শমশের গাজী : কৃষক আন্দোলনের এক বিশ্রুত নায়ক 

 তাপস দেবনাথ

অষ্টাদশ শতকে একের পর এক আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল, ভারতের নানা প্রান্ত। জমিদারি শোষণ, ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সন্দ্বীপের বিদ্রোহ, তাঁতিদের বিদ্রোহ, চাকমা বিদ্রোহ সহ ছোটো বড়ো বিদ্রোহের ঝড় উঠেছিল বাংলা প্রদেশ জুড়ে। 

শমশের গাজীর আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছিল রাজন্য ত্রিপুরা ও বাংলার নবাবকে। কৃষকরা পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। ওই সময় বেনিয়া ইংরেজরা বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে রাজদণ্ড হাতে নিতে উন্মুখ। বাংলার নবাব সিরাজউদৌল্লাকে হটাতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ১৭৫৭ সালে তারা সফল হয়। মোগল শাসকরা দুর্বল। কিন্তু কৃষকের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এমন এক সময়ে উত্থান শমশের গাজীর। 

মধ্যযুগে তথা ষোড়শ শতকে ত্রিপুরায় দাসপ্রথা যেমন ছিল তেমনি ছিল বেগার শ্রম। (রাজার সেবায় নিয়োজিত বিনে পয়সার শ্রমিক। একে বলা হত তিতুন প্রথা। বেগার শ্রম প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন গড়ে ওঠে ১৯৪৫ সালে জনশিক্ষা সমিতি গড়ার পর থেকে। ১৯৪৯ সালে রাজন্য যুগের অবসানে এই প্রথা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়)। অমর মাণিক্যের সময়ে (১৫৭৭-৮৬) রাজা অমরসাগর নির্মাণে শ্রীহট্টের তরপ অঞ্চলের শাসন কর্তার কাছে প্রচুর পরিমাণ দাস চেয়ে পাঠান। তরপের শাসনকর্তা দাস সরবরাহে অসম্মত হলে অমর মাণিক্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সে সময় অনাহার, জলকষ্ট, সর্দারদের নিপীড়ন, চার পাঁচ রকমের কর সহ নানা উৎপীড়নে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। সর্দাররা যে দাস নিয়োগ করতা তার বেশিরভাগ রাজার সেবায় নিয়োজিত থাকত। মূলত হাতি ধরার জন্য। শক্ত সমর্থ যুবকদের জোর করে বেগার খাটানো হত। সে সময় মানুষের চেয়ে মনুষ্যেতর জন্তুর দাম ছিল বেশি।

ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাসের বই ‘রাজমালায়’ সব রাজাকেই প্রজাবৎসল হিসাবে দেখানো হয়েছে। তাতে কোনোভাবেই প্রজাদের অবস্থা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবু রাজমালায় দু-এক ছত্র লেখা থেকে অনুমান করা যায় তৎকালীন সময়ের অবস্থা। রাজমালায় ‘অমর মাণিক্য’ খণ্ডে ত্রিপুরার অবস্থা সম্পর্কে একটি পঙ্‌ক্তি এরকম—

গোমূল্য চারি আনা ছাগ দুই পণ।                                                                                                  মানুষের মূল্য হৈল এক এক কাহন।

এক কাহন হল ১৬ পণ। সে সময় মানুষের মূল্য যাচাই হত পণ্য সামগ্রীর বিচারে। কিন্তু ত্রিপুরায় মধ্যযুগে মানুষের মূল্য গোরু ছাগলের সঙ্গে তুলনীয় ছিল। এর থেকে দুঃখের আর কী হতে পারে মানুষের জীবনে– এই একটি ছত্রেই প্রমাণিত। দাস শ্রমিক ও নির্যাতিত কৃষকরা তাই চাইছিলেন একটা প্রতিকার হোক। সেই প্রতিকারের নাম শমশের গাজী। বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালি, ফেনি, কুমিল্লা, শ্রীহট্টসহ বিস্তীর্ণ সমতলভূমি ত্রিপুরার রাজাদের দখলে ছিল। চাকলা রোশনাবাদ নামে এই জমিদারি থেকেই ত্রিপুরার মূল রাজস্ব সংগৃহীত হত। প্রথমে তা বাংলার নবাবের দখলে থাকলেও ১৭৬১ সালে আংশিক এবং ১৭৬৫ সালে তা পুরো চলে যায় ইংরেজদের দখলে। ত্রিপুরার রাজারা বাংলার নবাবকে তথা মোগল সম্রাটকে কর দিতে বাধ্য থাকতেন। ১৭৬৫ সালের পর দিতেন ইংরেজদের। এর আগে দ্বিতীয় ধর্মমাণিক্যের সময় ১৭২৯ সালে মোগলরা সমতল ত্রিপুরার ৫৮৯ বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয়। তখনই এই সমতল ত্রিপুরার নাম হয় চাকলা রোশনাবাদ। ত্রিপুরার রাজারা তখন থেকেই বাংলার নবাবের অধীন চাকলা রোশনাবাদের জমিদারে পরিণত হয়। এজন্য মোগলদের হাতি, ঘোড়া, রেশম, মোহর ইত্যাদি কর হিসাবে দিতে হত। রাজারা আবার এসব জমি জমিদার, তালুকদার, ইজারাদারদের হাতে দিতেন কর আদায়ের জন্য।

