নাচোল কৃষক বিদ্রোহ


সত্যেন সেন

দেশ বিভাগের পর মালদহ জেলার ৫টি থানা পূর্ববাংলার রাজশাহী জেলার সঙ্গে এসে যুক্ত হল। এই পাঁচটি থানা, নবাবগঞ্জ, ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, নাচোল ও গোমস্তাপুর। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই নাচোল, নবাবগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি থানার আধিয়ার বর্গাচাষিদের মধ্যে যেই অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছিল তা আমাদের কাছে ‘নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এ যুগের তরুণ তরুণীদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে কোনো কথাই জানে না, কিন্তু সেদিন এই অভ্যুত্থানের কাহিনি উভয় বঙ্গের সর্বসাধারণের মধ্যে এক বিপুল অলোড়নের সৃষ্টি করে তুলেছিল।

নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে কোনো কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে গতশতাব্দীর সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা। ব্রিটিশ সরকার সাঁওতাল পরগণার বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল কৃষকদের বিদ্রোহকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।

নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ ও তার মর্মান্তিক পরিণতি যেন তারই একটি ছোটো সংস্করণ। এই অভ্যুত্থানের মধ্যে সাঁওতাল, হিন্দু ও মুসলমান এই তিন সম্প্রদায়ের কৃষকরা যুক্ত থাকলেও এটা ছিল প্রধানত সাঁওতাল কৃষকদের অভ্যুত্থান।

গত শতাব্দীর সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থতায় ভেঙে যাওয়ার পর বিদ্রোহী সাঁওতালদের মধ্যে বহু লোক সরকারের অত্যাচারের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাদের জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সম্ভবত সেই সময়ই তারা বাংলাদেশের মালদহ, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। বহুদিন আগেকার কথা হলেও সেই বিদ্রোহের স্মৃতি তাদের মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি। বংশ পরম্পরাগত কাহিনি ও লোক সংগীতের মধ্য দিয়ে তা প্রবাহিত হয়ে আসছিল এবং অতি বড় দুঃসময়ে সেই স্মৃতি তাদের রক্তের মধ্যে ঝংকার জাগিয়ে তুলত। ১৯৩২ সালে মালদহ জেলার সাঁওতাল কৃষকরা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য গঠনের জন্য যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, তার মধ্য দিয়ে আমরা তার পরিচয় পাই।

এক সময় সাঁওতালরা তাদের আদি-জন্মভূমিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করত। যেই জমিকে তারা জন্মসূত্রে পেয়ে এসেছে, তারা জানত তারা নিজেরাই সেই জমির মালিক। সেই জমিতে মেহনত করে তারা যেই ফসল ফলাত, তারা নিজেরাই তা ভোগ করত, বাইরে থেকে আর কেউ এসে তার উপর ভাগ বসাতে পারত না। তারপর এক সময় কোথা থেকে নেমে এল সরকার, জমিদার, জোতদার। যাদের হাতে কাগজপত্র, তারাই নাকি জমির মালিক। কিন্তু তাদের নিজেদের হাতে কোনো কাগজ নাই, তাই তাদের সব কিছু থেকেও কিছুই নাই। যদি জমি চাষ করতে হয়, তবে তাদের কাছ থেকে জমি নিতে হবে, আর ফসল ফললে তার একটা মোটা ভাগ তাদের গোলা-ঘরে পৌছে দিতে হবে। এইটাই নাকি আইন। এই আইন না মানলে ঘরবাড়ি ভেঙে তাড়িয়ে দেয়, ধরে বেঁধে জেলখানায় আটক করে রাখে, এমন কি খুন করেও ফেলে। এইটাই নাকি বিচার!

কিন্তু এ কেমন আইন? এ কেমন বিচার? বাইরে থেকে এল যারা তাদের শান্তির সংসারের উপর হামলা করেছিল, জবরদস্তি করে তাদের উপর তাদের এই সমস্ত আইন চাপিয়ে দিয়েছিল, তাদের কথা তারা সহজে মেনে নেয়নি। এই নিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হয়েছে। কিন্তু ওদের শক্তি তাদের চেয়ে অনেক বেশি, ওরা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে বন্দুক নিয়ে লড়াই করে, ওদের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠা যায় না। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পোষ-মানা হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কখনও কখনও ভুল হয়ে যায়, আদিম রক্ত গর্জন করে ওঠে।

এখানকার তথাকথিত সভ্য জাতির মানুষেরা এই ‘অ-সভ্য’ সাঁওতাল আর তাদেরই মতো অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসী লোকদের ভাগ্য নিয়ে কি নিষ্ঠুর খেলাই না খেলে এসেছে! যে সব জায়গা নিবিড় বন-জঙ্গলে পূর্ণ ছিল, যেখানে বাঘ-ভালুক আর সাপ-খোপের ভয়ে কেউ প্রবেশ করতে চাইত না, জমিদার আর জোতদার নামে পরিচিত ভদ্র লোকেরা সেই সমস্ত জায়গায় এদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে নিয়ে আসত। আর এই সরল প্রাণ মানুষগুলি অনেক আশা বুকে নিয়ে আসত, জীবনের মায়া বিসর্জন দিয়ে এই সমস্ত দুর্গম অঞ্চলকে আবাদ করে সোনার ফসল ফলিয়ে তুলত। ‘কিন্তু বছর কয়েক’ বাদে তাদের জানিয়ে দেওয়া হত, এই জমির উপর তাদের কোনো স্বত্ব নাই। তাদের হাতে তৈরি জমি দিয়ে আর তাদেরই মজুর খাটিয়ে সেই সমস্ত ভদ্র মানুষদের উপস্বত্ব দিন দিন বেড়ে চলে, আর এই হতভাগ্য ভূমিহারার দল একপেট ক্ষুধা নিয়ে মজুরি খুঁজে খুঁজে বেড়ায়।

১৯৩০-৩২ সালে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্লাবন উথলে উঠেছে। মালদহ জেলার সাঁওতাল কৃষকদের মধ্যেও সেই আন্দোলন সাড়া জাগিয়ে তুলল। তারা সংকল্প করল, তারা স্বাধীন হবে, তাদের নিজেদের স্বাধীন রাজ্য গঠন করবে। স্বাধীন রাজ্য বলতে তারা বুঝেছিল, সেই রাজ্য যেখানে তাদের জমির ক্ষুধা মিটবে, তাদের জমির উপর তাদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এর পর থেকে ভদ্র বেশধারী কোনো জমিদার, কোনো জোতদার, কোনো মহাজন তাদের উপর কোনোরকম জুলুম আর শোষণ চালিয়ে যেতে পারবে না। জিতু সরদার ছিল তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা। তার ডাকে মালদহের সাঁওতাল কৃষকরা দলে দলে লড়াই করবার জন্য এগিয়ে এল। শহর থেকে আট মাইল দূরে আদিনা মসজিদের কাছে তারা তাদের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিল। অহিংস সংগ্রাম কাকে বলে, তা তারা জানতও না, বুঝতও না। সংগ্রাম বলতে একটা জিনিসই তারা জানত, যার নাম সশস্ত্র সংগ্রাম। আর এই সংগ্রাম করবার জন্য লাঠি, বল্লম, তীর-ধনুক ইত্যাদি হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে এসেছিল। অপরপক্ষে তাদের দমন করবার জন্য সরকারের পুলিশ বাহিনীও রাইফেল নিয়ে তৈরি হয়ে এল। এই যুদ্ধের পরিণতি কি হতে পারে? যা হবার তাই হল। এই সংঘর্ষে বহু সাঁওতাল মারা গিয়েছিল। তাদের সেদিনকার স্বাধীনতার সংগ্রামের এইখানেই হল ইতি।

এ হল ১৯৩২ সালের কথা। নাচোলের কৃষকদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। মাঝখানে ষোলোটি বছর কেটে গেছে। কিন্তু নাচোল কৃষক বিদ্রাহের সংগ্রামী কৃষকরা ১৯৩২ সালের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা কি একেবারেই ভুলে গিয়েছিল? ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই দুইটি সংগ্রামের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করবার মতো একজন লোক ছিলেন। তার নাম রামু সরকার। তিনি ১৯৩২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগ্রামীদের মধ্যে একজন। জিতু সরকারের অন্যতম বিশিষ্ট সহকর্মী এই বৃদ্ধ রামু সরকার এবারকার এই বিদ্রোহেও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ির মতো এই অঞ্চলেও বিরাট বিরাট জোতদারদের প্রাধান্য। জোতদারদের মধ্যে অধিকাংশই দু-চার হাজার বিঘার জমির মালিক। কৃষকদের হাতে জমি নাই বললেই চলে। এদের মধ্যে সবাই প্রায় ভাগ-চাষি। এরা শুধু নামেই কৃষক, জোতদারদের কাছ থেকে জমি না পেলে ক্ষেত মজুরি করা ছাড়া এদের আর কোনো উপায় ছিল না। ফলে জোতদারদের অনুগ্রহের উপর এদের সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হত। জোতদার খুশি হলে জমি দিত, আবার যে কোনো সময় যে কোনো কারণে তাদের হাত থেকে এই জমি ছুটিয়ে নিতে পারত। শুধু সাঁওতাল কৃষকদের কথা বলছি না, হিন্দু ও মুসলমান ভাগচাষিদের অবস্থাও ছিল এই একই রকম। জোতদারদের বলতে হিন্দুও ছিল, মুসলমানও ছিল। ধর্মের দিক দিয়ে পৃথক হলেও শ্রেণি-চরিত্রের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্যই ছিল না। হিন্দু-মুসলমান সাঁওতাল নির্বিশেষে সকল ভাগ চাষিদের উপরেই তারা একই নির্মম শোষণের রাজত্ব চালিয়ে আসছিল।

অথচ এই শতাব্দীর প্রথম দিকেও এখানকার কৃষকরা এমনভাবে সর্বহারা হয়ে পড়েনি। তখনও তাদের অনেকের হাতে নিজস্ব জমি ছিল। কোথায় গেল সেই সব জমি? এই অঞ্চলের কৃষকরা এখনও সে কথা ভুলে যায়নি। আজ যারা বৃদ্ধ তাদের মধ্যে অনেকে একসময়ে সুখের দিন দেখেছে। তখন তারা নিজেদের জমি নিজেরা চাষ করত। কি করে তাদের সেই সমস্ত জমি জোতদারদের হাতে গিয়ে পড়ল, এই প্রশ্নের উত্তর তারা নিজেরাও ভালো করে দিতে পারে না। জোতদাররা শুধু জোতদারই তো নয়, তারা একাধারে জোতদার ও মহাজন। কৃষকরা চাষের সময় বা কোনো প্রয়োজনের সময় এদের কাছ থেকেই যেই টাকা বা ধান কর্জ নিয়েছে তার বহুগুণ টাকা দিয়েও তারা সেই ঋণের দায় থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। এই নিরক্ষর ও সরল প্রাণ কৃষকদের জমি ছলে, বলে, কৌশলে নানাভাবে জোতদারদের হাতে গিয়ে জমেছে। আবার পেটের দায়ে অনুপায় হয়ে সেই সমস্ত জমিই তারা জোতদারদের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে আসছে অথবা এই সমস্ত জমিতেই তারা ক্ষেত-মজুরি করে আসছে। নিজেদের সেই সমস্ত জমি এখনও তারা চিনে নিতে পারে। এরা অজ্ঞ, অশিক্ষিত, নির্বোধ, কিন্তু সেই সমস্ত বঞ্চনা আর ছলনার নিষ্ঠুর ইতিহাস এরা এখনও ভুলে যেতে পারেনি। এরা স্বভাবত নিরীহ, শান্তিপ্রিয় ভালো মানুষ। তা হলেও নিদারুণ অভাবের জ্বালা আর স্মৃতির দংশন এদের মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত করে তোলে।

উত্তরবঙ্গের ভাগ-চাষিদের তেভাগা আন্দোলন এবং ময়মনসিংহের হাজং কৃষকদের টংক আন্দোলন সারা বাংলাদেশের কৃষক সমাজের উপর এক ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই প্রভাব এই অঞ্চলের কৃষকদের উপর বিশেষভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এখানকার দুর্গত কৃষক সমাজ বাঁচবার জন্য পথ খুঁজে মরছিল, এবার তারা নূতন পথের সন্ধান পেল। উত্তরবঙ্গের তেভাগা আন্দোলনের দৃষ্টান্তে এই অঞ্চলের চির শোষিত ভাগ-চাষিরা এক নতুন সংগ্রামী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠল। এই সংগ্রামে হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল, সকল সম্প্রদায়ের কৃষকরাই অংশ গ্রহণ করেছিল। তবে নির্ভীক সাঁওতাল কৃষকরাই ছিল তাদের অগ্রবাহিনী। এই সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি আঘাত তারাই বুক পেতে নিয়েছে।

দেশ বিভাগের আগে থেকেই অন্যান্য জেলার মতো এখানেও কৃষক সমিতি কৃষকদের মধ্যে কাজ করে আসছিল। আগেই বলা হয়েছে সে সময়ে রাজশাহী জেলার এই কয়টি থানা মালদহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। মালদহ জেলার কৃষক সমিতির সম্পাদক ছিলেন কমরেড রমেন মিত্র। নওয়াবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের এক জমিদার পরিবারের ছেলে তিনি। সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শে দীক্ষিত এই রমেন মিত্র নিজেদের শ্রেণি-চরিত্রের গন্ডি ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসে কৃষকদের মুক্তি সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে নাচোল ও নওয়াবগঞ্জ থানার ভাগচাষিদের মধ্যে যেই তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে যা এক বিদ্রোহের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তিনিই ছিলেন তার প্রধান সংগঠক ও নেতা।

সে সময় পূর্ব বাংলা জুড়ে ব্যাপক ধর-পাকড় চলছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের বিশেষ করে কমিউনিস্ট কর্মীদের বেছে বেছে বিনা বিচারে আটক করা হচ্ছিল। মুসলিম লিগ সরকার গণ-আন্দোলনের সামান্য প্রচেষ্টাটুকুকেও বরদাস্ত করতে পারত না। সেই আক্রমণের মুখেও যারা কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করে চলেছিলেন তাদের আত্মগোপন করেই কাজ করতে হচ্ছিল! প্রদেশের অন্যান্য জায়গার মতো এই অঞ্চলেও সেইভাবেই কাজ চলছিল। শুধু রমেন মিত্র নয়। এখানকার আন্দোলন পরিচালনার জন্য রাজশাহীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনিমেষ লাহিড়ী, ফনী, শিবু, কোড়ামুদি, বৃন্দাবন সাহা প্রভৃতি যে সমস্ত নেতৃস্থানীয় কর্মী এখানে এসেছিলেন, তাঁদেরও গোয়েন্দা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পলাতক অবস্থাতেই কাজ করতে হচ্ছিল। আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল নাচোল থানার চণ্ডীপুর গ্রাম। এই গ্রামে সাঁওতাল-নেতা মাতলা সরদারের বাড়ি। এই আন্দোলনের ইতিহাসে মাতলা সরদারের বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রধানত তাঁকেই অবলম্বন করে এই অঞ্চলের সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে উঠছিল। তিনি যে শুধু কর্মীদের আশ্রয় দিতেন বা নানাভাবে সাহায্য করতেন তা নয়, তিনি নিজেও ছিলেন একজন উদ্যোগী নেতৃস্থায়ীয় কর্মী। এই অঞ্চলের সাঁওতাল কৃষকদের উপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বা তাঁর পরিচয়-সূত্রে কর্মীরা বিভিন্ন জায়গার সাঁওতাল কৃষকদের মধ্যে বৈঠক, সভা সমিতি ইত্যাদি করতেন। মাতলা সরদার অনেক জায়গাতেই স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন এবং সেই সমস্ত বৈঠক ও সভায় সাঁওতালি ভাষায় বক্তৃতা দিতেন। তাঁর বক্তৃতা তাদের মধ্যে অদ্ভুত উন্মাদনার সৃষ্টি করত। আন্দোলনের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী। শুধুমাত্র কৃষকদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্যেই যে তাঁর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, তিনি এই আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শ দীক্ষিত হয়েছিলেন। এই অঞ্চলের সাঁওতাল কর্মীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য। তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো।

