সাইফুল্লা
একটা সময় ছিল যখন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ও তাঁর বাঁশের কেল্লার কথা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই প্রায় জানত৷ তখন পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের বইতে ‘বাঁশের কেল্লা’ নামের একটি রচনা সংকলিত ছিল৷ এটার প্রভাব খুব ইতিবাচক হয়েছিল৷ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যারা সংযুক্ত তারা জীবনের প্রথম ধাপে দাঁড়িয়েই তিতুমীরকে একরকম করে চিনে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল৷ আবার যাঁরা বিদ্যায়তনিক অঙ্গনে সেভাবে পা রাখার সুযোগ পাননি কখনো তাঁদের ক্ষেত্রেও তেমন সমস্যা ছিল না৷ তখন লোকমুখে তিতুমীর বেশ চর্চিত নাম৷ তাঁর লড়াইয়ের কথা মানুষ যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে৷ মনে পড়ছে, গত শতকের শেষের দিকের কথা৷ উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কেন্দ্রীয় বাস টারমিনাস-কে ঢেলে সাজানো হচ্ছে৷ প্রস্তাব এসেছে, নবনির্মিত টারমিনাসটিকে বিশেষ কোনো নামে নামাঙ্কিত করার৷ নিশ্চয়ই আরও অনেক নাম প্রস্তাবিত ছিল৷ অন্তত তেমনটা হওয়াই স্বাভাবিক৷ কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু শেষাবধি ওই সব বিকল্পের মধ্যে থেকে তিতুমীরকেই পছন্দ করলেন৷ বারাসাত বাসস্ট্যান্ডের নামকরণ করা হল তিতুমীর কেন্দ্রীয় বাস টারমিনাস৷ এখানেই শেষ নয়৷ বারাসাত কোর্ট চত্বরে তখন জেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় একটি সভাকক্ষ তৈরি করা হয়েছে৷ এই সভাকক্ষেরও নামকরণ করা হয় তিতুমীরকে স্মরণ করে …৷ অর্থাৎ সমাজমানসে তিতুমীর তখনো বেশ হিরো৷ পরে অবস্থার পরিবর্তন হয় ক্রমশ৷ ক্রমশ নায়কের থেকে খলনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে তিতুমীরকে৷ এখন তো অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে৷ কেবল তিতুমীর কেন, তাঁর ধর্ম-সম্প্রদায়ভুক্ত প্রত্যেকেই এখন কমবেশি খলনায়ক৷ এমন প্রতীপ ও বিপ্রতীপতার টানাপোড়েনে বিক্ষত আমরা আমাদের মতো করে মূল্যায়ন করতে চাইছি মানুষ তিতুমীর ও তাঁর কৃতিত্বকে৷
এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, তিতুমীর ও তাঁর মরণপণ সংগ্রামের বৃত্তান্তকে এই যে বিপরীত স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এ নিছকই সাম্প্রতিক কোনো বিষয়। গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার ফল এটা৷ বিষয়টা একেবারেই তা নয়৷ তিতুমীরকে নিয়ে বিপরীত ভাবনার জাল বোনা হয়ে আসছে সেই প্রথম দিন থেকেই৷ আর এই বিপরীত ভাবনার জাল বোনার বিষয়টি যে সম্পূর্ণ অমূলক তাও নয়৷ তিতুমীর-এর সংগ্রামী জীবনের এমন কিছু দিক বা মাত্রা রয়েছে যাকে চাইলে অন্য রকম করে ব্যাখ্যা করা চলে৷ হিন্দুদের মন্দিরের সামনে গোহত্যা করা, মন্দির গাত্রে গো-রক্ত ছিটিয়ে দেওয়া, মন্দিরের মধ্যে গো-মাংস নিক্ষেপ করা এসব ঐতিহাসিক বাস্তব৷ এমন বাস্তবতা আমাদেরকে বিচলিত করে বই-কি! এই বাস্তবতার সাপেক্ষে সম্ভাব্য যে-কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া তাই মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ বিরুদ্ধ পক্ষ তা করতে কার্পণ্য করেনি৷ অর্থাৎ একটা বিপরীত স্রোত বহমান রয়েছে সেই প্রথম দিন থেকে অদ্যাবধি৷ বিরুদ্ধ দৃষ্টিতে বিভিন্ন সময়ে তিতুমীরের যে মূল্যায়ন করা হয়েছে এখানে তার কিছু দৃষ্টান্ত চয়ন করা হল।
একটু গভীরে গিয়ে পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হবে৷ মনের দরজা উন্মুক্ত রেখে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে অগ্রসর হতে হবে৷ আর সেক্ষেত্রে প্রথমেই দৃষ্টিপাত করতে হবে ঔপনিবেশিক ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটচিত্রের উপর৷ একথা আমাদের সকলের জানা যে, পলাশির যুদ্ধোত্তর পর্বে এদেশে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা যেসব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিষয়টি৷ এদেশে তাদের শাসনতন্ত্রকে যদি স্থায়ীভাবে কায়েম করতে হয় তবে এখানকার দুই প্রধান ধর্ম সম্প্রদায় মুসলমান ও হিন্দু-র মধ্যে বিদ্বেষের বাতাবরণ রচনা করতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই৷ ফলত লক্ষ্য পূরণে যথাসাধ্য সচেষ্ট হয়েছিল কোম্পানির লোকজন৷ তাদের সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি বরং একটু বেশি মাত্রাতেই ফলপ্রসূ হয়েছিল৷ বাংলায় হিন্দু মুসলমানের সহাবস্থানের ইতিহাস তখন কমবেশি সাতশো বছর বিস্তৃত হয়েছে৷ এই দীর্ঘ সময়ে সাম্প্রদায়িকতা বলতে ঠিক যা বোঝায় তা সেভাবে ডানা মেলেনি তখনো৷ কখনো কখনো সম্প্রদায়গত কিছু সমস্যা যে দেখা দেয়নি তা নিশ্চয়ই নয় কিন্তু তা কখনোই সাম্প্রদায়িকতার রূপ নেয়নি৷ বিচ্ছিন্ন যা কিছু ঘটনা ঘটেছে তা শাসক বা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সংঘটিত, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এখানে ছিল না বললেই চলে৷ ইংরেজ আমলে কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হল৷ এখন হিন্দু ও মুসলমান মূলগতভাবে বিবদমান দুই সম্প্রদায়৷ ঐক্য-সংহতি যা কিছু আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে তা ওই গ্রামজীবন নির্ভর সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ ইংরেজ শাসনের কুপ্রভাব তখনো সেখানে সেভাবে সঞ্চারিত হয়নি৷ শহর, শহরতলি থেকে শুরু করে গ্রামের সেইসব মানুষ যারা শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে নিজেদের নামটি নথিভুক্ত করেছে তারা কেউই প্রায় আত্মরক্ষা করতে পারেনি এর থেকে। সকলেই কমবেশি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত হয়েছে৷ তিতুমীরের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে এই বিষয়টি৷
ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে স্পষ্ট প্রতিপন্ন হয়, তিতুমীর এমনিতে ধর্মপ্রাণ মানুষ হলেও একটা সময় পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শমাত্র তাঁর মধ্যে ছিল না৷ পরে ঘটনাচক্রে তিনি সাম্প্রদায়িকতার জালে কমবেশি জড়িয়ে পড়েন৷ তিতুমীরের জীবনকথা যতদূর জানা যায় তা থেকে দেখা যাচ্ছে, আরব বংশোদ্ভূত অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম৷ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন পড়তির দিকে৷ তেমন কোনো ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত পালিত হননি তিনি৷ স্থানীয় মক্তবে লেখাপড়ার সূচনা হয়। অতঃপর ধাপে ধাপে বেশ কিছুটা অগ্রসর হন৷ কিন্তু বিদ্যায়তনিক চর্চা কখনোই উপযুক্ত মাত্রা পায়নি৷ বিদ্যাচর্চা অপেক্ষা তিতুমীর ততদিনে সাধারণের মধ্যে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন বীর্যবত্তার কারণে৷ প্রথম থেকেই তাঁর শারীরিক সক্ষমতা সাধারণের থেকে একটু বেশি ছিল৷ তার উপর নিয়মিত শরীরচর্চার সাপেক্ষে তিনি অপ্রতিহত হয়ে উঠছিলেন দিনে দিনে৷ একটা সময়ে মল্লযোদ্ধা হিসেবে এলকায় তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না৷ এই অবস্থায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অস্ত্রে শান দিতে তিতু পা রাখেন শহর কলকাতায়, শরণাপন্ন হন তখনকার শ্রেষ্ঠ মল্ল প্রশিক্ষকের৷ তাঁর প্রশিক্ষণে দিনে দিনে তিতুমীর আরও শানিত হন৷ এমন অবস্থায় একদিন তিনি নিজস্ব শক্তিমত্তার পরীক্ষা দিতে অংশ নেন জাতীয়স্তরের কুস্তি প্রতিযোগিতায়৷ এই প্রতিযোগিতায় তিতু প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং দিকে দিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে যায়৷ এই সূত্রে সম্মানজনক চাকুরি মেলে গোবরডাঙ্গা অঞ্চলের এক জমিদার মহাশয়ের জমিদারিতে৷ এই চাকুরি উপলক্ষ্যে তিতু নিজস্ব এলাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং চাকুরি জীবনের পাশাপাশি বৈবাহিক জীবনে স্থিত হন৷ কিন্তু এই স্থিতাবস্থা বজায় থাকে না অধিক দিন৷ স্থানীয় জমিদারদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তখন লেগেই থাকত৷ এমন এক জমিদারি কাজিয়ায় বেশি রকমভাবে জড়িয়ে পড়েন তিতুমীর৷ সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই৷ তবে শোনা যায় এই সূত্রে তাঁর নাকি জেলও হয়৷ জেল হোক বা না-হোক জমিদারি এই কাজিয়া ও তার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার বিষয়টি নিতান্ত না পছন্দ হয় তিতুর৷ তিনি জমিদারের চাকুরি পরিত্যাগ করেন এবং পুনরায় কলকাতায় চলে আসেন৷ দ্বিতীয় পর্বের এই কলকাতা জীবনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় জনৈক ব্যক্তির, যার সঙ্গে পরবর্তীতে তিনি পবিত্র মক্কায় গমন গমন করেন এবং সেখানে স্বদেশীয় গুরুজন সৈয়দ আহমেদেরে প্রভাবে ইসলামি ধর্মাদর্শে বিশেষভাবে দীক্ষা নেন৷ এইসময় ইসলাম ধর্মের নতুন ভাষ্য ওয়াহাবি ভাবনার প্রতি আলাদা ভাবে আকৃষ্ট হন তিনি৷ পরে দেশে ফিরে এসে মনোনিবেশ করেন ওয়াহাবি ভাবনার প্রচার প্রসারে৷ তখন বাংলার মুসলমানদের অধিকাংশ নামে মাত্র মুসলমান ছিল৷ তাদের যাপিত জীবনে ইসলাম ধর্ম-সংস্কৃতির চর্চা সেভাবে ছিল না বললেই চলে৷ তিতুমীর সচেষ্ট হলেন এই নামে মাত্র মুসলিম ধর্ম-সম্প্রদায়কে প্রকৃত ইসলামের অনুসারী করে গড়ে তুলতে৷ আর তাতেই হল সমস্যা৷ তাঁর এই কাজ নানা কারণে না-পছন্দ হল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ক্ষমতাসীন পক্ষের৷ তারা তিতুমীরের বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগল৷ ততদিনে তিতুর ভক্তশ্রেণির সংখ্যাও বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ তারাও ঐক্যবদ্ধ হল যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে৷ এই প্রতিবাদ প্রবণতার চূড়ান্ত রূপ ১৮৩১ সনের নারকেলবেড়ের জং৷ যে যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন তিতুমীর ও তাঁর অসংখ্য অনুরাগী সহযোদ্ধা৷ এক্ষেত্রে ঘটনার গতি প্রকৃতি ছিল এইরকম৷
হজব্রত পালন করে স্বদেশে প্রত্যাগমনের পর তিতুমীর স্বগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করা ও ইসলাম-প্রচারে ব্রতী হলে তাঁর জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে৷ এতে তিনি আরও বেশি করে যত্নশীল হন ইসলামের প্রকৃত আদর্শকে সকলের মধ্যে সঞ্চার করে দিতে৷ পারস্পরিক সৌর্হাদ্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ ইসলাম ধর্মাদর্শের অন্যতম প্রধান দিক৷ তিতুমীরের অনুগামীরা অচিরেই ভ্রাতৃত্ববন্ধনে বাধা পড়ল৷ আমরা আগেই বলেছি, তাদের এই ভ্রাতৃত্ববোধ ক্ষমতাসীন পক্ষের বিশেষ মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিল৷ তখন ইংরেজ শাসনের প্রথম পর্ব৷ দেশীয় জমিদার শ্রেণি শাসকের বিশেষ স্নেহধন্য৷ যেন তারা ইংরেজ শাসনতন্ত্রেরই অংশ বিশেষ৷ শাসক ইংরেজ ভালো করেই বুঝতে পারছিল বিস্তৃত এই দেশের সর্বত্র সামানভাবে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু শাসনতন্ত্রের জাল বিছানো অসম্ভব প্রায়৷ তারা তাই বিকল্প কিছুর কথা ভাবছিল এবং জমিদার শ্রেণিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিকল্প হিসাবে৷ প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্বে জমিদাররা ছিল খাজনা আদায়কারী মাত্র৷ তারা রাজার প্রতিনিধি রূপে কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করত মাত্র৷ জমির উপর তাদের কিছুমাত্র কোনো অধিকার ছিল না৷ জমির তাৎক্ষণিক মালিক কৃষক ঊর্ধ্বতন মালিক রাজা৷ এর মাঝে কেউ ছিল না৷ কিন্তু শাসক ইংরেজ এই অবস্থার পরিবর্তন সাধন করল৷ তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারকেই করে দিল জমির প্রকৃত মালিক যাতে তারা ইংরেজ শাসনের প্রতি গভীর আনুগত্য পোষণ করে ইংরেজরাজকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে যথাসাধ্য যত্নশীল হয়৷ তখন স্থানীয় স্তরে সরকারি প্রশাসন বলতে প্রায় কিছু নেই৷ জমিদারশ্রেণি এখানে সর্বেসর্বা৷ তাদের ইচ্ছাই শেষ কথা৷ এর পাশাপাশি রয়েছে নীলকর শ্রেণি৷ আত্মস্বার্থচরিতার্থ করার জন্য তারা করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই৷ একদিকে জমিদার, অন্যদিকে নীলকর, উভয়পক্ষের সাঁড়াশি চাপে সাধারণ মানুষ তখন চূড়ান্ত রকমের বিপন্ন৷ অন্যায়ের প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, সামান্যতম প্রতিবাদেরও কোনো পথ খোলা নেই সাধারণের সামনে৷ কী করেই বা থাকবে৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যূনতম কোনো ঐক্য নেই, নেই সমবেত কোনো ভাবনা৷ প্রত্যেকে কোনোক্রমে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টায় মগ্ন৷ সম্মিলিত প্রতিবাদ, প্রতিরোধের নামগন্ধ মাত্র নেই৷ জমিদার ও নীলকর শ্রেণি তো বটেই, আরও সব সুবিধাভোগারীও এই অবস্থার সুযোগ নিচ্ছিল মনের আনন্দে৷ যার যা ইচ্ছা সে তাই করে চলছিল৷ তাদের এই একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হল তিতুমীরের দ্বারা৷ তিতুর অনুগামীরা তখন নিবিড় ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ৷ তিতু তাদেরকে বিশেষ করে বোঝালেন, এমন বিপদে আপদে, অত্যাচারীর দ্বারা কৃত অন্যায়ের প্রেক্ষিতে ধর্মভাই-এর জন্য তো সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতেই হবে, পাশাপাশি সাধারণ মজলুম মানুষ, যারা হয়তো ধর্মভাই নয় তাদেরও বিপদের দিনে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তাদের প্রতি কোনো অন্যায় অত্যাচার করা হলে তার প্রতিকার করার জন্য যথাসাধ্য সচেষ্ট হতে হবে৷
অনুগামীদের মধ্যে তিতুর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে৷ তাঁর মুখের কথাই যেন কোরআন হাদিসের বাণী৷ কাজেই তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসল ফলতে কোনো সমস্যা হল না৷ তিতুর অনুগামীরা যেমন পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল তেমনি অপরাপর নির্যাতিত মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে এল সমবেতভাবে৷ এতে বৃশ্চিক দংশন সুলভ যন্ত্রণায় কাতর হল সুবিধাভোগী শ্রেণি৷ তারা এখন পদে পদে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে শুরু করল৷ এতে ক্রমশ নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারল৷ কর্তৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে আরও বেশি করে অত্যাচার করার পথে পা রাখল তারা৷ বলাই বাহুল্য এর ফল ফলল বিপ্রতীপ ধারায়৷ অত্যাচার যত বাড়ল প্রতিবাদ-প্রতিরোধও ততই বাড়তে থাকল এবং একটা সময় বিষয়টি সীমা ছাড়াল৷ আর এমন করে এই পর্বেই ঘটেছিল সেই বিতর্কিত ঘটনা৷
ইসলাম ধর্মে পুরুষদের দাড়ি রাখার উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ এটা প্রত্যক্ষ সুন্নাত৷ তিতু তাই শিষ্যবর্গের প্রতি দাড়ি রাখার জন্য বিশেষ তাগিদ দেন৷ তাঁর এই তাগিদের সূত্রে এমনিতে কোনো সমস্যা হওয়ার ছিল না, তবু সমস্যা হল৷ আসলে এই সমস্যার মূল উৎসারিত হয়েছিল অন্য সব দিক থেকে৷ অনেক চেষ্টা করেও তিতুর অনুগামীদের বিপরীতে বিশেষ সুবধিা করতে পারছিলেন না জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মহাশয়৷ তাঁর শোষণতন্ত্র ততদিনে অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে৷ প্রতিদিন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দলে দলে মানুষ তিতুর দলে নাম লেখাচ্ছে এবং জমিদারতন্ত্রকে যখন তখন বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে৷ এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই সব কিছু ভেঙে পড়বে৷ তিনি তাই চরমপন্থী হতে দ্বিধা করলেন না৷ তিতুর অনুগামীরা যে দাড়ি রাখছে, এটাকেই উপলক্ষ্য করলেন তিনি৷ বললেন দাড়ি রাখতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে কর দিতে হবে আলাদা আলাদাভাবে৷ এখানেই বিষয়টা শেষ হল না৷ এই অনুষঙ্গে আরও বলা হল, দাড়ির মাপ অনুসারে দিতে হবে ধার্য অর্থ৷ জমিদার মহাশয়ের এই নির্দেশ কেবল কথার কথা মাত্র ছিল না৷ রীতিমতো মেপে মেপে দাড়ির পরিমাপ অনুসারে আদায় করা হতে থাকল দাড়ি-কর৷ সংগতভাবেই তিতু-পন্থীরা এর প্রতিরোধ করতে লাগল প্রাণপণে৷ তাদের এই প্রতিরোধের প্রেক্ষিতে একটা সময় জমিদার মহাশয় নিজের উপর আরও নিয়ন্ত্রণ হারালেন৷ তিনি তিতু ও তাঁর অনুগামীরা সর্পরাজপুরে যে মসজিদে নামাজ আদায় করতেন সেই মসজিদে দিলেন আগুন লাগিয়ে৷ এতদিনে যা হচ্ছিল তার ক্ষেত্রে তবু না হয় কথা ছিল৷ কিন্তু তাই বলে মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া৷ মুসলিম সমাজের ভাবাবেগেকে আহত করার ক্ষেত্রে এর থেকে মারাত্মক আর কিছু হতে পারে না৷ প্রত্যেকেই তাই যন্ত্রণায় রঙিন হয়ে গেল৷ প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে শুরু করল৷ এদিকে এই ঘটনার অভিঘাতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন স্বয়ং তিতুও৷ তিনি চূড়ান্ত প্রতিহিংসার পথে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ অনুরাগীদের একত্রিত করে চড়াও হলেন পুঁড়ার জমিদার বাবুর উপর৷ লুঠ করা হল জমিদার বাড়ি, গোহত্যা করে অপবিত্র করা হল জমিদার বাড়ির সন্নিহিত মন্দির, পাশাপাশি হত্যা করা হল মন্দিরের পুরোহিত মহাশয়কে৷ মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া থেকে গো রক্ত-মাংসে মন্দির অপবিত্র করা পিঠাপিঠি দুটি ঘটনা একটি অন্যটির অভিঘাত নিশ্চয়ই৷ তবে দ্বিতীয় ঘটনা প্রথম ঘটনার অব্যবহিত পরেপরেই ঘটেছিল এমনটা কিন্তু নয়৷ ইতিমধ্যে ঘটনার জল গড়িয়েছিল আরও কিছুদূর পর্যন্ত৷ জমিদার মহাশয় মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরে পরেই তিতু প্রতিহিংসার পথে পা রাখেননি৷ তিনি দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপর ভরসা রাখছিলেন তখনও পর্যন্ত৷ সেই অনুসারে যথানিয়মে জমিদার মহাশয়ের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন স্থানীয় আদালতে৷ কিন্তু তার ফল কিছু হয়নি বরং বিপরীত ফলই ফলেছিল এবং তার মূল কারণ ছিল ব্যবস্থাপনার অসারতা৷ আমরা আগেই বলেছি, তখন শাসনতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছিল সুবিধাভোগীদের অঙ্গুলিহেলনে৷ এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না৷ জমিদার মহাশয় তাঁর অপকর্মের গভীরতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন৷ তাই আগেই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন প্রয়োজন মতো৷ তিনি মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে বসেন৷ তাঁর অভিযোগে বলা হয়, তিতুপন্থীরা পরিকল্পনা করে তাঁকে ফাসানোর লক্ষ্যে নিজেরা মসজিদে আগুন লাগিয়েছে৷ তাঁর এই মিথ্যা অভিযোগের বিপরীতে মোটেই সুবিধা করতে পারেনি তিতুর লোকজন৷ এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল বসিরহাট থানার পুলিশ অধিকর্তা রামরাম চক্রবর্তী৷ তিনি সম্পর্কে কৃষ্ণদেব রায়ের আত্মীয় ছিলেন৷ একদিকে এই আত্মীয়তার দায় অন্যদিকে সহজাত স্বজাতি প্রীতি৷ দুয়ের অভিঘাতে ন্যায় ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলেন তিনি৷ প্রকৃত সত্যকে গোপন করে উদ্দেশ্যমূলক একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করা হল যেখানে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রতিপন্ন হলেন এবং মিথ্যা অভিযোগের দায়ে অভিযুক্ত হলেন তিতু ও তাঁর অনুগামীরা৷
এরপরেও কিন্তু তিতু হাল ছাড়েননি৷ তিনি অন্যায়ের প্রতিকারার্থে বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখারই সিদ্ধান্ত নেন৷ অপেক্ষা করতে থাকেন শেষ বিচারের জন্য৷ কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না৷ তখন গ্রামাঞ্চলে জমিদারের অপরিসীম দাপট৷ জমিদারের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ আলাদতে সাক্ষী দিতে উৎসাহী নয়৷ এদিকে উলটো পক্ষে সাক্ষীসাবুদের অভাব নেই৷ জমিদার কৃষ্ণদেব আদালতে হলফ নামা দিয়ে বললেন, তিনি ঘটনার দিন এলকায় উপস্থিত ছিলেন না, তখন তিনি কলকাতার বরাহনগর অঞ্চলে জনৈক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ তাঁর এই হলফনামার পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন অনেকেই৷ উলটোদিকের সাক্ষী পাওয়া গেল না সেভাবে৷ একে তো এই সমস্যা, তার উপর ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয়ের সহজাত অনুরাগ রয়েছে জমিদার শ্রেণির প্রতি৷ ফলত ফল যা হওয়ার তাই হল৷ প্রায় বেকসুর ভাবে খালাস করে দেওয়া হল জমিদার মহাশয়কে৷ দিনটা ছিল ২ সেপ্টেম্বর ১৮৩১৷ বিষয়টা এমনভাবে সম্পন্ন হল যাতে সামাজিকভাবে তো বটেই আইনের চোখেও অপদস্থ হতে হল তিতুকে৷ বলা বাহুল্য এর পরে আইন হাতে তুলে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না তিতুমীরের সামনে৷ তবু তারপরেও তিনি চেষ্টা করেছিলেন৷ সহযোদ্ধা ভাগিনেয় গোলাম মাসুদকে আবারও বারাসত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমীপে প্রেরণ করলেন সমস্ত বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানিয়ে পিটিশন দাখিল করার জন্য৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য ম্যাজিস্ট্রেট তখন বারাসাতে নেই৷ তিনি গেছেন পূর্ববঙ্গ পরিদর্শনে৷ ফিরতে যথেষ্ট বিলম্ব হবে৷ এতে হতাশ হয়ে ফিরে এলেন গোলাম মাসুদ, হতাশ হলেন তিতুও৷ ততদিনে অবস্থা তাঁদের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ সহকর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জন্য চূড়ান্ত রকমের কিছু একটা না করলেই নয়৷ তিতু তাই উপায়ান্তর না দেখে আইন হাতে তুলে নিলেন৷ এখন কথা হল, আইন হাতে তুলে নিয়ে তিনি মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছিলেন কি না৷ ঘটনা পরম্পরা সাপেক্ষে জমিদার বাড়ি লুঠ করা, তথায় অগ্নিসংযোগ করা এসব কোনো ব্যাপার নয়৷ হতেই পারে৷ বরং এটা না হওয়াই অস্বাভাবিক৷ তাই বলে মন্দিরের পুরোহিতকে হত্যা করা, গোহত্যা করে গোরক্ত ও গোমাংস সহযোগে মন্দির অপবিত্র করা প্রভৃতি৷ অব্যশই অত্যন্ত গুরুতর বিষয়৷ এই ঘটনাগুলি ঘটানোর কি খুব আবশ্যকতা ছিল৷ বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা দরকার৷ ঘটনার ময়নাতদন্ত থেকে এক্ষেত্রে যা প্রতিপন্ন হয় তা এইরকম—
জমিদার কৃষ্ণদেব কর্তৃক মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আকস্মিক বা সহসা ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় ছিল না৷ এরও একটা ধারাাবহিকতা ছিল৷ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এইভাবে৷ শুক্রবার অর্থাৎ জুম্মাবারের দিন ঐতিহ্য অনুসারে তিতুর অনুগামীরা সর্পরাজপুরের মসজিদে এসে উচ্চস্বরে আজান দিত ও নামাজ আদায় করত৷ তাদের এই আজান দেওয়ার বিরোধিতা করা হয় এবং এই বিরোধিতার কাজে এগিয়ে দেওয়া হয় জমিদার বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের৷ তারা যথাসময়ে মসজিদ চত্বরে উপস্থিত হয়ে আজানের সুরের সমান্তরালে বিকৃত সুর উচ্চারণ করতে থাকে ও নামাজিদের শারীরিক বিভঙ্গের সাপেক্ষে বিকৃত বিভঙ্গ সহযোগে তাদেরকে আরও উত্যক্ত করা শুরু করে৷ এটা ক্রমশ বাড়তেই থাকে৷ প্রতিবিধানের কোনো লক্ষণই দেখা যা না৷ এতে তিতুপন্থীরা জমিদার মহাশয়ের কাছে নালিশ জানায়৷ কিন্তু তিনি সে নালিশে কর্ণপাত মাত্র করেন না৷ বরং রুষ্ট হন৷ এমনিভাবে চলতে চলতে একদিন তিতুর পক্ষে দুই জন প্রতিনিধি আলাদা করে অভিযোগনামা সহ জমিদারের দরবারে হাজির হয়৷ এদিকে এদিনও জমিদার মহাশয় বিষয়টিকে একেবারেই ভালোভাবে নেন না৷ তিনি তাঁর বাড়ির ছেলে মেয়েদের প্রতি এই অভিযোগকে প্রজাদের চরম ঔদ্ধত্য বলে জ্ঞান করেন এবং প্রতিবিধানে দৃঢ়চিত্ত হন৷ তাঁর নির্দেশ মতো ওই দুইজন প্রতিনিধিকে আটকে রাখা হয়। শারীরিক নিপীড়নের পাশাপাশি তাদের দাড়িতে প্রস্রাব লাগিয়ে দেওয়া হয় বেশ করে— ‘‘কিন্তু জমিদার তাহারদের সর্দারকে ধরিতে আজ্ঞা দিয়া একজন হিন্দু নাপিত ডাকাইয়া ঐ সরদারের দাড়ি প্রস্রাব দ্বারা মুড়াইয়া এবং যষ্টিদ্বারা তাহারদিগকে প্রহার করিলেন৷’’ (‘সমাচার দর্পণ’, ২৮-০৭-১৮৩২) অতঃপর একদিন সংঘটিত হল মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি৷
বোঝাযাচ্ছে ঘটনার সূত্রপাত থেকে শেষপর্যন্ত তিতু ও তাঁর অনুগামীদের দিক থেকে প্রচেষ্টার শেষ ছিল না৷ তাঁরা সবসময় সুস্থ নিষ্পত্তি চেয়েছিলেন৷ কিন্তু জমিদারের গোয়াতুর্মি-ঔদ্ধত্য এবং প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার অসারতার কারণে তা সম্ভবপর হয়নি৷ বাধ্য হয়েই তিতুরা আইন হাতে তুলে নিয়েছিলেন৷ আমরা আগেই বলেছি, এইভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়াতে অন্যায় কিছু করা হয়নি৷ এ ছাড়া আর কিই-বা করার ছিল তখন৷ তবে তারপরেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে বসে তিতু নিজেই আর এক অন্যায়ের জালে জড়িয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে৷ মসজিদে আগুল লাগানোর প্রতিবিধান স্বরূপ গোহত্যা করে মন্দির মধ্যে গোমাংস ছড়িয়ে দেওয়া, হত্যা করা গোরুর মাথাটি মন্দির মধ্যে টাঙিয়ে রাখা কোনো সুস্থ চেতনার পরিচয় নয়৷ অন্তত তিতুর মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষে৷ যিনি ক্রমশ মজলুম মানুষের নেতা হয়ে উঠতে চলেছেন, তাঁর পক্ষে এমন কাজ মোটেই শোভন সুন্দর নয়৷
কোনো সন্দেহ নেই ৬ নভেম্বর দিনটি তিতুমীরের জীবনের একটি কালো দিন ওই দিনের ঘটনা তার বর্ণময় কর্মজীবনের পথে অমোচনীয় কালো দাগ স্বরূপ৷ এটা না থাকলে খুব ভালো হত৷ সেক্ষেত্রে তাঁর ভাবমূর্তি আরও সমুজ্জ্বল হত৷ তবে এও ঘটনা যে, এই একটি মাত্র ঘটনা সূত্রে তিতুর বর্ণময় জীবনবৃত্তান্তকে যেভাবে কলঙ্কৃত করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অন্যায়৷ তিতু গোড়া মুসলমান এবং ভয়ংকর রকমের হিন্দু বিদ্বেষী– এমনটাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ৷ ওয়াকিবহাল মহল মাত্র অবগত আছেন যে, এই অভিযোগ একই সঙ্গে সত্য এবং মিথ্যা৷ একদিক থেকে দেখলে তিতুকে গোড়া মুসলমান বলে স্বীকার করে নিতেই হবে৷ হজ করে আসার পর থেকে শরা-শরিয়ত সম্পর্কে তিনি সত্যিই একটু বেশি কঠোরতা দেখাতে শুরু করেছিলেন৷ কিন্তু কথা হল, এই কঠোরতার ফল হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কতটা বর্তেছিল বা আদৌ বর্তেছিল কি না৷ একটা সময় পর্যন্ত হিন্দুদের সঙ্গে তিতুর কোনোরকম বৈরিতা তো দূরের কথা সামান্য মন কষাকষিও ছিল না৷ তিনি স্বসম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মমত প্রচার নিয়ে মেতেছিলেন৷ হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাঁর এই ধর্মপ্রচারের কোনোরকম সম্পৃক্ততা ছিল না৷ এক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা পরে নানা ঘটনাসূত্রে তৈরি হয়েছিল তা আমরা দেখেছি৷ তিতুর ধর্মপ্রচারের সাপেক্ষে সেদিন যারা প্রাথামিকভাবে সবচেয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছিল তারা হল মুসলমান সমাজভুক্ত সেই শ্রেণি যারা ধর্মকে কায়েমিস্বার্থে ব্যবহার করতে রপ্ত ছিল৷ তখন পিরতন্ত্রের একাধিপত্য ছিল মুসলমান সমাজে৷ পির-সম্প্রদায়ের আলাদা করে কোনো কর্ম-জীবন ছিল না৷ তারা নানা কৌশলে ভক্তদের মস্তক মুণ্ডন করে পার্থিব জীবনে বেশ রসে বশে থাকতে পছন্দ করত৷ তিতু এই ছোটো, বড়ো, মাঝারি সব ধরনের পিরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলে তারা অত্যন্ত বিপন্নতা বোধ করে এবং কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার লক্ষ্যে অন্য পথে মোটেই সুবিধা না করতে পেরে স্থানীয় জমিদার মহাশয়ের শরণাপন্ন হয়৷ জমিদার মহাশয় এই সুযোগের অপেক্ষোতেই ছিলেন৷ তিতুর ক্রিয়াশীলতার সূত্রে প্রজাদের উপযুক্তভাবে শায়েস্তা করতে ও ইচ্ছা মতো কর আদায় করতে তাঁর বেশ সমস্যা হচ্ছিল৷ কাজেই তিনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে উঠে পড়ে লাগলেন৷ ন্যায় অন্যায় পথে শুরু করলেন তিতুর বিরোধিতা৷ তিতুও সচেষ্ট হলেন তাঁর মতো করে৷ উভয় পক্ষের এই সক্রিয়তার সূত্রে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের পক্ষে কোনো মাথাব্যথার কারণ হয়নি তা বলা বহুল্য৷ আসলে এক্ষেত্রে সমস্যা যা হয়েছে তা জমিদার মহাশয়ের তৈরি করা পথে৷ তিনি যদি ওভাবে তিতু ও তাঁর অনুগামীদের ধর্মজীবনের উপর হস্তক্ষপ না করতেন তবে কোনো কিছুই হত না৷ ধর্ম-নিরপেক্ষ রূপে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তিতুর আন্দোলন যে পথে পরিচালিত হচ্ছিল সেই পথেই পরিণতিতে পৌঁছাত৷ আর যদি সত্যিই তেমন কিছু হত তবে যে গৌরবজনক ইতিহাস রচিত হত তার তুলনা নেই বললেই চলে৷ তখন উনিশ শতকের তিন-চারের দশক মাত্র৷ ওই শতাব্দীর অবশিষ্ট অংশে তো বটেই বিশ শতকের প্রথম দশকেও এমন কোনো আন্দোলনের হদিস নেই যাকে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-রাষ্ট্রিক আন্দোলন হিসেবে পরিচিত করা চলে৷ তিতু নজিরবিহীন এই কাজটা করার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন বেশ কিছুটা৷ তাঁর সামনে সম্ভাবনা ক্ষেত্র আরও আরও প্রসারিত হচ্ছিল৷ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অদ্বিতীয় এক নায়কের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হতে পারতেন তিনি৷ সেক্ষেত্রে অন্যরকমভাবে রচিত হতে পারত ভারতেতিহাস৷ সেদিক থেকে দেখলে তিতু বেশ হতভাগ্যই৷ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উজাড় করে দিয়েও শেষাবধি ভাগ্যের হাতে বিধবস্ত হতে হল তাঁকে৷
তিতু যে সময়ে ও যে অঞ্চলে তাঁর আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন ঘটনাচক্রে ওই সময়ে ওই অঞ্চলের সব জমিদারই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত৷ কিন্তু যদি এর বিপরীত চিত্র হত তবে কী সুন্দরই না হতে পারত৷ ৬ নভেম্বরের ওই ঘটনার বাইরে তিতু কর্তৃক হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার করা বা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাবাবেগ আহত হতে পারে এমন কোনো ঘটনা ঘটানোর কোনোরকম তথ্য প্রামাণ নেই৷ তাঁর আক্রমণে শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল জমিদার পুত্র দেবনাথ রায়, কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কোথায়! এক্ষেত্রে জমিদারবাবু যদি হিন্দু সম্প্রদায় না হয়ে মুসলমান হতেন তবে ঘটনার পরিণতি মোটেই অন্যরকম কিছু হত না৷ হত না যে তার প্রমাণ তিতু কর্তৃক মুসলমান সমাজভুক্ত শোষক শ্রেণির বাড়ি ও সম্পত্তি লুণ্ঠিত হওয়া৷ কর্মক্ষেত্রে পা রেখে তিতু প্রথমেই লুঠ করেছিলেন জোতদার ইয়ার বস্কের বাড়ি৷ এই সময় মুসলমানদের মধ্যেকার সুবিধাভোগী শ্রেণি যে নিয়মিতভাবে তিতুর দলবলের হাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হচ্ছিল তা তাঁর বিরুদ্ধ সমালোচকরাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন— ‘‘ইহারা মুসলমানদের প্রতি যতদূর অত্যাচার করিয়াছিল, হিন্দুদের প্রতি এত করে নাই৷ এমন কি নিকটবর্ত্তী রুদ্রপুরের চৌকিদারদিগকে কোনো রূপে উচ্চকথা বলে নাই৷ কেবল পুঁড়ার জমিদারের প্রতি ক্রুব্ধ হইয়া পুঁড়ার হিন্দুদের মন্দিরে অত্যাচার ও পুরোহিতের প্রাণনাশ করিয়াছিল৷ কিন্তু মুসলমানের প্রতি অত্যন্ত অত্যাচার করে৷ … অনেক গৃহস্থ মুসলমানের ঘরবাড়ী লুট করিয়াছিল৷ অনেক মুসলমানের ঘর জ্বালাইয়া দিয়াছিল, এই রূপ অনেক অত্যাচার করিয়াছিল৷’’ (‘হিতৈষী’, ১১-১২-১৮৯৫)৷ একটা সময় পর্যন্ত তিতুর দলবল মুসলমান শোষক শ্রেণির প্রতিই তাদের মনোযোগ সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ রেখেছিল হিন্দুদের প্রতি আলাদা করে কোনো নজর দেয়নি৷ তিতুকে তাই হিন্দু বিদ্বেষী বলা যায় না কোনোভাবেই৷ এমন অভিধা তাঁর জন্য সম্পূর্ণ অমূলক ও অনৈতিক৷
এক্ষেত্রে আরও মনে রাখার যে, তিতু যদি সত্যিই গোড়া মুসলমান ও হিন্দু বিদ্বেষী হতেন তবে তাঁর পক্ষে খুবই সংগত ছিল শাসক ইংরেজদের সঙ্গে বৈরিতা না করে বরং সদ্ভাব বজায় রেখে লক্ষ্য পথে অগ্রসর হওয়া৷ হিন্দু জমিদারকে চাপে রেখে, তাঁদের থেকে নানাভাবে অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়ে তা মুসলমানদের সেবায় ব্যবহার করা৷ কিন্তু এমন সংকীর্ণতার স্পর্শ মাত্র ছিল না তাঁর মধ্যে৷ তিনি জমিদারদের পাশাপাশি জমিদারতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যেমন অস্ত্রধারণ করেছিলেন তেমনি কোম্পানির প্রশ্রয় পুষ্ট আর এক অত্যাচারী শ্রেণি নীলকরদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নিতে কোনোরকম দ্বিধা করেননি৷ তখন নীলকরদের অত্যাচারে কৃষকদের নাভিশ্বাস ওঠা শুরু হয়েছিল৷ তারা কৃষকদের সবচেয়ে বেকায়দায় ফেলত মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে দিয়ে৷ তিতু বিবেচনা করে দেখেন, এই অবস্থা থেকে কৃষকদের মুক্ত করার একটাই পথ খোলা রয়েছে তার সামনে— নীলকরের উপর চড়াও হয়ে নীলকুঠি লুঠ করা, বিশেষত খাতকদের ঋণ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র হস্তগত করে তা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া, যাতে ওইসব কাগজকে অবলম্বন করে নীলকররা আইনের আশ্রয় নিতে না পারে৷
অন্য আর কোনো নীলকুঠি তিতু ও তাঁর দলবল কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়েছিল কি না তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও বারঘরিয়ার নীলকুঠি লুটের বাস্তবতা তো অনস্বীকার্য৷ তিতুর লোকেরা সেদিন আক্ষরিক অর্থেই নীলকুঠি লুঠ করেছিল৷ কুঠি লুঠ করে যা কিছু কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছিল তা একত্রিত করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ এখানেই শেষ নয়৷ তিতুর লোকজনদের হাতে নীলকরদের পর্যুদস্ত হওয়ার আরও সংবাদ রয়েছে৷ বন্ধু জমিদার মহাশয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নীলকর ডেভিস সাহেব তিতুর বিরুদ্ধে লড়তে এলে এর ফল হয়েছিল এই যে, সেদিন কোনোক্রমে নিজের প্রাণটুকুমাত্র রক্ষা করে পলায়ন করতে হয়েছিল ওই সাহেবকে৷ বাকি সব দিক থেকেই হার হয়েছিল তার৷ নীল বিদ্রোহ তখনো অনেক দূরের বিষয়৷ বাংলার কৃষক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সাপেক্ষে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রবল প্রতাপান্বিত নীলকর সাহেবেরা। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম৷ এমন ঘটনা নিয়মিতভাবে পুনরাবৃত্ত হতে থাকলে এই ভারতভূমিতে নতুন করে স্বাধীনতার সূর্য উঠত অচিরেই, প্রায় দুই শতাধিক কাল বিলম্ব হত না৷
আমরা জানি, তিতুর শৌর্ষ ও বীর্যবত্তার প্রেক্ষিতে সেদিন কেবল নীলকররাই পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়নি, যারা রাজন্য ব্যক্তিত্ব বা প্রত্যক্ষত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশ বিশেষ তাদেরকেও একটা স্তর পর্যন্ত অবনত মস্তক হতে হয়েছিল৷ ১৯ নভেম্বরের যে লড়াইতে তিতু ও তাঁর বাঁশেরকেল্লার পতন হয়েছিল তার আগে কোম্পানিক পক্ষ থেকে আরও অভিযান পরিচালিত হয়েছিল এবং সেক্ষেত্রে পরাজয়ের গ্লানি ধারণ করতে হয়েছিল তাদের সর্বাঙ্গে৷ কোম্পানির পক্ষে একাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়েছিল৷ সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছিল বসিরহাট থানার দারোগা বাবুর৷ পালাতে পালতে তিনি শেষাবধি ধরা পড়েন এবং তিতুর লোকজন তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়৷ কোম্পানির সঙ্গে তিতুর এই প্রত্যক্ষ বিরোধের নেপথ্য বৃত্তান্তটি এখানে সুস্পষ্ট করা যেতে পারে৷ আমরা আগেই বলেছি, কোম্পানির শাসনের প্রথম পর্বে স্থানীয় জমিদাররাই ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার৷ যে-কোনো মূল্যে কোম্পানি তাঁদের স্বার্থরক্ষার জন্য দায়বদ্ধ ছিল৷ এই দায়বদ্ধতা থেকেই তারা তিতুর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল৷ সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ তৈরি করেও যখন মোটেই সুবিধা করা গেল না তখন জমিদাররা সকলে মিলে শরণাপন্ন হল তাদের ইংরেজ প্রভুদের৷ স্থানীয় সরকারি আধিকারিকরাও ঘটনার উপর নজর রাখছিলেন৷ তাঁরা ঘটনার গুরুত্ব বর্ণনা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করছিলেন৷ একটা পর্যায়ে এসে কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেন তিতুর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সেই অনুসারে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে নির্দেশ দেওয়া হয়৷ তিনি প্রাথমিকভাবে অভিযান করেন এবং পর্যুদস্ত হন৷ দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় বাঁশেরকেল্লা লক্ষ করে কামান দেগে তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয় তাকে৷
সেই অর্থে অস্ত্রশস্ত্র বলতে প্রায় কিছুই নেই৷ আছে লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেল, গাছের কাঁচা বেল প্রভৃতি৷ এই সামান্য মাত্র উপাদানকে সম্বল করে পাড়ার লড়াইতেও ঠিকঠাক নেতৃত্ব দেওয়া যায় না, দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করা তো দূর অস্ত৷ অথচ এমন অসম্ভবকেও সম্ভাব্যতার মাটিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল, কেবলমাত্র প্রবল ইচ্ছা শক্তির ডানায় ভর করে৷ এটা কে অস্বীকার করবে যে, ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে ভারতীয় মাত্রকে এই যে পরাধীনতার ঘানি টানতে হয়েছিল তার অবসান হত অনতিবিলম্বে যদি আপামর ভারতবাসী তিতুর অনুগামীদের মতো ইট, কাঠ হাতে যা পেত তাই নিয়ে ঘুরে দাঁড়াত৷ এটা যে শুধুই কথার কথা নয়, তার প্রমাণ হিসেবে ক্লাইভের সেই স্মৃতিচারণার কথা স্মরণ করা যায়৷ পলাশির যুদ্ধ জয় করে ক্লাইভ তখন সদলবলে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর পথের দু-ধারে অগণিত মানুষ সমবেত হয়ে তাদের দেখছে৷ এই সমবেত জনগোষ্ঠীকে দেখে, ক্লাইভের মনে মনে হয়েছিল, এরা প্রত্যেকে যদি একটা করে ইটের টুকরো নিক্ষেপ করত তাদের দিকে তাতেই তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হত ওখানেই, ইতি হত ভারতে কোম্পানি শাসনের৷
তিতুর পরাজয় উত্তরপর্বে আরও দেড় শতাধিক বর্ষ পরে এসেছিল আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা৷ এই দীর্ঘ সময়ে স্বাধীনতার জন্য কম লড়াই চলেনি৷ কিন্তু সে লড়াইয়ে সাফল্যের হার মোটেই সন্তোষজনক নয়৷ অগণিত মানুষের প্রাণ গেছে রক্তস্রোত বয়ে গেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে৷ তবু কেন আসেনি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য৷ আসলে এসব লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণ সেভাবে ছিল না বললেই চলে৷ বরাবরই কতিপয় আদর্শায়িত মানুষ দল বেধে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যকে সংহত করে শাসকশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন৷ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকার কারণে এই লড়াই কখনোই তেমন শক্ত ভিত্তি পায়নি৷ প্রায়শ এমনও হয়েছে, দেশের মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিরোধিতা করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের৷ এটা করে এমনিতে তারা অন্যায় করলেও এতে তাদের বিশেষ দোষ ছিল না৷ আসলে তারা ঠিক মতো করে জানতই না যে, এই মানুষগুলি তাদেরই জন্য লড়াই করছে, তাদের সুখ দুঃখের লক্ষ্যে, তাদের চোখের জল মোছাতে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে৷ আর এইখানেই এগিয়ে ছিলেন তিতুমীর। এক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্যের অধিকারী ছিলেন তিনি৷ রসদ বলতে যা বুঝায় তাঁর তা কিছুই ছিল না, তাঁর যা ছিল তা হল সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা৷ যে কোনো গণআন্দোলনের সাফল্য ব্যর্থতার ক্ষেত্রে এটাই হল মূল ফ্যাক্টর৷ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতাকে সমবেত করে দক্ষ হাতে তাদেরকে পরিচালনা করা এবং যথাসময়ে যথানিয়মে শক্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া৷ তিতু একাজ সম্পন্ন করেছিলেন অতি নিপুণভাবে৷ সেদিক থেকে গণ-আন্দোলনের পক্ষে আদর্শ স্থানীয় তিনি৷ নেতাকে সবসময় সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়, কোনো অবস্থাতেই তিনি এমন কোনো অবস্থান নিতে পারেন না যাতে তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ভুল কোনো বার্তা যায়, কোনো সন্দেহ দানা বাঁধার সুযোগ পায়৷ তিতু একথা খুব ভালো ভাবে জানতেন৷ তাই বরাবরই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷ অন্য দিনের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই৷ শেষের দিনটিতেও তিনি ছিলেন প্রশ্নাতীত অবস্থানে৷ তখন কামানের গোলায় ধ্বস্ত বাঁশেরকেল্লার ভেঙে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ তখনও তিনি অনুগামীদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সঞ্চার করে চলেছেন এবং তারা তাঁর কথায় উজ্জীবিত হয়ে দলবদ্ধভাবে লড়াই করতে করতে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছে৷ কিছুতেই কোনোক্রমে আত্মরক্ষা করা বা পিছপা হওয়াকে মনের কোণে স্থান দিচ্ছেন না৷ সেদিন যারা বাঁশেরকেল্লার সামনে শহিদ হয়েছিল তিতু ছিলেন তাঁদের দলেই৷ উপযুক্ত নেতৃত্ব তো একেই বলে৷ সহযোদ্ধাদের শত্রুর সামনে ঠেলে দিয়ে নিজেকে নিরাপদ রাখা, এমন নেতার দৃষ্টান্ত কম নেই বরং তারাই সংখ্যায় বেশি৷ তিতু এসব নেতৃত্ব থেকে শতযোজন দূরত্ব বজায় রেখেছেন৷ সাফল্যকে সর্বোপরি করায়ত্ত করতে পারেননি তিনি, এটা তাঁর ব্যর্থতা নিশ্চয়ই৷ কিন্তু যতটুকু অর্জন তিতুর ঝুলিতে সঞ্চিত হয়েছিল তারই বা দৃষ্টান্ত কোথায়! নেই বললেই চলে৷ বিরুদ্ধ সমালোচকরাও তাই তাঁর এই সাফল্যকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারেননি৷
কেবলমাত্র লোক লস্কর নিয়ে নিয়ে তাৎক্ষণিক কিছু সাফল্য অর্জন করা নয়৷ কোম্পানির শাসনের বিপরীতে সমান্তরাল প্রশাসন প্রবর্তন করেছিলেন তিতুমীর৷ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ ইংরেজকে রাজকর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল৷ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করতে কোনোরকম দ্বিধা হয়নি তিতু ও তাঁর সাথিদের৷ সামান্য কয়েক দিনের জন্য হলেও স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করেছিল মুষ্টিমেয় ভারতবাসী৷ এ কী পরম গৌরবের কথা নয়! কোম্পানির শাসনকালে সাধারণ মানুষদের পক্ষে সবচেয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল দেশীয় জমিদার সহ অনুরূপ অপরাপর সুবিধাভোগী শ্রেণি৷ নীলকরদের মতো অত্যাচারীদের দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই৷ কিন্তু জমিদারদের বাঁদরামি বজায় ছিল গোটা ইংরেজ আমলে তো বটেই স্বাধীন ভারবর্ষে এই সেদিন পর্যন্ত৷ কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না এঁদেরকে৷ এমন যে দুর্দান্ত জমিদার সম্প্রদায় তাদেরকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছিলেন তিতু৷ তাঁর এই বিরাট সাফল্যই তো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কার্ল মার্কস-এর মতো মানুষের৷ ভারত বিষয়ক ব্যক্তিগত নোটে তিনি সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছিলেন তিতুর কথা৷
ঠিক কত মানুষ ভারতের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তা নির্দিষ্ট করে বলার নয়৷ তবে সংখ্যাটা যে লক্ষ লক্ষ তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই৷ এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, এই বিরাট সংখ্যক মানুষদের মধ্যে কে সেই ব্যক্তি যে প্রথম নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন? এক্ষেত্রে দুই জনের নাম উঠে আসে— একজন তিলকা মাঝি, অন্যজন মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর৷ এঁদের মধ্যে কে প্রথম তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও সময়ের বিচারে তিলকা মাঝির দিকেই পাল্লা অপেক্ষাকৃত ঝুঁকে থাকে৷ যদি তাই হয় তাতেও কিছু এসে যায় না৷ তিতু হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় শহিদ৷ একদিক থেকে দেখলে তিতুকেই রাখা যেতে পারে প্রথম স্থানে৷ কেননা তিলকা মাঝির বিষয়টি ছিল কিছুটা ব্যক্তিগত স্তরের লড়াই৷ স্বাধীনতার সংগ্রাম বলতে ঠিক যা বোঝায় তিলকা মাঝির লড়াই সেই স্তর স্পর্শ করেনি৷ অন্যদিকে নারকেলবেড়ের জং কাঙ্ক্ষিত মাত্রাকে ছাড়িয়ে আরও ঊধর্বলোক স্পর্শ করেছিল৷ তিতু কোম্পানির শাসনকে প্রথম প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন, কোম্পানির কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে প্রবর্তন করেছিলেন বিকল্প শাসনতন্ত্র তা সে যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক৷ এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভাবনার নিজস্বতার দিকটি৷ এভাবেও ভাবা যায়! তাঁর আগে তাঁর মতো করে কেউ ভেবে দেখেননি, অন্তত আমাদের কাছে তেমন কোনো ভাবনার খবর নেই৷ উত্তরকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ভাবনা প্রশ্রয় পেয়েছে, উঠে এসেছে স্বায়ত্তশাসন, ডোমিনিয়নের ধারণা, অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি৷ এসব ভাব ভাবনা থেকে অনেকটাই অগ্রসর অবস্থানে ছিলেন তিতু৷ তিনি পূর্ণ স্বরাজের কথা বলেছিলেন৷ কোনোরকম কোনো সমঝোতা নয় একশো শতাংশ বিরোধিতায় ঘাড় ধরে বিদেশি শাসককে এদেশ থেকে বিড়াড়িত করা৷ আক্ষরিক অর্থেই স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করা ছিল তিতুর দর্শন৷ তাঁর এই দর্শনের চর্চা তাঁর সমকালে তো বটেই উত্তরকালেও তেমনটা হয়নি৷ অনেক দিন পরে কবি নজরুল তত্ত্বগতভাবে কথাটা আরও একবার উচ্চারণ করেছিলেন এবং তারও পরে এর বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ তিতু তাই কেবল একজন সংগ্রামী নেতা মাত্র নন, ভারতীয় প্রেক্ষিতে এক বিরাট রাষ্ট্রিক দর্শনের প্রথম ফলিত রূপ৷
এখন কথা হল এমন মহান যে ব্যক্তিত্ব তাঁর মহত্ত্বকে কতটা স্বীকার করে নিয়েছি স্বীকৃতি দিয়েছি আমরা৷ প্রায় কিছুই নয়৷ বরং নিন্দা স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে৷ যে অভিযোগ তাঁর সম্পর্কে করা হয়েছে এবং যে চোখা চোখা বাক্যবাণ তাঁর প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে তার পরিচয় আমরা ইতিপূর্বেই পেয়েছি৷ আমরা আগেই বলেছি, এইসব বাক্যবাণ অযৌক্তিকভাবে বর্ষিত হয়েছে তাঁর প্রতি; যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার মধ্যে ৬ তারিখের বৃত্তান্ত ছাড়া বাকি সবই অসার৷ আমরা আগেও বলেছি, তবু আরও একটু দেখে নেওয়া যাক কেন উক্ত অভিযোগ সমূহের সারবত্তা স্বীকার্য নয়৷
আমরা যদি সমকালীন পত্র-পত্রিকার পাতায় নজর রাখি তাহলে দেখব এখানে তিতু সম্পর্কে এমন সব কথা বলা হয়েছে যা শুধু হাস্যকর নয় অবিশ্বাস্য৷ কোনো কোনো প্রতিবেদনে একথা ফিরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে যে, তিতু বিশেষ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু মেয়েদের পক্ষে৷ সে শুধু হিন্দু মান্য ব্যক্তিদের অসম্মানিত করে ক্ষান্ত হত না হিন্দু মেয়েদের শ্লীলতা হানি করা, তাদেরকে জোরপূর্বক বিয়ে করা তাঁর নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল৷ অথচ সমকালীন সরকারি নথিতে এর কিছুমাত্র উল্লেখ নেই৷ যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকত তবে সরকারি নথিতে তার উল্লেখ থাকা খুবই স্বাভাবিক ছিল৷ প্রশাসনিক মানদণ্ডে বিচার করলে স্বীকার করতেই হবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রশংসনীয় ছিল৷ সংরক্ষণযোগ্য সম্ভাব্য সমস্ত বিষয়ই তখন যথাযথভাবে সংরক্ষিত হত৷ তিতুর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম না হওয়ারই কথা৷ তাঁকে কেন্দ্র করেও একটার পর একটা রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিপোর্ট প্রস্তুত করেছেন দুঁদে সব ইংরেজ অফিসাররা৷ তাঁরা তিতুর এমন সব অপকর্মের কথা শুনবেন, জানবেন এবং তারপরেও রিপোর্টে তা উল্লেখ করবেন না, এটা হতে পারে না৷ বিশেষত সেদিনের মান্য মুসলিম ব্যক্তিত্ব সমূহকে কালিমা লিপ্ত করা, সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলা, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধের আবহ তৈরি করা যেখানে কোম্পানির প্রায় ঘোষিত নীতি ছিল৷ বিদ্রোহী এই পরিচয়ের বাইরে সংশ্লিষ্ট সব রিপোর্টে তিতু সম্পর্কে অতিরিক্ত কোনো নেতিকথা বলা তো হয়নিই উলটে এমন সব কথা বলা হয়েছে যার সূত্রে তাঁর প্রতি আলাদা করে শ্রদ্ধাশীল হতে হয় …৷
তিতুকে অভিযুক্ত করতে গিয়ে ১২ নভেম্বর ১৮৯৫ তারিখে ‘হিতৈষী’ পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তার একস্থানে বলা হয়েছিল— ‘‘একজন অতি সম্ভ্রান্ত মুসলমানের কন্যাকে বলপূবর্বক আনিয়া তিতুমীর ও তাহার ভাগিনেয় উভয়ে বিবাহ করিয়াছিল৷’’ এটা যে কতখানি অবাস্তব কথা তা মুসলমান সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে ন্যূনতম খোঁজখবর রাখেন যাঁরা তাঁরা অনায়াসেই উপলব্ধি করবেন৷ ইসলামে একজন নারীর পক্ষে একই সঙ্গে দুই জন পুরুষের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার কোনো বৈধতা নেই৷ এটা সম্পূর্ণত নিষিদ্ধ বা হারাম বিষয়৷ সেদিন তিতুর নামে আর যত অভিযোগই করা হোক না কেন তাঁর ধর্মচেতনা নিয়ে কোনো রকম কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি৷ ধর্মের নামে তিনি ভণ্ডামি করেন— ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করেন এমন কোনো অভিযোগ ঘুণাক্ষরেও কেউ করেননি৷ অর্থাৎ তাঁর ধর্মনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দেহের কোনো জায়গা নেই৷ আর তাই যদি হবে তবে তিতু ও তাঁর অনুগামীর পক্ষে এক নারীকে বিবাহ করা কীভাবে সম্ভব! ইসলামে যার কোনো বৈধতা নেই! সম্পর্কে তিতু ও গোলাম মাসুম মামা ভাগ্নে ৷ এমন সামাজিক সম্পর্কে সম্পর্কিত দুই পুরুষ একই সময়ে তো নয়ই, ভিন্ন ভিন্ন সময়েও একই নারীকে বিবাহ করতে পারেন না৷ ইসলামে এটা করা জঘন্যতম অপরাধ ও কঠিনতম শাস্তিযোগ্য বলে ঘোষিত হয়েছে৷ কাজেই তিতুর মতো ধর্মপ্রাণ মানুষের পক্ষে এমন কিছু করা অসম্ভব৷
এমন বিরুদ্ধ প্রচার মূলক উদাহরণের শেষ নেই৷ ৯-১১-১৮৯৫ তারিখের ‘হিতৈষী’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেখানে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয় যে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় আদতে কোনো দাড়ি কর প্রবর্তন করেননি৷ এটা আসলে তিতু ও তাঁর অনুগামীদের অপপ্রচার৷ পত্রিকাটির ভাষ্য এইরকম– ‘‘সুতরাং তিনি তাঁহার প্রজাদিগের মধ্যে যাহারা তিতুমীরের কথামতো চলিতেছিল তাহাদের প্রত্যেকের প্রতি ১৷. কর আদায় করিবেন বলিলেন৷ অর্থাৎ যাহারা স্বব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইয়া নিজ পরিবারাদির ভরণপোষণ করিবে না ও তাঁহার প্রাপ্য খাজনার দায়ী হইতে চাহিল না, তাহাদের প্রতি উক্ত কর ধরা হইল৷ ইহাকেই ‘দাড়িকর’ বলিয়া তিতুমীর অভিহিত করিয়াছিল৷’’ এমন নির্জলা মিথ্যার প্রত্যুত্তরে কী বলা যেতে পারে৷ তিতু যে লড়াই এ অবতীর্ণ হয়েছিলেন তার মূলে যেসব গুরুতর কারণ ছিল দাড়িকর তার মধ্যে অন্যতম৷ দাড়িকর-এর বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশমাত্র নেই৷ সরকারি নথি সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এর প্রমাণ মেলে৷ অথচ তারপরেও বিষয়টিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ এই ব্যাখ্যা যে সম্পূর্ণত উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ কী ন্যায় নীতি, কী ধর্মীয় ভাবাবেগ সব দিক থেকে দাড়িকর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এমন একটা বিষযেরই যদি অবাস্তবতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয় তবে অন্যসব ক্ষেত্রে কী করা হয়ে থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়৷ ‘এডুকেশন গেজেট’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধৃতি যোগ্য– ‘‘তখন এই আড্ডাতে অধিক সংখ্যক মুসলমান ছিল না৷ সুতরাং জমিদার পক্ষের লোকেরা বলপূবর্বক লোক ছড়াইয়া মুসলমানদিগের প্রতি একটু অধিক মাত্রায় অত্যাচার আরম্ভ করিল৷ মুসলমানেরা অত্যাচার না দেখিয়া আপনাদিগের উপাসনাগৃহে অগ্নি প্রদান করিল৷’’ এমন মিথ্যাচারের কী ব্যাখ্যা হতে পারে! জমিদার মহাশয় রাজ-সরকারে মিথ্যা করে যে অভিযোগ করেছিলেন, অর্থাৎ মুসলমানরা নিজেরাই তাদের মসজিদে অগ্নি সহযোগ করে তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাসাতে চাইছে— জমিদারের এই মিথ্যা ভাষণের পুনরুক্তি করছেন একজন দায়িত্বশীল সম্পাদক৷ এর থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় তিতুকে জনমনে অপাঙ্ক্তেয় করে তোলার পরিকল্পনা ও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জল কতদূর গড়িয়েছিল সেদিন৷
বিরুদ্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তো বটেই, নিরপেক্ষ বিচারেও একটা বিষয় তিতুর বেশ বিপক্ষে যায়৷ নারকেলবেড়ের জং-এর অব্যবহিত পরে তিতুমীরের কৃতিকথা নিয়ে বেশ কিছু ছড়া ও গীত রচিত হয়েছিল৷ এই গীতগুলি তিতুর পক্ষে একেবারেই ইতিবাচক নয়৷ এখানে তাঁকে যারপরনাই নিন্দে মন্দ করা হয়েছে৷ যেমন— ‘‘নারিকেলবেড়ের তিতুমীর বুজরগি করিল৷/ যত সব মিঞা মোল্লা,/ বানায়ে বাঁশের কেল্লা/ ফিরিঙ্গি বাদসার সনে লড়াই জুড়িল৷৷/ মরি হায় হায়, হায় মরি, হায়রে হায়!/ সবে জব্দ হলো, কেল্লা গেল, মারা পলো তিতুমীর৷/ হায় মজার বুজরুগি তার হইল জাহির৷৷/ জূলনী উঠিয়া বলে উঠরে জোলা ঝাট৷/ হাজামবাড়ী যেয়ে শিগ্গির গোঁপ দাড়ি কাট৷’’ এমন আরও কিছু উদাহরণ রয়েছে৷ সুবিধাভোগী শ্রেণি বা হিন্দু প্রধান তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নানা সমীকরণকে সমীকৃত করে তিতুর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, এটা না হয় সত্য৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ কেন তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে৷ বিশেষত হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ যেখানে তাঁর অনুরাগী হয়েছিলেন, তাঁর হয়ে লড়াই করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন৷ আমাদের মনে হয়, এই বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক বলে মনে হলেও আদতে এখানে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই৷
আসলে তখন সময়টা একটু অন্য রকমের ছিল৷ এখন আমরা ইংরেজ অধিকার, স্বাধীনতা-স্বাধীনতার লড়াই এসব কিছুকে যে চোখে দেখতে অভ্যস্ত তখন তা ছিল না৷ জনমানসে শাসক ইংরেজ সম্পর্কে অতি মাত্রায় সমীহ বিরাজ করত৷ ইংরেজ রাজের বিরুদ্ধে প্রতিস্বর্ধী অবস্থানকে মোটেই ভালো চোখে দেখত না সাধারণ৷ ফলত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি সহজাত শ্রদ্ধাবোধ তো দূরের কথা বরং তাদের সম্পর্কে কমবেশি বিদ্বেষ ভাবই প্রশ্রয় পেত৷ অন্যসব কথা ছেড়ে দিয়ে যদি শুধু মহাবিদ্রোহের কথাতে আসা যায় তাহলেই বিষয়টা সুস্পষ্ট হবে৷ ভারতীয় জাতিসত্তার পক্ষ থেকে আজ আমরা মহাবিদ্রোহ কে উপলক্ষ্য করে যেভাবে গর্ববোধ করে থাকি এই সেদিন পর্যন্ত তাকে সিপাহি বিদ্রোহের অতিরিক্ত কিছু বলে মনে করা হত না এবং এই সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে সাধারণের মনে তেমন কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিল না৷ আর তার আগের অবস্থা তো আরও শোচনীয় ছিল৷ তখন সিপাহিদের এক একজনকে ডাকাত, লুটেরা, নিদেনপক্ষে উপদ্রবসৃষ্টিকারীর অতিরিক্ত কিছু বলে মনে করা হত না৷ কেবল সাধারণ মানুষই নয় তারা না হয় প্রকৃত অবস্থার পাঠ না নিতে পেরে বিভ্রান্ত হয়ে মিথ্যা ধারণায় উপনীত হতে পারে, কিন্তু রীতিমতো শিক্ষিত সচেতন মানুষরাও কেন এটা করবেন! অথচ তাঁরাও সেদিন তাই করেছিলেন৷ মহাবিদ্রোহের নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এমন শিক্ষিত সজ্জন মানুষের সংখ্যা সেদিন মোটেই বেশি ছিল না৷ যাঁরা ছিলেন তাঁরা ব্যতিক্রম হিসাবেই বিবেচিত হতেন৷ এর ফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল৷ সিপাহিদেরকে লক্ষ করে বাধা হয়েছিল ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক সব ছড়া৷ ঈশ্বর গুপ্তের মতো কবিদের ভূমিকার কথা তো আমাদের সকলেরই জানা৷
তখন জাতীয়তাবোধের ধারণা বেশ কিছুটা দানা বেঁধেছে, সচেতনতার স্রোত প্রবাহিত হয়েছে নিজস্ব মাত্রায় তবু তারপরেও মহাবিদ্রোহের সংগ্রমীদের পরিণতি যদি এই হয়ে থাকে তবে তিতুর অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়৷ তিতুর শত্রুর শেষ ছিল না৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, নীলকর সমাজ, স্থানীয় বড়ো-ছেটো-মেজো-সেজো জমিদার সবাই তাঁর শত্রু৷ তাঁর স্বজন বলতে আছে নিতান্ত চাষিবাসী ও দিনমজুর শ্রেণির কিছু মানুষ৷ এই মানুষরা তাদের ঐকান্তিকতার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ততদূর পর্যন্তই যেতে পারেন যতদূর তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তারা নিজেরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিশেষ কিছু করে উঠতে পারে না৷ যতদিন তিতু ছিলেন তাঁর জন্য নিজেদেরকে একশো শতাংশ নিংড়ে দিয়েছিল তারা৷ কিন্তু যখন তিতু আর তাদের মধ্যে নেই তখন আর তাঁর আদর্শকে বহন করে নিয়ে যেতে পারেনি তারা৷ হাওয়া তখন সম্পূর্ণ উলটো পথে বইতে শুরু করেছে৷ নিদারুণ হার হয়েছে তিতু ও তার অনুগামীদের৷ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে জমিদার শ্রেণি৷ এখন সাধারণের পক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করা মানে নিশ্চিত বিপর্যয়কে আবাহন করে আনা৷ তখনও তিতুপন্থী যারা জীবিত বা বর্তমান ছিল তারা তাই নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল৷ একদিকে তাদের এই নিজেদেরকে গুটিয়ে নেওয়া অন্যদিকে জমিদারের পেটোয়া শ্রেণির নিরন্তর অপ্রপ্রচারের ঢাক পিটিয়ে যাওয়া৷ এর সম্মিলিত প্রভাবে অনুরূপ ছড়া বা গান প্রণীত হওয়ার মধ্যে খুব অস্বাভাবিকতা নেই৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিতুর দিক থেকে নেতিবাচক আলোচ্য সব ছড়া যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আরও নানা বৃত্তান্ত যা তাঁর গরিমা বা সমুজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে বিশেষ মাত্রা দেয়৷ বাঁশের কেল্লার সামনে সম্মুখ যুদ্ধে তিতু যখন মৃত্যুবরণ করলেন, শহিদ হলেন তখন তাঁর দেহকে অধিকার করে ইংরেজ বাহিনী৷ অতঃপর তারা যা করে তা কোনো দিক থেকেই শিষ্টাচার সম্মত নয়৷ মৃত দেহকে অমর্যাদা করা অমার্জনীয় অপরাধ৷ অতি বড়ো শত্রুরও অধিকার থাকে মৃত্যুর পর প্রতিপক্ষের দিক থেকে ন্যূনতম সম্মান প্রাপ্ত হওয়া৷ কিন্তু তিতুর মৃতদেহের প্রতি সেই সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি সুশিক্ষিত, সভ্যতার গর্বে গর্বিত ইংরেজ সেনাদের দিক থেকে৷ ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের মৃতদেহকে কবরস্থ করা সাধারণ রীতি৷ বিশেষ কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে জলে ভাসিয়ে দেওয়ারও রীতি রয়েছে৷ তিতুর ক্ষেত্রে এর কোনোটাই করা হয়নি৷ অগ্নি সংযোগ করে সম্পূর্ণ রূপে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিতুর দেহকে৷ এটা করা হয়েছিল একটাই কারণে তিতুর অনুগামীরা যাতে কোনোভাবেই তাঁর দেহকে নিজেদের অধিকারে না নিতে পারে৷ তেমন হলে তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে ভক্তদের একত্রিত হওয়া, নতুন করে লড়াই শুরু করা অসম্ভব নয়৷ অন্তত তেমনটাই মনে হয়েছিল ইংরেজ পক্ষের৷ তারা তাই শত্রুর শেষ রাখতে চায়নি৷ পুড়িয়ে ছাই করে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছিল৷ একজন সংগ্রামী নেতার পক্ষে এটা অবশ্য পরম প্রাপ্তি৷
শেষ লড়াইয়ের দিন যখন তিতুর পতন হচ্ছে সেদিন কেল্লার মধ্যে তাঁর সঙ্গে কয়েক সহস্র লোক উপস্থিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়৷ যুদ্ধ যখন শেষ হয়েছে তখন এইসব লোকদের মধ্যে খুব কমজনকেই জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ সংখ্যাটা টেনেটুনে সাড়ে তিনশোর মতো হবে৷ বাকিরা মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছে৷ এক্ষেত্রে সরকারি হিসেবের খাতায় অবশ্য সংখ্যাটা তেমন বেশি করে দেখানো হয়নি৷ যতদূর মনে হয় এটা করা হয়েছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে যাতে সাধারণের কাছে বিষয়টা যথাসম্ভব হালকা করে দেখানো যায়৷ এক্ষেত্রে আমাদের ধারণা যে খুবই সংগত তার পরোক্ষ কিছু প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম একদিন৷ সেদিন যখন নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা পরিদর্শন করতে যাই তখন এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল৷ এখন যেখানে স্থানীয় পঞ্চায়েতের ব্যবস্থপনায় একটি কৃত্রিম বাঁশেরকেল্লা তৈরি করা হয়েছে তার অদূরেই রয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি বা ঢিবির মতো একটা জায়গা৷ এই ঢিবি থেকে সেদিন মাটি কাটছিল জনৈক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী৷ মাটি কাটতে কাটতে তারা সহসা বেশ কিছু হাড় দেখতে পায়৷ এই হাড় যে মানুষের তা নিয়ে সংশয় মাত্র নেই৷ তারা আমাদেরকে ডেকে হাড়গুলি দেখায় এবং আরও জানায় মাঝেমধ্যেই এমন হাড় তারা দেখতে পায়৷ গ্রামের মানুষের থেকে খবর নিয়ে জানা যায়, স্মরণাতীত কালের মধ্যে এখানে কোনো কবরস্থান ছিল না৷ তাহলে এত হাড় আসে কোথা থেকে৷ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এসব তিতুর অনুগামীদের দেহাবশেষ৷ অগণিত মানুষ সেদিন তাদের নেতার পাশে দাঁড়িয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল৷ এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে একটা অনুষঙ্গকে সামনে আনা যেতে পারে— ‘‘যুদ্ধের অবসানে সেই অসংখ্য বিদ্রোহীদিগের তিনশত পঞ্চাশ জন মাত্র জীবিত ছিল৷ ইহাদিগের এক শত চল্লিশ জনের কারাদণ্ড হয় এবং তিতুমীরের সেনাপতির প্রাণদণ্ড হয়৷’’ (‘সখা’, অক্টোবর ১৮৮৮ সংকলিত : “সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ”, প্রথম খণ্ড, স্বপন বসু) একজন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এত অধিক সংখ্যক মানুষ যখন অকতারে প্রাণ দেয় তখন মানুষটির অসামান্যতা সন্দেহাতীত মাত্রা পায়৷
তবু সন্দেহ করা হয়েছে৷ কেবল সন্দেহ করা নয় প্রতিরোধ স্পৃহার আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তিতুমীরের কৃতিত্বকে এ আমরা দেখেছি৷ সেই চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি এই যা ভরসার কথা৷ বহমান স্রোতে নির্বিচারে ব্যক্তিগত বিচার বুদ্ধিকে বিসর্জন না দিয়ে সমস্ত বিষয়টাকে নতুন করে ভেবে দেখার, মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে প্রাণিত হয়েছেন অনেকেই৷ তাঁদের এই ক্রিয়াশীলতার সূত্র ধরে নতুন করে আলোকিত হয়েছেন ও হচ্ছেন মীর নিসার আলী৷ তিতু ও তাঁর কৃতিকথাকে বিষয় করে লেখা হয়েছে প্রামাণ্য সব গ্রন্থ৷ ‘বিট্রিশ ভারতীয় নথিতে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীগণ’ (ড. মঈনুদ্দীন আহমদ খান), ‘নারকেলবেড়ের জঙ্গ : তিতুমীর’ (গৌতম ভদ্র), ‘মুসলিম সোসাইটি ইন ট্রান্সিশন তিতুমীর রিভোল্টস ১৮৩১’ (অভিজিৎ দত্ত), ‘এ স্টাডি ওয়াহাবি অ্যান্ড ফারায়েজি রিবেলস অব বেঙ্গল’ (নরহরি কবিরাজ), ‘বিজর বাঁশের কেল্লা’ (কুমারেশ দাস) প্রভৃতি যেমন৷ অধ্যাপক স্বপন বসু সম্পাদিত বিহারীলাল সরকার লিখিত ‘তিতুমীর’ এই ধারায় অনন্য সংযোজন৷ অধ্যাপক বসুর পূর্ব-উল্লেখিত ‘সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’, প্রথম খণ্ড (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে দুর্লভ সব তথ্য ও নথি৷ পাশাপাশি বিপরীতমুখী চর্চাও যে হয়নি তা নয়৷ উলটো দিক থেকেও দেখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ রুদ্রপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের শাশ্বত ভারত গ্রন্থমালা পর্যায়ের ‘নবরূপে তিতুমীর’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ মত প্রতি মত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷ এমন মত পার্থক্যের মধ্যে দিয়ে ক্রমে ক্রমে প্রকৃত সত্যে স্থিত হওয়াই আমাদের লক্ষ্য৷ তিতুর ক্ষেত্রে এই লক্ষ্যপূরণে কোনো সমস্যা হবে না এ আমাদের স্থিরবিশ্বাস৷
দোষে গুণে মানুষের পূর্ণতা৷ তিতুও তার ব্যতিক্রম নয়৷ তবে একটা জায়গায় তিনি অন্যদের থেকে অনেকটাই আলাদা৷ দোষ গুণের বেড়া ডিঙিয়ে তিতু শেষপর্যন্ত যে উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেননি অনেকেই৷ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন নিঃশেষ হয়ে আসে আমাদের প্রাণশক্তি৷ আর তিতু এখানেই খুব বেশি রকমের আলাদা৷ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া রূপ দীপশিখাকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়ে মানব কল্যাণের লক্ষ্যে পথে নেমেছিলেন তিনি৷ লক্ষ্য পথে চলতে চলতে অনেক চড়াই উৎরাই এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁকে৷ এমন চড়াই উৎরাই এর মাঝে পড়ে কখনো কখনো কমবেশি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন হয়তো, তবে শেষাবধি কোনো পদস্খলন হয়নি তাঁর৷ মানব কল্যাণের আদর্শে তিনি শেষদিন পর্যন্ত ভাস্বর রাখতে পেরেছিলেন নিজেকে৷ অসম যুদ্ধে সহযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে শহিদ হতে এতটুকুও দ্বিধা করেননি তিনি৷ যেদিন শাসকের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার উপায় ছিল না সেদিন শোষিত নির্যাতিত মানুষের সপেক্ষে বিস্ময়কর রকমভাবে উদ্ভাসিত ছিলেন মীর নিসার আলী৷ তাঁর এই উদ্ভাসন বিদ্রোহের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে প্রাণিত করেছিল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শোষিত-লাঞ্ছিত-নিপীড়িত এক জনসমাজকে৷ সেদিনের প্রেক্ষিতে তো বটেই, আজকের দিনে যা সহজ লভ্য নয়৷ গোটা উনিশ শতক জুড়ে আমাদের প্রাজ্ঞজনেরা যেখানে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন তিতু সেখানে অনায়াসে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন৷ তাঁর মধ্যে সংশয়ের লেশমাত্র ছিল না৷ ইংরেজ শাসনের কুফল ও এর ভয়ংকরতা সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তে কোথাও কোনো অস্পষ্টতা ছিল না৷ তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিতে পেরেছিলেন বিদেশি রাজের বিরুদ্ধে, উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন স্বাধীনতার জয় পতাকা৷ কোনো সন্দেহ নেই, তিতুমীর তার সময়ের থেকে অনেক অগ্রবর্তী৷ উত্তরকালে তাঁর দেখানো পথই অনুসরণ করেছেন অন্যেরা৷ বলা যায়, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখানেই তিতুর ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা তাঁর সংগ্রামী চেতনার অনন্যতার৷
কথা শেষ৷ তবু শেষের লেজুড় হিসেবে একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যেতে যেতে পারে৷ এই শতাব্দীর গোড়ার দিকের ঘটনা৷ প্রখ্যাত উনিশ শতক গবেষক স্বপন বসুর এক দৌহিত্র ভূমিষ্ঠ হয়৷ দাদু নাতির ডাকনাম রাখেন তিতু৷ জিজ্ঞাসুদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেন— বড়ো হয়ে ও কী হবে না হবে আমি জানি না, তবে একজন বড়ো মানুষের নামের সঙ্গে ওর নামটা যুক্ত হয়ে থাক, কিছুটা হলেও যদি তাঁর গুণের অধিকারী হয়৷
বি. দ্র. : উদ্ধৃতি বা পাদটীকার ভারে রচনাকে ভারাক্রান্ত না করা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত৷ তাই প্রাসঙ্গিক কথা বা বক্তব্য যথাসম্ভব কম উদ্ধৃত করা হয়েছে৷ প্রিয় পাঠক চাইলে উল্লেখিত তিতুমীর বিষয়ক গ্রন্থসমূহের পাঠ নিয়ে সত্যের গভীরে আরও বেশি করে পা রাখতে পারেন৷