ত্রিপুরায় রাজাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমতল ত্রিপুরা বা চাকলা রোশনাবাদে কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিলেন যিনি তিনি শমশের গাজী। ১৭৪০-এর দশক। ত্রিপুরার রাজা, বাংলার নবাব, জমিদার তালুকদার ইজারাদারদের খাজনার খাই মেটাতে কৃষককুল জর্জরিত। খাজনার অর্থ দিতে না পেরে কৃষকরা জমি হারাচ্ছে। পরিণত হচ্ছে ভূমিদাসে। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতেই শমশের গাজী কৃষকদের সংগঠিত করেন। 

শমশের গাজীর ক্ষমতা দখল

চাকলা রোশনাবাদের একটি পরগনা ছিল দক্ষিণ শিক। এই দক্ষিণ শিকের জমিদার ছিলেন নাসির মহম্মদ। দরিদ্র পিরের সন্তান শমশের গাজী জমিদারের বাড়িতে লালিত পালিত হন এবং পরে তহশিলদার নিযুক্ত হন। এ সময়ই তিনি জমিদারের অত্যাচারে কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে অবহিত হন। নিজে ক্রীতদাস ছিলেন বলেই ভূমিদাস, ক্রীতদাসদের জন্য তার মনে একটি সহমর্মের জায়গা ছিল। তিনি তাদের মুক্তি দিতে চেয়েছেন। আসলে নিজেকে মুক্ত করাও ছিল বিষয়। বিক্ষুব্ধ কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। কৃষকদের নিয়েই গড়ে তোলেন সৈন্যবাহিনী। যে বাহিনী তাঁর নেতৃত্বে জমিদার নাসির মহম্মদকে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করেছে। নিহত হয় জমিদারের ছেলেরাও। তহশিলদার থাকাকালীন জমিদারের কন্যাকে বিয়ে করতে চেয়ে নাসির মহম্মদের ক্রোধের মুখে পড়ে এক সময় পালিয়ে যাওয়া শমশের গাজী এবার সেই কন্যাকে বিয়ে করেন। দখল নেন দক্ষিণ শিক পরগনার জমিদারির। যদিও সেই কন্যা দরিয়া বিবি শমশেরের বশ্যতা স্বীকার করেননি। 

দক্ষিণ শিক পরগণার জমিদারি শমশের গাজী দখল করেছে খবর পেয়েই ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা ইন্দ্র মাণিক্য (১৭৩৯-১৭৪৪) অন্যমতে বিজয় মাণিক্য, অনেকের মতে যুবরাজ কৃষ্ণমণি শমশের গাজীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠান দক্ষিণ শিক পরগণায়। শমশের গাজী রাজার উজির জয়দেব ও সেনাপতি লুচিদর্প নারায়ণকে পরাজিত করেন। এদের কীভাবে নাকানি চোবানি খাইয়ে বাধ্য করেছেন তাকে জমিদার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে এ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে অধ্যাপক রমেন্দ্র বর্মণের সম্পাদিত বইতে। শেখ মনুহরের ‘গাজিনামা’ ১৯৯৮ সালে টীকা সহ প্রকাশিত হয় ড.রমেন্দ্র বর্মণের সম্পাদনায়। তাতে বলা হয়েছে, ‘সমশের গাজীর নেতৃত্বে কৃষকদের যে অভ্যুত্থান ঘটে তা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। যুগ যুগ ধরে রাজন্যবর্গ, নবাব, জমিদার, মহাজন এবং সবশেষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি শাসককুলের শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হবার ফলে বিদ্রোহ করা ছাড়া তাদের আর কোনো পথ খোলা থাকে না।’

এরপর সমগ্র চাকলা রোশনাবাদ এমনকি ১৭৪৮ সালে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর দখল করেন শমশের গাজী। উদয়পুর দখলের সময় তাঁর সঙ্গে ৬ হাজার সৈন্য ছিল। বাহিনীতে থাকায় কৃষকদের রোজগারও নিশ্চিত হয়। শমশেরের এক ভাই ছাদু গাজী ছিলেন সৈনিকদের নেতা। ভীমসম শক্তিশালী এই ছাদু গাজী হিন্দু মুসলিম যুবকদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা, শরীর গঠনে ভূমিকা নেন।

১৭৬১ সালে কৃষ্ণ মাণিক্য ত্রিপুরার রাজা হন। রাজা হওয়ার আগেই যুবরাজ থাকাকালীন উদয়পুর থেকে বিতাড়িত হয়ে পুরাতন আগরতলায় রাজপাট স্থাপন করেন। কিছুদিন মণিপুর এবং কাছাড়ের রাজ দরবারে যান। চেষ্টা করেন সৈন্য সংগ্রহের। কিন্তু বার বার পরাজিত হন শমশের গাজীর কাছে। শমশের গাজী এ সময় লক্ষ্মণ মাণিক্যকে উদয়পুরের সিংহাসনে বসিয়ে নিজে রাজত্ব চালাতে থাকেন। পরে ত্রিপুরার সিংহাসনে বসেন। নিজেকে রাজা নয় জমিদার হিসাবে উল্লেখ করেন। 

জমিদার যখন হবেন তখন মানুষের কাছ থেকে ট্যাক্স সংগ্ৰহ করবেন এটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তিনি চার প্রকার ট্যাক্স তুলে দিয়ে একটি ট্যাক্স চালু করেন। গরিব ও ভূমিদাসদের ট্যাক্সের আওতা থেকে বাদ দেন। যারা ট্যাক্স দিতেন তা যেন পুরো আদায় হয় এজন্য প্রতিটি পরগনায় সুদক্ষ প্রশাসক নিয়োগ করেন। বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। হিন্দু-মুসলিম দুই অংশের মানুষকে যুক্ত করেছিলেন তার শাসনভার চালাবার জন্য। ধর্মপুরের গঙ্গা গোবিন্দকে দেওয়ান, খণ্ডলের হরিহরকে নায়েব করেন। এদের ওপর ছিল রাজস্ব আদায়ের পুরো ভার। রোশনাবাদের শাসনকর্তা ছিলেন আব্দুল রাজ্জাক। 

এর বাইরে শমশের গাজীর মূল ভূমিকা ছিল সমাজ সংস্কারে। কৃষকদের স্বার্থেই তিনি বহু পদক্ষেপ নেন। দরিদ্র কৃষকদের দুঃখ দূর করার জন্য তিনি ভূমিদাসদের মুক্তি দিয়ে বিনামূল্যে জমি বণ্টন করেন। তাঁর রাজস্ব আদায়ের তালিকায় গরিব প্রজাদের নাম ছিল না। তিনি তাঁদের খাজনা মকুব করেন। যে কৃষক এতদিন তিন/ চার রকম খাজনা দিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত ছিলেন তাঁরা খুশি হন। ‘কৃষ্ণমালার’ তথ্য অনুযায়ী তিনি ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দান, পুকুর খনন, জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করে দেন। ৮২ সিক্কার সের চালু করেন। শমশের গাজীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মাণিক্য রাজা হয়ে নিষ্কর জমি কেড়ে নিতে চাইলে মানুষ প্রতিবাদ করেন। বলেন, ‘রায়ত হয়ে গাজী যদি নিষ্কর জমি দিতে পারে রাজা হয়ে তিনি পারেন না কেন?’

শমশের গাজীর শিক্ষা ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট উদার এবং আশ্চর্যরকম আধুনিক। প্রাথমিক শিক্ষাকে কার্যকরী করতে তিনি একদিকে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করেন। একই সঙ্গে ছাত্রদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। আজ থেকে ২৮০/ ৮১ বছর আগের এসব ঘটনা যে-কোনো মানুষকে বিস্মিত করবে৷ তিনি প্রাথমিক শিক্ষার অবাধ সুযোগ করে দেন। একই সঙ্গে আবাসিক শিক্ষা চালু করেন নিজের ভান্ডারখানায়। হিন্দু মুসলিম শিক্ষক এনে শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। তবে ২৮০/৮১ বছর আগে তার শিক্ষা চিন্তায় আধুনিকতা থাকলেও ধর্মের বিষয়ও ছিল। আজ বিশ্বায়নের যুগে, বিজ্ঞানের এত এত অগ্রগতির পরও দেশে দেশে ধর্মের নামে বিভাজন চলছে। হত্যা, দেশছাড়া করার জন্য ধর্মীয় জিগিরের উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের মনুষ্যত্ব, বিবেক, চিন্তার স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ নয় ধর্মই হয়ে উঠেছে প্রধান পরিচয়। ভারতবর্ষ এর জ্বলন্ত প্রমাণ। সেখানে শমশের গাজী ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক মানুষ। 

প্রজাহিতৈষী এত কাজ এবং কৃষক স্বার্থে ভূমিকা নিতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। আবার বাংলার নবাবকে বেশি রাজস্ব দিয়ে খুশি রাখতে হয়। এই অর্থ সংগ্রহের জন্য নিজের জমিদারির বাইরের জমিদারদের ধনভান্ডার লুঠ করে অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হন তিনি। এই অর্থ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। তাঁর ভূমিকা অনেকটা রবিন হুডের মতো। ‘গাজি নামা’-র লেখক শেখ মনুহর লিখেছেন, ‘সমশের একজন কৃপণ জমিদারের বাড়িতে ডাকাতি করে একলক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। কারণ, ঐ জমিদার কোন দান খয়রাত করত না।’ (এখানে বানান অবিকল সেই বইয়ের মতো রাখা হয়েছে।) 

কৃষকদের কাছ থেকে কম ট্যাক্স আদায়, অনেককে বিনামূল্যে ভূমিদানের ফলে তার অর্থের ঘাটতি দেখা দেয়। এজন্য ডাকাতি করে অর্থ আদায়সহ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের পরও ঘাটতি মেটানো সম্ভব হয়নি। ফলে ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর জোর দেন শমশের গাজী। সমস্ত পাইকারি ব্যবসা নিজের আওতায় আনেন। এতে আয় বাড়ে তাঁর। খুচরো ব্যবসার জন্য দাম নির্ধারণ করে দেন। এর বাইরে কেউ দাম রাখতে পারত না। কৈলাশচন্দ্র সিংহ তাঁর ‘রাজমালা’ বা ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থে সেই দাম সম্পর্কে যে তথ্য দেন তাতে দেখা যায়— একসের চাল এক পয়সা, শুকনো লঙ্কা এক পয়সা, গুড় দুই পয়সা, রসুন-পেঁয়াজ দুই পয়সা, কার্পাস পাঁচ পয়সা, কলাই, মশুরি ডাল এক পয়সা, মটর এক পয়সা, মুগ ডাল, অড়হর ডাল চার পয়সা, সরষের তেল তিন আন, ঘি পাঁচ আনা। প্রতিটি হাটে বাজারে পণ্যমূল্যের তালিকা টাঙানো ছিল। কেউ তা অমান্য করতে পারেনি। একইভাবে চোর ডাকাতদের উপদ্রব বন্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

শমশের গাজীর নেতৃত্বে পরিচালিত কৃষক বিদ্রোহের গতি প্রকৃতির সঙ্গে অষ্টাদশ শতকের বিদ্রোহগুলির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সুপ্রকাশ রায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘সকল বিদ্রোহই ছিল মূলত একসূত্রেই গাঁথা। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে শােষণ উৎপীড়নে ক্ষিপ্ত কৃষক যে সকল দাবি ও ধ্বনি লইয়া ‘সন্নাসী বিদ্রোহ’ আরম্ভ করিয়াছিল, তাহাই ছিল প্রায় সকল বিদ্রোহের মূল দাবি ও ধ্বনি। বিদেশি শাসন হইতে মুক্তি, জমিদার শ্রেণির হস্ত হইতে ভূমিস্বত্বের পুনরুদ্ধার এবং সকল প্রকার শোষণ-উৎপীড়ন হইতে মুক্তি— ইহাই ছিল সকল বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য। সুতরাং বিভিন্ন বিদ্রোহের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকিলেও এই বিদ্রোহগুলিকে সম্পর্কহীন বলা চলে না। প্রত্যেকটি বিদ্রোহই পূর্ববর্তী বিদ্রোহ হইতে অধিকতর সংগঠিত রূপ গ্রহণ করিয়াছিল এবং বিদ্রোহের অঞ্চলের অধিকতর বিস্তার ঘটিয়াছিল। প্রত্যেকটি বিদ্রোহই যেন উহার বহুমুখী অভিজ্ঞতা পরবর্তী বিদ্রোহের সংগ্রামী কৃষকের নিকট হস্তান্তরিত করিয়া দিয়াছে।’ উপরের তথ্যগুলি প্রমাণ দিচ্ছে কৃষক অভ্যুত্থানের নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত শমশের গাজী ছিলেন কৃষক দরদি জমিদার, যা মেনে নেয়নি অন্য জমিদার বা রাজারা।

শমশের গাজীকে হত্যা

ডাকাতির খবরে ভীত জমিদাররা শমশের গাজীর বিরুদ্ধে নবাবের কাছে বারবার অভিযোগ করেন। রাজত্ব হারিয়ে ত্রিপুরার যুবরাজ কৃষ্ণ মণিও নবাবের কাছে নালিশ জানান। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা আবুবক্করও শমশেরের কাছে পরাজিত হয়ে নবাবের কাছে অভিযোগ করেন। এসময় মুর্শিদাবাদ থেকে নবাবের সঙ্গে দেখা করার ফরমান আসে। তাঁর পরামর্শদাতারা তাঁকে মুর্শিদাবাদ যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেননা সময়মতো ট্যাক্স দিচ্ছেন, নজরানা পাঠাচ্ছেন, নবাবের আদেশ মানছেন। আর নবাবের আদেশ অমান্য করেন কীভাবে? যাওয়ার সময় নিয়ে যান উপঢৌকন। নবাব তার ব্যবহারে খুশি হয়ে তাকে পুরস্কৃত করেন। তিনি দলবল নিয়ে ফিরে আসছিলেন। কিন্তু রংপুরে আবু বক্করের বাহিনী শমশের গাজীকে কামানের মুখে হত্যা করে। তার হাতে হত্যা করার ফরমানও ছিল। কিন্তু সেই ফরমান যে শমশের গাজীর জন্য নয়, কুখ্যাত ডাকাত ‘সমসের’-এর জন্য, মৃত্যুর আগে জেনে যেতে পারেননি ত্রিপুরার শাসক শমশের গাজী। জানলে ইতিহাস অন্যরকম হত।

শমশের গাজীর হত্যার খবর মুর্শিদাবাদে পৌঁছালে আবু বক্করের বিরুদ্ধে ফরমান জারি হয়। নবাব যাঁকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি ছিল কুখ্যাত এক ডাকাত। নামও ‘সমসের গাজি’। ঢাকার কারাগারে বন্দি ছিল। নাম এক হওয়ার সুযোগ নেয় আবু বক্কর। পরে ওই ডাকাত ও চট্টগ্রামের শাসক আবু বক্করকে তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কৃষক দরদি জমিদার তথা কৃষক নেতা শমশের গাজী এভাবেই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন। শমশের গাজীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মাণিক্য ত্রিপুরার রাজা হন। ১৭৬১ সালে কৃষ্ণ মাণিক্যকে রাজা হিসাবে নবাব স্বীকৃতি দেন। 

শমশের গাজীর হত্যার কালখণ্ড ও ঐতিহাসিকদের অভিমত

শমশের গাজীর হত্যাকাণ্ডের সময় নিয়ে মতভেদ আছে। অধ্যাপক ড: নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরীর মতে ১৭৬০-এর আগে শমশের গাজীকে হত্যা করা হয়। সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের ‘কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইয়ে শমশের গাজীকে ১৭৬৮ সালে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ আছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ১৭৫২ সালে, ‘কৃষ্ণমালা’ অনুযায়ী ১৭৫৮ সালে হত্যা করা হয় তাঁকে। শমশেরের জীবনীকার সেখ মনুহর লিখেছেন—

এগারশো উনষাইট জ্যৈষ্ঠ মাসে                                                                                                     জুম্মাবারে যান তুমি জোহরের শেষে                                                                                                 উনত্রিশ তারিখ সেদিন ছিল শুক্রবার                                                                                                   চলিল পশ্চিম মুখে গাজি মরিবার।

এই তথ্য অনুযায়ী ১৭৫২ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি শমশের গাজী মুর্শিদাবাদের জন্য যাত্রা শুরু করেন। পথে ঢাকায় মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। এরপর মুর্শিদাবাদে কাটিয়ে তিনি যখন ফিরছিলেন তখন ষড়যন্ত্র ও হত্যার শিকার হন। যদিও ‘শেকড় লতা পাতা ও ঠিকানা’ গ্রন্থে এ কে এম আব্দুল আওয়াল মজুমদার লিখেছেন, ১৭৬০ সালের নভেম্বরে হত্যা করা হয়েছে শমশের গাজীকে। 

কৃষক আন্দোলনের এই বিদ্রোহী নেতাকে ত্রিপুরার রাজাদের কাহিনির বই ‘রাজমালায়’ ‘ডাকাত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও তাঁকে সে সময় ডাকাত ‘সমসের গাজি’-র সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর কৃষক দরদি চরিত্র মুছে দিতে প্রকৃত সত্য চেপে যাওয়া হয়েছে বলেই মনে হয়। সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে তাঁকে শুধুমাত্র কৃষক দরদি জমিদার বা সমাজ সংস্কারক নয়, কৃষক অভ্যুত্থানের নায়ক হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। রাজা জমিদারদের অত্যাচারের হাত থেকে তিনি কৃষকদের মুক্তি দিয়েছিলেন।

সন তারিখ নিয়ে এত বিভিন্নতা সত্ত্বেও একটা বিষয় পরিষ্কার শমশের গাজী ছিলেন কৃষক অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক। কৃষক বিদ্রোহের নেতাকে দস্যু বলে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে কৃষক জনসাধারণের সংগ্রামী চরিত্রকে বিকৃত করে দেখানোর প্রবণতাই কাজ করে। আমাদের দেশের কৃষক বিদ্রোহগুলি যে আসলে শোষণ মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী ধারা একথা রাজা-জমিদারদের ভাব সম্পদের পাহারাদার ঐতিহাসিকদের লেখায় স্বীকৃতি পায় না। এজন্য বিনয় ঘোষ এসব বিদ্রোহকে গরিব গণবিদ্রোহ আখ্যা দেন। তিনি লেখেন, ‘কাজেই এ যুগের আর্যাত্মাভিমানী ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীরা যদি প্রাক্-রাজনৈতিক যুগের গণবিদ্রোহকে দস্যুতা বলেন এবং বিদ্রোহীদের দস্যু বলে চিহ্নিত করেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানের বিচারে এই দস্যুতা ও ধর্মরাজ্য স্থাপনার কামনাজাত গণবিদ্রোহ যেমন প্রাক্-রাজনৈতিক যুগের গণবিদ্রোহ তেমনি আধুনিক সামাজিক আন্দোলনের প্রাগৈতিহাসিক পর্ব বিশেষ।’

শমশেরের গেরিলা যুদ্ধের প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ লিখেছেন, ‘যে গেরিলা রণকৌশলের কথা আজকাল সকলের মুখে শোনা যায় সেটা আবহমানকাল থেকে প্রাকৃতজনের আত্মরক্ষা ও আক্রমণের রণকৌশল। মাও সে-তুঙ, চে গুয়েভারা, মারিঘেলা অথবা অন্য কোনো একালের বিপ্লবী এই রণকৌশল উদ্ভাবন করেননি। বিপ্লবকালীন অভিজ্ঞতা ও আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার প্রখর আলোয় তাঁরা এই কৌশলকে অনেক বেশি উন্নত ও ফলপ্রদ করেছেন।’

কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৭৬১ খৃষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রিপুরায় ব্রিটিশ পতাকা উড্ডীন হইয়াছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীগণ প্রথমত ত্রিপুরাকে নবাবের অধিকার হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাদের প্রাপ্ত প্রদেশ চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করিতে যত্নবান হইয়াছিলেন। তাহারা প্রথম বৎসর চাকলে রোশনাবাদের বার্ষিক রাজস্ব ১,০০০০১ টাকা নির্ণয় করেন। ১১৭০ বঙ্গাব্দের (১৭৬৩ খৃষ্টাব্দের) বন্দোবস্তে বাঙ্গালার অন্যান্য অংশের ন্যায় ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্রের অন্তর্গত মহালসমূহের রাজস্ব অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ণীত হইয়াছিল। মাহাম্মদ রেজা খাঁর বন্দোবস্তে ১১৭২ বঙ্গাব্দে রোশনাবাদের রাজস্ব ১,০৫,০০০ টাকা নির্ণীত হয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ১,৫৫,০০১ টাকা এবং ১১৮৮ বঙ্গাব্দে ১,৬৮,০০১ টাকা রোশনাবাদের রাজস্ব অবধারিত হইয়াছিল।’ (বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

স্বাভাবিকভাবেই রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে এর চাপ এসে পড়ে নীচুতলার সাধারণ মানুষ, দরিদ্র কৃষকদের ওপরই। রাজা মহারাজা জমিদার, ইজারাদাররা তো তাঁদের পকেট থেকে টাকা দেবেন না। মানুষের কাছ থেকেই জোর জবরদস্তি সংগ্রহ করবেন। লালবিহারী দে’র ‘বাংলার চাষি’ গ্রন্থে জমিদারের অত্যাচারের পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। বিবৃত হয়েছে রক্ত পিপাসু জমিদারের কাহিনি। জমিদার তালুকদারদের সর্বব্যাপী অত্যাচার নিদারুণ দমন পীড়ন জুলুম থেকেই শমশের গাজীরা কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম নেতা হিসাবে উঠে এসেছেন। এ প্রসঙ্গে বিনয় ভূষণ চৌধুরী ‘ধর্ম ও পূর্বভারতে কৃষক আন্দোলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন— 

শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণ দিয়ে কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক রূপ বোঝানো যায় না, এর জন্য বিদ্রোহীদের মানসিকতা বিশ্লেষণ অপরিহার্য– একথা এখন মোটেই নতুন নয়। বিদেশে এবং ভারতবর্ষে এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে।

বিদ্রোহের উদ্ভবে অর্থনৈতিক কারণের ভূমিকা অনস্বীকার্য; কিন্তু বিদ্রোহের যৌথ সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ‘প্রভু’ শ্রেণি সম্পর্কে কৃষকদের নিরুদ্ধ আক্রোশের ফল নয়। তাদের নানা বিশ্বাস ও ধারণা প্রতিরোধের সংকল্পকে প্রভাবিত করে। যেমন, একটি বিশ্বাস তাদের ও প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর আপেক্ষিকতা সম্পর্কিত। বিদ্রোহ এক অর্থে ক্ষমতার লড়াই। …………… যে কোনো কৃষক আন্দোলনের একটা বড়ো দিক, তার সংগঠন। কৃষকদের শ্রেণি সম্পর্কের বিশিষ্ট বিন্যাস প্রতিরোধের মূলগতি ও ধারাকে নির্ধারিত করে।

সেই ধারাতেই শমশের গাজী কৃষক অভ্যুত্থানের এক বিশ্রুত নায়ক। আজ সময় এসেছে ইতিহাসের সেই ধারার পুনঃমূল্যায়ন করা।

কথাসাহিত্যে শমশের গাজী 

বাংলা কথা সাহিত্যেও কৃষক আন্দোলন জায়গা করে নিয়েছে। মূলত তেভাগা ও নকশাল বাড়ির ঘটনা নিয়েই বেশি গল্প উপন্যাস রয়েছে। অন্যান্য আন্দোলন নিয়ে গল্প উপন্যাস কম হলেও দুর্লভ নয়। শমশের গাজীর আন্দোলন সম্পর্কে স্বকৃত নোমান লিখেছেন উপন্যাস ‘হীরকডানা’। 

তেভাগা ও নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের প্রভাব থাকলেও ত্রিপুরার কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে ভৌগোলিকভাবে এই দুই আন্দোলনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। ত্রিপুরার কৃষক আন্দোলন নিয়ে সম্পৃক্ত দুটি উপন্যাস পাওয়া যায়। বিমল সিংহের ‘লংতরাই’, স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’। এখানে ‘হীরকডানা’-র বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পূর্ববাংলায় এক বিপ্লবীর অভ্যুদয় ঘটে। তাঁর নাম শমশের গাজী। ‘বাংলার বীর’, ‘ভাটির বাঘ’ তাঁর উপাধি। মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক লাঠিয়াল বাহিনী। উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। কবি সৈয়দ সুলতানের উত্তরপুরুষ সৈয়দ গদা হোসেন তাঁর অন্তরে জ্বালিয়ে দিলেন জ্ঞানপ্রদীপ। জমিদারকন্যা দরিয়াবিবির সঙ্গে অসফল প্রেম তাঁর জীবনকে উন্নীত করে ভিন্ন মাত্রায়। কৃষক-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার করে নেন জমিদারি। প্রজা বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে রোষানলের শিকার হন ত্রিপুর রাজের। শুরু হয় তুমুল লড়াই। গর্জে ওঠেন ভাটির বাঘ। ভুখানাঙা চাষাভুষাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ান তেজোদীপ্ত বীর শমশের। শত্রুসেনা বিনাশ করতে করতে হয়ে ওঠেন অবিনাশী যোদ্ধা, অপ্রতিরোধ্য হন্তারক। 

অধিকার করে নেন রাজ-সিংহাসন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন টানা এক যুগ। তাঁর কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে ইংরেজ বেনিয়ারা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হওয়ার পর বেনিয়াদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় তাঁর। শুরু হয় আর-এক লড়াই। চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দি হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। একদিকে তিনি অকুতোভয় বীর, প্রজা দরদি রাজা, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, অন্যদিকে মনকাড়া বাঁশিওয়ালা। গভীর রাতে বাঁশির সুর শুনে বেরিয়ে আসেন আত্মগোপন থেকে। অমীমাংসিত থেকে যায় তাঁর মৃত্যু। ইংরেজ ও ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস তাঁকে দস্যু-ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে, আর ভাটি বাংলার মানুষের কাছে কিংবদন্তির মহানায়ক হিসেবে অমর হয়ে থাকেন। জ্যোৎস্না রাতে হীরকডানায় ভর করে জিন হয়ে জিনের সঙ্গে, পাখি হয়ে পাখির সঙ্গে উড়ে বেড়ান। এসব ইতিহাস ও কিংবদন্তি উঠে এসেছে স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’-য়।

শুধু কথাসাহিত্যে নয়, অন্তত ২০ জন ঐতিহাসিক শমশের গাজীর উপর আলোকপাত করেছেন। এখনও অনেকে তাঁকে নিয়ে লিখে চলেছেন। আবিষ্কার করছেন। স্বাভাবিকভাবেই নিম্নবর্গের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসে শমশের গাজী অমর হয়ে থাকবেন। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

১) ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ – কৈলাশচন্দ্র সিংহ 

২) ‘শ্রীরাজমালা’ – কালীপ্রসন্ন সেন 

৩) ‘গাজিনামা’ – শেখ মনুহর, সম্পাদনা রমেন্দ্র বর্মণ

৪) ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ – সুপ্রকাশ রায় 

৫) ‘বৃহৎ বঙ্গ’ – দীনেশচন্দ্র সেন

৬) ‘ধর্ম ও পূর্ব ভারতে কৃষক আন্দোলন’ – বিনয়ভূষণ চৌধুরী 

৭) ‘মাণিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস’ – ডঃ নলিনী রঞ্জন রায়চৌধুরী

৮) ‘বিদ্রোহ বিবর্তন ও ত্রিপুরা’ – জগৎজ্যোতি রায়

৯) ‘আমার শহর আগরতলা’ – তাপস দেবনাথ

১০) ‘বাংলার চাষি’ – লাল বিহারী দে  

১১) ‘গরিব গণবিদ্রোহ এবং ভগবান’ – বিনয় ঘােষ 

১২) ‘শমশের গাজী’ – আহমদ মমতাজ

১৩) ‘শেকড় লতা পাতা ও ঠিকানা’ – এ কে এম আব্দুল আওয়াল মজুমদার

১৪) ‘Settlement report of Chakla Rushanabad Estate in the District of Tripura and Noakhali’, 1907: J G Cumming

[বিশেষ দ্রষ্টব্য: যেসব উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে সে সব উদ্ধৃতি অবিকল রাখা হয়েছে। ডাকাত সমসেরের নামের বানান শমশের গাজী থেকে আলাদা রাখা হয়েছে।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান