্যাসীদের উৎপত্তি বেদান্ত দর্শনের দিকপাল শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত অদ্বৈত বেদান্ত ধারা হতে। এই ধারার সূচনা নবম শতকে। শঙ্করাচার্য অদ্বৈত-বেদান্ত ধারার চর্চাকারী তথা সন্ন্যাসীদেরকে পৃথক দশটি ধারায় বিভক্ত করেছিলেন যা দশনামী সন্ন্যাসবাদ নামে পরিচিতি পেয়েছে।১১ দশনামী সন্ন্যাসবাদের চর্চাকারী তথা সন্ন্যাসীদেরকে, ‘Gossains’, ‘Mendicants’, ‘Priests’, ‘Bankars’, ‘Traders’, ‘Farmers’, এবং ‘Mercenaries’ ভূমিকায় পাওয়া যায় বলে এম ক্লার্ক মন্তব্য করেছেন।১২ দশনামী সন্ন্যাসীরা প্রত্যেকে নিজ নিজ শাখা অনুযায়ী তাদের নামের শেষে গিরি, পুরি, ভারতী, বান, অরণ্য, পর্বত, সাগর, তীর্থ, আশ্রম, সরস্বতী উপাধি ব্যবহার করতেন। এই দশভাগের মধ্যে তীর্থ, আশ্রম, সরস্বতী, ভারতী শাখাকে বলা হত দণ্ডী, বাকিদেরকে গোসাই। গোসাইগণ ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করতেন এবং ধর্মীয় ও পেশাগত কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন।১৩ ক্লার্ক মত প্রকাশ করেছেন যে, বৈষ্ণব বৈরাগীদের মঠের প্রধানকেও গোসাই বলা হত।১৪ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্ব থেকে এলাহাবাদ, বান্দা, ঝাঁসি, রাজপুতানা, গুজরাটসহ সমগ্র উত্তর ভারতে দশনামী সন্ন্যাসীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। দশনামী সন্ন্যাসীদের প্রত্যেকটি ভাগ আবার দুটি উপভাগে বিভক্ত। এদের একটি নাগা (নগ্ন) সন্ন্যাসী এবং অপরটি গৃহী সন্ন্যাসী। এই দুই উপভাগের চর্চা ও যাপনে পরিষ্কার পার্থক্য বিদ্যমান। নাগা সন্ন্যাসীরা ব্রহ্মচর্য পালন করতেন, থাকতেন আখরায়, পরিধান করতেন কৌপিন, শরীরে মেখে রাখতেন ছাই এবং সাথে রাখতেন লোহার শিকল, বেড়ি ইত্যাদি। অন্যদিকে গৃহী সন্ন্যাসীরা গোসাই নামে পরিচিত হতেন। স্থায়ী আবাস ছিল তাদের, বিয়ে-সংসার করার অনুমতি পেতেন তারা, পরিধান করতেন কমলা (গেরুয়া) ও নীল রংয়ের পরিপূর্ণ পোশাক।১৫ বিবাহিত সন্ন্যাসীদেরকে সাধারণত গোসাই হিসেবে ডাকা হত। বিহারে সন্ন্যাসীরা গোসাই নামে পরিচিত ছিল। গোসাই ছাড়াও সন্ন্যাসীরা, বিশেষ করে মঠপ্রধানগণ এ অঞ্চলে ‘মোহন্ত’ নামে পরিচিত হতেন। সন্ন্যাসী মঠের মোহন্তদেরকে মুঘল সম্রাটগণ নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতা করতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।১৬
ফকির-সন্ন্যাসীগণ সর্বদাই ধর্মীয় সাধনার অংশ হিসেবে ধর্মীয়ভাবে পবিত্র স্থান বা তীর্থস্থান ভ্রমণ করে থাকেন। এই প্রয়োজনেই প্রধানত তারা উত্তরবঙ্গে আসতেন। ফকির সাধকদের মধ্যে মাদারিয়া ফকির বা বুরহানা ফকিরগণ সাধনার অংশ হিসেবে বছরব্যাপী একটি চক্রাকার প্রক্রিয়ায় উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত ও বাংলার নানা স্থানে অবস্থিত দরগাসমূহে ভ্রমণ করতেন। ফকিরগণ সাধারণত কানপুরের শাহ মাদারের দরগা, বিহারে অবস্থিত সৈয়দ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন এর দরগা ও পূর্ণিয়ার নানা দরগা ভ্রমণ শেষে বাংলার বিভিন্ন দরগা ভ্রমণ করতেন। তাদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের পীর বদর উদ্দিনের মাজার, ঠাকুরগাঁওয়র নেকমরদের দরগা, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের শাহ বলখীর দরগা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।১৭ উত্তরবঙ্গের উল্লিখিত দরগা ভ্রমণ শেষে ফকিরগণ হয় বিহার হয়ে পুনরায় উত্তর ভারত ও নেপালের পথে নতুবা পূর্ব বঙ্গের অন্যান্য তীর্থস্থান বা পবিত্র স্থান দর্শনার্থে গমন করতেন। আসলে উত্তরবঙ্গের দরগাসহ অন্যান্য পবিত্র স্থাপনাসমূহ পশ্চিম প্রান্তের বিহার ও উত্তর প্রদেশ এবং পূর্ব প্রান্তের পূর্ববঙ্গের ধর্মীয় পবিত্র স্থাপনাসমূহের মধ্যে একটি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করত।১৮ ফন ডেন ব্রুকের মানচিত্র অনুযায়ী দেখা যায় যে, রাজশাহীকে পাবনা, বগুড়া ও রংপুরের সাথে সংযুক্তকারী একটি সড়ক উত্তরমুখী হয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে আসামের দিকে গেছে। অনুমিত হয় ফকির-সন্ন্যাসীগণ তীর্থভ্রমণ করতে এই পথও ব্যবহার করে থাকবেন।১৯ সুতরাং বোঝা যায় যায় যে, উত্তরবঙ্গে সুফি তরিকার মাদারি ও অন্যান্য ধারার পীর-দরবেশদের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থানগুলো দর্শনসহ মেলা, উরস বিবিধ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ফকিরগণ বছরের নানা সময় এ অঞ্চলে আসা-যাওয়া করতেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসীদের বছরব্যাপী সাধন প্রক্রিয়ায় তীর্থস্থান ভ্রমণ অত্যন্ত পবিত্র কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। উত্তর ভারতের প্রয়াগ, হরিদ্বার, বারানসী হতে শুরু করে উত্তরবঙ্গের বগুড়া পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথের নানা পবিত্র স্থানে সন্ন্যাসীরা কুম্ভমেলায় যোগদান, গঙ্গা ও করতোয়া নদীতে স্নান, অশোক অষ্টমীতে ব্রহ্মনদে স্নান, করতোয়া তীরবর্তী মহাস্থানে স্নান, জনকপুর (সীতার জন্মভূমি) ভ্রমণ, পুরী ভ্রমণ এর উদ্দেশ্যে সারা বছর জুড়ে অত্র অঞ্চলে গমনাগমন করতেন। সাধারণত সন্ন্যাসীগণ কুম্ভমেলায় যোগদান শেষে পূর্বে অযোদ্ধা পেরিয়ে উত্তর বিহারের উপর দিয়ে পৌঁছাতেন নেপাল সীমান্তের তরাইয়ে। এখান থেকে সীতার জন্মস্থান জনকপুর উৎসবে যোগদান শেষে পুর্নিয়ার উত্তর দিকে গিয়ে মহানন্দ পেরিয়ে সন্ন্যাসীগণ উত্তরবঙ্গের রংপুরে প্রবেশ করতেন। রংপুর থেকে তারা বগুড়ার মহাস্থানগড়ে অনুষ্ঠিত বারুণী উৎসবে যোগ দিতেন।২০ করতোয়া নদীতে স্নান ছাড়াও রংপুরের চিলমারীতে (বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলাধীন) ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান উৎসব ছিল উত্তরবঙ্গে সন্ন্যাসীদের আগমনের অন্যতম কারণ। করতোয়া ও ব্রহ্মনদে স্নান উৎসব শেষে সন্ন্যাসীদের একাংশ জলপাইগুড়ির জলপেশ ও বিহারের ভাগলপুরে শিবরাত্রি উৎসবে যোগ দিতে উত্তরবঙ্গের নানা পথ ব্যবহার করতেন।২১ উল্লিখিত পবিত্র স্থানসমূহ ব্যতীত উত্তরবঙ্গে সন্ন্যাসীদের আসার আরেকটি কারণ ছিল বগুড়ার ভবানীপুরে অবস্থিত দেবী তারার শক্তিপীঠ দর্শন। নাটোরের রাজবাড়ীর তত্ত্বাবধানে বগুড়ায় করতোয়া তীরবর্তী ভবানীপুরে নির্মিত মন্দিরে দেবী ভবানীর পূজা উপলক্ষে বছরের বিভিন্ন সময় এখানে সন্ন্যাসীদের আগমন ঘটত।২২ উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন স্থানে সারা বছর ধরে ফকির-সন্নাসীগণ কি শুধু তীর্থদর্শনসহ ধর্মীয় কর্তব্য পালনের জন্যই আসা-যাওয়া করতেন? এ জিজ্ঞাসার উত্তর সাম্প্রতিক গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে মিলেছে। ফকির ও সন্ন্যাসী এই দুই ধারার সাধকগণ পার্থিব বা বস্তুগত প্রয়োজনেও উত্তরবঙ্গে বিচরণ করতেন। ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে অংশটি বিয়ে করার অনুমতি পেতেন, গৃহী বা মঠকেন্দ্রিক জীবনযাপন করতেন, তারাই ধর্মীয় সাধনার পাশাপাশি ব্যক্তি বা সামষ্টিক পুঁজি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পুঁজিলগ্নি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রভৃত মুনাফা অর্জনকারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতেন। জীবনধারণের প্রয়োজনে রেওয়াজ অনুযায়ী ফকির-সন্ন্যাসীরা মানুষের দান বা ভিক্ষা সংগ্রহ করতেন। মুষ্টির চাল সংগ্রহ, হাট-বাজার-গঞ্জ থেকে অনুদান সংগ্রহ প্রভৃতি দানভিত্তিক অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদার শ্রেণির নিকট থেকে দান হিসেবে পাওয়া নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ের উপর নির্ভর করেই সাধারণত ফকির-সন্ন্যাসীরা জীবন ধারণ করতেন। মুঘল যুগে মাদাদ-ই-মাআশ বা জীবিকা নির্বাহমূলক ভূমি অনুদানের ব্যবস্থা থাকার কারণে ফকির-সন্ন্যাসীগণের একাংশ আইমা, পিরোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, দেবোত্তর— প্রভৃতি ধরনের ভূমিদান পেয়ে থাকবেন।২৩ এই নিষ্কর জমি ফকির-সন্ন্যাসীদের আয়ের একটি উৎস ছিল। গবেষক অতীশ কে. দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী, সন্ন্যাসীগণের কেউ কেউ বাংলায় মালদা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছোট জমিদারদের নিকট থেকে আঠারো শতকে ঐরূপ কিছু নিষ্কর জমিখণ্ড দান হিসেবে পেয়েছিলেন।২৪ অতএব এই দাবি করা সমীচীন হবে যে, এরূপ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনেও ফকির-সন্ন্যাসীগণ উত্তর বাংলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতেন।
স্থাবর সম্পত্তি তদারকি করা ছাড়াও ফকির-সন্ন্যাসীদের, বিশেষত সন্ন্যাসীদের উত্তরবঙ্গে বিচরণের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষা। এ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মধ্যে একদিকে ছিল পুঁজি বিনিয়োগ ও মুনাফা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড, আর অন্যদিকে ছিল পণ্যদ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা। সন্ন্যসাীদের একাংশ মুঘল আমল থেকেই মহাজনী ব্যবসায় জড়িত ছিল। বাংলার বিভিন্ন এলাকার জমিদারদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ন্যাসীদের নিকট থেকে ঋণ নিতেন। কৃষকদের মধ্যেও সন্ন্যাসীদের নিকট থেকে ঋণ নেওয়ার উদাহরণ বিদ্যমান।২৫ এই ধারা ব্রিটিশ আমলের শুরুর দশকগুলোতেও অব্যাহত ছিল। গবেষক আনন্দ ভট্টাচার্য কোম্পানি দলিলপত্রের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, বগুড়ার শেরপুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণ ও কয়েকজন চৌধুরী, রংপুরের চাকলার জমিদার খায়রুল্লাহ চৌধুরী, রাজশাহীর পুখুরিয়ার জমিদার সন্ন্যাসী মহাজনদের নিকট থেকে নগদ অর্থ ধার নিয়েছিলেন।২৬ মহাজনী কারবারের নিয়ম মেনে চুক্তি মোতাবেক হারে মুনাফাসহ নগদ অর্থে ধারকৃত মূল অংক ঐসব জমিদার সন্ন্যাসীদের ফেরত দিতে বাধ্য থাকতেন। উত্তরবঙ্গে মহাজনী ব্যবসায় যুক্ত সন্ন্যাসীদের মধ্যে বখতিয়ার গিরি, বপুত গিরি, মান গিরি, ডোমার গিরি, গণপত গিরি ছিলেন উল্লেখযোগ্য।২৭ মহাজনী ব্যবসা ব্যতিরেকে সন্ন্যাসীদের একাংশ ব্যক্তিগত ও মঠ-নিয়ন্ত্রিত পণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় জড়িত হতেন। উত্তর ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলা এই বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্কে সন্ন্যাসীরা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন ছিলেন। সন্ন্যাসীদের মঠগুলো ছিল তাদের কাছে ঐ বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্কের স্থানীয় আউটপোস্ট বা এজেন্ট। পণ্য বাণিজ্যে সন্ন্যাসীরা বাংলা থেকে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে সিল্কের কাপড় রপ্তানি করতেন। রাজশাহী সিল্ক বারাণসী, মির্জাপুর, গাজীপুর ও উত্তর ভারতের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাকেন্দ্রগুলোতে খুবই চাহিদা সম্পন্ন পণ্যের অন্যতম ছিল। মূলত গুজরাটি সন্ন্যাসী মার্চেন্টরাই রাজশাহী সিল্কের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন।২৮ বলা যেতে পারে যে, বারাণসী-মির্জাপুর-গাজীপুর এই বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে বাংলার সিল্ক কাপড়কে পরিচিত করিয়েছিলেন সন্ন্যাসী ব্যবসায়ীরা। কাঁচা সিল্ক ও সিল্ক কাপড় বাদেও বাংলার অন্যান্য সুতিবস্ত্র ভারতসহ নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে সন্ন্যাসীদের মাধ্যমেই রপ্তানি হতে দেখা যায়।২৯ আবার এই সন্ন্যাসী ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই বাংলায় সোনা, রূপা, দামি পাথর, মসলা প্রভৃতি পণ্য আসত। উত্তরবঙ্গের বাজারগুলো অবশ্যই এই বাণিজ্য নেটওয়ার্কের অংশ ছিল— এই দাবি করা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে সেকালে যেসব মেলা (যেমন, বারাণসীর মেলা) অনুষ্ঠিত হত, ফকির সন্ন্যাসীরা সেসব মেলাকে লক্ষ্য করেই পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত হতেন। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে যেহেতু ফকির-সন্ন্যাসীদের জন্য পবিত্র অনেক ধর্মীয় উৎসব হত যা ইতোমধ্যেই উল্লিখিত হয়েছে, সেহেতু সেসব উৎসবকে ঘিরে পরিচালিত মেলাতে (যেমন, নেকমরদের মেলা) অন্যান্য ব্যবসায়ীদের অনুরূপ ফকির-সন্ন্যাসীদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া কিছু অস্বাভাবিক ছিল না। যাহোক, সরকারি কাগজপত্রে বঙ্গে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত এমন সন্ন্যাসীদের মধ্যে গোবিন্দ গিরি, বেনি গিরি, মোহন্ত মান গিরি, সুবল গিরি প্রমুখের কথা জানা যায়।৩০ সুতরাং এটি নিঃসঙ্কোচে দাবি করা যায় যে, ধর্মীয় কর্তব্যের পাশাপাশি আর্থিক স্বার্থের কারণে উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিচরণ ছিল।
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ
কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহ করেছিলেন মূলত ফকিররা। এদের প্রধান নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ বুরহানা। তিনি ছাড়াও মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, করিম শাহ, সোবহান আলী শাহ, বোরহান শাহ, জহুরি শাহ, মতিউল্লাহ শাহ, নেওয়াজি শাহ, বুদ্ধু শাহ, ইমায়ুম বক্স শাহ, প্রমুখের নাম বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়। বিদ্রোহীদের প্রায় সকলেই মাদারিয়া দেওয়ানগন শাখার অনুসারি ছিলেন। সুফি ও ফকিরিধারার সাধকদের মধ্যে কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন প্রধানত মাদারিয়া দেওয়ানগন তথা মাদারিয়া ফকির তরিকার সাধকগণ।৩১ সন্ন্যাসীদের মধ্যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ভূমিকায় পাওয়া যায় ভবানী পাঠকের নাম। এছাড়া, নাম না জানা নাগা সন্ন্যাসী, যাদেরকে সরকারি কাগজপত্রে শুধু ‘সন্ন্যাসী’ নামে চিহ্নিত হতে দেখা যায়, তাদের এক বড়ো অংশ কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন।
কোম্পানি শাসনের শুরুর দিকে এর বিরুদ্ধে প্রথম ও দীর্ঘমেয়াদী সশস্ত্র তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল বাংলা, একথা সর্বজনগ্রাহ্য। বাংলায় এ বিদ্রোহ আবার সর্বাপেক্ষা উত্তরবঙ্গে বেশি প্রভাব বিস্তারি ছিল। কেন উত্তরবঙ্গে এ বিদ্রোহী তৎপরতা বেশি সক্রিয় ছিল? এর অন্যতম কারণ এই যে, উত্তরবঙ্গে ছিল বুরহানা বা মাদারিয়া ফকির সম্প্রদায়ের অন্যতম কর্মকেন্দ্র। মজনু শাহ বুরহানা সম্ভবত স্থানীয় ফকিরদের আহ্বানে বিহার হতে উত্তরবঙ্গে এসে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। ফকিরদের এই সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে সংসারত্যাগী ফকিরদের ন্যায় স্থানীয় গৃহী বা আবাসিক ফকিরগণও সক্রিয় ছিলেন। এই একই মন্তব্য বিদ্রোহের অন্য অংশীদার সন্ন্যাসীদের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। এ বিষয় পরবর্তী আলোচনায় স্পষ্টভাবে ধরা যাবে।
ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীগণ কী উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্রোহ করলেন? তারা আদতে সরকারের পতন চেয়েছিলেন কিনা? এসব প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দেওয়ার জন্য উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সম্ভবত আজ অবধি অপর্যাপ্ত। তবে নাটোরের মহারাণী ভবানীর নিকট লিখিত মজনু শাহের চিঠিতে পাওয়া নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা করা যেতে পারে।
“We have for a long time … been entertained in Bengal and we have long continued to worship God at the several shrines and altars without ever once abusing or opperssing any one. Nevertheless last year 150 Fakirs were without cause put to death… Now we are all collected and beg together. Displeased at this method they (The English) obstruct us in visiting the shrines … this is unreasonable. You are the ruler of the country. We are Fakirs who pray always for your welfare. We are full of hopes” (quoted form J M Ghosh’s ‘Sannyasi and Fakir Raiders in Bengal’. This letter was sent to Rani Bhawani around 1772)
রাণী ভবানীর নিকট প্রেরিত চিঠিতে ফকির নেতা মজনু শাহ তাদের ‘শাসক’ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাণী ভবানীকে তাদের ‘শাসক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই বক্তব্যে কোম্পানি শাসনকে তারা মানতে অস্বীকার করলেও এই নতুন শাসনের অবসান তারা চেয়েছিলেন, এমন দাবি উত্থাপন করা খুব যুক্তিযুক্ত হবে না। বরং চিঠির ভাষ্য বিচার করে এই দাবি করা যায় যে, ফকির জীবনে নতুন সরকারসৃষ্ট ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সংকট দূর করার জন্য ফকির নেতা রাণী ভবানীর নিকট এক ধরনের প্রতিকার প্রত্যাশা করেছেন। কোম্পানি কর্তৃপক্ষের ফকির স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপগুলোকে যে প্রতিরোধ করা হবে, এমন ইঙ্গিত অবশ্য চিঠিতে পাওয়া যায়। যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, কোম্পানি শাসনকে উৎখাত করে পুরোনো শাসকবর্গকে দেশের ক্ষমতার ফিরিয়ে আনা বা নতুন কোনো পক্ষকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্পষ্ট কোনো বক্তব্য ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনে ছিল না— এমন দাবি অযৌক্তিক হবে না। আবার একই সাথে এই দাবি করা যুক্তিযুক্ত হবে যে, দেশের ক্ষমতায় আসা কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে ফকির-সন্ন্যাসীরা সুনজরে দেখেন নি।
বাংলার মাটিতে বহুকালীন বিচরণ যাদের, সেই ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে কোম্পানি কর্মকর্তাগণ কোন দৃষ্টিতে দেখতেন? এ বিষয়েও একটি ধারণা পাওয়া আবশ্যক। দীর্ঘকাল বাংলার মাটিতে ও ভারতবর্ষে ব্যবসারত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা নিশ্চয় এতদ্ অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসীগণ কীভাবে জীবনযাপন করেন, সে বিষয়ে জেনে থাকবেন। এই জানা আরও স্পষ্ট হয়ে থাকবে যখন তারা সরাসরি শাসক হয়ে উঠলেন ঠিক তখন থেকে। কোম্পানি কর্মকর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস তার শাসনকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে সন্ন্যাসীদেরকে ‘gypsies of Hindustan’ হিসেবে চিহ্নিত করে মন্তব্য করেছিলেন যে, তারা ব্রিটিশ স্বার্থের পক্ষে সাংঘাতিক হুমকি।৩২ সন্ন্যাসীদেরকে ‘দস্যু’, ‘লুণ্ঠনকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে হেস্টিংস এবং কমিটি অব সার্কিটের অন্যান্য সদস্যগণ ১৭৭২ সালে মন্তব্য করেছেন:
“They are formed into regular communities, and their families subsist by the spoils … most of them were member of great robber caste bound together by hereditary ties, by the use of a secret language and secret signs, and like the thugs of a later day, by the common observance of religious rites, they looked like travellers or pilgrims” (quoted from Ananda Bhattacharya, ‘Reconsidering the Sannyasi Rebellion’, p.89)
ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জেমস রেনেল ফকির-সন্ন্যাসীদের অর্থ উত্তোলন প্রক্রিয়াকে ‘plundering’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া ব্রিটিশ কর্তাদের নানা লেখায় ও কোম্পানি কাগজপত্রে ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে ‘erratic beggers’, ‘religious vagrants’, ‘Lawless Mendicants’, ‘disorderly tribe of people’ ‘trading pilgrims’ ‘fanatics’ ‘gymnasophysts’, ‘set of a lawless banditti’, ‘dacoits of Bengal’ প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন মেলায় জড়ো হওয়া ফকিরদের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করা ভ্রমণকারী জর্জ ভাইকাউন্ট ভ্যালেন্সিয়া ফকিরদেরকে ‘all the rascals in India’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, সন্ন্যাসীরা ছিল আসলে মুঘল সেনাবাহিনীর চাকরি হারানো বেকার সৈন্যদল ও বাংলার ভূমিহীন কৃষক যারা সংখ্যায় প্রায় পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছেছিল।৩৩ সুতরাং খুব স্পষ্ট করে বোঝা যায় যে, জনতার নিকট হতে ফকির-সন্ন্যাসীদের অর্থ উত্তোলন কর্মকাণ্ড, তাদের চলাচল ও অবস্থান, সর্বোপরি ফকির-সন্ন্যাসীদের শক্তি সামর্থ্যকে বেনিয়া সরকার প্রচ্ছন্ন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছিল। বাংলায় কোম্পানি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এর প্রতি ফকির-সন্ন্যাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রতি কোম্পানি কর্তাব্যক্তিদের নজর দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘাত-সম্ভাবনা বৃদ্ধি করেছিল বেশ। এই সংঘাত-সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে পরিণত হয় দুই পক্ষের নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপের ফলে।
নাগা সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ বহুকালের রেওয়াজ অনুযায়ী তাদের সঙ্গে লৌহ নির্মিত এক ধরনের দণ্ড বা অস্ত্র বহন করতেন। সন্ন্যাসী বা ফকিরগণ সাধারণত দল বেধে ভ্রমণ ও তীর্থ যাত্রা করতেন। এবং যেখানে ইচ্ছা, সেখানে যেতেন। যাত্রাপথে তারা জীবন-ধারণের জন্য জনগণের নিকট থেকে অর্থ তোলা বা চাঁদা বা অনুদান হিসেবে গ্রহণ করতেন। এক্ষেত্রে অর্থ দিতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিবর্গের উপর ফকির-সন্ন্যাসীদের তরফে শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ ছিল বহু পুরোনো। এছাড়া, নাগা সন্ন্যাসীরা ছিলেন প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। এদের অনেককে অনেক আগে থেকেই স্থানীয় জমিদার, নবাব প্রভৃতি পক্ষের হয়ে বেতনভুক্ত সৈন্যের ভূমিকা নিতে দেখা যেত। নবাব মীর কাসিমের সৈন্যদলে নাগা সন্ন্যাসীদেরকে নিয়োগ করা হয়েছিল। শোনা যায়, জয়পুরের মহারাজার সৈন্যদলে প্রায় দশ হাজার নাগা সন্ন্যাসী অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘গিরি’ ও ‘পুরী’ উভয় সম্প্রদায়ের নাগা সন্ন্যাসীরা মারাঠা ও রাজপুত সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণযোগ্য ছিল।৩৪ কোম্পানি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৭৬৫ সালে সরকার পুলিশ ও বিচার প্রশাসন ঢেলে সাজায়। আওতাভুক্ত এলাকায় কেন্দ্রীয় শাসন সুপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার তার আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে এসময় থেকে বেশ কিছু বিধি-নিষেধ জারি করে, যা অচিরেই ফকির-সন্ন্যাসীদের দীর্ঘকালীন চর্চায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। যেমন সন্ন্যাসী-ফকিরদের বহনকৃত লৌহদণ্ড ও অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ হয়। সন্ন্যাসীদের ইচ্ছামাফিক চলাচল ও কিছু কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ১৭৭৩ এর জানুয়ারিতে সরকার ঘোষণা করে, প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন করা ব্যক্তি রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে গণ্য হবেন। বাংলা বা বিহারে নির্ধারিত সময়ের পর অস্ত্র বহনকারী কোনো সন্ন্যাসীকে পাওয়া গেলে তাকে আটক করা হবে এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। সরকার হুগলির কালেক্টরকে এই মর্মে আদেশ দেন যে, তীর্থযাত্রার বেশে অস্ত্র বহনকারী সন্ন্যাসীকে তার এলাকায় পাওয়া গেলে যেন তাকে প্রেপ্তার করা হয়। অস্ত্র বহনকারী সন্ন্যাসীদেরকে সরকার তার কর্তৃত্বের জন্য একটি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে সকল কালেক্টরকে এই হুমকি মোকাবেলায় সচেষ্ট থাকতে নির্দেশনা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় কালেক্টরগণ সব জমিদারকে নির্দেশনা দেন, যাতে জমিদারগণ তাদের জমিদারিতে থাকা সন্ন্যাসীদের নিকট থেকে সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়ার লিখিত অঙ্গীকার নামা আদায় করেন। বাংলায় ও এর বাইরে সন্ন্যাসীদের স্বাধীন মনোভাব দমন করার জন্য সরকার ১৭৮৬ সালে লখনৌ’র রেসিডেন্টকে নির্দেশ দেন যেন, তিনি অযোদ্ধায় বা মাহাদজী সিন্ধিয়ার রাজ্যে সন্ন্যাসীদেরকে প্রবেশ করতে না দেন।
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের গুরুতর আপত্তি ছিল তাদের অর্থ উত্তোলন প্রসঙ্গে। ফকির-সন্ন্যাসীগণ, বিশেষ করে সন্ন্যাসীগণ ময়মনসিংহের আলেপসিংহ পরগনা, দিনাজপুর ও অন্যান্য স্থানে জোরপূর্বক চাঁদা বা অনুদান তোলায় সংশ্লিষ্ট এলাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। ফলে, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছিল ও সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছিল। ১৭৭০ এর মন্বন্তরের পর ১৭৭৩ সালের কুম্ভমেলা শেষে পুরো বাংলা জুড়ে সন্ন্যাসীদের লুণ্ঠন ও আক্রমণ চলেছিল বলে প্রমাণ আছে। ফলে সরকার সন্ন্যাসী-ফকিরদের সংঘবদ্ধ চলাচলের বিরুদ্ধে সরব হয়। ১৭৭৫ সালের কুম্ভমেলা শেষে সন্ন্যাসীদেরকে সরকার বাংলা সীমান্তে প্রবেশের সুযোগ দেয়নি।
সরকারের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের ক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু সিদ্ধান্ত। মুষ্টির চাল সংগ্রহ প্রথা বাতিল করা, ধর্মীয় স্থাপনার জন্য ইতোপূর্বে যেসকল বরাদ্দ ফকির-সন্ন্যাসীরা পেতেন সেগুলো বাতিল করা, ফকির-সন্ন্যাসীদের জন্য করমুক্ত জমির বরাদ্দ বা লাখেরাজ বরাদ্দ বাতিল করা, প্রভৃতি অর্থনৈতিক সুযোগ যা ফকির-সন্ন্যাসীরা এতকাল অধিকার হিসেবে ভোগ করতেন, তা রহিত করার মাধ্যমে সরকার ফকির-সন্ন্যাসীদের পার্থিব জীবন সঙ্কটাপন্ন করে তোলে।৩৫
সরকারের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসীদের বিশেষ করে মহাজনী ব্যবসা ও পণ্যদ্রব্যের ব্যবসায়ে জড়িত সন্ন্যাসীদের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল মহাজনী পুঁজি বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফার হার সরকার কর্তৃক বেঁধে দেওয়া এবং তাদের বাণিজ্য পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত ১৭৭৩ সাল থেকে বাস্তবায়নের কারণে। এছাড়া, সন্ন্যাসীদের সিল্ক কাপড়ের ব্যবসার উপর পুলিশ ট্যাক্স আরোপ, ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোর পথে অতিরিক্ত কাস্টম্স পোস্ট স্থাপনসহ সরকারের আরও কিছু সিদ্ধান্ত সন্ন্যাসীদেরকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ১৭৬৬ সালে কোম্পানি ঘোষণা করে যে, কোম্পানির প্রয়োজন পূরণ হওয়ার পূর্বে কেউ কাঁচা সিল্ক কিনতে পারবে না।৩৬ বলা বাহুল্য, সরকারের উপর্যুক্ত পদক্ষেপ সন্ন্যাসী-ব্যবসায়ীদের আর্থিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছিল। যেখানে ঔপনিবেশিক সরকার পূর্ব মুঘল শাসকগণ এবং স্থানীয় শাসকবর্গের নিকট থেকে সন্ন্যাসী-ব্যবসায়ীগণ কোনো প্রকার বাধার শিকার হননি, যেখানে সন্ন্যাসীদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডকে পূর্ববর্তী সরকারসমূহ কখনোই বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত করেননি, যেখানে তীর্থ ভ্রমণকারী ও ভাড়াটে যোদ্ধার ভূমিকায় থাকা সন্ন্যাসীদের সেসব কর্তৃপক্ষ কখনোই বাধাগ্রস্ত করেননি, সেখানে কোম্পানি সরকারের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
নবপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের ক্ষুব্ধতার অন্যতম কারণ ছিল সরকারের বলপ্রয়োগ নীতি। মন্বন্তরের কিছু আগে থেকেই সরকার ফকির-সন্ন্যাসীদের অনেককে সরকারি নির্দেশ ও আইন না মানার অভিযোগে আটক করে। এমনকি সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (পুলিশ, সেনাবাহিনী) বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ ছিল। রাণী ভবানীর নিকট মজনু শাহ লিখিত পত্রে কোম্পানি কর্তৃক বিনা অপরাধে ১৫০ জন ফকিরকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
নিজ সম্প্রদায়ের নানাবিধ স্বার্থহানির পাশাপাশি সাধারণ জনগণের উপর সরকারি কর্মচারী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী (দেবী সিংহ, গোবিন্দ সিংহ, কান্তবাবু, রামকান্ত রায়, দুলাল রায়, দয়ারাম রায়, জয় নারায়ণ ঘোষাল প্রমুখ এর মতো বেনিয়া ও মুৎসুদ্দি) শক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেও ফকির-সন্ন্যাসীরা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কোম্পানি সরকারের ক্রমাগত রাজস্ব হার বৃদ্ধি, নগদে রাজস্ব প্রদান বাধ্যতামূলক করা, রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে রাজস্ব সংগ্রাহকদেরকে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান, নির্যাতনমূলক পুলিশি ব্যবস্থা, প্রভৃতির ফলে গ্রাম-গঞ্জে এক অদৃষ্টপূর্ব ভীতি ও অত্যাচার নেমে আসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রংপুর, দিনাজপুরের সাধারণ কৃষকদের নিকট থেকে ১৭৬৫ সালের পর থেকেই নির্ধারিত হারের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা হচ্ছিল। শুধু রংপুরের বিভিন্ন গ্রামের ১৭ জন ব্যক্তির নিকট থেকে সরকারি কর আদায়কারী কর্তৃক কেড়ে নেওয়া সম্পত্তির মূল্য ছিল তৎকালীন ৫৯,৫,৭৪১০ টাকা। এরূপ অত্যাচার দেখে রংপুরের তৎকালীন কোম্পানি সুপারভাইজার স্বয়ং ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। কোম্পানি সরকার নির্ধারিত রাজস্ব দিতে না পারার কারণে এবং রাজস্ব সংগ্রাহক কোম্পানি কর্মচারী এবং জমিদারদের অত্যাচারের ভয়ে অনেক রায়ত গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন এমন উদাহরণ অসংখ্য।
একদিকে বর্ধিত হারে ও নগদে রাজস্ব প্রদানের বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে বাজারে কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্যের যাঁতাকলে রায়তদের আয় অনেক কমে যাওয়ায় তারা ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে পূর্বের ন্যায় দান বা চাঁদা দিতে অপারগ হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ফকির-সন্ন্যাসীদের আয়ও কমে যায়। এই অবস্থার জন্য তারা সরকারকে দায়ী মনে করে এবং কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও অন্যান্য স্থাপনাতে আক্রমণ পরিচালনা করতেন বলে কোম্পানি কর্মচারী হ্যাচ মনে করতেন। তাছাড়া, কোম্পানির নীতির কারণে বহু পুরাতন জমিদার জমিদারি হারালে ফকির-সন্ন্যাসীদের অনেকে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছিলেন। এ কারণে দেখা যায়, জমিদারি হারানো বা বিদ্রোহী জমিদারদের সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে ফকির-সন্ন্যাসীরা অংশ নিয়েছিলেন। অত্যাচারের শিকার রায়ত ও ভক্তদের রক্ষা করতে ও অনেক ক্ষেত্রে ফকির-সন্ন্যাসীগণ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিলেন। কুমিল্লার হুলি ফকিরের বিদ্রোহ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ফকির-সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের অন্যতম প্রধান অভিযোগ ছিল সরকারি কাজে বাধাদান, কোম্পানির ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুট ও বিনষ্টকরণ, জমিদার ও কৃষকের উপর ফকির-সন্ন্যাসীদের অত্যাচার ও সম্পত্তি লুট, কোম্পানি কর্মচারীদের (সামরিক ও বেসামরিক) উপর আক্রমণ, জখম ও খুন এবং কোম্পানির সহযোগী দেশীয় ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি পণ্য লুট। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৭৬০ সালে বর্ধমান ও কৃষ্ণনগরে নাগা-সন্ন্যাসীদের উৎপাতে রাজস্ব আদায়কার্য বন্ধ রেখে কোম্পানি কর্মচারী ওয়াট ও হোয়াইট কলকাতায় ফিরে এসে পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন। ১৭৬৩ সালে বাকেরগঞ্জ, ঢাকা ও রাজশাহীতে কোম্পানির কুঠি আক্রমণ ও লুট, এবং সন্ন্যাসীদের জিম্মায় কোম্পানি কুঠিয়াল বেনেট নিহত হন। ১৭৬৯ সালে রংপুরে সন্ন্যাসীদের সাথে সংঘর্ষে লেফটেন্যান্ট কিম নিহত হন।৩৭ ১৭৭১ সালে রংপুরের কোম্পানি সুপারভাইজার জন গ্রোস জানিয়েছিলেন যে, ফকিরগণ রংপুরের বোদাতে অবস্থিত (বর্তমানে পঞ্চগড়ে অবস্থিত) কাছারি লুট করেছে। ১৭৭৬ সালে মজনু শাহ রাজশাহীর সাধারণ মানুষের নিকট থেকে অর্থ উত্তোলন করতে তার অনুসারিদেরকে নির্দেশ দেন। ময়মনসিংহের আলেপসিংহ পরগণার গোমস্তা ১৭৮০ সালের মার্চে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন যে, পাওয়া পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ফকিরদল জমিদারের ভাইয়ের ছেলে চন্দ্র শেখর আচার্যকে ধরে নিয়ে গেছে। সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে শিশু অপহরণের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল। ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা বন্ধ করা না গেলে রাজস্ব আদায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে জমিদারদের বারংবার পিটিশন সরকারকে ব্যস্ত করে তুলেছিল।৩৮ ফকির-সন্ন্যাসীরা কোম্পানির সহযোগী দেশীয় বানিয়াদের পণ্যবাহী নৌকাতে হানা দিতেন। ভবানী পাঠক ও তার সহযোগীরা উত্তরবঙ্গে কোম্পানির আফিম ও গাঁজার নৌকা লুট করতেন, লুট করতেন কোম্পানির সৈন্যদের জন্য আনা রসদ। সুতরাং, বেনিয়া কোম্পানি সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়, তার মুনাফা বৃদ্ধি ও শাসন-নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ফকির-সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতাকে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে নির্ধারণ করে। ফলে, এদেরকে দমন করার প্রয়োজনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ ও গুরুত্ব প্রদান করে। ফলস্বরূপ ফকির-সন্ন্যাসীদের তরফে সরকার বিরোধী বিদ্রোহী তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়।
উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহী তৎপরতা ও সরকারি প্রতিরোধ
তিস্তা-করতোয়া-ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা বিধৌত বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর ছিল ফকির-সন্ন্যাসীদের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। রংপুরে সেকালে বহুসংখ্যক মাদারিয়া ফকির স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করতেন— ব্রিটিশ কর্মকর্তা ফ্রান্সিস হ্যামিল্টন বুকানন এমন সাক্ষ্য দিয়েছেন।৩৯ অত্র অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রতি স্থানীয় মানুষের মান্যতা ছিল উল্লেখযোগ্য এবং তা এখনেও কম বেশি লক্ষণীয়। ফলে ফকির-সন্ন্যাসীদের সেকালে সামাজিক প্রভাব ছিল বেশ। সাধারণ রায়ত তো বটেই, স্থানীয় জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তি, এমনকি শাসক মহলেও তাদের প্রতি একটা বিশেষ সমীহ দেখা যেত। সেকালের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সে অর্থে পীর-ফকির-সন্ন্যাসীগণই ছিলেন জনগণের নেতা। ১৭৫৭ সালের বিজয়ের পর কোম্পানি কর্তারা বাংলাকে শাসন করবার জন্য পদ্ধতিগত প্রশাসনিক ও আইনগত যেসব পরিবর্তন আনে, তাতে অচিরেই ফকির-সন্ন্যাসীরা নিজেরাই ভীষণ চাপে পড়ে যান এবং তাদের এতকাল চর্চিত সামাজিক ক্ষমতা শীঘ্রই প্রায় অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। উপরন্তু, সর্বগ্রাসী মনোভাবাপন্ন কোম্পানি সরকার সবকিছুর উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠা করার ও নতুন সামাজিক শৃঙ্খলা তৈরির উদ্দেশ্যে যেভাবে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে বিন্যস্ত করে, সেই নতুন ক্ষমতা বিন্যাসে ফকির-সন্ন্যাসীগণ তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব হারায়। স্বাভাবিকভাবেই পূর্বতন অন্যতম স্থানীয় শক্তি হিসেবে ফকির-সন্ন্যাসীদের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল নতুন কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে— অন্তিমে বিদ্রোহ সেই প্রতিক্রিয়াজাত প্রকাশ।
উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসীদের সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করে দেখা উচিত। এর প্রথম পর্যায়টি মন্বন্তর পূর্ববর্তী এবং দ্বিতীয় পর্যায় মন্বন্তর পরবর্তী যা আঠারো শতকের শেষ অবধি চলমান ছিল। প্রথম পর্যায়ের সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডেই ফকির-সন্ন্যাসীগণ সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে। তবে এই পর্বে ফকির-সন্ন্যাসীদের লক্ষ্যবস্তু ছিল সরাসরি কোম্পানি সম্পত্তি, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন কুঠি, ফ্যাক্টরি, সামরিক স্থাপনা ও ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি। কিন্তু এদের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৎপরতা তুলনামূলক সহিংস, পরিসরে বিস্তৃত এবং অপেক্ষাকৃত সংগঠিত রূপ লাভ করেছিল। এ পর্যায়ে বিদ্রোহীরা সরাসরি কোম্পানির সম্পত্তি কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ছাড়াও কোম্পানি সরকারের এদেশীয় সহযোগী শক্তি (যেমন: জমিদার, গোমস্তা, ব্যবসায়ী) ও তার সম্পত্তি এবং স্থানীয় রায়ত ও ব্যবসায়ী যারা ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে অনুদান বা চাঁদা বা তোলা বা অন্যান্য পার্থিব সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও সহিংস হয়ে উঠেছিলেন। উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসীদের সরকার-বিরোধী তৎপরতা ফকির ও সন্ন্যাসী গোষ্ঠী যেমন আলাদা আলাদাভাবে চালিয়েছিল, তেমন কখনও কখনও তারা কৌশলগত কারণে ঐক্যবদ্ধভাবেও সক্রিয় ছিল। ফকির নেতা মজনু শাহ ও সন্ন্যাসী নেতা ভবানী পাঠকের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সমন্বয় ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে, উভয় গোষ্ঠী সর্বদাই একসাথে ব্রিটিশ শক্তির মোকাবেলা করেছে— এমন দাবি অগ্রহণযোগ্য। শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজনে ফকিরগণ নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সন্ন্যাসী যোদ্ধাদেরকে নিয়োগ করতেন এমন উদাহরণ অবশ্য কোনো কোনো দলিলপত্রে পাওয়া যায়। সন্ন্যাসী যোদ্ধা ছাড়াও বিদ্রোহী ফকির নেতৃবৃন্দ এমনকি নেপালি, ভুটানি ও পাহাড়ি যোদ্ধাদেরকেও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিতেন।
উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষের পরপরই ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহী তৎপরতা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সক্রিয় ছিল ফকিরদের তৎপরতা। ১৭৭০ এর দশকেই ফকিরদের কমপক্ষে ৩০টি আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। ১৭৮০ সালের পর অবশ্য এ অংশে সন্ন্যাসীদের সক্রিয়তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। সেই তুলনায় ফকিরদের তৎপরতা বেড়ে ছিল কয়েকগুণ। মন্বন্তরের পর উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে ফকির-সন্ন্যাসীদের আগমন ও অবস্থান তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে মনে হয়। এর একটি বিশ্বাসযোগ্য কারণ ছিল এই যে, বিহার ও বাংলার অন্যান্য অঞ্চল, বিশেষ করে বর্ধমান, চব্বিশ পরগনা, মুর্শিদাবাদে দুর্ভিক্ষ যতটা প্রভাব ফেলেছিল, রংপুরসহ পূর্ববঙ্গের জেলাগুলিতে তার প্রভাব সেই তুলনায় কম ছিল। এছাড়া এসময় ফকির-সন্ন্যাসীদের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে মনে হয়। কোম্পানির দলিলপত্রে প্রমাণ মেলে যে, মুঘল, নবাব ও জমি হারানো জমিদারদের চাকরি হারানো সৈন্য, বেকার শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক ও না খেতে পাওয়া মানুষের একাংশ ছদ্মবেশে ফকির-সন্ন্যাসীদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল। রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে বিশেষ করে দুর্ভিক্ষের পর, রাজস্ব দিতে অপারগ কৃষকদের একটি অংশও এই বিদ্রোহী শিবিরে যুক্ত হয়েছিল। সুতরাং সহজেই অনুমেয় যে, উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহী শক্তি যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল। এছাড়া, ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থানে থাকায় উত্তরবঙ্গ ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহী তৎপরতায় অন্যতম পছন্দসই কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র তৎপরতা তুলে ধরতে প্রধানত রতন লাল চক্রবর্ত্তীর লেখার উপর নির্ভর করা হয়েছে।
১৭৬৩ সালে সর্বপ্রথম বাখরগঞ্জে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কুঠি ফকির-সন্ন্যাসী কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং সন্ন্যাসীগণ তথাকার ফ্যাক্টরি প্রধান কেলীকে পরিবেষ্টন করে রাখেন। একই বছর ফকিরগণ ঢাকা ফ্যাক্টরি আক্রমণ করেন এবং পরিশেষে তা দখল করেন। এই আক্রমণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে ঢাকার ফ্যাক্টরি প্রধান লেস্টার তাঁর কর্মস্থল পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। শেষে ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ফকিরদের হাত হতে ঢাকা ফ্যাক্টরিকে পুনরুদ্ধার করেন এবং বন্দি ফকিরদের বলপূর্বক শ্রমে বাধ্য করেন। একই বছর সন্ন্যাসীগণ রাজশাহীর রামপুর বোয়ালিয়ায় কোম্পানির ফ্যাক্টরি আক্রমণ করে ঐ ফ্যাক্টরি প্রধান বেনেটকে গ্রেপ্তার করেন। বন্দি হিসেবে বেনেটকে পাটনায় প্রেরণ করা হলে সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসী তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য ১৭৬৭ সালে ক্যাপ্টন ডি ম্যাকেঞ্জিকে সৈন্যসহ রংপুরে প্রেরণ করা হয়। এ সময় সন্ন্যাসীগণ মালদার রেসিডেন্ট বারওয়েল কর্তৃক প্রেরিত এজেন্ট মার্টেলকে হত্যা করে। ক্যাপ্টেন ডি ম্যাকেঞ্জি এই সন্ন্যাসী দলের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে সন্ন্যাসীদল নেপালের দিকে অগ্রসর হয়।
১৭৭১ সালের দিকে ক্যাপ্টেন জেমস রেনেল ছিলেন পাবনা অঞ্চলে জরিপকার্যে রত। তিনি পাবনার সিরাজগঞ্জের নিকটস্থ স্থানে বেলকুচি হতে জানান যে ফকিরগণ সংখ্যায় অনেক এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ এই জেলার বিভিন্ন স্থানে সমবেত হচ্ছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এই তথ্য অবগত হয়ে রাজশাহী ও দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করেন।
১৭৭১ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। মন্বন্তর ও মন্বন্তর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে জনজীবনে যে সীমাহীন দুর্দশা লক্ষ করা যায় তার ফলশ্রুতি ছিল ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের ব্যাপকতায়। এ সময় বাংলাদেশের দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। ফকিরগণ বগুড়ার মহাস্থানগড়ে সমবেত হতেন তাঁদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য। ক্যাপ্টেন জেমস্ রেনেলের বর্ণনা হতে জানা যায়, ১৭৭১ সালে লেফটেন্যান্ট ফেলথামের নেতৃত্বে কোম্পানির একদল সৈন্য ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জের পথে ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ করেন। হঠ্যাৎ আক্রমণে ফকির-সন্ন্যাসীগণ পরাজিত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পলায়ন করেন। এ সময় অশ্বপৃষ্ঠে মজনু শাহ শতাধিক নিরস্ত্র অনুসারী নিয়ে মহাস্থানের দিকে অগ্রসর হন। এই ঘটনার পর মহাস্থানগড় এলাকায় স্থায়ীভাবে কোম্পানির সৈন্য মোতায়েনের প্রয়োজন হয়।
রাজশাহী জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতার প্রচণ্ডতা লক্ষ করা যায় ১৭৭২ সালে, যখন মজনু শাহ সশস্ত্র অনুচর নিয়ে উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত। রাজশাহীতে অবস্থানরত কোম্পানির সুপারভাইজারের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী কয়েকশ সশস্ত্র অনুচরসহ ফকির নেতা কোম্পানির আদায়কৃত খাজনার অর্থ নিয়ে যায়, এমনকি তাদের পক্ষে পরগনার কাছারি দখল করে রাখাও অসম্ভব হয়। নাটোরে অবস্থানরত কোম্পানির সুপারভাইজারের পত্রানুযায়ী ফকির দল ছিল তলোয়ার, বর্শা, গাদা বন্দুক ও কামানে সজ্জিত। একই বছর রংপুরে সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহাত্মক তৎপরতার তথ্য প্রদান করেন রংপুরের সুপারভাইজার পার্লিং, যিনি এই ঘটনার কয়েক মাস অব্যবহিত পরই সন্ন্যাসীদের হাতে নিহত হন।
১৭৭৬ সালে পুনরায় উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী ও দিনাজপুরে ফকির-সন্ন্যাসী তৎপরতার লক্ষ করা যায়। এ সময় বগুড়া জেলায় কোম্পানির সুপারভাইজার নিযুক্ত হয়ে আসেন গ্লাডডাউইন, যিনি ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এই অঞ্চলে কোম্পানির সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। কিন্তু কোম্পানির পক্ষ হতে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত লেফটেনান্ট রবার্টসনের নেতৃত্বে কোম্পানির একদল সৈন্য প্রেরণ করা হয় যাদের সাথে ফকির-সন্ন্যাসীদের তীব্র সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ সম্পর্কে গ্লাডউইনের বিবরণ ছিল: “গতরাত ন’টায় নিজের ক্যাম্প হতে রওনা হয়ে প্রায় নয় ক্রোশ পথ অতিক্রম করার পর আজ সকালে সূর্যোদয়ের পূর্বেই আমরা ফকির মজনুর শিবিরের নিকট উপস্থিত হলাম। আমাদের আগমন সম্পর্কে তাদের কাছে ছিল না কোনও পূর্বাভাষ। এ জন্যই তারা প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের চতুর্দিকে বৃত্তাকারে অবস্থান করছিল। সংখ্যায় ফকির-সন্ন্যাসীগণ তিন শতাধিক হলেও তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতই শিথিল ছিল যে তাদের বিশ গজের মধ্যেও আমাদের উপস্থিতি তারা উপলব্ধি করতে পারেনি। আমাদের দর্শন মাত্রই তারা অস্ত্রহাতে আমাদের আক্রমণে উদ্যত হল এবং এ সময়ই আমরা আমাদের সৈন্যদের গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিলাম। ফকির-সন্ন্যাসী দল পেছনের জঙ্গলে আশ্রয় নিল এবং আমাদের প্রতি পালটা গুলিবর্ষণ শুরু করল। এই গুলিবর্ষণে আমাদের কয়েকজন সৈন্য আহত হয় এবং আমার পায়েও একটা গুলি লাগে। আমরা ভাবতে পারিনি যে অপ্রস্তুত ফকির-সন্ন্যাসীগণ এরূপ অতর্কিত আক্রমণের পরও আমাদের রুখে দাঁড়াতে পারবে। প্রায় আধ ঘণ্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এই ফকির দল স্থান ত্যাগ করে। তাদের নেতা মজনু শাহও অশ্বপৃষ্ঠে পলায়নে সমর্থ হয়।
ময়মনসিংহের আলেপসিংহ পরগনায় ১৭৮২ সালের দিকে ফকির-সন্ন্যাসীদের তৎপরতা তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় পুখরিয়া নামক স্থানে মজনুর সাথে কোম্পানির সৈন্যদলের এক সংঘর্ষ হয় এবং মজনু শাহ শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুসারীদের নিয়ে মধুপুর জঙ্গলে পালিয়ে যান। ১৭৮৫ সালের দিকে মজনু শাহ পুনরায় মহাস্থানগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় কোম্পানির সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে। পরবর্তী বছর ফকিরগণ স্বতন্ত্র দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত হন। মজনু শাহের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ জেলা সংলগ্ন অঞ্চল এবং অন্যদিকে মুসা শাহের নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে কোম্পানি-বিরোধী বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা শুরু করেন। এই দ্বিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল সম্ভবত কোম্পানির শক্তি ও ক্ষমতাকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে অতিমাত্রায় ব্যস্ত করে তোলা। ১৭৮৬ সালে মজনু শাহের সাথে কোম্পানির সৈন্যদলের পর পর দুটি মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। এ সময় লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের সাথে কালেশ্বর এলাকায় সংঘর্ষে মজনু শাহ তাঁর বহুসংখ্যক অনুসারী হারান। তাঁর আহত অনুচরদের একাংশকে ডুলি যোগে মেওয়াট নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে মজনু শাহ্ নিজে কোন অভিযান পরিচালনা করেন নি। সম্ভবত ১৭৮৭ সালে কানপুর জেলার মাখনপুরে মজনু শাহ্ মৃত্যুবরণ করেন।
মজনু শাহের উত্তরাধিকারীগণ ছিলেন মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবাহান শাহ, মাদার বক্স, জরি শাহ, করিম শাহ প্রমুখ যারা অনেকেই ছিলেন মজনু শাহের আত্মীয়। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের পুরোধা মজনু শাহ লোকান্তরিত হবার পরও তার সুযোগ্য উত্তরসূরিগণ পুরো আঠারো শতক পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তবে ক্রমশ এই আন্দোলনের গতি হয়ে পড়ে স্তিমিত। বাংলাদেশে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিতে এবং প্রায় সমগ্র অঞ্চলজুড়ে প্রসার লাভ করেছিল।
১৭৮৮ সালে নিয়ামতপুরে মুসা শাহ ও তাঁর অনুসারীদের সাথে কোম্পানির সৈন্যদলের এক সংঘর্ষের পর ফকিরগণ শৈলবর্ষের দিকে অগ্রসর হলে দিনাজপুরের কালেক্টর রংপুরের কালেক্টরের মাধ্যমে রংপুর এলাকায় ফকিরদের আশ্রয় না দেয়া এবং ফকিরদের বাধা প্রদান ও গ্রেপ্তারেরর জন্য জমিদারদের সাহায্য কামনা করেন। জমিদারশ্রেণি ব্যতীত ফকির-সন্ন্যাসীগণ স্থানীয় জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করেন। বরকতুল্লাহ্ প্রদত্ত বিবরণীতে কিন্তু দেওয়ান কর্তৃক পরাগ আলী ও অন্যান্য ফকিরদের সাহায্য দান স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রমাণ করে যে ফকির-সন্ন্যাসীগণ স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্যও লাভ করেন। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে স্থানীয় জনগণের ভূমিকার স্বরূপ উদ্ঘাটনে কোম্পানির কর্মচারীগণও ব্যর্থ হয়েছেন। কখনও কখনও গ্রামবাসীদের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করে বিস্মিত হয়েছেন কোম্পানির কর্মচারীগণ। রাজশাহীতে এক সংঘর্ষের সময় গ্রামবাসী কোম্পানির জমাদার বা গুপ্তচর কাউকে সাহায্য করেনি; অন্যদিকে তারা ফকিরদের কোন প্রকার বাধা প্রদানও করেনি। প্রকৃতপক্ষে গ্রামবাসীদের এই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা প্রকারান্তরে ফকিরদের প্রতি সহযোগিতামূলক। এ তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে সাধারণ জনগণ তথা গ্রামবাসী ফকির-সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে কোম্পানিকে কোনও প্রকার সাহায্য করেনি, অধিকন্তু কোম্পানির সৈন্যদলের সাথে সংঘর্ষের একপর্যায়ে গ্রামবাসীগণ ফকির-সন্ন্যাসীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দিনাজপুরের কালেক্টর লিখেছেন যে, গ্রামবাসী বিপদের সময় ফকির-সন্ন্যাসীদের আশ্রয় প্রদান করে। গ্রামবাসীগণ এই তৎপরতা হতে বিরত না হলে ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। ফকির-সন্ন্যাসীদের সাথে গ্রামবাসীদের একাত্ম হয়ে যাবার তথ্য যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি, এই তথ্য নিঃসন্দেহে এই বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করে। এই দেশের বৃহত্তম সমাজে ফকির-সন্ন্যাসী একটি সম্প্রদায়। দেশের চরম আর্থিক দুর্দশা ও শাসনের যাঁতাকালে ফকির-সন্ন্যাসীদের স্বার্থ ও তাদের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্যের স্বার্থে সাধারণ জনগণের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য অভিন্ন হয়ে যায়। সুতরাং ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে নিয়োজিত বিশুদ্ধ সৈন্যদলের সাথে, সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক।
ফকির-সন্ন্যাসীদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মজনু শাহ্। পঞ্চানন দাসের মজনুর কবিতার অন্তরালে মজনু শাহের যে প্রভাব ও প্রতিপত্তির উপর আলোকপাত করা হয়েছে, তাও মজনুকে ফকির দলের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে মজনু শাহ্ ছিলেন শাহ্ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানার উত্তরকালীন মাদারীয়া সুফী সম্প্রদায়ের নেতা। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা একদিকে তাঁর অপ্রতিহত গতিকে রুদ্ধ করতে পারে, অন্যদিকে তাঁর সুফী নেতৃত্বের সামাজিক মর্যাদাতেও আঘাত হানতে পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় তাঁর প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল না। বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন প্রকৃতির আন্দোলনে ধর্মীয় নেতাদের নেতৃত্ব প্রদানের তথ্য সর্বজনবিদিত। সম্ভবত মজনু শাহ্ ছিলেন এই নেতৃত্বের পথিকৃৎ। অন্যদিকে সন্ন্যাসীদেরও এই বিদ্রোহে একাত্ম প্রকাশ করার পক্ষে কোনও বাধা ছিল না। কেননা ফকির-সন্ন্যাসীগণ উভয়েই ছিলেন তৎকালীন কোম্পানির শাসনপ্রসূত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচারের শিকার এবং উভয়েরই মূল লক্ষ্য ছিল এক। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ যেমন ফকির-সন্ন্যাসীদের সাধারণ শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেন ফকির-সন্ন্যাসীগণও তেমনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে শত্রু হিসেবে মনে করতেন। এছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই দুটি সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সন্ন্যাসীদের পক্ষেও ফকির নেতা মজনু শাহের নেতৃত্ব মেনে নেয়া অসম্ভব ছিল না। নেতৃত্বের প্রশ্ন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রথম পর্যায়ে লক্ষ করা যায়নি। সম্ভবত যে অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসীদের মধ্যে শক্তি ও সামর্থ্যরে তুলনায় যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন তারাই সে অঞ্চলে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ফকির বা সন্ন্যাসীগণ কখনও এককভাবে এবং কখনও যৌথভাবে অথবা কখনও উভয় দলই কোনও উল্লেখযোগ্য নেতা ছাড়াই বিদ্রোহ পরিচালনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এর কারণ ছিল তাদের মধ্যকার আদর্শগত ঐক্য। অবশ্য ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মধ্যে উভয় সম্প্রদায় কখনও কখনও আত্ম-বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন। এই তথ্যটি বর্তমান প্রবন্ধের পরিমণ্ডলে বিবেচনা করলে বলতে হয়, তাদের মধ্যকার আত্মকলহ সম্ভবত নেতৃত্বের কোন্দল বা ভুল বুঝাবুঝিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পরবর্তী নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক। ভবানী পাঠক একজন ভোজপুরী ব্রাহ্মণ এবং সরকারি নথিপত্র ভবানী পাঠককে ডাকাত হিসেবে অভিহিত করে। লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের বিবরণ অনুযায়ী দেবী চৌধুরাণী একজন ছোটো জমিদার, যার সাথে ভবানী পাঠকের যোগাযোগ রয়েছে এবং ভবানী পাঠকের সাথে মজনু শাহের যোগাযোগ রয়েছে। ভবানী পাঠক কেবলমাত্র কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের সহায়ক দেশীয় বণিকদের গাঁজা ও আফিমের নৌকাই লুট করছেন না, তিনি ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ প্রতিহত করার জন্য নিয়োজিত লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের সৈন্যদলের রসদ যোগানোর নৌকাও লুট করেছেন। অধিকন্তু ভবানী পাঠক কোম্পানির গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও সরাসরিভাবে অগ্রাহ্য করেছেন। তবে ভবানী পাঠককে দেবী চৌধুরাণী বা মজনু শাহের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কোন বিদ্রোহ পরিচালনা করতে দেখা যায় না। তাই পাঠক ও দেবী চৌধুরাণীর সাথে ফকির-সন্ন্যাসীদের সম্পর্ক কিছুটা অস্পষ্ট হলেও একথা বলা যায় যে ভবানী পাঠক ছিলেন কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী একজন নেতা।
আন্দোলনের পরিণতি ও প্রভাব
সুবা বাংলায় ব্রিটিশ কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আঠারো শতকেই ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষগুলোর তরফ থেকে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অনেকগুলো ছোটো-বড়ো সরকার বিরোধী আন্দোলন লক্ষ করা যায়। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বাদে ঐসব আন্দোলনের মধ্যে জমিদার বিদ্রোহ, ত্রিপুরা জেলার সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের বিদ্রোহ (১৭১৯), বাখরগঞ্জের সুবান্দিয়া বিদ্রোহ (১৯৭২) উল্লেখযোগ্য। এসব বিদ্রোহ বা সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের ভেতরে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশীল ছিল ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন। সময়ের পরিক্রমা ও সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের স্থানগত বিস্তৃতি তুলনায় এর মতো বড়ো পরিসরের আন্দোলন সমকালে আর ছিল না। তবে, অন্যান্য আন্দোলনের ন্যায় সমাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি ধারার এর চার দশকব্যাপী আন্দোলনকে কোম্পানি সরকার অন্তিমে দমন করতে সক্ষম হয়। দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উনিশ শতকের প্রথম দশকেই উত্তরবঙ্গের ফকির-সন্ন্যাসীদের সরকার বিরোধী তৎপরতা দৃশ্যত অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। সরকার সফলভাবে এই আন্দোলনের রাশ টেনে ধরে। সেই প্রয়োজনে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিল। ভ্রাম্যমান নাগা-সন্ন্যাসী ও ফকিরগণ যেন উত্তর ভারত ও নেপাল থেকে সহজে উত্তরবঙ্গে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন সীমান্তে ও প্রবেশমুখগুলোতে সরকার অনেকগুলো স্থায়ী ও অস্থায়ী সৈন্যঘাঁটি, নজরদারি চৌকি, কাস্টম পোস্ট, পুলিশ ক্যাম্প, প্রভৃতি স্থাপন করে। যেমন, ১৭৭০ সালে অযোদ্ধার চুনারে কোম্পানি স্থায়ীভাবে সৈন্যঘাঁটি গড়ে তোলে। ফলে পশ্চিম দিক থেকে উত্তরবঙ্গে নাগা সন্ন্যাসীদের প্রবেশ বহুলাংশে হ্রাস পায়। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দরগা ও তীর্থস্থানে স্থায়ী সৈন্যঘাঁটি ও থানা নির্মাণ করে সরকার আন্দোলনের গতি পালটে দিতে সক্ষম হয়। ১৭৭১ সালের পরপর বগুড়ার মহাস্থানগড়ে স্থায়ী সৈন্যঘাঁটি নির্মাণ করা হয়। দিনাজপুরের নেকমরদের দরগার সন্নিকটে (বর্তমান ঠাকুরগাঁও এর অধীন) ও বগুড়ার ‘Apole’ পরগনায় (বর্তমান অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি) পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের ফলে এ এলাকায় ফকির-সন্ন্যাসীদের চলাচল ও কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।৪০ এছাড়া, ধৃত অপরাধীদের আটক রাখার জন্য রংপুরে কারাগার স্থাপন করা হয়। সরকার মাঠ প্রশাসনে সর্বদাই সজাগ দৃষ্টি রাখতে, বিশেষত ফকির ও সন্ন্যাসী নেতাদেরকে আটক করতে গোয়েন্দা তৎপরতা চালায় ও পুরস্কার ঘোষণা করে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে সরকার ডাক হরকরা ও ঘাট মাঝিদেরকে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। ফকির নেতা চেরাগ আলীকে ধরিয়ে দিলে তৎকালীন ৪০০০ (চার হাজার) টাকা পুরস্কারের ঘোষণা রীতিমত চাঞ্চল্য তৈরি করে।৪১ এর বাইরে সরকার স্থানীয় সাধারণ জনতা ও জমিদারদেরকে নানা আইন, নির্দেশ ও প্রলোভনের মাধ্যমে এমনভাবে চালিত করে যাতে ফকির-সন্ন্যাসীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সরকার ১৭৯৪ সালে এক ঘোষণায় জানিয়ে দেয় যে, ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে হত্যা করলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না। প্রকৃত অর্থে, ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর বাংলায় সুবিন্যস্ত ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশী ও বিচারিক প্রশাসন গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার অল্পকালের মধ্যেই ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন শেষপর্যন্ত যে ব্যর্থ হল, তার অন্যতম কারণ হিসেবে আন্দোলনে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত নেতৃত্বের অভাবকে দায়ী করা হয়। উত্তরবঙ্গে ১৭৮৭ সালের পর ফকির আন্দোলনের প্রধান নেতা মজনু শাহ’র অনুপস্থিতি এবং ১৭৮৮ সালে তাঁর মৃত্যু এতদ্অঞ্চলের আন্দোলনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদিও এরপর মুসা শাহ, সোবহান আলী শাহ, চেরাগ আলী শাহ, আমুদি শাহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সরকার বিরোধী তৎপরতা চলমান রাখেন, কিন্তু তাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব অন্তিমে কোনো নির্ধারণী ফল আনেনি। ১৭৯২ সালে এরূপ অন্তকলহে ফকির নেতা পরাগ আলী শাহের হাতে মুসা শাহ নিহত হন। সন্ন্যাসী নেতা মুতি সিং এর সাথে দ্বন্দ্বে প্রাণ যায় চেরাগ আলী শাহ এর। পরিণতিতে, ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন ছাড়াই সমাপ্ত হয়।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন তবে কী কোনো প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়নি? নিঃসন্দেহে স্বীকার্য যে, উল্লিখিত আন্দোলন সমকালে তো বটেই, পরবর্তীকালেও ব্রিটিশ প্রশাসন ও এতদ্অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী জনতাকে এক ঘোরের মধ্যে রেখেছিল। নবপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানি সরকার এই অঞ্চলে শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন তথা নিজের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠালগ্নে যখন তৎপর, তখন ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন চার দশক ধরে তাকে যেভাবে চিন্তিত করেছিল— তার প্রমাণ পাওয়া যায় গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস স্বয়ং যখন এই আন্দোলন দমন করতে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের ফলে সরকার আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন কাছারি থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যেতে থাকে। বাকি পড়ে বহু অংকের রাজস্ব। শুধু রংপুর জেলাতেই ১৭৮০ সালে ৪৪,৪৪২ টাকা ও ১৭৮১ সালে ১,০৬,৮০৭ টাকা রাজস্ব বকেয়া ছিল।৪২ এছাড়া উত্তরবঙ্গে কোম্পানির গাঁজা, আফিম, নীলসহ অন্যান্য অর্থকরী পণ্য উৎপাদন ও বিদেশে পরিবহন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। ফলে, সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন কোম্পানি সরকারের নিকট থেকে স্থায়ী বিজয় অর্জন করতে না পারলেও উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের বৃহৎ অংশের নিকট এই আন্দোলন যথেষ্ট সমীহ আদায় করেছিল বলে অনুমিত হয়। উত্তরবঙ্গের বহু স্থানের নাম আজও ফকির-সন্ন্যাসীদের বিশেষ করে ফকিরদের নামে থাকায়, এটি প্রমাণিত হয় যে, উত্তরবেঙ্গর মানুষের এক উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে এরা আদরণীয় ছিলেন। যতই কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ও কাগজপত্র ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে ‘দস্যু’, ‘ডাকাত’ নামে অভিহিত করুক, সাধারণ মানুষের নিকট তাদের এই গ্রহণযোগ্যতা ইতিবাচকভাবে বিবেচনাযোগ্য। অবশ্য, ছদ্মবেশী, অত্যাচারী ও লুটেরা ফকির-সন্ন্যাসী যে সেকালে বিরল ছিল তাও নয়।
আন্দোলনের স্বরূপ
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনকে বহুরূপে বহুভাবে বিশ্লেষিত ও চিহ্নিত হতে দেখা যায়, স্থানীয় (ভারতীয় ও বাংলাদেশী) ও বিদেশী গবেষকদের দ্বারা। এই বিশ্লেষণের গোড়ায় কারও কারও আছে মতাদর্শিক পূর্ব অবস্থান, কারও কারও পার্থিব স্বার্থ ও কারও আছে শুধু কোম্পানি দলিল-দস্তাবেজ ভিত্তিক অনুসিদ্ধান্ত। যামিনী মোহন ঘোষণ এই আন্দোলনকে ‘রক্তপিপাসু লুটেরাদের’ আন্দোলন, আনন্দ ভট্টাচার্য ‘দুস্কৃতকারীদের কর্মকাণ্ড যারা গ্রামীণ জীবনে খলনায়ক ছিল’, ম্যাথিউ ক্লার্ক এ আন্দোলনকে ‘ছদ্মবেশী’ সন্ন্যাসীদের আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন। মার্ক্সবাদী গবেষক সুপ্রকাশ রায় এই আন্দোলনকে ‘উপনিবেশ বিরোধী’, ‘সামন্ত বিরোধী’ ‘কৃষকের যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অতীশ কে. দাসগুপ্ত ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এই আন্দোলনকে উপনিবেশ বিরোধী ‘গণ আন্দোলন’ হিসেবে দেখেছেন। রতন লাল চক্রবর্ত্তী এই আন্দোলনকে কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে ‘প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন কোনো অর্থেই দুস্কৃতিকারীদের আন্দোলন নয়, নয় উপনিবেশ বিরোধী, সামন্তবাদ বিরোধী কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল ঔপনিবেশিক ও শোষণমূলক নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু অসংগঠিত স্থানীয় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। এই আন্দোলন ছিল ঔপনিবেশিক, অগণতান্ত্রিক, আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে এই নতুন শাসন পদ্ধতিতে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থপক্ষসমূহের সশস্ত্র সংগ্রাম। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই সংগ্রামের এক পক্ষে ছিল প্রচণ্ড মুনাফাখোরী বিশ্বপুঁজির পতাকাবাহী স্বার্থ। অপরপক্ষে ছিল খুব ছোটো পরিসরের স্থানীয় পুঁজির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সচেষ্ট স্বার্থ। এই দুই স্বার্থপক্ষের মধ্যে কোনো পক্ষেরই সমঝোতা করা বা ছাড় দেওয়ার প্রবণতা ছিল না। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, এই দুই স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারীদের এক পক্ষ ছিল বাংলার তথা উপমহাদেশের মাটিতে সর্ব বিজয়ী ‘ইগো’ সম্পন্ন কোম্পানি। অপরপক্ষে ছিল এই মাটির আধ্যাত্মিক ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান, ইতোপূর্বেকার স্থানীয় শাসকবর্গের সমীহ আদায়কারী ও স্থানীয় জনগণের গুরুত্বপূর্ণ অংশের দৃষ্টিতে পার্থিব ও অপার্থিব সংকট-সমাধানকারী ‘ইগোসম্পন্ন’ ফকির-সন্ন্যাসীরা। ফলে, উভয়ের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত ছিল অনিবার্য।
পরিশেষে বলা যায় যে, আঠারো শতকে কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষে ফকির-সন্নাসী আন্দোলন যতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল, তার মধ্যে সুবা বাংলা ছিল অন্যতম। বৃহত্তর বাংলার অভ্যন্তরে উল্লিখিত আন্দোলন আবার উত্তরবঙ্গে সর্বাপেক্ষা সক্রিয় ছিল। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান, জলে ও স্থলে তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে সহজ যোগাযোগ সুবিধা, অসংখ্য পবিত্র তীর্থস্থান ও ধর্মীয় স্থাপনার উপস্থিতি ফকির-সন্ন্যাসীদেরকে দীর্ঘকালব্যাপী উত্তরবঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। পাশাপাশি এত্দঅঞ্চলের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা ও ধর্মানুভূতিও ফকির-সন্ন্যাসীদের এ অঞ্চলে বিচরণের অন্যতম কারণ। সেকারণে, উত্তরবঙ্গ জুড়ে ভ্রাম্যমান ফকির-সন্ন্যাসীদের সাথে সাথে গৃহী বা আবাসিক ফকির-সন্ন্যাসীদের উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছিল। ১৭৫৭ সালে সুবা বাংলা বিজয়ী কোম্পানি অত্র অঞ্চলে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মানসে যে মারমুখী আচরণ ও আইন-পদক্ষেপ-প্রতিষ্ঠান চালু করেছিল, তার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত স্থানীয় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন। সে অর্থে এটি ছিল শোষণমূলক মানসিকতাসম্পন্ন স্বৈরাচারী নতুন কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রভাবশালী অরাজনৈতিক পুরানো স্থানীয় শক্তির প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ উত্তরবঙ্গে সূচনা থেকেই সশস্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল। ১৭৭০ সালের পর এ অঞ্চলে সে প্রতিরোধ অপেক্ষাকৃত সহিংস, জোরালো ও নিয়মিত হয়ে পড়ে।
উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসীগণ শুধুই ধর্মীয় কারণে ও সামাজিক প্রভাব হারানোর শঙ্কায় ব্রিটিশ কোম্পানির বিরোধিতা করেছিল, বিষয়টি এত সরল নয়। এদের, বিশেষ করে সন্ন্যাসী মহাজন-ব্যবসায়ীদের পুঁজির স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে, যা সেকালে কোম্পানি সরকার অনুসৃত পদক্ষেপের কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, এরা নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তাছাড়া, সরকারি নীতির ফলে ফকির-সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ক্ষতিগ্রস্ত স্বার্থপক্ষের একাংশ— সম্পত্তিচ্যুত জমিদার, চাকরি হারানো সৈন্য, বেকার শ্রমিক-কারিগর, ভূমিহীন ও রাজস্ব দিতে অপারগ কৃষক, ইত্যাদি, এই আন্দোলনে সশস্ত্র এবং অন্যান্য ভূমিকায় অংশ নিয়েছিল। আবার এ আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে তাদের অপর অংশ সরকার বিরোধিতার আড়ালে আদতে সাধারণ জনতা ও উৎপাদক শ্রেণির উপর নিপীড়ন চালিয়েছিল বলে প্রমাণ মেলে।
উত্তরবঙ্গে আলাচ্য আন্দোলন দমন করতে সরকার প্রথম থেকেই সচেষ্ট হয়। সরাসরি শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সরকার আন্দোলন নস্যাৎ করতে গোয়েন্দা তৎপরতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ আনয়ন, নজরদারি বৃদ্ধি, স্থানীয় জমিদার ও জনতাকে সরকার-সহযোগী করে তুলতে ভীতিসৃষ্টিকারী অদৃষ্টপূর্ব পদক্ষেপ গ্রহণ, ফকির-সন্ন্যাসী নেতৃত্বের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি, প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলে, আঠারো শতকের শেষ দশকে এই আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়।
প্রকৃতপ্রস্তাবে, ব্রিটিশ ভারতব্যাপী ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবগুলোর সাথে মিল রেখেও উত্তরবঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ অঞ্চলে আলোচ্য আন্দোলন সাধারণ মানুষের বড়ো এক অংশের উপর প্রভাব ফেলেছিল লক্ষণীয় মাত্রায়। সরকার এ ভূখণ্ডেই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল— আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই, জনমনে অবস্থান তৈরির ক্ষেত্রেও তা বিবেচ্য। সমগ্র উত্তরবঙ্গব্যাপী ফকির-সন্ন্যাসীদের নামে অসংখ্য স্থানের নামকরণ সেই স্মৃতি-সার বহন করে। উল্লেখ্য, ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের স্বরূপ যেমন শুধু কোম্পানি দলিলে খুঁজা বাতুলতা, তেমনি আদর্শভিত্তিক ছাঁচে যাচাই ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য। খোলা মন নিয়ে চারঘাট বিবেচনা করে এই বিরাট ও জটিল ক্যানভাসকে দেখতে চেষ্টা করার বাইরে উপযুক্ত বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র:
১. মাহবুব সিদ্দিকী, ‘উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক পরিচয় ও প্রশাসনিক বিভাজন’, ড. মিজানুর রহমান নাসিম (সম্পা.), মননরেখা, বর্ষ ৬, সংখ্যা ১০, জুন ২০২২, পৃ. ২৮।
২. ড. আনন্দ গোপাল ঘোষ, ‘ঔপনিবেশিক শাসনামলের উত্তরবঙ্গ (১৭৬৫-১৯৪৭)’, মননরেখা, বর্ষ ৬, সংখ্যা ১০, পৃ. ৮০।
৩. কোনটি উত্তরবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের সীমানা বদল নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন; মননরেখা, বর্ষ ৬, সংখ্যা ১০, জুন ২০২২ এর ‘উত্তরবঙ্গ’-এর পরিচিত ও ভূরাজনীতি অংশের প্রবন্ধগুলো; ও Rai Monmohon Chakrabarti Bahadur; ‘A Summary of the Changes in the Jurisdition of Districts in Bengal 1757-1916’
৪. মননরেখা, বর্ষ ৬, সংখ্যা ১০, পৃ. ৮৩
৫. রতন লাল চক্রবর্ত্তী, ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০)’; মুনতাসীর মামুন (সম্পা.), বাংলাদেশ নিম্নবর্গ, দ্রোহ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ (১৭৬৩-১৯৫০), কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৪৮
৬. ঐ
৭. বিস্তারিত জানতে দেখুন, M. N. Haq, ‘Shah Badi-al Din and his Tarigh in Bengal’; Journal of the Asiatic Society of Pakistan, Vol. 12, Dacca, 1967. pp. 95-110
৮. Ananda Bhattacharyya, ‘The Wandering Fakirs of Bengal : Heroes or Villains?’, South Asia Research, Vol. 30 (1), Sage Publication, 2016, p. 6
৯. রতন লাল চক্রবর্ত্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮
১০. ঐ
১১. J. N. Farquhar, ‘The Organization of the Sahnayasis of the Vedanta’, Journal of the Royal Asiatic Society, Vol. 57 (3), 1925, pp. 482-83
১২. M. Clarck, ‘The Dasnami Sannyasis, The Integration of Ascetic Lineages into an Order’, Brill Academic Publishers, Boston, 2006, pp. 81-100
১৩. J. N. Farquhar, op. cit., pp. 481-83
১৪. M Clarck, op. cit., pp. 81-100
১৫. Ananda Bhattacharyya, ‘Sannyasi and Fakir Rebellion in Bihar (1766-1800)’, p. 31
১৬. op. cit., p. 32
১৭. রতন লাল চক্রবর্ত্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১-৫২; Ananda Bhattacharyya, ‘Sannyasi and Fakir Rebellion in Bihar (1766-1800)’, p. 41
১৮. Ananda Bhattacharyya, op. cit., p. 41
১৯. Md. Rezaul Karim, ‘Fakir-Sannyasi Movement in Rajshahi : Regional study of a Pioneer Peasant Resistance in Colonial Bengal’, Journal of Social Science, Rajshahi College, 2 (1), Rajshahi, July 2021, p. 71
২০. নিখিল সুর, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ’, সুবর্ণরেখা, কলিকাতা, ১৯৮২, পৃ. ৫০-৫১
২১. Ananda Bhattacharyya, ‘Reconsidering the Sanayasi Rebellion’, Social Scientist, Vol. 40, No. ¾ (March-April 2012), p. 85
২২. নিখিল সুর, প্রাগুত্ত, পৃ. ৪৯
২৩. সিরাজুল ইসলাম (সম্পা.) ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, ১৭০৪-১৯৭১’, ১ম খণ্ড, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২য় মুদ্রণ, ২০১৭, পৃ. ১০৮
২৪. Atis K. Dasgupta, ‘The Fakir and Sannyasi Uprisings’, K P Bagchi and Company, Kolkata, 1992, p. 10
২৫. Ananda Bhattacharyya, ‘Reconsidering the Sannayasi Rebellion’, p. 85
২৬. op.cit., p. 86
২৭. ibid
২৮. ibid, p. 87
২৯. ibid, p. 88
৩০. ibid, p. 83, 87
৩১. Ananda Bhattacharyya, ‘The Wandering Fakirs of Bengal : Heroes or Villains?’ op. cit., p. 6
৩২. L. S. Trotter, ‘Warren Hastings : A Biography’, London, 1910, pp. 100-06; M. E. Jones, ‘Warren Hastings in Bengal, 1772-74’, Oxford, 1918, pp. 178-79
৩৩. W. W. Hunter, ‘The Annals of Rural Bengal’, London, 1868, pp. 70-71
৩৪. নিখিল সুর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯ (ছাপার ভুলের কারণে পৃষ্ঠা নং ৯৪ উল্লেখ আছে।)
৩৫. সিরাজুল ইসলাম, ‘ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো’, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮-২৮০; সিরাজুল ইসলাম, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, ১ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮; Ananda Bhattacharyya, ‘Reconsidering the Sannayasi Rebellion’, p.90
৩৬. Ananda Bhattacharyya, ‘The wandering Fakirs…’, op. cit, p.4 ; Ananda, ‘Reconsidering…’, p. 86; Chakraborty 1 & Gupta, S. Dinajpur (1757-1947), Micro Computer center, Kolkata, 2014, p. 42
৩৭. সিরাজুল ইসলাম, ‘ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো’, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮১-৮২
৩৮. Amrita Sengupta, ‘Sannyasi Fakir Rebellion’, NSOU OPEN Journal vol. 3, no.2 (July 2020)
৩৯. Buchanan Hamilton, ‘Account of Rangpur’, India Office library and Records, 1810, Book 1, p. 76
৪০. রতন লাল চক্রবর্ত্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫ ; Ananda Bhattacharyya, ‘Horoes or Villains’; p. 16
৪১. Ananda Bhattacharyya, ‘Villains’; p. 16
৪২. Amrita Sengupta, op. cit.
[ কৃতজ্ঞতা : ‘মননরেখা’ ]