এই প্রসঙ্গে আরও একজন কর্মীর নাম উল্লেখ করতে চাই। তিনি হলেন শিবু কোরামুদি। তিনি এই অঞ্চলের লোক নন। তাঁর বাড়ি ছিল নাটোরে। তখনকার আন্দোলন পরিচালনার কাজে সাহায্য করবার জন্য তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছিল। কোরামুদি সাঁওতাল নয়, তবে তারা সাঁওতালদেরই মতো একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। শিবু পুঁথিগত শিক্ষার সুযোগ খুব কমই পেয়েছিলেন। প্রধানত কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁর শিক্ষা। তিনি ছিলেন রাজশাহী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির একজন জেলা-সংগঠক।

মাতলা সরদারের সঙ্গে রমেন মিত্রের একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। রমেন মিত্রের ঠাকুরদা মাতলার ঠাকুরদাকে এখানে জমি দিয়ে বসিয়েছিলেন। এই সূত্রে এই দুই পরিবারের মধ্যে, বিশেষ করে মাতলা ও রমেনের মধ্যে একটি প্রীতির সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। মাতলা রমেনকে ‘ভাই’ বলে ডাকতেন। কিন্তু এই প্রীতির সম্পর্কটা এইখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল না। জমিদারের ঘরের ছেলে হয়েও রমেন যে দিন নিজেদের পারিবারিক স্বার্থকে পদদলিত করে কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে এলেন, তখন মাতলার সঙ্গে এই প্রীতির সম্পর্কটা সহযাত্রী সহকর্মীর নিবিড় সম্পর্কে পরিণত হয়ে গেল। তাঁদের এই সম্পর্কের মধ্যে কোনোদিন চিড় ধরেনি। আর শুধু মাতলাই তো নয়, সারা অঞ্চলের ভাগ-চাষিরা, বিশেষ করে সাঁওতাল কৃষকরা রমেনকে আর তার সহকর্মীদের তাদের একান্ত আপনজন বলে চিনে নিতে পেরেছিল।

প্রাথমিক প্রচার-প্রস্তুতি ও সংগঠনের পর ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে এই অঞ্চলে তেভাগা-আন্দোলন শুরু হল। লিগশাহীর মিলিটারির প্রচণ্ড তাণ্ডবে উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে, সেই সময় তারই এক প্রান্তের একটি বিচ্ছিন্ন এবং অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এলাকায় জমির ক্ষুধায় উন্মত্ত ভূমিহীন চাষিদের বিদ্রোহের অগ্নিশিখা অতর্কিতে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ঝলকে উঠল। এই ধরনের অভ্যুত্থানের জন্য দেশের মানুষ বা সরকার কেউ যেন তৈরি ছিল না।

এই আন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাঁওতাল, হিন্দু ও মুসলমান, এই তিন সম্প্রদায়ের ভাগ-চাষিরা প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। সদ্য-বিভক্ত এই উপ-মহাদেশ তখনও সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল, এবং একমাত্র সেই শক্তির উপর নির্ভর করেই মুসলিম লিগ সরকার তার একচ্ছত্র শাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলে ভাগচাষিদের মধ্যে তারা তাদের সাম্প্রদায়িকতার বিষ-দাঁত ফুটিয়ে দিতে পারেনি। এই আন্দোলনে সাঁওতাল কৃষকরাই প্রধান ও আক্রমণমুখী ভূমিকা নিয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু তা হলেও অন্য দুই সম্প্রদায়ের কৃষকরাও তাদের সঙ্গেই ছিল, কেউ তাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারেনি।

এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল এইখানেই। তার ফলে আন্দোলনের প্রথম ধাক্কাতেই এতকালের সর্বশক্তিমান জোতদাররা সাধারণের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তাদের অবস্থাটা এতদূর অসহায় হয়ে পড়েছিল যে, খুব কম জায়গাতেই তারা বল প্রয়োগ করতে সাহস করেছিল।

ফসলকাটা শুরু হবার সময় সর্ব প্রথম রমেন মিত্র এবং তাদের অন্যান্য হিস্যার মালিকদের পাঁচ শ বিঘা জমির উপরে তেভাগার লাল ঝান্ডা তুলে দেওয়া হয়েছিল। এইখান থেকেই শুরু। তারপর অন্যান্য জোতদারদের জমিতে তেভাগা চলল। দেখতে দেখতে সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তেভাগার এই বিধান কার্যকরী হয়ে গেল। এই ব্যাপারে বাধা যে আসেনি তা নয়, কিন্তু সেই সমস্ত বাধা যেন ফুৎকারে মিলিয়ে গেল।

এবার আমরা এই অঞ্চলের আর একজন বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় কর্মীর কথা বলতে যাচ্ছি যার নাম এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে গ্রথিত হয়ে আছে। তিনি হচ্ছেন রমেন মিত্রের স্ত্রী ইলামিত্র। যারা নাচোল বিদ্রোহের কথা শুনেছে, তারা ইলামিত্রের নামও শুনেছে। একাধিক কারণে এই নামটি এই অভ্যুত্থানের মধ্য থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। তাঁর আন্দোলনের ক্ষেত্র ছিল পূর্ববাংলায়, কিন্তু তিনি উভয় বাংলার মানুষের কাছে সমভাবে পরিচিত।

ইলামিত্র যে রমেন মিত্রের শুধু জীবন সঙ্গিনী ছিলেন তাই নয়, তারা ছিলেন একই আদর্শে দীক্ষিত, একই সংগ্রামের সাথি। এই আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তাঁর বয়স চব্বিশ। সে সময় তিনি একটি শিশু পুত্রের জননী। আন্দোলনের প্রয়োজনে জমিদার বাড়ির কুলবধূ সংসার ও সমাজের গন্ডি ভেঙে, দুগ্ধপোষ্য শিশু পুত্রের মায়া কাটিয়ে চলে এলেন নাচোলে, প্রকৃতির সন্তান সরল প্রাণ সাঁওতাল চাষিদের মাঝখানে। অতি-অভ্যস্ত সুখের জীবন ছেড়ে নেমে এলেন পথের ধুলায়। এই তেজস্বিনী নারী শেষদিন পর্যন্ত আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে এসেছেন, নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। এই সরল প্রাণ সাঁওতাল চাষিরা তাঁর মধ্যে কি দেখতে পেয়েছিল তা তারাই জানে, তাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে তারা যেন এক নূতন শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠেছিল। তারা তাঁর নাম দিয়েছিল ‘রাণী মা’। ছোটো বড়ো, নারী-পুরুষ, সবাই তাঁকে এই নামেই ডাকত। কে জানে কোন গুণে, কোন মন্ত্রে, তিনি হাজার হাজার মানুষের হৃদয়রাজ্যের রাণীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

কিন্তু এই রাণী সিংহাসনের রাণী নন, তিনি সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশে গিয়েছিলেন। প্রয়োজনের তাগিদে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সাঁওতালি ভাষাকে আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন এবং সেই ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলতেন।

তারাও তাদের নিজেদের মাতৃ-ভাষায় তাঁর সঙ্গে মন খুলে কথা বলত। তিনি প্রাণ দিয়ে তাঁদের ভালোবেসেছিলেন, তারাও তাঁকে তেমনি করেই ভালোবাসতো। তাদের মধ্যে কোনো সম্ভ্রমের ব্যবধান ছিল না। কিন্তু নেত্রী হিসেবে তাদের উপর তাঁর অদ্ভুত প্রভাব ছিল। একথা এখনকার দিনের লোকে বিশ্বাস করবে কি না জানি না, কিন্তু তাদের মধ্যে এমন অনেক লোক ছিল যারা তাঁর কথায় স্বচ্ছন্দে জীবন দিতে পারত। এই শক্তি ও জনপ্রিয়তার উৎস কোথায়, এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার মনে হয় আন্দোলনের সেই বিশেষ পরিবেশ, এতগুলি মানুষের প্রাণ-ঢালা ভালোবাসা, অটল বিশ্বাস ও একান্ত নির্ভরতা তাঁর নিজস্ব শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এই আন্দোলন সম্পর্কে একটা কথা উল্লেখ করবার বিশেষ প্রয়োজন আছে। এই আন্দোলন তেভাগার আন্দোলন হলেও এর পিছনে ছিল ভূমিহারা চাষিদের বহুদিনের সঞ্চিত বিক্ষোভ এবং জমির জন্য অদম্য ক্ষুধা যেই জমি তাদের হাত থেকে বিভিন্ন সময়ে ছলে, বলে, কৌশলে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে সমগ্র নাচোল থানা এবং নবাবগঞ্জ থানার কতগুলি জায়গায় শুধু যে তেভাগার বিধান কার্যকরী হল শুধু তাই নয়, সত্য কথা বলতে গেলে সমস্ত অঞ্চলটা কিছু দিনের জন্য যেন কৃষক সমিতির করতলগত হয়ে গিয়েছিল।

এই ব্যাপক ও দৃঢ় ঐক্য আর সংগঠনের ফলে তখনকার মতো সাফল্য অতি সহজেই তাদের হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এল। সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তেভাগার বিধান চালু হয়ে গেল। জোতদাররা বিনা বাক্যে এই বিধান মাথা পেতে নিয়েছিল। না মেনে উপায় ছিল না। অবস্থা দেখে তারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এমন অঘটন যে ঘটতে পারে, এটা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু শুধু তেভাগা নিয়েই তারা তুষ্ট থাকেনি, এই সাফল্যের ফলে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে তারা আশা করছিল, এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের হারিয়ে ফেলা জমিগুলির উপর আবার তাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। বছরের পর বছর ধরে তারা যেই স্বপ্ন দেখে এসেছে এতদিন বাদে এখন তা সত্যসত্যই বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে।

সাময়িক সাফল্যের এই অসংযত উচ্ছ্বাসে সাধারণ চাষিরা যেন দিশাহারা হয়ে উঠেছিল। এতদিন তারা যেই জোতদারদের তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলে জেনে এসেছে আর মেনে এসেছে, আজ তাদের বিরুদ্ধে একটা কথা বলবার মতো সাহস ওদের নাই। প্রাণের ভয়ে ওরা তাদের প্রতিটি কথায় সায় দিয়ে চলে, এমন ভাব দেখায় যেন এরা তাদের যে কোনো দাবি মেনে নিতে রাজি আছে। শুধু কথায় নয়, কাজেও তাই দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের সমিতির ও সংগঠনের প্রয়োজনে এই সমস্ত জোতদারদের কাছে চাল, কাঠ ইত্যাদি যখন যা কিছু চেয়ে পাঠাচ্ছে, এরা পরম বশংবদের মতো সঙ্গে সঙ্গে তা সরবরাহ করে চলেছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের পক্ষে মাথাটা ঠিক রাখা একটু কঠিন বইকি। জোতদাররা আপাতত বে-কায়দায় পড়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে এমন মধুর ব্যবহার করছে বটে, কিন্তু তাদের পিছনে যেই বিরাট শক্তি আক্রমণের জন্য উদ্যত হয়ে আছে, যার তুলনায় তাদের নিজেদের শক্তি কিছুই নয়, সেই সত্যটা তলিয়ে দেখবার মতো মানসিক অবস্থা তাদের ছিল না।

আর তাদের মধ্যে যারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন, যারা তাদের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছিলেন, তারাই-বা কি ভাবছিলেন। হয়তো তারা ভেবেছিলেন, সরকারের তুলনায় তাদের শক্তি সামান্য, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই, কিন্তু এখানকার কৃষকদের এই সাফল্য সারা প্রদেশের কৃষকদের মনে এক বিপুল সংগ্রামী সাড়া জাগিয়ে তুলবে, যার ফলে তাদের সংগ্রাম এক উন্নততর স্তরে গিয়ে পৌঁছোবে। তাদের মূল লক্ষ্যটা ছিল সেই দিকে, স্থানীয় লাভ ছিল গৌণ।

কিন্তু সেদিন তাঁরা এক মারাত্মক ভুল করেছিলেন। সেই ভুলটা এখন তারা আন্তরিকভাবেই স্বীকার করেন। গণ-মুক্তির মূল লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য এমন অনেক স্থানীয় ও সাময়িক ক্ষয়-ক্ষতি সহ্য করতে হয়, আপাত-লাভের কথা বিবেচনা না করে বহু মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিতে হয়। এ কথা সকল দেশের পক্ষেই সত্য, আমাদের মতো দেশের পক্ষেও। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মূল গলদটা ছিল এই যে তারা কৃষকদের মধ্যে যেই ধরনের সংগ্রাম সৃষ্টি করে তুলতে চেয়েছিলেন, সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া তার পক্ষে একেবারেই অনুকূল ছিল না। প্রদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় স্বাধীন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তখনও খুবই আশাবাদী। মুসলিম লিগের নেতাদের সম্পর্কে তখনও তাদের মোহভঙ্গ ঘটেনি। কাজেই এই শিশু রাষ্ট্রে যারা কোনোরকম অশান্তি বা উপদ্রবের সৃষ্টি করে তুলে সরকারকে কাজ করবার সুযোগ দেয় না তারা কার্যত রাষ্ট্রের শত্রু। এরা তাদের পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলতে চায়। মুসলিম লিগের নেতারা এইভাবেই তাদের বোঝাচ্ছিল। অপরদিকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা সরকারের তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা ও কার্যকলাপের ফলে আশা ও মনোবল হারিয়ে কোনোমতে দিনগত পাপক্ষয় করে চলছিল। সরকারের অবিচার, অনাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবার মতো সাহস তাদের ছিল না। এই স্বাস্তব অবস্থার মধ্যে কোনো সার্থক শক্তিশালী শ্রেণি-সংগ্রাম বা গণ-বিদ্রোহ সৃষ্টি করে তোলার কল্পনাটা একেবারেই অবাস্তব।

