নানকার বিদ্রোহ

শঙ্কর ভুঁইয়া

ভূমিকা

বাংলাদেশের সিলেট জেলায় ‘নানকার’ শব্দটির সঙ্গে সাধারণ পরিচিতি থাকলেও, সর্বত্র তেমনভাবে পরিচিতি ঘটেনি। ‘নানকার’ হল মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী আমলের একটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা। নানকার প্রথাকে প্রকৃতপক্ষে দাসপ্রথা বললেও খুব একটা ভুল হবে না। ইতিহাসের পাতায় বর্ণিত দাসদের জীবনের সাথে নানকার-জীবনের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দাসত্ব-প্রথায় যেভাবে দাসদের জীবন দাস-মালিকের সম্মতির উপরে নির্ভর করত, তেমনি নানকারের অস্তিত্ব এ-যুগের জমির মালিক জমিদারদের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতপক্ষে নানকার-প্রথা যেন অতীতের দাসত্ব-প্রথারই নতুন রূপ। শুধুমাত্র বাংলাদেশের সিলেট জেলায় নয়, ভারতের অন্যান্য অনেক জায়গায়ও নানকার প্রথার মতো অনেক মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়নি। নানকার প্রথার উৎপত্তিকাল মোগল আমল বলে ধরে নিলেও তার আগে যে এমন কোনও প্রথা এদেশে বর্তমান ছিল না, এমনটি মনে করার কারণ নেই। ‘নান’ কিন্তু কোনও বাংলা শব্দ নয়। এটি হল একটি উর্দু ভাষার শব্দ। ‘নান’ শব্দের অর্থ হল ‘রুটি’। রুটি অর্থে নান শব্দ থেকেই নানকার শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। তবে জমিদারদের দ্বারা কৃষকের শ্রমকে লুণ্ঠন করার এক কৌশল ছিল এই নানকার প্রথা। নানকার প্রথা হল এমন এক ধরনের ব্যবস্থা যেখানে নানকাররা শুধুমাত্র খোরাকের বিনিময়ে জমিদারের জমিতে শ্রম দিতে বাধ্য থাকত। এখানে নগদ মুদ্রা অথবা প্রজার আপৎকালীন কোনও দায়িত্ব জমিদারের ছিল না। তবে এই বিদ্রোহ উদ্ভবের পেছনে জমিদারদের দ্বারা নানকারদের উপরে অত্যাচারের এক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ১৫-১৬) 

নানকার-প্রথার ধরন

নানকার-প্রথা ছিল সম্পূর্ণরূপে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানকার প্রজাদের স্বাধীনতা ছিল না বললেই চলে। জমির ক্রয় বিক্রয় এবং হস্তান্তরের অধিকার ছিল না প্রজাদের, এমনকি জমিতে কোনোরকম ফসলের বাগান করে ভোগ করার অধিকারও সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল। জমিতে উৎপাদিত যে-কোনও ধরনের মূল্যবান কাঠ বা শস্যের উপরে জমিদারদের অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হত। জমিতে উৎপাদিত ফসল যথাসময়ে জমিদারদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব ছিল এই প্রজাদের। তবে নানকার-প্রজার অধিকার শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ ছিল ভিটার মাটিতে। ভিটার মাটিতে উৎপাদিত স্বল্প শস্যের উপরে নির্ভর করে তাদের বেঁচে থাকতে হত, কিন্তু নানজমিতে নানকার-প্রজার অধিকার আইনত ও বাস্তবিক রূপে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল। জমিজমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানকার প্রজাদের উপরে প্রবল নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে, প্রজাদের জীবনযাত্রা এক প্রকার দারিদ্রতার মধ্যেই কাটাতে হত। একদিকে প্রজাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন ছিল, অন্যদিকে আপৎকালীন সময়ে নির্ভরশীল হবার মতো কোনও কিছু থাকত না তাদের কাছে। ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত ছিল। মূলধনের অভাব, জীবন জীবিকার প্রবল অনিশ্চয়তা এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাবের কারণে, কৃষিকাজে পণ্য উৎপাদন ছিল নামমাত্রই। জমিদাররা নানকার প্রজাদের খোরাকির উদ্দেশ্যে যেটুকু জমি জমা বরাদ্দ করতেন তার উপরেই নির্ভর করে জীবন জীবিকা পরিচালনা করতে বাধ্য হত। উৎপাদিত শস্যে নানকার প্রজাদের চাহিদা মেটানোও অত্যন্ত কঠিন ছিল।

তবে, নানকার প্রজার জীবন এবং শ্রমের উপরে জমিদারের সীমাহীন অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। জমিদারের প্রয়োজনে নানকারদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হত। জমিদারদের প্রয়োজনের কোনও সময়সীমা নির্ধারিত ছিল না। নানকার প্রজারা কোনোরকম কোনও অজুহাতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। এইভাবে জমিদার নানকার প্রজাদেরকে সারা বছর ছুটিয়ে বেড়াবার অধিকারী। যে-কোনও কাজে প্রজাকে নিয়োগ করার সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় জমিদারের হাতে। সুতরাং নানকার প্রজার প্রভুই হল এই জমিদার। নানকার প্রজারা পারিবারিক ব্যক্তিগত কারণে, কখনোই জমিদারের হুকুম অস্বীকার করতে পারত না। এমনকি আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতেও এমন হুকুম পালন না করাকে কারণ হিসেবে গ্রাহ্য করতে জমিদার বাধ্য ছিল না। তবে জমিদার ভেদে এই কারণগুলি একেবারেই গ্রহণযোগ্য যে হত না তা কিন্তু নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমিদারদের চরম হৃদয়হীনতার নজির কম ছিল না। 

প্রকৃতপক্ষে, নানকার প্রজাদের ঘরের খেয়ে জমিদারের বেকার খাটতে হত। জমিদাররা শুধুমাত্র নানকার প্রজাদের খোরাকির উদ্দেশ্যে জমিজমা বরাদ্দ করে দিয়েই সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতেন। প্রজাদের নগদ মজুরির কোনও প্রশ্নই ছিল না। এমনকি নানকাররা জমিদারের জমিতে কাজের সময়ে যে পান, চুন এবং তামাক ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন তাও তাদেরকে নিজের ঘর থেকেই নিয়ে আসতে হত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর তারতম্য ঘটলেও তা কিছু বাধ্যতামূলক রীতি বলে গ্রহণ করা যায় না। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ১৮-১৯) জমিদারের জমিতে বেগার খাটা, শুধুমাত্র পুরুষদেরই ব্যাপার নয়। নানকার প্রজাদের পরিবারের মহিলা এবং বালক বালিকাদেরকেও এর থেকে রেহাই ছিল না। এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু এবং প্রান্তিক মহিলাদের ও জমিদারের হুকুম অমান্য করার সাহস ছিল না। নানকার রমণীদের উপরে কাজের সাথে সাথে অনেক অসম্মানের অমর্যাদার ঘটনা ও ঘটত। নানকার প্রজাদের কাজের সময়, পরিমাণ এবং মর্যাদার কোনও মাপকাঠি ছিল না, জমিদারদের চোখে সবাই সমান ছিল। নানকার প্রজাদের এক প্রকার গোলাম বলেই বিবেচনা করা হত। জমিদাররা নানকারদের সঙ্গে আদিম যুগের দাসদের মতোই ব্যবহার করত। জমিদার পরিবারের সাথে নানকার পরিবারের মধ্যেকার সম্পর্ক ছিল অনেকখানি দাসত্ব প্রথায় দাস ও প্রভুর সম্পর্কের মতোই। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ১৯) 

নানকার-প্রজাদের পরিণতি

নানকার প্রজারা এক প্রকার বাধ্য থাকতেন জমিদারদের জমিতে গোলামি খাটতে। এটি ছিল এক প্রকার বাধ্যতামূলক ও অপমানজনক। নানকারদের এই ধরনের কাজে নিয়োগের ফলে, তাদের নিজেদের আপন আপন সমাজে তারা ছিলেন মর্যাদাহীন। আপন খণ্ড সমাজেও নানকার এবং অ-নানকারের মধ্যে বিভেদ রেখা স্পষ্ট ছিল। একদিকে নানকাররা জমিদারের কাছে সম্পূর্ণভাবে মর্যাদাহীন ছিল অন্যদিকে নিজ সমাজ ব্যবস্থাতেও অ-নানকারদের কাছে ছিল গুরুত্বহীন। তা সত্ত্বেও জমিদার ও সমাজের অত্যাচার এবং লাঞ্ছনা স্বীকার করে নানকারকে নানকার হয়েই চলতে হত। জমিদারের হুকুম অমান্য করলে ভিটেমাটি ধরে রাখার ক্ষমতা নানকারদের ছিল না। জমিদাররা খোরাকির জন্য নানকারদেরকে যেটুকু ভিটে বরাদ্দ করত, সেটি কেড়ে নেওয়ার অধিকার ছিল জমিদারদের হাতে। কোনও জমিদার যদি তার নানকার প্রজাকে ভিটে ছাড়া করে, তাহলে সেই প্রজা নিকটবর্তী কোনও জমিদারের জমিতেই আশ্রয় পেতেন না। ফলস্বরূপ ওই নানকার প্রজার সামনে জীবন ধারণের আর কোনও পথ বা পন্থা খোলা থাকত না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই নানকার প্রজারা আত্মগোপন করত। যে সমস্ত নানকার প্রজারা ভিটেচ্যুত হতেন, তারা পার্বত্য ত্রিপুরা, আসাম অথবা অন্য কোনও অজানা অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। জমিদারদের কাছে নানকার শাসনের এগুলি ছিল খুবই সাধারণ আইন। সিলেট জেলায় এই ধরনের উৎপীড়ন ও অত্যাচারের ঘটনা প্রায়ই লক্ষ করা যেত। এই ধরনের জমিদারি শাসন ব্যবস্থায় সরকারি কোর্ট কাছারির কোনও স্থান ছিল না। জমিদারি কাছারিগুলি ছিল এক প্রকার কোর্ট কাছারি এবং জমিদার ও তার নায়েবরাই ছিল ম্যাজিস্ট্রেট-হাকিম-সুবেদার ইত্যাদি। এদের মুখের কথাই ছিল আইন। মুখের কথাতেই মামলার সমাধান হয়ে যেত। মামলার নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে কোনোরকম কোনও আপত্তি করা যেত না। এমনকি জমিদারদের রায়ের বিরুদ্ধে কেউ কোনও প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করতে পারত না। জমিদারের ইচ্ছা অনুযায়ী একমাত্র এই রায় পরিবর্তন করা সম্ভব হত। জমিদারদের বিচারের নামে এক ধরনের বিচার ব্যবস্থার মহড়া বা অভিনয় চলত। এই ধরনের বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নানকার প্রজাদের শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা হত। 

নানকারদের শাস্তির ব্যাপারে সাধারণ কিল, চড় এবং জরিমানা থেকে আরম্ভ করে বেত মারা, হাত-পা বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে রাখা এবং লোহার শিক পুড়িয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাগ দেওয়া ছাড়াও বন্ধ ঘরে অভুক্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন আটকে রাখা ইত্যাদির নিদান জুটত। এই ধরনের জমিদারি বিচারে মারতে মারতে কাউকে একেবারে মেরে ফেলা হলেও তার আত্মীয়-স্বজন ভয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে পর্যন্ত পারতেন না। কি জানি তাতে যদি আবার জমিদারের সুবিচারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ হয়ে পড়ে। কোনোরকম কারণ ছাড়াই বা তুচ্ছ কারণেই জমিদাররা নানকারদেরকে যার তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিত। এমনিভাবেই জমিদারের দাপট টিকিয়ে রাখতে নানকারদেরকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হত। কোনও প্রজা হয়তো জমিদারের খাজনা দেয়নি বা হুকুম অমান্য করেছে, অতএব তার ধান লুট করতে হবে। কেউ জমিদারকে অপমান করলে বা আর্থিক লাভের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, তার বাড়িঘর, তার পরিবারের নারী নির্যাতন, এমনকি গ্রাম পর্যন্ত তছনছ করার হুকুম হত। প্রতিপক্ষ প্রবল হলে এবং প্রকাশ্যে এমন কিছু করা সম্ভব না হলে গোপনে চুরি ডাকাতির প্রয়োজনও হতে পারে। জমিদারদের পক্ষে এই সমস্ত কাজগুলি করার প্রধান হাতিয়ার ছিল নানকার প্রজারাই। নানকার প্রজারাই একপ্রকার বাধ্য থাকতেন ওই সমস্ত কাজগুলি করতে। এমনকি জমিদাররা নানকার প্রজাদের দিয়ে স্থায়ী বাহিনী তৈরি করে রাখত। প্রয়োজন মতো ব্যবহারের জন্য প্রজাদের দিয়েই চোর ডাকাতের দল তৈরি করা হত। ফলত, জমিদারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও পথ খোলা থাকত না নানকার প্রজাদের সামনে। সিলেট জেলায় ছোটো ছোটো ভূস্বামীদের আধিক্য লক্ষ করা যায়। ভূস্বামীদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে তালুকের সীমানা এবং জমির অধিকার নিয়ে বিরোধ প্রায় লেগেই থাকত। আদালতের খরচ বাঁচাতে এবং এই সমস্যার সহজ সমাধানের পথ ছিল, নিখরচায় নানকার প্রজাকে ডেকে এনে এককে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া। ফলে, জমিদারদের উপরে এই বিরোধের কোনও প্রভাব পড়ত না কিন্তু নানকারে নানকারে লাঠির লড়াই চলত। এই ধরনের ছোটো বড়ো হাঙ্গামাতে যারা খুন জখম হতেন, তাদের প্রতি জমিদারদের বিশেষ কোনও দায়িত্ব থাকত না। সুতরাং সামন্তবাদী জমিদারি শাসন এবং শোষণ ব্যবস্থা তাদের নিজ স্বার্থে গোটা নানকার সমাজকেই প্রায় মানবিক পরিবেশের বাইরে ফেলে রাখার এক ব্যবস্থা করেছিল। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ২২-২৪) 

নানকারদের কাজের প্রকৃতি

জমিদারদের সব ধরনের হুকুম পালন করাই ছিল নানকারদের কাজ। জমিদার পরিবারের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংসারিক ও ভোগবিলাসের যে-কোনও প্রয়োজন এই প্রথার বাইরে ছিল না। জমিদাররা খেয়াল খুশি হুকুম জারি করতে পারত। ইউরোপের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রভাবে এদেশের সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটলেও, সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার শিকড়কে সম্পূর্ণরূপে উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে কৃষিজীবী সমাজ ব্যবস্থা আজও সেই প্রাচীন ধারার থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে পারেনি। গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজে কর্মভিত্তিক বংশ পরিচয় আজও স্পষ্ট। সিলেট জেলার যে সমস্ত নানকার অঞ্চলগুলোতে এই পেশা ভিত্তিক খণ্ডসমাজগুলোর যে-যে অংশ নানকার প্রথার শিকলে বাধা পড়েছিল, সেগুলি হল—

১. কিরান (মনে করা হয় কৃষাণ শব্দের অপভ্রংশ)— মুসলমান সম্প্রদায়ের গৃহকর্মী। 

২. ভান্ডারি— হিন্দু সম্প্রদায়ের গৃহকর্মী। 

৩. নমঃশূদ্র— হিন্দু সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী, বাঁশ ও বেতের গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য বাঁশ বেতের কাজ এদের পেশা। 

৪. পাটনি— হিন্দু সম্প্রদায়ের, মৎস্যজীবী ও নৌকা চালনা ইত্যাদি এদের পেশা। 

৫. মাইমল— মুসলমান সম্প্রদায়ের, মৎস্যজীবী ও নৌকা চালনা ইত্যাদি এদের পেশা। 

৬. মালাকার— এরা হলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এদের পেশা হল মাটিকাটা, পালকি বহন করা ইত্যাদি। 

৭. ঢুলি— এরা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের বাদ্যকর। 

৮. নাপিত— হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষৌরকার। 

৯. বাজনি— মুসলমান সম্প্রদায়ের বাদ্যকর ইত্যাদি। 

এছাড়াও বাংলার বাইরে থেকে অন্যান্য অনেক ভাষাভাষী শ্রমিক, যারা জমিদারের আশ্রয়ে এসে বসবাস করতেন। এদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, তাদের সবাই নানকার পর্যায়েভুক্ত হয়ে জমিদারের অধীনে বসবাস করতেন। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ২০-২১) 

বিদ্রোহের সূচনা

দীর্ঘদিন ধরে নানকার প্রজাদের পক্ষে জমিদারদের অত্যাচার সহ্য করা সম্ভবপর ছিল না। তাই নানকার প্রজারা এই অসহনীয় অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছিলেন। তবে এটি একদিনে সম্ভব ছিল না। অন্যান্য দেশে দাস-বিদ্রোহের মতো সিলেট জেলায় তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি। নানকার প্রজারা তেমনভাবে নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র পরিসরে নানকার প্রজারা জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ ক্রোধে গর্জে উঠেছে। বিক্ষিপ্তভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে নানকার প্রজাদের প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও, জমিদারদের প্রবল প্রতিরোধের সামনে অচিরেই মলিন হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে নানকার প্রথা যেন সিলেট জেলার সঙ্গে চিরন্তন হয়ে থেকে গেছে। আবার অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে তখন নানকার প্রজারা জমিদারদের বিরুদ্ধে অসম সাহসে বিদ্রোহের থেকে পিছ-পা হয়নি। এমন অসংখ্য নজির চারিপাশে ছড়িয়ে থাকলেও তা কোনও ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনি। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সিলেট জেলায় নানকার সমাজ অবশেষে তাদের ইতিহাস সৃষ্টি করে। সিলেট জেলায় এই বিদ্রোহের সময়টা ছিল ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। এরপরে নানকার প্রথা আইনত বন্ধ হলেও, প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের সামন্ত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়নি। দাসত্ব প্রথায় যেভাবে দাসদেরকে সমস্ত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হত, তেমনি দাসজীবনের মতো সমস্ত লাঞ্ছনা বয়ে নিয়েই নানকার সমাজকে শতাব্দীগুলো পার হয়ে আসতে হয়েছে। নানকার প্রজারা এমন এক পরিস্থিতিতে বসবাস করত যেখানে থেকে জমিদারদের সামনে তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা প্রকাশ করা হল বিদ্রোহ ঘোষণা করার শামিল। জমিদারদের ইচ্ছা অনিচ্ছাই ছিল নানকার প্রজার ইচ্ছা অনিচ্ছা। জমিদারের হুকুম অমান্যকারীকে বিদ্রোহী ধরে নিয়ে কঠিন শাস্তির আয়োজন করা হত। এর থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় ছিল পালিয়ে যাওয়া অথবা সমান কাঠিন্য নিয়ে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা। তাই নানকার সমাজের টিকে থাকার মূল পথ ছিল তাদের বিদ্রোহী সত্তা। তাই তারা ছিলেন চিরবিদ্রোহী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অলিখিত নিয়ম কানুনের মধ্যেই কেটেছে নানকার প্রজাদের জীবন। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ২৬-২৭)

নানকার প্রজাদের জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তেমনই একটি উদাহরণ হল— বাহাদুরপুরের জমিদার রইছ মিয়া তার নানকার প্রজা মথুরা ধুপিকে ছোটো একটি অজুহাতের জন্য জুতোপেটা করলে, সেই প্রজা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে জমিদারের কাছারি থেকে বেরিয়ে যান। এটি কোনও নতুন ঘটনা ছিল না জমিদারদের কাছারিতে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রজাতির ভাবনায় ব্যতিক্রম ঘটে। বহুদিনের অত্যাচারের পর সেই দিনের এই নিপীড়নের ঘটনা তার স্বভাবে ও চেতনায় এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়। জমিদারের ক্ষমতার তোয়াক্কা না করে, প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তায় মথুরা ধুপি অস্থির হয়ে ওঠেন। সমস্ত পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে হঠাৎ একদিন প্রজাটি ছুটে গিয়ে জমিদারের সামনে রাখা জমিদারেরই জুতোর দুই পাটি দু-হাতে তুলে নিয়ে জমিদারের গালে আঘাত করতে শুরু করলেন। সমস্ত বিষয়টি এমনই আকস্মিক যে, চোখের সামনে কী ঘটছে না-ঘটছে বুঝতে না পেরে জমিদার হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটি এতটাই দ্রুততার সঙ্গে ঘটেছিল যে, জমিদার প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময়ই পায়নি। ঘটনাটির পরেই আসামি দ্রুত সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। আসামি খুব ভালোভাবেই জানত, এর ফল কী হতে পারে। তাই পরিবার নিয়ে অনেক আগেই অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। জমিদারের আজ্ঞাবাহকরা আসামির বাড়িতে হাজির হলেও, আসামি এবং তার বাড়ির লোকজন কাউকেই পাওয়া যায়নি। এই ঘটনা বলে দেয় যে, ওই নানকার প্রজাটি আসলেই দীর্ঘদিন ধরে জমিদারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সংকল্পে স্থির ছিল। এইরকম অনেক ঘটনা লক্ষ করা গিয়েছিল। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ২৮-২৯) 

সুখাইড় বিদ্রোহ (১৯২২-২৩)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে সুখাইড় গ্রামের নানকার প্রজারা সর্বপ্রথম বিদ্রোহ করেন। একটি স্থানীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। ঘটনাটির সূত্রপাত হয় এক নানকার রমণীকে কেন্দ্র করে। গ্রামের এক নানকার রমণীর প্রতি সেদিন জমিদারের নজর পড়েছিল। জমিদার তাকে ডেকে পাঠায় কিন্তু রমণীটি জমিদারের ডাকে চিরাচরিত প্রথা মতো ছুটে না-এসে বরং জমিদারের লোককে কড়া করে দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। এমন ঘটনা ছিল ওই গ্রামে সত্যি অকল্পনীয়। ফলস্বরূপ, জমিদার তার দলবল নিয়ে ওই নানকার রমণীর ঘরে চড়াও হয়। রমণীটি প্রতিরোধে চেষ্টা করলেও, তা ব্যর্থ হয়। জমিদার রমণীটিকে ধরে টেনে হিচড়ে বাড়ি এনে আটক করে রাখে। জমিদারদের সচরাচর এমন কাণ্ড করতে হয় না, কিন্তু করলেও তা তার অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করার কোনও কারণ ছিল না। নানকার পরিবারের পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই উপরে জমিদারের সমান অধিকার বজায় থাকত। কিন্তু সেদিনের ঘটনা হঠাৎ করে পালটে গিয়েছিল। নানকার প্রজারা একযোগে জমিদারের বাড়িতে চড়াও হয়ে রমণীকে মুক্ত করে এনেছিলেন। জমিদার এই ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলে, নানকার প্রজারাও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আওয়াজ তুলেছিলেন। এমনকি জমিদারের বাড়িতে প্রজারা সমস্ত রকম কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়ে তারা ভিটেমাটি আগলে বসে রইলেন। জমিদার নিজের গ্রামেই একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। সুখাইড় গ্রাম সিলেট জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে সুনামগঞ্জ মহকুমার ধর্মপাশা থানায় অবস্থিত। এইভাবে সুখাইড় গ্রামের নানকার প্রজাদের প্রচেষ্টায় পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতেও তার প্রভাব পড়েছিল। ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদী শাসন যন্ত্রের সাহায্যে জমিদারদের সমবেত ও সংঘটিত প্রতিরোধের সামনে এই বিদ্রোহ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। (ভট্টাচার্য্য, ১৯৯৯: ৩৩-৩৫) 

কুলাউড়া বিদ্রোহ (১৯৩১-১৯৩২) 

কুলাউড়া গ্রামের নানকার প্রজারাই বোধ হয় এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনকে শ্রেণিদৃষ্টিতে বিচার করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সিলেট জেলার দক্ষিণ অংশের রেল জংশন হল কুলাউড়া। প্রতিষ্ঠার সময়ে কুলাউড়া গ্রামের যে উচ্চবিত্ত জমিদার গোষ্ঠীর প্রভাব প্রতিপত্তি এই অঞ্চলের নামকরণে পেছনে কাজ করেছিল তার বিরুদ্ধেই ছিল নানকারদের বিদ্রোহ। ক্ষুদ্র পরিসরে এই বিদ্রোহ ঘটলেও এর ব্যাপকতা ও গভীরতা ছিল অনেকখানি। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের হাত থেকে মুক্তি লাভের আশায় নানকার প্রজারা ১৯৩১ সালে জমিদারদের বেগার খাটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সর্বস্বান্ত নানকার প্রজারাই সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে সামন্তবাদ বিরোধিতার সঙ্গে যুক্ত করে এবং স্বাধীনতার সামগ্রিক অর্থ জনসমক্ষে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। এই বিদ্রোহটি ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত চলেছিল। কিন্তু কুলাউড়া গ্রামের নানকাররা স্বাধীনতার সামগ্রিক অর্থ বুঝলেও, তাদের সহায়ক শক্তিগুলিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি। ফলস্বরূপ, এই বিদ্রোহ অবশেষে জমিদারদের প্রবল আক্রমণের মুখে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ৩৫-৩৮)

ভানুবিলে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৩২-১৯৩৩)

ভানুবিল অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস কোনও নতুন ঘটনা নয়। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পর সংগ্রাম করে এই অঞ্চলের কৃষকরা বহু আগে থেকেই তাদের একটা সংগ্রামী ঐতিহ্য তৈরি করতে পেরেছিলেন। সিলেট জেলার দক্ষিণ অংশে মৌলভিবাজার মহকুমার কমলগঞ্জ থানার অধীনস্থ এলাকা হল ভানুবিল। এই জেলায় জনসংখ্যার প্রধান অংশ বাঙালি হলেও, ভানুবিল অঞ্চলে প্রধানত মণিপুরি কৃষকদের বাস ছিল। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বাহিনী পূর্ব ভারতীয় স্বাধীন রাজ্য মণিপুর আক্রমণ ও দখল করে নিলে মণিপুরের বেশিরভাগ নাগরিক দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারা মূলত বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার নামে পরিচিত), আসাম ও সিলেট কাছাড়ে গিয়ে উপস্থিত হন। ভানুবিলের মণিপুরি কৃষক প্রজারা হল বিতাড়িত সেই মণিপুরি নাগরিকদেরই বংশধর। জমিদার ও তার কর্মচারীরা বিভিন্ন রকম ছলচাতুরীর মধ্য দিয়ে মণিপুরি কৃষকদের অবাধে লুট করতে লাগল। অত্যাচারের ফলে মণিপুরি কৃষকদের সহজ সরল জীবনযাত্রা বিপন্ন হতে থাকে। বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে মণিপুরি কৃষকরা সংঘবদ্ধভাবে জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। ভানুবিলের আশেপাশে বেশ কয়েকটা গ্রামের মণিপুরি কৃষকরা বসবাস করতেন। ফলস্বরূপ জমিদার বিরোধী সংগ্রামে তাঁরা খুব সহজেই জড়িয়ে পড়েছিলেন। সবকটা গ্রামের মণিপুরি কৃষক প্রজাদের এই জমিদার বিরোধী সংগ্রাম ভানুবিল অঞ্চলের কৃষকদের সংগ্রাম রূপে পরিচিত হয়েছিল। তবে দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ফলেও জমিদারদের অত্যাচার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এই অঞ্চলের কৃষকদের সংগ্রামের মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক সংগঠন। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ৪৪-৫০)

রফিনগর বিদ্রোহ (১৯৩৮-১৯৩৯)

ভাটিপাড়া জমিদারির নানকার অধ্যুষিত গ্রাম ছিল রফিনগর। ভাটিপাড়া জমিদারির ৩৫টি গ্রামে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হয়। জমিদাররা নানকার প্রজাদেরকে এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও, নানকার প্রজারা কিন্তু জমিদারদের পক্ষ নিয়ে এই প্রজা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করতে সম্মত হননি। কারণ এই আন্দোলনে তাদের নিজেদের সমস্যাও জড়িত ছিল। বরং প্রজারা নানকার ব্যবস্থা অবসানের দাবিতে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। জমিদারদের জমিতে বেকার খাটতেও অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ জমিদাররা প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল। জমিদাররা প্রজাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে এই আন্দোলনের ধারাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল জমিদাররা। তবে এইসব পদ্ধতি খুব একটা সফল হয়নি। কিন্তু জমিদার আর কোনও দিন এই গ্রামগুলিতে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি। রফিনগরের নানকার বিদ্রোহ প্রথম থেকেই ভাটিপাড়ার জমিদারির ৩৫টি গ্রামের মিলিত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ভূমিহীন নানকাররাই এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ৭৫-৭৬) 

এ ছাড়াও রনিকেলি বিদ্রোহ (১৯৩৮-১৯৩৯), ভাদেশ্বর বিদ্রোহ (১৯৩৮-১৯৩৯), বাহাদুরপুর বিদ্রোহ (১৯৩৮-১৯৩৯) এবং ১৯৩৯ সালের কৃষক সভার শিলং অভিযান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে জমিদারদের যে ব্যবস্থা নানকারদের ওপরে টিকে ছিল, সিলেট জেলার কৃষক আন্দোলন তার অবসান করতে অনেকখানি সক্ষম হয়েছে। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে— কৃষক-সভা, কংগ্রেস-সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। বিশেষত সিলেট জেলার কৃষক আন্দোলন ও শ্রমজীবী জনতার আন্দোলনের সমর্থনে সিলেট শহর থেকে “নয়া দুনিয়া” নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। কৃষক সমাজের আন্দোলনের ও সংগঠনের বিকাশে এই পত্রিকার যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৯: ৯৪) তবে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব সংশোধনী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষক শ্রেণি নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকারকে অনেকখানি সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। নানকার প্রজাদের উপরে জমিদারদের আধিপত্য ও অত্যাচারের ইতিহাসই নানকার বিদ্রোহ উত্থানের মূল কারণ। নানকাররা সিলেট জেলায় বিভিন্ন স্থানে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বিরোধের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। 

গ্রন্থপঞ্জি:

১. ভট্টাচার্য, অজয় (১৯৯৯), ‘নানকার বিদ্রোহ’, ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন। 

২. সমাদ্দার, শ্রী রনজিৎ কুমার (১৯৫৯), ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্থানীয় বিদ্রোহের প্রভাব’, কলকাতা: বনমালী বিশ্বনাথ প্রকাশন। 

৩. রায়, সুপ্রকাশ (১৯৮০), ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডি এন বি এ ব্রাদার্স। 

৪. রায়, সুপ্রকাশ (১৯৪৯), ‘ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস’, কলিকাতা: লক্ষ্মী-সরস্বতী প্রেস।৫. Shaikh, Raiz Ahmed (July 2016), ‘People’s History of Pakistan: Peasant’s Uprisings in East Bengal/ East Pakistan (1946-50)’, Pakistan Institute of International Affairs, Vol. 69, No. 3, Retrieved on April, 16, 2024.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান