পার্থপ্রতিম দুবে
কুটুম্বভরণাকুলৈঃ কুন্দালপ্রায়কৃষিভিঃ কৃষীবলৈরবলীবর্দৈরবলদ্ভিরুচ্চ ভাগভাষিতেন
—“হর্ষচরিত”, ‘সপ্তম উচ্ছ্বাস’/ বাণভট্ট
হুগলি জেলায় তেভাগা আন্দোলন নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনার তাগিদ থেকেই আমার এই প্রৌঢ় বয়সে আবার লেখনী ধারণ। অনতি অতীতে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে গভীরভাবে চর্চা করেছেন। আমি এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে তাঁদের গবেষণালব্ধ বিষয়গুলি থেকে সাহায্য যেমন নিয়েছি তেমনই তাঁদের মতামতকে নতুন আলোকে বিশ্লেষণ করতে প্রয়াসী হয়েছি।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বিশ শতকের ভারতবর্ষে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলন হল তেভাগা আন্দোলন। ভারত ভাগের অব্যবহিত পূর্বে এই আন্দোলনের জন্ম। এই আন্দোলনের সংগঠক ছিল ভারতীয় কৃষক সভার বঙ্গীয় ইউনিট এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্যশাখা। তবে ৪৬-এ এই আন্দোলনের সূচনা হলেও বাংলার কৃষকদের নিয়ে গভীর সমস্যা অনেকটা আগে থেকেই ছিল, তা নিয়ে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আলোড়ন কম হয়নি। এর ফলস্বরূপ ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে ফ্লাউড কমিশন গঠন হয়। এই কমিশনের সুপারিশে ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ এবং উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষককে দেওয়ার প্রস্তাব।
এর আগে কৃষকের সমস্যার কথা একেবারেই অনালোচিত ছিল তা নয় বরং নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৯) নেতা ফজলুল হক, যিনি পরবর্তীকালে কৃষক প্রজা পার্টির (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৩৫) নেতা হন, তিনি জমিদারি প্রথা বিলোপের জন্য ও কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে ভূমি রাজস্ব কমিশন, যা ফ্লাউড কমিশন নামে প্রসিদ্ধ, নিয়োগ করেন। স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউড কমিশনের কর্তা। তাঁর নামেই কমিশনের নাম। ১৯৪০ সালের ২ মার্চ কমিশন তাঁর সুপারিশ মন্ত্রিসভার কাছে পেশ করেন। সুপারিশে ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ ও কৃষকদের উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের মধ্যে দুই ভাগ তাঁদের প্রাপ্য।
বিধানসভায় ফ্লাউড কমিশন সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য শোনা যায়। বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় বলেন, “কমিশন নিয়োগ করে ভূমিব্যবস্থার আমূল সমস্যা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে, বাংলার কৃষককে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। …প্রয়োজন— বাংলার সমাজের আমূল পরিবর্তন।” মহাজনি আইনকে রায়ত শোষণ আইন বলে অভিহিত করে বিধায়ক অসিমুদ্দিন আহমদ বলেন, আইনের খসড়া কাট-ছাঁট করে এমন অবস্থায় দাঁড় করানো হয়েছে যে এর ফলে শতকরা দশজন খাতকও উপকৃত হবেন না। সৈয়দ আহমদ অভিযোগ করেন– “বাংলার কৃষকের সবই গেছে শুধু হাড়গুলি বাকি আছে। এই আইন সেই হাড়গুলিকেও কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।” বিধানসভার অভ্যন্তরে কৃষক নিয়ে ভাবনা জনমানসে প্রতিফলিত হয় তেভাগা আন্দোলনের মাধ্যমে। তেভাগা আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনার সুযোগ না পেয়ে বাজেটের বিভিন্ন খাতে বিতর্কে অংশ নিয়ে জ্যোতি বসু কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পুলিশ গরিব বর্গাদার ও আধিয়ারদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে তাঁর বিবরণ দেন।
আসলে গ্রামাঞ্চলে ফসলের ভাগ যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠিক একইরকমভাবে জমিদারদের জুলুম একটি অন্যতম বিষয়। বলা যেতে পারে তেভাগা আন্দোলন শুরুই হয় জমিদারদের জোর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। যে খাজনা আদায় করা হত তার একটা অংশ নিজের কাছে রেখে দিত জমিদাররা। অনেক ক্ষেত্রে চাষিদের উপর বিভিন্ন রকমের কর চাপাত এরা। এছাড়াও ছিল বিভিন্ন ধরনের সেলামি। জমির মালিক বা চাষিদের কাছ থেকে আদায় করত নানা ছলছুতোয়। বিষয়ভিত্তিক সেলামির কয়েকটির উদাহরণ হল : সম্পত্তি বিষয়ক, জীবিকা নির্বাহ বিষয়ক, পেশাভিত্তিক কর, জমিদারের উৎসবানুষ্ঠান বিষয়ক, লোকাচার বিষয়ক, নিয়মভঙ্গ বিষয়ক, জাতপাত বিষয়ক ও বারবনিতা সম্পর্কিত। এছাড়া জমির শ্রেণি পরিবর্তন, পিতা-মাতা, ব্রাহ্মণাদি গুরুজনকে কটুকথা বলা বা মারধর করা, কারও নামে মিথ্যা অপবাদ রটানো, নীচু জাতির কোনও ব্যক্তির সাথে দাঙ্গা বা বিবাদ করার জন্যও জরিমানা দিতে হত।
পুরোনো ছক
বেদের সময় ভূমি সর্বসাধারণের সম্পত্তি হিসেবে ধরা হত। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই ভূমি দান প্রচলিত ছিল না মালিকানাস্বত্ব না থাকার কারণে। তবে কৃষির ওপর গুরুত্ব ছিল। যর্জুবেদের একটি মন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। মনুসংহিতা-র একটি শ্লোকে যে বক্তব্য উঠে এসেছে তা হল, যে জঙ্গল কেটে আবাদ করে সে ঐ ভূমির অধিকারী।
এখন প্রশ্ন হল তাহলে কখন থেকে ফসলের ভাগ নেওয়ার পদ্ধতি চালু হল। বৌদ্ধ যুগে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কৃষিকার্যে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কৃষিকাজের প্রয়োজন। তাঁরাই প্রথম জমি ভাগে দেওয়া শুরু করেন।
সুলতানি ও মুঘল যুগ
আলাউদ্দীন খিলজির আমল থেকেই ভূমি রাজস্ব— খরাজ ও মল প্রচলিত হয় (১২৯৬-১৩১৬) যা মুঘল সাম্রাজ্যেও অব্যাহত ছিল। ভূমি করের প্রবর্তনে কৃষকের সাথে তার ঊর্ধ্বতনের সম্পর্ক পুনর্গঠিত হল। প্রতিটি কৃষকের নামে কর ধার্য হওয়ায় লিখিত রাজস্বের অনুপ্রবেশ ঘটল। আবুল ফজল ব্যবসায়ী ও কৃষকদের ওপর চাপানো করকে সমর্থন করলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ রাজস্বের আয় কৃষকের উদ্বৃত্ত সম্পদ। এছাড়াও কৃষকের ওপর চেপে বসত গ্রামীণ স্তরের ভূম্যধিকারীদের দাবি।
ব্রিটিশ পর্ব
পলাশির যুদ্ধ পরবর্তীকালে ইংরেজরা খাজনা নিয়ে চিন্তিত ছিল। এর কারণও ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সেসময়ে (১৭৬৫-৭৩) মুঘল বাদশাহকে ছাব্বিশ লাখ টাকা বছরে দিতে হত। ১১৭৬ (১৭৭০ খ্রিঃ)-এর মন্বন্তরের অব্যবহিত পরেই পাঁচ বছরের (১৭৭২-৭৭) সেট্ল্মেন্ট অ্যাক্ট চালু করা হয়। এতে বলা হয় জমি চাষিদের পাঁচ বছরের জন্য দেওয়া হবে (খাজনার বিনিময়ে)। পরবর্তীকালে এল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কাউন্সিলের চারজন সদস্য সমেত গভর্নরকে নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হবে যারা নিয়মিত জেলা পরিদর্শনে যাবেন, কালেক্টর নামে এখন থেকে সুপারভাইজারদের ডাকা হবে, দেওয়ান পদের সৃষ্টি হবে।
এসব ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক উৎপাদন কাঠামোর সঙ্গে কৃষিজমির সংযুক্তকরণের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্তর সৃষ্টি করে রাজস্ব ব্যবস্থা নিরুপদ্রবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। এর সাথে ছিল জমিদার ও অন্যান্য স্বত্বভোগীদের ব্যক্তি মালিকানার নিরাপত্তা।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শোষণমূলক চরিত্র অচিরেই কৃষকদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে এই ক্ষোভ আন্দোলনের চেহারা নেয়।
সে সময়ের যুক্ত বাংলার ক্ষেত্রে দেখা যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উদ্ভূত জমিদারকুলের বেশিরভাগ অংশই হিন্দু ও ধনী কৃষক আর রায়ত ছিল অনেকাংশে মুসলমান। পূর্ব বাংলায় ১৯২৬-৩১ সালে হিন্দু জমিদার ও কুসীদজীবীদের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রজাদের বিক্ষোভ দেখা যায়; পরবর্তীকালে ঐ আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।
১৯৩২-৩৩ সালের পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনের আঁচ প্রশমিত হয়ে গেলে ভাগচাষিদের আন্দোলন ও দাবিদাওয়া তীব্র রূপ ধারণ করে। জোতদারদের হয়ে সমঝোতার প্রস্তাব কংগ্রেস দল নিয়ে এলে ভাগচাষিদের ক্ষোভ প্রশমিত না হয়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল। এ বৃদ্ধির কারণ হল নতুন এক শক্তি গ্রামাঞ্চলে আত্মপ্রকাশ করেছে যাদের হাতে রয়েছে আন্দোলনের রাশ। তাঁরা হলেন কমিউনিস্ট পার্টির কৃষকসভার নেতৃবৃন্দ। ১৯৪০ সালে কৃষক সভা যশোর জেলার (বর্তমান বাংলাদেশে) কেশবপুর থানার অন্তর্গত পাঁজিয়া গ্রামে তেভাগার দামি প্রথম তুললেও তা কার্যকর হতে ছ-বছর লেগে যায়। মৌভোগ সম্মেলন হয় খুলনা জেলার মৌভোগে। এর তিন মাস পরে সেপ্টেম্বর মাসে (১৯৪৬) পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা তেভাগা আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
হুগলি জেলা
এবার আমি মূল প্রসঙ্গে— হুগলি জেলায় তেভাগা আন্দোলনের কথায় আসব। এ লেখা লিখতে গিয়ে প্রথম চোটেই হোঁচট খেলাম, কারণ সুস্নাতবাবু ঘোষণা করে দিয়েছেন, তেভাগা আন্দোলন শ্রীরামপুর ও আরামবাগে হয়নি। সদরে বিজয় মোদকের নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বলাগড় থানার শ্রীকান্ত ও গোপালপুরে আন্দোলন হয়। আরামবাগে সামান্য চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় বর্গাদারদের মধ্যে।১ এ মতের সমর্থকও বেশ নামজাদা ব্যক্তি নূহ-উল-আলম লেলিন।২ ফলে লেখা পরিত্যক্তের পথে। কিন্তু বাঁচিয়ে দিলেন দুজনেই। লেলিন যে বইটি সংকলন করেছেন সেই ‘তেভাগার কথা’-তেই সুচরিতা সেন-এর লেখায় এসেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারাণের নাতজামাই’ ও ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’-র প্রসঙ্গ, যা তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা। সেখানে বলা আছে ‘ছোটো বকুলপুর আসলে বড়ো কমলাপুর। সে যুগে এক আন্দোলনের কেন্দ্র।৩ সুস্নাত বাবু আরও একবার হুগলি জেলার তেভাগার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘পরিচয়’-এর পাতায়।৪ আসলে তেভাগা আন্দোলনকে অনেকে দুই বা তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।৫ হুগলি জেলার আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। বর্গাদার বিল যা ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’ বলে পরিচিত; তৎকালীন ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী কর্তৃক তেভাগার দাবি স্বীকৃত হবার আঠারো দিন পর ক্যালকাটা গেজেটে প্রকাশিত হয় ২২ জানুয়ারি ১৯৪৭ সালে যা তেভাগা আন্দোলনকে গতি দেয়। কৃষকেরা বুঝতে পারে তেভাগার দাবি এখন আইন স্বীকৃত। জোতদাররা হতবুদ্ধি হলেও তারা বিলটিকে মানতে রাজি না হওয়ায় তেভাগার সংগ্রাম দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে।৬ তবে এর সাথে যুক্ত ছিল মূলত জমিদার বিরোধী আন্দোলন। আবদুল্লাহ রসুলও ১৯৪৮-৪৯ সালের আন্দোলনে শহিদদের তেভাগার শহিদ নয়া বলে কৃষক আন্দোলনের শহিদ বলে চিহ্নিত করেছেন।৭ কৃষকদের আত্মসংঘবদ্ধ হবার প্রয়াসকে আমরা কয়েকটি স্থান ধরে আলোচনা করব।
আরামবাগ
১৯২১ সালে আরামবাগ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হয়। কংগ্রেস দল বন্যা দুর্গত অঞ্চলে ত্রাণের কাজ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময়ে তাঁরা লক্ষ করেন তাঁতিদের দুরবস্থা, সেচের অবনতি ও দুর্বল নিকাশি ব্যবস্থা, যার কারণে বন্যা পরবর্তীকালে মহামারির আস্ফালন। আর এসবের জন্য গান্ধিবাদী কর্মীরা দায়ী করেন অপদার্থ ইউনিয়ন বোর্ডকে ও বে-আইনি আদায়কারী সেচ দপ্তরকে। একটা কথা বলা দরকার আরামবাগের আন্দোলনকারীরা বেশিরভাগ আরামবাগের অধিবাসী নন।৮ ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করে। বহু ইউনিয়নে চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ হয়। ট্যাক্সের দায়ে সরকার অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করতে লাগে। কিন্তু ক্রোক করা সম্পত্তি কেনবার লোক নেই। অস্থাবর সম্পত্তির মাল বহনকারী পাওয়া যায় না। গোরুর গাড়ি কেউ দেয়নি। যেসব জায়গায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সে স্থানগুলি হল: বড়োডোঙ্গল, মানিক পাট, গৌরহাটি, ডহরকুন্ডু, ঘাসুয়া, তালিত, পাতুল, নন্দনপুর, রাউৎখোলা, কদর, খানাকুল, রায়খা, ইন্দিরা, নকুণ্ডা, শ্যামবাজার, বদনগঞ্জ, কুনুই, রসুলপুর, বেঙ্গাই, নারানপুর, ফতেপুর, শ্যামপুর প্রভৃতি অঞ্চল। বদনগঞ্জে পুলিশের গুলি চলে, কয়েকজন আহত হন। আরামবাগ অঞ্চলে গণ-আন্দোলন প্রথম দিকে প্রফুল্ল সেনের নেতৃত্বে এবং তাঁর গ্রেপ্তারের পর অতুল্য ঘোষ ও ভূপেন্দ্র নারায়ণের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।৯
আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আরামবাগ মহকুমার চন্দ্রকোণা থানার অন্তর্গত চেচুয়া গ্রামে পুলিশের অত্যাচার বেড়ে গেলে গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে থানা আক্রমণ করে ও দু-একজন (!) পুলিশের মৃত্যু ঘটে। এর ফলে পুলিশি হামলা আরও বেড়ে যায়। গ্রেপ্তার হন অতুল্য ঘোষ, বিজয় মোদক, পঞ্চানন বসু, মেদিনীপুরের সরোজ রায় ও আরও অনেকে। পুলিশের ভয়ে গ্রামের এক একজনের বাড়িতে গোপন কংগ্রেস ক্যাম্প হত। যেমন ঘেসুয়া গ্রামে লক্ষ্মী জানার বাড়ি, আরামবাগে গোষ্ঠ বেড়ার বাড়ি, চুলোট গ্রামে একজনের বাড়িতে ক্যাম্প বসত। এ আন্দোলনে গ্রামের মেয়েদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বড়োডোঙ্গলের হরিনারায়ণ রায়ের মা জেলে গেছেন। এছাড়া মৃগেনবালা রায়, বরদাদেবী হাইত, শৈলবালা ঘোষ, লাঙলপাড়ার প্রখ্যাত কর্মী প্রাণকৃষ্ণ মিত্রের মা আইন অমান্য আন্দোলন ও রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা কর্মী।
১৯৩২ সালের আন্দোলন ছিল আইন অমান্য ছাড়াও চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ ও সেট্ল্মেন্ট বর্জন আন্দোলন। সেট্ল্মেন্ট বয়কট আন্দোলনটি এক বিশেষ রূপ নেয়। হিল সাহেব ছিলেন সেট্ল্মেন্ট অফিসার। তাঁর কড়া পুলিশি প্রহরাতেও কাজ এগোয় না। জমি মাপার জন্য ‘চেন’ ফেলা হয় আর স্বেচ্ছাসেবক ও গ্রামবাসীরা গিয়ে ‘চেন’ ধরে ফেলে। পুলিশ মারপিট করছে, গ্রেপ্তার করছে, সেট্ল্মেন্টের বয়কটের ফলে চাষের জমি জোর করে হস্তান্তর করলেও মানুষ দমেনি। খানাকুলের খাড়োল গ্রামে সব লোক গ্রাম ছেড়ে চলে যায় পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে।
আরামবাগের আন্দোলনের প্রসঙ্গে একজনের কথা বলা দরকার। তিনি হচ্ছেন লাঙ্গুলপাড়া গ্রামের প্রখ্যাত কর্মী প্রাণকৃষ্ণ মিত্র। ইনি ১৯৩২ সালে প্রকাশ্যে অস্ত্র আইন অমান্য করেন। তিনি, গান্ধিবাদী কংগ্রেস কর্মী, সরকারকে জানিয়ে ১৯৩০ সালে ২৬ জানুয়ারি বড়োডোঙ্গলের বাজারে বন্দুকের কার্তুজ বিক্রি করেন ও গ্রেফতার হন। এনার মা, ভাই সকলেই ১৯৩০ সালে জেলে যান।
আরামবাগের কৃষক সমিতির প্রসার বেশি না হলেও পূর্বাঞ্চলের পশ্চিমপাড়ার কাছাকাছি মরগোয়াল গ্রামে কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে স্থানীয় কিছু কর্মীর চেষ্টায়। যার মধ্যে একজন অসিতরঞ্জন দাশগুপ্ত। এঁরই চেষ্টায় হুগলি জেলা কৃষক সমিতি আরামবাগে প্রবেশ করে। ইনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।১০
আমরা আগেই বলেছি যে আরামবাগে ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলন শেষ পর্যন্ত জমিদারদের খাজনা বন্ধের আন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলনে আহ্বান জানান বিজয় মোদক। বড়োডোঙ্গল হাটতলা সমাবেশ থেকে যা ছড়িয়ে পড়ে গোঘাট, আরামবাগ, খানাকুল, পুড়শুড়া এমনকি বাঁকুড়া জেলার সংলগ্ন চড়ুইপাতিতে। শিহড় গ্রাম সহ ১৪৮টি গ্রামে। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষে আরামবাগের গ্রামাঞ্চলে রিলিফের কাজে যুক্ত হন বিজয় মোদক। এ কাজে তাঁর সাথে ছিলেন আইনজীবী ফকির চন্দ্র পাল যিনি গোঘাট থানার বালিদেওয়ানগঞ্জে রিলিফ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এছাড়া কাদড়া গ্রামের সুরেন্দ্র মণ্ডল, বেতবনী গ্রামের মনোরঞ্জন রায়ের সাহায্যে শ্যামবাজার, বদনগঞ্জ, ফুলুই গ্রামে রিলিফ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এসবের মধ্য দিয়ে কৃষকদের কাছে কৃষকসভার রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপিত হয়।১১ কৃষক সভার মোদ্দা কথাগুলি যেমন, জমিদারি প্রথার বিনা ক্ষতিপূরণে উচ্ছেদ, হাটের তোলা, আবওয়াব, বহিঃখাজনা প্রভৃতি বাজে আদায় বন্ধ, বেগার প্রথা, মহাজনি জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে যুক্ত হল সেচ, ফসলের দাম ইত্যাদি গ্রামাঞ্চলে কৃষকের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে।১২
দ্বারবাসিনীর গ্রামাঞ্চলে বেগার বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। তেভাগা আন্দোলন দেখা যায় চণ্ডীতলা থানার অন্তর্গত কৃষ্ণরামপুর, রমানাথপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। স্থানীয় কৃষককর্মীরা অংশগ্রহণ করেন, যেমন মহম্মদ সুকুর, গিয়াসুদ্দিন, বিজয় মালিক প্রভৃতি। কানাইডাঙ্গা অঞ্চলেও আন্দোলনের জের চলে দীর্ঘদিন। ১৯৪৭-এ সিঙ্গুরে জমিদার বিরোধী সম্মেলন হয় অজিত বসু, মনোরঞ্জন হাজরার নেতৃত্বে, মালঞ্চপাড়ার ক্ষেতমজুর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন পরিতোষ চট্টোপাধ্যায়। আরামবাগের তিরোল, বাতানল, মায়াপুর প্রভৃতি গ্রামে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।১৩
দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে আন্দোলনের ধরন ও প্রকৃতি বুঝতে। আরামবাগ থানার বাতানলের তেঁতুলতলায় কৃষক সমাবেশ। আত্মগোপন অবস্থায় বিজয় মোদক বক্তৃতা করবেন। পুলিশের চোখ এড়িয়ে বাতানলে উপস্থিত হলেও শেষ মুহূর্তে গোয়েন্দাদের নজরে পড়ে যান। বাতানলের দিকে এগিয়ে আসছে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। বর্গক্ষত্রিয় অধ্যুষিত গ্রাম রইতে চক। শংকর– সেই গ্রামেরই চার বছরের বাচ্চা। সে ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল পুলিশ আসছে। ভয়ভীতির বেড়া ভেঙে কৃষকেরা গড়ে তুলল প্রতিরোধের ব্যারিকেড,– বিজয় মোদককে গ্রেফতার করা যাবে না। পুলিশ কিছু হটল। বিজয় মোদক সভাতে বক্তৃতা করলেন।১৪
দ্বিতীয় ঘটনা আরামবাগ থানার মাঠরণবাগপুরের ঘটনা। এখানে তারাপদ রাউতের বাড়ির বাইরে এক কামড়া ছিটে বেড়ার একটি ঘর ছিল। বিজয় মোদক বেশিরভাগ সময় ঐ ঘর ব্যবহার করতেন। গ্রামের মাঠে ছিল আখ চাষের খেত। মুণ্ডেশ্বরী নদীর চরে ছিল ঘন কাশবন। অনেক সময় কয়েকটা লম্বা কাশ ঝাড়কে একত্রিত করে উপরের ডগাগুলিকে বেঁধে দিয়ে ঘর বানিয়ে শ্রী মোদক থাকতেন। সঙ্গী ছিল ঐ গ্রামেরই অমত্য মান্না বলে এক মাতাল খেতমজুর, যার বাস্তুভিটা থাকলেও ঘর ছিল না, আপনজনও কেউ ছিল না। এই অমত্য মান্নাই চাষিদের বাড়ি থেকে ভাত, গুড়, মুড়ি সংগ্রহ করে শ্রীমোদককে খাওয়াতেন। এ সময় গ্রামে প্রচার ছিল যে, উনি (শ্রীমোদক) খুব উচ্চশিক্ষিত মানুষ কিন্তু খুনের আসামি, নিজের স্ত্রীকে খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পরে হাটে শ্রীমোদক চোঙা ফুঁকে জনসভা করলে সবাই জানতে পারলে উনি কমিউনিস্ট নেতা– নাম বিজয় মোদক।১৫
বিজয় মোদক কেবল একা নন বহু তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী একাজে ব্রতী হন। যেমন মহীতোষ নন্দী। তাহলে এখন দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের বিরোধিতা স্তিমিত হয়ে গেলে একদল তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেন।১৬
আমাদের এক্ষেত্রে কৌতূহল, যে মানুষজন ওই তরুণ কমিউনিস্টদের রক্ষা করেছেন তারা কি প্রত্যেকেই মার্কসবাদে শিক্ষিত বা কমিউনিস্ট কর্মী ছিলেন বা জাতপাত, নিজ নিজে ধর্ম পালন করতেন না? অমত্যবাবুর মতো মানুষ বা শংকরের মতো বাচ্চা বা হাটতলার সাধারণ মানুষ জনের আচরণ অর্থনীতি বা শ্রেণি সম্প্রদায় দিয়ে বিচার করা যায় কিনা তা সন্দেহজনক। বরং স্বতঃস্ফূর্ততার প্রকাশ ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখানে প্রণিধানযোগ্য।
বলাগড়
“জমি চাষ করে কৃষক, কৃষিকাজ চালাতে হলে যে মূলধন চাই তা কৃষক যোগায়। লাঙ্গল কিনবার টাকা, বলদের খরচ, বীজের দাম এ সমস্ত খরচই কৃষক বহন করে। এ ছাড়া কায়িকশ্রম তো আছেই। জমিতে লাঙল দেওয়া থেকে আরম্ভ করে উৎপন্ন জিনিস বিক্রি করা পর্যন্ত সমস্ত দায়িত্ব কৃষকের, কিন্তু জমিদারী প্রথা অনুসারে জমির মালিক অলস জমিদার। জমিচাষে তার কোনই অবদান নেই। অথচ বছর বছর নির্দিষ্ট হাড়ে জমির খাজনা, তহরী, পার্ব্বনী, আবওয়াব প্রভৃতি আদায় করে জমিদার কৃষককে শোষণ করে। ভারতীয় সমাজের ধনোৎপাদন ক্ষেত্রে কৃষিকার্য একটি প্রধান অঙ্গ, সেই কৃষির বাহক এবং পরিপোষক কৃষক শ্রেণি, জমিদারের কাজ শুধু এই কৃষককে শোষণ করা।”১৭
তাহলে কৃষক কী চায়? স্বাভাবিকভাবেই জমিদারি প্রথার বিলোপ। কীভাবে? বিদ্রোহ করে! কারণ মুঘল যুগ থেকে প্রচলিত যে বাঙালিরা পোষ্য এবং যথাসময়ে খাজনা দেয়।১৮ এছাড়া ছিল ধর্মভয়। রাজাকে মান্য করতে মনু সেই কবে নির্দেশ দিয়েছেন।১৯ কৃষক সভা এই মান্যতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রয়াসী হয় হুগলি জেলার বলাগড় অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে। ১৮৭০ সালের আগে যুক্ত বাংলার গ্রামে কোনও ভূমিহীন কৃষক ছিল না বলে দাবি করেছেন হান্টার তাঁর মহাগ্রন্থে। অনেক গবেষক তা সমর্থনও করেছেন।২০ অল্পবিস্তর জমি সকল কৃষকেরই ছিল। কিন্তু ১৮৫৯ সালের রেন্ট অ্যাক্টের মাধ্যমে খাজনা বৃদ্ধির হাত থেকে স্থিতিশীল কৃষক রেহাই পেলেও অধস্তন প্রজা বিলির অধিকার দেওয়ায় ক্রমশ অধস্তন প্রজা ও ভাগচাষ বাড়তে থাকে। ১৮৭০ সাল থেকে উপর্যুপরি দুর্ভিক্ষ হওয়ায় অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষকেরা ক্রমশ ঋণগ্রস্ত হয়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ধনী কৃষক জমি কিনে জোতদারে পরিণত হতে থাকে। এ সময় থেকেই ভাগচাষি ও অধস্তন প্রজা বাড়তে থাকে। এছাড়া আর-একটি প্রথা চালু হয় এসময়, তা হল অভাবের সময়ে কৃষকদের ধান ধার দেওয়ার প্রথা।২১
পরিস্থিতি এতটাই সংকটময় হল যে ১৯২১ সালে প্রতি হাজার জন কৃষকের মধ্যে প্রায় ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল ২৯১ জন। আর ১৯৩১ সালে দেখা গেল প্রতি হাজার জন কৃষকের মধ্যে ভূমিহীন কৃষক ৪০৭ জন। কৃষিক্ষেত্রে লোকের চাপ অতিমাত্রায় বেশি হওয়ায় ভূমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে বিভক্ত হয়ে পড়তে লাগল।২২
এই পরিপ্রেক্ষিতে হুগলি সদর মহকুমা কৃষক সম্মেলনের ডাক দেওয়া হয়। ২৮শে জ্যৈষ্ঠ রবিবার ১৩৪০ সালে চুঁচুড়ার নিকটবর্তী কাশশেওড়া গ্রামে এ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। ডাক দেন আনন্দ পাল, অস্থায়ী সম্পাদক– অভ্যর্থনা সমিতি। ডাক দেওয়ার তারিখ হল ২৮শে বৈশাখ ১৯৪০ বঙ্গাব্দ।২৩
দামোদরের বন্যায় হুগলি জেলার বলাগড় থানার বহু গ্রাম প্লাবিত হয়। সাল ১৯৩৯। ত্রাণ ও রিলিফের কাজে বিজয় মোদক মহীতোষ নন্দী ও আর-একজনকে সঙ্গে নিয়ে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে বলাগড় থানার শ্রীকান্ত, কদমডাঙ্গা, নতুন বগা, পুরাতন বগা, ভগবতীতলা গ্রামে যান। বন্যা কবলিত গ্রামবাসীদের চরম অবস্থা দেখে ইউনিয়ন বোর্ডের কর ও খাজনা ছাড়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। নেতৃত্বে বিজয় মোদক। আন্দোলনকে প্রতিহত করতে চাইল পুলিশ প্রশাসন ও জমিদাররা। ফলে আন্দোলনটি গণ প্রতিরোধে পর্যবসিত হয় এমনই বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টির (সি পি আই এম) অভিমত।২৪
ট্যাক্স আদায়ের জন্য বলাগড় থানার আন্দোলনে যুক্ত গ্রামগুলিতে পুলিশি জুলুমের পাশাপাশি চলে দক্ষিণ গোপালপুরের কুখ্যাত জমিদার ও সেই সময়ের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট সুরেন ঘোষালের জোর জুলুম। তিনি ট্যাক্স আদায়ের নামে কৃষকের পাট ও অন্যান্য ফসল, ঘটিবাটি জুলুম করে নেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের সম্পত্তি ক্রোক করে নেওয়ায় আন্দোলনের মাত্রা তীব্রতম হয়ে ওঠে নতুন বগা, পুরাতন বগা, শ্রীকান্ত, ভগবতীতলা, কদমডাঙ্গা গ্রামগুলিতে। নতুন বগা গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ছানু মাঝি, দাশু ঘোষাল, পঞ্চু মণ্ডল, কিশোর দাস, মোহন দাস ও পলাই দাসের নেতৃত্বে কৃষকেরা। “হুগলি জেলা কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে যে গ্রামাঞ্চলে বলাগড়ে হয় সেই কৃষক সমিতির অধীনে সংঘটিত প্রথম আন্দোলন। এই আন্দোলন প্রায় সারা বলাগড়ে ছড়িয়ে পড়ে”— এমনই অভিমত বিজয় মোদকের। অকথ্য পুলিশি নির্যাতন সত্ত্বেও কৃষকের ক্রোক করা সম্পত্তি পুলিশবাহিনী গ্রামের বাইরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। আন্দোলনে গতি বাড়াতে শহর থেকে সুশীল বসু (আসল নাম অনাথ রায়)-কে নিয়োগ করে জেলা নেতৃত্ব। এ সময়ে নতুন বগা গ্রামের ছানু মাঝি, দাশু ঘোষাল, পঞ্চু মঙ্গলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হলেও অনেকে গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পাঁচটি গ্রামে সশস্ত্র পুলিশ পিকেট বসে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে। চিরুনি তল্লাশির পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের জেলা প্রশাসন বিজয় মোদক, মহীতোষ নন্দী, বিনোদ দাশ, সুশীতল রায়ের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রামের কৃষকরা কৃষক নেতাদের মাটির নীচে ঘর করে আত্মগোপনে সাহায্য করেন, দিনের পর দিন কাঠের টাইপে ছাপা পোস্টার আশেপাশের গাছে টাঙিয়ে দেওয়া হত। পরিতোষ চট্টোপাধ্যায় জমিদারের দালাল ও পুলিশের যোগসাজশে গ্রেফতার হলেও পরে ছাড়া পান। এসময় সংগঠক সুশীল বোসও গ্রেপ্তার হয়ে যান। দুলাল রায় (গায়ক), ভূপেন মিত্র (বিনোদ দাশ), প্রেমানন্দ দে (চুঁচুড়া), অবনী সিংহ (সোমড়া), ডা: নাঙ্কু বন্দোপাধ্যায়, তাঁর কম্পাউন্ডার সিদ্ধেশ্বর পাল, মশাড়ার জৈনুদ্দিন, সন্তোষ ঘোষ ও অমূল্য ঘোষ আন্দোলনের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেন বলাগড় থানার করিণ্যা, ড্যামরগাছা, হামজামপুর, সোমড়ার মশড়া, মুক্তারপুর জাগুলিয়া ও সিজা গ্রামে।২৫
১৯৩৭-৩৮ সালে জমিদার বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে বলাগড় থানার সোমড়া অঞ্চলের মশড়া গ্রামে। বলাগড়ের জমিদার শৈলেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সোমড়ার জমিদার সত্যপদ শীলের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও জমিদারি প্রথা বিলোপের স্বপক্ষে আন্দোলনে যুক্ত হন বামপন্থী কংগ্রেসি জৈনুদ্দিন, তাঁর ভাই বসিরুদ্দিন, অবনী সিংহ (সোমড়া), রাধানাথ মুস্তাফি (শ্রীপুর), উৎসব রাউত (গুপ্তিপাড়া), ইন্দু মাধব বন্দোপাধ্যায় (গুপ্তিপাড়া), নরেন্দ্র মৈত্র, অনিল বসু (চুঁচুড়ার কনকশালি), রতনলাল গাঙ্গুলী ও বিনোদ দাশ। বিনোদ দাশ সেসময় কংগ্রেসের মধ্যে ছিলেন।২৬ তেভাগার সময়ও স্থানীয় কৃষকরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
বিজয় মোদকের মতে, “১৯৪৬ সালে ‘তেভাগা’ আদায়ের আওয়াজ তোলা হয়। …আমাদের জেলা বড়ো জমিদারদের জায়গা না হলেও শ্রীকান্ত গ্রামে তেভাগা আন্দোলন করার মধ্য দিয়ে আমাদের ঘাঁটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।”২৭
হুগলি জেলার সদর মহকুমা শাসক জনাব এ কিউ এম মহীউদ্দীন সাহেব সরকারকে তেভাগা আন্দোলন সংক্রান্ত রিপোর্টে জানাচ্ছেন, “বলাগড় থানার শ্রীকান্ত গ্রামে ভাগচাষী কৃষকদের, বিশেষত রাউথ ও রামানীচে (তপশিলভুক্ত এই এলাকায় অধিকাংশ কৃষকের পদবি)-র মধ্যে কমিউনিস্ট নেতা বিজয় মোদক ও ভূপেন বসু ভাগ জমির ফসলের এক তৃতীয়াংশের বেশি ভাগ জমিদারদের না দেবার কথা বলে প্রচার চালাচ্ছেন। বলাগড়ের গোপালপুর হাটে ১৯৪৭ সালের ৫ জানুয়ারি স্থানীয় জমিদারের কয়েকজন দারোয়ানকে মারধর করা হয়। এতে প্রায় কুড়ি জন ব্যক্তি জড়িত ছিল। যাইহোক, এই বিশেষ এলাকাতেই আন্দোলন গণ্ডিবদ্ধ আছে। অন্যত্র কোনো সাধারণ বা স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ দেখা যায়নি।”২৮
বিষয়টি এত সরল ছিল না। বিনোদ দাশের লেখায় যে চিত্রটি ফুটে ওঠে তা হল, “শ্রীকান্ত, কদমডাঙ্গা, ভগবতীতলা, ঝোড়ো প্রভৃতি গ্রামে তেভাগা ফসলের দাবিতে লড়াই সংগঠিত করেছিলাম। ডুমুরদহ গ্রামে উত্তমানন্দ গিরি মহারাজের (উত্তমানন্দ আশ্রম) ৩০০ বিঘা জমির ধান, তৎকালে দুর্দান্ত জমিদারের ২৫০ বিঘা জমির ফসল আমরা নিজ খামারে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। প্রায় তিন শতাধিক পরিবার তিন ভাগ ফসলের দাবির লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছিল। এ লড়াই চলাকালীন গোপালপুর গ্রামের জমিদার সুরেন ঘোষাল, ঝোড়ো গ্রামের ভাগচাষির নিজ খামারে তোলা ধান লাঠিয়াল সহ গোমস্তা-ম্যানেজার ছিনিয়ে নিতে এসে চাষিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালান। সে সময় বিজয় মোদক, আমি, অনাথ রায়, গোপাল রাউৎ, নকুল রাউৎ, ভদ্রেশ্বর রাউৎ, কালীপদ রাউৎ, গয়ারাম রমানি, লালচাঁদ রমানি প্রভৃতিরা উপস্থিত ছিলাম। জমিদারের প্রেরিত লাঠিয়াল ও দারোয়ানদের প্রচণ্ড মার দিয়ে খামারের ধান রক্ষা করা হয়। তেভাগা দাবির আন্দোলনের ঢেউ পাশের এলাকা মহীপালপুর, ভালকি গ্রামে প্রসারিত হয়। উত্তমা আশ্রমের সাধু ও জমিদারের পরামর্শে কৃষকের নিজ খামারে গাদা করা ধান পুলিশ ‘সিজ’ করে। স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। দীর্ঘকাল মামলা চলার পর ভদ্রেশ্বর রাউৎ ও কালীপদ রাউতের কয়েক মাস জেল হয়।২৯ পরবর্তীকালে আন্দোলন অবদমিত হয়।
বড়া কমলাপুর
বাংলার কৃষক কোনোকালেই ভালো ছিল না বঙ্কিমচন্দ্রোপাধ্যায়ের লেখাতেই তা পাওয়া যায়৩০। ধান চালের দেশ পূর্ববঙ্গের খুলনা জেলাতেই ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুতে একমন চালের দাম ছিল ১০.৩৭ পয়সা কিন্তু মাসের শেষে সেই একমন চালের দাম হয়ে দাঁড়াল তিরিশ টাকা। এই আকাল নিয়ে আসে মন্বন্তর ও মহামারি।৩১ হুগলি জেলা চিরকালই খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি জেলা, বছরে প্রায় ৫০ লাখ মন চাল বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। ১৯৪৩ সালের জুন-জুলাই মাসের বন্যা পঞ্চাশ হাজার মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। আমন ধানের ফলন ভালো হলেও রোগাক্রান্ত মানুষ তা ঘরে তুলতে পারেনি। চোরাবাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০/৫০ টাকা মন দরে। কমিউনিস্টরা জেলার বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা খোলে। এমনকি ধর্মশালা তৈরি হয় ঝাঁকারী গ্রামে। ঘনশ্যামপুরে জনৈক ধনী কৃষক মজুত ২০০ মন ধান বিক্রির চেষ্টা করলে গ্রামবাসীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কমিউনিস্টরা স্থির করে ৫০ মন ধান ‘বাড়ি’ (বীজতোলা) স্বরূপ ধার দেওয়া হবে আর বাকি ধান ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া হবে। এতে উৎসাহিত হয়ে অপূর্বপুরে ৯৫ মন ধান, তেলিপুকুরে ৩০০ মন ধান, মামুদপুরে ৩০ মন ধান ও বলরামহাটিতে ৫০ মন ধান বাড়ি হিসেবে আদায় হয়।৩২
প্রশ্ন এক্ষেত্রে আসে প্রত্যন্ত গ্রাম বড়া কমলাপুরে কৃষক সভার বনিয়াদ এত মজবুত কীভাবে হল? দেখা যাচ্ছে প্রাদেশিক কৃষক সভার দ্বিতীয় সম্মেলন হয় ২-৩ ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালে হুগলি জেলার বড়ায়। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন আরম্ভ হওয়ার সময় থেকে জেলের বাইরে ব্যাপক আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বন্দিদের মুক্তি দিলে তাঁদের মধ্যে গ্রামে বসবাসকারী অনেকে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩৯ সালের গয়াতে সারা ভারত কৃষক সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়, “কৃষক সংগঠন জোরের সহিত ঘোষণা করছে যে সময় এসে গেছে … যাতে পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা ও ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা যায় এবং তাই থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-মজুর রাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।” এ চিন্তা বাংলার কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।৩৩ বড়া অঞ্চলও তার ব্যতিক্রম নয়।
স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা ঘোষণা হলে কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনি ঘোষণা করলে পার্টির সদস্যরা আত্মগোপন করতে থাকেন। বড়া কমলাপুরেও কমল চ্যাটার্জি আত্মগোপন করে থাকেন দেড় বছর।৩৪ বড়া তখন জমিদারবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার। নেতৃত্বে অজিত বসু।৩৫
এখন, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরা যাক।
আমাদের বাড়িতে পার্টির ক্যাম্প ছিল। অজিত বসু থাকতেন। ফণী সেন তখন ডাকসাইটে সি আই ডি পুলিশ অফিসার। অজিতবাবু তাকে একদিন চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে আসেন ক্যাম্পে। আবার চোখ বেঁধে ফিরিয়ে দিয়ে আসেন পুলিশ ক্যাম্পে (দ্বিজেন্দ্রনাথ সাঁতরা)।
তে-ভাগা আন্দোলনে আমরা successful হতে পারিনি। … আমাদের পুরো এলাকা তো পান চাষ এলাকা। পানচাষিই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্গা চাষ এখানে খুবই কম। …আমাদের এলাকার অপরেশ মণ্ডল (আধা জোতদার), সূর্যকান্ত মণ্ডল (জোতদার), বালটিপের জমিদার নীলমণি দাস তে-ভাগার দাবি মেনে নিয়েছিল (গুইরাম ধারা)।
জমিদারি শোষণ ও অত্যাচারে জর্জরিত ছিল এই অঞ্চলের গরিব কৃষক সমাজ। … বড়ার পার্শ্ববর্তী গ্রাম যেমন কালিয়ারা, বালদ্বীপ, খোসালপুর, রানাগাছা, দোগাছা, ডুবীর প্রভৃতি গ্রামে কৃষকদের জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত করেছিলাম। …নেতৃত্বে ছিলেন অজিত বসু ও অপরেশ মণ্ডল। … জমিদাররা আমাদের উপর খুন, ডাকাতি সহ বহু মিথ্যা মামলা দায়ের করে আমাদের বিরুদ্ধে খুন ডাকাতি সহ ৮টি মিথ্যা মামলা রুজু করে। … আমাদের এখানের জোতদার বিষ্ণু সরখেল ও অশ্বিনী সরখেলের জমিতে তে-ভাগা করতে গেলাম। …কিন্তু ওরা দাবি না মেনে আক্রমণ করল। … গ্রাম শুদ্ধ কৃষকরা দলে দলে আসতে লাগল, … ব্যাপক কৃষক জমায়েত হতে দেখে, জোতদাররা ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করল। … জমিদাররা দরবার করে অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্ল সেনের কাছে। … পুলিশ ক্যাম্প করে কয়েক হাজার পুলিশ বড়া কমলাপুরে মোতায়েন করে। এই পুলিশি ব্যবস্থা সরেজমিন দেখতে তৎকালীন পুলিশ মন্ত্রী কিরণ শংকর রায় নিজে এসেছিলেন (শিরীষ দাস)।
… দেখুন তেভাগা এ অঞ্চলে চলে না। পান চাষ এলাকা, বর্গাদার নেই বললেই চলে। এখানের কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে, জমিদারের উচ্ছেদ। চাষির হাতে জমি, বেগার প্রথার বিরুদ্ধে। … এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন অজিত বসু। আমার মামা। বেগার প্রথার বিরুদ্ধে, জমির দাদন, খাজনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম বড়া কমলাপুরে। …কৃষক আন্দোলন ভাঙতে প্রায় ৭ হাজার পুলিশ এল। … পুলিশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারফিউ জারি করত। কোনও সময়ে টানা তিন দিন পর্যন্ত কারফিউ ছিল। …১২ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের সারেন্ডার করতে হুমকি দিয়েছিল পুলিশ। …আমরা প্রায় ৭ বৎসর লড়াই করেছিলাম। …এই আন্দোলন ভাঙবার জন্য দীর্ঘকাল আমাদের জেলে আটক রাখা হয়। …পার্টি বেআইনি থাকাকালীন সর্বপ্রথম বড়া-কমলাপুরের নারীরা বন্দি মুক্তি ও পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে মিছিল করে কলকাতায় মহাকরণ অভিযান করে। (বিশ্বনাথ রায় ডাকনাম ফেলুবাবু, অজিত বসুর ভাগ্নে, জমিদার বাড়ির ছেলে।)
…তখন কৃষক সমাজের অবস্থা ছিল “নাও হীন নৌকা”, ১৯৩৮ সালে ‘বড়া’-র কৃষকসভার ২য় সম্মেলনে খেত মজুর স্তরে আন্দোলন শুরু করা হবে এবং তা হবে ফসলের ৬০/৪০ ভাগ হারের। খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমরেড বঙ্কিম মুখার্জিকে, তিনি সেই খসড়া নিয়ে কমরেড লেলিনের সাথে আলোচনা করেন, এবং আমাদের ল্যান্ড অ্যান্ড সয়েল অনুসারে কমরেড লেলিন তা অনুমোদন করেন। (!) … শেষের দিকে আর এই আন্দোলনে ভাগের স্লোগান ছিল না। আন্দোলন ক্ষমতামুখী হয়ে ওঠে… এই আন্দোলনকে আর বিশেষ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। — ঐসব অঞ্চলে মাস কমিউনিকেশন করে ওঠা হয়নি। (মনোরঞ্জন হাজরা, নেতৃত্বরূপে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।)৩৬
সি পি আই-এর মন্ত্র নিয়ে আন্দোলন করেছি, জমিদারের খাজনা দেব না। পুলিশ বড়ায় যখন এসেছে মেয়েরা শাঁখ বাজিয়ে দিয়েছে। …আন্দোলন যখন শেষ হয় জ্যোতি বাবু দেখতে এসেছিল। …পুলিশ আসছিল, ইট পাটকেল ছুড়ছিল। কার্তিক ও গুঁইরামকে ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে কৃত্তিবাস গাত্রর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। … ভাগচাষ এখানে কম ছিল। জেল এখানকার অধিকাংশ মানুষই খেটেছে। গোপাল দাস, ফেলু (অজিত বাবুর ভাগ্নে), আশু কাঁড়ার, ধনঞ্জয় দাস নেতৃত্ব দিত; অরুণ সোম, ভীম দাসও ছিল। গোপী বসু জমিদার ছিল, কংগ্রেস করত। বাড়িতে থাকতে পারতাম না (কৃষ্ণচন্দ্র শীট)।
… জমিদার বাড়ির ছেলে অজিত বোস এখানকার প্রধান নেতা। …কৃষকরা আওয়াজ তুলল বোস জমিদারদের খাজনা দেব না। জমিদাররা বড়ার বাজার থেকে তোলা আদায় করত। …সবাই আত্মগোপন করে আছে। …এমন সময় পুলিশ কমলাপুর গ্রাম থেকে শত্রুঘ্ন গড়ানকে অতর্কিতে গ্রেফতার করে। …হঠাৎ কার্তিক ও গুঁইরাম শত্রুঘ্নকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চলে। কার্তিক ও গুঁইরাম মারা যায় (কমল চ্যাটার্জী)।৩৭
জমিদার ছিলেন বিকাশ বোস, কেষ্ট বোস, গোপী বোস, নৃপেন বোস। এদেরই সাথে ঝামেলা হয়। বড়া রাসতলাতে রাসপুজো নিয়ে খুব মেলা হত। ঠাকুর আনা থেকে সব কাজ করত বাগদিরা কিন্তু তাদের ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ নিষেধ ছিল। জমিদার আগে বসবে পরে বাগদিরা। ভূষণ বোস প্রথম আপত্তি করে। পরে অজিত বোস। ভূষণ বাবুর উপর আক্রমণ হলে বিশাল আকারের আন্দোলন হয়। এরপরই পুলিশ আসে গ্রামে। কেউ বিয়ে করে এলে গাড়ি চেপে বড়-বৌ যেতে পারবে না, হেঁটে যেতে হবে। রাসমঞ্চের কাছে জমি নিয়েই ঝামেলা হয়। অজিতবাবুর বাড়িতে দুর্গোৎসব ও সরস্বতী পুজো নিয়ে উন্মাদনা ছিল। … মহিলাদের মধ্যে ছিলেন যোগমায়া কোলে (পরিচিত নাম যোগানি, অনেকে নগনিদিও বলে থাকেন)। স্বামী ফকির কোলে। রানি ছিল ঝাকারীর নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতৃত্বে। জোগানির বাড়িতে অজিত বাবু লুকিয়ে থাকতেন। …মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস তখন কম ছিল। এদের মধ্যে ছিলেন হামিদ মোল্লা (নিজামপুর কমলাপুর), এরফান মোল্লা (ঠাকুরহাট)। যখন মারা যান কার্তিক ধাড়ার বয়স ছিল ৩৬ বছর। বাবার নাম উপেন্দ্রনাথ ধাড়া। গুঁইরাম মণ্ডলের বয়স ছিল ৬৫ বছর। বাবার নাম সন্ন্যাসী মণ্ডল। গুলি চলে বেলা ৩.৩০ মিনিট নাগাদ। উকিল ছিলেন চিত্রপ্রিয় বাবু, মুহুরি জলধর দাস। …কিরণশঙ্কর রায়কে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজিত বোসের কাছে আলোচনার জন্য। বিপত্তি ঘটে ওনার ফেরবার সময়। ভুল সংকেত দেওয়া হয় যার অর্থ পুলিশ গ্রামবাসীদের আক্রমণ করেছে। দামামা, শাঁখ বেজে ওঠে। ঘেরাও আরম্ভ হয়। রোডগুলো ব্লক করে দেওয়া হয়। পুলিশের ওপর আক্রমণ চলে। গুলি চলে… (শ্যামাপদ দাস, সাক্ষাৎকারের তারিখ ২৩/০৮/২০১৫)।
রায়ত চাষি হব এ ভাবনা ছিল। স্বত্ব দিতে হবে। কিন্তু জমি দখল পর্যায়ে যায়নি। যে যেটা দখল করছে তার ওপর রায়ত কর। … কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বাস করত না কৃষক বিপ্লব করবে, শ্রমিক শ্রেণি করবে। … কমলাপুরের নিতাই মণ্ডল, সতীশ মণ্ডলদের প্রচুর জমি ছিল কিন্তু আমাদের পক্ষে ছিল। হরিনাম করতেন, মন্দির করেছেন। … বিভূতি সোম, ভীম দাস রামচন্দ্রপুরের সুবল কোলে দিনরাত কালীর গান গাইছে আবার আন্দোলনে আছে (অরুণ সোম, সাক্ষাৎকারের তারিখ ০৫/০৯/২০১৫)।
অজিত বসুর বাঁ কান কাটা ছিল। ব্রিটিশদের কারণে হতে পারে। কমিউনিস্ট পার্টিতে আসেন ১৮২৮-২৯ সালে। ১৯৩৪ সালে পার্টি মেম্বার। এম এ পাস করেন জেলে থেকেই। ১৯৫২-৫৭ এম এল এ। …অজিত বসুর জ্ঞাতির মধ্যে মিহির বোস বিপক্ষে ছিলেন (অশোক বসু বা পাখি বাবু, ইনি অজিত বাবুর ভাই অরুণ বোসের পুত্র, সাক্ষাৎকারের তারিখ ২১/০২/২০২৪)।
বড়া কমলাপুরের হত্যার ঘটনা ডঃ তন্ময় কুমার ঘোষ যেমন লিখেছেন, “সরকার … জোতদার কৃত্তিবাসের স্বার্থরক্ষার্থে তার বাড়িতে সশস্ত্র পুলিশ পিকেট বসায়। …১৯৪৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলায় শত্রুঘ্ন, যুপল ধারা, পঞ্চু ধাড়া ও গোপাল দাসকে যখন গ্রেফতার করে পশ্চিমপাড়ার কাছে এল তখন নারায়ণ মণ্ডল ঢাক বাজিয়ে এ খবর গ্রামবাসীদের জানাতে লাগল। … কৃষক পুরুষ ও মহিলারা দাবি জানাতে থাকে ওদের ছেড়ে দেওয়া হোক। পুলিশ এই দাবিতে কোনও কর্ণপাত না করে ওই চারজনকে টেনে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে যখন নিয়ে যাচ্ছে সেই সময় কার্তিক ও গুঁইরাম বন্দিদের ছিনিয়ে নিতে গেলে জমি পুলিশের বন্দুকের গুলি কার্তিক ও গুইরামের বুক ভেদ করে দেয়। … মনোরঞ্জন হাজরা রক্তাক্ত বস্ত্র খন্ড তুলে ধরে বলেন, “এই আমাদের রক্তপতাকা এর সম্মান আমাদের যে কোনো মূল্যে রাখতে হবে।”৩৮
বড়া কমলাপুর বিখ্যাত হয়ে আছে সাহিত্য জগতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে। ‘হারাণের নাতজামাই’ ও ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’-র লেখক স্বয়ং এসেছিলেন বড়া কমলাপুরে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির উৎস সন্ধানে।
এ প্রসঙ্গে কমল চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৪৮-এর গোড়ার দিকের কথা। তখন বেলা ১০-১১টা। কমলাপুরে একটা বাড়িতে বসে ছিলেন কমলবাবু ও ফেলুবাবু (বিশ্বনাথ রায়)। একটি কৃষক খবর যুবক খবর দিল, পাশের গ্রাম চক থেকে কমলাপুর আসার পথে এক ভদ্রলোককে এখানকার ছেলেরা আটকে রেখেছে। তিনি কমলাপুরে আসতে চাইছেন। তিনি দিয়াড়া স্টেশনে নেমেছেন, তারপর হেঁটে চক পর্যন্ত এসেছেন। নাম বলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কমলবাবু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন। যুবকটিকে বলা হল তাঁকে আনতে। তিনি বললেন যে, বড়া কমলাপুরের কৃষকদের ওপর পুলিশের অত্যাচার এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের খবর তিনি জানেন। তিনি স্বচক্ষে সেটা দেখবার ও বুঝবার জন্য এসেছেন। তিনি শহিদদের হত্যাস্থল দেখেন, বহরমপুর, কমলাপুর, চক, পহলামপুর বড়ার সকল কর্মী ও নগনি দিদি ও যে মেয়েরা গোপন সভায় মানুষগুলিকে রক্ষা করেছেন, শিলাকে (শেফালী নন্দী) রক্ষা করেছেন তাঁদের সাথে তিনি দেখা করেন। প্রথম দিন তিনি রাত্রি কাটান কমলাপুর উত্তরপাড়ার একটি বাড়িতে, পরের দিন সকাল দুপুর ঘুরে দিয়াড়া স্টেশন থেকে হাওড়াগামী ট্রেন ধরেন।
এরপর এক চিত্রশিল্পীর কথা। কমল বাবু ও ফেলুবাবু সকালে কমলাপুরে সুবল সাঁতরার বাড়িতে বসে আছেন। শিরীষ (ওখানকার কর্মী) এসে খবর দিল যে দুজন মহিলা দিয়াড়া স্টেশনে নেমে কমলাপুরে এসেছেন। এখানকার কোনও নেতার সঙ্গে দেখা করবেন। উপেন সাঁতরার বাড়িতে তাঁদেরকে বসানো হয়। তিনি বলেন যে তাঁর নাম রেবা দাশগুপ্ত, বাড়ি কলকাতায় এবং তিনি একজন চিত্রকর। পরে জানা যায় তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির মেয়ে। তিনি বলেন যে, তিনি এসেছেন সংগ্রামী পুরুষ ও মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করতে, তাদের সংগ্রামী জীবনকে জানতে। তিনি তাঁর ছবির মধ্যে এদের ফুটিয়ে তুলতে চান। নগনি দিদি ও ক-জন এসে দেখা করেন ও এও বলেন যে ক-টা মানুষ পুলিশের দালালি করছিল তাদের গ্রাম থেকে তাড়ানো হয়েছে। এমনকি ডাক্তার দেবেন চট্টোপাধ্যায়কেও। তিনি দ্রুত রেখাচিত্র নেন বসে থাকা মেয়েদের। আলাপ করেন গ্রামের সবাইয়ের সাথে। দুদিন বড়া কমলাপুরে থাকার পর তাঁদেরকে পূবদিকের জলা ও মাঠ পেরিয়ে শেওড়াফুলি স্টেশনে তুলে দেওয়া হয় কারণ দিয়ারা স্টেশনে পুলিশ বসানো ছিল। রেবা দাশগুপ্ত বিয়ে করেন সোমনাথ হোরকে। থাকতেন শান্তিনিকেতনে। পরবর্তীকালে কমলবাবু চিঠি লিখে তাঁর কাছ থেকে লেখা ও ছবি চাইলে তিনি বলেন যে, তিনি অসুস্থ আর রেখাচিত্রগুলি কোথায় আছে তিনি মনে করতে পারছেন না।৩৯
এরপর আমরা হুগলি জেলার ডুবির ভেড়ি অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের কথা বলব।
ডুবির ভেড়ি
জমি কার? জমিতে উৎপন্ন ফসল কার,– এ বিষয়ে আলোচনা চলে আসছে বহুকাল থেকে,– প্রমথবাবুর লেখাতেও তার স্পষ্ট অভিঘাত পাওয়া যায়।৪০ আর জমিদারদের অত্যাচার এত কুখ্যাত ছিল যে বাংলা সাহিত্যের আনাচে-কানাচে বহু নিদর্শন পাওয়া যায়।৪১ হুগলি জেলার ডুবির ভেড়ি অঞ্চলও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
ডুবির ভেড়ি অঞ্চলে তরুণ কমিউনিস্ট কর্মীদের সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলে ১৯৩৭ সাল থেকে। ছাত্র ফেডারেশনের দল সেখানে বয়স্ক নিরক্ষরদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়ে ছাড়াও কৃষক জীবনের সমস্যা ও কৃষক সংগ্রামের ছবি ও লেখা পোস্টার সহ গ্রামে গ্রামে কৃষক সাধারণের কাছে প্রচার করতে থাকে।৪২
হুগলি জেলার সদর ও শ্রীরামপুর মহকুমার সীমান্ত চিহ্নিত ঘিয়া, কুন্তী ও সরস্বতী নদী বেষ্টিত গ্রাম ডুবির ভেড়িতে সামন্তবাদী শোষণের তীব্র রূপ দেখা যায়। জমিদারি ব্যবস্থায় যারা খাজনার বিনিময় কৃষককে জমির পাট্টা দিতেন আর তার বিনিময়ে কৃষকের কাছ থেকে কবুলিয়াত লিখিয়ে নিতেন। এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন— দীঘাপতিয়ার মহারাজা ও নাড়াজোলের মহারাজার এস্টেট, মানকুন্ডুর খাঁবাবুদের, উত্তরপাড়ার তারক মুখোপাধ্যায়, হাট গোলার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঁশবেড়িয়ার কুমার মনীন্দ্র দেব রায়, কলকাতার পরেশনাথ ঘোষ প্রমুখ। এঁরা মোটা টাকার বিনিময়ে সমগ্র জমিদারির একটা অংশ কয়েকজন মধ্যস্বত্বভোগীকে পত্তনি দিতেন; এরা আবার কয়েকজনকে দর-পত্তনিদার হিসেবে ইজারা দিতেন। এদের সাথে ছিল তহশিল আদায়ের জন্য নায়েব, গোমস্তার দল, লাঠিয়াল পাইক ও বরকন্দাজ। অর্থাৎ কৃষকের মাথার উপরে ৫-৬ জন পরগাছা বিনা পরিশ্রমে বিলাসব্যসনে দিন যাপন করত ব্রিটিশ সরকারকে নামমাত্র কর প্রদানের মাধ্যমে।
১৯৩৯ সালে এ অঞ্চলে বন্যা হয়। সে সময় সাধারণ মানুষ সাহায্য করলেও জমিদারদের আদায় উশুল কমেনি। খাজনা অনাদায়ে উচ্ছেদের কবুলিয়তে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে, গোমস্তারূপী মহাজন ২ বস্তা ধান কর্জ দিয়ে নিরক্ষর চাষির ছাপ নিয়ে সম্পত্তি উদরস্থ করেছে। খোসলাপুরের শ্রীলক্ষ্মণ মালিকের অনুপস্থিতিতে তার সদ্য প্রসূতি স্ত্রীকে তার ঘর থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে, বাস্তু থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ সময় ১৯৪০ সাল নাগাদ আওয়াজ ওঠে আদায় উশুল বন্ধ করার, বাঁধ সংস্কারের জন্য বাঁধে স্রুইস গেট বসানোর, সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি কৃষিঋণের ও রিলিফের। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন গ্রামে যেমন চন্দননগরের বেড়াবেড়ি, মহীষটীকরী, মথুরকুড়, ব্যাজরা, বকুবপুর, পাউনান; সিঙ্গুরের আনন্দনগর, হাবাসপোতাতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। দোগাছিয়ার প্যাঁচাটির মাঠে সম্মেলন হয়। নেতৃত্বে ছিলেন কালীচরণ ঘোষ, সন্তোষ ভড়, সুশীতল রায়চৌধুরী, তিনকড়ি মুখোপাধ্যায়, স্মৃতিশ বন্দোপাধ্যায়, পাঁচু গোপাল ভাদুড়ী, বিজয় মোদক, ভবানী মুখোপাধ্যায়, তুষার চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ ঘোষ আর এর সাথে ভেড়ি অঞ্চলের উমাচরণ পাল, সুধন্য ধাড়া, নীলমণি দাস, গোপাল দাস ও অপরেশ দাস মণ্ডল। অপরেশ বাবু জমিদারের সন্তান। এছাড়া ছিলেন গোপাল দাস।
১৯৪৮ সালের পর থেকে তেভাগার দাবি সোচ্চার হল। তেভাগার ব্যাখ্যা হল ১ ভাগ জমির জন্য, লাঙল বীজ সারের জন্য ১ ভাগ আর মেহনত দিয়ে যে চাষ করবে তার ১ ভাগ। দখলে রেখে চাষ করো, নিজ খামারে ধান তোলো আওয়াজের সাথে ‘খেত মজুরদের আড়াই টাকা মজুরি দিতে হবে’— এমন দাবিও ওঠে।
ডুবির, কচুয়া, উকলীগ্রাম, বালীদ্বীপ, মহিষ নগর গ্রামে শুরু হয় ধান কাটার আন্দোলন। শুরু হলে কৃষকেরা ধান কেটে নিয়ে নিজে খামারে তোলা শুরু করে। রাশু ময়রার জমিতে তেভাগা শুরু করলে জমিদাররা ভয় পেয়ে কৃষকসভা চৌকিদার-দফাদারের দল বন্দুক নিয়ে ঘিরে ধরলে তিন চারখানা গ্রামের লোক তাদের বন্দুক কেড়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলে ও তিনজনকে বেঁধে ফেলে। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ ঐ তিনজনের বাঁধন খুলে দেয়। জনতা আওয়াজ তোলে ‘দালালকো হালাল করো’। জমিদার ও তার পক্ষের লোকেরা ছিল অশ্বিনী সরখেল, বিষ্টু সরখেল, বিজয়চন্দ্র বক্সী, বেণীমাধব মাইতি, ভূপতিচরণ মান্না, শরৎচন্দ্র ধাড়া, গৌড়চন্দ্র পাখিরা ও ভোলা পাখিরা।
এর মধ্যে একদিন জমিদার বিষ্ণু সরখেল অভিমন্যু ভৌমিকদের (শহিদ পাঁচুবালা ভৌমিকের স্বামী) কাছে এসে তাঁর বাড়ি যেতে বললে অভিমন্যুবাবু, গোপাল দাস, অজিত দাশ ও শিরীষ দাস বিষ্ণুবাবুর বাড়ি যান। তিনি বন্দুক বের করে গুলি করার উপক্রম করলে অভিমন্যুবাবু হাত মুচড়ে ধরেন ও শিরীষবাবু বন্দুকের নল ভেঙে দেন। পরে বিষ্ণু বাবুকে কৃষক সভার অফিসে নিয়ে এলে তিনি কান্নাকাটি করতে থাকেন ও তেভাগার দাবি মেনে নেন। তাঁকে ছেড়ে দিলে তিনি থানায় গিয়ে রিপোর্ট করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল পুলিশ বাহিনী চলে আসে।
পরদিন অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার অন্ধকারে পশ্চিমপাড়া দিয়ে ডুবির ভেড়ি গ্রামে জোতদাররা সশস্ত্র পুলিশবাহিনী নিয়ে ঢোকে। গ্রামের মহিলারা শঙ্খধ্বনি শুরু করে দেন। পুলিশ বীরেন্দ্রনগর স্কুলে ক্যাম্প করে বসে থাকে। সশস্ত্র পুলিশের রাস্তা আটকে ব্যারিকেড তৈরি করে ডুবি, রানাগাছা, কচুয়া ও উকলী গ্রামের মহিলারা। পিছনে অন্য গ্রামের মহিলা ও পুরুষেরা। আধঘণ্টা চেষ্টা সত্ত্বেও চন্দননগরের এক পুলিশ কর্তা ব্যারিকেড ভাঙতে অপারগ হলে ছলনার আশ্রয় নিয়ে মাতৃসুলভ সৎ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পিপাসার ভান করে জল চাইল। সরল বিশ্বাসে মায়ের মন জল আনতে যাবার জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পিছু হটতেই বন্দুকের নল সোজা করে সাথে সাথে সময় নষ্ট না করে গুলি চালিয়ে দেয় পুলিশ। ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান পাঁচুবালা ভৌমিক, মুক্তকেশী মাঝি ও দাসীবালা মাল। পাঁচুবালার পেট বেয়নেট দিয়ে চেরা ছিল। চণ্ডীবালা পাখিরা, পুষ্পবালা মাঝি তখনও জীবিত। এদের দুজনকেই বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। বাকি তিনটি মৃতদেহ যাতে পুলিশ না নিতে পারে সেজন্য বস্তা আর বাঁশের তৈরি স্ট্রেচার করে মৃতদেহগুলি ‘সোজ্জ্বল’ শ্মশানের অপর পারে বালিটীপায় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি সারারাত মৃতদেহগুলিকে পাহারা দিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি ‘সোজ্জ্বল’ শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। চণ্ডীবালা দেবী ১০-১২ দিন পর চুঁচুড়া হাসপাতালে মারা যান। পুষ্প বালাও মারা যান। অনেকে বলেন এঁদের সাথে মারা যান রাজকৃষ্ণের মা ও ভদ্রেশ্বর সামন্তের মা। এসময়ের মহিলা নেতৃবৃন্দ হলেন সন্ধ্যা চ্যাটার্জি, আরতি চ্যাট্যার্জী, শেফালী নন্দী, পুষ্প ঘোষ, দীপালি গাঙ্গুলী প্রমুখ।৪৩
ডুবির ভেড়ির সংগ্রাম নিয়ে বই লিখেছেন সমরেশ বসু ‘বাঘিনী’, যা পরে চলচ্চিত্রায়িত হয়। পূর্ণেন্দু পত্রী ডুবির ভেড়িতে গেছেন ও সেখানকার লোককবি আশু ভৌমিকের উপর কবিতা লিখেছেন।৪৪ আশু ভৌমিকের গান কয়েকটি সংগ্রহ করেন অভিমন্যু ভৌমিক।
নটে গাছ মুড়োনোর আগে
হুগলি জেলার তেভাগার সময়ে কৃষক আন্দোলনের উপর লিখতে গিয়ে কয়েকটি জায়গার আন্দোলনের কথা তুলে ধরার সাথে সাথে আগ্রহী পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এ এক অসম্পূর্ণ কথা। বেশ কিছু প্রশ্ন ঘটনাবলির পাশাপাশি পাঠকের মনে জন্ম নেবে এটা আশ্চর্য নয়। অনেক প্রশ্নের কোনো জবাব পাইনি। তবুও প্রশ্নগুলি ফুরিয়ে যায়নি বলে আমার ধারণা। আপনারা বুঝতে পারছেন যে রোদে জলে ভিজে যে ফসল ফলাচ্ছে যত অভিঘাত তার উপরেই নেমে আসছে।৪৫ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কথা উঠেছিল কি? যদি ওঠে তাহলে তার পরিণতি কী হল?— এ প্রশ্ন প্রবন্ধের আনাচেকানাচে-তে আছে। প্রশ্ন ওঠা উচিত সশস্ত্র পুলিশের সামনে নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের এগিয়ে দেওয়া কী উচিত হয়েছে? যেখানে বন্দুক পেলে কৃষক ভেঙে ফেলে, ব্যবহার করতে জানে না। আন্দোলনকারী কৃষক শ্রেণিসচেতন ছিল? খেতমজুররা কেন ভাগচাষিদের সাথে লড়বে যখন তাদের কোনো স্বার্থ ছিল না? ধর্ম মানতেন আবার আন্দোলনেও আছেন এমন কৃষক দেখা গেছে, তাতে কী আন্দোলন ব্যাহত হয়েছে? স্থানীয় নারীশক্তি কেমন ছিল, নেতৃত্বের স্তরে কেউ কী উঠতে পেরেছেন? খামতি কোথায়? তেভাগা নিয়ে আলোচনার বিপজ্জনক দিক হল একটি পরিকাঠামোর মধ্যে ঢুকে পড়া। কৃষি, কৃষক, জোতদার, রায়ত, সর্বহারা— যেন একটি বৃত্ত। বিশেষত সর্বহারা দেখানোর ও তা সৃষ্টি সুখের উল্লাস পীড়াদায়ক।৪৬ সোমনাথ হোর ‘তেভাগা ডায়েরী’-তে আশা প্রকাশ করেছিলেন, “আশা করব তাঁরা নিজেরাই একদিন নিজেদের ইতিহাস লিখবেন; অন্যের প্রয়োজনে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে উঠবেন না।”৪৭ বহু নেতা, কর্মী ও তত্ত্ববিদকে প্রশ্ন করে এর উত্তর পাইনি। মনে রাখতে হবে যখন সোমনাথ বাবু এ প্রশ্ন তুলছেন তখন ‘Can Subaltern Speak?’– প্রশ্ন ওঠেনি।
শেষ করার আগে গোলাম কুদ্দুসের দুটি অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলে আন্দোলনের প্রকৃত চেহারা খানিকটা হলেও বোঝা যাবে।
শ্রীলা বসু গোলাম কুদ্দুসের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করেন ‘এখনকার কমরেডদের সম্পর্কে আপনার মনোভাব কীরকম?’ উত্তরে গোলাম কুদ্দুস বলেন, “দেখ, সবাই ভালো। … একটা গল্প বলি তোমায়। মুজফফর সাহেব অরুণ মিত্রকে অনুবাদ করতে বলেন লেনিনের ‘গ্রামের গরিবের প্রতি’ বইটি। তা একদিন অরুণ মিত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলুন তো, চট করে বলুন। বইটার গোড়ায় কী লেখা আছে?’ উনি বললেন ‘কেন গ্রামের গরিব কৃষকদের দুর্দশার কথা’। আমি আর কিছু বললাম না। মুজফফর সাহেবকে বললাম উনিও এক কথা বললেন। অথচ বইটার গোড়ায় স্পষ্ট করে লেখা আছে যে, গ্রামের গরিব কৃষকদের প্রতি শহরের শ্রমিকরা জানাচ্ছে সোশালিজমের মাধ্যমে তাদের দুরবস্থা কীভাবে দূর হতে পারে— তার কথা। যিনি অনুবাদ করছেন আর যিনি করাচ্ছেন তাঁরাই যদি খুঁটিয়ে না পড়েন— তাহলে আর বাকিদের কী বলব…’।৪৮
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। জয়ন্ত ভট্টাচার্যের তে-ভাগা আন্দোলন বিষয়ক গ্রন্থটির ভূমিকা লেখেন সুধী প্রধান। গোলাম কুদ্দুস এ বিষয়ে পত্র দেন সুধী প্রধানকে ২৯/০৫/১৯৯৬-এ। সেই চিঠির কিয়দংশ তুলে ধরা হচ্ছে। “… খাঁপুরে ১৮ জনের মৃত্যুর পর কাঁটাতার দিয়ে পুলিশ গ্রাম ঘেরাও করল। ফলে তে-ভাগা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করার আনন্দ আমার কাছে নিরানন্দে পরিণত হতে লাগল। … কলকাতায় ফিরে আমাদের পত্রিকার সম্পাদক এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সোমনাথ লাহিড়ীর সামনে যথাসাধ্য চিত্রটা তুলে ধরি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন লাহিড়ীর সঙ্গে আমাদের সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল। তাঁকে বিনা দ্বিধায় সব কথা বলা যেত এবং তাঁরও কান পেতে শোনার অভ্যাস ছিল। আমার মনে এতটাই ক্ষোভ জমেছিল যে, তাঁকে প্রায় একঘণ্টা “ধমকে” ছিলাম, যার মর্মার্থ ছিল— আন্দোলন শুরুর আগে আপনারা কি ভাবেননি আন্দোলন কতদূর যেতে পারে, নিরীহ কৃষককে গুলির সম্মুখীন হতে হবে, হলে তারা কী করবে, এতগুলো প্রাণ চলে যাবে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় কোনো যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন না, আপনারা কী দায়িত্বশীল, আপনারা কী নিষ্ঠুর ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি প্রথম দিকে হাসিমুখে পরে গম্ভীর হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন। অবশেষে আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম, আপনারা কৃষকদের বন্দুক হাতে তুলে দিতে চান?
লাহিড়ী নিশ্চুপ।
“তা হলে তাদের বন্দুক হাতে তুলে দিতে চান না?”
লাহিড়ী নিশ্চুপ।
“হ্যাঁ কি না?”
লাহিড়ী নিশ্চুপ।
“তা হলে বলুন, ‘কিছু বলব না।’”
তথাপি লাহিড়ী নিশ্চুপ। তখন তাঁর মুখের গম্ভীরভাব পাষাণে পরিণত হয়েছে। আমার হঠাৎ প্রিয় মানুষটির প্রতি দয়া হল বুঝলাম, লাহিড়ীর মতো লোকও যে কোনো কারণেই হোক নিরুপায়। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কী মত বিনিময় হয়েছে, তা আমি জানব কী করে। … তখন আমাদের অপ্রস্তুতির কথা ভাবলে বিপ্লবের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং তজ্জনিত লক্ষ কোটি মানুষের কথা ভেবে বিচলিত হতে হয়।…”৪৯
নটে গাছ মুড়োল।
উল্লেখপঞ্জি:
১. সুস্নাত দাশ, ‘অবিভক্ত বাংলার কৃষক সংগ্রাম’, ‘তেভাগা আন্দোলনের আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত-পর্যালোচনা-পুনর্বিচার’, নক্ষত্র, ২০১২, পৃ. ১৪৫
২. নূহ-উল-আলম লেলিন, ‘তেভাগার কথা ও বাংলার কৃষক আন্দোলন’, প্যাপিরাস, ২০০৫, পৃ. ১৮৩।
৩. সুচরিতা সেন, ‘বাংলা সাহিত্যের আয়নায় তেভাগা’, নূহ-উল-আলম লেলিন সংকলিত ‘তেভাগার কথা ও বাংলার কৃষক আন্দোলন’, ২০০৫, পৃ. ১১৭
৪. ক। সুস্নাত দাশ, ‘অবিভক্ত বাংলার কৃষক সংগ্রাম’, ‘তেভাগা আন্দোলনের আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত-পর্যালোচনা-পুনর্বিচার’, নক্ষত্র, ২০১২, পৃ. ১৮৭
খ। সুস্নাত দাস, ‘গোলাম কুদ্দুসের সাহিত্যে তেভাগার লড়াই’, পরিচয়, নভেম্বর ২০০৬-এপ্রিল ২০০৭, পৃ. ৪১
৫. জয়ন্ত ভট্টাচার্য, ‘বাংলার তেভাগা— তেভাগার সংগ্রাম’, (বিনয় চৌধুরী রচিত ভূমিকা), এন. বি. এ., ১৯৯৬
৬. ক। শেখর দত্ত, ‘তেভাগা আন্দোলন’, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫, পৃ. ৭৫-৭৬
খ। সুস্নাত দাশ, ‘অবিভক্ত বাংলার কৃষক সংগ্রাম’, নক্ষত্র, ২০১২, পৃ. ১৪৯
গ। কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, প্রগতি প্রকাশন, ১৯৮৮, পৃ. ৬৩২
৭. মুহম্মদ আব্দুল্লাহ রসুল, ‘কৃষকসভার ইতিহাস’, এন. বি. এ, ১৯৯০, পৃ. ৩১৯
৮. পার্থ চ্যাটার্জী, ‘দি ল্যান্ড কোয়েশ্চেন’, কে. পি. বাগচী, ১৯৮৪, পৃ. ২০০
৯. তুষার চট্টোপাধ্যায়, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে হুগলি জেলা’, নবজাতক প্রকাশন, ২০১০, পৃ. ৮৯। তুষারবাবু স্থানগুলির নাম পান রতনমণি চট্টোপাধ্যায়ের ১৯৬১ সালে লেখা ‘স্মরণী’ থেকে।
১০. তুষার চট্টোপাধ্যায়, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে হুগলি জেলা’, নবজাতক, ২০১০, পৃ. ৮৯-১২৮
১১. বিনোদ দাশ, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলনের অতীতের পথ বেয়ে’, পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা ৩৪-তম সম্মেলন স্মরণিকা, অভ্যর্থনা সমিতি, ২০০৯ পৃ. ২৭১-৭৩
১২. বিজয় মোদক, ‘হুগলি জেলার আন্দোলনের প্রথম অধ্যায়’, বিজয় মোদক শতবর্ষের স্মৃতিচারণা, বিজয় মোদক জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ২০০৬, পৃ. ৮২
১৩. তুষার চট্টোপাধ্যায়, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে হুগলি জেলা’, নবজাতক, ২০১০, পৃ. ১৭১। চণ্ডীতলাতে ভগবতীপুর, পাঁচঘড়া ও রমানাথপুরে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বদন পণ্ডিত, গিরীশ পণ্ডিত (জয়ন্ত ভট্টাচার্য, ‘বাংলার তেভাগা— তেভাগা সংগ্রাম’, এন. বি. এ., ১৯৯৬, ৯২
১৪. বিজয় মোদক, ‘সেদিন গ্রামাঞ্চলে সমিতির গণভিত্তিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল শাসক কংগ্রেস’, ‘তেভাগার লড়াই’, সংকলন, এন. বি. এ., ১৯৯৪ পৃ. ১১
১৫. প্রবোধ সামন্ত (পুরশুড়া), ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে জানা কিছু ঘটনায় বিজয় মোদক’, ‘বিজয় মোদক শতবর্ষের স্মৃতিচারণা’, বিজয় মোদক জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ২০০৬, পৃ. ৬৭-৬৮
১৬. পার্থ চ্যাটার্জি, ‘দি বেঙ্গল ১৯২০-১৯৪৭’, ‘দি ল্যান্ড কোয়েশ্চেন’, কে. পি. বাগচী, ১৯৮৪, পৃ. ১০১
১৭. ভবানী সেন, ‘কৃষকদের দাবি’, গণ সাহিত্য চক্র, ঢাকা, সাল পাওয়া যায়নি, পৃ. ১
১৮. আবুল ফজল, ‘আইন-ই-আকবরী’ দ্বিতীয় খণ্ড, এইচ এস জ্যারেট ও মধুনাথ সরকার কর্তৃক অনূদিত ও পরিমার্জিত, ক্রাউন পাবলিকেশনস, ১৯৮৮, পৃ. ১৩৪
১৯. ‘মনুসংহিতা’, অনুবাদক সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ, ২০০২, পৃ. ১৭৬-৭৭
২০. ক। ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার, ‘এ স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল’, ভল্যুম – ৯, ডি. কে. পাবলিশিং হাউস, নিউ দিল্লি, ১৯৭৪, পৃ.১১৪-৩৫
খ। রত্না রায় সান্যাল, ‘তেভাগা মুভমেন্ট অফ নর্থ বেঙ্গল : উওমেনস্ আপরাইজিং’, প্রসিডিংস অফ দি ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস, ভল্যুম ৬৫, ২০০৪, পৃ. ৫৩৯-৫৪৫
২১. বিনয় চৌধুরী, ‘কৃষক আন্দোলনের এক অমর অধ্যায়’, তেভাগার লড়াই, তেভাগার লড়াই সংকলন, এন. বি. এ., ১৯৯৪, পৃ. ৭
২২. মুজফফর আহমদ, ‘ভারতের কৃষক-সমস্যা’, অগ্রণী, ১৯৩৮, পৃ. ২২
২৩. ক। এটি প্রকাশিত হয় ‘গণনায়ক’-১ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, শনিবার ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪০ (২০শে মে, ১৯০৩)
খ। ‘আমাদের সূত্র : তেভাগার সংগ্রাম’, পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা, ১৯৯৬, পৃ. ১০২
২৪. ক। বিনোদ দাশ, ‘বিজয় মোদক শতবর্ষের আলোকে হুগলি জেলার স্বাধীনতা এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন’, বিজয় মোদক জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ২০০৬ পৃ. ১৫
খ। অবিনাশ প্রামাণিক, ‘অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির প্রতিবেদন’, হুগলি জেলার কৃষক সমিতি ৩০তম সম্মেলন, ১৯৯৯, পৃ. ৫
২৫. ক। বিজয় মোদক, ড: তন্ময় কুমার ঘোষকে ১৭/০৩/১৯৯০ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
সূত্র : ১। তন্ময় কুমার ঘোষ, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলন (১৯৩০-৫৫)’, রুপালী, ২০২১ পৃ. ২১৯-২২২
খ। হুগলি জেলা কৃষক সমিতি, ৩০-তম সম্মেলন, ১৯৯৯, পৃ. ৪
২৬. তন্ময় কুমার ঘোষ, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলন (১৯৩০-৫৫)’, রুপালী, ২০২১ পৃ. ২২২-২২৪
২৭. বিজয় মোদক, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলনের প্রথম অধ্যায়’, বিজয় মোদক জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি, ২০০৬, পৃ. ৮২
২৮. ক। জয়ন্ত ভট্টাচার্য, ‘বাংলার তেভাগা— তেভাগার সংগ্রাম’, এন. বি. এ., ১৯৯৬, পৃ. ৯৯
খ। শ্রীরামপুর মহকুমা শাসকের চিঠি, নম্বর ৯৮/ সি, ১৩/০৩/১৯৪৭
গ। গৌতমকুমার দে, ‘হুগলি জেলার গণআন্দোলন’, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০৪, পৃ. ২২২
ঘ। গভর্নমেন্ট অফ বেঙ্গল, ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তর, ফাইল নং ৬ M-৩৮/৪৭ বি, ডিসেম্বর, ১৯৪৮
ঙ। ইরা মিত্র, ‘হুগলি জেলার কৃষক সংগঠনের কৃষক সমিতির ভূমিকা ১৯৩০-১৯৪৭’, ইতিহাস অনুসন্ধান ভল্যুম ১১, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, ১৯৯৮, পৃ. ৬২৪
২৯. বিনোদ দাশ, ‘জমির অধিকার, ফসলের অধিকার’, ‘হুগলি জেলার কৃষক সংগ্রাম : প্রকৃতি ও উৎস’, সারা ভারত কৃষক সভা, হুগলি জেলা কমিটি, কৃষক সভার ৬০ বৎসর, ১৯৯৭, পৃ. ৩৫-৩৬
৩০. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’, ‘বঙ্কিম রচনাবলী সাহিত্য সমগ্র’, তুলিকলম, ১৩৯৩, পৃ. ২৮
৩১. ক। সুকুমার মিত্র সম্পাদিত, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যশোর ও খুলনা’, ১ম সংস্করণ, কালামের কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ৩১৪, ৩২৬ ও ৩২৭
খ। সতী দত্ত, ‘খুলনা জেলার নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা (১৯০০-৪৭)’, ‘ইতিহাস অনুসন্ধান’ ভল্যুম ১৩, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ ১৯৯৮, পৃ. ৬৫৭
৩২. তন্ময় কুমার ঘোষ, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলন’, রূপালী, ২০১১, পৃ. ১৬-১৭০। ‘জনযুদ্ধ’ ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ ও ‘জনযুদ্ধ’ ২৩শে জুন ১৯৪৩, পৃ. ৪
৩৩. মুহম্মদ আব্দুল্লাহ রসুল, ‘কৃষক সভার ইতিহাস’, এন. বি. এ, ১৯৯০, পৃ.৬৮-৭১
৩৪. কমল চট্টোপাধ্যায়, ‘নো পাসারান’, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার কমিটি, ১৯৯৮, পৃ. ১৯
৩৫. অজিত বসু বড়ার জমিদার বাড়ির ছেলে। তিনবারের বিধানসভার বিধায়ক। পাখিবাবু অরুণ বসুর পুত্র। অরুণবাবু বসিরহাটে বিধায়ক পদে দাঁড়িয়েছিলেন।
৩৬. ধৃতি, ‘তেভাগা কৃষক সংগ্রামের ৫০ বছর পূর্তি স্মরণে’, ১৪০৩, পৃ. ৪০২-৪১২
৩৭. চিররঞ্জন পাল, ‘তেভাগার নারী’, র্যাডিকাল ইম্প্রেশন, ২০১৬, পৃ. ১১৬-১৭
৩৮. তন্ময় কুমার ঘোষ, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলন’, রূপালী, ২০১১, পৃ. ৩২৭
৩৯. কমল চট্টোপাধ্যায়, ‘নো পাসারান’, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি, ১৯৯৮, পৃ. ১০১-১০৪
৪০. প্রমথ চৌধুরী, ‘রায়তের কথা’, ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’, বিশ্বভারতী, ২০০৩, পৃ. ৩৯৫-৪০০
৪১. রেভারেন্ড লালবিহারী দে, ‘বেঙ্গল পেজ্যান্ট লাইফ’, অনুবাদক লীলা মজুমদার, অন্নপূর্ণা প্রকাশনী, ১৩৮৫, পৃ. ২২২-২২৩
৪২. কমল চট্টোপাধ্যায়, ‘নো পাসারান’, বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি, ১৯৯৮, পৃ. ৩৮
৪৩. ক। তন্ময় কুমার ঘোষ, ‘হুগলি জেলার কৃষক আন্দোলন’, রূপালী, ২০২১, পৃ. ৩৩১-৩৩৩; ৩৪৭-৪৮
খ। গোপাল দাস, ‘ডুবির ভেড়ির পঞ্চকন্যা’, ‘তেভাগার লড়াই’, এন. বি. এ., ১৯৯৪, পৃ. ২৩-২৭
গ। সাক্ষাৎকার : শ্রীকান্ত মান্না, কালীপদ মাঝি, মহাদেব পাখীরা, মথুরা ভৌমিক, অভিমন্যু ভৌমিক, ধৃতি, বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা, ১৪০৩, পৃ. ৪১২ ৪১৮
ঘ। বর্তমান প্রবন্ধকারের নেওয়া সাক্ষাৎকার—
i. বলাই সাঁবুই, ১৫/০৮/২০১৫
ii. ভবানী পাল, ২৯/0৮/২০১৫
iii. ব্রজগোপাল নিয়োগী, ২২/০৮/২০১৫
iv. বাসুদেব পাঁজা, ৩০/০৮/২০১৫
v. আশুতোষ মুখার্জী, ০৫/০৯/২০১৫
vi. মথুরা ভৌমিক ৩০/০৮/২০১৫। এনার বাড়ি পূর্ণেন্দু পত্রীও যান।
৪৪. শুভঙ্কর ঘোষ, ‘তেভাগার ফসল’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ১৯৯৮, পৃ. ৭১
৪৫. সুকুমার রায়, ‘হ য ব র ল’, ‘রচনাসমগ্র’, রিফ্লেক্ট, ১৯৯০, ২৫১
৪৬. প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘আমাদের সময় ধারণা, আমাদের সময়, সময়ের চিন্তা’, মন্তাজ, সংখ্যা ৬, নভেম্বর ২০০৫, পৃ. ২৯
৪৭. সোমনাথ হোর, ‘তেভাগার ডায়েরি ও চা-বাগিচার কড়চা’, সুবর্ণরেখা, ২০১০, পৃ. ৯১
৪৮. শ্রীলা বসু, ‘কথোপকথন : গোলাম কুদ্দুস’, পরিচয় গোলাম কুদ্দুস রাম বসু স্মরণে, নভেম্বর ২০০৬ – এপ্রিল ২০০৭, পৃ. ৫৬
৪৯. গোলাম কুদ্দুস, ‘সুধীপ্রধানকে প্রেরিত পত্র’, ধৃতি, বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা, ভাদ্র-আশ্বিন, পৃ. ২৭৮-৭৯