তাই সেদিনকার প্রতিকূল পরিবেশে নাচোলের কৃষকদের এই ধরনের অভ্যুত্থান দুদিন বাদেই ভেঙে পড়তে বাধ্য, ভেঙে পড়েও ছিল। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান যত ক্ষণস্থায়ীই হোক না কেন, তার মধ্য দিয়ে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে যে বৈপ্লবিক উদ্যোগ ও সংগঠনি শক্তি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জেগে উঠেছিল, তা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না। সাধারণ সময়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমরা যা কিছুতেই আশা করতে পারি না, গণ-অভ্যুত্থানের সময় কে জানে কেমন করে সেই অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়। সেদিক থেকে নাচোলের কৃষকদের এই অভ্যূত্থান যে কোনো বিপ্লবী পার্টির বা যে কোনো বিপ্লবী চরিত্রের পক্ষে শিক্ষা ও প্রেরণা লাভের এক অমূল্য উৎস।

এই কাহিনি বলতে বলতে এই আন্দোলনের জনৈক ও বিশিষ্ট নেতা বলছিলেন, সেই বিদ্যুৎগর্ভ দিনগুলি আমার কাছে চির-উজ্জ্বল হয়ে আছে, কোনোদিন ভুলতে পারব না। আমরা কজন ছিলাম সেই অভ্যুত্থানের নেতা, একথা তারাও জানত আমরাও জানতাম। কিন্তু আমাদের নির্দেশ ছাড়াই সমস্ত অঞ্চল জুড়ে এমন দ্রুতগতিতে আর এমন সুশৃঙ্খলভাবে কাজ কর্ম চলেছিল যে তা দেখে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকত না। কি করে কি হচ্ছে, সত্যিকথা বলতে গেলে আমরা তা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারতাম না! হাজার হাজার ভলান্টিয়ার যেন আপনা থেকেই গজিয়ে উঠেছে। তারা তির ধনুক, বল্লম ইত্যাদি হাতিয়ারে সুসজ্জিত হয়ে গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে ফিরত, তাদের দেখে মানুষের মনবল বহুগুণে বেড়ে যেত। তারা প্রতিটি ইউনিয়নে, প্রতিটি গ্রামে কাজকর্মের তদারক করে ফিরত, প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে যোগ রক্ষা করে চলত। দেখে মনে হত এই অঞ্চল যেন সত্য সত্যই তাদের স্বদেশ, এখানকার প্রশাসন কার্যের ভার তাদের উপরেই পড়েছে, আর তারা সুশৃঙ্খলভাবে সেই দায়িত্ব পালন করে চলছে।

আমরা নেতা, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হত এই সমস্ত ঘটনা যেন আমাদের মাথা ডিঙিয়ে ঘটে চলেছে। চণ্ডীপুর ছিল আমাদের মূল কেন্দ্র বা সদর দফতর। প্রতিদিন দুবেলা সেখানে চার-পাঁচশত ভলান্টিয়ার খাওয়া দাওয়া করত। একি সহজ কথা! এই ব্যয়বহুল কাজ কেমন করে চলছে? অবাক হয়ে ভাবতাম, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হত না। এমন কাজের ব্যাপারে কেউ আমাদের কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে আসত না। সমস্ত কাজ যেন আপনা থেকেই নিজস্ব গতিতে চলতে থাকত। এই কথাটা নিয়ে অনেক ভেবেছি, আর মনে মনে এই উত্তর পেয়েছি যে, সেই রোমাঞ্চকর ঘটনাবহুল পরিবেশে নেতৃত্ব উদ্যোগ আর সংগঠনি শক্তি তাদের নিজেদের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসছিল। তার ফলে এসব ব্যাপারে যা করবার তারা নিজেরাই করত, নির্দেশের জন্য আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হত না। যৌথ নেতৃত্ব কাকে বলে, এই অভ্যুত্থানে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই আমি সর্বপ্রথম তার সার্থক পরিচয় পেয়েছি।

কিছুদিন পর্যন্ত এই ঘটনা প্রবাহ অবাধে বয়ে চলেছিল। কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলতে পারে না। এখানকার রিপোর্ট পেয়ে সরকারি মহল সচকিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অবস্থাটার গুরুত্ব তখনও তারা ভালো করে বুঝে উঠতে পারেনি। এখানকার অবস্থা সঠিকভাবে জানতে পারলে মাত্র পাঁচজন পুলিশ আর একজন দারোগাকে পাঠিয়ে এখানকার সংঘবদ্ধ ও সশস্ত্র জনতার শক্তি পরীক্ষা করতে চাইত না। পুলিশদের প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল ছিল। এই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসতে দেখে সাঁওতাল কৃষকরা উত্তেজনায় আগুন হয়ে উঠল। দীর্ঘ দিনের অনাচার আর অত্যাচারের ফলে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ এবার বিস্ফোরণমুখী হয়ে উঠল। প্রথমে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে পথ করে দিল তারা। এগিয়ে এল পুলিশেরা। তারা বুঝতে পারেনি যে তারা এক বাঘের গুহার মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে। হঠাৎ পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল, তারা চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে গিয়েছে, বেরোবার পথ নেই। এবার শুরু হল সংঘর্ষ। তারা মরিয়া হয়ে গুলিবর্ষণ করে চলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না, সেই সংঘর্ষের ফলে পাঁচজন পুলিশ আর একজন দারোগা সবাই মারা পড়ল।

এই ঘটনার পরেই নাচোল কৃষক বিদ্রোহের সর্বশেষ অধ্যায় উন্মোচিত হয়ে গেল। ঘটনা দ্রুত গতিতে ঘটে চলল। পুলিশদের হত্যার সংবাদ সরকার অনেকদিন পর্যন্ত পায়নি। তবে এই ঘটনার পরেই এই সংবাদটা তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল যে যেই পাঁচজন পুলিশ ও একজন দারোগা বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে গিয়েছিল, তারা আর ফিরে আসেনি। এর তাৎপর্যটা অনুমান করা কঠিন নয়। সঙ্গে সঙ্গেই উর্ধ্বতন সরকারি মহল তৎপর আর সক্রিয় হয়ে উঠল। এবার আর পুলিশ নয়, বহু সশস্ত্র সৈন্য আমনুরা স্টেশনে নামল। বহু সৈন্য, তবে সৈন্য সংখ্যা কত তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। কেউ বলে এক হাজার, কেউ বলে দু হাজার, কেউ বলে তার চেয়েও বেশি। রীতিমতো যুদ্ধের জন্য তারা আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে এসেছে।

আমনুরা স্টেশন নাচোল থেকে আট মাইল দূরে। সৈন্যেরা দ্রুত গতিতে নাচোলের দিকে ছুটে চলল। কার সঙ্গে যুদ্ধ করবে তারা, প্রতিপক্ষের সৈন্যেরা কোথায়, এই প্রশ্ন নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। তারা আগে থাকতেই জেনে এসেছিল, এখানকার প্রতিটি লোক তাদের শত্রু, এখানকার প্রতিটি লোকের সঙ্গেই তাদের লড়াই, এখানে ছোটো, বড়ো, নারী-পুরুষ যাকে পাবে তাকেই তারা নির্বিচারে হত্যা করবে। তারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে লাগল, যাকে সামনে পেল তাকেই মারল। ভলান্টিয়াররা তাদের প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। বর্শা, বল্লম ও তীর ধনুক দিয়ে কি আর মেশিনগান ও রাইফেলের বিরুদ্ধে লড়াই করা চলে। কিন্তু সেই ব্যর্থ চেষ্টাই তারা করেছিল এবং সেজন্য তাদের যথেষ্ট মূল্যও দিতে হয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম ওরা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে লাগল। কত মানুষ যে মারল, তার হিসাব কে রাখে! যারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিল, তারা দেখেছে, পথে ঘাটে কত মৃতদেহ পড়ে আছে! যারা জখম হয়ে পড়ে ছিল, তাদেরও সেই একই গতি। সেই দুঃসময় কে তাদের শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে তুলবে!

আক্রমণটা বিশেষভাবে সাঁওতালদের উপরে। তারাই ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রধান শিকার। তাদের মেহনতে এখানকার জমিতে সোনার ফসল ফলত, এই দেশের এই মাটির বুকে তাদের ঠাঁই হল না। তাদের মধ্যে একদল জীবন দিল, আর একদল জীবন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাল। যুগে যুগে দেশে দেশে এমন ঘটনা কতই না ঘটে! ইতিহাস থেকে থেকে একই অধ্যায় আর একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। এই মর্মান্তিক অধ্যায়ের শেষ হবে কবে?

সেই সমস্ত হিংস্র জন্তুগুলির হাত থেকে বাঁচবার জন্য যে যেদিক দিয়ে পারে পালিয়ে যাচ্ছিল। কোথাও একক ও বিচ্ছিন্নভাবে, কোথাও বা দলবদ্ধ হয়ে। সকলেরই লক্ষ্য বর্ডারের দিকে। বর্ডার ছাড়িয়ে ভারতের সীমানায় গিয়ে পড়তে পারলে আপাতত নিরাপদ। তারপর? তারপর কার অদৃষ্টে কি আছে কে জানে! সেই সময় রমেন আর ইলা বিভিন্ন এলাকায় ছিলেন। এই দুর্যোগের মুখে তারা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পাননি। কয়েক শ জঙ্গি সাঁওতাল রমেন আর মাতলা সর্দারকে ঘিরে নিয়ে বর্ডারের দিকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছিল। স্বয়ং মাতলা সর্দার ছিলেন তাদের পথ-প্রদর্শক। এ অবস্থায় কোন পথ সব চেয়ে নিরাপদ, সে বিষয়ে মাতলা সর্দার ছিলেন সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বে এই দল নিরাপদে বর্ডারের ওপারে চলে গেল।

নিরাপদে চলে এলেন বটে, কিন্তু এপারে এসে মাতলা সর্দার কপালে করাঘাত করে হায় হায় করে বিলাপ করতে লাগলেন। আন্দোলনের মূল কেন্দ্র তাদের গ্রাম চণ্ডীপুরে। সেই গ্রামটার উপর ওদের আক্রোশ সব চেয়ে বেশি। এমন অতর্কিতে সেই গ্রামের উপর এমন আক্রমণ করেছিল যে, খুব কম লোকেই সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। তার ভাই, ভাই-পো এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে প্রায় সবাই মারা গেছে। কিন্তু সে জন্য কাঁদছেন না তিনি। তার বিলাপের মধ্য থেকে একটা কথাই বার বার শোনা যাচ্ছে, রাণীমা? রাণীমা এখনও এলেন না কেন? তারা সেই কখন এসে পৌঁছে গেছেন, কিন্তু রাণীমা? রাণীমা এখনও এলেন না কেন? আর তিনি কখন আসবেন? আর কি তিনি আসতে পারবেন? তাদের এ পারের কমরেডরা বর্ডার-ঘেঁষা সমস্ত অঞ্চলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে কিন্তু কোথাও তাদের সন্ধান মেলেনি। তবে? তবে তিনি কোথায়? তিনি কি তবে শত্রুদের হাতে ধরা পড়েছেন? শুধু কি মাতলা সর্দার, যে সমস্ত সাঁওতালরা বর্ডার পেরিয়ে এ পারে চলে এসেছে তাদের সবার মুখে এই একই প্রশ্ন, সবার কণ্ঠে এই একই বিলাপ, রাণীমা? রাণীমা কোথায়? তাদের নয়নের মণি, তাদের হৃদয়ের বল রাণীমাকে হারিয়ে তারা কেমন করে বাঁচবে! এখনও এলেন না রাণীমা, তবে কি তিনি শত্রুদের হাতে ধরা পড়েছেন!

শেষ পর্যন্ত তাদের সেই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল। প্রথমে ভাসা-ভাসা, পরে পাকা খবর পাওয়া গেল, ইলা মিত্র সত্যসত্যই ধরা পড়েছেন। ইলা মিত্র আর কয়েকজন বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় কর্মী তিন-চার শ জঙ্গি সাঁওতাল কর্মীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে বর্ডার পার হবার জন্য এগিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে পথ দেখিয়ে নেবার মতো উপযুক্ত লোক ছিল না। তার ফলেই সর্বনাশটা ঘটল। তারা চলতে চলতে যেই জায়গাটা সব চেয়ে বিপজ্জনক সেই রহমানপুর স্টেশনের কাছে গিয়ে পৌঁছোলেন। তার কাছেই ছিল সৈন্যদের ছাউনি। তাদের দেখতে পেয়ে সৈন্যরা এসে তাদের ঘেরাও করে ফেলল।

এই দলের একটি লোককেও তারা ছেড়ে দেয়নি। তারা প্রথমত তাদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের সনাক্ত করে বার করবার চেষ্টা করল। ইতিমধ্যে রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, মাতলা সরদার এবং আরও কয়েকজনের নামে হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। এদের মধ্য থেকে তাদের কয়েকজনকে পাওয়া গেল। ইলা মিত্র সাঁওতাল মেয়ের মতো পোশাক পরেছিলেন, সাঁওতালি ভাষায় কথা বলছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওদের কাছে ধরা পড়ে যেতে হল তাঁকে।

এবার যা ঘটল, তা ইলা মিত্রের ভাষায় বলি:

ওরা প্রথম থেকেই নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করল। শুধু আমাকে নয়, আমাদের সবাইকেই। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে এল নাচোলে। আমি মারপিটের ফলে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম, আমার সর্বাঙ্গে বেদনা। ওরা আমাকে একটা ঘরের বারান্দায় বসিয়ে রাখল। আমাদের সঙ্গে যে সকল সাঁওতাল কর্মীরা ছিল, আমার চোখের সামনে তাদের সবাইকে জড় করে তাদের উপর বর্বরের মতো মারপিট করে চলল। আমি যাতে নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখতে পাই, সেজন্যই আমাকে তাদের সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

ওরা তাদের মারতে মারতে একটা কথাই বার বার বলছিল, আমরা তোদের মুখ থেকে এই একটা কথাই শুনতে চাই, বল, ইলা মিত্র নিজেই পুলিশদের হত্যা করবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। এই কথাটুকু বললেই তোদের ছেড়ে দেব। কিন্তু যতক্ষণ না বলবি, এই মার চলতেই থাকবে। মারতে মারতে মেরে ফেলব, তার আগে আমরা থামব না।

কথাটা তারা যে শুধু ভয় দেখাবার জন্য বলছিল, তা নয়, তারা মুখে যা বলছিল, কাজেও তাই করছিল। ও সে কি দৃশ্য! আর সেই দৃশ্য আমাকে চোখ মেলে দেখতে হচ্ছিল। এ কি শাস্তি! কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই হিংস্র পশুর দল আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে। রক্তে ওদের গা ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কারু মুখে কোনো শব্দ নাই, একটু কাতরোক্তি পর্যন্ত না। ওরা নিঃশব্দ হয়ে ছিল, কিন্তু দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললাম আমি। এই দৃশ্য আমি আর সইতে পারছিলাম না। মনে মনে কামনা করেছিলাম, আমি যেন অজ্ঞান হয়ে যাই। কিন্তু তা হল না, আমাকে সজ্ঞান অবস্থাতেই সব কিছু দেখতে হচ্ছিল, কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না, এত দুঃখের মধ্যেও আমাদের এই বীর কমরেডদের জন্য গর্বে ও গৌরবে আমার বুক ভরে উঠেছিল। একজন নয়, দুজন নয়, প্রতিটি মানুষ মুখ বুজে নিঃশব্দ হয়ে আছে, এত মার মেরেও ওরা তাদের মুখ খোলাতে পারছে না। এমন কি করে হয়! এমন যে হতে পারত এ তো আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

মনে মনে একটা কথা আবৃত্তি করে চলেছিলাম, হে বীর সাথিরা আমার, তোমাদের কাছ থেকে যে শিক্ষা আমি আজ নিলাম, তা যেন আমার বেলায় কাজে লাগাতে পারি। আমার উপর অত্যাচার এই তো সবে শুরু হয়েছে। আমি জানি, এর পর বহু অত্যাচার আর লাঞ্ছনা আমার উপর নেমে আসবে। সেই অগ্নি-পরীক্ষার সময়, হে আমার বীর সাথিরা, আমি যেন তোমাদের এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিঃশব্দে মুখ বুজে থাকতে পারি। আর যদি মরতেই হয়, যেন অমনি নিঃশব্দে মরে যেতে পারি।

প্রচণ্ড তর্জনগর্জনের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম, চেয়ে দেখি, হয়েককে দলের মধ্য থেকে মারতে মারতে বার করে নিয়ে আসছে। ওদের মুখে সেই একই প্রশ্ন, বল, ইলা মিত্র সেই পুলিশদের হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিল। না বললে মেরে ফেলব, একদম মেরে ফেলব। আমি চেয়ে আছি হয়েকের মুখের দিকে। অদ্ভুত ভাববিকারহীন একখানি মুখ। অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে আছে। ওদের এত সব কথা যেন তার কানেই যাচ্ছে না। ক্ষেপে উঠল ওরা। কয়েকজন মিলে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। তারপর ওরা ওদের মিলিটারি বুট দিয়ে তার পেটে বুকে সজোরে লাথি মেরে চলল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, হয়েকের মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তারপর তার উপর ওরা আরও কতক্ষণ দাপাদাপি করল। একটু বাদেই এক খণ্ড কাঠের মতো স্থির হয়ে পড়ে রইল হয়েক। ওদের মধ্যে একজন তাকে নেড়ে চেড়ে দেখে বলল, ছেড়ে দাও, ওর হয়ে গেছে। এই বলে ওরা আর একজনকে নিয়ে পড়ল।

মরে গেছে। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হয়েক। অনেক দিন আগেকার পুরানো একটা কথা মনে পড়ে গেল। একদিন হয়েককে পার্টির একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই কাজের সময় তার দেখা মেলেনি। এজন্য কৈফিয়ত চাইলে পরে সে বলেছিল, তার গরুটা হারিয়ে যাওয়ায় সে তাকে খোঁজ করতে বেরিয়েছিল। সেই জন্যই সে সময় মতো উপস্থিত থাকতে পারেনি। বলা বাহুল্য, তার এই কৈফিয়তে কেউ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এজন্য অনেকের সামনে তাকে তিরষ্কার শুনতে হয়েছিল। তার পর থেকে তার উপর কোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার দেওয়া হত না। এটা বুঝতে পেরেছিল হয়েক। এই নিয়ে সে একদিন অভিমান-ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিল, আমাকে কি মনে করেন আপনারা? জানেন, প্রয়োজন হলে পার্টির জন্য আমি জীবন দিতে পারি? এই ধরনের বাগাড়ম্বর অনেকেই করে। তার এই কথায় কেউ ততটা আমল দেয়নি। কিন্তু আজ? আজ হয়েক তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেল, সেদিন সে যা বলেছিল, তা বাগাড়ম্বর নয়, অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হয়েক। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। একটু আগেই আমি কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সমস্ত কান্না শুকিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে ভিতর থেকে প্রচণ্ড একটা জিদ মাথা তুলে জেগে উঠছে। আমার মন বলে চলেছে, মারুক, মারুক, ওরা আমাকেও এমনি করে মারুক। আর মনে হচ্ছে, এই যে আমাদের কয়েক শ সাথি, এদের মধ্যে কাউকে দিয়ে ওরা কথা বলাতে পারবে না। কিছুতেই না। ওদের হার হয়েছে। ওদের হার মানতে হবে।


এর পর ইলা মিত্রকে নবাবগঞ্জ থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পনেরো দিন ধরে তার উপর বীভৎস অত্যাচার চালানো হয়েছিল। কিন্তু সেই কাহিনি এখন নয়, তিনি আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের সামনে যেই বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেই কাহিনি তার মধ্যেই পাওয়া যাবে। তবে সেই অগ্নি-পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি বিজয়িনীর বেশে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। মানুষ নামধারী সেই পশুগুলি বহু অত্যাচার করেও তার মুখ থেকে একটি কথাও বার করে নিতে পারেনি।

নাচোল কৃষক বিদ্রোহের এই সর্বশেষ পরিণতি বড়ই মর্মান্তিক, কিন্তু গৌরবময়। ওরা ওদের মামলা সাজাবার উদ্দেশ্যে স্বীকারোক্তি আদায় করবার জন্য শত সাঁওতাল কৃষকের উপর দিনের পর দিন ধরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। কত লোককে মারতে মারতে মেরে ফেলেছে, কিন্তু ওদের মুখ থেকে একটি কথাও বার করতে পারেনি। তারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নির্বাক থেকে গেছে। ওরা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভেঙে-চুরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তবু তারা কোনো কথা বলেনি। কি করে এই তীব্র যন্ত্রণা নিঃশব্দে সহ্য করতে হয়, একজন নয়, দুজন নয়, তাদের মধ্যে বহু লোক আমাদের সামনে তার দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। এত কিছু করেও ওরা তাদের মধ্য থেকে একটি রাজসাক্ষীকেও দাঁড় করাতে পারেনি। ওরা এদের কাছে হার মেনে গেছে। এই বীরদের স্মৃতি যেন আমরা ভুলে না যাই, এই ইতিহাস আমরা যেন হারিয়ে না ফেলি।

নবাবগঞ্জ থানার সেই বিভীষিকাময় পনেরো দিন অতিক্রান্ত হবার পর ইলা মিত্রকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হল। অত্যাচারের ফলে তখন তিনি চলচ্ছক্তিহীন, শয্যাশায়ী। সেই সময় কয়েক শত সাঁওতাল কৃষককে রাজশাহী জেলের হাজতে এনে আটক করা হয়েছিল। তারপর মাসের পর মাস ধরে মামলার প্রহসন চলল। এই সময়ের মধ্যে সেই বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে বহুলোক এই পৃথিবীর বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই দুর্দিনে কে তাদের খোঁজ নিবে! বিচারাধীন বন্দিদের এভাবে গুম করে ফেলার জন্য কে চাইবে কৈফিয়ত সরকারের কাছে! কার এমন দুঃসাহস। তা ছাড়া এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, এই বিদ্রোহের প্রথম থেকে তার শেষ পরিণতি পর্যন্ত কোনো সংবাদ পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে পারেনি। দেশ-বিদেশের মানুষ এ সম্পর্কে কোনো কথাই জানল না। এই যবনিকার অন্তরালে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী পাকিস্তান সরকার তার যা ইচ্ছা তা-ই করে চলেছিল এবং তাদের এই কুকীর্তির ইতিহাসকে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই মামলা পরিচালনার সাথে সাথে সেই চাপা দেওয়া খবরগুলি একটু একটু করে লোকের কাছে প্রকাশিত হতে লাগল! অবশ্য সেই মামলার বিবরণী, এমন কি মামলার প্রধান আসামি ইলা মিত্রের সেই লোমহর্ষক বিবৃতিটিও কোনো পত্রিকায় স্থান পায়নি। পূর্ব বাংলার বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টি সেদিন এই বিবৃতি নিয়ে হাজার হাজার ইস্তাহার ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার ফলেই সভ্য বলে পরিচিত পাকিস্তান সরকারের সেই বীভৎস অত্যাচারের কাহিনি সর্বপ্রথম লোক-নয়নের সামনে এসে পড়ল। সেই সময় থেকে দীর্ঘ এগারো মাস কাল তাঁকে এক নির্জন সেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেই সেলে আলো-প্রবেশের জন্য যেই পথটুকু ছিল, সরকারের সুবিবেচনায় সেই পথটিকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে সেই শয্যাশায়ী রোগিণীকে সেই নির্জন আর অন্ধকার সেলের মধ্যে এগারো মাস কাল ধরে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে চলে আসতে হয়েছে।

মামলার তারিখ এগিয়ে আসছিল। আসামির জবানবন্দি দিতে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি কি বলবেন না বলবেন, তাই নিয়ে তাঁকে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছে। তার উপরে এ এক বিরাট দায়িত্ব। অথচ পাশে এমন একটি লোক নাই, যার সঙ্গে তিনি এই বিষয়ে একটু পরামর্শ করতে পারেন। এ সম্পর্কে তাঁর যেটা করণীয় তা সম্পূর্ণভাবে নিজ দায়িত্বে করতে হবে। এই সংকট-মুহূর্তে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে একটা গোপন-বার্তা তাঁর হাতে এসে পৌঁছোল। সে সময় সেই জেলের ফটকে বরিশালের মনোরমা বসু (মাসিমা), খুলনার ভাণু দেবী প্রভৃতি কয়েকজন রাজবন্দিনী ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে ছোট্ট এক টুকরো চিঠি গোপন পথে তাঁর হাতে এসে গেল। সেই চিঠিতে যা লেখা ছিল, তার মর্ম এই: পাকিস্তান সরকারের চরিত্র উদ্‌ঘাটন করে দেবার পক্ষে এইটাই সব চেয়ে বড় সুযোগ। আপনি এই সুযোগ কিছুতেই নষ্ট করবেন না। আদালতে আপনার জবানবন্দি দেবার সময়, আপনার যত কিছু অত্যাচার হয়েছে, আপনি তার সব কথা পরিষ্কারভাবে খুলে বলবেন। মেয়েদের সংস্কার ও লজ্জা যেন আপনাকে সেই সত্য কথাগুলি স্পষ্ট ভাষায় বলতে কোনোরকম বাধা দিতে না পারে। সেদিন তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে মন স্থির করার ব্যাপারে এই চিঠিখানি তাঁর পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। তাঁর সেই বিবৃতির মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি যে তিনি সেই সত্য কথাগুলিকে সমস্ত দেশবাসীর সামনে, সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে পরিষ্কারভাবে বলতে পেরেছেন।

আসামিদের পক্ষ সমর্থন করবার মতো সাহসী উকিল সে সময় ছিল দুর্লভ। এমন এক গুরুতর মামলায় আসামিদের পক্ষ সমর্থন করতে গেলে স্বৈরাচারী সরকারের বিষ নজরে পড়তে হবে, এই আশঙ্কা অনেকের মনেই ছিল। এই দুঃসময়ে আসামিদের পক্ষে দাঁড়াবার জন্য নির্ভয়ে এগিয়ে এলেন কুমিল্লার স্বনামধন্য নেতা কামিনী দত্ত। এই প্রথম নয়, ব্রিটিশ আমল থেকে এই স্বাধীনতার আমল পর্যন্ত বহুবারই তিনি আদালতের মধ্যে সংগ্রামী কৃষকদের পক্ষ হয়ে লড়াই করে এসেছেন। এই ব্যাপারে তিনি কোনোদিনই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি।

এই মামলায় আসামিদের প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। পরে আপিলে এই দণ্ড কমে গিয়ে তাঁদের সব কজন দশ বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইলামিত্র যেই বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁর অনুলিপি যথাযথভাবে দেওয়া হল:

কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

বিগত ৭-১-৫০ তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোলে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধোর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সব কিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে এই বলে এস. আই. আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মতো কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে। আমাকে কোনো খাবার দেওয়া হয়নি, একবিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যে বেলাতে এস. আই-এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময়ে আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর আমার কাপড়-চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবত এস. আই.-এর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিন্ত ছিলাম না।

যে কামরাটিতে আমায় নিয়ে যাওয়া হল সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাল। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিল এবং সে সময়ে চারিধারে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা বলছিল যে আমাকে ‘পাকিস্তানি ইনজেকশন’ দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময়ে তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিল। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলেছিল। সিপাইরা আমাকে ধরা ধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেল কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিল না। সেলের মধ্যে আবার এস. আই সেপাইদেরকে চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল এবং বলল, ‘এবার সে কথা বলবে।’ তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিৎ করে শুইয়ে রাখল এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।

৯-১-৫০ তারিখে সকালে যখন আমার জ্ঞান হল তখন উপরোক্ত এস. আই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুটে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করল। এরপর আমার ডান পায়ের গোড়ালীতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হল। সে সময়ে আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এস. আইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম: আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এস. আই এবং সিপাইরা ফিরে এল এবং তারা আবার সেই হুমকি দিল। কিন্তু আমি যেহেতু তখনও কিছু বলতে রাজি হলাম না তখন তিন-চারজন আমাকে ধরে রাখল এবং একজন সেপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করল। এর অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।

পরদিন ১০-১-৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে, আর আমার কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হল। নবাবগঞ্জ জেলে গেটের সিপাইরা জোর ঘুঁষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল।

সে সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটি সেলের মধ্যে বহন করে নিয়ে গেল। তখনও আমার রক্তপাত হচ্ছিল এবং খুব বেশি জ্বর ছিল। সম্ভবত নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় আমার জ্বর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রি। যখন তিনি আমার কাছে আমার দারুণ রক্তপাতের কথা শুনলেন তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরো কম্বলও দেওয়া হল।

১১-১-৫০ তারিখে সরকারি হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেটা জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিল সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হল। এই পুরো সময়টা আমি নবাবগঞ্জ জেলের একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশি জ্বর ছিল, তখন আমার দারুণ রক্তপাত হচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।

১৬-১-৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হল এবং আমাকে বলা হল যে পরীক্ষার জন্যে আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশি শরীর খারাপ থাকার জন্যে আমার নড়াচড়া সম্ভব নয় একথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হল এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এরপর আমাকে অন্য এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। আমি সেখানে কিছুই বলিনি, কিন্তু সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে আমার সই আদায় করল। তখন আমি আধা অচেতন অবস্থায় খুব বেশি জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল সে জন্যে পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হল। এরপর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হল তখন আমাকে ২১-১-৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানে জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হল।

কোনো অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং উপরে যা বলেছি তার বেশি আমার আর

বলার কিছু নেই।

[ কৃতজ্ঞতা : বাংলা একাডেমি ঢাকা ] 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান