অনন্ত কুমার মন্ডল
সারা বিশ্বের যে-কোনও স্থানেই ‘কৃষিকার্য’ বলতে প্রাথমিক ভাবে সমতল ক্ষেত্রে ভূমি-কর্ষণের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদনকেই বোঝানো হয়। কিন্তু সমতল ক্ষেত্রের বদলে পার্বত্য ঢালকেই যখন ভূমি হিসাবে ব্যবহার করা হয় এবং সেই ভূমিও আদৌ লাঙল দ্বারা কর্ষিত হয় না, তখন সেই কৃষিকে ‘ঝুম চাষ’ তথা ‘স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে কৃষিকার্য’ বলা হয়– যা কিনা প্রধানত কয়েকশো বছর আগে ত্রিপুরায় দেশান্তরিত হয়ে আসা চাকমা উপজাতি-ভুক্ত মানুষদের একটি একান্ত বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে ত্রিপুরায় যে পাহাড়গুলির ঢালে এই কৃষিকর্ম সংঘটিত হয়, তা ত্রিপুরা বন দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন।
ঝুম চাষ সম্পর্কে বিস্তৃত কোনও বিবরণ দিতে হলে যে-চিত্রটি উঠে আসে, তা এ রকম: ‘প্রথমত পাহাড়ের ঢালে এবং সম্ভব হলে কোনও বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি স্থানে থাকা কোনও উপযুক্ত অঞ্চলের জমি নির্বাচন করতে হয়। একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগের কৃষিকর্মের জন্য এই ধরনের ভূমি নির্বাচনের বিষয়টি অতি অবশ্যই জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া উচিত। কেননা, একবার এই নির্বাচন পর্বটি সম্পন্ন হওয়ার পরই সেই জমির যাবতীয় বাঁশ ও ঝোপঝাড়, গাছপালা ও লতাপাতা এবং ঘাস-গুল্ম ইত্যাদি গোড়া থেকে কেটে ওই জমির উপরেই বিশালাকার স্তূপ হিসাবে রৌদ্রের তাপে পুরোপুরি শুকানোর জন্য একমাস যাবৎ ফেলে রাখা একান্ত প্রয়োজন। আর তার পরেই এপ্রিল মাসে সেই স্তূপীকৃত জঞ্জালে অগ্নিসংযোগ করা হলে, আগুন অতি সহজেই সেই শুকনো বস্তুগুলি পুড়িয়ে নিঃশেষিত করে– তার ছাই এবং ২ ইঞ্চি পরিমাণ ভূমির উপরাংশকে কৃষ্ণবর্ণে রূপান্তরিত করে ফেলবে। এর পরই চলবে বর্ষাকাল আসার প্রতীক্ষা, কেননা ওই কৃষক সম্প্রদায় ভালমতোই জানে যে, একমাত্র তুমুল বৃষ্টিপাতই ওই ছাইগুলিকে মাটির সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম, যা কিনা আসলে জমির উর্বরা শক্তির বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম, এক স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক সারপ্রয়োগ পদ্ধতি।
একটানা ও প্রবল বৃষ্টিপাতের দ্বারা পাহাড়ি ঢালের ভূমিভাগ যখন পুরোপুরি সিক্ত হয়ে ওঠে, তখনই সেই ঢালের বুকে ছোটো এক-একটি কাস্তে বা দায়ের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর ছোটো ছোটো গর্ত খোঁড়ার মাধ্যমে শুরু হয় ঝুম চাষ। গর্তগুলি সারি-বরাবর খোঁড়া হয়ে গেলেই, কৃষকেরা তাদের নিজস্ব ভূমির সেই সব গর্তের মধ্যে মুঠো-ভরা ধান, তুলো, তিল, কয়েক রকম ফল ও সবজির বীজ অদ্ভুত এক প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে দিতে থাকে। মিশ্রিত সেই বীজগুলি ছড়ানো হয়ে গেলে, আলগা মাটি ফেলে আবারও ওই গর্তগুলি ঢেকে দেওয়া হয়। অমন করে পাঁচমিশালি বীজ বসানোর উদ্দেশ্য হল, বছরের বিভিন্ন সময়ে যেন বিভিন্ন রকমের ফসল পাওয়া যায় একটিমাত্র জমি থেকেই। সাধারণত ধান ও অন্যান্য সবজি ওঠানোর সময় হল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং তুলো ও তিল ওঠানোর সময় হল নভেম্বর-ডিসেম্বর।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এ ধরনের কৃষিকাজের জন্য সারা বছর জুড়েই অত্যন্ত যত্ন ও দেখাশোনার প্রয়োজন, এবং একমাত্র অসম্ভব শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব। বিশেষত যখন কোনও একটি নির্দিষ্ট ফসল কাটা হয়, তখন কাস্তে-ব্যবহারকারীকে পাশের ফসলটির যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সে বিষয়ে চরম সতর্ক থাকতে হয়। এ ছাড়াও তাকে আগাছা ইত্যাদি রসগ্রাহী গৃহশত্রুর আক্রমণ-বিষয়ে যেমন তৎপর থাকতে হয়, তেমনই সতর্ক থাকতে হয় ক্ষেত-ধ্বংসকারী শুয়োর, হরিণ, টিয়া, বাঁদর ইত্যাদি বহিঃশত্রুর আক্রমণ বিষয়ে। এ ছাড়াও রয়েছে আরও বহুগুণ সাংঘাতিক এক শত্রুর ঝাঁক— ফসলখোর ইঁদুরের বিপুল কোনও বাহিনী। গোটা একটি কৃষিভূমির যাবতীয় ফসলই এই চির-ক্ষুধার্ত দাঁতালো মূষিকদলের পেটে ঢুকে গিয়েছে, তেমন উদাহরণও আছে বই-কি।
এই ধরনের হাজারো সমস্যা থেকে কৃষিপণ্য বাঁচানোর লক্ষ্যে, চাকমাদের মরিয়া প্রয়াসগুলি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু একটু অন্যভাবে ভাবলেই দেখা যাবে, পৃথিবীর সমস্ত স্থানের আদিবাসীদের মধ্যেই এ ধরনের কঠিন পরিশ্রমের প্রবণতা রয়েছে। তবে কিনা চাকমা উপজাতির কৃষকদের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন একটি সৃজনশীলতা– যার ফলে তারা তাদের ঝুমচাষের ক্ষেত্রগুলির চারপাশ ঘিরে গাঁদা ফুলের অজস্র সারিবদ্ধ ঝোপ সৃষ্টি করে তাকে এক অপূর্ব সৌন্দর্য দান করে। প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের বাস্তব ভূমিকেও এভাবে বিরল এক নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ করাই অন্যতম এক চাকমা-বৈশিষ্ট্য।
এখন পরম্পরাগত এই ঝুম চাষ ছাড়াও, খুব স্বল্প সংখ্যক পাহাড়িয়া কৃষক কিন্তু সমতলভূমির লাঙল-দ্বারা কর্ষণের প্রথাতেও কৃষিকর্মকে আয়ত্ত করেছিল। যদিও অধিকাংশ আদিবাসীই ছিল এর বিপক্ষে এবং সেজন্যই তারা কখনও ওই পদ্ধতিটিকে শস্য উৎপাদনের উপযোগী বলে ভাবেনি।
ত্রিপুরার অন্তর্বর্তী ভূখণ্ডে না হলেও, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে (এখন বাংলাদেশের অন্তর্গত) অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে উপজাতীয় রাজারা যে বেশ কিছু বাঙালি সম্প্রদায়ের কৃষককে পর্বত-সারির পাদদেশে আমন্ত্রণ করে এনে, তাদের ভূমিস্বত্ব প্রদান করেছিলেন, সে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, এবং সে-কারণেই ওই অঞ্চলের সমতলভূমির লাঙল-কর্ষণ পদ্ধতির প্রথম প্রবেশ ঘটে।
এমনকি আজও তাদের বংশধরদের ওই একই স্থানে হলকর্ষণের মাধ্যমে সমতলভাগের কৃষি ব্যবস্থাকে চালু রাখতে দেখা যায়। যদিও এখন আর তাদের ‘পাহাড়িয়া’ বা ‘পাহাড়বাসী’ না বলে ‘সমতলবাসী’ নাগরিক বলা হয়। ধর্মগতভাবে এই মানুষগুলি হল ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের যথেষ্টই দৈহিক ও সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। এখানে এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত ১৫০ বছর যাবৎ বহু পাহাড়বাসীই তথাকথিত এই ‘বাঙালি’-দের থেকে হলকর্ষণ পদ্ধতিটিকে আয়ত্ত করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ের সানুদেশে বসবাসকারী এই বাঙালি কৃষকেরা তাদের কৃষিকার্যের উপযোগী সেচব্যবস্থার জন্য মূলত পাহাড়ের ছোটো নদীগুলির উপরেই নির্ভরশীল। যাই হোক, এ ধরনের পার্বত্য এলাকার কৃষিক্ষেত্রগুলি এজন্যই ঠিক দু-ভাগে বিভক্ত— ‘ঝুম’ চাষের অঞ্চল ও সমতলীয় চাষের অঞ্চল। যদিও একথা স্বীকার করতেই হবে যে, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দেখলে ‘ঝুম’ চাষের সম্মিলিত অর্থনৈতিক অবস্থান পর্বত-নিম্ন সমতলীয় ‘হলকর্ষণ’ পদ্ধতির চাষের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে।
আর একবার ফেরা যাক চাকমাদের ‘ঝুম’ চাষের প্রসঙ্গে। এই চাষের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ধানই সর্বাগ্রগণ্য হলেও, তার পিছনেই রয়েছে ভুট্টা, তিল, তুলো, কুমড়ো, তরমুজ, লঙ্কা, মিষ্টি আলু, শসা ইত্যাদি ফসল। আমরা ইতিমধ্যেই দেখিযেছি যে, অধিকাংশ পাহাড়ি জাতিই ঝুম চাষে অভ্যস্ত এবং বছরের বিভিন্ন মাসে এই চাষ থেকে প্রাপ্ত নানা ফসলের উপরে তারা নির্ভরশীল। এবার আমরা তাদের খাদ্যাভ্যাসের দিকটিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, চাকমা-রা মূলত মাংসাশী এবং শুকনো মাছ ও বাঁশের নতুন অঙ্কুরের অংশটি দিয়ে বানানো পদের অনুরাগী। যদিও তাদের গোমাংস ভক্ষণের কোনও প্রমাণ মেলেনি। এ ছাড়া তাদের পছন্দের তালিকায় থাকা অন্য কৃষি ফসলগুলি হল মুগ ও মশুর ডাল এবং আলু, পেঁয়াজ, বাঁধাকপি ইত্যাদি ছাড়াও স্থানীয় ভাষায় ‘পেনালু’ ও ‘থাডালু’ নামে কিছু মূল ও কন্দ, সমস্ত বনাঞ্চলেই যা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। আর সর্বশেষ এটি লক্ষ করা গেছে যে, তাদের মধ্যে দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্যের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও তার বিকল্প হিসাবে চা এবং ঘরে-তৈরি মদের ব্যবহার রয়েছে।
এবার সেখানকার পর্বতের পাদদেশের সমতল ভূমিতে হলকর্ষণ-মাধ্যমে যে কৃষিব্যবস্থা রয়েছে, সে দিকে নজর ফেরালে আমরা দেখতে পাব: ধান ও রবিশস্য (সর্ষে, তামাক, লঙ্কা, ঢেঁড়শ, মিষ্টি আলু, বেগুন, আখ ইত্যাদি যে-ফসলগুলি বসন্তে পাওয়া যায়) ছাড়াও আম, কাঁঠাল, লেবু, তরমুজ ইত্যাদি কয়েকটি ফল, এবং নানা ফসলের মধ্যবর্তী সময়ের উৎপাদন স্বরূপ স্বল্প পরিমাণে তুলোও উৎপাদিত হয় স্থানীয় বাজারের চাহিদা হিসাবে।
এবার আমাদের দেখার পালা, পার্বত্য চাষে বহু শতবর্ষ প্রাচীন ‘ঝুম’ পদ্ধতির বদলে সমতল ভূমির চাষে ব্যবহৃত আধুনিক ‘হলকর্ষণ’ পদ্ধতিটিকে চালু করার উদ্দেশ্যে যে-নিষ্ফল প্রয়াসগুলি চালানো হয়েছিল, তার পরিণতির দিকটিকে। প্রকৃতপক্ষে, ১৯ শতকের শেষ দিকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে (এখন যা বাংলাদেশের অন্তর্গত) উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শক্তির হাত ধরেই এই উদ্যোগের সূচনা হয়। মূলত দুটি কারণ ছিল সেই উদ্যোগের পিছনে। প্রথমত, ব্রিটিশরা এটি বরদাস্ত করতে পারছিল না যে, পার্বত্য উপজাতির এক বিশাল জনসংখ্যার উপরে শুধু তাদের গোষ্ঠী প্রধানদেরই নিয়ন্ত্রণ বলবৎ থাকবে, যারা কিনা আবার তুমুলভাবে ঝুম চাষের সমর্থক। দ্বিতীয়ত, বিদেশি শাসকেরা এটিও চাইছিলেন যে, পার্বত্য উপজাতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পার্বত্য অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থায় এখনই আধুনিক হলকর্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটাতে পারলে, উৎপাদন-বৃদ্ধির সঙ্গেই আদিবাসীদেরও ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ছত্রছায়ায় আনা সম্ভব হবে।
এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের আরও যা উৎসাহিত করে, তা হল: পুরানো নথিপত্রে ধরম বক্স খান নামে এক দেশীয় রাজা যে ১৯ শতকের গোড়ায় এমনই একটি প্রয়াস করেছিলেন, সেই প্রমাণ খুঁজে পাওয়া। অবশ্যই তিনি যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিলেন, কেননা দেখা যাচ্ছে, তিনি রাঙামাটি বিল এলাকায় চট্টগ্রাম পর্বতমালার পাদদেশে ও ‘নয়াবাদ’ বন্দোবস্তের অধীনে, কয়েকজন বাঙালি কৃষককে মোট ৪৫০ একর কৃষিজমির ভূমিস্বত্ব প্রদান করেছিলেন– যা সেই কৃষকদের ওই ভূখণ্ডে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত চাষাবাদের অধিকার প্রদান করে, এমনকি রাজা তার মেয়াদ বৃদ্ধিরও অধিকারী ছিলেন। ১৮১৮ সালের ‘নয়াবাদ বন্দোবস্ত’-র নথিতে এই ভূমিদানের বিষয়টি ‘বিশেষ স্বত্ব দান’ হিসাবে লিখিত হয়েছিল। এ ছাড়াও তারা একই রকমের ভূমিস্বত্ব প্রদানের আরও একটি দৃষ্টান্তের কথা জানতে পারেন বরাদম নামে অন্য একটি অঞ্চলের নথিতে, যেখানে হলকর্ষণ পদ্ধতিতে কৃষিকর্মকে উৎসাহিত করার জন্য শীলচন্দ্র নামে এক ‘হেডম্যান’ তাঁর নিজের ৭৫ একর জমিকেই শুধু বিশেষ ‘ভূমি স্বত্ব’ হিসাবে কৃষকদের কাছে প্রদান করেননি, উপরন্তু সেই সঙ্গেই কৃষি-উপযোগী গবাদি পশু ও লাঙলও প্রতিটি ভূখণ্ড বাবদ ইচ্ছুক কৃষকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১৮৭৪–এ।
যদিও এত বিপুল পরিমাণে উৎসাহ দানের পরিণাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক বৃহৎ শূন্যতেই পর্যবসিত হয়। অন্তত ১৮৭৬ সালের এক বর্ণনায় প্রখ্যাত স্কটিশ ঐতিহাসিক ও সংকলনকার ডাবলিউ ডাবলিউ হান্টার ঠিক তেমনটাই জানিয়ে বলেন যে: শীলচন্দ্রের ডেকে-পাঠানো পার্বত্যভূমির কৃষকেরা জমি, গোরু ও লাঙলের অত বড়ো চিত্তাকর্ষক প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই, নিজেদের সাবেক ‘ঝুম’-চাষের খেতে ফিরে যান।
কিন্তু কেন? এই ধাঁধার একটি যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা পেতে হলে, আমাদের অবশ্যই খোলা চোখে ও সতর্ক মনে ইতিহাসের আরও কিছুটা পথ পাড়ি দিতে হবে। মূলত চাকমা উপজাতিদের ব্যবহৃত কৃষিজমিগুলির কর্ষণ-পদ্ধতিটিকে আধুনিক করার লক্ষ্যে ব্রিটিশদের প্রথম প্রয়াসটি ছিল মি. ম্যাকগিলের দক্ষ নেতৃত্বে, এবং বাংলার তৎকালীন সরকারের বদান্যতায় প্রাপ্ত মোট ৩৮,০০০ (আটত্রিশ হাজার) টাকার এক আর্থিক অনুদান-তহবিলের সাহায্যে কৃষি-সরঞ্জাম এবং গবাদি পশুক্রয়-ঋণের বন্দোবস্তের সুবিধায়। যদিও এই পদক্ষেপ গ্রহণের সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসন বরাবরই উপজাতি-প্রধানদের তরফ থেকে ভূমিস্বত্ব-প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা করছিল, এবং এজন্যই তারা ঘোষণা করে যে: এখন থেকে উপজাতি-প্রধানদের সম্মানিত ‘তহশিলদার’ মর্যাদাবিশিষ্ট বলে গণ্য করা হবে এবং ‘ভূমি-বন্দোবস্ত’-র সুবিধা-প্রাপকরা এবার থেকে ‘তহশিলদার’-দের অধীনস্থ ‘ভূমিস্বত্ব প্রাপক’ হিসাবে গণ্য হবে।
কিন্তু হায়! ঊনবিংশ শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক হাচিনসন একেবারে সুস্পষ্ট ভাষায় জানাচ্ছেন যে, প্রথম কয়েক বছরে (১৮৭২ পর্যন্ত) ঔপনিবেশিক শাসকদের ভাগ্যে আদিবাসীদের দিক থেকে আসা কোনও সুফলই জোটেনি। কেননা তত দিনে ৩৮,০০০ (আটত্রিশ হাজার) টাকার মতো বিরাট এক তহবিলের মধ্য থেকে মাত্র ১,১৪০ (এক হাজার একশো চল্লিশ) টাকার মোট অনুদানই বণ্টন করতে পেরেছিল ৩৮-টি পরিবারকে, যাদের পাওয়া মোট কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১২০ একর। ব্যাপারটি ছিল যেন এক বিরাট ঠাট্টার মতন, কেননা কম-মুনাফার মান্ধাতার আমলের ‘ঝুম’ চাষে অভ্যস্ত কৃষকেরা তথাকথিত আধুনিক ও লাভজনক ‘হলকর্ষণ’ পদ্ধতিটির থেকেই শুধু মুখ ফিরিয়ে রইল না— বরং ব্রিটিশদের দেওয়া সুদহীন ঋণদানের অত্যন্ত প্রলোভক প্রস্তাবটিকেও তারা হেলায় উপেক্ষা করল। শুধু মাত্র কয়েকজন বাঙালি কৃষকই শেষে এই কৃষি ঋণের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল, এবং সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে ভূমিস্বত্ব লাভ করেছিল, এ কথা সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায়। যদিও তাদের বসবাস এবং কৃষিকার্যের জন্য কিছু প্রান্তিক ও অনাবাদী ভূমিই বরাদ্দ করা হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে উপজাতি-প্রধানদের দীর্ঘস্থায়ী এক শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানই শাসকদের নতুন পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করে। যে পদক্ষেপ অনুসারে হলকর্ষণ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সম্ভাব্য কৃষকদের এবার থেকে উপজাতি প্রধানদের বদলে ‘দেওয়ান’ এবং ‘রোওয়াজা’-দের সঙ্গে ভূমি-স্বত্বে আবদ্ধ হতে হবে। যদিও আদিবাসীদের উপরে ওই দুই আধিকারিকের প্রভাবের চিত্রটি তেমন সুস্পষ্ট ছিল না, কেননা তখনকার বাংলার একজন প্রশাসক এ-বিষয়ে যে মত দিয়েছিলেন, তা হল : “খুবই অস্পষ্ট এবং অ-প্রত্যক্ষ”।
এ জন্যই ১৮৭৪-এর ভূমি-সংক্রান্ত নথিপত্রের যে করুণ দৃশ্যটি পাওয়া যায়, তা হল: ৫৪০ জন ‘ঝুমিয়া’ তথা পার্বত্য উপজাতির ঝুম-চাষির যে-দলটি ‘ভূমি-স্বত্ব’ গ্রহণে সম্মতি প্রকাশ করেছিল, তার মধ্য থেকে শুধু মাত্র একজনই ‘হলকর্ষণকারী কৃষক’ হিসাবে নথিবদ্ধ হয়। কিন্তু অদৃষ্টের প্রকৃত পরিহাসটি ছিল অন্য জায়গায়। যেহেতু গবাদি পশু ও কৃষি-সরঞ্জাম কেনার খরচ-বাবদ ওই ৫৪০ জন ঝুমিয়াকেই ইতিমধ্যে নগদ আর্থিক ঋণ বণ্টন করা হয়ে গিয়েছিল, ফলে তখন শুরু হল একে একে তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়েই স্থানীয় প্রশাসনের তরফে ওই ঋণ-অর্থ পুনরায় সরকারি তহবিলে প্রত্যর্পণের জন্য ক্রমাগত অনুরোধ জানানোর পালা। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ওই টাকার একেবারে তুচ্ছ একটি অংশই মাত্র উদ্ধার করা গিয়েছিল।
যাই হোক, রাজস্ব পরিষদ অবশ্য এমন কোনও পরিণতি সম্পর্কে আগেভাগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিল। এ ছাড়া পাওয়ার, হান্টার এবং অ্যাসকোলি-র মতো তিনজন সুপণ্ডিত এবং এ-বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিও আগেই প্রমাণ দেখান যে, উপজাতি-প্রধানরা কীভাবে রক্তচক্ষু দেখিয়ে, ইচ্ছুক উপজাতি-কৃষকদেরও সমতলভূমির ‘হলকর্ষণ পদ্ধতি’-র চাষে অংশ নিতে দিচ্ছে না। আসলে ওই উপজাতি-প্রধানদের এমন বাধাদানের কারণ হল, তাদের আশঙ্কা ছিল, একবার ওই ভূমিস্বত্ব গ্রহণ করলেই তাদের গোষ্ঠীর মানুষেরা আর তাদের বাৎসরিক কর প্রদান করবে না, কেননা তারা তো তখন জেলাশাসকের ক্ষমতাধীন হয়ে যাবে।
এবার দেখা যাক, পূর্বোক্ত কৃষি-বিষয়ক নগদ ঋণের ক্ষেত্রে কী কী শর্ত লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল :
(১) কোনও পার্বত্য উপজাতির কৃষককেই ৮ পাউন্ডের অধিক নগদ ঋণ প্রদান করা হবে না।
(২) এই অগ্রিম ঋণের অর্থ কোনও সুদ ছাড়াই আগামী ৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
(৩) সমভূমিতে কৃষিকার্যের ক্ষেত্রে ‘একেবারে একটিই শস্য চাষ’ এই নীতিটি মেনে চলতে হবে।
(৪) কোনও উপজাতি পরিবারকেই ১০ একরের অধিক পরিমাণ ভূমি প্রদান করা হবে না।
(৫) প্রথম ৫ বছর কোনও খাজনা দিতে হবে না।
(৬) উপজাতি-প্রধানদের ক্ষেত্রে তাদের গোষ্ঠী-সদস্য বাবদ প্রদেয় মাথাপিছু কর পুরোপুরি রেহাই করা হবে।
(৭) কৃষকদের প্রতি বছর অন্তত ২/৩ একর জমি চাষ করতেই হবে।
(৮) এই ভূমিস্বত্ব তথা ইজারা শুধু ৩০ বছরের জন্য ধার্য হবে।
(৯) স্বত্বপ্রাপ্ত কৃষকেরা প্রথম বছরে একই সঙ্গে তাদের ‘ঝুম’ চাষও চালিয়ে যেতে পারবে।
তালিকাভুক্ত শর্তগুলি ছিল নিঃসন্দেহে কৃষক-সহায়ক। কিন্তু এগুলি কি সঠিকভাবে কোনও উপজাতি-প্রধানের আর্থিক লোকসানের দিকটিকে মেটাতে সক্ষম ছিল? কেউই এই ব্যাপারটিতে নিশ্চিত ছিল না। সে কারণেই ১৮৭৯-তে এ-ব্যাপারে অভিজ্ঞ মি. বিম-এর পরামর্শ অনুসারে একটি নতুন নিয়মবিধি প্রণয়ন করা হয়– যে বিধি অনুসারে উপজাতীয় গোষ্ঠীপ্রধানদের হাতেই পার্বত্য কৃষকদের চাষ করা জমির খাজনা আদায়ের সম্পূর্ণ অধিকারটি প্রদান করা হয়। আদায়ীকৃত যে-অর্থ থেকে নিজেদের জন্য আকর্ষণীয় একটি অংশ কেটে রাখার পর, তবেই প্রধানরা তা জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছে জমা দেবেন। এই আইন প্রণয়নের দু-বছর পরেও আরও কয়েকটি শর্ত যোগ করার পর, তবেই এটি ১৮৮১ সালে বলবৎ করা হয়।
এই আইন মোতাবেক ভূমি-স্বত্ব প্রদানের প্রতিটি শর্তকেই পুরোপুরি স্বচ্ছতা প্রদান করা হয়। শর্তগুলি ছিল:
(১) কোনও কৃষককে প্রদেয় ভূমিস্বত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে ৫০ একর।
(২) এই চাষের অতিরিক্ত হিসাবে ‘ঝুম’ চাষ করার দরুন উপজাতি শ্রেণির কৃষকদের কোনও কর দিতে হবে না।
(৩) হলকর্ষণকারী কৃষকদের খাজনা ৪ টাকা কম দিতে হবে।
(৪) প্রথম ২ বছরে কোনও ভূমি-রাজস্ব দিতে হবে না।
(৫) তৃতীয় বছর থেকে প্রদেয় খাজনা দিতে হবে গোষ্ঠীপ্রধানকে।
(৬) প্রধানেরা সেই অর্থ থেকে নিজেদের ভাগ রেখে, তবেই তা জমা দেবেন।
(৭) সমস্ত ভূমিস্বত্বই ৩০ বছরের জন্য প্রদান করবেন জেলার উপ-অধ্যক্ষ।
(৮) ভূমিস্বত্বের মেয়াদ ফুরোনোর পর ফের ৩০ বছরের জন্য তার নবীকরণ করা যাবে।
(৯) ভূমিস্বত্বের দুটি মেয়াদকাল শেষে কৃষক ওই জমিটির মালিক গণ্য হবেন।
এ ছাড়াও ঘোষিত হয়েছিল যে, ভূমিস্বত্ব প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পর্বতাংশের কৃষক এবং সমতলাংশের কৃষকদের সমান অধিকার থাকবে। বস্তুত এমনটাই আশা করা হয়েছিল যে, এই ভূমিস্বত্ব দরিদ্র কৃষকদের উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠবে। এজন্যই ‘খাজনাহীন’ সময়কালের মেয়াদ বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয় এবং হলকর্ষণ ছাড়াও ‘ঝুম’ চাষ সংঘটনের মেয়াদ বাড়িয়ে ৩ বছর করা হয়েছিল– যে সময়কালে তাদের কোনও কর দিতে হবে না। যদিও এটি সুস্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, একবার ভূমিস্বত্ব লাভের পর, কৃষকেরা কোনও অবস্থাতেই নিজ বাসগৃহ ও কৃষিজমি ছেড়ে দেশান্তরী হতে পারবে না।
যাই হোক, এই নব-সংযোজিত শর্তগুলি অনেকটাই ফলপ্রসূ হয়ে দেখা দিয়েছিল, কেননা চাকমা বিভাগের কৃষকদের জন্য রক্ষিত ২৬০৮ একর জমিতে মোট ৩৫০টি ইজারা-স্বত্ব ব্রিটিশ ভূমিস্বত্ব নীতি অনুযায়ী বণ্টিত হয়েছিল। যদিও এই অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসকদের মনে একটি বড়ো আকারের কৌতূহল থেকেই গিয়েছিল এবং সে জন্যই তারা একটি গোপন অনুসন্ধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, তা থেকেই এক বিচিত্র সত্য উদ্ঘাটিত হয়। সেটি কী ছিল? আসলে এই চমকপ্রদ সাফল্যের সবটুকু স্বীকৃতিই স্থানীয় ‘দেওয়ান’ পদাধিকারীদের প্রাপ্য ছিল– যাঁরা নিজেদের ‘ক্রয় করা’ জমিতে কয়েকশো কৃষককে ‘ইজারা-স্বত্বপ্রাপ্ত’ হিসাবে বহাল করেছিলেন। কিন্তু আরও একটি রহস্য উদ্ঘাটিত হতে তখনও বাকি ছিল। তা হল ওই ‘ইজারা প্রাপক’-দের পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য। হ্যাঁ, পার্বত্য চাকমা উপজাতির কৃষক হওয়ার বদলে দেখা গেল, তারা সকলেই আসলে সমতল ভূমির বাঙালি কৃষক।
এভাবেই চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা উপজাতির কৃষকদের ভূমিকর্ষণ রীতিকে সাবেক ‘ঝুম’ পদ্ধতি থেকে আধুনিক ‘হলকর্ষণ’ পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করার একমাত্র ব্রিটিশ উদ্যোগটি এক ‘বৃহৎ ব্যর্থতা’ হিসাবেই সমাপ্ত হয়। এবং ঠিক এই ক্ষেত্রটিতেই আমাদের যে-প্রবাদবাক্যটিকে মান্যতা দেওয়া উচিত, তা হল: ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে’। কেননা, অভিপ্রয়াণকারী চাকমা উপজাতির ‘ঝুম’ চাষের এই প্রবণতাটিকে সেই ব্রিটিশ-ব্যর্থতার প্রায় সার্ধশতবর্ষ পরে, আজও হুবহু অ-পরিবর্তিত অবস্থাতেই দেখা যায় চট্টগ্রাম থেকে বহু দূরে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্যভূমিতে। যেখানে চাকমারা আজও পাহাড়ের ঢালে তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘ঝুম’ চাষ থেকে কোনোমতে দু-বেলা গ্রাসাচ্ছাদন করতে পেরেই পরম তৃপ্তি বোধ করে। তবে তার চেয়েও বড়ো সত্য হল, যেন আত্মসংযমের কী এক অদ্ভুত শক্তিতেই তারা গোটা বিশ্ব-স্বীকৃত বহুগুণ আধুনিক ও লাভজনক ‘হলকর্ষণ’ কৃষির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে। এজন্যই দিনের শেষে এমন একটি ঐতিহ্যপূর্ণ দৃঢ়তাকে কুর্নিশ জানানো ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনও বিকল্পই থাকে না।
References:
1. Singh, K.S. (Ed.), (1996), ‘People of India (Tripura)’ Volume XLI. Calcutta. Anthropological Survey of India.
2. Khan, Sufia. (1997), ‘Parbotya Chattogramer Upajati’: Bengali Translation of Prof. Pierre Bessaignet’s ‘Tribesmen of the Chittagong Hill Tracts’. Dhaka : Bangla Academy.
3. Hutchinson, R.H. Sneyd. (1909), ‘Eastern Bengal and Assam District Gazetteers: Chittagong Hill Tracts’. Allahabad : Pioneer Press.
4. Debroy, Debrarata. (2007), ‘Tripurar Adibashi Samaj O Sanskriti’ (a compilation of essays on tribal life and culture of Tripura). Kolkata : Akshar Publication.
5. Lewin, Thomas Herbert. (1869), ‘The Hill Tracts of Chittahong and the Dwellers therein’. Calcutta : Kessinger Publication.
6. May, Wolfgang. (1996), ‘Parbatya Chattagramer Kaumasamaj Ekti ArthaSamajik Itihas’ : Bengali translation by Swapan Bhattacharya (Chakraborti). Calcutta : Firma KLM Private Limited.
7. Hunter. William Wilson. (1876), ‘A Statistical Account of Bengal’, Volume VI. London : Creative Media Partners.
8. Risley, H.H. (1891), ‘The Tribes and Castes of Bengal’, Volume II. Calcutta.
9. Ascoli, David. (1918). ‘The Mons Star: The British Expeditionary Force’. Barlinn.
10. Chakma Karmmi, Madhab Chandra. (1940), ‘Rajnama’. Agartala : Tripura Government of Tribal Research Centre.
11. Dewan, Ashok Kumar. (1993), ‘Chakma Jatir Itihas Bichar’. Kolkata : Bodhicorio Sabha (Published on the occasion of World Chakma Conference).